নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে যাচ্ছিল অদিতি। ফুসফুসের আবদ্ধ বাতাস আস্তে-আস্তে বার করে দিয়ে সে বলে, তাড়িয়ে দিয়ে ভালোই করেছেন অমিতাদি। চাঁপাকে একবার হাতে পেলে লোকটা খুন করে ফেলবে। হি ইজ জেঞ্জারাস।
হ্যাঁ। দেখেশুনে মনে হল একটা অ্যান্টিসোশাল রাফায়েল। বলে একটু ভেবে আবার শুরু করেন অমিতাদি, নগেন আমাদের শাসিয়ে গেছে। কী বলেছে জানো?
দলবল জুটিয়ে এখানে হানা হবে। এরকম একটা জঘন্য টাইপের মাতাল, বজ্জাত এখানে এসে খিস্তিখেউড় করবে, হল্লা বাধাবে, ভাবতেই আমার বিশ্রী লাগছে। তা ছাড়া আশেপাশের লোকজন কী ভাববে বলো তো?
অদিতি বিষণ্ণ হাসে। বলে, অমিতাদি, মেয়েদের সামাজিক সম্মান আর মর্যাদা রক্ষার জন্যে আমরা রাস্তায় নেমেছি। কে কী বলল বা ভাবল তা নিয়ে মাথা ঘামালে চলে! কত ইনফ্লুয়েনশিয়াল মেম্বার রয়েছেন নারী-জাগরণ-এ। আমরা একটা বাজে লোককে শায়েস্তা করতে পারব না?
বিব্রতভাবে অমিতাদি বলেন, নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু আমার একটা কথা ভেবে দেখো—
বলুন
এইসব অ্যান্টিসোশালদের পেছনে আমরা যদি সময় আর শক্তি ক্ষয় করে ফেলি, আসল কাজ কখন করব?
এটাই তো আসল কাজ অমিতাদি। এরকম জন্তুদের হাতেই তো বেশিরভাগ মেয়ে টরচারড হচ্ছে। এই মেয়েদের জন্যে যদি একটা আঙুলও তোলেন, নগেনের মতো বিস্টরা এখানে লাইন দিয়ে হানা দেবে। আর সেটা যদি হয়, বুঝব সঠিক কাজটাই শুরু করতে পেরেছি।
ডানদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে এষা। তার বাঁ-হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মেয়েটা চেইন-স্মোকার। এষার পরনে জিনস এবং ঢোলা শার্ট। ডান হাতের কবজিতে চওড়া স্টিল ব্যান্ডে চৌকো ঘড়ি। চুল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। এই পোশাক এবং সিগারেট বা চুলের ছাঁট পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট। সে এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এবার বলে ওঠে, নারী-জাগরণ-এর একজাট কাজটা তা হলে কি এই হবে অদিতিদি?
কী?
আমরা অনবরত সোসাইটির টরচারড় মেয়েদের নিয়ে এসে শেলটার দেব, আর তাদের মাতাল স্বামীরা যখন ঝামেলা করতে আসবে তাদের টি করব?
অদিতি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই অমিতাদি বলে ওঠেন, ও-সব পরে হবে। এখন চাঁপার প্রবলেমটা কী করে সলভ করা যায় সেটা ভাবো।
অদিতি এষার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অমিতাদিকে লক্ষ করতে থাকে।
অমিতাদি বলে, চাঁপার ব্যাপারে একটা লিগ্যাল পয়েন্টও রয়েছে।
অদিতি জিগ্যেস করে, কী সেটা?
নগেন থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে পারে, আমরা বে-আইনিভাবে তার স্ত্রীকে এখানে আটকে রেখেছি। তা হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, চিন্তা করে দেখো। কোর্ট উকিল উইটনেস–সব মিলিয়ে একটা ভীষণ কমপ্লিকেটেড ব্যাপার।
এ-দিকটা ভেবে দেখেনি অদিতি। সে একটু হকচকিয়ে যায়, পরক্ষণেই কী মনে পড়তে বলে ওঠে, চিন্তা নেই অমিতাদি, নগেন মরে গেলেও পুলিশের কাছে যাবে না।
মানে?
প্রথমত, সে হল, অ্যান্টিসোশাল, তার ওপর চাঁপা তার থার্ড ওয়াইফ। হিন্দু কোড বিল পাশ হবার পর ও কি গিয়ে বলবে, আমরা তিন নম্বর স্ত্রীকে নারী-জাগরণ গায়ের জোরে আটকে রেখেছে?
কিন্তু চাঁপা বলছিল, নগেনের পেছনে নাকি পলিটিক্যাল পার্টির লোকেরা রয়েছে। তারা এসে হাঙ্গামা করতে পারে।
আগে হাঙ্গামা করুক। তারপর দেখা যাবে। এত ভয় পেলে কোনো কাজই করা যাবে না অমিতাদি। যা চলে আসছে, মেয়েদের ওপর অত্যাচার, বধূহত্যা, পণপ্রথা, নারীর অসম্মান–এ সবই তা হলে চলুক। নারী-জাগরণ-এর তা হলে আর দরকার কী?
রমেন বাঁ-দিকে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে, অদিতি ঠিকই বলেছে। গায়ে আঁচ লাগবে না, অথচ রাতারাতি সোশাল প্যাটার্ন পালটে যাবে, এটা হয় না অমিতাদি।
ডানদিকের শেষ মাথা থেকে হৈমন্তী বলে, আমরা কিন্তু আবার অন্যদিকে সরে যাচ্ছি। চাঁপার ব্যাপারটা ঠিক করে নেওয়া যাক।
হৈমন্তী নারী-জাগরণ-এর একজন অত্যন্ত সক্রিয় মেম্বার। নির্যাতিত মেয়েদের অসংখ্য সমস্যা, কলেজ আর ছাত্রছাত্রী নিয়ে তার জগৎ। এ-সবের বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না।
নারী-জাগরণ-এর পক্ষে থেকে একটা ত্রৈমাসিক বাই-লিংগুয়াল অর্থাৎ দ্বিভাষিক পত্রিকা বার করা হয়। দুই ভাষার একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। সমাজের নানা স্তরের মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা এখানে তুলে ধরা হয়। ছাপা হয় ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা মেয়েদের ইন্টারভিউ। কাগজটির নাম নারী। এজন্য পশ্চিমবাংলা ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরে নারীর অনেক মহিলা রিপ্রেজেন্টেটিভ রয়েছে। যদিও সম্পাদক হিসেবে এতে অমিতা সরকারের নামটা রয়েছে, আসল কাজটা করে হৈমন্তী-হৈমন্তী আচার্য। সে একটা কলেজে ফিজিক্স পড়ায়। খানিকটা রোগা হলেও, অত্যন্ত ধারালো চেহারা, চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা।
অমিতাদি বললেন, অবস্থা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে চাপাকে আর নগেনের কাছে পাঠানো যাবে না।
সবাই সায় দিয়ে জানায়, চাঁপাকে পাঠালে মারাত্মক ঝুঁকি নেওয়া হবে। চাঁপার যদি খারাপ কিছু হয়, আইনত না হলেও নৈতিক দিক থেকে নারী-জাগরণ-এর সভ্যরা এর জন্য ষোলআনা দায়ী থাকবে।
অমিতাদি বলেন, আমরা নাহয় চাঁপার দায়িত্ব নিলাম। একটা মানুষকে দুটো খেতে দেওয়া এমন কিছু ব্যাপার না। কিন্তু ও থাকবে কোথায়? আমাদের বেয়ারা একটামাত্র ঘরে বউ-বাচ্চা নিয়ে পেছন দিকে থাকে। চাঁপাকে সেখানে বা অফিসে রাখা সম্ভব না। একটা ইয়ং গার্ল একা অফিস বিল্ডিয়ে রাত্রিবেলা থাকবে, সেটা ঠিক না।