নেই কাজ তো খই ভাজ।
অদিতিদের ঘিরে এই মুহূর্তে বস্তির শ-খানেক ল্যাংটো-আধাল্যাংটো কাচ্চাবাচ্চা অপার কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের বয়স তিন থেকে পাঁচের ভেতর। ইন্ডিয়াতে পপুলেশন এক্সপ্লোশান কী ধরনের হয়েছে তার কিঞ্চিৎ নমুনা ঢাকুরিয়ার এই বস্তিতে এলে টের পাওয়া যায়।
যদিও অদিতি চূড়ান্ত আশাবাদী এবং তার মধ্যে একটি অদম্য জেদ রয়েছে তবু চারপাশের এই অস্বস্তিকর পরিবেশে বসে নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে কতটা কী করতে পারবে, ভাবতেই খানিকটা হতাশ বোধ করে। পরক্ষণেই সব নৈরাশ্য ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সজীব করে তোলে। এর মধ্যেই তাকে কাজ করতে হবে।
অদিতি বিকাশদের কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দেখা যায় যুধিষ্ঠির বস্তির ভেতর থেকে একটি অবাঙালি মেয়েমানুষকে সঙ্গে করে তাদের কাছে নিয়ে এসেছে।
যুধিষ্ঠির অদিতিকে বলল, দিদিমণি, লছিমাকে নিয়ে এলাম। এখন একে দিয়েই শুরু করুন। পরে অন্যদের নিয়ে আসছি। অদিতিকে বলার কারণ আছে। কদিন লক্ষ করে যুধিষ্ঠির টের পেয়েছে, এই ছোট টিমটার সে-ই নেত্রী।
অদিতি বেশ সমাদর করেই লছিমাকে বলে, বসুন দিদি, বসুন—
বিকাশরা সরে গিয়ে গিয়ে অনেকটা জায়গা করে দেয়। লছিমা জড়সড় হয়ে বেঞ্চের একধারে অদিতির মুখোমুখি বসে পড়ে।
লছিমার বয়স বোঝার উপায় নেই। তাবে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম নয়। শক্ত গড়নের চেহারা তার, হাত-পায়ের হাড় মোটা মোটা। গাল খানিকটা ভেঙেছে, হনু দুটো বেশ উঁচু, গায়ের চামড়ায় যৌবনের উজ্জ্বলতা নেই, পেনসিলের অল্প টানের মতো সরু সরু দাগ পড়তে শুরু করেছে। চোখের কোলে হালকা কালির ছোপ। তবু তার মধ্যে লাবণ্যের সামান্য একটু তলানি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।
মুখটি সারল্যে মাখানো। ঘোমটাটা কপালের আধাআধি নেমে এসেছে। দুই ভুরুর মাঝামাঝি এবং হাতের পাতার পিছন দিকে অনেকগুলো উল্কি–তার কোনোটা পদ্ম, কোনোটা শঙ্খ, কোনোটা হরিণ বা পাখি। পরনে বিহার বা উত্তরপ্রদেশের দেহাতী ঢংয়ে রঙিন শাড়ি। হাতে রুপোর কাংলা, আঙুলে চাঁদির আংটি।
যদিও লাজুক, লছিমার চোখেমুখে কৌতুকের একটি হাসি যেন আটকে আছে।
চোখের ইশারায় বিকাশকে টেপ রেকর্ডার চালাতে বলে অদিতি সোজা লছিমার দিকে তাকায়, দিদি, আপনি বাংলা জানেন তো?
লছিমা মৃদু গলায় বলে, জরুর। দশ বরষ কলকাত্তা শহরে কেটে গেল। আর বাংলা বুলি জানব না?
আপনাকে পনেরো-বিশ মিনিট একটু কষ্ট দেব। আমরা কটা কথা জানতে চাই। যদি দয়া করে বলেন
হাঁ হাঁ, পুছ করুন না।
অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার নাম?
লছিমা দুসাধ।
স্বামীর নাম?
গালের পাশে ঘোমটা টেনে দ্রুত অন্য দিকে মুখ ফেরায় লছিমা। বলে, শরমকি বাত। মরদের নাম কেউ মুখে আনে?
ওধার থেকে যুধিষ্ঠির বলে ওঠে, বদরী দুধ।
এদিকে লছিমার ইন্টারভিউ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের লোকজন অদিতিদের দিকে এগিয়ে এসেছে। লছিমাকে এমন অনেক প্রশ্ন করতে হবে, এত লোকজনের সামনে সেসবের উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অদিতি যুধিষ্ঠিরকে ডেকে তার কানে নীচু গলায় বলে, এরকম ভিড় হলে তো আমাদের পক্ষে কাজ করাই যাবে না। ওদের চলে যেতে বলুন যুধিষ্ঠিরদা–
আগের দুদিনও লোকজন সরিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছে অদিতি। মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের ভেতর থেকে একজন জবরদস্ত নেতা বেরিয়ে আসে। সে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দাপটের গলায় বলে, এই, তোমরা এখানে কী করছ? সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না-থেকে যে যার কাজে যাও। একদম ঝামেলা করবেন।
লোকগুলো বস্তির দিকে অনেকটা পিছু হটে। তবে একেবারে চলে যায় না। দূর থেকেই অদিতিদের লক্ষ করতে থাকে। খানিকটা অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, পঞ্চাশ গজ তফাত থেকে ওরা কেউ তাদের কথা শুনতে পাবে না।
অদিতি এবার যুধিষ্ঠির, বিকাশ এবং রমেনকে চায়ের দোকানে গিয়ে বসতে বলে। কেননা তার প্রশ্নের উত্তরে এমন সব তথ্য লছিমাকে জানাতে হবে যা স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সামনে মুখে আনা যায় না।
ব্যাটারি সেটের টেপ রেকর্ডার চালু করাই ছিল। অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার স্বামী কী কাজ করেন?
লছিমা বলে, রিকশা গাড়িয়া চালায়।
নিজের রিকশা?
নহী দিদিজি। রিকশা কেনার পাইসা কোথায়?
মাসে কীরকম আয় হয়?
মালিককে গাড়িয়ার জন্যে রোজ পাঁচ রুপাইয়া দিতে হয়। সেসব দিয়ে দু থেকে ঢাই শ (আড়াইশো) রুপাইয়া থাকে।
আপনি কিছু করেন?
হাঁ। পাঁপড় বানিয়ে বিক্রি করি।
লাভ কেমন থাকে?
হর মহিনা একশো-দেড়শো। তবে সমসারের সব কাম সেরে সময় তো বেশি পাই না। তা হলে আরও কিছু কামাই হত।
আপনাদের সংসারে কত লোক?
সাত। আমি, আমার মরদ আউর পাঁচ বাচ্চা। আউর বলতে বলতে থেমে যায় লছিমা।
আর কী?
আমার বুডটী সাসও (শাশুড়ি) থাকে আমাদের সঙ্গে।
সবসুদ্ধ আপনারা আটজন। আয় মোটে সাড়ে তিনশো-চারশো টাকা। এতে সংসার চালানো তো মুশকিল।
হাঁ। বহোত মুসিবত-তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করে সায় দেয় লছিমা।
অদিতি বলে, এত ছেলেপুলে হওয়া ভালো না। তাদের মানুষ করে তোলা কি সোজা কথা!
চোখের কোণ দিয়ে অদিতিকে লক্ষ করতে করতে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে লছিমা। ঝপ করে গলার স্বর অনেকটা নীচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, এ আপনি কী বলছেন দিদিজি! শাদি হয়েছে, মরদের পাশে শুয়ে রাত কাটাচ্ছি। মরদ বুকের ওপর তুলে আমাকে আধি রাত পর্যন্ত আটার মতো ডলছে। আর বাচ্চা হবে না বলে সামনের দিকে অনেকখানি বুকে অদিতির সিঁথি এবং কপাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।