অদিতি বলে, বাবা বড়দা ছোটদা এসব জানে?
জানা তো উচিত।
আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল অদিতি, দুর্গা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলে, ছোটদি, বড়বাবু তোমাকে ডাকছেন। এক্ষুনি নীচে যাও
ঠিক আছে, তুই যা। আমি আসছি। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় অদিতি। তার মুখ-চোখ দেখে মনে হয়, ভেতরে ভেতরে সিংশুর ব্যাপারে একটা কিছু সিদ্ধান্ত করে ফেলেছে।
দরজার কাছ থেকে চলে যায় দুর্গা। মৃণালিনী বলেন, চললি?
হ্যাঁ।
আমার কথাটা মনে থাকে যেন।
থাকবে।
নীচে নামতে নামতে অদিতি দেখতে পায়, দোতলার বারান্দায় বড় বউদি বন্দনা আর ছোট বউদি মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হেমলতাকে এবার আর দেখা যায় না। অদিতির পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তারা থামকে যায়। বোঝা যাচ্ছে, তার সম্পর্কেই দুই বউদি কিছু আলোচনা করছিল।
বড় বউদি বন্দনার বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। ছেলেপুলে হয়নি। খুবই গরিবের ঘরের মেয়ে বন্দনা। বরুণ প্রেম করে তাকে বিয়ে করেছিল। যেমন চতুর তেমনি স্বার্থপর। পারিবারিক ডিপ্লোম্যাসিটা এমনভাবে চালিয়ে যায় যাতে ধরার উপায় নেই। কার সঙ্গে কী ব্যবহার করলে, কার কানে কী লাগালে, কার মন যুগিয়ে চললে স্বার্থটি বজায় থাকে, সে সব সুচারুভাবে করে যায় বন্দনা। তার কাজ এতটাই নিখুঁত যে ধরার উপায় থাকে না।
মীরাও প্রেমের রাস্তাতেই, কিঞ্চিৎ ঘুরপথে এ-বাড়িতে এসে ঢুকেছিল। তবে ছোটদা মৃগাঙ্ক তাকে বিয়ে করে আনেনি। তিন মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে বিয়ের আগেই তার প্রবেশ। প্রথমটা মৃগাঙ্ক মীরার সন্তানের দায়িত্ব স্বীকার করতে চায়নি। এই নিয়ে প্রচুর ঝাট হয়েছে। পরে পাড়ার ছেলে এবং পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর চাপে সুড় সুড় করে বিয়ে করেছে। তাদের একটিমাত্র ছেলে–চিকু। সে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।
মীরার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। তার বাপের বাড়ির অবস্থা বন্দনাদের তুলনায় অনেক ভালো। বন্দনার মতো সে অতটা স্বার্থপর বা ধুরন্ধর নয়। তার মধ্যে কিছুটা উদারতা এবং সারল্য রয়েছে।
দুই বউদি একটিও কথা না বলে অদিতিকে লক্ষ করতে লাগল। অদিতি তাদের দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।
নীচের ড্রইংরুমে আসতে রমাপ্রসাদ বললেন, এত দেরি করলি! সেই কখন থেকে সিতাংশু বসে আছে। বস।
একটা ছেঁড়া জরাজীর্ণ সোফায় বসতে বসতে অদিতি জিগ্যেস করে, আমার জন্যে?
হ্যাঁ।
সব জেনে-শুনেও অদিতি বলে, কেন?
বিব্রতভাবে রমাপ্রসাদ বলেন, এই তোর সঙ্গে একটু আলাপ করবে। তাই
অদিতি বলে, কার কাছে যেন শুনেছিলাম সিতাংশুবাবু একজন বিরাট বিল্ডার বিরাট কনস্ট্রাকশান বিজনেস আছে ওঁর। কিন্তু সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি জানি শেক্সপিয়র, শেলি, কিটস, টেনিসন, সুইনবার্ন, এলিয়ট। এঁদের নিয়ে আলোচনা করলে আমার আপত্তি নেই।
বিপন্ন মুখে রমাপ্রসাদ বলেন, না, মানে
তীক্ষ্ণ চোখে বাবাকে দেখতে দেখতে অদ্ভুত হাসে অদিতি। বলে, বাবা বড়দা ছোটদা, তোমরা ওপরে যাও। সিতাংশুবাবুর সঙ্গে আমিই আলাপ করে নিচ্ছি।
অদিতি যা বলেছে তা প্রায় অভাবনীয়। এর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সবাই প্রথমটা হকচকিয়ে গেল। তাপর চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
অদিতি এবার সিতাংশুকে বলে, আপনি চা খেয়েছেন?
সিতাংশু শশব্যস্তে বলে ওঠে, হা হা, নিশ্চয়ই।
আরেকবার দিতে বলব?
আপনি যদি খান তা হলে
ঠিক আছে, খাব।
অদিতি জানে ঘরের বাইরে রমাপ্রসাদ না থাকুন, দুই দাদা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। সিতাংশুর সঙ্গে তার কথাবার্তা শোনার জন্য তাদের দম আটকে আছে। গলা তুলে অদিতি বলে, ছোটদা-বড়দা, দুর্গাকে দিয়ে দু-কাপ চা পাঠিয়ে দিও–
বরুণ বা মৃগাঙ্কর সাড়া পাওয়া যায় না। তবে কয়েক মিনিটের ভেতর চা দিয়ে যায় দুর্গা।
একটা কাপ তুলে নিয়ে অদিতি বলে, সারাদিন নানা কাজে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। আমি ভীষণ টায়ার্ড। আপনিও শুনলাম বেশ কিছুক্ষণ ওয়েট করছেন। বাজে ভণিতা না করে কাজের কথা শুরু করা যাক
সিতাংশু চায়ের কাপ তুলে নিয়েছিল। সে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে উৎসুক চোখে তাকায়।
অদিতি সোজাসুজি সিতাংশুকে লক্ষ করতে করতে বলে, দেখুন কেউ আমাকে স্ট্রেট কিছু বলেনি। তবে মাস দু-তিনেক ধরে খবর পাচ্ছি আপনি রেগুলার আমাদের বাড়ি আসছেন। আমার দাদাদের আপনি বন্ধু, বাবারও বিশেষ পরিচিত। আসাটা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে আমার মাথা ঘামাবার কিছু ছিল না।
কী?
কয়েকদিন হল টের পাচ্ছি, বাবা আর দাদারা চান আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক আর সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ওঁরা ঠিক করেছিলেন আজ আপনার সঙ্গে আমার ফরম্যাল আলাপের সুযোগ করে দেবেন। ঠিক বলছি তো?
কোনো মেয়ে সরাসরি এ জাতীয় কথা এত অসঙ্কোচে বলতে পারে, সিতাংশুর ধারণা ছিল না। সে প্রথমটা অবাক হয়ে যায়। তারপর দ্বিধান্বিতভাবে বলে, ঠিক
যদি আমার কোথাও ভুল হয় কারেক্ট করে দেবেন।
সিতাংশু উত্তর দেয় না।
অদিতি আবার বলে, আপনি যখন কয়েকঘণ্টা ওয়েট করছেন তখন ধরে নিতে পারি এ বিয়েতে আপনারও সায় রয়েছে।
চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে মুখ হেলিয়ে দেয় সিতাংশু।
অদিতি বলে, যাক, বিয়ের ব্যাপারে আপনার পরিষ্কার মতামতটা যখন জানা গেল তখন আলোচনা করতে সুবিধে হবে।