আচমকা বরুণ চিৎকার করে ওঠে, আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কী?
পালটা চেঁচিয়ে উঠতে পারত অদিতি। তা না করে খুব সংযত গলায় বলে, এই প্রশ্নটা তো আমার করার কথা।
কী বলতে চাস তুই?
বলতে চাই, একটা ডিবচ বদমাস স্কাউন্ট্রেলকে তোমরা আমার কাঁধে চাপিয়ে দেবার জন্য বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছ। আমাকে কোন লেভেলে নামতে চাইছ, ভালো করে ভেবে দেখেছ?
রমাপ্রসাদ এই সময় চড়া গলায় বলেন, সিতাংশু একজন রেসপেক্টবল বিজনেসম্যান। তার সম্বন্ধে ভদ্রভাবে কথা বল
মৃগাঙ্ক ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, একজ্যাক্টলি।
সোজা রমাপ্রসাদের চোখের দিকে তাকিয়ে অদিতি বলে, রেসপেক্টবল! যার দু-দুটো স্ত্রী ডিভোর্স করে চলে গেছে, একটা স্ত্রী মার্ডার হয়েছে।
মৃগাঙ্ক মাঝখান থেকে গলা চড়িয়ে বলে, কে বললে মার্ডার? হঠাৎ আগুন লেগে মারা গেছে। ইটস অ্যান অ্যাকসিডেন্ট
কোনটা অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটা মার্ডার, সেটুকু বুঝবার মতো বয়েস এবং বিদ্যাবুদ্ধি আমার হয়েছে। কোনো সাফাই গাইবার দরকার নেই। অদিতি ঘুরে মৃগাঙ্কর দিকে তাকায়।
বরুণ ওধার থেকে বলে ওঠে, মার্ডার হলে কোর্টে কেস উঠত না? আইন ওকে ছেড়ে দিত?
অদিতি এবার বরুণের দিকে ফিরে দাঁড়ায়, টাকা থাকলে পাঁচটা খুন করেও যে পার পাওয়া যায়, তুমি কি জানো না? তীব্র বিদ্রুপে তার ঠোঁট বেঁকে যায়।
বরুণ পলকের জন্য থতিয়ে যায়। পরক্ষণেই গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে দেয়, আমি জানি সিতাংশু সম্পর্কে কে এই স্ক্যান্ডাল রটাচ্ছে। তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেব।
রমাপ্রসাদ তীব্র গলায় বলেন, সেই যে পয়তাল্লিশ বছর আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল, তারপর থেকে সারাটা জীবন জ্বালিয়ে যাচ্ছে। এবার আমি আর বরদাস্ত করব না, সহ্যের সীমা একেবারে পার হয়ে গেছে।
মৃগাঙ্ক বলে, বাবা, পিসি এ-বাড়িতে থাকলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি কিছু একটা ব্যবস্থা করো। আমাদের খাবে, আর দিন রাত আমাদেরই ক্ষতির মতলব করবে, এটা কিছুতেই হতে দেব না। একটা উইচ।
নিজের অজান্তেই অদিতির মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। ছোটদা, সব ব্যাপারের একটা লিমিট আছে, তুমি সেটা ছাড়িয়ে গেছ। যে ভাষাটি নিজের পিসি সম্পর্কে বললে তাতে সন্দেহ হয় ভদ্রবংশে জন্মেছ কিনা। তারপরই রমাপ্রসাদের দিকে ফিরে বলতে থাকে, বাবা, পিসি আমার ওয়েল উইশার, তাই আগে থেকে ওই ডিবচ বদমাসটার সম্পর্কে ওয়ার্নিং দিয়েছে। তোমাদের একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, উইলে দাদু এ-বাড়ির একটা অংশ পিসিকে দিয়ে গেছে। তাকে তাড়াবার চেষ্টা করলে ফলাফল মারাত্মক হবে। আমি কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেব না। বলতে বলতে মৃগাঙ্কর দিকে ফেরে সে, জীবনে নিজে কপয়সা রোজগার করেছ যে পিসিকে খাওয়াবার কথা বললে! পিসির সমস্ত খরচ আমি দিয়ে থাকি। ডোন্ট ফরগেট
শাট আপ। গলার শির ছিঁড়ে চেঁচিয়ে ওঠে মৃগাঙ্ক।
তোমার ভয়ে? অনেস্টলি যে একটা পয়সা রোজগার করতে পারেনি, গ্যাম্বলিং যার একমাত্র প্রফেশান, তার মতো ডার্টি বাজে লোকের ধমকে আমাকে চুপ করে যেতে হবে?
মৃগাঙ্ক হিতাহিত জ্ঞানশুন্যের মতো অদিতির ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রমাপ্রসাদ বলেন, বাবলু, তুই এখান থেকে যা। যা বলার আমি বুবুকে বলছি।
তাঁর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে আর দাঁড়ায় না মৃগাঙ্ক। হিংস্র চোখে অদিতিকে দেখতে দেখতে দুমদাম পা ফেলে ওধারের একটা ঘরে গিয়ে ঢোকে।
রমাপ্রসাদ এবার তাঁর স্ট্র্যাটেজি বদলে ফেলেন। ভয় দেখিয়ে চড়া মেজাজে তাঁর এই একগুঁয়ে মেয়েটিকে কোনোভাবেই বাগ মানানো যাবে না। তাঁকে এগুতে হবে সুকৌশলে, ঠান্ডা মাথায়।
শান্ত, সস্নেহ ভঙ্গিতে রমাপ্রসাদ বলেন, রাগারাগি, হইচই করে কিছু লাভ আছে? তুই আমার কাছে এসে বস। আয়–
এটা বাবার যে একটা চতুর চাল, বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির। তবু দেখাই যাক রমাপ্রসাদ তার জন্য ফাঁদটা নতুন করে কীভাবে সাজান। সে পায়ে পায়ে বাবার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পড়ে। বলে, কী বলবে বলো–
দ্যাখ, মিনুর মতো আমরা যে তোকে ভালোবাসি, এটা নিশ্চয়ই মানিস।
অদিতি চুপ করে থাকে।
রমাপ্রসাদ আবার বলেন, মিনু তো ঘর থেকে বেরুতে পারে না। ওকে কে সিতাংশু সম্পর্কে উলটোপালটা খবর দিয়ে গেছে। তাই শুনে ও একটা খারাপ ধারণা করে নিয়েছে। আমি বলছি, সিতাংশু খুব ভালো ছেলে–জেম অফ এ বয়।
এবারও উত্তর দেয় না অদিতি।
রমাপ্রসাদ চোখের কোণ দিয়ে মেয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে বলেন, বিরাট কনস্ট্রাকশনের ফার্ম ওর। লাখ লাখ টাকা ইনকাম। আমি বলছি, এ বিয়ে হলে তুই সুখে থাকবি।
কিন্তু বাবা
কী?
আমি তো ওই লোকটকাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছি।
রমাপ্রাসাদ হঠাৎ আশান্বিত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, এটা বুঝি অদিতির রাজি হওয়ার লক্ষণ। বলেন, সে জন্যে তুই ভাবিস না। আমি গিয়ে বোঝালে এ ব্যাপারটা ও আর মনে রাখবে না। তা হলে কালই ওদের বাড়ি চলে যাই?
অদিতি হাত তুলে বলে, দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও কিছু কথা তোমার সঙ্গে বাকি আছে।
কী রে?
বড়দা ছোটদা আর তুমি, তিনজনে সিতাংশু ভৌমিকের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছ-এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না।