হৈমন্তী বলে, এতে ভীষণ রিস্কও থেকে যায়। আমরা কেউ এখানে রাত্তিরে থাকি না। চাঁপার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে মানে কত রকমের বাজে এলিমেন্ট রয়েছে, তারা একেবারে বেপরোয়া। কে যে কী করে বসবে! হয়তো দরজা-টরজা ভেঙে ঢুকেই পড়ল। তার পরের কথা আর ভাবা যায় না। খারাপ কিছু ঘটে গেলে তার সব দায় কিন্তু এসে পড়বে আমাদের ওপর।
অমিতাদি আস্তে মাথা নাড়েন, তাহলে?
অদিতি এবার বলে, চাঁপাকে আমাদের কারও বাড়িতে আপাতত শেল্টার দিতে হবে।
অমিতাদি বলেন, আমার ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট। আমার ভাই আর আমি থাকি। তাছাড়া রয়েছে একজন কাজের লোক। সেখানে একস্ট্রা আরেকজনকে নিয়ে গিয়ে ভীষণ অসুবিধে হবে।
কৃষ্ণা বলে, আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু পরশু কানাডা থেকে সেজদিরা এসেছে। বাড়ি একেবারে প্যাকড়। দশ বছর পর এল। ওরা মাস তিন-চারেক থাকবে। আমাদের অবস্থাটা কী, বুঝতেই পারছেন।
এরপর অন্য সবাই একে একে তাদের অসুবিধের কারণগুলি জানিয়ে দেয়।
একজন তো বলেই বসল, আমাদের বাড়িতে প্রচুর জায়গা। একজন কেন, দশজন বাড়তি লোকও থাকতে পারে। কিন্তু দ্যাট আন্টিসোশাল গুন্ডা, সে নিশ্চয়ই গিয়ে চড়াও হবে। বাবা এসব পছন্দ করবে না।
এটা ঠিক, অনেকের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে জায়গা বেশ কম। যাদের বাড়ি বড় তারা নগেনের ভয়ে চাঁপাকে আশ্রয় দিতে চাইছে না। এ-জাতীয় সমাজবিরোধী ক্রিমিনাল টাইপের লোককে তারা এড়িয়ে চলতে চায়।
অদিতি অন্যমনস্কর মতো সবার কথা শুনছিল। শুনতে শুনতে তার চোখের সামনে অদৃশ্য সিনেমার স্ক্রিনে তাদের বাড়িটা ফুটে উঠছিল। সেখানে চাঁপার মতো পঞ্চাশজনের জায়গা হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা মা এবং দাদারা কীভাবে চাঁপার ব্যাপারটা নেবে, ভেবে উঠতে পারছিল না অদিতি। দ্বিধার ভাবটা কাটিয়ে এক সময় মনঃস্থির করে ফেলে সে। বলে, ঠিক আছে, সবার যখন এত অসুবিধা তখন ওকে আমাদের বাড়িই নিয়ে যাচ্ছি। একটু থেমে বলে, আমি যখন চাঁপাকে বস্তি থেকে নিয়ে এসেছি তখন মরাল রেসপনসিবিলিটি আমার।
সবাই একসঙ্গে প্রায় গলা মিলিয়ে বলে, এভাবে ব্যাপারটা নিও না। রেসপনসিবিলিটি আমাদের সকলের। কিন্তু কিছু কিছু অসুবিধে তো প্রত্যেকের থাকে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।
অদিতি উত্তর দেয় না।
অমিতাদি আবার বলেন, চাঁপাকে মেয়েদের কোনো হোমে আপাতত রেখে দিলে কী হয়?
অদিতি মনস্থির করে ফেলে। দৃঢ় গলায় বলে, না।
না মানে?
আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাই না। ওকে আজই আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। তারপর দেখা যাক, কী করা যায়–
অমিতাদি অস্বস্তি বোধ করেন। বলেন, চাঁপার ব্যাপারটা তোমাদের বাড়ির লোকেরা জানেন?
অদিতি বলে, এখনও জানে না। নিয়ে যাবার পর জানতে পারবে।
হঠাৎ এভাবে নিয়ে গেলে বলতে বলতে থেমে যান অমিতাদি। তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির।
সে বলে, এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন না অমিতাদি বলে চাঁপার দিকে চোখ ফেরায়, চল আমার সঙ্গে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।
চাঁপাও হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলে উঠে পড়েছিল। অমিতাদি বলেন, এখনই যাবে?
অদিতি মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয়, হ্যাঁ।
আজ তো বস্তিতে যাওয়া হল না।
হ্যাঁ। কাল থেকে যাব।
অমিতাদি বলেন, তুমি আসার আগে একটা বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম।
অদিতি কোনো প্রশ্ন না করে অমিতাদির দিকে তাকায়।
তিনি থামেননি, তুমি বরং কিছুদিন বস্তিতে যেও না। পরশু থেকে আমরা যে সেমিনার করছি সেখানে মডারেটর হিসেবে থাকো।
অমিতাদির মনোভাব খুবই স্পষ্ট। বস্তিতে গেলে নগেন গন্ডগোল করতে পারে, সেই কারণে তিনি অদিতিকে সেখানে যেতে দিতে চান না।
পরশুদিনের সেমিনারটার কথা অদিতি জানে। দিল্লি বম্বে বাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ থেকে নাম-করা সোশিওলজিস্ট, ঐতিহাসিক, ইকনোমিস্ট, রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এতে বক্তা হিসেবে যোগ দেবেন। তাছাড়া কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক এবং ঐতিহাসিককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এজন্য তিনমাস আগেই একটা এয়ার-কন্ডিশনড হল ভাড়া করা হয়েছে। অবশ্য নারী-জাগরণ-এর এতে একটি পয়সাও খরচ নেই। একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি সেমিনারটা স্পনসর করছে। বড় বড় কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে শুরু করে ভালো হোটেলে বক্তাদের রাখার ব্যবস্থা, তাঁদের প্লেন ভাড়া, ইত্যাদি যাবতীয় দায়িত্ব ওই কোম্পানির।
অদিতির এ জাতীয় সেমিনার খুব একটা পছন্দ নয়। সে গ্লাস-রুটে গিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটা করতে চায়।
অদিতি বলে, আপনি কী ভাবছেন বুঝতে পারছি অমিতাদি। কিন্তু একটা অ্যান্টিসোশাল হুলিগানের ভয়ে যদি বস্তিতে যাওয়া বন্ধ করে দিই তার চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। আজ আর হল না, কাল থেকে আবার বস্তিতে যাব। আপনি অন্য কারও ওপর সেমিনারের দায়িত্ব দিন। বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার যদি এখানে খুব জরুরি কাজ না থাকে, আমাদের সঙ্গে আসবে?
বিকাশ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, না, তেমন কোনো কাজ নেই। চলো–
.
রাস্তায় বেরিয়ে বিকাশ আর অদিতি পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। তাদের পিছনে চাঁপা।
অদিতি আগে কোনোদিন তাকে এভাবে ডেকে নিয়ে আসেনি। বিকাশ বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল। সে বলে, আমাকে কিছু বলবে?