এখন কিছুদিন বস্তিতে আসবেন না।
যুধিষ্ঠির তার সত্যিকারের হিতাকাঙ্ক্ষী। বস্তিতে এলে নগেন ঝাট বাধাতে পারে, সেই ভয়ে সে আসতে বারণ করছে। তার মানে, দারিদ্রসীমার নীচে ক্যালকাটা মেটোপলিসের বস্তিবাসী মেয়েদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের যে বিপুল পরিকল্পনা তারা নিয়েছে, সেটা স্থগিত রাখতে হবে। একটু চিন্তা করে অদিতি বলে, দেখা যাক।
কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, অদিতিরা চাঁপাকে নিয়ে সামনের গলিটা দিয়ে বড় রাস্তার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে বস্তির লোকজন বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
.
০৩.
আগে আগে হাঁটছে রমেন বিশাখা এবং চাঁপা। তাদের পেছনে অদিতি আর বিকাশ।
বিকাশ নীচু গলায় অদিতিকে বলে, এটা তুমি কী করলে?
দূরমনস্কর মতো হাঁটছিল অদিতি। চমকে উঠে বলে, কোনটা?
চাঁপাকে দেখিয়ে বিকাশ বলে, এই যে মেয়েটাকে নিয়ে এলো বলতে বলতে সে থেমে যায়।
তার ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির। সে বলে, না নিয়ে এলে মেয়েটার অবস্থা কী হত, নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না।
তোমার কি মনে হয়, ওই মাস্তানটা ওকে খুন করে ফেলত! খুনটা এত সোজা ব্যাপার না।
আজকাল ওটাই বোধহয় সবচেয়ে সোজা হয়ে গেছে। নগেন হয়তো একেবারে শেষ করে ফেলত না, তাবে মারাত্মক টরচার করত।
এরকম বউ-পেটানোর ঘটনা রোজ হাজারটা ঘটছে। তুমি সবাইকে বাঁচাতে পারবে?
একজনকেও যদি পারি সেটাই কম নাকি?
চাঁপাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসাটা আদৌ পছন্দ হয়নি বিকাশের। সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে। তারপর বলে, সব ব্যাপারে তুমি নিজেকে বড় বেশি ইনভলভূ করে ফেলো
অদিতি-
চোখের কোণ দিয়ে বিকাশকে লক্ষ করতে করতে ঈষৎ তীক্ষ্ণ গলায় অদিতি বলে, সোশাল ওয়ার্ক করতে নেমেছি অথচ এতটুকু দায়দায়িত্ব নেব না, তাই কখনও হয়?
আমাদের কাজ হল, মেয়েদের সম্বন্ধে ইনফরমেশন জোগাড় করে সেগুলো নানা মিডিয়ার হেল্প নিয়ে দেশের মানুষ আর গভর্নমেন্টকে জানানো। আই মিন, এই সোসাইটিতে মেয়েরা কীভাবে জেনারেশনের পর জেনারেশন কী ভয়ঙ্কর জীবন কাটাচ্ছে, সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা।
তার মানে নিজেদের চামড়া বাঁচিয়ে যেটুকু করা যায়–তাই না?
অদিতির চোখেমুখে এবং কণ্ঠস্বরে চাবুকের মতো এমন কিছু শ্লেষ ছিল যাতে চমকে ওঠে বিকাশ। কিছু বলতে গিয়ে সে থেমে যায়।
খানিকক্ষণ চুপচাপ।
তারপর বিকাশ বলে, মেয়েটাকে তো নিয়ে এলে। এখন ওর কী ব্যবস্থা করবে? কোথায় রাখবে?
অদিতি বলে, নারী জাগরণ-এর অফিসে আগে যাই। অমিতাদির সঙ্গে আলোচনা করে একটা কিছু করতে হবে।
বিকাশ আর কোনো প্রশ্ন করে না। তবে চাঁপার ব্যাপারে সে যে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত এবং বিচলিত, তার চোখমুখ দেখেই তা টের পাওয়া যায়।
.
নারী জাগরণ-এর অফিসে যখন অদিতিরা এসে পৌঁছোয়, সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় কর্পোরেশনের তেজি আলোগুলো জ্বলে উঠেছে।
দক্ষিণ কলকাতার এই নিরিবিলি পাড়ায় সন্ধেবেলাতেও লোকজন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দু-একটা স্কুটার, অটো রিকশা বা প্রাইভেট কার এখানকার অগাধ শান্তিকে তোলপাড় করে হুস হুস শব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে।
নারী-জাগরণ-এর অফিসটা দুপুরের মতো অতটা জমজমাট না হলেও বেশ কিছু মেম্বার এ-ঘরে উত্তেজিতভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলছে। অমিতাদিকেও সামনের ঘরে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে থাকতে দেখা গেল।
বোঝা যায়, বধূ হত্যার প্রতিবাদে দুপুরে মিছিল করে নারী-জাগরণ-এর মেম্বাররা যে বেরিয়ে পড়েছিল, নানা রাস্তা ঘুরে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে মেমোরান্ডাম জমা দিয়ে তারা ফিরে এসেছে। এখন সেই বিষয়েই তাদের আলোচনা চলছে।
অদিতি ভেতরের একটা ঘরে চাঁপাকে বসিয়ে সামনের ঘরে এসে অমিতাদির মুখোমুখি বসে পড়ে। বিকাশ, রমেন এবং বিশাখা আগেই থেকে গিয়েছিল। তারা আর ভেতরে যায়নি।
অমিতাদি বললেন, যে মেয়েটিকে ও-ঘরে রেখে এলে সে কে?
অদিতি দ্রুত একবার বিকাশদের দেখে নেয়। বুঝতে পারে, ওরা চাঁপার সম্পর্কে এখনও কেউ কিছু অমিতাদিকে বলেনি। অদিতি সংক্ষেপে চাঁপার ব্যাপারটা বলে, কী পরিস্থিতিতে তাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে জানিয়ে দেয়।
শুনতে শুনতে কপালে ভাঁজ পড়ে অমিতাদির। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেন, তাইতো, এখানে ওকে নিয়ে এলে–
না এলে উপায় ছিল না অমিতাদি। আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?
ডিফিকাল্ট কোশ্চেন। যাই হোক, এনেই যখন ফেলেছ তখন ওর সম্পর্কে আমাদের একটা দায়িত্ব এসে গেছে। চাঁপাকে নিয়ে কী করবে, কিছু ভেবেছ?
না। আপনি কী করতে বলেন?
একটু চিন্তা করে অমিতাদি বলেন, প্রথমে যেটা সব চাইতে জরুরি তা হল, থানায় ওর সম্পর্কে একটা রেকর্ড করিয়ে রাখা। নইলে পরে ওর স্বামী–মানে হুলিগান টাইপের সেই লোকটা গোলমাল বাঁধাতে পারে।
উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে ব্যস্তভাবে অদিতি বলে, অমিতাদি, আজ আমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। বাবা বলে দিয়েছিল, সন্ধের আগে আগেই যেন ফিরে যাই। ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।
তাহলে আজ বাড়িই যাও। দারোয়ান আর তার বউকে বলে যাচ্ছি, চাঁপা রাত্তিরে এখানে থাকবে। কাল এসেই কিন্তু থানায় চলে যাবে। আশা করি নগেন ওকে যেভাবে মারধোর করেছে, নিজে থেকে আজকেই থানায় যেতে সাহস করবে না।