একধারে দেওয়াল ঘেঁষে একটা তক্তাপোষে শুয়ে আছেন মৃণালিনী। ঘরের মাঝখানে একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। এধারে-ওধারে দু-তিনটে পাল্লা-ভাঙা আলমারি। উলটোদিকের অন্য একটা দেওয়ালে গোল আয়না, সেটার তলায় কাঠের তাকে চিরুনি চুলের কাঁটা, একটা খোলা পাউডারের কৌটো, নেইল কাটার, ইত্যাদি। বর্ষার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে গোটা ঘরটায় কালচে কালচে দাগ ধরে আছে। সিলিং থেকে পলেস্তারা খসে খসে ভেতরকার লোহার ফ্রেম বেরিয়ে পড়েছে।
মৃণালিনীর বয়স পঁয়ষট্টি ছেষট্টি। বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাঁর হাইট রীতিমতো ভালোই-পাঁচ ফিট সাত-আট ইঞ্চির মতো। চওড়া চওড়া হাড়ের ফ্রেমে একসময় দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ছিল তাঁর। খুবই সুন্দরী ছিলেন যৌবনে। হেমলতাও অসাধারণ রূপসি। কিন্তু দুজনের রূপ দুই ধরনের। হেমতলার দৈহিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে থাকত ভীরুতা। কিন্তু মৃণালিনীকে ঘিরে যা ছিল তা দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিত্ব। এমন তেজি মহিলা খুব বেশি দেখেনি অদিতি।
অবশ্য এই পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়েসে রূপ এবং স্বাস্থ্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। হেমলতার মতোই তাঁর সবকিছু শেষ গেছে। তার ওপর পাঁচ বছর ধরে পক্ষাঘাতে ডানদিকটা পড়ে গেছে। হেমলতা তবু চলে ফিরে বেড়ান, সংসারের টুকিটাকি নানা কাজকর্ম করেন। মৃণালিনীর সে সামর্থ্যটুকুও নেই। আমৃত্যু তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হবে।
মৃণালিনী বললেন, আমার কাছে আয়।
অদিতি এগিয়ে গিয়ে মৃণালিনীর পাশে বসে পড়ে বলে, আমি যে এখন আসব, জানলে কী করে?
দুর্গাকে জানলার কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম। তোকে দেখলেই যেন ধরে নিয়ে আসে।
কেন?
তোর বাবা, রাজা, বাবলু আর সেই লোকটা কী যেন নাম?
সিতাংশু ভৌমিক।
হ্যাঁ সিতাংশু। ওদের হাতে পড়ার আগে তোকে অনেক কথা জানাবার আছে।
বলো।
স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তোর বাবা আর ভাইরা তোকে সিতাংশুর সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। তবে এটাকে বিয়ে বলে না।
রমাপ্রসাদ, বরুণ আর মৃগাঙ্ক তার বিয়ে যে সিতাংশুর সঙ্গে দিতে চায়, সেটা অনেক আগেই টের পেয়েছে অদিতি। কিন্তু এর সঙ্গে তাদের স্বার্থসিদ্ধির কী সম্পর্ক, বোঝা যাচ্ছে না।
বিমূঢ়ের মতো সে বলে, বিয়ে বলে না!
না।
তাহলে এটা কী?
মৃণালিনীর শরীরের যে অংশটা সুস্থ, সেখানে কোনো অদৃশ্য বৈদ্যুতিক প্রবাহ খেলে যায়। প্রবল উত্তেজনায় সে দিকটা কাঁপতে থাকে। বাঁ হাতটা তুলে তিনি বলেন, তোকে ওরা বেচে দিতে চায়।
এবার হকচকিয়ে যায় অদিতি, মানে।
কিছুই কি তুই টের পাসনি বুবু?
কী টের পাব?
আশ্চর্য, আমি এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব জানতে পারি আর তোর যে এতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে সে খবরটুকুও রাখিস না! বলে একটু থামেন মৃণালিনী। পরক্ষণেই তীব্র গলায় আবার শুরু করেন, তোর বাপ আর দাদারা ওই লোকটার কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছে। সেসব শোধ করার ক্ষমতা এ জন্মে ওদের হবে না। এদিকে সিতাংশুর নজর পড়েছে তোর ওপর। বিয়ে হলে টাকাটা আর তাকে ফেরত দিতে হবে না।
বাবা আর দাদারা যে এতটা নীচে নেমে গেছে, ভাবতে পারেনি অদিতি। পক্ষাঘাতে-অসাড় মানুষের মতো সে বসে থাকে।
মৃণালিনী বলেন, নারী-জাগরণ নারী-জাগরণ করে তো খাওয়া-দাওয়া ঘুম-বিশ্রাম সব প্রায় ছেড়েছিস, দিন রাত সারা শহর তোলপাড় করে বেড়াচ্ছিস কিন্তু নিজের জাগরণটা কবে হবে?
অদিতি আস্তে আস্তে মৃণালিনীর দিকে তাকায়। তবে কোনো উত্তর দেয় না।
মৃণালিনী সস্নেহে তাঁর বাঁ হাতটি অদিতির কাঁধে রেখে বলেন, ভয় পাস না, আমি তোর পেছনে আছি।
বাবা এবং দাদাদের নীচতা আর গোপন ষড়যন্ত্র অদিতিকে প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছিল। মৃণালিনী একটু আগে যা বললেন সেই কথাগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ভাবছে। নিজের সম্বন্ধে অদিতির ধারণা, নারী স্বাধীনতা এবং মেয়েদের অসংখ্য সমস্যার ব্যাপারে সে একজন ধর্মযোদ্ধা। এই শহরে যেখানেই বধূহত্যা, নারী নির্যাতন বা মেয়েদের ওপর আক্রমণ সেখানেই অদিতি। মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তার কারণে সে ঊধ্বশ্বাসে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলেছে। অথচ তাকেই যে বিক্রি করে দেবার চক্রান্ত চলছে সেই খবরটা পর্যন্ত সে রাখে না। অদিতি নিজে একজন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত তরুণী, আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট স্বাবলম্বী। একটি কলেজে সে পড়ায়। সামাজিক মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠা বলতে যা বোঝায় সে সবই তার আছে। তার মতো একটি মেয়ের স্বাধীনতা যেখানে বিপন্ন সেখানে তার চেয়ে অনেক নীচের স্তরের অশিক্ষিত এবং আর্থিক দিক থেকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল মেয়েদের জন্য সে কতটুকু কী করতে পারে? হঠাৎ অদ্ভুত এক নৈরাশ্য চারিদিক থেকে তাকে যেন ঘিরে ধরতে থাকে।
মৃণালিনী আবার বলেন, নিজেকে শক্ত রাখবি বুবু। ওদের কথায় একেবারে রাজি হবি না। আমাদের পরিবারে দুটো দুর্ঘটনা ঘটছে। তৃতীয়বার আর যেন না ঘটে। আমি অন্তত ঘটতে দেব না।
মৃণালিনীর মতো মহিলা এই সামাজিক সিস্টেমে ক্বচিৎ কখনও দেখা যায়। পক্ষাঘাতে একটা দিক পড়ে গেছে, দশ বছর একটানা শয্যাশায়ী হয়ে আছেন কিন্তু এখনও মনের জোর তাঁর অপরিসীম। তাঁর মধ্যে একটি অপরাজেয় দৃঢ়তা আছে, কোনো কারণেই সেটা মাথা নোয়াতে জানে না।
দুটি পারিবারিক দুর্ঘটনার কথা যে মৃণালিনী বলেছেন তার একটি ঘটেছে মৃণালিনীর জীবনে, অন্যটি সুজাতার। সুজাতা অদিতির ছোটদি।