অমিতাদি চেইন স্মোকার। তাঁর হাতে সিগারেট নেই, এমন দৃশ্য আদৌ চোখে পড়ে না।
তিনি ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়ান। পুরু চশমা, শার্ট-ট্রাউজার্স, সিগারেট, মাথায় বয়েজ-কাট চুল–সব মিলিয়ে অমিতাদিকে ঘিরে রয়েছে প্রচণ্ড এক ব্যক্তিত্ব।
অমিতাদির জীবনের গ্রাফটি বিচিত্র। সেখানে প্রচুর বাঁক এবং উত্থান-পতন। সতেরো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। পৈতৃক পদবি সরকার পালটে তিনি হয়েছিলেন অমিতা দত্ত। কিন্তু সেই বিয়েটা তিন বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।
যে ফ্যামিলিতে তিনি বধু হয়ে যান সেটা ছিল বেজায় গোঁড়া, প্রচণ্ড রক্ষণশীল এবং তেমনি তাদের শুচিবাই। উত্তর কলকাতার যেটা তাঁর শ্বশুরবাড়ি সেটা মুঘল হারেমের চাইতেও দুর্ভেদ্য। ছোট ছোট জানলায় একদিকে থাকত তারের জাল, আরেক দিকে মোটা পর্দা। যেদিকে তাকানো যাক, দরজায় জানলায় শুধু পর্দা আর পর্দা।
বাড়ি থেকে এক-পা বেরুবার উপায় ছিল না, এমনকী বাপের বাড়িতেও পুজোয় আর জামাইষষ্ঠীতে এই দুবারের বেশি যেতে দেওয়া হত না। একা স্বামীর সঙ্গে বেরুনোও নিষিদ্ধ। সিনেমা থিয়েটারে যেতে হলে পাহারাদার হিসেবে যেত শাশুড়ি কি খুড়শাশুড়ি কিংবা বিধবা বড় এক ননদ। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অমিতাদিকে বাড়িঘর এবং আসবারের মতো একটা পারিবারিক সম্পত্তি মনে করতেন। তাঁর আলাদা যে এক অস্তিত্ব আছে, এটা কেউ ভাবতেও চাইতেন না।
তিন বছর সেই দুর্গে আটকে থেকে যখন অমিতাদির দম বন্ধ হয়ে আসছে সেই সময় একদিন মরিয়া হয়ে বাপের বাড়ি পালিয়ে এসেছিলেন। আর কোনোদিন স্বামীর কাছে ফিরে যাননি। আশ্চর্য, স্বামী বা শ্বশুর তাঁর খোঁজখবর করতে একবারও বাবার কাছে আসেননি। শেষপর্যন্ত বাবা ডিভোর্সের জন্য অ্যাপিল করেন। কিন্তু এবারও স্বামী বা শ্বশুরকে কোর্টে দেখা যায়নি। একতরফা মামলা চালিয়ে জিতে যান অমিতাদিরা এবং মসৃণভাবে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে যায়। আসলে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আর বিনা অনুমতিতে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তাকে ফিরিয়ে নেবার মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করেননি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
এরপর অমিতাদির বাবা আবার তাঁর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজি হননি। প্রথম বিয়ের আগে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। নতুন করে এই ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে তিনি সোজা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, বাবা চিরকাল থাকবেন না, বাবার কিছু ঘটলে কে তাঁকে আশ্রয় দেবে? কোথায় পাবেন নিরাপত্তা?
পরের মুখাপেক্ষী না-হয়ে বেঁচে থাকতে হলে তাঁর প্রয়োজন সম্মানজনক কোনো চাকরি-বাকরি। কিন্তু সামান্য একজন ম্যাট্রিকুলেটকে কে কাজ দেবে?
চার বছর কলেজে এবং দু-বছর ইউনিভার্সিটিতে মোট ছটা বছর চোখের পলকে যেন কেটে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই অমিতাদি কলেজে লেকচারারশিপ পেয়ে যান। সেখানে বছর সাতেক পড়াবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে চলে আসেন। এই সময় তাঁর জীবনে আসে আরেকটি পুরুষ–বিমলেশ।
বিমলেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে অমিতাদির বিয়ে হয়নি। স্বামী-স্ত্রীর মতো তাঁরা একসঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছেন কিন্তু সম্পর্কটা একেবারেই স্থায়ী হয়নি। কেন না তখন তিনি জানতেন না বিমলেশ বেজায় অলস এবং প্রচণ্ড মাতাল। পাকস্থলীতে হুইস্কিটা বেশি পরিমাণে ঢুকে গেলে সে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠত। তার ওপর একসঙ্গে মাস তিনেক কাটাবার পর সে দুম করে চাকরি ছেড়ে দেয় এবং অমিতাদির কাঁধে চড়ে বসে। তার ধারণা ছিল চিরকাল অমিতাদি তাকে পুষবেন আর মদের পয়সা যোগাবেন। অতিষ্ঠ অমিতাদি একদিন তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেন। সেই থেকে পুরুষ সম্পর্কে তাঁর ধারণা আগাগোড়া পালটে যায়। বিশেষ করে বিবাহিত এবং অবিবাহিত দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে তাঁর কোনোরকম মোহ বা আকর্ষণ থাকে না। এ ব্যাপারে তাঁর পুরোপুরি স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যায়।
আজকাল অমিতাদি যে অনবরত সিগারেট খান, শার্ট-ট্রাউজার্স পরেন~-এ-সবই এক ধরনের প্রোটেস্ট। নারী জাগরণ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পুরুষের প্রভুত্ব, স্বার্থপরতা আর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করেছেন বলা যায়।
অমিতাদি প্রেসিডেন্ট হলেও টেবিলের ওধারে বসে যে মেয়েটি (অর্থাৎ অদিতি) ডিকটেশন নিচ্ছে সে-ই এই কাহিনির প্রধান চরিত্র।
অদিতি নারী-জাগরণ-এর একজন অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। তার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ। গায়ের রং ডিমের ভেতরকার কুসুমের মতো। টান টান সতেজ চেহারা। লম্বাটে মুখ, নাক সটান কপাল থেকে নেমে এসেছে। উজ্জ্বল চোখ তার, রাজহাঁসের মতো গলা, নিটোল হাতে কোথাও এতটুকু ভাঁজ নেই। দীর্ঘ ঘন চুল এলোমেলোভাবে একটি খোঁপায় আটকানো।
পরনে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি এবং হলুদ ব্লাউজ। অমিতাদির মতোই তার হাতে একটি ঘড়ি ছাড়া আর কোনো গয়না-টয়না নেই। এতেই তাকে অলৌকিক মনে হয়। তার চেহারায় অভিজাত্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব মিশে আছে।
অদিতি একটা কলেজে ইংরেজি পড়ায়। এমন এক পরিবার থেকে সে এসেছে, যার ইতিহাস রীতিমতো জটিল। কিন্তু সেকথা এখন না, পরে বিস্তৃতভাবে বলতে হবে।
একসময় ডিকটেশন নেওয়া শেষ হয়।
.
অমিতাদি বলেন, কৃষ্ণাকে মেমোরেন্ডামটা টাইপ করতে দাও। খুব তাড়াতাড়ি যেন করে দেয়। দশ মিনিটের ভেতর আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।