রমাপ্রসাদ ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। বলেন, হ্যাঁ। মানে শেয়ার মার্কেটের ব্যাপারে–এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ থেমে যান।
অদিতি বলে, তুমি শেয়ার মার্কেটে ফাটকাবাজি করে আর দাদারা জুয়া রেস, এইসব করে টাকাটা উড়িয়ে দিয়েছে। আমার সঙ্গে সিতাংশু ভৌমিকের বিয়ে হলে টাকাটা আর ফেরত দিতে হবে না, কী বলে?
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকেন রমাপ্রসাদ।
অদিতি বলতে থাকে, তার মানে, সাড়ে চার লাখ টাকায় তোমরা আমাকে একটা বজ্জাতের কাছে বেচে দিতে চাইছ।
রুদ্ধ গলায় রমাপ্রসাদ বলেন, কী যা তা বলছিস বুবু! আমি তোর বাবা
তাঁকে শেষ করতে দেয় না অদিতি। তীক্ষ্ণ গলায় বলে, এখানেই তো আমার অদ্ভুত লাগছে। তোমরা শেষ পর্যন্ত আমাকে একটা প্রপার্টি ভাবছ। টাকার বদলে আমাকে একটা বদ লোকের হাতে তুলে দিতে চাইছ। কিন্তু তা হবে না। আর
হঠাৎ ভীষণ অসুস্থবোধ করেন রমাপ্রসাদ। তাঁর হাত-পায়ের জোড় যেন আলগা হয়ে যেতে থাকে। শিথিল গলায় কোনোরকমে বলেন, আর কী?
তোমরা যদি ভেবে থাকো, তোমাদের ধার শোধ করার জন্য সিতাংশু ভৌমিককে এই বাড়ি বেচে দেবে, তা আমি কিছুতেই করতে দেব না। তোমরা জুয়া ফাটকা খেলে টাকা ওড়াবে, তার জন্যে বাকি সকলে পথে বসবে, সেটা হতে দেব না। দাদুর উইল আমি দেখেছি। এ-বাড়ি বিক্রি করা যাবে একটি মাত্র কন্ডিশানে। বিক্রির সময় এই ফ্যামিলির যারা বেঁচে থাকবে তাদের সবার কনসেন্ট না-পাওয়া গেলে কেউ বাড়ি ব্রিকি করতে পারবে না। দু-একজনের খামখেয়ালিতে পারিবারিক প্রাপার্টি নষ্ট করে অন্যদের কিছুতেই পথে বসানো চলবে না।
রমাপ্রসাদ চমকে ওঠেন। তাঁর আর্থারাইটিসের কষ্টটা হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সামলাতে সামলাতে কাতর গলায় বলেন, কিন্তু
কী?
বাড়িঘর বা আমাদের ধারদেনার কথা থাক। বাবা হিসেবে তোর ওপর আমার কিছু কর্তব্য তো আছে।
রমাপ্রাসাদ ঠিক কী বলতে চান, বুঝতে না পেরে অদিতি জিগ্যেস করে, কোন কর্তব্যের কথা বলছ?
রমাপ্রসাদ বলেন, তোর তো এবার বিয়ে দেওয়া দরকার।
কর্তব্যের ছদ্মবেশে রমাপ্রসাদ কী ধরনের তুখোড় চাল দিতে চাইছেন, ধরতে চেষ্টা করে অদিতি। হঠাৎ তার মনে হয়, রমাপ্রসাদ বুঝে ফেলেছেন সিতাংশুর সঙ্গে তার বিয়ে কোনোভাবেই ঘটাতে পারবেন না। তাই কি এ বাড়ি থেকে তাকে কৌশলে বার করে দিতে চাইছেন? সে এখানে থাকলে বাড়ি বিক্রির কনসেন্ট সবার কাছ থেকে সহজে আদায় করা যাবে না। অথচ এটা না বেচলে ঋণ শোধ করা অসম্ভব। ওদিকে টাকা ফেরত না পেলে সিতাংশু কিছুতেই ছাড়বে না। এতগুলো টাকা নিঃস্বার্থভাবে দান খয়রাত করার মতো মানুষ আর যে-ই হোক, সিতাংশু নয়।
সতর্কভাবে অদিতি বলে, বাবা, যে মেয়েদের পক্ষে বিয়েটা ভীষণ জরুরি, আমি কিন্তু তাদের মধ্যে পড়ি না। আমি মোটামুটি একটা চাকরি করি। আমি কারও ঘাড়ের ওপর বোঝ হয়ে নেই।
এতক্ষণ হেমলতা রমাপ্রসাদের পেছনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি কথাও বলেননি। এবার শ্বাসরুদ্ধের মতো বলেন, বুবু, দেশাচার বলে একটা কথা আছে, সেটা কি না মানলে চলে?
রমাপ্রসাদ তৎক্ষণাৎ সায় দেন, ঠিকই তো। মেয়েরা যতই লেখাপড়া শিখুক, যতই রোজগার করে স্বাবলম্বী হোক, তার বিয়ে না দিলে মা-বাপকে লোকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়।
অদিতি স্থির চোখে রমাপ্রসাদকে দেখতে দেখতে বলে, কে কী বলল, সে-সব আমি গ্রাহ্য করি না। একটু থেমে আবার বলে, আচ্ছা বাবা, তোমরা কি বিয়ের নাম করে আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছ?
কোমরে হাত চেপে দ্রুত খাড়া হয়ে বসেন রমাপ্রসাদ। বলেন, মানে?
আমি এখান থেকে চলে গেলে অন্যের ওপর প্রেসার দিয়ে বাড়ি বিক্রির কনসেন্ট আদায় করা অনেক সহজ হয়।
রমাপ্রসাদের মুখ-চোখ করুণ দেখায়। বিমর্ষ গলায় তিনি বলেন, তুই আমাকে কী ভাবিস বুবু? আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি।
তার কথায় কতটা আন্তরিকতা এবং কতটা অভিনয়, অদিতি বুঝতে পারে না। সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তের মতো বলে, ঠিক আছে, বাড়ি বেহাত না হলেই ভালো।
হেমলতা বলেন, কিন্তু তুই কি বিয়ে করবি না বুবু?
একটু চুপ করে থাকে অদিতি। তারপর খুব আস্তে বলে, বিয়ে করব না, এমন প্রতিজ্ঞা তো করিনি মা, নিশ্চয়ই করব। আর
আর কী?
আমার বিয়ের জন্য তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।
আমরা চিন্তা না করলে বিয়েটা হবে কী করে?
ও ব্যাপারে আমি ভেবেছি। পরে তোমাদের জানাব।
মৃগাঙ্ক স্নায়ুগুলো টান টান করে অদিতিকে লক্ষ করছিল। এবার সে বলে, তুই কি বিকাশকে বিয়ে করবি বলে ঠিক করেছিস?
মৃগাঙ্কর দিকে মুখ ফেরায় অদিতি। শান্ত গলায় বলে, একটু ধৈর্য ধরো, পরে জানতে পারবে।
মৃগাঙ্ক অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ গলায় বলতে থাকে, নতুন করে জানাবার আর কিছু নেই। আমি সবই জানি। নিজের চোখে কতদিন দেখেছি ওই ছোকরার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। শুধু আমি একাই না, আমার বন্ধুরাও দেখে যা তা বলে।
অসহ্য রাগে মাথার ভেতর শিরা ছিঁড়ে যায় যেন অদিতির। ভাবে, চিৎকার করে উঠবে। কিন্তু প্রাণপণে নিজেকে সংযত রেখে কোনোরকম বিস্ফোরণ ঘটতে দেয় না।
মৃগাঙ্ক থামেনি, ছোকরার কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। শুনেছি থাকার মধ্যে ভবানীপুরের থার্ড ক্লাস গলির ভেতর পুরোনো ভাঙাচোরা ছোট একটা বাড়ি। তা-ও একার না, ভাগের বাড়ি। এরকম একটা