মাঠময় উৎকণ্ঠিত জনতা। তাদের মাঝখানে সারি সারি বেশ কিছু চেয়ার টেবল। সেখানে কয়েকজন বসে আছেন। বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আন্দাজ করা যায়, এঁরা ত্রাণশিবিরগুলোর কর্মকর্তা হবেন। হিরন্ময়দের দেখে সবাই শশব্যস্তে উঠে পড়লেন। এগিয়ে গিয়ে বিশেষ করে হিরন্ময়কে সসম্ভ্রমে বললেন, আসুন স্যার, আসুন–
হিরন্ময় জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কতক্ষণ এখানে ওয়েট করছেন?
নটা থেকে। আপনি যেমন ইনস্ট্রাকশন পাঠিয়েছেন, সেইমতো রিফিউজিদের মাঠে চলে আসতে বলেছিলাম। ঠিক সময়েই তারা এসে গেছে।
হাতঘড়ি দেখে হিরন্ময় বললেন, এখন নটা সতেরো। অনেকদূর থেকে আসছি তো। সামান্য লেট হয়ে গেছে।
একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, আন্দামানে যাবার কথা রিফিউজিদের বলেছেন তো?
বলেছি।
রি-অ্যাকশন কীরকম?
ভাল না স্যার। আমরা অনেক করে বুঝিয়েছি, কিন্তু কালাপানি পাড়ি দিতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। দেখুন আপনারা বললে যদি শোনে—
হিরন্ময়কে রীতিমতো চিন্তিত দেখায়। তবে এ নিয়ে আর কিছু বললেন না। হঠাৎ কী খেয়াল হতে ত্রাণশিবিরের অফিসার-ইন-চার্জদের সঙ্গে বিনয়, বিভাস আর নিরঞ্জনদের অর্থাৎ যারা উদ্বাস্তুদের আন্দামানে নিয়ে যাবে, আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি। এঁরা হলেন সোমনাথ দত্ত, মহাদেব কুণ্ডু, অজিতেশ সমাজপতি আর নীলমাধব কর। তাছাড়া ওঁদের কজন সহকারীও রয়েছেন।
সোমনাথরা হিরন্ময়দের নিয়ে চেয়ারগুলোতে বসালেন। বিনয়কেও ওঁদের পাশেই বসানো হল।
বিনয় লক্ষ করল, উদ্বাস্তুরা এখন আরও সন্ত্রস্ত। খনিক আগের চাপা কণ্ঠস্বরগুলি থেমে গেছে। বিশাল মাঠ জুড়ে নেমে এসেছে অপার নৈঃশব্দ্য। দম বন্ধ করে কয়েক শ মানুষ হিরন্ময়দের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন। যেন এই আগন্তুকরা তাদের জন্য মৃত্যুর পরওয়ানা বয়ে এনেছেন।
হিরন্ময় মাঠের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি বিপুল জনতাকে ধীরে ধীরে একবার দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বলতে লাগলেন, আজ আমরা কী জন্যে এখানে এসেছি, সোমনাথবাবুরা আপনাদের তা জানিয়ে দিয়েছেন।
কেউ উত্তর দিল না।
হিরন্ময় থামেননি, দেশভাগের ফলে আপনাদের সর্বস্ব গেছে। ইন্ডিয়ায় এসে কী কষ্ট করে ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন, প্রতি মুহূর্তে সেটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু সারাজীবন এভাবে চলতে পারে না। আপনাদের ছেলেমেয়ে আছে, তাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। পশ্চিম বাংলায় জায়গা জমির খুবই অভাব। তাই সরকার ঠিক করেছে, আপনাদের আন্দামান পাঠাবে। সেখানে প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া হবে একুশ বিঘে করে চাষের জমি। বাড়িঘর কারার জন্যে আরও কিছু জায়গা। স্কুল, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস-সব তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তানে যা যা ফেলে এসেছেন, ওখানে গেলে সমস্ত পেয়ে যাবেন। যে টাইপ-করা কাগজের তাড়ায় ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নাম রয়েছে সেটা তার হাতেই ছিল। পকেট থেকে পেন বার করে বললেন, কারা কারা যাবেন, বলুন। আমি তাদের নামের পাশে দাগ দিয়ে রাখি। বলুন–বলুন
প্রথমটা সাড়াশব্দ নেই। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে জনতার ভেতর থেকে একজন ভয়ে ভয়ে, কাঁপা গলায় বলে ওঠে, আমরা আন্ধারমানে যামু না।
লহমায় সারা জমায়েতে বিদ্যুৎ খেলে যায়। চারদিক থেকে শোরগোল উঠতে থাকে, আন্ধারমানে যামু না, যামু না
হিরন্ময় হতচকিত। তার পাশে যে অফিসাররা রয়েছেন তারাও চমকে উঠেছেন। হিরন্ময় জিজ্ঞেস করলেন, কেন যেতে চাইছেন না? সেখানে এত সুযোগ-সুবিধা
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ভিড়ের সামনের দিক থেকে একটা শীর্ণ, আধবুড়ো লোক চেঁচিয়ে বলে, ছার (স্যার), আপনেগো কুনো কথা হুনুম না। আমরা জানি রিফুজগো জাহাজে ভইরা লইয়া গিয়া মইদ্য সমুন্দরে ফালাইয়া দ্যায়। হাঙ্গরে কুমিরে (কুমিরে) হেগো খাইয়া শ্যাষ করে।
কী উত্তর দেবেন, ভেবে পাচ্ছেন না হিরন্ময়। বিমূঢ়ের মতো তিনি লোকগুলোকে দেখতে থাকেন।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল নিরঞ্জন। এবার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। গলার স্বর চড়িয়ে বলে, ক্যাঠা কইছে এই কথা?
আধবুড়োটা বলে, ছার (স্যার), আমরা হগল খবরই পাই।
মিছা কথা, পুরা মিছা। আমি আপনেগো লগে আন্দামান যামু। আপনেরা এতটি (এতজন) মানুষ। কেও যদিন কালাপানিতে আপনেগো ফালাইয়া দিতে চায়, হের আগে আমারে সমুন্দরে ফেইকা (ছুঁড়ে দিয়েন।
আধবুড়ো লোকটা ধন্দে পড়ে যায়। বার বার ঢোক গিলে জুতসই একটা জবাব হাতড়াতে থাকে, কিন্তু সেটা খুঁজে পায় না।
উদ্বাস্তুদের জটলা থেকে এবার অন্য একটা লোক উঠে দাঁড়ায়। ক্ষয়াটে চেহারা, ভাঙা গাল, পাশুটে রঙের পাতলা চুল, শিরা বার-করা হাত, চোখ গর্তে ঢোকানো। সে বলে, আন্ধারমান তরি (অবধি) না হয় গ্যালাম, কিন্তুক হেইহানে তো আলিসান জঙ্গল। সাপখোপ বাঘ-ভাল্লুক থিক থিক করতে আছে। আমরা কি সাপের ছুবল খাইয়া মরুম, না বাঘের প্যাটে যামু?
গলার স্বর আরও কয়েক পর্দা চড়িয়ে দেয় নিরঞ্জন, আন্দামানে মাপও নাই, বাঘও নাই। আছে পালে পালে হরিণ। আর ওইহানের সমুন্দরে কত যে মাছ তার ল্যাখ্যাজোখা নাই। জঙ্গলে ঢুকলেই হরিণ পাইবেন। জালের একখান খ্যাও (খেপ) দিলে সমুন্দুর থিকা দশ স্যার পনরো স্যার কইরা মাছ উঠব। প্যাট ভইরা যত ইচ্ছা মাছ, যত ইচ্ছা মাংস খাইতে পাইবেন।