সেখান থেকে যুধিষ্ঠির, রমেন, বিকাশ এবং আরও দু-চারজন বেরিয়ে আসে। জলের কলের ওধারে যে ভিড়টা সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো অনড় দাঁড়িয়েছিল, এবার তারা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে।
অদিতি যুধিষ্ঠিরকে বলে, যত তাড়াতাড়ি পারেন একজন ডাক্তার ডেকে আনুন যুধিষ্ঠিরদা
নিরাসক্ত ভঙ্গিতে যুধিষ্ঠির জিগ্যেস করে, কেন, ওই চাঁপার জন্যে? বলে আঙুল বাড়িয়ে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।
হ্যাঁ। দেখছেন না, কী হাল হয়েছে এর
অদিতির উৎকণ্ঠাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয় না যুধিষ্ঠির। বলে, এ নিয়ে ভাববেন না দিদিভাই। রোজ বস্তিতে এরকম ঠেঙানোর ঘটনা বিশ-পঞ্চাশটা করে ঘটছে। রাত দশটা পর্যন্ত একদিন এখেনে থাকলে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন কতগুলোন মেয়েছেলে জখম হল। ডাক্তার ডেকে কি কূল পাবেন। তা হলে এখেনে হাসপাল বসিয়ে দিতে হয়।
দেখা গেল, চারধারের লোকজনের মধ্যেও কোনোরকম চাঞ্চল্য নেই। বস্তিতে মেয়েমানুষ-পেটানো রোজকার রুটিনের একটা আইটেম। এসব বিচলিত হবার মতো ঘটনাই নয়।
অদিতি বলে, না না, এগুলো কোনো কাজের কথা নয়। এখন ডাক্তারকে খবর দিন।
আপনি পয়লা দিন দেখলেন তো, তাই ঘেবড়ে গেছেন। ডাক্তার ডেকে গুচ্ছের পয়সা লষ্ট করে লাভ নেই। চাঁপা রোজ জখম হচ্ছে, রোজ ঘা শুকিয়ে যাচ্ছে
যুধিষ্ঠিরের অবিচলিত অটল মনোভাব অদিতির স্নায়ুকে ধাক্কা দিয়ে যায়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মোটা কর্কশ গলায় চেঁচাতে চেঁচাতে বস্তির দিক থেকে মাংসল ঘাড়ে গদানে-ঠাসা মধ্যবয়সি একটা লোক বেরিয়ে আসে। তার রুক্ষ চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। রক্তবর্ণ চোখ, থ্যাবড়া থুতনি, গোল মুখ, মোটা মোটা হাড়ের ফ্রেমে মজবুত শরীর সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে মারাত্মক নিষ্ঠুরতা।
লোকটার হাতে রয়েছে একটা ভোঁতা নিরেট কাটারি। তাকে দেখে লোকজন সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সরে সরে পথ করে দিল। সে ক্রুদ্ধ কর্কশ গলায় পেঁচিয়েই যাচ্ছে, কোথায় গেলি খানকী মাগী, আজ তোর বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়ব।
সামনের বেঞ্চ থেকে উঠে দ্রুত অদিতির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় চাপা। ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গেছে সে। আড়ষ্ট গলায় বলে, দিদি, ও আমাকে নিঘুঘাত মেরে ফেলবে।
বোঝা গেল, হাতের ওই কাটারিটা দিয়ে কিছুক্ষণ আগে এই লোকটাই নির্দয়ভাবে চাঁপাকে মারধোর করেছে। অদিতি জিগ্যেস করে, লোকটা কে?
ওধার থেকে যুধিষ্ঠির নীচু গলায় জানায়, ও লগা লগেন দাস। হেভি মস্তান দিদিভাই। চাঁপা লগার তিন নম্বর ওয়াইভ।
যদিও যুধিষ্ঠির এই বস্তির একজন মান্যগণ্য নেতাগোছের লোক তবু অদিতি টের পেল নগেনকে যথেষ্টই ভয় পায় সে। আরও জানা গেল, লোকটার তিন-তিনটে স্ত্রী রয়েছে। তবে তিনজনই জীবিত কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। থাকলে, ধরে নেওয়া যায়, হিন্দু কোড বিলকে একেবারেই পরোয়া করে না নগেন।
এরকম মারাত্মক একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে, বস্তিতে আসার আগে ভাবতেই পারেনি অদিতি। তার মতো স্মার্ট সাহসী মেয়েও প্রথাটা রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। বিমূঢ়ের মতো নগেনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
চারপাশের জনতা সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নগেন এলোমলো পা ফেলে এধারে-ওধারে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসে। সে ভিড়ের মধ্যে চাঁপাকে খুঁজছে।
এদিকে আতঙ্কে অদিতির পিঠে একেবারে লেপটে গেছে চাঁপা। অদিতি বুঝতে পারে, মেয়েটা ভীষণ কাঁপছে। পেছন থেকে ভয়ার্ত ঝাপসা গলায় চাঁপা বলে, আমাকে বাঁচান দিদি
চাঁপার কথা যেন শুনতেই পায় না অদিতি। তার দুই চোখ নগেনের ওপর স্থির হয়ে আছে।
শেষ পর্যন্ত চাঁপাকে দেখতে পায় নগেন। তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক হিংস্রতা যেন ঝিলিক দিয়ে যায়। লম্বা লম্বা লালচে চুলগুলো এক ঝটকায় পেছন দিকে সরিয়ে অদিতিদের দিকে এগিয়ে আসে সে। বাঁ-হাতে কাটারিটা বাগিয়ে ধরা। ডানহাতের আঙুল নাচাতে নাচাতে বলে, বেরিয়ে আয় মাগী, আভূভি-আভি
হঠাৎ স্বয়ংক্রিয় কোনো নিয়মে অদিতির মাথার ভেতর কিছু একটা ঘটে যায় যেন। নিজের অজান্তেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, চুপ কর জানোয়ার
এক ধমকেই কিছুটা কাজ হয়। নগেন প্রথমটা হকচকিয়ে যায় এবং প্যাকিং বক্সটার ওধারে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে ভক ভক করে গন্ধ বেরিয়ে আসছে। এখনও অনেকটা বেলা রয়েছে, চারদিকে রোদের ছড়াছড়ি। এরই মধ্যে সে কিন্তু প্রচুর পরিমাণে দিশি মদ গিলেছে।
ধাতস্ত হতে খানিকটা সময় লাগে নগেনের। সে চোখ ছোট করে অদিতিকে লক্ষ করতে থাকে। নেশা-টেশা করলেও বুঝতে পারে, বস্তির লোকজনের ওপর যে মেজাজ চালানো যায়, এর কাছে সেটা চলবে না। অদিতিকে কিছু না বলে নগেন চাঁপাকে ডাকতে থাকে, ভালো চাস তো চলে আয় চাঁপা–চাঁপা উত্তর দেয় না, অদিতির শরীরের সঙ্গে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দেয় সে।
অদিতি বুঝতে পারছিল, ভয় পেলে নগেন একেবারে মাথায় চড়ে বসবে। কোনোভাবেই সেটা হতে দেওয়া যায় না। রুক্ষ গলায় সে বলে, চাঁপা এখন যাবে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও—
কেউ যে নগেনের মুখের ওপর এভাবে বলতে পারে, বস্তির লোকজনের কাছে তা ছিল অভাবনীয়। তারা একেবারে হাঁ হয়ে যায়।
দাঁতে দাঁত চেপে নগেন ভেংচে ওঠে, অর্ডার দিচ্ছেন নাকি মেমসাহেব?