একটা ঢোক গিলে সিতাংশু বলে, বুঝতেই পারেন, এতগুলো টাকা
ডেফিনিটলি পারি। অদিতি বলতে থাকে, শর্তগুলো কি এইরকম? সাড়ে চার লাখ টাকা ইন্টারেস্ট সুষ্ঠু পার্টিকুলার একটি পিরিয়ডের ভেতর ফেরত দিতে না পারলে, আরও কিছু টাকা দিয়ে এই বাড়িটা আপনি দখল করবেন
মানে আমি তো একজন বিজনেসম্যান। তাই
সিতাংশুর কথা শেষ হবার আগেই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় অদিতি, লেট মি ফিনিশ। প্রথম দিকে হয়তো আপনার ইচ্ছে ছিল, এই বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়িটার পজেশন নিয়ে পুরোনো বিল্ডিং ভেঙে এখানে হাইরাইজ বিল্ডিং বানিয়ে বেচে দেবেন। তাতে মিনিমাম পঞ্চাশ লাখ টাকা লাভ হবে। আফটার অল, ইউ আর ইন দা কনস্ট্রাকশান বিজনেস। কি, ঠিক বলছি?
সিতাংশু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। এই মেয়েটির সঙ্গে আগে কখনও আলাপ হয়নি। রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং মৃগাঙ্কর সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে সেটা এতই গোপন যে কারো পক্ষেই তার আঁচ পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু অদিতি টের পেল কী করে? যদি তার নিয়মিত যাতায়াত এবং রমাপ্রসাদের টাকা দেওয়া থেকে এ-সব ধরে নিয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে অদিতির মতো অসাধারণ বুদ্ধিমতী এই পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
সিতাংশু কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অদিতি আবার শুরু করে, এবার শুনুন, তার পরের স্টেজটা এরকম হয়েছিল কিনা। হাইরাইজ বিল্ডিয়ের ব্যাপারটা প্ল্যান করতে করতে হঠাৎ আপনার নজর এসে পড়ে আমার ওপর। লোকে আমাকে সুন্দরীই বলে থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দু-একজন ফিল্ম ডিরেক্টর তাদের ছবিতে হিরোইন করার জন্য আমাদের বাড়ি পর্যন্ত হানা দিয়েছিল। মেয়েদের সম্বন্ধে আপনার উইকনেস আর লোভের তো শেষ নেই। আমাকে দেখেই আগের প্ল্যানটা অ্যাপসেট হয়ে যায়। আপনি বাবা আর দাদাদের নতুন করে প্রোপোজাল দেন। আমার সঙ্গে বিয়ে হলে সাড়ে চার লাখ টাকা ছেড়েও দিতে পারেন।
ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে সিতাংশুর। জিভ দিয়ে শুকনো খসখসে ঠোঁট দুটো চেটে অস্পষ্ট গলায় সে কী বলে, বোঝা যায় না।
অদিতি বলে, কিন্তু মিস্টার ভৌমিক, আপনার একটা পরিকল্পনাও সাকসেসফুল হবে না। প্রথমত, এই বাড়ি আপনি পাচ্ছেন না। যতরকমভাবে সম্ভব আমি বাধা দেব। আর আমার সঙ্গে বিয়ে! বলতে বলতে তার গলায় স্বর কয়েক পর্দা উঁচুতে উঠে যায়! ডিবচ, স্কাউলে, আ গাটার স্রাইপ-তোমার এতবড় সাহস আমাকে বিয়ে করতে চাও! গেট আউট, গেট আউট। আর কোনোদিন যেন তোমাকে এ-বাড়িতে না দেখি—
সিতাংশুর নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। শরীরের সমস্ত রক্ত একলাফে মাথায় চড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ঠিক আছে কিন্তু কাজটা আপনি ভালো করলেন না–
কতটা খারাপ করেছি আর কতটা করা উচিত ছিল, আমি জানি। নাউ গেট আউট-বলে সোজা দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়। জ্বলন্ত চোখে অদিতিকে দেখতে দেখতে উন্মাদের মতো এলোমেলো পা ফেলে বেরিয়ে যায় সিতাংশু।
৩. সিতাংশু চলে যাওয়ার পর
০৫.
সিতাংশু চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ দু-হাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকে অদিতি। সেই বিকেল থেকে একের পর এক বিস্ফোরক ঘটনাগুলি তার শালীনতা ভদ্রতা এবং সৌজন্যের বোধগুলিকে একেবারে চুরমার করে দিয়েছে। একটু আগে যে ভাষায় সিতাংশুকে সে আক্রমণ করেছে, যেভাবে তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে, এখন সেসব ভাবতে গিয়ে এক ধরনের গ্লানি বোধ করতে থাকে। পরক্ষণেই মনে হয়, এটা না করে তার উপায়ই বা কী ছিল? লোকজন ডেকে লোকটাকে ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে এবং বেদম মারতে মারতে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিলেই ভালো হত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি রয়েছে তার, একটা নামকরা কলেজের সে অধ্যাপিকা। অদিতির যা শিক্ষাদীক্ষা এবং রুচি তাতে একটা বিশেষ লেভেলের নীচে তার পক্ষে নামা অসম্ভব।
একসময় উত্তেজিত স্নায়ুগুলো জুড়িয়ে এলে আস্তে আস্তে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে বাইরের প্যাসেজে চলে আসে অদিতি। আর তখনই দেখতে পায় দশ ফুট দূরত্বে ওপরে ওঠার সিঁড়িটার মুখে দাঁড়িয়ে আছে বরুণ এবং মৃগাঙ্ক। অবশ্য রমাপ্রসাদ আশেপাশে কোথাও নেই।
সিতাংশুর সঙ্গে কথা বলার সময়ই অদিতির মনে হয়েছিল, কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। বরুণরা। তার ধারণা যে আগাগোড়া নির্ভুল, হাতেনাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সে চোখ বুজে বলে দিতে পারে, সিতাংশুর সঙ্গে তার যা যা আলোচলা হয়েছে–সবটাই বরুণরা শুনেছে। কেননা এই আলোচনার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে।
সিঁড়ির কাছে এসে বরুণ এবং মৃগাঙ্ককে ভালো করে লক্ষ করতেই চমকে ওঠে অদিতি। দুই ভাইয়ের চোখে এই মুহূর্তে ঘাতকের দৃষ্টি।
প্রথমটা ভয় পেয়ে যায় সে। পরক্ষণেই স্বয়ংক্রিয় কোনো পদ্ধতিতে নিজের মধ্যে অদম্য এক দৃঢ়তা অনুভব করে। দুই ভাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। বরুণদের পার হয়ে যাবার পর, পেছনে না-ফিরেও অদিতি টের পায় ভাইদের চোখ থেকে আগুন ঝরছে।
দোতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে আসতে দেখা গেল ওধারের বিশাল বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে একটা চেয়ারে ঘাড় গুঁজে বসে আছেন রমাপ্রসাদ। তাঁর পাশে হেমলতা। চিরদিনের ভীরু মাকে এই মুহূর্তে আরও শঙ্কিত এবং সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। একটু দূরে শ্বাসরুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুই বউদি-বন্দনা আর মীরা। ওদের দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, এইমাত্র এ-বাড়িতে কোনো মারাত্মক পারিবারিক বিপর্যয় ঘটে গেছে।