তার চাউনির মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে অদিতি। বিব্রতভাবে বলে, কী দেখছেন।
কপালে সিনুর (সিঁদুর) নেই। আপনার শাদি হয়নি–তাই না দিদিজি?
হ্যাঁ, কেন?
শাদি হলে দেখতেন, আপনার মরদ কীভাবে সুহাগ করত! বলতে বলতে কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে আনে, আর সুহাগ পেলে দেড়-দো সাল পর পর একটা করে বাচ্চা পয়দা করে ফেলতেন। দুনিয়ার এই নিয়ম দিদিজি।
বস্তিবাসী এই মেয়েমানুষটির মুখে কিছুই আটকায় না। কান লাল হয়ে ওঠে অদিতির। নাকমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। ওধারে বেঞ্চে বসে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রয়েছে বিশাখা। বোঝা যায়, অবরুদ্ধ হাসির তোড় গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রাণপণে সে সেটা আটকে রেখেছে। ফলে তার চোখমুখও লাল হয়ে উঠেছে।
আচমকা বিশাখার দিকে ফিরে লছিমা বলে, দিদিজি, আপনিও রেহাই পাবেন না। বুঝবেন মরদের সুহাগ কাকে বলে!
এরকম অভাবিত আক্রমণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে বিশাখা। বিপন্ন মুখে বলে, কী আজেবাজে বলছেন!
আজেবাজে নহী দিদিজি, জিওনের এই হল আসলি বাত। শাদিটা একবার হোক না আপনার, তখন
লছিমাকে থামিয়ে দিয়ে অদিতি বলে, ও-সব আলোচনা থাক। কাজের কথা হোক। একটু আগের বিব্রতভাবটা কাটিয়ে উঠেছে সে। গাম্ভীর্য এবং ব্যক্তিত্ব ফিরে এসেছে তার চোখে-মুখে এবং কণ্ঠস্বরে।
লছিমা সোজা হয়ে বসে, শান্ত চোখে তাকায় অদিতির দিকে। তার চাউনির মধ্যে একটু আগের চটুলতার চিহ্নমাত্র নেই।
অদিতি এবার বলে, একটা কথা জিগ্যেস করব। ঠিক ঠিক জবাব দেবেন—
হাঁ, জরুর।
আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর সম্পর্ক কেমন?
গালের ভেতর জিভটা ঘোরাতে ঘোরাতে লছিমা বলে, নফা আর হবে! দুনিয়ার সব আদমি আর জেনানাদের মধ্যে যেমন হয় আমাদেরও তেমনি।
অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসে?
এই একটি প্রশ্নে আবার লছিমার চটুলতা ফিরে আসে। নীচু তারে কণ্ঠস্বরকে বেঁধে রেখে রিন রিন করে সে হেসে ওঠে, এ কী বলছেন দিদিজি, সুহাগই যদি না করবে, পাঁচ-পাঁচটা বাচ্চা পয়দা হল কী করে!
এই খোলা জায়গায়, যেখানে লোকজন থিক থিক করছে, এ-জাতীয় ইন্টারভিউ নেওয়া খুবই অস্বস্তিকর। বিশেষ করে লছিমার মতো মুখ-আলগা হালকা টাইপের মেয়েমানুষদের! অদিতি দ্রুত ভেবে নেয়, ইন্টারভিউগুলো অন্যভাবে নিতে হবে। সে বলে, আপনার স্বামী কখনও খারাপ ব্যবহার করে না?
হে রামচন্দজি, করে আবার না! দুই হাত প্যাকিং বাক্সের ওপর লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে লছিমা বলে, না করলে এই দাগগুলো কীসের দিদিজি?
লছিমার দুই হাতের উলটো পিঠ থেকে ব্লাউজের হাতা পর্যন্ত খোলা জায়গায় চামড়ার ওপর অগুন্তি কালশিটে পড়ে আছে। কোনো কোনোটা পুরোনো, কিছু কিছু একেবারে তাজা।
অদিতি এবং বিশাখা শিউরে ওঠে। একইসঙ্গে বলে, এভাবে মেরেছে আপনাকে!
বা-রে মারবে না! এখানে এত্তে আদমি দাঁড়িয়ে আছে। নইলে জামাকাপড় খুলে দেখিয়ে দিতাম সারা গায়ে কত দাগ। অনেক জায়গায় চামড়া ফেটে ঘা হয়ে রয়েছে।
এভাবে মারে, আর আপনি কিছু বলেন না!
কী বলব দিদিজি! মরদ সুহাগও করবে, আবার পিটাইও লাগাবে। পিটাই না দিলে আওরতকে কি মুঠির ভেতর রাখা যায়! বলতে বলতে একটু থামে লছিমা। দম নিয়ে পরক্ষণে আবার শুরু করে, আমার মরদটা যখন দারু খেয়ে ঘরে ফেরে তখন কি তার হোশ থাকে। হাতের কাছে যা পায় তা-ই পিটাই করে।
অদিতি লক্ষ করল, লছিমা এক নাগাড়ে এই যে বলে গেল, এতে বিন্দুমাত্র অভিযোগের সুর নেই। স্বামীর হাতে মার খাওয়ার বিবরণ এমন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সে দিয়েছে যাতে মনে হয় এটাই দৈনন্দিন জাগতিক নিয়ম।
অদিতি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বস্তির ভেতর থেকে মেয়ে-গলার একটানা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে। সে এবং বিশাখা চমকে সেদিকে তাকায়।
কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, বস্তি থেকে বেরিয়ে একটি মেয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে এবং চিৎকার করতে করতে এদিকে আসছে। তার খোলা চুল বাতাসে উড়ছে, পরনে শাড়ি এলোমেলো, আঁচল বুক থেকে খসে মাটিতে লুটোচ্ছে।
অদিতি বুঝতে পারে, এই মেয়েটিরই গলা একটু আগে তাদের কানে ভেসে এসেছিল।
বিমূঢ়ের মতো মেয়েটিকে দেখছিল অদিতি। তার এভাবে ছুটে আসার কারণ কিন্তু একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না।
মেয়েটি কোনোদিকে না-কিয়ে সোজা এসে অদিতির সামনে লুটিয়ে পড়ে। তার দুই পা বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে বলে, আমাকে বাঁচান দিদি
মেয়েটির বয়স বাইশ-তেইশ, বিবাহিত। কপালে সিঁদুর লেপটে আছে। মাথা থেকে চুলের ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত গড়িয়ে আসছে, হাতে ঘাড়ে এবং কণ্ঠায় চাপ চাপ রক্ত। থুতনির কাছে মাংসের একটা রক্তাক্ত জেলা প্রায় ঝুলছে। তার গায়ে যে এলোপাথাড়ি কোনো ধারালো অস্ত্র-টস্ত্র চালানো হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। সমানে কেঁদে চলেছে। সে। চোখের জল এবং রক্তে তার মুখ প্রায় মাখামাখি।
ঘটনাটা এতই আকস্মিক এবং অভাবনীয় যে প্রথমটা হকচকিয়ে যায় অদিতি। পরক্ষণেই মেয়েটির সারা গায়ে আঘাতের দগদগে দাগগুলি দেখে শিউরে ওঠে। বিহুলের মতো সে বলে, ওঠো, ওঠো। তোমার এ অবস্থা কী করে হল?
মেয়েটি পা ছাড়ে না। কান্না-ভেজা বিকৃত গলায় বলে, সব বলব, আগে বলুন আমাকে বাঁচাবেন।
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আগে আর কখনও পড়েনি অদিতি। কোন বিপদ থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে, সেটা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা, আগে না-জেনে কথা দেওয়া যায় না। হাত ধরে তাকে পায়ের কাছ থেকে তুলে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিতে দিতে ব্যস্তভাবে বলে, আগে একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। যুধিষ্ঠিরদা, যুধিষ্ঠিরদা বলতে বলতে সে চায়ের দোকানটার দিকে মুখ ফেরায়।