রাস্তার একটা বাঁক ঘুরে অদিতিরা চায়ের দোকানের সামনে চলে আসে। যুধিষ্ঠির তাদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। তক্তাপোষ থেকে নেমে একরকম দৌড়েই বাইরে বেরিয়ে এল সে। উৎসুক মুখে বলে, এসেছেন দাদাবাবুরা, দিদিমণিরা–আসুন আসুন-বলে নিজেই টানা-হাচড়া করে চায়ের দোকানের একটা বেঞ্চ, একটা পুরোনো চেয়ার এবং উঁচু প্যাকিং বাক্স বার করে আনে, বসুন, বসুন–
এর আগেও বারচারেক এই বস্তিতে মেয়েদের সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করতে এসেছে অদিতিরা। প্রথম দু-বার কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হুট করে এসে তারা মেয়েদের ডেকে ডেকে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিল। এতে সবাই ভয়ানক ঘাবড়ে যায়। অদিতিরা অতিথিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এতই সন্দিন্ধ হয়ে ওঠে যে কেউ মুখ খোলেনি। এরা যদি কিছুই না-জানায় এখানে আসার মানে হয় না। যে বিপুল সমস্যার কেন্দ্রে তারা যেতে চায়, এরা কিছু না
দু-বার ফিরে যাবার পর তৃতীয় দিন এসে অদিতিরা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে নেয়। তারা আগেই খবর পেয়েছিল যুধিষ্ঠির এই বস্তির একজন নেতাগোছের লোক। তার কথা মোটামুটি সবাই মেনে চলে। এখানে তার প্রচণ্ড দাপট।
স্থানীয় কারো সহযোগিতা না পেলে বস্তিতে আসা-যাওয়া সার হবে। অদিতিরা গোপনে যুধিষ্ঠিরকে কিছু টাকা দিয়ে জানিয়েছিল, তাদের সাহায্য করলে আরও প্রাপ্তির আশা আছে। কিছু না পেলে অকারণে পরোপকার করতে কে-ই বা চায়?
কাজেই অদিতিদের ব্যাপারে উৎসাহ বেড়ে গেছে যুধিষ্ঠিরের। অদিতিরা কবে আসবে, আগে থেকেই জানিয়ে যায়। সেদিন বিকেল-হতে-না হতেই সে তাদের জন্য অস্থির হয়ে থাকে।
বলামাত্রই বসে না অদিতিরা। প্রথমে লাল শালুর ফেস্টুন টাঙিয়ে দেয়। পোস্টারগুলোর সঙ্গে কাঠের খুঁটি আটকানো রয়েছে, সেগুলো মাটিতে পুঁতে দেয়। পোস্টারগুলোতে লেখা রয়েছে, নারী নির্যাতন বন্ধ করো, নারীকে সম্মান দিতে হবে, নারীর স্বাধীনতা চাই-ইত্যাদি ইত্যাদি।
যুধিষ্ঠির হইচই বাঁচিয়ে স্ত্রীকে দিয়ে চার কাপ ইস্পেশাল চা বানিয়ে আনে। প্লেটে আটখানা নোনতা বিস্কুট নিয়ে আসে তার মেয়েটা। সসম্ভমে বলে, দাদাবাবু, দিদিমণিরা, কাজ শুরুর আগে একটুস চা খেয়ে ল্যান-
অদিতিরা লক্ষ করেছে, টাকাপয়সা পাওয়ার পর থেকে যুধিষ্ঠিরের খাতিরের মাত্রাটা আচমকা বেড়ে গেছে। চা না খেলে রেহাই নেই। বাজে সময় নষ্ট না করে অদিতিরা চা-বিস্কুট নেয়। খেতে খেতে বলে, যুধিষ্ঠিরদা, দেরি করতে পারব না। আমরা এখনই কাজ শুরু করতে চাই।
যুধিষ্ঠির জানে, এবার তাকে কী করতে হবে। বস্তির মেয়েদের একজন একজন করে নিয়ে আসতে হবে। ঠিক করা আছে, রোজ পঁচিশ-তিরিশজন মেয়ের ইন্টারভিউ টেপ করা হবে এবং ক্যামেরায় তাদের ছবিও ভোলা হবে। যুধিষ্ঠির বলল, ঠিক আছে, আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর একজনকে হাজির করে দিচ্ছি। বলে আর দাঁড়ায় না, লম্বা লম্বা পা ফেলে বস্তির মধ্যে ঢুকে যায়।
ভোটারদের লিস্ট দেখে অদিতিরা আগেই জেনে নিয়েছে, এই বস্তিতে সবসুদ্ধ তিন হাজার দুশো বাইশজন অ্যাডাল্ট মেয়েমানুষ রয়েছে। একদিনে তিরিশ-বত্রিশ জনের সঙ্গে কথাবার্তা বললে অন্তত একশো বার তাদের এখানে আসতে হবে।
প্রথম দু-দিন কোনো কাজ হয়নি। তার পরের দুদিনে চল্লিশ জনের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। নতুন জায়গায় শুরু করতে হয়েছে বলে প্রথম প্রথম বেশি মেয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাদের আড়ষ্টতা এবং সন্দেহ ঘোচাতে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হয়েছে। তবে আজ থেকে সংখ্যাটা বাড়াতেই হবে।
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অদিতি বলে, এবার রেডি হয়ে নাও। যুধিষ্ঠিরদা এখনই ফিরে আসবে। বলতে বলতে একমাত্র চেয়ারটায় বসে পড়ে।
চেয়ারের সামনে উঁচু প্যাকিং বক্স। ওটা টেবিলের কাজ করবে। প্যাকিং বক্সের পর নড়বড়ে বেঞ্চটায় ভাগাভাগি করে বাকি তিনজন বসে পড়ে। তারপর ব্যাগ থেকে ক্যামেরা, নোটবুক এবং টেপ রেকর্ডার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
অদিতিরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে বিশ-বাইশ ফুট দূরত্বে কর্পোরেশনের কদুটোতে এখন বিকেলের জল এসে গেছে। ওখানে এখন বিরাট লাইন। দেড়শো দুশো পুরুষ এবং মেয়েমানুষ বালতি হাঁড়ি ডেকচি পর পর বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় হলে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে এতক্ষণ তুলকালাম হয়ে যেত কিন্তু এখন কারো জলের দিকে নজর নেই, অপার কৌতূহল এবং বিস্ময় নিয়ে তারা অদিতিদের লক্ষ করছে।
যারা লাইন দেয়নি, এমন কিছু লোকজন একধারে দাঁড়িয়ে অদিতিদের দেখতে দেখতে জটলা করছিল। ফিসফিসিয়ে তারা এভাবে বলাবলি করছে।
একজন বলে, এই দাদাবাবু-দিদিমণিরা দু-চারদিন পর পর কী জন্যি আসছে?
নারী-স্বাধীনতার জন্যে। ওই তো লেখা আছে, নারী নিয্যাতন বন্ধ করো। নারীর মুক্তি চাই। বলে কিছুটা লেখাপড়া জানা একটি লোক আঙুল বাড়িয়ে একটা পোস্টার দেখিয়ে দেয়।
ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বল দিকিন।
ওই যে আমরা ঘরের মেয়েমানুষদের ঠেঙাই, সেটা বোধহয় এরা বন্ধ করতে চায়।
হাই ভগবান, মেয়েমানুষকে না ঠেঙালে কি বশে থাকে? হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাবে না?
যা বলেছ। বড়লোকের ছেলেমেয়েদের তো কাজ নেই। মাথায় পোকা নড়ে উঠেছে, অমনি বস্তির মেয়েমানুষদের জন্যে দরদ উথলে উঠেছে।