ফোন নামিয়ে অদিতি নিজেদের বাড়িতে আসে। বাবা মা বড়দা এবং দুই বউদি দোতলাতেই ছিল।
অদিতি তীব্র গলায় বলে, এ-বাড়িতে আমার কি সামান্য অধিকারও নেই?
বরুণের চোখ কুঁচকে যায়। সে বলে, তার মানে?
আমি একটা অসহায় মেয়েকে আমার ঘরে এনে রাখলাম, আর তোমরা তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলে?
আমাদের ফ্যামিলির সিকিউরিটি নষ্ট হয়, এ হতে দেওয়া যায় না।
অদিতির মাথার ভেতর কোথায় যেন বারুদের স্তূপে আগুন ধরে যায়। সে বলে, আর তোমরা ফ্যামিলির জন্যে কী করতে যাচ্ছ? একটা বজ্জাত ডিবচের কাছে আমাকে বেচতে যাচ্ছিলে? আমার ধারণা টাকার জন্যে ওই লোকটা এ বাড়ির সবাইকে পথে বসাবে। আর তার জন্যে তোমরা দায়ী।
রমাপ্রসাদ গলা চড়িয়ে বলেন, এভাবে তুমি কথা বলবে না বুবু। বড়দের সম্মান দিতে শেখো–
বড়দের উচিত এমন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাতে ছোটরা সম্মান করতে বাধ্য হয়। সে যাক, একটা পরিষ্কার কথা জানতে চাই, তোমরা চাঁপাকে এখানে থাকতে দেবে কিনা–
না, কিছুতেই না। আমাদের নিজেদেরই যথেষ্ট প্রবলেম আছে। চাঁপা থাকা মানেই নিত্যনতুন ঝামেলা।
ঠিক আছে, তাহলে আমাকেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়।
হেমলতা ওধার থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন, কী বলছিস বুবু? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল?
রমাপ্রসাদ বলেন, একটা উটকো মেয়ের জন্যে কেন এত জেদ ধরে আছিস?
অদিতি বলে, বাবা, শুধু চাঁপার জন্যেই না, আমার নিজের জন্যেই আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। আমার অজান্তে যেদিন তোমরা আমাকে একটা বদমাসের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলে সেদিনই ভেবেছিলাম এই পরিবেশে থাকা ঠিক না। চাঁপা আসার পর তোমরা যা করলে তাতে ডিসিশানটা নিতেই হল।
হেমলতা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে অদিতির দুই হাত ধরে বলেন, কোথাকার কে একটা মেয়ে, তার জন্যে বাপ-মা, বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাবি বুবু? বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন।
মায়ের কষ্টটা খুবই আন্তরিক। নরম গলায় অদিতি বলে, চাঁপার জন্যে না, আমার নিজের জন্যে বাড়ি ছাড়ছি মা।
অদিতিকে হেমলতার মতো কে আর বেশি চেনে। যেমন জেদি তেমনি একগুঁয়ে। সিদ্ধান্ত যা সে নিয়েছে সেখান থেকে তাকে ফেরানো যাবে না।
হেমলতা ব্যাকুল হয়ে বলেন, কোথায় যাবি তুই?
এই মুহূর্তে বাড়ির আবহাওয়া যেরকম তাতে বিকাশের নাম বললে মারাত্মক কিছু ঘটে যাবে। অদিতি বলে, পরে জানাব।
এরপর রমাপ্রসাদ, বন্দনা, এমনকী মীরা আর বরুণও অদিতিকে আটকাবার চেষ্টা করে। তারা বলে, এভাবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ভালো দেখায় না, লোকের কাছে মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না, ইত্যাদি। কিন্তু অদিতি অনড় থাকে। সে বলে, কাল-পরশু এসে আমার জিনিসপত্র নিয়ে যাব।
হেমলতা বলেন, তুই কি এ-বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে দিলি বুবু?
কে বললে শেষ করে দিলাম? দু-চারদিন পর পর এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যাব। বলে আর দাঁড়ায় না অদিতি। সোজা তেতলায় গিয়ে একটা সুটকেসে কিছু জামা-কাপড়, ব্রাশ পেস্ট, এমনি টুকিটাকি দরকারি জিনিস পুরে মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে পড়ে।
গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে আগে আর আসেনি অদিতি। তবে বিকাশের কাছ থেকে ঠিকানাটা জেনে নিয়েছিল। চাঁপাকে সঙ্গে করে খুঁজে খুঁজে ফ্ল্যাটটা যখন সে বের করল, কলকাতা মেট্রোপলিসের ওপর সন্ধে নামতে তখন আর বেশি দেরি নেই।
এখনও কলিংবেল লাগানো হয়নি। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে মুখোমুখি দাঁড়ায় বিকাশ। অদিতিরা পৌঁছুবার আগেই সে এখানে এসে বসে আছে। দারুণ খুশিতে তার চোখমুখ ঝকমক করছে। অদিতির জন্য অসীম ধৈর্য নিয়ে চার-পাঁচটা বছর সে অপেক্ষা করেছে। এত দিনে কাম্য নারীটি নিজের থেকেই তার কাছে ধরা দিল।
হেসে হেসে বিকাশ বলে, এসো এসো। বলতে বলতেই অদিতির পেছনে চাঁপাকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে এক ফুয়ে আলো নিভিয়ে দেবার মতো তার মুখ কালো হয়ে যায়। নিরুচ্ছাস গলায় এবার বলে, এ কি, চাঁপাকেও নিয়ে এসেছ!
চাঁপা সে এখানে কতটা অবাঞ্ছিত, মুহূর্তে টের পেয়ে যায় আদিতি। সে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই বলে, ওর জন্যেই আজ বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। এখন বলো ভেতরে ঢুকব কি ঢুকব না?
বিকাশ লজ্জা পেয়ে যায়। শশব্যস্তে অদিতির হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে বলে, কী আশ্চর্য, এসো। প্লিজ
ভেতরে যেতেই অদিতি দেখতে পায় বসবার ঘরে খানতিনেক চেয়ার পাতা রয়েছে। এগুলোও সে আশা করেনি। চেয়ার দেখিয়ে জিগ্যেস করে, পেলে কোথায়?
তুমি আসবে বলে পাশের ফ্ল্যাট থেকে চেয়ে এনেছি। কিন্তু
বলো–
তুমি তো বললে বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছ। এখানে খাট, বিছানা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা কিছুই নেই।
ওসব কোনো প্রবলেম না।
একটু ভেবে বিকাশ বলে, হঠাৎ এভাবে চলে এলে। আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
উত্তর না দিয়ে অদিতি চাঁপাকে অন্য একটা ঘরে রেখে ফিরে আসে। বলে, এত হেস্টি ডিসিশান নিতে অবাক হয়ে গেছ-না?
তা তো হয়েছিই।
এবার সব ঘটনা জানিয়ে অদিতি জিগ্যেস করে, এ ছাড়া আমি আর কী করতে পারতাম বলো?
খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে বিকাশ। অদিতির একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে গাঢ় গলায় বলে, তুমি তো জানো এই দিনটার জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। কিন্তু ওই চাঁপাও আমাদের লাইফে অনেক সমস্যা নিয়ে আসবে। অকারণে অশান্তি, টেনশান, থানা-পুলিশ! ওর হাজব্যান্ড লোকটা একটা জঘন্য ক্রিমিনাল