অদিতি চাঁপার একটা হাত ধরে মৃণালিনীর ঘরে নিয়ে আসে। বলে, পিসি, ও তোমার কাছে রইল। আমি আসছি।
মৃণালিনী বোমার আওয়াজ এবং হল্লা শুনে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। বলেন, নীচে কী হচ্ছে রে বুবু? কারা বোমা ফাটাচ্ছে?
পরে এসে বলব। এখন দাঁড়াবার সময় নেই। একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে অদিতি।
পাশের বাড়ি গিয়ে একবার ডায়াল করতেই সৈকতকে পাওয়া যায়। সৈকত রীতিমতো অবাক, আরে তুমি! কতদিন পর তোমার গলা শুনলাম! ভালো আছ?
অদিতি বলে, ফিজিকালি অলরাইট। একটা বিপদে পড়ে তোমাকে ডিসটার্ব করছি ভাই-
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে চমকে ওঠে সৈকত। সেই চমকের রেশ টেলিফোনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসে যেন, কী হয়েছে।
দলবল নিয়ে নগেন কীভাবে ঝামেলা করছে, সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, কিছু একটা ব্যবস্থা করো সৈকত।
ব্যস্তভাবে সৈকত বলে, হা হা, নিশ্চয়। তুমি লাইনটা ছেড়ে দাও। আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ফোন করে দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে যাবে। তোমাদের বাড়ি অ্যাড্রেসটা দাও–
ঠিকানা জানিয়ে দেয়, অদিতি।
সৈকত এবার বলে, ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন করে কী হল, না-হল, খবরটা দিও। ডোন্ট ওরি–
ফোন নামিয়ে পাশের বাড়ি থেকে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে নিজের বাড়ির গেটের দিকে যেতে যেতে থামকে দাঁড়ায় অদিতি।
ওখানে তুলকালাম ব্যাপার চলছে এই মুহূর্তে।
মৃগাঙ্ক নগেনের গলার কাছটা জামাসুদ্ধ চেপে ধরে চিৎকার করছে, বাস্টার্ড, তোমার চামড়া গুটিয়ে ছাড়ব। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি
নগেনের মাথাতেও খুন চেপে গেছে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় সে বলে, শালা! অন্যের মেয়েছেলেকে ঘরে পুরে রেখে ভদ্দরলোক সেজেছে! ভদ্রলোকের আমি–এরপর জঘন্য একটা খিস্তি করে সে।
তোমার মুখ আমি তুবড়ে দেব শুয়োরের বাচ্চা।
যা যা মাকড়া! তোর মতো তুবড়ে দেনেবালা আমি বহুত দেখেছি! নিজের ভালো চাইলে চাঁপাকে বার করে দে! নাইলে
একটা বাজে অ্যান্টিসোশাল তাকে তুই-তোকারি করছে। মাথায় রক্ত ফুটতে থাকে মৃগাঙ্কর। ঝাঁপিয়ে পড়ে নগেনের গলা টিপে ধরে সে, নইলে কী?
আবার ঝাড়া মেরে মৃগাঙ্কর হাতটা আলগা করে করে দেয় নগেন। বলে, তোমার লাইফ কিচাইন হয়ে যাবে। আমাকে তুমি চেনো না শালা!
এদিকে বরুণ চেঁচাচ্ছিল, এই জানোয়ারেরা ভাগ এখান থেকে
রমাপ্রসাদও হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো চিৎকার করছিলেন। নগেনের সঙ্গে যারা এসেছে তারাও সমানে চিৎকার এবং খিস্তি করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় বোমা ফটাচ্ছে।
এদিকে মৃগাঙ্ক আবার নগেনের দিকে দৌড়ে যায় এবং উন্মত্তের মতো তার মুখে ঘুষি চালিয়ে দেয়।
নগেনের নাক-মুখ ভেঙেচুরে রক্তাক্ত মাংসের দলা হয়ে গেল। লাট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজের রক্ত দেখে খুন চড়ে যায় তার। চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। কোমরের কাছ থেকে লিকলিকে একটা ছোরা বের করেই মৃগাঙ্কর গায়ে বসিয়ে দেয় নগেন।
আতঙ্কে রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং অনেকটা দূরে অদিতি চেঁচিয়ে উঠেছিল। মৃগাঙ্ক ক্ষিপ্র একটি মোচড়ে শরীরটাকে বাঁ দিকে হেলিয়ে দেয়। যদিও তার বুক ছিল নগেনের টার্গেট, সেখানে না-বসে ছোরার ফলা মৃগাঙ্কর কাঁধে গেঁথে যায় এবং গরম তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।
মৃগাঙ্কর শরীর মুহূর্তে কুঁকড়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে হাত দুটোয় মুঠো পাকিয়ে যন্ত্রণা সামলাতে চেষ্টা করে সে কিন্তু পারে না। এক সময় হাত-পায়ের জোর আলগা হয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে যায় সে।
হল্লা এবং বোমার আওয়াজে চারদিকের বাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু ভয়ে কেউ এগুতে পারছে না। অন্যের জন্য অকারণে কে আর ঝুঁকি নিতে চায়?
বরুণ আর রমাপ্রসাদ মৃগাঙ্কর দিকে দৌড়ে যায়। অদিতি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মৃগাঙ্কর এই পরিণতির যাবতীয় দায়িত্ব যে তারই, সেটা মেনে নিয়েই উদ্ভ্রান্তের মতো সে এগিয়ে যায়।
এদিকে ছুরি মারায় একটু থমকে গিয়েছিল নগেন। হঠাৎ অদিতিকে দেখে সে কিছু বলতে যাবে, পুলিশের একটা কালো ভ্যান কর্কশ আওয়াজ করে গেটের সামনে এসে ব্রেক কষে।
তৎক্ষণাৎ নগেন এবং তার গ্যাংটা উধাও হয়ে যায়।
ছজন আর্মড কনস্টেবল সঙ্গে করে একজন অল্পবয়সি অফিসার ভ্যান থেকে নেমে মৃগাঙ্ককে দেখতে দেখতে বলে, কে এঁকে স্ট্যাব করল?
ছুরি মারার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে হেমলতা, মীরা এবং বন্দনা পাগলের মতো বেরিয়ে এসেছিল। তারা রক্তাক্ত বেহুশ মৃগাঙ্ককে পড়ে থাকতে দেখে বুক-ফাটা কান্না জুড়ে দেয়।
হাজার বিপদেও ধৈর্য হারায় না অদিতি। সে পুলিশ অফিসারকে একধারে ডেকে বলে, যাঁকে স্ট্যাব করা হয়েছে উনি আমার ছোটদা। পরে আপনাকে সব বলব, আপনি ছোটদাকে নিয়ে আগে কোনো হসপিটালে চলুন।
মৃগাঙ্ককে ধরাধরি করে ভ্যানে তোলা হয়। তার সঙ্গে বন্দনা, মীরা, রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং অদিতিও ওঠে। আর হেমলতা, মীরাকে বোঝানো হয়েছিল, পরে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে, কিন্তু তাদের ভ্যান থেকে নামানো যায়নি।
হাসপাতাল পর্যন্ত সারাটা পথ হেমলতা নিঃশব্দে কেঁদে যান। কিন্তু মীরা পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে এবং মৃগাঙ্কর এই অবস্থার জন্য যে অদিতিই একমাত্র দায়ী, সেটা কান্না-জড়ানো ভাঙা ভাঙা গলায় একনাগাড়ে বলে যায়।