.
মিনিট পনেরো পর অমিতাদি বিরাট মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। একেবারে সামনের দিকে লাল শালুর ফেস্টুনের দুই প্রান্ত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন মাঝবয়সি মহিলা সদস্য।
পাশাপাশি দুটি লাইন করে রাস্তার বাঁ ধার ঘেঁষে মিছিলটা চলছে। অনেকের হাতেই পোস্টার। যেগুলোতে নারী-স্বাধীনতা, নারী-নির্যাতন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বড় বড় হরফে অনেক কথা লেখা আছে। দুই লাইনের মাঝখানে অনিমেষ আকাশের দিকে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে নানারকম উত্থান-পতন ঘটিয়ে স্লোগানটা সে চমৎকার দিতে পারে। তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে গোটা মিছিলটা গলা মিলিয়ে চিৎকার করে উঠছে।
পণপ্রথা–
বন্ধ করো, বন্ধ করো।
বধু হত্যা—
চলবে না, চলবে না।
বন্ধু হত্যাকারীদের
শাস্তি চাই, শাস্তি চাই।
নারীর মর্যাদা-
রক্ষা করুন, রক্ষা করুন।
স্লোগান দিতে দিতে মিছিল গোল পার্কের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে অদিতিও বেরিয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে রয়েছে বিকাশ, রমেন এবং অন্য একটি মেয়ে, বিশাখা। ওরাও ফেস্টুন এবং তিন-চারটে পোস্টার একটা বড় প্যাকেটে করে নিয়ে এসেছে। আর এনেছে নোটবুক, ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডার ইত্যাদি।
নারী-জাগরণ-এর অফিস থেকে ঢাকুরিয়ার বস্তি দু-আড়াই কিলোমিটার দূরে। ওরা খানিকটা বাসে, খানিকটা হেঁটে যখন সেখানে পৌঁছুল, বিকেল হয়ে গেছে।
.
০২.
ঢাকুরিয়ার এই বস্তি প্রায় মাইলখানেক জায়গা জুড়ে। ভাঙাচোরা টালি বা ফুটিফাটা টিনের চালার লাইন এঁকেবেঁকে নানা দিকে গেছে। প্রতিটি চালায় একটি করে ফ্যামিলি থাকে। মুখোমুখি দুই লাইনের মাঝখানে সঁতসেঁতে সরু গলি। সেগুলো একই সঙ্গে পায়ে চলার পথ এবং নর্মা। দু-ধারের ঘরগুলো থেকে থুতু, কফ, মাছের আঁশ, যাবতীয় আবর্জনা ওখানে ছুঁড়ে ফেলা হয়। এখানে-ওখানে বাচ্চাদের প্রাকৃতকর্মের কিছু চিহ্নও আকছার চোখে পড়বে। এখানকার বাতাসে একটা ঘন চাপ-বাঁধা দুর্গন্ধ সারাক্ষণ অনড় হয়ে থাকে।
এখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই বাঙালি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আর সুন্দরবন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ভূমিহীন চাষি কাজকর্ম না পেয়ে এই বস্তিতে এসে উঠেছে। কলকাতায় এসে রোজগারের একটা-না-একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে এই ভরসায়। যাদের সামান্য জমিজমা ছিল, ঋণের দায়ে সেসব খুইয়ে তাদের অনেকেই চলে এসেছে। তারা এসেছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িষা, মধ্যপ্রদেশ আর অন্ধের গরিব হাভাতে কিছু মানুষ। এদের সবারই বিশ্বাস, কলকাতা কাউকে ফেরায় না। কোনো-না-কোনোভাবে পেটের দানার ব্যবস্থা করে দেয়।
এখানকার পুরুষমানুষেরা অনেকেই সাইকেল-রিকশা চালায়, কেউ ঠেলাওলা, কেউ গ্যারেজে বাস-লরির ক্লিনার, কেউ হকার, কেউ চোর, কেউ বে-আইনি চোলাই বানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিক্রি করে। এইভাবে নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করে তারা পেট চালায়।
বস্তিটার ডানদিকে ঝকঝকে চওড়া একটা রাস্তার ওপারে পশ্চিমবঙ্গ আবাসন পর্ষদের বিশাল হাউসিং কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে হাজার দেড়-দুই নানা টাইপের ফ্ল্যাট।
হাউসিং কমপ্লেক্সটার বাঁ-দিকে সাউথ ক্যালকাটার পশ লোকালিটি। ওখানে নিও রিচ বা নতুন বড়লোকদের একটা পাড়া স্বাধীনতার পর গজিয়ে উঠেছে। সেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত আর্কিটেচারের দারুণ দারুণ সব বাড়ি। কিছু মানুষের হাতে কী পরিমাণ টাকা জমেছে, এখানে এলে টের পাওয়া যায়। বস্তি এবং বড়লোকদের পাড়ার মাঝখানে বাউন্ডারি লাইন হল সেই ঝকঝকে অ্যাসফাল্টের রাস্তাটা।
বস্তির পুরুষদের একার রোজগারে সংসার চলে না। তাই মেয়েদেরও হাউসিং কমপ্লেক্স আর পশ পাড়ায় কাজে বেরুতে হয়। বস্তিটা মেইড সারভেন্ট সাপ্লাইয়ের প্রকাণ্ড একটা আড়ত।
বস্তিটার ঠিক মুখেই পাশাপাশি দুটো জলের কল এবং একটা ল্যাম্পপোস্ট। বছর তিনেক আগে নির্বাচনের সময় কর্পোরেশন থেকে এখানে রাস্তার আলো এবং জলের ব্যবস্থা করা হয়। এই বস্তিবাসীরা সরকারি খাস জমিতে জবরদখল করে বসে গেছে কিন্তু এদের বেশির ভাগেরই বৈধ রেশনকার্ড এবং ভোট আছে। ভোট পেতে হলে একটু কিছু তো করতেই হয়।
জলের কল এবং ল্যাম্পপোস্টের ধার ঘেঁষে একটা নীচু টালির চালার তলায় চায়ের দোকান। দোকানটার সামনে দু-তিনটে নড়বড়ে বেঞ্চ পাতা। সেখানে আট-দশটা লোক চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে বসে আছে।
ভেতরে উঁচু তক্তপোষে মাঝবয়সি পেটানো চেহারার একটি লোককে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে ছোট টিনের ক্যাশবাক্স এবং অনেকগুলো কাঁচের বোয়েম সাজানো রয়েছে। সেগুলোতে রয়েছে শস্তা বিস্কুট, লজেন্স, মোয়া, বাদাম, হজমিগুলি ইত্যাদি। বাঁ-পাশে খেলো কাঠের র্যাকে রয়েছে গাদা গাদা বিড়ির বান্ডিল, চিড়ে-মুড়ি এবং বাজে বেকারির পাউরুটি।
দোকানটার এক কোণে প্রকাণ্ড উনুন জ্বলছে। সেটার পাশে বসে আছে বয়স্কা একটি মেয়েমানুষ। তার কপালে এবং সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। তার সামনে একটা সিলভারের বড় পরাতে অনেকগুলো খালি চায়ের গেলাস, ডিশ-টিশ রয়েছে। পাশেই সারি সারি জলের বালতি। একটি কমবয়সি মেয়ে সেখানে এঁটো গেলাস-টেলাস ধুচ্ছে।
মধ্যবয়সি লোকটার নাম যুধিষ্ঠির, এই চায়ের দোকানটা তার। বয়স্কা মেয়েমানুষটি তারই স্ত্রী। গেলাস-টেলাস যে ধুচ্ছে সে তারই মেয়ে।