কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর অদিতি এভাবে শুরু করে, বাবা, আমার সঙ্গে তোমাদের কী জরুরি কথা যেন ছিল–
সুর কেটে গিয়েছিল। রমাপ্রসাদ ক্লান্ত গলায় বলেন, আজ থাক, কাল শুনিস—
আমি তা হলে এখন ওপরে যাই।
রমাপ্রসাদ উত্তর দেয় না।
অদিতি আর বসে না, চাঁপাকে নিয়ে তেতলায় চলে যায়
.
০৮.
পরদিন সকালে সবে রোদ উঠেছে, একটানা বোমার আওয়াজে অদিতিদের নিরিবিলি অভিজাত পাড়াটা হকচকিয়ে যায়। এই অঞ্চলটা কলকাতার ভেতরে থেকেও যেন কলকাতার বাইরে একটা প্রায় নির্জন দ্বীপ বা লেগুনের মতো। এখানকার চিরস্থায়ী শান্তি চুরমার করে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি।
খুব ভোরে ওঠা অদিতির বহুকালের অভ্যেস। সে যখন ওঠে, এ-বাড়ির কারোর ঘুম ভাঙে না। তেতলায় তার নিজের ঘরটিতে হিটার এবং চা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম রয়েছে। মুখটুখ ধুয়ে এসে এক কাপ করে নেয় সে, তারপর টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। এই সময়টা হয় পড়াশুনো বা লেখালেখি কিছু করে, নইলে ছাত্রছাত্রীদের খাতা দেখে।
আজ দুকাপ চা করে নিয়েছিল অদিতি। এক কাপ নিজের জন্য, দ্বিতীয় কাপটা চাঁপার।
চা খেতে খেতে অদিতি ক্লাস টেস্টের খাতা দেখছে, আর চাঁপা রাস্তার দিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়ির সামনে এবং পেছনে ঝুপসি গাছপালার মাথায় তুমুল হই-চই বাঁধিয়ে অগুন্তি পাখি উড়ছে। দূরের রাস্তা দিয়ে ক্কচিৎ ক্যালকাটা মিল্ক সাপ্লাইয়ের দু-একটা ভ্যান কিংবা রিকশা চলেছে। আর দেখা যাচ্ছে খবরের কাগজওলাদের। ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল ছুটিয়ে তারা এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঢুকে পড়ছে। কাগজ ফেলে দিয়ে আবার দৌড়।
এমন এক উত্তেজনাশূন্য শান্ত সকালে এইরকম একটি পাড়ায় বোমা ফাটানোর মতো মারাত্মক ব্যাপার ঘটতে পারে, এখানকার বাসিন্দাদের কাছে তা অভাবনীয়। বোমার আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে উত্তেজিত চিৎকারও ভেসে আসছে।
খাতা দেখতে দেখতে চমকে উঠে অদিতি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চাঁপার ভয়ার্ত গলা শোনা যায়, দিদি
দ্রুত ঘুরে বসতেই অদিতি দেখতে পায়, চাঁপা প্রায় কাঁপছে। সে এতই সন্ত্রস্ত যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
অদিতি জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?
জানলার দিকে আঙুল বাড়িয়ে শিথিল গলায় চাঁপা বলে, ওরা–ওরা এসেছে।
বোমা ফাটিয়ে হল্লা করতে করতে কারা এভাবে হানা দিতে পারে, মুহূর্তে আন্দাজ করে নেয় অদিতি। চেয়ার থেকে উঠে এক দৌড়ে রাস্তার দিকের জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। যা ভেবেছিল তা-ই। তাদের বাড়ির গেটটার ঠিক বাইরে প্রচণ্ড উত্তেজিত ভঙ্গিতে আট-দশটা চোয়াড়ে হুলিগান ধরনের লোক সমানে চেঁচাচ্ছে আর মাঝে মাঝে দু-একটা বোমা ফাটাচ্ছে। ওদের ভেতর নগেনকে দেখতে পাওয়া যায়।
একসঙ্গে চিৎকার করে তারা কী বলছে, কিছুই প্রায় বোঝা যায় না। তবে অকথ্য খিস্তিখেউড় যে দিচ্ছে, তাদের অঙ্গভঙ্গি থেকেই সেটা টের পাওয়া যায়।
নগেনরা যে এতদূরে এসে সকালবেলা চড়াও হবে, ভাবতে পারেনি অদিতি। বাড়িতে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তার একটা পরিষ্কার ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে অদিতির। প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে যায় অদিতি। পরক্ষণেই অসহ্য রাগে তার মাথায় বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। একটা অ্যান্টিসোশাল ক্রিমিনালের এত বড় সাহস যে তাদের বাড়ির সামনে এসে বোমা ফাটয়ে খিস্তি করছে।
তাদের ব্যাচমেট সৈকত আই.পি.এস হয়ে এখন লালবাজারে পোস্টেড। অদিতি ঠিক করে ফেলে এখনই তাকে ফোন করে পুলিশ পাঠাতে বলবে।
আগে এ-বাড়িতে ফোন ছিল। বিল দিতে না পারায় অনেক দিন আগেই ক্যালকাটা টেলিফোনের লোকেরা লাইন কেটে দিয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে অবশ্য ফোন আছে। তেমন জরুরি ব্যাপার হলে ওখানে চলে যায় অদিতি। ওরা খুবই ভদ্র, আপত্তি করে না।
যেভাবে নগেনরা হামলা করছে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এখন যাওয়া ঠিক হবে না। পেছন দিয়ে সরু একটা প্যাসেজ রয়েছে, ওই দিক দিয়েই যাবে অদিতি।
চাঁপা বলে, কী হবে দিদি?
অদিতির মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, কী আবার হবে! নগেনকে ঢিট করার ব্যবস্থা করছি। আমি একটা ফোন করে আসি। তুমি এঘর থেকে একেবারে বেরুবে না। একটু ভেবে বলে, ঠিক আছে, তোমাকে পিসির কাছে দিয়ে যাই। কাল রাত্তিরেই তেতলায় এসে মৃণালিনীর সঙ্গে চাঁপার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল অদিতি।
চাঁপা যেন তার কথা শুনতে পাচ্ছিল না। অপরাধীর মতো মুখ করে সে বলে, আমার জন্যে আপনি কী বিপদে পড়লেন বলুন তো। একটা কথা বলব?
কী?
আমি বরঞ্চ ওর সনগে চলেই যাই। আমার কপালে যা আছে তা-ই হোক। চাঁপার মুখ দেখে মনে হয়, তার ভেতরকার সব শক্তি এবং সাহস একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
না। প্রায় ধমকের গলায় বলে ওঠে অদিতি, এসো আমার সঙ্গে।
কিন্তু যাওয়া আর হয় না। তার আগেই চোখে পড়ে, মৃগাঙ্ক এবং বরুণ বাড়ির ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে গেটের দিকে যাচ্ছে। দুজনেই, বিশেষ করে করে মৃগাঙ্ক দারুণ গোঁয়ার। কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রচুর মারদাঙ্গা করেছে। পুলিশে ওর নামে রিপোর্টও হয়েছিল বারকয়েক।
দুই দাদার পর রমাপ্রসাদকেও গেটের দিকে যেতে দেখা যায়। বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না, কোমরে বহুদিনের আর্থরাইটিস, হার্টের অবস্থাও বেশ খারাপ। বিপজ্জনক কিছু একটা ঘটে যেতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। তার আগেই লালবাজারে সৈকতকে ফোনটা করা দরকার।