টিলা বেয়ে বেয়ে এতক্ষণে জোহেরি কেসুঙের কঠিন চত্বরে চলে এসেছে পুলিশ সুপার বসওয়েল। কী এক ব্যভিচারের জন্য নাকে পচন লেগেছিল; একটি হাড় খেসারত দিয়ে নাকটাকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য দুটো বড় গর্ত হয়ে রয়েছে। বীভৎস মুখখানায় একটা কদর্য হাসি ছুটে বেড়াচ্ছে। কেলুরি গ্রামের লাস্ট সিটাডেল, লাস্ট ফ্রন্টিয়ারে উদ্ধত ভঙ্গিতে পা ফেলে, পকেট থেকে আইভরি পাইপ বার করে, সুগন্ধি তামাক পুরতে লাগল বসওয়েল। তারপর লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করল।
বসওয়েলের পেছন পেছন উঠে এসেছে মেহেলীর বাপ সাঞ্চামাখাবা, রাঙসুঙ এবং মেজিচিজুঙ। আর এসেছে সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার, অসংখ্য জোয়ান ছেলে ও পুলিশের দল।
রক্তাক্ত নারীদেহগুলো চারদিকে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে। বুড়ি বেঙসানুর উলঙ্গ শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছে। পাটকিলে রঙের পাথুরে ধুলো রক্তে ভিজে থকথকে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
ভয়ানক গলায় আবার হেসে উঠল বসওয়েল, ওয়ারফ্রন্ট! এহ, উই ইনভেড অ্যান্ড কঙ্কার। এহ্, হোয়াট আ জয়! হাঃ-হাঃ-হাঃ–বসওয়েলের তামাটে চুলগুলো বুনো বাতাসে উড়ছে। বড় বড় দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভ বেরিয়ে পড়েছে। উল্লাসের আতিশয্য ঘটলে বসওয়েল ঘন ঘন ঠোঁট চাটে। মোটা তামাক-পোড়া ঠোঁট দুটো চেটে সে হুঙ্কার ছাড়ল, আগুন লাগাও–
এক ঝক শিকারি কুকুরের মতো জনকতক পুলিশ জোহেরি বংশের বাড়িটার দিকে ছুটে গেল। আতামারি পাতার চাল, চারপাশে আস্ত আস্ত বাঁশের দেওয়াল, কাঠের পাটাতন শুকিয়ে আগুনের জন্য যেন উন্মুখ হয়ে রয়েছে। চক্ষের পলকে ঘরের চালে আগুন নেচে উঠল। বাঁশের গাঁটফাটা ফট ফট আওয়াজ হতে লাগল।
মেহেলীর উরুর ওপর থেকে হাতের ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল সেঙাই। রাগ, আক্রোশ, রোষ–মনের আদিম বৃত্তিগুলো চেতনার মধ্যে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। অশক্ত দুর্বল দেহ। রক্ত ঝরে ঝরে শরীরটা সাঙ্ঘাতিক কাহিল হয়ে পড়েছে। গোঙাতে গোঙাতে সেঙাই বলল, আহে ভু টেলো! শয়তানেরা আমাদের ঘরটা পুড়িয়ে দিল। আমাদের বংশের ইজ্জত সাবাড় করল। খুঁড়েই ফেলব সব কটাকে।
নিষ্পলক তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল মেহেলী। একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে। হঠাৎ তার দৃষ্টিটা সামনের দিকে গিয়ে পড়ল। নানকোয়া ও সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেরা তার দিকে এগিয়ে আসছে। সবার আগে আগে আসছে তার বাপ সাঞ্চামখাবা। এমনকি বুড়ো সর্দার ফাটা মাথা নিয়ে উঠে পড়েছে, এখন টিলা বাইছে।
গলা ফাটিয়ে মেহেলী আর্তনাদ করে উঠল, সেঙাই, এই সেঙাই—
উঁ–
শয়তানেরা আমাকে কেড়ে নিতে আসছে।
বর্শাটা আমার বাঁ হাতে দে দেখি একবার। ফিস ফিস, অবশ গলায় সেঙাই বলল, তোর গায়ে একবার হাত দিয়ে দেখুক–
ইজা হুবুতা! সাঞ্চামখাবা খেঁকিয়ে উঠল, টেঙের বাচ্চার পিরিত দ্যাখ। সেই কবে রাঙসুঙের কাছ থেকে পণের বর্শা বাগিয়েছি আর ছুঁড়িটা এখানে এসে শত্তুরদের ছোঁড়াটার সঙ্গে কেমন পিরিত জমিয়ে বসেছে দ্যাখ।
এতহুণে টিলার মাথায় উঠে এসে সাঞ্চামখাবার পাশে দাঁড়িয়েছে সালুয়ালাঙের বুড়ো সর্দার। বেঙসানুর পাথরের ঘা লেগে মাথা ফেটে গিয়েছে। ঘন রক্তের ধারা কপাল, খসখসে চোখের পাতা এবং শুকনো তোবড়ানো গালের ওপর জমাট বেঁধে রয়েছে।
সাঞ্চামখাবা বলল, তুই একবার বল সদ্দার, মাগী আর মরদটাকে বর্শার ডগায় ফুঁড়ে বস্তিতে নিয়ে যাই।
সাঞ্চামখাবার কথায় কান দিল না সর্দার। বিকট মুখভঙ্গি করে সমানে চেঁচাতে লাগল, শয়তানীটার জন্যে সকলে আমাদের ঘেন্না করছে। যেই এ-খবর চাউর হয়েছে অমনি অঙ্গামীরা ধান বদল করছে না, কোনিয়াকরা হাঁড়ি-শাবল-কোদাল দিচ্ছে না। মাগীর জন্যে আমাদের অত নামকরা বস্তির ইজ্জত আর রইল না। আহে থুঙকু সালো!
একটু থেমে, ঘড়ঘড়ে গলায় কেশে, সর্দার গলাটা আরো চড়াল, বস্তিতে নিয়ে মাগী তোর ছাল উপড়ে নেব। শত্রুরদের বস্তিতে তোকে মারব না, আনিজার গোসা হবে।
পাখির পালকের মুকুটটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সাঞ্চামখাবা বলল, উঠে আয় মেহেলী, উঠে আয়।
না না, আমি যাব না।
যাবি না? খেঁকিয়ে উঠে রক্তচোখে তাকাল সাঞ্চামখাবা।
না। ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করতে লাগল মেহেলী। মাথার সঙ্গে সমস্ত শরীরটা নাড়াতে লাগল, না না, যাব না। সেঙাইকে ছেড়ে কিছুতেই যাব না।
যাবি না! কেন যাবি না? অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিশাল খারে বর্শার ফলাটা আকাশের দিকে বাগিয়ে আরো সামনে এগিয়ে এল সাঞ্চামখাবা। বুনো মোষের মতো ফোঁস ফেস করতে করতে বলল, বেশি ফ্যাকর ফ্যাকর করবি না মাগী। সিধে কথায় না উঠে এলে বর্শায় গেঁথে টানতে টানতে বস্তিতে নিয়ে যাব। শয়তানী, তোর জন্যে বংশের ইজ্জত রইল না। অঙ্গামীরা, কোনিয়াকরা, চারপাশের বস্তির লোকেরা আমাদের দেখলেই গায়ে থুতু দিচ্ছে। উঠে আয়, উঠে আয় বলছি।
টেমে নটুঙ! আমি তো বললাম, যাব না। আর পনেরো দিন পর তেলেঙ্গা সু মাসে আমার বিয়ে হবে। সেঙাই আমার সোয়ামী হবে। সেঙাইকে ছেড়ে যাব না। তুই চলে যা বাপ, নইলে সেঙাই তোকে সাবাড় করে ফেলবে। বলতে বলতে সেঙাই-এর মুখের দিকে তাকাল মেহেলী। তার উজ্জ্বল তামাটে মুখখানা, স্বাস্থ্যপুষ্ট পেশল দেহটা এখন বড়ই কাহিল দেখাচ্ছে।