ভয়ে ভয়ে হেমলতা ডাকেন, বুবু এদিকে আয়
সিঁড়ি দিয়ে তেতলার দিকে উঠতে উঠতে অদিতি বলে, শাড়ি-টাড়ি পালটে আসছি মা। নারী-জাগরণ-এর অফিসে চাঁপাকে রেখে আসার পর পোশাক-টোশাক বদলাবার সময় পাওয়া যায়নি। সারাদিনের ধুলোবালি ঘাম আর গ্যাসোলিনের ধোঁয়া-মাখা শাড়ি-ব্লাউজ গায়ে জড়িয়ে আছে। ওগুলো না-ছাড়া পর্যন্ত বিশ্রী লাগছে অদিতির।
তেতলায় উঠতেই কোত্থেকে দুর্গা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। বলে, পিসিমা তোমাকে ডাকছে ছোটদি–
অদিতি ঠিকই করে রেখেছিল, সবার আগে মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করে সিতাংশুর সঙ্গে তার যা যা কথা হয়েছে, জানাবে।
সে বলে, পিসিকে বল দশ মিনিটের ভেতর আসছি।
মৃণালিনীর ডানপাশে অদিতির ঘর। সোজা সেখানে চলে আসে সে।
ঘরটার মাঝখানে সিঙ্গল-বেড খাটে ধবধবে বিছানা। একধারে জানলা ঘেঁষে লেখাপড়ার টেবিল-চেয়ার। আরেক দিকের গোটা দেয়াল জুড়ে পর পর অনেকগুলো আলমারি। সেগুলো বইয়ে-ঠাসা। আরেক দেয়ালের গায়ে নীচু নীচু র্যাক। সেগুলোও ভর্তি হয়ে বই উপচে পড়ছে। এমনকী মেঝেতেও প্রচুর ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ, প্যামফ্লেট ডাঁই হয়ে আছে।
আরেক দেওয়ালে ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল। জামাকাপড়ের আলমারি। অন্য সব ঘরের মতো এ-ঘরেও অ্যাটাচড বাথরুম।
আলমারি থেকে কাঁচানো শাড়ি জামা-টামা বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ে অদিতি। দ্রুত মুখ-টুখ ধুয়ে, পোশাক বদলে ঠিক দশ মিনিটের ভেতর মৃণালিনীর ঘরে চলে আসে।
মৃণালিনী প্রায় দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন। হাত বাড়িয়ে অদিতিকে তার পাশে বসিয়ে বলেন, কী কথা হল ওই বদমাসটার সঙ্গে? তাঁর চোখে মুখে কণ্ঠস্বরে অসীম ব্যগ্রতা এবং উৎকণ্ঠা, ওদের ফাঁদে পা দিসনি তো?
অদিতি হাসে, না পিসি। তারপর বাবা এবং দাদাদের ড্রইংরুম থেকে বের করে দিয়ে সিতাংশুর সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে, সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়।
ঠিক বলেছিস। মৃণালিনীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমার এই অবস্থা! বিছানায় পড়ে না-থাকলে আমি নিজেই পশুটাকে যা বলার বলতাম। তোকে ওর কাছে পাঠাতাম না। তা হারে–
বলো—
তোর বাপ আর দাদারা ওদের শয়তানিটা কাঁচিয়ে দেবার পর কিছু বলেনি তোকে?
এখনও বলেনি। তবে সবাই আমার জন্যে বন্দুক শানিয়ে বসে আছে। একবার গেলেই
আমি তোর বাপ-দাদাদের হাড়ে হাড়ে চিনি। ওরা হয়তো রাগারাগি কিংবা কাকুতি-মিনতি করে এ বিয়েতে তোকে রাজি করাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু ওদের কোনো কথা শুনবি না।
মৃণালিনী যে তার কতবড় হিতাকাঙ্ক্ষী, অদিতি নতুন করে আবার অনুভব করে। রমাপ্রসাদের স্বার্থের কারণে তার জীবন, তার ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য তাঁর দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের শেষ নেই। অদিতি বলে, তুমি ভেবো না পিসি।
খাওয়া-দাওয়া তো হয়নি তোর?
না।
যা, খেয়ে আয়।
অদিতি উঠে পড়ে, জানো পিসি, আজ নারী-জাগরণ-এর কাজে একটা বস্তিতে গিয়ে দারুণ ব্যাপার ঘটে গেছে। ফিরে এসে তোমাকে বলছি।
নারী-জাগরণ-এর কাজকর্ম সম্পর্কে প্রবল উৎসাহ মৃণালিনীর। আবহমানকাল ধরে এ দেশের মেয়েরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে এখানে নারীর অসম্মান। প্রতিদিন এখানে নারীহত্যা, নারীনিগ্রহ। এইসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেছে নারী-জাগরণ। মৃণালিনী মনে মনে নিজেকে এই যুদ্ধের একজন সৈনিক মনে করেন। তাঁর আক্ষেপ, পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। নইলে বাকি জীবনটা নারী-জাগরণ-এর কাজেই কাটিয়ে দিতেন।
ঘর থেকে বেরুতে না পারলেও অদিতি রাত্তিরে বাড়ি ফিরলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর নেন মৃণালিনী। নারী-জাগরণ-এর মেম্বাররা মেয়েদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রায় রোজই হয় মিছিল বার করছে, নইলে স্ট্রিট কর্নার মিটিংয়ের বক্তৃতা দিচ্ছে, কিংবা সমাজের নানা স্তরের লোকজন ডেকে এনে সেমিনার বসাচ্ছে। মিছিলে কী হল, কে কী বক্তৃতা দিল–সমস্ত কিছু না-জানা পর্যন্ত তাঁর ঘুম আসে না।
নারী-জাগরণ-এর খবর তো আছেই, তাছাড়া রাস্তায় চলতে ফিরতে অদিতি কী দেখল, কার সঙ্গে কী কথা হল, কলেজে গিয়ে কটা ক্লাস করল, ইত্যাদি ইত্যাদি সব জানা চাই মৃণালিনীর।
আসলে অদিতি আর দুর্গা ছাড়া তাঁর ঘরে এ-বাড়ির কেউ বিশেষ আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাথার দিকের জানলা দিয়ে আকাশের একটা টুকরো, বাড়ির সামনে ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই খানিকটা জমি, ভাঙা গেটের বাইরে পিচের রাস্তা, রাস্তার ওধারে দু-চারটে বাড়ি-টাড়ি ছাড়া এই শহরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এর বাইরে বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে যে সামান্য যোগাযোগটুকু এখনও বজায় আছে তা অদিতির জন্যই। প্রতিদিন রাত্তিরে নানা মানুষ এবং অসংখ্য ঘটনার খবর এনে অদিতি পঙ্গু শরীরের ভেতরে তাঁর উন্মুখ অস্থির মনকে সতেজ করে তোলে।
মৃণালিনী বলেন, আচ্ছা, যা।
.
দোতলায় নেমে এসে অদিতি দেখতে পায় দুই বউদি, মা আর বাবা অবিকল কিছুক্ষণ আগের মতো দাঁড়িয়ে এবং বসে আছে। এবার অবশ্য দাদারাও আছে। সে যখন তেতলায় ছিল তখন বরুণরা নীচের সিঁড়ি থেকে উঠে এসেছে।
অদিতি লক্ষ করে, মা ছাড়া সবার চোখে-মুখেই অদ্ভুত এক কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতা ফুটে রয়েছে। বোঝা যায়, এরা তাকে সহজে ছাড়বে না। অদিতি নিজের স্নায়ুগুলোকে টান টান রেখে সতর্ক ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে থাকে।