একটু চুপ করে থাকার পর অমিতাদি বলেন, তুমি নারী-জাগরণ-এর অফিসে আসতে পারবে?
অদিতি বলে, যত তাড়াতাড়ি পারি। বস্তির সেই সাভের কাজটা সবে আরম্ভ করেছিলাম। চাঁপার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে ওটা আবার নতুন করে স্টার্ট করতে হবে।
কিন্তু এখানে নগেন থাকে-অমিতাদির গলা শুনে মনে হয় তিনি বেশ চিন্তান্বিত।
থাক না। ক্রিমিনালরা বেসিক্যালি কাওয়ার্ড হয়। ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলে পৃথিবীতে কোনো কাজই করা সম্ভব না।
ঠিক আছে, তুমি এলে এ নিয়ে কথা হবে। আমাদের মেম্বাররা তোমার জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।
ফোন নামিয়ে আর দেরি করে না অদিতি। ব্যাগ এবং ছেলেমেয়েদের অ্যানসার পেপারের একটা বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
.
১০.
বাড়ির কাছে এসে গেটের পাশে চাঁপাকে বসে থাকতে দেখে থমকে যায়। ভয়ে এবং আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আছে মেয়েটা।
কী হতে পারে চাঁপার? কেন সে রাস্তায় বসে আছে? তবে কি তাকে নিয়ে বাড়িতে নতুন করে কোনো ব্যাট হয়েছে? ঝাঁক বেঁধে এইসব প্রশ্ন অদিতিকে বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন করে তোলে।
প্রায়ই দৌড়েই সে চাঁপার কাছে চলে আসে। বলে, তুমি এখানে।
চাপা উত্তর দেয় না। তার ঠোঁটদুটো শুধু কাঁপতে থাকে এবং চোখ জল ভরে যায়।
চাঁপাকে হাত ধরে টেনে তোলে অদিতি। প্রবল উৎকণ্ঠায় জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?
চাঁপা এবারও কিছু বলে না, মুখ নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
অদিতি আবার বলে, কী হল, কথা বলছ না কেন?
ভাঙা ভাঙা ঝাপসা গলায় এবার চাঁপা বলে, বড়দা, বাবা আর বউদিরা আমাকে বার করে দিয়েছে।
অদিতি চমকে ওঠে, কখন?
আপনি কলেজে যাবার পর।
তারপর থেকে এখানে বসে আছ?
হ্যাঁ।
অদিতি দ্রুত বাঁ-হাতের কবজি উলটে ঘড়িটা দেখে নেয়। তিনটে বেজে কুড়ি। সে বেরিয়েছে দশটায়। তার মানে পাঁচ ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মেয়েটা রাস্তায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
অদিতি জিগ্যেস করে, আমি বেরুবার পর কোনো গোলমাল হয়েছিল কি?
না।
তা হলে তোমাকে বের করে দিল যে?
জানি না। হঠাৎ ওনারা এসে দরজা খুলতে বলল। আমি ভয়ে ভয়ে খুলে দিলাম। ওনারা বলল, এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও। নইলে পুলিশ ডাকব। পুলিশের নামে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তবু বললাম, ছোটদি আমাকে এখানে থাকতে বলেছে। শুনে ওনারা রেগে গিয়ে এত গালাগাল দিতে শুরু করলে যে থাকতে সাহস হল না। অবশ্যি
কী?
পাশের ঘর থেকে পিসিমা সমানে বলে যাচ্ছিল আমাকে যেন তাড়িয়ে না দেয়। কিন্তু তেনার বিছানা ছেড়ে নামার ক্ষ্যামতা নেই। এদিকে বস্তিতে যে ফিরে যাব, সে রাস্তাও বন্ধ।
শুনতে-শুনতে মুখ শক্ত ওঠে অদিতির। পঙ্গু শয্যাশয়ী পিসিমা ছাড়া বাড়ির প্রতিটি মানুষ চাঁপার বিরুদ্ধে। তার জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতি কারও নেই। এদিকে সারাক্ষণ তাকে পাহারা দিয়ে বাড়িতে বসে থাকার মতো পর্যাপ্ত সময় অদিতির নেই। তার কলেজ আছে, নারী-জাগরণ আছে, বাইরে হাজার রকম কাজ আছে। তাকে বেরুতেই হবে। যদি জোর করে চাঁপাকে আবার বাড়িতে নিয়েও যায়, সে যখন বাইরে বেরুবে, বাবা দাদা এবং বউদিরা নিশ্চয়ই ফের তাড়িয়ে দেবে। তাতে তিক্ততা আর অশান্তিই শুধু বাড়বে।
রাস্তায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ ভেবে ভবিষ্যৎ কার্যসূচি ঠিক করে নেয় অদিতি। কেন না সে জানে, বিকেল চারটে পর্যন্ত আজ অফিসে থাকবে বিকাশ। তার আগেই তাকে ফোন করা অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া বাড়ির লোকেদের সঙ্গে তার বোঝাঁপড়া আছে। যাকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছে তাকে সবাই মিলে তাড়িয়ে দেবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। অন্তত একটা জোরালো প্রতিবাদ করতেই হবে।
অদিতি বলে, তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।
চাঁপা ভীরু গলায় বলে, দিদি একটা কথা বলব?
বলো
আমার জন্যে বাড়িতে গিয়ে রাগারাগি করবেন না।
চাঁপার মনোভাব বুঝতে অসুবিধে হয় না। ইদানীং এ বাড়িতে যেসব অশান্তি এবং দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কারণ সে। এজন্য মেয়েটা লজ্জায় সঙ্কোচে একেবারে কুকড়ে আছে।
অদিতি বলে, ঠিক আছে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর পেছন দিক দিয়ে পাশের বাড়ি চলে যায়। প্রথমে বিকাশকে ফোন করা দরকার।
এক ঘন্টা আগে যার সঙ্গে কথা হয়েছে, এত অল্প সময়ের মধ্যে আবার তার ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হয়ে যায় বিকাশ। বলে, কী ব্যাপার!
অদিতি বলে, চারটের সময় তুমি তো বেরিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতে আমার যে অংশটা রয়েছে সেটা দাদাকে বিক্রি করে দিচ্ছি। ওই ব্যাপারে আমাদের ল-ইয়ার এগ্রিমেন্ট ড্রাফট করে রেখেছেন। সেটা দেখতে যাব।
মুশকিল হল। আজ ল-ইয়ারের কাছে না গিয়ে যদি কাল যাও, খুব অসুবিধে হবে?
কেন?
তোমার সঙ্গে আজ আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি।
হঠাৎ কী হল? কিছুক্ষণ আগে যখন কথা বললাম তখন তো এত আর্জেন্সির কথা জানাওনি।
অদিতি বলে, হঠাৎ নতুন একটা ডেভলাপমেন্ট হয়েছে।
কী ডেভলাপমেন্ট? বিকাশের কণ্ঠস্বরে একই সঙ্গে উৎকণ্ঠা এবং আগ্রহ।
ফোনে বলা যাবে না। দেখা হলে শুনো।
ঠিক আছে, ল-ইয়ারকে ফোন করে দিচ্ছি, কালই যাব। এখন বলল, আমাকে কী করতে হবে?
তুমি অফিস থেকে সোজা গলফ গ্রিনের নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাও। আমি ঘণ্টাখানেকের ভেতর ওখানে পৌঁছে যাব।
আচ্ছা।