- বইয়ের নামঃ ভূমিকা
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. নারী-জাগরণ-এর অফিসে
০১.
নারী-জাগরণ-এর অফিসে আজ প্রবল উত্তেজনা। শ-পাঁচেক মেম্বারের প্রায় সবাই দুপুর একটার মধ্যে চলে এসেছে। আশা করা যাচ্ছে, দুটোর ভেতর বাদবাকিরা এসে পড়বে। কেননা সভাপতি অমিতাদি তিনদিন আগেই বোর্ডে নোটিশ টাঙিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ যার যত জরুরি কাজই থাক, সব ফেলে প্রতিটি মেম্বারকে দুটোর মধ্যে অফিসে হাজির হতে হবে। শুধু টাইপ-করা নোটিশ লাগিয়েই বসে থাকেননি অমিতাদি, প্রতিটি সদস্যকে আলাদা আলাদা করে আসতে বলেছেন। যাদের এ-কদিন অফিসে দেখা যায়নি, তাদের বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছেন।
নারী-জাগরণ মেয়েদের একটি সমিতি। সমাজের সকল স্তরে নারীর মর্যাদা এবং সম্মান রক্ষার জন্য এরা কাজ করে চলেছে। নারী প্রগতি, নারী স্বাধীনতায় এরা বিশ্বাসী। মেয়েদের ওপর যেখানেই অন্যায় বা নির্যাতন চলে সমিতি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। মেয়েরা পারিবারিক এবং সামাজিক দিক থেকে কোন লেভেলে পড়ে সেই সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব এরা নিয়েছে।
নারী-জাগরণ-এর মেম্বার প্রধানত মহিলারাই। তবে সমধর্মী কিছু পুরুষ, যারা ভারতবর্ষের মতো পিছিয়ে-থাকা দেশে মেয়েদের হাজার রকম সমস্যা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে–এই সমিতির সভ্য হয়েছে। এরা সমাজের সকল স্তরে মেয়েদের সমানাধিকার দাবি করে। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরা একইরকম মর্যাদা নিয়ে চলবে, এটাই তাদের কাম্য।
নারী-জাগরণ-এর অফিসটা দক্ষিণ কলকাতার নিরিবিলি এক রাস্তায়। বড় কম্পাউন্ডওলা একতলা বাড়ি, সামনে অনেকটা খোলামেলা জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস। চারদিকে প্রচুর গাছপালা এবং অসংখ্য পাখি। কলকাতার মতো শহরে যেখানে প্রতিদিন পপুলেশন এক্সপ্লোশান অর্থাৎ জনবিস্ফোরণ ঘটে চলেছে, মানুষ বাড়ছে হু-হুঁ করে, মাথাপিছু যেখানে দশ স্কোয়ার ফিটও বরাদ্দ নেই সেখানে এরকম একটা জায়গার কথা ভাবা যায় না।
অফিসবাড়িটায় সবসুদ্ধ সাতখানা ঘর। দুটো ঘর নিয়ে চমৎকার একখানা লাইব্রেরি। অন্য ঘরগুলোতে নারী-জাগরণ-এর নানা ডিপার্টমেন্ট। এইসব ঘরের দেয়াল জুড়ে উঁচু উঁচু আলমারি। আলমারিগুলো নানারকম এবং ফাইলপত্রে ঠাসা। মেয়েদের নিয়ে সারা ভারতে যেখানে যা যা ঘটনা ঘটে চলেছে, এবং খবরের কাগজে এ-বিষয়ে যেসব রিপোর্ট বেরুচ্ছে। ফাইলগুলোতে তার কাটিং সাজানো রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ঘরেই রয়েছে টেবিল-চেয়ার, টাইপরাইটার ইত্যাদি।
আজ অমিতাদি সবাইকে জরুরি তলব করে যে ডেকে এনেছেন তার কারণ এইরকম। দুদিন আগে বালিগঞ্জের এক দামি, অভিজাত পাড়ায় দাবি অনুযায়ী পণ দিতে না পারায় একটি বধূকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বধূ-হত্যার প্রতিবাদে আজ দুটোয় নারী-জাগরণ মিছিল বার করবে। সদস্যরা না এলে মিছিল হবে কী করে?
একসঙ্গে এতজন মেম্বার এসে পড়ায় অফিসে জায়গা হয়নি। বেশিরভাগই বাইরের সবুজ জমিতে বসে আছে। মিছিলে নিয়ে যাবার জন্য কয়েকজন পোস্টারে স্লোগান লিখছে। বাকিরা দুদিন আগের বউ-পোড়ানোর ঘটনা নিয়ে তুমুল চেঁচামেচি করেছে। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির শেষের দিকে এরকম জঘন্য ঘটনা যে ঘটতে পারে-~এর চাইতে লজ্জার কী হতে পারে! এই কলকাতায়, যেখানে একশো-সোয়াশো বছর আগেই নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন হয়েছে, আজ সেখানেই কিনা পুত্রবধূ পোড়ানো হচ্ছে! ভাবা দরকার সোসাইটি সামনের দিকে কতটা এগিয়েছে, নাকি মধ্যযুগের বর্বরতায় ফিরে যাচ্ছে? এর প্রতিকার এখনই করা দরকার, ইত্যাদি।
অফিসের সামনের বড় ঘরটায় গ্লাস-টপ অর্ধবৃত্তাকার একটি টেবলের ওধারে বসে ছিলেন নারী-জাগরণ-এর প্রেসিডেন্ট অমিতাদি-অমিতা সরকার। তিনি মুখে মুখে ডিটেশন দিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁর মুখোমুখি টেবিলের ধারে বসে মুখ নীচু করে নোট নিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে–অদিতি।
এঘরে আরও কয়েকটি তরুণ-তরুণীকেও দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ ফাইল ঠিক করে রাখছে, কেউ খবরের কাগজের কোনো দরকারি রিপোর্ট কাঁচি দিয়ে কাটছে, কেউবা সামনের আলমারি থেকে লাল শালুর ফেস্টুন বার করছে। ফেস্টুনটায় বড় বড় হরফের লেখা আছে-নারী-জাগরণ।
অমিতাদি যে ব্যাপারে ডিকটেশন দিচ্ছেন সেটা হল একটা মেমোরেন্ডাম অর্থাৎ স্মারকলিপি মিছিলটা দক্ষিণ কলকাতা ঘুরে শেষপর্যন্ত রাইটার্স বিল্ডিংসে যাবে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে এই স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
এবার অমিতাদির দিকে ভালো করে তাকানো যেতে পারে। তার বয়েস পঞ্চান্নছাপ্পান্ন। কাঁচা-পাকা চুল ছেলেদের মতো ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা।
বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাঁকে লম্বাই বলা যায়। হাইট পাঁচ ফিট ছয় কি সাত। গায়ের রং বাদামি, নাক-মুখ কাটা কাটা, ধারালো চিবুক। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, পুরু লেন্সের ওধারে ঝকঝকে তীক্ষ্ণ চোখ। বাঁ হাতে চওড়া স্টিল ব্যান্ডের চৌকো ইলেকট্রনিকস ঘড়ি ছাড়া সারা শরীরে গয়না-টয়না বলতে কিচ্ছু নেই।
অমিতাদির পরনে পুরুষদের মতো ট্রাউজার্স আর হাতা গোটানো ফুলশার্ট, পায়ে চপ্পল। পুরুষ এবং নারীর কোনোরকম পার্থক্য তিনি মানেন না। এমনকি পোশাকের বেলাতেও না।
তাঁর হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সামনের অ্যাশট্রেটা পোড়া সিগারেটের টুকরোয় প্রায় বোঝাই।