সিতাংশু উত্তর দেয় না। তার চোয়াল পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে।
অদিতি বলে, ভিকটোরিয়ান মরালিটি বলতে যা বোঝায় আমি তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না। মানুষের বায়োলজিক্যাল প্রয়োজনটা বাস্তব ব্যাপার। নীতি-টীতি দিয়ে সেটা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। এনিওয়ে আপনার হয়তো বলতে সংকোচ হচ্ছে। ধরেই নিলাম, এ ব্যাপারে যা শুনেছি, সেটা রিউমার নয়।
মুখের কাঠিন্য বাড়তে থাকে সিতাংশুর। রুক্ষ গলায় সে বলে, সেটা ডেফিনিটলি রিউমার।
আপনি তা হলে ওই ব্যাপারটা অস্বীকার করছেন?
নিশ্চয়ই।
তা হলে এই টপিকটা থাক।
আচ্ছা
বলুন।
আমার সম্বন্ধে সোন্ডারিং-এর খবরই শুধু আপনার কানে এসেছে। একটাও ভালো ইনফরমেশন পাননি?
চমকে ওঠার মতো ভঙ্গি করে অদিতি বলে, পেয়েছি বইকি, অবশ্যই পেয়েছি।
সিতাংশুকে কিছুটা উৎসুক দেখায়, তবে মুখের সেই কঠোরতা কমে না। সে বলে, কী পেয়েছেন?
আপনি অত্যন্ত দয়ালু। আপনার মতো হৃদয়বান মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না।
সিতাংশু হকচিকয়ে যায়। একটু আগে যে অদিতি রক্ষিতাদের ব্যাপারে উলটোপালটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, সে এই মুহূর্তে কোমল গলায় এমন কিছু বলছে যার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না সিতাংশু। মেয়েটাকে একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। এক প্রসঙ্গ থেকে এত দ্রুত অভাবনীয় এমন একদিকে সে সরে যাচ্ছে যে খেই রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিমূঢ়ের মতো সিতাংশু বলে, মানে?
শুনেছি কেউ বিপদে পড়লে আপনি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।
মুখের সেই কর্কশ কাঠিন্য এখন আর নেই সিতাংশুর। লাজুক হেসে নরম গলায় সে বলে, না না, ওটা এমন কিছু ব্যাপার না। কারও দুঃখের দিনে যদি পাশে গিয়ে না-দাঁড়াই সোসাইটিতে বাস করা কেন? সামাজিক কিছু দায়দায়িত্বও তো থাকা দরকার।
একজাক্টলি সো? অদিতি আস্তে মাথা নেড়ে বলতে থাকে, আচ্ছা মিস্টার ভৌমিক
বলুন।
এখনও পর্যন্ত কত লোককে আপনি সাহায্য করেছেন?
এই মূহুর্তে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত এবং খুশি দেখাচ্ছে সিতাংশুকে। অদিতি যে পরোপকারের কারণে তার সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। বিপন্ন দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করার খবর তাকে কে দিয়েছে, কে জানে! যে-ই দিয়ে থাক, সিতাংশু তার কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও সাহায্যের ব্যাপারটা কতখানি সত্যি, সে-ই সব চেয়ে ভালো জানে। সিতাংশু বুঝতে পারে অদিতি এমন একটি মেয়ে মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, দামি গাড়ি-বাড়ি, বিলাসের উপকরণ বা অঢেল আরাম দিয়ে যার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে না। যাকে সে শ্রদ্ধা করতে পারবে তেমন একটি পুরুষকেই শুধু বিয়ে করবে। সিতাংশু মনে মনে ঠিক করে ফেলে তার সম্পর্কে অদিতির যে দুর্বলতাটুকু দেখা দিয়েছে সেটাকে টোকা মেরে মেরে উসকে দেবে।
সিতাংশু বলে, এসব জিগ্যেস করলে খুব লজ্জা পাই। আমার সারপ্লাস কিছু টাকা আছে। লোকের দরকারে দিই। কাকে দিলাম, কেন দিলাম–সেসব মনে করে রাখি না।
অদিতি বলে, তাই তো উচিত। যারা কিছু দিয়েই ঢাক পিটিয়ে প্রচারে নামে তাদের আমি খুব ঘৃণা করি। যাই হোক, আপনি মনে করে না রাখলেও আমি তিনজনের নাম বলে দিতে পারি যাদের আপনি প্রচুর টাকা দিয়েছেন।
সিতাংশু একটু অবাক হয়েই বলে, তারা কারা?
অদিতি বলে, আবার বাবা আর দুই দাদা
সিতাংশু কীসের একটা সংকেত পেয়ে চমকে ওঠে। স্থির চোখে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে অদিতিকে লক্ষ করতে থাকে।
অদিতি বলে, বাবা আর দাদাদের কত টাকা দিয়েছেন আপনি?
তার কণ্ঠস্বরে একটু আগের কোমলতা নেই, চাপা তীব্রতা বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে।
আক্রমণটা এমনই আকস্মিক যে কী উত্তর দেবে, প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না সিতাংশু। কোনোরকমে বলে, আপনি মানে
চোখ মুখ ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠতে থাকে অদিতির। সে বলে, আমার কথার উত্তর দিন। কত টাকা দিয়েছেন? কারেক্ট ফিগারটা আমি জানতে চাই।
অদিতির বলার ধরনে এমন একটা কর্তৃত্ব রয়েছে যা সিতাংশুকে প্রায় মাটিতে নুইয়ে রাখে। সে মিনমিনে গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।
অদিতি একটু ভেবে বলে, আপনার তো আবার দান-টান করে কিছুই মনে থাকে না। আমি হেল্প করছি। আশা করি মনে পড়ে যাবে। বাবা আর দাদাদের এখনও পর্যন্ত সাড়ে চার। লাখ টাকার মধ্যে দিয়েছেন। তাই না? ভুল হলে কারেক্ট করে দেবেন।
সিতাংশু চুপ করে থাকে।
অদিতি থামেনি, এতগুলো টাকার কী গতি হয়েছে আপনি কি জানেন?
সিতাংশু এবারও উত্তর দেয় না।
অদিতি বলতে থাকে, ডেফিনিটলি আপনি জানেন কিন্তু আমাকে বলতে বোধহয় আটকাচ্ছে। ঠিক আছে, তবু আরেকবার বলা যাক। বাবা শেয়ার মার্কেটের ফাটকাবাজিতে আর দুই দাদা রেস গ্যাম্বলিং উইম্যানজিংয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। আমার ধারণা, এইসব মহৎ উদ্দেশ্যে বাবা দাদারা চাইলে আরও টাকা আপনি দেবেন। কারেক্ট? একটু থেমে পরক্ষণেই আবার সে শুরু করে, মিস্টার ভৌমিক, লোকে দু-পাঁচশো, বড়জোর হাজার দু-হাজার পর্যন্ত দান-টান করে। কিন্তু বিনা স্বার্থে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে বসেছে, এমন দানবীরকে চোখে তো দেখিইনি, নামও শুনেনি। আমার ধারণা–
এতক্ষণে সিতাংশুর গলা থেকে একটি মাত্র শব্দ বেরিয়ে আসে, কী?
নিশ্চয়ই স্ট্যাম্পড কাগজে বাবা-দাদাদের দিয়ে সই করিয়ে এই টাকাগুলো আপনি দিয়েছেন। সেখানে কী কী শর্ত আছে, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি।