অন্যমনস্কর মতো মাথাটা সামান্য কাত করে অদিতি, হ্যাঁ।
বলো–বিকাশ উদগ্রীব হয়ে তাকায়।
কাল বলছিলে, তোমার ফ্ল্যাটটার পজেশান শিগগিরই পেয়ে যাবে
হ্যাঁ।
এক উইকের মধ্যে পাওয়া কি সম্ভব?
চেষ্টা করতে পারি। কেন বলোতো?
অদিতি বলে, মনে হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি আমাকে একটা ডিসিশান নিতে হতে পারে।
শোনার পরও ব্যাপারটা বিকাশের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সে। তার পরই টের পায় বুকের ভেতর হাজারটা ঘোড়া যেন ছুটে যাচ্ছে। মনে হয়, প্রবল রক্তচাপে তার হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে যাবে। প্রবল আগ্রহে তার চোখ মুখ ঝকমক করতে থাকে। সে বলে সত্যি!
অদিতির চোখে মুখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শান্ত নিস্পৃহ মুখে সে বলে, হ্যাঁ।
অদিতির এই একটি কথা শোনার জন্য কতদিন উন্মুখ হয়ে আছে বিকাশ। এমনকী কালও রাত্তিরে যখন অদিতিকে তাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় তখনও সে মনস্থির করে উঠতে পারেনি। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর হঠাৎ কী এমন ঘটে গেল যাতে তাকে এরকম স্পষ্ট একটি সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে?
যাই ঘটুক তা নিয়ে বিকাশের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। অদিতি যে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে তাতেই সে খুশি।
আসলে বিকাশ যে নারী-জাগরণ-এর মেম্বার হয়েছিল তার একমাত্র কারণ অদিতি। মেয়েরা যে অনবরত লাঞ্ছিত হচ্ছে বা তাদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে, এসব নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না সে। নারীর মর্যাদা রক্ষার নৈতিক এবং সামাজিক দায় যে প্রতিটি শিক্ষিত সচেতন মানুষের থাকা উচিত, এমন কোনো বোধ তার মধ্যে বিশেষ নেই। তার লক্ষ্য শুধুই অদিতি। এতকাল পর সে তার ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার দাম পেতে চলেছে।
বিকাশ বলে, তাহলে তো
কী? নিরুৎসুক সুরে জিগ্যেস করে অদিতি।
ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে নোটিশ দিতে হয়।
এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
ঠিক আছে। বিকাশ বলতে থাকে, হাউসিং বোর্ডে আমার কিছু জানাশোনা অফিসার আছে। কালই তাহলে ফ্ল্যাটটার ব্যাপারে তাদের ধরা যাক, না কী বলো
অদিতি উত্তর দেয় না। কেন না যা বলার আগেই বলে দিয়েছে। এক কথা বার বার বলা সে পছন্দ করে না।
হঠাৎ কিছু মনে পড়তে গলা অনেকটা নামিয়ে বিকাশ চাপা গলায় বলে, চাঁপাকে তো নিয়ে এলে। তার কী হবে?
হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে বিকাশের দিকে তাকায় অদিতি। আস্তে করে বলে, কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে।
এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না বিকাশ।
একসময় ওরা বড় রাস্তায় চলে এল এবং কালকের মতো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল।
আধ ঘণ্টা পর অদিতিদের বাড়ির কাছে চাঁপা এবং অদিতিকে নামিয়ে দিয়ে বিকাশ ভবানীপুর চলে যায়।
.
০৭.
সামনের ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই একতলার বসার ঘরে সিতাংশু ভৌমিকের চড়া গলায় শাসানি কানে আসে।
আপনাদের একমাস সময় দিচ্ছি। এর ভেতর আমার টাকাটা শোধ করে দেবেন না। হলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
শুনতে শুনতে অদিতির হাসিই পায়। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে লোকটা আমূল বদলে গেছে এবং তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।
এবার দুই দাদা এবং বাবার ভীরু-মিনমিনে কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
আপনি শান্ত হোন। দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন। আমরা বুবুকে আরেকবার বোঝাব।
অদিতির রাগ হয় না, বরং মজাই লাগে। বাবা এবং দাদারা এখনও আশা করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে দিয়ে সিতাংশুর গলায় বরমাল্য পরাতে পারবে।
কিন্তু ফাঁপা রঙিন প্রতিশ্রুতিতে কাজ হয় না। সিতাংশু ঝানু ব্যবসাদার। লেনদেনের হিসেবটা তার কাছে পরিষ্কার। সে বলে, অদিতি যেভাবে কাল আমাকে অপমান করেছে, তারপর আর বোঝাবার দরকার নেই। আমার কথাটা মনে রাখবেন, এক মাসের মধ্যে টাকাটা ফেরত চাই।
প্যাসেজে অন্য দিনের মতো আজও টিমটিমে বালটা ওপর থেকে ঝুলছিল। সেটার তলা দিয়ে চাপাকে নিয়ে যেতে যেতে অদিতির চোখে পড়ে, বাঁ-পাশের ড্রইংরুমে সিতাংশু,
বাবা এবং দুই দাদা কালকের মতোই মুখোমুখি বসে আছে।
ওরা চারজনই ভেতর থেকে অদিতি আর চাঁপাকে দেখতে পেয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চুপ করে যায় এবং তার মধ্যেই অদিতিরা সিঁড়ির কাছে চলে আসে। সেখানে কালকের মতোই দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই বাইরের ঘরের কথা শুনছিল।
দুর্গা তার এবং মৃণালিনীর গুপ্তচর। ভালো ট্রেনিং পেলে আরেকটি মাতাহারি হয়ে উঠতে পারত। অদিতি জানে, সে যদি এখন না-ও ফিরত সিতাংশুর আসার খবর আর বাবা-দাদাদের সঙ্গে তার কথাবার্তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল মস্তিষ্কে নোট করে রাখত দুর্গা এবং শুতে যাবার আগে এসব জেনে যেত অদিতি।
দুর্গা বলে, সেই লোকটা আবার এসেছে ছোটদি।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে অদিতি বলে, দেখলাম তো। তুই কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?
তা আধঘণ্টা হবে।
বোঝা যায়, ঠিক আধ ঘণ্টা আগেই এ বাড়িতে ঢুকেছে সিতাংশু এবং সে এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত দুর্গাকে নড়ানো যাবে না।
দুর্গা কথা বলতে বলতে বার বার চাঁপার দিকে তাকাচ্ছিল।
এবার সে জিগ্যেস করে, এ কে গো ছোটদি?
পরে শুনিস।
দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে, বাঁ-দিকের ঢালা বারান্দায় হেমলতা একটা জামায় বোতাম লাগাচ্ছেন। প্রায় রোজই বিকেলের পর মাকে এখানে বসে থাকতে দেখা যায়। হয় সেলাই-ফোঁড়াই কিছু করছেন, নইলে বই পড়ছেন বা চাল বাছছেন।