.
হাসপাতালে পৌঁছোবার পর ডাক্তারেরা এমার্জেন্সিতে ভর্তি করে নেন মৃগাঙ্ককে এবং পরীক্ষা করে জানান, প্রাণের আশঙ্কা নেই। যদিও ছুরির ফলা কাঁধের মাংসপেশীগুলোকে খুবই জখম করেছে। রক্তপাতও হয়েছে প্রচুর। অবশ্য ডাক্তারদের ধারণা, মৃগাঙ্ককে চার-পাঁচদিনের বেশি হাসপাতালে থাকতে হবে না, তার পরেই তাকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। বাড়িতে সপ্তাহখানেক রেস্ট নিলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে সে।
অদিতিরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই জ্ঞান ফিরে আসে মৃগাঙ্কর এবং তাকে এমার্জেন্সি থেকে পেয়িং বেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
এইসব করতে করতে ঘণ্টাদুয়েক কাটে। তারপর একটা ট্যাক্সি করে মীরা আর হেমলতাকে নিয়ে বরুণ বাড়ি ফিরে যায়। রমাপ্রসাদ এবং অদিতি আদ্যোপান্ত জানিয়ে নগেনের নামে ডায়েরি করিয়ে বলে, লোকটা খুবই বিপজ্জনক।
তরুণ পুলিশ অফিসারটি বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, নগেনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যারেস্ট করা হবে।
অদিতি বলে, ধন্যবাদ। আপনার এখান থেকে আমি কি একটা ফোন করতে পারি?
নিশ্চয়ই। ব্যস্তভাবে টেলিফোনটা অদিতির দিকে এগিয়ে দেয় পুলিশ অফিসার।
বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে পুলিশ অদিতিদের বাড়ি যাবার পর কী হল না হল, সব জানিয়ে দিতে বলেছিল সৈকত। সে নিশ্চয়ই উগ্রীব হয়ে আছে। ডায়াল ঘুরিয়ে লালবাজারে কানেকশান পেয়ে যায় অদিতি। লাইনের ওধার ধেকে সৈতকের গলা ভেসে আসে, হ্যালো
অদিতি বলছি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।
পুলিশ আসার পর এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব বলে গেল অদিতি।
সৈকত বলে, আগে যে ফোন করেছিলে তখন একটা কথা মনে হয়নি
কী?
নগেন তোমাদের বাড়ির ঠিকানা পেল কোথায়?
একটু চিন্তা করে অদিতি বলে, জানি না। তবে মনে হচ্ছে, ও আরও একবার নারী-জাগরণ-এর অফিসে গিয়েছিল। ওখানে যে কাজের লোকটা থাকে তাকে ভয় দেখিয়ে ঠিকানাটা নিয়েছে। কিংবা অন্য কারও কাছ থেকেও জোগাড় করতে পারে।
সৈকত বলে, যাইহোক, লোকটা খুবই ডেসপারেট। অবশ্য ওকে অ্যারেস্ট করতে অসুবিধে হবে না। যদি দরকার হয়, পরে আমাকে ফোন কোরো।
আচ্ছা।
খুট করে একটা শব্দ হল। সৈকত ফোন নামিয়ে রেখেছে।
৪. বাড়ির আবহাওয়া থমথমে
০৯.
বিয়ের ব্যাপারে অদিতি সিতাংশুকে নাকচ করে দেবার পর থেকেই বাড়ির আবহাওয়া থমথমে হয়ে গিয়েছিল। নগেন মৃগাঙ্ককে ছুরি মারলে সেটা একেবারে বিস্ফোরণের পর্যায়ে চলে আসে। এই ঘটনার জন্য মৃণালিনীকে বাদ দিলে বাড়ির প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে মীরা আঙুল তুলে অদিতিকেই দায়ী করছে। শুধু তাই না, মা বাবা বড়দা এবং বউদিরা দিনরাত সমস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, চাঁপাকে বের করে দিতে হবে। সে এখানে থাকলে বাড়ির লোকেদের যে আরও মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে, এতে কারও এতটুকু সংশয় নেই। উটকো ঝামেলা ঘরে পুষে রেখে নিজেদের অকারণে বিপন্ন করতে কে-ই বা চায়?
প্রচণ্ড জেদে গোটা বাড়ির বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যায় অদিতি। যত চাপই আসুক, চাঁপাকে কিছুতেই তাড়িয়ে দিতে পারবে না। সে এ বাড়িতেই থাকবে।
অদিতি বোঝাতে চেষ্টা করে, কেন তোমরা এত ভয় পাচ্ছ? লালবাজারে আমি কথা বলেছি, খুব শিগগিরই নগেনকে অ্যারেস্ট করা হবে। তাছাড়া দরকার হলে আমাদের বাড়িতে আমর্ড গার্ডের ব্যবস্থা করা যাবে।
রমাপ্রসাদ বলেন, তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমাদের আত্মীয় না, স্বজন না, চেনা-জানাও না, এমন একটা মেয়ের জন্য ফ্যামিলি পিস ডিসটার্বড় হোক, এটা আমি একেবারেই চাই না। তুই ওকে যেখান থেকে এনেছিস সেখানে দিয়ে আয়।
অদিতি বলে, না, কিছুতেই না। তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ফুটে বেরোয়।
হেমলতা বলেন, খুব বাড়াবাড়ি করছিস বুবু।
যে মায়ের গলা কোনোদিন কোনো কারণেই একটা বিশেষ সীমারেখার ওপর ওঠে না, হঠাৎ তাকে এভাবে বলতে দেখে হকচকিয়ে যায় অদিতি। সে বলে, মা, আমি একটা মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করছি। তুমি একে বাড়াবাড়ি বলছ।
হেমলতা বলেন, ওকে বাঁচাতে গিয়ে যদি আমাদের কারও সর্বনাশ হয়ে যায়, সেটা কিছুতেই মানব না। ছুরিটা বাবলুর কাঁধে না লেগে বুকে লাগলে কী হত, আগে তার জবাব দে।
অদিতি বুঝতে পারছিল, মৃগাঙ্ককে ছুরি মারার ঘটনায় হেমলতা ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এটা মায়ের আশঙ্কা এবং আবেগের ব্যাপার! যুক্তি-তর্ক বা সামাজিক দায়িত্ববোধের ব্যাপারগুলো তাঁর মাথায় কিছুতেই ঢোকানো যাবে না। ছেলেমেয়ে বা স্বামীর নিরাপত্তা তাঁর কাছে সবার ওপরে। সেখানে অন্য সমস্ত কিছুই তুচ্ছ।
অদিতি জানে সে বাড়ি থেকে বেরুলেই চাঁপাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তাই একটি মুহূর্তের জন্যও সে বাইরে যাচ্ছে না। সারাক্ষণই চাঁপাকে আগলে আগলে রাখছে।
কিন্তু সে একটা চাকরি করে। ইচ্ছেমতো কলেজে ছুটি নিলে চলে না। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা এসে যাচ্ছে। অনার্সের কোর্স অর্ধেকটাই পড়ানো হয়নি। হাতে আর আছে মাত্র ছটি মাস। এর ভেতরে পুরো কোর্স শেষ করে দিতে হবে। রেগুলার ক্লাস ছাড়াও টিউটোরিয়াল ক্লাসগুলো রয়েছে। এখন একটা দিনও কলেজে না গেলে ছেলেমেয়েদের দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে।
তবু দুটো দিন চাঁপাকে নিয়েই রইল অদিতি। কিন্তু আজ সকালে প্রিন্সিপ্যাল পাশের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছেন, অদিতি যেন অবশ্যই কলেজে আসে। দু-দিন ক্লাস না হওয়ায় ছেলেমেয়েরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারা প্রিন্সিপ্যালের ঘরে এসে খুব হইচই করেছে।