অগত্যা, চাঁপাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে দশটা নাগাদ যখন অদিতি বেরুতে যাবে, চাঁপা ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, দিদি, আপনি কখন ফিরবেন?
অদিতি বলে, পাঁচটার ভেতর। ক্লাস হয়ে গেলে এক মিনিটও দেরি করব না। সাবধানে থাকবে।
আচ্ছা। কিন্তু
বলো।
আমার খুব ভয় করছে।
চাঁপা আসায় বাড়িতে যে দমবন্ধ-করা যুদ্ধকালীন অবস্থা চলছে, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি তার আছে। অদিতি ভরসা দিয়ে বলে, কীসের ভয়? আমি দুর্গাকে বলে যাচ্ছি তোমার ভাত দিয়ে যাবে।
চাঁপা বলে, এভাবে কদিন আমাকে আগলে রাখবেন?
এই প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই অদিতির। সে বলে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা যাচ্ছি।
.
কলেজে এসে পর পর দুটো অনার্স ক্লাস নিয়ে আগের দুদিনের যেসব ক্লাস নেওয়া হয়নি তার থেকে দুটো ক্লাস নিল। সে ঠিকই করে রেখেছে, রোজ একটা-দুটো করে একস্ট্রা ক্লাস নিয়ে মেক-আপ করে ফেলবে।
একটানা চারটে ক্লাস নেবার পর স্টাফরুমে আসতেই অরুণা বলে, অদিতিদি, বিকাশবাবু তিনবার ফোন করেছেন। উনি অফিসে চারটে পর্যন্ত থাকবেন। তোমাকে রিং করতে বলেছেন। অরুণা এই কলেজে হিস্ট্রি পড়ায়, বিকাশকে চেনে।
দুদিন বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু বিকাশ কেন, বাইরের সবার সঙ্গেই অদিতির যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই দুটো দিন সারাক্ষণ চাঁপাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে সে।
স্টাফরুমের এক কোণে উঁচু একটা টুলের ওপর টেলিফোনটা রয়েছে। অদিতি উঠে সেখানে চলে যায়। বার তিনেক ডায়াল করার পর বিকাশকে ধরতে পারে সে।
বিকাশ বলে, কী ব্যাপার, দুদিন তোমার দেখা নেই। কলেজে কাল-পরশু ফোন করেছিলাম। নারী-জাগরণ-এর অফিসে রোজ যাচ্ছি। কেউ কোনো খবর দিতে পারছে না। আজ অফিসে আসার পর রমেনের ফোন পেলাম। ও বলছিল তোমাদের বাড়িতে নাকি কারা রেইড করেছিল। কী হয়েছিল? তার কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার ছাপ।
মৃগাঙ্ককে ছুরি মারার ঘটনা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে সংক্ষেপে সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, বুঝতেই পারছ, কেন আমাকে বাড়িতে আটকে থাকতে হয়েছিল?
হ্যাঁ। কিন্তু-
কী?
এভাবে কতদিন চলবে?
যতদিন না সমস্যাটার কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল যে।
অদিতি হাসে, সহজ সরল হলে সেটা আবার সমস্যা থাকে নাকি?
অনিশ্চিতভাবে বিকাশ বলে, তা অবশ্য। একটু থেমে আবার বলে, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া খুব দরকার। জানো, হাউসিং বোর্ড থেকে কাল আমার, মানে আমাদের ফ্ল্যাটটার পজেশান দিয়েছে।
হঠাৎ মৃদু উত্তেজনা অনুভব করে অদিতি। চাঁপার মুখটা বিদ্যুৎচমকের মতো এক পলক তার চোখের সামনে ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। বলে, এত তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল?
বিকাশ বলে, তুমি সেদিন বলার পর হাউসিং-বোর্ডে গিয়ে খুব ধরাধরি করেছি। বলেছি, ফ্ল্যাট না পেলে বিয়েটা আটকে যাচ্ছে বলতে বলতে তার গলা তরল এবং হালকা শোনায়।
বিকাশের তারল্য বা লঘুতা অদিতির ওপর কোনো দাগ কাটে না। সে অন্যমনস্কর মতো বলে, একটা ভালো খবর দিলে।
এখন ফ্ল্যাটটা তো সাজাতে হবে। কাল একজন ইন্টেরিওর ডেকরটরের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা মান্থলি ইনস্টলমেন্টে সবকিছু করে দিতে চাইছে। এই চান্সটা আমাদের নেওয়া উচিত। তবে–
কী?
কীভাবে ঘর সাজানো হবে, ওয়ার্ডরোব খাট ডাইনিং টেবিল–এ-সব কীরকম ডিজাইনের হবে, কোন ঘরে কী রাখা হবে, তুমি বলে না দিলে ডেকরেটর কিছু করতে পারবে না। তোমার সঙ্গে ডেকরেটরের কথা হওয়া দরকার। বেস্ট হত, তুমি যদি এরমধ্যে সময় করে একদিন ফ্ল্যাটে আসতে, ডেকরেটরকেও তখন আসতে বলতাম। কবে আসতে পারবে?
ঠিক বলতে পারছি না। যাবার আগে তোমাকে ফোন করব।
ফোনটা একটু তাড়াতাড়িই কোরো।
আচ্ছা
আরেকটা কথা, অমিতাদি তোমার জন্যে ওরিড। তাঁকে একটা রিং কোরো। আজ তোমার ফোন না পেলে কাল উনি তোমাদের বাড়ি যাবেন।
অমিতাদি বাড়িতে এলে খুব ভালো লাগবে। অবশ্য আমি এক্ষুনি ওঁকে ফোন করছি।
রাখলাম—
ঠিক আছে।
এবার ইউনিভার্সিটিতে ফোন করে একবারই অমিতাদিকে পেয়ে যায় অদিতি।
সব শোনার পর অমিতাদি বলে, খুব বিপদ হল তো।
কণ্ঠস্বরে মনে হয় অমিতাদি খুবই উদ্বিগ্ন। অদিতি বলে, তা একটু তো হবেই। যা চলছে তার বিরুদ্ধে গেলে কেউ কি তা মেনে নিতে চায়? প্রবলেম যখন এসেছে তখন ফেস করব।
একটা কথা বলব অদিতি?
বলুন না—
তুমি চাঁপাকে ওদের বস্তিতে পাঠিয়ে দাও।
অদিতির মনে হয়েছিল, ঠিক এমনই কিছু একটা বলবেন অমিতাদি। আগেও তিনি এবং নারী-জাগরণ-এর আরও অনেকেই এ-জাতীয় পরামর্শ দিয়েছে। বাড়ির লোকেরা তো চাঁপাকে বের করে দেবার জন্য প্রথমদিন থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
অমিতাদির কথায় উত্তেজিত হয় না অদিতি। খুব শান্ত গলায় বলে, এখন আর তা সম্ভব না। আমি যখন ওকে বস্তি থেকে নিয়েই এসেছি, শেষপর্যন্ত দেখতে চাই।
ফাইট টু ফিনিশ?
রাইট।
একটা মেয়ের জন্যে নাহয় তুমি লড়াই করলে, কিন্তু আমাদের সোসাইটিতে চাঁপার মতো হাজার হাজার মেয়ে রয়েছে। তাদের সবার জন্যে তো এই মুহূর্তে কিছু করতে পারছ না।
এই কথাগুলোও নতুন না। আগেও কয়েকজনের মুখে শুনেছে অদিতি। সে বলে, একজনকে দিয়েই শুরু করা যাক না। যদি তেমন কিছু করে উঠতে পারি, অনেকেই এগিয়ে আসবে।