শিবপ্রসাদ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, কিন্তু তোর ভবিষ্যৎ?
সেটা আমি ভেবে রেখেছি।
সেদিনই শিবপ্রসাদ এবং রমাপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে শ্বশুরবাড়ির নামে একটা ডায়েরি করেছিলেন। পরের দিন থেকে নতুন করে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল।
শিবপ্রসাদ বেঁচে থাকতে থাকতেই মৃণালিনী এম.এ পাশ করে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। এতে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। মেয়েদের সম্পর্কে এই পরিবারের ধ্যানধারণার সঙ্গে চাকরিটা একেবারেই খাপ খায় না। মেয়েরা পয়সা রোজগারের জন্য বাইরে বেরুবে, এটা ছিল একেবারে অভাবনীয়। ক্ষুব্ধ শিবপ্রসাদ বলেছিলেন, আমি কি তোকে দু-বেলা দুটো খেতে দিতে পারি না?
মৃণালিনী বলেছিলেন, নিশ্চয়ই পারো। তুমি যতদিন আছ ততদিন ঠিক আছে। তারপর?
রমাপ্রসাদ কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার ওপর তোর কি বিশ্বাস নেই মিনু? তাঁর চোখে-মুখে অভিমান এবং কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে।
মৃণালিনী বলেছেন, কাউকেই আমি অবিশ্বাস করি না দাদা। এম.এ পাশ করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। কিছু একটা করা ভালো।
শিবপ্রসাদ কুণ্ঠিত মুখে বলেছিলেন, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
মৃণালিনী জিগ্যেস করেছিলেন, কী কথা?
আবার যদি তোর বিয়ে দিই?
মেয়েদের ব্যাপারে এ বাড়ির লোকেরা বিয়ে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না। সেটাই যেন তাদের পক্ষে ভবিষ্যতের একমাত্র গ্যারান্টি। সেই যে মৃণালিনীর শ্বশুর উত্তেজিত ভঙ্গিতে চলে গিয়েছিল, তার কয়েক দিন বাদেই চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিল, মৃণালিনীর সঙ্গে তাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই, তাঁর কাছে শ্বশুরবাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। চিঠিটা পাওয়ার পরই ভঙ্গুর বিবাহিত জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মৃণালিনীর হাতে যে শাখা ছিল তা খুলে ফেলেছেন তিনি, সিঁথি থেকে সিঁদুর ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছেন। একমাসের দাম্পত্যজীবন এইভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সতেরো বছর বয়সে পুরুষদের সম্পর্কে যে মারাত্মক ধারণাটি তাঁর হয়েছিল তাতে নতুন করে বিয়ের ফাঁদে আর পা দিতে চাননি। মৃণালিনী বলেছেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর দরকার নেই।
কিন্তু~~
আমার সম্বন্ধে অত ভেবে ভেবে এই বয়সে কেন শরীর খারাপ করছ? শুধু এ বাড়িতে আমাকে একটু থাকতে দিও। আর কিছু দরকার নেই। আমি তো বাচ্চা মেয়ে নই। কীসে আমার ভালোমন্দ সেটা বুঝি। আমার ভাবনা আমাকেই ভাবতে দাও।
তারপর দশ বছর আগে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী না-হওয়া পর্যন্ত একটানা স্কুলে পড়িয়ে গেছেন মৃণালিনী। হেড মিস্ট্রেসও হয়েছিলেন।
এর মধ্যে শিবপ্রসাদ এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মৃণালিনীর মা মারা গেছেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি অদিতির ছোটদি সুজাতাকে নিয়ে। সুজাতার স্বামী এবং শ্বশুর ব্যবসার নাম করে রমাপ্রসাদের কাছে বেশ কিছু টাকা চেয়েছিল কিন্তু তখন এ-বাড়ির অবস্থা পড়ে গেছে। টাকা দেবার ক্ষমতা এদের ছিল না। ফলে সুজাতাকে আর বাপের বাড়ি আসতে দেওয়া হয় না। অদিতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একরকম শেষ-ই হয়ে গেছে বলা যায়। তবে মন্দের এটুকুই ভালো, বধূহত্যার তালিকায় তার নামটা অন্তত ওঠেনি।
মৃণালিনীর মতো সুজাতার অতটা সাহস বা দৃঢ়তা ছিল না। শ্বশুরবাড়ি থেকে মাথা উঁচু করে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শ্বশুর এবং স্বামীর সিদ্ধান্ত সে নিঃশব্দে মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল…।
মৃণালিনী এবার বললেন, এই বিয়েতে আমি মত দিলাম বুবু, যদি বুঝতাম সিতাংশু ভালো ছেলে। কিন্তু ওটা পাজির পা ঝাড়া
এতক্ষণ মৃণালিনী এবং সুজাতার অতীত জীবনের কথা ভাবছিল অদিতি। সে চমকে ওঠে।
মৃণালিনী থামেননি, দুশ্চরিত্র, লম্পট। অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে।
অবাক হয়ে পিসিকে দেখতে থাকে অদিতি। এই মহিলা কি অলৌকিক কোনো ক্ষমতার অধিকারিণী? ঘরে শুয়ে থেকে এত সব খবর পান কী করে? নিজের অজান্তেই অদিতি বলে, তুমি কেমন করে জানলে?
মৃণালিনী বলেন, যখন খবর পেলাম তোর বাবা আর দাদারা সিতাংশুর সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার মতলব করেছে তখন চিঠি লিখে টোকনকে ডাকিয়ে এনেছিলাম।
টোকন অদিতির দূর সম্পর্কের খুড়তুতো ভাই। বছর দেড়েক আগে বি.এস সি পাশ করেই নিজের চেষ্টায় একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ জোগাড় করে ফেলেছে। টোকন দারুণ তুখোড় আর স্মার্ট। অসম্ভব বলে তার কাছে কোনো ব্যাপারই নেই। যে কাজেই তাকে লাগিয়ে দেওয়া যাক, যেভাবেই হোক, সেটি করবেই।
অদিতি এবং মৃণালিনী দরকার হলেই তাকে খবর দেন। পিসি যখন চিঠি দিয়ে ডাকিয়ে এনেছিলেন তখন গোয়েন্দা হিসেবে নিশ্চয়ই সিতাংশুর পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন এবং টোকন অবশ্যই তার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে গেছে। এসব কাজে টোকনের প্রচণ্ড উৎসাহ।
মৃণালিনী আবার বললেন, বুঝতেই পারছিস কেন টোকনকে চিঠি লিখেছি। ও পরশু জানিয়ে গেছে, সিতাংশু এর আগে দু-বার বিয়ে করে দু-বার ডিভোর্স করেছে। তা ছাড়া দু-একটা রক্ষিতাও নাকি আছে। তা ছাড়া প্রায়ই নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে পোয়া, গোপালপুর এমনি সব জায়গায় যায়। কন্ট্রাক্টারি করে লাখ লাখ টাকা করেছে–প্রচুর নাকি ব্ল্যাক মানি। পাপের টাকা এইভাবেই খানিকটা ওড়াচ্ছে।