অদিতি বিকাশ এবং চাঁপা আপাতত তিনজন রাতে তিনটে বেডরুমে থাকে।
এখানে আসার দিন পাঁচেক বাদে হঠাৎ একদিন দরজায় খুট খুট আওয়াজে দরজা খুলে সে অবাক। বিকাশ দাঁড়িয়ে আছে।
অদিতি বলেছে, তুমি!
বিকাশ বলেছে, আমার ঘরে চলো।
বিকাশের আচ্ছন্ন চোখ, চাপা অথচ তীব্র কণ্ঠস্বর বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী চায়। অদিতি শান্ত মুখে বলেছে, না।
তুমি তো কোনোরকম বাজে সংস্কার মানো না। বিকাশ আরেকটু এগিয়ে এসেছিল।
তা হয়তো মানি না, কিন্তু তুমি যা চাইছ মানসিক দিক থেকে আমি তার জন্যে এখনও প্রস্তুত হতে পারিনি।
আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল বিকাশ। তারপর ঝুঁকে দুহাতে অদিতির মুখ তুলে ধরে গভীর আবেগে চুমু খায়। অদিতি বাধা দেয় না।
.
১২.
আরও কয়েক মাস কেটে যায়।
এর মধ্যে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিকাশকে বিয়ে করেছে অদিতি। বলা যায় করতে হয়েছে। এই বিয়েটার জন্য প্রথম থেকেই মা প্রবল চাপ দিয়ে গেছেন। যখনই অদিতি বালিগঞ্জের বাড়িতে সবার খোঁজখবর নিতে গেছে হেমতলার এক কথা, এবার বিয়েটা করে ফ্যাল বুবু, আর দেরি করিস না। লোকে আজেবাজে কথা বলছে।
বিয়ে বিয়ে করে মা প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন, রাগারাগি করেছেন, জেদ ধরেছেন। তিনি পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ, সংস্কার এবং চিরাচরিত প্রথা ভাঙার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। একটি পুরুষ এবং একটি নারী বিয়ে না-করে সমাজে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করবে, তাঁর কাছে এটা অভাবনীয়। তিনি মনে করেন এ ধরনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অপবিত্র। তাঁর স্থির বিশ্বাস, বিয়ে না করে, একসঙ্গে থেকে অদিতিরা পাপ করেছে।
হেমতলা যে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছিলেন, অদিতির বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। বিয়েটা সে নিশ্চয়ই করত, তবে আরও কিছুদিন পরে। মায়ের তাড়াতেই তাকে সব কাজ ফেলে একদিন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে ছুটতে হয়েছিল।
কিন্তু বিয়ের পর দ্রুত পালটে যেতে থাকে বিকাশ। তার ভেতর থেকে এমন একটা পুরুষ বেরিয়ে আসতে থাকে যে প্রচণ্ড রক্ষণশীল, অধিকারবোধে সচেতন, স্ত্রী যার কাছে ব্যক্তিগত প্রপার্টির মতো। যে মনে করে তার পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী স্ত্রী উঠবে বসবে চলবে ফিরবে। বৈধ আইনসিদ্ধ বিয়েটা যেন স্ত্রীর ওপর অবাধ প্রশ্নাতীত মালিকানা তার হাতে তুলে দিয়েছে।
এ জাতীয় পুরুষ চারদিকে আকছার দেখা যায় এবং তাদের মেনেও নেওয়া হয়। সামাজিক প্যাটার্নটাই তো এইরকম। কিন্তু বিকাশের ভেতর পুরুষশাসিত সমাজের এমন একজন মারাত্মক প্রতিনিধি যে আত্মগোপন করেছিল, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি অদিতি। সে একেবারে হকচকিয়ে যায়।
বিয়ের পর থেকেই নারী-জাগরণ-এ যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে বিকাশ। সে চায় না অদিতিও ওখানকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখুক। দেশে গভর্নমেন্ট আছে। রাজনৈতিক দল, সোশাল অর্গানাইজেশন, চ্যারিটেবল সোসাইটি–এসবের অভাব নেই। তারাই লাঞ্ছিত অপমানিত মেয়েদের কথা ভাবুক, তাদের দায়দায়িত্ব নিক। বিকাশ বা অদিতির মতো দু-একজন এ ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলে যাবে।
বিকাশের জীবনদর্শন খুবই পরিষ্কার, সেখানে কোনোরকম গোঁজামিল নেই। সে চায় প্রচুর টাকা, অফিসে প্রোমোশন। গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটের তিন গুণ একটা ফ্ল্যাট বা সল্টলেকে বাংলো ধরনের বাড়ি, ঝকঝকে গাড়ি, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হই-হুল্লোড়, দু-তিন বছর পর পর বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং আরামের বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে সে ভাবতে চায় না। তবে কটা বছর অসীম ধৈর্যে নারী-জাগরণ-এ সে যে ঘোরাঘুরি করেছে তার একমাত্র কারণ অদিতি।
যাই হোক, অদিতি তার কথা শুনেছে ঠিকই কিন্তু নিজে যা করেছিল তা-ই করে গেছে। কলেজ, নারী-জাগরণ, বস্তিতে সার্ভে বা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্ট্রিট কর্নার মিটিং, এইসব কর্মসূচি থেকে তাকে এতটুকু সরানো যায়নি। এই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি এবং টেনশান শুরু হয়েছে।
চাঁপা এখনও তাদের ফ্ল্যাটে আছে। তাকে নিয়ে পুরোনো গোলমালটা থেকেই গেছে। তার উপযুক্ত কাজ আজ পর্যন্ত জোটানো যায়নি। তবে এ নিয়ে খুব একটা হই-চই করছে না বিকাশ। কেননা রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাড়ির যাবতীয় কাজই করে। তারা দুজন যখন বেরিয়ে যায়, সে ফ্ল্যাটে পাহারা দেয়। অবশ্য অদিতি যতক্ষণ থাকে, চাঁপাকে সাহায্য করে।
আশ্রয় এবং চারবেলা খাওয়ার বদলে যার কাছ থেকে এত কাজ পাওয়া যায়, নিজেদের স্বার্থেই তাকে তাড়ানোর কথা তেমন করে আর বলে না বিকাশ। নগেন যদি আর হামলা-টামলা না করে হয়তো চাঁপা এখানে স্থায়ীভাবেই থেকে যাবে। তবে অদিতির একেবারেই তা ইচ্ছে নয়। চাঁপাকে ঝি খাটাবার জন্য সে বস্তি থেকে নিয়ে আসেনি। সসম্মানে স্বাধীনভাবে মাথা তুলে এই সমাজে বাস করার সুযোগ সে পাক, এটা সে চায়। সেজন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই তার।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ফোন করে সৈকত জানিয়ে দিল, ট্রান্সফার হয়ে সে নর্থ-বেঙ্গল যাচ্ছে।
সৈকত চলে যাবার দিন সাতেক পর একদিন সকালে দলবলসুদ্ধ নগেন হানা দিল। অকথ্য খিস্তি এবং চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে তারা। উদ্দেশ্য চাঁপাকে নিয়ে যাবে। বোঝ যায়, এতদিন সৈকত তাকে কন্ট্রোলে রেখেছিল। এখন সে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।