সিতাংশু হাত-টাত নেড়ে ভারিক্কি চালে বাবা আর দাদাদের কী যেন বোঝাচ্ছে।
কেন বাবা বার বার সন্ধের আগে তাকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলেন, এতক্ষণে বুঝতে পারে অদিতি। দুপুরে সে যখন বেরোয়, ঘুণাক্ষরেও জানাননি, আজ সিতাংশু আসবে! জানালে সে কিছুতেই ফিরত না।
সিতাংশু যে তার জন্য সেই বিকেল থেকে ঝাড়া দু-তিন ঘণ্টা বসে আছে, এ ব্যাপারে অদিতি পুরোপুরি নিশ্চিত। লোকটার অসীম ধৈর্য।
সিংতাশুকে দেখতে দেখতে অদম্য ক্রোধ অদিতিকে পেয়ে বসে। মাথায় প্রবল রক্তচাপ টের পায় সে। একটি চড় মেরে লোকটাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে কিনা যখন ভাবছে, সেই সময় হঠাৎ রমাপ্রসাদ তাকে দেখতে পান। কাত করা শরীরটা টেনে-হিঁচড়ে খাড়া করতে করতে ব্যস্তভাবে বলেন, বুবু তুই! ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়। অদিতির ডাক নাম বুবু।
অদিতি উত্তর দিতে যাচ্ছিল, আচমকা তার চোখে পড়ে একটু দূরে সিঁড়ির মুখে তাদের কাজের মেয়ে দুর্গা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় সে।
ড্রইংরুম থেকে রমাপ্রসাদের গলা ভেসে আসে, কী হল রে, কোথায় যাচ্ছিস? এখানে এলি না?
একটু পরে আসছি।
দুর্গার কাছাকাছি আসতেই চাপা গলায় সে বলে, পিসিমা তোমাকে এক্ষুনি একবার ওপরে যেতে বলেছে ছোটদি।
দুর্গার বয়েস সতেরো-আঠারো। কালো সুশ্রী চেহারা। মেয়েটা অদিতির খুবই অনুগত।
অদিতি রীতিমতো অবাকই হল। সে যে এই মুহূর্তে ফিরে আসবে, তেতলার ঘরে শুয়ে শুয়ে পিসিমা কী করে টের পেলেন, কে জানে! জিগ্যেস করল, কেন রে?
দুর্গা বলল, জানি না।
একটু ভেবে অদিতি বলে, তুই পিসিমাকে গিয়ে বল, বাবা দাদারা আর এক ভদ্রলোক আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ওপরে যাচ্ছি।
সিতাংশুবাবু এসেছে তো?
অদিতি চমকে ওঠে। দুর্গা এমনিতে খুবই চালাক চতুর। তার দুটোর জায়গায় দশটা করে চোখ, দশটা করে কান। তার চোখ-কান এড়িয়ে এ বাড়িতে কিছু হবার উপায় নেই। বোঝা গেল, সিতাংশু যে কিছুদিন ধরে এখানে হানা দিচ্ছে, দুর্গা তা জানে। কোন উদ্দেশ্যে সিতাংশুর যাতায়াত, সেটাও হয়তো তার অজানা নেই।
অদিতি বলে, হ্যাঁ। তুই সিতাংশুবাবুকে চিনলি কী করে?
চোখ দুটো চিকচিকিয়ে ওঠে দুর্গার। ঠোঁট কুঁচকে মজার একটা ভঙ্গি করে বলে, বা রে, চিনব না! তিন মাস ধরে সকাল নেই বিকেল নেই আসছে তো আসছেই। বড়বাবু আর দাদাবাবুদের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে গুজুর-গুজুর কী পরামর্শ যে করে!
এ খবরটা নতুন এবং খানিকটা চাঞ্চল্যকরও। অদিতির ধারণা ছিল তিন-চার বারের বেশি এ বাড়িতে আসেনি সিতাংশু। কিন্তু দুর্গা যা বলছে তাতে মনে হয় নিয়মিতই সে হাজিরা দিচ্ছে।
অদিতি জিগ্যেস করল, আমি যখন থাকি না তখনও আসে?
তখনই তো বেশি আসে গো ছোটদি।
তুই আমাকে বলিসনি তো?
তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছ?
দুর্গার স্বভাবই হল, গায়ে পড়ে কোনো কথা বলে না। সে শুধু দেখে আর শুনে যায়। অদিতি এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না।
দুর্গা এবার তাড়া লাগায়, ওপরে চলো ছোটদি। পিসিমা বলে দিয়েছে বড়বাবু, সিতাংশুবাবু আর দাদাবাবুদের কথা কইবার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে। খুব দরকার।
আচ্ছা চল।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে দোতলার বড় বারান্দায় হেমলতাকে দেখতে পায় অদিতি। হেমলতা তার মা। রোগা পাতলা চেহারা। একসময় দুর্দান্ত সুন্দরী ছিলেন। এখন টকটকে রং জ্বলে গেছে। চোখের কোলে কালির ছোপ। মুখটা ভেঙেচুরে কণ্ঠা আর গালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। চুল উঠে উঠে কপালটা চওড়া মাঠের মতো দেখায়। হাতের দিকে তাকালে ফর্সা কোঁচকানো চামড়ার তলায় নীল শিরাগুলো দেখা যায়। শরীরে সারাংশ বলতে বিশেষ কিছু নেই। চারদিকে শুধু ধ্বংসের ছাপ।
হেমলতা একটা আধ-ছেঁড়া মোড়ায় বসে খানিকটা ঝুঁকে কী যেন সেলাই করছিলেন। গোল বাইফোকাল চশমাটা নাকের নীচের দিকে নেমে এসেছে।
পায়ের শব্দে মুখ তুললেন হেমলতা। সিঁড়িতে অদিতিকে দেখতে পেয়ে আবছা গলায় বললেন, এই ফিরলি বুবু? তাঁর কণ্ঠস্বর এর বেশি কখনোই ওঠে না।
অদিতি থেমে যায়। বলে, হ্যাঁ, মা
সিতাংশু এসেছে।
দেখেছি।
তোর বাবা, রাজা আর বাবলু তাকে নিয়ে বাইরের ঘরে বসে ছিল।
রাজা এবং বাবলু বরুণ আর মৃগাঙ্কর বাড়ির ডাক নাম।
অদিতি বলে, ওরা এখনও বসে আছে।
ওদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে?
না। আগে পিসিমার সঙ্গে দেখা করে আসি।
ভয়ে ভয়ে হেমলতা বলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে এলেই পারতিস।
সেই ছেলেবেলা থেকে অদিতি দেখে আসছে মা সারাক্ষণ শঙ্কিত এবং তটস্থ হয়ে থাকেন। গলা চড়িয়ে তাঁকে কেউ কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি। এ বাড়িতে তিনি যে আছেন সেটা প্রায় বোঝাই যায় না। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে নিঃশব্দে ছায়ার মতো চলাফেরা করেন। সবসময় কী একটা অজানা দুর্বোধ্য ভয় তাঁকে তাড়া করে নিয়ে চলেছে।
অত ভেবো না মা। দশ মিনিট পরে ওখানে গেলে এমন কিছু মারাত্মক অপরাধ হয়ে যাবে না।
যা ভালো বুঝিস কর। পরে যেন এ নিয়ে আবার অশান্তি না হয়।
অদিতি বলে, অশান্তি হবেই মা। ভেবে ভেবে তুমি মাথা খারাপ করে ফেললেও ওটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এই বলে সে আর দাঁড়ায় না। দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে তেতলার কোণের দিকে একটা ঘরে চলে আসে।