আমার জন্যে ওকে মেনে নাও। প্লিজ বিকাশ–অদিতি বিকাশের মুখের দিকে স্থির চোখে তাকায়।
দ্বিধান্বিতভাবে বিকাশ বলে, ঠিক আছে।
বিকাশ রাজি হয়েছে বটে, তবু অদিতির মনে হয় সবটাই বোধহয় ঠিক নেই। কোথায় যেন অদৃশ্য একটা কাঁটা থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য বিকাশের দিকটাও ভেবে দেখা দরকার! নারী সচেতনতা, নারীর মর্যাদা রক্ষা–এইসব জরুরি ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু যে নতুন বিয়ে করবে সে কখনোই চাইবে না স্ত্রীর সঙ্গে একটি বিপজ্জনক এবং স্থায়ী সমস্যা এসে হাজির হোক।
বিকাশ এবার বলে, চলো, ফ্ল্যাটটা তোমাকে দেখাই। তারপর খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা করা যাবে।
মোট তিনটে বেড রুম, একটা বড় হল, দুটো বাথরুম, কিচেন, ব্যালকনি, দেওয়ালে এবং সিলিংয়ে টাটকা পেইন্টের গন্ধ, মোজেক-করা ঝকঝকে ফ্লোর-সব মিলিয়ে ফ্ল্যাটটা চমৎকার।
দেখা হয়ে গেলে বিকাশ জিগ্যেস করল, কি, পছন্দ হয়েছে?
অদিতি ঘাড় হেলিয়ে দেয়, হ্যাঁ।
এবার বাজারে যাওয়া যাক। একটা কথা ভাবছি—
বলো
যতদিন না খাট-টাট কেনা হচ্ছে ডেকরেটরদের কাছ থেকে বালিশ তোষক মশারি-টশারি ভাড়া করে আনলে কেমন হয়?
আমিও ঠিক সেই কথাই ভেবেছি।
চাঁপাকে ফ্ল্যাটে রেখে অদিতি এবং বিকাশ বাজারে চলে যায়। ডেকরেটরকে বিছানা-টিছানা পাঠাতে বলে কিছু স্টেনলেস স্টিলের বাসন এবং কাপ-প্লেট কেনে। তাছাড়া কেরোসিন স্টোভ, দশ লিটার কেরোসিন, চাল, ডাল, চিনি, জেলি, মাখন, চা, দুধের টিন, কিছু আনাজ, মশলা, বাদাম তেল ইত্যাদি কিনে ফিরে আসে।
আপাতত জোড়াতালি দেওয়া অস্থায়ী সংসার পাতা যাক। পরে ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে নেওয়া যাবে।
ফিরেই স্টোভ ধরিয়ে চা করতে বসে যায় অদিতি। সেই কখন নাকেমুখে গুঁজে কলেজে ছুটেছিল। বাড়ি ফেরার পর ক্রমাগত এমন সব নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেছে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যায়নি।
এতক্ষণে দম বন্ধ করা নাটকের পর টান-টান স্নায়ুগুলো এখন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এক কাপ চা না পেলে মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। তা ছাড়া খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড।
ক্ষিপ্র হাতে তিনজনের মতো চা এবং টোস্ট করে নেয় অদিতি। তার আর বিকাশের চায়ের কাপ-টাপ নিয়ে সে চলে আসে বাইরের ঘরে। চাঁপা কিচেনে বসেই খাবে।
চায়ে একটা চুমুক দিয়ে হেসে ফেলে বিকাশ। বলে, এমন ড্রামাটিকালি কেউ সংসার শুরু করেছে কিনা, আমার অন্তত জানা নেই।
হালকা শব্দ করে অদিতিও হাসে, না।
এলোমেলো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বিকাশ বলে, তুমি এসেছ, মোস্ট ওয়েলকাম। কিন্তু একসঙ্গে জীবন শুরু করার আগে একটা খুব ইম্পর্টান্ট ফরমাল ব্যাপার রয়েছে। সেটা সেরে নেওয়া দরকার।
বিয়ের কথা বলছ?
হ্যাঁ। মানে সামাজিক রেকগনিশনের কথাটাও তো ভাবতে হয়।
অদিতি হাসে, লোকনিন্দার ভয় তোমার তাহলে আছে।
বিকাশ বিব্রতভাবে বলে, মানুষের মধ্যে থাকতে হলে কিছু কিছু প্রথা তো মানতেই হয়, যখন বিয়ের সাবস্টিটিউট আমরা ভেবে উঠতে পারিনি এখনও। তোমার সিঁথিতে সিঁদুর-চিঁদুর না দেখলে চারপাশের লোক আজেবাজে কমেন্ট করবে
তোমার কি ধারণা, বিয়ের পর আমি সিঁদুর পরব? ওটা বুঝি সাধু স্ত্রীর সার্টিফিকেট?
তা বলছি না। ওটা বহুকালের সিস্টেম। তাহলে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিশ দিই?
ওসব পরে ভাবা যাবে। সিঁদুর, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, এ নিয়ে এখন মাথা খারাপ করার দরকার নেই। সারাদিন চাঁপা আর আমার ওপর দিয়ে যা গেছে তাতে আমাদের রেস্ট দরকার।
বিকাশ সংকোচ বোধ করে। বলে, সরি! একটু থেমে আবার শুরু করে, একটা কথা ভেবে দেখলাম।
বলো।
যতদিন না আমাদের বিয়েটা হচ্ছে, আমি ভবানীপুরের বাড়িতে থেকে যাব। তোমরা এখানে থাকবে।
তুমিও এখানে থাকলে, আমার আপত্তি নেই। অবশ্য যদি বাড়িতে থাকাটা খুব জরুরি হয় তাহলে আলাদা কথা।
খানিকটা চুপচাপ।
তারপর অদিতি ফের বলে, তুমি নিশ্চয়ই আমার বদনামের কথা ভাবছ—
বিকাশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলে, হ্যাঁ, মানে
ওসব আমি গ্রাহ্য করি না। তোমার আর আমার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা বড় ব্যাপার। বিয়েটা তো হাতেই রইল। এক সময় ওটা করে ফেললেই হবে। তার চেয়ে এখন বড় ব্যাপার হল, চাঁপার জন্যে এমন কিছু করে দেওয়া যাতে অন্যের ওপর নির্ভর না করে, নিজের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
হুঁ। অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে বিকাশ।
.
১১.
দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে যায়।
গলফ গ্রিনে আসার পরদিন সকালেই অদিতি লালবাজারে সৈকতকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, সে এখন থেকে এখানেই থাকবে। যদি জরুরি কোনো খবর থাকে তার কলেজে যেন ফোন করে সৈকত। নইলে গলফ গ্রিনে লোক পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে হবে।
সৈকত সেদিন একটা দরকারি খবর দেয়। নগেনকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তবে তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। কেন না লোকটার পেছনে একজন পাওয়ারফুল রাজনৈতিক দাদা রয়েছেন। নগেন তাঁর জন্যে জান দিয়ে ইলেকশানের সময় খাটে। কাজেই দাদাটি তার প্রভাব খাঁটিয়ে যেন-তেন প্রকারে নগেনকে পুলিশের কবজা থেকে বের করে আনবেনই। তবে অদিতি বা চাঁপার ভয় নেই। সে যাতে বড় রকমের গোলমাল বাধাতে না পারে, ব্যক্তিগতভাবে সেদিকে নজর রাখবে সৈকত।
তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অদিতি ভেবেছে, লালবাজারে তার জানাশোনা না থাকলে নগেন যে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলত, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।