মোটামুটি এরকমই আন্দাজ করেছিল বিনয়। কিন্তু এই পারিবারিক তিক্ততা সম্পর্কে সে কী-ই বা বলতে পারে। তার অস্বাচ্ছন্দ্য বাড়তেই থাকে।
গলার স্বর এবার উঁচুতে তুললেন রামরতনের স্ত্রী, এই বিমলের লেইগা কী না করছি আমরা। ও যহন চাইর পাঁচ বচ্ছরের পোলা হেই সোময় আতশা (আচমকা) কয়দিন আগে-পরে অর (ওর) মায়-বাবায় মইরা গেল। হেই থিকা কোলে-পিঠে কইরা অরে আমরা বড় কইরা তুলছি। মেট্রিক (ম্যাট্রিক পাস করনের পর তুমার মাউসামশয় বিমলরে কইলকাতার কলেজে ভর্তি কইরা, হুস্টেলে রাইখা পড়াইছে। কারে কারে য্যান চিঠি লেইখা চাকরির ব্যবস্তা কইরা দিছে। হেই বিমলের বউ চায় না আমরা এইখানে থাকি। পারলে ঘেটি ধইরা বাইর কইরা দ্যায়। কিন্তুক তিন মাইয়া লইয়া কই যামু আমি? টাকাপয়সার জোর নাই, মাথা গোজনের জাগা (জায়গা) নাই, হের উপুর তুমার মাউসামশয় মারা যাওনে অত বড় শোকটা পাইলাম। পাকিস্থানে বস্যের মাইয়াগো (যুবতী) লইয়া কী বিপদে যে আছিলাম! ইন্ডিয়ায় আইয়া ভাবলাম, বুঝিন বাইচা গ্যাছি। কিন্তুক এইখানে আর-এক বিপদ। কী যে করুম!
সদ্য স্বামী হারিয়েছেন রামরতনের স্ত্রী। শোকাতুরা বৃদ্ধা সেই দুঃখ আর বিহ্বলতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার আগেই মাথার ওপর আকাশ শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। যে নিরাপত্তা আর আশ্রয়ের আশায় পরিজনদের কাছে ছুটে এসেছিলেন সেটা পুরোপুরি ধূলিসাৎ। নিজের এবং তিন মেয়ের জন্য তার এখন অনন্ত দুর্ভাবনা। বিনয়ের হঠাৎ মনে হল, তার সঙ্গে এই বৃদ্ধাদের কোথাও একটা মিল আছে। সেও ঝিনুককে নিয়ে সুনীতির শ্বশুরবাড়ি এবং নিজের বাবার কাছে গিয়েছিল। সুধারা ছাড়া কেউ তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেনি। ঝিনুকের কারণে বিনয়কেও কম অসম্মান আর লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়নি। রামরতনের স্ত্রী এবং তাঁর তিন মেয়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে বিনয়ের। বৃদ্ধা যেন খোঁচা দিয়ে দিয়ে তার বুকের ভেতর থেকে ঝিনুককে বার করে এনেছেন। চিরদুঃখী মেয়েটার সঙ্গে তারা যেন একাকার হয়ে গেছেন।
বিনয় ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, বিমলবাবু নিজে কী বলেন?
বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ও আর কী কইব! পোলাপান কালের হেই বিমল কি আর আছে! কী ভাল আছিল। কত সরল, কত সাদাসিধা! তুমার মাউসামশয় আর আমারে ছাড়া পিরথিমীর আর কেওরে জানত না। আমরাই আছিলাম অর সব। হেই মানুষ কত বদলাইয়া গ্যাছে। অর বউ আমাগো দুঃখু দ্যায়। ও দেইখাও দ্যাখে না। মুখ বুইজা থাকে। বউর মুখের উপুর কথা কওনের বুকের পাটা কি অর আছে! রামরতনের স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে তীব্র অভিমান। পুঞ্জীভূত যাবতীয় ক্ষোভ তিনি উগরে দিতে থাকেন।
আচমকা অন্য একটা চিন্তা বিনয়কে কিছুটা আনমনা করে তোলে। চোদ্দ ঘর ভাড়াটের সঙ্গে বিমল যে প্রাচীন, বিবর্ণ বাড়িটায় থাকে সেটা দেখলে মনে হয় না, সে বড় মাপের কোনও চাকরি বাকরি করে। তেমন রোজগার হলে এমন জায়গায়, এত লোকজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে পড়ে থাকত না। নিশ্চয়ই অনেক ভাল বাড়িতে থাকত। সেখানে চাকচিক্য থাকত ঢের বেশি। পরিবেশ হতো অন্যরকম। মনে হয়, বিমল যা মাইনে পায় তাতে তার সংসার মোটামুটি চলে যায়। তার ওপর চার চারটে মানুষের ভার বহন করতে তার নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে। যে জেঠাইমা সযত্নে, অসীম মমতায় তাকে মানুষ করে তুলেছেন, হঠাৎ তারা দেশের সর্বস্ব খুইয়ে চলে আসার পর প্রাথমিক আবেগটুকু দ্রুত ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বিরাট আকারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। স্থূল এবং জৈবিক। এতগুলো মানুষের চলবে কী করে? রোজকার চাল ডাল জুটবে কোত্থেকে? দুচারদিনের ব্যাপার নয়। বৃদ্ধারা যদ্দিন বাঁচবেন ততদিনই তাদের টানতে হবে। তাছাড়া, দুই অবিবাহিত মেয়ে আছে রামরতনের। তাদের বিয়ের প্রশ্ন আছে। এসব দায়িত্ব এখন বিমলের কাঁধে। ক্রমশ অবস্থা এমন দুঃসহ হয়ে উঠবে যে বিমলদের কাছে এই অতি প্রিয়জনেরাও অত্যন্ত অবাঞ্ছিত হয়ে যাবেন। এ এক অদ্ভুত সংকট। বিনয় ভাবল, এখানে না এলেই বোধ হয় ভাল হতো।
বৃদ্ধা এবার বললেন, শুনতে আছি, পাকিস্থান থিকা যারা আইছে গরমেন্ট তাগো লেইগা কেম্পে (ক্যাম্পে থাকনের ব্যাবোস্তা করছে। রিফুজিগো খাওনের থাকনের সগল দায় সরকারের। আমাগো বডার (বর্ডার) স্লিপ আছে। তুমি কি বাবা খোঁজখবর লইয়া কুনো কেম্পে আমাগো থাকনের বন্দোবস্ত কইরা দিতে পারবা?
বিনয় চমকে উঠল। কতখানি মানসিক নির্যাতন ভোগ করলে রামরতনের স্ত্রীর মতো একজন বৃদ্ধা, কলকাতা সম্বন্ধে যাঁর স্পষ্ট ধারণাই নেই, হয়তো জামতলি গাঁয়ের বাইরে দূরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি–এমন একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু শরণার্থী শিবির নামে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য রাতারাতি যে-সব ক্যাম্প খাড়া করা হয়েছে, সেগুলো কেমন, কে জানে। কলকাতায় আসার পর কোনও ক্যাম্পেই বিনয়ের যাওয়া হয়নি। যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তবে যুগল ছাড়াও অনেকের মুখেই শুনেছে, ক্যাম্পগুলোর বেশির ভাগই নরককুণ্ড। সেগুলোর পরিবেশ, আবহাওয়া জঘন্য। দমবন্ধ করা। কদর্য। নিতান্ত নিরুপায় না হলে কেউ সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। যারাই পারছে, দলে দলে বেরিয়ে গিয়ে বনবাদাড়, জলা জায়গা আর ফাঁকা পোড়ো জমিতে জবরদখল কলোনি বসাচ্ছে। মুকুন্দপুরে ছিন্নমূল মানুষের তেমন এক উপনিবেশ নিজের চোখেই দুআড়াই সপ্তাহ আগে দেখে এসেছে বিনয়। এমনকি পুরো একটা দিনও বিলের ধারে যুগলদের কাঁচা বাঁশের বেড়ার ঘরে কাটিয়েছিল।