প্রথমে মৃণালিনীর কথাই ধরা যাক। এক সময় দারুণ ছাত্রী ছিলেন মৃণালিনী। সতেরো বছর বয়সে স্কলারশিপ নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। তার পরেই ঠাকুরদা তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। মৃণালিনী আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রচুর পয়সা করলেও এ-বাড়ির আবহাওয়ায় বহুকালের প্রাচীন সংস্কার শিকড় গেড়ে ছিল। পনেরো পেরুবার আগেই এই বংশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। সেদিক থেকে বয়স দুবছর বেশি হয়ে গিয়েছিল মৃণালিনীর। বিয়েটা আটকাবার জন্য প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন তিনি, পুরো তিনটে দিন প্রতিবাদ হিসেবে কিছু খাননি। কিন্তু রমাপ্রসাদকে টলানো যায়নি। মেয়ের জন্য পারিবারিক প্রথা তিনি পুরোপুরি ভাঙতে পারেন না।
বিয়ে হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক বনেদি অভিজাত পরিবারে। পৃথিবীতে কাম্য বস্তু বলতে তাদের যদি কিছু থাকে তা হল অর্থ। নিজেদের কোনোরকম অভাব ছিল না। গোটাচারেক বাড়ি, তিন-চারটে গাড়ি, ওয়েলার ঘোড়ায় টানা ফিটন ইত্যাদি। তাছাড়া ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট অজস্র টাকা, নানা কোম্পানিতে আট-দশ লাখ টাকার শেয়ার। তবু তাদের খাই মিটত না। এইসব টাকার বেশিরভাগ এসেছে ছেলেদের বিয়ের যৌতুক হিসেবে। মৃণালিনীর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়েটাকে টাকা বানাবার একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করত। বেছে বেছে এমন সব বাড়ি থেকে পুত্রবধু যোগাড় করত যাদের প্রচুর অর্থ, বিপুল প্রপার্টি।
মৃণালিনীর বিয়ের সময় তাঁর শ্বশুরেরা যৌতুক এবং নগদ টাকা যা আদায় করার তা তো আদায় করেছিলই, মাসখানেক পর থেকে আরও টাকা আনার জন্য মৃণালিনীর ওপর চাপ দেওয়া শুরু হয়েছিল। প্রথম প্রথম শাশুড়িই তাঁকে টাকার কথা বলত, মৃণালিনী শুনতেন কিন্তু উত্তর দিতেন না। পরে শ্বশুর বলতে শুরু করেছিল। অন্য পুত্রবধূরা যে কত ভালো এবং তাদের বাপেরবাড়ি থেকে কতভাবে কত টাকা নিয়ে এসেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বলত, শ্বশুরবাড়িই হচ্ছে মেয়েদের সর্বস্ব এবং সব মেয়েরই কর্তব্য সেখানকার বিষয়-সম্পত্তি আর টাকাপয়সা অনবরত বাড়িয়ে চলা। মৃণালিনীর স্বামীরও এ ব্যাপারে পুরোপুরি সায় ছিল।
মৃণালিনী আগে জানতেন না, পরে শুনেছেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে বধূ হত্যার দু-একটি দৃষ্টান্ত আছে। যে পুত্রবধূরা বাপেরবাড়ি থেকে টাকা আনতে রাজি হয়নি বা এ-ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছে তাদের অকালে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। একেবারে খুনির বংশ। পয়সার জন্য এরা না-পারে এমন কোনো কাজ নেই।
দু-চারবার শোনার পর মৃণালিনী মনস্থির করে ফেলেছিলেন। একদিন শ্বশুরকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে নিয়ে বাবার কাছে চলুন।
শ্বশুরের চোখ-মুখ লোভ চকচকিয়ে উঠেছিল। সে তক্ষুনি চুনোট-করা ধাক্কাপড় কাচি ধুতি, গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে পায়ে গুঁড়োলা নাগরা লাগিয়ে, মাথায় পরিপাটি টেড়িটি কেটে মৃণালিনীকে নিয়ে ফিটনে উঠেছিলেন।
ওল্ড বালিগঞ্জে নিজেদের বাড়ি এসে শ্বশুরকে ড্রইংরুমে বসিয়ে বাবা, দাদা এবং মাকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন মৃণালিনী। শান্ত গলায় বাবাকে বলেছিলেন, বাবা, থানার
অফিসার-ইন-চার্জকে খবর দাও, এখনই যেন তিনি চলে আসেন।
সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। শিবপ্রসাদ বিমূঢ়ের মতো বলেছিলেন, থানার অফিসার এসে এখানে কী করবে?
শ্বশুরকে দেখিয়ে মৃণালিনী বলেছিলেন, এই লোকটার নামে আমি একটা ডায়েরি করব।
মা বাবা দাদা, এমনকী মৃণালিনীর শ্বশুর পর্যন্ত আঁতকে উঠেছিল। মা বলেছিলেন, কার সম্বন্ধে কী বলছিস মিনু! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
মাথা আমার ঠিকই আছে মা। তোমরা ভালো করে খোঁজখবর না নিয়ে খুনিদের বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়েছিলে।
শিবপ্রসাদ ধমকে উঠেছিলেন, মিনু!
মৃণালিনী বলেছিলেন, আমার সব কথা আগে শুনে নাও। এরা আমার বিয়ের সময় তোমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা আদায় করেছিল। এখন আবার পঞ্চাশ হাজার চাইছে। আর সেই টাকাটা নেবার জন্যেই আমাকে নিয়ে এখানে এসেছে। তোমরা যদি না দাও আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। ঠিক সেই কারণে তিন-চারটি বউকে এরা খুন করেছে।
ভয়ে মৃণালিনীর শ্বশুরের মুখ প্রথমটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই অসহ্য রাগে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। গলায় শির ছিঁড়ে চিৎকার করে উঠেছিল, এই অপমানের কথা আমার মনে থাকবে।
মৃণালিনী বলেছিলেন, মনে থাকাটা খুব দরকার।
শ্বশুর আর দাঁড়ায়নি, দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে গিয়েছিল।
শিবপ্রসাদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। তারপর বলেছেন, এ তুই কী করলি মিনু! পঞ্চাশ হাজার টাকা নাহয় আমি দিতাম।
কিছুতেই না। এই অন্যায়কে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। আজ পঞ্চাশ হাজার দিয়ে তুমি রেহাই পাবে ভেবেছ! কালই আবার এক লাখ চেয়ে বসবে। ওদের লোভের শেষ নেই।
কিন্তু যে কাণ্ড তুই করলি তাতে শ্বশুরবাড়ির দরজা তো চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
আমি সেটাই চাই। ওইরকম পশুদের বাড়ি আমি কখনোই যাব না।
পাগলামি করিস না। আমি তোর শ্বশুরমশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বরং-~
একেবারে না বাবা। তীব্র গলায় মৃণালিনী বলেছিলেন, একটা ইতর শয়তানের কাছে তুমি হাতজোড় করে গিয়ে দাঁড়াবে, এ আমি ভাবতেই পারি না।