ব্যস্তভাবে সিতাংশু বলে, আমিও সেন্ট পারসেন্ট অনেস্ট থাকতে চাই। কিন্তু ওই যে একটু আগে বললাম, ব্ল্যাক মানি ছাড়া বিজনেসে একটা স্টেপও ফেলা যায় না। অনেস্টি নিয়ে চললে সাতদিনে আমার কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে। আর নিট রেজাল্ট হবে এই, চারশো ওয়ার্কার সঙ্গে সঙ্গে বেকার হয়ে যাবে। এই লোকগুলোর ভবিষ্যৎ কী, তারা কী খাবে, কী হবে তাদের ছেলেমেয়ের–এসবও তো মাথায় রাখতে হয়।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে অদিতি বলে, অনেস্ট হওয়ার সমস্যাও তা হলে আছে দেখছি।
সিতাংশু বলে, আমাদের সোশিও-ইকনমিক প্যাটার্নটাই এরকম দাঁড়িয়ে গেছে। দু-একজন অনেস্ট হয়ে কী করবে?
ডিজঅনেস্টি যদি চারশোটা ফ্যামিলিকে বাঁচাতে পারে, তা হলে সততা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলেনা কি বলেন?
সিতাংশু উত্তর দেয় না।
অদিতি বলে, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনার একজাট বয়স কত?
বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মতো উলটোপালটা জেরা করে অদিতি তার কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য বের করে নিতে চাইছে, বোঝা যাচ্ছে না। সে সতর্ক ভঙ্গিতে জিগ্যেস করে, বয়েস জানতে চাইছেন কেন?
বলুন না—
চল্লিশের কাছাকাছি।
আমাদের দেশের পক্ষে বিয়ের বয়েসটা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছেন। পুরোনো কাল হলে বানপ্রস্থর আগে স্টেজে চলে যেতেন। বলতে বলতে সামনের দিকে ঝুঁকে গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে দেয়, এতদিন বিয়ে করেননি কেন?
হঠাৎ ভীষণ ঘাবড়ে যায় সিতাংশু। তার মতো একজন সফল স্মার্ট বিজনেসম্যানও উপযুক্ত উত্তরটি খুঁজে পায় না। কোনোরকমে সে বলে, আমি–আমি মানে
অদিতি তার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল। আস্তে আস্তে বলে, আমি আপনার সম্বন্ধে একটা খবর পেয়েছি। সেটা কতদুর সত্যি, আদৌ সত্যি কিনা, আপনিই শুধু বলতে পারবেন। তিনটে বিয়ের কথাই মৃণালিনী তাকে জানিয়েছেন কিনা, সে মনে করতে পারল না। অবশ্য সিতাংশু তিনটে করুক কি দশটা করুক সংখ্যায় তার কিছু এসে যায় না।
কী খবর?
আপনি আগে তিনবার বিয়ে করেছেন। একবার ডিভোর্স হয়েছে। একবার
অদিতির কথা শেষ হবার আগেই সিতাংশু বলে ওঠে, প্রথম বিয়েটা হয়েছিল নামমাত্র। অ্যাডজাস্টমেন্ট হল না, বছরখানেকের ভেতর আমরা মিউঁচুয়ালি সেপারেশন করে নিই।
আদিতি বলে, আর সেকেন্ড ম্যারেজ? শুনেছি মিস্টিরিয়াস অবস্থায় আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। ব্যাপারটা থানা পুলিশ পর্যন্ত নাকি গড়িয়েছিল?
সিতাংশুর কপালে দানা দানা ঘাম জমতে থাকে। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে সে বলে, কে আপনাকে এসব বাজে খবর দিয়েছে, জানি না। মনে হয়, বিজনেসে আমার যারা শত্রুপক্ষ তারাই এভাবে ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন করছে। ইটস আ ডার্টি সোন্ডারিং এগনেস্ট মি। আসলে ঘটনাটা খুবই আনফরচুনেট। একটা গ্যাস সিলিন্ডার বাচঁ করে রমলা, মানে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যায়। এ নিয়ে থানা-পুলিশের ইনভলভমেন্টটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। একটানা দম-আটকানো গলায় বলে যায় সে।
অদিতি বলে, আপনার মতো একজন বিশিষ্টি শিক্ষিত ভদ্রলোক যখন বলছেন তখন তা বিশ্বাস করা উচিত। আমিও করলাম। এবার থার্ড ম্যারেজের কী গতি হল বলুন।
অদিতির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না সিতাংশু। ঘাড় ভেঙে তার মাথা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে যেন। সে বলে, সেটাও আমার পক্ষে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রেখার সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত অ্যাডজাস্ট করা গেল না। কোর্ট থেকে আমরা ডিভোর্স নিয়েছি বছর তিনেক আগে।
তৃতীয় বিয়েটার কথা স্রেফ আন্দাজেই বলেছে অদিতি। দেখা গেল, সেটাও লেগে গেছে। কে জানে, আরও ডজনখানেক বিয়ে সিতাংশু করে বসে আছে কিনা। অদিতি অত্যন্ত শান্ত নিস্পৃহ মুখে বলে, আপনি যে কোনো কিছু না লুকিয়ে সব কথা ফ্রাঙ্কলি জানিয়েছেন, সে জন্য অনেক ধন্যবাদ।
গল গল করে ঘামতে ঘামতে এবং সেই ঘাম মুছতে মুছতে সিতাংশু বলে, লুকোবার কী আছে? যা ঘটেছে তা একদিন-না-একদিন জানাজানি হয়ে যাবেই। আমি আর কদিন চাপা দিয়ে রাখতে পারব?
দ্যাট শুড বি দ্যা স্পিরিট। অদিতি বলতে থাকে, আরও কিছু খবর আমার কানে এসেছে। যদিও কোনোরকম রিউমার আমি গ্রাহ্য করি না, তবু ব্যাপারটা আপনার কাছ থেকে শুনলে আপনাকে বুঝতে আমার পক্ষে সুবিধে হয়।
আমার সম্বন্ধে আর কী শুনেছেন? সিতাংশুর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে থাকে।
অদিতি কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে, সংকোচ হচ্ছে, তবু বলি। শুনেছি, কয়েকটা ফ্ল্যাট কিনে আপনি চার-পাঁচজন রক্ষিতা রেখেছেন।
দ্রুত মাথা তোলে সিতাংশু। তার মুখ থেকে পরতে পরতে রক্ত নেমে গিয়ে একেবারে ফ্যাকাশে দেখায়। ঝাপসা গলায় সে বলে, কারা কারা এসব রটিয়ে বেড়াচ্ছে? দিজ আর অ্যাবসোলুটলি ফলস্।
অদিতি হাসে, আপনার চোখ-মুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে মিস্টার ভৌমিক।
কী বলতে চাইছেন আপনি?
যা বলার তা তো বলেই ফেলেছি। তার মধ্যে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই। বিয়ের ব্যাপারে আপনি যেভাবে বললেন, আশা করি রক্ষিতাদের বিষয়েও ঠিক সেইরকম ফ্রাঙ্ক হবেন।
কয়েক সেকেন্ড আগে মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এবার শরীরের সব রক্ত সেখানে উঠে এসে মুখটাকে ভয়ংকর করে তোলে। সে বলে, কে আপনাকে এ খবর দিয়েছে?
যে-ই দিক, তার নাম বলব না। কথাটা সত্যি কিনা সেটুকুই শুধু জানতে চাইছি।