- বইয়ের নামঃ শতধারায় বয়ে যায়
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ করুণা প্রকাশনী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৫. কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল
শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
উৎসর্গঃ সমরেশ মজুমদার অনুজপ্রতিমেষু
প্রসঙ্গত
‘কেয়াপাতার নৌকো’র অখন্ড সংস্করণের ভূমিকায় জানিয়েছিলাম, দেশভাগভিত্তিক এই উপন্যাসের পর আরও কয়েকটি পর্ব ভিন্ন ভিন্ন নামে লিখব। সেই অনুযায়ী ‘কেয়াপাতার নৌকো’-র পরবর্তী পর্ব শতধারায় বয়ে যায় প্রকাশিত হল। আমার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। হাতে সময় বড় কম। তাই এর পরের অংশগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে চাই।
‘শতধারায় বয়ে যায়’ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল বর্তমান পত্রিকার রবিবাসর বিভাগে, দীর্ঘ দু’বছর ধরে। এই বিভাগের সম্পাদক এবং তার সহকারী কাকলি চক্রবর্তী ও সাহানা নাগচৌধুরির অবিরল তাগাদা ছাড়া এটি লেখা আদৌ সম্ভব হতো না। প্রসঙ্গত অনুজপ্রতিম কথাসাহিত্যিক শচীন দাসের কথা না বললেই নয়। সেও এটি লেখার জন্য সমানে আমাকে উসকে গেছে। এদের সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তাতে সামান্য ধন্যবাদ জানানো যথেষ্ট নয়। তিন স্নেহভাজনকে শুধু আন্তরিক শুভকামনাই জানাতে পারি। ‘শতধারায় বয়ে যায়’-এর জন্য পুরনো পত্রপত্রিকার অসংখ্য প্রতিবেদন তো বটেই, বহু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং সাংবাদিকের গবেষণাগ্রন্থ থেকেও প্রচুর তথ্য পেয়েছি। এঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
দেশভাগের কারণে বাঙালির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে যে মহাতমসা নেমে এসেছিল, এমনটা আর কখনও দেখা যায়নি। এই বিপর্যয়ের জের কাটিয়ে উঠতে কত যুগ লাগবে, কে জানে।
বঙ্গ-বিভাজন শতসহস্র জনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ নিদারুণ প্রতিকূলতার মধ্যেও সহজে পরাভব মানে না। ভগ্ন্যুপের ভেতর থেকে সর্বস্ব-হারানো উদ্বাস্তুদের অনেকে মাথা তুলে আবার নিজেদের নির্মাণ করে চলেছে। বিনাশের পাশাপাশি সৃজন।
অনতিদূর অতীতের সেই চরম বিপর্যয়ের সময় থেকে বর্তমান কাল অবধি বাঙালির ধ্বস্ত জীবনকে আমার এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলিতে ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু কতটা সম্ভব হবে জানি না। তবে অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাব।
আমি গুরুতর অসুস্থ। তাই প্রফ সংশোধনে কিছু ভুলচুক থেকে যেতে পারে। পরবর্তী সংস্করণে তা ঠিক করে দেব।
—গ্রন্থকার
০১.
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, বিনয়ের খেয়াল নেই। বিহ্বলতা যখন কাটল, মনে হল, শত আলোকবর্ষ পার হয়ে গেছে। রাস্তায় একই রকম ব্যস্ততা, জনস্রোত। কর্পোরেশনের ঘোলাটে-আলোগুলো ঘিরে কুয়াশার ঘোট ঘোট বলয়। ট্রাম বাস ঘোড়ার গাড়ি, এমন অজস্র যানবাহন রকমারি আওয়াজ তুলে আগের মতোই ছুটে চলেছে। চিরদুঃখী এক তরুণী উদ্ভ্রান্তের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেছে, জানা নেই। কিন্তু মহানগরের আহ্নিক গতিতে লহমার জন্যও তাল কাটেনি। সবই আগের মতো চলমান। ধ্বনিময়। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নেই।
বিনু আর সেই বিনু নেই। দেশভাগের পর নানা ঘা খেয়ে খেয়ে অজস্র অভিজ্ঞতায় এখন সে এক পরিপূর্ণ যুবক। [কেয়াপাতার নৌকো’র বিনু জীবনের এই পর্ব থেকে বিনয়।
হিম ঝরে চলেছে বিরতিহীন। শীতল উত্তুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। উত্তর থেকে দক্ষিণে। গায়ে কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু শরীর কেমন যেন অনুভূতিশূন্য। চোখের সামনে মানুষজন, গাড়িঘোড়া সব ছেঁড়া ছেঁড়া, ঝাপসা ছবির মতো। অসংলগ্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও যোগ নেই।
অসাড় ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাবার পর বিনয়ের মনে হয়, মাথায় অবিরল ধারালো শেল বিধছে। বুকের ভেতর কী যে অসহ্য যন্ত্রণা! কেউ যেন অতল অন্ধকার খাদে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। শ্বাস আটকে আটকে আসছে তার।
লক্ষ লক্ষ মানুষের এই আধো-চেনা শহর দিগ্বিদিকে ছড়ানো, এখানে ঝিনুককে কোথায় খুঁজবে বিনয়? কোথায় গেলে তাকে ফিরে পাওয়া যাবে, জানা নেই।
ঝিনুক যে কত মায়ায়, কত অজস্র পাকে, তাকে আমূল জড়িয়ে আছে, সেই কিশোর বয়স থেকেই বিনয় অনুভব করে এসেছে। নইলে এত ঝুঁকি নিয়ে সে কি ওকে বুকের ভেতর আগলে আগলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে আসতে পারত? প্রতি মুহূর্তে সেখানে ছিল ঘাতক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। জলেস্থলে সর্বক্ষণ সেখানে মৃত্যুভয়। আকাশ বাতাস বিষ-বাষ্পে ভরা। কিন্তু ঝিনুকের জন্য কিছুই গ্রাহ্য করেনি বিনয়।
এখন, হেমন্তের এই কুহেলিমাখা রাত্তিরে, কলকাতার সদাব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝিনুক যে তার জীবনের শত দিগন্ত জুড়ে রয়েছে, নতুন করে আবার তা টের পেল সে। একটা হুহু কান্না শরীরের রক্তমাংস ভেদ করে বেরিয়ে আসছে।
কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া যাবে না। কিছু একটা করতেই হবে বিনয়কে। কী করা যায়?
এতক্ষণ ঝিনুকের চিন্তাটা এমন ব্যাকুল করে রেখেছিল যে অন্য কিছুই ভাবতে পারছিল না বিনয়। হঠাৎ অবনীমোহনের মুখ, চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা নিশ্চয়ই কোনও একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। পরক্ষণে মাথায় সংশয়ের মেঘ জমে। অবনীমোহন কি ঝিনুককে খুঁজে বার করার জন্য আদৌ কিছু করবেন? একটা ধর্ষিত মেয়ে আচমকা এসে তাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে, ঘটিয়েছে তার শাস্তির ব্যাঘাত। হঠাৎ সে চলে যাওয়ায় তার তত খুশি হওয়ারই কথা। অনন্ত স্বস্তি। অবাঞ্ছিত আপদ বিদায় হলে যেমনটা হয় আর কি।
তবু বাবার কাছে না গিয়ে উপায় নেই। উধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরে এল বিনয়। একসঙ্গে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকে তেতলায় সোজা অবনীমোহনের ঘরে। সমানে হাঁপাচ্ছে। ভেতরে যে উথালপাতাল ভাবটা চলছে, হাড়পাঁজর ভেদ করে তা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অবনীমোহন খাটের ওপর বালিশে ভর দিয়ে একটা বিশাল বইয়ের ভেতর ডুবে ছিলেন। নিশ্চয়ই কোনও ধর্মগ্রন্থ। খুব সম্ভব হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মশাই মূল মহাভারতের বাংলা যে অনুবাদ করেছেন তার কোনও একটি খণ্ড।
পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন অবনীমোহন। ছেলের মুখচোখ লক্ষ করে তার মনে হল, অঘটন কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বিনু?
উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় বিনয়ের কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঝাপসা গলায় কোনওরকমে বলতে পারল, ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে না।
হাতের বইটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন অবনীমোহন, সে কী! কোথায় যাবে সে! এত বড় বাড়ি। দেখ, কোনও ঘরে নিশ্চয়ই আছে।
একতলা থেকে তেতলার প্রতিটি কামরা, অলিন্দ, প্যাসেজ, ছাদ, সব আঁতিপাঁতি করে খুঁজে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত তো বটেই, এমনকি ট্রামরাস্তা অবধি ছুটে গিয়েছিল বিনয়। সবিস্তার সমস্ত জানিয়ে সে বলল, কোথাও নেই ঝিনুক।
আশ্চর্য! অবনীমোহন যেন থই পাচ্ছেন না, এমন সুরে বললেন, কী এমন ঘটেছে যে কারওকে না জানিয়ে চলে গেল!
বিনয় উত্তর দিল না।
অবনীমোহন এবার বললেন, তুই কি ওকে কিছু বলেছিস?
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বিনয় হয়তো তার সঙ্গে এমন কোনও আচরণ করেছে যাতে মেয়েটা ক্ষোভে, বেদনায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তার বলতে ইচ্ছা হল, যে-মেয়েকে বুকের ভেতর পুরে পাকিস্তানের সীমানা পার করে নিয়ে এসেছে তাকে এতটুকু আঘাত কি সে দিতে পারে? বিমূঢ়ের মতো বাবার মুখের দিকে তাকালো বিনয়। বলল, তখন তোমার ঘর থেকে বেরুবার পর ঝিনুকের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। তাকে কিছু বলার প্রশ্নই নেই।
লহমায় বদলে গেলেন অবনীমোহন। তড়িৎস্পৃষ্টের মতো তাঁর শরীর বেঁকে দুমড়ে যেতে লাগল যেন। রক্তের ভেতর আগুনের হলকা ছুটছে। কাঁপা গলায় বললেন, তবে কি, তবে কি, ওকে হোমে পাঠাবার যে কথাগুলো তোকে বলেছিলাম, ঝিনুক তা শুনে ফেলেছে?
বিনয়ের অনুমানও ঠিক তা-ই। সে চুপ করে রইল।
অবনীমোহনের আক্ষেপ থামেনি, মেয়েটার হয়তো আর-এক বার সর্বনাশই করে ফেললাম। এত বড় শহরে কোথায় যাবে সে, কোন বদ লোকের পাল্লায় পড়বে, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বাবার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে বিনয়। নিরাসক্ত মানুষটিকে ভীষণ বিচলিত মনে হচ্ছে। সংসারের যাবতীয় বন্ধন যিনি ছিঁড়ে ফেলেছেন, সুখ দুঃখ মায়া মোহ কিছুই যাঁকে স্পর্শ করে না, সেই অবনীমোহন একেবারে বদলে গেছেন। অনুতপ্ত। তীব্র মনস্তাপ তাকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে।
খাট থেকে দ্রুত নেমে অবনীমোহন বললেন, চল আমার সঙ্গে
বিনয় রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
থানায়।
থানায় কেন?
এখানকার ওসির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমাদের পক্ষে কতটুকু কী-ই বা করা সম্ভব? পারলে পুলিশই ঝিনুককে খুঁজে বার করতে পারবে। চল–
যা পরে ছিলেন, সেই পোশাকেই বিনয়কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লেন অবনীমোহন।
.
থানা খুব দূরে নয়। বাড়ি থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক লাগে।
গম্ভীর, ভীতিকর চেহারা নিয়ে থানার মস্ত লাল ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। গেটের মুখে বন্দুকধারী, ধড়াচুড়ো-পরা, হিন্দুস্থানী সেন্ট্রি। প্রকাণ্ড চেহারা, জমকালো গালপাট্টা। তাকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, ওসি তার কামরাতেই আছেন।
ভারী ভারী সেকেলে আলমারি, ভারী ভারী টেবল চেয়ার, টেবলে স্তূপাকার ফাইল, কালো রঙের টেলিফোন ইত্যাদি দিয়ে জবরজং সাজানো একটা বড় কামরায় বাবার পিছু পিছু এসে ঢুকল বিনয়।
টেবলের ওধারে যিনি বসে ছিলেন তাঁর বয়স বাহান্ন তিপ্পান্ন। কোঁকড়া চুল, নিখুঁত কামানো লম্বাটে মুখ, গায়ের রং বেশ ফর্সা। চোখের দৃষ্টি শান্ত এবং গভীর। এই বয়সেও মেদ জমেনি। বেতের মতো ছিপছিপে শরীর। দারোগা বলতে যে রুক্ষ রাগী কর্কশ মুখের ছবিটি ফুটে ওঠে তার সঙ্গে একে মেলানো যায় না। দুর্গের মতো একটা দমবন্ধকরা পরিবেশে তাঁকে যেন ঠিক মানায় না।
ওসি বললেন, আসুন আসুন অবনীবাবু। বসুন অবনীমোহনরা বসলে জিজ্ঞেস করলেন, অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। শুনেছিলাম, আপনি হরিদ্বার উত্তরকাশী না কনখল, কোথায় যেন গেছেন। আপনার গুরুদেবের কাছে কি?
বিনয় অনুমান করল, অবনীমোহন সম্পর্কে অনেক খবরই রাখেন ওসি। তার গতিবিধিও ওঁর অজানা নয়।
অবনীমোহন মৃদু হাসলেন, গুরু এবং তীর্থদর্শন দুটোই সেরে এলাম। মাসখানেকের ভেতর আবার গুরুর আশ্রমে ফিরে যাব।
মজার সুরে ওসি বললেন, আপনার মতো সাধুসন্ন্যাসী মানুষ হঠাৎ এই পাপীতাপীদের আখড়ায়? কোনও দরকার আছে?
হ্যাঁ।
বিনয় সম্পর্কে ওসির কৌতূহল হচ্ছিল। বার বার তার চোখ সেদিকে চলে যাচ্ছে। বললেন, দরকারের কথা পরে শুনছি। বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, এটি কে? চিনতে পারলাম না তো।
আমার ছেলে। দিনকয়েক হল পাকিস্তান থেকে এপারে চলে এসেছে। ওসির সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন অবনীমোহন। তার নাম দিবাকর পালিত।
দিবাকর বললেন, এর কথা বোধহয় আপনার মুখে শুনেছিলাম। বিনয়কে বললেন, পাকিস্তানে থাকা গেল না বুঝি?
আস্তে মাথা নাড়ল বিনয়।
অনেকটা আপন মনেই এবার দিবাকর বললেন, ওখানকার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রোজ হাজার হাজার রিফিউজি চলে আসছে ইন্ডিয়ায়। এই মানুষগুলোর কী যে ভবিষ্যৎ!
একটু চুপচাপ।
তারপর দিবাকর অবনীমোহনকে বললেন, এবার আপনার প্রয়োজনের কথাটা শোনা যাক।
নানা সংকটের ভেতর দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে ঝিনুকের এপারে চলে আসা থেকে শুরু করে কিছুক্ষণ আগে তার নিরুদ্দেশ হওয়া পর্যন্ত বিশদভাবে সব বলে গেলেন অবনীমোহন। অবশ্য ঝিনুকের ধর্ষিত হবার ঘটনা আর হেমনলিনীর নির্দয় ব্যবহারটুকু বাদ দিয়ে।
শান্ত মানুষটিকে এবার বেশ চঞ্চল দেখাচ্ছে। দিবাকর বললেন, হঠাৎ আপনার বাড়ি থেকে মেয়েটি চলে গেল। কী হয়েছিল?
বিব্রত অবনীমোহন এক পলক ছেলেকে দেখে নিয়ে বললেন, তেমন কিছুই হয়নি। তিনি যে অস্বস্তি বোধ করছেন, চোখেমুখে তা ফুটে উঠেছে।
দিবাকর অবনীমোহনকে লক্ষ করেননি। চিন্তিতভাবে বললেন, কোথায় যেতে পারে বলে আপনাদের ধারণা?
কোনও ধারণাই নেই। কলকাতায় এই প্রথম এসেছে, এখানকার পথঘাট কিছুই চেনে না। তার ওপর এই ঠাণ্ডার রাত। কী যে হবে, ভাবতেই পারছি না।
আপনি বলেছেন, পাকিস্তান থেকে আসার পর ঝিনুক আপনার দুই মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। ওই দুজায়গায় খোঁজ নিয়েছেন? যদি ওদের কারও কাছে গিয়ে থাকে–
বিনয় জানে প্রাণ গেলেও সুনীতিদের বাড়ি যাবে না ঝিনুক। সেখানে তাকে যে অসম্মান করা হয়েছে, হেমনলিনী যেভাবে তাকে আবর্জনার মতো একধারে ফেলে রেখেছিলেন, সেখানে যাবার প্রশ্নই নেই। ঝিনুকের অভিমান এবং আত্মসম্মানবোধ খুবই প্রখর। তবে সুধাদের বাড়ি গেলেও যেতে পারে। সুধা আর হিরণ অপার মমতায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। লহমার জন্য হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিল পুরানো দুঃস্বপ্নের যাবতীয় স্মৃতি। কলকাতায় ওটাই একমাত্র ভূখণ্ড যেখানে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারবে ঝিনুক। কিন্তু এই হিমঋতুতে গাঢ় কুয়াশায় যখন চতুর্দিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে, পথ চিনে চিনে তার পক্ষে টালিগঞ্জে পৌঁছনো সম্ভব? বিনয় আন্দাজ করতে পারে, বাড়ি থেকে ঝিনুক যখন বেরোয় তখন তার মাথার ঠিক ছিল না। আচমকা আঘাতে তখন তার পাগল পাগল, উদভ্রান্ত অবস্থা। শিরা-উপশিরার মতো এই শহরে কত যে রাস্তা! পাকে পাকে জড়ানো কত গলিঘুজি! কোন পথ ধরে এই জটিল গোলকধাঁধায়, কোথায় যে ঝিনুক হারিয়ে গেছে, কে জানে।
অবনীমোহন বলছিলেন, না। খোঁজ নেওয়া হয়নি। আমার মেয়েদের কাছে গেলে নিশ্চয়ই ওরা। জানাতে।
দিবাকর বললেন, তবু আজই মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এমনও হতে পারে সে ওই দুটো জায়গার কোথাও এখনও পৌঁছতে পারেনি।
ঠিক আছে, যোগাযোগ করব।
আমিও কলকাতার সব থানায় জানিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটি সম্পর্কে ডিটেলে বলুন। নাম তো বললেন ঝিনুক। ওটা নিশ্চয়ই ডাক-নাম। ভাল নাম কিছু আছে?
আছে। তাপসী লাহিড়ি।
শুধু নামই নয়, বয়স, হাইট, রং, চেহারার খুঁটিনাটি বর্ণনা, আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য যেমন শরীরের খোলা অংশে জড়ল, জন্মদাগ, কাটার চিহ্ন আছে কি না–সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে দিবাকর বললেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভেতর থেকে একটি মেয়েকে খুঁজে বার করা তো সহজ নয়। তাই এত ডিটেল দরকার। ওর কোনও ফোটো দিতে পারেন?
অবনীমোহন বিনয়ের দিকে তাকালেন। ঝিনুকের ফোটো থাকলে বিনয়েরই জানার কথা। রাজদিয়ার মানুষদের ছবিটবি তোলার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ বা শখ ছিল না। সুযোগ ছিল তার চাইতেও কম। ফোটো তুলতে হলে যেতে হতো নারায়ণগঞ্জ কি ঢাকায়। ঝিনুকের বালিকা বয়সে ভবতোষ দুএকবার ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ফোটো তুলেছিলেন। কিশোরী বয়সের তিন-চারখানা ছবিও আছে তার। সুধা সুনীতির বিয়ের সময় দুজোড়া বর কনেকে ঘিরে কে যেন কটা গ্রুপ ফোটো তুলেছিল। এইসব ছবির কপি বাঁধিয়ে হেমনাথদের বাড়িতে রাখা আছে। বিনয়ের স্পষ্ট মনে আছে, ঝিনুকের তরুণী বয়সের কোনও ফোটো নেই। সে যখন কিশোরী থেকে যুবতী হচ্ছে সেই সময়টা সারা দেশ জুড়েই মহাসংকট। যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ব্রিটিশ আর আমেরিকান টমিরা ভারতবর্ষের ব্যারাকগুলো ফাঁকা করে প্লেন কি জাহাজ বোঝাই হয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের দেশে। ইংরেজরা বুঝতে পারছিল, কয়েক হাজার মাইল দূরের এই উপমহাদেশে কলোনি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মিত্রশক্তি জিতেছে ঠিকই, কিন্তু জার্মান বোমায় অর্ধেক লন্ডন ধ্বংসস্তূপ। অর্থনীতি ফোপরা হয়ে গেছে। তারা চাটিবাটি গুটিয়ে ভারতবর্ষ ছাড়ার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছে।
যুদ্ধের ডামাডোল কাটতে না কাটতেই শুরু হল দাঙ্গা, ধর্ষণ, আগুন, ব্যাপক গণহত্যা, অবশেষে দেশভাগ। এর মধ্যে ছবি তোলার মতো শখ কার প্রাণেই বা থাকতে পারে? ঝিনুকের ছেলেবেলা বা কিশোরী বয়সের কোনও ছবিই পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসেনি বিনয়। আনলেই বা কাজের কাজ কতটুকু হতো? তরুণী হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের আদল অনেকখানিই বদলে গেছে।
বিনয় বলল, না, ফোটো নেই।
দিবাকর বললেন, থাকলে সুবিধা হতো। যাক, মেয়েটির যে ডেসক্রিপশন শুনলাম, অন্য থানাগুলোতে তা-ই জানিয়ে দেব।
অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটাকে পাওয়া যাবে তো দিবাকরবাবু? তার বলার মধ্যে সংশয় আর উৎকণ্ঠা মেশানো।
দিবাকর মৃদু হাসলেন, আশা তো করছি। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না। তারপর দেখা যাক।
আমার ছোট মেয়ের বাড়িতে টেলিফোন নেই। সেখানে কারওকে পাঠাতে হবে। আপনাদের এখান থেকে বড় মেয়েকে একটা ফোন করা যাবে?
অবশ্যই। করুন না–
এক্সচেঞ্জে ধরে সুনীতিদের বাড়িতে যোগাযোগ করলেন অবনীমোহন। ওধারে আনন্দ লাইনটা ধরেছিল। ঝিনুকের কথা শুনে সে হকচকিয়ে যায়। উদ্বেগের সুরে জানায়, ঝিনুক তাদের বাড়ি যায়নি। জিজ্ঞেস করলে, আমি কি চলে আসব?
অবনীমোহন বললেন, এই রাত্তিরবেলা এসে আর কী করবে? আসার দরকার নেই।
আনন্দ বলল, এক্ষুনি থানায় জানানো খুব জরুরি।
বিনু আর আমি ভবানীপুর থানায় এসেছি। সেখান থেকেই কথা বলছি।
আপনি আমাকে এখন কী করতে বলেন?
আপাতত কিছু করার নেই। তেমন বুঝলে পরে তোমাকে জানাব।
আমরা ভীষণ চিন্তায় থাকব। ঝিনুকের খবর পেলে তক্ষুনি আমাদের ফোন করবেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে আনন্দর সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে, ওসিকে জানিয়ে দিলেন অবনীমোহন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের কী করণীয়?
দিবাকর বললেন, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এখন বাড়ি যান। দুচার দিনের ভেতর মেয়েটাকে পাওয়া না গেলে খবরের কাগজের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলমে বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
ঠিক আছে। দেব। আচ্ছা চলি
আসুন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অবনীমোহন বললেন, বিনু রোজ একবার এখানে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করে খবর নিয়ে যাবে।
দিবাকর বললেন, আপনাদের দুশ্চিন্তার কারণটা বুঝি। বেশ, ছেলেকে পাঠাবেন।
থানার বাইরে এসে ধরা গলায় অবনীমোহন বললেন, মেয়েটার কী ক্ষতি যে করে ফেললাম। আক্ষেপ আত্মগ্লানি অপরাধবোধ, সব একাকার হয়ে তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল।
বিনয় উত্তর দিল না।
থানার সামনেই ট্রাম রাস্তা। নীরবে ওপারে গিয়ে অবনীমোহন বললেন, এক কাজ কর বিন
কী? জিজ্ঞাসু চোখে বাবার দিকে তাকায় বিনয়।
রাত খুব একটা বেশি হয়নি। তুই একবার সুধাদের বাড়ি চলে যা। দেখে আয় ঝিনুক ওখানে গেছে কি না।
যদি ছোটদির ওখানে গিয়ে থাকে, কী করব?
বিনয় যে ইঙ্গিতটা দিয়েছে, নিমেষে বুঝে নিয়েছেন অবনীমোহন। ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে ফিরিয়ে আনবে কি না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, আগে খবরটা নিয়ে আয়। তারপর দেখি কী করা যায়–
দ্বিধাটা এখনও কাটেনি অবনীমোহনের। ধর্ষিত মেয়েটিকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি মনস্থির করতে পারেননি। ঝিনুকের সন্ধানে ছেলেকে যে সুধাদের কাছে পাঠাতে চাইছেন, তার পেছনে রয়েছে খুব সম্ভব ক্ষণিকের অনুশোচনা। বিনয় এক পলক বাবার মুখের দিকে তাকালো। কোনও উত্তর দিল না।
বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। টালিগঞ্জের ট্রাম এসে গেল। বিনয়কে ট্রামে তুলে দিয়ে অবনীমোহন বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
.
এখন রাস্তায় লোজন বেশ কমে গেছে। গাড়িটাড়িও তেমন চোখে পড়ে না। রাত যত বাড়বে, মানুষ এবং যানবাহন তত বিরল হতে থাকবে।
ধাতব শব্দ করে ট্রাম ছুটে চলেছে। দুচারটে বিড়ি সিগারেট কি চায়ের দোকান ছাড়া রাস্তার দুধারে বাকি সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। হিম আরও ঘন হয়ে নামছে। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে হুস হাস ছুটে যাচ্ছে ছাদ-খোলা দোতলা বাস, উলটো দিকের ট্রাম, প্রাইভেট কার কি ঘোড়ার গাড়ি।
একটা জানালার ধারে বসে ছিল বিনয়। হুহু উত্তরে বাতাস মুখেচোখে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে। ঠাণ্ডায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। জানালাটা যে বন্ধ করে দেবে, সেদিকে লক্ষ নেই। তার অবিরাম একটাই চিন্তা, সুধাদের বাড়িতে ঝিনুককে পাওয়া যাবে কি? বিনয় প্রায় নিশ্চিত, ঝিনুক ওখানে যায়নি। তবু একবিন্দু অলীক দুরাশা বুকের ভেতর যেন ধুকধুক করে। যদি গিয়ে থাকে?
টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের তলা দিয়ে ট্রাম একসময় সুধাদের বাড়ির কাছাকাছি স্টপেজটায় এসে থামতেই নেমে পড়ল বিনয়। ব্রিজের ওধারের তুলনায় এদিকটায় আলো অনেক কম। সব কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা। চারদিকের বাড়িটাড়ি এবং টিনের চালের চাপ-বাঁধা বস্তি ভুতুড়ে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কুয়াশা আর আলো-আঁধারি ভেদ করে সুধাদের বাড়ির সামনে এসে কড়া নাড়ল বিনয়। একটু পর সদর দরজা খুলে দিল উমা। বিনয়কে দেখে সে ভীষণ অবাক। সন্ধেবেলায় ঝিনুককে নিয়ে যে চলে গিয়েছিল, দু-আড়াই ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই আচমকা সে ফিরে আসবে, উমা ভাবতে পারেনি।
প্যাসেজে আলো জুলছিল। উমার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে বিনয় ডাকতে লাগল, ছোটদি, হিরণদা–
ওধারের কোনও একটা ঘর থেকে হিরণ আর সুধা প্রায় ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির মুখে চলে এল। বিনয়কে দেখে উমার মতো তারাও হতবাক। বিস্ময় একটু থিতিয়ে এলে সুধা জিজ্ঞেস করল, তুই চলে এলি! ঝিনুক কোথায়? বাবার সঙ্গে বলতে বলতে বিনয়ের মুখের দিকে ভাল করে নজর পড়তেই থমকে গেল। চুল এলোমেলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা। দেখেই টের পাওয়া যায়, তার ওপর দিয়ে এলোপাতাড়ি ঝড় বয়ে গেছে।
রুদ্ধ গলায় সুধা বলল, কী হয়েছে রে বিনু?
হিরণ একদৃষ্টে বিনয়কে লক্ষ করছিল। সুধাকে বলল, আগে ঘরে এসে বিনু বসুক। তারপর যা জিজ্ঞেস করার কোরো।
বাইরের ঘরে এনে বিনয়কে বসানো হল। হিরণরাও বসেছে। মুহূর্তের জন্যও ভাইয়ের মুখ থেকে চোখ সরায়নি সুধা। সে কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিনয় বলে, ঝিনুক কি তোদর এখানে এসেছে?
হিরণ সুধা, দুজনেই চমকে ওঠে। সুধা বলে, না। তোর সঙ্গে এই কিছুক্ষণ আগে ও-বাড়িতে গেল। একা একা এখানে ফিরে আসবে কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
ভাঙা ভাঙা, আবছা গলায় বিনয় বলল, ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে না।
হতচকিত সুধা প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কী বলছিস বিনু!
হিরণ ধীর, স্থির, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। সহজে বিচলিত হয় না। সেও বিহুলের মতো বলে, কোথায় যাবে ঝিনুক? তোমাদের বাড়িটা ভাল করে খুঁজে দেখেছ?
একতলা থেকে তেতলা অবধি সবগুলো ঘর, বারান্দা, প্যাসেজ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে।
হঠাৎ কী এমন হল যে, ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে গেল? ও-বাড়িতে ওকে নিয়ে যাওয়ায় তোমার বাবা কি খুশি হননি? মানে, উনি হয়তো ঝিনুককে — কথা শেষ না করেই থেমে গেল হিরণ।
হিরণের ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়ার সঠিক কারণটা ধরে ফেলেছে সে। বিনয় তক্ষুনি উত্তর দেয় না। অদ্ভুত এক কষ্ট তার গলার ভেতর জমাট বাঁধতে থাকে। অনেকক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে শুরু করে। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে ঝিনুককে নিয়ে সন্ধেবেলায় অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা করার পর থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব জানিয়ে বলে, ঝিনুকের খোঁজে বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিল। বাবাকে গিয়ে খবরটা দিই, ও এ-বাড়িতে আসেনি।
শুনতে শুনতে শ্বাসক্রিয়া যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সুধার, হিরণের। ফুসফুসে জোরে বাতাস টেনে হিরণ বলল, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই
বিনয় উঠে পড়েছিল, না না, এত রাতে আপনাকে যেতে হবে না। ট্রাম বাস চলছে। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।
সুধা আর হিরণও উঠে দাঁড়ায়। উৎকণ্ঠিত সুধা জিজ্ঞেস করল, ঝিনুককে কি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে?
এতক্ষণ নিজেকে অনেকখানি সংযত রেখেছিল বিনয়। এবার উন্মাদের মতো মাথা ঝাঁকাতে থাকে, জানি না, জানি না, জানি না–
.
০২.
সেই যে ঝিনুক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল তারপর কদিন কেটে গেল। বিনয় প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে অবনীমোহনের কাছেই আছে। সারাক্ষণ উভ্রান্তের মতো অবস্থা। সকালের দিকে বেলা একটু বাড়লে সে সোজা থানায় চলে যায়। ফের যায় সন্ধেবেলায়। যদি ঝিনুকের কোনও খবর পাওয়া যায়। কিন্তু নেহাতই দুরাশা।
ওসি দিবাকর পালিত অত্যন্ত ভদ্র, ভালমানুষ। পুলিশ বলতে যে রুক্ষ, কর্কশ, হাড়হিম করা একটা চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে তার সঙ্গে এঁর আদৌ মিল নেই। খুবই সহানুভূতিপ্রবণ। বিনয় থানায় এলে তাকে যত্ন করে বসান। তার কথাবার্তায় সহৃদয়তার ছাপ, গভীর সমবেদনা।
যখনই বিনয় থানায় আসে, বিব্রতভাবে দিবাকর বলেন, না, কোনও খবর নেই। একটি মেয়ে হিমঋতুর এক সন্ধ্যায় কলকাতার মতো বিপুল শহরে বিলীন হয়ে গেছে, অথচ সুশৃঙ্খল, রিশাল পুলিশবাহিনী তাকে খুঁজে বার করতে পারছে না, এ লজ্জা, এ গ্লানি যেন তারই।
বিনয় করুণ মুখে বলে, আপনাদের লোকজনকে একটু ভাল করে খোঁজ নিতে বলুন স্যার। এই একই কথা রোজই বলে সে। একই ধরনের কাকুতি মিনতি।
কোমল স্বরে দিবাকর বলেন, আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই বিনয়। শুধু কলকাতা পুলিশ নয়, সারা ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশকেও অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। ঝিনুকের খবর পাওয়ামাত্র তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দেব।
তা তো বলেছেনই। তবু ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। কীভাবে যে আমার দিন কাটছে বলে বোঝাতে পারব না।
স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। তোমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারি বিনয়।
বিনয় বলে, সেই জন্যে আপনার কাছে চলে আসি।
দিবাকর বলেন, যখন ইচ্ছে, আসবে। মেয়েটাকে যতক্ষণ না ফিরে পাচ্ছি, আমাদেরও স্বস্তি নেই।
একটু চুপ করে থাকে বিনয়। তারপর বলে, আমি যে রোজ দুবার করে আসি, বিরক্ত হন না তো স্যার?
বিনয়ের একটা হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিয়ে দিবাকর বলেন, দুবার কেন, দশবার আসবে। আমাদের কাজ হল মানুষকে সাহায্য করা। কিন্তু ঝিনুকের বেলায় কিছুই করতে পারছি না। মেয়েটার জন্যে ভীষণ কষ্ট হয় বিনয়। পুলিশবাহিনীর অক্ষমতা তাঁকে বিমর্ষ করে তোলে।
শুধু দুবেলা থানাতেই হাজিরা দেয় না বিনয়। সময়ে অসময়ে যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ঘুরতে থাকে কখনও ট্রামে, কখনও বাসে। কখনও বা অলিগলির সহস্র পাকে জড়ানো মহানগরীর নানা প্রান্তে, পায়ে হেঁটে। চতুর্দিকে অজস্র মানুষ। ভিড়ের ভেতর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রিয় নারীটির মুখ খুঁজে বেড়ায় সে।
.
ঝিনুকের অদৃশ্য হবার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল আনন্দ, সুনীতি আর ঝুমা। তাছাড়া অবনীমোহন দীর্ঘ তীর্থভ্রমণের পর কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তার সঙ্গেও দেখা করা দরকার। সবাই জানে কিছুদিন পর চিরকালের জন্য তিনি তার গুরুর আশ্রমে চলে যাবেন। আর কখনও ফিরবেন কি না, ফিরলেও কবে ফিরবেন, তার ঠিক নেই।
অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা করার চেয়েও ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়াটা অনেক বিরাট আকারে, অনেক বেশি সংকট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দও সমানে ঝিনুকের খোঁজখবর চালিয়ে যাচ্ছে। তার চেহারার বিবরণ দিয়ে কতজনকে যে সন্ধান নেবার কথা বলেছে তার ঠিক নেই।
আনন্দ সুনীতি ঝুমা–সবাই ভীষণ চিন্তিত, বিমর্ষ। আনন্দ বিষণ্ণ সুরে বলেছে, কোথায় যে গেল মেয়েটা, কিছুই বুঝতে পারছি না।
সুনীতি অবনীমোহনকে বলেছে, বাবা, তোমার ওভাবে ঝিনুককে বলা ঠিক হয়নি।
ঝিনুক হারিয়ে যাবার পর অবনীমোহন প্রতিটি মুহূর্ত অনুশোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন। জবাবদিহির সুরে বলেছেন, আমি কিন্তু ঝিনুককে কিছুই বলিনি। বিনুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলব বলে ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছিলাম। চলেও গিয়েছিল। কিন্তু বাইরে গিয়ে মেয়েটা যে শুনে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি।
এদিকে পলকহীন আনন্দর দিকে তাকিয়ে থেকেছে বিনয়।
বিনয়ের মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে আসছিল, আমার বাবাই শুধু নয়, তোমার মাও কতখানি হৃদয়হীন ব্যবহার ঝিনুকের সঙ্গে করেছে সেটা ভেবে দেখ– কথাগুলো অবশ্য বলা হয়নি।
ঝুমা কিন্তু বিনয়কে আড়ালে ডেকে নিয়ে হেমনলিনী সম্পর্কে বলেছে, আমার দিদা এখন ভালমানুষ মাজছে। সারাক্ষণ তার মুখে ঝিনুকের জন্য আহ, উন্থ। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। দিদার ন্যাকামো দেখে গা জ্বলে যায়। ঝিনুক যখন ও-বাড়িতে ছিল, কী অসভ্যতা করেছে, আমি জানি না?
একটা মানুষের নিরুদ্দেশ হবার সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের যে কত রকম প্রতিক্রিয়া! বিনয় উত্তর দেয়নি।
ঝুমা তীব্র, কটু গলায় এবার বলেছে, কীরকম কায়দা করে দিদা ও-বাড়ি থেকে মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিল! ইতর! অমানুষ! সে থামেনি, দিদা যদি ঝিনুককে তাদের কাছে থাকতে দিত, এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটত না।
বিনয় বলেছে, তুমি যা ভাবছ তা হয়তো ঠিক নয়, ঝুমা।
বুঝতে না পেরে ঝুমা জিজ্ঞেস করেছে, কী ঠিক নয়?
ধর তোমার দিদিমা হয়তো ভাল ব্যবহার করতেন। কিন্তু তাঁর কাছে চিরকাল তো থাকা যেত না। একদিন না একদিন বাবার কাছে চলে আসতে হতো। ছোটদিদের কাছে সপ্তাহ দুই থেকে চলেও এসেছিলাম। কিন্তু বাবাও একই কাণ্ড করলেন। একা মাউইমাকে দোষ দিয়ে কী হবে? সবই ওর ভাগ্য।
ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিও না বিনুদা। দু-দুটো বয়স্ক মানুষ ওর ওপর এমন জঘন্য অন্যায় করল, আর তুমি ভাগ্যের ওপর ওদের অপরাধ চাপিয়ে দিচ্ছ! তোমার কাছে এটা আশা করিনি। একটু থেমে ধরা ধরা গলায় বলেছে, ঝিনুকের জন্যে কী কষ্ট যে হচ্ছে বিনুদা– তার দুচোখ ক্রমশ বাষ্পে ভরে যাচ্ছিল।
হতবাক তাকিয়েই থেকেছে বিনয়। এই কি সেই ঝুমা যে চটুল, প্রগম্ভ, সারাক্ষণ যার কলকলানি। সেই কোন কৈশোর থেকে তার মাথায় অবিরল প্রেম প্রেম খেলা চলে আসছে। অদৃশ্য পোকার মতো যেটা সমানে কুটুর কুটুর কামড়ায়। বিনয়কে রাজদিয়ায় প্রথম দেখার পর থেকেই সেই কামড়টা শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পাকা মেয়েটা মাত্র বারো বছর বয়সে একটি চুম্বনে তার রক্তমাংসে শুধু শিহরনই জাগায়নি, তাকে এক লহমায় যৌবনের অনন্ত রহস্যের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে। ঘিরে ঝিনুকের সঙ্গে কী তীব্র প্রতিযোগিতা, কী নিদারুণ মহাযুদ্ধ! তাকে দখল করার জন্য কতরকম ফন্দিই না বার করত ঝুমা। কিন্তু ঝিনুকের চোখে ধুলো ছিটানো অত সহজ নয়। ফি বারই কুমার যাবতীয় কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে সে। কলকাতায় এসেও কি সেই অঘোষিত যুদ্ধ থেমেছে? ঝিনুক লাঞ্ছিত হয়েছে, তার শরীর ও মন ভেঙেচুরে তছনছ, মাথার ওপর সৌরলোক শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে কিন্তু লহমার জন্যও বিনয়ের স্বত্ব ছাড়তে সে রাজি হয়নি। এদিকে ঝুমাও পণ করেছিল, বিনয়কে সহজে ছেড়ে দেবে না।
অথচ সেই ঝুমারই দুচোখ ঝিনুকের জন্য জলে ভরে গেছে। এই ঝুমা বিনয়ের অচেনা। যাকে সে এতকাল দেখে এসেছে, যার স্বভাবের অন্ধিসন্ধি তার জানা, সে যেন অন্য কেউ। ঝুমার ভেতর থেকে এমন বিস্ময়কর এক তরুণী বেরিয়ে এসেছে যার কথা আগে কখনও ভাবেনি বিনয়। একই মানুষের ভেতর কত ধরনের মানুষ যে লুকনো থাকে! ঝিনুকের জন্য ঝুমার কষ্ট যে কতখানি আন্তরিক তা বুঝিয়ে দিতে হয় না।
ঝুমা আকুলভাবে বলেছে, বিশ্বাস কর বিনুদা, এটা আমি চাইনি। যেমন করে পার ওকে খুঁজে বার কর। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করেছে, রাস্তায় বেরুলে আমাদের বয়সী মেয়ে দেখলেই তার দিকে ভাল করে তাকাই, যদি ঝিনুককে পেয়ে যাই। কিন্তু না, আজও তার দেখা পাইনি তার গলা বিষাদে ভরে গেছে।
সুধা আর হিরণ কাছাকাছি থাকে। তারা রোজই এসেছে।
সুধা জানিয়েছে, তার দাদাশ্বশুর এবং জেঠশাশুড়ি এক্ষুনি পাটনা থেকে ফিরছেন না। আরও মাসখানেক মাসদেড়েক ওখানে থাকবেন। কাচুমাচু মুখে বলেছে, বাবার কাছে তোদের যদি আসতে না দিতাম! আরও কিছুদিন তোরা আমার কাছে থেকে যেতে পারতিস। মেয়েটা কত সুস্থ, কত স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল।
বিনয় জবাব দেয়নি।
সুধা একটানা বলে গেছে, ঝিনুককে বাবার কাছে না নিয়ে এলে এমন বিপদ ঘটত না।
বিনয় বলেছে, তোদের ওখানে চিরকাল তো থাকা যেত না। এক, দেড় মাস না হয় তোর দাদাশ্বশুরের আসা পিছিয়ে গেছে। তারপর কী হতো?
সুধা চুপ করে থেকেছে।
বিনয় বলেছে, তাছাড়া বাবা ফিরে এসেছে। তারপর তোদের ওখানে কি আর থাকা যায়?
সুধা একটু ভেবে বলেছে, বাবার যে এতটা পরিবর্তন হবে, চিন্তা করতে পারিনি। কত উদার ছিলেন। ভেবেছিলাম ধর্মকর্ম করছেন। কিন্তু সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারলেন না।
এখন এসব আলোচনা করে কী হবে ছোটদি? সবচেয়ে আগে যা দরকার তা হল ঝিনুককে খুঁজে বার করা।
একটা কথা তোকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি—
কী?
সুধা জেদি গলায় বলেছে, ঝিনুককে পাওয়া গেলে আমার কাছে নিয়ে যাব। সে ওখানেই থাকবে।
এসব সুধার আক্ষেপের কথা মনঃকষ্টের কথা আবেগের কথা মানসিক যাতনার কথা। অবনীমোহনের ওপর সে যে ভয়ানক ক্ষুব্ধ, সুধার মতো একটি চিরদুঃখী মেয়ের প্রতি তার নির্দয় আচরণ সে যে আদৌ মেনে নিতে পারেনি, অশেষ ক্লেশে তার বুক যে ভেঙেচুরে গেছে, সেটা বুঝতে পেরেছিল বিনয়। অসহ্য ক্রোধে, অভিমানে সুধার মাথা থেকে যাবতীয় যুক্তিতর্ক লোপ পেয়ে গিয়েছিল। ঝিনুককে যদি সত্যিই পাওয়া যায় আর সুধা তাকে টালিগঞ্জে নিজের কাছে নিয়ে তোলে, পাটনা থেকে ফিরে ওর দাদাশ্বশুররা এসে তাকে দেখলে কত সহস্র সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেসব ভাবেনি সুধা। রাগে, অসন্তোষে, মস্তিষ্কের অসহ্য উত্তাপে তখন সে টগবগ ফুটছে। তাকে বোঝাতে যাওয়া মুশকিল। অগত্যা বিনয় চুপ করে থেকেছে।
সুধা কিন্তু অত সহজে ছাড়েনি, কী, ঝিনুক আমার কাছে থাকবে তো?
বললাম তো, ও আগে ফিরে আসুক। তারপর দেখা যাবে।
.
আরও কটা দিন পার হয়ে গেল।
থানায় বা রাস্তায় রাস্তায় উন্মাদের মতো বিনয়ের ছোটাছুটিই সার। মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে কোথায় যে ঝিনুক মিলিয়ে গেছে তার কোনও হদিসই পাওয়া গেল না। কখনও পাওয়া যাবে কি না, কে জানে।
একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে বিনয়। ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর সবার আক্ষেপ এবং ক্লেশের তীব্রতা ক্রমশ কমে আসছে। শোক, দুঃখ বা মানসিক যাতনা তো চিরদিন উঁচু তারে বাঁধা থাকে না। পার্থিব নিয়মেই শিথিল হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা সয়েও আসে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসহনীয় বলে বুঝি বা কিছু নেই। কিন্তু বিনয়ের কষ্টটা যত দিন যাচ্ছে, অসহ্য হয়ে উঠছে। জীবনের কতখানি অংশ যে ঝিনুক ফাঁকা করে দিয়ে গেছে, প্রতিটি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে। আর দুঃখের সীমা-পরিসীমা নেই সুধার। বিনুর সঙ্গে দেখা হলে তার একটাই কথা কেন মেয়েটাকে ভবানীপুরে আসতে দিয়েছিলাম! কেন তাকে জোর করে নিজের কাছে ধরে রাখিনি!
কদিনে সবচেয়ে আশ্চর্য রকমের বদলে গেছেন অবনীমোহন। গোড়ার দিকের সেই মনস্তাপ প্রায় নেই বললেই চলে। ইদানীং তিনি বলছেন, কারও কিছু করার নেই। ঈশ্বরের খুব সম্ভব এটাই ইচ্ছা ছিল। তার নির্দেশ ছাড়া কিছুই হবার নয়। এমনকি একটা ঘাসের ডগাও নড়ানো যায় না। যা ঘটে গেছে ঈশ্বরের বিধান হিসেবে তা মেনে নিতে হবে।
ধর্মকর্ম করলে মানুষ কি চরম নিরাসক্ত হয়ে যায়? কিংবা নিষ্ঠুর? অবনীমোহনের সান্ত্বনা বাক্যগুলি ফাঁকা ফাঁকা, অসার মনে হয়। ঝিনুকের নিরুদ্দেশ হবার মতো এত বড় একটা ঘটনাকে ঈশ্বরের ইচ্ছায় চাপিয়ে দিয়ে যিনি দায়মুক্ত হতে চান তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভয় হয় বিনয়ের। এই নির্মোহ, মমতাহীন অবনীমোহন তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অন্য কোনও অপরিচিত গ্রহের মানুষ।
বাবাকে দেখতে দেখতে চমকে ওঠে বিনয়। মনে পড়ে সেদিন ঝুমাকে সেও বলেছিল, ঝিনুক যে নিরুদ্দেশ হয়েছে সেটা তার ভাগ্যলিপি। অবনীমোহন ঈশ্বরের ঘাড়ে দায়টা চাপিয়েছেন আর সে চাপিয়েছে ভাগ্যের ওপর। দোহাইটা প্রায় একইরকম। কিন্তু ভাগ্যকে টানাটানি করার লেশমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। কেন যে মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছিল তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ঝিনুকের নিখোঁজ হবার আসল হেতুটা কী তা সে জানে না? খুব জানে। এ নিয়ে যত ভাবে, নিজের কাছে ততই ছোট হয়ে যায়।
অবনীমোহন আজকাল প্রায়ই বলেন, ঝিনুকের চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তোমার সামনে অফুরন্ত ভবিষ্যৎ। তুমি তার কথা ভাবো।
বাবার কথায় উত্তর দেয় না বিনয়। তার সব উৎসাহ, বেঁচে থাকার আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। সমস্ত উদ্দীপনা ম্রিয়মাণ।
.
আজ বৃহস্পতিবার।
অঘ্রান মাস পড়ে গেছে। বেশ কিছুদিন হল উত্তুরে হাওয়ায় টান ধরেছিল। এমনিতে কলকাতায় ঠাণ্ডাটা একটু দেরিতেই হানা দেয়। কিন্তু এ-বছর অনেক আগেই এসে পড়ল।
অবনীমোহন তেতলায় তার ঘরের পাশের ঘরটায় বিনয়কে থাকতে বলেছিলেন। অর্থাৎ যে কদিন বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা না হচ্ছে, এখানেই সে থাকুক। বিনয় তেতলাটা পছন্দ করেনি। দোতলার কোণের একটা ঘর বেছে নিয়েছে।
অন্যদিনের মতো আজও সকালের দিকে থানায় গিয়েছিল বিনয়। তারপর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঝিনুকের খোঁজে ঘোরাঘুরি করে যথারীতি ক্লান্ত এবং নিরাশ হয়ে দুপুরের খানিক আগে ফিরে এসেছে। চান করতে হয় তাই চান করেছে, খেতে হয় তাই খেয়েছে। মুখ এতই বিস্বাদ, জিভ আগাগোড়া এমনই কটু এবং তিক্ততায় ভরা যে ভাত ডাল তরকারি কী খেয়েছে, কিছুই ভাল করে বুঝতে পারছিল না।
খাওয়ার পর নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল বিনয়। শিয়রের দিকের জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হুহু করে। কলকাতার তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ঝপাঝপ। অতি দ্রুত।
বেলা অনেকটা হেলে গেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে দূরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর আড়ালে। অঘ্রানের ক্ষীণায়ু দিন ঝটিতি ফুরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ত্বরিত পায়ে নেমে আসবে সন্ধে। তারই তোড়জোড় চলছে।
কনকনে হাওয়া যে গায়ে ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছে, খেয়াল নেই বিনয়ের। তার শরীর থেকে শীতবোধটাই কেউ বুঝি বা হরণ করে নিয়েছে।
অবনীমোহন বাড়িতে নেই। কী একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছেন সন্ধের পর ফিরবেন। খগেন একতলায় কী করছে, কে জানে। লোকটা হাত-পা গুটিয়ে এক লহমা চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। সর্বক্ষণ এটা করছে সেটা করছে।
কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে, নিজেই টের পায়নি বিনয়।
আচমকা চেনা একটা গলা কানে ভেসে আসতে শিরায়ুতে চমক খেলে যায়। ছুটোবাবু ছুটোবাবু –সেই সঙ্গে সিঁড়ি ভাঙার ধুপধাপ আওয়াজ।
খানিক পরে দেখা যায় দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যুগল, সুধা এবং সবার পেছনে খগেন।
চকিতে হাতের পিঠে চোখের জল মুছে ধড়মড় করে উঠে বসে বিনয়। যুগলকে এ-বাড়িতে এসময় দেখতে পাবে, ভাবতে পারেনি। আসলে ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর যুগলের কথা ক্ষণকালের জন্যও তার মাথায় আসেনি। সারা পৃথিবী তার কাছে পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
বিনয় বলল, আয় ছোটদি, এস যুগল, ভেতরে এসে বোসো- খগেন যে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তাকে বলল, তুমি তোমার কাজ কর গিয়ে
খগেন নীরবে চলে গেল।
যুগল আর সুধা ঘরে এসে ঢোকে। সুধা বিনয়ের খাটের একধারে বসে পড়ে। যুগল মেঝেতে থেবড়ে বসে। বিনয় লক্ষ করল, যুগলের পায়ের ব্যান্ডেজ অনেক ছোট হয়ে গেছে। চলাফেরায় বা উঠতে বসতে আগের সেই কষ্টটা আর নেই। মারাত্মক চোটটা প্রায় সেরে এসেছে।
বিনয় হাঁ হাঁ করে ওঠে, ও কী, ওই ঠাণ্ডা মেঝেতে বসলে কেন? ওই কোণে বেতের মোড়া আছে। একটা টেনে এনে বোসো।
যুগল তার কথায় আমল দেয় না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, এইটা কী অ্যামন টালকি (ঠাণ্ডা)? আমাগো মুকুন্দপুরে গিয়া দ্যাহেন, শীতে শরীল এক্কেরে কালাইয়া যাইব। হেইতেই আমার কিছু হয় না। কইলকাতার এই টালকিতে কী আর হইব? আমার লেইগা ভাইবেন না ছুটোবাবু
যুগল যে তার সামনে উঁচু জায়গায় অর্থাৎ চেয়ার বা মোড়ায় বসতে চায় না তা আগেই জেনে গেছে বিনয়। যাদের বাড়িতে কামলা খেটেছে তাদের সঙ্গে একই উচ্চতায় তাকে বসানো মুশকিল। অন্য সময় হলে জোরজার করত কিন্তু এই মুহূর্তে এ-সব নিয়ে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
যুগল পলকহীন বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখটা ক্রমশ মলিন হয়ে যেতে থাকে। বিষঃ এবং করুণ। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বলল, বিষুদবার বিষুদবার হাসপাতালে ঘাও (ঘ) ধুয়াইয়া, পট্টি পালটাইয়া ছুটোদিদির বাড়িত যাই। আইজ আইয়া যা শুনলাম, বুক এক্কেরে ভাইঙ্গা গ্যাছে ছুটোবাবু। এয়া (এ) আমি চিন্তাও করতে পারি নাই। তার কণ্ঠমণিটা সমানে ওঠানামা করছে। গলা ধীরে ধীরে বুজে এল।
বিনয়ের মনে পড়ে গেল, ফি বেস্পতিবার হাসপাতাল থেকে সুধাদের বাড়ি আসে যুগল। সে কী ইঙ্গিত দিয়েছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। যুগলের কষ্টটা তার নিজের যন্ত্রণাকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিনয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, পারল না। গলার কাছে শক্ত, নিরেট পাথরের মতো কী যেন ডেলা পাকিয়ে গেল।
সুধা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলল, হাসপাতাল থেকে আমাদের কাছে এসেই যুগল তোদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ঝিনুক চলে গেছে শুনে পাগলের মতো হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তক্ষুনি তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে চলে আসতে চাইছিল। সেই কতদূর মুকুন্দপুর থেকে কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি। অনেক কষ্টে ওকে আটকে রেখে দুটি ভাত খাওয়ালাম। তারপর আর ধরে রাখা গেল না। আমিও ওর সঙ্গে চলে এলাম। একটু থেমে বলল, খগেনের কাছে শুনলাম বাবা নাকি বেরিয়েছে।
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, হ্যাঁ।
প্রশ্নটা অর্থহীন, তবু সুধা জিজ্ঞেস করে, ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া গেল না?
বিনয় চুপ করে থাকে। তার নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই উত্তরটা রয়েছে।
বিমর্ষতা খানিক কাটিয়ে উঠেছিল যুগল। ঝাঝালো গলায় এবার বলে, পুলিশের অত জবর জবর কর্তারা রইছে। গরমেন তাগো মেলা মেলা (অনেক অনেক) ট্যাকা দিয়া পুষতে আছে। এট্টা বষ্যের মাইয়া (যুবতী) সন্ধ্যাবেলা শয়ে শয়ে মাইষের চৌখের সুখে (সামনে) হারাইয়া গ্যাল। হেরে (তাকে) অ্যাত দিনেও বিচরাইয়া (খুঁজে) বাইর করতে পারল না? পুলিশের পিছনে ট্যাকা খরচা করনের কুন কাম? পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, রাগ এবং বিরক্তি উগরে দিতে লাগল সে।
বিনয় কী জবাব দেবে? সে তো রোজই দুবার করে থানায় হাজিরা দেয়। দিবাকর পালিতদের আন্তরিকতা বা চেষ্টার কোনও খামতি নেই। থানায় যাওয়া ছাড়া বিনয় নিজেও রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে, কতদিন ধরে কম ঘুরছে? কিন্তু ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে কই?
আক্ষেপের সুরে যুগল এবার বলল, ঝিনুক বইনেরে আমাগো মুকুন্দপুরে যদিন লইয়া যাইতেন, এই সব্বনাশটা হইত না। আমরা বইনেরে বুকে কইরা রাখতাম।
আবেগের ঝেকে কথাগুলো বলল যুগল। কিন্তু সবে ঝিনুককে নিয়ে কলকাতায় এসেছে বিনয়। এখনকার আত্মীয়পরিজন ছেড়ে বহু দূরে এক বিজন এলাকার জবরদখল কলোনিতে তাকে নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব ছিল? যুগল যদিও ভরসা দিয়েছিল, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত তরুণী অনেকেই আছে মুকুন্দপুরে। সেখানে ঝিনুকের অসম্মান বা গ্লানির কোনও কারণই নেই, তবু সংকটের অবসান এত সহজ নয়।
প্রথমত, যুগলের সঙ্গে গত বেস্পতিবার যখন তার দেখা হয়, তখনও অবনীমোহন কলকাতায় ফিরে আসেননি। তার সঙ্গে কথা না বলে সে ঝিনুককে নিয়ে মুকুন্দপুরে যায়ই বা কী করে? আর যুগল বলল বলেই হুট করে ওখানে গিয়ে থাকতে শুরু করল, তা কি আদৌ সম্ভব? সুধা তাদের ছাড়ত না, হিরণ ছাড়ত না। সুনীতি আর আনন্দ মুখ ফুটে হয়তো কিছু বলত না। কিন্তু কষ্ট কি কম পেত? তাছাড়া মুকুন্দপুরে উঠতই বা কোথায়? কলোনির লাগোয়া বিশাল জঙ্গল নির্মূল করে জমি বার করা হবে, সেখান থেকে তাকে সাত কাঠা জায়গা দেওয়া হবে। মোটামুটি এটাই ওখানকার বাসিন্দাদের একান্ত ইচ্ছা। কিন্তু জমি পেলেই তো হয় না, সেই জমিতে ঘরবাড়ি তুলতে হবে, তবেই মুকুন্দপুরে যাওয়া। অবশ্য তারা গেলে যুগলরা তো বটেই, কলোনির অনেকেই তাদের ঘর ছেড়ে দিত। শুধু তাই না, মাথায় করেও রাখত। কিন্তু ওভাবে তো থাকা যায় না।
পরক্ষণে বিনু নিজেকে জোরে ধমক কষায়। মুকুন্দপুরের মানুষজন সবাই যুগলের মতো সোজাসাপটা সাদাসিধে হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। প্যাগোয়া লোকও কি দুচারটে ওখানে নেই? মুখ ফুটে হয়তো তারা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করত না, কিন্তু তাদের অনেকের মাথায় এই প্রশ্নটা অবিরত পাক খেত, বিনুর সঙ্গে ঝিনুকের সম্পর্কটা কী? বিয়ে হয়নি তবু তাকে নিয়ে হাজির হয়েছে, এটা খুবই দৃষ্টিকটু।
তাছাড়া, কলকাতায় বিনয়ের চাকরি ঠিক হয়ে আছে। খবরের কাগজের নিয়মকানুন কিছুই তার জানা নেই। কতক্ষণ তাকে অফিসে থাকতে হবে, কী করতে হবে, কখন ছুটি পাওয়া যাবে, কে জানে। অতদূর থেকে রোজ তিন সাড়ে তিন মাইল হেঁটে আগরপাড়া স্টেশনে এসে শিয়ালদা, সেখান থেকে বাসে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। কাজ সেরে একই রুটে আবার মুকুন্দপুরে ফেরা। না না, রোজ এত সব তার পক্ষে অসম্ভব।
হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল হল, কী হাবিজাবি ভাবছে সে। যাকে নিয়ে মনের ভেতর এমন আলোড়ন, সেই ঝিনুকই তো নিরুদ্দেশ। এ ধরনের অনর্থক চিন্তায় নিজেকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না।
দুই হাঁটুর ফাঁকে থুতনি রেখে কী ভাবছিল যুগল। হঠাৎ তড়িৎগতিতে মুখ তুলে ডাকল, ছুটোবাবু।
বিনয় চকিত হয়ে ওঠে, কিছু বলবে?
আমার কী মনে লয় জানেন?
কী?
ঝিনুক বইনে হেই দিন মনের কষ্টে কুনখানে যাইতে পারে, মেলা (অনেক) ভাইবা দেখলাম।
অবাক বিনয় জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে?
যুগল বলে, আমার মনে লয়, দুইহানে হের (তার) যাওনের জাগা আছে। পেরথমটা হইল পাকিস্থান
বিনয় এবং সুধা হতভম্ব। একসঙ্গে তারা বলে ওঠে, পাকিস্তান! কী বলছ তুমি! যেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বিনয় তাকে বর্ডারের এপারে নিয়ে এসেছে, ঝিনুক সেই হননপুরীতে ফিরে যাবে, এ ভাবাই যায় না। সেখানে তার ভরসা বলতে হেমনাথ, স্নেহলতা আর শিবানী। এই মুহূর্তে হেমনাথরা কোন সংকটের মধ্যে রয়েছেন, কে জানে। তার চেয়েও বড় সমস্যা ঝিনুক একা একা ট্রেনে, স্টিমারে এবং নৌকোয় করে রাজদিয়ায় ফিরে যেতে পারবে তা কল্পনা করতেও সাহস হয় না। এই সম্ভাবনাটা পুরোপুরি নাকচ করে দিল বিনয়। কলকাতায় যতই অসম্মান আর গ্লানিবোধে ঝিনুকের সমস্ত অস্তিত্ব খান খান হয়ে যাক, পাকিস্তানে তার ফিরে যাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
যুগল বলল, তাইলে আর-একহানে যাইতে পারে—
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কোথায়?
শিয়ালদার ইস্টিশানে। হেইহানে রিফুজিগো লগে বুঝিন মিশ্যা রইছে।
হাতে একটা পয়সা নেই। তার ওপর এই শহরের কতটুকুই বা দেখেছে ঝিনুক! সেদিন সন্ধ্যায় হিমঋতুর কুয়াশা যখন অবিরল ঝরে চলেছে তখন সে কি হেঁটে হেঁটে যেতে পেরেছে শিয়ালদা পর্যন্ত এতটা পথ? পরক্ষণে ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা বিনয়ের মাথায় চকিতে হানা দিয়ে যায়। গেলে একমাত্র সেখানেই যেতে পারে ঝিনুক। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে। শিয়ালদা স্টেশন, সেখানকার অতগুলো প্ল্যাটফর্ম, বাইরে বিশাল খোলা চত্বর জুড়ে শুধুই উদ্বাস্তু। হাজার হাজার মানুষের থিকথিকে ভিড়ে আশ্রয় পেতেই পারে সে, আদৌ যদি শিয়ালদায় পৌঁছে থাকে।
যুগল বলল, লন (চলুন) যাই ছুটোবাবু, শিয়ালদা ইস্টিশানখান একবার বিচরাইয়া দেহি। ভগমান মুখ তুইলা চাইলে, ঝিনুক বইনেরে হেইখানে পাইয়াও যাইতে পারি– ।
সাঁতার না-জানা মানুষ মহাসমুদ্রে পড়লে হাতের কাছে একটা কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। সুধা বলল, যা না বিনু, যুগলের সঙ্গে শিয়ালদায় গিয়ে একবার দ্যাখ। কে বলতে পারে, ঝিনুক হয়তো সেখানেই চলে গেছে
গুছিয়ে ভাবার মতো শক্তি বা সাহস কোনওটাই অবশিষ্ট নেই বিনয়ের। শিয়ালদায় গেলেই ঝিনুককে পাওয়া যাবে, এমন আশা শতভাগের একভাগও আছে কি না সন্দেহ। তবু কেউ যেন ভেতর থেকে তাড়া দিয়ে বিনয়কে টেনে তুলল। নাও যদি পাওয়া যায়, যুগল যখন চিন্তাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, একটা চেষ্টা অন্তত করা যাক।
জামাকাপড় পালটে যুগলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বিনয়। ওদের সঙ্গে সুধাও বেরুল। সে বাড়ি ফিরে যাবে। রাস্তা পেরিয়ে ওধারে গিয়ে বাসে উঠল বিনয়রা। টালিগঞ্জের ট্রামের জন্য এপাশে দাঁড়িয়ে রইল সুধা।
.
০৩.
ধর্মতলায় এসে বাস বদলে বিনয় আর যুগল যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছল, শীতের বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দূরে হ্যারিসন রোড আর সার্কুলার রোডের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় যে মলিন, নিবু নিবু রোদটুকু লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? চোখের পলক পড়তে না পড়তেই মুছে যাবে।
এর মধ্যেই মিহি কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি হিমকণা।
ট্রামরাস্তা দিয়ে পাঁচমেশালি আওয়াজ করে স্রোতের মতো ঊধ্বশ্বাসে ছুটছে অজস্র যানবাহন। ট্রাম বাস রিকশা ট্যাক্সি ঘোড়ার গাড়ি, এমন কত কী। আর রয়েছে মানুষের ভিড়। কেউ থেমে নেই। সবাই দৌড়চ্ছে। কলকাতা সদাব্যস্ত, সতত ধাবমান। লহমার জন্যও কারও দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। সকাল থেকে বেশ খানিকটা রাত পর্যন্ত কলকাতার যে-কোনও বড় রাস্তায় এমনটাই চোখে পড়ে।
ট্রাম লাইন পেরিয়ে এধারে এসে শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে ঢুকে পড়ল বিনয়। চতুর্দিকে সেই পরিচিত দৃশ্য। সীমান্তের ওপার থেকে আসা শরণার্থীতে সমস্ত এলাকা থিক থিক করছে। তাদের রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি বা করা যায়নি। সর্বত্র হই হই, চিৎকার, খিস্তিখেউড়, কুৎসিত কলহ।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে করে তার নিজস্ব কায়দায় একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছিল যুগল, ঝিনুক বইন আছ? থাকলে হুমৈর (সাড়া) দাও। ছুটোবাবুও আমার লগে আছে। যেইখানেই থাক হুমৈর দাও, হুমৈর দাও তার কণ্ঠস্বর শীতঋতুর বায়ুতরঙ্গে ভাসতে ভাসতে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
বিনয়ও চারপাশে ব্যগ্র চোখে উদ্বাস্তুদের মধ্যে ঝিনুককে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ঝিনুক বইন, ঝিনুক বইন করে চিৎকার করার ফাঁকে ফাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের যে উদ্বাস্তুরা পঁচিশ তিরিশ বর্গফুট জায়গা দখল করে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী সংসার পেতে বসেছে তাদের কাছেও খোঁজখবর নিচ্ছে যুগল, বয্যের (যুবতী) এক মাইয়া, অবিয়াত (অবিবাহিত), সোন্দরী, একইশ বাইশ বচ্ছর বস (বয়স), নাম হইল ঝিনুক। বড় দুখী, পাগল পাগল অবস্থা। দ্যাশ আছিল ঢাকা জিলার রাইজদা। তেনারে আপনেরা কেও দেখছেন?
দেশের ভিটে থেকে উৎখাত এইসব মানুষ, যে-যার নিজের নিজের হাজারো সমস্যায় এবং ভবিষ্যতের চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারা জানায়, এমন কারওকে দেখেনি। অন্যদিকে নজর দেবার সময় কোথায় তাদের?
গোটা চত্বর ঘুরতে ঘুরতে সন্ধে নেমে গেল। কুয়াশা দ্রুত গাঢ় হচ্ছে। সেই সঙ্গে গাড়ির ধোঁয়া আর ধুলো মাখামাখি হয়ে সব কেমন যেন আবছা আবছা।
একসময় দুজনে শিয়ালদা সাউথ সেকশনের স্টেশনের ভেতর চলে এল। এখানেও শয়ে শয়ে উদ্বাস্তু। বুড়োবুড়ি, যুবকযুবতী, মাঝবয়সী পুরুষ এবং মেয়েমানুষ, বাচ্চাকাচ্চা। আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন নরনারীর দল। যেদিকেই তাকানো যাক, সারি সারি ভাঙাচোরা, সন্ত্রস্ত মুখ। আঁতিপাঁতি করে খুঁজে এখানেও ঝিনুককে পাওয়া গেল না।
এবার বিনয়রা এল শিয়ালদা মেন স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মের এক মাথা থেকে আর এক মাথা অবধি যে ছিন্নমূল মানুষেরা সীমান্তের এপারে এসে ইটের সীমানা-ঘেরা ছোট ছোট খোপের ভেতর পড়ে আছে তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে ঝিনুকের চেহারার বর্ণনা দিয়ে খোঁজ করল। না, ঝিনুকের সন্ধান এখানেও কেউ দিতে পারল না।
যেখানে অগুনতি মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়, সারাক্ষণ যেখানে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা আর তাণ্ডব চলছে, সেখানে যুগলের বিবরণের সঙ্গে মেলে এমন একটি তরুণী যদি এসেও থাকে, কেউ তাকে লক্ষ করেনি।
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা চিরে গিয়েছিল যুগলের। সে বলল, কুনোহানেই তো ঝিনুক বইনেরে পাইলাম না। কই যে গেল! অহন কী করন যায় ছুটোবাবু?
বিনয় উত্তর দিল না। শিয়ালদা এসেই ঝিনুককে পাওয়া যাবে, তাও এতদিন বাদে, এমনটা ভাবতে পারেনি সে। তবু যুগলের কথায় তার মনের কোনও গোপন তলদেশে একটু দুরাশার সৃষ্টি হয়েছিল– যদি নিরুদ্দেশ ঝিনুকের সন্ধান মেলে। তাই এখানে ছুটে এসেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে অনুভব করল, বুকের ভেতর ধস নেমেছে। ভেঙেচুরে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত কিছু। মনে হল জীবন থেকে চিরকালের মতো যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বৃথাই তার খোঁজে ছোটাছুটি।
শ্রান্ত, হতাশ যুগল এবার বলে, আর এইহানে খাড়ইয়া থাইকা কী হইব? লন (চলুন) যাই গা। আপনেরে ধম্মতলার বাসে উঠাইয়া দিয়া আইসা আগরপাড়ার টেরেন ধরুম। আপনে ধম্মতলা থিকা বাড়িত যাইয়েন গা।
যে যুগল শিয়ালদা এলেই রাজদিয়া ও তার চারপাশের গ্রামগঞ্জ আর ভাটি অঞ্চলের মানুষজনের খোঁজ করে, আজ আর সে-সম্বন্ধে তার কোনও উৎসাহ নেই। দেশের মানুষ সম্পর্কে সব আগ্রহই যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। আসলে ঝিনুকের জন্য দুঃখে, বিষাদে মন ভরে আছে। কিছুই ভাল লাগছিল না তার।
বিনয় বলল, হ্যাঁ, চল– তার কণ্ঠস্বরে নৈরাশ্য মাখানো। এলোমেলো পায়ে যুগলের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে।
প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত থেকে গেটের দিকে যখন ওরা বেশ খানিকটা চলে এসেছে সেই সময় গোটা স্টেশন জুড়ে তুমুল চাঞ্চল্য দেখা দিল। প্ল্যাটফর্মের একধারে এখানকার পুরানো শরণার্থীদের দেখাশোনা এবং প্রতিদিন নতুন নতুন যারা আসছে তাদের আশ্রয় আর খাদ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করার জন্য সরকারি রিফিউজি অ্যান্ড রিলিফ ডিপার্টমেন্টের যে ক্যাম্প বসানো হয়েছে সেখান থেকে অফিসার এবং কর্মীরা ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এসে রেললাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দিন নেই, রাত নেই, সারাক্ষণ শিয়ালদা স্টেশনে তীব্র শোরগোল। এখন সেটা হাজারগুণ বেড়ে গেছে। পুরানো উদ্বাস্তুরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী বলতে লাগল, প্রথমটা বোঝা গেল না। পরে অবশ্য সব স্পষ্ট হল।
আইতে আছে, আইতে আছে—
পাকিস্থানের টেরেন আইতে আছে।
ঝিনুককে না পেয়ে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল বিনয়। নইলে ট্রেন আসার শব্দটা নিশ্চয়ই শুনতে পেত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, অনেক দূরে ডিসটান্ট সিগনালের ওধারে একটা ইঞ্জিন প্রকাণ্ড সরীসৃপের মতো ট্রেনের কামরাগুলো টানতে টানতে দুরন্ত গতিতে এদিকে ধেয়ে আসছে। সেটার কপাল থেকে হেডলাইটের তীব্র আলোর ছটা চারপাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে।
যুগল বলল, পাকিস্থানের টেরেন। ইট্টু খাড়ন ছুটোবাবু। দেহি যদিন আমাগো উইদিকের চিনাজানা (পরিচিত) কেও আইয়া থাকে। শরণার্থীদের ট্রেন দেখে রাজদিয়া অঞ্চলের মানুষজন সম্পর্কে পুরানো উদ্দীপনা আবার ফিরে এসেছে তার।
যুগল থেমে গিয়েছিল। তাকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। অগত্যা বিনয়ও দাঁড়িয়ে পড়ল। চকিতে তার মনে হল, এমনও তো হতে পারে, ঝিনুক সত্যিই রাজদিয়ায় ফিরে গেছে। আজকের এই ট্রেনে ওখানকার কেউ যদি এসে থাকে, তার কাছে হয়তো ঝিনুকের খবর পাওয়া যাবে। সেই যে নিত্য দাস হেমনাথের চিঠি নিয়ে এসেছিল এবং পরে সেই চিঠির উত্তর নিয়ে চলে গিয়েছিল, তারপর আর লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। রিফিউজিদের জন্য নির্দিষ্ট আজকের স্পেশাল ট্রেনটায় পরিচিত কারও দেখা মিললে শুধু ঝিনুকই নয়, হেমনাথদের সম্পর্কেও জানা যাবে।
চারদিক ঝাঁপিয়ে, সিটি দিতে দিতে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে থামল। লম্বা দৌড় শেষ। কয়লার ইঞ্জিন ফোঁস ফোঁস করে এখন হাঁপাচ্ছে।
মাসখানেকও কাটেনি, এমনই একটা ট্রেনে গোয়ালন্দ থেকে ঝিনুককে নিয়ে শিয়ালদায় এসেছিল বিনয়। সেদিনের মতো আজও প্রতিটি কামরায় গাদাগাদি ভিড়। ছাদের ওপরও অজস্র মানুষ, নানারকম লটবহর। বাক্স-পেটরা, পোঁটলা-পুটলি, হাঁড়িকুড়ি, ডালাকুলো, এমনই নানা জিনিস। যে যেটুকু পেরেছে, নিয়ে এসেছে।
পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর ইন্ডিয়ায় এসেও সবাই দিশেহারা। হয়তো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বিহুলের মতো তারা তাকিয়ে তাকিয়ে আলোকোজ্জ্বল স্টেশনের মানুষজন দেখছে। অনেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী সব বলছে। তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা। প্রতিটি কামরা থেকে বাচ্চাদের কান্না ভেসে আসছে।
প্রতিদিন রিফিউজি স্পেশাল এলে যা হয়, আজও তার হেরফের নেই। মাইকে অবিরাম ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তান থেকে যারা এসেছেন, হুড়োহুড়ি করবেন না। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে নেমে আসুন। সবার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করা আছে, ইত্যাদি। সরকারি ত্রাণবিভাগের কর্মীরা প্রতিটি কামরার সামনে গিয়ে উদ্বাস্তুদের ধীরে ধীরে নামিয়ে আনছে।
শিয়ালদায় এলে যা করে থাকে, আজও তাই করতে লাগল যুগল। কামরায় কামরায় হানা দিয়ে গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলে একটানা হেঁকে যাচ্ছে, রাইজদা দেলভাগ রসুইনা ডাকাইতা পাড়া মাইনকার চর গিরিগুঞ্জ সুজনগুঞ্জ থিকা কেউ আইয়া থাকলে হুমৈর দ্যান,
বিনয় যুগলের সঙ্গে যায়নি। প্ল্যাটফর্মের কোনায় দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছিল।
অনেকক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল যুগল। দশ কম্পার্টমেন্টের ট্রেনটা বিশাল লম্বা; পুরো প্ল্যাটফর্ম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাসা ভিড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনের শেষ মাথায় গিয়ে আবার এতটা ফিরে আসা মুখের কথা নয়।
যুগল বলল, আমাগো রাইজদার দিকের কেউ আইজকার গাড়িতে আহে নাই। লন (চলুন) যাই–
দুজনে গেটের দিকে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। কয়েক পা গেছে, পেছন থেকে কেউ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকল, বিনু–এই বিনু
গলার স্বরটা খুবই পরিচিত। চমকে ঘুরে দাঁড়াল বিনয়। আর তখনই রাজদিয়া হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার আশু দত্তকে দেখতে পেল। এক হাতে থুথুড়ে একজন বৃদ্ধাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন। আরেক হাতে চামড়ার মাঝারি সুটকেস, বগলে শতরঞ্চি-জড়ানো বিছানা দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার উষ্কখুষ্ক চুলে তেল জল বা চিরুনি পড়ে নি বহুদিন। গালে খাড়া খাড়া দাড়ি। পরনে। দলামোচড়া ধুতি আর টুইলের ফুল শার্ট। পায়ে লাল ক্যাম্বিসের পুরানো ফিতেওলা জুতোর ওপর ধুলোর প্রলেপ। মাথায়, জামাকাপড়ে কয়লার অজস্র কুচি। বোঝাই যায়, এই ট্রেনেই ওঁরা এসেছেন।
বৃদ্ধাটিকে ভালই চেনে বিনয়। আশু দত্তর মা। কতদিন ওঁদের বাড়ি গিয়ে তার হাতের ক্ষীরের নাড়, চিতই পিঠে, চিড়ের মোয়া কি পাটিসাপটা খেয়ে এসেছে।
কয়েক পলক হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। রাজদিয়ার এই শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশায়টি দেশ ছেড়ে কোনওদিন ইন্ডিয়ায় চলে আসবেন, ভাবা যায়নি। তার ধারণা ছিল, জন্মভূমিতেই তিনি আমরণ থেকে যাবেন।
পাশ থেকে যুগল ব্যগ্র সুরে বলে ওঠে, ছুটোবাবু, আমাগো রাইজদার মাস্টর মশয়– বলেই আশু দত্তর দিকে দৌড়ে গেল।
বিনয়ও লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে আশু দত্ত এবং তার মাকে প্রণাম করে। দেখাদেখি যুগলও দুজনের পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকায়।
প্রশ্নটা অনাবশ্যক। তবু বিনয় জিজ্ঞেস করে, স্যার চলে এলেন? দেশে আর থাকা গেল না বুঝি?
মুখে কিছু বললেন না আশু দত্ত। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন শুধু।
আশু দত্তর হাত থেকে সুটকেস বিছানা টেনে নিয়ে যুগল বলে, টেরেনের এই মাথা থিকা উই মাথায় সমানে ডাইকা গ্যাছি, রাইজদা থিকা কেউ আইছেন? চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া গলার নলি ফাইড়া গ্যাছে। হুমৈর দ্যান নাই ক্যান?
আশু দত্ত বললেন, চারদিকে এত শোরগোল, তোর ডাক শুনতে পাইনি। বিনয়কে বললেন, ট্রেন থেকে নেমে মহা বিপদে পড়ে গেছি।
বিনয় জানতে চায়, কী বিপদ স্যার?
আমার এক মাসতুতো ভাইকে চিঠি লিখেছিলাম। শিয়ালদায় এসে আমাদের যেন নিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। তাকে কোথাও পেলাম না।
আপনি শোনেননি, আজকাল পাকিস্তানের চিঠি ঠিকমতো এপারে আসে না? হয়তো আপনার ভাই চিঠি পাননি।
আশু দত্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। ভীষণ উদ্বিগ্ন। উদ্ভ্রান্তের মতো বলেন, এখন উপায়?
বিনয় বলে, কীসের?
আশু দত্ত জানালেন, উনিশ শউনচল্লিশের জুলাইয়ে, মহাযুদ্ধ শুরু হবার মুখে কলকাতায় শেষ এসেছিলেন। তারপর এই। মাঝখানে প্রায় একটা যুগ কেটে গেছে। এই শহর তার প্রায় অচেনা। নৌকোয় স্টিমারে এবং ট্রেনের দম বন্ধ করা ভিড়ে তিনটে দিন কেটেছে। প্রচণ্ড ধকলে বৃদ্ধা মা এবং তাঁর শরীরে সারবস্তু কিছু আর অবশিষ্ট নেই। হাত-পা ভেঙে হুড়মুড় করে যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যাবেন। কীভাবে যে নিজেদের খাড়া রেখেছেন, তারাই জানেন। এই অবস্থায় কেমন করে মাসতুতো ভাইয়ের বাসায় পৌঁছবেন, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, ঠিকানা জানেন তো?
তা জানি। ভাইয়ের নাম সন্তোষ–সন্তোষ নাগ। ঠিকানা সাতাশের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। কালীঘাট।
চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
দুর্ভাবনার আপাতত কিছুটা অবসান। মুখচোখ দেখে মনে হল, আশু দত্ত খানিক স্বস্তি বোধ। করছেন। বললেন, তোর সঙ্গে দেখা না হলে কী যে করতাম! কিন্তু
কী?
এখানে তোর অন্য কোনও কাজ নেই তো? আমাদের নিয়ে গেলে অসুবিধে হবে না?
না স্যার। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরব।
কীভাবে কালীঘাট যাব?
বিনয় লক্ষ করল, এই মুহূর্তে একটি মাত্র চিন্তাই আশু দত্তর মাথায় ভর করে আছে। কালীঘাটে মাসতুতো ভাইয়ের বাড়ি নিরাপদে পৌঁছতে হবে। এছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। বিনয়ের সঙ্গে কত দিন বাদে দেখা। কেন সে শিয়ালদায় এসেছিল, কলকাতার কোথায় থাকে সে, দেশ। থেকে এখানে এসে কেমন আছে, এ-সব সম্বন্ধে তাঁর এতটুকু আগ্রহ নেই।
বিনয় জানালো, কালীঘাট অনেক দূরের পথ। ট্রাম বাস পালটে যাওয়া যায়। কিন্তু আশু দত্তরা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যেভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আছেন, তাতে ভিড়ে-ঠাসা যানবাহনে টানাচড়া করে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সে বলল, এখান থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি নেব।
আশু দত্তর হঠাৎ কী খেয়াল হল। উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, আমার কাছে হাজারখানেক পাকিস্তানি টাকা আছে। ইন্ডিয়ায় কি সেই টাকা চলবে?
বিনয় জানায়, এই শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরেই চড়া হারে বাট্টা দিলে পাকিস্তানি টাকার বদলে ভারতীয় টাকা পাওয়া যায়।
আশু দত্ত জামার ভেতরের পকেট থেকে টাকা বার করে বিনয়কে দিতে দিতে বললেন, বদলানোর ব্যবস্থা কর।
একসময় মেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে দালালদের কাছ থেকে টাকা বদলাবদলি করে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল বিনয়। আশু দত্ত এবং তার মাকে গাড়িতে তুলে নিজেও উঠে বসল। যুগল সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। সে আশু দত্তদের মালপত্র গাড়িতে তুলে দিল।– এতক্ষণে যেন যুগলের ওপর ভালভাবে নজর পড়ল আশু দত্তর। খানিক আগে বিনয়ের সঙ্গে সেও যে তাঁকে প্রণাম করেছে, বুঝি বা তা লক্ষ করেননি। উৎকণ্ঠায়, দুর্ভাবনায় তখন তিনি দিশেহারা। বললেন, তুই যুগল না?
যুগল অল্প হাসল, হ মাস্টর মশয়।
গাড়িতে উঠলি না যে?
আশু দত্তর প্রশ্নের জবাবটা দিল বিনয়, ও কলকাতার বাইরে থাকে। আগরপাড়ায়। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে ওকে যেতে হবে।
অনেক দূরে?
না। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। আগরপাড়ায় নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়।
আশু দত্ত যুগল সম্বন্ধে আর কোনও কৌতূহল প্রকাশ করলেন না।
যুগল বলল, আমার টেরেনের সময় হইয়া আইছে। অহন যাই মাস্টর মশয়। পরে ছুটোবাবুরে লইয়া আপনের লগে দেখা করুম। সে স্টেশনের দিকে ফিরে গেল।
অশ্বক্ষুরের আওয়াজ তুলে বিনয়দের গাড়ি শিয়ালদার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় চলে এল।
এর মধ্যে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। রাস্তায় কর্পোরেশনের বাতি জ্বলে উঠেছে। গাঢ় কুয়াশা ক্রমশ সেগুলোর টুটি টিপে ধরতে শুরু করেছে। দুধারের সারি সারি দোকান এবং বাড়িগুলোতেও প্রচুর আলো। কিন্তু শীতের সন্ধ্যায় গাঢ় কুয়াশার কারণে সেগুলোও কেমন যেন নিস্তেজ। মলিন। চারদিকে প্রচুর লোকজন। স্রোতের মতো ছুটে চলেছে ট্রাম বাস মোটর ট্যাক্সি, ইত্যাদি।
.
০৪.
ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে মুখোমুখি লম্বাটে সিট। একদিকের সিটে বসেছে বিনয়। তার সামনের সিটটায় আশু দত্ত এবং তার মা। গাড়ির দোলানিতে বৃদ্ধার ঘুম এসে গিয়েছিল। তিনি ঢুলছিলেন। আশু দত্ত জানালার বাইরে ধাবমান গাড়িঘোড়া মানুষজন এবং দোকানপাটের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুই তখন দেশ ছেড়ে আসার কথা জিজ্ঞেস করছিলি না?
খানিক আগে শিয়ালদা স্টেশনে মাসতুতো ভাইকে দেখতে না পেয়ে আশু দত্ত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। বিনয় বুঝতে পারে, সেই অস্থির অস্থির ভাবটা এখন অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছেন। আস্তে মাথা নেড়ে সে বলে, হ্যাঁ।
আশু দত্ত বললেন, দিনকে দিন দেশের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠছে। হিন্দুরা কতদিন সেখানে থাকতে পারবে, জানি না। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করলেন, ইন্ডিয়া থেকে কিছু বিহারী মুসলমান রাজদিয়ায় গিয়ে উঠেছে। তারা স্থানীয় লোকজনদের খুব তাতাচ্ছে। তাছাড়া রাজাকারদের উৎপাতও বেড়ে গেছে।
কিছুদিন আগে হেমনাথের চিঠিতে বিশদভাবে না হলেও এ-সবের ইঙ্গিত ছিল। নতুন করে উৎকণ্ঠায় মন ভরে যেতে থাকে বিনয়ের।
আশু দত্ত থামেননি, আমার ক্ষতিটা হয়েছে দুদিক থেকে। তাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম।
উত্তর না দিয়ে পলকহীন রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
আশু দত্ত জানান, রাজদিয়া হাইস্কুল–যা ছিল যৌবনের শুরু থেকে তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, কলকাতায় ভাল ভাল চাকরির শত প্রলোভন উপেক্ষা করে তাই নিয়েই জীবনের মহার্ঘ বছরগুলি কাটিয়ে দিয়েছেন। উনিশ শ সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্টের পর যখন পূর্ব পাকিস্তানে ভাঙন ধরল তখনও তিনি তার চিরদিনের সেই স্বপ্নটাকে আঁকড়ে রাজদিয়ায় পড়ে রইলেন। দেশ দুটুকরো হয়েছে, দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক ঘৃণা আর অবিশ্বাসের বিষবাষ্পে সমস্ত পরিবেশ ছেয়ে গেছে, কিন্তু সে-সব দিকে তার লক্ষ ছিল না। রাজদিয়া হাই স্কুল থেকে নতুন নতুন ছাত্র বেরিয়ে, তাদের মেধা দিয়ে সদ্যোজাত পাকিস্তানকে গড়ে তুলবে, এই নিয়েই তিনি বিভোর ছিলেন।
কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হল আচমকা। নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। রাজদিয়া হাই স্কুলের গভর্নিং বডিতে হেমনাথ ছাড়াও রাজদিয়া তো বটেই, চারপাশের গ্রামগুলোর বেশ কিছু সুশিক্ষিত, বিশিষ্ট মানুষজনও ছিলেন। মুসলিম লিগ একরকম গায়ের জোরে গভর্নিং বডি ভেঙে দিয়েছে। আমূল বদলে দিয়েছে সমস্ত কিছু। মোতাহার হোসেন যে স্কুলে একটানা ছাব্বিশ বছর ধরে হেড মাস্টার, কংগ্রেস করার অপরাধে রাতারাতি তাকে তাড়ানো হয়েছে। আশু দত্ত এবং আরও কয়েকজন মাস্টার মশাইকে, প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে যাঁরা রাজদিয়া হাই স্কুল গড়ে তুলেছেন তাদের রিটায়ারমেন্টের নোটিশ ধরিয়ে একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিদায় করে দেওয়ায় রাজদিয়া এবং চারপাশের বহু মানুষ খুব ক্ষুব্ধ। ছাত্ররা একদিন স্ট্রাইকও করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
রাজদিয়ায় হেমনাথ এবং মোতাহার হোসেনের পর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ আশু দত্ত। এত বড় অসম্মানে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় আঘাত এসেছিল অন্য দিক থেকে। তার ছোট ভাই সুরেশ দত্ত রেলে চাকরি করতেন। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গার্ড। অবিবাহিত। থাকতেন ঢাকায় রেলের কোয়ার্টার্সে। দেশভাগের সময় সরকারি আধা-সরকারি কর্মচারীদের অপশন দেওয়া হয়েছিল, ইচ্ছা হলে যে কেউ ইন্ডিয়ায় চলে যেতে পারে। সুরেশ দত্ত পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন। ছুটিছাটায় বাড়ি আসতেন। খুব বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইদানীং হয়নি ঢাকায়। তবে উত্তেজনা রয়েছে। মাঝে মাঝেই স্ট্যাবিংয়ের ঘটনা ঘটছে। একদিন রাতে ডিউটি সেরে ফেরার পথে সুত্রাপুরের কাছে তাকে ছুরি মারা হয়। রক্তাপ্লুত বেহুঁশ অবস্থায় সুরেশকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার জ্ঞান আর ফেরেনি। দুদিন পর তিনি মারা যান।
এই মৃত্যুটা আশু দত্তদের তুমুল ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। ঢাকা থেকে শোচনীয় খবরটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আশু দত্তর মা মূৰ্ছিত হয়ে পড়েন। হুঁশ ফেরার পর শোককাতর বৃদ্ধা আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। সারাক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকতেন। আর মাঝে মাঝেই উন্মাদের মতো বুকে চাপড় মারতে মারতে আকুল হয়ে কাঁদতেন। তার কান্নার আওয়াজ অনেকটা তীরবেধা পশুর আর্তনাদের মতো। এক মুহূর্তও তিনি পাকিস্তানে থাকতে চাইছিলেন না। অবিকল ঝিনুকের মতো।
নিরুপায় আশু দত্ত শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানে আর থাকবেন না। গোপনে পূর্বপুরুষের বাড়িঘর জমিজমা বিক্রি করার চেষ্টা যে করেননি তা নয়। কেননা জানাজানি হলে রাজাকাররা প্রচণ্ড হামলা করবে। হিন্দুর সম্পত্তি বেচা প্রায় অসম্ভব। খদ্দের তিনি পেয়েও ছিলেন। কিন্তু তারা ভয়ে আশু দত্তর সঙ্গে রেজিস্ট্রি অফিস পর্যন্ত যেতে পারেনি। অগত্যা বাড়িতে তালা লাগিয়ে সম্পত্তির দলিলপত্র সঙ্গে নিয়ে মায়ের হাত ধরে নৌকোয় উঠেছিলেন। তারপাশা স্টিমারঘাটে আসা, গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে বর্ডারে পৌঁছনো বিনুর যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রায় তেমনটাই ঘটেছে আশু দত্তর বেলায়। সেই আতঙ্ক, সেই উৎকণ্ঠা, সেই মৃত্যুভয়। ভেবেছিলেন, পাকিস্তানে উত্তেজনা কমলে, পরিবেশ খানিকটা স্বাভাবিক হলে, দেশে ফিরে বাড়িঘরের ব্যবস্থা করে আসবেন। কিন্তু বর্ডারে পৌঁছবার পর আরেকটা মারাত্মক আঘাতে শেষ আশাটুকুও চুরমার হয়ে গেল। পাকিস্তানি অফিসাররা তাঁর যাবতীয় দলিল-টলিল ছিনিয়ে নেয়। দুঃস্বপ্নের সীমান্ত পেরিয়ে তিনি যখন কলকাতায় এলেন, একেবারে নিঃস্ব। কপর্দকহীন। সেই সঙ্গে ভাইয়ের ভয়াবহ মৃত্যুতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।
একনাগাড়ে বলে যাবার পর থামলেন আশু দত্ত। জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগলেন।
ঘোড়ার গাড়ির ভেতর স্তব্ধতা নেমে আসে। কেমন যেন দমবন্ধ করা পরিবেশ, ভীষণ অস্বস্তিকর। বাইরে থেকে অশ্বক্ষুরের ধ্বনি আর পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া যানবাহন এবং মানুষজনের কলরোল ভেসে আসছে যথারীতি।
ঝিনুকের চিন্তাটা ফের মাথায় ফিরে আসে বিনয়ের। কিন্তু কীভাবে তার কথা জিজ্ঞেস করবে, ঠিক করে উঠতে পারছে না।
অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকার পর আশু দত্ত আবার শুরু করেন, এক জামাকাপড়ে মাকে নিয়ে দেশ থেকে চলে এলাম। মাসতুতো ভাইয়ের ক্ষমতা আর কতটুকু? শুনেছি সে প্রাইভেট ফার্মের কেরানি। স্বামী, স্ত্রী, তিন চারটে ছেলেমেয়ে। তার ওপর মা আর আমি এসে ওদের ঘাড়ে চাপলাম। কী করে যে চালাবে? কী হবে আমাদের? তাঁকে খুবই অসহায় দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যাকুল।
পলকহীন প্রাক্তন মাস্টার মশাইটির দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। মোতাহার হোসেন চৌধুরি রাজদিয়া হাই স্কুলের হেড মাস্টার হলেও প্রবল প্রতাপে স্কুলটা চালাতেন আশু দত্তই। শুধু স্কুল কম্পাউন্ডেই নয়, দাপট ছিল তার সারা রাজদিয়া জুড়ে। সেখানকার প্রতিটি মানুষ তাকে সমীহ করত। এতকাল কী শ্ৰদ্ধাই না তিনি পেয়ে এসেছেন! সেই আশু দত্তকে এখন আর চেনাই যায় না। উদ্বেগে দুর্ভাবনায় তার শক্ত শিরদাঁড়া নুয়ে পড়েছে।
জড়সড় বিপর্যস্ত বৃদ্ধটিকে দেখতে দেখতে মায়াই হয় বিনয়ের। চকিতে আর-একজন মাস্টার মশাই জামতলির রামরতন গাঙ্গুলির মুখটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। শয়ে শয়ে সর্বস্ব হারানো, ভয়ার্ত মানুষের মতো বিনয় আর ঝিনুক ওঁদের সঙ্গে তারপাশা থেকে স্টিমার ধরেছিল। জীবন্ত রামরতন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসতে পারেননি। এসেছিল তার মৃতদেহ। দুই অবিবাহিতা তরুণী মেয়ে, এক বয়স্কা বিধবা মেয়ে এবং বৃদ্ধা স্ত্রীর যাবতীয় দুশ্চিন্তা পৃথিবী নামের এই গ্রহটিতে ফেলে রেখে চিরকালের মতো তিনি চোখ বুজেছেন। বিনয়ের মনে পড়ল, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা তার ভাইপো বিমলের কাছে উঠেছে। বিমলের ঠিকানা লিখে নিয়েছিল বিনয়। কথা দিয়েছিল একদিন তাদের বাড়ি যাবে। যাওয়া হয়নি। কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুককে নিয়ে একের পর এক এত সংকট বেড়াজালের মতো তাকে ঘিরে ধরেছে যে ওদের কথা খেয়াল ছিল না। প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করল বিনয়। ভাবল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিমলদের বাসায় গিয়ে ওদের খোঁজখবর নেবে।
আশু দত্ত এবং রামরতন গাঙ্গুলির মধ্যে প্রচুর মিল। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ব্যাপকভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। একটা জাতিকে বড় হতে হলে সুশিক্ষিত, আদর্শবাদী মানুষ দরকার। যৌবনের শুরু থেকে মানুষ গড়ার কাজটাই নিষ্ঠাভরে করে গেছেন তারা। কিন্তু স্বাধীনতার পর কী মূল্য পেলেন দুজনে? জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে, শূন্য হাতে আত্মীয় পরিজনের কাছে একটু আশ্রয়ের আশায় সপরিবারে তাঁদের পাড়ি দিতে হয়েছে। মৃত্যু রামরতনের সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়েছে। কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা আশু দত্তকে যেন গিলে ফেলছে।
বিনয় বলল, অত ভাবছেন কেন স্যার? ইন্ডিয়ায় যখন পৌঁছতে পেরেছেন, রোজগারের একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আশু দত্ত বললেন, এই বৃদ্ধ বয়েসে কে আমাকে স্কুলে চাকরি দেবে?
রিফিউজি বোঝাই গোয়ালন্দের স্টিমারে দোতলার ডেকে বসে অবিকল এইরকম প্রশ্নই করেছিলেন রামরতন। বিনয় বলল, স্যার, আপনি পণ্ডিত মানুষ। স্কুলে কাজ না পেলেও ছাত্র পড়িয়ে অনেক টাকা পেতে পারেন।
ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন আশু দত্ত। তাঁর শিরদাঁড়া টান টান হয়ে যায়। কঠোর গলায় বলেন, তুই কি প্রাইভেট টিউশনের কথা বলছিস?
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছুর আভাস রয়েছে যাতে হকচকিয়ে যায় বিনয়। ভয়ে ভয়ে বলে, হ্যাঁ, মানে পরক্ষণে সেই ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শীতগ্রীষ্ম বারোমাস প্রতিদিন সন্ধের পর পুরানো সাইকেলে চেপে সারা রাজদিয়া টহল দিয়ে বেড়াতেন আশু দত্ত। মৃধা বাড়ি, রক্ষিত বড়ি, সৈয়দ বাড়ি, ঘটক বাড়ি-এমনি নানা জায়গায় হানা দিয়ে দেখতেন তার স্কুলের কোন ছাত্রটি পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে, কে অ্যারিথমেটিকের প্রবলেমের অঙ্ক কষতে হিমসিম খাচ্ছে, কার মাথায় বাংলা ব্যাকরণের সমাস ঠিকমতো ঢুকছে না, কে ইতিহাসের মুঘল বাদশাদের রাজত্বকালের সাল তারিখের হিসেব রাখতে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সবার ভুলটুল শুধরে, পড়াগুলো জলবৎ বুঝিয়ে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন প্রায় মধ্যরাত। এর জন্য কারও কাছ থেকে কখনও একটি পয়সাও তিনি নেননি।
আশু দত্ত ধমকে ওঠেন, প্রাইভেট টিউশন করে টাকা নেব! কী বলছিস তুই? এতখানি সাহস তোর হল কী করে? তার ভেতর থেকে রাজদিয়ার সেই প্রবল পরাক্রান্ত মাস্টার মশাইটি লহমার জন্য আগুনের ঝলকের মতো বেরিয়ে আসেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ফের ঝিমিয়ে পড়েন, নির্জীব সুরে বলেন, কে জানে, পেটের জন্যে শেষপর্যন্ত হাত পেতে তাই হয়তো নিতে হবে। গভীর নৈরাশ্যে তার গলা বুজে আসে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
আশু দত্তর কথা শুনতে শুনতে ঝিনুকের চিন্তাটা কখনও চাপা পড়ে যায়, আবার সেটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু সরাসরি ঝিনুক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। যা জানার কৌশলে জানতে হবে।
বিনয় বলল, আসার সময় আমার দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
আশু দত্ত বললেন, রওনা হওয়ার আগের দিন হেমদাদার বাড়ি গিয়েছিলাম। তাকে বললাম আমরা চলে যাচ্ছি। আপনিও যত তাড়াতাড়ি পারেন ইন্ডিয়ায় চলে যান। কিন্তু দেশ ছেড়ে তিনি আসবেন না। অনেক বুঝিয়েও কাজের কাজ কিছু হল না। কোন দিন যে কী বিপদ ঘটে যাবে!
হেমনাথের অনড় মনোভাবের কথা বিনয়ের অজানা নয়। সেজন্য তার পাহাড়-প্রমাণ দুশ্চিন্তা। নিজের থেকে যদি তিনি না বোঝেন কী নিদারুণ বিপদের মধ্যে আছেন, অন্যে কী আর করতে পারে? কিন্তু এই মুহূর্তে ঝিনুকের ভাবনাটাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বিনয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাড়িতে দাদু ছাড়া আর কার সঙ্গে দেখা হল?
বউ ঠাকরুন আর শিবানী দিদি।
এঁরা ছাড়া অন্য কেউ ছিল না?
হেমদাদার তো তিনজনের সংসার। ওঁরা ছাড়া আর কে থাকবে? ও হ্যাঁ, তোদের সেই পুরানো কামলা করিম–তাকেও দেখেছি।
মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে, ঝিনুক রাজদিয়ায় যায়নি। পাকিস্তান থেকে চলে আসার জন্য যে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, আবার সেই হননপুরীতে সে ফিরে যাবে এটা মনে করাই ভুল। তবু ক্ষীণ দুরাশাকে বিনয় প্রশ্রয় দিয়েছে–যদি গিয়ে থাকে? রাজদিয়ায় গেলে হেমনাথ কি আর আশু দত্তকে জানাতেন না? তীব্র হতাশায় ডুবে যেতে থাকে বিনয়।
আশু দত্ত এবার বললেন, হেমদাদা তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তার বাবার আর দুই দিদির ঠিকানাও দিয়েছেন। শিয়ালদায় নেমে প্রথম দিনই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এতক্ষণ তো আমার কথাই শোনালাম। তোর খবর বল। কী করছিস? কোথায় আছিস?
ঝিনুক রাজদিয়ায় ফেরেনি, সেটা বুঝে যাবার পর ভেতরে ভেতরে একেবারে ভেঙে পড়েছে বিনয়। কথা বলতে ভাল লাগছিল না। তবু বলতে হল। ঝিনুকের ব্যাপারটা গোপন করে বাকিটা ঠিক ঠিক জানিয়ে দিল।
আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, ভবতোষের মেয়ে ঝিনুক তোর সঙ্গে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল না?
ঝিনুকের নামটা আশু দত্তর মুখ থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল বিনয়ের। দাঁতে দাঁত চেপে ঝাপসা গলায় সে বলল, হ্যাঁ, স্যার।
মেয়েটা নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। ওকে যত্ন করিস। দেখিস নতুন করে আর যেন কষ্ট না। পায়।
ঝিনুকের চরম লাঞ্ছনার খবরটা জগৎসংসারে কারও জানতে বাকি নেই। আশু দত্ত রাজদিয়ার মানুষ। তিনি তো জানবেনই।
বিনয় উত্তর দিল না। নীরবে, নতচোখে বসে রইল।
একসময় ঘোড়ার গাড়ি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে যায়।
.
০৫.
রাস্তাটা বেশ সরু। এঁকে বেঁকে, পাক খেতে খেতে, এগিয়ে গেছে। এখানে বেশির ভাগই পুরানো বাড়ি। একতলা, দোতলা। ক্কচিৎ দু-একটা তিনতলা। সবই সাদামাঠা, ছিরিছাঁদহীন। প্রতিটি দালান কোঠার গায়ে মলিন ছাপ। ফাঁকে ফাঁকে টালি বা টিনের চালের ঘর, মাটকোঠা। মনে হয়, আদ্যিকালের কোনও শহরের পথ।
কর্পোরেশনের যে বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, ঘন কুয়াশা চারপাশ থেকে সেগুলোর দম বন্ধ করে দিচ্ছে। হিমঋতুর এই রাতের সঙ্গে যুঝে যুঝে কোনওরকমে তারা ঝাপসা আলো বিতরণ করে চলেছে।
এখানে প্রচুর দোকানপাট। কোনওটা তেলেভাজার, কোনওটা মুড়িমুড়কি বাতাসা এবং ছোলাভাজার, কোনওটা চায়ের, কোনওটা মুদিখানা। তাছাড়া দুচার পা ফেললেই ছোটখাটো লন্ড্রি, মনিহারি দোকান, মিষ্টির দোকান, সোনারুপোর গয়নার দোকান। এই দোকানগুলোর কটাতেই বা ইলেকট্রিক আলো! হয় কেরোসিনের লম্ফ, হেরিকেন বা লম্বা উঁটিওলা গ্যাসবাতি জ্বলছে।
রাস্তায় যথেষ্ট লোকজন চোখে পড়ছে। হিমে, কুয়াশায় এবং চতুর্দিকের নিস্তেজ আলোয় মনে হয় ছায়ামূর্তির মিছিল।
নিরুৎসুক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনয়। চারদিক দেখতে দেখতে আবছাভাবে ভাবল, সে যেন পরিচিত পৃথিবীর বাইরে অচেনা, ভুতুড়ে, অবাস্তব কোনও গ্রহে এসে পড়েছে।
রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে সন্তোষ নাগদের ভাড়া বাড়ির হদিস পেতে অসুবিধা হল না। এই এলাকার অন্য সব বাড়ির মতো সেকেলে ধাঁচের দোতলা। বয়স কম করে ষাট সত্তর বছর তো হবেই। তৈরি হবার পর সেই যে রং করা হয়েছিল, তারপর ওটার গায়ে আর হাত পড়েনি। পলেস্তারা অনেক জায়গায় খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলার কালো কালো ছোপ। রেন-ওয়াটার পাইপ ভাঙাচোরা। বন্ধ সদর দরজার মাথায় অল্প পাওয়ারের একটা বাম্ব জ্বলছিল। সেই আলোয় দেখা গেল, কপাটের পাল্লায় চকখড়ি দিয়ে বড় হরফে লেখা : ২৭বি।
ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে বিনয় জোরে জোরে দরজার কড়া নাড়তে লাগল।
একটু পর তেরো চোদ্দ বছরের একটি সুশ্রী কিশোরী দরজা খুলে বলল, কাকে চান? এখানে সন্তোষ নাগরা থাকেন? ঠিকানাটা খুঁজে বার করার পরও পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য প্রশ্নটা করল বিনয়।
হ্যাঁ। আমার বাবা।
তিনি বাড়ি আছেন?
হ্যাঁ।
তাঁকে খবর দাও, পাকিস্তানের রাজদিয়া থেকে তার এক দাদা আশু দত্ত মশাই এসেছেন-
এক্ষুনি বাবাকে ডেকে আনছি।
মেয়েটি এক ছুটে ভেতর দিকে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে যখন ফিরে এল, সঙ্গে একজন প্রৌঢ় এবং আরও তিনটি ছেলেমেয়ে, যাদের বয়স ছয় থেকে দশ এগারোর মধ্যে। অপার কৌতূহল নিয়ে তারা একবার বিনয়, পরক্ষণে ঘোড়ার গাড়ির আরোহীদের লক্ষ করতে লাগল।
প্রৌঢ়টির উচ্চতা মাঝারি। গোলগাল, ভালমানুষ গোছের চেহারা। পরনে আধময়লা ধুতি এবং হাফ শার্টের ওপর চাদর জড়ানো। বিনয় বুঝতে পারছিল, ইনিই আশু দত্তর মাসতুতো ভাই সন্তোষ নাগ।
সন্তোষ ব্যগ্রভাবে বললেন, আশু দাদা কোথায়? আশু দাদা
ঘোড়ার গাড়ি থেকে ততক্ষণে আশু দত্ত নেমে এসেছেন। বললেন, এই যে
পাকিস্তান থেকে আসবেন, আগে জানাননি তো? চিঠি লিখলে শিয়ালদায় চলে যেতাম
বিনয় কলকাতায় পৌঁছে আনন্দ এবং হিরণকে যা বলেছিল, হুবহু তাই বললেন আশু দত্ত। অর্থাৎ চিঠি লিখেছিলেন। হিরণদের মতো একই উত্তর দিলেন সন্তোষ। আশু দত্তর চিঠি তিনি পাননি। সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন, পাকিস্তানের চিঠিপত্র আজকাল নিয়মিত আসছে না। কথা বলতে বলতে নিচু হয়ে আশু দত্তর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সদরের সামনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলোকে বললেন, ইনি জেঠু। নমো কর ।
বলমাত্র ঢিপ ঢিপ করে তারা প্রণাম সেরে একধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে রইল।
সন্তোষ বললেন, মাসিমা আসেনি?
এসেছে। এই তো আঙুল বাড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িটা দেখালেন আশু দত্ত।
সুরেশদাদাকে দেখছি না তো
গাড়ির ভেতর জড়পিণ্ডের মতো যে বৃদ্ধাটি এক কোণে বসে ছিলেন, আচমকা ক্ষীণ, করুণ সুরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য গলায় সুরেশের নাম করে একটানা কী বলে যেতে লাগলেন। তার বিলাপের ধ্বনি কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতটাকে বিষাদে ভরিয়ে তুলল।
সন্তোষ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, কী হয়েছে দাদা? মাসিমা কাঁদছে কেন?
ভারী গলায় আশু দত্ত বললেন, পরে শুনিস।
এরপর গাড়ির দরজা খুলে আশু দত্তর মাকে এবং সীমান্তের ওপার থেকে সামান্য যা জিনিসপত্র আনা সম্ভব হয়েছিল, ধরাধরি করে সব নামানো হল।
সন্তোষ কিশোরী মেয়েটার দিকে ফিরে বললেন, শিগগির তোর মাকে ডেকে আন। মাসিমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে।
মেয়েটা আরে-একবার দৌড়ে চলে গেল। এবার সঙ্গে করে নিয়ে এল কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা একজন মাঝবয়সী মহিলাকে। আশু দত্তর মা সমানে কেঁদে চলেছেন। সন্তোষের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা সযত্নে তাকে ধরে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল।
এদিকে ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। সওয়ারিদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এক লহমাও সে আর এখানে নষ্ট করতে রাজি নয়। তাকে ছেড়ে দেবার জন্য সমানে তাড়া দিতে শুরু করেছে।
বিনয় ভাড়া দিতে যাচ্ছিল, এক ধমকে তাকে থামিয়ে আশু দত্ত নিজেই তা মিটিয়ে দিলেন। গাড়ি ধীর চালে বড় রাস্তার দিকে চলতে শুরু করল। একটু পর সামনের একটা বাঁক ঘুরে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিনয় বলল, স্যার, আমি এখন চলি। আপনারা ভীষণ ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন।
এতক্ষণ আশু দত্তদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন সন্তোষ। হঠাৎ বিনয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একে তো চিনতে পারলাম না।
আশু দত্ত বললেন, রাজদিয়ার হেমনাথ মিত্রের নাতি বিনয়। স্কুলে আমার ছাত্র ছিল। তুই তো হেমদাদাকে চিনিস।
চিনব না? কলকাতায় চাকরি পাওয়ার আগে যখন রাজদিয়ায় আপনাদের বাড়ি যেতাম, হেমদাদার সঙ্গে দেখা না করলে খুব অভিমান করতেন। এমন মানুষ হয় না।
শিয়ালদায় ট্রেন থেকে নামার পর তোকে না দেখে কী করব যখন ভেবে পাচ্ছি না তখন বিনয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ও-ই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বিনয়ের সঙ্গে দেখা না হলে ভীষণ বিপদে পড়তাম।
সন্তোষ ভাল করে বিনয়কে লক্ষ করলেন। বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট। তাকে আপনি করে না বললেও চলে। বললেন, রাস্তা থেকে চলে যাবে, তাই কখনও হয়। এস
বিনয় বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ থাক। পরে একদিন আসব।
আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কবে আসবি?
দুচার দিনের ভেতর।
আসবি কিন্তু। তোর সঙ্গে অনেক দরকারি কথা আছে।
আচ্ছা
বিনয় আর দাঁড়ালো না। সরু গলিটা ধরে বড় রাস্তার দিকে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। সেখান থেকে ট্রাম বাস, কিছু একটা ধরে সোজা ভবানীপুর যাবে।
০৬-১০. ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট
০৬.
ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে আশু দত্তদের সেই যে বিনয় পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, তারপর দুটো দিন পেরিয়ে গেল।
সুবিশাল এই মহানগরের জনারণ্যে ঝিনুক হারিয়ে গেছে। বিনয় প্রায় নিশ্চিত, তাকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু বুকের ভেতরে অদৃশ্য কোনও কুঠুরিতে অতি ক্ষীণ একটু আশা এখনও ধুকপুক করে। তাই সকাল হলেই চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। ট্রাম রাস্তা, বাস রাস্তা ছাড়াও সরু সরু অলিগলিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়। চারপাশের প্রতিটি মানুষকে লক্ষ করে, যদি অলৌকিক কোনও ভোজবাজিতে ঝিনুকের দেখা মেলে। তারপর চলে যায় থানায়। থানা থেকে ফিরে কোনওরকমে চান-খাওয়া সেরে মুহ্যমানের মতো কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে। বেলা একটু পড়লে আবার রাস্তায় রাস্তায় ছোটাছুটি। খোঁজাখুঁজি।
এই দুদিনও তার হেরফের ঘটেনি। কিন্তু বৃথাই এই অনুসন্ধান। রাত্রিবেলা যখন সে বাড়ি ফেরে তার যাবতীয় উদ্যম আর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, হতোদ্যম বিনয়কে দেখলে তখন কষ্টই হয়।
.
আজও সকালে চা খাওয়া শেষ হলে ঘর থেকে বেরুতে যাবে, বাধা পড়ল। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খগেন। সে ডাকল, দাদাবাবু
মুখ ফিরিয়ে তাকায় বিনয়, কিছু বলবে?
বড়বাবু আপনাকে একবার ওপরে যেতি বলেছেন।
বিনয়ের ঘর দোতলায়। অবনীমোহন থাকেন তেতলায়, মাত্র চোদ্দ ফুট উঁচুতে। একই বাড়িতে কদিন ধরে তারা আছে। কিন্তু দুজনের দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা খুব কমই হয়েছে। অবনীমোহন ভোর থেকে তার জপতপ, পুজো এবং ধর্মগ্রন্থ নিয়ে মগ্ন থাকেন। ইহকালের সুখদুঃখ বা অন্য সব সমস্যা সম্পর্কে তিনি প্রায় উদাসীন। আর বিনয়ের ধ্যানজ্ঞান ঝিনুক। এই মেয়েটার চিন্তায় চিন্তায় সারাক্ষণ সে আচ্ছন্ন। দুজনের কক্ষপথ আলাদা। মাঝখানে লক্ষ কোটি যোজনের ব্যবধান। তারা যেন ভিন্ন দুই গ্রহের মানুষ। পরস্পরের সম্পূর্ণ অচেনা।
এ-বাড়িতে আসার পর নিজের থেকে অবনীমোহন কখনও তাকে ডেকে পাঠাননি। হঠাৎ কী এমন হতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না। বেশ অবাকই হল বিনয়। জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছেন, জানো?
খগেন মাথা নাড়ে, না।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
খগেন চলে গেল। এবেলা আর বেরুনো হল না। কিছুটা কৌতূহল এবং খানিক সংশয় নিয়ে তেতলায় বাবার ঘরে চলে এল বিনয়।
এর ভেতর স্নান হয়ে গেছে অবনীমোহনের। ভাজকরা ধবধবে থান-ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। তার ওপর খদ্দরের হাফ-হাতা পাঞ্জাবি এবং গরম শাল। বিছানায় শিরদাঁড়া টান টান করে বসে আছেন। সামনে নিচু ডেস্কের ওপর কোনও সগ্রন্থ খোলা রয়েছে। গীতা কিংবা উপনিষদ। খুব সম্ভব সেটাই পড়ছিলেন।
পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন অবনীমোহন। বইটা বন্ধ করে বললেন, ওখান থেকে একটা চেয়ার এনে বোস।
ডানপাশের দেওয়াল ঘেঁষে খানচারেক চেয়ার সারি দিয়ে দাঁড় করানো। তার একটা খাটের কাছে টেনে এনে নিঃশব্দে বসে পড়ল বিনয়।
অবনীমোহন কয়েক পলক ছেলেকে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, শুধু শুধু রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে শরীর নষ্ট করছিস কেন? যে নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে তাকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
বিনয় চমকে উঠল। জাগতিক ব্যাপারে অবনীমোহন তাহলে একেবারে নিস্পৃহ নন। ছেলের গতিবিধির ওপর তার নজর আছে। উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, যা ঘটে গেছে তা নিয়ে মন খারাপ করে যদি সারাক্ষণ কাটাস, জীবনে দাঁড়াবি কীভাবে? এমন করে চলতে পারে না। ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবতে হবে।
এবারও জবাব দিল না বিনয়।
অবনীমোহন খানিক ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, অফিসে তোকে কবে জয়েন করতে হবে যেন?
বিনয় মনে মনে হিসেব করে বলল, দিনকয়েক পর।
একটু নীরবতা।
তারপর অবনীমোহন বললেন, যদি ঠিক করে থাকিস, এ-বেলা বেরুবি, ঘুরে আয়। ও-বেলা কিন্তু বাড়িতে থাকবি।
বিনয় বলল, কোনও দরকার আছে?
হ্যাঁ। বিকেলে সুধা সুনীতি আনন্দ আর হিরণকে আসতে বলেছি। আমার লইয়ারও আসবেন। আর এই বাড়ি যিনি কিনবেন তিনিও আসছেন। সেইসময় তোর থাকা দরকার।
বিনয় হতচকিত। পাকিস্তান থেকে আসার পর যেদিন অবনীমোহনের সঙ্গে প্রথম দেখা হল তখনই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। ব্যবসার জন্য বাজার থেকে প্রচুর লোন নিয়েছিলেন। ব্যবসা ফেল পড়ায় সিকি পয়সাও ফেরত দিতে পারেননি। ঋণের টাকা সুদে আসলে বিপুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়ি ছাড়া তার অন্য সম্বল নেই। এটা বেচে তাবৎ ধারদেনা শোধ করতে চান। ঋণমুক্ত হতে না পারলে মরেও তিন স্বস্তি পাবেন না। এ-সব সবিস্তারে বললেও বিনয়ের স্মৃতি থেকে পুরোটাই মুছে গিয়েছিল। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর সে এমনই দিশেহারা, যে অন্য কিছু ভাবার, অন্য দিকে তাকাবার সময় পায়নি।
এই মুহূর্তে অবনীমোহনের কথা শুনতে শুনতে বিনয়ের মনে হল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙেচুরে খান খান হয়ে নেমে আসছে। বাড়ি বিক্রির তারিখটা যে নিঃশব্দে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, আজ বাবার ঘরে আসার আগে সে টেরও পায়নি। কী বলবে, কী করবে, ভেবে পেল না বিনয়।
অবনীমোহন বললেন, কথা হয়ে গেল। এখন তুই যেতে পারিস।
বিনয় উঠে দাঁড়ালো। তারপর দোতলায় নিজের ঘরটিতে এসে পশ্চিম দিকের চওড়া জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
এখান থেকে খানিক দূরে রসা রোডের একটা অংশ চোখে পড়ে। মহানগরের ব্যস্ততা এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। লোকজন কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ট্রাম বাস এবং অন্য যানবাহনও। ক্কচিৎ জৈদকা কোম্পানির ছাদখোলা দু-একটা দোতলা বাসও। মানুষ বা গাড়িঘোড়া কারওই যেন বিশেষ তাড়া নেই। ঢিলেঢালা, অলস ভঙ্গিতে তারা চলে যাচ্ছে। কাল রাতে ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছিল, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। ভোরের দিকে যে ঠাণ্ডা, হিমেল হাওয়া বইছিল তার তাপাঙ্ক একটু একটু করে বাড়ছে। অনেক উঁচুতে আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কটা পাখি উড়ছিল। কী পাখি ওগুলো? কী তাদের নাম? শঙ্খচিল কি?
তাকিয়েই আছে বিনয়। কিন্তু এই টুকরো টুকরো চলমান দৃশ্যাবলী তার মাথায় একেবারেই দাগ কাটছে না। সব কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, অসংলগ্ন, অর্থহীন। একে ঝিনুকের চিন্তাটা তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে পাষাণভারের মতো চেপে বসে আছে। তার ওপর আরেকটা সমস্যা বিশাল আকার নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। অবনীমোহন এ-বাড়ি বিক্রি করে দিলে কোথায় থাকবে সে? বিনয় জানে, সুধার দরজা চিরকালই তার জন্য খোলা। ঝিনুক নেই, সুনীতিদের কাছে গিয়ে থাকলে হেমনলিনী আপত্তি করবেন না। বরং যথেষ্ট সমাদর করে কাছে টেনে নেবেন। কিন্তু বোনেদের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়াটা কি আদৌ সম্মানজনক?
অস্থির, ব্যাকুল বিনয় অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে শুয়ে শূন্য চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সকালটা কখন দুপুর হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা নরম ভাবটা কেটে গিয়ে বোদ কখন ঝকঝকে হয়ে উঠেছে, খেয়াল করেনি বিনয়। সকালের দিকের আলস্য গা থেকে ঝেড়ে ফেলে শহর জুড়ে এখন তুমুল ব্যস্ততা। ট্রাম রাস্তা ধরে উধশ্বাসে ছুটে চলেছে রকমারি যানবাহন। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে নানা ধরনের মিশ্র আওয়াজ। গাড়িঘোড়ার, মানুষের কলরোলের। সবই তীব্র। কর্কশ। চড়া তারে বাঁধা।
হঠাৎ খগেনের গলা কানে এল, দাদাবাবু, অনেক বেলা হয়েছে। চান করে খেয়ে নিন।
চমকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে বিনয়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে খগেন। সামনের দেওয়ালের দিকে বিনয়ের নজর চলে যায়। ওয়েস্ট-এন্ড ওয়াচ কোম্পানির একটা গোলাকার ঘড়ি সেখানে আটকানো। এখন একটা বেজে তেত্রিশ।
বিনয় একটু লজ্জা পেল। কেননা তার খাওয়া না হলে খগেন খাবে না। তার জন্যই লোকটা এত বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। খাট থেকে নামতে নামতে ব্যস্তভাবে সে বলল, তুমি যাও। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসছি। একটা ঘরে-পরার পাজামা আর শার্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।
গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নেবার পর নিরামিষ আহার শুরু করেছেন অবনীমোহন। এ-বাড়িতে এসে তা-ই খাচ্ছে বিনয়। তার জন্য আলাদা করে মাছ মাংসের ব্যবস্থা হোক, এটা সে চায়নি। খগেনের বাড়তি খাটনি হবে, ভাবতে সঙ্কোচ হয়েছে।
বিনয়ের মনে হয়, এখানে সে যেন একজন উটকো অতিথি। কেউ তাকে ডেকে আনেনি, নিজের থেকেই এসে হাজির হয়েছে। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর কদিন একটু বিচলিত হয়েছিলেন অবনীমোহন। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে থানায় পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর আবার যে-কে সে-ই। আগের মতোই নিরাসক্ত। পার্থিব সমস্ত ব্যাপারেই উদাসীন। নিজের চারপাশে শক্ত একটা বলয়। তৈরি করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। বিনয় কী খাচ্ছে না খাচ্ছে, তার কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কিনা, এ-সব নিয়ে খোঁজটোজও নেন না।
স্নান সেরে একতলা থেকে খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে ফের নিজের ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল বিনয়। দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই তার। ঘড়ির কাঁটা আজ বড় বেশি মন্থর। সময় যেন কাটতেই চায় না। বিছানায় ছটফট করতে লাগল সে।
.
০৭.
কখন সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছিল, কখন বাতাসে হিম মিশতে শুরু করেছে আর কখনই বা রোদ ঝলমলে ভাবটা হারিয়ে মলিন হয়ে গেছে, বিনয় খেয়াল করেনি।
খগেন এসে আবার দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলল, সব্বাই বড়বাবুর ঘরে এসি গেচেন, আপনারে যেতি বললেন–
যাচ্ছি
তেতলায় এসে বিনয় দেখতে পেল, অবনীমোহন যথারীতি তার খাটে বসে আছেন। কাছাকাছি মেঝেতে খানকয়েক চেয়ার সাজানো রয়েছে। সেখানে বসে আছে সুধা হিরণ সুনীতি এবং আনন্দ। কয়েকটা চেয়ার এখনও ফাঁকা।
বিনয় দোতলায় যে ঘরখানায় থাকে সেখান থেকে ওপরে-নিচে ওঠানামার সিঁড়ি চোখে পড়ে না। তাই কখন সুধা সুনীতিরা তেতলায় উঠে এসেছে, সে টের পায়নি। ফাঁকা চেয়ারগুলোর একটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে অবনীমোহন বিনয়কে বসতে বললেন। নীরবে বসে পড়ল সে। ওবেলা অবনীমোহন জানিয়েছিলেন তার অ্যাডভোকেট এবং এ-বাড়ি যিনি কিনবেন তাকেও আসতে বলেছেন। কিন্তু এখনও তারা এসে পৌঁছননি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর কী ভেবে অবনীমোহন সুধা সুনীতিদের বললেন, এ-বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত যে আমি নিয়েছি, বিনুকে তা আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আজ এখানে আসার পর তোমাদেরও শুনিয়েছি।
কেউ উত্তর দিল না।
বাড়ি বেচার কারণটা বিনয়কে বিশদভাবে আগেই বার দুই বলেছেন অবনীমোহন। এবার দুই মেয়ে ও দুই জামাইকেও বললেন। অঋণী হয়েই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চান। ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুর কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তার কাছে সেটা নরকযন্ত্রণার সমান।
এবারও মেয়ে জামাইরা চুপ করে থাকে।
অবনীমোহন থামেননি, আমার ধারদেনার পরিমাণ বিরাশি হাজার টাকা। এই বাড়ির দাম পাচ্ছি। এক লাখ পনেরো হাজার। ঋণ মিটিয়ে আমার হাতে থাকছে তেত্রিশ হাজার। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই টাকা নিয়ে আমি গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব। পরে মত বদলেছি।
খাটের সামনে বসে শ্রোতারা উন্মুখ তাকিয়ে থাকে।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, গৃহী জীবনের কোনও কিছু নিয়ে আমি আশ্রমে যেতে চাই না। এখানকার সব পেছনে ফেলে রেখে খালি হাতে চলে যাব। আমার ইচ্ছা, ওই বাড়তি টাকাটা সুধা সুনীতি আর বিনুকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে দিই। তোমরা কী বল?
সুধা বলল, ওই টাকার আমার দরকার নেই। আমার ভাগেরটা তুমি বিনুকে দিও।
সুনীতিও তার মনোভাব জানিয়ে দেয়। সেও টাকা নেবে না। তার ভাগেরটাও যেন বিনয়কেই দেওয়া হয়। হিরণ এবং আনন্দর এ-ব্যাপারে আন্তরিক সায় আছে। শ্বশুরের কাছে তাদের আদৌ কোনও প্রত্যাশা নেই। বরং পুরো তেত্রিশ হাজার টাকা পাওয়া গেলে বিনয় অনেকখানি নিশ্চিন্ত হতে পারবে। ওই টাকাটা তার ভবিষ্যতের পক্ষে বড় রকমের বল-ভরসা।
অবনীমোহন খুব সম্ভব খুশিই হলেন। বললেন, বেশ, তা-ই হবে। বিনুর নামে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাটা আমি জমা করে দেব।
বিনয় বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। পলকহীন। সে মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না, অবনীমোহনের জন্য ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে কি না, কে জানে। যদি বেঁচেও থাকে, তার জীবন আরও গ্লানিকর, আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে কি না, কে বলবে। বাবার প্রতি তার কত যে ক্রোধ, কত যে অভিমান, কত যে ক্ষোভ! বিনয় চাপা ধরনের মানুষ। ভেতরে যে তুমুল আলোড়ন চলছে তা ফেটে বেরিয়ে আসতে দেয় না। নীরস গলায় সে বলে, আমি ছোটদি বড়দির ভাগের টাকা চাই না। আমাকে যা দিতে চেয়েছেন তাও নেব না।
অবনীমোহন হকচকিয়ে যান। নম্র, মৃদুভাষী বিনয় যে মুখের ওপর এত স্পষ্ট করে না বলে দিতে পারে, ভাবা যায়নি। বিহুলের মতো কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তিনি। ছেলের এই প্রত্যাখ্যান তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। ঢোক গিলে বললেন, টাকাটা নিলে তোর সুবিধে হতো। অর্থ একটা বড় শক্তি।
আনন্দদা আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। আশা করি, তাতেই চলে যাবে। ওই তেত্রিশ হাজার না পেলেও অসুবিধেয় পড়ব না।
বিনয় তার সংকল্পে এতটাই অনড় যে কী বলবেন, অবনীমোহন ঠিক করে উঠতে পারলেন না।
সুধা হঠাৎ বলে ওঠে, বাবা, তুমি তো বাড়ি বেচে চলে যাচ্ছ। বিনু কোথায় থাকবে?
অবনীমোহনের উত্তর দেওয়া হল না। দুজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন, ভেতরে আসতে পারি?
অবনীমোহন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আসুন, আসুন– বিনয়ের পাশে যে ফাঁকা চেয়ারগুলো পড়ে ছিল সেখানে তাদের বসানো হল। একজন বেশ লম্বা, ধারালো ফলার মতো মেদহীন স্বাস্থ্য। রীতিমতো সুপুরুষ। পরনে নিখুঁত বিলেতি স্যুট। তার সঙ্গীটির উচ্চতা মাঝারি। ভারী চেহারা। গোলাকার মুখ, শরীরে প্রচুর অনাবশ্যক চর্বি। পরনে ধুতি, সার্জের পাঞ্জাবির ওপর গলাবন্ধ লং কোট, মাথায় পাগড়ি। কপালে এবং কানের লতিতে চন্দনের বড় টিপ। ধুতি পরার ধরন, চন্দন এবং পাগড়ি চিনিয়ে দেয়, লোকটা মারোয়াড়ি।
অবনীমোহন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্যুট-পরাটি হাইকোর্টের নাম করা অ্যাডভোকেট। নাম অজিতেশ লাহিড়ি। তিনিই বাড়ি বিক্রির দলিল তৈরি এবং রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করবেন। ধুতিওল্লা রাধেশ্যাম জালান। বড়বাজারে তার গদি। নানা ধরনের ব্যবসা করেন। যেটুকু আন্দাজ করা গেল, লোকটার অঢেল টাকা।
অজিতেশ জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি বিক্রির বিষয়ে আপনার ছেলেমেয়ে জামাইদের মতামত নিয়েছেন?
রাধেশ্যামরা কয়েক পুরুষ কলকাতার বাসিন্দা। সামান্য টান থাকলেও বাংলাটা নির্ভুল বলেন। তারও একই জিজ্ঞাস্য, ছেলেমেয়েরা খুশি মনে বাড়ি বিক্রিতে রাজি হয়েছে কি না। বাবার সিদ্ধান্তের জন্য পরে যেন তারা আপশোষ না করে। কারও মনে দুঃখ দিয়ে তিনি সম্পত্তি খরিদ করতে চান না।
অবনীমোহন বললেন, না, কারও কোনও আপত্তি নেই। ওদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। লাহিড়ি সাহেব আপনি দলিল তৈরি করুন। রাধেশ্যামজি, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
রাধেশ্যাম বললেন, হাঁ হাঁ, বলুন কী অনুরোধ।
দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই আমি চলে যাব। আমার ছেলে বিনুর কথা আপনাকে সবই বলেছি। সবে পাকিস্তান থেকে এসেছে। ওর থাকার একটা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত দয়া করে যদি ওকে কিছুদিন এখানে থাকতে দেন–
যতদিন ইচ্ছা ছোটবাবুজি এ-বাড়িতে থাকবেন। এক বছর, দুবছর–আমার আপত্তি নেই।
অবনীমোহন বললেন, কী বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা– তার কথা শেষ হবার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বিনয়, না না, বাবা চলে গেলে আমি আর এক মুহূর্তও এ-বাড়িতে থাকব না। নিজের বাবাই যখন ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন, অনাত্মীয়, অচেনা একটা মানুষের করুণা তার প্রয়োজন নেই।
ঘরের ভেতর অপার স্তব্ধতা নেমে আসে। সবাই ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। একসময় রাধেশ্যাম বললেন, ঠিক আছে ছোটবাবুজি, আপনার যেমন ইচ্ছা। এখন চলি– তিনি উঠে পড়লেন।
দেখাদেখি অজিতেশ লাহিড়িও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
রাধেশ্যাম জালান এবং অজিতেশ লাহিড়ি চলে যাবার পর বিব্রতভাবে অবনীমোহন বললেন,একটা ব্যবস্থা করেছিলাম, তুই রাজি হলি না। আমি আর কদিনই বা কলকাতায় আছি। তারপর কোথায় থাকবি?
বিনয় রুক্ষ স্বরে বলতে যাচ্ছিল, তার সম্বন্ধে অবনীমোহনকে চিন্তা করতে হবে না। ধর্মকর্ম আর গুরুদেব নিয়ে যিনি মত্ত, অন্যের দুঃখ কষ্ট, সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তার বিচলিত না হলেও চলবে। কিন্তু কী ভেবে থমকে গেল। উদাসীন মুখে শুধু বলল, দেখি—
হঠাৎ আনন্দ বলে ওঠে, এই নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। বিনু আমাদের কাছে থাকবে। বিডন স্ট্রিট থেকে ওর অফিস খুব দূরে নয়, হেঁটেই চলে যাওয়া যায়।
চকিতে হেমনলিনীর চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। কী নিষ্ঠুরভাবেই না ওই মহিলা একরকম গলাধাক্কা দিয়ে ঝিনুককে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে যে কী মানসিক পীড়ন! ঝিনুকের সেই চরম লাঞ্ছনা এবং অপমান এই তো সেদিনের ঘটনা। পলকের জন্যও সে-সব ভুলতে পারে না বিনয়। সারাক্ষণ সেগুলো তার মাথায় যেন শেল বেঁধাতে থাকে। মুখ কঠোর হয়ে ওঠে তার। খুব ঠাণ্ডা গলায় সে বলে, আপনাদের বাড়িতে থাকার কথা বলবেন না আনন্দদা। আমি ওখানে কিছুতেই যাব না।
বিনয়ের অনিচ্ছার কারণটা বুঝতে পারে আনন্দ। ঝিনুকের অসম্মানে সবচেয়ে বেশি ক্লেশ আর যাতনা যে ভোগ করেছে সে বিনয়। মুখ কালো হয়ে যায় আনন্দর। কিছু একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করে কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।
আনন্দর ডান পাশে ছিল সুনীতি। ঝিনুকের প্রতি হেমনলিনীর আচরণে সেও কম কষ্ট পায়নি। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার বিনয়ের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। সে জানে তার এই ভাইটি ভীষণ জেদি। শত অনুরোধেও সে তার শ্বশুরবাড়িতে আর কখনও যাবে না।
বিনয়ের গা ঘেঁষে বসে ছিল সুধা। সে বলল, ঠিক আছে, বিনুকে আমার কাছেই নিয়ে যাব।
ছোটদি আর হিরণের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই বিনয়ের। অপার মমতায় ওরা ঝিনুককে কাছে টেনে নিয়েছিল। লাঞ্ছিত মেয়েটা ভয়ে গ্লানিতে আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকত। সুধাদের কাছে এসে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল সে। কতকাল পর সহজভাবে শ্বাস নিতে পারছিল। ত্রাসের বেড়াজাল ছিঁড়ে খুশিতে তখন সে ভরপুর। চঞ্চল পাখির মতো তখন সে ডানা মেলতে শুরু করেছে। সারাক্ষণ তার কলকলানি, গান বাজনা সিনেমা থিয়েটার–সব ব্যাপারেই তার অফুরান কৌতূহল, অনন্ত প্রশ্ন। তার ভয়ার্ত মলিন মুখে ফিরে এসেছিল ঝলমলে হাসি। কত যত্নে, কত মায়ায় সুধারা ঝিনুকের দুঃখের স্মৃতিগুলোকে যে মুছে দিয়েছিল।
ছোটদির কথার জবাব দেয় না বিনয়। নীরব থেকে বুঝিয়ে দিল সুধাদের কাছে থাকতে তার আপত্তি নেই। সেখানে সে স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করবে। দিবারাত্রি হেমনলিনীর মুখ অন্তত দেখতে হবে না। তবু একটু দ্বিধা সূক্ষ্মভাবে মাথার ভেতর কোথায় যেন খোঁচা দিতে থাকে। সুধারা খুব যত্ন করেই তাদের কাছে রাখবে। কিন্তু চিরকাল তত বোন-ভগ্নীপতির বাড়িতে থাকা যায় না। সে ভেবে নিল, অবনীমোহন চলে যাবার পর আপাতত কিছুদিন সুধাদের কাছেই কাটাবে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলাদা ব্যবস্থা করে নেবে।
ঘরের ভেতর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল।
এবার অবনীমোহন বললেন, তখন ওই তেত্রিশ হাজার টাকার বিষয়ে আলোচনা করতে করতে অন্য কথা এসে গেল। তোমরা কেউ তো টাকাটা নিতে রাজি না। কিন্তু ওটার বন্দোবস্ত করা দরকার। আমি একটা কথা ভেবেছি।
কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।
অবনীমোহন থামেননি, এখন হয়তো তোমাদের আপত্তি রয়েছে। পরে মত বদলেও যেতে পারে। চিন্তা করে দেখলাম টাকাটা তোমাদের তিনজনের নামে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে রেখে যাব। পরে তোমরা যা ভাল বুঝবে তা-ই কোরো।
আনন্দ নিচু গলায় বলল, ঠিক আছে, আপনার যখন সেরকম ইচ্ছে তাই করুন।
অবনীমোহন বললেন, আমার আরও কিছু কথা আছে।
বলুন–
তোমরা জানো, যুদ্ধের আমলে রাজদিয়ায় মজিদ মিঞার কাছ থেকে তিরিশ কানি ধান-জমি কিনে চাষবাস শুরু করেছিলাম। তারপর তো কনট্রাক্টরি করতে আসামে গেলাম। সুধা-সুনীতির বিয়ের সময় মাঝখানে একবারই মাত্র রাজদিয়ায় যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ থামলে সোজা চলে এলাম কলকাতায়
অবনীমোহনের বক্তব্য ঠিক ধরতে পারছিল না আনন্দরা। তারা তাকিয়েই থাকে।
অবনীমোহন সবিস্তার জানালেন, কবছর আসামে এবং পরে কলকাতায় কাটানোর কারণে রাজদিয়ার জমিজমা কী অবস্থায় আছে, সে-সম্বন্ধে তাঁর ধারণা নেই। তাছাড়া যৌবনের শুরু থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে একবার এদিকে একবার সেদিকে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ গতিপথ পুরোপুরি বদলে গেল। জীবনে কত কী-ই তো করেছেন! অধ্যাপনা। ব্যবসা। কন্ট্রাক্টরি। চাষবাস। কিন্তু কোনও কিছুই দীর্ঘকাল তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে সেটা, সেটা ছেড়ে অন্য একটা এভাবেই কেটে গেছে জীবনের বেশির ভাগটাই। লম্বা দৌড়ের পর পরমায়ুর শেষ মাথায় পৌঁছে স্থিত হয়েছেন অবনীমোহন। এখন তার একটাই পথ, একটাই গন্তব্য। ধর্ম, গুরুদেব এবং তার আশ্রম। গৃহী জীবনের সমস্ত চিন্তা পেছনে ফেলে তিনি কলকাতা থেকে চলে যেতে চান। বাড়ি বিক্রি, ঋণশোধ–সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে। বিনয় চাকরি পেয়েছে। সেদিক থেকে তার দুর্ভাবনার অবসান ঘটেছে। বাকি শুধু রাজদিয়ার ওই তিরিশ কানি জমি।
অবনীমোহন বিনয়কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আসামে চলে যাবার পর আমাদের জমিগুলো কি এমনিই পড়ে থাকত?
বিনয় বলল, না, তোক দিয়ে নিজের জমিজমার সঙ্গে দাদু ওগুলোও চাষ করাতেন। এ কবছর ধান-পাট বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাওয়া গেছে। সে-সব দাদুর কাছে আছে।
পাকিস্তানে যা চলছে ওই টাকা ইন্ডিয়ায় নিয়ে আসা এখন অসম্ভব। সে যাক, আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম।
বিনয় দুচোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায়।
অবনীমোহন বললেন, জমিগুলোর দলিল টলিল কার কাছে রয়েছে? তুই কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিস?
না। ওগুলো দাদুর কাছেই আছে। বিনয় জানায়, যে অবস্থায় তাকে পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে, দলিলের কথা তখন মাথায় আসেনি। হেমনাথও সেই সময় এমনই বিচলিত, এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত যে অন্য কোনও দিকে তার লক্ষ্য ছিল না। সীমান্ত পেরিয়ে ঝিনুককে নিয়ে নিরাপদে কীভাবে ঘাতকবাহিনীর নজর এড়িয়ে বিনয় ইন্ডিয়ায় পৌঁছবে, সেটাই ছিল একমাত্র চিন্তা। যদি মনে করে হেমনাথ জমিজমার দলিলগুলো সঙ্গে দিতেন, বিপদ শতগুণ বেড়ে যেত। কেননা, পাকিস্তান বর্ডারে ওগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হতো।
অবনীমোহন স্বস্তিবোধ করেন, মামাবাবুর কাছে রয়েছে। এ একরকম ভালই হয়েছে। পাকিস্তানে যা চলছে, দলিল কেড়ে নিলে জমিগুলো খুব সম্ভব হাতছাড়া হয়ে যেত। একটু থেমে বললেন, খবরের কাগজে পড়ি, গায়ের জোরে ওখানে মাইনোরিটিদের প্রপার্টি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। দলিলগুলো আছে, এটুকুই যা সান্ত্বনা।
বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে অনেক আগেই যিনি মোহমুক্ত হয়েছেন, গৃহী জীবনের সমস্ত স্মৃতি পেছনে ফেলে যিনি চিরকালের মতো গুরুর আশ্রমে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের কয়েক কানি জমির ব্যাপারে তিনি যে কেন এত চিন্তিত, কারণটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না।
অবনীমোহন অবশ্য সব বিশদ করে বুঝিয়ে দিলেন। আপাতত রাজদিয়ার জমিগুলো হেমনাথের রক্ষণাবেক্ষণে যেমন আছে তেমনই থাক। পরে পাকিস্তানের অবস্থা যদি আদৌ ফেরে, সুদিন আসে, বিনয়, হিরণ এবং আনন্দ দেশে গিয়ে বা হেমনাথকে চিঠি লিখে তার পরামর্শমতো ওগুলোর ব্যবস্থা। করতে পারে। অবনীমোহন বলতে লাগলেন, তিনজনের পক্ষে একসঙ্গে যদি যাওয়া সম্ভব না হয়, আমি এমনভাবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে যাব, যাতে যে-কেউ গিয়ে জমি বিক্রি করে আসতে পারবে। অবশ্য এতে পাকিস্তানে কাজ হবে কি না জানি না। তবে একটা কথা মনে রেখো, কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাজদিয়ায় যাবে না।
বিনয়রা উত্তর দিল না। ছেলেমেয়ে এবং জামাইদের মুখ দেখে অবনীমোহনের মনে হয় না, সুদূর রাজদিয়ার এক টুকরো ভূখণ্ড নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে।
.
০৮.
সেই যে হিমঋতুর এক বিকেলে পারিবারিক সভা বসেছিল, তারপর পলকে যেন চারটি দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রাধেশ্যাম জালানের নামে বাড়ি রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। বিনয়ের নামে রাজদিয়ার জমিজমা সম্পর্কে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন অবনীমোহন। তারপরও একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ভবানীপুরের তেতলা বাড়িটা জুড়ে সেকেলে ভারী ভারী প্রচুর আসবাব। সবই মেহগনি কাঠের। কত কাল ধরে কত যত্নে তিনি আর সুরমা এ-সব তৈরি করিয়েছিলেন! কত সুখস্মৃতি যে ওগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
অবনীমোহনের ইচ্ছা ছিল, সুধা আর সুনীতি ভাগ করে আপাতত আসবাবগুলো নিক। পরে। বিনয় বিয়ে-টিয়ে করে ঘর-সংসার পাতলে সে যদি এইসব খাট আলমারি থেকে কিছু পছন্দ টছন্দ। করে নিতে চায়, দুই বোন তা দিয়ে দেবে।
এই বিলি-ব্যবস্থায় প্রচণ্ড আপত্তি বিনয়ের। বাবার প্রতি তার তীব্র অভিমান। হেমনলিনীর মতো তিনিও ঝিনুকের সঙ্গে যে নির্দয় আচরণ করেছেন তাতে তার কোনও কিছুই সে নেবে না। একটি কপর্দকও নয়। অবশ্য অবনীমোহনের মুখের ওপর সে-কথা না বললেও, সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।
সুধা এবং সুনীতিরও প্ৰরল অনিচ্ছা। যে-অবনীমোহন তাদের ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন তার টাকা পয়সা বা অন্য কোনও কিছুর ভগ্নাংশও তারা ছুঁতে চায় না। তাছাড়া, সুধার ভাড়া বাড়িটা দোতলা হলেও বেশ ছোট। তার নিজেরই নানা জিনিসে বোঝাই। এর ভেতর বড় বড় খাট আলমারি নিয়ে কোথায় তুলবে? সুনীতি অবশ্য সে সমস্যা নেই। তাদের বিশাল বাড়ি। কিন্তু আনন্দ, বিশেষ করে হেমনলিনী চান না, ছেলের শ্বশুরবাড়ির পুরানো, ব্যবহার-করা আসবাব তাঁর বাড়িতে ঢুকুক। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি রাজি হয়েছেন। একতলার দুটো ফাঁকা ঘরে কিছুদিনের জন্য ওগুলো গাদাগাদি করে রাখা হবে। আনন্দদের বাড়িতে মালপত্র পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।
.
যাবতীয় আয়োজন শেষ। খগেন এবং অবনীমোহনের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। আজ তারা সন্ধের ট্রেনে হরিদ্বার চলে যাবেন।
বিনয় আপাতত ভবানীপুরের বাড়িতেই আছে। বিকেলে আনন্দ সুনীতি সুধা আর হিরণ চলে এল। তারা সবাই অবনীমোহনের সঙ্গে হাওড়ায় গিয়ে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। অবনীমোহনের ইচ্ছা ছিল না। কষ্ট করে কারও স্টেশনে যাবার দরকার নেই। কিন্তু তার আপত্তিতে কেউ কান দেয়নি।
রাধেশ্যাম জালানকে আসতে বলেছিলেন অবনীমোহন। তিনিও এসে গেছেন। বাড়ির চাবি তার হাতে দিয়ে খগেনকে দিয়ে দুটো ট্যাক্সি ডাকানো হল। মালপত্র সামান্যই। একটা মাঝারি চামড়ার সুটকেসে অবনীমোহনের খানকতক জামাকাপড়, কটি ধর্মগ্রন্থ এবং টুকিটাকি ছোটখাটো জিনিস। আর আছে হোল্ড-অলে বাঁধা বিছানা। খগেনেরও গোটা দুই পুঁটলি হয়েছে। সব একটা ট্যাক্সির ডিকিতে ভরা হলে সেটায় উঠলেন অবনীমোহন। পেছনের সিটে তার দুপাশে বসেছে সুধা আর সুনীতি। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বিনয়। দ্বিতীয় ট্যাক্সিটায় আনন্দ, হিরণ এবং খগেন।
ছেলেবেলা থেকেই সুধার বড় বেশি আবেগ। অবনীমোহন সব মায়া, সব বন্ধনের গিটগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছেন। ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকে অঝোরে কেঁদে চলেছে সুধা। কান্নার দমকে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক। সুনীতির স্বভাবটা চাপা ধরনের। সেও কাঁদছে, কিন্তু শব্দহীন। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, টকটকে লাল এবং সজল।
বিনয় উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। নিমেষের জন্যও পেছন ফিরে দেখছিল না। অবনীমোহনের প্রতি তার সুতীব্র ক্ষোভ। বুকের ভেতর কত যে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে-সব উধাও। জগতে এই মানুষটির সঙ্গে তার সম্পর্ক সব চেয়ে নিবিড়। এরই রক্ত তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে। এরকম নিকটজন আরও একজন ছিলেনমা। তিনি তো রাজদিয়ায় চিতাভস্মে কবেই বিলীন হয়ে গেছেন। বাবার সঙ্গে এ-জীবনে আর হয়তো কখনও দেখা হবে না।
বিনয় পুরুষমানুষ। সুধার মতো হাউ হাউ করে কাঁদতে পারে না। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে প্রাণপণে সেটা রুখে দিচ্ছিল সে।
অবনীমোহন মেরুদণ্ড টান টান করে স্থির হয়ে বসে আছেন। চিরবিদায়ের আগে মেয়েদের কান্না বা বিনয়ের থমথমে চেহারা তাকে কতখানি চঞ্চল করেছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আবেগহীন সুরে মাঝে মাঝে তিনি বলে উঠছেন, কেঁদো না, কেঁদো না।
পৌনে ছটায় ট্রেন। মিনিট কুড়ি আগেই হাওড়ায় পৌঁছে গেলেন অবনীমোহনরা। রিজার্ভ করা বার্থ খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগল না।
সুধা-সুনীতি হোল্ড-অল খুলে যত্ন করে বিছানা পেতে অবনীমোহনকে বসালো। হিরণ আর আনন্দ তার সুটকেস এবং অন্য টুকিটাকি জিনিস বাঙ্কে রেখে দিল।
অবনীমোহনের সামনের বার্থটা খগেনের। সে তার পোঁটলা দুটো বাঙ্কের মাথায় রেখে একধারে দাঁড়িয়ে আছে। সুধারা তার বার্থে বসে পড়ল।
ধরা ধরা গলায় সুনীতি খগেনকে বলল, তুমি তো বাবার সঙ্গে থাকবে
খগেন ঘাড় কাত করল, হ্যাঁ বড়দি
দেখো, বাবার যেন কোনওরকম অসুবিধে না হয়–
খগেন জানায়, না, হবে না। পাঁচ বছর সে অবনীমোহনের সঙ্গে আছে। ছায়ার মতো। সেবাযত্নের কখনও ত্রুটি হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
হিরণ অবনীমোহনকে বলল, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার হরিদ্বারের ঠিকানাটা নেওয়া হয়নি। পকেট থেকে কলম আর এক টুকরো কাগজ বার করল সে।
অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, ঠিকানা নিতে চাইছ কেন?
হিরণ থতিয়ে গেল, কোনও দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। সেই জন্যে
অবনীমোহন বললেন, হরিদ্বারের ঠিকানা নিয়ে লাভ নেই। কতদিন সেখানে থাকব, জানি না। গুরুদেব হয়তো কনখল কি উত্তরকাশীর আশ্রমে পাঠিয়ে দেবেন। তেমন বুঝলে আমিই তোমাদের চিঠি লিখব।
বিনয় বাবাকে লক্ষ করছিল। মনে হল, অবনীমোহন তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে চান, চিরতরে। ঠিকানা না দেবার কারণ সেটাই। তাছাড়া তার ধারণা, বাবা বললেন বটে, কিন্তু কোনওদিনই হয়তো চিঠি লিখবেন না।
ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছিল। অবনীমোহন বললেন, আর বসে থেকো না, তোমরা গাড়ি থেকে নেমে যাও।
প্ল্যাটফর্মে নেমে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। বিষণ্ণ। নীরব। চোখেমুখে সীমাহীন ব্যাকুলতা।
একসময় গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। কয়লার ইঞ্জিন তীক্ষ্ণ সিটি বাজিয়ে সারা স্টেশন চকিত– করে স্টার্ট দিল। ধীর গতিতে বিশাল সরীসৃপের মতো ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল।
যতক্ষণ অবনীমোহনকে দেখা যায়, হাত নাড়তে থাকে সুধারা। অবনীমোহনও জানালার পাশে বসে হাত নাড়ছিলেন। খানিক পরে দূরে সবুজ আলো জ্বালিয়ে যে ডিসটান্ট সিগনালগুলো নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর পাশ দিয়ে ট্রেনটা অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। অবনীমোহনের জীবনের নানা পর্ব শেষ। এবার অন্তিম পর্বের দিকে তাঁর চিরতরে প্রস্থান।
ট্রেন মিলিয়ে যাবার পরও প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিনয়রা। তারপর ভারী গলায় হিরণ বলল, এবার ফেরা যাক।
আগেই ঠিক করা আছে, স্টেশন থেকেই হিরণ আর সুধা বিনয়কে সোজা তাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে যাবে। আনন্দ আর সুনীতি চলে যাবে বিডন স্ট্রিটে।
স্টেশনের ঠিক বাইরে একধারে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। তার গা ঘেঁষে আলাদা আলাদা ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশার জটলা।
আনন্দ সুধাদের বলল, তোমাদের অনেক দূর যেতে হবে। একটা ট্যাক্সি নাও। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে।
হিরণ বলল, তাই ভেবে রেখেছি। আপনারা?
আমরা ঘোড়ার গাড়ি নেব। হ্যারিসন রোড আর সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে গেলে বিডন স্ট্রিটে। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। চল, আগে তোমাদের ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই ।
স্ট্যান্ডে লাইন দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। তার একটায় সুধাদের তুলে দিয়ে বিব্রতভাবে আনন্দ বলল, বিনু, বলার মুখ নেই তবু একটা অনুরোধ করছি। যদি কখনও তোমার ইচ্ছে হয়, আমাদের বাড়ি চলে এস।
বিনয় উত্তর দিল না। আনন্দকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে, ওদের বাড়িতে আর কখনও যাবে না। সেই সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি বদলাবার কোনও কারণ নেই।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিলে আনন্দরা ঘোড়ার গাড়ির আস্তানার দিকে চলে গেল।
.
০৯.
এবার সুধাদের বাড়ি আসার পর বিনয়ের কোনও ব্যাপারেই যেন চাড় নেই। শরীর আর মন জুড়ে বিচিত্র এক জড়তা। শুধু তা-ই না, সেই সঙ্গে অসীম ক্লান্তি। চরম অবসাদ। মা তো কবেই চলে গেছেন। ঝিনুক নিরুদ্দেশ। এরা দুজনে জীবনের অনেকখানি অংশ ফাঁকা করে দিয়ে গেছে। অবনীমোহনের প্রতি তার প্রবল বিতৃষ্ণা। তবু তিনি হরিদ্বারে চলে যাবার পর আর-এক দিকে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই মানুষটার সঙ্গে অনেকগুলো বছর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তিনি যে শিরায় স্নায়ুতে, সমস্ত অস্তিত্বে, শত বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন, এখন সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
একে একে প্রিয়জনেরা দূরে সরে যাচ্ছে। মা। বাবা। ঝিনুক। বাকি রয়েছে দুই দিদি। কিন্তু তারাও তো অন্যের স্ত্রী। বিনয়ের প্রতি তাদের অপার মায়া, গভীর সহানুভূতি। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই, তারাও অনেকটাই পর হয়ে গেছে। সুনীতির মাথার ওপর রয়েছেন হেমনলিনী। তার দাপট, তার কর্তৃত্বের কাছে সারাক্ষণ সে তটস্থ হয়ে থাকে। শ্বশুরবাড়িতে সুনীতির ক্ষমতা আর কতটুকু! ইচ্ছা থাকলেও সে কি ঝিনুককে বাড়িতে রাখতে পেরেছে? সুধা অবশ্য দুহাত দিয়ে ঝিনুককে আগলে রেখেছিল। কিন্তু তার দাদাশ্বশুর আর জেঠশাশুড়ি বাড়িতে থাকলে কতটা কী করতে পারত, বলা মুশকিল। এই যে হিরণরা তাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছে, পাটনা থেকে দ্বারিক দত্তরা ফিরে এলে তারা এটা কতখানি ভাল চোখে দেখবেন, কে জানে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তাদের স্বত্ব বাপের বাড়ির লোকজনদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশ্য অফিসে জয়েন করার পর সাত দিনও সে এখানে থাকবে না। অন্যের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে ভাবলেই ভীষণ অস্বস্তি হয় বিনয়ের।
অবনীমোহন পুরানো সব বন্ধন ছিঁড়ে গুরুর আশ্রমে চলে যাবেন, আগেই তা স্থির হয়ে ছিল। এটা আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়। তবু সত্যিই যখন তিনি চলে গেলেন সেই ধাক্কাটা তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে গেছে হিরণ এবং সুধাকেও।
সুধা চিরকালই চুলবুলে। সদা চঞ্চল। সারাক্ষণ চারপাশে কলরোল তুলে হাওয়ায় উড়তে থাকে। হিরণও খুব আমুদে। হাসিখুশি। কখনও কখনও হুল্লোড়বাজ। কিন্তু ওরাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। বাড়ির আবহাওয়া ম্রিয়মাণ। মলিন। বিষাদ-মাখানো।
কিন্তু শোক, দুঃখ বা মানসিক আঘাতের তীব্রতা চিরস্থায়ী হয় না। ধীরে ধীরে জাগতিক নিয়মেই তার উপশম ঘটে।
তিনদিনের দিন সকালবেলা চা খেয়ে, বাসি জামাকাপড় পালটে বিনয় বলল, হিরণদা, ছোটদি, আমি একটু বেরুচ্ছি।
মাঝখানের দুটো দিন শুয়ে বসে, অস্থিরভাবে পায়চারি করে বা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়। কিন্তু দোতলার কটা কুঠুরির ভেতর আটকে থাকতে আজ আর ভাল লাগছে না। বড় বেশি একঘেয়ে মনে হচ্ছে। ভীষণ ক্লান্তিকর।
সুধা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবি?
বিনয় বলল, এই একটু ঘুরে টুরে আসি।
সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিল হিরণ, ঘুরেই আসুক। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকার মানে হয় না।
সুধা বলল, বেশি দেরি করিস না।
আচ্ছা–
ট্রাম রাস্তায় এসে ফুটপাথ ধরে টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের দিকে হাঁটতে লাগল বিনয়। বিশেষ কোনও গন্তব্য নেই। কেমন যেন দূরমনস্ক। লক্ষ্যহীন।
ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর কটা দিন উদভ্রান্তের মতো এই শহরের বড় বড় রাস্তা এবং জিলিপির প্যাঁচ-লাগা অগুনতি অলিগলিতে ছুটে বেড়িয়েছে বিনয়। তার উদ্যম প্রায় শেষ। উদ্দীপনা স্তিমিত। আশাও প্রায় বিলীন। ক্রমশ সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ঝিনুককে আর কখনও পাওয়া যাবে না। বৃথাই কলকাতার পথে পথে ঘুরে জীবনীশক্তিকে ক্ষয় করে ফেলা।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সাদার্ন অ্যাভেনিউর কাছাকাছি চলে এসেছে, খেয়াল নেই। আচমকা রামরতন গাঙ্গুলির মুখটা মনে পড়ে গেল। জামতলির বৃদ্ধ, শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইটি প্রায় সমস্ত জীবন জাতিগঠনের কাজে কাটিয়ে দিয়েছেন। শেষ বয়সে শরীর যখন অশক্ত, জরার ভারে পিঠ নুয়ে পড়েছে, সেই সময় এক কাপড়ে পাকিস্তান থেকে তাঁকে ভয়ে আতঙ্কে পূর্বপুরুষের বাসভূমি ছেড়ে ইন্ডিয়ার দিকে পা বাড়াতে হয়েছিল। সম্পূর্ণ নিঃস্ব। মাথার ওপর পাষাণভারের মতো বৃদ্ধা স্ত্রী, এক বিধবা এবং দুই তরুণী মেয়ে। তখন সারাক্ষণ মৃত্যুভয়। জলেস্থলে ঘাতকবাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বুঝি মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল! এই বুঝি দুই যুবতী মেয়েকে কেড়ে নিয়ে গেল!
রাজদিয়ার আশু দত্তর সঙ্গে রামরতনের অনেকটাই মিল। তবে রামরতনের সমস্যা অনেক জটিল। তার স্ত্রী আছেন, তিন মেয়ে আছে। সেদিক থেকে আশু দত্ত প্রায় ঝাড়া হাত-পা। বৃদ্ধা অথর্ব মা ছাড়া তাঁর কেউ নেই।
তারপাশার স্টিমারঘাটে রামরতনদের সঙ্গে বিনয়ের প্রথম আলাপ। স্টিমারের ডেকে গাদাগাদি ভিড়ে শয়ে শয়ে সর্বস্ব খোয়ানো শরণার্থীর সঙ্গে তারা এসেছিল গোয়ালন্দে। তারপর কলকাতার ট্রেন ধরেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় পৌঁছনো আর হল না। জীবন্ত রামরতন আসতে পারেননি, এসেছিল তার নিষ্প্রাণ শরীর। পথেই তার যাবতীয় যন্ত্রণা আর দুর্ভাবনার অবসান ঘটে গেছে।
শিয়ালদায় রামরতনের ভাইপো বিমলকে বিনয় কথা দিয়েছিল, খুব শিগগিরই একদিন তাদের বাড়ি যাবে। কিন্তু শোকাতুর মানুষগুলোর কথা ভাবার মতো সময়ই পাওয়া যায়নি। কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কত কিছুই না ঘটে গেল। সুনীতিদের বাড়ি গিয়ে ঝিনুকের চরম লাঞ্ছনা, সুধাদের কাছে আশ্রয় পাওয়া, খবরের কাগজে আনন্দর চাকরি জোগাড় করে দেওয়া, তীর্থস্থান থেকে অবনীমোহনের ফিরে আসা, ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রি, ঝিনুকের প্রতি অবনীমোহনের হৃদয়হীন আচরণ, জনমদুখিনী মেয়েটার নিখোঁজ হওয়া, চিরকালের মতো অবনীমোহনের গুরুর আশ্রমে চলে যাওয়া। একের পর এক ঘটনা। একের পর এক সংকট। এ-সবের বাইরে তার চিন্তায় আর কিছুই ছিল না।
অঘ্রানের এই সকালে নরম শীতল রোদে যখন চারদিক ভরে আছে, উত্তুরে হাওয়ার দাপট টের পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, সেই সময় রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েদের জন্য এক ধরনের আকুলতা অনুভব করে বিনয়।
এখনও অফিস টাইমের ভিড় শুরু হয়নি। ট্রাম বাস বেশ ফাঁকা ফাঁকা। রাস্তার ওপারে গিয়ে একটা দোতলা বাসে উঠে পড়ল বিনয়। ওটার দৌড় বালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজার।
বিমলদের ঠিকানা তার স্পষ্ট মনে আছে। তিরিশ নম্বর মদন বড়াল লেন। রামরতন গোয়ালন্দগামী স্টিমারের ডেকে পাশাপাশি বসে বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যামবাজারে চিত্রা সিনেমার পাশ দিয়ে মিনিট দুই হাঁটলেই বাঁ দিকের গলিটাই মদন বড়াল লেন।
দোতলা বাসটা আধ ঘণ্টার মধ্যে চিত্রা সিনেমার সামনে বিনয়কে পৌঁছে দিল। তারপর বিমলদের বাড়িটা খুঁজে বার করতে বেশিক্ষণ লাগল না।
এলাকাটা পুরানো এবং ঘিঞ্জি। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। সবই সাদামাঠা, কারুকার্যহীন। কোথাও পাঁচ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা নেই। তবে আশেপাশে কোনও বস্তি টস্তি চোখে পড়ছে না।
বিমলদের বাড়িটা তেতলা। সদর দরজা হাট করে খোলা। রাস্তা থেকেই টের পাওয়া যায়, ভেতরে প্রচুর লোকজন। তাদের চলাফেরা, টুকরো টুকরো কথাবার্তা এবং বাসনকোসনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সূর্যোদয় হয়েছে অনেক আগেই। আনকোরা একটা দিন। ঘর-গেরস্থালির ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।
বিনয় গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগল, বিমলবাবু–বিমলবাবু–
খানিক পরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো বিমল নয়, রামরতনের মাঝবয়সী বিধবা মেয়ে বাসন্তী। বিনয়কে দেখে চকিতে তার চোখেমুখে চাপা আলোর মতো কিছু খেলে যায়। ব্যগ্র সুরে সে বলে, রোজই ভাবি আপনে আইবেন। কিন্তুক আহেন আর না। মায় (মা), আমি আর আমার দুই বইনে। রাস্তার দিকে তাকাইয়া থাকি। পরে ভাবলাম, পথের আলাপ। কে আর কারে মনে রাখে। চোখের আবডাল হইলে সগলে ভুইলা যায়—
তারপাশা থেকে কলকাতায় আসার সময় দেড় দিনেরও বেশি সময় তাদের একসঙ্গে কেটেছে। বিনয়ের মনে হয়েছিল, মহিলা স্বল্পভাষী। সারাক্ষণই বিমর্ষ। ম্রিয়মাণ। কিন্তু আজ প্রচুর কথা বলছে। বেশ অবাকই হল সে। বিব্রতভাবে কিছু একটা কৈফিয়ৎ দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই হয়তো বাসন্তীর খেয়াল হয়, বিনয়কে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যস্তভাবে বলল, আহেন, ভিতরে আসেন। আপনেরে আমাগো বড় দরকার–
বাসন্তীর পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সামান্য অস্বস্তি বোধ করে বিনয়। বিমল বাসন্তীর খুড়তুতো ভাই। নিজের পরিজনেরা থাকতে কেন তাকেই ওদের প্রয়োজন, কেন তার জন্য ওরা অপেক্ষা করে আছে, কে জানে।
.
১০.
সদর দরজা পেরুলেই মস্ত চাতাল। কোনও এক কালে, হয়তো পঞ্চাশ কি ষাট বছর আগে, ওটা যত্ন করে বাঁধানো হয়েছিল। চাকলা চাকলা সিমেন্ট উঠে এখন এবড়ো খেবড়ো, নানা জায়গায় ইট বেরিয়ে পড়েছে।
চাতালটার একধারে তিনটে এজমালি জলের কল। দুটো পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত জলের। টালার মস্ত ট্যাঙ্ক থেকে ওই জলটা দিনে তিনবার সাপ্লাই করা হয়। সকালে, দুপুরে এবং বিকেলে। খাওয়া, স্নান, রান্নাবান্না–সব এই জল দিয়ে। তৃতীয় কলটা গঙ্গাজলের। দিনরাত ওটা পাওয়া যায়। সরবরাহে কোনও ছেদ নেই। এই জলটা ঘর ধোওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদি মোটা কাজের জন্য ভীষণ জরুরি। মাসখানেকের মতো কলকাতায় কাটানোর ফলে এই শহরের ওয়াটার সাপ্লাই সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গেছে বিনয়ের।
সে জানে, সকালের দিকটায় এই মহানগরের লোকজনের ভীষণ ব্যস্ততা। তখন বাড়ির গিন্নিদের রান্নার তাড়া। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে যাবার তাড়া। বাড়ির কর্তাদের অফিসে যাবার তাড়া। যাদের দোকান বা অন্য ব্যবসাপত্তর আছে তাদের বেরুবার তাড়া।
ভেতরে পা দিয়েই বিনয় আঁচ করে নিল, গোটা তেতলা বাড়িটা আগাপাশতলা ভাড়াটেতে ঠাসা। কলতলায় এখন মেলা বসে গেছে। বড় বড় টিনের বালতি, গামলা, ডেকচি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে অনেকে। বিশেষ করে নানা বয়সের মেয়েরা। কিশোরী, যুবতী এবং মাঝবয়সী গিন্নিবান্নিরা তো আছেই, বেশ কজন পুরুষকেও দেখা গেল। কে আগে জল নেবে, কার বেরুবার বেশি তাড়া, এই নিয়ে রীতিমতো বচসাও চলছে। ওদিকে তিনটে পায়খানার সামনেও লাইন। কয়েকজন জলের বালতি এবং মগ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিম্নগামী বেগ সামলাচ্ছে। বাসন্তী যে একটি অচেনা যুবককে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে তার দিকে কারও লক্ষ্য নেই।
ঘরে ঘরে কয়লার উনুন ধরানো হয়েছে। চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। একতলায়, দোতলায়, তেতলায়–সর্বত্র।
চাতালটা ঘিরে সারি সারি ঘর। সেগুলোর সামনে দিয়ে টানা, চওড়া বারান্দা।
চাতালের আধাআধি পেরিয়ে ডান পাশে যেতে যেতে বাসন্তী ডাকতে লাগল, মা মা, দ্যাখো ক্যাঠা (কে) আইছে।
কোণের দিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রামরতনের স্ত্রী। তার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনয়ের। হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে যায়। শিয়ালদা স্টেশনে শেষ তাকে দেখেছে সে। স্বামীর মৃতদেহ আগলে অঝোরে কাঁদছিলেন। তখনও তার পাকা চুলের সিঁথিতে ডগড়গে সিঁদুরের টান। কপালে মস্ত সিদুরের টিপ। হাতে ধবধবে শাখা, লাল পলা আর রুপো-বাঁধানো লোহা। পরনে লাল-পাড় শাড়ি। আর এখন? সিঁদুর নেই। শাখা নেই। লোহা নেই। গায়ে সাদা ফ্যাটফেটে সেমিজ আর থান। কদিনে বৃদ্ধা আমূল বদলে গেছেন। যেন অচেনা এক বিষাদপ্রতিমা। তার এই চেহারা চোখে শেল বেঁধাতে থাকে বিনয়ের।
তাকে দেখে হঠাৎ যেন একটু উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন রামতরনের স্ত্রী, আসো বাবা, আসো,
পাশের একটা ঘর থেকে ছায়া আর মায়াও বেরিয়ে এসেছিল। কেমন যেন জড়সড়, ত্রস্ত। চকিতের জন্য বিনয়ের মনে হয়, ওরা কি এখানে ভাল নেই? লক্ষ করল, তাকে দেখে দুই তরুণীর মুখে ক্ষীণ আভা ফুটে উঠেছে।
বিনয় খুব অবাকই হয়। বাসন্তী জানিয়েছে ছায়া-মায়া এবং তাদের মা বিমলের বাসায় আসার পর থেকে তার জন্য অধীরভাবে দিন গুনে যাচ্ছে। ভাবনায় আবছা একটা ছায়া পড়ে। এই চার রমণীর তার কাছে কি কোনও প্রত্যাশা আছে?
একটা ছোট ঘরে বিনয়কে এনে বসানো হয়। খুবই সাধারণ সাজসজ্জা। খানচারেক সস্তা চেয়ার, একটা নিচু চৌকো টেবল, সেকেলে ধাঁচের কাঁচের আলমারিতে বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র এবং আধুনিক লেখকদের কিছু বই, দেওয়ালে ইংরেজি-বাংলা মেশানো বড় মাপের ক্যালেন্ডার, একধারে সুজনি-ঢাকা সরু তক্তপোশ, মাথার ওপর লম্বা উঁটিওলা মান্ধাতার আমলের ফ্যান।
বাসন্তীরা দাঁড়িয়ে আছে। বিনয় বলল, আমি তো বসে পড়লাম। আপনারাও বসুন–
অনেক বলার পর রামরতনের স্ত্রীই শুধু কুণ্ঠিতভাবে একটা চেয়ারে বসলেন। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা, বিনয়ের লেইগা চা কইরা লইয়া আয়–
বিনয় আপত্তি করতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছায়া মায়া ছুটে বেরিয়ে গেছে।
এদিক সেদিক তাকিয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, আপনারাই শুধু রয়েছেন। বিমলবাবুকে তো দেখছি না। তিনি কোথায়?
বৃদ্ধা বললেন, বিমল গ্যাছে র্যাশনের দোকানে। র্যাশন তুইলা, বাজার কইরা ফিরব। আইজ হ্যায় (সে) অফিস যাইব না। অর (ওর) বউ হের (তার) পোলামাইয়া লইয়া সখের বাজারে বাপের বাড়িত গ্যাছে। আইজ আর ফিরব না।
কথায় কথায় জানা গেল, উত্তর কলকাতার এই পুরানো, বয়স্ক বাড়িটায় সবসুদ্ধ পনেরোটি ভাড়াটে পরিবারের বাস। পরিবার পিছু আড়াই খানা করে ঘর, এক ফালি রান্নার জায়গা আর সামনের দিকের বারান্দার একটা অংশ। সবার সমান ভাড়া। মাসে সাঁইত্রিশ টাকা। বাড়িওলা এ বাড়িতে থাকে না। বেলেঘাটায় তার আরও একটা বাড়ি আছে, সেখানেই থাকে, আর মাসের পাঁচ তারিখে একবার এসে এখানকার ভাড়া আদায় করে নিয়ে যায়। যুদ্ধের আগে থেকে এ-বাড়িতে আছে বিমল। তার এক ছেলে, এক মেয়ে।
রামরতনের স্ত্রী আরও জানান, বিমলের শ্বশুরদের আদি বাড়ি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। যুদ্ধের ঠিক পরে পরে দেশের পাট চুকিয়ে শ্বশুর সখের বাজারে বাড়ি করেছেন। বুদ্ধিমান মানুষ। অত্যন্ত দূরদর্শী। তখনই আঁচ করেছিলেন, ভবিষ্যতে কলকাতা ছাড়া গতি নেই। সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি।
বিমলদের এই ভাড়াটে বাড়ি বা তার শ্বশুর সম্পর্কে বৃদ্ধা কেন যে সাতকাহন করে এত কথা বলছেন, বোঝা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই এ-সব শোনাবার জন্য তারা বিনয়ের জন্য প্রতীক্ষা করে ছিলেন না।
ছায়া আর মায়া চা এবং একটা প্লেটে খুব সস্তা বেকারির খানকতক নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসেছিল। বিনয় শুধু চায়ের কাপটাই তুলে নিল।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, পাকিস্থান থিকা আইনের সময় কইছিলা, তুমার দুই বইন আর বাবা কইলকাতায় আছেন। কার কাছে উঠছ?
এ-শহরে আসার পর যা ঘটে গেছে, সে-সব বাদ দিয়ে সংক্ষেপে বিনয় শুধু বলল, ছোটদির বাড়িতে আছি।
বাবা থাকতে বোনের কাছে কেন থাকে, এ-নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না বৃদ্ধা। বললেন, চাকরি বাকরি কিছু পাইছ?
বিনয় জানায়, খবরের কাগজে ছোটখাটো একটা কাজ জুটেছে।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, ভাল, খুব ভাল। বউমা ক্যামন আছে?
আফজল হোসেন থেকে হরিন্দ কেঁড়াদার, এবং আরও অনেকেই ধরে নিয়েছে ঝিনুক তার স্ত্রী। রামরতনরাও হুবহু তাই ভেবেছেন। অনাত্মীয় অবিবাহিত এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে কোনও যুবক যে একা একা চলে আসতে পারে, এমনটা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল বিনয়ের। ঝিনুকের প্রসঙ্গ যে উঠতে পারে, এখানে আসার আগে ঘুণাক্ষরেও তার মাথায় আসেনি।
ধাক্কাটা সামলাতে খানিক সময় লাগল বিনয়ের। সবার ধারণায় স্থির হয়ে যেটা বসে গেছে, এখন আর তা অস্বীকার করা যায় না। তাই বলা গেল না ঝিনুক তার স্ত্রী নয়। এমনকি ঝিনুক যে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, তাও জানাতে পারল না বিনয়। ঝাপসা গলায় শুধু বলল, ভালই আছে
একটু চুপচাপ।
তারপর অনুযোগের সুরে রামরতনের স্ত্রী বললেন, তুমার পথ চাইয়া থাইকা থাইকা এক সোময় মনে হইছিল, আমাগো কথা বুঝিন ভুইলাই গ্যাছ। এই জীবনে আর দেখা হইব না। অথচ তুমারে আমাগো যে কত দরকার।
লহমায় বিনয়ের স্নায়ুমণ্ডলী সজাগ হয়ে উঠল। এতক্ষণ যা চলছিল সেগুলো নেহাতই কথার কথা। অনাবশ্যক। অসংলগ্ন। এবার আসল প্রসঙ্গটা উঠবে। বাসন্তী তার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল। দরকারের কথা সেও বলেছে।
হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সোজাসুজি রামরতনের স্ত্রীর দিকে তাকায় বিনয়।
বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, বড় ভাল দিনে আইছ। বিমল কি হের (তার) বউ বাড়ি থাকলে পরান খুইলা কথা কইতে পারতাম না।
বিনয় চকিত হয়ে ওঠে। রামরতুনের স্ত্রী কী এমন বলতে চান যা তার ঘনিষ্ঠ পরিজনদের সামনে বলা অসম্ভব?
বৃদ্ধা থামেননি, তুমার মনখান যে কত বড়, মানুষখান যে তুমি ক্যামন, দ্যাশ থিকা আইনের সোময় বুঝতে পারছি। তুমাগো নিজেগোই কত বিপদ, তবু হের (তার) মইদ্যে আমাগো দুই ডানা (ডানা) দিয়া আগলাইয়া পাকিস্থান থিকা ইন্ডিয়ায় লইয়া আইছ। নিজের চৌখে তো দেখছি তুমার মাউসা (মেসো) মশয়রে বাঁচানের লেইগা কী চ্যাষ্টা, কী যত্নই না করছ, আপন জনেরাও হেয়া (তা) করে না।
বিব্রত মুখে বিনয় বলে, এ-সব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। মানুষের জন্যে মানুষ এটুকু করেই।
বৃদ্ধা জোরে জোরে মাথা নাড়ালেন, কেও করে না বাবা। এক দেখলাম নাসেররে। হ্যায় (সে) পাশে না খাইলে ছায়া আর মায়ারে কি রক্ষা করতে পারতাম? রাইক্ষসেরা অগো (ওদের) কাইড়া লইয়া যাইত। হ্যায় কয়জন জুয়ান পোলারে লইয়া পরি (পাহারা) দিয়া দিয়া তারপাশায় আইনা গোয়ালন্দর ইস্টিমারে তুইলা দিল। নাসেরের পর দেখলাম তুমারে। আমাগো লেইগা কী না করছ! তুমরা দুইজন হইলা সত্যকারের মানুষ। একটু থেমে ফের শুরু করলেন, পাকিস্থান হওনের পর তুমাগো লাখান আমন আর কেওরে দেখলাম না।
সামনাসামনি বসে একটানা প্রশংসা শুনতে শুনতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল বিনয়ের। তারই মধ্যে ভাবছিল বৃদ্ধার এত গুণগানের পেছনে গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে।
রামরতনের স্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, বিমল কিছুক্ষণের মইদ্যে র্যাশন বাজার সাইরা ফিরা আসব। হের (তার) আগেই কথাখান সাইরা লই।
উত্তর না দিয়ে তাকিয়েই থাকে বিনয়।
বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, মাইয়াগো লইয়া এই বাড়িতে আমরা বড় অশান্তিতে আছি বাবা। পাকিস্থান থিকা আইনের পর বিমলরা খুব যত্ন করত। সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকত। তুমার মাউসামশয়ের ছাদ্ধশান্তি ভাল কইরাই করছে। পাঁচজন বামন, শ্মশানবন্ধু আর এই বাড়ির ভাড়াইটাগো পাকা ফলার খাওয়াইছে। কিন্তুক হের পরই অগো, বিশেষ কইরা বিমলের বউ দীপ্তির মতিগতি বদলাইয়া গেল। আমাগো লগে ভাল কইরা কথা কয় না, দিনরাইত মুখ ভার। নিজের মনে গজর গজর করে। আমরা য্যান বোঝা হইয়া অগো কান্ধে চাপছি।
মোটামুটি এরকমই আন্দাজ করেছিল বিনয়। কিন্তু এই পারিবারিক তিক্ততা সম্পর্কে সে কী-ই বা বলতে পারে। তার অস্বাচ্ছন্দ্য বাড়তেই থাকে।
গলার স্বর এবার উঁচুতে তুললেন রামরতনের স্ত্রী, এই বিমলের লেইগা কী না করছি আমরা। ও যহন চাইর পাঁচ বচ্ছরের পোলা হেই সোময় আতশা (আচমকা) কয়দিন আগে-পরে অর (ওর) মায়-বাবায় মইরা গেল। হেই থিকা কোলে-পিঠে কইরা অরে আমরা বড় কইরা তুলছি। মেট্রিক (ম্যাট্রিক পাস করনের পর তুমার মাউসামশয় বিমলরে কইলকাতার কলেজে ভর্তি কইরা, হুস্টেলে রাইখা পড়াইছে। কারে কারে য্যান চিঠি লেইখা চাকরির ব্যবস্তা কইরা দিছে। হেই বিমলের বউ চায় না আমরা এইখানে থাকি। পারলে ঘেটি ধইরা বাইর কইরা দ্যায়। কিন্তুক তিন মাইয়া লইয়া কই যামু আমি? টাকাপয়সার জোর নাই, মাথা গোজনের জাগা (জায়গা) নাই, হের উপুর তুমার মাউসামশয় মারা যাওনে অত বড় শোকটা পাইলাম। পাকিস্থানে বস্যের মাইয়াগো (যুবতী) লইয়া কী বিপদে যে আছিলাম! ইন্ডিয়ায় আইয়া ভাবলাম, বুঝিন বাইচা গ্যাছি। কিন্তুক এইখানে আর-এক বিপদ। কী যে করুম!
সদ্য স্বামী হারিয়েছেন রামরতনের স্ত্রী। শোকাতুরা বৃদ্ধা সেই দুঃখ আর বিহ্বলতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার আগেই মাথার ওপর আকাশ শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। যে নিরাপত্তা আর আশ্রয়ের আশায় পরিজনদের কাছে ছুটে এসেছিলেন সেটা পুরোপুরি ধূলিসাৎ। নিজের এবং তিন মেয়ের জন্য তার এখন অনন্ত দুর্ভাবনা। বিনয়ের হঠাৎ মনে হল, তার সঙ্গে এই বৃদ্ধাদের কোথাও একটা মিল আছে। সেও ঝিনুককে নিয়ে সুনীতির শ্বশুরবাড়ি এবং নিজের বাবার কাছে গিয়েছিল। সুধারা ছাড়া কেউ তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেনি। ঝিনুকের কারণে বিনয়কেও কম অসম্মান আর লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়নি। রামরতনের স্ত্রী এবং তাঁর তিন মেয়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে বিনয়ের। বৃদ্ধা যেন খোঁচা দিয়ে দিয়ে তার বুকের ভেতর থেকে ঝিনুককে বার করে এনেছেন। চিরদুঃখী মেয়েটার সঙ্গে তারা যেন একাকার হয়ে গেছেন।
বিনয় ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, বিমলবাবু নিজে কী বলেন?
বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ও আর কী কইব! পোলাপান কালের হেই বিমল কি আর আছে! কী ভাল আছিল। কত সরল, কত সাদাসিধা! তুমার মাউসামশয় আর আমারে ছাড়া পিরথিমীর আর কেওরে জানত না। আমরাই আছিলাম অর সব। হেই মানুষ কত বদলাইয়া গ্যাছে। অর বউ আমাগো দুঃখু দ্যায়। ও দেইখাও দ্যাখে না। মুখ বুইজা থাকে। বউর মুখের উপুর কথা কওনের বুকের পাটা কি অর আছে! রামরতনের স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে তীব্র অভিমান। পুঞ্জীভূত যাবতীয় ক্ষোভ তিনি উগরে দিতে থাকেন।
আচমকা অন্য একটা চিন্তা বিনয়কে কিছুটা আনমনা করে তোলে। চোদ্দ ঘর ভাড়াটের সঙ্গে বিমল যে প্রাচীন, বিবর্ণ বাড়িটায় থাকে সেটা দেখলে মনে হয় না, সে বড় মাপের কোনও চাকরি বাকরি করে। তেমন রোজগার হলে এমন জায়গায়, এত লোকজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে পড়ে থাকত না। নিশ্চয়ই অনেক ভাল বাড়িতে থাকত। সেখানে চাকচিক্য থাকত ঢের বেশি। পরিবেশ হতো অন্যরকম। মনে হয়, বিমল যা মাইনে পায় তাতে তার সংসার মোটামুটি চলে যায়। তার ওপর চার চারটে মানুষের ভার বহন করতে তার নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে। যে জেঠাইমা সযত্নে, অসীম মমতায় তাকে মানুষ করে তুলেছেন, হঠাৎ তারা দেশের সর্বস্ব খুইয়ে চলে আসার পর প্রাথমিক আবেগটুকু দ্রুত ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বিরাট আকারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। স্থূল এবং জৈবিক। এতগুলো মানুষের চলবে কী করে? রোজকার চাল ডাল জুটবে কোত্থেকে? দুচারদিনের ব্যাপার নয়। বৃদ্ধারা যদ্দিন বাঁচবেন ততদিনই তাদের টানতে হবে। তাছাড়া, দুই অবিবাহিত মেয়ে আছে রামরতনের। তাদের বিয়ের প্রশ্ন আছে। এসব দায়িত্ব এখন বিমলের কাঁধে। ক্রমশ অবস্থা এমন দুঃসহ হয়ে উঠবে যে বিমলদের কাছে এই অতি প্রিয়জনেরাও অত্যন্ত অবাঞ্ছিত হয়ে যাবেন। এ এক অদ্ভুত সংকট। বিনয় ভাবল, এখানে না এলেই বোধ হয় ভাল হতো।
বৃদ্ধা এবার বললেন, শুনতে আছি, পাকিস্থান থিকা যারা আইছে গরমেন্ট তাগো লেইগা কেম্পে (ক্যাম্পে থাকনের ব্যাবোস্তা করছে। রিফুজিগো খাওনের থাকনের সগল দায় সরকারের। আমাগো বডার (বর্ডার) স্লিপ আছে। তুমি কি বাবা খোঁজখবর লইয়া কুনো কেম্পে আমাগো থাকনের বন্দোবস্ত কইরা দিতে পারবা?
বিনয় চমকে উঠল। কতখানি মানসিক নির্যাতন ভোগ করলে রামরতনের স্ত্রীর মতো একজন বৃদ্ধা, কলকাতা সম্বন্ধে যাঁর স্পষ্ট ধারণাই নেই, হয়তো জামতলি গাঁয়ের বাইরে দূরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি–এমন একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু শরণার্থী শিবির নামে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য রাতারাতি যে-সব ক্যাম্প খাড়া করা হয়েছে, সেগুলো কেমন, কে জানে। কলকাতায় আসার পর কোনও ক্যাম্পেই বিনয়ের যাওয়া হয়নি। যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তবে যুগল ছাড়াও অনেকের মুখেই শুনেছে, ক্যাম্পগুলোর বেশির ভাগই নরককুণ্ড। সেগুলোর পরিবেশ, আবহাওয়া জঘন্য। দমবন্ধ করা। কদর্য। নিতান্ত নিরুপায় না হলে কেউ সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। যারাই পারছে, দলে দলে বেরিয়ে গিয়ে বনবাদাড়, জলা জায়গা আর ফাঁকা পোড়ো জমিতে জবরদখল কলোনি বসাচ্ছে। মুকুন্দপুরে ছিন্নমূল মানুষের তেমন এক উপনিবেশ নিজের চোখেই দুআড়াই সপ্তাহ আগে দেখে এসেছে বিনয়। এমনকি পুরো একটা দিনও বিলের ধারে যুগলদের কাঁচা বাঁশের বেড়ার ঘরে কাটিয়েছিল।
বিনয় জানায়, রিফিউজি ক্যাম্প সম্বন্ধে সে বিশেষ কিছুই জানে না। যে-সব খবর কানে এসেছে তার আধাআধিও যদি ঠিক হয়, তাহলে সম্ভ্রান্ত ভদ্র পরিবারের মানুষজনের শাগ্য বাসস্থান সেগুলো নয়। বিশদভাবে তা বুঝিয়ে দিয়ে সে বলল, ক্যাম্পে না যাওয়াই ভাল ।সমা। আপনার কম বয়সের মেয়েরা আছে– পরিষ্কার একটা ইঙ্গিত দিয়ে থেমে গেল সে। আসলে বিনয়ের মাথায় চকিতের জন্য শিয়ালদা স্টেশনের সেই দৃশ্যটি ঝিলিক দিয়ে গেল। একটা আড়কাঠি পতিতপাবনের সদ্য যুবতী মেয়েকে ফুসলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, আর পতিতপাবন প্রচণ্ড আক্রোশে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা টিপে স্টেশনের পাথুরে চত্বরে তাকে আছড়ে ফেলেছিল। অনেকে মিলে টানাটানি করে ছাড়িয়ে না দিলে লোক্টা খুনই হয়ে যেত। এইরকম মেয়ে-শিকারি কি আর ক্যাম্পগুলোর চারপাশে হানা দিচ্ছে না? নিশ্চয়ই দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অসহায় হিন্দু মেয়েদের নিয়ে। লুটের বাজার এখন রমরমিয়ে চলছে। সুযোগ পেলেই তারা ছোঁ মেরে রামরতনের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবে। যে ঘাতক আর লুটেরা বাহিনীর ভয়ে রামরতনরা পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলেন, সীমান্তের এপারেও তেমন হাঙররা থিক থিক করছে। অশক্ত, দুর্বল বৃদ্ধার সাধ্য কী, তাদের হাত থেকে যুবতী দুই মেয়েকে রক্ষা করেন।
বিনয়ের ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন রামরতনের স্ত্রী। একেবারে মুষড়ে পড়েন তিনি। বিনয় লক্ষ করে, ছায়া, মায়া এবং বাসন্তীও ভেতরে ভেতরে ধসে পড়েছে।
সারি সারি হতাশ, করুণ, কাতর মুখচ্ছবি। মা আর তিন মেয়ে হয়তো ভেবেছিল, হয়তো নিজেদের মধ্যে গোপনে পরামর্শও করেছিল, ক্যাম্পে গেলে সরকারি দাক্ষিণ্যে থাকতে পারবে। বিমলদের বাড়ির অসহনীয় পরিবেশ থেকে সেটাই খুব সম্ভব ছিল তাদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। অন্তত সেই রকমই মনে হয়েছিল চার মা-মেয়ের।
শুকনো গলায় রামরতনের স্ত্রী বললেন, তুমি তাইলে কেম্পে যাইতে না কর?
ঘুরিয়ে উত্তরটা দিল বিনয়, না যাওয়াই ভাল—
কিন্তুক
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
একটু চিন্তা করে বৃদ্ধা এবার বললেন, আমাগো জামতলিতে মাইয়াগো ইস্কুল নাই। কিন্তুক তুমার মাউসামশয় ছায়া আর মায়ারে বাড়িতে অনেক দূর পড়াইছে। পেরাইভেটে (প্রাইভেটে) ছায়া-মায়া দুইজনেরই মেট্রিক দেওনের কথা আছিল। বিয়াও ঠিক হইয়া গেছিল ছায়ার। মেট্রিক পরীক্ষার পরই বিয়াটা হইত। পাত্র ঢাকা শহরে থাকত। ভাল পোলা। এম. এ পাস। বড় চাকরি করত। মাইষে ভাবে এক, হয় আর-এক। হেই বচ্ছরই বাধল দাঙ্গা। মুসলমানেরা কয় পাকিস্থান চাই। চাইর দিকে আগুন আর রক্তগঙ্গা। হেই দাঙ্গায় পাত্র তার মা বাপ ভাই বইন সুদ্ধা ঢাকায় খুন হইয়া গেল। ছায়া-মায়ার পরীক্ষাও দেওয়া হইল না। সগলই অদ্দিষ্ট বাবা। বুকের অতল স্তর ভেদ করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রামরতনের স্ত্রীর। দুচোখ জলে ভরে যেতে থাকে।
ক্যাম্পে যাবার প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে বৃদ্ধা কেন যে ছায়া-মায়ার ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর ছায়ার বিয়ের কথায় চলে এলেন, বোঝা যাচ্ছে না। নিজের অজান্তেই বিনয়ের চোখ ছায়ার দিকে ঘুরে। যায়। নতমুখে সে দাঁড়িয়ে আছে। পরীক্ষা যে দেওয়া হয়নি, স্থির হয়ে-যাওয়া বিয়ের পাত্র যে খুন হয়ে গেছে–এ-সব যেন তারই অপরাধ। মেয়েটার জন্য বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে বিনয়ের।
বেশ কিছুক্ষণ পর ধরা গলায় রামরতনের স্ত্রী বললেন, হুনছি গরমেন্ট রিফুজিগো ম্যালা (অনেক) সুযুগ সুবিদা চাকরি বাকরি দিতে আছে। ছায়া-মায়ার হাতে মেট্রিকের ছাপ নাই, কিন্তুক হেই তরি (সেই পর্যন্ত) তো পড়ছে। অরা যদিন কাজকম্ম পাইত, রোজগারপাতি করতে পারত, আমরা ভিন্ন বাসা ভাড়া কইরা উইঠা যাইতাম। ছায়া-মায়া সম্বন্ধে এত কথা কেন বৃদ্ধা বলছেন, এতক্ষণে তার কাটা ধরা গেল।
রামরতনের স্ত্রী বলতে লাগলেন, কইলকাতায় তো শুনি মাইয়ারা আফিসে গিয়া কাম করে। তুমার বাবার, দুই ভগ্নীপতির তো কত বড় বড় মাইষের লগে জানাশুনা। তেনাগো কইয়া ছায়া মায়ার এট্টা গতি কইরা দিতে পার?
এতদিন তার জন্য কেন যে ব্যাকুলভাবে রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েরা অপেক্ষা করছিল, তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। পথের আলাপ। তারপাশা থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদা স্টেশন। মাত্র দুটো দিন তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে। এটা ঠিক, বিনয় ওদের জন্য অনেক করেছে। তারপাশায় নাসের আলি তার ওপর রামরতনদের কলকাতায় পৌঁছে দেবার যে বিরাট দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা সাধ্যমতো পালন করে গেছে বিনয়। সঙ্গে সদাত্রস্ত ঝিনুক, সে আবার পুরোপুরি স্বাভাবিকও নয়। তাকে সামলে স্টিমার এবং ট্রেনের দমবন্ধ-করা ছিন্নমূল মানুষের ভিড়ে যতটা সম্ভব রামরতনদের দুর্ভোগ আর কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছে। রামরতন যখন পাকিস্তানের ট্রেনে মারা গেলেন তখন চারটি শোকার্ত, বিপন্ন নারীকে সে দুহাতে ঘিরে রেখেছিল। তার আন্তরিকতায়, তার সমবেদনায় নিশ্চয়ই প্রাক্তন হেডমাস্টার মশায়ের স্ত্রী এবং মেয়েরা অভিভূত। হয়তো তারা ভেবেছে, পথের দেখা, অনাত্মীয় এই যুবকটির ওপর নির্ভর করা যায়। বিমলদের বাড়িতে এসে যখন অনাদরে, অসম্মানে তারা জর্জরিত, তখন এই অচেনা শহরে বিনয়ের কথাই বার বার তাদের মনে পড়েছে। বুঝি বা সে-ই তাদের শেষ অবলম্বন। তাকে আঁকড়ে ধরে তারা নতুন করে বাঁচতে চায়। সসম্মানে। নিজেদের মর্যাদা বজায় রেখে।
বিনয় জানে, কলকাতার গার্লস স্কুল আর কলেজগুলোতে মেয়েরা পড়ায়। কিন্তু বাঙালি মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি বসে অফিসে কাজ করে কি না, সে সম্বন্ধে তার ধারণা নেই। অবশ্য আনন্দদের অফিসে একটি তরুণী রিসেপশনিস্ট চোখে পড়েছে তার। উগ্র সাজপোশাক। চোখধাঁধানো যৌবন। তবে সে বাঙালি নয়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। আদৌ বাঙালি মেয়েরা যদি অফিসে কাজ করেও, ম্যাট্রিক পরীক্ষা যারা দিতে পারেনি অর্থাৎ ছায়া-মায়াদের পক্ষে কি চাকরি পাওয়া সম্ভব? শিক্ষাগত এই যোগ্যতায় খুব সম্ভব কাজ জুটবে না। হঠাৎ বিনয়ের মনে পড়ল, রিফিউজিদের ব্যাপারে গভর্নমেন্ট অনেক সহানুভূতিশীল। ম্যাট্রিক, আই এ, বি এ পাস করতেই হবে, এমন কোনও কড়াকড়ি নেই। ক্লাস নাইন টেনের বিদ্যাতেও ছোটখাটো কাজ জুটে যায়। নইলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়া মুকুন্দপুরের নিশিকান্ত আচার্য সরকারি রেশনের দোকানে চাকরি পেত না।
বিনয় বলল, নিশ্চয়ই আমি জামাইবাবুদের বলব। আমি নিজেও আপনার মেয়েদের চাকরির জন্যে খোঁজখবর নেব।
বিনয়ের একটা হাত আঁকড়ে ধরে আকুল সুরে রামরতনের স্ত্রী বললেন, এই কামটা তুমারে কইরা দিতেই হইব। যত তরাতরি পার–
আমি চেষ্টা করব মাসিমা
তাকে না বলে ছায়া-মায়ার চাকরির কথা বিমলকে কেন বললেন না বৃদ্ধা? প্রশ্নটা করতে গিয়ে থমকে গেল বিনয়। একে তিন মেয়েকে নিয়ে গলগ্রহ হয়ে আছেন, তার ওপর চাকরি জুটিয়ে দেবার জন্যে ছোটাছুটি করতে বললে নিশ্চয়ই বিমল খুশি হতো না। তাই সেটা উত্থাপন করতে সাহস হয়নি বৃদ্ধার।
বাইরে থেকে কার গলা ভেসে এল, ছায়া-মায়া, এদিকে আয় তো~
সচকিত রামরতনের স্ত্রী গলা নামিয়ে বললেন, বিমল আইছে। তুমার লগে এতক্ষণ যে কথা হইল, অরে কিন্তু এই সগল কিচ্ছু কইবা না। বোঝোই তো বাবা
বুঝতে ঠিকই পেরেছে বিনয়। বাড়িতে এনে তোলার পর সারাক্ষণ মানসিক পীড়ন চালাচ্ছে বিমলরা, কিন্তু রামরতনের স্ত্রী যে বাইরের কারও সাহায্য চাইবে, সেটাও হয়তো ওদের সম্মানে বাধবে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
বিনয় বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মাসিমা। আমি বিমলবাবুকে কিছুই বলব না।
বসার এই ঘর থেকে কোনাকুনি খোলা সদর রজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় একটা রিকশা চোখে পড়ে। সেটায় বসে আছে বিমল। তার পাশে এবং পাদানিতে অনেকগুলো বড় বড় চটের থলে। জিনিসপত্রে বোঝাই।
ছায়া-মায়া দৌড়ে গিয়েছিল। একটু পর তিনজনে থলেগুলো রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে ফিরে এল।
সামনের চাতালে জলের কল আর পায়খানাগুলোতে এখনও যথেষ্ট ভিড়। তবে খানিক আগে বাড়িটার তিনটে তলা জুড়ে গল গল করে যে কয়লার ধোঁয়া বেরুচ্ছিল, এখন আর তা নেই। পনেরো ঘর ভাড়াটের উনুনগুলো নিশ্চয়ই ধরে গেছে।
আগে লক্ষ করেনি। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় উঠতেই বিমলের চোখে পড়ল বাইরের ঘরে বসে আছে বিনয়। দেখামাত্র চিনতে পারল। ব্যস্তভাবে বলল, বসুন। আসছি
পাশের ঘরে হাতের থলে রেখে তৎক্ষণাৎ চলে এল বিমল। ঝপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। রেশন তুলে, বাজার করে, মালপত্র নিয়ে আসার ধকল তো কম নয়।
বিমল জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ এসেছেন?
বিনয় বলল, মিনিট চল্লিশেক হবে। শুনলাম আজ আর অফিসে যাবেন না। তাই অপেক্ষা করছিলাম। কথাটা ঠিক বলা হল না। বিমলের জন্য মোটেও সে বসে নেই। রামরতনের স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। দরকার হলে অন্যের অহংকে তুষ্ট করতে। কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। বিনয় যেন রামরতনের স্ত্রী বা মেয়েদের জন্য নয়, বিমলের সঙ্গে দেখা করতেই এ-বাড়িতে এসেছে।
বিমল বলল, রেশনের দোকানে লম্বা লাইন ছিল। তাই ফিরতে দেরি হয়ে গেল। জেঠিমা, বাসন্তীদিদি, বিনয়বাবুকে চা দিয়েছ?
বিনয়ই উত্তরটা দিল, হ্যাঁ, আতিথ্যে কোনও ত্রুটি হয়নি।
বিমল বলল, খুব টায়ার্ড লাগছে। চা না হলে এনার্জি পাচ্ছি না। আশা করি, আর-এক কাপ খেতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি হবে না বিনয়বাবু–
বিনয় হাসল। তার আপত্তি নেই।
বিমল ছায়া-মায়াকে বলল, চট করে একটু চা করে নিয়ে আয়।
বিনয় যেটুকু দেখেছে, তাতে মনে হয়েছে, এই দুই বোন যেন জোড়ের পাখি। সারাক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। বিমলের মুখ থেকে কথা খসার সঙ্গে সঙ্গে তারা ডান পাশে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল।
বিমল এবার বিনয়ের দিকে তাকায়, শিয়ালদা স্টেশনে সেই প্রথম আর শেষ দেখা। প্রায়ই ভাবি, আপনি আসবেন। ঠিকানাও জানি না যে নিজেই গিয়ে দেখা করব। এদিকে জেঠিমারা সর্বক্ষণ আপনার কথা বলে
শিয়ালদার প্রসঙ্গ ওঠায় ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে বিনয়। চারটি শোকগ্রস্ত নারী এবং রামরতনের মৃতদেহ বিমলের হাতে তুলে দিয়ে সে ঝিনুককে নিয়ে বাবা আর দিদিদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল। শরীর তখন এতটাই ভেঙে পড়েছে যে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। তারপর সেদিন রাতে কী হয়েছে, কীভাবে বিমল সবদিক সামাল দিয়েছে, কিছুই জানা নেই।
বিনয় বলল, ওই দিনটায় আপনার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল? পাশে থেকে যে একটু সাহায্য করব, তার উপায় ছিল না।
বিমল জানায়, রামরতনের মৃত্যুশোক ছাড়া অন্য কষ্ট তেমন হয়নি। বিনয় রিফিউজি অ্যান্ড রিলিফ ডিপার্টমেন্টের যে অফিসারটির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার মতো মহানুভব মানুষ এই স্বার্থপর পৃথিবীতে একান্তই বিরল। তিনিই খাট ফুল মালা নতুন কাপড়চোপড়, এমনকি নিমতলায় নিয়ে যাবার জন্য চারজন শববাহকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দাহের খরচও দিয়েছেন। সবই অবশ্য উদ্বাস্তু ত্রাণ বিভাগের টাকা। টাকা যেখান থেকেই আসুক, নিজে দায়িত্ব নিয়ে এতটাই বা কে করে?
বিমল কৃতজ্ঞ সুরে বলতে লাগল, আপনি ওই অফিসারের সঙ্গে আলাপ না করিয়ে দিলে মহা বিপদে পড়তাম–
একটু চুপচাপ।
তারপর বিমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনয়কে হাজারটা প্রশ্ন করে। এই সহৃদয়, পরোপকারী যুবকটি সম্পর্কে তার অপার কৌতূহল। কলকাতায় সে কোথায় থাকে, কী করছে, ঝিনুকের খবর কী, ইত্যাদি ইত্যাদি। রামরতনের স্ত্রীকে যা যা বলেছিল, বিমলকেও তাই বলল বিনয়। ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়া আর অবনীমোহনের গুরুর আশ্রমে চলে যাওয়া-যথারীতি এই দুটো বাদ দিয়ে।
চা এসে গিয়েছিল। খাওয়া শেষ হলে বিনয় উঠে পড়ল, অনেকক্ষণ এসেছি। এবার চলি—
বিমল বলল, কষ্ট করে যখন এসেছেন, দুপুরে দুটি ডাল ভাত খেয়ে গেলে খুশি হব।
বাড়িতে না জানিয়ে চলে এসেছি। আরও দেরি হলে ছোটদিরা খুব ভাববে।
বিমল আর রামরতনের স্ত্রীও উঠে দাঁড়িয়েছেন। বাসন্তীরা তো দাঁড়িয়েই আছে।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, তরাতরি আইসো কিন্তুক এই কথাটা তিনি আগে আরও একবার বলেছেন।
দ্রুত মা এবং তিন মেয়েকে দেখে নিল বিনয়। সবার চোখেমুখে অনন্ত আগ্রহ। এর হেতুও তার জানা। বলল, নিশ্চয়ই আসব
বিমল বলল, চলুন, আপনাকে ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
না না, আপনি ক্লান্ত হয়ে আছেন। আর কষ্ট করতে হবে না।
কষ্ট আবার কী–
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নীরবে কয়েক পা হাঁটার পর বিমল কিছুটা ইতস্তত করে বলল, আপনি এসেছেন, খুব ভাল হয়েছে। আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
একটু সতর্ক হল বিনয়, কী অনুরোধ বলুন তো?
কাচুমাচু মুখে বিমল বলল, আমি স্টেট গভর্নমেন্টের এমপ্লয়ি। আপার ডিভিশন ক্লার্ক। কটা টাকা আর মাইনে পাই? বাড়ি ভাড়া, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, অসুখবিসুখ, খাওয়ার খরচ–একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। তার ওপর জেঠিমারা পাকিস্তান থেকে চলে এলেন। বুকে করে যাঁরা মানুষ করেছেন তাদের তো ফেলে দিতে পারি না। এদিকে আসছে মাস থেকে রেশনের চাল চিনি গমের দাম বাড়ছে। সাড়ে ছআনা সেরের মোটা চাল সাড়ে সাত আনা হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে আটা চিনি আর অন্য সব জিনিসের দাম। কীভাবে যে চলবে ভেবে পাচ্ছি না বিনয়বাবু–
এত লম্বা ভণিতা করে কী জানাতে চায় বিমল? তার কাছে লোকটার কি কোনও প্রত্যাশা আছে? একটা ব্যাপার অবশ্য বিনয়ের ভাল লাগল। বিমল অমানুষ নয়। জেঠা-জেঠি তার জন্য কী করেছেন তা ভুলে যায়নি। পুরানো দিনের স্মৃতি সে হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় না। কিন্তু রাজ্য সরকারের কেরানি। পয়সার জোর নেই। তাছাড়া একদিকে কর্তব্যবোধ, কৃতজ্ঞতা, অন্য দিকে স্ত্রী। মহিলার আদৌ ইচ্ছা নয়, ঘাড়ে চারটে বাড়তি মানুষ আজীবন চেপে থাকুক। স্ত্রী এবং জেঠিমাদের মাঝখানে পিষে যাচ্ছে বিমল। লোকটার জন্য করুণাই হয় বিনয়ের।
বিমল এবার বলল, শুনেছি আপনার বাবা আর ভগ্নীপতিরা খুবই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। সন্ধের দিকে যদি দুতিন ঘণ্টার জন্য একটা পার্ট-টাইম কাজের ব্যবস্থা করে দেন–
রামরতনের স্ত্রী চান ছায়া-মায়ার জন্য চাকরি জুটিয়ে দিতে।বিমল চায় পার্ট-টাইম কাজ। বিনয়ের হাসি পেল। সে নিজেই রয়েছে ভাসমান অবস্থায়। দুদিন পর কোথায় থাকবে, ঠিক নেই। এই সুবিশাল শহরে পরিচিতজনের সংখ্যা আর কজন? শুধু হিরণ আর আনন্দকেই সে বলতে পারে। কিন্তু ওরা ছায়া-মায়া আর বিমলের জন্য কতদূর কী করতে পারবে, কে জানে।
গলির একটা বাঁকের মুখে এসে পড়েছিল তারা। বিমলকে নিরাশ করতে ইচ্ছা হল না বিনয়ের। বলল, নিশ্চয়ই আপনার কথা সবাইকে বলব। অনেকদূর এসেছেন। এবার বাড়ি যান।
সঙ্গ দেবার জন্য জোর করল না বিমল। দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হাতজোড় করে বলল, নমস্কার। আমার কথাটা কিন্তু মনে রাখবেন।
রাখব। নমস্কার
গলির আর-একটা পাক ঘুরে ট্রাম রাস্তায় এসে বিনয়ের চক্ষুস্থির। ডাইনে বাঁয়ে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটটার যতদূর অবধি দেখা যায়, সারি সারি ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর দুপাশে বাস লরি রিকশা ঘোড়ার গাড়ি-যাবতীয় যানবাহন। কোনওটারই নড়াচড়া নেই। সব যেন একটা বিশাল ফাঁদের ভেতর আটকে গেছে। বাসের কন্ডাক্টর, ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, রিকশাওলা, রাস্তার লোজন গলার স্বর সবচেয়ে উঁচু পর্দায় তুলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কে কী বলছে, বোঝার উপায় নেই। সব মিলিয়ে যে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে তা যেন আকাশ ফেড়ে ফেলবে। সমস্ত এলাকা জুড়ে তুমুল বিশৃঙ্খলা।
হতবুদ্ধি বিনয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রাম বাস না চললে টালিগঞ্জে ফিরবে কী করে? গাড়িঘোড়া যেভাবে জট পাকিয়ে আছে, ফের কখন চালু হবে, কে বলবে। একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, গ্রে স্ট্রিটের কাছে ট্রাম তার ছিঁড়ে লাইন থেকে ছিটকে গিয়ে, আড়াআড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার ফলে এই জট-পাকানো হাল।
এখন অফিস টাইম। বিনয় লক্ষ করল, ফুটপাথ ধরে মানুষের স্রোত। কারও দাঁড়াবার সময় নেই। সবাই সামনের দিকে হাঁটছে। সেও স্রোতে গা ছেড়ে দিল। হঠাৎ মনে পড়ল, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যেতে পারলে এসপ্ল্যানেডের বাস পাওয়া যাবে। তারপর টালিগঞ্জ যাওয়া এমন কি কঠিন?
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার জ্যামের দুর্ভাবনাটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায় বিনয়ের। চেখের সামনে বিমলদের বাড়ির ছবিটা ফুটে ওঠে। যদি ছায়া কি মায়ার চাকরি না জোটে, বিমলের স্ত্রী যদি ওদের তাড়িয়ে দেয়, এই বিশাল মহানগরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তারা? কে তাদের আশ্রয় দেবে? চিন্তাটা তাকে আকুল করে তোলে।
কখন হাতিবাগান, স্টার থিয়েটার, রূপবাণী সিনেমা পেরিয়ে বিডন স্ট্রিটের মুখে এসে পড়েছিল, খেয়াল নেই বিনয়ের। এখান থেকে ডান পাশে ঘুরে মিনিট চার পাঁচেক হাঁটলেই সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল সে। বিডন স্ট্রিটে সুনীতির শ্বশুরবাড়ি। কেউ দেখে ফেললে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইবে। হেমনলিনী যতদিন বেঁচে আছেন, ও-বাড়ির ছায়া মাড়াবে না বিনয়। বিডন স্ট্রিট থেকে আরও খানিকটা এগিয়ে বেথুন কলেজের দক্ষিণ দিকের বাউন্ডারি ওয়ালের গা, ঘেঁষে যে সরু রাস্তাটা সোজা পশ্চিমে চলে গেছে সেটা ধরলেও সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যাওয়া যায়।
ফুটপাথ দিয়ে কয়েক পা যেতে না যেতেই খুব পরিচিত গলার ডাক ভেসে এল, বিনুদা বিনুদা।
সারা শরীরে তড়িৎপ্রবাহ খেলে গেল বিনয়ের। এধারে ওধারে তাকিয়ে দেখতে পেল, উলটো দিকে হেদুয়ার সুইমিং পুলের পাশের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা।
১১-১৫. চোখাচোখি হতে হাতছানি
১১.
চোখাচোখি হতে হাতছানি দিল ঝুমা, এখানে এস– সেই কবে, যুদ্ধের আমলে রাজদিয়ায় থাকার সময় বিনয়ের নাকে একটা অদৃশ্য বঁড়শি আটকে দিয়েছিল মেয়েটা। তারপর কত কী-ই তো ঘটে গেল! দুর্ভিক্ষ। দাঙ্গা। দেশভাগ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সঙ্গে ধর্ষিত ঝিনুককে নিয়ে পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে চলে আসা। কবছরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উথালপাতাল। কিন্তু সেই বঁড়শিটা যেমন ছিল তেমনই নাকে গেঁথে আছে।
ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে পায়ে পায়ে ঝুমার কাছে চলে গেল বিনয়। ঝিনুক নিখোঁজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সারাক্ষণ জড়িয়ে আছে শ্বাসবায়ুতে। রয়েছে সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। কিন্তু কুমার সঙ্গে দেখা হলেই নিশ্বাস তপ্ত হয়ে ওঠে। পা থেকে মাথা অবধি কেমন যেন আনচান আনচান করতে থাকে। একদিন দুপুরে ওদের রাজদিয়ার ছাদের ঘরে তাকে দুহাতে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছিল মেয়েটা। তার নতুন, নরম স্তন লেপটে গিয়েছিল বুকের ভেতর। তার ভোলা চুল আর সারা শরীর থেকে আশ্চর্য এক সুগন্ধ উঠে এসে নাকের ভেতর দিয়ে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গিয়ে সব কিছু অবশ করে দিয়েছিল। সেদিন আচ্ছন্নের মতো বাড়ি ফিরে গিয়েছিল বিনয়। সেই একটি তপ্ত চুম্বন, কিশোরীর সুগোল স্তনের প্রথম স্পর্শ, তার দেহের অলৌকিক সুঘ্রাণ–সব একাকার হয়ে যৌবনের অপার, অজানা রহস্যের দরজা খুলে গিয়েছিল বিনয়ের সামনে।
এতকাল বাদেও সেই আচ্ছন্নতা কাটেনি। কলকাতায় আসার পর বার দুই ঝুমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। একবার সুনীতির শ্বশুরবাড়িতে। আর-একবার টালিগঞ্জে সুধাদের বাড়িতে। ওকে দেখলেই নেশার মতো ঝিন ঝিন করে মাথার ভেতর কী যেন বাজতে থাকে। আজও তার হেরফের নেই। নেশার ঘোরটা নতুন করে বিনয়কে আবার পেয়ে বসে।
এই কবছরে কত সুন্দর হয়ে উঠেছে ঝুমা। এখন সে পূর্ণ যুবতী। পুষ্ট স্তন, রাজহাঁসের মতো মসৃণ গলা, লম্বাটে ভরাট মুখ, সরু কোমর, ঘন পালকে-ঘেরা চোখের গভীর দৃষ্টি, সুঠাম চিবুক, কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা মিহি সিল্কের মতো চুল। পেছন দিকটা ভারী। কলকাতার বড় ঘরের মেয়েদের চেহারায় আলাদা একটা পালিশ থাকে। ঝুমারও আছে।
এই মুহূর্তে কুমার পরনে মেরুন রঙের দামি রেশমি শাড়ি, একই রঙের ব্লাউজ, পায়ে ধবধবে সাদা ফিতেওলা স্লিপার। কাঁধ থেকে একটা সুদৃশ্য চামড়ার ব্যাগ নেমে এসেছে। গলায় সোনার সরু চেন, বুকের কাছে মীনে-করা মাছের আকারে লকেট ঝুলছে। বাঁ হাতে সোনালি ব্যাণ্ডে বাঁধা ফেবার লিউবা কোম্পানির ওভাল শেপের ঘড়ি। কানে রক্তবিন্দুর মতো চুনি-বসানো কানফুল, নাকের পাটায় হীরের নাকছাবি। যখনই ঝুমার সঙ্গে দেখা হয়, মনে হয়, এক অপার্থিব পরী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
পৌষ মাস প্রায় এসে গেল। এগারোটা বাজতে চলেছে। শহরের তাপাঙ্ক সামান্য বেড়েছে, কিন্তু উত্তুরে হাওয়া কদিন আগের তুলনায় অনেক বেশি শীতল, অদৃশ্য হিম ছড়িয়ে ছড়িয়ে উলটোপালটা বয়ে চলেছে।
বাতাসে ঝুমার চুল উড়ছিল। রাজদিয়ায় যেমনটা হতো, অবিকল তেমনি ঝুমার গা থেকে, তার শাড়ি টাড়ি থেকে মিষ্টি গন্ধ উঠে এসে নাকে ঢুকছে। তবে এই গন্ধটা রাজদিয়ার তুলনায় অনেক বেশি উগ্র।
ঝুমা বলল, তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ!
ঝুমা ম্যাট্রিক আর আই এতে ভাল রেজাল্ট করেছিল। নামকরা কলেজে অনার্স নিয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে তার কথাবার্তায় দুচারটে ইংরেজি শব্দ ঢুকে যায়। বিনয় বলল, তোমাকে দেখব, আমিও ভাবিনি।
বা রে, এটা আমাদের পাড়া। হেদুয়ার বাঁধানো সুইমিং পুলের ওধারে আঙুল বাড়িয়ে ঝুমা বলল, ওই যে আমাদের কলেজ
হেদুয়ার সামনের দিকে বেথুন কলেজ। উলটো দিকে স্কটিশ চার্চ। ঝুমা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল সে স্কটিশে পড়ে।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কলেজে যাচ্ছিলে?
না। ঝুমা জানায়, কলেজে গিয়েছিল, কিন্তু একজন প্রাক্তন অধ্যাপকের মৃত্যু-সংবাদ আসায় ছোটখাটো একটা শোকসভার আয়োজন করা হয়। তারপর পরলোকগত শিক্ষকের সম্মানে প্রিন্সিপ্যাল ছুটি দিয়ে দেন। এখন সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
বিনয় বলল, ও–।
তুমি তো সেই টালিগঞ্জে সুধা মাসিদের কাছে থাক। এদিকে কোথায় এসেছিলে? আনন্দমামাদের বাড়ি?
অবনীমোহন বাড়িটাড়ি বেচে হরিদ্বার চলে যাবার পর সে যে সুধাদের কাছে গিয়ে উঠেছে, এই খবরটা নিশ্চয়ই সুনীতিদের কাছে জেনেছে ঝুমা। আনন্দদের বাড়ির কথা বলতেই চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠে বিনয়ের। রূঢ় গলায় বলে, না।
বিনয়ের মনোভাব আঁচ করে নেয় ঝুমা। তার মুখ ম্লান হয়ে যায়, হা, দিদা ঝিনুকের সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে, তাতে তুমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছ। বুঝতে পারি ও-বাড়িতে তুমি আর কখনও যাবে না।
বিনয় উত্তর দিল না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর ঝুমা জিজ্ঞেস করে, মামাদের বাড়ি যাওনি। তাহলে?
বিনয় বলল, রামরতন গাঙ্গুলির স্ত্রী আর মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।
এরা কারা?
বিনয়ের মনে পড়ল, রামরতনদের সম্বন্ধে কখনও ঝুমার সঙ্গে তার কথা হয়নি। জামতলির প্রাক্তন হেড মাস্টারটির সঙ্গে কীভাবে আলাপ, গোয়ালন্দ থেকে কলকাতায় আসার পথে রিফিউজি বোঝাই স্পেশাল ট্রেনে কীভাবে তার শোচনীয় মৃত্যু, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা নিজেদের ঘনিষ্ঠ পরিজন বিমল গাঙ্গুলির ভাড়াটে বাসায় কী দুঃসহ, গ্লানিকর জীবনযাপন করছে, ধীরে ধীরে সব শোনালো সে।
বিষণ্ণ সুরে ঝুমা বলল, পাকিস্তান অনেক লোকের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। শুনতে পাই ওপার থেকে যারা আসছে তারা কেউ সুখে নেই। মহা বিপদে তাদের দিন কাটছে।
বিনয় কিছু বলে না।
ঝুমা বলল, তুমি হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছিলে?
টালিগঞ্জ ফিরতে হবে না?
ঝুমা বেশ অবাক হল, চিত্রা সিনেমার কাছ থেকেই তো এসপ্ল্যানেডের গাড়ি ধরতে পারতে। এসপ্ল্যানেড থেকে টালিগঞ্জের রুটের প্রচুর ট্রাম বাস পাওয়া যায়
এতটা রাস্তা হেঁটে আসার কারণ জানিয়ে দিল বিনয়।
হঠাৎ ঝুমার চোখমুখ খুশির ছটায় ভরে যায়। রামরতনের স্ত্রী ও মেয়েদের জন্য খানিক আগের সেই বিষাদের লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। ভাবনাহীন, চঞ্চল বালিকার মতো সে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, ভাগ্যিস তার ছিঁড়ে ট্রাম ডিরেলড হয়েছিল, তাই তোমার সঙ্গে দেখা হল।
সেই কবে থেকে মেয়েটাকে দেখে আসছে বিনয়। সারাক্ষণ যেন লঘু মেজাজে হাওয়ায় ভাসছে। এই পৃথিবীর শোক, দুঃখ আর যাতনা, তাকে ছুঁয়ে যায় ঠিকই। বিচলিতও করে। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী। দীর্ঘকাল সে-সব নিয়ে মগ্ন থাকা তার স্বভাবে নেই।
ঝুমা বলল, রাজদিয়ায় তুমি আমাকে একটা প্রমিস করেছিলে বিনুদা—
বিনয় মনে করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কীসের প্রমিস বল তো?
কলকাতায় এলে আমাদের বাড়ি আসবে। সুধা মাসিদের ওখানে গিয়ে সেদিনও তোমাকে বলে এসেছি। বুঝি, ঝিনুকের জন্যে আসতে পারনি। এখন তো সে ভয় নেই। এস
বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে ওঠে বিনয়ের। ঝুমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঝিনুকের চিন্তা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। জাদুকরীর মতো অসীম শক্তি এই মেয়েটার। সৌরলোকের সব কিছু
সে লহমায় ভুলিয়ে দিতে পারে।
ঝুমার কাছে এলে কেন যে অন্য কিছু মনে থাকে না? কিন্তু একমাত্র ঝিনুককেই ভোলা যায় না। তার জন্য হঠাৎই অনুশোচনায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে যেতে থাকে। চকিতে একবার আকাশের দিকে তাকায় বিনয়। সূর্য প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে। বিমলদের বাড়িতে যা বলেছিল, ঝুমাকেও তাই বলল, সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কোথায় যাচ্ছি, ছোটদিকে বলে আসা হয়নি। অনেক বেলা হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ওরা খুব চিন্তা করছে। আজ তোমাদের বাড়ি যাওয়া হবে না। আর-একদিন ঠিক যাব।
আদুরে গলায় ঝুমা বলল, এখন তোমাকে কিছুতেই ছাড়ছি না। আমাদের বাড়ি এখান থেকে মিনিট তিনেকের রাস্তা। বেশিক্ষণ আটকাব না। তোমাকে দেখলে সবাই ভীষণ খুশি হবে।
বেলার দোহাই দিয়ে ফের আপত্তি করতে যাচ্ছিল বিনয় কিন্তু কিছুতেই ঠেকানো গেল না ঝুমাকে, কোনও বাহানা শুনতে চাই না। ফের যদি না না কর, হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাব। সেটা কি ভাল হবে?
সারা শরীরে চমক খেলে গেল বিনয়ের। ঝুমার অসাধ্য কিছু নেই। একটি চোখধাঁধানো, বেপরোয়া তরুণী প্রকাশ্য দিবালোকে শয়ে শয়ে মানুষের চোখের সামনে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে, দৃশ্যটা ভাবার মতো দুঃসাহস তার নেই। এই একটি মেয়ে, যার সামনে কোনও সংকল্পই বেশিক্ষণ অটুট। রাখা যায় না। মিনমিনে গলায় বিনয় বলল, ঠিক আছে, চল
ঝুমার ঠোঁটের ফাঁকে নীরব হাসির আভা ফুঠে ওঠে। কী মিশে আছে সেই হাসিতে? সীমাহীন অহমিকা? দম্ভ? সে কি বোঝাতে চায়, একটি পুরুষকে তুড়ি মেরে নিজের ইচ্ছায় চালানোর ক্ষমতা তার আছে?
দুই চোখ সামান্য ছোট করে ঝুমা বলে, দ্যাটস লাইক আ গুড বয়। এস একটু থেমে বলল, আমাদের বাড়ি গেলে রাজদিয়ার দুজনের সঙ্গে দেখা হবে। তোমার খুবই চেনাজানা।
বিনয় উৎসুক হল, কারা তারা?
চলই না। এত অধৈর্য কেন?
হেদুয়ার দক্ষিণ পাশের রাস্তা থেকে ডান দিকে সেকেন্ড যে গলিটা বেরিয়েছে সেটাই রমাকান্ত চ্যাটার্জি লেন। মাঝারি রাস্তাটা দিয়ে কপা এগুলেই ঝুমাদের দোতলা বাড়ি। আনন্দদের মতো বিশাল না হলেও বাড়িটা বেশ বড়ই। সামনের দিকে ফুলের বাগান। তারপর গাড়ি-বারান্দা। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে চওড়া চাতাল। তারপর কারুকাজ করা বিশাল দরজা।
বিনয় শুনেছে হেমনলিনীরা এই বাড়িটি তার মেয়ে-জামাই অর্থাৎ স্মৃতিরেখা ও শিশিরকে যৌতুক দিয়েছেন। বিয়ের পর থেকে ওঁরা ওখানে আছেন। এ-বাড়িতেই রুমা ঝুমা, দুই বোনের জন্ম।
দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে শ্বেত পাথরে বাঁধানো বড় হল-ঘর। ভারী ভারী সোফা, আলমারি, চার ব্লেডওলা বিরাট বিরাট ফ্যান দিয়ে সাজানো সেটার একধারে কটা বেডরুম, কিচেন, খাবার জায়গা। দুজন কাজের লোককে সেখানে দেখা গেল। ব্যস্তভাবে তারা কী সব করছে।
হল-ঘরের আর-এক ধারে দোতলায় যাবার সিঁড়ি। ওপরে উঠতে উঠতে গলার স্বর উঁচুতে তুলে ঝুমা ডাকতে লাগল, মা মা, দেখ কাকে নিয়ে এসেছি।
দোতলার চওড়া বারান্দার একদিকে ঢালাই-করা লোহার নকশাদার রেলিং। অন্যদিকে সারি সারি ঘর। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে একটা নরম কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, কে রে ঝুমা, কাকে এনেছিস? পরক্ষণে দেখা যায় ওধারের শেষ ঘরখানা থেকে স্মৃতিরেখা রেরিয়ে এসেছেন। ঝুমার মা।
সেই যুদ্ধের সময় স্মৃতিরেখাকে শেষ দেখেছিল বিনয়। জাপানি বোমার ভয়ে হাজার হাজার মানুষ কলকাতা ফাঁকা করে পূর্ব বাংলায় উধাও হয়েছিল। সেই আতঙ্কগ্রস্ত পলাতকদের মধ্যে রুমা ঝুমা আনন্দ স্মৃতিরেখা শিশিররাও ছিলেন।
প্রতিমার মতো নিখুঁত মুখ, টানা চোখ, ফুরফুরে লম্বাটে নাক। তখনই কত বয়স স্মৃতিরেখার। কিন্তু ত্বকে ছিল মসৃণ সোনালি আভা। কোমর অবধি চুল। হালকা, মেদহীন শরীর। মাঝখানে কটা বছর কেটে গেছে। কত কিছুই না ঘটে গেল! দুর্ভিক্ষ। মহাযুদ্ধের অবসান। দাঙ্গা। দেশভাগ। কিন্তু কিছু চুল পেকে যাওয়া আর শরীর ভারী হওয়া ছাড়া চেহারা তেমন বদলায়নি।
মাথায় তেল মেখেছেন স্মৃতিরেখা। দূর থেকৈও মৃদু সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। কাঁধে ধবধবে সাদা তোয়ালে। খুব সম্ভব স্নান করতে যাচ্ছিলেন। বিনয়কে দেখামাত্র চিনতে পারলেন। দুচোখে অনন্ত বিস্ময় নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বিনু না?
বারান্দায় উঠে এসেছিল ঝুমারা। হ্যাঁ দিদি এগিয়ে গিয়ে স্মৃতিরেখাকে প্রণাম করল বিনয়। ভগ্নীপতির দিদি। সেই সম্পর্ক ধরে স্মৃতিরেখা তারও দিদি। একটা কথা মনে পড়তে ভারী মজা লাগল তার। সে স্মৃতিরেখাকে দিদি বলে। কিন্তু তাঁর মেয়ে তাকে বলে দাদা। মামা বলা উচিত।
স্মৃতিরেখা বললেন, এস, এস। কত বড় হয়ে গেছ!
একথার জবাব হয় না। সময় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না। নিঃশব্দে তার কাজ করে যায়। বিনয় মুখে কিছু বলল না। একটু হাসল শুধু।
যে-ঘর থেকে স্মৃতিরেখা বেরিয়ে এসেছিলেন, বিনয়দের সেখানেই নিয়ে গেলেন। ঘরটা প্রকাণ্ড। বিশাল ছত্রিওলা মেহগনি কাঠের খাট, পুরো পাল্লা জোড়া কাঁচ-বসানো আলমারি, গদিওলা সোফা, ডিভান, ড্রেসিং টেবল, কুশন–এত সব আসবাব থাকা সত্ত্বেও এধারে ওধারে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। বিনয় আঁচ করে নিল এটা শিশির আর স্মৃতিরেখার বেডরুম।
একটা সোফায় বিনয়কে বসিয়ে স্মৃতিরেখা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, বিনুকে কোথায় পেলি?
খাটের এক কোণে বসতে বসতে ঝুমা বলল, হেদোর সামনে বিনুদার সঙ্গে দেখা। আসতে চায় না। জোর করে ধরে নিয়ে এলাম।
ভাল করেছিস। বলতে বলতে কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে স্মৃতিরেখার, কিন্তু
কী?
কলেজ ফাঁকি দিয়ে হেদোর সামনে ঘুরছিলি নাকি?
কী যে বল না- ঝুমা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। তারপর প্রাক্তন অধ্যাপকের মৃত্যু, শোকসভা, প্রয়াত শিক্ষকের সম্মানে ছুটি হয়ে যাওয়া এবং বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই বিনয়ের সঙ্গে দেখা, ইত্যাদি জানিয়ে দেয় সে।
স্মৃতিরেখা খাটের আর-এক কোনায় বসে পড়েছিলেন। কেন উত্তর কলকাতার এই এলাকায় হেদুয়ার সামনে বিনয় এসেছিল তা নিয়ে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো এখন সুধা আর হিরণের কাছে আছ?
ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে গেল বিনয়। এই প্রশ্নের খেই ধরে কোন দিকে, কতদূর স্মৃতিরেখা এগুবেন, বোঝা যাচ্ছে না। সংক্ষেপে বিনয় বলল, হ্যাঁ।
মেসোমশাই, মানে তোমার বাবা বাড়িটাড়ি বেচে হরিদ্বার চলে গেলেন। সবে তুমি পাকিস্তান থেকে এসেছ। আর কিছুদিন থেকে, তোমাকে একটু দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলে বোধ হয় ভাল হতো।
কেন, আমি তো একটা চাকরি পেয়েছি।
বিনয়ের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন স্মৃতিরেখা। মনে হল, অবনীমোহনের কার্যধারা সম্পর্কে মন্তব্য করা বোধহয় ঠিক হয়নি। বিশেষ করে বিনয়ের কাছে। ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য ব্যস্তভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার খেয়াল ছিল না। শুনেছি, খবরের কাগজে কাজ পেয়েছ।
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।
স্মৃতিরেখা বললেন, গভর্নমেন্ট কি বড় সাহেব কোম্পানিতে চাকরি পেলে ভাল হতো। ওই সব জায়গায় অনেক সুযোগ সুবিধা। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
বিনয় বলল, সেটা ঠিক। আপাতত যা পেয়েছি তাই করি। পরে দেখা যাবে।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। তেমন কিছু জরুরি নয়। খুব সাধারণ। এমন দিনে বিনয় এল যখন শিশির বাড়িতে নেই। অফিসে গেছে। যে-বছর আনন্দর বিয়ে হয় সে-বছরই ঝুমার দিদি রুমারও বিয়ে হয়েছিল। সে থাকে টাটানগরে। তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। ওরা থাকলে বিনয়কে পেয়ে হইচই বাধিয়ে দিত। ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেশ খানিকটা সময় স্মৃতিরেখার সঙ্গে কাটালো বিনয়। অনেক কথাও হল। ভেতরে ভেতরে চাপা উদ্বেগ চলছিল তার। এই বুঝি ঝিনুকের প্রসঙ্গ ওঠে। কিন্তু সেদিক দিয়েই গেলেন না স্মৃতিরেখা। মাত্র কদিন আগে মেয়েটা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। বিশ্বসুদ্ধ কারও সেটা জানতে বাকি নেই। স্মৃতিরেখা শোনেননি, তা তো আর হয় না। কিন্তু মহিলা বুদ্ধিমতী। অত্যন্ত বিচক্ষণ। সহৃদয়ও। ঝিনুকের জন্য কার বুকের ভেতর কতখানি ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে আছে, তার অজানা নেই। অহেতুক ঝিনুকের প্রসঙ্গ তুলে ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?
কথা বলতে বলতে উৎকণ্ঠা কেটে যাচ্ছিল বিনয়ের। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল সে।
একসময় স্মৃতিরেখা বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখানেই চান টান করে দুটি শাকভাত খেয়ে নাও
ব্যস্তভাবে বিনয় বলল, না না, আজ আর খেতে বলবেন না দিদি।
এই দুপুরবেলায় কেউ না খাইয়ে ছাড়ে?
কেন তার টালিগঞ্জে এখনই ফিরে যাওয়া দরকার, বুঝিয়ে বলল বিনয়। ঝুমাকেও তা-ই বলেছিল।
একটু চুপ করে থেকে স্মৃতিরেখা বললেন, হ্যাঁ, তোমার ফিরে যাওয়াই দরকার। তবে তুমি প্রথম দিন এলে, একটু কিছু মুখে দিয়ে না গেলে আমাদের খুব খারাপ লাগবে। আমি তাড়াতাড়ি চান করে আসছি। হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় ঝুমাকে বললেন, ওই দেখ, একদম খেয়াল ছিল না। তুই বিনুকে তোর দাদু আর ঠামুর ঘরে নিয়ে যা। ওকে দেখলে ওঁরা খুশি হবেন।
ঝুমারও মনে পড়ে গেল। বিনয়কে বলল, তোমাকে তখন দুজন দেশের মানুষের কথা বলছিলাম না? দেখবে চলণ
কুমার দাদু আর ঠাকুমা। তার মানে রামকেশব এবং তার স্ত্রী। ওঁরাও তাহলে রাজদিয়া ছেড়ে চলে এসেছেন! রামকেশব মানুষটা ছিলেন ভীষণ একরোখা, প্রচণ্ড সাহসী। অবিকল হেমনাথের মতো। তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাই ঘটুক, জন্মভূমি ফেলে কখনও সীমান্তের এপারে আসবেন না। এই তো সেদিন বিনয় কলকাতায় এসেছে। রাজদিয়ায় থাকতে প্রায়ই রামকেশবদের বাড়ি গিয়ে ওঁদের খোঁজখবর নিত। নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন কিছু ঘটেছে–ভয়াবহ এবং বিপজ্জনক–যাতে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হয়নি। তার সংকল্পের ভিতটা টলে গেছে। রামকেশব যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, হেমনাথ কি আর ভাল আছেন? উৎকণ্ঠায় বুকের গভীর তলদেশ পর্যন্ত কেঁপে যায় বিনয়ের।
নিত্য দাসের হাত দিয়ে হেমনাথকে দ্বিতীয় যে চিঠিখানা বিনয় পাঠিয়েছিল, এখনও তার জবাব আসেনি। হঠাৎ মনে পড়ল, চিঠিটা নিয়ে যাবার পর লোকটাকে আর দেখা যায়নি। হেমনাথের জন্য অসীম শঙ্কায় শ্বাস আটকে আসতে থাকে। তারই ভেতর বিনয়ের মনে হয়, কবে পাকিস্তান থেকে হেমনাথের উত্তর আসবে তার ঠিকঠিকানা নেই। ঝুমাদের বাড়ি এসে একরকম ভালই হয়েছে। রামকেশবের মুখ থেকে হেমনাথদের এখনকার খবরটা জানা যাবে।
বারান্দার আর-এক মাথায় শেষ ঘরখানায় বিনয়কে নিয়ে এল ঝুমা। স্মৃতিরেখা শিশিরের শোবার ঘরের মতো এটাও সেকেলে আসবাবে বোঝাই।
ঘরের মাঝখানে খাটের ওপর শুয়ে ছিলেন রামকেশব। অন্যদিকে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে কাঠের সিংহাসনে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মূর্তি। কোনওটা তামার, কোনওটা পাথরের, কোনওটা রুপোর। রামকেশবের স্ত্রী পশমের আসনে বসে পুজোর আয়োজন করছিলেন।
ওই সিংহাসন আর দেবদেবীদের রাজদিয়ায় রামকেশবের বাড়িতে বহুবার দেখেছে বিনয়। দেশ থেকে আর কিছু আনতে পেরেছেন কি না, কে জানে। কিন্তু ঠাকুরদেবতাকে ফেলে আসেননি।
ঝুমা হইহই করতে করতে ঘরে ঢুকেছে, দাদু, ঠামু, দেখ তোমাদের দেশের লোককে ধরে আনলাম।
খাটের ওপর ধড়মড় করে উঠে বসলেন রামকেশব। পরনে ধুতি এবং ফতুয়ার ওপর মোটা উলের ফুলহাতা সোয়েটার।
হেমনাথের কাছাকাছি বয়স। হয়তো দুচার বছরের ছোটই হবেন রামকেশব। কিন্তু এর মধ্যেই ভীষণ বুড়িয়ে গেছেন। মুখ শীর্ণ। ঘোলাটে চোখ। চুল উঠে উঠে মাথা প্রায় কঁকা। যা কয়েক গাছা আছে সেগুলোর রং পাঁশুটে।
মাথার বালিশের পাশে বিঘত খানেক লম্বা চশমার খাপ ছিল। সেটা খুলে নিকেলের গোলাকার বাইফোকাল চশমা বার করে পরে নিলেন রামকেশব। বিনয়কে দেখে বৃদ্ধ খুবই খুশি। বেশ অবাকও। বললেন, আরে বিনু না? কলকাতায় পা দিতে না-দিতেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বোসো-বোসো-।
বিনয় এগিয়ে গিয়ে রামকেশবকে প্রণাম করল। এদিকে দেবদেবীর আরাধনা স্থগিত রেখে ঘুরে বসেছেন রামকেশবের স্ত্রী। তারও পা ছুঁতে যাচ্ছিল বিনয়, কিন্তু বাধা পড়ল। রামকেশবের স্ত্রী হাত নেড়ে বললেন, পুজোয় বসেছি। এখন প্রণাম নিতে নেই।
অগত্যা খাটের কোণে বসে পড়ল বিনয়। ঘরের অন্য এক ধারের দেওয়াল ঘেঁষে খানকয়েক গদিওলা মোড়া দাঁড় করানো রয়েছে। তার একটা টেনে এনে কাছাকাছি বসল ঝুমা। হাসি হাসি মুখে বলল, কী দাদু, কালই বিনুদার কথা বলছিলে। আজই তাকে তোমার সামনে হাজির করে দিলাম। ভাবতে পেরেছিলে?
রামকেশব হাসলেন, না রে দিদি, ভাবিনি।
কাল তার সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছিল এ-বাড়িতে। কী বলেছিলেন রামকেশব? আন্দাজ করতে চেষ্টা করল বিনয়। কিন্তু আকাশপাতাল হাতড়ে কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। এই নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। এখানে যখন এসেই পড়েছে, কী কথাবার্তা হয়েছে, অবশ্যই জানা যাবে। সে উৎসুক হয়ে রইল।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, দেশ থেকে কবে এলেন?
রামকেশব বললেন, পরশু
আপনি না বলেছিলেন, কোনওদিন রাজদিয়া ছেড়ে আসবেন না?
হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা পালন করা গেল না। হঠাৎ কী হল?
তুমি থাকতে থাকতে রাজাকারদের কিছু কিছু উৎপাত হচ্ছিল। গত দশ দিনে তাদের অত্যাচার যে কতগুণ বেড়েছে, ভাবতে পারবে না।
রাজাকারদের দৌরাত্মের কথা হেমনাথও তার চিঠিতে লিখেছিলেন। হয়তো খানিকটা রেখে ঢেকে, বিনয়রা যাতে দুশ্চিন্তায় না থাকে। কিংবা চিঠি লেখার সময় তা অতখানি মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। নির্যাতন কতটা লাগামছাড়া হয়ে উঠলে রামকেশবের মতো মানুষও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তা অনুমান করতে পারছে বিনয়।
রামকেশব সবিস্তার আরও জানালেন। রাজাকারদের ঝাট থাকলেও বাঙালি মুসলমানরা তাদের খুব একটা পাত্তা দিত না। পার্টিশানের পর ইন্ডিয়া থেকে পশ্চিমা মুসলমানরা ঢাকা চট্টগ্রাম খুলনা রাজশাহী, এইসব বড় বড় শহরে চলে আসছিল। বছরখানেক হল, তাদের অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানের ছোটখাটো, নগণ্য টাউন, এমনকি গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু কিছু পশ্চিমা রাজদিয়ায় আগেই এসেছিল। ক্রমশ তাদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। এরা বাঙালি মুসলমানদের সমানে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা পাকিস্তানের মালিক। ওখানকার জমিজিরাত, বাগ-বাগিচা, দালানকোঠা-সমস্ত কিছু মুসলমানের। অন্য কারও নতুন এই রাষ্ট্রে থাকার অধিকার নেই। তারা তাদের ইন্ডিয়ায় চলে যাক। ক্রমাগত উসকানিতে বেশ কিছু বাঙালি মুসলমান আর আগের মতো শান্ত, নম্র নেই। ভীষণ বদলে যাচ্ছে। লোকগুলো এখন রূঢ়। উদ্ধত। তাদের কর্কশ ব্যবহার। চোখের দৃষ্টিতে উগ্রতা। পুরুষানুক্রমে তারা যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, সুখে-দুঃখে শোকে-আনন্দে উৎসবে-পরবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে তা যেন ভাবাই যায় না। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অপরিচিত এক হিংস্র বাহিনী চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিনয়ের মনে পড়ে, এই পশ্চিমা মুসলমানদের কথাও হেমনাথের চিঠিতে ছিল। তারা রাজদিয়ায় বিষ ছড়াচ্ছে।
রামকেশব বলতে লাগলেন, রোজ পাঁচ দশটা করে হুমকি দিয়ে বেনামা চিঠি আসে। এক কাপড়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাও। রাত্তিরে বাড়িতে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়ে। রাস্তা দিয়ে ওরা শাসিয়ে যায়। সাতদিন সময় দিলাম। তার ভেতর দেশ না ছাড়লে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে। এরপর আর রাজদিয়ায় থাকতে সাহস হল না।
বিনয় কিছু বলে না, রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। রামকেশব জিজ্ঞেস করলেন, রাজদিয়ার নিত্য দাসের কথা মনে আছে?
বিনয় বলল, থাকবে না কেন? কলকাতায় দুতিনবার তার সঙ্গে দেখাও হয়েছে।
খুব ধূর্ত, করিৎকর্মা। পোস্ট অফিসের ওপর ভরসা নেই। ওই ডিপার্টমেন্টটা প্রায় নিষ্কর্মা হয়ে গেছে। কিন্তু নিত্য দাসের লোক পাকিস্তানের চিঠি ইন্ডিয়ায় নিয়ে যায়, ইন্ডিয়ার চিঠি পাকিস্তানে পৌঁছে দেয়।
জানি। নিত্য দাসের হাত খুব লম্বা।
আমার কপাল ভাল। শাসানি যখন চলছে, নিত্যর লোকটা হঠাৎ রাজদিয়ায় গিয়ে হাজির। তার হাতে শিশিরকে চিঠি পাঠালাম। আমাকে যেন ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করে।
রামকেশব জানালেন, কলকাতায় শিশির যখন হিন্দু হোস্টেলে থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন তখন তাঁর সহপাঠী ছিলেন তোফায়েল আমেদ। অসাধারণ ছাত্র। দুজনের ছিল গভীর বন্ধুত্ব। গ্র্যাজুয়েশনের পর পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে অফিসার হয়ে যান তোফায়েল। আর ইংরেজিতে এম এ করে খাস ব্রিটিশ কোম্পানি ম্যাকিনন অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জিতে বড় চাকরি পান শিশির। দুজনের কাজের জায়গা আলাদা। কিন্তু সম্পর্কটা আগের মতোই নিবিড় থেকে গেছে।
তোফায়েলরা খাস পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টে ওঁদের আদি বাড়ি। কিন্তু দেশভাগের পর এখানকার জমিজমা বাড়িঘর বেচে অপশন নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে যান। ওয়েস্ট বেঙ্গলে কম্পিটিশন অনেক বেশি। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তুলনায় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সুযোগসুবিধা প্রচুর। সেখানে খোলা মাঠ। পোমোশন পেয়ে খুব তাড়াতাড়ি তরতর করে অনেক ওপরে ওঠা যায়।
ঢাকায় চলে যাবার পরও দুই বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগটা রয়েছে। চিঠিপত্রে নয়, টেলিফোনে। দুই দেশের ভেতর ওই যন্ত্রটা এখনও চালু আছে। রামকেশবের চিঠি পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত শিশির তোফায়েলকে ফোন করেন। তোফায়েল এখন ঢাকার পুলিশ কমিশনার। তিনি নিরাপত্তার সবরকম বন্দোবস্ত করে রামকেশব এবং তার স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখান থেকে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের প্লেনে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। রাজদিয়ার বাড়িতে তালা লাগিয়ে পার্থিব যাবতীয় সম্পত্তি ফেলে শুধু দেবদেবীর মূর্তি আর তাদের সিংহাসনটা নিয়ে সীমান্তের এপারে চলে আসতে পেরেছেন রামকেশবরা।
এক নাগাড়ে বলতে বলতে হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন রামকেশব। একটু থামলেন। জোরে জোরে বারকয়েক শাস টেনে ফের শুরু করলেন, ইসমাইল দফাদারকে মনে পড়ে?
বিনয় বলল, পড়বে না কেন? রাজদিয়ায় থাকতে বছর বছর আপনাদের চকের জমি ওকে ভাগচাষ করতে দিতেন।
তিন পুরুষ ধরে চাষ করে আসছিল। দেশভাগের আগে মাথা তুলে কথা বলত না। দেখা হলেই কথায় কথায় সেলাম আর আদাব। চোখ সবসময় মাটিতে। অনেকবার বললে তবে বারান্দায় উঠে জড়সড় হয়ে বসত। পাকিস্তান হবার পরও কিছুদিন আগের মতোই ছিল। কিন্তু ইদানীং রাজাকার আর পশ্চিমা মুসলমানরা তার মাথায় হাজারটা কুবুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছে। রাতারাতি ভোল পালটে গেছে ইসমাইলের
তীব্র কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে ছিল বিনয়। জিজ্ঞেস করল, কীরকম?
রামকেশব বললেন, কিছুদিন হল, বাড়িতে এসে সে আর উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকত না। সোজা বসার ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ত। আগের মতো নরম তরম নেই। এখন মেজাজ অনেক চড়া। কথাবার্তা রোখাচোখা। আমি যদি কিছু বলি আর সেটা যদি তার পছন্দ না হয়, মুখের ওপর তার কী চোটপাট!
রামকেশব আরও জানালেন, মাঝে মাঝেই দুই জোয়ান ছেলেকে নিয়ে হাজির হচ্ছিল ইসমাইল। আগে পরত সস্তা লুঙ্গি আর নিমা, খালি পা। পাকিস্তান হবার কিছুদিন পর থেকে পরছে ধবধবে পাজামা আর ফুলশার্ট, পায়ে পাম্প শু। চুল থাকত রুখাশুখা, সাতজন্মে তেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। এখন তার মুখ পরিষ্কার কামানো। মাথা থেকে ভুরভুর করে ফুলেল তেলের সুবাস বেরোয়।
প্রথম প্রথম ছেলেদের সঙ্গে করে একতলায় বসত ইসমাইল। বলত, পাকিস্থান হইয়া গ্যাছে। অহন আমরা সোমান সোমান (সমান সমান)। আপনেগো নিচে আর নাই। আপনেগো রান্ধনীরে (রাঁধুনি) আমাগো লেইগা চা বানাইতে কন। হের (তার) লগে লাড়ু মোয়া উপরাও (মুড়কি) দিতে কইয়েন।
রামকেশব বলতে লাগলেন, এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ দিনকয়েক আগে ইসমাইলরা সোজা দোতলায় একেবারে শোবার ঘরে এসে খাটের ওপর বসল। বাধা দেবার সাহস হল না। ইসমাইলরা চা, চিড়েভাজা, তিলা-কদমা খেয়ে বলল, মজার মশয় (মজুমদার মশায়) একখান কথা মন দিয়া হুনেন। মেলা (অনেক) বচ্ছর আপনেগো জমিন চছি। ধানপাট বেইচা আপনেরা লাল হইয়া গ্যাছেন। আমাগো কপালে হুদা (শুধু ঠনঠনঠন। এইবার জমিনের আধাআধি রেজিস্টারি কইরা আমাগো নামে লেইখা দ্যান। যারা শোওয়ার ঘরে উঠে এসেছে তাদের লম্বা ঠ্যাং ভবিষ্যতে আরও কতদুর পর্যন্ত যাবে, কে জানে। সেদিন বুঝলাম, দেশে আর থাকা যাবে না। ভাগ্যই বলব, এর দুদিন পর নিত্য দাসের লোক গিয়ে হাজির। তারপর কীভাবে কলকাতায় এসেছি তা তো আগেই শুনেছ।
বিনয় জানে, পাকিস্তানে এখন তিনটে টার্গেট। যুবতী নারী। জমিজমা। আর সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের আত্মসম্মান বোধ। এই তিন জায়গায় আক্রমণ হানতে পারলে পাকিস্তান ফাঁকা হয়ে যাবে। সে জিজ্ঞেস করে, রাজদিয়ার বাড়ি আর জমির কী ব্যবস্থা করে এসেছেন?
রামকেশব বললেন, বাড়িতে তালা লাগিয়ে এসেছি। জমি যেমন ছিল তেমনিই পড়ে আছে। তোফায়েলকে সব জানিয়েছি। সে থাকে ঢাকায়। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। প্রচুর দায়িত্ব। অতদূর থেকে রাজদিয়ায় আমার প্রপার্টির খবর রাখা কি তার পক্ষে সম্ভব? অবশ্য বলেছে চেষ্টা করবে। তবে
তবে কী?
একটাই আশার আলো, নিত্য দাস তার লোক মারফত খবর পাঠিয়েছে, ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে যে মুসলমানেরা পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে তাদের কারও জমি-জায়গার সঙ্গে আমাদের প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করিয়ে দেবে। দুএকদিনের মধ্যে সে এ-বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তখন তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হবে। তারপর দেখা যাক
চকিতে বিনয়ের মনে পড়ল, নিত্য দাস হেমনাথের জমি-বাড়ির এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে কোনও এক শাজাহান সাহেবের সঙ্গে কথা পাকা করে রেখেছে। প্রথম চিঠিতে হেমনাথ জানিয়েছেন, দেশ। ছেড়ে আসবেন না কিন্তু রামকেশব যা জানালেন, তাতে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড়। দিনকে দিন রাজদিয়ায় আতঙ্ক মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে। এক দণ্ডও হেমনাথের আর সেখানে থাকা উচিত নয়।
বিনয় ব্যাকুল স্বরে বলল, আসার সময় আমার দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
রামকেশব বললেন, চিরদিনের মতো রাজদিয়া ছেড়ে চলে আসব আর হেমদাদার সঙ্গে দেখা করব না, তাই কখনও হয়? তাকে কত বোঝালাম, পাকিস্তানে থাকতে পারবেন না। তোফায়েল আমাদের ঢাকায় নিয়ে কলকাতার প্লেনে তুলে দেবে। বউ-ঠাকরুন আর শিবানী দিদিকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন। এই সুযোগ আর জীবনে আসবে না। কিন্তু কে কার কথা শোনে! ঘাড় একেবারে শক্ত করে রইল হেমদাদা।
বিমর্ষ মুখে বসে থাকে বিনয়। পাকিস্তানে হেমনাথদের যে কী ভবিষ্যৎ, ভাবতেও সাহস হয় না।
রামকেশব থামেননি, কলকাতার খবরের কাগজে কি এই খবরটা বেরিয়েছে?
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কোন খবর?
উর্দুকে পাকিস্তানের স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ করা হচ্ছে। এই নিয়ে ইস্ট বেঙ্গলে কিছু কিছু গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। বাঙালিরা ওয়েস্ট পাকিস্তানের সিন্ধি আর পাঞ্জাবি মুসলমানদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। তাদের একটা সেকশন চায়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
বিনয় মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, বেরিয়েছে। রামকেশব বললেন, যারা ভাষা ভাষা করে হই চই বাধিয়েছে তারা আর কজন? ইস্ট পাকিস্তানের টোটাল পপুলেশনের এক পারসেন্টও নয়। কিন্তু এতেই হেমদাদার কী উৎসাহ! একেবারে নেচে উঠেছে। স্বপ্ন দেখছে, ইস্ট পাকিস্তানে খুব শিগগিরই নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হবে। এখন যে তাণ্ডব চলছে, কিছুদিনের মধ্যে তার লেশমাত্র থাকবে না।
বিনয়কে কিছুদিন আগে হেমনাথ যে চিঠি লিখেছিলেন তাতেও এই কথাগুলো ছিল। সে উন্মুখ হয়ে রামকেশবের দিকে তাকিয়ে থাকে। রামকেশব থামেননি, টু-নেশন থিওরির ওপর যে-দেশের সৃষ্টি, সেখানে জন্মাবে বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম! সোনার পাথর বাটি! হেমদাদার কোনও কালেই বাস্তব বোধ নেই।
স্মৃতিরেখা ঘরে ঢুকলেন। এর ভেতর তার স্নান হয়ে গেছে। পরনে নকশা-পাড় ধবধবে টাঙ্গাইল শাড়ি। ভেজা চুল আঁচড়াবার পর পিঠময় ছড়ানো। কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। সিঁথির মাঝামাঝি পর্যন্ত ঘোমটা। যেন অলৌকিক এক দেবীপ্রতিমা। তার এক হাতে চিনামাটির বড় প্লেটে নলেন গুড়ের প্রচুর তালশাঁস সন্দেশ আর কাঁচাগোল্লা। অন্য হাতে জলভর্তি কাঁচের গেলাস। ঝুমাকে বললেন, একটা সাইড টেবল এনে বিনুর কাছে রাখ।
ঝুমা ব্যস্ত পায়ে উঠে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে টেবল নিয়ে এল। স্মৃতিরেখা প্লেট আর গেলাস তার ওপর রাখলেন। বিনয়কে বললেন, খাও–
পাকিস্তান সম্পর্কে রামকেশবের কাছে যা শোনা গেল তাতে অসীম উৎকণ্ঠায় বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্কর মতো বিনয় বলল, এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
স্মৃতিরেখা বললেন, প্রথম দিন এলে। একটু কিছু মুখে না দিলে আমাদের ভীষণ খারাপ লাগবে।
ঝুমা আর রামকেশবের স্ত্রীও খাওয়ার জন্য প্রায় জোরজারই করতে লাগলেন।
আপত্তি করে রেহাই পাওয়া যাবে না। নীরবে চামচে করে একটা মিষ্টি তুলতে যাচ্ছিল বিনয়, রামকেশব হঠাৎ বললেন, কলকাতায় এসে একটা খবর পেলাম। বউমা আর শিশির বলছিল, ঝিনুক নাকি নিখোঁজ হয়ে গেছে। কত কষ্ট করে তাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে এসেছিলে। তার
ঝুমা এবং স্মৃতিরেখা হতচকিত। বিব্রত মুখে তারা বাধা দিতে লাগলেন, ও-সব কথা থাক–
কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না রামকেশব। নিজের ঝোঁকে বলে যাছিলেন, এ একরকম ভালই হয়েছে বিনু। ওই মেয়েকে নিয়ে কী করতে তুমি! সারা জীবন গলায় কাঁটার মধ্যে বিধে থাকত। না পারতে তাকে ফেলতে, না পারতে তাকে–
সব বুড়োবুড়িই এক ছাঁচে ঢালাই। একই সংস্কারের বেড়াজালে বন্দি। হেমনলিনী। অবনীমোহন। রামকেশব। বিনয়ের মনে হল, একটা তপ্ত লোহার ফলা তার মস্তিষ্কে আমূল বিধে যাচ্ছে। কদিনে ঝিনুকের জন্য যাতনার তীব্রতা খানিকটা কমে এসেছিল। রামকেশব পুরোনো ক্ষতটাকে খোঁচা দিয়ে ফের রক্তাক্ত করে তুলেছেন।
বিনয় লক্ষ করেছে, রাজদিয়ার যার সঙ্গেই দেখা হোক, যত কথাই হোক, সব আলোচনার শেষে অনিবার্যভাবে ঝিনুক আসবেই। ঝিনুক ছাড়া পৃথিবীতে যেন অন্য কোনও বিষয় নেই।
হাতের চামচটা প্লেটে নামিয়ে রেখে তড়িৎস্পৃষ্টের মতো খাট থেকে নেমে পড়ে বিনয়। সোজা দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
ঘরের অন্য সবাই চমকে ওঠে। রামকেশব বললেন, কী হল বিনু, কোথায় যাচ্ছ?
স্মৃতিরেখা বললেন, যেও না, যেও না
বিনয়ের বুকে কোথায় কোন অদৃশ্য স্তরে রক্তপাত হচ্ছে, তার কারণটা কী, কুমার চেয়ে কে আর তা ভাল জানে। ব্যাকুল স্বরে সে ডাকতে লাগল, বিনুদা–বিনুদা ।
কিছুই শুনতে পাচ্ছে না বিনয়, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। একেবারে অন্ধ আর বধির। উদ্ভ্রান্তের মতো সামনের বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে নেমে একেবারে রাস্তায়।
পেছন পেছন চলে এসেছিল ঝুমা। কিন্তু বিনয়কে ধরা গেল না। সে ততক্ষণে রমাকান্ত চ্যাটার্জি লেনের শেষ মাথায় চলে গেছে। আর এগোয় না ঝুমা। গেটের কাছে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই কিছুক্ষণ আগে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ঝুমার সঙ্গে তাদের বাড়ি চলে এসেছিল বিনয়। সেই কুহক উধাও। কৈশোর থেকে তাকে ঘিরে দুই নারীর কী যে তীব্র টানাপোড়েন! ঝুমাকে দেখলে তার শরীরে শিহরন জাগে, তপ্ত হয়ে ওঠে শ্বাসবায়ু। সবই ঠিক। ঝিনুক নিখোঁজ হয়ে গেছে, সেটাও ঠিক। আর কখনও তার সঙ্গে দেখা হবে কি না, কে জানে। তবু বিনয় এই মুহূর্তে ফের অনুভব করে মেয়েটা সহস্র পাকে এখনও জড়িয়ে আছে। সেই পাকগুলি এত তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব।
কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে এসে এসপ্ল্যানেডের ট্রামে উঠে পড়ল বিনয়। এতক্ষণে এই রুটে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
.
১২.
ঝুমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পর তিনটে দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রোজ সকালের দিকে একবারই মোটে হিরণের সঙ্গে বাজারে গেছে বিনয়। বাকি দিনটা বাড়ি থেকে আর বেরোয়নি। সেদিন রামকেশব ঝিনুক সম্পর্কে নিষ্ঠুর একটা মন্তব্য করে যে কষ্ট দিয়েছেন, তার রেশ এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।
দোতলার কোণের দিকের একটা ঘর বিনয়ের জন্য চমৎকার সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে সুধা। এই কদিন সারাক্ষণ সেখানে শুয়ে শুয়ে কাটিয়েছে সে। অফিসে জয়েন করতে এখনও কিছু দিন বাকি। অলস মন্থর ভারাক্রান্ত সময় আর কাটতে চায় না। তার ওপর ঝিনুকের জন্য ক্লেশ তো রয়েছেই।
ঘরের জানালা দিয়ে সোজাসুজি ট্রাম রাস্তা চোখে পড়ে। সেখানে রকমারি দৃশ্য। ধাবমান যানবাহন। মানুষজনের যাতায়াত। কতরকম আওয়াজ ভেসে আসে ওখান থেকে। ট্রামের ঘটাং ঘটাং, রিকশার ঠুন ঠুন, বাস কন্ডাক্টরদের একনাগাড়ে চিৎকার, কালীঘাট, ভবানীপুর, ধরমতল্লা। খালি গাড়ি, খালি গাড়ি
সুধাদের এই জাফর শা রোডে দুচারটে ফেরিওয়ালা, ফেরিওয়ালিও ঢুকে পড়ে। কেউ টেনে টেনে হাঁকে, খাগড়াই বাসন– কেউ হাঁকে, চিনা সিঁদুর, তরল আলতা– কেউ হাঁকে পাউরুটি, বিস্কুট চড়া রঙের জমকালো শাড়ি-পরা, কপালে উল্কি-আঁকা, পশ্চিমা মধ্য তিরিশের যুবতী ফেরিওয়ালিরা কোমরে ঢেউ তুলে মরাল-গমনে চলতে চলতে মিষ্টি সুরেলা গলায় হেঁকে যায়, বেলোয়ারি চুড়ি লিবে গ– কেউ হাঁক পাড়ে, ঘুট্টি লিবে। গুল লিবে–
অন্যমনস্কর মতো রাস্তার নানারকম আওয়াজ শুনতে শুনতে আর দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে দিনগুলো কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়। সুধা মাঝে মাঝে এসে তাড়া দিয়েছে, সারাদিন ঘরে আটকে আছিস। যা না, একটু ঘুরে টুরে আয়। ভাল লাগবে। .
ঝুমাদের বাড়ি গিয়ে সেদিন যা যা ঘটেছিল, রামকেশব ঝিনুক সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন, সুধা আর হিরণকে সবই জানিয়েছে বিনয়। রামকেশবের ওপর ক্ষোভে রাগে ফেটে পড়েছিল দুজনে। সুধা জানে, ঝিনুকের জন্য নতুন করে মন খারাপ হয়ে আছে বিনয়ের। হৃদয়হীন বৃদ্ধটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার বুকের ভেতরকার ক্ষতস্থানটি রক্তাক্ত করে দিয়েছেন।
ছোটদি যে তাকে হাসিখুশি দেখতে চায়, বিনয় তা জানে। কিন্তু বাড়ির বাইরে কোথায় যাবে সে? এই সুবিশাল শহরে তার চেনাজানা মানুষ আর কটা? খুবই সামান্য। আত্মীয়-পরিজন অবশ্য আছে। সুনীতিদের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই নেই। সেখানে হেমনলিনী রয়েছেন। ঝুমাদের বাড়ি যাবার কথা ভাবাই যায় না। সেখানে রামকেশব আছেন। বিমল গাঙ্গুলিদের বাড়ি গিয়ে প্রথম দিনই যা দেখে এসেছে, তাতে দ্বিতীয়বার সেখানে যেতে মন সায় দেয় না। মন-খারাপটা আরও বহু গুণ বেড়ে যাবে। ছায়া-মায়ার কথা খেয়াল আছে তার। হিরণ আর আনন্দকে বলতে হবে, যদি মেয়ে দুটোর জন্য কিছু করে দিতে পারে।
এই তিন দিনে অবশ্য অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছে। শওকত আলি খান এ-বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। হিরণদের রাজদিয়ার প্রপার্টির সঙ্গে তাঁদের বাড়ি খান মঞ্জিল এক্সচেঞ্জ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইস্ট পাকিস্তানে চলে যেতে চান। দু সপ্তাহ সময় দিয়ে গেছে তাঁর লোক। এর ভেতর হিরণ যদি এক্সচেঞ্জের বন্দোবস্ত করে, শওকত সাহেবের হাতে অনেক খদ্দের আছে, পাকিস্তান থেকে হাজারে হাজারে মানুষ এপারে চলে আসছে, তাদের কারও সম্পত্তির সঙ্গে তিনি বাড়ি পালটাপালটি করে চলে যাবেন।
এক্সচেঞ্জের পর মুসলমানদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে ভীষণ আপত্তি ছিল সুধা আর হিরণের জেঠিমার। সুধাকে অতি কষ্টে রাজি করানো হয়েছে। সে বুঝেছে, এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলে পরে আপশোশের অন্ত থাকবে না। হিরণের জেঠিমা এলে তাকেও বোঝানো হবে। আশা করা যায়, শেষপর্যন্ত তিনিও গোঁ ধরে থাকবেন না।
শওকত আলির লোকটির সঙ্গে কথা বলার পর হিরণ আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি। তক্ষুনি পাটনায় দ্বারিক দত্তকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে। তিনি যেন অবিলম্বে কলকাতায় চলে আসেন।
.
আজ বেস্পতিবার। নটা বাজতে না বাজতেই অফিসে চলে গেছে হিরণ। উমা রান্নাঘরে খুটখাট করে কীসব করছে। হিরণ অফিসে বেরিয়ে গেলেই স্নান সেরে নেয় সুধা। সে এখন বাথরুমে।
বিনয় তার ঘরে শুয়ে শুয়ে আজকের খবরের কাগজটা পড়ছিল। ওধারে সুধাদের চানঘর থেকে ছর ছর করে কলের জল পড়ার শব্দ আসছে। এছাড়া বাড়িটা প্রায় নিঝুম।
আচমকা বাইরে থেকে যুগলের হাঁক ভেসে আসে, ছুটোবাবু, ছুটো দিদি, আমি আইয়া গ্যাছি। উমারে সদর দুয়ার খুলতে কন– নিচু গলায় কথা বলতে পারে না সে। যখনই আসে, চারদিক উচ্চকিত করে ডাকাডাকি করে।
উমা বোধহয় শুনতে পেয়েছিল। যাই বলে সে ত্বরিত পায়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল।
সেই যে ঝিনুকের খোঁজে সেদিন যুগলের সঙ্গে শিয়ালদা স্টেশনে গিয়েছিল, তারপর আর তার কথা খেয়াল ছিল না বিনয়ের। রামকেশব তাকে আমূল দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলেন। কাগজটা এক পাশে রেখে বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের প্যাসেজে আসতেই চোখে পড়ল সিঁড়ি বেয়ে উমার পেছন পেছন ওপরে উঠে আসছে যুগল। বিনয়কে দেখে হাসিমুখে বলল, হাসপাতাল থিকা পায়ের পট্টি (ব্যান্ডেজ) পালটাইয়া আইলাম। ডাক্তরবাবু কইছে, আর দুই বিষ্যদ্বার পর পট্টি বাতে (বাঁধতে) লাগব না। ঘাওখান (ঘাখানা) পুরা সাইরা যাইব।
জবরদখল কলোনি বসাতে গিয়ে মুকুন্দপুরের এক নৈশযুদ্ধে জমিদারের গুণ্ডাদের সড়কির ফলা যুগলের পা এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছিল। তখন থেকে লেকের ধারের পুরানো মিলিটারি হাসপাতলে ফি বেস্পতিবার পা ড্রেস করাতে আসে সে। সেখান থেকে সোজা সুধাদের বাড়ি।
বিনয় কিছু বলল না। অল্প হেসে যুগলকে সঙ্গে করে বাইরের ঘরে এসে একটা চেয়ারে বসল। প্রাক্তন মনিবের নাতি নাতনিদের সামনে চেয়ারে বসে না যুগল। আগের মতোই সে মেঝেতে বসে পড়ল। বিনয় লক্ষ করল, পা ভালই মুড়তে পারছে যুগল। কিছুদিন আগের কষ্টটা নেই বললেই হয়।
যুগল বলল, চিল্লাইয়া চাইর দিক ফাইড়া ফালাইলাম। আমার গলা হুনলেই তো ছুটোদিদি লৌড়াইয়া (দৌড়ে) আহে (আসে)। তেনি কি বাড়ি নাই?
যুগলকে দেখলে বিনয় খুব খুশি হয়। এর মধ্যে এমন একটা আপন-করা ভাব আছে যাতে ওকে ভাল না লেগে পারা যায় না।
বিনয় জানায়, সুধা বাথরুমে আছে। যুগলের ডাক নিশ্চয়ই তার কানে গেছে। চান হলেই এ ঘরে চলে আসবে।
হেই কন। এই বাড়িত আইয়া ছুটোদিদিরে না দেখলে মন খারাপ হইয়া যায়। যুগল একটু হাসল। তারপর গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঝিনুক বইনের কিছু খবর নি পাইলেন?
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, না
এইর ভিতরে থানায় গ্যাছিলেন?
ঝিনুকের সন্ধানে প্রায়ই যে বিনয় থানায় যায়, যুগল তা জানে। বিনয় বলল, কদিন যাওয়া হয়নি। খবর থাকলে পুলিশ থেকে জানিয়ে দিত। ছোটদির বাড়ির ঠিকানা থানায় দেওয়া আছে।
বিষাদ-মাখা মুখে চুপচাপ বসে থাকে যুগল। এই নিরক্ষর যুবকটি চূড়ান্ত আশাবাদী। তার ধারণা ছিল, নিশ্চয়ই ঝিনুককে এই বিশাল মহানগরের জনারণ্যের ভেতর থেকে খুঁজে বার করা যাবে। বিনয়ের সঙ্গে দেখা হলে কত ভাবেই না সে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু আজ মনে হল, তার বিশ্বাস এবং আশার ভিতটা যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে।
যুগল বলল, মুকুন্দপুরে আমাগো রাইজদার ম্যালা (অনেক) মানুষ আছে। হেরা (তারা) নানান কামকাইজে রোজই কইলকাতায় আহে (আসে)। তাগো কইয়া রাখছি, ঝিনুক বইনেরে দ্যাখলে য্যান (যেন) মুকুন্দপুরে লইয়া যায়। কিন্তুক কেও হেরে দ্যাখে নাই। আমিও যে কইলকাতায় আহি, দুই চৌখ মেইলা (মেলে) হেরে (তাকে) বিচারেই (খুঁজি)। কত মানুষ দেখি, খালি ঝিনুক বইনই বাদ। কী যে হইব তার বুক তোলপাড় করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ঝিনুককে যে পাওয়া যাবেই, এমন কথা তার মুখ থেকে আজ আর বেরুল না।
ঝুমাদের বাড়ি থেকে আসার পর তিনটে দিন মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে বিনয়ের। ঝিনুকের জন্য মানসিক চাপ আর নিতে পারছে না সে। তাই একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, তোমাদের মুকুন্দপুরের খবর কী?
তাদের কলোনির কথা উঠলেই যুগল একেবারে অন্য মানুষ। তার সারা শরীর যেন চনচন করতে থাকে। তখন তার কী যে উদ্দীপনা! জঙ্গল কেটে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালিয়ে, নতুন এক জনপদ গড়ে তুলছে, সে-জন্য উন্মাদনার শেষ নেই।
ঝিনুকের জন্য ক্লেশ আর বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগল যুগলের। তারপর বলল, হেই ব্যাপারে আইজ আপনের লগে ম্যালা (অনেক) কথা আছে।
ঠিক আছে। বল–
বিলের কিনারে আলিসান জঙ্গলের কিছুটা কাইটা আমরা কুলোনি বহাইছি। হে তো আপনে দেইখাই আইছেন।
বিনয় সায় দেয়, হা–
যুগল বলে, হের পরেও তিন ডবল জঙ্গল রইছে। সাপখোেপ, শুয়োর, বাঘডাসার বাসা। চাইর দিন হইল আরও জঙ্গল আমরা সাফা করতে শুরু করছি।
বিনয়ের মনে পড়ল, যুগলের একমাত্র স্বপ্ন এবং সংকল্প, মুকুন্দপুরের অবশিষ্ট বনভূমি নির্মূল করে কলোনির বিস্তার ঘটাবে। ভাটির দেশ এবং রাজদিয়া অঞ্চলের মানুষজন খুঁজে খুঁজে এনে পূর্ব বাংলাকে সীমান্তের এপারে নতুন করে নির্মাণ করবে।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ বাকি জঙ্গলটা কাটছ কেন? কলোনিতে লোকজন কি বেড়েছে?
ম্যালা, ম্যালা (অনেক, অনেক)। যুগল জানায়, রাজদিয়া, ডাকাইতা পাড়া, গিরিগুঞ্জ, সুজনগুঞ্জ ইত্যাদি এলাকার যে-সব শরণার্থী কলকাতায় চলে এসেছিল, মুকুন্দপুর কলোনির খবর পেয়ে তারা দলে দলে হাজির হচ্ছে। কম করে পঞ্চাশ ষাট ঘর তো হবেই। কলোনিতে আগে এসে যারা থিতু হয়ে বসেছে তাদের বাড়িঘর তো আর রাজপ্রাসাদ নয় যে এত লোকজনকে ভাগাভাগি করে নিয়ে জায়গা দেবে। ফলে ওই উদ্বাস্তুরা খোলা আকাশের তলায় পড়ে আছে। দিনের বেলা একরকম কেটে যায়, কিন্তু হিমঋতুর রাতগুলো অসহ্য। খুব তাড়াতাড়ি ঘর তুলতে না পারলে বউ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শীতেই ওরা শেষ হয়ে যাবে। তাই জঙ্গলের যে অংশটা এখনও টিকে আছে তা কেটে না ফেলে উপায় নেই।
যুগল বলতে লাগল, ভুরে (ভোরে) সূর্য্য উঠনের লগে লগে কুলোনির পুরুষমানুষগুলান জঙ্গলে গিয়া সান্ধে (ঢোকে)। যতক্ষণ রইদ (রোদ) থাকে, কুড়াল আর দাও (দা) দিয়া বড় বড় গাছ আর ছুটো ছুটো ঝোপ কাটন (কাটা) চলে। এইর ভিতরে অনেকখানি জাগা (জায়গা) সাফা কইরা ফালান হইছে।
চকিতের জন্য বিনয়ের মনে হল, যেভাবে হাজারে হাজারে মানুষ পাকিস্তান থেকে চলে আসছে, পশ্চিম বাংলার কোথাও আর বনজঙ্গল এবং জলাভূমি অবশিষ্ট থাকবে না। জলা বুজিয়ে, বন কেটে গড়ে উঠবে উদ্বাস্তুদের বাসস্থান। ছিন্নমূল মানুষদের জন্য কলোনির পর কলোনি।
যুগল জিজ্ঞেস করে, আইজ আপনের কুনো জবোরি কাম আছে?
বিনয় অবাক হল, না, কেন?
তয় (তবে) আমার লগে মুকুন্দপুরে লন (চলুন)।
মুকুন্দপুরে যাব! কেন?
যুগল জানালো, এর আগে বিনয় যখন মুকুন্দপুরে গিয়েছিল, তখনই ঠিক করা হয়েছে কলোনির পাশের জঙ্গল সাফ হলে তাকে সাত কাঠা জমি দেওয়া হবে। মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি হরনাথ কুণ্ডু পাকা খাতায় তা লিখেও রেখেছিল। এখন জমি বেরিয়েছে। বিনয় গিয়ে, যে জায়গা পছন্দ করবে, সেটাই তাকে দেওয়া হবে। যুগল তো বটেই, মুকুন্দপুরবাসীদের সনির্বন্ধ আর্জি–হেমকর্তার নাতি কষ্ট করে একবার সেখানে গিয়ে জমি বেছে নিক। তারা বিশেষভাবে যুগলকে, বলে দিয়েছে, আজই যেন বিনয়কে মুকুন্দপুরে নিয়ে যায়।
বিনয়ের একটু মজাই লাগল। তার বাবা কলকাতার বাড়ি বেচে তাকে একরকম রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেছেন। যদিও সুধারা আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু চিরকাল তো তার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব নয়। এই বিশাল মহানগরে নিজের বলতে এক ইঞ্চি জায়গা তার নেই। আর মুকুন্দপুরের মানুষজন, বিশেষ করে যুগল, সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, তার সঙ্গে রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই, কতকাল আগে হেমনাথের বাড়িতে কামলা খাটত, সে কি না তার জন্য জমির ব্যবস্থা করে ছুটে এসেছে!
বিনয়ের বুকের ভেতরটা গভীর আবেগে তোলপাড় হয়ে যায়। যাঁর রক্ত আজন্ম তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে সেই অবনীমোহন তাঁর জীবনের পরিধি থেকে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যুগল তাকে কত কাছে টেনে নিয়েছে। অবনীমোহনের দিক থেকে অনেক কিছু হারিয়েছে বিনয়, কিন্তু যুগল তার দুহাত ভরে দিয়েছে। তার আগ্রহ, তার প্রগাঢ় ভালবাসা, তার নিবিড় আন্তরিকতা তুচ্ছ করার মতো নয়। কোনওদিনই হয়তো মুকুন্দপুরে থাকা হবে না, তবু বিনয় বলল, তোমাদের ওই জমি আমি নেব। হাতে এখন কাজ নেই। চল, তোমার সঙ্গে মুকুন্দপুরেই ঘুরে আসি।
যুগলের চোখেমুখে আলোর ঝলক খেলে যায়। দুই হাত মুঠো করে শরীরটা বাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে খুশিতে শিশুর মতো কুটিপাটি হতে থাকে যুগল, আপনে আমাগো কাছে থাকবেন কী আনন্দ যে হইতে আছে ছুটোবাবু!
খবরের কাগজে চাকরি হয়েছে। কলকাতা থেকে অত দূরে বাড়িঘর বানিয়ে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সে-কথা বলা গেল না। যুগল দুঃখ পাবে। বিনয় হাসিমুখে চুপ করে থাকে।
যুগল এবার বলে, আমার আর-একখান কথা আছে ছুটোবাবু
বল
আশু মাস্টারমশয়ের লগে আইজই একবার দেখা করতে চাই
মাঝখানে কটা দিন যা যা ঘটে গেছে তাতে আশু দত্তর কথা ঘুণাক্ষরেও মনে পড়েনি বিনয়ের। অথচ শিয়ালদা স্টেশন থেকে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে বলে এসেছিল, খুব শিগগিরই একদিন গিয়ে দেখা করবে। কথা রাখা যায়নি। ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে।
বিনয় বলল, ঠিক আছে। তোমার সঙ্গে মুকুন্দপুরে তো যাচ্ছিই। যাবার পথে আশু স্যারের ওখানে হয়ে যাব। কিন্তু
কী?
তুমি আশু স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছ কেন? কোনও দরকার আছে?
জবর দরকার ছুটোবাবু।
প্রথমটা বিনয় ভেবেছিল আশু দত্ত দেশের মানুষ। সেদিন রিফিউজি স্পেশাল থেকে সবে শিয়ালদায় নেমেছেন। ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। ভাল করে কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করে হয়তো পাকিস্তানের হালচাল জানতে চায় যুগল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে।
বিনয় জানতে চাইল, কীরকম?
বিপুল উৎসাহে যুগল বলতে থাকে, আপনেরে কইছিলাম না, মুকুন্দপুরে একখান ইস্কুল বমু (বসাব)। মনে আছে?
বিনয় সোজা হয়ে বসে, আছে।
দ্যাশে থাকলে কুননা চিন্তা আছিল না। কত যে খাল বিল আর নদী হের (তার) ল্যাখাজোখা নাই। তার উপুর মাইলের পর মাইল চাষের জমিন। এক মাথায় খাড়ইলে আর-এক মাথা দেখা যায় না। হেইখানে মাছ ধর, ধান রোও (বোনো), পাট বরাও, রবিশস্যের খন্দে কলই সউরষা মুং (মুগ) মুসৈর বরাও। জনম কাইটা যাইব। কিন্তু এইখানে? জল কই? মরা মরা নদী, কয়টা খাল, আর কয়টা বিল আছে হাতে গইন্যা কওন যায়। এইখানকার খাল বিলের উপর ভরসা কইরা কি বাচন যায়? অন্যের জমিনে যে কাম করুম হের উপায় নাই। মালিকগো বান্ধা কিষান আছে। এক নাগাড়ে বলতে বলতে হাঁপিয়ে পড়েছিল যুগল। দম নিয়ে ফের সে শুরু করে, আমাগো জনম তো হাবিজাবি টাণ্টামাষ্ঠা কইরা (উঞ্ছবৃত্তি করে) কুনোরকমে কাইটা যাইব। কিন্তু আমাগো পোলামাইয়াগো?।
যুগল কী ইঙ্গিত দিচ্ছে মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছে বিনয়। সে উন্মুখ হয়ে থাকে।
যুগল বলে, চাকরি বাকরি ছাড়া ইন্ডিয়ায় আমাগো লাখান রিফুজগো গতি নাই, কিন্তুক চাকরি তো মুখের কথা খসাইলে হয় না। হের লেইগা বিদ্যা চাই। প্যাটে কালির অক্ষর সান্ধাইতে (ঢোকাতে) হইব। হে তো অ্যামনে অ্যামনে হয় না। ইস্কুল বহাইতে (বসাতে) হইব। আশু মাস্টমশয় দ্যাশ ছাইড়া আহনে (আসায়) আন্ধারে আলোর ইটু রেখ (অন্ধকারে আলোর রেখা) দেখতে পাইতে আছি। তেনি যদিন মুকুন্দপুরে ইস্কুল বহান (বসান), কুলোনির পোলাপানগুলান মানুষ হইব।
মুগ্ধ বিস্ময়ে যুগলের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। অক্ষরপরিচয়হীন এই যুবকটি একসময় ছিল খুবই আলাভোলা ধরনের। খাল বিল নদী মাছ পাখি ধানের খেত পাটের খেত-এ-সবের বাইরে অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না। সীমান্তের এপারে এসে সে বুঝেছে, লেখাপড়া ছাড়া উদ্বাস্তুদের ছেলে-মেয়েদের গতি নেই। শিক্ষাই হল আসল শক্তি। সেটা ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না, একেবারে শেষ হয়ে যাবে।
মুকুন্দপুরে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা আগেও বিনয়কে জানিয়েছিল যুগল। সেজন্য পছন্দমতো মাস্টার মশায়ের খোঁজ করছিল সে। কিন্তু তেমন কারওকে পাচ্ছিল না। ফলে কিছুটা হতাশই হয়ে পড়েছিল। আশু দত্তকে দেখার পর তার স্বপ্নটা নতুন করে ফিরে এসেছে।
যুগল এবার উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, আপনের কী মনে লয় (হয়) ছুটোবাবু, আশু মাস্টরমশয় কি মুকুন্দপুরে ইস্কুল বহাইবেন (বসাবেন)?
বিনয় লক্ষ করল, যুগলের চোখেমুখে বিপুল উদ্দীপনা। একটু চিন্তা করে বলল, ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখ।
রাইজদায় তো দেখছি, লিখাপড়া, ইস্কুল আর ছাত্র, দিনরাইত এই লইয়াই থাকতেন। আপনে তেনির কাছে পড়তেন। কী ভালাটাই না আপনেরে বাসেন। হের উপুর হ্যামকর্তার নাতি আপনে। যদিন তেনিরে ইটু বুঝাইয়া কন–
ঠিক আছে, ওঁকে বলব। তারপর দেখা যাক উনি কী করেন–
মিনতির সুরে যুগল বলতে লাগল, য্যামন কইরা পারেন মাস্টর মশয়রে রাজি করাইতেই হইব ছুটোবাবু। আপনে ত্যামন কইরা ধরলে তেনি না কইতে পারবেন না।
যুগলের ব্যাগ্রতা বিনয়কে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। বলল, আচ্ছা আচ্ছা। আগে তো ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
সুধা ঘরে এসে ঢুকল। সবে চান সেরেছে। পরনে পাটভাঙা শাড়ি, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। হাতে একটা ট্রেতে তিন কাপ চা আর মিষ্টির প্লেট। এক কাপ চা আর মিষ্টি যুগলের জন্য। বাকি দুকাপ চা তার এবং বিনয়ের। ট্রেটা টেবলে নামিয়ে রেখে একটা বেতের সোফায় বসতে বসতে সুধা হাসিমুখে যুগলকে বলল, চানঘর থেকে তোমার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। নাও, চা খাও
যুগল একমুখ হাসল, ছুটোদিদিরে কিছু কইতে হয় না। আমার পরানটা যে অহন চা চা করতে আছিল, ঠিক ট্যার পাইয়া গ্যাছে। চা বানাইয়া নিজের হাতে লইয়া আইছে। এ-বাড়িতে তার কোনওরকম সংকোচ নেই। ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলে নিল সে।
বিনয় এবং সুধাও তাদের কাপ তুলে নিয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়ে যুগলদের খোঁজখবর নিতে লাগল সুধা। পাখি এবং তার ছেলেরা কেমন আছে, মুকুন্দপুরের বাসিন্দারা কে কী করছে, রাজদিয়া অঞ্চলের আরও মানুষজন সেখানে এসেছে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
চা খাওয়া হয়ে গেলে সুধা উঠে পড়ল, এক্ষুনি ধোপা আসবে। ময়লা কাপড়চোপড়ের লিস্টটা করে ফেলি।
বিনয় জানে, কাছাকাছি এক ধোপাবাড়ির সঙ্গে সুধাদের মাসকাবারি ব্যবস্থা আছে। ফি বেস্পতিবার ধোপা এসে সারা সপ্তাহের ময়লা জামাকাপড় নিয়ে যায়। সুধা একটা খাতায় তা লিখে রাখে। মাসের শেষে হিসেব করে টাকা মিটিয়ে দেয়। সে যখন দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, যুগল ডাকল, ছুটোদিদি
সুধা থেমে গেল, কিছু বলবে?
আপনের রান্ধন (রায়া) কদ্দূর?
হয়ে গেছে।
তাইলে আমারে আর ছুটোবাবুরে যত তরাতরি পারেন, খাইতে দ্যান।
সুধা অবাক হল, কেন বল তো? এত তাড়া কীসের?
যুগল বলল, ছুটোবাবুরে লইয়া মুকুন্দপুরে যামু। আশু দত্তর কথাটা অবশ্য সে জানালো না।
ভাইয়ের দিকে ফিরে সুধা জিজ্ঞেস করল, আজ যে মুকুন্দপুর যাবি, আগে বলিসনি তো?
বিনয় বলল, আগে কী জানতাম যে যাব? তুই যখন চান করছিলি যুগল একটা সুখবর দিল।
কী সুখবর রে?
সেবার যখন মুকুন্দপুরে যাই, ওরা বলেছিল, বাকি জঙ্গল কাটার পর যে-জমি বেরুবে তার থেকে আমাকে সাত কাঠা দেবে। জঙ্গল সাফ হয়েছে। জমি বুঝিয়ে দেবার জন্যে যুগল আমাকে নিতে এসেছে।
আশু দত্তর সঙ্গে দেখা করার কথাটা বিনয়ও বলল না। সেই প্রসঙ্গ তুললে অনেক প্রশ্নের জবাব। দিতে হবে। এখন আর বকবক করতে ভাল লাগছে না। মুকুন্দপুর থেকে ফিরে এসে সুধা এবং হিরণকে সব জানিয়ে দেবে।
ঝুমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পর কটা দিন ঘরের কোণে পড়ে আছে বিনয়। চুপচাপ, বিষণ্ণ। সুধা ভাবল, যুগলের সঙ্গে গেলে মন হালকা হবে ছেলেটার, বিষাদের ভাবটা কেটে যাবে। লঘু সুরে বলল, তুই তো হলে জমিদার হয়ে যাচ্ছিস?
বিনয় হাসল, তাই তো দেখছি।
কখন ফিরবি?
সুধার প্রশ্নটার উত্তর দিল যুগল, আগে তো ছুটোবাবু মুকুন্দপুর পৌঁছাউক, হের পর তো ফিরনের কথা। রাইত বেশি হইলে ছাড়ুম না কিলাম (কিন্তু)। আমাগো উইখানেই রাইখা দিমু। না ফিরলে চিন্তা কইরেন না।
সুধা আর দাঁড়ালো না। ব্যস্তভাবে ভেতর দিকে চলে গেল।
.
১৩.
আধ ঘণ্টা পর খাওয়াদাওয়া সেরে যুগলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনয়। ধুতি আর শার্টের ওপর ফুল-হাতা সোয়েটার পরে নিয়েছে সে। সন্ধের পর আজকাল জাঁকিয়ে শীত পড়ছে। তাই একটা গরম চাদরও সঙ্গে নিল।
টালিগঞ্জ থেকে বাস ধরে কালীঘাট ট্রাম ডিপোর স্টপেজে যুগলকে নিয়ে নেমে পড়ল বিনয়। রাস্তা পেরিয়ে কালী টেম্পল রোড আর সদানন্দ রোড হয়ে একটু ঘুরপথে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছতে তিন চার মিনিটের বেশি লাগল না।
মাসখানেক পেরিয়ে গেছে পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে এসেছে বিনয়। এর মধ্যে নিরুদ্দেশ ঝিনুককে পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করতে করতে এই বিশাল মহানগরের প্রচুর রাস্তাঘাট এবং অলিগলি চিনে ফেলেছে। তাছাড়া কোথাও একবার গেলে সহজে সেই জায়গাটা সে ভুলে যায় না।
সেদিন রাত্রিবেলা আশু দত্তকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে দিয়েছিল বিনয়। তখন ছিল গাঢ় কুয়াশা আর অন্ধকার। যদিও চারদিকে টিম টিম করে ইলেকট্রিক আলল, গ্যাসবাতি, হেরিকেন কী কেরোসিনের কুপি জ্বলছিল, তবু সব ঝাপসা ঝাপসা। বাড়িঘর ভুতুড়ে।
এখন দিনের আলোয় পাক খেতে খেতে এগিয়ে যাওয়া ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের প্রায় শেষ মাথায় সন্তোষ নাগদের ২৭ বি বাড়িটা খুঁজে বার করতে আদৌ কোনও অসুবিধা হল না। এমনকি হদিস জানার জন্য রাস্তার কোনও লোককে জিজ্ঞেসও করতে হয়নি।
সেকেলে, পলেস্তারা-খসা, নোনা-লাগা বাড়িটার সদর দরজা বন্ধ ছিল। কড়া নাড়তে সেদিনের সেই কিশোরীটি দরজা খুলে দিল। সন্তোষ নাগের মেয়ে। বিনয়কে চিনতে পেরেছে সে। তার মুখটা আলো হয়ে উঠল। বলল, আপনি কদিন আগে জেঠু আর ঠাকুমাকে নিয়ে এসেছিলেন না?
হাসিমুখে বিনয় বলল, হ্যাঁ। স্যার কি বাড়িতে আছেন?
আছেন। আসুন
মেয়েটির সঙ্গে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বিনয় জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?
সবিতা।
কোন ক্লাসে পড়?
এইটে। মহারানী গার্লস হাইস্কুলে।
আজ তো বেস্পতিবার। স্কুল যাওনি?
না। আজ আমাদের স্কুলের ফাউন্ডনেশন ডে। তাই ছুটি!
সবিতা মেয়েটা বেশ সপ্রতিভ। লেশমাত্র জড়তা নেই। বিনয়ের খুব ভাল লাগল তাকে।
বাড়ির বাইরেটা যেমনই হোক, ভেতরটা কিন্তু বেশ পরিষ্কার। সদর দরজার গা থেকেই বাঁধানো উঠোন। দুএক জায়গায় সিমেন্ট সামান্য উঠে গেলেও তকতক করছে। সেটার এক পাশে কলতলা এবং জোড়া পায়খানা।
একতলায় খানতিনেক ঘর এবং এক ফালি রান্নাঘর চোখে পড়ল বিনয়ের। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলাটাও নিচের তলারই মতো। সারি সারি শোবার ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি। বাড়তির মধ্যে ওপরের ঘরগুলোর সামনে ঢালাই লোহার রেলিং-দেওয়া চওড়া বারান্দা, নিচে যা নেই।
বাড়িটা প্রায় নিঝুম। পায়ের শব্দে একজন মাঝবয়সী মহিলা আর একজন বৃদ্ধা দোতলার কোনও ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। কৌতূহলী চোখে বিনয়দের দেখতে লাগল।
একতলার রান্নাঘরে সন্তোষের স্ত্রী খুব সম্ভব বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছিলেন। মহিলাকে আগের দিনই দেখে গেছে বিনয়। তাই চিনতে পারল।
উঠোন থেকেই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে সবিতা, মা, জেঠু, দেখ কারা এসেছেন–
ঘোমটা সিঁথি পর্যন্ত টেনে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সন্তোষ নাগের স্ত্রী। কোণের দিকের একটা ঘর থেকে ততক্ষণে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন আশু দত্ত। প্রাক্তন ছাত্রটিকে দেখে খুব খুশি। বললেন, আয়, আয়-যে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন সেখানেই বিনয়দের নিয়ে গেলেন। সবিতা সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
ঘরের একধারের দেওয়াল ঘেঁষে বড় তক্তপোশে বিছানা পাতা। আর-এক দিকের দেওয়ালে কাঠের তাক বসিয়ে আয়না চিরুনি ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা। তিন চারটে বেতের চেয়ারও রয়েছে। একটা টেবলও।
আশু দত্ত খাটের ধারে বসতে বসতে বিনয়দের বললেন, বোস্
তাঁকে প্রণাম করে একটা চেয়ারে বসল বিনয়। যথারীতি যুগল মেঝেতে বসেছে।
অনুযোগের সুরে আশু দত্ত এবার বিনয়কে বললেন, সেদিন রাত্তিরে আমাদের এখানে দিয়ে সেই যে চলে গেলি আর কোনও খবর নেই। ভাবলাম বুঝি ভুলেই গেছিস।
রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েরা হুবহু এইভাবেই তাদের যাবতীয় অভিমান জানিয়েছিল।
মাঝখানে বিনয়ের জীবনে যা যা ঘটে গেছে সে-সব জোড়া লাগালে একখানা মহাভারত হয়ে যায়। সবিস্তার তা শুনিয়ে বৃদ্ধ মাস্টার মশাইটিকে ভারাক্রান্ত করতে ইচ্ছা হল না। বিনয় শুধু জানালো, আশু দত্তকে সে কি ভুলতে পারে? নানা সমস্যায় এমনই জড়িয়ে পড়েছিল যে এসে খোঁজ নিতে পারেনি। জিজ্ঞেস করল, ঠাকুমা কেমন আছেন?
ঠাকুমা অর্থাৎ আশু দত্তর মা। তিনি বললেন, ওই একইরকম। পাশের ঘরে শুয়ে আছে। কীভাবে যে বেঁচে রয়েছে। যে কোনও সময় প্রাণটা বেরিয়ে যাবে।
বিনয়েরও তেমনই ধারণা। জড়পিণ্ডের মতো যে বৃদ্ধাটিকে সেদিন শিয়ালদায় দেখেছে তার আয়ু যে ফুরিয়ে এসেছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। বলল, সন্তোষবাবু আর তার অন্য ছেলেমেয়েদের তোত দেখছি না।
আশু দত্ত বললেন, সন্তোষের অফিস আছে না? কখন বেরিয়ে গেছে। তিনি আরও জানালেন, সন্তোষের আর দুটি ছেলেমেয়ে সবিতাদের স্কুলে পড়ে না। তাদের অন্য স্কুল। খেয়েদেয়ে দশটায় তারা চলে গেছে।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিনয় বলল, এই কদিন কি বাড়িতেই ছিলেন স্যার?
আশু দত্ত বললেন, পায়রার খোপের মতো এই ঘরের ভেতর কতক্ষণ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়। তাছাড়া
প্রশ্ন না করে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
আশু দত্ত পুরানো ছাত্রকে লক্ষ করছিলেন। বললেন, তুই তো জানিসই, মাত্র এক হাজার টাকা ছাড়া পাকিস্তান থেকে এপারে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। রোজগারপত্তরের কিছু একটা চেষ্টা তো করতে হবে।
সেদিন রাতে শিয়ালদা থেকে আসার সময় তার দুর্ভাবনার কথা বলেছিলেন আশু দত্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আয়ের একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। নইলে মহা বিপদ। বিনয় বলল, এই তো সবে দেশ থেকে এলেন। এর মধ্যে কাজকর্মের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন?
আশু দত্ত বিশদভাবে জানালেন, মাসতুতো ভাই সন্তোষ মাঝারি ধরনের একটা চাকরি করে। কত আর মাইনে! এদিকে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও ওর তিন ছেলেমেয়ে। রেশনে চাল গম চিনির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দিনকে দিন বাজার আগুন হয়ে উঠছে। মাছ মাংস আনাজপাতিতে হাত ঠেকানো যায় না। খরচের কী অন্ত আছে? বাড়িভাড়া, খাওয়ার খরচ। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ। ট্রাম ভাড়া, বাস ভাড়া। তার ওপর সবিতা তেরো পেরিয়ে চোদ্দয় পা দিয়েছে। বড় জোর আর তিন চার বছর। তারপর মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে।
ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এই বাড়িটায় যুদ্ধ লাগার অনেক আগে থেকেই আছে সন্তোষরা। পুরো একতলাটা নিয়ে। দোতলায় থাকে বাড়িওলারা। তারা মানুষ ভালই। যে ভাড়ায় সন্তোষরা ঢুকেছিল এখনও মাসে মাসে তাই দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িওলা ভাড়া বাড়ানোর কথা মুখ ফুটে আজ পর্যন্ত বলেনি। এটুকুই যা বাঁচোয়া।
তবে দুবছর আগেও এই রাস্তার বেশির ভাগ বাড়িতে অনেক ঘর ফাঁকা পড়ে থাকত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে মানুষের ঢল নামার পর কোনও বাড়িই আর খালি নেই। মওকা বুঝে বাড়িওলারা ভাড়ার মাত্রা দ্বিগুণ, তিনগুণ করে দিয়েছে। সন্তোষদের বাড়িওলা কতদিন নির্লোভ মহাপুরুষ হয়ে থাকবে, ঠিক নেই।
আশু দত্ত বলতে লাগলেন, এই অবস্থায় আমরা এসে পড়েছি। সন্তোষরা আমাদের শেলটার দিয়েছে। কিন্তু এটা তো বেশিদিন চলতে পারে না। ওদের কথাও তো ভাবতে হবে।
শুনতে শুনতে রামরতনের স্ত্রী, বাসন্তী, ছায়া আর মায়ার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বিনয়ের। হুবহু একই চিত্র। একই পরিস্থিতি। তফাতের মধ্যে আশু দত্তরা যথেষ্ট আদর যত্নে আছেন। রামরতনের পরিবারের জন্য শুধুই লাঞ্ছনা, অসম্মান।
আশু দত্ত থামেননি, বুঝলি বিনু, একদিন কালীঘাট আর চেতলার অনেকগুলো স্কুল ঘুরলাম। হেড মাস্টার মশাইদের সঙ্গে দেখা করে বললাম, রাজদিয়া হাইস্কুলে চল্লিশ বছর পড়ানোর এক্সপিরিয়েন্স আছে। শয়ে শয়ে ছাত্র আমার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। আমি একজন ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া এম এ। কপর্দকশূন্য হয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছি। যদি আমাকে একটা কাজ দেওয়া হয়, বেঁচে যাব। সব শুনে হেডমাস্টার মশাইরা অনেক সহানুভূতির কথা বললেন। চা খাওয়ালেন। সেই সঙ্গে জানালেন, আপাতত কোনও ভ্যাকেন্সি নেই। তাছাড়া আমার বয়েসটাও অনেক বেশি হয়ে গেছে। নতুন চাকরি পাওয়ার পক্ষে সেটাও বড় বাধা। তবু স্কুলের গভর্নিং বডিকে বলবেন, স্পেশাল কেস হিসেবে যদি কিছু করা যায়। মাঝে মাঝে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন। একটু থেমে বিমর্ষ মুখে ফের শুরু করেন, আশার কোনও লক্ষণ দেখি না। তবে সন্তোষ আমার জন্যে প্রাইভেট টিউশনের খোঁজ করছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্র পড়িয়ে কোনওদিন তো টাকা পয়সা নিইনি। কী জানি, শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়তো নিতে হবে।
এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি যুগল। মেঝেতে বিনয়ের কাছাকাছি নীরবে বসে ছিল। এবার আঙুল দিয়ে বিনয়ের পায়ে আলতো একটা ঠেলা দিল। বিনয় তার দিকে তাকাতেই মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে চোখের একটা ইঙ্গিত করল।
যুগলের সংকেতটা বুঝে নেয় বিনয়। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, স্যার, যুগল আপনাকে কিছু বলতে চায়।
পুরোনো ছাত্রর সঙ্গে নানা কথাবার্তায় আশু দত্ত এতটাই মগ্ন ছিলেন যে যুগলের দিকে নজর ছিল না। এবার তার সম্বন্ধে মনোযোগী হলেন, তুই আগরপাড়ায় থাকিস না?
সেদিন শিয়ালদার প্রচণ্ড ভিড়ে, তুমুল হট্টগোলে আগরপাড়ার কথাটা একবারই বলেছিল বিনয়। সেটা ভুলে যাননি আশু দত্ত। বেশ অবাক হল যুগল। বলল, ঠিক আগরপাড়ায় না। ইস্টিশানে লাইমা পুবে দুই মাইল হাটলে মুকুন্দপুর। আমি হেইখানে থাকি মাস্টর মশয়–
সেদিনও তোকে বিনুর সঙ্গে দেখেছি। আজও তার সঙ্গে এসেছিস। রোজই তুই অতদূর থেকে বিনুর কাছে আসিস না কি?
রোজ নয়, ফি বেস্পতিবার কী কারণে তাকে কলকাতায় আসতে হয় এবং তারপর কোথায় বিনয়ের সঙ্গে দেখা করে, জানিয়ে দিল যুগল। খুব সংক্ষেপে।
আশু দত্ত বললেন, কী বলতে এসেছিস, এবার শোনা যাক–
যুগল বিনয়ের দিকে তাকায়, আপনেই কন ছুটোবাবু। আমি কি মাস্টরমশয়ের লাখান পণ্ডিত মাইনষেরে গুছাইয়া হগল কইতে পারি?
বিনয় একটু হাসল। তারপর দেশভাগের পর যুগল পশ্চিম বাংলায় এসে কীভাবে বন জঙ্গল সাফ করে মুকুন্দপুরে জবরদখল কলোনি বসিয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে থাকে। কাজটা মসৃণভাবে হয়নি। যে জমিতে তারা উপনিবেশ গড়ে তুলেছে তার মালিক ওদের উৎখাত করার জন্য দিন নেই রাত নেই, যখন তখন হানাদার পাঠাচ্ছে। যুগল এবং তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সশস্ত্র বাহিনীর প্রায়ই লড়াই বাধে। যুগলদের অদম্য জেদ, একবার তারা পাকিস্তানে ভিটেমাটি খুইয়ে এসেছে। মুকুন্দপুরের নতুন বাসস্থানের দখল কিছুতেই ছাড়বে না। এর জন্য দরকার হলে আমরণ লড়াই চালিয়ে যাবে।
বিনয় আরও জানায়, মানুষের বাসভূমি শুধু তো কয়েকটা বাড়িঘরের সমষ্টি নয়। তার জন্য আরও অনেক কিছু দরকার। স্কুল, হাসপাতাল, শিক্ষিত মানুষ। যুগলের স্বপ্ন, মুকুন্দপুরে রাজদিয়ার মতো একটা জনপদ গড়ে তোলা। শিয়ালদা স্টেশন, রিফিউজি ক্যাম্প ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে রাজদিয়া অঞ্চলের প্রচুর মানুষজন নিয়ে সেখানে জড়ো করেছে সে। এখন দরকার একটা স্কুলের। কিছুদিন ধরেই যুগল এমন একজন নিঃস্বার্থ মাস্টার মশায়ের সন্ধান করে বেড়াচ্ছিল যিনি মুকুন্দপুরে স্কুল বসাবেন। ছিন্নমূল মানুষদের কলোনিতে ছড়িয়ে দেবেন শিক্ষার দিব্য বিভা। আশু দত্তকে দেখার পর থেকে যুগলের মনে হয়েছে, এতদিনে তার ইচ্ছাপূরণ হতেও পারে।
শুনতে শুনতে আশু দত্তর দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল। হেমনাথের বাড়ির এক কামলা, অক্ষরপরিচয়হীন, দেশে থাকতে যে ধান বুনত, সর্ষে কলাই রুইত, পাট জাগ দিত, খাল বিল নদীতে মাছ ধরে বেড়াত, সে যে এমন বড় আকারে ভাবতে পারে, পূর্ব বাংলার এক স্বপ্নবৎ জনপদকে পশ্চিম বাংলার এক প্রান্তে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়–সব শোনার পরও যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। ব্যগ্র সুরে বললেন, তোদের কলোনিতে একদিন আমাকে নিয়ে যাবি যুগল?
এই সুযোগটা হাতছাড়া করল না যুগল, অন্য দিন না, আইজই আপনেরে লইয়া যাইতে চাই। বিনয়কে দেখিয়ে বলল, ছুটোবাবুও আমার লগে যাইব। না কইরেন না মাস্টর মশয়।
সামান্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন আশু দত্ত। সন্তোষ তাঁদের আশ্রয়দাতা। তাঁকে না জানিয়ে হুট করে যুগলদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়াটা কী ঠিক হবে?
যুগল বলতে লাগল, মুকুন্দপুরে গ্যালে আপনের বড় ভালা লাগব। দ্যাশের ম্যালা (অনেক) মাইনষের লগে দেখা হইব। আপনের কথা বেবাকরে (সবাইকে) কইছি। হেরা নিজের চৌখে আপনেরে দ্যাখলে কী আনন্দ যে পাইব, মুখে কইয়া কতটুক আর বুঝাইতে পারুম?
যুগলের ব্যাকুলতা আশু দত্তকে ভেতরে ভেতরে ঝাঁকি দিচ্ছিল। তিনি বললেন, কিন্তু মুকুন্দপুর তো অনেক দূরের পথ।
কদ্দুর আর। আধা ঘণ্টার ভিতরে বাইর হইলে সন্ধ্যার পর পর ছুটোবাবুর লগে ফিরা আইতে পারবেন। যদিন সাহস দ্যান, একখান কথা কই।
যুগলের এত আগ্রহ, এমন আন্তরিকতা হেলাফেলার বস্তু নয়। সস্নেহে হেসে আশু দত্ত বললেন, ঠিক আছে, বল
ছুটোবাবুরে কইতে আছিলেন, এইখানে ইস্কুলে ইস্কুলে ঘুরতে আছেন, কিন্তুক কাম পাইবেন কি না, ঠিকনাই। হের থিকা আমাগো মুকুন্দপুরে গিয়া ইস্কুল বহান (বসান)। আমরা তো জানি, আপনে কত বড় বিদ্বান, দ্যাশের মানুষ আপনেরে কত সোম্মান করত। আপনে মুকুন্দপুরে গ্যালে আমাগো পোলাপানগুলান মানুষ হইব। আপনেরে আমরা মাথায় কইরা রাখুম।
দেশভাগের পর সামান্য কটা বছরে কত কিছুই না ঘটে গেল। না, রাজদিয়ায় কেউ তাঁকে হত্যা করতে চায়নি। কিন্তু সমস্ত পরিবেশ রাতারাতি বিষবাষ্পে ভরে গেছে। যে-স্কুল তিনি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন, চল্লিশটা বছর যা ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখান থেকে তাঁকে তাড়ানো হল। রাজদিয়ায় তার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। চারপাশের মানুষজনের চোখে অবিশ্বাস, ঘৃণা, সন্দেহ। ওখানে বাস করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
যুগলের কথাগুলো শুনতে শুনতে আশু দত্তর সমস্ত শরীরে খাড়া ঝিলিকের মতো কিছু খেলে যায়। বিচিত্র এক বিদ্যুৎ-তরঙ্গ। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সব প্রলোভন হেলায় ছুঁড়ে ফেলে হেমনাথ আর মোতাহার হোসেন চৌধুরির সঙ্গে হাত মিলিয়ে একদিন রাজদিয়া হাইস্কুলের পত্তন করেছিলেন। সেই বিপুল উদ্দীপনা যেন নতুন করে ফিরিয়ে দিয়েছে যুগল। তাঁর নিষ্প্রভ ঘোলাটে চোখে আশ্চর্য দ্যুতি ফুটে ওঠে। ব্যগ্র স্বরে বললেন, আমি যাব তোদের সঙ্গে। দরজার কাছে সবিতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বললেন, তোর মাকে ডেকে নিয়ে আয়–
একটু পর মাকে সঙ্গে করে ফিরে এল সবিতা। আশু দত্ত বললেন, আমি বিনুদের সঙ্গে একটু বেরুব। ফিরতে ফিরতে মনে হয় রাত হয়ে যাবে। সন্তোষ অফিস থেকে এলে বোলো, আমার জন্যে যেন চিন্তা না করে। তোমার হাঁড়িতে কি আমাদের তিনজনের মতো ভাত হবে?
সন্তোষের স্ত্রী ঘোমটাটা কপালের আধাআধি টেনে দিয়েছেন। হাজার হোক আশু দত্ত তার ভাসুর। মৃদু গলায় বললেন, হবে।
মনে হচ্ছে তোমাকে মুশকিলে ফেললাম। আমার ভাত তো বেঁধেছই। বিনু আর যুগল খেলে তোমার আর সবিতার জন্যে আবার ভাত বসাতে হবে।
সন্তোষের স্ত্রী কী উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই হাঁ হাঁ করে ওঠে বিনয়, আমরা এইমাত্র খেয়ে এসেছি। আমাদের জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না।
আশু দত্ত বিনয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক বলছিস তো?
স্যার, আপনার কাছে মিথ্যে বলতে পারি?
যুগলও বিনয়ের কথায় সায় দেয়, মাস্টর মশয়, ছুটোবাবু সাচাই (সত্যিই) কইছে। আমাগো প্যাট ঠাসা। এক গরাস ভাত খাওনের লাখান জাগা (জায়গা) নাই–
আগের মতোই নিচু গলায় সন্তোষের স্ত্রী বললেন, লজ্জার কোনও কারণ নেই। পরে দুটি চাল ফুটিয়ে নিতে তিলমাত্র অসুবিধা হবে না। দুপুরবেলা এসে বিনয়রা না খেয়ে চলে যাবে, এটা তার ভাল লাগছিল না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করতে হল।
মিনিট কুড়ির মধ্যে চান-খাওয়া চুকিয়ে বিনয়দের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন আশু দত্ত।
.
১৪.
শিয়ালদা স্টেশনে যখনই যুগল আসে, শরণার্থীদের থিকথিকে ভিড়ে রাজদিয়া এলাকা কি ভাটির দেশের লোকজন খুঁজে বেড়ায়। আজ সেদিকে তার লক্ষ্য নেই।
দুনম্বর প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। ওটা আগরপাড়া হয়ে নৈহাটির দিকে যাবে।
প্ল্যাট ফর্মের দিকে পা চালাতে চালাতে যুগল ব্যস্তভাবে বলল, ছুটোবাবু, মাস্টর মশয়, আসেন আসেন। আমাগো টেরেন অহনই ছাইড়া দিব। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে এই লাইনের ট্রেনের টাইমটেবল তার মুখস্থ।
আশু দত্ত বললেন, এটা কী হচ্ছে?
থমকে দাঁড়িয়ে যায় যুগল, কীয়ের (কীসের) কথা কন?
ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিস। টিকেট কাটতে হবে না?
সারা মুখ জুড়ে হাসে যুগল। মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, আমাগো লাখান রিফুজগো টিকট লাগে না মাস্টর মশয়
আশু দত্ত স্তম্ভিত। বিমূঢ়ের মতো বলেন, বলিস কী রে!
কিছুদিন আগে বিনা টিকেটে ভ্রমণের পক্ষে বিনয়কে যা যা বলেছিল যুগল, এবারও নিপুণভাবে সেই যুক্তিজাল বিস্তার করে। ভিটেমাটি, দেশ, সর্বস্ব গেছে। স্বেচ্ছায় কেউ ইন্ডিয়ায় আসেনি। আসতে বাধ্য করা হয়েছে। গরু ছাগল পোকা মাকড়েরওঅধম হয়ে তারা কোনওরকমে টিকে আছে। সরকারের উচিত ছিল তাদের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু তারা উদ্বাস্তুদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দূরে থাক, পেট ভরে সম্মানের সঙ্গে খাওয়ারও বন্দোবস্ত করেছে কি? এই অবস্থায় কীসের রেলের টিকেট? যতদিন বেঁচে আছে বিনা পয়সায় তারা ট্রেনে চড়বে।
যুগলের ক্ষোভের কারণটা বুঝতে পারছিলেন আশু দত্ত। পকেট থেকে টাকা বার করে নরম গলায় বললেন, বে-আইনি কাজ আমি করতে পারব না। যা, তিনটে টিকেট নিয়ে আয়।
যুগল ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, পহা (পয়সা) খরচা কইরা এই হালার গরমেনরে লাই দিয়েন না মাস্টার মশয়–
সস্নেহে ধমক দিলেন আশু দত্ত, গেলি হারামজাদা
ঘোর অনিচ্ছায় টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় যুগল।
.
আগরপাড়া স্টেশনে যখন ওরা এসে নামে, সুর্য পশ্চিম দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। কলকাতার তুলনায় তাপাঙ্ক এখানে কয়েক ডিগ্রি কম। বিকেল হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই উত্তুরে হাওয়া কনকনে হতে শুরু করেছে। মিহি মখমলের মতো বহু দূরের গাছপালার মাথায় কুয়াশা নামছে।
ট্রেন লাইনের ওপারে গিয়ে বিনয় বলল, স্যার, মুকুন্দপুর এখান থেকে তিন সাড়ে তিন মাইল। যুগল অবশ্য বলে দুমাইল। রিকশা নেব?
এধারে প্রচুর দোকানপাট। অনেক লোকজনও চোখে পড়ছে। ডালপালাওলা একটা বটগাছের তলায় সাইকেল রিকশার স্ট্যান্ড। রিকশাওলারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সওয়ারি ডাকছিল।
আশু দত্ত বিনয়কে বললেন, তিন সাড়ে তিন মাইল কতটুকু পথ! দেশে থাকতে লাটসাহেবদের মতো কি গাড়িঘোড়া চড়তাম? পায়ে হেঁটেই চকের পর চক পার হয়ে গেছি। চল, হাঁটতে হাঁটতেই যাই। জায়গাটাও ভাল করে দেখা হবে।
ঠিক আছে–
আগরপাড়া আধা গ্রাম, আধা শহর। ছাড়া ছাড়া সব বাড়িঘর। বেশির ভাগই টালি কি টিনের চালের। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু দালান কোঠাও চোখে পড়ে।
মিনিট দশেকের ভেতর লোকালয়ের চৌহদ্দি ফুরিয়ে গেল। পাকা রাস্তাও শেষ। এরপর দুধারে ধানের খেত, আঁকাবাঁকা খাল, সাঁকো, মাছরাঙা। আকাশ জুড়ে কত যে রংবেরঙের পাখি। উঁচু উঁচু তালগাছ। ক্কচিৎ দু-একটি মানুষ। দূরে দূরে চাষীদের ছন্নছাড়া গ্রাম। প্রায় সব জমি থেকেই ফসল কাটা হয়ে গেছে। বাকি খেতগুলো সোনালি ধানের লাবণ্যে ভরপুর। বাতাসের ঝাঁপটা লেগে ধানের শিষগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে। শব্দ উঠছে ঝুন ঝুন ঝুন ঝুন–
তিনজনে কথা বলতে বলতে কখনও জমির আলের ওপর দিয়ে, কখনও সরু মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল।
চারদিক দেখতে দেখতে আশু দত্তর খুব ভাল লাগছে। বললেন, অনেকটা আমাদের দেশের মতো
এলাকাটা যে মাস্টার মশায়ের পছন্দ হয়েছে, সেজন্য বেজায় খুশি যুগল। বিপুল উৎসাহে সে বলতে থাকে, নানা খানে ঘুইরা এই জাগাখান (জায়গা) বিচরাইয়া বাইর করছি। নাইলে যাদবপুর বাশধানি গইড়ায় (গড়িয়ায়) জমিন পাইছিলাম। লই নাই। হেই হল জাগাতে খালি মানুষ। মাইনষের মাথা মাইনষে খায়। আর ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি, গায়ে গায়ে বাড়ি। উয়াস (নিশ্বাস) ফালান যায় না।
হঠাৎ দূর থেকে কলরোল ভেসে আসে। অনেক মানুষ একসঙ্গে হইচই করলে যেমন শোনায়, অবিকল সেইরকম আওয়াজ।
দাঁড়িয়ে পড়ল যুগল। কুকুরের মতো কান খাড়া করে শব্দটা শুনল। তারপর উদ্বিগ্ন মুখে বলল, মনে লয় (হয়), আমাগো মুকুন্দপুরে কুনো হাঙ্গম বাধছে। আমি লৌড়াই (দৌড়ই)। আপনেরা আস্তে আস্তে আহেন। জমির আলের ওপর দিয়ে উধ্বশ্বাসে সে ছুটতে লাগল।
বিনয়রা হতচকিত। আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কী হতে পারে?
বিনয় বলল, কী জানি, বুঝতে পারছি না
তাড়াতাড়ি চল—
বিনয়রা জোরে জোরে পা চালাতে থাকে।
সামনের দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, ধানখেতের ভেতর দশ বারোটা তালগাছের জটলা। অনেক উঁচুতে মাথা তুলে আকাশে পরমাশ্চর্য নকশা এঁকে দাঁড়িয়ে আছে। হিমঋতুর পড়ন্ত বেলার নরম রোদ এসে পড়েছে সেগুলোর ওপর।
চোখের পলকে গাছগুলোর ওধারে উধাও হয়ে গেল যুগল।
আশু দত্ত বেশ চিন্তিত। বিনয়কে বললেন, ও তো আমাদের ফেলে চলে গেল। তুই চিনে যেতে পারবি?
এই কদিন আগে মুকুন্দপুরে ঘুরে গেছে বিনয়। আগরপাড়া স্টেশন থেকে যুগলের সঙ্গে হেঁটে এসেছিল। ফিরেও গিয়েছিল হেঁটেই। এদিকের রাস্তাঘাটে কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই। মাঠের মাঝখান দিয়ে সোজাসুজি হাঁটলেই যুগলদের কলোনি। সব পরিষ্কার মনে আছে তার। বলল, পারব স্যার
মুকুন্দপুরে পৌঁছে দেখা গেল প্রচণ্ড হট্টগোল চলছে। সমস্ত আবহাওয়ায় তুমুল উত্তেজনা।
কেউ আর ঘরে নেই। কলোনির মাঝখানের বিশাল খোলা চত্বরে যুগলকে ঘিরে ধরে নানা বয়সের বউ-ঝিরা চিৎকার করে কী সব বলছে। সবাই একসঙ্গে চেঁচানোয় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
মেয়েরা সবাই সশস্ত্র। কারও হাতে ধারাল ছ্যান দা, কারও হাতে সড়কি, কারও হাতে বঁটি, কারও হাতে কুড়োল। সেদিন এসে বিনয় যাদের দেখে গিয়েছিল তাদের এখন আর চেনা যাচ্ছে না। সবাই ক্রুদ্ধ। হিংস্র। মনে হয়, কিছুক্ষণ আগে তাদের সঙ্গে কোনও শত্রুপক্ষের খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। তার জের এখনও কাটেনি।
এই ক্ষিপ্ত নারীবাহিনীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি করে যাকে চোখে পড়ছে সে পাখি। তার মাথায় ঘোমটা নেই। আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে। সিঁদুর লেপটে কপালে মাখামাখি। শাড়ি এবং ব্লাউজের অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। দুচোখ থেকে আগুন ঠিকরোচ্ছে। একেবারে রণরঙ্গিণী মূর্তি।
চকিতে কবছর আগের, তখনও দেশভাগ হয়নি, একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। রাজদিয়া থেকে সুজনগঞ্জের হাটে যাবার পথে যুগলের সঙ্গে নৌকোয় করে তার পিসতুতো বোন টুনিদের বাড়ি গিয়েছিল বিনু। সেদিনের বিনু আজকের বিনয়। টুনিদের বাড়িটা অদ্ভুত। দশ পনেরো হাত উঁচু মোটা মোটা খুঁটির মাথায় মহাশূন্যে দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা আশ্বিন মাস। বর্ষায় ধানখেত, মাঠঘাট, খালবিল, বিশাল বিশাল চক ভেসে গিয়েছিল। সেই জল তখনও নামেনি। চারদিকে অগাধ জলরাশি। বর্ষার সময়কার মাতামাতি অবশ্য ছিল না। যতদূর চোখ যায়, শান্ত নিস্তরঙ্গ এক সমুদ্র।
টুনিদের বাড়ির পাছদুয়ার থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাপলা শালুক আর জলপদ্মের বনের ভেতর দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে পাখি এসে উঠেছিল যুগলের নৌকোয়। অলৌকিক জলপরীর মতো
মনে হয়েছিল তাকে। কিশোর বিনয়ের সামনে যুগলের সঙ্গে কথা বলতে তার কী লজ্জা! কী ভাল যে লেগেছিল পাখিকে। নম্র। কোমল। টুনিদের নজর এড়িয়ে যুগলের দেখা করতে সঙ্গে এসেছে। পাছে ধরা পড়ে যায় সেজন্য সদাস্ত।
সেদিনও মুকুন্দপুরে এসে পাখিকে দেখেছে বিনয়। তার হাতের রান্না খেয়েছে। টুনিদের বাড়িতে যেমনটি দেখেছিল, হুবহু একই রকম। তেমনই লাজুক, স্নিগ্ধ, মায়াময়। কে বলবে সে দুছেলের মা।
কিন্তু আশ্চর্য এক ভোজবাজিতে কদিনের মধ্যে আগাগোড়া বদলে গেছে পাখি। এতকালের চেনা লজ্জানত, জড়সড় মেয়েটির ভেতর এমন আগুন লুকিয়ে ছিল, কে ভাবতে পেরেছে! একটু খুঁটিয়ে লক্ষ করতে চোখে পড়ল, পাখির মাথার সামনের দিকের ডান পাশটা অনেকখানি ফুলে আছে। বাঁ হাতের কনুইতে জমাট-বাঁধা রক্ত। অর্থাৎ শত্রুপক্ষ যারাই হোক, তারা সহজে ছেড়ে দেয়নি; লাঠিসোঁটা বর্শা টর্শা চালিয়েছে।
এবার অন্য মেয়েদের ওপরও নজর এসে পড়ল বিনয়ের। তাদের অনেকেরই হাল পাখির মতো। ছেঁড়াফাড়া শাড়ি জামা। কারও কাঁধে, কারও কপালে, কারও বা পায়ে চোটের চিহ্ন।
শুধু মেয়েরাই না, ভিড়ের ভেতর পতিতপাবন, হরিন্দ, হরনাথ কুণ্ডু, হাচাই পাল–নানা বয়সের জনাকয়েক পুরুষকেও দেখা গেল। তারাও কেউ অক্ষত নেই। সবার শরীরেই অল্পবিস্তর চোট আঘাত লেগেছে।
হঠাৎ কে যেন বিনয় আর আশু দত্তকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে চিল্লানি থামা। ছুটোবাবু আর রাইজদার মাস্টরমশয় আইছে। লোকটা খুব সম্ভব রাজদিয়া বা তার কাছাকাছি কোনও গ্রামের বাসিন্দা ছিল। আশু দত্তকে সে চেনে।
লহমায় শোরগোল থেমে যায়। প্রবল উত্তেজক পরিস্থিতির মধ্যে এসে যুগলের খুব সম্ভব বিনয়দের কথা মনে ছিল না। সে দৌড়ে আসে। সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, তরাতরি দুইখান চ্যার (চেয়ার) লইয়া আয়।
তৎক্ষণাৎ দুটো হাতলভাঙা, নড়বড়ে চেয়ার চলে আসে। বিনয় আর আশু দত্তকে বসিয়ে যুগল কাঁচুমাচু মুখে বলে, কুলোনিতে হাইন্দাই (ঢুকেই) তাফালে পইড়া গ্যালাম। দুফারে হুমুন্দির পুতেরা এইখানে আইয়া ম্যালা (অনেক) ঝঞট কইরা গ্যাছে। হেই হগল হুনতে হুনতে আপনেগো কং খ্যাল (খেয়াল) আছিল না।
বিনয় এবং আশু দত্ত, দুজনেই উৎকণ্ঠিত। কী হতে পারে, মোটামুটি আঁচ করে নিয়েছিল বিনয়। তবু জিজ্ঞেস করে, কারা এসেছিল? কীসের ঝঞ্ঝাট?
যুগল বলে, হগল হুইনেন। অতখানি পথ হাইটা আইসা হয়রান হইয়া পড়ছেন। হাত-পাও ধুইয়া চা-মিঠাই খাইয়া আগে জিরাইয়া লন (নিন)। হের পর হুনামু।
বিনয় জোরে জোরে মাথা নাড়ে, না, আগে বল।
আশু দত্তও সায় দেন। তিনি রীতিমতো হকচকিয়ে গেছেন। হয়তো একটু ভয়ও পেয়েছেন। সব না শোনা পর্যন্ত তার উদ্বেগ কাটছে না।
হট্টগোল আগেই থেমে গিয়েছিল। কলোনির বউ-ঝিদের সেই অগ্নিমূর্তি আর নেই। কুমারী মেয়েরা ছাড়া সধবা বিধবা সবাই কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দিয়েছে। বউগুলো ফের আগের মতোই গৃহলক্ষ্মী। ক্ষণিকের রণং দেহি ভাবটা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
বিনয় তবু আগে এসেছে। কিন্তু রাজদিয়ার শ্রদ্ধেয়, দাপুটে মাস্টার মশাইটি যে এতদূরে তাদের কলোনিতে চলে আসবেন, মুকুন্দপুরবাসীদের কাছে এ ছিল স্বপ্নেরও অতীত। যুগল শুরু করার আগে তার পায়ে মাথা ঠেকাবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পা দুটো গুটিয়ে হাতজোড় করে আশু দত্ত বলেন, সবার প্রণাম আমি নিলাম। পায়ে হাত দিতে হবে না। যুগলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার তুই বল
কী ভেবে যুগল বলল, দুফারে আমি তো কুলোনিতে আছিলাম না। আপনেগো জানতে কইলকাতায় গ্যাছিলাম। হরনাথ দাদায় আইজ আপিসে যায় নাই। জ্বর হইছে। কুলোনিতেই আছিল। আমার থিকা তেনিই ভালা কইতে পারব। ভিড়ের একধারে দাঁড়িয়ে ছিল হরনাথ কুণ্ডু। তাকে বলল, আপনে কন।
হরনাথ সবিস্তার বিবরণ দিয়ে গেল। যেখানে কলোনি বসানো হয়েছে সেখানে আগে ছিল। আলিসান জঙ্গল। সাপটাপ মেরে সেই জঙ্গল সাফ করে জনপদ গড়ে তোলা হল।
জায়গাটা জমিদার পালচৌধুরিদের। ব্যাপারটা তারা সুনজরে দেখেননি। সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের ওপার থেকে চিরতরে এসে যে দুঃখী দিশেহারা মানুষগুলো পরিত্যক্ত, অকেজো জঙ্গল নির্মূল করে মাথা গোঁজার মতো কাঁচা বাঁশের বেড়া আর টিন কি টালি দিয়ে চালাঘর বানিয়ে নিয়েছে, তা মেনে নেবার মতো মহানুভবতা তাদের অন্তত নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কি কেউ আছে যে বিঘত পরিমাণ ভূখণ্ডের স্বত্ব ছাড়তে চায়? কলোনি যখন পত্তন হচ্ছে তখন থেকেই হানাদার বাহিনী পাঠিয়ে মুকুন্দপুরের বাসিন্দাদের উৎখাত করার চেষ্টা করে চলেছেন পালচৌধুরিরা। উদ্বাস্তুরাও জবর দখল ছাড়বে না। এই নিয়ে কবছর ধরে সমানে লড়াই চলছে। জমিদারের সশস্ত্র বাহিনী মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে এসে হানা দেয়। তাদের হয়তো ধারণা, সবাই যখন ঘুমে বেহুঁশ থাকে সেইসময় ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সমস্ত ছারখার করে দেবে। কিন্তু মুকুন্দপুরবাসীরা ভীষণ সতর্ক। পালা করে রাত জাগে। তাদের চোখ কান নাক–সমস্ত ইন্দ্রিয় খুবই সজাগ। অনেকটা বুনো জন্তুর মতো তারা সর্বক্ষণ বলবান প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকাবার জন্য প্রস্তুত। দূর থেকে শত্রুর গন্ধ পেলে তারা আকাশ বাতাস ফেড়ে ধ্বনি দিতে থাকে, কালী মাঈকি জয়
এখানকার প্রতিটি ঘরই দুর্গ। প্রতিটি ঘরই অস্ত্রভান্ডার। শত্রুর সঙ্গে যুঝবার জন্য মজুদ করা রয়েছে ছ্যান দা, রামদা, বল্লম, সড়কি, বয়রা বাঁশের মজবুত লাঠি, শাবল ইত্যাদি। পরিচিত সেকেলে সব মারণাস্ত্র।
কালী মাঈকি জয় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পলকে জেগে ওঠে কলোনির পুরুষেরা। তারপর লাঠি দা সড়কি নিয়ে রে রে করে বেরিয়ে আসে। এইভাবে বহুবার মুকুন্দপুরে নৈশযুদ্ধ হয়ে গেছে। দুপক্ষে জখমও হয়েছে কম নয়। কিন্তু পালচৌধুরিরা তাদের এক ইঞ্চি জমিও উদ্বাস্তুদের দখল থেকে উদ্ধার করতে পারেননি।
এতদিন আক্রমণটা হচ্ছিল রাতের দিকে। এবার কৌশলটা পালটে ফেলেছেন পালচৌধুরিরা। দিনের বেলা পুরুষেরা কলোনিতে থাকে না। যে যার কাজে বেরিয়ে যায়। রোজগারপাতি না করলে
পেটের ভাত জুটবে কোত্থেকে? তাদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। কারও কারও বা সন্ধে। দিনের বেলায় কলোনিতে থাকে শুধু বাচ্চাকাচ্চা, বুড়োবুড়ি আর মেয়েরা। উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ এই সময়টা প্রায় অরক্ষিতই। সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন পালচৌধুরিরা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বউ-ঝিরা বেশির ভাগই বিছানায় শরীর ঢেলে জিরিয়ে নিচ্ছিল। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেকে বাইরের চত্বরে পিঠময় চুল ছড়িয়ে শীতের রোদ পোহাচ্ছিল।
তখনই হানাদার বাহিনী তুমুল শোরগোল তুলে কলোনিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েরা প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। প্রাথমিক ভীতিটা কাটিয়ে পাখি চিৎকার করে ওঠে, লাঠি রাম দাও কুড়াল বল্লম লইয়া আসো
চত্বরে যারা ছিল তারা তো বটেই, হইচইতে যারা ঘরে শুয়ে ছিল তারাও দা কুড়াল টুড়াল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পতিতপাবন, হরিন্দ আর হরনাথ কুণ্ডু আজ বেরোয়নি; কলোনিতেই ছিল। তারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসে, তবে আজকের লড়াইয়ে কলোনির যোদ্ধাদের আসল সেনাপতি পাখি।
হানাদারেরা ছিল সবসুদ্ধ সাত আটজন। হয়তো ভেবেছিল, কলোনির মেয়েরা কী আর করতে পারবে? তাদের দেখে আতঙ্কে সিটিয়ে যাবে। সেই ফাঁকে তারা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাধিয়ে দেবে।
কিন্তু হিংস্র নারীবাহিনী সংখ্যায় অনেক। খানিকক্ষণ লাঠিসোটা চালিয়ে, অকথ্য খিস্তি করে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে হানাদাররা পালিয়ে যায়। যাবার আগে কয়েকজনকে অল্প বিস্তর জখম করেছে। তারাও পালটা মার খেয়েছে কম নয়। বুঝে গেছে দিনদুপুরে কি রাত দুপুরে, যখনই আসুক, হাতছাড়া জমি ফেরত পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
দুপুরবেলার মহাযুদ্ধের বিবরণ দেবার পর দক্ষিণ দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় হরনাথ, উই দ্যাহেন, হালার পুতেরা আমাগো একেবারে ছাড়ে নাই। অনেকখানি ক্ষতি কইরা দিয়া গ্যাছে।
মুকুন্দপুর কলোনির ইতিহাস ভূগোল সবই বিনয়ের জানা। কোথায় কে ঘর তুলেছে, আগের দিনই দেখে গিয়েছিল। সমস্ত মনে আছে। চোখে পড়ল, বিলের এধারে যুগলের খুড়শ্বশুর কানাই দাস আর পিসশ্বশুর নবীন দাসের আধপোড়া বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
হরনাথ বলতে লাগল, শুয়োরের ছাওরা উই দুই ঘরে আগুন ধরাইয়া দিছিল। আমরা হগলে মিলা নিভাইছি।
একটু চুপচাপ।
তারপর যুগল হেসে আশু দত্তকে বলল, ছুটোবাবু আমাগো কথা বেবাক জানে। আপনেও। হোনলেন (শুনলেন)। দ্যাশ থিকা আইয়া এইভাবে যুধু কইরা বাইচা আছি মাস্টর মশয়–
আশু দত্ত অপার বিস্ময়ে সব শুনে যাচ্ছিলেন। দেশে থাকতেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, সাতপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে এপারে এসে উদ্বাস্তুদের প্রায় সবাই রাস্তায়, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কিংবা ত্রাণশিবিরে ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের সংকটের, তাদের কষ্টের অবধি নেই। এটাকেই তারা ললাটলিপি ধরে নিয়েছে। কিন্তু তারই স্বদেশবাসী এই মানুষগুলো–এই যুগল, এই পতিতপাবন, এই পাখিদের দলটা হার মানেনি। পলকের জন্য এটাকে ভাগ্যের মার ভেবে হাত পা গুটিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার জন্য বসে থাকেনি। পশ্চিম বাংলার সুদূর এই ভূখণ্ডে বিপুল পরিশ্রমে, প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে, পূর্ব বাংলার আদলে একটা জনপদ গড়ে তুলছে।
পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়ায় পা দিয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন আশু দত্ত। হতাশ। ভবিষ্যতের চিন্তায় বিপর্যস্ত। কিন্তু ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যুগলের সঙ্গে কথা বলে মুষড়ে পড়া ভাব অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। যুগল তার মধ্যে বিলীয়মান উদ্দীপনাকে উসকে দিয়েছে। মুকুন্দপুরে এসে তিনি আপ্লুত। এখানকার মানুষজন তার একান্ত পরিচিত। চোখের সামনে অগুনতি চেনা মুখের সারি। এইসব নিরক্ষর, যুদ্ধরত, জেদি নারীপুরুষেরা তার কাছে যেন হাজারটা উজ্জ্বল আলো জ্বেলে। দিয়েছে।
এদিকে যুগল ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ম্যালা (অনেক) কথা হইছে। তুমরা কেও মাস্টর মশয় আর ছুটোবাবুর লেইগা হাত-পাও ধোওনের জল আইনা দাও। পাখিকে বলল, নয়া যে দুইখান গামছা কিনা আনছিলাম, দিয়া যা। তেনারা মুখটুখ মুছব। হের পর চা বানাইয়া লইয়া আয়। মনে কইরা বিস্কুট আর মিঠাইও আনিস।
যুগল ঠিকই করে রেখেছিল, যেভাবেই হোক আশু দত্ত এবং বিনয়কে আজ এখানে নিয়ে আসবে। প্রবল আত্মবিশ্বাস তার। সে জানে, তার মুখের ওপর ওঁরা না বলতে পারবেন না। আগে থেকে তাই আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করে রেখেছে। নিজেদের ব্যবহার করা জিনিস তো আশু দত্তদের মতো মানুষদের দেওয়া যায় না। তাই আগরপাড়ার বাজার থেকে কাল নতুন একজোড়া গামছা, সন্দেশ, দানাদার আর ভাল বিস্কুট কিনে এনে রেখেছিল।
আগে বিনয় যখন মুকুন্দপুরে আসে, কাছের বিল থেকে বালতি করে হাতমুখ ধোবার জল এনে দিতে চেয়েছিল যুগল। বিনয় রাজি হয়নি। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেছিল। আজও প্রবল আপত্তি জানায় সে। আশু দত্তও জোরে জোরে মাথা নেড়ে জল আনতে বারণ করলেন। কেউ জল টেনে এনে দেবে আর তিনি হাত-পা ধোবেন, এটা হয় না। তাছাড়া, তিনি এমন অথর্ব হয়ে পড়েননি যে আড়াই শ হাত দূরের বিল পর্যন্ত যেতে অসুবিধা হবে।
হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল হল, হানাদারদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে যাদের চোট লেগেছে তাদের ডাক্তার দেখানো দরকার। সে বলল, চাটা পরে হবে। যাদের জখমটা বেশি তাদের এক্ষুনি আগরপাড়ার ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া দরকার।
ব্যাপারটা প্রায় তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিল যুগল, এইখানে কারও শরীল ননী-মাখম দিয়া বানাইনা (বানানো) না। ইটু আধটু চোট লাগছে, দুই চাইর ফোঁটা রক্ত পড়ছে, হেইর লেইগা ডাক্তরের বাড়িত লৌড়াইতে (দৌড়তে) হইলে তো গ্যাছি, দুব্বা ঘাস ছেইচা রস লাগাইয়া দিলে রক্ত বন্দ হইয়া যাইব। ঘাও হইব না। লাঠির বাড়ি খাইয়া যাগো ড্যানা (হাত), কপাল কি পাও ফুইল্যা গ্যাছে, চুনা-হলদি গরম কইরা লাগাইয়া দিলে তাগো টাটানি আর ফুলা এক রাইতেই কইমা যাইব।
তড়িৎগতিতে ছুটে গিয়ে গামছা নিয়ে এল পাখি। যুগল বলে, আপনেরা তো জল আনতে দিবেন না। লন বিলে যাই
বিলের নারকেল গুঁড়ির ঘাটলায় এসে, অনেকখানি ঝুঁকে টলটলে ঠাণ্ডা জল সারা মুখে ছিটোতে লাগলেন বিনয় আর আশু দত্ত। কুলকুচো করলেন। পায়ের চেটো থেকে হাঁটু পর্যন্ত ভাল করে ডলে ডলে ধুয়ে নিলেন। যুগল জোড়া গামছা নিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে দুটো চেয়ে নিয়ে হাতমুখ মুছে জুতো পায়ে দিয়ে দুজনে ফের চত্বরে এসে বসলেন।
ভিড়টা এখনও জমাট বেঁধে আছে। বিনয় আর আশু দত্তকে পেয়ে কেউ নড়তে চায় না।
যেভাবে পাখি গামছা দিয়ে গিয়েছিল সেই গতিতেই চা এবং মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে এল। তার গায়েও লাঠির বাড়ি কি সড়কির খোঁচা-টোচা লেগেছে। কিন্তু সে-সব গ্রাহ্যই করছে না মেয়েটা। তার হাতে পায়ে যেন বিজলি খেলে যাচ্ছে। সম্মানিত অতিথিদের আপ্যায়নে এতটুকু ত্রুটি হতে দেবে না সে।
এত মানুষের সামনে বসে খেতে ঠিক স্বস্তি বোধ করছিলেন না আশু দত্ত আর বিনয়। শুধু চা আর একটা করে বিস্কুট তুলে নিলেন তারা। সন্দেশ আর দানাদার নেবার জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগল যুগল। যদিও সে মান্য অতিথিদের মিষ্টিমুখের আয়োজন করেছে, মুকুন্দপুরবাসীরা সবাই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের একই সনির্বন্ধ অনুরোধ।
আশু দত্ত এবং বিনয় হেসে হেসে জানান, অবেলায় খাওয়ার অভ্যাস তাঁদের নেই। কিছুক্ষণ আগে দুপুরের খাওয়া সেরে এসেছেন। পেটের ভাত হজম হয়নি। এখন খেলে শরীর খারাপ হবে। কেউ যেন কিছু মনে না করে।
এর ওপর কোনও কথা নেই। সকলে চুপ করে থাকে। পাখি আর যুগলের মুখ ম্লান হয়ে যায়। সবচেয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে তারা।
একসময় ভিড়ের ভেতর থেকে আশু দত্তকে লক্ষ করে একের পর এক প্রশ্ন ভেসে আসতে থাকে। দেশের, বিশেষ করে রাজদিয়া এবং তার চারপাশের লোকালয়গুলোর এখনকার খবর তারা জানতে চায়। মুকুন্দপুরবাসীরা অনেকদিন আগেই পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে। এখন সেখানে কী চলছে, অবস্থা কতখানি আতঙ্কজনক, এর মধ্যে কারা কারা ভিটেমাটি ফেলে চলে গেছে, কারা কারা এখনও পড়ে আছে, ইত্যাদি নানা ব্যাপারে তাদের অনন্ত কৌতূহল। পৃথিবীর সেই ভূখণ্ডে আর কোনওদিনই যাদের ফেরা হবে না, তবু তাদের ছত্রিশ নাড়িতে এখনও তা জড়িয়ে রয়েছে।
যুগল অসহিষ্ণু সুরে বলে, যে-ই কুলোনিতে আহে দ্যাশের কথা হোননের (শোনার) লেইগা হেরে ছাইকা (হেঁকে) ধরে। পাকিস্থানের গতিক যদিন ভালাই হইব, মাস্টর মশয় কি চইলা আইতেন? দ্যাশ ট্যাশ ভুইলা যাও। অহন কামের কথা হোনো (শোন)। ক্যান আইজ কইলকাতায় গিয়া হাতে পায়ে ধইরা ছুটোবাবুর লগে মাস্টর মশয়রে কুলোনিতে লইয়া আইছি, হেয়া (তা) তো তুমরা জানো।
সবাই মাথা ঝাঁকায়–জানে।
মাস্টর মশয়রে হেই কথাহান কইছি।
তেনি কী কইছেন?
কলোনির বাচ্চাকাচ্চা কিশোরকিশোরীরা ভিড়ের ভেতর ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে ছিল। জনতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যুগল আশু দত্তকে বলল, এই পোলামাইয়াগুলানের ভার আপনেরে নিতেই হইব মাস্টর মশয়। লিখাপড়ি না শেখলে ইন্ডিয়ায় অগো জনম বেবাক আন্ধার। হঠাৎ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলতে থাকে, তয় একখান কথা। পথের ভিখারি হইয়া ইন্ডিয়ায় আইছি। কুনোরকমে বাইচা আছি। আমাগো ক্ষ্যামতা আরা কতটুক? ট্যাহাপহা (টাকা পয়সা) বেশি দিতে পারুম না। আপনের আর আপনের মায়ের খাওন-পরনের কষ্ট না হয়, হেইটা আমরা দেখুম
অদ্ভুত এক ঢল-নামানো আবেগে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল আশু দত্তর। কোনও অদৃশ্য ডানায় ভর করে তিনি ফিরে যেতে লাগলেন পঁয়তাল্লিশ বছর আগের দিনগুলোতে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসার পর মোতাহার হোসেন আর হেমনাথের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলেছিলেন রাজদিয়া হাইস্কুল। স্বপ্ন দেখতেন দেশের মুক্তি বেশি দূরে নয়। ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের জন্য জাতি গঠনের কাজে বিভোর হয়ে থাকতেন। সে-সব দিনে কী বিপুল উন্মাদনা তার। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যুগল তাঁর যুবা বয়সের সেই উদ্দীপনার কিছুটা ফিরিয়ে দিয়েছিল; এই মুহূর্তে পুরোটাই।
যুগল বলছিল, একখান কথা ভাইবা রাখছি মাস্টর মশয়। অহনও কেওরে কই নাই। কইলকাতা থিকা অ্যাদূরে রোজ আহন-যাওনে শরীল নষ্ট, সোময় নষ্ট। আপনেরে আমাগো এইখানেই থাকতে হইব।
আশু দত্ত অবাক। এখানে কোথায় থাকব?
হেই চিন্তা আমাগো। ছুটোবাবু এইখানে জমিন লইতে রাজি হইছে। আপনেরে হুদা (শুধু) জমিনই না, ঘরও বানাইয়া দিমু।
কিন্তু
আশু দত্তকে শেষ করতে দিল না যুগল। প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল, আপনের কুনো আপত্ত হুনুম (শুনম) না, হুনুম না, হুনুম না। আমাগো পোলামাইয়াগুলানরে মানুষ কইরা দিতেই হইব
বাকি সবাই তুমুল হইচই বাধিয়ে সায় দেয়, মাস্টার মশাইয়ের কোনও আপত্তিই গ্রাহ্য করা হবে না। মুকুন্দপুরবাসীরা রাজদিয়া এবং তার চারপাশের অঞ্চল থেকে এসেছে। আশু দত্তর চিরপরিচিত। একান্ত আপনজন। মাস্টার মশায়কে তারা অসীম শ্রদ্ধায়, নিবিড় মমতায় ঘিরে রাখবে।
হাত তুলে সবাইকে থামাতে থামাতে আশু দত্ত বললেন, আগে আমার কথাটা বলতে দে।
কী ভেবে যুগলরা বলল, ঠিক আছে। কন—
আমি সন্তোষের কাছে উঠেছি। সে আমার আশ্রয়দাতা। তার মতামত না নিয়ে আসি কী করে?
যুগল বলে, যত ইচ্ছা তেনির লগে কথা কন, তেনির মতামত লন (নিন)। কিন্তুক মুকুন্দপুরে আপনেরে আইতেই হইব। ছাড়ন ছাড়ন নাই।
যুগলের মধ্যে সরল অবুঝ একগুঁয়ে একটি বালক রয়েছে। তার কাঁধে জেদ চাপলে সেটি না করা পর্যন্ত যেন শান্তি নেই। আশু দত্ত হেসে ফেললেন।
যুগল আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বেইল (বেলা) পইড়া গ্যাছে। ইট্ট পরেই সন্ধ্যা নামব। দুটোবাবু, মাস্টর মশয়, লন আপনেগো জমিন দ্যাহাইয়া আনি। হের লগে কুনহানে ইস্কুল বহাইবেন হেই জাগাখানও। দ্যাহেন আপনেগো পছন্দ হয় কি না—
শীতের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। রোদ এখন আরও নিস্তেজ। বাতাস আরও কনকনে। দেখতে দেখতে আঁধার নেমে যাবে। জমি দেখে তিন সাড়ে-তিন মাইল হেঁটে আগরপাড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়। আশু দত্ত এবং বিনয় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।
আগে একদিন যুগলের সঙ্গে মুকুন্দপুরে এসে কলোনির সীমানা অবধি বিনয় দেখে গিয়েছিল, তারপর থেকে ছিল চাপ-বাঁধা ঘন জঙ্গল। ঝোপঝাড়, ডালপালা ছড়ানো বিশাল বিশাল সব প্রাচীন বনস্পতি আর কত ধরনের যে বুনো লতা। সেই জঙ্গলের অনেকটাই এর ভেতর সাফ করে ফেলা হয়েছে। একধারে পাহাড়ের মতো উঁই হয়ে পড়ে আছে গাছের মোটা মোটা গুঁড়ি, শাখাপ্রশাখা আর কাঁটাঝোপ এবং লতাপাতা।
অন্য দিকে বিলের পাড় ঘেঁষে যে উদ্দাম কচুবন ছিল সেটার গায়ে হাত পড়েনি। কত ধরনের যে কচু তার লেখাজোখা নেই। পানিকচু, মানকচু, শোলাকচু, লতিকচু, খারকন। সমস্ত অটুট রয়েছে। মুকুন্দপুরবাসীদের কাছে এইসব কচু বিরাট বলভরসা, মস্ত খাদ্যভাণ্ডার। অন্য তরিতরকারি না জুটুক, ভাতের সঙ্গে কচুর একটা পদ পেলে দিনের পর দিন কেটে যাবে।
জঙ্গল নির্মূল করে প্রায় আধ মাইলের মতো জমি বার করা হয়েছে। আশু দত্ত আর বিনয়কে সঙ্গে করে যুগলরা সেখানে চলে এল। বউ-ঝিরা কেউ আসেনি। তবে কলোনির অল্পবয়সী ছেলের পাল ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে রয়েছে।
যুগল বলল, বুঝলেন নি মাস্টর মশয়, বুঝলেন নি ছুটোবাবু, সুমখের দিকে আমাগো কুলোনির বাঘির যেইখানে তুলছি হেইখানকার জঙ্গল সাফ করতে তেমুন কষ্ট হয় নাই। কিন্তু এই দিকের বন কাটাতে জবর তাফালে (বিপদে) পড়ছিলাম।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কেন?
যুগল জানায়, সারা বনভূমিতেই সাপ রয়েছে, কিন্তু এই জায়গাটাতেই ছিল সব চাইতে হিংস্র, সব চাইতে বিষধর সাপেদের আসল আস্তানা। কত যে গর্ত, তার হিসেব নেই।
যুগল বলতে লাগল, জঙ্গলে সাইন্দা (ঢুকে) গাছে যেই কোপ মারি, এক এক গাদ (গর্ত) থিকা দশখান কইরা সাপ বাইর হইয়া ল্যাজে ভর দিয়া খাড়য়। কী লোখ হালার পুতেগো! সাপ না তো সাক্ষাইত যম। পতিতপাবন দাদায় একদিন তো ছোবল খাইতে খাইতে বাচছে। কম কইরা দ্যাড় দুই শ জাতি সাপ নিপাত করছি।
আশু দত্ত অবাক। বললেন, বলিস কী রে, এত সাপ!
পাশের বিপুল জলাশয়টা দেখিয়ে যুগল বলল, বিলান (বিল অঞ্চলের) জাগা, বচ্ছরের পর বচ্ছর পইড়া আছিল। সাপের বসত হইব না? আর হুদা কি সাপ, বাঘডাসা আর ভামই তো মারছি বিশ তিরিশটা। আর মারছি শ্যাজা (শজারু)। হেও পনরা ষোলটা। শ্যাজার মাংসের বড় সোয়াদ। আমরা কুলোনির মানুষ হেই মাংস ভাগ কইরা লইয়া খাইছি। শিয়ালও আছিল ম্যালা। নতুন করে যে জঙ্গল কাটা হয়েছে, তারপরেও রয়েছে বিপুল বনভূমি। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে যুগল বলল, শিয়ালগুলানরে মারণ যায় নাই। হালারা জবর চালাক। উই দিকের জঙ্গলে পলাইয়া গ্যাছে।
একটু চুপচাপ।
তারপর যুগল ফের বলে, গাছগাছালি না কাটলে, জন্তু-জাওনার (জানোয়ার) সাপখোপ মাইরা শ্যাষ না করলে মানুষ থাকব কই? বডারের উই পার থিকা যত মানুষ আইব, এই পারের বনজঙ্গল, পশুপক্ষী তত নিব্বংশ হইব।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন আশু দত্ত, হ্যাঁ, মানুষ বড় স্বার্থপর জীব।
হরনাথ বলল, উই হগল কথা থাউক। মাস্টর মশয়, বিনয়বাবু, আপনেরা নিজেগো জমিন পছন্দ কইরা লন। যেই জাগা দেহাইবেন, হেই জাগাই আপনেগো দিমু।
যুগল এবং অন্য সবাই যারা সঙ্গে এসেছিল, সমস্বরে হরনাথের কথায় সায় দেয়।
বিনয় বুঝতে পারছিল, যুগলরা কোনও রকম আপত্তি কানে তুলবে না। মুকুন্দপুরের জমি নিতেই হবে। বলল, আমি আর কী পছন্দ করব? যা দেওয়া হবে তাই নেব।
আশু দত্তও একই কথা বললেন।
অগত্যা যুগলরাই অনেক দেখেটেখে দক্ষিণ দিকের সব চাইতে সেরা জমি বেছে দিল। জানালো, সবে জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন ধুধু ফাঁকা মাঠ। পরে পাশাপাশি সাত কাঠা করে জমি মেপে বাঁশের খুঁটি পুঁতে সীমানা ঠিক করে দেবে। দুজনের ঘরবাড়ির জন্য জমি বাছার পর স্কুলের জন্য অনেকখানি জায়গা দেখে রাখা হল।
জমি বাছাবাছি করতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। সূর্য পশ্চিম আকাশের গা বেয়ে এর ভেতর আরও অনেকখানি নেমে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওটা দিগন্তের তলায় অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাতাসে হিমকণা মিশতে শুরু করেছে আরও বেশি করে। গাছপালার মাথায় শীতের মরা মরা রোদ আবছাভাবে লেগে আছে।
আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিনয় চঞ্চল হল, কাজ তো মিটে গেল। এবার আমরা কলকাতায় ফিরব।
কিন্তু হরনাথ তাদের এত সহজে ছাড়ল না। বলল, আর সামাইন্য এটু কাম আছে। দশ মিনিটও লাগব না। হের পর যাইয়েন গা–
কী কাজ?
আহেন আমার লগে।
হরনাথ বিনয় আর আশু দত্তকে মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতির অফিসে নিয়ে এল। অফিস আর কি। কাঁচা বাঁশের বেড়া, মাটির মেঝে। মাথায় টালির চাল। একধারে পুরনো আধভাঙা আলমারি। মাঝখানে সস্তা টেবল, কটা নড়বড়ে চেয়ার। বেড়ার গায়ে বাংলা-ইংরেজি মেশানো ক্যালেন্ডার। তাছাড়া বরেণ্য দেশনেতাদের কটা ছবি ঝুলছে। দেশবন্ধু, নেতাজি, গান্ধিজি, রবীন্দ্রনাথ।
ভিড়টা সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। যুগল, হরনাথ, আশু দত্ত আর বিনয় ছাড়া বাকি সবাই অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
বিনয় আর আশু দত্তকে চেয়ারে বসিয়ে আলমারি থেকে মোটা খাতা বার করে হরনাথ মুখোমুখি বসল। তারপর সেটা খুলে একটা পাতায় খোপকাটা ঘরে আশু দত্তর নাম, বাবার নাম, দেশের বাড়ির ঠিকানা, কোন তারিখে বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছেন, ইত্যাদি টুকে নিয়ে তলায় লিখল : রাজদিয়া হাই স্কুলের প্রাক্তন অ্যাসিস্টান্ট হেড মাস্টার শ্রীযুক্ত আশুতোষ দত্ত মহাশয়কে মুকুন্দপুর উদ্বাস্তু কলোনিতে বসবাসের উপযোগী সাত কাঠা জমি দেওয়া হইবে। ইহা ছাড়া বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বাবদ স্বতন্ত্রভাবে এক বিঘা জমিও তাঁহাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে।
এ-সব লেখার পর আশু দত্তকে নিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হল।
হরনাথ মানুষটা দূরদশী। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মুকুন্দপুরের বাসিন্দাদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে লিখে রাখছে। তার ধারণা, পরে সরকারের কাছে এগুলো পেশ করে আবেদন জানালে নিশ্চয়ই অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। তার কাজে এতটুকু খুঁত নেই।
বিনয় সম্বন্ধে কিছু লেখা হল না। কেননা, কিছুদিন আগে যুগল প্রথম যেদিন তাকে মুকুন্দপুর নিয়ে আসে সেদিনই হরনাথের খাতায় তার নাম উঠে গিয়েছিল।
লেখালেখি শেষ হলে বিনয়রা উঠে পড়ল। আর দেরি করা যাবে না। মুকুন্দপুরবাসীরা কলোনির সীমান্ত পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে গেল। তবে যুগল আর পতিতপাবন সঙ্গ ছাড়ল না, আগরপাড়া স্টেশনে গিয়ে ওদের কলকাতার ট্রেনে তুলে দিল।
.
১৫.
কিছুক্ষণ হল সন্ধে নেমেছে।
শীতের কুয়াশা আর অন্ধকার ভেদ করে ট্রেন কলকাতার দিকে ছুটছে উধ্বশ্বাসে।
বিনয়দের কামরাটার দরজা-জানালা সব বন্ধ। কেননা বাইরে প্রবল প্রতাপে উত্তরে বাতাস বয়ে চলেছে। একটু ফাঁকফোকর পেলেই ভেতরে হানা দিয়ে হাড়মজ্জা কাঁপিয়ে দেবে।
সন্ধের দিকে ডাউন ট্রেনগুলোতে ভিড় থাকে না বললেই হয়। বিনয়দের কামরাটা প্রায় ফাঁকাই। দশ বারোটি প্যাসেঞ্জার এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।
একটা বন্ধ জানালার পাশে মুখোমুখি বসে ছিল বিনয় আর আশু দত্ত। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই বিনয় লক্ষ করেছে, আশু দত্ত কেমন যেন চুপচাপ। গভীর কোনও চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন।
দুতিনটে স্টেশন পেরিয়ে যাবার পর আশু দত্ত বললেন, বুঝলি বিনু, একটা কথা তখন থেকে ভাবছি।
বিনয় উৎসুক চোখে তার প্রাক্তন মাস্টারমশায়টির দিকে তাকায়। কোনও প্রশ্ন করে না।
আশু দত্ত বলতে থাকেন, যুগলরা আমার মাথায় এত বড় গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দিল। নাও বলতে পারলাম না। কিন্তু আমি কি পারব?
এই মানুষটিই একদিন বিপুল উৎসাহে হেমনাথ আর মোতাহার হোসেন চৌধুরির সঙ্গে যৌথভাবে রাজদিয়া হাই স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। শুধু তাই না, সেটা পূর্ব বাংলার একটা সেরা শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কত ভাল ভাল ছেলে যে তার হাত দিয়ে বেরিয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে, দিকে দিকে রাজদিয়া হাই স্কুলের নাম তারা উজ্জ্বল করেছে, তার লেখাজোখা নেই। দিবারাত্রি কী প্রচণ্ড পরিশ্রমই না তিনি করতেন! আজ দুপুরে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে গিয়ে যুগল যখন তাঁকে মুকুন্দপুরে স্কুল বসাবার কথা বলল তখনও তার কী উদ্দীপনা! খানিক আগে কলোনির বাসিন্দারা স্কুলের জন্য যখন কাকুতি মিনতি করছিল তখনও আপত্তি করেননি। কিন্তু স্কুলের জায়গা দেখা হয়ে গেছে, তাঁর ঘরবাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। নিজের চোখে সব দেখে আসার পরও হঠাৎ এখন তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। এবং কিছুটা দ্বিধান্বিত।
বিনয় বেশ জোর দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই পারবেন স্যার। রাজদিয়া হাই স্কুলের মতো অত বড় স্কুল করতে পেরেছেন। কলোনির ছোট একটা প্রাইমারি স্কুল বসানো কি আপনার পক্ষে কঠিন ব্যাপার?
আশু দত্ত বললেন, তখন আমার কত আর বয়েস! তরতাজা ইয়াং ম্যান। এখন আমি বৃদ্ধ।
কিন্তু আপনি তো স্যার, কদিন ধরে কাজের জন্যে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর
বিনয় কী বলতে চায়, আঁচ করতে পারছিলেন আশু দত্ত। তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, কয়েক ঘণ্টার জন্যে কোথাও গিয়ে পড়িয়ে আসা, আর একটা স্কুল বসানো, সেটা যত ছোটই হোক, কি এক কথা হল? একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, আমার সেই বয়েসের এনার্জি, কর্মশক্তি কি আর আছে? তাছাড়া, রাজদিয়ায় আমার সঙ্গে কারা ছিলেন? হেমনাথদাদা, মোতাহার হোসেন সাহেব। তেমন মানুষ এখানে কোথায় পাব? যা করার নিজেকে একাই করতে হবে।
আশু দত্তর দ্বিধাটা অকারণে নয়। বিনয় কী জবাব দেবে, ভেবে পায় না।
আশু দত্ত বলতে লাগলেন, পার্টিশান হল। ভাইটা ঢাকায় খুন হয়ে গেল। ভিটেমাটি ফেলে, সর্বস্ব হারিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে এলাম। মনের জোরও অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে বিনু। মানসিক শক্তি না থাকলে ধুকে ধুকে কোনওরকমে বেঁচে থাকা হয়তো যায় কিন্তু বড় কিছু গড়ে তোলা কি সম্ভব?
বিনয় বলল, যুগলরা বড় আশা করে আছে স্যার। একটু সাহস করে শুরু করে দিন। একবার কাজে ডুবে গেলে দেখবেন, পুরানো কষ্ট ভুলে গেছেন। কাজটাই আপনার এনার্জি ফিরিয়ে আনবে।
একটু চুপ।
তারপর বিনয় ফের বলে, কলকাতার স্কুলে চাকরি পাবেন কি না, ঠিক নেই। টিউশন করে টাকা নেওয়াটা আপনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। আপনি নিজেই বলেছেন, সন্তোষবাবুদের অবস্থা এমন নয় যে চিরকাল ওঁদের কাছে থাকতে পারবেন। তাহলে?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন আশু দত্ত, হ্যাঁ। এ-সব খুবই চিন্তার ব্যাপার।
সামনের দিকে ঝুঁকে গভীর আগ্রহে বিনয় বলে, মুকুন্দপুরের লোকজন সকলেই আপনার চেনাজানা। সে বোঝাতে থাকে, ওখানে গিয়ে থাকলে দেশের পরিবেশটাই পুরোপুরি পেয়ে যাবেন আশু দত্ত। যুগলরা তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করে। তাঁর সমাদরের অভাব হবে না।
আশু দত্ত বললেন, তা আমি জানি। যুগলও এই কথাই বলেছে।
ব্যাকুলভাবে বিনয় বলে, স্যার, দ্বিধা করবেন না। স্কুলটা গড়ে তুলুন। সে আরও বলে, ইউনিভার্সিটি থেকে বেরুবার পর রাজদিয়া হাই স্কুল বসানো দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন আশু দত্ত। পরমায়ু যখন শেষ হয়ে আসছে, সেই সময় সর্বহারা ছিন্নমূল মানুষগুলির সন্তানদের দায়িত্ব তিনি তুলে নিন। তাঁর জীবনের বৃত্ত এতে সম্পূর্ণ হবে। যৌবনের শুরু থেকে তিনি যা করতে চেয়েছেন, যা নিয়ে মগ্ন থেকেছেন, মুকুন্দপুরের উপনিবেশে তা সার্থক হয়ে উঠবে।
বিনয়ের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন আশু দত্ত। হঠাৎ উৎসাহের সুরে বলে উঠলেন, ঠিকই বলেছিস তুই। এ-সব যে আমি ভাবিনি তা নয়। একটু থেমে ফের বললেন, আমার একটা কথা রাখবি?
উৎসুক দৃষ্টিতে আশু দত্তর দিকে তাকায় বিনয়, কী কথা স্যার?
তুই আমার সঙ্গে থাকবি? তোকে পাশে পেলে অনেকখানি ভরসা পাব। আশু দত্ত বলতে লাগলেন, একদিন হেমদাদার হাত ধরে রাজদিয়া হাই স্কুল বসিয়েছিলাম। এবার তার নাতিকে নিয়ে নতুন করে মুকুন্দপুরে শেষ জীবনটা শুরু করা যাক।
বিনয় চমকে ওঠে, কিন্তু স্যার
কী হল?
আপনাকে তো বলেছি, কলকাতায় আমি একটা চাকরি পেয়েছি। কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে জয়েন করতে হবে। আমার পক্ষে মুকুন্দপুরে থেকে স্কুল বসানোর কাজে হেল্প করা তো সম্ভব নয়। তবে
তবে কী?
বিনয় বলল, উইকে একবার নিশ্চয়ই ওখানে যাব। তখন যা বলবেন তাই করে দেব।
আশু দত্ত বললেন, মুকুন্দপুরে শেষ পর্যন্ত হয়তো যেতেই হবে। তুই সপ্তাহে একদিন এলেও অনেকখানি সাহায্য হবে।
একসময় ট্রেন শিয়ালদায় এসে গেল। সেখান থেকে বার দুই বাস ট্রাম বদলে আশু দত্তকে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে দিয়ে টালিগঞ্জে এল বিনয়।
১৬-২০. হিমঋতুর কুয়াশা
১৬.
এখন আটটার মতো বাজে। গাঢ় হয়ে নামছে হিমঋতুর কুয়াশা। উত্তুরে হাওয়া সাঁই সাঁই চাবুক হাঁকাতে হাঁকাতে শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। কর্পোরেশনের টিমটিমে বাতিগুলো বড় বেশি নিস্তেজ। কুয়াশা সেগুলোকে চারপাশ থেকে ঠেসে ধরেছে।
এর মধ্যেই এলাকার দোকানপাটে ঝাঁপ পড়ে গেছে। দুএকটা পানবিড়ি আর চায়ের দোকান এবং একটা খালসা হোটেল এখনও খোলা রয়েছে। শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস ওগুলো মাঝরাত পর্যন্ত চালু থাকে। তবে তীব্র শীতল বাতাসকে রুখে দেবার জন্য দুধারের বাড়িগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় লোকজন খুব কম। মাঝে মাঝে কঁকা ড্রাম কি পাবলিক বাস ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে।
বিনয় বড় রাস্তা থেকে জাফর শা রোডে চলে আসে। সুধাদের বাড়ির সদর দরজায় কিছুক্ষণ কড়া নাড়তে ওপর থেকে উমা নেমে এসে সেটা খুলে দিল। সে ভেতরে ঢুকতেই দরজায় খিল লাগাতে লাগাতে উমা বলল, দাদাবাবু, ওপরে গিয়ে দেখ, কারা এসেছে
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কারা রে?
উমা নামটাম জানালো না। বলল, তর সইছে না বুঝি? ওপরে যাও। দেখতে পাবে।
দোতলায় আসতেই বাইরের ঘরে হিরণ এবং সুধা ছাড়া আরও দুজন চেনা মানুষের দেখা পাওয়া গেল। হিরণের ঠাকুরদা দ্বারিক দত্ত আর তার জেঠিমা সরস্বতী।
কদিন আগে হিরণ পাটনায় টেলিগ্রাম করেছিল। শওকত আলি তাঁদের টালিগঞ্জের বিষয় সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করে পাকিস্তানে হিরণদের বাড়িতে চলে যাবার জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছেন। হিরণরা যদি গড়িমসি করে কিংবা কোনও কারণে দেরি করে ফেলে, তিনি অন্য ব্যবস্থা করবেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে রোজ ঝুঁকে ঝাঁকে মানুষ এপারে চলে আসছে। প্রপার্টি বিনিময় করার জন্য তারা হন্যে হয়ে ঘুরছে। দালালরা রোজই এই ধরনের দুচারটে করে খদ্দেরের খবর শওকত আলির কাছে নিয়ে আসছে। তিনি দুসপ্তাহের বেশি অপেক্ষা করবেন না।
টেলিগ্রাম পেয়ে আজই যে দ্বারিক দত্তরা চলে আসবেন, ভাবতে পারেনি বিনয়। লক্ষ করল, বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ মানুষটি অনেক বেশি শক্তপোক্ত আছেন। সরস্বতী কম করে তার চেয়ে বিশ বছরের ছোট। সবে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই অথর্ব, লুজবুজে হয়ে পড়েছেন।
সবাই মোটা পশমি চাদর জড়িয়ে বসে গল্প করছিলেন। দ্বারিক দত্তকে রাজদিয়ায় থাকতে কতবার দেখেছে বিনয়। মানুষটার এক সময় ছিল ভীষণ মজলিশি মেজাজ, হইহই করে দিন কাটাতে ভালবাসতেন। বয়স তার পুরানো স্বভাব পুরোপুরি হরণ করতে পারেনি। বিনয়কে দেখে খুব খুশি হলেন। গলার স্বর উঁচুতে তুলে বললেন, আয় আয়, আমার পাশে বো–
বিনয় দ্বারিক দত্ত আর সরস্বতীকে প্রণাম করে ওঁদের কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল। জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছেন আপনারা?
দুপুরবেলায়। এসেই শুনলাম যুগলরা যেখানে কলোনি বসিয়েছে সেই মুকুন্দপুরে গেছিস। কতকাল পর যে তোকে দেখলাম–
সরস্বতীও দুর্বল স্বরে তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, তোর আশায় পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছি।
এই বৃদ্ধ মানুষ দুটির আন্তরিকতা বুকের ভেতরটা ছুঁয়ে গেল বিনয়ের। সে জিজ্ঞেস করল, কে আপনাদের নিয়ে এল?
দ্বারিক দত্ত জানালেন, পাটনায় যে ভাইপোর বাড়িতে গিয়েছিলেন সেই অজিত তাঁদের পৌঁছে দিয়ে সন্ধের ট্রেনে ফিরে গেছে। তার অফিসের প্রচণ্ড জরুরি কাজ। দুচারদিন যে কলকাতায় কাটিয়ে যাবে, তার উপায় নেই। বিনয়ের সঙ্গে এবার দেখা হল না বলে খুব আক্ষেপ করে গেছে অজিত। তার ইচ্ছা, বড়দিনে কলকাতায় আসবে। তখন অন্তত সপ্তাহখানেক থেকে যাবে।
এরপর মুকুন্দপুর নিয়ে কিছু কথাবার্তা হল। অনেকদিন আগে দ্বারিক দত্ত পাকিস্তান থেকে চলে এসেছেন কলকাতায়। যুগলের সব খবরই তার জানা। পূর্ব বাংলার নিরক্ষর, সামান্য এক কামলা ময়দানবের উদ্যম নিয়ে নির্জন বনভূমি সাফ করে জনপদ বানিয়েছে–এতে তিনি চমৎকৃত। আশু দত্ত কলোনিতে গিয়ে স্কুল বসাবেন, শুনে খুশি হলেন।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর জোরে শ্বাস ফেলে দ্বারিক দত্ত বললেন, ত্রৈলোক্য সেনরা, রামকেশবরা, আশু দত্তরা রাজদিয়া ফাঁকা করে সবাই চলে এল। শুধু হেমদাদা বাদ। জেনে শুনে মরণের ওষুধ কেউ কানে বাঁধে! পাকিস্তানে কেউ থাকতে পারবে না, এই বোধবুদ্ধিটুকু পর্যন্ত নেই!
বিনয় উত্তর দিল না। কী বলবে সে? নিত্য দাসকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে কত বোঝানো হয়েছে হেমনাথকে। কিন্তু কোনও কথা শুনবেন না তিনি। সৎ পরামর্শ দিলে উড়িয়ে দেবেন। পুরোপুরি অবুঝ। একগুঁয়ে। অপরিণামদর্শী।
একসময় খুব ভারী গলায় দ্বারিক দত্ত বললেন, পাটনা থেকে এসে একটা খুব খারাপ খবর শুনলাম বিনু
সচকিত বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী খবর দাদু? দ্বারিক দত্ত হিরণের ঠাকুরদা। সেই সুবাদে তারও দাদু।
দ্বারিক দত্ত বললেন, ঝিনুক নাকি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তোর বাবা, সুনীতির শাশুড়ি, সবাই ওর সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছে। কিন্তু কী অপরাধ মেয়েটার?
সরস্বতী ধরা ধরা, ভাঙা গলায় বললেন, সারা জীবন দুঃখই পেল ঝিনুক। আমরা কলকাতায় থাকলে ওকে কোথাও যেতে দিতাম না। নিজেদের কাছে রেখে দিতাম।
স্তব্ধ হয়ে দুটি বৃদ্ধ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। গলার কাছটা থির থির কাঁপছে। বাষ্পে ভরে যাচ্ছে দুচোখ।
এই মানুষ দুটি সম্পর্কে কত সংশয় ছিল বিনয়ের। কী নিদারুণ উৎকণ্ঠা! ভেবেছিল, ঝিনুককে দেখামাত্র দূর করে দেবেন ওঁরা। তীব্র ঘৃণায়। অপরিসীম বিতৃষ্ণায়।
বিনয় ভাবল, মাত্র কটা দিন আগে যদি দ্বারিক দত্তদের সঙ্গে দেখা হতো!
দ্বারিক দত্ত বললেন, যেমন করে পারিস মেয়েটাকে খুঁজে বার করে আমাদের কাছে নিয়ে আয়।
দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে বিনয়, অনেক খুঁজেছি। ওকে পাওয়া। যাবে না।
আমার মন বলছে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। ভাল করে চেষ্টা কর–
সুধা আর হিরণ তো প্রথম থেকেই তার পাশে রয়েছে। আজ আরও দুজনকে পাওয়া গেল। সমস্ত নৈরাশ্য দুহাতে ঠেলে সরিয়ে নতুন উদ্যমে ঝিনুকের খোঁজে আবার তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। যদি সে বেঁচে থাকে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই গিয়ে থাক, তাকে নিয়ে আসবে। আসবেই।
.
১৭.
খান মঞ্জিল-এর সঙ্গে রাজদিয়ার বিষয়সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করার যে ব্যবস্থা হিরণ করে ফেলেছে তাতে প্রথমেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন দ্বারিক দত্ত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অযাচিতভাবে যে সুযোগটা পাওয়া গেছে সেটা হাতছাড়া করলে বাকি জীবন আপশোশ করে কাটাতে হবে। পাকিস্তানে ফিরে যাবার আর সম্ভাবনা নেই। সেখানকার ফেলে-আসা বাড়িঘর জমিজমা পুরোপুরি বেহাত হয়ে যেত। রাজাকার বা ইন্ডিয়া থেকে চলে-যাওয়া বিহারী মুসলমানরা একবার সে-সব দখল করে বসলে কে তাদের কবল থেকে তা উদ্ধার করবে? কলকাতায় থেকে ওদের চুলের ডগাও ছোঁওয়া যাবে না। কেউ যদি দখল করে নাও নেয়, অন্যদিক থেকে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা রয়েছে। হাওয়ায় হাওয়ায় এখন একটাই গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান গভর্নমেন্ট খুব তাড়াতাড়িই হিন্দুদের ফাঁকা বাড়ি-টাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করবে। তাহলে সব আশায় জলাঞ্জলি। এই অবস্থায় পাকিস্তানের বাড়িঘরের বদলে যদি কলকাতায় একখানা বাড়ি পাওয়া যায়, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?
দ্বারিক দত্তর যুক্তি হল, তার তত তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। কদিন আর বাঁচবেন? কিন্তু হিরণ আর সুধার সামনে অনন্ত ভবিষ্যৎ। হিরণ ভাল চাকরি করে ঠিকই কিন্তু তার পক্ষে সংসার চালিয়ে কলকাতায় একটা বাড়ি করা কি মুখের কথা। তাঁর মতে খান মঞ্জিল নেওয়াটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ।
কিন্তু মুসলমানের সম্পত্তি বলে ভীষণ আপত্তি ছিল সুধা এবং হিরণের জেঠিমা সরস্বতীর। সুধাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো গেলেও, সরস্বতী ঘাড় বাঁকিয়ে ছিলেন। পাটনা থেকে ফিরে আসার পর দ্বারিক দত্ত, হিরণ আর বিনয় পুরো দেড় দিনের অবিরল চেষ্টায় তার মস্তিষ্কে শেষ পর্যন্ত এটা প্রবেশ করিয়ে দিতে পেরেছে যে এমন সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না। মুসলমানের সম্পত্তি বলে দোষটা কোথায়? সম্পত্তি সম্পত্তিই। তাছাড়া শওকত আলিরা তো তাঁদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকছেন না। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মত দিয়েছেন।
কিন্তু হিরণ ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ খান মঞ্জিল দেখেনি। অবশ্য বিনয় রাজদিয়া থেকে চলে আসার পর একদিন হিরণ তাকে বাইরে থেকে বাড়িটা দেখিয়ে এনেছিল। দ্বারিক দত্তরা দেখেননি, তার কারণ শওকত আলির সঙ্গে যখন এক্সচেঞ্জের কথা হচ্ছে সেইসময় দ্বারিক দত্ত আর সরস্বতী পাটনা চলে গেলেন। ওঁদের বাদ দিয়ে সুধা বাড়িটা দেখতে যেতে চায়নি। যা দেখার হিরণই দেখে এসেছে।
সরস্বতীকে রাজি করানোর পর দ্বারিক দত্ত বলেছিলেন, এক্সচেঞ্জ করে কেমন বাড়ি পাওয়া যাবে, সেটা একবার দেখাবি না হিরণ?
হিরণ বলেছে, নিশ্চয়ই। সে শওকত আলিকে খবর পাঠিয়েছিল, দ্বারিক দত্তরা পাটনা থেকে ফিরে এসেছেন। যেদিন তিনি এক্সচেঞ্জ করতে চাইবেন সেদিনই তা করা হবে। তবে দাদুরা একবার খান মঞ্জিল দেখতে চান। শওকত আলি যদি দেখাবার ব্যবস্থা করেন সে কৃতজ্ঞ থাকবে।
শওকত আলি তাঁর একটি লোককে দিয়ে খান মঞ্জিল-এর চাবি এবং একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, চারদিন পর বিনিময়ের যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলা হবে। তিনি একজন অ্যাডভোকেটকে নিয়ে হিরণদের বাড়ি আসবেন। হিরণও যেন তার উকিলকে সেই সময় থাকতে বলে। এক্সচেঞ্জের প্রক্রিয়া নিখুঁত হল কিনা দুই আইনজ্ঞ সেটা খুঁটিয়ে দেখবেন।
আজ রবিবার। ঠিক হল, বেলা খানিকটা চড়লে, দিনের তাপাঙ্ক বাড়লে খান মঞ্জিল দেখতে যাওয়া হবে। সবাই যেতে রাজি হলেও, সরস্বতী পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, যাবেন না। বাড়িটা সারিয়ে সুরিয়ে, ভোল পালটে যেদিন পুজোটুজো দিয়ে শুদ্ধিকরণ করা হবে, সেদিন যাবেন। তার আগে নয়। রক্তের মধ্যে বদ্ধমূল সংস্কার কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। এ-জীবনে বুঝিবা তা আর সম্ভব হবে না।
অগত্যা দুটো রিকশা ডেকে দ্বারিক দত্ত, হিরণ, সুধা আর বিনয় বেরিয়ে পড়ল। বিনয় এবং হিরণ বসেছে একটা রিকশায়। অন্যটায় দ্বারিক দত্ত আর সুধা।
হিমঋতুর বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীর লয়ে। কুয়াশা কেটে গেছে। রোদের তেজ কিছুটা বাড়ায় ঠাণ্ডাটা সেভাবে গায়ে বিধছে না। শীতের দিন হলেও ঝলমলে আলোয় ভরে আছে চারদিক।
জাফর শা রোড থেকে বেরিয়ে নানা অলিগলির ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে দুই রিকশা। একটার পেছনে আর-একটা।
সপ্তাহ কয়েক আগে এই এলাকায় হিরণের সঙ্গে বাজার ফেরত একবার এসেছিল বিনয়। দুধারের গরিব মুসলমানদের বস্তিগুলোতে সেই পরিচিত দৃশ্য। অগুনতি বাচ্চা কাচ্চা ছুটোছুটি করছে। তুমুল হইচই। তাদের সঙ্গে রয়েছে একপাল মুরগি আর রাস্তার নেড়ি কুকুর। খাঁটিয়া পেতে বয়স্ক কিছু পুরুষ ময়লা কাথা বা ধুসো কম্বল গায়ে জড়িয়ে রোদ থেকে উত্তাপ শুষে নিচ্ছে। এখানে পর্দার কড়াকড়ি নেই। সেদিনের মতো আজও দেখা গেল, দূর থেকে নানা বয়সের অনেকগুলো মেয়েমানুষ তাদের লক্ষ করছে। এখানকার বাসিন্দাদের চোখেমুখে যতটা কৌতূহল, তার চেয়ে উদ্বেগ এবং অস্বস্তি অনেক বেশি। হিরণের কাছে বিনয় শুনেছিল, ছেচল্লিশের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের দিন এই-সব বস্তি থেকে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান স্লোগান দিতে দিতে লম্বা মিছিল গড়ের মাঠের দিকে গিয়েছিল। যে নেতারা একদিন এদের উসকে দিয়েছিল, ইন্ডিয়াকে দুটুকরো করে মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য গরম গরম বুলিতে রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে লটবহর গুছিয়ে সীমান্তের ওপারে তারা উধাও হয়েছে। পড়ে আছে এইসব হা-ভাতে গরিব মানুষের দঙ্গল। এই সেদিন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ঘটে গেছে। কলকাতা শহর হয়ে উঠেছিল নিদারুণ এক বধ্যভূমি। চারদিকে শুধু হত্যা। আগুন। অবিরল রক্তপাত। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের পাহাড়। সেদিনের ভয়াবহ দাঙ্গা কারও স্মৃতি থেকে এখনও বিলীন হয়ে যায়নি। বরং দগদগে ক্ষতের মতো টাটকা। এইসব বস্তির বাসিন্দারা হয়তো ভাবে, চারপাশের মানুষ সারাক্ষণ অস্ত্রে শান দিচ্ছে। তাই ভয়। তাই শঙ্কা। তাই উৎকণ্ঠা।
হিরণ বলেছিল, পার্টিশানের পর এই এলাকা থেকে অনেকেই চলে গেছে। এখনও যাচ্ছে। কেউ পূর্ব পাকিস্তানে। কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু বস্তির এই মানুষগুলো ঘাড় গুঁজে এখানেই পড়ে আছে।
নতুন দেশে গিয়ে কোথায় আশ্রয় পাবে, কী করবে, কী খাবে, কিছুই জানা নেই। হয়তো সেখানে গেলে আরও বড় কোনও সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। কিন্তু এই টালিগঞ্জ তাদের পরিচিত জায়গা। কয়েক পুরুষ ধরে তারা এখানে বাস করে আসছে। দেশভাগের পর ভয়ে ভয়ে তাদের দিন কাটছে। রয়েছে প্রবল দুর্ভাবনা। তবু এই এলাকা ছেড়ে তারা চলে যেতে পারেনি।
চাপ-বাঁধা বস্তিগুলোর পর আরও কটা অলিগলি পেরিয়ে একটা বেশ চওড়া রাস্তায় এসে পড়ল বিনয়রা। ডান পাশে মিনিট খানেক যেতেই খান মঞ্জিল। হিরণ রিকশাওলাকে বলল, এখানে থামো–
রিকশা দাঁড়িয়ে পড়ল। সুধারা পেছন পেছন আসছিল। তাদের রিকশাও থেমে গেল।
হিরণ বলল, আমরা এসে গেছি। সবাই নেমে পড়।
বিনয় লক্ষ করল, সেদিনের মতো আশেপাশের কটা বাড়ির জানালায় আজও বেশ কিছু কৌতূহলী মুখ। পুরুষ কম। মেয়েরাই বেশি। কিশোরী থেকে মধ্যবয়সিনী। উৎসুক দৃষ্টিতে তারা বিনয়দের দেখছে।
দ্বারিক দত্তকে ধরে ধরে নামিয়ে এনেছিল সুধা। ভাড়া মিটিয়ে বিনয় সবাইকে নিয়ে খান মঞ্জিল এর গেটের সামনে চলে এল।
মস্ত লোহার ফটকের পাশে বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে বাড়িটার নাম এবং প্রতিষ্ঠার বছর বড় বড় কালো হরফে লেখা রয়েছে। দ্বারিক দত্তর চোখ ফলকটায় আটকে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেটা পড়ে হিরণকে জিজ্ঞেস করলেন, এক্সচেঞ্জ করার পর বাড়ির নাম খান মঞ্জিলই থাকবে না কি?
হিরণ শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, না না, বাড়িটা তখন আমাদের হয়ে যাবে। পছন্দমতো একটা নাম দেব। কদিন আগে বিনুকে বাড়িটা দেখাতে এনে সেই কথাই বলেছি।
কী নাম দিতে চাস?
সেটা তোমাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করব।
দ্বারিক দত্ত খুশি হলেন, হ্যাঁ, ভেবে চিন্তে একটা সুন্দর নাম দিতে হবে।
গেটের দুটো পাল্লা শেকল দিয়ে আটকে তালা লাগানো ছিল। তালা খুলে সকলকে সঙ্গে করে ভেতরে ঢুকে পড়ল হিরণ।
সেকেলে ধাঁচের তেতলা বাড়িটা মাঝখানে। সেটাকে ঘিরে চারপাশে অনেকটা করে ফাঁকা জায়গা। এককালে সামনের দিকে বাগান ছিল। এখন মানুষজন থাকে না। যত্ন নেই। পরিচর্যা নেই। ফুলের গাছগুলো শুকিয়ে কাঠিসার। নানা ধরনের বাহারি লতা ছিল। সব দড়ি পাকিয়ে গেছে। পাতাবাহার গাছ, ঝাউ গাছ, কোনওটাই সতেজ নেই। সেগুলোরও মরণদশা।
হিরণ সুধা আর দ্বারিক দত্তকে জিজ্ঞেস করল, আগে বাড়ির ভেতরে যাবে, নাকি চারপাশ দেখে নেবে?
সুধারা জানায়, চারদিক দেখার পর মূল বাড়িতে ঢুকবে।
চল–
বাড়িটার দুধারে এবং সামনে পেছনে এক চক্কর ঘোরা হল। দুপাশে লাইন দিয়ে দেবদারু গাছ। সেগুলোও মলিন। ম্রিয়মাণ। বাড়ির সামনের অংশের মতো পেছনেও বেশ বড় বাগান। সেখানকার গাছগুলোর একই হাল। একধারে একটা গ্যারাজ আর ঘোড়ার আস্তাবল রয়েছে। এসব এ-বাড়ির সুখের দিনের স্মৃতিচিহ্ন। শওকত আলির বাবা রহমত আলি ছিলেন বাঘা উকিল। বিপুল পশার ছিল তার। সেই সময় একটা অস্টিন গাড়ি, ফিটন আর ঘোড়া কিনেছিলেন। এখন গাড়ি ঘোড়া কিছুই নেই। গ্যারাজ, আস্তাবল ফাঁকা পড়ে আছে।
চারপাশ দেখানোর পর তালা খুলে মূল বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল হিরণরা। বিনয় সেদিন বাইরে থেকে দেখে গিয়েছিল। বাইরেটা সাদামাঠা, সাবেক ধাঁচের হলেও ভেতরটা চমৎকার। একতলা থেকে তিনতলা, সমস্ত ঘরের মেঝে, বারান্দা, সিঁড়ি, সবেতেই শ্বেত পাথর বসানো। সিলিংয়ে পঙ্খের সুন্দর সুন্দর নকশা। চওড়া চওড়া দেওয়াল। প্রতিটি জানালায় দুটো করে পাল্লা। একটা রঙিন কাঁচের। অন্যটা কাঠের খড়খড়ি। সেগুন কাঠের পুরু দরজাগুলোতে কত রকমের কারুকাজ। ওঠানামার সিঁড়ির ধারে কাঠের রেলিংয়ের ওপর পেতলের পাত বসান। প্রতিটি ঘর বার্মা টিকের ভারী ভারী আসবাবে বোঝাই। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল, চেয়ার, কুশন ইত্যাদি রকমারি জিনিস।
ছাদটাও ঘুরে ঘুরে দেখা হল। কার্নিস কোথাও কোথাও ভেঙে গেছে। রেন-ওয়াটার পাইপের মুখে ফাটল। সমস্ত দেখা হয়ে গেলে প্রতিটি ঘরে তালা লাগিয়ে নিচে নামতে নামতে হিরণ সবাইকে জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলে বাড়িটা?
দ্বারিক দত্ত তারিফের সুরে বললেন, খাসা। আমাদের রাজদিয়ার বাড়িঘর আর জমিজমার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে কলকাতায় এমন একটা বিল্ডিং পাওয়া যাবে, ভাবতেই পারিনি। এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা করে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস হিরণ। খান মঞ্জিল হাতছাড়া হলে পস্তাতে হতো। দক্ষিণ আর পুব দিকটা পুরো খোলা। আলো হাওয়ার কোনওদিন অভাব হবে না। তা ছাড়া
কী?
দেখে টেখে মনে হল, বাড়িটা ভীষণ মজবুত। যেটুকু মেরামতি দরকার, তাতে খুব একটা খরচ হবে না। তবে রান্নাঘর টর ভেঙে নতুন করে বানাতে হবে।
ইঙ্গিতটা ধরে ফেলেছিল হিরণ। বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
সুধা বলল, পুরো বাড়িটার ভেতরে বাইরে রং করাতে হবে। নইলে জেঠিমাকে এখানে আনা যাবে না।
হিরণ বলল, রংও করাব। বিল্ডিংটার ভোল এমন পালটে দেব যে চিনতেই পারবে না। মনে হবে একেবারে নতুন।
হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় চিন্তাগ্রস্তের মতো সুধা বলে উঠল, কিন্তু
আবার কী?
এ-বাড়িতে যে খাট আলমারি টালমারি রয়েছে সেগুলোর কী হবে?
এদিকটা আগে ভেবে দেখেনি হিরণ। কী উত্তর দেবে, ঠিক করে উঠতে পারল না।
সুধা থামেনি, এ-সব ফার্নিচার আমরা কিছুতেই ব্যবহার করব না।
হিরণের মাথাতেও আসবাবগুলোর চিন্তা পাক খাচ্ছিল। চকিতে সমস্যার একটা সমাধানও সে পেয়ে গেল। বলল, শওকত সাহেবকে তার খাট টাট নিয়ে যেতে বলব।
সেই ভাল। নিজেদের জিনিস ওরা নিয়ে যাক।
.
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে রাস্তায় চলে এল বিনয়রা।
যে রিকশা দুটোয় চড়ে তারা এখানে এসেছিল, কোথাও তাদের দেখা পেল না। ভাড়া বুঝে নিয়ে ওরা চলে গেছে।
এখানকার কাজ শেষ। খান মঞ্জিল দেখে সুধা এবং দ্বারিক দত্ত দুজনেই খুশি। দ্বারিক দত্ত তো উচ্ছ্বসিতুই হয়ে উঠেছেন। বেশ ভালই লাগছে হিরণের।
এবার ফেরার পালা। সেই দুটো রিকশা না থাকলেও ডান পাশে খানিক দূরে একটা ডালপালাওলা ঝকড়া রেন-ট্রির তলায় রিকশা স্ট্যান্ড চোখে পড়ল হিরণের। পাঁচ ছটা গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত নেড়ে তাদের ডাকতে যাচ্ছিল, বাধা পড়ল।
দ্বারিক দত্ত বললেন, এখন বাড়ি যাব না। রিকশা ডাকিস না।
হিরণ অবাক হল, কী করবে এখানে থেকে?
বাড়ি তো ভালই জোগাড় করেছিস। তবে আশেপাশের লোকজন, পরিবেশ কেমন, সেটা একটু বুঝবার চেষ্টা করি। প্রতিবেশী ভাল না হলে বড় অশান্তি।
দ্বারিক দত্তর মনোভাবটা পরিষ্কার। হিরণ বলল, তুমি কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জিজ্ঞেস করবে, মশায় আপনারা মানুষ কেমন? কথায় কথায় কি ঝামেলা বাধান, না শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক?
দ্বারিক দত্ত হেসে ফেললেন, আরে বাবা, কারও বাড়িতেই আমি ঢুকব না। দুনিয়ায় কতকাল বেঁচে আছি! বয়েস আর এক্সপিরিয়েন্স তো কম হল না। মানুষের মুখ দেখলে তার চরিত্র কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। কোথাও গেলে, সেই জায়গাটা কেমন, ভাল না মন্দ, তার গন্ধ পাই।
হিরণ এ নিয়ে কথা বাড়াল না। বলল, কোন দিকে যাবে, বল–।
এধারে ওধারে তাকিয়ে দ্বারিক দত্ত বললেন, বাঁ দিকটায় চল ওই দিকটায় অনেকগুলো দোতলা তেতলা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ওপারেও বেশ কিছু দালানকোঠা। দূরে একটা মাজার চোখে পড়ছে।
হাঁটতে হাঁটতে সব লক্ষ করছিলেন দ্বারিক দত্ত। বললেন, এখানে হিন্দুদের বাড়ি খুব কম– তাই না?
হিরণ বলল, আগে এই এরিয়ায় টেন পারসেন্টের মতো হিন্দু ছিল। এখন প্রায় সেভেন্টি পারসেন্ট। যত বাড়ি দেখছ তার বেশির ভাগই এখানকার মুসলিমরা, এক্সচেঞ্জ করে বা বেচে পাকিস্তানে চলে গেছে। বাকি যারা রয়েছে তারাও অনেকে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে।
ও।
আগেই রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর জানালায় জানালায় সারি সারি উৎসুক মুখ দেখা গিয়েছিল। এখনও তারা অপার কৌতূহলে তাকিয়ে আছে। কী উদ্দেশ্যে বিনয়রা এ-পাড়ায় এসেছে, সেটা আঁচ করে নিতে চাইছে।
বাঁ পাশের তিন চারটে উঁচু বাড়ি পেরিয়ে যাবার পর একটা দোতলার সামনে আসতে দেখা গেল, গেটের কাছে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবির ওপর গরম পশমি চাদর জড়ানো। পায়ে চটি।
টকটকে রং ভদ্রলোকের। ধারালো নাক। বড় বড় চোখ। চওড়া কপাল। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হলেও বেশির ভাগ চুলই কুচকুচে কালো। অল্পই পেকেছে। সব মিলিয়ে বেশ সুপুরুষ। কিন্তু চোখের তলায় গাঢ় কালির ছোপ। সমস্ত চেহারায় অনন্ত বিষাদ মাখানো। তার দিকে তাকানোমাত্র টের পাওয়া যায়, সারাক্ষণ বুঝি বা কী এক যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন।
ভদ্রলোক যেচে আলাপ করলেন। হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার। আমার নাম মধুসূদন ভট্টাচার্য। আমাদের দেশ ইস্ট পাকিস্তানে। কুমিল্লায়। সম্প্রতি ইন্ডিয়ায় এসেছি। তাঁর কথায় পূর্ব বাংলার টান।
বিনয়রা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সবাই প্রতি-নমস্কার জানালো। দ্বারিক দত্ত নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমাদের দেশ ছিল ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের রাজদিয়ায়। আরও জানালেন সুধা, হিরণ আর তিনি বেশ কবছর হল কলকাতায় এসেছেন। বিনয় এসেছে দেশভাগের অনেক পর, এই সেদিন।
মধুসূদন বললেন, আপনাদের খান মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। আজকাল ইস্ট পাকিস্তানের অনেকে এখানকার মুসলিমদের বাঘিরের সঙ্গে তাদের দেশের প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে চলে আসছে। আপনাদেরও কি সেইরকম ইচ্ছা?
ঠিকই ধরেছেন। দ্বারিক দত্ত জানান, খান মঞ্জিল-এর সঙ্গে তারা রাজদিয়ার বিষয়আশয় এক্সচেঞ্জ করবেন। কথা পাকা হয়ে গেছে।
গভীর আগ্রহে মধুসূদন বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে আসুন। বাইরে থেকে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় খান মঞ্জিল বিল্ডিংটা বেশ মজবুত। চারপাশে জায়গাও অনেকখানি। একটু থেমে নিজের বাড়িটা দেখিয়ে বললেন, এক দালাল মারফত এক্সচেঞ্জ করে আমিও এটা পেয়েছি। ঈশ্বরের করুণাই বলতে পারেন। পাকিস্তানের যা হল, আর দেরি হলে সেখানকার প্রপাটি বেহাত হয়ে যেত। আমাদের শিয়ালদা স্টেশনে কিংবা রিফিউজি ক্যাম্পে পচে মরতে হতো।
বিনয়রা এবার খুঁটিয়ে মধুসূদন ভট্টাচার্যের বাড়িটা লক্ষ করল। সদ্য কলি ফেরানো হয়েছে। দরজা জানালা থেকে টাটকা পেন্টের গন্ধ ভেসে আসছে।
হিরণ বলল, আপনিও বেশ ভাল বাড়ি পেয়েছেন।
মধুসূদন সামান্য হাসলেন।
খান মঞ্জিল-এর একতলা থেকে তেতলার ছাদ পর্যন্ত ওঠানামা করে, ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখে, তারপর রাস্তায় বেরিয়ে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন দ্বারিক দত্ত। হাজার হোক, বয়স তো কম হয়নি। তার ওপর তেষ্টাও পেয়েছে। বললেন, ভট্টাচাজ্জি মশায়, আমাকে এক গেলাস জল খাওয়াতে পারেন?
বিনয়দের নজরে পড়ল, কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়েছেন মধুসূদন। চোখেমুখে অস্বাচ্ছন্দ্য ফুটে বেরিয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে দ্বারিক দত্তদের অনেক আগেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মধুসূদনের মধ্যে এ-ব্যাপারে কোথায় যেন একটা বাধা আছে। এদিকে তৃষ্ণার্ত মানুষটিকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জল এনে দেওয়া যায় না। দ্বিধাভরে তিনি বললেন, ভেতরে আসুন
গেটের পর সুরকির পথ পেরিয়ে মূল বাড়ির সদর দরজা। সেটা ভোলাই ছিল। মধুসূদন সবাইকে একতলার বসার ঘরে নিয়ে এলেন। গদি-বসানো খানকয়েক বেতের সোফা, কাঁচ-লাগানো গোলাকার নিচু সেন্টার টেবল দিয়ে ঘরটা সাজানো। অবশ্য এক ধারে ধবধবে চাদর পাতা একটা তক্তপোশ আর গোটা দুই বইয়ের আলমারিও রয়েছে।
মধুসূদন বললেন, বসুন। আমি জল নিয়ে আসছি—
বিনয়রা সবে বসেছে, আচমকা বাড়ির ভেতর থেকে তীব্র কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। কোনও মহিলার বুকফাটা বিলাপ। করুণ, একটানা।
ত্রস্ত, সচকিত মধুসূদন দৌড়ে ডানদিকের একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। অতিথিদের দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না।
আর বিমূঢ়ের মতো বিনয়রা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।
.
১৮.
যে কাঁদছে তার কত বয়স, কে জানে। তবে কিশোরী বা যুবতী নয়। হয়তো বয়স্ক কোনও মহিলা। কান্নাটা তার শিরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। কী যে তীব্র আকুলতা আর ক্লেশ এর সঙ্গে জড়ানো, ঠিক বোঝানো যায় না। এটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে, দেশের ভিটেমাটি সোনাদানার চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান কিছু না খোয়ালে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে না।
মধুসূদন ভট্টাচার্যের পরিবারে এমন কিছু ঘটেছে যা শোকাবহ, নিদারুণ। তার তলকূল অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিনয়রা ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
হিরণ চাপা গলায় বলল, আমাদের এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। চল—
বিনয় বলল, মধুসূদনবাবুর মুখচোখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল, বাড়ির ভেতর আমাদের নিয়ে আসার ইচ্ছা ওঁর ছিল না। দাদু জল খেতে চাইলেন, তাই ভদ্রতার খাতিরে ডেকে এনেছেন। একটু থেমে বলল, এদের বাড়িতে মারাত্মক কিছু ঘটেছে। হিরণদা ঠিকই বলেছে, আমাদের চলে যাওয়াই উচিত; উঠে পড়–
বিনয়, সুধা আর হিরণ উঠতে যাচ্ছিল, হাত নেড়ে তাদের থামিয়ে দিলেন দ্বারিক দত্ত, লোকটা আমাদের বাড়িতে এনে বসিয়েছে। তাকে না বলে চলে যাব? এটা কোন দেশি শিষ্টাচার? তাছাড়া
বিনয় জিজ্ঞেস করল, তাছাড়া কী?
ওরা আমাদের ইস্ট বেঙ্গলের লোক। উদ্বাস্তু। নিশ্চয়ই কোনও বড় রকমের দুঃখের কারণ ঘটেছে। সমস্ত জেনে নিয়ে, পারলে ওদের সাহায্য করা উচিত। দেশের মানুষের পাশে না দাঁড়ালে চলে?
অগত্যা কারওই আর ওঠা হয় না। যে যার চেয়ারে বসে থাকে।
বাড়ির ভেতরে কী হচ্ছে, বাইরের ঘর থেকে তার কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। শুধু কান্না আর করুণ, কাতর বিলাপ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই।
অনেকক্ষণ পর কান্নার তীব্রতা কমতে কমতে থেমে যায়। বাড়িটা একেবারে নিঝুম হয়ে গেছে।
একসময় মধুসূদন বাইরের ঘরে ফিরে এলেন। তার হাতে ঝকঝকে কাঁসার থালায় চার গেলাস জল। সঙ্গে এসেছে একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের কিশোর। রোগা, ফর্সা, মুখখানা ভারী মলিন। চুল উষ্কখুষ্ক। পরনে হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্টের ওপর সোয়েটার। তার হাতেও একটা কাঁসার থালা। সেটায় সাজানো রয়েছে অনেকগুলো নারকেলের নাড় আর কাঁচাগোল্লা। অতিথিদের শুধু জল তো দেওয়া যায় না।
বিনয় লক্ষ করল, মধুসূদনকে আগের থেকে অনেক বেশি বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। সারা মুখে অসহ্য কষ্টের ছাপ। কেমন যেন উভ্রান্ত লাগছে।
টেবলে কাঁসার থালাসুদ্ধ জলের গেলাসগুলো নামিয়ে রাখলেন মধুসূদন। কিশোরটিও তার হাতের থালাটা সেটার পাশে রাখল।
দ্বারিক দত্ত বললেন, খালি জল চেয়েছিলাম। আবার মিষ্টি কেন?
মধুসূদন বললেন, এই সামান্য একটু
দাঁড়িয়ে কেন? বসুন–
মধুসূদন একটা চেয়ারে নিঃশব্দে বসে পড়লেন। দ্বারিক দত্ত কিশোরটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কে? ছেলে?
আস্তে মাথা নাড়লেন মধুসূদন, হ্যাঁ।
দ্বারিক দত্ত ছেলেটিকে ডেকে তার পাশে বসিয়ে বললেন, কী নাম তোমার দাদাভাই?
ছেলেটি সবে কলকাতায় এসেছে। এখনও জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আড়ষ্টভাবে বলল, মন্টু। ভাল নাম কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্য।
কোন ক্লাসে পড়?
দেশে থাকতে নাইনে পড়তাম। এখানে এসে এখনও স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি।
মধুসূদন জানালেন, কাছাকাছি দুতিনটে স্কুলে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। আশা করা যায়, এই সপ্তাহেই কোথাও ভর্তি করে দিতে পারবেন।
জলের গেলাস তুলে নিলেন দ্বারিক দত্ত। বিনয়রাও একটা করে তুলল। ঘোরাঘুরি করে তাদেরও তেষ্টা পেয়েছে।
মধুসূদন বললেন, প্রথম দিন এলেন। একটু মিষ্টিমুখ না করলে কি হয়? একটা নাড় কি কাঁচাগোল্লা অন্তত নিন।
দ্বারিক দত্ত বয়সের দোহাই দিয়ে জানালেন, বৃদ্ধ হয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছেন। তার ওপর খেলে কষ্ট হবে। বিনয়রা অবশ্য রেহাই পেল না। তাদের নাড়-টাড় নিতেই হল।
জল খাওয়া হলে দ্বারিক দত্ত বললেন, যদি অন্যায় না হয়, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
মধুসূদন কয়েক মুহূর্ত দ্বারিক দত্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন। পলকহীন। তারপর জোরে শ্বাস টেনে বললেন, আপনি কী জানতে চাইছেন তা আন্দাজ করতে পারছি।
দ্বারিক দত্ত উত্তর দিলেন না।
মধুসূদন মন্টুকে বললেন, তুই ভেতরে যা। ছেলে চলে যাবার পর এভাবে শুরু করলেন, মন্টুর সামনে কথাটা বলতে চাই না, তাই পাঠিয়ে দিলাম। অবশ্য ও বড় হয়েছে। সবই বোঝে। তবু– শেষ না করে থেমে গেলেন তিনি।
দ্বারিক দত্ত এবারও চুপ।
মধুসূদন বলতে লাগলেন, যার কান্না শুনে আপনাদের বসিয়ে রেখে বাড়ির ভেতর দৌড়ে গিয়েছিলাম সে আমার স্ত্রী কমলা। দিন নেই, রাত নেই, যে-কোনও সময় ও এইভাবে কেঁদে ওঠে। যতদিন বেঁচে আছে, কেঁদেই যাবে। ওর কান্নার শেষ নেই।
ঘরের ভেতর স্তব্ধতা নেমে আসে।
কিছুক্ষণ পর নৈঃশব্দ্য ভেঙে মধুসূদন এলোমেলোভাবে যা বললেন, গুছিয়ে নিলে এইরকম দাঁড়ায়।
তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। কয়েক পুরুষ ধরে তারা গুরুগিরি করে এসেছেন। গোটা ইস্ট বেঙ্গল জুড়ে তাদের কত যে শিষ্য-সেবক ছিল তার লেখাজোখা নেই।
মধুসূদনদের শহরে এবং গ্রামে দুজায়গাতেই বিশাল বাড়ি। তারা অবশ্য বেশির ভাগ সময় শহরে থাকতেন। মাঝে মাঝে গ্রামে। বাড়ি ছাড়াও গ্রামে ছিল চকের পর চক জুড়ে জমিজমা। ফলের বাগান। তিন চারটে দীঘি। ফলে প্রচুর ধান, প্রচুর পাট, অজস্র ফল, অঢেল মাছ। সে-সব তদারকি করতে তাঁদের গ্রামে যাওয়া।
ব্রাহ্মণত্বের যাবতীয় গোঁড়ামি এবং সংস্কার ছিল মধুসূদনদের হাড়ে-মজ্জায়। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্ম উত্তরাধিকার হিসেবে সেগুলো পেয়ে আসছিল। ঠাকুরদা পর্যন্ত তাঁদের বংশের সবাই টোলে গিয়ে সংস্কৃত টংস্কৃত পড়ে এসেছেন। গুরুগিরিটা চলছিল মসৃণ নিয়মে। কিন্তু সময় বদলে যাচ্ছিল ত্বরিত গতিতে। মধুসূদনের বাবা শশিশেখর টোলে আদ্য মধ্য ইত্যাদি পড়তে যাননি। বংশধারা বিরোধী কাজই করেছিলেন তিনি। ইংরেজি শেখার জন্য কেঁদেকেটে শহরের অন্য সব বাড়ির ছেলেদের মতো প্রথমে এম ই স্কুলে পড়ে হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। গুরুগিরি-টিরি তার ধাতে ছিল না। ম্যাট্রিকটা পাশ করার পর ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন। তখন ব্রিটিশ আমল। ডি. এম খাঁটি ইংরেজ। ম্লেচ্ছর দপ্তরে গোলামি করার জন্য বাড়িতে অশান্তি কম হয়নি।
সেই যে পরম্পরা ভেঙে গিয়েছিল, সেটা আর ঠেকানো যায়নি। শশিশেখরের ছেলে মধুসূদনও গুরুগিরি বা সংস্কৃত টংস্কৃত নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাননি। বি এ পাস করার পর জুট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলেন। তাদের শহরে কোম্পানিটার ব্রাঞ্চ অফিস ছিল। চারপাশের চাষীদের কাছ থেকে পাট জোগাড় করে তাঁরা নারায়ণগঞ্জের জুট মিলে পাঠাতেন।
জুট কোম্পানিতে কয়েক বছর কাজ করার পর যুদ্ধ লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যাঙ্ক গজাতে লাগল সারা দেশে। পূর্ব বাংলায় তাদের সেই শহরটিও বাদ পড়ল না। তেমনই একটা ব্যাঙ্কে অনেক বেশি মাইনেতে কাজ পেয়ে গেলেন মধুসূদন। প্রথমে ডেপুটি ম্যানেজার, পরে ম্যানেজার।
যুদ্ধ থামার পর শতকরা নব্বই ভাগ ব্যাঙ্কই মানুষের টাকাপয়সা মেরে দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দিল। কিন্তু মধুসূদনদের ব্যাঙ্কের মালিকরা লোকজনকে সর্বস্বান্ত করে, পথের ভিখিরি বানিয়ে, নিজেরা রাতারাতি লক্ষপতি, কোটিপতি হতে চাননি। তেমন কু-মতলব তাদের ছিল না। তাঁরা সৎভাবে ব্যবসা করতে এসেছিলেন। অন্যগুলো লাল বাতি জ্বাললেও মধুসূদনদের ব্যাঙ্ক রমরম করে চলতে লাগল।
মহাযুদ্ধের অবসান হল ঠিকই, কিন্তু ভারতবর্ষের ওপর চরম দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। নিমেষে কত কী-ই যে ঘটে গেল। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের এ দেশে আসা, আই এন এর সেনাপতিদের বিচার। রশিদ আলি ডে। স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল শহর বন্দর গ্রামগঞ্জ। নৌ-বিদ্রোহ। পাকিস্তানের দাবিতে অনড় জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। কলকাতা বিহার নোয়াখালি বোম্বাই পাঞ্জাব-সারা দেশ জুড়ে শুধুই হত্যা। লুটপাট। ধর্ষণ। আগুন।
মধুসূদনদের শহরে উত্তেজনার আঁচ যে ছড়িয়ে পড়েনি তা নয়। কিন্তু খুন বা আগুনের মতো কোনও ঘটনাই তখনও সেখানে ঘটেনি। শহরটা মোটামুটি শান্তই ছিল।
ডাইরেক্ট অ্যাকশনের এক বছরের মধ্যে দেশভাগ হয়ে গেল। অখণ্ড ভারতবর্ষকে দুটুকরো করে তৈরি হল আলাদা একটি দেশ-পাকিস্তান। বাকি অংশটা সাবেক নামই ধরে রাখল–ভারত।
পার্টিশানের পর কিছুদিন নির্বিঘ্নেই কেটেছে। কিন্তু তারপর শুরু হল মুসলিম লিগ আর রাজাকারদের উৎপাত। তাছাড়া, ইন্ডিয়া থেকে যে পশ্চিমা মুসলমানরা ইস্ট বেঙ্গলে চলে গেছে তাদের অনেকেই মধুসূদনদের শহরে গিয়ে আস্তানা গেড়েছিল। এরা হাত মিলিয়েছিল রাজাকারদের সঙ্গে। স্থানীয় বহু মুসলমানও এদের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল। ওদের সবার লক্ষ্য হিন্দুদের প্রপার্টি। শহরের আবহাওয়া দ্রুত পালটে যেতে লাগল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক।
প্রথম প্রথম ওরা বেনামা চিঠি দিত। যত তাড়াতাড়ি পার, হিন্দুস্থানে চলে যাও।
খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও দেশ ছাড়ার কথা ভাবেননি মধুসূদন। কয়েক পুরুষ ধরে পাশাপাশি বাস করে আসছেন, এমন মাতব্বর জাতীয় কয়েকজনকে গিয়ে চিঠিগুলো দেখিয়েছেন তিনি। তারা ভরসা দিয়েছেন, ইন্ডিয়ায় যাবার কোনও প্রায়োজন নেই। যেমন আছেন তেমনি থাকুন। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। অন্য সবার মতো জন্মভূমিতে থাকার হক তার আছে।
আশ্বাস পাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু দুর্ভাবনা কাটল না। আগে যারা বেনামা চিঠি পাঠাত এবার তাদের চেহারাগুলো দেখা যেতে লাগল। রাস্তায় বেরুলেই সামনে এসে তারা দাঁড়াত।
পাকিস্থান অহন আমাগো দ্যাশ। এইখানে পইড়া আছেন ক্যান? ইন্ডিয়ায় ম্যালা সুযুগ সুবিধা পাইবেন। যান গিয়া।
শহরের মান্যগণ্য মানুষগুলোর কাছে আবার ছুটলেন মধুসূদন। ফের আশ্বাস জুটল।
এইভাবে চলল মাস দেড় দুই। তারপর সরাসরি হুমকি শুরু হল।
ভাল কথায় কতবার কইছি, কিন্তুক আপনে কানে তুললেন না। ভসচাষ (ভট্টাচার্য) মশয়, এইবার কিম জবর তাফালে (বিপদে পড়বেন।
তাদের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী বলে যাঁকে জানতেন, সেই শাহাবুদ্দিন সাহেব, শহরের মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান, তার কাছে দৌড়লেন মধুসূদন। খাতির যত্ন করে তাঁকে বসালেন শাহাবুদ্দিন। মন দিয়ে তার দুর্ভাবনার কথা শুনলেন।
আগে বহুবার শাহাবুদ্দিনের কাছে এসেছেন। কিন্তু এবার কোনওরকম ভরসা দিলেন না। চিন্তাগ্রস্তের মতো গম্ভীর মুখে বললেন, টাউন জবর গরম হইয়া উঠছে। আপনার লাখান অনেকেরই দ্যাশ ছাড়নের লেইগ্যা পশ্চিমারা আর রাজাকাররা শাসাইতে আছে। অবোস্থা দিন দিন আমার কনট্রোলের বাইরে চইলা যাইতে আছে। একটু থেমে সদয় সুরে বলেছিলেন, আমার একখান কথা হোনবেন?
কিসের একটা সংকেত পেয়ে গিয়েছিলেন মধুসূদন। বলেছিলেন, কী?
চির কাল তো দেইখা আইছেন, আমি আপনেগো হিত চাই। ইন্ডিয়ায় চইলাই যান।
আপনিও চলে যেতে বলছেন?
আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে শাহাবুদ্দিন সাহেব বলেছিলেন, হ। নাইলে শয়তানের ছাওরা কহন যে কী কুকম্ম কইরা ফালাইব ক্যাঠা জানে।
শেষ ভরসাটুকুও মুহূর্তে ধূলিসাৎ। মধুসূদন দিশেহারার মতো বলেছিলেন, কিন্তু আমাদের বাড়িঘর, জমিজমা-এ-সবের কী হবে? ইন্ডিয়ায় গিয়ে কী করব? কী খাব? তার গলার স্বর বুজে এসেছিল।
হেই হগলের কথাও আমি ভাইবা রাখছি। দ্যাশ ছাইড়া চইলা গ্যালে আপনেগো বিষয়আশয় বেদখল হইয়া যাইতে পারে। উই রাজাকাররা কি পশ্চিমারা যদিন একবার গাইড়া বসে, সব্বনাশ। এই জম্মে আর হেইগুলা ফিরত পাওনের আশা নাই। আমি আপনেগো শহরের বাড়িখান দেখুম, কেও.যাতে বইয়া পড়তে না পারে। ইন্ডিয়া থিকা চিঠিপত্তরে যুগাযুগ রাইখেন। যদিন সুদিন ফিরে, দ্যাশে চইলা আইয়েন। কিন্তুক
কিন্তু কী?
টাউনে বইসা আপনেগো গেরামের জমিজেরাত সামলান তো সম্ভব না। তাই কই কি, হেই হগলের লেইগা আমি দ্যাড় লাখ টাকা দিমু। গেরামের উই সোম্পত্তি আমারে লেইখা দিবেন।
মধূসূদন বুঝতে পারছিলেন, শাহাবুদ্দিন সাহেব শুভাকাঙ্ক্ষী ঠিকই, কিন্তু তার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এছাড়া উপায়ই বা কী? তবু টাকার অঙ্কটা বাড়ানোর শেষ একটা চেষ্টা করেছিলেন, আমাদের সত্তর কানি ধান-পাটের জমি, গ্রামের বাড়ি, বাগান, তিন-তিনটে দীঘি, এত কিছুর বদলে মাত্র দেড় লাখ টাকা!
ভাইবা দ্যাখেন, চাইর দিকের যা হাল হেতে আপনে একখান ঘষা পয়সাও পাইতেন না। খালি হাতে ভিটামাটি ছাইড়া যাইতে হইত। হেই জাগায় আমি দ্যাড় লাখ দিতে আছি। কম হইল?
বুঝতেই পারেন, সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে হবে। কী যে কষ্ট! আমাকে কটা দিন ভাবতে দিন।
দ্যাশের গতিক দিনকে দিন খারাপ হইয়া যাইতে আছে। যা ভাবনের তরাতরি ভাইবেন।
কয়েক দিনের মধ্যে শহরের অবস্থা আরও ঘোরালো হয়ে উঠল। বেশ কটা বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। খুন হয়ে গেল পাঁচ ছজন।
শহরে ভাঙন শুরু হল। সর্বস্ব ফেলে স্রোতের মতো শয়ে শয়ে মানুষ পালাতে লাগল সীমান্তের ওপারে–ত্রিপুরায়, আসামে, পশ্চিম বাংলায়। তাদের ছেড়ে-যাওয়া জমিজমা বাড়িঘর দখল করে নিতে লাগল রাজাকাররা, ইন্ডিয়া থেকে যাওয়া পশ্চিমারা। এমনকি স্থানীয় মুসলমানরাও।
এদিকে আরও একটা মারাত্মক ব্যাপার ঘটছিল। এতদিন সংখ্যালঘুদের বিষয় সম্পত্তির দিকে চোখ ছিল ইবলিশদের। এবার তাদের নজর এসে পড়ল যুবতী মেয়েদের ওপর। শহরের পুরানো বাসিন্দা আচার্যদের, গুহদের, বসাকদের এবং এমন আরও কয়েকটা বাড়ির সাত-আটটা মেয়েকে রাতের অন্ধকারে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। তাদের টার্গেট তখন থেকে শুধু প্রপাটিই নয়, যুবতী নারীও।
মন্টু ছাড়াও মধুসূদনের একটি মেয়ে ছিল। দীপালি। তার বয়স তখন আঠারো। কলেজে পড়ছে। একদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এল সে। মুখ ছাইবর্ণ। আতঙ্কে চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।
বাড়িতে ঢুকেই ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়েছিল দীপালি। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছিল সে।
মধুসূদন সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। শরীরটা ভাল ছিল না। জ্বর জ্বর ভাব। তাই ব্যাঙ্কে যাননি। তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনেই মেয়েকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। গভীর উদ্বেগে অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর জানা গেছে, স্থানীয় লিগের এক পাণ্ড নিয়ামত আলির ছেলে শোভান সেদিন কলেজ কমপাউণ্ডে তার হাত ধরে টানাটানি করেছে। সে মার্কামারা বদমাশ। বলেছে, তাকে শাদি করতে চায়। দীপালি কোনওরকমে হাত ছাড়িয়ে বাড়িতে পালিয়ে এসেছে। উন্মাদের মতো সে বলে যাচ্ছিল, আর কলেজে যাবে না। পাকিস্তানে এক মুহূর্ত থাকবে না। তক্ষুনি নিরাপদ কোনও জায়গায় তাকে নিয়ে যেতে হবে।
মধুসূদন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। প্রাণ গেলেও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ের এ-জাতীয় বিয়ে হতে দেবেন না। কিন্তু শোভান বেপরোয়া, মারাত্মক। পাকিস্তান কায়েম হবার পর তার মতো শয়তানের পালের দাপট শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাবার ব্যাপারে মধুসূদনের সামান্য দ্বিধা ছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন। তবে সব গোছগাছ করে নিতে দুচারদিন লাগবে। সেই সময়টুকুর জন্য নিরাপত্তা দরকার। তিনি থানায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শোভানের বিরুদ্ধে কোনওরকম অভিযোগ শুনতে তারা রাজি নয়। নিরুপায় হয়ে এবার গিয়েছিলেন এস ডি ওর কাছে। তরুণ অফিসার। ভদ্র এবং সহৃদয়। নাম রফিকুল ইসলাম। আশ্বাস দিয়েছিলেন, সুরক্ষার ব্যাপারটা তিনি দেখবেন। লিগের পাণ্ডার ছেলেকে রফিকুল কতটা দমিয়ে রাখতে পারবেন, সে-সম্বন্ধে সংশয় ছিল। তবু খানিকটা স্বস্তি বোধ করেছিলেন মধুসূদন।
এস ডি ওর সঙ্গে কথা বলে তিনি গিয়েছিলেন শাহাবুদ্দিন সাহেবের কাছে। দেড় লাখ টাকায় গ্রামের যাবতীয় সম্পত্তি তার হাতে তুলে দিতে তিনি প্রস্তুত। এই হননপুরীতে আর এক লহমাও থাকা ঠিক নয়। বিশেষ করে দীপালিকে বাঁচাতে হলে দেশ ছাড়তেই হবে।
মধুসূদন জিজ্ঞেস করেছিলেন, টাকা নিয়ে কীভাবে ওপারে যাব? টের পেলে পথে ডাকাতরা কেড়ে নেবে। না দিলে খুন করে ফেলবে। যদিও বা তাদের নজর এড়াতে পারি, বর্ডারের অফিসাররা ছাড়বে না। পাকিস্তানের টাকা পাকিস্তানেই রেখে যেতে হবে।
শাহাবুদ্দিন সাহেব কিছুটা স্বার্থপর হলেও বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ লোক। বহু খবর রাখেন। বলেছেন, ঢাকায় মারোয়াড়িরা আছে। হেগো কাছে টাকা জমা দিয়া হুণ্ডি করন লাগব। কইলকাতায় হেগো আসল গদি। হেইখানে গিয়া হুণ্ডির কাগজ দ্যাখাইলে ট্যাকাটা পাইয়া যাইবেন।
ঠিক হল পরদিন স্ট্যাম্প কাগজে বিষয়সম্পত্তি লিখে সই করে দেবার পরই মধুসূদনকে নিয়ে ঢাকায় যাবেন শাহবুদ্দিন। সেইমতো যাওয়াও হল।
হুণ্ডি করে একটা রাত ঢাকায় কাটিয়ে যখন নিজেদের শহরে ফিরে এলেন, মধুসূদনের চোখের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। যে রাতটা তারা ছিলেন না, সেই সময়টুকুর মধ্যে বেশ কয়েকটা বাড়িতে আগুন ধরানো হয়েছিল। তাদের বাড়িটাও বাদ যায়নি। তবে সেটা খুব বেশি পোড়েনি। কিন্তু যেটা সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার তা হল, বাড়িতে কেউ নেই। না স্ত্রী, না মন্টু, না দীপালি। চারদিক খাঁ খাঁ করছে।
উন্মাদের মতো মধুসূদন ছুটেছিলেন এস ডি ওর কাছে। এই বিপদের দিনে শাহাবুদ্দিন সাহেব তার সঙ্গেই ছিলেন।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিকারি পাড়ায় স্ত্রী এবং মন্টুকে পাওয়া গিয়েছিল। গরিব নিকারিরা তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীপালির হদিস নেই। সারা শহরে তল্লাশি চালিয়েও তার সন্ধান মেলেনি।
শেষ পর্যন্ত মন্টু আর স্ত্রীর হাত ধরে সীমান্তের এপারে চলে এসেছেন মধুসূদন। কিছুদিন শিয়ালদা স্টেশন, কিছুদিন রিফিউজি ক্যাম্প ঘুরে, ইস্ট পাকিস্তানে তাদের সেই পোড়া বাড়িটার সঙ্গে টালিগঞ্জের এই বাড়িটা এক্সচেঞ্জ করেছেন। শাহাবুদ্দিন সাহেব কথা রেখেছিলেন, দেশের সেই বাড়িটা তিনি গ্রাস করেননি। বাড়ি বিনিময়ের কথা তাকে জানানো হয়েছিল। তিনি খুশি হয়েছেন।
মধুসূদন উদ্বাস্তু। বি এ পাস। বয়সটা বেশি হলেও একটা চাকরি জুটেছে। তাছাড়া সেই দেড় লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছেন। পয়সাকড়ির দিক থেকে তিনি নিশ্চিন্ত।
কিন্তু তার জীবনের সব চেয়ে বড় সংকটের কারণ হলেন তার স্ত্রী। রাতের অন্ধকারে দীপালিকে চোখের সামনে জোর করে হননকারীর দল তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। বছরখানেক হল, ইন্ডিয়ায় চলে এসেছেন তারা। দিন নেই, রাত নেই, যখন তখন, হঠাৎ হঠাৎ স্ত্রী বুক ফাটিয়ে কেঁদে ওঠেন। সহজে সেই কান্না থামতে চায় না।…
.
কথা শেষ করে অনেকক্ষণ বসে রইলেন মধুসূদন, নীরবে। বিধ্বস্ত, ভাঙাচোরা। তারপর রুদ্ধস্বরে বলতে লাগলেন, আপনারা আমাদের প্রতিবেশী হবেন। একদিন তো সবই জানতে পারবেন। আগেই তাই জানিয়ে দিলাম। একটু থেমে ফের শুরু করেন, মেয়েটাকে পাওয়া যায়নি। এ একরকম ভালই হয়েছে। পেলে কী করতাম? বিয়ে দেওয়া যেত না। কেউ আমাদের হাতের ছোঁয়া জল খেত না। ধর্ম গেছে। বংশের মান-সম্মান নাশ হয়েছে। সন্তানের মৃত্যুকামনা করতে নেই। কিন্তু দিবারাত্রি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, মেয়েটা যেন মরে যায়, মরে যায়, মরে যায়—
তার শেষ কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হতে থাকে সমস্ত বাড়ি জুড়ে। বিনয় মধুসূদনের দিকে তাকিয়ে ছিল, একদৃষ্টে। বুকের ভেতর শ্বাস আটকে যাচ্ছে। দীপালি যেন আরেক ঝিনুক। যার সঙ্গেই দেখা হয়, কোনও না কোনওভাবে, অনিবার্য এক নিয়মে, লাঞ্ছিত অপমানিত ঝিনুক বার বার তার স্মৃতিকে তোলপাড় করে দিয়ে যায়।
কারও মুখে কথা নেই। সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। যে ভয়াবহ সর্বনাশ মধুসূদনের হয়ে গেছে, সামান্য দুচারটে সহানুভূতির কথায় তার কতটুকু ক্ষতিপূরণই বা করা যায়!
একসময় বিদায় নিয়ে দ্বারিক দত্তরা উঠে পড়লেন। তাঁদের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। চোখমুখ বেদনাকাতর।
মধুসূদন সঙ্গ ছাড়েননি গেট অবধি বিনয়দের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এলেন। ধরা ধরা, ভাঙা গলায় বললেন, খান মঞ্জিল-এ এসে তো থাকবেনই। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসবেন।
দ্বারিক দত্ত মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মধুসূদন এবার সুধার দিকে তাকান, মা, তুমি এসে তোমার মাসিমাকে একটু বুঝিও, যা ভাগ্যে ছিল তাই ঘটেছে। এর ওপর তো মানুষের হাত নেই।
সুধার আবেগটা বড় বেশি প্রবল। কারও দুঃখের কথা শুনলে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। তীব্র ক্লেশে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। ঝাপসা গলায় বলল, আমার যতদূর সাধ্য, বোঝাতে চেষ্টা করব।
সুধাকে মধুসূদন যে আলাদা করে বেছে নিয়েছেন, তার কারণ সে মেয়ে। দ্বারিক দত্তদের অর্থাৎ পুরুষদের তুলনায় একটি মেয়ের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন তার স্ত্রী। সুধার সাহায্য চাইলেও মধুসূদনের অবশ্য সংশয় রয়েছে। খানিকটা আপন মনেই বললেন, ওর যা মনের অবস্থা তাতে কতটা কাজ হবে, কে জানে।
সুধা উত্তর দিল না।
সামনের রাস্তায় তিনটে সাইকেল রিকশা দেখা গেল। কোথাও সওয়ারি নামিয়ে সেগুলো ওধারের গাছতলার স্ট্যান্ডে ফিরে যাচ্ছে। হিরণ হাত তুলে দুটো রিকশাকে থামালো। তখনকার মতোই একটায় বিনয়কে নিয়ে সে উঠে পড়ল। অন্যটায় সুধা আর দ্বারিক দত্ত।
আগে আগে অলিগলির ভেতর দিয়ে, গরিব মুসলিমদের বস্তিগুলোর গা ঘেঁষে ঘেঁষে পথ দেখিয়ে, নিয়ে চলেছে হিরণ। পেছনে সুধারা।
মধুসূদন ভট্টাচার্যের মেয়ে দীপালির কথা শোনার পর থেকে সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী ছিঁড়ে পড়ছে বিনয়ের। যতটা দীপালির জন্য, তার বহুগুণ ঝিনুকের কারণে। সময় শোক এবং দুঃখের তীব্রতা ধীরে ধীরে জুড়িয়ে দেয়। প্রলেপ লাগিয়ে দেয় অদৃশ্য ক্ষতমুখে। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর প্রথম দিকে যতটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, অসহনীয় কষ্টে যতটা ছটফট করত, পরে সেটা মোটামুটি সামলে উঠেছিল সে। মানুষের সহ্যশক্তির বুঝি সীমাপরিসীমা নেই। কিন্তু দীপালির ঘটনাটা যখন মধুসূদ বলছিলেন, তার হৃৎপিণ্ডে একটা অদৃশ্য শেল আমূল বিধে যাচ্ছিল।
রিকশায় ওঠার পর থেকে একটি কথাও বলেনি বিনয়। আচ্ছন্নের মতো বসে আছে। দুধারে নানা দৃশ্যাবলী–পুরোনো আমলের বাড়িঘর, খাপরা কি টিনের চালের চাপ-বাঁধা মুসলমানদের বস্তি ফাঁকা মাঠ, ঝোপঝাড়, পানাপুকুর–কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এলাকাটা যত নিরিবিলিই হোব কিছু শব্দ তো হচ্ছেই। মানুষের কথাবার্তার, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাইকেল রিকশা কি কচি দুএকটা মোটরের। কিছুই শুনতে পাচ্ছে না বিনয়। শুধু টের পাওয়া যাচ্ছে, বুকের ভেতরে কোথা যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অবিরল।
হঠাৎ তারপাশার স্টিমারঘাটে সেই ভাঙাচোরা, করুণ চেহারার আধবুড়ো লোকটার মুখ চোখে সামনে ভেসে ওঠে। নয়া চিকন্দি গ্রামের হরিদাস সাহা। তার যুবতী মেয়েকে জোর করে তুলে নিন যাওয়া হয়েছে। হরিদাসের স্ত্রী ঘোমটায় মুখ ঢেকে একটানা কেঁদে যাচ্ছিল। শুধু কি সে-ই, যুগলদে মুকুন্দপুর কলোনিতে গিয়েও বেশ কটি মেয়েমানুষের এমন কান্না শুনে এসেছে বিনয়। সেই সব নিরবচ্ছিন্ন বিলাপ। সে যে কী বুক-নিঙড়ানো কাতরতা! ওদের মেয়েদেরও কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে
মধুসূদন, হরিদাস সাহা আর মুকুন্দপুরের সেই শোকাকুল মায়েদের মতো দেশভাগের পর আর কত যে মা-বাপের যুবতী মেয়ে খোয়া গেছে তার লেখাজোখা নেই। এদের সবার অফুরান কান্না সঙ্গে ঝিনুকের জন্য বিনয়ের অন্তহীন কষ্টটা একাকার হয়ে যেতে লাগল।
হিরণ বিনয়কে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল। আস্তে ডাকল, বিনু
বিনয় চমকে ওঠে, কিছু বলবেন?
কী ভাবছিলে? ঝিনুকের কথা? হিরণ আর সুধা এই কয়েক দিনের মধ্যেই বিনয়কে অনেকখা বুঝে ফেলেছে। ওরা জানে, পূর্ব পাকিস্তানের কোনও ধর্ষিত, লাঞ্ছিত কিংবা জোর করে ছিনি নিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা শুনলেই সে ভীষণ ভেঙে পড়ে। ঝিনুকের চিন্তাটাই তখন পাষাণভারে মতো তার ওপর নতুন করে চেপে বসে।
বিনয় মুখে কিছু বলল না। আস্তে মাথা নাড়ল শুধু।
হিরণ বলতে লাগল, ঝিনুককে তবু ঢাকা থেকে উদ্ধার করে আনা গিয়েছিল। কিন্তু মধুসূদ ভট্টাচার্যের মেয়েকে আর কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। বলেই হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে, ঝিনুককে অবশ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। সেও ফিরে আসবে কি না, কে জানে।
বিনয় উত্তর দিল না। তার দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে।
.
১৯.
বাড়ির সামনে সাইকেল রিকশা থেকে সবাই নেমে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে হিরণ সদরে কড়া নাড়তে উমা এসে দরজা খুলে দিল। বলল, একজন অনেকক্ষণ বসে আছে। আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাবে না।
হিরণ জিজ্ঞেস করল, কে লোকটা?
চিনি না। আগে কখনও দেখিনি।
হিরণ বিরক্ত হল, আমরা যখন থাকব না, অচেনা কারওকে বাড়িতে ঢোকাতে বারণ করেনি না?
উমা ভয় পেয়ে গেল। বলল, আপনাদের দেশের মানুষ। সেই সঙ্গে আরও খানিকটা জুড়ে দিল। লোকটি বেশ বয়স্ক। সাধু সাধু চেহারা। কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, খুবই সরল। সাদাসিধে। কোনওরকম দুরভিসন্ধি তার মধ্যে নেই। তবু বার বার আপত্তি করেছে উমা, তাকে পরে আসতে বলেছে। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। এমন ধরেছিল যে শেষ পর্যন্ত বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে পারা যায়নি।
কী নাম তার?
উমা অনেকখানি গুটিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করিনি।
গাধা মেয়ে। দেশের লোক বলে একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে বসাসনি তো?
না-না– সবেগে মাথা ঝাঁকায় উমা, সেটুকু বুদ্ধি আমার আছে। বাইরের ঘরে বসিয়েছি।
জেঠিমাকে লোকটার কথা জানিয়েছিস?
আপনারা যাবার পর জেঠিমার শরীর খারাপ লাগছিল। শুয়ে পড়েছেন। তাই জানাইনি।
সবাই ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। হিরণ ত্বরিত গতিতে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে দোতলায় উঠে গেল। তার পেছন পেছন বিনয়ও। সকলের শেষে দ্বারিক দত্তকে ধরে ধরে ওপরে তুলতে লাগল সুধা।
হিরণ আর বিনয় বাইরের ঘরে চলে এসেছিল। চেয়ারে যে বসে আছে তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। বুক পর্যন্ত কাঁচাপাকা দাড়ি। কাঁধ অবধি চুল। পরনে গেরুয়া রঙে ছোপানোমোটা সুতোর ধুতি আর পাঞ্জাবির ওপর ভারী খদ্দরের চাদর। সেটার রংও গেরুয়া। পায়ে কয়েক গণ্ডা তালি মারা পুরোনো লাল কেডস। চোখে নিকেলের গোল বাই-ফোকাল চশমা, যেটার উঁটিদুটো টেড়াবাঁকা, ঢেউ-খেলানো। তার পাশে পেট-মোটা, ধুসো ক্যাম্বিসের পুরানো, ঢাউস একটা বাক্স। সেটার গায়ে পেল্লায় তালা ঝুলছে।
উমা মিথ্যে বলেনি। সত্যিই মুনি-ঋষি মার্কা চেহারা। মুখটা চেনা চেনা লাগল বিনয়ের। রাজদিয়ার লোক নয়, তবে ওখানে এর যাওয়া-আসা ছিল। মনে পড়ল, হেমনাথের কাছেও দু-একবার এসেছে।
বিনয় এবং হিরণকে দেখে উঠে দাঁড়াল লোকটা। একমুখ হেসে বলল, আমারে চিনতে নি পারেন? আমি কিলাম আপনাগো দেইখাই চিনা ফালাইছি। আপনে হ্যামকার নাতি, আর আপনে হইলেন দ্বারিক দত্ত মশয়ের নাতি। কী, ঠিক কইছি তো?
এইসময় দ্বারিক দত্ত বাইরের ঘরে ঢুকলেন। সুধা একবার উঁকি দিয়ে ভেতর দিকে চলে গেল। দল বেঁধে সকালবেলায় খান মঞ্জিল দেখতে বেরিয়েছিল। রান্নাবান্না কিছুই হয়নি। উমাকে নিয়ে কোমর বেঁধে এখনই কাজে লাগতে হবে।
বিনয় আর হিরণ লোকটার কথার কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই দ্বারিক দত্ত থমকে দাঁড়িয়ে কয়েক পলক লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, তালতলির গুপীবল্লভ আচায্যি না?
তালতলি রাজদিয়ার থেকে মাইল দশেক দূরের মাঝারি একটা গঞ্জ। গুপীবল্লভ ছিল সেখানকার নামকরা কবিরাজ তারিণী সেন ভিষকরত্নের শাগরেদ। তারিণী কবিরাজের যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। আশির কাছাকাছি। রোগভোগ নিয়ে যারা তার কবিরাজখানায় আসত, তাদেরই শুধু চিকিৎসা করতেন। বাইরের রোগী দেখতে যেতে পারতেন না। সেই কাজটা করত গুপীবল্লভ। বহু বছর তারিণীর সঙ্গে লেগে থেকে কবিরাজিটা মোটামুটি শিখে নিয়েছিল সে। বাইরের রোগী দেখা ছাড়াও সুজনগঞ্জ, ইনামগঞ্জ, দেলভোগ–এমনি সব হাটে হাটে ঘুরে তারিণী সেনের বিখ্যাত মকরধ্বজ, স্বর্ণসিন্দুর, মৃতসঞ্জীবনী ইত্যাদি নানা ওষুধ এবং সালসা টালসা বিক্রি করত। মাঝে মাঝে রাজদিয়ায় এলে হেমনাথের সঙ্গে দেখা করে যেত। তবে বিনয়ের সঙ্গে তখন সেভাবে আলাপ হয়নি।
গুপীবল্লভের মুখের হাসিটা আরও ছড়িয়ে পড়ল। বলল, হ দত্তমশয়, আমি গুইপা আচায্যিই। গুপীবল্লভের ডাক নাম গুপী। পূর্ব বাংলায় বলে গুইপা।
দ্বারিক দত্ত বললেন, বোস বোস্। দেশের মানুষ দেখলে কী ভাল যে লাগে!
সবাই বসে পড়ে।
দ্বারিক আপেক্ষের সুরে এবার বলেন, দেশভাগের পর রাজদিয়া রসুনিয়া ডাকাইতা পাড়া গিরিগঞ্জ তালতলি মালখানগর, এমনি নানা গ্রামগঞ্জের মানুষ যে কত দিকে ছিটকে পড়েছে। তাদের অনেকের সঙ্গে এ-জীবনে আর দেখা হবে না। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তান থেকে কবে এলি?
গুপীবল্লভ বলল, তা হইব মাস ছয়েক
কোথায় উঠেছিস?
আমার এক ভাইগনা গইরার (গড়িয়া) উই দিকে জবরদখল কুলোনিতে ঘর তুলছে। আমি হের কাছেই থাকি।
তারিণী কবিরাজের খবর কী? তিনি কি তালতলিতেই পড়ে আছেন?
তেনি মারা গ্যাছেন। কবিরাজখানাও উইঠা গ্যাল। আমি দ্যাশে থাইকা কী করুম? চইলা আইলাম–
তারিণী সেনের স্ত্রী? ছেলেমেয়ে?
স্যান কত্তার স্ত্রী তো আগের বচ্ছরই স্বগৃগে গ্যাছেন। আর ওনাগো (ওঁদের) পোলামাইয়া নাই।
একটু চুপচাপ।
তারপর দ্বারিক দত্ত বললেন, তা আমাদের এ-বাড়ির খোঁজ পেলি কী করে?
গুপীবল্লভ বলল, কয়দিন আগে আতখা (হঠাৎ) আপনেগো রাইজদার তৈলোক্য-ত্রৈলোক্য) স্যানের বড় পোলা পরিতোষ স্যানের লগে দেখা। তৈলোক্য স্যান, যেনি যৈবনকালে মগের মুল্লুকে (বর্মায়) চইলা গ্যাছিলেন, যুদ্ধ বাধলে দ্যাশে ফিরা আইলেন–
লোকটা একটু বেশি মাত্রাতেই বকবক করে। এক কথা বলতে গিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। বাধা দিয়ে দ্বারিক দত্ত বলে উঠলেন, পরিতোষ কী করল তাই বল–
গুপীবল্লভ একটু অপ্রস্তুত হল। হ-হ, এক কথা কইতে গিয়া আর-এক কথা আইয়া পড়ছে। তা পরিতোষ স্যান আমারে তেনাগো ঢাকুইরার (ঢাকুরিয়া) বাড়ি লইয়া গ্যালেন। পুরা দিনটা আছিলাম হেইখানে। ওনাগো কাছেই আপনেগো ঠিকানা পাইছি। গইরা থিকা টালিগঞ্জ আর কদ্দূর? আপনেগো দ্যাখনের লেইগা কয়দিন ধইরা পরানটা উথালপাতাল হইতে আচ্ছিল। আইজ সকালে উইঠা চইলা আইলাম।
বিনয় লক্ষ করছিল, গুপীবল্লভ দ্বারিক দত্তর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বার বার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। একটু অস্বস্তি বোধ করল সে। ত্রৈলোক্য সেনদের বাড়িতে যখন গেছে, ঝিনুকের খবর কি আর সে পায়নি? সে-সম্বন্ধে ফস করে কি কিছু বলে বসবে নোকটা?
উমা সবার জন্য চা আর গুপীবল্লভের জন্য আলাদা করে মিষ্টি-টিষ্টি দিয়ে গেল। সুধা পাঠিয়ে দিয়েছে। দেশের মানুষ বাড়িতে এসেছে। তাকে আপ্যায়ন করা যে দরকার, শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেদিকে খেয়াল আছে তার।
যেতে যেতে দেশের কথা হতে লাগল। কোন স্বর্গসুখে দিন কাটিয়েছে, আর পার্টিশানের পর সীমান্তের এপারে এসে পচে মরতে হচ্ছে, এজন্য আক্ষেপের অবধি নেই গুপীবল্লভের। দ্বারিক দত্তও মাথা নেড়ে সায় দিতে লাগলেন।
গুপীবল্লভ অনেক খবর রাখে। সে জানায়, দেশভাগের পর রাজদিয়া এবং তার আশেপাশের নানা অঞ্চলের কারা কারা আসামে ত্রিপুরায় বিহারে বা উত্তর বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেকের ঠিকানা পর্যন্ত জোগাড় করে ফেলেছে। বাকিদেরও খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বিনয় অবাক হয়ে শুনছিল। অনেকটা যুগলের মতোই দেশ থেকে উৎখাত হয়ে আসা মানুষ সম্পর্কে লোটার বিপুল আগ্রহ। কী চায় গুপীবল্লভ? যুগলের মতোই কি দেশের পরিচিত মানুষজন জড়ো করে সীমান্তের এপারে পূর্ববঙ্গের সেই ভুখণ্ডটিকে নতুন করে নির্মাণ করতে?
দ্বারিক দত্তও কম অবাক হননি। এত লোকের ঠিকানা কী করে পেলি?
গুপীবল্লভ বলল, একজনের কাছে গ্যালে আরেক জনের খবর পাই। এইভাবে ঘুইরা ঘুইরা অ্যাতগুলান ঠিকানা জুটাইছি।
দ্বারিক দত্তর শুধু নয়, হিরণ এবং বিনয়ের বিস্ময়ও ক্রমাগত বাড়ছিল। হিরণ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি দেশের মানুষের ঠিকানার জন্যে এর ওর বাড়ি ঘুরে বেড়ান?
গুপীবল্লভ হেসে হেসে বলল, ঠিকই ধরছেন ছুটো নাতিন জামাইবাবু সুধা-সুনীতির বিয়েতে তালতলি থেকে নেমন্তন্ন খেতে রাজদিয়ায় এসেছিল সে। হেমনাথের সঙ্গে হিরণদের সম্পর্কটা সে জানে।
এইসব ঠিকানা দিয়ে কী হবে?
কামে লাগক। হুদাহুদি (শুধু শুধু) কেউ এ বস্যে (বয়সে) ছুটাছুটি করে?
হিরণ আর কোনও প্রশ্ন করে না।
দ্বারিক দত্ত বললেন, দেশের মানুষের বাড়ি তো ঘোরাঘুরি করে বেড়াস। কাজকর্ম কী করিস? তারিণী সেনের চেলাগিরি করে তো জীবন কাটিয়ে দিলি। তার কাছে কিছু কিছু শিখেছিসও। এপারে এসে কি কবিরাজি করছিস?
হতাশার সুরে গুপীবল্লভ বলল, স্যানকত্তার কাছে যা শিখছিলাম হেয়া গেরামে-গুঞ্জে চলত। কইলকাতার লাখান জবর শহরে কেও স্বন্ন সিন্দুর, সালসা মালসা পোছে না। কত বড় বড় ডাক্তর : আর হাসপাতাল এইখানে! রোগ ব্যারাম হইলে মাইষে হেগো কাছে লৌড়ায়।
তাহলে?
গুপীবল্লভ জানায়, দূর সম্পর্কের যে ভাগনের কাছে সে উঠেছে তারই সংসার চলতে চায় না। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। কাজেই নিজের পেটের চিন্তা নিজেকেই করতে হয় তাকে। কলকাতায় তার কবিরাজি অচল। তাই রোজগারের জন্য ভেবেচিন্তে অন্য ফিকির বার করেছে। তারিণী সেন ভাল জ্যোতিষ জানতেন। কবিরাজির সঙ্গে এই বিদ্যেটাও তার কাছ থেকে মোটামুটি শিখে নিয়েছিল গুপীবল্লভ। জ্যোতিষের মার নেই। জীবনে সমস্যা নেই, এমন কোনও মানুষের দেখা আজকাল মেলে না। বিশেষ করে দেশভাগের পর। বেশির ভাগেরই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যারা রিফিউজি ক্যাম্পে কি শিয়ালদা স্টেশনে পড়ে আছে তারা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কিন্তু ওপার থেকে যারা কিছু টাকা পয়সা আনতে পেরেছে, এখানে মাথা গোঁজার মতো জায়গাও হয়তো জুটিয়ে নিয়েছে, তাদেরও দুর্ভাবনার শেষ নেই। ছেলের পড়াশোনা বা চাকরি, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি নানা সমস্যায় তারা জর্জরিত। হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলে কী খাবে, কী করবে, রোজগারের কোনও উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে কি না– এ-সব জানার জন্য সবাই ব্যাকুল। সুতরাং গুপীবল্লভের দুপয়সা আয় হচ্ছে। জ্যোতিষের সঙ্গে সে আরও একটা কাজ করে। ঘটকালি। অবশ্য খাটতে হয় প্রচুর। লোকের বাড়ি বাড়ি যাওয়া তো আছেই। দূরে যারা থাকে, নিয়মিত চিঠিপত্রে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়।
বিনয়রা এতক্ষণে বুঝতে পারল, এই বয়সে গুপীবল্লভের এত ঘোরাঘুরির কারণটা কী। পেটের জন্য মানুষ কত কী-ই না করছে!
শুপীবল্লভ বলে যাচ্ছিল, আপনেরা দ্যাশের মানুষ। আপনজন। আপনেগো কাছে লুকাছাপা নাই। টাণ্ঠা মাণ্ঠা কইরা বাইচা তো থাকতে হইব। হুদা (শুধু কবিরাজি লইয়া থাকলে না খাইয়া মরতাম। অ্যাতিষ আর ঘটকালি কইরা ভালাই আছি।
দ্বারিক দত্ত গুপীবল্লভকে দেখার পর থেকেই তার পোশাক আশাক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন। নানা ব্যাপারে কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গটা তোলার সুযোগ হয়নি। এবার জিজ্ঞেস করলেন, যতদূর মনে পড়ে, দেশে থাকতে সাদা ধুতি সাদা জামা পরতিস। এখানে এসে গেরুয়া ধরেছিস কেন?
গুপীবল্লভ বলল, ভ্যাক না ধরলে কি ভিখ মিলে দত্তমশয়? গেরুয়া দ্যাখলে মাইনুষে ভাবে সাধু-সন্ন্যাসী। তাগো মনে ভক্তিভাব জাগে। আমার উপর বিশ্বাস বাইড়া যায়। দ্যাশভাগের পর আগের দিন কি আর আছে? ফন্দিবাজি কইরা না চললে টিকা থাকন মুশকিল।
দ্বারিক দত্ত একটু হাসলেন।
গুপীবল্লভ জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। মেলা বেইল (অনেক বেলা) হইছে। আপনেরা ছান (স্নান) খাওয়া করেন। আইজ চলি–
দ্বারিক দত্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন, না-না, এই দুপুর বেলা না খেয়ে যাবি কী! এটা একটা কথা হল?
হাতজোড় করে গুপীবল্লভ বলল, আইজ হাতে সোময় নাই। বাগবাজারে একজনের লগে সাড়ে বারোটার ভিতরে দেখা করতে হইব। হের কাছে কিছু টাকা পামু। দেরি করলে দেখা পামু না।
তাহলে আর আটকাব না। মাঝে মাঝে আসিস কিন্তু।
আইতে তো হইবই। বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে গুপীবল্লভ বলল, উই ছুটোবাবুর লেইগা কতবার আইতে লাগব, ক্যাঠা জানে–
বিনয় প্রথমটা হতবাক। তারপর বলে, আমার জন্যে?
হ মাথা দোলাতে দোলাতে উঠে দাঁড়ায় গুপীবল্লভ।
কী ব্যাপার বলুন তো?
পরথম দিন আইলাম। আতথা কওনটা (আচমকা বলাটা) ঠিক হইব না। পরে ধীরেসুস্থে কমু। গুপীবল্লভের চোখেমুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।
দ্বারিক দত্ত এবং হিরণেরও কৌতূহল হচ্ছিল। কথাটা শোনার জন্য তারা প্রায় জোরই করতে থাকে। গুপীবল্লভ কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলল না। তার পেল্লায় বাক্সটা তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।
ভীষণ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল বিনয়। কী বলবে নোকটা? ঝিনুকের কথা কি? দেশের মানুষজন যার সঙ্গেই দেখা হোক, শুরুতেই ঝিনুক সম্পর্কে জানতে চায়। কেউ সহানুভূতি জানায়, আহা উঁহু করে, কেউ আভাসে বুঝিয়ে দেয় অমন একটা মেয়ে নিজের থেকে চলে গিয়ে বিনয়কে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নইলে সারাটা জীবন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেত।
ঝিনুকের কথা নিশ্চয়ই গুপীবল্লভের জানতে বাকি নেই, কিন্তু তার সম্বন্ধে টু শব্দটিও করেনি সে।
হঠাৎ বিনয়ের মনে হল, ঝিনুক বা হিরণদের সম্পর্কে গুপীবল্লভের খুব একটা আগ্রহ নেই। জাফর শা রোডের এই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে শুধু তারই জন্য এখানে হানা দিয়েছে, লোকটা। জানিয়ে গেছে, আবারও আসবে। আসবে বার বার।
যে-লোক সীমান্তের এপারে এসে রাতারাতি সাধুর ভেক ধরেছে সে যে খুবই চতুর এবং ধুরন্ধর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। গুপীবল্লভ তাকে নিয়ে কী মতলব এঁটেছে তার তলকূল পাচ্ছে না বিনয়। তীব্র অস্বস্তি তার মাথায় কাঁটার মতো বিধতে থাকে।
.
২০.
খান মঞ্জিল দেখে আসার পর দুটো দিন কেটে গেছে। অলস। মন্থর। ঢিলেঢালা। বিনয়ের অফিসে জয়েন করতে এখনও কদিন বাকি। কাজকর্মের মধ্যে থাকলে একঘেয়ে লাগে না। কিন্তু আপাতত উপায় কী?
এর ভেতর বাড়ি থেকে বেরোয়নি বিনয়। এই বিশাল শহরে তার চেনাজানা মানুষ খুব কম। একরকম হাতে গোনা। আনন্দদের বাড়ি সে কখনও যাবে না। বিমল গাঙ্গুলিদের বাড়ি যাওয়া যেত। কিন্তু ছায়া মায়ার জন্য এখনও কোনও চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করা যায় নি। মদন বড়াল লেনে গেলে ওরা যখন বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে তার মুখের দিকে তাকাবে কী বলবে বিনয়? না, আপাতত সেখানে যাওয়া যাবে না।
ঝুমাদের বাড়ির দরজা তার জন্য সারাক্ষণ খোলা। কিন্তু পাকিস্তান থেকে রামকেশব চলে এসেছেন। কিন্তু সেদিন তিনি ঝিনুক সম্বন্ধে যা সব বলেছেন, জঘন্য এবং কুৎসিত, তারপর আর সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। বিনয় যায়নি।
ঝুমা তাদের কলেজে গিয়ে বার বার দেখা করতে বলেছে। সেখানে অবশ্য যাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে রয়েছে কী যে প্রচণ্ড আকর্ষণ! কাছে গেলে বিনয়ের মনে হয়, বিচিত্র সম্মোহনে ঝুমা শিরাস্নায়ু অবশ করে দিচ্ছে। মনে হয়, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে! হাতের মুঠি থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে বন্ধু। নিশির ডাকের মতো ঝুমা মাঝে মাঝেই তাকে টানতে থাকে। কিন্তু নিজের অজান্তে যদি তার দিকে পা বাড়াবার কথা বিনয় ভাবেও, ঝিনুকের হাজার স্মৃতি পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাই ঝুমার কলেজে যাওয়া হয়নি।
আশু দত্তর কাছে বা মুকুন্দপুরে গিয়েও খানিকটা সময় কাটিয়ে আসা যেত। কিন্তু এই তত ক দিন আগে আশু দত্তকে নিয়ে যুগলদের কলোনিতে ঘুরে এল। এত তাড়াতাড়ি তাদের কাছে ফের যাওয়ার মানে হয় না।
অনেকদিন থানায় গিয়ে ঝিনুকের খোঁজ নেওয়া হয়নি। বিনয় যে ভবানীপুর থেকে জাফর শা রোডে সুধাদের বাড়ি চলে এসেছে, এই ঠিকানা বদলের খবরটা ওসি দিবাকর পালিতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষটি সহানুভূতিশীল। বলেছিলেন, রোজ রোজ কষ্ট করে থানায় যাওয়ার দরকার নেই। ঝিনুকের সন্ধান পাওয়া মাত্র তিনি বিনয়ের কাছে লোক পাঠিয়ে দেবেন। কাজেই থানায় যাওয়ার কথা ভাবলেও শেষপর্যন্ত যায়নি।
পরিচিত মানুষজনের কাছে না যাক, সারাক্ষণ বাড়িতে বসে না থেকে একা একা রাস্তায় কি লেকে খানিকটা ঘুরে আসা যেত না? যেত। কিন্তু বিনয়ের মন সায় দেয়নি। তার কারণ ঝিনুক।
সেদিন খান মঞ্জিল দেখে মধুসূদন ভট্টাচার্যের বাড়ি গিয়েছিল বিনয়রা। মধুসূদনের মেয়ে দীপালির কথা শুনতে শুনতে আতঙ্কে সিটিয়ে গেছে সে। আর বার বার ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। প্রায় একই কাহিনি। করুণ। নিদারুণ কষ্টদায়ক।
ঝিনুককে আর কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। তার কথা নতুন করে ভেবে ভেবে এই দুটো দিন আচ্ছন্নের মতো কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়।
.
আজ সকাল থেকে জাফর শা রোডের ছোট দোতলা বাড়িটা জুড়ে তুমুল ব্যস্ততা শুরু হয়েছে।
নটা নাগাদ শওকত আলি তার দুই বন্ধু এবং লইয়ারকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। হিরণ কাল আনন্দদের বাড়ি গিয়ে তাকে আর সুনীতিকে বিশেষ করে বলে এসেছে। ওরা দুজনে তো আসবেই। হিরণ আগেই একজন উকিল ঠিক করে রেখেছিল। তিনিও ওই সময়েই চলে আসবেন। আজই হিরণদের রাজদিয়ার জমিজমা এবং বাড়ির সঙ্গে শওকত আলিদের খান মঞ্জিল এক্সচেঞ্জের পাকা ব্যবস্থা করা হবে। প্রায় মাস দুয়েক ধরে ব্যাপারটা কথাবার্তার স্তরে ছিল। সুধা আর সরস্বতী যেভাবে বেঁকে বসেছিলেন তাতে কী হতো, বলা মুশকিল। এবার সব অনিশ্চয়তার অবসান। হিরণরা খান মঞ্জিল-এর পুরোপুরি মালিকানা পেয়ে যাবে।
শওকত আলির সঙ্গে তার যে দুই বন্ধুর আসার কথা তারা এক্সচেঞ্জের সাক্ষী হবেন। উকিলরা বিনিময়ের যে বয়ান ঠিক করে স্ট্যাম্প কাগজে টাহপ করিয়ে নিয়েছেন তাতে ওই দুজনের সই থাকবে। আর হিরণদের তরফে সাক্ষী হবে বিনয় আর আনন্দ। আনন্দ আসবে আর সুনীতি আসবে না, তাই কখনও হয়? কলকাতায় আত্মীয় পরিজন বলতে তো একমাত্র ওরাই। এমন একটা শুভ কাজে আনন্দ সুনীতিরা না থাকলে চলে?
এতগুলো মানুষ আসবে। তাদের আপ্যায়নে যাতে বিন্দুমাত্র খুঁত না থাকে সেজন্য ভোরে ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোড়জোড় চালাচ্ছে সুধা। হিরণের রুণ জেঠিমা তার দুর্বল, অথর্ব শরীর টেনে টেনে সুধাদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন। না বললে শুনছেন না। কারও নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই এখন।
কালই বেশ খানিকটা কাজ এগিয়ে রেখেছে সুধারা। বাড়িটা ধুয়েমুছে তকতকে করে তোলা হয়েছে। বাইরের ঘরের সোফার গদির ওয়াড় আর পদাগুলো পালটে ফেলেছে তারা। মেঝেতে পেতে দিয়েছে রঙিন জুটের কার্পেট।
হিরণ অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছিল। আজ আর সময় পাওয়া যাবে না। তাই কালই বাজার করে রেখেছে। বাড়ির লোকজন তো বটেই, তবে বিশেষ করে অতিথিদের, অর্থাৎ শওকত আলি, তার দুই বন্ধু এবং দুপক্ষের উকিলদের জন্য হবে লুচি, বেগুনভাজা, আলুভাজা, আলুকপির তরকারি, ছোলার ডাল। তাছাড়া দ্বারিক ঘোষের দোকান থেকে প্রচুর মিষ্টি আর চিনিপাতা দইও এনে রাখা হয়েছে।
সম্পত্তি বিনিময়ের কাজ সারতে বড় জোর ঘণ্টাখানেক কি ঘণ্টাদেড়েক। তারপর শওকতরা লুচি মিষ্টি খেয়ে চলে যাবেন। কিন্তু আনন্দ আর সুনীতিদের ছাড়া হবে না। সারাদিন এখানে কাটিয়ে সন্ধের পর তারা বাড়ি ফিরবে। তাদের জন্য রান্নার আয়োজনও কম হয়নি। তিন রকমের মাছ হবে। পাঁঠার মাংসের কোর্মা হবে। তাছাড়া নিরামিষ পদ আর দুইমিষ্টি তো আছেই।
নটা বাজতে না বাজতেই সবাই আসতে শুরু করল। প্রথমে সবান্ধবে উকিলসমেত এলেন শওকত আলি। ওঁরা এসেছেন ঘোড়ার গাড়িতে। হিরণরা প্রস্তুত হয়েই ছিল। বিনয়কে সঙ্গে করে সে খুব খাতির করে দোতলার বসবার ঘরে শওকতদের নিয়ে এল। দ্বারিক দত্ত সেখানেই ছিলেন। বুড়ো মানুষ। তার পক্ষে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করা কষ্টকর।
শওকতদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন দ্বারিক দত্ত। হাতজোড় করে বললেন, বসুন, বসুন। আমার বয়েস সত্তর। শরীরও কাহিল হয়ে পড়েছে। তাই আপনাদের নিচে গিয়ে নিয়ে আসতে পারিনি।
আদাব জানিয়ে শওকত আলি বিব্রতভাবে বললেন, নানা, আপনি গেলে আমাদের খুব খারাপ লাগত। আদি বাড়ি বিহারে হলেও তিন পুরুষ কলকাতায় আছেন। পরিষ্কার বাংলা বলেন। বিন্দুমাত্র জড়তা নেই।
দ্বারিক দত্ত আগে শওকত আলিকে দেখেননি। তবে আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। সকলে বসার পর হিরণ তাঁর সঙ্গে শওকতের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শওকত আলির বয়স চুয়ান্ন পঞ্চান্ন। দাড়িগোঁফ কামানো, লম্বাটে মুখ। মাথায় কাঁচাপাকা চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখের তলায় কালির ছোপ। পরনে ঢোলা ফুল প্যান্ট আর লম্বা ঝুলের শার্টের ওপর মোটা উলের পুল-ওভার। পায়ে ফিতে-বাঁধা কাবলি চপ্পল। সমস্ত চেহারায় কেমন যেন বিষাদ মাখানো।
শওকত তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে দ্বারিক দত্তদের আলাপ করিয়ে দিলেন। তার বন্ধুদের একজন বেশ সুপুরুষ। টকটকে রং। মেদহীন শরীর। গালে অল্প অল্প দাড়ি। পরনে পাজামা এবং চিকনের কাজ করা ধবধবে পাঞ্জাবির ওপর শাল। শওকতেরই সমবয়সী হবেন। কলুটোলায় ওঁর আতর-সুর্মার কারবার। নাম সালমান সিদ্দিকি। ওঁরা উত্তরপ্রদেশের মুসলমান। তবে শওকতদের মত এই শহরের কয়েক পুরুষের বাসিন্দা।
শওকত আলির দ্বিতীয় বন্ধুটিও অবাঙালি। ওরা হায়দরাবাদের লোক। নাম শেখ মুনাব্বর। বেজায় ঢ্যাঙা এবং বোগা। চোখ কোটরে ঢোকানো। ভাঙা গালে ঘন দাড়ি। পরনে ঢোলা শেরওয়ানি কুর্তার ওপর লম্বা কোট। টেরিটি বাজারে তার বিরাট ফলের ব্যবসা।
ওঁদের উকিলটি হলেন নৃসিংহ রাহা। গোলাকার মাংসল চেহারা। গোল মুখ। গোল গোল চোখে গোল বাই-ফোকাল চশমা। পরনে ঢলঢলে সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্টের ওপর কালো কোট।
শওকতরা আসার মিনিট পনেরো পর আনন্দ আর সুনীতি এল। ওরা এসেছে ট্যাক্সি করে। আনন্দ ওপরে উঠে বাইরের ঘরে বসল। সুনীতি সোজা চলে গেল ভেতর দিকে। সুধাদের কাছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হলেন হিরণের লইয়ার সুরঞ্জন লাহিড়ি। বয়স ষাটের ধারে কাছে। অটুট স্বাস্থ্য তাঁর। এই বয়সেও দুচারটের বেশি চুল পাকেনি। দাঁতগুলো সবই আসল এবং সাদা ধবধবে। চওড়া কপাল। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে শান্ত চোখ দুটিতে গভীর দৃষ্টি। যার দিকে তাকান, মনে হয় তার বুকের তল পর্যন্ত দেখতে পান। সমস্ত চেহারায় অদ্ভুত এক বুদ্ধির ঝলক। পরনে উকিলদের পোশাক। সাদা শার্ট এবং কালো কোট।
আনন্দ এবং সুরঞ্জনের সঙ্গে শওকতদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অবশ্য সুরঞ্জন এবং নৃসিংহ রাহা পরস্পরকে চেনেন। পেশা এক। কাজের সূত্রে কোর্টে রোজই তাদের দেখা হয়। চেনাই তো স্বাভাবিক।
দ্বারিক দত্ত বয়সে সবার বড়। নিজেই আজকের অনুষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব তুলে নিলেন। কাজ শুরু করার আগে একটু চা খাওয়া যাক।
নৃসিংহ রাহা বললেন, শুধু চা কিন্তু
দ্বারিক দত্ত বললেন, আপাতত। কাজ হয়ে যাবার পর মিষ্টিমুখ না করিয়ে কিন্তু ছাড়ছি না।
সবাই হাসিমুখে চুপচাপ বসে থাকেন। যে কারণে আজ এখানে তারা জড়ো হয়েছেন সেটা সুচারুভাবে সমাধা হয়ে গেলে মিষ্টিমুখে কারও আপত্তি নেই।
হিরণকে বলতে হল না, ব্যস্তভাবে ভেতরে চলে গেল। দশ মিনিটের ভেতর সে আর উমা দুটো বড় ট্রেতে কয়েক কাপ চা আর প্লেট বোঝাই করে বিস্কুট এনে সেন্টার টেবলে রাখল।
চা খেতে খেতে দ্বারিক দত্ত শওকতকে বলেন, আপনাদের বাড়ি সেদিন দেখে এলাম। হিরণ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।
শওকত জিজ্ঞেস করেন, কেমন লাগল আমাদের বাড়ি?
ভাল। বেশ মজবুত মনে হল।
আমার আব্বাজান প্রায় সত্তর বছর আগে খুব যত্ন করে সেরা মেটিরিয়াল দিয়ে বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন। চারতলার ভিত। একটু সারিয়ে টারিয়ে নিলে আরও পঞ্চাশ ষাট বছর নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।
হিরণ এইসময় বলে ওঠে, আপনাদের বাড়ি তো আমরা দেখেছি। কিন্তু আমাদের রাজদিয়ার বাড়ি, জমিজমা সম্বন্ধে খোঁজ নেবেন বলেছিলেন। নিতে পেরেছিলেন কি?
হিরণের সঙ্গে শওকতের আগেই কথা হয়েছিল, টালিগঞ্জে তাঁদের তেতলা বাড়ির বিনিময়ে পাকিস্তানে তারা হিরণদের বিষয় সম্পত্তি কী পাবেন, সে ব্যাপারে যেন ভাল করে খবর নেন। দেশের যা অবস্থা, হিরণদের পক্ষে রাজদিয়ায় গিয়ে সে-সব দেখানো সম্ভব নয়। পরে যেন শওকতের মনে না হয়, তারা তাকে ঠকিয়েছে। শওকত জানিয়েছিলেন, এক আত্মীয় বেশ কিছুদিন আগে বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে গেছে। নাম জাহাঙ্গির চৌধুরি। শওকত তাকে খবর পাঠিয়েছিলেন, সে যেন রাজদিয়ায় গিয়ে হিরণদের বাড়িটাড়ি নিজের চোখে দেখে আসে।
শওকত বললেন, হ্যাঁ। জাহাঙ্গির লোক মারফত আমাকে জানিয়েছে, আপনাদের বাড়িও খুব ভাল। চাষের জমিগুলোতে তিনবার ফসল হয়। এই ধরনের প্রপার্টিই আমি চাইছিলাম।
দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, আপনি খুশি তো?
হ্যাঁ, খুশি।
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
উকিল সুরঞ্জন লাহিড়ি বললেন, বারোটা নাগাদ আমাকে অন্য এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। এবার কাজটা সেরে ফেলা যাক।
সবাই তার কথায় সায় দিলেন।
ভারত এবং পাকিস্তান, এই দুই দেশে সম্পত্তি বিনিময়ের প্রক্রিয়াটা খুব একটা জটিল নয়। দ্বারিক দত্তর নামে রয়েছে রাজদিয়ার জমি-বাড়ি-বাগান-পুকুর ইত্যাদি। তিনি স্ট্যাম্প কাগজে সেগুলো দানপত্র করে দেবেন শওকত আলি খানকে। সাক্ষী থাকবে তার এবং শওকতের তরফে দুজন করে চারজন। একই পদ্ধতিতে শওকতও তার বাড়ি দ্বারিক দত্তকে লিখে দেবেন।
শওকতের দানপত্রের বয়ানটা আগেই তৈরি করেছিলেন তার উকিল নৃসিংহ রাহা। সেটা দ্বারিক দত্তদের উকিল সুরঞ্জন লহিড়ি খুঁটিয়ে দেখার পর সামান্য অদল বদল করে দুকপি টাইপ করা হয়েছে। একটা কপি আগেই সুরঞ্জনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। অ্যাটাচি কেস থেকে সেট বার করে তিনি পড়তে লাগলেন।
আমি শওকত আলি খান, পিতা মরহুম রহমত আলি খান, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কলিকাতাস্থ টালিগঞ্জের ১৮/২ আমিনুল হক স্ট্রিটে অবস্থিত ত্রিতল বসত গৃহ খান মঞ্জিল, মোট জমির পরিমাণ ছয় কাঠা সাড়ে তিন ছটাক, নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্ণে, বর্তমানে কলিকাতাস্থ টালিগঞ্জের ১৩-এ জাফর শা রোডের বাসিন্দা, শ্রীদ্বারিক দত্তকে, পিতা রাজারাম দত্ত, আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে পাকিস্তান) ঢাকা জিলার রাজদিয়া শহর, বিনামূল্যে দানপত্র করিয়া দিলাম। উক্ত খান মঞ্জিল-এর উপর এই দানপত্রে স্বাক্ষর করার মুহূর্ত হইতে আমার বা আমার পুত্রকন্যা বা আমার পরিবারের কাহারও কোনও অধিকার রহিল না। শ্রীদ্বারিক দত্ত মহাশয় এবং তাহার উত্তরাধিকারীরা অদ্য হইতে পুরুষানুক্রমে উহা ভোগদখল করিবেন।
পড়া হয়ে গেলে টাইপ-করা কাগজটা এবং একটা কলম শওকত আলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সুরঞ্জন লাহিড়ি বললেন, নিচে সই করে দিন। তারপর সাক্ষীরা সই করবেন।
নীরবে কাগজটা টেবলে রেখে, কলম ধরে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন শওকত। তার হাত ভীষণ কাঁপছিল, বার বার ঢোক গিলছিলেন। কণ্ঠমণিটা ক্রমাগত ওঠা-নামা করছে। দুচোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরতে লাগল তার।
সমস্ত ঘরটা লহমায় নিঝুম হয়ে গেল। তীব্র একটা কষ্ট ভেতরে ভেতরে শওকত আলি খানকে যে ভেঙেচুরে ফেলছে তা বুঝতে পারছিল বিনয়রা। এই যাতনার কারণটাও খুব স্পষ্ট।
অনেকটা সময় কেটে গেল।
উকিল বা ডাক্তারদের পেশাটাই এমন যে সহজে তারা অস্থির হয়ে পড়েন না। তবে নৃসিংহ রাহা সামান্য বিচলিত হয়েছিলেন। ঘরের নৈঃশব্দ্য ভেঙে একসময় নরম গলায় বললেন, সইটা করে ফেলুন শওকত সাহেব ।
শওকত আলি খান যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। এই জগতেই বুঝি বা তিনি নেই। বহু দূরে, অন্য কোনও গ্রহে চলে গেছেন।
শওকতের পিঠে একখানা হাত রেখে নৃসিংহ বলতে লাগলেন, পাকিস্তানে চলে যাওয়াই যখন মনস্থ করে ফেলেছেন তখন শেষ মুহূর্তে এপারের বিষয় সম্পত্তির জন্যে মায়া করে কী লাভ? তাতে শুধু দুঃখ বাড়বে।
শওকত যেন ফের এই ঘরে ফিরে এলেন। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ধরা ধরা গলায় বললেন, ঠিকই বলেছেন রাহা সাহেব। পিছুটান রেখে লাভ নেই। বলে দানপত্রের নিচে সই করে দিলেন। তারপর বললেন, কত সাল আমরা ইন্ডিয়ায় আছি। আমার বাপজান, দাদা, পরদাদা, তাঁদের বাপ দাদা, পরদাদারা। জেনারেশনের পর জেনারেশন। এখন থেকে আমরা আর এ-দেশের কেউ না। পুরোপুরি বিদেশি হয়ে গেলাম– তাঁর স্নায়ুমণ্ডলী ভেদ করে অফুরান আক্ষেপ বেরিয়ে এল। সর্বস্ব হারানোর বেদনা।
নৃসিংহ রাহা পেশাদার কাজের লোক। মক্কেলের দুঃখে বেশিক্ষণ কাতর হয়ে থাকলে তার চলে না। এবার তিনি যান্ত্রিক নিয়মে সাক্ষীদের দিয়ে সইগুলো করিয়ে নিলেন। সইয়ের সঙ্গে তাদের ঠিকানা এবং তারিখ লিখিয়ে নেওয়া হল। মোট চারজন সাক্ষী।
শওকতের দুই বন্ধু তো বটেই, সেই সঙ্গে হিরণ আর বিনয়।
নৃসিংহ বললেন, আজকাল যেভাবে এক্সচেঞ্জ চলছে তাতে স্ট্যাম্প কাগজে সই-ই যথেষ্ট। তবে যদি মনে করেন, কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে নিতে পারেন।
শওকত বললেন, আপনি যেটা ভাল মনে করেন তাই করবেন।
হিরণ আগাগোড়া শওকত আলি খানকে লক্ষ করছিল। কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু কেমন যেন স্রিয়মাণ। সারা মুখে বিষাদ মাখানো। জন্মভূমির সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক ছিঁড়ে চিরকালের জন্য চলে যাওয়া কি সোজা কথা! কতকাল ধরে লোকটার বুকের ভেতর গোপনে রক্তক্ষরণ হতে থাকবে, কে জানে।
হিরণ ডাকল, শওকত সাহেব ।
শওকত মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।
হিরণ বলতে লাগল, আপনার কষ্টটা বুঝতে পারি। কেন না আমরাও ভুক্তভোগী। দেশ ছেড়ে আমাদেরও চলে আসতে হয়েছে। সারা জীবনে এ দুঃখ ঘুচবে না।
এ-সব আবেগের কথা একবার শুরু হলে থামতে চায় না। সুরঞ্জন লাহিড়ির চলে যাবার তাড়া ছিল। তিনি কাজের কথায় চলে এলেন। নৃসিংহ রাহার কাছে দ্বারিক দত্ত এবং শওকত আলি খান, দুজনেরই টাইপ-করা দানপত্র ছিল। তিনি নৃসিংহকে বললেন, এবার দ্বারিক দত্ত মশায়ের দানপত্রটা পড়ে শোনান।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ব্যাগ থেকে টাইপ-করা পাকিস্তানের স্ট্যাম্প পেপার বার করলেন নৃসিংহ।
হিরণ হতবাক। কিছুক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে থাকার পর বলল, পাকিস্তানি স্ট্যাম্প পেপার কোথায় পেলেন?
নৃসিংহর চোখ দুটো আধাআধি বুজে গেল। গোলাকার মুখে মিটি মিটি, চতুর হাসি ফুটে উঠেছে। লোকটা যে অতীব ধুরন্ধর সেটা ওই হাসিই বুঝিয়ে দেয়। বললেন, কোথায় পেলাম, কীভাবে পেলাম, সে-সব অবান্তর। রিফিউজি ছাড়াও রেগুলারলি কিছু লোক এপার থেকে বর্ডারের ওপারে যাচ্ছে। ওপার থেকে এপারে আসছে। তাদের কারও সঙ্গে দুচারটে পাকিস্তানি স্ট্যাম্প পেপার চলে আসা কি অসম্ভব ব্যাপার? না কী বলেন লাহিড়ি সাহেব? সুরঞ্জন লাহিড়ির দিকে একবার চকিত দৃষ্টিক্ষেপ করে, মুখ ফিরিয়ে টাইপ-কৰা লেখা পড়তে শুরু করলেন।
দ্বারিক দত্তর দানপত্রের বয়ান অবিকল শওকত আলি খানের বয়ানের মতোই। শুধু নামধামগুলো আলাদা। এখানে দ্বারিক দত্তর বাবা ও ঠাকুরদার নাম এবং রাজদিয়ায় তাদের বসত-বাড়ি এবং চাষের জমির অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। পড়া শেষ হলে সেটা দ্বারিক দত্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে সই করতে বললেন নৃসিংহ রাহা।
শওকতের মতো ততটা ভেঙে পড়েননি দ্বারিক দত্ত। দানপত্রে সই করে বিমর্ষ সুরে বললেন, দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও চিরকালের মতো চুকেবুকে গেল। শওকতের দিকে ফিরে বললেন, আমাদের রাজদিয়ার বাড়ির তালাগুলোর দুগোছা করে চাবি আছে। এক গোছা হিরণ আপনাকে আগেই দিয়েছিল। অন্যটা আজই দিয়ে দেব। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে আপনারা গিয়ে সেখানে সুখে শান্তিতে থাকুন। বলতে বলতে তার বুকের অতল স্তর ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
ঘরের আবহাওয়া আগেই ভারী হয়ে উঠেছিল। চারপাশে বিষাদ আরও ঘন হতে লাগল।
হাতজোড় করে শওকত আলি খান বললেন, আপনি, আপনার বাপদাদা, পরদাদা, ছেলে নাতি– কতকাল ধরে সবাই রাজদিয়ায় বাস করে এসেছেন। আমরা গিয়ে থাকব ঠিকই। কিন্তু ও-বাড়ি আপনাদেরই। পাকিস্তানে গেলে ওখানেই উঠবেন। আপনাদের জন্যে সবসময় একখানা ঘর তালাবন্ধ থাকবে। যখন যা, ওটা খুলে দেওয়া হবে।
ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বারিক দত্ত বললেন, আমার যা বয়েস তাতে কি আর কোনওদিন পাকিস্তানে যেতে পারব! তাছাড়া ওখানকার যা হাল! সেই বাকিটা আর শেষ করলেন না।
শওকত আলি খান বললেন, চিরকাল কি এমন হাল থাকবে? সব বদলে যাবে চাচাজি দ্বারিক তার বাবার না হলেও কাকার বয়সী তো হবেনই। তাই চাচাজি বলা।
দ্বারিক দত্ত উত্তর দিলেন না।
শওকত এবার বললেন, আপনি যেতে না পারেন, হিরণবাবু আছেন। তার বয়েস কম, অনেক দিন বেঁচে থাকবেন। দেশের বাড়ি দেখতে যাবার ইচ্ছে কি কখনও তার হবে না?
দ্বারিক দত্ত বললেন, হয়তো হবে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, উকিলবাবুরা যদি মনে করেন, আপনার দানপত্রটা এখানে রেজিষ্ট্রি হতে পারে, কিন্তু আমি পাকিস্তানে গিয়ে আমার দানপত্র রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসতে পারব না।
শওকত বললেন, আপনাকে এজন্যে কষ্ট করে এখন বর্ডারের ওপারে যেতে হবে না। তিনি সবিস্তার জানালেন, তার এত্মীয় জাহাঙ্গির যে হিন্দু ভদ্রলোকটির সঙ্গে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে নারায়ণগঞ্জে চলে গেছেন তিনি অনেক আগেই বাড়িঘর এক বিশ্বাসী মুসলমান বন্ধুর হেফাজতে রেখে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। জাহাঙ্গিরের সঙ্গে এক্সচেঞ্জের কথাবার্তা তার কলকাতাতেই হয়েছিল। তিনি দ্বারিক দত্তর মতোই পাকিস্তানি স্ট্যাম্প পেপারে দানপত্র করে দিয়েছিলেন কিন্তু নিজে নারায়ণগঞ্জে আর যাননি। জাহাঙ্গির কীভাবে যেন আইনের দিক থেকে সেটা বৈধ করিয়ে নিয়েছে। শওকত আলি খানকে সে জানিয়ে দিয়েছে, সেরকম দরকার হলে সব ব্যবস্থা সে-ই করে দেবে। শওকত যত তাড়াতাড়ি পারেন দ্বারিক দত্তকে দিয়ে দানপত্র লিখিয়ে যেন পাকিস্তানে চলে যান।
তাহলে তো ভালই হয়।
একটু চুপচাপ।
তারপর দ্বারিক দত্ত ফের বলতে লাগলেন, পাকিস্তানে গেলে রাজদিয়ার বাড়িতে গিয়ে যে আমাদের থাকতে বলেছেন তাতে মন ভরে গেছে। একটা অনুরোধ করছি।
উৎসুক চোখে দ্বারিক দত্তর মুখের দিকে তাকান শওকত, কী অনুরোধ?
ইন্ডিয়ায় এলে আপনিও আপনাদের খান মঞ্জিল-এ এসে থাকবেন। যে ক দিন ইচ্ছে, থেকে যাবেন। কোনওরকম সংকোচ করবেন না।
বিনয় অবাক হয়ে শুনছিল। এই দ্বারিক দত্তই কিছুদিন আগে মুসলমানের প্রপার্টির সঙ্গে রাজদিয়ার বাড়িঘর এক্সচেঞ্জ করতে চাননি। অন্ধ সংস্কার তার রক্তে ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে কতকাল ধরে। তিনিই কিনা শওকতকে তাদের কাছে এসে থাকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
শওকত বললেন, অনেক ধন্যবাদ চাচাজি। নতুন দেশে যাচ্ছি। সব গোছগাছ করে বসতে কতদিন লাগবে, কে জানে। ইন্ডিয়ায় কবে আসতে পারব তার ঠিক নেই। একটু চুপ করে থাকার পর হেসে ফের বললেন, তবে মরার আগে একবার আসবই। মানুষ যেখানে জন্মায়, যেখানে তার জীবনের বেশির ভাগটাই কেটে গেছে, সেই জায়গার ওপর নাড়ির টান থাকে, তাই না?
দ্বারিক দত্ত তো বটেই, ঘরের সবাই আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
শওকত আলি খান কী ভেবে একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যান, নতুন দেশে যাচ্ছি। সমস্ত কিছুই অজানা। আমার চেনা যারা কলকাতা থেকে পাকিস্তানে চলে গেছে তাদের বেশির ভাগই উঠেছে ঢাকায়, কেউ কেউ নারায়ণগঞ্জে। শুনেছি রাজদিয়া থেকে সে-সব টাউনে যেতে লঞ্চে পাঁচ সাত ঘণ্টা সময় লাগে। ওদের সঙ্গে চট করে দেখা করার উপায় নেই। এদিকে রাজদিয়ার কারওকে চিনি না। সেখানকার মানুষজন কীরকম হবে, আমাদের তারা পছন্দ করবে কি না, কে জানে। হয়তো নানা ঝাটে পড়তে হবে।
শওকত আলি খানকে বেশ ভাল লাগছিল বিনয়ের। মানুষটি ভদ্র। আবেগপ্রবণ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, পিতৃভূমির সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক চুকিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে তার যে কষ্ট হচ্ছে ঠিক তেমনটাই হচ্ছে দ্বারিক দত্তদেরও। এখনকার উত্তেজনা, অশান্তি কেটে সুদিন এলে পাকিস্তানে গিয়ে তাদের কাছে হিরণদের থেকে আসার জন্য বলেছেন শওকত আলি। সেটা শুধু মুখের কথা নয়। যথেষ্ট আন্তরিকও। কিন্তু তার শেষ কথাগুলো শুনে চমকে উঠেছে বিনয়।
আবহমান কালের ভারতবর্ষকে ছিন্ন করে মুসলমানেরা আলাদা একটা ভূখণ্ড চেয়েছিল। সম্পূর্ণ নিজস্ব এক দেশ। নতুন মুসলিম জাহান। সেজন্য কত যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। কত দাঙ্গা। কত হত্যা। কলকাতা-নোয়াখালি-বিহার-পাঞ্জাব, সমস্ত ভারত জুড়ে কত যে রক্তের স্রোত বয়ে গেছে! শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কায়েম হল। আর সেখানেই ছেলেমেয়ে স্ত্রী, সবাইকে নিয়ে সপরিবারে চলে যাচ্ছেন শওকত। সদ্যোজাত মুসলিম দেশটিতে যাবেন, সেজন্য তার উল্লসিত হবার কথা। খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু অপরিচিত পরিবেশে স্থানীয় লোকজন দুহাত বাড়িয়ে তাঁদের বুকে টেনে নেবে কি না, সে সম্বন্ধে শওকতের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
বিনয় কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শওকত জিজ্ঞেস করেন, আপনারা রাজদিয়ায় জেনারেশনের পর জেনারেশন কাটিয়ে এসেছেন। ওখানকার মানুষগুলো কেমন? এখন থেকে তাদের সঙ্গেই তো আমাদের থাকতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন, পড়োশি মনের মতো না হলে সুখশান্তি সব খতম। সারাক্ষণ ঝামেলা, অশান্তি নিয়ে থাকতে কি ভাল লাগে?
বিনয় ইতস্তত করতে থাকে। রাজদিয়া একসময় ছিল শান্ত। নির্ঞ্ঝাট। খাল-বিল-নদী আর অবারিত ধানের খেত দিয়ে ঘেরা প্রকৃতির সেই চোখজুড়ানো ভূমণ্ডলে কোথাও কোনও উত্তেজনা ছিল না। জীবন ধীর চালে বয়ে যেত। তিরতিরে, স্রোতের মতো। বাসিন্দারা ছিল সাদাসিধে। অকপট। তাদের চোখেমুখে সারল্য মাখানো থাকত। কিন্তু গেল কবছরে সব আমূল বদলে গেছে। এখন সর্বক্ষণ ভয়। আতঙ্ক। পারস্পরিক অবিশ্বাস। এসব বলতে গিয়ে থেমে গেল বিনয়।
কিন্তু উত্তরটা দিলেন দ্বারিক দত্ত, রাজদিয়ার মানুষ খুবই ভাল ছিল। এতকাল আমরা কী আনন্দে যে পাশাপাশি থেকে এসেছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো সবকিছু নেই। তবে —
সামনের দিকে ঝুঁকে শওকত জিজ্ঞেস করলেন, তবে কী?
আপনাদের কোনও ভয় নেই। আপনারা বিপদে পড়েন, এমন কিছুই ওরা করবে না।
ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। স্বজাতের মানুষজনকে রাজাকাররা নিশ্চয়ই রেহাই দেবে।
তবু কোথায় যেন খানিক ধন্দ থেকেই যায় শওকতের। একটু চিন্তা করে তিনি বলেন, আপনার একটা পরামর্শ চাইছি চাচাজি
বলুন
রাজদিয়ায় গিয়ে যদি অসুবিধায় পড়ি, কার কাছে যাব? মানে যিনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন দ্বারিক দত্ত। তারপর বলেন, একজনের কথা বলতে পারি। নির্দ্বিধায় আপনি তার কাছে যেতে পারেন।
কে তিনি?
আমার বন্ধু হেমনাথ মিত্র। বিনয়ের দাদা (দাদু)। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, পার্টিশান হয়ে যাবার পর লাখ লাখ হিন্দু ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে। রোজই দলে দলে আসছে। আবার লক্ষ লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানে থেকেও গেছে। তারা ভিটেমাটি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আসবে না। হেমনাথ তাদেরই একজন। রাজদিয়ার সে সব চাইতে রেসপেক্টেড পার্সন। আমাদের সেই ছোট্ট টাউনটা ঘিরে তিরিশ চল্লিশটা গ্রামের সব মানুষ, হিন্দুই হোক কি মুসলমান হোক, তাকে সম্মান করত। যতদূর জানি, এখনও করে। হেমনাথ যে আজীবন কত মানুষকে কত ভাবে সাহায্য করেছেন, বিপদের দিনে সবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে দ্বারিক দত্ত বললেন, সে কারওকে ফেরায় না। তার দরজা সব সময় সকলের জন্যে খোলা।
শওকতের দুর্ভাবনা কিছুটা কেটে যায়। উৎসুক সুরে বলেন, মেহেরবানি করে আমার সম্বন্ধে, ওঁকে একটা চিঠি লিখে দেবেন?
নিশ্চয়ই দেব। আপনি তো এখনও কদিন ইন্ডিয়ায় আছেন। চিঠিটা এর মধ্যে লিখে রাখব। আপনি নিজে এসে নিয়ে গেলে খুশি হব। কারণ আপনার সঙ্গে আর একবার দেখা হবে। নইলে কারওকে পাঠাবেন। তার হাতে দিয়ে দেব।
আমি নিজেই আসব।
খুব ভাল।
হঠাৎ বিনয়ের মনে হয়, দ্বারিক দত্ত বেশ কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছেন। দেশের হাল তখন যা দেখে এসেছিলেন, এর ভেতর তার চাইতে ঢের খারাপ হয়ে গেছে। এখন আতঙ্ক অনেক বেশি তীব্র। দিনকে দিন সমস্ত বদলে যাচ্ছে। আজ যতটা খারাপ, কাল তার চেয়ে আরও খারাপ। হেমনাথ এই মুহূর্তে কী অবস্থায় আছেন, বিপুল সম্মান নিয়ে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হচ্ছে কি না, কিছুই জানা নেই।
নিত্য দাস তার যে চিঠিখানা দিয়ে গিয়েছিল, তারপর দুসপ্তাহের মতো কেটে গেছে। এর মধ্যে রাজদিয়ায় কী ঘটে চলেছে, কলকাতায় বসে সেই সব ঘটনাপ্রবাহের হদিস পাওয়া অসম্ভব। নিত্য দাসও আর আসেনি যে তার কাছ থেকে সেখানকার কোনও খবর পাওয়া যাবে। প্রয়োজন হলে শওকতের জন্য হেমনাথের পক্ষে এই মুহূর্তে কতটা কী করা সম্ভব, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
চকিতে অন্য একজনের মুখ বিনয়ের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মোতাহার হোসেন চৌধুরি। হেমনাথের পর ওই অঞ্চলের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ। হিন্দু মুসলমানের বিভাজন কোনওদিনই মেনে নেননি। দুই সম্প্রদায়ের ভেদ-বিভেদ যখন মাথা চাড়া দিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছল, কী কষ্টই না পেয়েছেন! দেশভাগের পর একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। বিনয় তো সেইসময় দেখেছে, সারাক্ষণ মুহ্যমান হয়ে থাকতেন মোতাহার হোসেন। মনে হতো, মানুষ নয়, একটা ভগ্নস্তূপ।
সেই ছেচশ্লিশ সাল থেকে রাজদিয়ার বেশির ভাগ লোকজন রাতারাতি পালটে গেল। দুদিন আগেও যারা হেসে হেসে কথা বলত, তাদের মুখ থেকে হাসি উধাও হল। তখন তাদের দুচোখে ঘৃণা। সন্দেহ। কিন্তু মোতাহার হোসেন চৌধুরি একই রকম থেকে গেলেন। হেমনাথের মতো তিনিও অন্যের জন্য দুহাত বাড়িয়ে রেখেছেন।
মোতাহার হোসেনের কী জাত, কোন সম্প্রদায়, এ নিয়ে রাজদিয়ার কেউ কখনও মাথা ঘামায়নি। তিনি মাস্টার মশায়, শ্রদ্ধেয় গুরুজন। ব্যস, এ-ই ছিল তার একমাত্র পরিচয়। বাকি সব কিছুই অনাবশ্যক। অর্থহীন।
কিন্তু এই মুহূর্তে আচমকা বিদ্যুৎচমকের মতো বিনয়ের মাথায় যা খেলে গেল তা হল, মোতাহার হোসেন হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ যতই অপছন্দ করুন, দেশভাগ যতই তার বুকে শেল বিধিয়ে দিক, তিনি একজন মুসলমান। পাকিস্তানের এখন যা পরিস্থিতি তাতে হেমনাথ মিত্রের চেয়ে মোতাহারই হয়তো অনেক বেশি উপকার করতে পারবেন।
বিনয় শওকতকে বলল, আমিও একজনকে চিঠি লিখে দেব। তার সঙ্গেও দেখা করবেন।
শওকত জিজ্ঞেস করলেন, কার কথা বলছেন?
বিনয় মোতাহার হোসেন সম্পর্কে বিশদভাবে জানায়।
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই দুই আইনজ্ঞ দুনম্বর দানপত্রে সাক্ষীদের দিয়ে সই-সাবুদ করিয়ে নিয়েছেন।
প্রতিটি দানপত্রের দুটো কপি করা হয়েছে। আপাতত একটা করে কপি দুই উকিলের কাছে থাকবে। পরে সেগুলো তাদের মক্কেলদের দেওয়া হবে।
যে-উদ্দেশ্যে আজ জাফর শা রোডের এই বাড়িটিতে এতগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে তা সুচারুভাবে শেষ হল। কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই।
এবার আপ্যায়নের পালা।
হিরণ ভেতরে গিয়ে খবর দিতেই সুধা, সুনীতি এবং উমা লুচি তরকারি মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে এল।
.
অতিথিরা চলে যাবার ঘণ্টাদেড়েক পর খাবার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে দ্বারিক দত্তদের খেতে বসিয়ে দিল সুধা। সুনীতিদের মতো এ-বাড়িতেও টেবল-চেয়ারে নয়, মেঝেতে সুতোর ফুল-তোলা আসন পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা।
প্রথমে পুরুষেরা খাবে। তারপর সুধা সুনীতি উমা এবং সরস্বতী।
মুখোমুখি খেতে বসেছিল হিরণরা। একদিকে সে আর বিনয়। অন্যদিকে দ্বারিক দত্ত এবং আনন্দ। পরিবেশন করছিল সুধা আর সুনীতি। উমা তাদের হাতে এটা সেটা এগিয়ে দিতে লাগল দরকার মতো। রান্না হয়েছে প্রচুর। উমাকে সঙ্গে নিয়ে দশভুজা হয়ে সব প্রায় একাই করে ফেলেছে সুধা। সুনীতি এ-বাড়িতে এসেছে বেলা করে। এসেই রান্নায় হাত লাগিয়েছে। সেও দু-একটা পদ বেঁধেছে।
খেতে খেতে নানা কথা হচ্ছিল। তার সবটাই আজকের এই দানপত্রের বিষয়ে। আনন্দ বলছিল, ক, কলকাতায় তোমাদের একটা ভাল প্রপার্টি হল।
হিরণ খুব খুশি। দুটো মাস প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিল সে। দ্বারিক দত্ত আর সরস্বতী যেভাবে বেঁকে বসেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল খান মঞ্জিল হাতছাড়া হয়ে যাবে। আজ সব দুর্ভাবনার অবসান। এতদিনের দৌড়ঝাঁপ সার্থক।
হিরণ হেসে হেসে বলল, তা হল। কোনওদিন ভাবিনি, কলকাতায় আমরা বাড়ি করতে পারব।
আনন্দ বলল, যত তাড়াতাড়ি পার, বাড়িটা সারিয়ে টারিয়ে নাও ।
তা তো নিতেই হবে। দুচারদিনের ভেতর প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করব।
তার পরও যদি কিছু টাকা দরকার হয়, আমাকে বোলো। লজ্জা কোরো না।
আগে দেখি কতটা পাওয়া যায়। তাতে না কুলোলে আপনার কাছে হাত পাততেই হবে।
একটু ভেবে আনন্দ জিজ্ঞেস করল, বাড়িটার নাম খান মঞ্জিলই থাকবে না কি?
হিরণ মাথা নেড়ে বলে, না না, দাদুর সঙ্গে আগেই কথা হয়েছে অন্য একটা নাম দিতে হবে। সবে তো আজ দানপত্র হল। পরে সবাই মিলে বসে নামটা ঠিক করে নেব। সেদিন সুনীতি দিদি আর আপনাকেও ডাকব। এর মধ্যে আপনারাও নাম ভাবতে থাকুন। আমরাও ভাবি। যেটা বেশি ভোট পাবে সেই নামই রাখা হবে।
খেতে খেতে বিনয় লক্ষ করছিল, দ্বারিক দত্ত কোনও মন্তব্য করছেন না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন। কিছু একটা চিন্তার ভেতর মগ্ন হয়ে আছেন। কেমন যেন ঝিম-ধরা ভাব। অথচ খানিক আগে শওকতরা যখন ছিলেন, অনবরত কথা বলছিলেন।
কী ভাবছেন তিনি? দেশের বাড়িঘর জমিজমা ফেলে চলে আসতে হয়েছে। হয়তো বেদখল হয়ে যেত, তবু বলা যেত, সে-সব তাঁদেরই। তারাই রাজদিয়ার ওই সম্পত্তির বৈধ স্বত্বাধিকারী। কিন্তু দানপত্রে সই করার পর রাজদিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের যে পলকা গিটটা ছিল, পট করে সেটা ছিঁড়ে গেল। সেই জন্যই কি দ্বারিক দত্ত এমন নিঝুম? এমন বিমর্ষ?
খাওয়াদাওয়ার পর সবাই ঘণ্টা দুই বিছানায় গড়িয়ে নিল। তারপর শীতের বেলা ঢলে পড়লে চা খেয়ে আনন্দ আর সুনীতি বেরিয়ে পড়ল। ওরা বাড়ি ফিরে যাবে। হিরণ এবং বিনয় ওদের এগিয়ে দিতে সঙ্গে সঙ্গে চলল।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আনন্দ বিনয়কে বলছিল, তোমার অফিসে জয়েন করার সময় কিন্তু হয়ে এসেছে। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। মনে আছে তো?
বিনয় ঘাড় কাত করল, নিশ্চয়ই
সেদিন সকালে এখানে এসে তোমাকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাব। মানে প্রথম দিন
কলকাতার রাস্তাঘাট এর মধ্যেই অনেকটা সড়গড় হয়ে গেছে বিনয়ের। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে তাদের অফিসে চোখ বুজে সে চলে যেতে পারবে। টালিগঞ্জ থেকে ট্রাম বা বাসে ধর্মতলা, সেখান থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে যে বাসগুলো শ্যামবাজারের দিকে যায় তার কোনও একটা ধরলেই হল। তাদের অফিসের সামনেই স্টপেজ। তাছাড়া বিনয় নাবালক নয় যে তাকে অফিসে পৌঁছে। দিতে হবে। তবে আনন্দ যখন চাইছে তখন তার মুখের ওপর না বলল না সে।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর গলা নামিয়ে বিব্রতভাবে আনন্দ বলল, বলার মুখ নেই, তবু বলছি। মা তোমাকে একবার আমাদের বাড়ি যেতে বলেছে।
চকিতে হেমনলিনীর চেহারাটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন এক মহিলা। দাঁতে দাঁত চেপে থাকে বিনয়। উত্তর দেয় না।
ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আনন্দর। সে বলে, জানি, আমাদের ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে। তবু বলছি, যদি তোমার ইচ্ছে হয়, একবার যেও।
বিনয় এবারও চুপ। এই জীবনে হেমনলিনীর মুখদর্শন করার ইচ্ছা তার নেই। বড় রাস্তায় এসে সুনীতি আর আনন্দকে একটা ফাঁকা ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে সে আর হিরণ বাড়ি ফিরে আসে।
২১-২৫. হিরণদের রাজদিয়ার জমিবাড়ি
২১.
হিরণদের রাজদিয়ার জমিবাড়ি এক্সচেঞ্জের পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবার দুদিন বাদে হঠাৎ লাফাতে লাফাতে নিত্য দাস এসে হাজির। সে এল সন্ধের পর। বেশ কিছুদিন বাদে তাকে সুধাদের বাড়িতে দেখা গেল।
এর মধ্যে হিরণ অফিস থেকে ফিরে এসেছিল। এখন বাড়িতে রয়েছে সে, বিনয়, দ্বারিক দত্ত এবং উমা। সুধা আর সরস্বতী নেই। কাছেই এক বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো। ওঁরা বিশেষ করে যাবার জন্য বলে গিয়েছিলেন। সরস্বতী আগের তুলনায় ইদানীং অনেকটাই ভাল। জবুথবু ভাব আর ততটা নেই। মোটামুটি হাঁটাচলা করতে পারেন। সুধা তাঁকে নিয়ে পুজোবাড়িতে গেছে। পুজো শেষ হলে গীতাপাঠ হবে। তারপর প্রসাদ নিয়ে ওদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।
অনাত্মীয় লোকজন এলে যেমনটা করা হয়, নিত্য দাসকেও তেমনি বাইরের ঘরে বসানো হয়েছে। ওখানেই রয়েছে বিনয়, হিরণ এবং দ্বারিক দত্ত।
আজ সেই বিকেল থেকেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। যত সময় যাচ্ছে, ঠাণ্ডার দাপট ততই বেড়ে চলেছে। কনকনে হাওয়া ছেড়েছে উত্তর দিক থেকে। চামড়ায় লাগলে মনে হয়, ছুরির ফলা কেটে কেটে বসে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে গাঢ় হয়ে নামছে কুয়াশা।
দ্বারিক দত্তর পরনে মোটা খদ্দরের ধুতি, পাঞ্জাবি এবং সোয়েটারের ওপর শাল। মাথায় কানঢাকা উলের টুপি। বিনয় আর হিরণের গায়ে ঘরে পরার পোশাক। পাজামা এবং পাঞ্জাবির ওপর ভারী পুল-ওভার। নিত্য দাসও তুষের রোঁয়াওলা চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে।
উত্তুরে বাতাস রুখবার জন্য ঘরের সব দরজা-জানালা সেই বিকেল থেকে বন্ধ। তবু অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতর হিম এসে ছুঁচের মতো হাড়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
টালিগঞ্জের এই এলাকাটায় মশাদের প্রচণ্ড উৎপাত। বেলা পড়ে এলে তারা ঝাঁকে ঝাকে চারপাশের বাড়িগুলোতে হানা দিতে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই নেই। মশাদের একটা পল্টন ঠিক ফাঁক খুঁজে খুঁজে হিরণদের এই বাইরের ঘরটায় চলে এসেছে। পিন পিন আওয়াজ তুলে সমানে চক্কর দিচ্ছে। আর তাক বুঝে চারটি মানুষের শরীরে যেখানে যেখানে খোলা জায়গা নজরে পড়ছে, ঝাঁপিয়ে পড়ে হুল বেঁধাচ্ছে।
উমা চা-বিস্কুট দিয়ে গিয়েছিল। একটা কাপ তুলে সশব্দে লম্বা চুমুক দিয়ে নিত্য দাস বলল, ভাবছিলাম কাইল দিনের বেইলে আহুম। কিন্তুক শুনাশুন একখান কথা কানে আইতে আইজই লৌড়াইয়া আইলাম।
অন্য সবাইও চায়ের কাপ তুলে নিয়েছিল। হিরণ জিজ্ঞেস করল, কী শুনে দৌড়ে এলেন?
প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে নিত্য দাস বলে, এইটা কি ভালা হইল হিরণ ভাই?
আপনার কথা কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কোনটা ভাল হল না?
এই যে দ্যাশের বাড়ি-জমিন এচ্চেঞ্জ করলেন, হেই খবরটা একবার আমারে জানাইলেন না?
হিরণ অবাক। পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে বলে, আপনাকে জানাবার কথা কি ছিল?
অনুযোগের সুরে নিত্য দাস বলল, হেয়া আছিল না। কিন্তুক আমি আপনেগো দ্যাশের লোক। আপনে তো জানেন, আমি হিন্দুস্থান-পাকিস্থানের সোম্পত্তি এক্ষেঞ্জের কারবার করি। আগে যেইদিন আইছিলাম, ঠিকানা দিয়া গ্যাছি। একখান পোস্টোকার্ড ছাইড়া দিলে কবে চইলা আইতাম।
লোকটা কী চাইছে, বুঝতে না পেরে তাকিয়েই তাকে হিরণ।
নিত্য দাস এবার বলে, রাইজদায় আপনেগো দুই-ফসলী ষাইট কানি সরস চাষের জমিন, বাগ বাগিচা, পুকৈর, বসত বাড়ি–হেই হগলের বদলে পাইলেন কিনা খান মঞ্জিল। যাইট সত্তর বছরের পুরানা একখান দালান।
অপার বিস্ময়ে হিরণ জিজ্ঞেস করে, খান মঞ্জিল-এর সঙ্গে আমাদের বাড়িটাড়ি এক্সচেঞ্জ করেছি, আপনি জানলেন কী করে?
এক বচ্ছরের উপুর এই কাম করতে আছি হিরণভাই। ম্যালা (অনেক) খবর আমারে রাখতে হয়। কারা ইন্ডিয়ার সোম্পত্তি বদলাবদলি কইরা পাকিস্থানে যাইতে চায়, কারা পাকিস্থান থিকা একই উদ্দিশ্য লইয়া ইন্ডিয়ায় আইতে চায়–এই হগল না জানলে কারবার চালামু ক্যামনে?
হিরণ উত্তর দিল না।
এদিকে বিনয় একদৃষ্টে নিত্য দাসকে লক্ষ করছিল। রাজদিয়া থেকে হেমনাথের চিঠি এসেছে কি না, জানার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাচ্ছে না।
নিত্য দাস বলে ওঠে, আমার হাতে আরও বড় গাহেক (খদ্দের) আছিল। আপনেগো জমিন বাড়ির বদলে এই টালিগুঞ্জেই খান মঞ্জিল-এর দ্যাড়া (দেড় গুণ) বাড়ি আর পেরায় নয় কাঠা জমিন পাইয়া যাইতেন। আর হেই বাড়িও খান মঞ্জিল-এর লাখান অত কালের পুরানা না। একটু থেমে ফের শুরু করে, আপনেগো জবর লুকসান হইয়া গ্যাল। আমিও মধ্যিখান থিকা ফাঁকে পইড়া গ্যালাম। আপনেগো কাছ থিকা বেশি কিছু নিতাম না; কিন্তু অন্য পক্ষ কম কইরা পাঁচ সাত হাজার নিয্যস (নিশ্চয়) দিত। ইস, দানপত্র করনের আগের দিনও যদিন ট্যার পাইতাম, খান মঞ্জিল এর এচ্চেঞ্জটা আটকাইয়া দিতাম।
নিত্য দাসের এত মনস্তাপ, এমন আফসানির কারণ এতক্ষণে বোধগম্য হল। বিরাট অঙ্কের দালালিটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় শোক উথলে উঠেছে তার।
হিরণ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, তা পারতেন না।
ক্যান?
অনেক আগেই শওকত আলি খানের সঙ্গে এক্সচেঞ্জের কথাবার্তা বলে রেখেছিলাম। তখনও আপনি আমাদের এ-বাড়িতে আসেননি। দাদু আর জেঠিমা সেই সময় পাটনায়। দেশের জমিজমার বদলে মুসলিম প্রপার্টি নিতে ওঁদের ভীষণ আপত্তি ছিল। সুধারও মত ছিল না। পরে অবশ্য সবাই রাজি হল। শওকত সাহেব আমাদের আশায় এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন। তাকে কি ফট করে না বলে দেওয়া যায়?
দ্বারিক দত্ত নিঃশব্দে দুজনের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। এবার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, কথা যখন দেওয়া হয়েছে তার নড়চড় করা ঠিক হতো না।
নিত্য দাস থতমত খেয়ে গেল। নিমেষে সামলে নিয়ে গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে বলল, একখান কথা কমু, কিছু মনে কইরেন না। আপনেরা অহনও সইত্য যুগে পইড়া আছেন। দিনকাল আর আগের লাখান নাই। যা করলে লাভ বেশি হেয়াই করন উচিত। যদিন সুযুগ পাওন যায় হেইটা পুরা উশুল কইরা নেওন হইল বুদ্ধিমানের কাম। কারে শুকনা মুখের কথা দিছিলেন হেয়া ধইরা বইয়া থাকলে চলে?
নিত্য দাস নামে এই ধুরন্ধর লোকটা জগতে মাত্র কয়েকটা জিনিসই বোঝে। অনেক টাকা। অনেক লাভ। আর সুযোগ এলে পুরোপুরি সেটা কাজে লাগাবার জন্য সারাক্ষণ চোখকান খোলা রাখা।
একনাগাড়ে উপদেশ বর্ষণ করে হাঁফিয়ে পড়েছিল নিত্য দাস। একটু দম নিয়ে আবার আরম্ভ করে, দ্যাশের অত সোম্পত্তির বদলে আপনেরা পাইলেন মোটে ছয় কাঠা জমিন আর পুরানা একখান দালান। আর আমার কপালে ঠনঠনঠন। একটা ঘষা আধলাও জুটল না। হগলই অদ্দিষ্ট। আক্ষেপে তার গলা বুজে আসে।
খানিক চুপচাপ।
যার জন্য এতক্ষণ অস্থির হয়ে ছিল, এই ফাঁকে সেটা বলে ফেলে বিনয়, অনেক দিন পর আপনি এলেন। আর দু-একদিন দেখে আপনার বাড়িতে যেতাম। কেন জানেন? দাদুকে যে সেই চিঠি লিখেছিলাম তার উত্তর এখনও পাইনি। রাজদিয়া থেকে তার চিঠি কি এসেছে?
আস্তে মাথা নাড়ে নিত্য দাস, না। তয় (তবে) আমার হেই লোকটা, জয়নাল যার নাম, ঢাকা আর ফরিদপুর থিকা চিঠিপত্তর আইনা বর্ডারে পৌঁছাইয়া দ্যায়, হেয় খবর পাঠাইছে পরের হপ্তায় হ্যামকত্তার চিঠি লইয়া আইব।
দাদুর জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি।
চিন্তা তো হওনের কথাই। হ্যামকত্তার চিঠি যে আর কয়দিনের মইধ্যেই পাইবেন হেই কথাখান কওনের লেইগা কাইল আইতাম। কিন্তু হিরণ ভাইগো সোম্পত্তি এচ্চেঞ্জের খবর পাইয়া আইজই চইলা আইছি।
দাদু আর দিদারা কেমন আছেন কিছু জানেন?
না।
দিন কুড়ি আগে দাদু যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন তাতে লিখেছেন, রাজদিয়ার অবস্থা দিনকে দিন খুব খারাপ হচ্ছে। এখন ওখানে কী চলছে, কে জানে।
নিত্য দাস বলে, বডারে জয়নালের লগে দেখা না হওন তরি (পর্যন্ত) কিছুই কইতে পারুম না। আর তো কয়টা দিন। হের পর হ্যামকত্তার চিঠি আইনা দিমু। হগল জানতে পারবেন। তদ্দিন এটু ধৈয্য ধইরা থাকেন।
সরকারি ডাক বিভাগে এখনও ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। প্রায় অচল। হেমনাথের সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ সবই নিত্য দাসের মারফত। তার নোকজন পূর্ব পাকিস্তানের, বিশেষ করে ঢাকা আর ফরিদপুরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। তারা ওই দুই ডিস্ট্রিক্টের হিন্দুদের চিঠিপত্র বা অন্যান্য খবরাখবর বর্ডার অবধি পৌঁছে দেয়। সীমান্তের এপারেও বেশ কিছু লোককে কাজে লাগিয়েছে নিত্য দাস। তারা এখানকার মুসলমানদের চিঠি টিঠি সীমান্তে নিয়ে গিয়ে নিত্যর ওপারের লোকেদের হাতে তুলে দেয়। তেমন জরুরি কিছু হলে স্বয়ং নিত্যকেই বর্ডারে গিয়ে তার পাকিস্তানি এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
যতদিন না নিত্য দাস হেমনাথের চিঠি নিয়ে আসছে, অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া উপায় কী?
রাত বাড়ছিল। তাপাঙ্ক হু হু করে নেমে যাচ্ছে। বড় রাস্তা থেকে ক্কচিৎ ট্রাম বাস কিংবা অন্য যানবাহনের ছুটে যাওয়ার ক্ষীণ শব্দ বা লোকজনের অস্পষ্ট কথা ভেসে এসেই মিলিয়ে যায়। ঘরে বসেই টের পাওয়া যায়, রাস্তাঘাট দ্রুত ফাঁকা হয়ে আসছে। এই শীতের রাতে মহানগর যখন হিমে কুয়াশায় কুঁকড়ে রয়েছে, কে আর বাইরে থাকতে চায়?
নিত্য দাস অন্যমনস্কর মতো কী ভাবছিল। হঠাৎ তার দুই চোখ চকচক করে ওঠে। বেশ উত্তেজিত ভাবেই ডাকে, ছুটোবাবু
নিত্যর গলার স্বরের পরিবর্তনটা খট করে কানে ধাক্কা দেয় বিনয়ের। সে রীতিমতো অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবেন?
হ। নিত্য বলতে থাকে, আপনের বাবায় কেতুগঞ্জের মজিদ মিঞার কাছ থিকা তিরিশ কানি জমিন কিনছিলেন না? তিন ফসলী চেমৎকার খেতি। বচ্ছরে তিনবার ফসল হইত। আউশ আমন আর রবিখন্দের সোময় তিল কলই সউর (সর্ষে) রান্ধনি–
বিনয় সায় দেয়, হ্যাঁ, খুবই ভাল জমি।
শুনছি, আপনের বাবার তীর্থধম্মে মতি হইছে। তেনি সোংসার, পোলমাইয়ার মায়া ছাইড়া কুন এক গুরুর কাছে চইলা গ্যাছেন?
হ্যাঁ।
তা রাইজদার হেই জমিগুলানের কী ব্যবস্তা কইরা গ্যাছেন?
অবনীমোহন গুরুর কাছে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রাজদিয়ায় তার বিষয়আশয়ের ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বিনয়ের। নিত্য দাস কিন্তু ভোলেনি। পাকিস্তানে তার পরিচিত মানুষজনের কার কতটুকু জমি এবং অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, সমস্ত কিছু তার নখদর্পণে।
বিনয় বলল, বাবা কোনও ব্যবস্থাই করে যাননি। জমিগুলো যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে। দাদু লোক দিয়ে কবছর ধরে চাষবাস করাচ্ছেন।
বিপুল উদ্যমে বিনয়ের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিত্য দাস, আমার একখান পরামশ্য লন (নিন) ছুটোবাবু।
কী পরামর্শ?
হ্যামকত্তা তেনার বিষয় সোম্পত্তি এচ্চেঞ্জ করবেন কি না, তেনিই জানেন। ওনার মতিগতির তল পাই না। পাকিস্থান হইয়া গ্যাছে। উইখানের লগে আমাগো সম্পর্ক শ্যাষ। এত বড় বিদ্বান মানুষ, ক্যান যে বুঝেন না, হিন্দুরা বডারের উইধারে থাকতে পারব না। দ্যাশের উপুর ক্যান যে অ্যাত টান! ক্যান যে অ্যাত মায়া! হে যাউক, উনি যা ভালা মনে করবেন হেয়াই করবেন। কিন্তুক আপনেগো জমিনগুলান এচ্চেঞ্জ কইরা ফালান। আমার হাতে গাহেক আছে।
ইঙ্গিতটা আগেই পেয়ে গিয়েছিল বিনয়। কিন্তু জমিজমা, বিষয়আশয় সম্পর্কে তার কোনও রকম মোহ নেই। তাছাড়া রাজদিয়ার ওই জমি তার একার নয়, সুধা এবং সুনীতিরও। ওই ব্যাপারে তাদেরও খুব একটা আগ্রহ নেই।
বিনয় বলল, দেখুন, বাবা আমাদের তিন ভাই বোনকে বলে গেছেন, ওই জমিটা নিয়ে আমরা যা ভাল বুঝি তাই যেন করি। কিন্তু এ নিয়ে আমরা এখনও কিছু ভাবিনি। একটু থেমে ফের বলল, রাজদিয়ার জমি এক্সচেঞ্জ করলে ওয়েস্ট বেঙ্গলে খানিকটা জমি হয়তো পাব কিন্তু সে-সব কে দেখাশোনা করবে? কে চাষবাস করাবে? আমাদের অত সময় নেই। ওগুলো যেমন আছে তেমনই থাক।
নিত্য দাস সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। জোঁকের মতো সে লেগে থাকে। জমিনের বদলে যদিন এই পারের জমিন না ন্যান, অন্য এট্টা উপায়ও হইতে পারে।
লোকটা ফন্দিবাজ। নিশ্চয়ই তার মাথায় হঠাৎ কোনও একটা মতলব খেলে গেছে। বিনয় সামান্য। উৎসুক হল, কী উপায়?
জমিন না নিয়া ট্যাকা নিতে পারেন।
টাকা নেব কী করে? দলিল টলিল সব পড়ে আছে রাজদিয়ায়, দাদুর কাছে। এখন আমাদের কারও পক্ষে পাকিস্তানে গিয়ে সে-সব নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
নিত্য দাস দুহাত তুলে হাঁ হাঁ করে ওঠে, আপনেগো পাকিস্থানে যাওন লাগব না। টালিণ্ডঞ্জের এই বাড়িত বইয়াই ট্যাকা পাইয়া যাইবেন। পদ্ধতিটাও সে বিশদভাবে জানিয়ে দেয়। বিনয় সুধা আর সুনীতি, তিন ভাইবোন স্ট্যাম্প পেপারে লিখে জমি বিক্রি বা হস্তান্তরের ক্ষমতা হেমনাথকে দেবে। নিত্যর লোক সেটা নিয়ে রাজদিয়ায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। কলকাতা থেকে পাকিস্তানে চলে যেতে চায়, নিত্যর হাতে এমন বহু ক্রেতা আছে। সবচেয়ে বেশি দাম যে দেবে তার নামেই বিনয়দের জমিটা রেজিস্ট্রি করে দেবেন হেমনাথ। টাকাটা ঢাকার মারোয়াড়িদের কাছ থেকে হুন্ডি করিয়ে ওদের কলকাতার বাজারের গদি থেকে তুলে নিতে তিলমাত্র অসুবিধা হবে না। এইভাবে মারোয়াড়িদের মারফত ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের মধ্যে আকছার টাকা পয়সার লেনদেন চলছে। বিনয়দের কষ্ট করে বড়বাজার অবধি যেতেও হবে না। নিত্য দাস নিজে গিয়ে টাকাটা এনে দেবে।
একটু ভেবে সে আরও বলে, আপনেরা সন্দ (সন্দেহ) করলেও করতে পারেন যে আমি ট্যাকাটা মাইরা দিমু। কিন্তুক এক দ্যাশে আমাগো বাড়ি। আপনেরা আমার আপন মানুষ। হ্যামকত্তারে কত সোম্মান করি। তেনার নাতি-নাতিনগো আমি ঠকামু না। মাথার উপুর ভগমান আছে, ধম্ম আছে। আমারে বিশ্বাস করতে পারেন। যদিন আপনেগো ট্যাকা মারনের মতলব করি, নিঃবংশ হমু। আমাগো মাথায় ঠাটা (বাজ) পড়ব।
এত বুঝিয়ে সুঝিয়েও সুফল কিছুই হল না। বিনয় নিস্পৃহ সুরে বলল, রাজদিয়ার জমি নিয়ে আমরা কিছুই করব না। যা করার দাদুই করবেন।
হিরণদের জমি বাড়ি তো হাতছাড়া হয়েছেই। সে-সবের জন্য দালালির আশা নেই। এদিকে বিনয়রাও তাদের অতটা জমি বেচবেও না, এক্সচেঞ্জও করবে না। কী যে এদের ভাবগতিক! নিত্য দাস মুষড়ে পড়ে। হতাশার সুরে বলে, নিজেগো কতখানি ক্ষেতি করলেন, অখন বুঝতে পারবেন না ছুটোবাবু। একখান কথা কইয়া থুইলাম, পরে কপাল থাপাড়াইতে হইব। তখন আর কিছু করনের থাকব না।
একটু চুপচাপ।
তারপর নিত্য দাস বলল, ম্যালা রাইত হইয়া গ্যাছে। আইজ উইঠা পড়ি। শীতের রাইতে গাড়িঘুড়া কইমা যায়। এইর পর কসবার বাস পামু না। ছুটোবাবু আপনে খাড়া না কইয়া দিছেন। তর্ভু আমি লাইগা থাকুম কিলাম (কিন্তু)। পরের হপ্তায় হ্যামকত্তার চিঠি লইয়া আহুম। এইর মইধ্যে রাইজদার জমিনটা বেচবেন কিনা, ভাইবা দেইখেন। দুই বইনের লগে, দুই ভগ্নীপতির লগে পরামশ্য কইরেন। দ্বারিক কত্তা বুড়া মানুষ। পিরেথিমীতে কত কিছু দ্যাখছেন, কত কিছু হোনছেন। তেনার মতও লইয়েন।
নিত্য উঠে পড়েছিল, হঠাৎই জামতলি হাই স্কুলের মৃত হেডমাস্টার রামরতন গাঙ্গুলির বৃদ্ধা স্ত্রী এবং তাঁদের তিন মেয়ে ছায়া মায়া আর বাসন্তীর মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিনয়ের। তারপাশা স্টিমারঘাটে পাহারা দিয়ে দিয়ে ওঁদের পৌঁছে দিয়েছিলেন রামরতনের প্রাক্তন ছাত্র নাসের আলি এবং তার অনুগত কয়েকটি সশস্ত্র যুবক।
তারপশায় নাসের আলি আর রামরতনের কথাবার্তা শুনে বিনয় জানতে পেরেছিল, জামতলিতে রামরতনদের চল্লিশ কানি উৎকৃষ্ট চাষের জমি ছাড়াও আছে বসত-বাড়ি, বাগান, পুকুর ইত্যাদি। তাদের সম্পত্তির দলিল রেখে এসেছেন নাসেরের কাছে। রামরতন বিশেষ করে অনুরোধ করেছিলেন নাসের যেন সুযোগ পাওয়ামাত্র তাদের জমিবাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করেন। খালি হাতে কলকাতায় যাচ্ছেন। সেখানে টাকার বড় দরকার।
কদিন আগে বিমলদের বাড়ি গিয়েছিল বিনয়। রামরতনের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, নাসের আলি এর মধ্যে তাদের বাড়িটাড়ি বেচার বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন কি না। অবশ্য তেমন কিছু হলে বৃদ্ধা নিশ্চয়ই তাকে খবরটা দিতেন। খুব সম্ভব কলকাতায় আসার পর নাসেরের সঙ্গে তিনি যোগাযোগই করতে পারেননি।
নিত্য দাস যে ধরনের ফন্দিবাজ লোক, রামরতনের সম্পত্তির ব্যাপারে মাথা খাঁটিয়ে কিছু একটা ফিকির কি আর বার করতে পারবে না? বিনয় হাত নেড়ে বলল, আর একটু বসে যান। কাজের কথা আছে।
নিত্য দাস অবাক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, কী কাম?
আগে বসুন তো। সব শুনুন। কাজটা করে দিতে পারলে আপনার বেশ ভাল লাভ থাকবে।
টাকা পয়সার গন্ধ পেয়ে মুষড়ে-পড়া ভাবটা কেটে যায় নিত্য দাসের। লহমায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে সে। কাপ করে ফের চেয়ারে বসে পড়ে।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, জামতলির নাম শুনেছেন?
নিত্য দাস বলল, হুনুম না ক্যান? তারপাশা ইস্টিমারঘাটা থিকা চার মাইল পুবে। আলিসান গেরাম। বামন কায়েত যুগী তেলী কুমার কামার মুসলমান-নানা জাইতের মাইনষের বাস। আছে বড় বড় দিঘি, পদ্মবিল। ম্যালা দালানকোঠা। এককালে দশ বিশটা টোল আছিল। পাকিস্থান–
নিত্য দাস যেভাবে শুরু করেছে তাতে জামতলির ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক বিবরণ আরও অনেকক্ষণ চলত। হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল বিনয়, বুঝেছি, ওই জায়গাটা আপনি ভাল করেই চেনেন।
হেইখানে গ্যাছিও কয়েক বার। তা আতখা (হঠাৎ) জামতলির কথা উঠাইলেন যে ছুটোবাবু?
দরকার আছে। পাকিস্তানে আপনার যে কাজের লোকেরা আছে তারা কি জামতলি যেতে পারবে?
জামতলি ক্যান, ট্যাকা পাইলে পাকিস্থানের যেইহানে কইবেন হেইহানে চইলা যাইব। কন (বলুন) জামতলিতে কী করতে হইব?
রামরতন গাঙ্গুলি এবং তার পরিবার সম্পর্কে সবিস্তার জানিয়ে বিনয় বলল, ওঁদের জমি বাড়ির দলিল আছে নাসের আলি নামে এক ভদ্রলোকের কাছে। তিনি জামতলি হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেড মাস্টার। একসময় রামরতনবাবুর প্রিয় ছাত্র ছিলেন। খুবই ভাল মানুষ। রামরতনবাবু তাকে সম্পত্তি বিক্রির দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন। খুব সম্ভব তিনি এখনও তা করে উঠতে পারেননি।
নিত্য দাস জোরে মাথা ঝাঁকায়, হ। ফন্দিফিকির না জানলে পাকিস্থানে বইয়া হিন্দুর সোম্পত্তি ব্যাচন (বেচা) অত সোজা না।
আপনি কি আপনার লোকদের দিয়ে রামরতনবাবুর বাড়িটাড়ি বিক্রি করতে পারবেন? ওঁর ফ্যামিলি ভীষণ কষ্টে আছে। টাকাটা পেলে ওঁরা বেঁচে যাবেন। অবশ্য আপনার যা প্রাপ্য, ঠিকই পাবেন।
উদ্দীপনায় দুচোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে নিত্য দাসের। নিয্যস পারুম। আপনে তো জানেন আমার হাতে কত গাহেক আছে। তেনারা এহানেই ট্যাকাপয়সা দিয়া দানপত্র ল্যাখাইয়া বডারের উই পারে চইলা যাই।
বিনয় বলে, তাহলে তো খুবই ভাল হয়। যত তাড়াতাড়ি পারেন, ব্যবস্থা করে দিন।
আগে নাসের আলির কাছে লোক পাঠাই। গাঙ্গুলি মশয়ের সোম্পত্তিগুলান নিয়া তেনি কদ্দূর কী করতে পারছেন, খবর লই। হের পর যা করনের করুম।
কবে আপনার লোক নাসের আলির কাছে যেতে পারবে?
খানিক চিন্তা করে নিত্য দাস বলল, কাইলই বারের উই পারে খবর পাঠামু। লগে লগে তক্ষনই আমার লোক জামতলিতে চইলা যাইব। পরের হপ্তায় তো হ্যামকার চিঠি লইয়া আপনের কাছে আইতেই আছি। নাসের আলির লগে দ্যাখা কইরা আমার নোক কী জানতে পারছে, আপনেরে কইয়া যামু। যদিন নাসের সাহেব অহনও কিছু না কইরা উঠতে পারেন, গাঙ্গুলি মশয়ের ফেমিলির লগে আমার দ্যাখা করন লাগব।
বিনয় বলল, কোনও অসুবিধে নেই। যেদিন বলবেন সেদিনই আপনাকে রামরতনবাবুর স্ত্রী আর মেয়েদের কাছে নিয়ে যাব।
নিত্য দাস আর বসল না। চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উৎসাহে সে টগবগ করছে। মনে লয় (হয়), মা কালীর দয়ায় এই কামটা আমি কইরা দিতে পারুম ছুটোবাবু। চলি– সবার। কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে দরজার দিকে পা বাড়ায়।
.
২২.
আজ বিনয়ের অফিসে জয়েন করার দিন। জীবনের একটা পর্ব শেষ। এবার নতুন পর্বের সূচনা। কাল রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারেনি সে। বার বার ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিল। আর মাথার ভেতর নানা চিন্তা বিজ বিজ করছিল। ছিল অদ্ভুত এক মানসিক চাপ। চাপের কারণটা এইরকম। আনন্দ। তার বাবার এক সময়ের মক্কেল এবং তাদের পারিবারিক হিতাকাঙ্ক্ষী জগদীশ গুহঠাকুরতাকে ধরে চাকরিটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে তাকে পছন্দও হয়েছে জগদীশের। ছোটখাটো একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। জগদীশের কাগজের নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক তাকে একটা প্রতিবেদন লিখতে দিয়েছিলেন। পরীক্ষায় সে ভালই উতরে গিয়েছিল। তারাপদ লেখাটার যথেষ্ট তারিফ করেছেন। তার লেখার হাত যে চমৎকার সেটা জগদীশকে জানিয়েও দিয়েছেন।
একটা লেখা না হয় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারাপদ বলেছেন, রোজই বিনয়কে কিছু না কিছু লিখতে হবে। এমন সব রিপোর্ট যা পাঠকরা গোগ্রাসে গিলবে। তাতে কাগজ সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। প্রচারও বেড়ে যাবে হু হু করে। আর প্রচার বাড়লে, কাগজের লাভ হলে, কর্মীদেরও ষোল আনা লাভ। তাদের মাইনে এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও বাড়বে। সবই ঠিক। কিন্তু বিনয়ের দুশ্চিন্তা, নিত্য নতুন, চমকপ্রদ লেখার জোগান কি সে দিতে পারবে? জগদীশ গুহঠাকুরতা আর তারাপদ ভৌমিককে তার ভাল লেগেছে। জগদীশ রাশভারী। উচ্ছ্বাসহীন। তবু টের পাওয়া গেছে তিনি স্নেহপ্রবণ। তবে তারাপদ ভৌমিক একেবারে মাটির মানুষ। কিন্তু অন্য সহকর্মীরা কেমন হবে, কে জানে। এইসব মিলিয়ে বিনয় নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।
সকালে উঠেও অস্থিরতা, দুর্ভাবনা কাটেনি। কর্মজীবনে প্রথম পা ফেলতে চলেছে, সেজন্য এব ধরনের উত্তেজনাও হচ্ছে। সেই সঙ্গে আনন্দও যে হচ্ছে না তা নয়। এ-সবের মধ্যেই মুখটুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে হিরণ সুধা এবং দ্বারিক দত্তর সঙ্গে চা খেতে বসল সে।
বিনয় চাকরিতে জয়েন করবে। কিন্তু সুধার উত্তেজনা তার চাইতেও বেশি। চা খেতে খেতে ভাইকে জিজ্ঞেস করল, তোকে কখন বেরুতে হবে?
বিনয় বলল, আনন্দদা এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে। দেখি কখন আসে—
সুধা বলল, সেই কবে বলে গিয়েছিল। ভুলে টুলে যায়নি তো?
হালকা ধমকের সুরে হিরণ বলে, ভুলে যাবে! কী যে বল তার মাথামুণ্ডু নেই।
দ্বারিক দত্তও বললেন, আনন্দকে তো জানি। খুবই দায়িত্বশীল ছেলে। কথা যখন দিয়েছে ঠিক চলে আসবে। চিন্তা কোরো না।
হিরণ নটা নাগাদ অফিসে বেরিয়ে যায়। চান টান সেরে পৌনে নটায় খেতে বসে। তাই রোদ উঠতে না উঠতেই এ-বাড়িতে কয়লার উনুন ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়। তবে সকাল বিকেল সন্ধে বা রাতে চাটা করা হয় ইলেকট্রিক হিটারে কিংবা স্টোভে।
রান্না হয় দুভাগে। প্রথমেই মাছের ঝোল। সরস্বতী বিধবা মানুষ। নিরামিষ খান। আমিষের ছোঁয়া পর্যন্ত বারণ। তাই মাছ হয়ে গেলে উনুন ভাল করে নিকিয়ে ভাত ডাল ভাজা দুতিন রকমের নিরামিষ তরকারি করা হয়। আজ হবে বেগুন ভাজা, মুগের ডাল, আলু কপির ডালনা এবং পালংয়ের ঘন্ট।
মাছ নামিয়ে উনুন সাফ করে, ডাল বসিয়ে, চা করে নিয়ে এসেছিল সুধা। উমাকে আনাজ কাটার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে। তবে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে সব দেখে আসছে। ডাল ফুটে উঠলেই সম্বরা দিয়ে নিজের হাতে অন্য রান্নাগুলো সেরে ফেলবে।
সুধা বিনয়কে জিজ্ঞেস করল, আনন্দদা কখন আসবে, তোকে বলে গেছে?
বিনয় মাথা নাড়ল, না।
ভাল করে জেনে নিসনি কেন?
বিনয় জানে, তার এই ছোটদিদিটি ছোটখাটো, তুচ্ছ ব্যাপারেও ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। সে উত্তর দিল না।
একটু চিন্তা করে সুধা এবার বলল, তুই এক কাজ কর—
কী?
চান করে তোর হিরণদার সঙ্গে খেয়ে রেডি হয়ে থাক। আনন্দদা এলে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে পারবি।
সুধার এই কথাগুলো মনঃপূত হল বিনয়ের। আনন্দ আসার পর তাকে বসিয়ে রেখে চান-খাওয়া সারতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। প্রথম দিনই লেট করলে তার সম্বন্ধে অফিসের লোকজনের, বিশেষ করে কর্তৃপক্ষের ধারণা খারাপ হবে। সেটা একেবারেই চায় না বিনয়। বলল, ঠিক আছে।
সুধা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, উমা এসে খবর দিল, ডাল ফুটে গেছে।
এখন আর এক মুহূর্তও বসার সময় নেই। এক ঢোকে বাকি চা শেষ করে সুধা রান্নাঘরে ছুটল।
বিনয়ের এই ছোটদিদি একসময় ছিল কুঁড়ের বাদশা। পাশ ফিরে শুতেও তার যেন কষ্ট হতো। কিন্তু বিয়ের পর কবছরে আগাগোড়া পালটে গেছে। এখন সে ঘরের লক্ষীমার্কা সুগৃহিণী। সারাক্ষণ সংসারের যাবতীয় ঝক্কি দশভুজা হয়ে সামলায়।
ক্ষিপ্র হাতে সাড়ে আটটার ভেতর সব রান্না সেরে ফেলল সুধা। এর মধ্যে হিরণ আর বিনয়ের চান হয়ে গিয়েছিল। কাঁটায় কাঁটায় পৌনে নটায় তাদের খেতে বসিয়ে দিল।
খাওয়াদাওয়া সেরে হিরণ অফিসে চলে গেল। আর সাদামাঠা ঘরোয়া পোশাকে অপেক্ষা করতে লাগল বিনয়। আনন্দ এলে জামাকাপড় পালটাতে আর কতক্ষণ? তারপর দুজন বেরিয়ে পড়বে।
নটার পর দশটা বাজল। তারপর এগারোটা। বেলা যত বাড়ছে ততই চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে সুধা। বিনয়কে বলে, কি রে, আনন্দদা এখনও এল না যে? অফিস তো দশটায় বসে যায়।
বিনয়েরও যে চিন্তা হচ্ছিল না তা নয় কিন্তু সেটা জানালে সুধা আরও অস্থির হয়ে পড়বে। তার দুর্ভাবনা কাটিয়ে দেবার জন্য স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করল বিনয়। বলল, অফিস থেকে হয়তো দেরি করে নিয়ে যেতে বলেছে। আনন্দদা আগে এসে কী করবে?
সুধা উত্তর দিল না। তার চাঞ্চল্য কতটা কমল, আদৌ কমল কি না, কে জানে।
শেষ পর্যন্ত উৎকণ্ঠার অবসান। সোয়া বারোটায় আনন্দ এল। সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে উমা নিচে গিয়ে তাকে বাইরের ঘরে নিয়ে এল। সুধা আর বিনয় সেখানে বসে ছিল।
অন্য দিনের মধ্যে দ্বারিক দত্ত এগারোটা নাগাদ খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন। বুড়ো মানুষ। শরীর নড়বড়ে হয়ে গেছে। খাওয়ার পর ঘন্টা তিনেক দিবানিদ্রা না হলে তার খুব কষ্ট হয়। বাড়ির অন্য কারও এখনও খাওয়া হয়নি। সরস্বতী বাথরুমে। স্নানের পর তার পুজো আছে। তারপর খেতে বসবেন। তার খাওয়া হলে সুধা আর উমা খাবে।
সুধা জিজ্ঞেস করল, এত দেরি করলেন যে আনন্দদা?
কোথায় দেরি? একটা বেতের চেয়ারে শরীর ঢেলে দিয়ে আয়েশ করে বসে পড়ল আনন্দ।
সোয়া বারোটা বাজে। দেরি নয়?
আনন্দ বুঝিয়ে দিল, খবরের কাগজের অফিস, বিশেষ করে নিউজ ডিপার্টমেন্ট, অর্থাৎ বার্তা বিভাগ চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। তবে কাজের ব্যস্ততা বাড়ে দুপুরের পর থেকে। তখন প্রধান সম্পাদক থেকে শুরু করে নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার সবাই চলে আসেন। পৃথিবী নামে গ্রহটি তো আগের মতো অপার শান্তির স্বর্গ হয়ে নেই। প্রায়ই কোথাও না কোথাও ঘটছে ভয়াবহ সব ঘটনা। গণহত্যা। স্বাধীনতার জন্য লড়াই। বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে ফেলে দিয়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে সেই যে শুরু হয়েছে তার শেষ নেই। শুধুই অশান্তি। এছাড়া মারাত্মক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই। ভূমিকম্প। বন্যা। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। কোনও আগ্নেয়গিরি বহু কাল ঘুমিয়ে থাকার পর আচমকা জেগে উঠে লাভা উগরে দিয়ে ধ্বংস করে দেয় অগুনতি জনপদ। চারদিকে শুধু লোকক্ষয়। এই ধরনের কিছু ঘটলে, সকাল হোক আর মধ্যরাতই হোক, সম্পাদক বার্তা-সম্পাদক সবাই অফিসে দৌড়ে আসেন।
বিনয় যাঁদের কাছে কাজ করবে, এমনিতে তাদের কেউ দুটোর আগে আসেন না। তাই তাড়াতাড়ি যাবার মানে হয় না। আনন্দ বিনয়কে বলল, হাতে অনেক সময় আছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ধীরেসুস্থে খেয়ে নাও।
বিনয় বলল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। হিরণদা অফিস থাকলে পৌনে নটায় খেতে বসে। ছোটদি তার সঙ্গে আমাকেও জোর করে বসিয়ে দিয়েছিল। যদি দেরি করে গেলে চাকরিটা ফসকে যায়, তাই।
আনন্দ তার শ্যালিকাটিকে ভালই জানে। কারণে অকারণে তার দুশ্চিন্তা। হেসে হেসে বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
সুধা অপ্রস্তুত। ঠোঁট কামড়ে সামান্য হেসে বিনয়কে বলল, সেই কখন খেয়েছিস। আর দুটি খেয়ে নে। আনন্দদা, আগের দিন যখন এসেছিলেন নেমন্তন্ন করা হয় নি। হাতজোড় করে মজার সুরে বলতে লাগল, নিজগুণে ত্রুটি মার্জনা করে আপনিও দুমুঠো খান।
বিনয় এবং আনন্দ কেউ রাজি হল না। বিনয় বলল, অসম্ভব। এখনও ভাত হজম হয়নি। আনন্দ জানায়, বিনয়কে নিয়ে যাবে বলে সে আজ অফিসে যায়নি। বাড়ি থেকে এইমাত্র খেয়েদেয়ে আসছে। আদরের শ্যালিকাটি যেন জোরজার না করে।
শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল সুধা।
আনন্দ বিনয়কে বলল, বাড়িতে বসে থেকে কী হবে? চল, বেরিয়ে পড়া যাক।
বিনয় ওধারের একটা ঘর থেকে পাঁচ মিনিটের ভেতর ধবধবে ধুতি এবং ফুল শার্টের ওপর সোয়েটার পরে চলে এল। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে নিয়েছে। জুতোও পরা হয়ে গেছে।
যাচ্ছি রে ছোটদি
বিনয়রা বেরুতে যাবে, হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল সুধার। শশব্যস্তে সে বলল, দাঁড়া দাঁড়া। জুতো খুলে আমার সঙ্গে আয়
বিনয় অবাক। কোথায়?
আয় না ।
সুধার কার্যধারার তল পাওয়া মুশকিল। অগত্যা জুতো খুলতে হল বিনয়কে। তার একটা হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে আনন্দকে বলল, এক মিনিট আনন্দদা। আমরা যাব আর আসব—-
আনন্দ হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে।
সুধা ভাইকে টানতে টানতে তার আর হিরণের শোবার ঘরে নিয়ে এল। খাট আলমারি ড্রেসিং টেবল ইত্যাদি দিয়ে ঘরটা সাজানো। একধারে কাঠের সিংহাসনে রয়েছে লক্ষ্মী দুর্গা সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং কাঁচ দিয়ে বাঁধানো কালীর ফোটো।
আগে পুজোটুজোর তেমন ঝোঁক ছিল না সুধার। কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় যেভাবে পার্ক সার্কাসে অনিবার্য মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে তারা নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পেরেছিল, সেটাকে দৈব করুণা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। তখন থেকেই তার ঈশ্বর-ভক্তি বেড়ে গেছে। রোজ সকালে বাসি কাপড় ছেড়ে, গা ধুয়ে, পরিষ্কার শাড়ি পরে, দুর্গা লক্ষ্মী ইত্যাদি চার দেবদেবীকে প্রণাম করে তার দিন শুরু হয়। হিরণ অফিসে বেরিয়ে যাবার পর স্নান সেরে ফের শাড়ি বদল। এবার দেবদেবীর ফোটোগুলো গঙ্গাজলে ধুয়েমুছে ফুলচন্দন দিয়ে সাজিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে পুজো চলে। সন্ধেবেলায় পেতলের পঞ্চপ্রদীপ এবং সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে হাতজোড় করে অনেকক্ষণ ধ্যান করে সে। দৈনিক তিন পর্বে তার আরাধনা। শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস, এই রুটিনের হেরফের নেই।
সরস্বতী আসার পর পুজোর মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। দেশ থেকে তিনি কুলদেবতা দেবাদিদেব মহেশ্বরকে নিয়ে এসেছিলেন। পাথরে খোদাই মূর্তিটা রয়েছে তার শোবার ঘরে। তিনিও তিনবার পুজোয় বসেন। হিরণ মাঝে মাঝে রগড় করে সুধাকে বলে, তুমি আর জেঠিমা দুজনে মিলে বাড়িটাকে একেবারে পোবন বানিয়ে ছাড়বে দেখছি।
সুধার দ্বিতীয় দফার পুজো হয়ে গিয়েছিল। দেবদেবীর সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাইকে বলল, শুভ কাজে যাচ্ছিস। ঠাকুর প্রণাম করে যা।
ঈশ্বর-টিশ্বর নিয়ে সুধার মতো বাড়াবাড়ি নেই বিনয়ের। এই ব্যাপারে কোনওদিন সে মাথা ঘামায়নি। খানিকটা নিস্পৃহ ভাব। ভগবান ভগবানের মতো থাকুন, আমি আমার মতো থাকি, এইরকম আর কি। কিন্তু আজ কী যে হয়ে গেল, হাঁটু মুড়ে বসে মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে আলাদা আলাদা করে চার দেবতাকে প্রণাম করল। নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলেছে। মনে মনে হয়তো ঈশ্বরের করুণা চেয়ে নিল।
বিনয় উঠে দাঁড়াতেই সিংহাসন থেকে দুচারটে পুজোর ফুল তুলে নিয়ে তার কপালে ঠেকিয়ে পকেটে পুরে দিতে দিতে সুধা বলল, ফেলে দিস না কিন্তু তার বিশ্বাস, পুজোর এই ফুল ভাইয়ের কর্মজীবনকে রক্ষাকবচের মতো নির্বিঘ্ন করবে।
বিনয় মাথা নেড়ে জানায়, ফেলবে না।
সুধা বলল, চল এবার। আনন্দদা অপেক্ষা করছেন।
দুজনে বাইরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
.
২৩.
সুধাদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তায় এসে ঘড়ি দেখল আনন্দ। একটা বাজতে এখনও সাত মিনিট বাকি। চারদিকে বেশ লোকজন আছে। ট্যাং ট্যাং আওয়াজ করে ট্রাম চলছে। চলছে প্রাইভেট বাস। কন্ডাক্টরদের হাঁক কানে আসছে, রাসবিহারী….কালীঘাট……হাজরা…..ভবানীপুর…ধর্মতলা……খালি, গাড়ি, খালি গাড়ি….উঠে আসুন…।
মাসখানেক আগে পাকিস্তান থেকে এই শহরে আসার পর যে-কোনও বড় রাস্তায় পা ফেললে, তা টালিগঞ্জেই তোক কি শিয়ালদা বা শ্যামবাজারেই, কন্ডাক্টরদের একই লজ শুনে আসছে বিনয়। একই ধরনের খ্যানখেনে টানা সুর, একই বলার ভঙ্গি। মনে হয়, কোনও এক স্পেশাল গানের স্কুল থেকে স্বরলিপি রপ্ত করে এই কন্ডাক্টররা সুরটা গলায় তুলে নিয়েছে। অবশ্য বাসের রুট অনুযায়ী লিরিকটা পালটে পালটে যায়। টালিগঞ্জের বাস হলে রাসবিহারী…কালীঘাট….ইত্যাদি। শ্যামবাজারের বাস হলে হাতিবাগান…হেদো….বিবেকানন্দ রোড……কলেজ ইস্টিট…..
শীতের এই দুপুরবেলায় মানুষজন আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের কোনওরকম তাড়া নেই। ট্রাম বাস কি অন্য সব গাড়িটাড়ি চলছে ঢিকিয়ে টিকিয়ে। সবই কেমন যেন অলস। ত্বরাহীন। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে অফিস টাইমের যে ব্যস্ততা ছিল, এখন তার লেশমাত্র চোখে পড়ে না।
রাস্তার একধারে লাইন দিয়ে কটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, চল, একটা ট্যাক্সি নেওয়া যাক—
উঁহু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।
– উঁহু কেন?
রোজ রোজ তো আপনি ট্যাক্সি করে অফিসে পৌঁছে দেবেন না। ট্রামে-বাসে আমাকে যাতায়াত করতে হবে। তাই ধরা যাক। তাছাড়া হাতে যথেষ্ট সময় আছে। আম জনতার গাড়িতে গেলেও দুটোর ভেতর ঠিক পৌঁছে যাব।
আনন্দ হাসল, ঠিক আছে।
ওদের কথাবার্তার মধ্যেই একটা ট্রাম এসে গেল। দুজনে সামনের দিকের ফার্স্ট ক্লাসে উঠে পড়ে। গাড়ি প্রায় ফাঁকাই। জানালার ধারের জোড়া সিটে আনন্দ আর বিনয় পাশাপাশি বসল।
ট্রাম ধীর চালে চলতে থাকে। হিমঋতুর এই দুপুরে বোদ বেশ ঝলমলে, যদিও তেজ কম। শহরের গায়ে সোনালি মলিদার মতো সেটা জড়িয়ে রয়েছে। ট্রাম যত এগুচ্ছে, দুধারের বাড়ি, রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্ট, ডালপালাওলা উঁচু উঁচু গাছ পেছন দিকে সরে সরে যাচ্ছে। অনেক সময় সিনেমার ব্যাক প্রোজেকশনে যেমন দেখা যায়।
খানিকটা চলার পর আনন্দ ডাকল, বিনু
জানালার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। মুখ ফিরিয়ে উৎসুক চোখে তাকালো।
কদিন ধরেই তোমার সম্বন্ধে সুনীতির সঙ্গে আলোচনা করছিলাম।
কী আলোচনা?
বাবার বন্ধু জগদীশবাবুর কাগজের অফিসে তোমার চাকরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাজারে আরও অনেক কাগজ রয়েছে। জগদীশবাবু খুবই আশাবাদী। তার ধারণা তার পেপার বছরখানেকের ভেতর দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু
কী?
এটা ফ্যাক্ট, পশ্চিমবাংলায় মানুষ অনেক বেড়ে গেছে। রিডারশিপও বাড়ছে। কিন্তু খবরের কাগজ পড়াটা হল হ্যাবিট। প্রত্যেকটা কাগজের কম হোক বেশি হোক, কিছু লয়াল পাঠক থাকে। তারা চট করে নতুন কাগজের দিকে ঝুঁকবে না। পিকিউলিয়ার সাইকোলজি। আর নিউ জেনারেশনের যে রিডার বাড়ছে তাদেরও ঝোঁক পুরোনো নামকরা কাগজগুলোর দিকে। পরিচিত কোনও কিছুর বাইরে মানুষ সহজে যেতে চায় না।
বিনয় ধন্দে পড়ে গেল। আপনি কী বলতে চাইছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।
আনন্দ বুঝিয়ে দিল, নতুন একটা কাগজের পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, শুধু থাকাই নয়, সেটা লাভজনক করে তোলা অত্যন্ত কঠিন। জগদীশ গুহঠাকুরতা যদিও যথেষ্ট উদ্যোগী এবং অত্যন্ত বিচক্ষণ শিল্পপতি, শেষ না দেখে ছাড়বেন না, তবু এক বছরের মধ্যে কাগজ কতটা কী করতে পারবে সে সম্বন্ধে সংশয় থেকেই যায়। যত টাকাই থাক, যদি ক্রমাগত লোকসান দিতে হয়, উৎসাহ ঝিমিয়ে পড়তে বাধ্য।
আনন্দ বলতে থাকে, আপাতত যা পাওয়া গেছে সেটাই করো। দুমাস পর আমাদের অফিসে কিছু লোক নেবে। নানা ডিপার্টমেন্টে কম করে বারো চোদ্দ জন জুনিয়র অফিসার দরকার। ছমাস প্রবেশান পিরিয়ড। তারপর পার্মানেন্ট করা হবে। প্রবেশানের সময় মাসে দেবে চার শ করে। পার্মানেন্ট হয়ে গেলে সাড়ে আট শ দিয়ে শুরু। তাছাড়া, অন্য সব বেনিফিট আছে। তোমার বড়দি বলছিল তোমার জন্যে ওখানেই ব্যবস্থা করে দিতে। একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে নেক্সট উইকে আমাকে দিও।
খবরের কাগজে বিনয়ের চাকরি হয়েছে, কিন্তু এ নিয়ে হিরণ আর সুধাও খুব একটা খুশি নয়। বরং বলা যায় বিনয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছে। নতুন কাগজ। কবে আছে, কবে নেই। সুধাদের ইচ্ছা, সরকারি বা নামকরা বড় কোনও কোম্পানিতে ভাইয়ের চাকরি হোক যাতে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকে। হিরণ তাদের অফিসে তো বটেই, আরও দু-একটা অফিসে বিনয়ের দরখাস্ত জমা দিয়ে রেখেছে। সুধাদের মনোভাব অবিকল আনন্দদের মতোই। যত দিন না মনের মতো কিছু একটা জুটছে, খবরের কাগজের কাজটাই চালিয়ে যাক বিনয়। বেকার বসে থেকে লাভ নেই।
বিনয় বলল, ঠিক আছে। অ্যাপ্লিকেশনটা কার নামে দিতে হবে?
আনন্দ বলল, টু দা জেনারেল ম্যানেজার, তার তলায় আমাদের কোম্পানির নাম আর ঠিকানা লিখবে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ভাল কথা, পাকিস্তান থেকে হেমদাদু তোমার ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমিডিয়েট আর গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট ডিগ্রিটিগ্রিগুলোর ডুপ্লিকেট পাঠাতে পেরেছেন?
না। সেই যে একখানা চিঠি লিখেছিলেন তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। তবে কদিন আগে নিত্য দাস ছোটদির বাসায় এসেছিল। বলে গেছে, এক সপ্তাহের ভেতর দাদুর সেকেন্ড চিঠিটা নিয়ে আসবে। সেই চিঠির সঙ্গে পাঠাতে পারেন।
রাজদিয়া থেকে ঝিনুককে নিয়ে রাজেক মাঝির নৌকোয় নদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় মামুদপুরে বিনয়দের মালপত্র লুট হয়ে যায়। বাক্স-পেটরার ভেতর ছিল তার সার্টিফিকেট, ডিগ্রির কাগজপত্র। হানাদাররা বাক্সটাক্সর সঙ্গে সে-সবও নিয়ে গেছে। আত্মীয়-পরিজনেরা এ খবর জানে। আনন্দ খানিক চিন্তা করে বলল, জগদীশবাবু ভাল মানুষ। তার ওপর নিজেই কাগজের মালিক। তিনি ডিগ্রিটিগ্রি না দেখে তোমাকে চাকরি দিলে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু গভর্নমেন্ট অফিসই হোক আর বড় মার্চেন্ট অফিসই হোক, তোমার সার্টিফিকেটগুলো খোয়ানোর কথা হয়তো বিশ্বাস করবে কিন্তু ওগুলো না দেখে চাকরি দেবে না। একটু থেমে বলল, পাকিস্তানে এখন যা অবস্থা, তাড়াতাড়ি ডিগ্রিটিগ্রির নকল পাওয়া অসম্ভব। অন্তত মার্কশিটের ডুপ্লিকেট কিংবা যে স্কুল আর কলেজে পড়েছ সেখানকার হেডমাস্টার আর প্রিন্সিপ্যাল যদি লিখে দেন তুমি ওই সব ইনস্টিটিউশন থেকে পাশ করেছ, তা হলেও আশা করি, কাজ চলে যাবে। আমার ধারণা, রিফিউজি হিসেবে এটুকু কনসিডারেশন তোমার প্রাপ্য।
এ-জাতীয় কথাবার্তা হিরণের সঙ্গে আগেই হয়েছে বিনয়ের। আনন্দের সঙ্গে হয়েছিল কি না, মনে পড়ল না। ডিগ্রিটিগ্রির ডুপ্লিকেট না পাওয়া যাক, হেডমাস্টার এবং প্রিন্সিপ্যালের চিঠি পাওয়া যাবে ধরে নিয়ে হিরণ তার চাকরির জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে।
বিনয় বলল, আপনি যা বললেন, দাদুকে সব জানিয়েছি। এখন দেখা যাক, কী উত্তর আসে।
পাকিস্তান থেকে আসার সময় যে বর্ডার স্লিপ দিয়েছিল সেটা যত্ন করে রেখেছ তো?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
ইন্টারভিউর সময় ওটা লাগবে। তুমি যে জেনুইন রিফিউজি, ওটা তার ডকুমেন্ট।
ট্রাম কালীঘাট, ভবানীপুর, সাকুলার রোড পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছে। এখন বাঁ দিকে আদিগন্ত ময়দান। ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিশাল এক জাদু কার্পেট। দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় পরি নেচে চলেছে অবিরাম। আরও দূরে রেস কোর্সের সাদা গ্যালারি। তার গা ঘেঁষে রাস্তা। ওই রাস্তা ধরেও ট্রাম বাস মোটর চলছে। এধার থেকে সেগুলো খেলনা-গাড়ির মতো মনে হয়। ময়দানের নানা জায়গায় থোকায় থোকায় মানুষ বসে আছে। অনেকে ঘাসে পা ডুবিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চার দঙ্গল ফাঁকা মাঠ পেয়ে উদ্দাম হয়ে উঠেছে। মনের খুশিতে তারা যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও স্থির চিত্র। কোথাও চলমান ছবি।
পাশ থেকে হঠাৎ আনন্দ বলল, জানো বিনু, আমার দিদি আর জামাইবাবু সেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিল। ওদেরও খুব ইচ্ছে, আমার অফিসে তোমার চাকরিটা যেন হয়। আমাকে চাপ দিয়ে গেছে, যেমন করে পারি ওটা করে দিতেই হবে।
বিনয় প্রথমটা হতবাক হয়ে যায়। আনন্দর দিদি জামাইবাবু মানে শিশির এবং স্মৃতিরেখা। ঝুমার মা আর বাবা। তার চাকরির জন্য ওঁরা এত উৎসাহী কেন? নিজের অজান্তে প্রশ্নটা করেই ফেলল সে।
হাসির চিকন একটা রেখা খেলে গেল আনন্দর ঠোঁটে। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, কারণ কিছু একটা আছে।
বিনয় ধন্দে পড়ে যায়। তার চাকরি সম্বন্ধে শিশির এবং স্মৃতিরেখার আগ্রহের পেছনে কীসের একটা সংকেত যেন রয়েছে। ঠিক ধরা যাচ্ছে না। বলল, কী কারণ?
উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল আনন্দ। সামলে নিয়ে বলল, ছেলেবেলা থেকে ওরা তোমাকে দেখছে। তোমার ভীষণ ওয়েল-উইশার। ভাল চাকরি পেলে জীবনে এস্টাব্লিশড হবে, সেটাই ওরা চায়। এই আর কি–।
বিনয় পরিষ্কার টের পায়, আসল উত্তরটা এড়িয়ে গেল আনন্দ। কয়েক পলক আনন্দকে লক্ষ করে সে। স্মৃতিরেখাদের সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন না করে ধীরে ধীরে জানালার বাইরে চোখ ফেরায়।
এসপ্ল্যানেডে এসে ট্রাম থেকে নেমে যে বাসগুলো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে শ্যামবাজারের দিকে যায় তার একটা ধরে যখন বিবেকানন্দ রোডের কাছাকাছি বিনয়রা এসে নামল, দুটো বাজতে তখনও মিনিট সাতেক বাকি।
রাস্তার যে-দিকটায় ওরা নেমেছে তার উলটো দিকে জগদীশবাবুদের কাগজের অফিস। ওপারে যেতে যেতে বিনয়ের চোখে পড়ল মস্ত অফিসের গেটের মাথায় সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে। হলুদের ওপর বড় বড় লাল হরফে লেখা : নতুন ভারত।
বিনয় বলল, সেদিন যখন এসেছিলাম, সাইন বোর্ডটা তো দেখিনি–।
আনন্দ বলল, কেমন করে দেখবে? কী নাম পাওয়া যাবে তখনও তো ঠিক হয়নি। কদিন হল পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সাইন বোর্ড করিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বুঝতে না পেরে বিনয় জিজ্ঞেস করল, নাম পাওয়া যায়নি মানে?
আনন্দ বুঝিয়ে দিল, ইচ্ছামতো পত্রপত্রিকা বার করা যায় না। সেজন্য দিল্লি থেকে সরকারি অনুমতি দরকার। কেননা, নিয়ন্ত্রণ না থাকলে একই নামে হয়তো পাঁচটা কাগজ বেরিয়ে যাবে। তাতে বিরাট সমস্যা। জগদীশবাবু মাস দুতিনেক আগে তার কাগজের জন্য অনেকগুলো নাম পাঠিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত নতুন ভারত নামটার অনুমোদন পাওয়া গেছে।
আনন্দ জিজ্ঞেস করল, কী, নামটা ভাল লেগেছে?
বিনয়ের পছন্দ হয়েছিল। বলল, খুব ভাল।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। নতুন করে সেটা গড়ে তুলতে হবে। এব্যাপারে নিউজ পেপারের একটা বড় বোল রয়েছে। সেদিক থেকে নামটা বেশ সিগনিফিকান্ট।
হঠাৎ বিনয়ের নজরে পড়ল, অফিস বিল্ডিংটার গোটা ছাদ জুড়ে মস্ত প্যান্ডেল খাটানোর তোড়জোড় চলছে। বাঁশের ফ্রেম তৈরি করে আধাআধি তেরপল দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। মজুররা হাঁকডাক করে বাকি অর্ধেক এখন ঢাকছে।
ছাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, ওখানে কী হবে আনন্দদা?
আনন্দ মুখ তুলে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। বেশ অবাক হয়ে বলে, বুঝতে পারছি না। ভেতরে চল। জগদীশবাবুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
কদিন আগে আনন্দর সঙ্গে প্রথম যখন বিনয় এখানে আসে, বাড়িটা ছিল প্রায় নিঝুম। বাইরে থেকে শুধু রোটারি মেশিন চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আজ সেটা তো আছেই, সেই সঙ্গে ভেসে। আসছে অন্য আওয়াজও। বহু মানুষ একসঙ্গে কথা বললে যেমন শোনায় ঠিক তেমনই।
গেটের কাছে এসে দেখা গেল, একজন মাঝবয়সী হিন্দুস্থানী দারোয়ান টান টান দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে খাকি উর্দি, মাথায় পাগড়ি। সেদিন একে দেখা যায়নি। আনন্দ তাকে জিজ্ঞেস করে, জগদীশবাবু। এসেছেন?
লোকটা হেসে বলল, হাঁ সাব। এক বাজে মালিক আ গিয়া—
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, চারদিক সরগরম। সারা অফিসে তুমুল ব্যস্ততা। ছোটাছুটি। একতলার বিশাল হল-ঘরের আধখানা জুড়ে সেদিনই রোটারি মেশিন দেখে গিয়েছিল বিনয়, অন্য দিকটায় বেশ কটা লাইনো মেশিন। মেশিনগুলোর পাশে উঁচু দেওয়াল তুলে নিউজপ্রিন্ট রাখার ব্যবস্থা। বিশাল বিশাল গোলাকার চাকার মতো বিদেশি নিউজপ্রিন্টের রিল উঁই হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে আবার একটা দেওয়াল। ওই দেওয়ালের পর কাতার দিয়ে নতুন সাইকেল। কম করে ষোল সতেরোটা। প্রতিটি সাইকেলের সামনের হ্যাঁন্ডেলের সঙ্গে আটকানো হলুদ রং করা টিনের প্লেটে লাল হরফে লেখা আছে : নতুন ভারত। এতগুলো সাইকেল দিয়ে কী হবে, কে জানে। বিনয় অবাক হলেও এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না।
সেদিন ছাপাখানায় বেশি লোক ছিল না। বড় জোর পাঁচ সাত জন। লাইনো মেশিন চালাচ্ছিল দু-তিনটি কম্পোজিটার। আজ দুজায়গাতেই প্রচুর লোক। সারা এলাকায় ঝড় তুলে রোটারি মেশিন চলছে। ওধারে কম্পোজিটাররা সামনে হাতে-লেখা কপি রেখে দ্রুত বোতাম টিপে টিপে কম্পোজ করে চলেছে।
হল-ঘরটার একধারে সিঁড়ি। আনন্দ আর বিনয় দোতলায় উঠে এল। এখানেও একতলার মত লম্বা হল-ঘর। কাঠ আর কাঁচ দিয়ে গোটা হল জুড়ে অগুনতি খুপরি বানানো হয়েছে। একটা খুপরিও ফাঁকা নেই।
দোতলা থেকে তেতলা। সব ফ্লোরের নকশাই একরকম। এখানে হল-ঘরের অর্ধেক জুড়ে বিশাল নিউজ ডিপার্টমেন্ট। সেটার একধারে নিউজ এডিটর এবং অ্যাসিস্টান্ট এডিটরদের আলাদা আলাদা কামরা। বাকি আধখানা ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ডিরেক্টর, এডিটর, জেনারেল ম্যানেজারদের চেম্বার।
আজ নিউজ ডিপার্টমেন্ট গম গম করছে। দুটো টেলিপ্রিন্টার খট খট আওয়াজ তুলে হিল্লি দিল্লির খবর উগরে দিচ্ছে। ক্লান্তিহীন। অবিরাম।
বিনয়কে সঙ্গে করে আনন্দ নিউজ ডিপার্টমেন্টের উলটো দিকে জগদীশ গুহঠাকুরতার চেম্বারের সামনে চলে এল। পালিশ-করা কাঠের চওড়া দরজার পাল্লায় চকচকে পেতলের প্লেট লাগানো হয়েছে। সেটায় লেখা ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড এডিটর। আগের দিন এই প্লেটটা দেখেনি বিনয়।
সেদিনের সেই বেয়ারাটাই দরজার বাইরে টুলের ওপর বসে ছিল। আনন্দকে সে চেনে। ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার স্যার
প্রতি-নমস্কার হিসেবে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে আনন্দ বলল, তোমাদের সাহেবকে খবর দাও। আমরা ওঁর সঙ্গে দেখা করব।
সাহেবের ঘরে এখন কেউ নেই। একাই আছেন। আপনার ব্যাপারে খবর দিতে হবে না। যান জগদীশ গুহঠাকুরতার সঙ্গে আনন্দর সম্পর্ক কতটা নিবিড়, বেয়ারাটা তা জানে। সে পান্না ঠেলে দরজাটা আধাআধি খুলে দিল।
জগদীশ বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবলের ওপর ঝুঁকে খুব মগ্ন হয়ে কী সব টাইপ-করা কাগজপত্র দেখছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন, ও-আনন্দ। এস এস। বোসো
বিনু মানে বিনয়কে নিয়ে এলাম। বলতে বলতে বসে পড়ল আনন্দ।
সেভাবে বিনয়কে লক্ষ করেননি জগদীশ। এবার তার দৃষ্টি ওর মুখের ওপর স্থির হল। চিনতে একটু সময় লাগল যেন। আনন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সেই শ্যালক না?
হ্যাঁ, জগদীশকাকা–।
বিনয় দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দর কাছে সে শুনেছে, জগদীশ গুহঠাকুরতা একজন বিরাট বিজনেসম্যান। নানা ধরনের কলকারখানার মালিকও। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। এত সব ব্যবসা এবং ইন্ডাস্ট্রি সামলানো কি মুখের কথা! আজ এই সমস্যা। কাল সেই সমস্যা। লেবার ট্রাবল। ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা। ফ্যাক্টরিগুলোতে পোডাকশন বাড়ানোর ছক তৈরি করা। যে-সব বিজনেস লোকসানে চলছে সেগুলো চাঙ্গা করে লাভজনক করার জন্য পরিকল্পনা। তার বিভিন্ন কোম্পানিতে ডিরেক্টররা রয়েছেন। আছেন দক্ষ ম্যানেজাররা। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকেই। ফলে সর্বক্ষণ প্রচণ্ড চাপে থাকেন। বিনয়ের মতো একজন তুচ্ছ, আনকোরা রিপোর্টার কবে তার কাগজে কাজ শুরু করবে, হয়তো খেয়ালই নেই জগদীশের। না-থাকারই কথা।
আনন্দ ফের বলে ওঠে, আজ বিনয়ের এখানে জয়েন করার তারিখ। তাই চলে এলাম।
জগদীশ গুহঠাকুরতার কপালে ভাঁজ পড়ল। আনন্দর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, নো আনন্দ, নো
আনন্দ হকচকিয়ে গেল। জগদীশ কী বলতে চান, সে বুঝতে পারছে না।
জগদীশ থামেননি, ওকে সঙ্গে করে আনা ঠিক হয়নি।
আনন্দ আমতা আমতা করতে থাকে, না, মানে–
ছেলেটিকে স্বাবলম্বী হতে দাও। বলে জগদীশ আবার বিনয়ের দিকে তাকালেন, যে-ডিপার্টমেন্টে তোমার জয়েন করার কথা, সেখানে গিয়ে ডিপার্টমেন্টাল এডিটরের সঙ্গে দেখা কর। তিনি তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবেন। যাও ।
কদিন আগে যে-জগদীশের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল তিনি ছিলেন নরম, স্নেহশীল একজন মানুষ। কিন্তু সেক্রেটারিয়েট টেবলের ওধারে আজ যিনি বসে আছেন তিনি একেবারে আলাদা। আবেগহীন। যান্ত্রিক। আনন্দ বিনয়কে নিয়ে এসে জগদীশকে ধরে তার কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ঠিক আছে। তারপর কেউ তাকে আগলে আগলে রাখুক সেটা তিনি চান না।
এদিকে আনন্দ উঠে দাঁড়িয়েছিল। বিনয়কে বলল, চল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
তর্জনী বাড়িয়ে আনন্দ যে-চেয়ারে বসে ছিল সেটা দেখিয়ে দিলেন জগদীশ। ধমকের সুরে বললেন, সিট ডাউন। আমি ওকে একা গিয়ে দেখা করতে বলছি। একটা কথা মনে রেখ আনন্দ, যখন ইচ্ছে তুমি আমার কাছে আসতে পার, কিন্তু তোমার শ্যালকের ব্যাপারে এখন থেকে কোনও অনুরোধ করবে না। প্রোটেকশন দিয়ে চললে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারবে না। লেট হিম ফেস দা ওয়র্ল্ড।
জগদীশের চেম্বারের বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিনয়। তার মনে পড়ল, আজ তাকে নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিকের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে।
হল-ঘরের ওদিকটায় অর্থাৎ যেখানে সাব-এডিটর, রিপোর্টার, প্রুফ-রিডারদের বসার জায়গা সেখানে একটানা ভনভনে আওয়াজ হচ্ছে। তার সঙ্গে তবলার সঙ্গতের মতো টেলিপ্রিন্টারের অনবরত খটখটানি।
তারাপদ ভৌমিকের কামরাটা বিনয় চেনে। প্রথম যেদিন এখানে আসে, ওই কামরায় তাকে যেতে হয়েছিল। নিউজ ডিপার্টমেন্টের সাংবাদিকদের বসার জন্য টেবলগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে হল-ঘরের এধার থেকে ওধারে যাবার জন্য ফাঁকে ফাঁকে প্যাসেজ রয়েছে।
বিনয় আর দাঁড়াল না। প্যাসেজের ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে তারাপদ ভৌমিকের কামরার সামনে। চলে এল।
.
২৪.
নিউজ এডিটরের কামরার দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ নয়। খানিকটা খোলা রয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, তারাপদ ভৌমিক এদিকে মুখ করে বসে আছেন। তাঁর টেবলের এধারে রয়েছে আরও কয়েকজন। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। পিঠের দিকটা চোখে পড়ছে। বোঝা যায়, ওরা জরুরি কোনও মিটিং করছে। আজ এখানে পা দিয়ে সারা অফিস বিল্ডিং জুড়ে যে তুমুল ব্যস্ততা বিনয় লক্ষ করছে তাতে মনে হয়, নতুন ভারত খুব শিগগিরই বাজারে বেরিয়ে যাবে। সেই ব্যাপারেই হয়তো নিউজ এডিটরের ঘরে আলোচনা চলছে। দ্বিধান্বিতের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে রইল বিনয়। এই অবস্থায় ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে কি না, সে বুঝতে পারছে না।
মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত দরজার খুব কাছে চলে এল বিনয়। কিন্তু এবারও ঢুকতে গিয়ে সেই দ্বিধা। খানিকটা ভয়ও। মিটিংয়ের সময় বিরক্ত করলে নিউজ এডিটর নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন।
তারাপদ ভৌমিক তাঁর কামরায় অন্যদের কী বোঝাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ল বিনয়ের ওপর। হাত নেড়ে বললেন, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এস ।
তারাপদর কামরাটা মাঝারি মাপের। নতুন টেবল, চেয়ার, টেলিফোন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। একধারের দেওয়াল জুড়ে বুক-সমান উঁচু বইয়ের সারি সারি র্যাক। সেখানে নানা ধরনের রেফারেন্সের বই, ইয়ার বুক, ডিকশনারি। সিলিং থেকে ঝুলছে চার ব্লেডওলা ফ্যান। এখন নিশ্চল। এই হিম ঋতুতে সেটা চালানোর প্রশ্নই নেই।
ভেতরে আসতে তারাপদ বললেন, বোসো
বাইরে থেকে বোঝা যায়নি, ঠিক কজন টেবলের এধারে বসে ছিল। এখন দেখা গেল মোট চারজন। ওদের পাশে আরও তিনটে চেয়ার ফাঁকা রয়েছে। তার একটায় বসে পড়ল বিনয়। জড়সড় ভঙ্গি।
তারাপদ বললেন, তোমার জন্যে আমরা ওয়েট করছিলাম। সে যাক। আগে তোমাদের আলাপ করিয়ে দিই।
যারা বসে ছিল তাদের তিনজনের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। একজন পঞ্চাশের কাছাকাছি। বয়স্ক লোকটির একহারা, রোগাটে চেহারা। খুব ফর্সা। মাথায় কাঁচাপাকা ঘন চুল। মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর তার শান্ত চোখে গভীর দৃষ্টি। চোয়াল এবং থুতনির গড়নে বেশ একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে বেরিয়েছে। তবু মনে হয়, তার মধ্যে কোথায় যেন গাঢ় বিষাদ জমা হয়ে আছে। পরনে ধুতি পাঞ্জাবির ওপর গরম কাপড়ের জহর কোট। তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে তারাপদ বললেন, ইনি প্রসাদ লাহিড়ি। আমাদের চিফ রিপোর্টার। কলকাতায় অন্য একটা নামী পত্রিকার নাম করে বলেন, জগদীশবাবু ওঁকে ওই কাগজ থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
অন্য তিনজন হল সুধেন্দু চক্রবর্তী, মণিলাল কর এবং রমেন বিশ্বাস। এরাও রিপোর্টার। প্রসাদ লাহিড়ি আগে যেখানে ছিলেন সুধেন্দু আর মণিলাল সেই কাগজে কাজ করত। প্রসাদের সঙ্গে ওরাও। নতুন ভারত-এ চলে এসেছে।
সুধেন্দু খুব লম্বা। ছফিটের ওপরে হাইট। পেটানো স্বাস্থ্য। লম্বাটে মুখ। রীতিমতো কালো। তার চেহারা যতই জবরদস্ত হোক, চোখ দুটিতে আশ্চর্য এক সারল্য রয়েছে। মনে হয় খুব ভালমানুষ। কোনওরকম ঘোরপ্যাঁচ নেই। পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট এবং শার্টের ওপর পুল-ওভার।
মণিলাল কর তেমন লম্বা নয়। মাঝারি উচ্চতা। তামাটে রং। গোলগাল চেহারা, গোলাকার মুখ। চওড়া কপাল। চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। পরনে ধুতি, ফুল শার্ট আর গরম চাদর।
রমেন বিশ্বাসের খুব সাদামাঠা চেহারা। গড়পড়তা বাঙালির যেমন হয়। বিশেষ করে নজরে পড়ার মতো কিছুই নেই। চোখে গোল চশমা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা সোয়েটার। ঢাকার একটা কাগজে সে কাজ করত। মাস ছয়েক আগে পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। চাকরির জন্য কলকাতার নামকরা কাগজগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরছিল কিন্তু কোথাও ভ্যাকান্সি নেই। যখন পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছে সেই সময় হঠাৎ খবর পায়, জগদীশবাবু নতুন কাগজ বার করতে চলেছেন। সোজা তার সঙ্গে দেখা করে সে চাকরির আর্জি জানায়। রমেনের সঙ্গে কথা বলে জগদীশবাবু খুশি। তারাপদর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেন।
বিনয় সম্পর্কে অন্যদের সবিস্তার জানিয়ে দিলেন তারাপদ। তারপর বিনয়কে বললেন, আপাতত তোমাদের পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের রিপোর্টিং সেকশনের টিম। তুমি মেনলি প্রসাদবাবুর কাছে কাজ করবে। তেমন দরকার হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব। তুমিও ইচ্ছে হলে আমার কাছে চলে আসতে পার।
বিনয় ভাবছিল তার অন্য চার কলিগের কাগজে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সে-ই শুধু আনকোরা। তার মানে নতুন ভারত-এর কর্তৃপক্ষ এবং পাঠকের নজরে পড়তে হলে এইসব ঝানু সাংবাদিকদের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে। ভয় নয়, মানসিক চাপ নয়, টের পেল, এক ধরনের জেদ তার মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে। তারাপদর কথার উত্তরে সে মাথা হেলিয়ে দিল,, আচ্ছা
তারাপদ সুধেন্দু, মণিলাল এবং রমেনকে বললেন, তোমাদের সঙ্গে আগেই কথা হয়ে গেছে। নিজেদের জায়গায় গিয়ে বোসো। প্রসাদবাবু আর বিনয়ের সঙ্গে আমার কিছু ডিসকাশন আছে।
সুধেন্দুরা চলে যাবার পর তারাপদ বললেন, প্রসাদবাবু, আপনাকে সেদিন বলেছিলাম, জগদীশবাবুর খুব ইচ্ছে বিনয়কে বিশেষভাবে কাজে লাগাতে হবে। রিফিউজি প্রবলেম আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলে এখন সব চাইতে মারাত্মক সমস্যা। ও মাসখানেক কি মাসদেড়েক হল ইস্ট পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। পাকিস্তানে হিন্দুরা কী আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, কেন তারা ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে, ও ভাল করেই জানে। কেন না নিজেও ও ভুক্তোভোগী। বিনয়ের এক্সপিরিয়েন্সটা। আমাদের কাজে লাগাতে হবে। একটু থেমে বললেন, রিফিউজিদের সমস্যা, পাকিস্তানে যে লক্ষ লক্ষ মাইনোরিটি কমিউনিটির মানুষ এখনও পড়ে আছে তাদের সমস্যা যদি আমরা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারি, রিডারদের নজর আমাদের কাগজের ওপর এসে পড়বেই। স্পেশালি ইস্ট বেঙ্গলের, উদ্বাস্তুদের।
প্রসাদ সায় দিলেন, জগদীশবাবু ঠিকই বলেছেন। উদ্বাস্তুদের ব্যাপারটা সঠিক ধরতে পারলে আমরা ভাস্ট রিডারশিপ পেয়ে যাব। শুরু থেকে সার্কুলেশন হু হু করে বেড়ে যাবে।
কী?
সব কাগজই রিফিউজিদের নিয়ে কিছু কিছু লিখছে। শিয়ালদায় রোজ ঢাকা, মেল কি খুলনা মেলে যে উদ্বাস্তুরা আসছে তাদের সম্বন্ধে খবর টবর জোগাড় করে আর রাইটার্সে রিফিউজি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের মিনিস্টার আর সেক্রেটারির ইন্টারভিউ নিয়ে ছাপছে। এ-সব তো আছেই। আমার মনে হয়, আলাদাভাবে স্পেশাল কিছু করা দরকার। এ নিয়ে আপনি কিছু ভেবেছেন?
হ্যাঁ। তারাপদ ভৌমিক বিশদভাবে জানালেন, কলকাতার আশেপাশে এবং পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অগুনতি মিলিটারি ব্যারাক বানানো হয়েছিল। যুদ্ধের পর ব্রিটিশ আর আমেরিকান টমিরা জাহাজ আর প্লেন বোঝাই হয়ে দেশে ফিরে যায়। তাদের ছেড়ে যাওয়া খালি ব্যারাকগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, রোজই তো সীমান্তের এপারে মানুষের ঢল নামছে। নতুন নতুন ত্রাণশিবির বসিয়ে তাদের রাখা হচ্ছে। শুধু তাই না, ফাঁকা মাঠ, জলা নিচু জায়গা, বনজঙ্গল যা পাচ্ছে সেখানে বসে পড়ছে উদ্বাস্তুরা। গড়ে তুলছে জবরদখল কলোনি। এইসব কলোনি সংখ্যায়, যে কত, তার লেখাজোখা নেই।
তারাপদ বলতে লাগলেন, অন্য কাগজগুলো সরকারি ক্যাম্পের, মিলিটারি ব্যারাকের আর জবরদখল কলোনির রিফিউজিদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই লিখছে না। উদ্বাস্তুদের ওপর আমরা জোর দেব। বিনয় প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে কলোনি বা ক্যাম্পে গিয়ে সেখানকার মানুষজন কীভাবে আছে, কী তাদের সমস্যা, সব ডিটেলে জেনে বড় একটা লেখা লিখবে। ওর সঙ্গে ফোটোগ্রাফার যাবে। লেখার সঙ্গে কলোনি টলোনির বাসিন্দাদের ছবিও ছাপা হবে।
প্রসাদ প্রায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ভেরি গুড আইডিয়া
আরও একটা কথা ভেবেছি।
কী?
যে-সব গ্রাম ছেড়ে মানুষ চলে আসছে ফি উইকে সেইরকম দুটো গ্রামের ওপর রিপোর্টাজও লিখতে হবে বিনয়কে। লেখাটার নামও আমি ঠিক করে রেখেছি। আমার দেশ, আমার গ্রাম। অবশ্য এর চেয়ে বেটার কিছু পাওয়া গেলে সেটাই দেওয়া হবে। আপনারাও ভাবুন।
প্রসাদের মনে সামান্য সংশয় দেখা দেয়। তিনি জিজ্ঞেস করেন, লেখার মেটিরিয়াল পাবে কী করে?
তারাপদ বললেন, যে-সব গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে মানুষ আসছে তাদের জিজ্ঞেস করে। ওদের গ্রামের ফোটো অবশ্য পাওয়া যাবে না। আর্টিস্টকে দিয়ে স্কেচ আঁকিয়ে নিতে হবে।
খুব মগ্ন হয়ে তারাপদ আর প্রসাদের কথা শুনছিল বিনয়। ভয়ে ভয়ে বলল, আমি একটা কথা বলব?
তারাপদ বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
বিনয় জানালো, রোজ যারা ওপার থেকে আসছে, পথে তাদের কী ধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আতঙ্কজনক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে কীভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে তারা ইন্ডিয়ায় আসতে পেরেছে, আবার অনেকে পারেনি, রাস্তায় তাদের শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে–সপ্তাহে তেমন দু-চারজনকে নিয়ে যদি লেখা যায়, উদ্বাস্তুদের নিদারুণ অসহায়তা সম্বন্ধে পাঠকের পরিষ্কার একটা ধারণা হতে পারে।
একসেলেন্ট তারাপদ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, গোয়ালন্দ থেকে আসার সময় ট্রেনে একজন বৃদ্ধ মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর কথা লিখে আমাকে দেখিয়েছিলে। পড়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল। হৃদয়কে টাচ করে এমন লেখা খুবই জরুরি।
তারাপদ ভৌমিক মানুষটি যে যথেষ্ট আবেগপ্রবণ, আগেই জেনেছে বিনয়। খুবই উদার। আর সেই লেখাটা পড়ে ঢালাও প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দর সুপারিশে নতুন ভারত-এ তার চাকরি হতোই। সে আনন্দর শ্যালক এবং উদ্বাস্তু। করুণাবশত কোনও একটা ডিপার্টমেন্টে হেলাফেলা করে তাকে হয়তো বসিয়ে দিতেন জগদীশ। কিন্তু তারাপদর অঢেল বাহবায় বার্তা বিভাগে সসম্মানে সে কাজটা পেয়েছে। তারাপদর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার।
উৎসুক সুরে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, কোন মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর কথা লিখেছে বিনয়?
রামরতন গাঙ্গুলির কথা বললেন তারাপদ।
প্রসাদ ভীষণ উৎসাহিত। বললেন, এই ধরনের হিউম্যান স্টোরি পেলে কাগজের উপকার হবে। কিন্তু
কী?
শিয়ালদা স্টেশন, রিফিউজি ক্যাম্প, কলোনি, এত কিছু সামলে বিনয় কি এ-সব লিখতে পারবে? ওর ওপর ট্রিমেন্ডাস প্রেসার পড়ে যাবে।
তারাপদ বললেন, ইয়াং ম্যান। এই তো খাটার বয়েস। আমার মনে হয়, পারবে। চ্যালেঞ্জটা নিক না– একটু থেমে ফের মনে করিয়ে দিলেন, জগদীশবাবুর ইচ্ছে, রিফিউজিদের ব্যাপারে বিনয়কে ভালভাবে কাজে লাগানো হোক। কথা হয়ে গেল। বিনয়কে নিয়ে আপনার সেকশানে যান। খুব তাড়াতাড়ি রিপোর্টারদের কার্ডগুলো কিন্তু করিয়ে দিতে হবে।
আজই ওদের ফোটো তোলার ব্যবস্থা করছি। দুতিন দিনের ভেতর কার্ডগুলো হয়ে যাবে?
কীসের কার্ড, কেন রিপোর্টারদের ফোটো তোলা হবে, কিছুই বুঝতে পারল না বিনয়। তবে এ নিয়ে তার কৌতূহল হলেও কোনও প্রশ্ন করল না।
প্রসাদ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বিনয়কেও তার সঙ্গে যেতে হবে। সেও উঠে পড়ল।
.
নিউজ ডিপার্টমেন্টের বাঁদিকে খানিকটা জায়গা নিয়ে রিপোর্টারদের বসার ব্যবস্থা। চিফ রিপোর্টারের জন্য বেশ বড় টেবল। সামনে অনেকগুলো চেয়ার। অন্যদের টেবলগুলো তুলনায় ছোট। সেখানে এসে দেখা গেল রমেন বিশ্বাস, সুধেন্দু চক্রবর্তী আর মণিলাল কর চিফ রিপোর্টারের টেবলের এধারে বসে কথা বলছে। প্রসাদকে দেখে তারা সবাই উঠে দাঁড়াল।
প্রসাদ সবাইকে বসতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। বিনয় সুধেন্দুদের পাশে বসে পড়ল।
প্রসাদ বললেন, তোমরা কি লক্ষ করেছ, কলকাতার রাস্তায় আমাদের কাগজের পোস্টার পড়েছে।
বিনয় খেয়াল করেনি। তবে সুধেন্দুরা দেখেছে। তারা জানালো, হ্যাঁ। নতুন ভারত শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে।
কাল থেকে কলকাতার সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরুবে।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কাগজ বেরবার ডেট ঠিক হয়েছে?
প্রসাদ বললেন, আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন পর বেরুবে। ছাদে ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে দেখেছ কি?
অফিসে ঢোকার সময় ছাদে মজুরদের কাজ করতে দেখেছিল বিনয়। তারপর জগদীশ গুহঠাকুরতার চেম্বার হয়ে তারাপদ ভৌমিকের কামরায় এসে নানা কথায় প্যান্ডেলের ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে উৎসুক হয়ে উঠল, হা হা, দেখেছি। কী হবে ওখানে?
প্রসাদ জানালেন, নতুন ভারত পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষে বড় একটা অনুষ্ঠান করা হবে। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। নামকরা বিজনেসম্যান, শিল্পপতি, শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক, চলচ্চিত্র পরিচালক, রাজনৈতিক নেতা, বিখ্যাত খেলোয়াড়, অভিনেতা বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জগদীশ গুহঠাকুরতা খুবই প্রভাবশালী। তার বিপুল প্রতিপত্তি। তিনি ডাকলে কেউ না বলতে পারবেন না। সবাই চলে আসবেন।
রাজদিয়ায় থাকতে বিধানচন্দ্রের নাম বহুবার শুনেছে বিনয়। ডাক্তার হিসেবে তিনি লিজেন্ডের নায়ক। ভারতবর্ষের সেরা ধন্বন্তরি। মৃত্যু অবধারিত, এমন কত রোগীকে যে তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছেন তার হিসেব নেই। বিধানচন্দ্র যে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সেটা অনেক আগেই জেনেছে বিনয়। তাকে তো বটেই, প্রসাদ অন্য যে-সব খ্যাতিমান মানুষদের নাম করলেন তাঁদেরও দেখা যাবে। ভাবতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।
প্রসাদ এবার বললেন, সুধেন্দুরা নিউজ পেপারে চাকরি করেছে। ওরা জানে কাগজে তিন শিফটে কাজ চলে। মর্নিং, ডে আর নাইট। সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত একটা শিফট। দুটো থেকে রাত দশটা অবধি একটা শিফট। রাত দশটা থেকে ভোর পর্যন্ত আর-একটা শিফট। বিনয়, তুমি বোধহয় এই ব্যাপারটা জানো না?
বিনয় বলল, না। আমার তো এই প্রথম চাকরি
মাসে এক উইক করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাদের নাইট ডিউটি দেওয়া হবে। তখন কিন্তু বাড়ি যেতে পারবে না।
বিনয় এতকাল জেনে এসেছে, চাকরি মানেই দশটা থেকে পাঁচটা। খবরের কাগজের নিয়ম যে আলাদা, এই প্রথম শুনল। বলল, আচ্ছা–
রাতে খুব একটা এমার্জেন্সি না হলে বারোটা সাড়ে বারোটার ভেতর কাজ শেষ হয়ে যায়। অফিসে বিছানা আছে। বাকি রাতটা ঘুমোত পারবে।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিনয় বাদে বাকি তিনজনকে বললেন, নেক্সট উইক থেকে কে কোন শিফটে কাজ করবে, কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে, সব ঠিক করে দেব। এই উইকে তেমন প্রেসার নেই। তোমরা বেলা দেড়টা দুটোয় এস। রাতে আটটা নটায় চলে যেও। এখন সাব-এডিটর নিউজ ট্রানস্লেশন করে দিচ্ছে। তাছাড়া এটা সেটা দিয়ে পাতা মেক-আপ করে মেশিনের ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে। পরের সপ্তাহ থেকে পুরোদস্তুর কাজ শুরু হবে। রাইটার্স, পলিটিক্যাল পার্টির অফিস, হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটি, লালবাজার–সব জায়গার রিপোর্ট চাই। খবরের কাগজে যা যা থাকে, সমস্ত দিয়ে পাতা সাজানো হবে। বিনয়কে বললেন, তোমাকে কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়ে গেছে। নেক্সট উইকের জন্যে তোমাকে ওয়েট করলে চলবে না। দু-চার দিনের ভেতর রিফিউজি কলোনি, আর রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে যেতে শুরু কর। কাগজ বাজারে বেরুবার আগে যতগুলো লেখা সম্ভব, তৈরি করে ফেল। ওগুলো জমা করে রাখা হবে। যেদিন কাগজ বেরুবে সেদিন থেকে ছাপতে শুরু করব।
বিনয় মাথা হেলিয়ে বলল, আচ্ছা
প্রসাদ বললেন, তুমি তো সবে ইস্ট পাকিস্তান থেকে এসেছ। কোথায় কোথায় রিলিফ ক্যাম্প আর জবরদখল কলোনি বসেছে, জানো কি?
বিনয় জানালো, আগরপাড়া থেকে তিন মাইল দূরে যুগলদের মুকুন্দপুর কলোনি ছাড়া অন্য কোনও কলোনি সে দেখেনি। তবে শুনেছে, যাদবপুর বাঁশদ্রোণী গড়িয়া অঞ্চলে অনেক জবরদখল উপনিবেশ তৈরি হয়েছে। রিলিফ ক্যাম্পগুলো সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না। ভাসা ভাসা ধারণা আছে মাত্র।
একটু চিন্তা করে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি থাকো কোথায়?
বিনয় বলল, টালিগঞ্জে, জাফর শা রোডে
একটা কাজ করতে পারবে?
বলুন
হরিশ মুখার্জি রোড চেনো? ভবানীপুরে পূর্ণ সিনেমার পেছন দিকটায়– ।
চকিতে মনে পড়ে গেল বিনয়ের। এই তো সেদিন হিরণদের সঙ্গে ঝিনুক আর সে ওখানকার হরিশ পার্কে জলসা শুনতে গিয়েছিল। জগন্ময় হেমন্ত শচীনদেব–কুড়ি পঁচিশ ফিট দূরে বসে স্বপ্নের এইসব শিল্পীদের নিজের চোখে দেখে, তাদের গান শুনে ঝিনুক অভিভূত। জলসা শেষ হলে বাড়ি ফিরে বালিকার মতো তার কী উচ্ছ্বাস! কত হইচই! অফুরান খুশির প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল মেয়েটা। ঝিনুকের মুখ মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা চাপা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে বিনয়ের। নিচু গলায় বলল, চিনি–
প্রসাদ বললেন, ভালই হল। ওখানে হরিশ পার্কের উলটোদিকে একটা রাস্তা আছে। মহেশ হালদার লেন। ওই রাস্তার তেইশ নম্বর বাড়িটা হল মেসবাড়ি। নাম শান্তিনিবাস। আমি সেখানে থাকি। কাল সকাল সাড়ে-আটটা নটা নাগাদ একবার আমার মেসে আসতে পারবে?
মেস ব্যাপারটা বিনয়ের জানা। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের কর্মচারী, ছোটখাটো ব্যবসায়ী, ইন্সিওরেন্স কোম্পানির দালাল–এমনি নানা ধরনের মানুষ, কলকাতায় যাদের ফ্যামিলি থাকে না, মেস হল তাদের অস্থায়ী আস্তানা। কলকাতার কাছাকাছি যাদের পৈতৃক বাড়ি তারা শনিবার হাফ-ডের পর চলে যায়, ফেরে সোমবার। আর যাদের বাড়ি দূরে, বড় ছুটি না পড়লে তাদের যাওয়া হয় না। কেন না দেড় দিনের মধ্যে কাজের জায়গায় ফিরে আসা সম্ভব নয়। বিনয় জানে, দেশভাগের আগে পূর্ব বাংলার বহু মানুষ কলকাতার মেসে সারা বছর পড়ে থাকত। পুজোর লম্বা ছুটিতে তারা দেশে স্বজন-পরিজনের কাছে চলে যেত। রাজদিয়ার এমন অনেককেই সে দেখেছে।
বিনয় একটু ধন্দে পড়ে গেল। প্রসাদ কেন তাকে তার মেসে যেতে বললেন, বোঝা যাচ্ছে না। এ নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। শুধু বলল, পারব।
প্রসাদ ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন, আমার কাছে অনেকগুলো জবরদখল কলোনি আর ক্যাম্পের ঠিকানা লেখা আছে। লিস্টটা রয়েছে আমার মেসে। তুমি এলে সেগুলো দিয়ে দেব। তোমার কাজের সুবিধে হবে। বলেই কী ভেবে ব্যস্তভাবে জানালেন, না না, সকালে কষ্ট করে আসার দরকার নেই। কাল দুপুরে অফিসে তো আসছই। আমি লিস্টটা নিয়ে আসব। তখন দিয়ে দেব।
যদিও মাথার উপরে তারাপদ ভৌমিক আছেন কিন্তু সরাসরি কাজটা তাকে করতে হবে প্রসাদের অধীনে। তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা খুবই জরুরি। পরে না বললেও তিনি নিশ্চয়ই চান বিনয় তার মেসে যাক।
অফিসের পরিবেশ একরকম। সেখানে নানা ব্যস্ততার মধ্যে কারওকেই পুরোপুরি বোঝা যায় না। কিন্তু মেসে গেলে খোলামেলা আবহাওয়ায়, চাপমুক্ত অবস্থায় জানা যাবে প্রসাদ লাহিড়ি মানুষটা কী ধরনের, তার মেজাজ কেমন, ইত্যাদি। বিনয় বলল, আমার একটুও কষ্ট হবে না। সকালে তো কোথাও কাজ নেই। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকা। ট্রাম-বাস কিছু একটা ধরে চলে যাব।
প্রসাদের হয়তো মনে হল, কাজ শুরু করার জন্য উৎসাহে টগবগ করছে ছেলেটা। কম বয়স। উদ্যম বেশি। একটু হাসলেন তিনি, ঠিক আছে, এস। এবার তোমাদের ফোটো তোলার ব্যবস্থা করি। বলেই একটা মাঝবয়সী বেয়ারাকে ডেকে বললেন, অধীরকে ক্যামেরা নিয়ে এক্ষুনি আমার এখানে আসতে বল। দেরি যেন না করে।
বেয়ারা চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পর একটি যুবক প্রসাদ লাহিড়ির টেবলের পাশে এসে দাঁড়াল। বয়স কুড়ি একুশ। ছিপছিপে চেহারা। শ্যামবর্ণ। লম্বা ধাঁচের মুখে পাতলা, নরম দাড়ি। মাথাভর্তি এলোমেলো জংলা চুল প্রায় কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। বহুকাল ওগুলোতে তেল পড়েনি। বোধহয় নিয়মিত আঁচড়ায়ও না। সব চেয়ে আশ্চর্য ওর চোখ। সারাক্ষণ যেন সে-দুটো স্বপ্ন দেখছে। পোশাক-আশাকের দিকে নজর নেই। পরনে দলামোচড়া আধময়লা ফুল প্যান্ট আর শার্টের ওপর মোটা উলের পুল-ওভার। কাঁধ থেকে একটা ঢাউস ক্যামেরা ঝুলছে।
বোঝাই যায় ছেলেটি অধীর। নতুন ভারত-এর ফোটোগ্রাফার সে। বিনয়দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে প্রসাদ তাকে বললেন, এদের পাসপোর্ট সাইজের ফোটো চাই। এখনই তুলে নাও। কাল ডেভলাপ করে দেবে। প্রত্যেকটা ফোটো দুকপি করে।
অধীর ঘাড় কাত করে বলল, আচ্ছা—
একটু দূরে, রিপোর্টিং সেকশানের এক কোণে বিনয়দের নিয়ে গিয়ে লেন্স ঠিকঠাক করে চারজনের ছবি তুলে ফেলল অধীর।
পনেরো মিনিটের ভেতর কাজ শেষ। তারপর বিনয়রা প্রসাদ লাহিড়ির কাছে ফিরে আসে। অধীর হল-ঘর পেরিয়ে নিউজ ডিপার্টমেন্টের অন্য প্রান্তে চলে গেল।
সুধেন্দু বলল, প্রসাদদা, আজ এখানে জয়েন করলাম কিন্তু প্রথম দিন অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছেন না। চুপচাপ বসে থাকার মানে হয়? সে আর মণিলাল নতুন ভারত-এ আসার আগে অন্য একটা কাগজে প্রসাদের সহকর্মী ছিল। অনেক দিনের সম্পর্ক। তাই ওভাবে বলতে পারল।
সুধেন্দু যা বলল, হুবহু তাই ভাবছিল বিনয়। অফিসে এসে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে তারও ভাল লাগবে না। কিন্তু প্রসাদ তার ডিপার্টমেন্টের ইন-চার্জ। আজই পরিচয় হয়েছে। তার পক্ষে সুধেন্দুর মতো করে বলা সম্ভব নয়।
খানিক চিন্তা করে প্রসাদ বললেন, ঠিক আছে, তোমরা দোতলায় লাইব্রেরিতে চলে যাও। ওখানে ইন্ডিয়ার অন্য সব শহরের নামকরা ইংলিশ ডেইলি আর নিউজ ম্যাগাজিন রয়েছে। সেগুলো উলটে পালটে দেখ ইন্টারেস্টিং কিছু পাও কি না। তার বেসিসে প্রত্যেকে একটা করে রাইট-আপ তৈরি কর। রোজই তো ট্রায়াল দেবার জন্যে কাগজ ছাপা হচ্ছে। তোমাদের লেখাগুলো কম্পোজ করে পাতায় বসিয়ে দেওয়া হবে। যখন রেগুলারলি কাগজ বেরুতে শুরু করবে তখন যদি দেখা যায়, ওই লেখাগুলোর টপিক পুরোনো হয়ে যায়নি, ফের ছাপা যেতে পারে।
খবরের কাগজের কাজের পদ্ধতি সম্বন্ধে বিনয়ের ধারণা পরিষ্কার নয়। তবে নতুন ভারত এ চাকরি পাবার পর থেকে সারাক্ষণ নিজের মধ্যে একটা চনমনে ভাব টের পাচ্ছে। তার লেখা ছাপার হরফে বেরুবে। হাজার হাজার মানুষ সে-সব পড়বে। কম উত্তেজনা? প্রসাদ একটা লেখার কাজ দেওয়াতে সে খুশি হল। আজকের লেখাটা কাগজে ছাপা হবে ঠিকই, কিন্তু বাইরের লোক জানতে পারবে না। না জানুক, তবু তো ছাপা হবে। বিনয় ভাবল, খুব যত্ন করে লেখাটা লিখবে। রামরতন গাঙ্গুলির মৃত্যুর বিবরণ পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন তারাপদ। আজ এমন কিছু লিখবে যাতে প্রসাদ সন্তুষ্ট হন। প্রথম দিন থেকেই সে চিফ রিপোর্টারের নজরে পড়তে চায়।
সুধেন্দুদের সঙ্গে দোতলায় নেমে এল বিনয়। চারদিক সরগরম। কাঠ আর কাঁচ দিয়ে বানানো কুঠুরিগুলোতে যারা কাজ করছিল তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করে লাইব্রেরির হদিস পাওয়া গেল।
ডানদিকের শেষ প্রান্তে একটা চওড়া দরজার মাথায় পেতলের প্লেটে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা : লাইব্রেরি।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, কামরাটা বিশাল। কম করে তিন শ স্কোয়ার ফিট। দেওয়াল ঘেঁষে উঁচু উঁচু কাঁচের আলমারি বোঝাই নানা ধরনের বই। অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সিনেমা, স্পোর্টস–এমনি কত যে বিষয়। আছে এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে শুরু করে ইয়ার বুক, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঘরের মাঝখানে মস্ত লম্বা টেবলের দুপাশে পাঁচটা করে চেয়ার। একসঙ্গে দশজন বসে পড়তে পারে। কিন্তু কামরাটা একেবারে ফাঁকা।
কোথায় চালু খবরের কাগজগুলোর কপি রয়েছে, কে জানে। বিনয়রা যখন এধারে ওধারে তাকাচ্ছে, আচমকা কেউ বলে উঠল, এই যে এদিকে শ্লেষ্ম জড়ানো নাকি সুর। সর্দি হলে কিংবা অতিরিক্ত নস্যি টানলে যেমনটা শোনায়।
এবার দেখা গেল, ডানদিকের শেষ মাথায় একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসে আছেন। তার সামনে বড় টেবল। টেবলের এপাশে দুটো চেয়ার।
বিনয়রা এগিয়ে গেল। ভদ্রলোকের রং ধবধবে ফর্সা। চেহারা গোলগাল, নাড়ুগোপাল মার্কা। ভীষণ শীতকাতুরে। পরনে ধুতি এবং পাঞ্জাবির ওপর সোয়েটার। তার ওপর চাদর। গলায় মাফলার জড়ানো। ঠাণ্ডা যাতে না লাগে সেজন্য নিজেকে দুর্ভেদ্য করে রেখেছেন। হাতে ঢাউস একটা বই। খুব সম্ভব সেটা পড়ছিলেন।
বইটা টেবলে নামিয়ে রেখে ভদ্রলোক বললেন, আগে তো চাঁদবদনদের দেখিনি। নতুন ভারত এ নতুন আমদানি বুঝি! তার বলার ভঙ্গিতে একটা মজাদার ব্যাপার আছে।
সুধেন্দু বলল, হ্যাঁ। আজই আমরা জয়েন করেছি। দিল্লি বম্বের ইংরেজি ল্যাংগুয়েজের কাগজগুলোর লাস্ট মাস্থের সব কপি দেখতে চাই। দয়া করে
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, হবে হবে, সব হবে। আগে একটু গা-শোঁকাকি হোক। বিনয়দের পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করলেন, হাঁটুর বয়িসি সব ছেলে। তোমাদের কিন্তু তুমি করে বলছি—
লোকটাকে বেশ ভাল লেগে গেল বিনয়ের। গা-শোঁকাকি শুনে আন্দাজ করে নিল আলাপ পরিচয় করতে চাইছেন।
এদিকে সুধেন্দু বলে উঠেছে, তুমি করেই তো বলবেন।
আমার সামনে মোটে দুখানা চেয়ার। তোমরা চারজন। ওখেন থেকে আর দুখানা টেনে এনে বোসো দিকিন। বলে ভদ্রলোক ঘরের মাঝখানের মস্ত পড়ার টেবলটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।
বিনয়রা চেয়ার এনে ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসে পড়ল। তিনি এবার বললেন, প্রথমে নিজের কথা বলি। আমার নাম রামগোপাল দত্ত। আমরা দত্তরা কোলকেতার খাস বাসিন্দে। কত জেনারেশন ধরে এখেনে আচি, হিসেব নেই। দেড়শ বছর আগে আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, নাকি তারও ঠাকুরদা এই শহরে এসে শেকড় গেড়েছিল। আমার গায়ে নাক ঠেকালে সেকেলে কোলকেতার গন্ধ পাবে। সে যাক গে, আমি দত্ত বংশের কুলাঙ্গার। আমার বাপ-ঠাকুরদারা টাকা ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝত না। ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা কামিয়ে গেছে। আমি আবার বই ছাড়া কিছু বুঝি না। পৃথিবীতে কত জানবার আচে। বই ছাড়া জানব কী করে? বি এ পাস করার পর বনের মোষ তাড়ানো শুরু করলাম। মানে একটা বড় পাবলিক লাইব্রেরি চালাতাম। নতুন ভারত-এর মালিক জগদীশবাবুর সঙ্গে একটু আধটু জানাশোনা ছিল। তিনি হিড়হিড় করে টেনে এনে এখানে জুড়ে দিলেন। বললেন, ভাল একটা লাইব্রেরি করতে হবে। লাইব্রেরি ছাড়া কাগজ চলে না। জার্নালিস্টরা যে লিখবে, তার জন্যে নানা রেফারেন্সের বই দরকার। ভুল বেরুলে কাগজের বদনাম হয়ে যাবে। রিডার নতুন ভারত চিমটে দিয়েও ছুঁয়ে দেখবে না। মনের মতন কাজ পেয়ে চান-খাওয়া শিকেয় তুলে দুমাসে এই লাইব্রেরি খাড়া করেছি। এখনও অনেক কাজ বাকি। আরও বইটই কিনতে হবে। বলে পকেট থেকে একটা নস্যির কৌটো বার করে বড় এক টিপ নস্যি নিয়ে নাকে পুরলেন। তারপর ঝিম মেরে চোখ বুজে বসে রইলেন। নস্যির ঝঝটা মস্তিষ্কে চারিয়ে যাচ্ছে। সেটা তিনি বেশ উপভোগ করছেন।
বিনয় যা আঁচ করেছিল সেটা মিলে গেল। তাদের লাইব্রেরিয়ানের নস্যির নেশা আছে।
কিছুক্ষণ বাদে চোখ মেলে পটকা ফাটার মতো আওয়াজ করে নাক ঝেড়ে রুমালে মুছে নিলেন। রামগোপাল। তারপর বললেন, আমার সম্বন্ধে পরে আরও জানতে পারবে। এবার তোমাদের ঠিকুজি শোনা যাক। নামগুলো বল
সুধেন্দুরা তাদের নাম জানিয়ে দিল।
কে কোন ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলে?
রিপোর্টিংয়ে–
সব্বাই?
হ্যাঁ।
আগে কোনও কাগজে কাজ করতে?
সুধেন্দু জানালো, সে মণিলাল আর রমেন অন্য দৈনিকে সাত-আট বছর কাজ করেছে। তবে বিনয়ের এটাই প্রথম চাকরি।
রামগোপাল সস্নেহে বিনয়ের দিকে তাকালেন, তুমি তাহলে এই গোয়ালের একমাত্তর কচি বাছুর। আর সব্বাই ঝানু মাল
রামগোপালের কথাবার্তা, স্বরক্ষেপণ, মুখচোখের ভাব–সবই নাটকের কমেডিয়ানের মতো। বিনয় হেসে ফেলল, তা বলতে পারেন।
এবার রামগোপাল মণিলালের দিকে তর্জনী তুলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার মতন কোলকেতার পুরনো তেলাপোকা, না বাইরে থেকে এসে জুটেচ?
মণিলাল বলল, আমাদের বাড়ি হাওড়ায়—
কাছেই। ঘটি। রামগোপালের তর্জনী সুধেন্দুর দিকে ঘুরে গেল, তোমার দেশ ছিল কোতায়?
যশোর ডিস্ট্রিক্টে। এখন ইস্ট পাকিস্তান
তুমি তাহলে হাফ বাঙাল?
বুঝতে না পেরে সুধেন্দু বলল, হাফ বাঙাল মানে?
পদ্মার ওপারের মালগুলো হল রিয়েল বাঙাল। তোমরা না ইস্ট বেঙ্গলের, না ওয়েস্ট বেঙ্গলের। মাজখানে ঝুলে আছো।
দিনির্ণয় যন্ত্রের কাটার মতো রামগোপালের আঙুল রমেনের দিকে ঘুরল, তোমার দেশ?
রমেন বলল, ঢাকায়। ঢাকা সিটিতেই আমরা কয়েক পুরুষ আছিলাম। পার্টিশানের পর কইলকাতায় চইলে আসি। তার গলায় পূর্ব বাংলার টান। কলকাতার ভাষাটা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি ঠিকমতো। ঢাকাই ডায়লেক্টের ভেজাল মিশে অদ্ভুত শোনায়।
রামগোপাল কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলে বলে উঠলেন, অ্যাই–অ্যাই হল আসল বাঙাল। এখনও জিভের আড় ভাঙেনি। হাঁ করেচে, অমনি পদ্মার ওপারের গন্ধ বেরুচ্চে ভুর ভুর করে।
এরপর বিনয়ের পালা। তোমার কোথায় হে?
খুব ছেলেবেলার কয়েকটা বছর বাদ দিলে বিনয়ের জীবনের সেরা সময়টাই কেটেছে রাজদিয়ায়। রাজদিয়ার খাল-বিল-নদী, অবারিত ধানের খেত, অফুরান আকাশ, পাখিতে পাখিতে ছয়লাপ মহাশূন্য–এ-সবের মধ্যেই তার বড় হয়ে ওঠা। পূর্ব বাংলার সেই ছোট্ট ভূখণ্ডটিই তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। রাজদিয়াকেই সে নিজের দেশ মনে করে। বলল, আমার বাড়িও ঢাকায়। তবে ঢাকা সিটিতে নয়। সেখান থেকে অনেকটা দুরে, ছোট একটা মফস্বল টাউনে।
তুমিও বাঙাল! কপালে একটা চাপড় মেরে রামগোপাল বলে উঠলেন, বাঙালে বাঙালে কোলকেতাটা একেবারে ছেয়ে গেল! ছ্যা ছ্যা। যেখনেই যাবে সেখেনেই বাঙাল!
রামগোপালের কথাগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ বা ঘৃণা রয়েছে, তা মনে হয় না। বরং এমন একটা লঘু মজার ব্যাপার রয়েছে যে বিনয়রা হেসে ফেলল।
রামগোপাল ফের বললেন, যেভাবে তোমরা ওপার থেকে এসে পঙ্গপালের মতো কোলকেতাটাকে হেঁকে ধরেচ, আমাদের ঘটিদের ন্যাজ গুটিয়ে পালাতে হবে দেকছি।
স্রেফ রগড়। বিনয়রা হাসতেই থাকে।
রামগোপাল থামেননি, তবে হ্যাঁ, একটা কথা মানতেই হবে। তোমাদের হেঁকোড় আচে। ওয়েস্ট বেঙ্গল যদি পাকিস্তানে পড়ত, আমরা যে কী করতুম, ভাবলে ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয়।
একটু চুপচাপ।
তারপর রামগোপাল নতুন উদ্যমে শুরু করলেন, রিফুজিরা বনজঙ্গল সাবাড় করে কলোনি হাসাচ্চে, হকারি কোরচে, দোকানপাট খুলচে, যারা লেখাপড়া জানে তারা চাকরি বাকরি জোটাচ্চে। বাঙাল মেয়েগুনোও তাক লাগিয়ে দিলে। মদ্দদের সঙ্গে তারাও কাজকম্মো জোগাড় করে পয়সা রোজগারে নেমে পড়েছে। সিধে কথা, বাঁচতে হবে। আমরা হলে পরতুম না গো। স্রেফ কেতরে পড়তুম। আবার বলচি, তোমাদের হেঁকোড় আচে।
হেঁকোড় কথাটার মানে কী? ক্ষমতা? সাহস? উদ্যম? পরিষ্কার বোঝা না গেলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে ওইরকম একটা কিছু। রামগোপালের সঙ্গে যেটুকু আলাপ হয়েছে তাতে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু শব্দ শেখা গেল যা আগে কখনও শোনেনি বিনয়। কলকাতার অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে তার। কিন্তু তাদের উচ্চারণ বেশ খানিকটা আলাদা। এমন সব শব্দ তাদের মুখ থেকে বেরোয়নি। অথচ রামগোপাল নাকি এই শহরের আদি বাসিন্দা, তার নিজের কথায় তারা কলকাতার প্রাচীন তেলাপোকা। তবে কি সেকেলে কলকাতার বংশধরদের ভাষা টা একটু অন্য ধরনের? প্রথম দিনই তা জিজ্ঞেস করা যায় না। এখন থেকে প্রায়ই তো লাইব্রেরিতে আসতে হবে। পরে ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই তা জানা যাবে।
রামগোপালের হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। চিড়িক মেরে উঠে বললেন, আমার সঙ্গে বসে বসে গুলতুনি মারলেই হবে? আপিসের ডিউটি আছে। ওঠ, উঠে পড়। দিল্লি বম্বের কাগজগুনো ওইখানে আচে। যাও হাত উঁচুতে তুলে আঙুল বাড়িয়ে ডানদিকের কোণটা দেখিয়ে দিলেন।
বিনয়রা হতচকিত। যে লোকটা লঘু মেজাজে গল্প করছিলেন, লহমায় তিনি আদ্যোপান্ত বদলে যাবেন, ভাবা যায়নি। ধড়মড় করে সবাই উঠে পড়ে। রামগোপালের আঙুল বরাবর দেওয়ালের কাছে এসে দেখতে পায় সারি সারি চওড়া স্টিলের র্যাক। প্রতিটি র্যাকের মাথায় টিনের পাতে একটা করে কাগজের নাম লেখা আছে। আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী, স্বাধীনতা, স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দু, ফ্রি প্রেস জার্নাল, হিন্দুস্থান টাইমস, দা নেশন ইত্যাদি। পুরু শালু দিয়ে প্রতিটি কাগজের এক মাসের সব কপি একসঙ্গে যত্ন করে বাঁধিয়ে এক-একটা তাকে রাখা আছে। দুমাস আগে নতুন ভারত-এর লাইব্রেরি করা হয়েছে। বোঝা যায় তখন থেকেই এইসব কাগজ রাখছেন জগদীশবাবুরা। প্রতি তাকে দুমাসের জন্য দুটো করে ফাইল।
কলকাতার কাগজগুলোর নাম বিনয় জানে। সুধাদের বাড়িতে দুখানা কাগজ রাখা হয়। একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। অন্য পত্রিকাও মাঝে মাঝে কিনে আনে হিরণ। কিন্তু এখানে কলকাতার বাইরের যে-সব কাগজ রয়েছে সেগুলোর নাম আগে তো শোনেইনি, কোনটা দেশের কোন শহর থেকে বেরোয় সে সম্পর্কেও তার কোনও ধারণা নেই। সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই কাগজগুলোর কোনটা থেকে লেখার মালমশলা জোগাড় করা যাবে, কে জানে।
নিরুপায় বিনয় সুধেন্দুদের দিকে তাকায়। এরা সবাই তার চেয়ে চোদ্দ পনেরো বছরের বড়। সাত আট কি দশ বছর ধরে সাংবাদিকতা করে হাড় পাকিয়ে ফেলেছে। খবরের কাগজের কাজের ঘোঁতঘাত নাড়ি-নক্ষত্র সব ওদের জানা।
ঢোক গিলে বিনয় বলল, সুধেন্দুদা, আমাকে একটু হেল্প করবেন?
সুধেন্দু তাক থেকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর ফাইল নামাতে নামাতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো, কীসের হেল্প?
বিনয় তার সমস্যার কথা বলল।
হু, বুঝেছি। পয়লা দিন থেকেই জ্বালানো শুরু হল। এরপর এটা করে দাও, সেটা করে দাও এরকম চলতে থাকবে। আমার লাইফ মিজারেবল করে ছাড়বে দেখছি। বলে ভুরু কুঁচকে কী একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, এক কাজ কর, দিল্লির পেপারগুলো দেখ। শুনেছি, তোমাকে রিফিউজিদের ব্যাপারে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। ইস্ট পাকিস্তান থেকে যেমন লাখ লাখ মানুষ চলে আসছে তেমনি ওয়েস্ট পাকিস্তান থেকে আসছে হিন্দু আর শিখেরা। হিন্দুস্থান টাইমস কি দিল্লি এডিশনের কাগজগুলোতে ওদের খবর বেশি থাকে। মনে হয়, তোমার লেখার মতো ভাল মেটিরিয়াল পেয়ে যাবে।
দিল্লির নানা পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে আপাতত গেল মাসের একটা ডেইলির ফাইল নিয়ে মাঝখানের প্রকাণ্ড টেবলটায় এসে বসল বিনয়। সুধেন্দুরাও এক-একটা ঢাউস ফাইল নিয়ে বসে পড়েছে।
বিনয় ধীরে ধীরে কাগজের পাতা উলটে যাচ্ছিল। কলকাতার পত্রিকাগুলোর মতো এখানেও প্রায় প্রতিদিনের প্রথম পাতার বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে কাশ্মিরের খবর। পশ্চিম সীমান্তের ওপার থেকে হানাদার বাহিনী সেখানে এসে অবিরাম উৎপাত চালাচ্ছে। পাকিস্তানি ফৌজ সমানে তাদের মদত দিয়ে যাচ্ছে। মনোরম ভূস্বর্গে রোজ আগুন। রোজ হত্যা। রোজ রক্তপাত। দেশভাগের। সময় থেকে সেই যে অশান্তি শুরু হয়েছিল, যত দিন যাচ্ছে সেটা ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। এই সমস্যার কোনওদিনই বুঝি বা অবসান ঘটবে না।
বিনয়ের মনে পড়ল, বেশ কিছুদিন আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লা খান বলেছিলেন, কাশ্মিরে ইউ এন ওর হস্তক্ষেপ চাই। তখন থেকে ছোট-বড় সব পাকিস্তানি নেতাই তারস্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মেদিনী কাঁপয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধিদের কাশ্মিরে আসতে হবে। আসতেই হবে।
কাশ্মির ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ভাষণ প্রায় প্রতিদিনই থাকে। সম্প্রতি এশিয়ায় নতুন স্বাধীন এক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। বার্মা। সে দেশের রাষ্ট্রপতি সাও সোয়ে যাইক এবং প্রধানমন্ত্রী থাকিন নু সারা পৃথিবীর, বিশেষ করে ভারতের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করেছেন। মাঝে মাঝে তাদের খবরও চোখে পড়ছে। একদিনের কাগজে দেখা গেল, বেশ কিছু মুসলিম এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সরকারি অফিসার দেশভাগের সময় অপশন দিয়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই নানা অসুবিধার কারণে ইন্ডিয়ায়, তাদের ফেলে-যাওয়া স্বদেশে ফিরে আসতে চাইছেন।
দেশ-বিদেশের নানা সংবাদের মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা নেই বললেই চলে। তবে পশ্চিম পাঞ্জাব কি সিন্ধু থেকে উৎখাত হয়ে আসা মানুষের অনন্ত দুর্দশার সবিস্তার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দিল্লির চারপাশের ত্রাণ-শিবিরগুলোর ছবিও।
পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল বিনয়ের। তিন কলম জুড়ে বিরাট একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বড় বড় হরফে যে শিরোনাম রয়েছে, বাংলায় তর্জমা করলে তা এইরকম দাঁড়ায়। করাচি থেকে এক অপহৃত তরুণীকে উদ্ধার করে ভারতে প্রেরণ : যুবকের মহত্ত্ব।
পড়তে পড়তে বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে আসতে থাকে বিনয়ের। অবিকল ঝিনুকেরই কাহিনি। শুধু শেষটা অন্যরকম।
বিনয় জানে, দেশভাগের আগে আগে বাংলাদেশের মতো সিন্ধু এবং পাঞ্জাবেও ভয়াবহ দাঙ্গা হয়ে গেছে। এই দুই প্রভিন্সে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে তখন প্রতিদিন গণহত্যা। রক্তের সমুদ্র বয়ে গিয়েছিল সেখানে। বড় বড় শহরেই শুধু নয়, সুদূর দুর্গম গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল তাণ্ডব। সারা পাঞ্জাব আর সিন্ধু তখন কসাইখানা।
হত্যার পাশাপাশি একটানা চলেছে আগুন, ধর্ষণ। বিনয় একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে, সব জায়গায়–তা বাংলা হোক, বিহার হোক বা পাঞ্জাব-হননকারীদের মূল টার্গেট তিনটে। প্রপার্টি, মানুষের প্রাণ আর নারী। দাঙ্গার সময় শয়ে শয়ে যুবতী লুট হয়ে গেছে।
বাংলার মতো সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট পাঞ্জাবও দুটুকরো হয়ে গিয়েছিল। দেশভাগের আগে এবং পরে লাহোর থেকে ট্রেন বোঝাই হয়ে শরণার্থীরা চলে এসেছিল অমৃতসর, দিল্লি কি লুধিয়ানায়। অনেকে কানপুর, বম্বে এবং কলকাতাতেও। তেমনি এপার থেকেও ট্রেন বোঝাই হয়ে উদ্বাস্তু গেছে সীমান্তের ওধারে। এমনও শোনা গেছে, দাঙ্গার সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে কোনও কোনও ট্রেনে এসেছে শুধুই লাশ। তেমনি পাকার মৃতদেহ নিয়ে সেই সব ট্রেন ওপারে ফিরে গেছে। লাশের বদলে লাশ। হত্যার বদলা হত্যা।
দেশভাগের পরও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের সীমান্তের এপার থেকে ওপারে যাওয়া, কিংবা ওপার থেকে এপারে আসা বন্ধ হয়নি। কবে যে এর অবসান ঘটবে, আদৌ ঘটবে কি না, কে জানে।
লাখে লাখে মানুষ এসেছে, ক্রমাগত আরও আসছে, কিন্তু যে তরুণীদের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে হানাদারেরা তাদের শতকরা দুজনও ফিরে আসেনি।
নতুন ভারত-এর লাইব্রেরিতে বসে বিনয় এই মুহূর্তে দিল্লির কাগজের যে প্রতিবেদনটা পড়ছিল তাতে ছেচল্লিশের আগস্ট থেকে ধারাবাহিক দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে এনে লেখা হয়েছে, দুই দেশের সরকার উদ্ধার কমিটি তৈরি করেছিল বেশ কিছুদিন আগে। তাতে পদস্থ অফিসাররা ছাড়াও রয়েছেন সমাজসেবী এবং নানা ক্ষেত্রের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশিষ্ট জনেরা। এঁদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দাঙ্গায় লুট হয়ে যাওয়া তরুণীদের খুঁজে বার করে যেন সরকারের হাতে তুলে দেন। ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান সরকার এই লাঞ্ছিত মেয়েদের মা-বাবা, স্বামী কি আত্মীয় পরিজনের হাতে পৌঁছে তুলে দেবে। যদি কারও আপনজনের সন্ধান না পাওয়া যায়, সংশ্লিষ্ট সরকার তার সুরক্ষার ব্যবস্থা তো করবেই, ভবিষ্যতে সে যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তার সুযোগও করে দেবে।
এই পটভূমিতে প্রতিবেদক নীলম নামে মেয়েটির কথা সবিস্তার জানিয়েছেন।
সাতচল্লিশে, স্বাধীনতার কিছু আগে, দেশজোড়া সেই দাঙ্গার সময়, সশস্ত্র হিংস্র ঘাতকের দল একদিন রাতে মশাল জ্বালিয়ে তুমুল হল্লা করতে করতে লাহোরের বড় একটা মহল্লায় ঢুকে পড়েছিল। এলাকাটা পাঁচমেশালি। নানা ধরনের মানুষ সেখানে থাকত। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, হাতে-গোনা কটি খ্রিস্টান পরিবারও। হানাদারদের টার্গেট হিন্দু এবং শিখেদের বাড়িগুলো। তেমন বাড়ি পাওয়ামাত্র পেট্রোল বা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। দাউ দাউ জ্বলতে জ্বলতে বাড়িগুলো চোখের সামনে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। প্রাণ বাঁচাতে ভয়ে, আতঙ্কে উদ্ভ্রান্তের মতো যারা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল, শুধু তরুণীরা বাদে বাকি সবাই মুহূর্তে লাশে পরিণত হচ্ছিল।
মহল্লার যে মানুষগুলো কয়েক পুরুষ পাশাপাশি বাস করে এসেছে তাদের সকলে সেই নিদারুণ দুঃসময়ে পশু হয়ে য়নি। চিরকাল এমন অনেকেই আছে, হাজার উসকানিতেও তারা অটল থাকতে পারে। মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দেবার কথা ভাবতেই পারে না। এই ধরনের কিছু মানুষ বিপন্ন শিখ এবং হিন্দু পড়োশিদের বাঁচাতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু হানাদার ঘাতক বাহিনীকে পুরোপুরি ঠেকাবার শক্তি তাদের ছিল না।
মহল্লার বেশ কিছু বাড়ি ধ্বংসস্তূপ আর বেশ কিছু জীবন্ত মানুষকে লাশ বানিয়ে পঁচিশ তিরিশটি তরুণীকে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গিয়েছিল দাঙ্গাবাজরা। এই মেয়েদের একজন নীলম। তারা হিন্দু, জাঠ।
নীলমদের ছিল মাঝারি ধরনের পরিবার। বাবা, মা, ঠাকুমা, ছোট একটা ভাই এবং সে নিজে। বাড়িতে আগুন লাগানোর পর বাইরে বেরিয়ে দিশেহারার মতো যে যেদিকে পারে পালিয়ে গিয়েছিল। হানাদারেরা তাদের নাগাল পায়নি। বাড়ির সবাই পারলেও নীলমের পক্ষে পালানো সম্ভব হয়নি।
নীলমের বাবার নাম রাজিন্দর সিং। মা জানকী। ছোট ভাই হল অজিত। ঠাকুমার নাম মহালছমী।
রাজিন্দর আর জানকী মহল্লা থেকে অনেকটা দূরে একটা জংলা মতো জায়গায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। অজিত আরও দূরে প্রকাণ্ড এক তালাও অর্থাৎ দিঘিতে চাপ-বাঁধা টোপা পানার ভেতর গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে ছিল। আর তাদের মহল্লারই এক প্রতিবেশী জামাল খান জীবনের ঝুঁকি নিয