ছোট বউদি মীরা একধারে বসে হেমলতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগামী শীতের কথা মাথায় রেখে একটা কার্ডিগান বুনছে।
একটু দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে অদিতি। প্রথমে সে ভেবেছিল, চাঁপাকে নিয়ে সোজা তেতলায় নিজের ঘরে চলে যাবে এবং পরে এসে তার কথা সবাইকে জানাবে। কিন্তু এখন ঠিক করে ফেলে, আগেই চাঁপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তার এ বাড়িতে থাকার কথা বলবে। তারপর ওপরে নিয়ে যাবে।
অদিতি চাঁপাকে বলে, এসো আমার সঙ্গে
দুজনে বারান্দায় এলে হেমলতা এবং মীরা চোখ তুলে তাকায়। মীরার মুখ মুহূর্তে থমথমে হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ এক হেঁচকায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয় সে এবং দুমদাম পা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। কাল রাতের সেই উত্তেজক ঘটনার পর মীরা তার সঙ্গে কথা বলছে না।
হেমলতা অদিতির সঙ্গে একটি অচেনা বিবাহিত মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ঘুচ-সুতো আর জামা নীচে নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে বলেন, মেয়েটি কে রে?
অদিতি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। মুখ ফেরাতেই অদিতির চোখে পড়ে, একসঙ্গে দুটো-তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে রুদ্ধশ্বাসে তেতলায় চলে গেল দুর্গা। একটু পরে বরুণ, মৃগাঙ্ক এবং রমাপ্রসাদ উঠে এসে সোজা দোতলায় চলে আসেন।
রমাপ্রসাদ বেশ নরম গলায় অদিতিকে বলেন, খানিকক্ষণ আগে তোকে আসতে দেখলাম। আজ তোর মুড কেমন আছে রে বুবু?
এসব কীসের ভূমিকা, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে অদিতি। বাবা বা দাদারা খুব সম্ভব স্ট্র্যাটেজিটা পালটে ফেলেছে। সে ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে যায়। বলে, এখনও পর্যন্ত ভালোই আছে। এরপর যদি তোমরা খারাপ করে দাও, আলাদা কথা—
তোর সঙ্গে একটা কাজের কথা ছিল বলতে বলতে হঠাৎ চাঁপার দিকে নজর চলে যায় রমাপ্রসাদের। কপালটা সমান্য কুঁচকে যায় তার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাঁপাকে দেখতে দেখতে বলেন, মেয়েটিকে তো চিনলাম না।
অদিতি বলে ওর নাম চাঁপা।
তা এখানে—
আমি ওকে নিয়ে এসেছি।
কিছুই বুঝতে পারছিলেন না রমাপ্রসাদ। রীতিমতো অবাক হয়েই জিগ্যেস করেন, হঠাৎ?
অদিতি বলে, তোমরা বসো। ওর কথা তোমাদের শোনা দরকার।
রমাপ্রসাদ বলেন, মেয়েটির কথা পরে শোনা যাবে। ও অন্য কোথাও একটু বসুক। তোর সঙ্গে আমাদের আলোচনাটা আগে সেরে নিই।
অদিতি প্রায় জেদই ধরে, না। চাঁপার ব্যাপারটা ভীষণ জরুরি। এটা ওর লাইফ অ্যান্ড ডেথের প্রশ্ন।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রমাপ্রসাদ বলেন, ঠিক আছে, তুই যখন না-শুনিয়ে ছাড়বি না তখন বল
বারান্দার এধারে-ওধারে কয়েকটা বেতের মোড়া এবং চেয়ার-টেয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেগুলো টেনে এনে রমাপ্রসাদরা বসে পড়েন। অদিতিও বসে। কিন্তু চাঁপাকে বসতে বললেও সে একধারে দেয়ালের গায়ে সেঁটে একেবারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
কাল নারী-জাগরণ-এর তরফ থেকে বস্তিতে সমীক্ষা চালাতে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত চাঁপাকে নিয়ে যা যা ঘটেছে, সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, ওকে বাড়িতে না-নিয়ে এসে আমার উপায় ছিল না বাবা। তোমরাই ভেবে দেখো, মেয়েটাকে আমরা জানোয়ারের হাতে তুলে দিতে পারি না।
ষাট-সত্তর বছরের এই পুরোনো বাড়িটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপরেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃগাঙ্ক বলে, এটা কি ধর্মশালা যে তাকে শেলটার দিতে হবে?
বরুণও তীব্র গলায় বলে, সব ব্যাপারের একটা সীমা আছে। বস্তি থেকে একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এল। এর দায়িত্ব কে নেবে?
রমাপ্রসাদ অবশ্য কিছু বলেন না। মুখচোখ দেখে টেরে পাওয়া যায়, তার আর্থারাইটিসের যন্ত্রণাটা হঠাৎ চাড়া দিয়ে উঠেছে।
চাঁপার কথা বললে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে, অদিতির সে সম্পর্কে ধারণা ছিল। সে আদৌ উত্তেজিত হয় না। অত্যন্ত শান্ত মুখে বলে, তোমাদের কাউকেই ওর দায়িত্ব নিতে হবে না। তা ছাড়া চাঁপা থাকবে আমার ঘরে। সেখান থেকে ও বেরুবে না। বাইরে যাবার দরকার হলে আমিই ওকে নিয়ে যাব। কোনোভাবেই ও কাউকে ডিসটার্ব করবে না।
বরুণ বলে, তুমি রোজগার করো, ওকে খেতে দিতে পারবে। সবই জানি। তবু ওর এ-বাড়িতে থাকা চলবে না।
মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে অদিতির, কেন? কিছুদিন আগে দিল্লি থেকে তোমার এক পাঞ্জাবি বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে এসে যখন দেড়মাস থেকে গেল তখন আমি তো আপত্তি করিনি।
কাদের সঙ্গে কার তুলনা করছিস। তারা বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
চাঁপাকে তুমি অভদ্র ধরে নিলে কী কারণে? বস্তিতে থাকে বলে?
বরুণ বলে, একজাকটলি। এদের নানারকম ঝামেলা থাকে। তা ছাড়া ওই টাইপের হুলিগান যার হাজব্যান্ড তাকে নিয়ে অনেক প্রবলেম। পরে ঝঞ্ঝাট হলে কে সে-সব সামলাবে।
অদিতি বলে, এ নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না।
মৃগাঙ্ক ওধার থেকে বলে, যে-ই দায়িত্ব নিক, এ-বাড়িতে ওইরকম একটা মেয়েকে থাকতে দিতে আমার অন্তত আপত্তি আছে। আই ডোন্ট লাইক ইট।
অদিতি এবার রমাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা, তোমার কী মত?
রমাপ্রসাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তিনি কাতর গলায় বলেন, ওরা যখন চাইছে না তখন
বাবাকে দেখতে দেখতে স্তম্ভিত হয়ে যায় অদিতি। সে এম.এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, একটা বড় কলেজের নামকরা অধ্যাপিকা, তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা রয়েছে। সাংসারিক খরচের অনেকটাই সে দিয়ে থাকে। অথচ বাবার কাছে অদিতির সামাজিক দায়িত্ববোধের চেয়ে দুই জুয়াড়ি ছেলের মতামতের দাম অনেক বেশি। অদিতির মন বিষাদে ভরে যায়। সে বলে, তার মনে তোমারও আপত্তি আছে। কিন্তু তোমরা যাই ভাবো, যতদিন কিছু ব্যবস্থা নাহয় চাঁপা এখানে থাকবে।