অদিতি হাত তুলে মৃগাঙ্ককে থামিয়ে দেয়। গম্ভীর মুখে বলে, ছোটদা, আমি বাচ্চা মেয়ে নই। আমি কাকে বিয়ে করব, না করব, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আর বিকাশ অত্যন্ত শিক্ষিত, একজন ভদ্রলোক। তার সম্মান রেখে কথা বলবে। সে আরও বলতে যাচ্ছিল, বিকাশ আর যাই হোক মৃগাঙ্কর মতো রেস বা জুয়ায় সর্বস্ব উড়িয়ে দেয় না। কী ভেবে শেষ পর্যন্ত আর বলে না।
মৃগাঙ্ক ভেংচে ওঠে, ভদ্রলোক। শিক্ষিত! আমি–
তাকে শেষ করতে দেন না রমাপ্রসাদ। বলেন, বাবলু, এত রাতে এরকম চেঁচামেচি আমার ভালো লাগছে না।
ঠিক আছে মৃগাঙ্ক আর দাঁড়ায় না, উত্তেজিতভাবে পা ফেলে ফেলে উত্তর দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢোকে।
দশ ফুট দুরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল মীরা। সে চাপা গলায় বলে, নিজের বিয়ের ব্যাপারে বাপ আর বড় ভাইদের সঙ্গে কোনো মেয়েকে এভাবে কথা বলতে আগে দেখিনি। নির্লজ্জ কোথাকার!
তীব্র মোচড়ে শরীরটা মীরার দিকে ঘুরে যায় অদিতির। ভেবেছিল, কোনো প্ররোচনাতেই সে উত্তেজিত হবে না বা ধৈর্য হারাবে না। কিন্তু এখন আর মাথাটা একেবারেই ঠান্ডা রাখা যাচ্ছে না। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে, তোমার চেয়েও আমি বেশি নির্লজ্জ! আমি তো বাবা আর দাদাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। বিয়ের আগে তুমি এ-বাড়িতে কীভাবে এসে উঠেছিলে, মনে আছে?
অদিতির ইঙ্গিতটা মারাত্মক। বিয়ের আগে পেটে বাচ্চা নিয়ে মীরা যে এখানে চলে এসেছিল সেটাই নতুন করে জানিয়ে দিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় তার। রাগের মাথায় তার এই লেভেলে নেমে যাওয়া ঠিক হয়নি।
মীরা আকস্মিক আঘাতে প্রথমটা চমকে ওঠে। তারপর আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে প্রায় টলতে টলতে উত্তর দিকে তার ঘরে চলে যায়।
কিছুক্ষণের জন্য গোটা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তারপর হেমলতা বলেন, অনেক রাত হল। সবাই এবার খেয়ে নেবে চলো।
বার বার ডাকা সত্ত্বেও বরুণ মৃগাঙ্ক মীরা বা বন্দনা, কেউ খেতে আসে না। মৃগাঙ্কর ছেলে চিকু আর মৃণালিনীকে সন্ধের পরই খাইয়ে দেওয়া হয়। অগত্যা রমাপ্রসাদ হেমলতা আর অদিতি দোতলার একধারে খাবারঘরে চলে যায়।
খাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিঃশব্দে, পাতের ওপর ঘাড় গুঁজে রুটি তরকারি বা মাংসের নাড়াচাড়া করে এক সময় উঠে পড়ে অদিতি।
তেতলায় এসে প্রথমেই মৃণালিনীর ঘরে যায় অদিতি।
মৃণালিনী তার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। বলেন, নীচে এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন রে?
এই মুহূর্তে একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না অদিতির। নেহাত মৃণালিনী তার জন্য জেগে থাকবেন, তাই আসতে হয়েছে।
অদিতি বলে, কাল শুনো পিসি। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করেন মৃণালিনী। বলেন, আচ্ছা যা, শুয়ে পড় গিয়ে। আর আমার ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যা।
অদিতি সুইচ টিপে ঘর অন্ধকার করে দেয়। তারপর বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
.
০৬.
পরের দিন কলেজে পর পর চারটে ক্লাস ছিল অদিতির। একেকটা ক্লাসে প্রায় সত্তর-আশিজন মেয়ে। হিন্দি ফিল্মের ভিলেনের মতো গলার স্বর চড়ায় না তুললে লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রীরা ক্লাস-লেকচার শুনতে পাবে না।
একটানা দুশো মিনিট গলায় ফেনা তুলে চেঁচিয়ে অদিতি যখন কলেজ থেকে বেরুল, চারটে বেজে গেছে। এই মুহূর্তে তার মাথা ঝিম ঝিম করছে।
অমিতাদি কাল বলে দিয়েছিলেন, আজ অবশ্যই যেন, নারী-জাগরণ-এর অফিসে একবার চলে আসে। কেন না, কাল ঢাকুরিয়ার বস্তি থেকে চাঁপাকে নিয়ে গিয়ে ওখানে রাখা হয়েছে। তার সম্বন্ধে কী করা যায়, আজ সেটা ঠিক হবে।
কলেজটা বড় রাস্তার ওপর। একটা বাস ধরে অদিতি যখন সাউথ ক্যালকাটায় নারী-জাগরণ-এর অফিসে পৌঁছোয়, সন্ধে হতে খুব দেরি নেই।
কাল বধূহত্যার প্রতিবাদে মিছিল বার করার কারণে প্রায় সব মেম্বারই হাজির ছিল। কালকের মতো অত ভিড় না থাকলেও বেশ কিছু মেম্বারকে আজও দেখা যাচ্ছে।
অমিতাদির ঘরে ঢুকতেই অদিতির চোখে পড়ে দশ-বারোজন মেম্বার এখানে রয়েছে। তাদের মধ্যে বিকাশ এবং চাঁপাকেও দেখা গেল। চাঁপা দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে।
অদিতিকে দেখে যারা বাইরে ছিল, তারাও এঘরে চলে আসে। এতজনের বসার মতো চেয়ার-টেয়ার নেই, বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে থাকে।
অদিতি লক্ষ করে, সবার চোখে মুখেই প্রচণ্ড উত্তেজনা। তার ধারণা, সে এখানে আসার আগে মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে।
অমিতাদি বলেন, বসো অদিতি
অমিতদির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে ছিল কৃষ্ণা। সে উঠে গিয়ে অদিতির জন্য জায়গা করে দেয়। অদিতি বসতেই অমিতাদি বলেন, তোমার জন্যেই আমরা ওয়েট করছি। এত দেরি করলে?
অদিতি দেরিতে আসার কারণ জানিয়ে বলে, এখানে কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে–
অমিতাদি গম্ভীরমুখে বলেন, হ্যাঁ। চাঁপাকে নিয়ে খুব আনপ্লেজান্ট ব্যাপার ঘটে গেল একটু আগে।
ঘরের আবহাওয়া দেখে সেরকমই কিছু একটা মনে হচ্ছিল অদিতির। ভেতরে ভেতরে সে বেশ উৎকণ্ঠাই বোধ করে। বলে, কী হয়েছে?
নগেন নামে একটা লোক ড্রিংক করে এসে নানারকম কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে খিস্তি করছিল। লোকটার মুখ অত্যন্ত ফিলদি। যেমন তার জঘন্য ল্যাংগুয়েজ তেমনি তার চিৎকার। প্রথমে তো আমরা একেবারে স্টান্ড। পরে জানতে পারলাম, নগেন চাঁপার স্বামী। সে এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। আমরা অবশ্য তাড়িয়ে দিয়েছি। অমিতাদি বলতে থাকেন, সহজে কি যেতে চায়? একরকম জোরই করতে হয়েছে।