আমারও তাই মনে হয়।
অদিতি উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিকাশও উঠে দাঁড়ায়।
অমিতাদি চোখ সরু করে মজার গলায় বলেন, অদিতি যথেষ্টই সাবালিকা-সাফিসিয়েন্টলি অ্যাডাল্ট। ও নিজের সামর্থেই বাড়ি চলে যেতে পারবে। তোমার পৌঁছে না দিলেও চলবে।
ঘরের অন্য সবাই হাসতে থাকে। অদিতির সঙ্গে বিকাশের সম্পর্ক কতটা গভীর, নারী-জাগরণ-এর প্রতিটি মেম্বার তা জানে।
বিব্রত মুখে বিকাশ বলে, না, অদিতির সঙ্গে আমার দরকারি কিছু কথা আছে। তাই তার মুখ লাল হয়ে ওঠে।
অমিতাদি হেসে হেসে খানিকটা প্রশ্রয়ের ঢংয়েই বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে আনাড়ি প্রেমিকদের মতো অত লজ্জা পেতে হবে না।
অদিতিরা থাকে বালিগঞ্জের পুরোনো পাড়ায়, বিকাশরা ভবানীপুরে।
খানিকটা হাঁটতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে যায় দুজনে। ঠিক হয় বিকাশ অদিতিকে তাদের বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে ভবানীপুরে চলে যাবে।
ট্যাক্সিতে ওঠার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। তারপর হঠাৎ বিকাশই শুরু করে, আমি কিন্তু গলফ গ্রিনে একটা ফ্ল্যাট বুক করে ফেলেছি। নেক্সট উইকে পজেশান পেয়ে যাব।
কই, আমাকে আগে কিছু বলেনি তো।
তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
কবে বুক করলে?
দিন কুড়ি আগে।
এত টাকা পেলে কোথায়?
ভবানীপুরে আমাদের বাড়িতে আর জায়গা হচ্ছিল না। আমার অংশটা দাদাকে লিখে দিলাম। দাদা প্রফিডেন্টফান্ড থেকে লোন নিয়ে আমাকে দিল। তাই দিয়েই
বিকাশদের বাড়ির যাবতীয় খবরই অদিতির জানা। সে বলল, ও—
বিকাশ অদিতির দিকে ঘুরে বসে প্রচণ্ড উৎসাহে বলতে থাকে, জানো, ফ্ল্যাটটা দারুণ। থ্রি বেড রুমস, দুটো বাথ, ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল, তিনটে ব্যালকনি। সব মিলিয়ে কার্পেট এরিয়া সাড়ে বারোশো স্কোয়ারফিট। তিনটে দিক ভোলা-সাউথ, ইস্ট আর ওয়েস্ট। কবে দেখতে যাবে বলো–
যাব একদিন
একদিন-ট্যাকদিন না, নেক্সট রবিবারই তোমাকে নিয়ে যাব।
একটু চুপ করে থেকে অদিতি বলে, আচ্ছা–ফ্ল্যাটের কথায় সে খুশি হয়েছে কিনা বোঝা যায় না।
অদিতি খুবই চাপা ধরনের। বাইরে থেকে তাকে সমান্যই বোঝা যায়, তার স্বভাবের বেশির ভাগটাই গোপন। বিকাশ বলতে থাকে, ফ্ল্যাটটা কিন্তু খুব ভালো করে সাজাতে হবে।
অদিতি উত্তর দেয় না।
বিকাশের উদ্দীপনা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সে বলে, ইন্টেরিয়র ডেকরেটরদের হাতে ছেড়ে দেব, না নিজেরাই সাজাব?
অতিদি বলে, তুমি যা ভালো বুঝবে।
জানো, অকশনে দুর্দান্ত সব জিনিস-খাট কার্পেট মিক্সি আলমারি শসোফা ক্ৰকারি–খুব শস্তায় পাওয়া যায়। এ সপ্তাহেই তোমাকে অকশন হাউসগুলোতে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
প্রায় রোজই এই সময়টা ট্রাফিক জ্যাম থাকে। আজ কোথাও বাস মিনিবাস ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কার জট পাকিয়ে সবকিছু অচল করে দেয়নি। মসৃণ গতিতে ট্যাক্সিটা পুরোনো বালিগঞ্জে চলে আসে।
বিকাশ বলে, ফ্ল্যাট তো হল। সাজাবার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে কিন্তু আসল কাজটাই এখনও হল না। সেটা ছাড়া এইসব ফ্ল্যাট-ট্যাট একেবারে মিনিংলেস–একটু থেমে গাঢ় গলায় এবার বলে, ভবানীপুরে ভাঙাচোরা বাড়ি, সেখানে অনেক অসুবিধে ছিল কিন্তু এখানে সেসব ব্যাপার নেই। কীরকম সময় আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে যেতে পারব?
শেষের এই কথাটা আগে বেশ কয়েকবার বলেছে বিকাশ। তবে এতটা জোর দিয়ে কখনোই নয়। অদিতির নিজের দিক থেকে এখনও কিছু দ্বিধা আছে, বাড়ির দিক থেকে বেশ খানিকটা বাধাও। কিন্তু সেসব কথা পরে।
অদিতি বলে, আমাকে কিছুদিন ভাববার সময় দাও।
অনেক ভেবেছ। আর সময় পাবে না। ফ্ল্যাটটা সাজানো হয়ে গেলে আমি কিন্তু কোনো কথা শুনব না। বিকাশের গলায় অসহিষ্ণুতা ফুটে বেরোয়।
অদিতি বলে, এত অধৈর্য হলে চলে! ট্যাক্সি তাদের বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একপলক দেখেই সে ট্যাক্সিওলাকে বলল, সর্দারজি, এখানে একটু থামান।
শিখ ড্রাইভার ব্রেক কষতেই ঘ্যাস্-স্-স্ করে চাকার ঘষ্টানির আওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি থেমে যায়। দরজা খুলে রাস্তায় নামতে নামতে অদিতি বলে, চলি। কাল নারী-জাগরণ-এর অফিসে আসছ তো? চাঁপাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে।
বিকাশ বলে, আসব। আমার কথাটা মনে রেখো। একমাসের বেশি সময় কিন্তু দিচ্ছি না।
অদিতি হাসে, উত্তর দেয় না।
ট্যাক্সিটা আর দাঁড়াল না, বিকাশকে নিয়ে চলে গেল।
তারপর কিছুক্ষণ রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অদিতি। একটা কথা ভেবে তার ভীষণ খারাপ লাগে। প্রায় রোজই তাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায় বিকাশ কিন্তু বিকাশকে সে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না। কেননা বাড়ির কেউ তাকে একেবারেই পছন্দ করে না। হঠাৎ বিকাশকে তার সঙ্গে আসতে দেখলে বাড়িতে অশান্তি এবং উত্তজেনা এতই বেড়ে যাবে যে অদিতির পক্ষে একটা দিনও এখানে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ট্যাক্সিটা অদিতিদের বাড়ি ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে এসে থেমেছিল। একসময় অদিতি ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।
২. ছড়ানো কম্পাউন্ডের মাঝখানে
০৪.
ছড়ানো কম্পাউন্ডের মাঝখানে অদিতিদের বিশাল তেতলা বাড়ি। লোহার গেটের দুটো পাল্লা অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছিল। জায়গাটা হাট করে করে খোলা। গেট পেরিয়ে অদিতি ভেতরে চলে আসে।
এ বাড়িটা ষাট-সত্তর বছর আগে তৈরি করিয়েছিলেন অদিতির ঠাকুরদা শিবপ্রসাদ ব্যানার্জি। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন নামকরা স্টিভেডর। জাহাজি ব্যবসাতে প্রচুর টাকা করেছিলেন।