কৃষ্ণ যখন বারণাবতে এসেছিলেন তখন সমগ্র উত্তর-পশ্চিমভারতে তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। কিন্তু এখানে তিনি না এসে পারেননি, কারণ, রাজনৈতিক দিক দিয়েই পাণ্ডব-ভাইদের তার বিশেষ প্রয়োজন। অন্যদিকে তিনি যেখানে থাকেন, সেখানে তার আপন স্বজন জ্ঞাতি-গুষ্টির মধ্যেই এক ভীষণ গণ্ডগোল বেধে গেছে। সে সব কথা আমরা সময়মতো বলব। আপাতত এইটুকু না বলে পারছি না যে, আমাদের এখন হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক পটভূমি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নজর দিতে হবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে, বৃন্দাবনে এবং মথুরায়।
বৃন্দাবনে কৃষ্ণ যখন কংস-প্রেরিত তথাকথিত অসুর-রাক্ষসদের বধ করে আপন পরাক্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন, অঘাসুর-বকাসুর তৃণাবর্তেরা যখযমদ্বারে এক পংক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, নাগরাজ কালিয় যখন কৃষ্ণের আদেশ মেনে যমুনা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন, বৃন্দাবনে কৃষ্ণকে তখন সকলে এক ডাকে চেনে। শেষমেশ পূর্বতন বৈদিক দেবতাদের প্রতিভূ ইন্দ্রের অভিমানও যখন কৃষ্ণের প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধিশালিতায় বিপর্যস্ত হয়ে গেল, কৃষ্ণ তখন ব্রজের মানুষদের মধ্যে দেবতার মতো সম্মান পাচ্ছেন। ইন্দ্রের মেঘ-বিক্রমে বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ যখন ব্রজবাসীদের গোবর্ধনের সুরক্ষিত আশ্রয় দান করে মেঘ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করলেন ব্রজবাসীদের, সেদিন তারা চমৎকৃত হয়েছিল। দেবতাদের প্রতিভূ ইন্দ্র সেদিন কৃষ্ণের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কৃষ্ণের ক্ষমতা এবং প্রজ্ঞার বিশালত্ব মেনে নিয়ে ইন্দ্র সেদিন সসম্মানে নবযুগের প্রতিভূ কৃষ্ণের মাহাত্ম্য স্বীকার করেছিলেন।
দেবতাদের ইন্দ্রের সঙ্গে ব্রজবাসীদের গোবিন্দ যেদিন বন্ধুত্বের বন্ধন স্বীকার করে নিলেন, সেদিন ইন্দ্র কৃষ্ণকে অনুরোধ করেছিলেন–হস্তিনাপুরের রানী তোমার পিসি কুন্তীর গর্ভে আমার একটি পুত্র আছে। তার নাম অর্জুন। আমাকে তুমি যে দৃষ্টিতে দেখছ, তুমি তোমার পিসতুতো ভাই অর্জুনকেও সেই দৃষ্টিতে দেখবে–দ্রষ্টব্যশ্চ যথাহং বৈ ত্বয়া মান্যশ্চ নিত্যশঃ। তুমি সদা সর্বদা তার রক্ষা বিধান করো। তুমি জেনো যুদ্ধকালে সে তোমার বিশেষ সহায় হবে–স তে বন্ধুঃ সহায়শ্চ সংগ্রামে ভবিষ্যতি। এই কিছুক্ষণ আগে বারণাবতে জতুগৃহের ভস্মরাশির পাশে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের এই কথা একবারও মনে হয়নি যে, তার সমবয়সী অর্জুনের মৃতদেহ এখানে পড়ে আছে। অবশ্য মৃতদেহ পরীক্ষা করার পরই তার সমস্ত ভয় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। তিনি নির্দ্বিধায় ফিরে গেছেন দ্বারকাপুরীতে।
বৃন্দাবনে কৃষ্ণের প্রতি ইন্দ্রের এই অনুরোধ-বাক্য শুনেই আমরা হস্তিনাপুরে চলে এসেছিলাম। সেখানে পিতার মৃত্যুর পর পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে আসা থেকে আরম্ভ করে, তাদের অস্ত্রশিক্ষা, তাদের প্রতি দুর্যোধনের ঈর্ষা-অসূয়ার বৃত্তান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের চক্রান্তে পাণ্ডবদের জতুগৃহে আগমন তথা তাদের বেঁচে ফিরে যাওয়ার কাহিনীও আমরা বলেছি। ধৃতরাষ্ট্র যেমন পাণ্ডবদের বেঁচে ফিরে যাওয়ার রহস্য জানতেন না, তেমনই কৃষ্ণ সে খবর জানতেন না। জতুগৃহে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের তথাকথিত মৃত্যুর খবর হস্তিনাপুরে এবং দ্বারকায় পৌঁছেছিল। কৃষ্ণ তখন কংসবধের পর মথুরা–দ্বারকায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। অপিচ পাণ্ডবদের মৃত্যুর খবর পেয়ে বারণাবতে স্বয়ং উপস্থিত হয়েছিলেন সাত্যকিকে নিয়ে।
কৃষ্ণ কেন এসেছিলেন বারণাবতে, কী পরিস্থিতিতে এসেছিলেন অথবা তিনি আদৌ এসেছিলেন কিনা–সে খবর মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে দেননি। দেননি, কারণ তিনি পাণ্ডবদের গৌরব কাহিনী লিখতে বসেছেন, কৃষ্ণের জীবন তার কাছে আপাতত পার্শ্ব-কাহিনী মাত্র। আমরা যেহেতু মহাভারতের সমস্ত ঘটনাগুলিকে তৎকালীন ভারত-ইতিহাসের এক বিরাট অংশ মনে করি, তাই পরম্পরাসূত্রে আবদ্ধ কৃষ্ণের জীবন আমরা বাদ দিতে পারি না। কৃষ্ণ কোন অবস্থায় বারণাবতের দগ্ধ-ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, এবং তার পিছনে রাজনৈতিক কারণ কী ছিল সে কথায় আমরা পরে আসব। কেননা যে পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ বারণাবতে এসেছিলেন, তার পিছনে তাঁর জীবনের আনুপূর্বিক পরম্পরা আছে। এবং সে পরম্পরা ধরা আছে অন্যান্য পুরাণে এবং মহাভারতের পরিশিষ্ট স্বরূপ খিল-হরিবংশে। আমাদের তাই আপাতত বৃন্দাবনে ফিরে যেতে হবে; ফিরে যেতে হবে কৃষ্ণের কাছে, ঠিক যেখানে তাঁকে আমরা রেখে এসেছিলাম।
আমরা পৌরাণিক মিথলজিস্টদের দৃষ্টি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি যে, বৃন্দাবনে পূর্বে ইন্দ্র-যজ্ঞ করা হত। কৃষ্ণ সেই প্রাচীন রীতি স্তব্ধ করে দিয়ে গিরিযজ্ঞ প্রতিষ্ঠা করলেন। বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের পূজা–পার্বণ বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত জনপদবাসীকে দিয়ে তাদের জীবিকা এবং আশ্রয় গোপূজা করালেন কৃষ্ণ। আমরা আগেই জানিয়েছি–একটি অঘাসুর অথবা একটি বকাসুর বধ করতে শারীরিক শক্তি লাগে বটে, কিন্তু একটি প্রাচীন রীতি বা প্রাচীন সংস্কার ভেঙে দিতে ব্যক্তিত্ব লাগে অনেক বেশি। ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে গোপূজার ব্যবস্থা করা, অর্জুনবৃক্ষ উৎপাটন করে বৃক্ষ–পূজা করা নাগরাজ কালিয়কে স্থানান্তরিত করা এবং নিজের জীবিকার প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলে গোপূজার রীতি প্রবর্তন করা নিজেদের বসতিস্থান গিরি গোবর্ধনের গৌরব বৃদ্ধি করা–এ সবের পিছনে যে ব্যক্তিত্ব কাজ করে, সেই ব্যক্তিত্বের চরম পর্যায়ে কৃষ্ণ এখন উপনীত।