গথিক স্ট্রাকচারের এই বাড়িটায় বিরাট বিরাট পিলার, চওড়া চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি। খাঁটি বার্মা টিক আর মেহগনির ওপর কারুকাজ-করা ভারী ভারী আসবাব দিয়ে বাড়ি সাজিয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। ড্রেয়িং-টেবিল আর আলমারির গায়ে যেসব লাইফসাইজ আয়না লাগানো ছিল সেগুলো আনানো হয়েছে ইতালি থেকে। দু-হাজার বর্গফিটের প্রকাণ্ড ড্রইংরুমটা ন-ইঞ্চি পুরু কাশ্মীরি কার্পেটে মোড়া থাকত। খাস লন্ডন থেকে জমকালো আটটা ঝাড়লণ্ঠন আনিয়ে সেখানে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন শিবপ্রসাদ।
দুর্দান্ত বিলিতি আর জার্মান গাড়ি ছিল চার-পাঁচটা। চাকর-বাকর শোফার কুক ইত্যাদি নিয়ে ডজনখানেক। বাড়ির পেছনে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া নীচু সার্ভেন্টস কোয়ার্টাসে তারা থাকত।
এ-সব পুরোনো দিনের ইতিহাস। এখন এগুলো সুখকর অলীক স্মৃতি মাত্র।
অদিতির জন্মের অনেক আগেই তাদের পরিবারের গোল্ডেন পিরিয়ড বা স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গেছে। বিলিতি গাড়ি, ফার্নিচার, শ্যান্ডেলিয়ার, কার্পেট, গন্ডা-গন্ডা চাকর-বাকর–এ সবের কথা সে শুনেছে মা-বাবা পিসিমা কিংবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের মুখে।
স্বাধীনতার ঠিক দশ বছর বাদে অদিতির জন্ম। জ্ঞান হবার পর থেকে সে যা দেখে আসছে তা এইরকম।
প্রথমে বাড়িটায় কথাই ধরা যাক। ঠাকুরদার আমলে নাকি তিনটে মালি বছরের পর বছর অক্লান্ত খেটে বাড়ির সামনে এবং পেছনে চমৎকার মরশুমি ফুল আর ফলের বাগান আর সবুজ ঘাসের লন বানিয়েছিল। সে-সবের চিহ্নমাত্র নেই। বিশ-পঁচিশ বছর ধরে বাড়িটাকে ঘিরে শুধু আগাছার জঙ্গল। শ্বেতপাথরের সিঁড়ির কোনোটাই প্রায় অক্ষত নেই। পিলার এবং দেওয়ালগুলোর গা থেকে পলেস্তারা খসে দগদগে ঘায়ের মতো দেখায়। ছাদের কার্নির্স এবং আলসে ভেঙেচুরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। দেওয়াল আর ছাদ ফাটিয়ে নানা জায়গায় অশ্বখ গজিয়ে গেছে। ঘুলঘুলিতে বংশপরম্পরায় পায়রা আর চড়ুইয়েরা তাদের সংসার বাড়িয়ে চলেছে। বাড়িভর্তি ইঁদুর আরশোলা এবং ছুঁচোর রাজত্ব।
স্বাধীনতার পর থেকে এ-বাড়িতে আর রং-টং করানো হয়নি। জানলার রঙিন কাঁচ বা খড়খড়ি বলতে কিছু নেই। ভাঙা জায়গাগুলোতে চট বা পুরোনো খবরের কাগজ গুঁজে দেওয়া হয়েছে। মোট কথা, বাড়িটার ধ্বংসের কাজ অনেকটাই এগিয়ে আছে। আর বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ বছর, তারপর হুড়মুড় করে হয়তো একদিন ভেঙে পড়বে। চার-পাঁচটা দামি গাড়ির একটাও আর নেই। পুরোনো আসবাব, কার্পেট, শ্যাভেলিয়ার, এ-সব কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। বর্মা টিকের আসবাবের বদলে ঘরে ঘরে এখন খোলা কাঠের টেবিল-চেয়ার তক্তাপোষ আলমারি ইত্যাদি।
নিজেদের বংশলতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই অদিতির। শিবপ্রসাদের আগে তাদের পরিবারের সব ইতিহাসই কুয়াশায় ঢাকা। অর্থাৎ আঁক করে বলার মতো তখন কিছুই ছিল না। তাদের বংশে যে ক্ষণস্থায়ী সুখের দিন এসেছিল তা একমাত্র শিবপ্রসাদের জন্যই।
শিবপ্রসাদ মারা গেছেন স্বাধীনতার কয়েকমাস আগে। তারপর আটত্রিশ বছর কাটতে-না-কাটতেই মাত্র দুটো জেনারেশনের মধ্যে বাড়িটার হাল কেন এরকম গেল সেটা বুঝতে হলে অদিতির বাবা এবং দাদাদের জীবনচরিত জানা একান্ত জরুরি। কিন্তু সেসব কথা পরে।
.
গেট দিয়ে ঢুকলেই এবড়ো-খেবড়ো খোয়ার রাস্তা। অদিতির ছেলেবেলায় এই পথটাতে বাদামি রঙের নুড়ি বিছানো থাকত। তারপর কবে যে নুড়িগুলো উধাও হয়ে তার জায়গায় খোয়া ফেলা হয়েছিল, এখন আর মনে পড়ে না।
দু-ধারে আগাছার ঝাড়। পুরোনো দিনের সুখস্মৃতির মতো মাঝে মধ্যে দু-একটা সিলভার পাম এখনও কোনোরকমে টিকে আছে।
কম্পাউন্ডের ভেতর চার-পাঁচটা ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রিকের খরচ বাঁচাতে আট-দশ বছর ধরে আলো জ্বালানো হয় না। ফলে এই সন্ধেবেলাতেই চারদিকে ঝুপিসি অন্ধকার। আলোর ছুঁচের মতো সেই অন্ধকারকে ফুড়ে ফুড়ে অগুন্তি জোনাকি উড়ছে। সিলভার পামের মাথা থেকে পাখিদের ডাকাডাকি আর ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ ভেসে আসছে।
অন্যমনস্কের মতো খোয়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাড়ির সামনে এসে পড়ে অদিতি। দশটা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেই বিশাল লাউঞ্জ।
লাউঞ্জ পেরিয়ে বিরাট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চওড়া প্যাসেজ। সেটার বাঁ-দিকে বিশাল ড্রইংরুম, ডানদিকে ওপরে যাবার সিঁড়ি। দু-ধারে বসার ঘর আর সিঁড়ি রেখে প্যাসেজটা সোজা বাড়ির পেছন দিকে চলে গেছে। সেখানে কিচেন, স্টোর, ডাইনিংরুম। যে দু-একটি কাজের লোক এখনও রয়েছে, তারা ওখানেই থাকে।
প্যাসেজে একটা কম পাওয়ারের টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেখানে পা দিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অদিতি। নিজের অজান্তেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
অদিতি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ড্রইং রুমটা খুব বেশি হলে সাত-আট ফুট দূরে। ঘরের ভেতর দুই দেওয়ালে দুটো জোরালো টিউব লাইট জ্বলছে।
অদিতি দেখতে পায়, বেতের সোফায় তেলচিটে গদির ওপর বসে আছে সিতাংশু সিতাংশু ভৌমিক। তার মুখোমুখি দুই দাদা-বরুণ আর মৃগাঙ্ক। পাশে একটা সোফায় কাত হয়ে আছেন রমাপ্রসাদ। রমাপ্রসাদ ব্যানার্জি অদিতির বাবা।
রমাপ্রসাদের আর্থারাইটিসের কষ্টটা আজ নিশ্চয়ই খুব বেড়েছে, নইলে ওভাবে আড় হয়ে থাকতেন না।