কিন্তু এখনকার প্রতিবেশীরা মানুষ ভালো। তারা নগেনদের তাড়িয়ে দেয়।
নগেনরা নতুন করে ঝামেলা করায় পুরোনো অশান্তিটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে। বিকাশ বিরক্ত মুখে বলে, ওকে তাড়াও
অদিতি বলে, তাড়াবার জন্যে ওকে নিয়ে আসিনি।
কিন্তু ওই অ্যান্টিসোশালটা ফের ঝঞ্জাট বাঁধালে কে সামলাবে? আমাকে দিয়ে ওসব হবে না।
তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব।
.
এইভাবেই চলছিল।
হঠাৎ একদিন রাত্তিরে খেতে খেতে বিকাশ বলে, একটা খবর শুনেছ?
অদিতি মুখ তুলে তাকায়। বিকাশকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে, কী খবর?
তোমার দাদারা আর বাবা তোমাদের বাড়িটা বেচে দিতে যাচ্ছেন।
অদিতি চমকে ওঠে, কে বললে?
বিকাশ জানায়, একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা আছে। তার কাছেই শুনেছে, রমাপ্রসাদরা নাকি তাদের কোম্পানিকে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে।
অদিতি নিজের অজান্তেই জিগ্যেস করে, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক কে? সিতাংশু ভৌমিক?
না। অরুণোদয় ভট্টাচার্য। সিতাংশু ভৌমিক আবার কে?
একজন কন্ট্রাক্টর। সে-ও বাড়ি-টাড়ি কেনে।
ও।
অদিতি বুঝতে পারে কাউকে না-জানিয়ে বাড়ি বেচে সিতাংশুর ধার শোধ করতে চাইছেন রমাপ্রসাদরা। সিতাংশুর কাছে বিক্রি করতে গেলে কিছুতেই এত টাকা পাওয়া যাবে না। যে টাকাটা সে জুয়া এবং ফাটকার জন্য ঋণ দিয়েছিল তার ওপর সামান্য কিছু দিয়ে বাড়িটা নির্ঘাত লিখিয়ে নেবে।
বিকাশ আবার বলে, ও বাড়িতে তোমারও তো অংশ রয়েছে।
অদিতি লক্ষ করে, বিকাশের চোখ চকচক করছে। তার স্নায়ুগুলো মুহূর্তে টান টান হয়ে যায়। সে বলে, হয়তো আছে। কেন?
তোমার ভাগের টাকাটা পেলে সল্ট লেকে জমিটমির চেষ্টা করা যাবে। তারপর ছোটখাটো বাংলো টাইপের সুন্দর একটা বাড়ি
বিকাশের কথাবার্তা, আচরণ অনেকদিন থেকেই পছন্দ হচ্ছে না অদিতির। এই মুহূর্তে ঘৃণায় তার ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। লোকটা এত লোভী, আগে টের পাওয়া যায়নি।
অদিতি উত্তর দেয় না। তবে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা তার মাথায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। দু-এক দিনের ভেতর বালিগঞ্জে গিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে।
.
যেদিন বিকাশ বাড়ি বিক্রির খবর দিল তার পরদিন দুপুরে অদিতি যখন কলেজে বেরুচ্ছে সেই সময় মৃণালিনীর চিঠি এল। লিখেছেন, চিঠি পেয়েই যেন অদিতি বালিগঞ্জে চলে যায়, তিনি খুবই বিপন্ন।
আজ কলেজের পর ঢাকুরিয়া বস্তিতে যাবার কথা আছে। কিছুদিন হল, কাজটা খুব ঢিলেঢালা চলেছে। এভাবে চললে একটা বস্তির সার্ভে শেষ করতে পাঁচ বছর লেগে যাবে। এ ব্যাপারে স্পিড় আনতেই হবে। অদিতি ঠিক করে রেখেছিল, আজ কম করে পঁচিশ-তিরিশটি মেয়ের ইন্টারভিউ নেবে। কিন্তু এই চিঠির পর কিছুই করা সম্ভব না।
কোনোরকমে কলেজে জরুরি ক্লাসগুলো নিয়ে বিকেলের দিকে বালিগঞ্জ চলে আসে। মৃণালিনী তাকে জানান, বাড়ি বিক্রির চক্রান্ত চলছে। যদি তা না করা যায়, মোটা টাকায় মর্টগেজ দেওয়া হবে। বাড়ির একটা অংশ মৃণালিনীর নামে দিয়ে গেছেন তাঁর বাবা–অদিতির ঠাকুরদা। তাঁর ওপর রীতিমতো জুলুম করা হচ্ছে যেন তিনি বিক্রি বা মর্টগেজে রাজি হন। নিরুপায় হয়েই শেষ পর্যন্ত অদিতিকে চিঠি লিখতে হয়েছে।
সব শোনার পর অদিতি ট্যাক্সি ডেকে আনে। মৃণালিনীকে সে নিজের কাছে নিয়ে যাবে।
রমাপ্রসাদরা আটকাতে চেষ্টা করেছিল, একরকম জোর করেই মৃণালিনীকে ট্যাক্সিতে নিয়ে তোলে অদিতি।
.
রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে মৃণালিনীকে দেখে কপাল কুঁচকে যায় বিকাশের।
কী কারণে মৃণালিনীকে নিয়ে আসতে হয়েছে জানিয়ে অদিতি বলে, বলো তো, কী অন্যায় জোর করা হচ্ছে পিসির ওপর!
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে বিকাশ বলে, তা হলে টাকা আসবে কী করে? বাড়ি বেচলে তবে তো টাকা!
অদিতি নিশ্চুপ। স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটায় বিকাশ। চিৎকার করে বলে, ভেবেছ কি–এটা ধর্মশালা, না রিফিউজি ক্যাম্প। যাকে খুশি এনে তুলছ! এসব এখানে চলবে না।
অদিতি বিন্দুমাত্র বিচলিত বা অস্থির হয় না। গম্ভীর গলায় শুধু বলে, ঠিকই বলেছ। ভেবে দেখলাম আমারও এভাবে চলবে না। দু-চারদিনের ভেতরে চাঁপা, পিসিকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।
বিকাশ বলে, তোমাকে যাবার কথা তো বলিনি।
অদিতি উত্তর দেয় না।
.
দিন সাতেক পর একটা বাড়ি ভাড়া করে চাঁপা মৃণালিনীকে নিয়ে যাদবপুরে চলে যায় অদিতি। সে বুঝতে পারছে, চারপাশে তার জন্য অসংখ্য রণক্ষেত্র সাজানো হয়েছে। যুদ্ধ ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই অদিতির।