এই দশ দিনে নানা ঘটনা ঘটে গেছে।
এর মধ্যে একদিন বালিগঞ্জে নিজস্ব জিনিসপত্র আনতে গিয়েছিল অদিতি। হেমলতা সেদিন তার দুই হাত নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে ব্যাকুলভাবে বলেছিলেন, তুই কোথায় আছিস বুবু-আমাকে বলতেই হবে।
মায়ের কষ্ট, দুর্ভাবনা এবং ব্যাকুলতা যে কতটা আন্তরিক তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি অদিতির। সে বলেছে, তোমাকেই তো বলব মা, কিন্তু পরে। গাঢ় গভীর আবেগে তার গলা বুজে এসেছিল।
পরে না, এখনই বল।
একটু ভেবে অদিতি মুখ নামিয়ে বলেছে, গলফ গ্রিনে, বিকাশের ফ্লাটে।
হেমতলা স্থির চোখে অদিতিকে লক্ষ করতে করতে বলেছেন, তোদের বিয়ে হয়ে গেছে?
না মা।
বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি পারো, করে ফেলো।
যে কথাগুলো বিকাশকে অসংকোচে বলতে পেরেছিল অদিতি, মা-কে তা বলা যায়নি। সে বলেছে, এত তাড়া কী মা?
হেমলতা বলেছেন, লোকসমাজে বাস করতে হলে ওটা দরকার বুবু। মানুষকে বাদ দিয়ে তো কেউ বাঁচতে পারে না। তাদের পছন্দ-অপছন্দ আর মতামতকে উপেক্ষা করলে কি চলে? বিয়েটা কিন্তু করে ফেলবে?
চিরকালের দুর্বল শঙ্কিত মায়ের ভেতর থেকে অন্য এক মা বেরিয়ে এসেছিল যেন। তাঁর আচরণে কথাবার্তায় এতটুকু ভীরুতা নেই। যা রয়েছে তা হলে কর্তৃত্ব এবং দৃঢ়তা। অদিতি বলে, ঠিক আছে। তোমাকে একদিন গলফ গ্রিনে নিয়ে যাবে।
আগে তোদের বিয়ে হোক, তার আগে নয়।
রমাপ্রসাদ বরুণ মীরা এবং বন্দনার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। তারা কেউ অদিতির সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। শুধু প্রবল আক্রোশে তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
হাসপাতাল থেকে মৃগাঙ্ককে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছিল। অদিতি তার ঘরে গিয়ে জিগ্যেস করেছিল, এখন কেমন আছ ছোটদা?
মৃগাঙ্ক খাটে শুয়ে ছিল। উত্তর না দিয়ে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরেছে। আর মীরা কর্কশ গলায় বলেছে, যথেষ্ট হয়েছে আর আহ্লাদের দরকার নেই।
হেমলতাকে বাদ দিলে আর যিনি সেদিন সস্নেহ এবং স্বাভাবিক ব্যবহার করেছেনে তিনি মৃণালিনী।
মৃণালিনী কাছে বসিয়ে পিঠে এবং মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে অদিতি কোথায় আছে, সেখানে আর কে কে থাকে ইত্যাদি নানা খবর খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন। তারপর জিগ্যেস করেছিলেন, হা-রে, বিকাশ ছেলেটা কেমন?
অদিতি বলেছে, এখন পর্যন্ত ভালোই মনে হচ্ছে।
বিয়ে হয়ে গেছে তোদের?
না।
সব দিক বুঝে বিয়ে করবি। পরে যেন আপসোস না করতে হয়।
মৃণালিনীর জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অন্য মেয়েদের থেকে একেবারে আলাদা। বিয়ের পর প্রচণ্ড ধাক্কায় তিনি আমূল বদলে গেছেন। যে সমাজে পুরুষের অবাধ প্রভুত্ব সেটা তিনি ঘৃণার চোখে দেখে থাকেন। পৃথিবীর কোনো পুরুষকেই তিনি শতকরা একশো ভাগ বিশ্বাস করেন না।
অদিতি হেসে বলেছে, মা তো এক্ষুনি বিয়েটা সেরে ফেলার জন্যে চাপ দিচ্ছে। নইলে নাকি ভীষণ দুর্নাম রটে যাবে।
মৃণালিনীকে এবার অসহিষ্ণু দেখিয়েছে। তিনি বলেছেন, না না, বউদির কথা মোটেও শুনবি না। আমাদের সময় মেয়েদের সুনাম আর সতীত্বের দাম ছিল। ও দুটোর জোরেই তাদের বিয়ের বাজারে বিকোতে হত। কিন্তু তুই একালের মেয়ে, সুন্দরী, সবচেয়ে বড় কথা চাকরি-বাকরি করিস। তোকে বিয়ে করার জন্যে কত ছেলে হাঁ করে আছে। কিছুদিন মেলামেশা করে দ্যাখ, বিকাশ ছেলেটা কেমন। যদি মনে হয় খাঁটি, বিয়ে করবি। নইলে কোনোমতেই না।
তুমি একজন রিবেল পিসি।
তাতে আমার কোনো সংকোচের কারণ নেই। জানবি ওটাই আমার আসল পরিচয়। যাক-গে, বাড়ির অন্যসব খবর বলো। সেই লোকটা মানে সিতাংশু ভৌমিক এখনও আসে?
রোজ। তবে আগের মতো হই-চই আর হয় না। মনে হয়, কিছু একটা মতলব ওরা করছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। দুর্গাকে অবশ্য লাগিয়ে রেখেছি, ঠিক জেনে যাব।
একটু চিন্তা করে অদিতি এবার বলে, আমি চলে যাবার পর সবাই তোমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করছে?
মৃণালিনী হাসেন, আগের চেয়ে খারাপ কিছু না। তোর মাকে বাদ দিলে সকলেই আমার মৃত্যু চায় কিন্তু অত সহজে আমি মরছি না।
অদিতি বলে, আমি ঠিকানা লিখে কটা পোস্টকার্ড নিয়ে এসেছি। তেমন দরকার হলে চিঠি লিখে দুর্গাকে দিয়ে পোস্ট করিয়ে দিও।
আচ্ছা। একদিন তোদের ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে যাস।
নিশ্চয়ই।
এরমধ্যে নিয়মিত কলেজে গেছে অদিতি। রোজ চারটে কি পাঁচটা করে ক্লাস নিয়েছে। কলেজ থেকে গেছে নারী-জাগরণ-এর অফিসে। সেখান থেকে বিকাশ কৃষ্ণা হৈমন্তী বা রমেনকে সঙ্গে করে ঢাকুরিয়ার বস্তিতে গেছে।
প্রথমদিকে অমিতাদিরা বাধা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁদের ভয়, বস্তিতে অদিতি ফের গেলে গোলমাল হবে কিন্তু তাকে আটকানো যায়নি। যে কাজের দায়িত্ব সে নিয়েছে একটা ক্রিমিনালের ভয়ে তা মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার মানে হয় না।
এদিকে সৈকত যা বলেছিল তা-ই ঘটেছে। অ্যারেস্ট করার পর নগেনকে ধরে রাখা যায়নি। রাজনৈতিক দাদাটি তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। তবে আগের মতো অতটা মারমুখী উগ্র নেই নগেন। দূর থেকে অদিতির উদ্দেশে রোজই কিছু খিস্তিখেউড় দিয়ে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে সে অদৃশ্য হয়ে যায়।
নারী-জাগরণ-এর কাজের সঙ্গে সঙ্গে চাঁপার জন্য একটা কাজের চেষ্টা চলছে। অমিতাদি থেকে শুরু করে প্রতিটি মেম্বারই এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে।
এর মধ্যে চমকপ্রদ যে ব্যাপারটা ঘটেছে তা এইরকম। প্রথম যেদিন অদিতি গলফ গ্রিনে আসে, সেই রাতটা ফ্ল্যাটে থাকেনি বিকাশ। ভবানীপুরে তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন অফিস থেকে সোজা নারী-জাগরণ হয়ে গলফ গ্রিনে চলে আসে। তারপর থেকে এখানেই আছে।