অদিতি বলে, অর্ডার নয়। কোথাও গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভদ্রলোকের মতো এসো। তখন কথা হবে।
ভদ্রলোক। বস্তিতে ভদ্দরলোক থাকে বলে শুনেছেন! মাতাল ফোরটোয়েন্টি, খচ্চর হারামি ছাড়া এখানে কেউ থাকে না মেমসাহেব। আমি তাদের ভেতর আবার সব চাইতে ওঁচা মাল। অনেক ভ্যানতাড়া হয়েছে। এবার মাগীটাকে পিঠের কাছ থেকে টেনে বার করে দিন। শালীর চুলের কুঁটি ধরে টেনে নিয়ে যাই।
মেয়েটার কী হাল হয়েছে–দেখছ?
মরে তো যায়নি।
তুমি মানুষ, না কী?
একটু আগে যা বলেছেন তাই জানোয়ার।
মাথার ভেতর রক্ত ফুটতে শুরু করেছিল অদিতির। উত্তেজিত ভঙ্গিতে সে বলে, চাঁপা না তোমার স্ত্রী!
নগেন বলে, সেই জন্যেই তো ঠেঙাতে পারছি। অন্য মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুললে ঝামেলা হয়ে যেত। মেলাই ভ্যাজর ভ্যাজর করছেন মেমসাহেব, আমার মাল আমার হাতে তুলে দিন। কেটে পড়ি।
না দেব না।
যুধিষ্ঠির বকের মতো গলা বাড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে, চাঁপাকে দিয়ে দ্যান দিদিমণি। লগেন খুব হারামি লোক–
যুধিষ্ঠিরের কথার জবাব দেয় না অদিতি, স্থির চোখে নগেনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যেন প্রচণ্ড অবাক হয়েছে, এমন একটা ভঙ্গি করে নগেন বলে, আমার বউকে আটকে রাখবেন! এ তো গা-জোয়ারি কারবার হল মেমসাহেব! বলতে বলতে সে এগিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে ধীরে ধীরে আগের সেই বেপরোয়া হিংস্রতা ফের ফুটে উঠতে থাকে।
বিপজ্জনক কিছু একটা আঁচ করে রমেন এবং বিকাশ দ্রুত মাঝখানে চলে এসে অদিতিকে আড়াল করে দাঁড়াতে চায়। অদিতি তাদের সরিয়ে দিয়ে তীব্র চাপা গলায় নগেনকে বলে, এক পা-ও আর এগুবে না।
নগেন থমকে যায়। বলে, আমাকে অত ধমকাবেন না মেমসাহেব, আমি আপনার বাবার চাকর লই। ভালো কথায় আমার বউকে ছেড়ে দ্যান।
না।
নগেন বলে, ভদ্দরলোকের বাড়ির মেইয়ে বলে এতক্ষণ খাতির করে কথা কইছি। এরপর কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে। বলতে বলতে নগেনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতে থাকে। কদিন ধরেই খবর পাচ্ছি, আপনারা বস্তির মেয়েমানুষদের খেপিয়ে যাচ্ছেন। আমায় ঘটাননি, তাই কিছু বলিনি। এবার কিন্তু সাপের ল্যাজে পা দিয়ে ফেলেছেন। আপনাকে আমি ছাড়ছি না।
মস্তিষ্কের মধ্যে কোথায় যেন বিস্ফোরণ ঘটে যায় অদিতির। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো সে চিৎকার করে ওঠে, স্কাউলে, এতবড় সাহস তোমার। তোমাকে আমি পুলিশে দেব।
পুলিশের নামে খানিকটা দমে যায়। পরক্ষণেই তেরিয়া হয়ে ওঠে, আমাকে পুলিশের ভয় দেখাবেন না মেমসাহেব। বছরে বিশবার ধরা পড়ি। এক ঘণ্টার বেশি কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। পুলিশ মাকড়াদের আমার বহোতবার দেখা আছে।
অদিতি নগেনের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। অত্যন্ত শান্ত গলায় বলে, বছরে যাতে বারো মাস জেলে কাটাতে পারো তার ব্যবস্থা করে দেব।
হইচই উত্তেজনায় নগেনের নেশা অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছিল। অদিতি তার কতটা ক্ষতি করতে পারে ঠিক বুঝতে পারছিল না। সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে অদিতিকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে সে, তারপর বলে, আপনার মতলবটা কী?
চাঁপাকে নিয়ে আমি সোজা এখান থেকে থানায় যাব।
যেখানে খুশি নিয়ে যান। শুধু দুটো কথা মন দিয়ে শুনে রাখুন। এক লম্বর লগেন দাসকে এখনও আপনি চেনেননি। দু-লম্বর, এই মাগীকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন কোন বাপ ওকে বাঁচায় দেখব বলে আর দাঁড়ায় না, ভিড়ের ভেতর দিয়ে বস্তির গোলকধাঁধায় অদৃশ্য হয়ে যায়।
যুধিষ্ঠির পাশ থেকে বলে, কাজটা ভালো হল না দিদিমণি।
বস্তির আরও দু-চারজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বলে, দিদিমণি, চাঁপাকে লগেনের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিন। সোয়ামি-ইস্তিরির কারবার। এখন গেলে লগা ঠেঙাবে ঠিকই, আবার মিটমাটও হয়ে যাবে।
একটু দ্বিধান্বিতই হয়ে পড়ে অদিতি। এই বস্তিতে দাম্পত্য জীবনের প্যাটানটা কীরকম, সে-সম্বন্ধে তার পরিষ্কার ধারণা নেই। চাঁপার দিকে ফিরে বলে, তুমি কি ঘরে ফিরে যাবে?
চাঁপা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বলে, না না, ওর কাছে আর যাব না। আমাকে পেলে একেবারে খুন করে ফেলবে। আপনি আমাকে বাঁচান দিদি।
এক মুহূর্ত কী ভাবে অদিতি, তারপর বলে, ঠিক আছে, আপাতত আমাদের সঙ্গে চলো। তারপর ভেবে কিছু একটা ঠিক করা যাবে। যুধিষ্ঠিরকে বলে, আজ আর কোনো মহিলাকে ডাকার দরকার নেই। বিকাশ এবং রমেনকে পোস্টারগুলো তুলে ফেস্টুনটা খুলে নিতে বলে। এরপর যুধিষ্ঠিরকে একধারে ডেকে নিয়ে গোটাকয়েক টাকা দেয়।
এটা তার কাজের মজুরি। যুধিষ্ঠির টাকাটা পকেটে পুরতে পুরতে বলে, চাঁপাকে সগে করে না-নিয়ে গেলেই পারতেন দিদিমণি।
এই সৎ পরামর্শটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে এবং বস্তির কয়েকজন কিছুক্ষণ আগেই একবার দিয়েছে। অদিতি হাসে। তারপরেই হঠাৎ কিছু মনে পড়তে সে বলে, চাঁপার ছেলেমেয়ে আছে?
না।
ভালোই হল। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে অসুবিধে হত।
গলা অনেকখানি নামিয়ে যুধিষ্ঠির বলে, দিদি, একটা কথা বলব?
অদিতির কপাল সামান্য কুঁচকে যায়। সে জিগ্যেস করে, কী?
এট্টু সাবধানে থাকবেন। লগা কেমন হারামজাদা, নিজের চোখেই দেখলেন। তাছাড়া পাট্টির লিডাররা আছে ওর পেছনে।
পাট্টি মানে পলিটিক্যাল পা.। এতক্ষণে বোঝা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের মদতেই নগেদ দাস এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছে। অন্যমনস্কর মতো সে বলে, জানা রইল।