অদিতি একটি মেয়েকে ডেকে স্মারকলিপির খসড়াটা তার হাতে দেয়। সে পাশের ঘরে টাইপ করতে চলে যায়।
অমিতাদি এবার অন্য একটি মেয়েকে বলেন, ইন্দ্রাণী, তুমি বাইরে গিয়ে একটু দেখো তো, ওদের পোস্টার লেখা হয়ে গেছে কিনা।
একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, এবং কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে খবর দেয় পোস্টার লেখা শেষ করে সবাই অপেক্ষা করছে।
কৃষ্ণার টাইপ হয়ে গিয়েছিল। সে নারী-জাগরণ-এর একটা খাম এবং মেমোরেন্ডমটা নিয়ে এসে অমিতাদির হাতে দেয়। অমিতাদি দ্রুত একবার টাইপ-করা জায়গাটা দেখে, খামে পুরে মুখটা বন্ধ করে দেন। তারপর বলেন, অদিতি, কৃষ্ণা–এবার ওঠা যাক। অনেকটা রাস্তা আমাদের যেতে হবে। একজন গিয়ে দারোয়ানকে বলো, সে যেন অফিস বন্ধ করে দেয়।
নারী-জাগরণ-এর অফিসে একজন দারোয়ান এবং দুটি বেয়ারা রয়েছে। কম্পাউন্ডের পেছনদিকে যে সার্ভেন্টস্ কোয়ার্টাস আছে, তারা সেখানে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অদিতি বলল, আমি কিন্তু আপনাদের সঙ্গে মিছিলে যাচ্ছি না অমিতাদি।
অমিতাদি রীতিমতো অবাকই হন। বলেন, কেন?
আজ ঢাকুরিয়ার বস্তিতে যাবার প্রোগ্রাম আগে থেকেই কিন্তু ঠিক করা আছে। ওখানে খবরও পাঠানো হয়েছে। বস্তির মেয়েরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
আপাতত নারী-জাগরণ-এর একটা বড় কাজ হল, কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সেখানকার মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিক দিক থেকে তারা কোন লেভেলে পড়ে আছে সে ব্যাপারে পুত্থানাপুঙ্খ খবর সংগ্রহ করে মোটা মোটা ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। পরে এদের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বস্তিবাসী মেয়েদের সমস্যা এতই জটিল, বিশাল এবং সুদূরপ্রসারী যে নারী-জাগরণ-এর মতো একটি ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কিছুই প্রায় করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি আর বে-সরকারি সাহায্য একান্ত জরুরি।
নারী-জাগরণ-এর তরফ থেকে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট আর মিনিস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। অমিতাদি, অদিতি এবং আরও কয়েকজন চারটি চেম্বার অফ কর্মাসের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করেছেন। সব জায়গাতেই ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। সকলেই অসহায় মেয়েদের সম্পর্কে সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন, সঠিক প্রস্তাব পাওয়া গেলে তাঁরা অবশ্যই সাহায্য করবেন।
অমিতাদির মনে পড়ে যায়। তিনি বলেন, বউ পোড়ানোর এই ঘটনাটা নিয়ে এতই ডিসটার্বড় হয়ে ছিলাম যে ঢাকুরিয়ার প্রোগ্রামটার কথা মনে ছিল না। ঠিক আছে, তুমিই যাও। তোমার সঙ্গে আর কে কে যাবে?
ঘরের কোণে একটি ঝকঝকে চেহারার যুবক বই থেকে কিছু নোট করছিল। সে মুখ তুলে বলে, আমি অদিতির সঙ্গে যাব।
অমিতাদি হেসে বললেন, জানি বিকাশ। অদিতি যেখানে যাবে, তুমিও সঙ্গে থাকবে। তাঁর হাসিতে প্রশ্রয় এবং মজা দুই-ই রয়েছে।
বিকাশ বিব্রত মুখে বলে, না, মানে
অমিতাদি এবার জিগ্যেস করলেন, দুজনে তো হবে না। তোমাদের সঙ্গে কৃষ্ণা, রমেন আর এষা যাক। বলেই গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, রমেন, এষা, এ ঘরে এসো
পাশের ঘর থেকে রমেন এবং এষা এঘরে চলে আসে। দুজনেরই বয়েস তিরিশের নীচে।
রমেন একটা ব্যাঙ্কে জুনিয়র গ্রেডের অফিসার। গোলগাল ভালোমানুষ চেহারা। এই মুহূর্তে তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি।
এষা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে উঁচু ক্লাসে ফিজিক্স পড়ায়। পোশাকের ব্যাপারে সে বেপরোয়া। তার পরনে জিন্স এবং টি-শার্ট, পায়ে পুরুষদের চম্পল। চুলে বয়েজ-কাট। পোশাকে এবং চালচলনে পুরুষদের সঙ্গে কোনোরকম পার্থক্যই সে রাখতে চায় না। দারুণ স্মার্ট আর ঝকঝকে চেহারা। অমিতাদির মতো চেইন স্মোকার না হলেও সিগারেটটা একটু বেশিই খায়। অবশ্য এই মুহূর্তে তার হাতে সিগারেট নেই।
অমিতাদি এষা এবং রমেনকে বললেন, আজ ঢাকুরিয়া বস্তিতে আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে। অদিতি আর বিকাশের সঙ্গে তোমাদের দুজনকে সেখানে যেতে হবে।
দুজনেই জানায়, বস্তিতে যেতে তাদের আপত্তি নেই।
অদিতি এষাকে লক্ষ্য করতে করতে হঠাৎ বলে ওঠে, এষা না গেলেই ভালো হয়।
অমিতাদি ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, কেন?
অদিতি যা উত্তর দেয় তা এইরকম। তারা যেখানে যাচ্ছে, এষার মতো পুরুষালি পোশাক এবং চুলের ছাট সেখানে একেবারেই খাপ খায় না। বস্তির মেয়েরা এতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। শামুকের মতো নিজেদের গুটিয়ে রাখবে। তারা যদি সহজভাবে কাছে এগিয়ে না আসে, তাদের সমস্যার কথা জানা যাবে কী করে?
এষা বিরক্ত হচ্ছিল। সে কিছুটা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ওরা শুধু আমার চুলের কাট আর জিন্স-টিন্স নিয়েই মাথা ঘামাবে? ওদের সম্পর্কে আমার সিম্প্যাথি আর সিনসিয়ারিটির কথা ভাববে না?
অদিতি কোনো কারণেই সহজে উত্তেজিত হয় না। শান্ত মুখে সে বলে, বস্তি নিয়ে আমি বছরখানেক কাজ করছি। ওখানকার মেয়েদের সাইকোলজি খানিকটা বুঝি। এমনভাবে ওখানে যাওয়া উচিত যাতে ওরা মনে করে আমরা ওদেরই লোক। না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
এষা ঝাঁঝালো মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন অমিতাদি। অদিতি কী বলতে চেয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তাঁর। বলেন, ঠিক আছে, এষা আমাদের সঙ্গে চলুক। চিফ-মিনিস্টারের হাতে মেমোরান্ডমটা ও-ই দেবে। অদিতি, তুমি যাকে সুটেবল মনে করো, নিয়ে যাও।