- বইয়ের নামঃ ভূমিকা : বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. ভূমিকা : ইতিহাসের যুক্তি
১. বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
প্রথম পরিচ্ছেদ। বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ
বাঙলার ইতিহাস ও বাঙালীর ইতিহাসে প্রভেদ কোথায় এ কথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় না। যে বিষয়ের আলোচনার জন্য এই গ্রন্থ, তাহাকে বাঙলার ইতিহাস বলিলে আপত্তি করিবার কিছু নাই; তবু, বাঙালীর ইতিহাস যখন বলিতেছি তখন তাহার কারণ নিশ্চয়ই একটু আছে।
বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ
স্বর্গত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ইংরেজি ভাষায় রচিত বাঙলার পাল রাজবংশের কাহিনী এবং তাহার বাঙ্গালার ইতিহাস বহুদিন প্রাচীন বাঙলার প্রামাণিক ইতিহাস বলিয়া গণ্য। কয়েক বৎসর আগে শেষোক্ত গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে; এখনও যে সে গ্রন্থের মূল্য পণ্ডিতমহলে স্বীকৃত ইহাই তাহার প্রমাণ স্বগত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের ‘গৌরাজমালা’ও ঐতিহাসিকের কাছে সুপরিচিত এবং মূল্যবান গ্রন্থ। ‘গৌড়রাজমালা’ প্রকাশিত হইবার পর শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, বিনয়চন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র রায়, রাধাগোবিন্দ বসাক, প্রমোদলাল পাল, স্বগত ননীগোপাল মজুমদার, গিরীন্দ্রমোহন সরকার এবং আরও অনেক প্রখ্যাত পণ্ডিত ও মনীষী প্রাচীন বাঙলার রাজকীয় ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় রচনা করিয়া তুলিয়াছেন। এ কথা স্বীকার করিতেই হয় যে ইঁহাদের এবং অন্যান্য আরও অনেক গবেষকের সম্মিলিত চেষ্টা ও সাধনার ফলে আজ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস আমাদের কাছে অল্পবিস্তর সুপরিচিত; অন্তত মোটামুটি কাঠামো সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা কিছু নাই। কিন্তু, একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের গবেষণার ফলে, সমবেত চেষ্টার ফলে, প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের যাহা জানিবার সুযোগ হইয়াছে তাহার অধিকাংশই প্রাচীন রাজবংশাবলীর কথা– রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়পরাজয়ের কথা। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি এবং রাজকর্মচারীদের সম্বন্ধে কিছু কিছু সংবাদ জানিবার সুযোগও হইয়াছে। প্রাচীন বাঙলাদেশ সম্বন্ধে যে সমস্ত লেখমালা ও যে কয়েকখানি সাহিত্যগ্রন্থ সম্পাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে তাহা হইতেও এইসব রাজকীয় সংবাদ ছাড়া কিংবা রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতির কথা ছাড়া আর কিছু আহরণ করিবার চেষ্টা কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত বিশেষ কিছু হয় নাই। কোনও কোনও সম্পাদক, যেমন স্বগর্ত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, ননীগোপাল মজুমদার, গঙ্গামোহন লস্কর, পারজিটার, নগেন্দ্রনাথ বসু, লালমোহন বিদ্যানিধি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কীলহর্ন, শ্ৰীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী, রাধাগোবিন্দ বসাক, দীনেশচন্দ্র সরকার, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ পণ্ডিতেরা সমাজ সম্বন্ধেও কিছু কিছু তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। কিন্তু এই সমাজ সর্বত্রই বর্ণাশ্রমবদ্ধ সমাজ, এবং তাঁহাদের আহৃত সমাজ-সংবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চতর বর্ণের সমাজ-সংবাদ। এ-যাবৎ সামাজিক অবস্থা বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘সমাজ’ কথাটা অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে, উচ্চতর বর্ণ-সমাজ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; এবং সে সংবাদও অত্যন্ত অপ্রচুর। মোটামুটি ইহাই ছিল কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও বাঙলার ইতিহাসের উপাদান। গ্রন্থাকারে বা প্রবন্ধকারে প্রাচীন বাঙলার যত ইতিহাসাধ্যায় রচিত হইয়াছে তাহতে রাজ্য, রাজা, রাজকর্মচারী, রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি এবং উচ্চতর বর্ণ-সমাজসম্পৃক্ত সংবাদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। ইহাই আমাদের বাঙলার ইতিহাস।
আরও কিছু আছে। ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধেও আমাদের কিছু কিছু জানিবার সুযোগ আছে। এ বিষয়ে সর্বাগ্রে স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের নাম করিতে হয়। প্রাচীন বাঙলার সাহিত্য এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে তিনিই সর্বপ্রথম আমাদের সজাগ করিয়াছিলেন। তাহার এবং স্বৰ্গত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের প্রদর্শিত পথে শিল্প, সাহিত্য, ভাষা ও ধর্ম-সম্পৃক্ত সংবাদ আহরণ ও আলোচনায় স্বৰ্গত নগেন্দ্রনাথ বসু, গিরীন্দ্রমোহন সরকার, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সরসীকুমার সরস্বতী, অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, নলিনীনাথ দাশগুপ্ত, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র রায়, শ্রীমতী স্টেলা ক্রামরিশ প্রভৃতি পণ্ডিত ও মনীষীরা নানাদিকে উল্লেখযোগ্য উদ্যম প্রকাশ করিয়া বাঙলার ইতিহাসের সীমা ও পরিধি বিস্তৃত করিয়াছেন। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, ঢাকার সরকারী চিত্রশালা এবং বাঙলার ও বাঙলার বাহিরের অন্যান্য ক্ষুদ্র বৃহৎ সাধারণ ও ব্যক্তিগত প্রত্নবস্তু-সংগ্রহের সহায়তায় প্রাচীন বাঙলার ভাষা ও সাহিত্য, ধর্ম ও শিল্প সম্বন্ধে আজ আমাদের জ্ঞান ও দৃষ্টি অনেকটা সুস্পষ্ট। ইঁহার এবং এইসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের পথ সুগম করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও এ কথা সত্য ছিল যে, কি বাঙলা কি ইংরাজি, কি অপর কোনও ভাষায় প্রাচীন বাঙলার সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপূর্ণ একটা রূপ কেহ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করেন নাই। ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যাহা জানিতাম তাহার অধিকাংশই বর্ণ-ধর্মের কথা—সে ধর্ম বৌদ্ধই হউক আর পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মই হউক,—সভাশিল্প বা নাগর সমাজের অভিজাত শিল্পের কথা, সংস্কৃত সভা-সাহিত্যের কথা। যে ধর্ম বর্ণাশ্রমীদের, যে শিল্প বা সাহিত্য রাজসভায় বা বিত্তশালী বণিক অথবা গৃহস্থের পোষকতায় পুষ্ট ও লালিত, যে শিল্প বা সাহিত্য বর্ণাশ্রম ধর্মের, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ও শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসন, সাধন-পদ্ধতি এবং লক্ষণদ্বারা শাসিত, সেই ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যের কথাই এ-যাবৎ আমরা পড়িয়া আসিয়াছি। লোকধর্ম, লোকশিল্প, লোকসাহিত্য প্রভৃতি সম্বন্ধে আমরা বহুদিন একেবারে সজাগই ছিলাম না। স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় মাঝে মাঝে আমাদের একটু সজাগ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন মাত্র।
বহুদিন আগে বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন, “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না…।” তিনি শুধু রাজা ও রাষ্ট্রের ইতিহাস-রচনা কামনা করেন নাই; চাহিয়াছিলেন বাঙলার সেই ইতিহাস যে-ইতিহাস বলিবে :
… রাজ্যশাসন প্রণালী কিরূপ ছিল, শান্তিরক্ষা কিরূপে হইত। রাজসৈন্য কত ছিল, কি প্রকার ছিল, তাহদের বল কি, বেতন কি, সংখ্যা কি?…কতপ্রকার রাজকর্মচারী ছিল…? কে বিচার করিত…রাজা কি লইতেন, মধ্যবর্তীরা কি লইতেন, প্রজারা কি পাইত, তাহাদের সুখদুঃখ কিরূপ ছিল? চৌর্য, পূর্ত, স্বাস্থ্য এসকল কিরূপ ছিল?…কোন ধর্ম কতদূর প্রচলিত ছিল? …তখনকার লোকের সামাজিক অরস্থা কিরূপ? সমাজভয় কিরূপ? ধর্মভয় কিরূপ-বাণিজ্য কিরূপ, কি কি শিল্পকার্যে পারিপাট্য ছিল? কোন কোন দেশোৎপন্ন শিল্প কোন কোন দেশে পাঠাইত? … ভিন্ন দেশ হইতে কি কি সামগ্ৰী আমদানি হইত, পণ্যকার্য কি প্রকারে নির্বাহ হইত?
আজ বহুদিন পর বঙ্কিমচন্দ্রের এই কামনা কিছু সার্থক হইয়াছে, বলা যায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুকূল্যে শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদারের সুযোগ্য সম্পাদনায় এবং প্রভূত শ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে ইংরাজি ভাষায় রচিত বাঙলার ইতিহাসের সুবৃহৎ প্রথম খণ্ড, অর্থাৎ প্রাচীন বাঙলার পরিপূর্ণ সুপরীক্ষিত, সআলোচিত তথ্যবহুল একটি সামগ্রিক ইতিহাস প্রকাশিত হইয়াছে। প্রায় সাতশত পৃষ্ঠায় বারোজন বাঙালী পণ্ডিত ও মনীষীর সমবেত প্রচেষ্টায় প্রসূত এই গ্রন্থকে বাঙলার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে বিগত ৭৫ বৎসরের সম্মিলিত গবেষণার সমষ্টিগত ফল বলা যাইতে পারে। আলোচনারম্ভেই যে অভাব সম্বন্ধে অভিযোগ করা হইয়াছে, এই গ্রন্থ প্রকাশের ফলে সেই অভাব কিছুটা মিটিয়াছে এ কথা বোধ হয় বলা যায়। এ গ্রন্থ বাঙালীর পণ্ডিত ও মনীষার গৌরব, এমন উক্তি করিলে খুব অত্যুক্তি কিছু করা হয় না। সম্প্রতি রমেশবাবু এই সুবৃহৎ গ্রন্থের একটি বাঙলা সংক্ষিপ্তসারও প্রকাশ করিয়াছেন।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও বাঙলার এই ইতিহাসকে বাঙালীর ইতিহাস বোধ হয় বলা চলে না। তাহার কারণ একটু সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে। প্রথমত, ইতিহাসের কোনও যুক্তি, কার্যকরণ-সম্বন্ধের কোনও ব্যাখ্যা বা ইঙ্গিত এই ইতিহাস-পরিকল্পনার পশ্চাতে নাই; তাহা না থাকিবার ফলে প্ৰত্যেকটি অধ্যায় সুপরীক্ষিত, সুআলোচিত ও তথ্যবহুল হওয়া সত্ত্বেও এই গ্রন্থে সমসাময়িক বাঙালীর সমগ্র জীবনধারার যথার্থ পরিচয় ফুটিয়া উঠিতে পারে নাই। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন বাঙলায় যাহাদের বলা যায় জনসাধারণ, যাঁহারা বর্ণসমাজের বাহিরে, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বাহিরে অথবা বৌদ্ধধর্মের বাহিরে, যাহারা রাষ্ট্রের দরিদ্র ভূমিহীন প্রজা বা স্বল্পভূমিবান প্রজা বা সমাজশ্রমিক তাহাদের কথা এই গ্রন্থে যথেষ্ট স্থান পায় নাই; অথচ তাঁহারাই যে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এ সম্বন্ধে তো সন্দেহ নাই। যে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবী, গ্রাম্য জনসাধারণের জীবনযাত্রা, গ্রামের সঙ্গে নগরের পার্থক্য ও-যোগাযোগের অধিকতর তথ্য, যে অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর সমগ্র জীবনধারা প্রবহমান তাহার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা জনসাধারণের এই ইতিহাসকে পূর্ণতর ও উজ্জ্বলতর করিতে পারিত, তাহা পরিপূর্ণ মর্যাদায় এই গ্রন্থভুক্ত হইতে পারে নাই | সত্য বটে, ইঁহাদের কথা বলিবার মতো যথেষ্ট তথ্য হয়তো আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই; তবু, যতটুকু জানা যায় ততটুকু অন্তত প্রাচীন বাঙলাদেশকে বেশি জানা। তৃতীয়ত, এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি অধ্যায় বিচ্ছিন্ন; একে অন্যের সঙ্গে অপরিহার্য অনিবার্য সম্বন্ধসূত্রে গ্রথিত নয়। সুলিখিত এবং তথ্যবহুল রাজকাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের আলোচনা এই গ্রন্থের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অধিকার করিয়া আছে; কিন্তু এত বেশি মূল্য পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন দিকের যোগাযোগ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সচেতনতা এই অধ্যায়গুলিতে নাই। ভাষা এবং সাহিত্য গম্বন্ধে অধ্যায় দুইটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তথ্যবহুল এবং অত্যন্ত সুলিখিত; কিন্তু ইঁহাদের মধ্যেও সাহিত্যের সঙ্গে সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সম্বন্ধের ইঙ্গিত অত্যন্ত কম। ধর্মের অধ্যায়ে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবীর অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রায় নাই বলিলেই চলে; অথচ, বাঙলাদেশে উচ্চতর বর্ণসমাজে যে ধর্মের প্রচলন তাহার ভিত্তিভূমিই হইতেছে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবী ও লৌকিক আচারানুষ্ঠান। সমাজ কথাটিও অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; তবু জনসাধারণের কথা যাহা কিছু তাহা সমাজ-অধ্যায়েই আছে। একমাত্র এই অধ্যায় এবং ইহার পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থার অধ্যায়েই জনসাধারণ আমাদের দৃষ্টির বাহিরে পড়িয়া থাকে নাই। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রেও ধর্ম, সমাজ ও আর্থিক অবস্থার সঙ্গে রাজা ও রাষ্ট্রের এবং গণ বিন্যস্ত, শ্রেণী-বিন্যস্ত বৃহত্তর সমাজের সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা যথেষ্ট করা হয় নাই।
রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আর্থিক বিন্যাস প্রভৃতি সমস্ত কিছুই গড়িয়া তোলে মানুষ; এই মানুষের ইতিহাসই যথার্থ ইতিহাস। এই মানুষ সম্পূর্ণ মানুষ; তাহার একটি কর্ম অন্য আর একটি কর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন নয় এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিলে দেখা ও পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না; একটি কর্মের সঙ্গে অপরাপর কর্মকে যুক্ত করিয়া দেখিলে তবেই তাহার সম্পূর্ণ রূপ ও প্রকৃতি দৃষ্টিগোচর হয়। দেশকালধৃত মানুষের সমাজ সম্বন্ধেও এ কথা সত্য এবং সর্বত্র স্বীকৃত। এই সত্য স্বীকৃতি না পাইলে ইতিহাস যথার্থ ইতিহাস হইয়া উঠিতে পারে না। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত যে ভারতবর্ষের ইতিহাস ব্রিটিশ ইতিহাস-রচনার আদর্শ এবং আমরা আমাদের দেশে যে আদর্শ ও পদ্ধতি এ-যাবৎ অনুসরণ করিয়া আসিয়াছি তাহার মূলে পূর্বোক্ত তার স্বীকৃতি যথেষ্ট নাই। ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির যুক্তি না লিয়াও বলা যায়, উনবিংশ শতকের মধ্যপাদ হইতেই মানবিক তথ্য ও তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও আলোচনায় এই সত্য স্বীকৃত যে, মানুষের সমাজই মানুষের সর্বপ্রকার কর্মকৃতির উৎস, এবং সেই সমাজের বিবর্তন-আবর্তনের ইতিহাসই দেশকালধৃত মানব-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে। আমাদের দেশে ইতিহাসালোচনায় এই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টি ও আলোচনা-পদ্ধতি আজও পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করে নাই। তাহা ছাড়া, এই দেশে রাজকাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্র-কাহিনী আজও ঐতিহাসিক গবেষণা ও আলোচনার একটা প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে। ইহার কারণ অবশ্য সহজবোধ্য ও সুপরিজ্ঞাত। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের রাজসভায় রাজা ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যে-সব গ্রন্থ রচিত হইত তাহার মধ্যে রাজকাহিনী, রাষ্ট্রকাহিনী গ্রন্থের অপ্রাচুর্য ছিল না—রাজসভায় তাহা হইয়াই থাকে—কিন্তু এইসব গ্রন্থে দেশের সমাজবিন্যাস বা জ্ঞান-বিজ্ঞান সৃষ্টি ও আলোচনার যথেষ্ট স্থান বা মূল্য ছিল না। অথচ, রাজা ও রাষ্ট্র ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় কখনও একান্ত হইয়া থাকে নাই। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্র আমাদের জীবন ছিল একান্তই সমাজকেন্দ্রিক, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়; আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের যাহা কিছু কর্মকৃতি সমস্তই আবর্তিত হইত সমাজকে ঘিরিয়া। কিন্তু, উনবিংশ শতকে ইতিহাস-রচনার যে রীতিপদ্ধতি ও আদর্শের সন্ধান আমরা ইংরাজি শিক্ষার ভিতর দিয়া পাইয়াছি তাহা একান্তই রাজা ও রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক। বিংশ শতকে তাহ অনেকটা সমাজ ও সংস্কৃতি আলোচনার দিকে মোড় ফিরিয়াছে সত্য, কিন্তু এখনও সমাজকেন্দ্ৰিক হইয়া উঠে নাই।
অথচ, দেশে রাজা বা রাজপাদোপজীবী কয়জন? রাষ্ট্রশাসনযন্ত্র যাঁহারা পরিচালনা করেন তাঁহারাই বা কয়জন? যুদ্ধবিগ্রহ নিত্য হইত না, সমগ্র ইতিহাসে তাহার স্থান কতটুকু? আজিকার দিনের সামগ্রিক যুদ্ধের মতো তখনকার দিনের যুদ্ধবিগ্রহ সমাজের মূল ধরিয়া টান দিত না। যুদ্ধ সাধারণত যুদ্ধের স্থান, রাজা, সেনাধ্যক্ষ, সৈন্যবাহিনী, রাজসভা, রাজকর্মচারী— ইঁহাদের মধ্যেই আবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ থাকিত। যুদ্ধের ফলাফল নিকট ও দূর ভবিষ্যৎকে একান্তভাবে রূপান্তরিতও করিতে পারিত না। রাজা ও রাজসভার বাহিরে ছিল অগণিত জনসাধারণ, বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত, বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসদ্বারা শাসিত, বিভিন্ন শ্রেণীর সীমায় সীমিত, ঠিক এখনও বাঙলাদেশে যেমনটি আমরা দেখি। তবু বর্তমান কালে, রাষ্ট্র যতটা সর্বগ্রাসী, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, প্রাচীনকালে এমনটি এতটা হইবার সুযোগ ছিল না। এক রাজা পরাজিত হইয়াছে, অন্য রাজা রাজমুকুট পরিয়া রাজসিংহাসনে বসিয়াছেন; তাহাতে অগণিত জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনের বৈপ্লবিক রূপান্তর কিছু ঘটে নাই, বৃহত্তর সমাজব্যবস্থারও খুব দ্রুত উলেট-পালট কিছু হইয়া যায় নাই; যাহা হইয়াছে তাহা ধীরে ধীরে এবং সমাজের উচ্চতর স্তরে।
আসল কথা, প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্র সমগ্র সমাজব্যবস্থার রক্ষক ও নিয়ামক মাত্র। রাজা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল এই সমাজব্যবস্থাকে রক্ষণ ও পালন করা, আর সমাজের দায়িত্ব রাজা ও রাষ্ট্রকে প্রতিপালন করা। সমাজ আছে বলিয়াই রাষ্ট্র এবং রাজাও আছেন; সমাজহীন রাষ্ট্র কল্পনাও করা যায় না। রাজা ও রাষ্ট্রের পক্ষে ধন যেমন অপরিহার্য, সমষ্টির পক্ষেও তাহাই। ধনব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা, শ্রেণীব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা—সমস্তই সামাজিক ধনকে কেন্দ্র করিয়া; ধন না হইলে রাজা ও রাষ্ট্র প্রতিপালিত হয় না। এই ধন উৎপাদনের তিন উপায় প্রাচীন বাঙলায় দেখিতে পাওয়া যায়—কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য। এই তিন উপায় তিন শ্রেণীর করায়ত্ত : ভূমিবানশ্রেণী, শিল্পীশ্রেণী, বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী। এই তিন উপায়ে উৎপাদিত অর্থদ্বারা সমাজ-ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিপালিত হইত এবং সদ্যকথিত তিন শ্রেণী ও রাষ্ট্র মিলিয়া উৎপাদিত ধন বণ্টনের ব্যবস্থা করিতেন। কাজেই, রাজা ও রাষ্ট্র ছাড়া সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে এই শ্রেণীর অর্থাৎ ধনোৎপাদক শ্রেণীর একটা বিশেষ স্থান ছিল, এবং রাজা ও রাজকর্মচারীদের অপেক্ষা ইহারা যে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন তাহ সহজেই অনুমেয়। অথচ, ইঁহাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানিবার সুযোগ নাই। ধনোৎপাদন, ধনবন্টন, ভূমিব্যবস্থায় ভূমিবানদের সঙ্গে ভূমিহীন কৃষককুল ও কৃষিশ্রমিকদের সম্বন্ধ, শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের সম্বন্ধ, শ্রেণী-ব্যবস্থা ও বর্ণ-ব্যবস্থায় বর্ণের সঙ্গে শ্রেণী, বর্ণের সঙ্গে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে আমাদের কিছু জানিবার সুযোগ আজও অতি অল্পই আছে।
এই মাত্র যে ধনোৎপাদক শ্রেণী ও কৃষিশ্রমিকদের কথা বলিলাম, ইঁহাদের জীবনাচরণ যে শুধুই ধনসর্বস্ব, ধনকেন্দ্রিক ছিল, এ কথা বলা চলে না। ইঁহাদের রক্ষা ও পালন যাহারা করিতেন সেই রাজা ও রাজপাদোপজীবীদের জীবনে ধর্ম ও শিল্পের, শিক্ষা ও সাহিত্যের, এক কথায় সংস্কৃতিরও প্রয়োজন ছিল। সেই সংস্কৃতি স্বভাবতই এমন হওয়া প্রয়োজন ছিল যাহা তদানীন্তন সমাজ-সংস্থানের পরিপন্থী নয়। এই সংস্কৃতির পুষ্টি ও পালন ধনসাপেক্ষ : সেই ধন সমাজের উদকৃত্ত ধন। দৈনন্দিন একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করিয়া যে-ধন থাকিত সেই ধনের কিয়দংশ যাহারা দিতেন ও দিতে সমর্থ ছিলেন তাহারাই পরোক্ষভাবে উচ্চতর সমাজস্তরের সংস্কৃতির আদর্শ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করবেন, ইহাই তো স্বাভাবিক। অপরোক্ষভাবে ইহাকে রূপদান করিতেন সমাজের বুদ্ধিজীবীরা—ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শাস্ত্রবিদেরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলকরা, এবং ইঁহাদের প্রায় সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ অথবা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য-ধর্মাশ্রয়ী। শিক্ষা ও ধর্মাচরণের, সামাজিক স্মৃতি ও ব্যবহারাদি, নিয়ম-আচার প্রভৃতি প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল তাহদের। এ দায়িত্ব তাহারা পালন করিতেন বলিয়া সমাজের মধ্যে সমর্থ শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ জৈন, বৌদ্ধ, যতি ও ব্রাহ্মণদের প্রতিপালন ও ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিত। সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ইঁহাদের বর্ণ ও শ্রেণীগত স্থান ও ব্যবহার, রাষ্ট্রের সঙ্গে ইঁহাদের সম্বন্ধ, ধনোৎপাদক ও বণ্টক শ্রেণীদের সঙ্গে সম্বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপার, এবং ইঁহাদের সৃষ্ট সংস্কৃতির আদর্শ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করিয়া লইবার সুযোগ আজও কম। ইহারা ছাড়া, সমাজের নিম্নতর স্তরগুলিতে নিরক্ষর জনসাধারণেরও একটা মানস-জীবন ছিল, সংস্কৃতি ছিল। এ সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান স্বল্পই। অথচ, ইহারাও সমাজের বিশেষ একটি অঙ্গ, এবং এই সংস্কৃতির যথার্থ স্বরূপ ও ইতিহাস বাঙলার ও বাঙালীর ইতিহাসেরই কথা।
রাজা, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, কৃষক, কৃষিজীবী, ভূমিবান সম্প্রদায় প্রভৃতি শ্রেণীর অসংখ্য লোকের বিচিত্র প্রয়োজনের সেবার জন্য ছিল আবার অগণিত জনসাধারণ। ইঁহাদের অশন-বসন, বিলাস-আরাম, সুখ-সুবিধা, দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র কর্তব্য প্রভৃতি সম্পাদনার জন্য প্রয়োজন হইত নানা শ্রেণীর, নানা বৃত্তির সমাজসেবক ও সমাজশ্রমিক শ্রেণীর অসংখ্যতর ইতর জনের—প্রাচীন লিপিমালায় যাঁহাদের বলা হইয়াছে অকীর্তিত বা অনুল্লিখিত জনসাধারণ। ইঁহাদের ছাড়াও সমাজ চলিত না, এই অকীর্তিত জনসাধারণও সমাজের অঙ্গবিশেষ, এবং সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে ইঁহাদেরও স্থান ছিল। অথচ, ইঁহাদের কথাও আমরা কমই জানি। ইঁহাদেরও ধর্মবিশ্বাস ছিল, দেবদেবী ছিল, পূজানুষ্ঠান ছিল, সংস্কৃতির একটা ধারা ছিল। উৎপাদিত ধনের খানিকটা— খুব স্বল্পতম অংশ সন্দেহ নাই— ইঁহাদের হাতে আসিত কোনও না কোন সূত্র ধরিয়া। এসব সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টি আজও যথেষ্ট সচেতন নয়।
কাজেই, রাজা, রাষ্ট্র, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, ব্যবসায়ী, শ্রেষ্ঠী, মানপ, ভূমিবান মহত্তর, ভূমিহীন কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবক, সমাজশ্রমিক, ‘অকীর্তিতান্ আওণ্ডালান্’ প্রভৃতি সকলকে লইয়া প্রাচীন বাঙলার সমাজ। ইঁহাদের সকলের কথা লইয়া তবে বাঙালীর কথা, বাঙালীর ইতিহাসের কথা। এই অর্থেই আমি ‘বাঙালীর ইতিহাস’ কথাটি ব্যবহার করিতেছি। বাঙালী-সমাজও এই বৃহত্তর অর্থেই বুঝিতেছি।
অথচ এই অর্থে বাঙলার অথবা বাঙালীর ইতিহাস সম্বন্ধে মনীষী ঐতিহাসিকেরা সকলেই কিছু একেবারে সজাগ ছিলেন না, এ কথা সত্য নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আগে বলিয়াছি; তাঁহার মন দেশকালধৃত ইতিহাসের এই সমগ্ররূপ সম্বন্ধে সচেতন ছিল বলিয়া মনে হইতেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের বহুদিন পরে আর-এক-বাঙালী ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতেও এই বাঙালীর ইতিহাসের কল্পনা ধরা দিয়াছিল। ‘গৌড়রাজমালা’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্বৰ্গত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় লিখিয়াছিলেন, ‘রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়পরাজয়—ইহার সকল কথাই ইতিহাসের কথা। তথাপি কেবল এইসকল কথা লইয়াই ইতিহাস সংকলিত হইতে পারে না। বাঙালীর ইতিহাসের প্রধান কথা—বাঙালী জনসাধারণের কথা।’ এই বাঙালী জনসাধারণের কথা এযাবৎ বাঙলার ইতিহাসে সম্যক কীর্তিত হয় নাই।
২. উপরোক্ত অর্থে বাঙালীর ইতিহাস কেন রচিত হইতে পারে নাই
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । উপরোক্ত অর্থে বাঙালীর ইতিহাস কেন রচিত হইতে পারে নাই
কেন হয় নাই তাহার কারণ খুঁজিতে খুব বেশি দূর যাইতে হয় না। উনবিংশ শতকের শেষপাদে এবং বিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় পাদে ঐতিহাসিক গবেষণার যে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বাঙলাদেশে, তথা ভারতবর্ষে প্রচলিত সে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পাইয়াছি সমসাময়িক যুরোপীয়, বিশেষভাবে ইংরেজি ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণার রীতিপদ্ধতি ও আদর্শ হইতে। এই আদর্শ পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এবং রাজা ও রাষ্ট্রই এই গবেষণার কেন্দ্র। সামাজিক চেতনা এই আদর্শ ও পদ্ধতিকে উদ্বুদ্ধ করে নাই। স্থলদৃষ্টিতে দেখা যায়, রাষ্ট্রই সকল ব্যবস্থার নিয়ন্ত; যেদিকে তাকানো যায়, সেইদিকেই রাষ্ট্রের সুদীৰ্ঘবাহু বিস্তৃত, ইহাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে; এবং সেই রাষ্ট্রও কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ ব্যক্তি-সমষ্টিকেই যেন আশ্রয় করিয়া আছে, ইহাই সর্বজনগোচর হয়। অথচ, সেই রাষ্ট্রের পশ্চাতে যে বৃহত্তর সমাজ এবং সমাজের মধ্যে যে বিশেষ বিশেষ স্বার্থের লীলাধিপত্য তাহা সহজে চোখে ধরা পড়ে না। সমাজবিকাশের অমোঘ নিয়মের বশেই যে রাজা ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি এ কথা উনবিংশ শতকের ইংরেজি ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণা স্বীকার করে নাই। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রেও তেমনই তখনও পর্যন্ত ইংলন্ডে এবং যুরোপেও অধিকাংশ পণ্ডিত মহলে ফরাসী বিপ্লবের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের, কার্লাইলের বীর ও বীরপূজাদর্শের বিজয়-পতাকা উড়িতেছে। এদেশে আমরা তাহার অনুকরণ করিয়াছি মাত্র। ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি সেইজন্যই বিশেষভাবে রাজা ও রাষ্ট্রের দিকেই আকৃষ্ট হইয়াছে, এবং সমাজ সম্বন্ধেও তথ্য যখন আহৃত ও আলোচিত হইয়াছে, তখন সমাজ অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থেই গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হইয়াছে। কিন্তু উনবিংশ শতকের তৃতীয় পাদ হইতেই যুরোপের কোথাও কোথাও, বিশেষভাবে অস্ট্রিয়া ও জার্মানীতে, কিছুটা ফরাসী দেশেও, সমাজবিকাশের বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক গবেষণার সূত্রপাত হয়, এবং তাহার ফলে সর্বত্র পণ্ডিতসমাজ এ কথা স্বীকার করিয়া লন যে, ধনোৎপাদনের প্রণালী ও বণ্টন-ব্যবস্থার উপরই বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন কালের বৃহত্তর সমাজ-সংস্থান নির্ভর করে, বিভিন্ন বর্ণ, শ্রেণী ও স্তর এই ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়াই গড়িয়া ওঠে। এই ব্যবস্থাকে রক্ষণ ও পালন করিবার জন্যই রাজা ও রাষ্ট্র প্রয়োজন হয়; এবং এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করিবার জন্যই একটি বিশেষ সংস্কৃতির উদ্ভব ও পোষণের প্রয়োজন হয়। সমাজ-বিকাশের এই বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ক্রমশ সমগ্র যুরোপে ছড়াইয়া পড়ে, এবং বিগত প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যেও এই ব্যাখ্যার প্রভাব দেখা দেয়। য়ুরোপে যাহা উনবিংশ শতকের শেষ পদেই আরম্ভ হইয়াছিল, এবং যাহার ঢেউ কতকটা বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্ততটে আসিয়া আঘাত করিয়াছিল, বিংশ শতকের প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে ইংলন্ডেও তাহর প্রবর্তনা দেখা দেয়। ইহার কিছুদিন আগে হইতেই সমাজ, সামাজিক ধন, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সংস্কৃতি প্রভৃতির পারস্পরিক সম্বন্ধ ইত্যাদি লইয়া প্রামাণিক গ্রন্থ ইংলন্ডেও রচিত হইতেছিল; কিন্তু জনতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার প্রসার ও প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই নূতন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপ ক্রমশ আরো সুস্পষ্ট হইতেছে। আমাদের দেশের ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণায় এই ইঙ্গিত আজ বিংশ শতকের দ্বিতীয় পাদেও ধরা পড়িল না! এইজন্যই আজ পর্যন্ত বাঙালীর বা ভারতবাসীর যথার্থ ইতিহাস রচিত হইতে পারিল না।
উপরোক্ত ধ্যান ও ধারণা-গত কারণ ছাড়া সমগ্র জনসাধারণের ইতিহাস রচিত না হওয়ার একটা বস্তুগত কারণও আছে; তাহা জনসাধারণের ইতিহাস-রচনার উপযোগী উপাদানের অভাব। প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে সমগ্রভাবেই এই অভিযোগ করা চলে, বাঙলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে তো চলেই। রাজা, রাজবংশ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রদর্শ, রাজকর্মচারী ইত্যাদির কথাই প্রভূত যত্নে তিল তিল করিয়া সংগ্ৰহ করিতে হইয়াছে, তবে আজ আমরা এতদিনের পর আমাদের ইতিহাসের অল্পবিস্তর স্পষ্ট একটা রূপ দেখিতে পাইতেছি। এখনও এমন কাল ও এমন দেশখণ্ড আছে যাহার ধারাবাহিক ইতিহাস সংকলন অত্যন্ত আয়াসসাধ্য। রাজা ও রাষ্ট্রের ইতিহাস সম্বন্ধেই যেখানে এই অবস্থা, সেখানে বৃহত্তর সমাজ ও সমাজের ইতিহাস সম্বন্ধে উপাদানের অপ্রাচুর্য থাকিবে ইহাতে আর আশ্চর্য কী! সমগ্র ভারতবর্ষের কথা বলিয়া লাভ নাই; বাঙালীর ইতিহাস রচনা করিতে বসিয়া বাঙলাদেশের কথাই বলি। বাঙলার রাষ্ট্র ও রাজবংশাবলীর ইতিহাস যতটুকু আমরা জানি তাহার বেশির ভাগ উপাদান যোগাইয়াছে প্রাচীন লেখমালা। এই লেখমালা, শিলালিপিই হউক আর তাম্রলিপিই হউক, ইহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় রাজসভাকবি রচিত রাজার অথবা রাজবংশের প্রশস্তি, কোনও বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে রচিত বিবরণ, বা কোনও ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিল, অথবা কোনও মূর্তি বা মন্দিরে উৎকীর্ণ উৎসর্গলিপি। ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিলগুলিও সাধারণত রাজা অথবা রাজকর্মচারীদের নির্দেশে রচিত ও প্রচারিত। এই লেখমালার উপাদান ছাড়া কিছু কিছু সাহিত্য জাতীয় উপাদানও আছে; ইঁহাদের অধিকাংশই আবার রাজসভার সভাপণ্ডিত, সভাপুরোহিত, রাজগুরু অথবা রাষ্ট্রের প্রধান কর্মচারীদের দ্বারা রচিত স্মৃতি, ব্যবহার ইত্যাদি জাতীয় গ্রন্থ। ধোয়ীর ‘পবনদূত’, সন্ধ্যাকর নদীর ‘রামচরিত’, শ্ৰীধর দাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’—জাতীয় দুই চারিখানি কাব্যগ্রন্থও আছে; সেগুলি অধিকাংশ রাজা বা রাজসভাপুষ্টকবিদের দ্বারা রচিত বা সংকলিত। বৃহদ্ধর্ম, ব্রহ্মবৈবর্ত এবং ভবিষ্যপুরাণের মতো দুই-তিনটি অর্বাচীন পুরাণগ্রন্থও আছে; এগুলি রাজসভায় রচিত হয়তো নয়, কিন্তু রাজসভা, রাজবংশ অথবা অভিজাত সম্প্রদায়-কর্তৃক পুষ্ট ও ললিত ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের রচনা। ইহা ছাড়া, অন্যান্য প্রদেশের সমসাময়িক লিপিমালা এবং গ্রন্থাদি হইতেও কিছু কিছু উপাদান পাওয়া যায়; কিন্তু এগুলির চরিত্রও প্রায় একই প্রকারের ফা হিয়ান, য়ুয়ান-চোয়াঙ, ইৎসিঙের মতন বিদেশী পর্যটকদের বিবরণী, গ্রীক ও মিশরীয় ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকদের বিবরণী, তিব্বতে ও নেপালে প্রাপ্ত নানা বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়-গত বিভিন্ন বিষয়ক পুঁথিপত্র হইতেও কতক উপাদান সংগৃহীত হইয়াছে, এখনও হইতেছে। কিন্তু, এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন বিদেশী পর্যটকের রাজ-অতিথিরূপে বা রাষ্ট্রের সহায়তায় এই দেশ পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন, এবং তাহারা বিশেষ বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। বিদেশী পাশ্চাত্য ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকের রচনাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকদের শ্রেণী ও সম্প্রদায়-গত পাথদুষ্টিকে অতিক্রম করিতে পারে না। আর, তিব্বতে-নেপালে প্রাপ্ত পুথিগুলি তো একান্তভাবে শাদ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ছত্রছায়ায় বসিয়াই লেখা হইয়াছিল যতগুলি উপাদানের উল্লেখ করা হল তাহার অধিকাংশই রাজসভা, ধর্মগোষ্ঠী বা বণিকগোষ্ঠীর পোষকতায় রচিত। তবে রাজা, মা বা রাজবংশের অথবা অন্য কোনও অভিজাত বংশের প্রশস্তিলিপিগুলি হইতে এবং রামচরিতে’র মতো সাহিত্যগ্রন্থ হইতেই রাজ্য ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে; আর আর্য-মঞ্জুশ্রীমূলকল্প জাতীয় অন্যান্য ধর্ম অথবা সাহিত্য গ্রন্থ, অন্যান্য স্মৃতি ব্যবহার ও পুরাণ গগু হইতে কিংবা ভূমি দান-বিক্রয়ের তাম্রপট্ট হইতে যে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে তাহা পরোক্ষ। পাণভট্টের হর্ষচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত বা কলহনের রাজতরঙ্গিণীর মতন কোনও ইতিহাস গ্রন্থ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস রচনায় সহায়তা করিতেছে না। এই অবস্থায়, রাজা, রাজবংশ, রাষ্ট্র ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস-রচনার উপাদানই তো অপূর্ণ ও অপ্রচুর, সামাজিক ইতিহাসের তো কথাই নাই।
উপরোক্ত উপাদানগুলি বাঙলার বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাসেরও উপাদান। সমাজ সম্বন্ধে যে গবাদ ইঁহাদের মধ্যে পাওয়া যায় তাহা যে শুধু পরোক্ষ সংবাদ তাহাই নয়, শুধু যে অপূর্ণ ও আপ্রচুর তাহাই নয়, কতকটা একদেশীয়, একপক্ষীয় হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথমত, সামাজিক তিহাসের সংবাদ দেওয়া তাহদের উদ্দেশ্য নয়। যতটুকু সংবাদ পাওয়া যায় তাহা পরোক্ষভাবে, বিবৃত ঘটনা ও পারিপাশ্বিকের জন্য যতটুকু প্রয়োজন হইয়াছে তাহার প্রসঙ্গক্রমে। সেই দিক হইতে যাহা পাওয়া যায় তাহাই মূল্যবান এবং ঐতিহাসিকের নিকট গ্রহণযোগ্য সন্দেহ নাই। দ্বিতীয়ত, যেহেতু স্বভাবতই এই সব উপাদানের উৎপত্তিস্থল হইতেছে রাজসভা, অভিজাতসম্প্রদায় বা ধর্মগোষ্ঠী সেইহেতু স্বভাবতই তাহদের মধ্যে সমাজের অন্যান্য শ্রেণী বা গোষ্ঠী সম্বন্ধে যে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে তাহ অত্যন্ত স্বল্প শুধু নয়, অপক্ষপাতদৃষ্টিও তাহার মধ্যে নাই। শিল্পী ও বণিকশ্রেণী, ক্ষেত্রকর ও সমাজ-শ্রমিক শ্রেণীর মতন সমাজের এমন প্রয়োজনীয় শ্রেণীদের সম্বন্ধেও এই সব উপাদান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরব। তাহা ছাড়া, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশেষভাবে সামাজিক ইতিহাস-রচনায় যে সাহায্য সমকালীন ধর্ম, স্মৃতি, সূত্র এবং অর্থশাস্ত্রজাতীয় গ্রন্থাদি হইতে পাওয়া যায়, প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাস-রচনায় সেই ধরনের সাহায্য একাদশ-দ্বাদশ শতকের আগে পাওয়া যায় না বলিলেই চলে। অবশ্য অনেকে ধরিয়া লন যে, এই জাতীয় গ্রন্থাদিতে বর্ণিত সামাজিক অবস্থা তদানীন্তন বাঙলাদেশেও হয়তো প্রচলিত ছিল। তবু যেহেতু এই জাতীয় কোনও গ্রন্থ বাঙলাদেশে রচিত হইয়াছিল বলিয়া নিঃসংশয়ে বলা যায় না, সেই কারণে প্রাচীন বাঙলায় ইতিহাস-রচনায় তাহদের প্রমাণ অনুমানের অধিক মূল্য বহন করে না, এবং ঐতিহাসিকের কাছে অনুমানসিদ্ধ প্রমাণের মূল্য খুব বেশি নয়, যদি সমাজবিকাশের প্রাকৃতিক নিয়মম্বারা তাহা সিদ্ধ ও সমর্থিত না হয়। এই সব কারণেও বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাস-রচনার দিকে, তথা বাঙালীর ইতিহাস-রচনার দিকে, আমাদের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় নাই।
৩. বাঙালীর সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালীর ইতিহাস
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
তৃতীয় পরিচ্ছেদ । বাঙালীর সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালীর ইতিহাস
বস্তুত, সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই প্রকৃত জনসাধারণের ইতিহাস। প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই এই গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বলিয়াও ইহার নামকরণ করিয়াছি ‘বাঙালীর ইতিহাস’। রাজা ও রাষ্ট্র এই সমাজবিন্যাসে যতটুকু স্থান অধিকার করে ততটুকুই আমি ইহাদের আলোচনা করিয়াছি। এই সমাজবিন্যাসের বস্তুগত ভিত্তি, সমাজের বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণী, সমাজে ও রাষ্ট্রে তাহদের স্থান, তাহাদের দায় ও অধিকার, বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর ও রাষ্ট্রের সম্বন্ধ, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্বন্ধ, সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি ইত্যাদি সমস্তই প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের, তথা জনসাধারণের ইতিহাসের আলোচনার বিষয়। এই সমাজবিন্যাসের ইতিহাস-রচনার কতকটা পরিচয় পাওয়া যায় জার্মান পণ্ডিত ফিক্ (Fick)- রচিত বুদ্ধদেবের সমসাময়িক উত্তর-পূর্ব ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’- গ্রন্থে (Die Sociale Gielderung in Nordostlichen zu Buddhas Zeit)। অবশ্য, জাতকের অসংখ্য গল্পে এবং প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে তদানীন্তন সমাজবিন্যাসের যে চিত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, প্রাচীন বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদানে সে স্পষ্টতা বা সম্পূর্ণতা একেবারেই নাই। তবু, সমাজতাত্ত্বিক রীতিপদ্ধতি অনুযায়ী প্রাচীন বাঙলার ঐতিহাসিক উপাদান সযত্বে বিশ্লেষণ করিলে আজ মোটামুটি একটা কাঠামো গড়িয়া তোলা একেবারে অসম্ভব হয়তো নয়। বর্তমান গ্রন্থে তাহার চেয়ে বেশি কিছু করা হইতেছে না, বোধ হয় সম্ভবও নয়। বাঙলাদেশে ঐতিহাসিক উপাদান আবিষ্কারের চেষ্টা খুব ভালো করিয়া হয় নাই। এক পাহাড়পুর নানাদিক দিয়া প্রাচীন বাঙলার জনসাধারণের ইতিহাসে অভিনব আলোকপাত করিয়াছে; কিন্তু, তেমন উদ্যম অন্যত্র এখনও দেখা যাইতেছে না। বেশির ভাগ উপাদানের আবিষ্কার আকস্মিক এবং পরোক্ষ। তবু, ক্রমশ নূতন উপাদান সংগৃহীত হইতেছে, এবং আজ যাহা কাঠামো মাত্র, ক্রমশ আবিষ্কৃত উপাদানের সাহায্যে হয়তো এই কাঠামোকে একদিন রক্তে-মাংসে ভরিয়া সমগ্র একটা রূপ দেওয়া সম্ভব হইবে।
উপাদান সম্বন্ধে সাধারণ দুই-একটি কথা
সমাজবিন্যাসের অথবা বৃহত্তর অর্থে সামাজিক ইতিহাস রচনার একটা সুবিধাও আছে, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস রচনায় যাহা নাই। রাষ্ট্রীয়, বিশেষভাবে রাজবংশের, ইতিহাসে সন-তারিখ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য। কোন রাজার পরে কোন রাজা, কে কাহার পুত্র অথবা দৌহিত্র, কোন যুদ্ধ কবে হইয়াছিল ইত্যাদির চুলচেরা বিচার অপরিহার্য। সন-তারিখ লইয়া সেইজন্য প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনায় এত বিতর্ক। এই ইতিহাসে ঘটনার মূল্যই সকলের চেয়ে বেশি এবং সেই ঘটনার কালপরম্পরার উপরই ইতিহাসের নির্ভর। সামাজিক ইতিহাস-রচনায় এই জাতীয় ঘটনার মূল্য অপেক্ষাকৃত অনেক কম; সন-তারিখের মোটামুটি কাঠামোটা ঠিক হইলেই হইল, যদি না। কিছু রাষ্ট্রীয় অথবা সামাজিক বিপ্লব-উপপ্লব সমাজের চেহারাটাই ইতিমধ্যে একেবারে বদলাইয়া দেয়। তাহার কারণ সহজেই অনুমেয়। সামাজিক বর্ণবিভাগ, শ্রেণীবিভাগ, ধনোৎপাদন ও বণ্টন-প্রণালী, জাতীয় উপাদান, ভূমিব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ ইত্যাদি, এক কথায় সমাজবিন্যাস রাজা বা রাজবংশের হঠাৎ পরিবর্তনে রাতারাতি কিছু বদলাইয়া যায় নাই; অন্তত প্রাচীন বাঙলায় বা ভারতবর্ষে তাহা হয় নাই। প্রাচীন পৃথিবীতে সর্বত্রই এইরূপ। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৃহৎ কিছু একটা বিপ্লব-উপপ্লব সংঘটিত হইলে সমাজবিন্যাসও হয়তো বদলাইয়া যায়; কিন্তু তাহাও একদিনে, দুই-দশ বৎসরে হয় না। বহুদিন ধরিয়া ধীরে ধীরে এই বিবর্তন চলিতে থাকে, সমাজপ্রকৃতির নিয়মে। অবশ্য, বর্তমান যুগে ভৌতিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে এই বিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত সংঘটিত হইয়া থাকে। কিন্তু এই সব আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত তাহ ধীরে ধীরেই হইত। আর্যদের ভারতাগমন প্রাচীন কালের একটি বৃহৎ সামাজিক উপপ্লবের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যাইতে পারে। অনার্য অথবা আর্যপূর্ব সমাজবিন্যাস ছিল একরকম, তারপর আর্যেরা যখন তাহদের নিজেদের সমাজবিন্যাস লইয়া আসিলেন, তখন দুই আদর্শে একটা প্রচণ্ড সংঘাত নিশ্চয়ই লাগিয়াছিল। সেই সংঘাত ভারতবর্ষে চলিয়ছিল হাজার বৎসর ধরিয়া, এবং ধীরে ধীরে তাহার ফলে যে নূতন ভারতীয় সমাজবিন্যাস গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহাই পরবর্তী হিন্দুসমাজ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যখন লৌহধাতুর আবিষ্কার হইয়াছিল, তখনও এইরকমই একটা সামাজিক বিপ্লবের সূচনা হয়তো হইয়াছিল, কারণ এই আবিষ্কারের ফলে ধন-উৎপাদনের প্রণালী বদলাইয়া যাইবার কথা, এবং তাহার ফলে সমাজবিন্যাসও। কিন্তু এই পরিবর্তনও একদিনে হয় না। প্রাচীন বাঙলায় ঐতিহাসিক কালে— প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা আমি বলিব না, তাহার কারণ সে সম্বন্ধে স্পষ্ট করিয়া আমরা এখনও কিছুই জানি না— এমন কোনও সামাজিক উপপ্লব দেখা দেয় নাই। যুদ্ধবিগ্রহ যথেষ্ট হইয়াছে, ভিন্নদেশাগত রাজা ও রাজবংশ বহুদিন ধরিয়া বাঙলাদেশে রাজত্বও করিয়াছেন, মুষ্টিমেয় সৈন্য ও সাধারণ প্রাকৃতজন নানা বৃত্তি অবলম্বন করিয়া এদেশে নিজেদের রক্ত মিশাইয়া দিয়া বাঙালীর সঙ্গে এক হইয়াও গিয়াছেন, কিন্তু এইসব ঐতিহাসিক পরিবর্তন বিপ্লবের আকার ধারণ করিয়া সমাজের মূল ধরিয়া টানিয়া সমাজবিন্যাসের চেহারাটাকে একেবারে বদলাইয়া দিতে পারে নাই। অদল-বদল যে একেবারে হয় নাই তাহা নয়, কিন্তু যাহা হইয়াছে, তাহা খুব ধীরে ধীরে হইয়াছে, এখানে-সেখানে কোন কোন সমাজ-অঙ্গের রং ও রূপ একটু-আধটু বদলাইয়াছে, কোনও নুতন অঙ্গের যোজনা হইয়াছে, কিন্তু মোটামুটি কাঠামোটা একই থাকিয়া গিয়াছে। অদল-বদল যাহা হইয়াছে তাহা প্রাকৃতিক ও সমাজবিজ্ঞানের নিয়মের বশেই হইয়াছে। কাজেই, রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অজ্ঞাত যুগ সামাজিক ইতিহাসের দিক হইতে একেবারে অজ্ঞাত নাও হইতে পারে। পূর্বের এবং পরের সমাজবিন্যাসের ইতিহাস যদি জানা থাকে তাহা হইলে মাঝখানের ফাকটা কল্পনা ও অনুমান দিয়া ভরাট করিয়া লওয়া যাইতে পারে, এবং তাহা ঐতিহাসিক সত্যের পরিপন্থী না হওয়াই স্বাভাবিক | প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসেও একথা প্রযোজ্য।
কিন্তু সুবিধার কথা যদি বলিলাম, অসুবিধার কথাও বলি। আগেই বলিয়াছি জনসাধারণের ইতিহাস-রচনার যে সব উপাদান আমাদের আছে, তাহার অধিকাংশ রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠীর আশ্রয়ে রচিত। রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠী সম্বন্ধে যাহা জ্ঞাতব্য তাহার অনেকাংশ এইসব উপাদানের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর যে অগণিত জনসাধারণ তাহদের বা তাহাদের আশ্রয়ে রচিত কোনও উপাদানই আমরা পাই না কেন? যে বণিক-সম্প্রদায় দেশে-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতেন তাহারা মূখ বা নিরক্ষর ছিলেন না, এমন অনুমান সহজই করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি যতদিন ছিল ততদিন সমাজে তাহদের স্থান বেশ উপরেই ছিল, রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনায় তাহদের প্রভুত্বও কম ছিল না; একথা অনুমান-সাপেক্ষ নয়, তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে; তথাপি তাহদের কথা বিশেষভাবে কেহ বলে নাই। শিল্পী ও ক্ষেত্রকর-সম্প্রদায় সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। আর, চণ্ডাল পর্যন্ত যে অকীর্তিত জনসাধারণ তাহদের কথা না-ই বলিলাম। ইহারা তো নিরক্ষরই ছিলেন; সমাজে ইঁহাদের আধিপত্য বা অধিকার বলিয়া কিছু ছিল, এমন প্রমাণও নাই। কাজেই, ইঁহাদের সম্বন্ধে যে বিশেষ কিছু জানি না তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। কিন্তু কি শিল্পী-মানপ-ব্যাপার-বণিক, কি ক্ষেত্রকর, কি নিম্নতম সম্প্রদায়, ইহার রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠী দ্বারা কীর্তিত কিংবা কীর্তনযোগ্য বিবেচিত না হইলেও, ইঁহাদের সকলের দৈনন্দিন সুখদুঃখের, জীবনসমস্যার, নিজের বৃত্তি-সম্পৃক্ত নানা প্রশ্নের, এবং সাফল্য-অসাফল্যের প্রকাশ ও পরিচয় তদানীন্তন বাঙালী সমাজের মধ্যে কোথাও না কোথাও ছিলই। হয়তো সকল শ্রেণীর প্রকাশ ও পরিচয় সমভাবে একত্র কোথাও হইত না; হয়তো বিশেষ শ্রেণীর জীবনধারার প্রকাশ ও পরিচয় শ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যেই আবদ্ধ থাকিত। কিন্তু যেভাবেই তাহা হউক, তাহা কোথাও লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে নাই; সভাকবি, রাজপণ্ডিত, অভিজাতসমাজপুষ্ট কবি ও লেখক, বা ধর্মগোষ্ঠীর নেতাদের কাছে এইসব প্রকাশ ও পরিচয় লিপিযোগ্য বা গ্রন্থনযোগ্য মর্যাদা লাভ করিতে পারে নাই। স্মৃতি-ব্যবহার-পুরাণ গ্রন্থাদিতে পরোক্ষভাবে কিছু কিছু সংবাদ লিপিবদ্ধ হইয়াছে মাত্র, ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চতর বর্ণসমাজের সঙ্গে ইঁহাদের সম্বন্ধ নির্ণয়ের প্রসঙ্গে। তাহা ছাড়া, রাজসভা ও ধর্মগোষ্ঠী উভয়েরই লেখ্য ভাষা ছিল সংস্কৃত; অথচ, এই দেবভাষা যে প্রাকৃতজনের ভাষা ছিল তাহা তো সর্বজনস্বীকৃত; বাঙলার লিপিমালায়ও তাহার প্রমাণ বিক্ষিপ্ত। প্রাচীন বাঙলার প্রাকৃতজনের এই ভাষার বিশেষ কিছু পরিচয় আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই। স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়-কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং অধুনা সুপরিচিত চর্যাগীতিগুলির ভাষা হয়তো দশম-দ্বাদশ শতকের এই প্রাকৃত ভাষা, কিন্তু সন্ধ্যাভাষায় রচিত এই দোহা ও গানগুলিকে ঐতিহাসিক উপাদানরূপে পুরোপুরি গ্রহণ করা সর্বত্র সম্ভব নয়। ধর্মের ইতিহাসে অবশ্য এই পদগুলির বিশেষ মূল্য আছে। ডাক ও খনার বচনগুলিতেও কিছু কিছু ইতিহাসের উপাদান আছে। পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন যে, এই বচনগুলিতে সমাজের যে পরিচয় টুকরা টুকরা ভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহা নিঃসংশয়ে খ্ৰীষ্টীয় দশম অথবা একাদশ শতকের, কিন্তু ঐতিহাসিকের বিপদ এই যে, এই বচনগুলি বর্তমানে আমরা যে রূপে পাই, যে ভাষায় বর্তমানে ইহারা আমাদের হাতে আসিয়াছে, সে রূপ ও সে ভাষা এত প্রাচীন নয়। কাজেই মুখে মুখে প্রচলিত বচনগুলি পরবর্তী কালে ক্রমশ যখন লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তখন যে সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক যুগের সমাজের পরিচয় কিছু কিছু তাহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়ে নাই তাহার নিশ্চয়তা কি? শূন্যপুরাণ’, ‘গোপীচাদের গীত’, ‘সেখ শুভোদয়া, আদ্যের গম্ভীরা’, ‘মুর্শিদ্যা গান’, প্রাচীন রূপকথা ইত্যাদি সম্বন্ধেও এই সন্দেহ প্রযোজ্য, যদিও ইঁহাদের বিষয়বস্তু প্রাচীনতর কাল সম্পর্কিত। মধ্যযুগের আরো দুই-চারটি বাঙলা বই সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। আসল কথা হইতেছে, জনসাধারণ প্রাকৃতজনসুলভ ভাব ও ভাষায় তাহাদের দৈনন্দিন জীবনের যে-সব সুখ-দুঃখ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ জীবন-সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ করিত গানে-গল্পে-বচনে-গাথায়-রূপকথায়, তাহ কেহ লিখিয়া রাখে নাই; লোকের মুখে মুখেই তাহা গীত ও প্রচারিত হইয়াছে এবং বহুদিন পরে তাহ হয়তো লিপিবদ্ধ হইয়াছে যখন প্রাকৃতজনের ভাষা লেখা-মর্যাদা লাভ করিয়াছে। কিন্তু মুশকিল হইতেছে, এইসব প্রমাণ স্বসম্পূর্ণ স্বয়ংসিদ্ধ প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করিবার উপায় নাই, যতক্ষণ পর্যন্ত সমসাময়িক প্রমাণদ্বারা তাহা সমর্থিত না হয়।
পূর্বেই বলিয়াছি প্রাচীন লিপিমালা এবং কিছু কিছু ধর্ম ও সাহিত্য গ্রন্থই বাঙালীর ইতিহাসের উপাদান এবং ইঁহাদের সাক্ষ্যই প্রামাণিক। এই লিপিগুলি সমস্তই সমসাময়িক; স্মৃতি, পুরাণ, ব্যবহার এবং কাব্য-গ্রন্থগুলিও প্রায় তাহাই। কোথাও কোথাও কিছু কিছু পরবর্তী অথবা পূর্ববর্তী প্রামাণিক লিপি ও গ্রন্থের সহায়তা আমি গ্রহণ করিয়াছি, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সমসাময়িক প্রামাণিক সাক্ষ্যদ্বারা তাহা সমর্থিত না হইয়াছে ততক্ষণ আমার বক্তব্যের পক্ষে অনুমানের অধিক মূল্য কখনও আমি দাবি করি নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি বাঙলাদেশের সাক্ষ্যপ্রমাণই গ্রহণ করিয়াছি, তবে মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও কোনো সাক্ষ্য বা উক্তি সুস্পষ্ট করিবার জন্য প্রতিবেশী কামরূপ অথবা বিহার অথবা ওড়িশার সাক্ষ্য-প্রমাণও উল্লেখ করিয়াছি। সেগুলি প্রমাণ বলিয়া স্বীকৃত না হইলেও একথা অনুমান করিতে বাধা নাই যে, বাঙলাদেশেও হয়তো অনুরূপ রীতি প্রচলিত ছিল।
বাঙলাদেশের লিপিগুলি কালানুযায়ী সাজাইলে খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক দ্বিতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া তুর্কী বিজয়েরও প্রায় শতবর্ষ কাল পর পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায়। তবে খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক হইতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্তই ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়, এবং এই সাত-আট শত বৎসরের সামাজিক ইতিহাসের রূপই কতকটা স্পষ্ট হইয়া চোখের সম্মুখে ধরা দেয়। পঞ্চম শতকের আগে আমাদের জ্ঞান প্রায় অস্পষ্ট এবং অনেকটা অনুমানসিদ্ধ। লিপিগুলির সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারের আর-একটু বিপদও আছে। খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতকে উৎকীর্ণ দামোদরপুরে (পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি) প্রাপ্ত কোনও তাম্রপট্টে ভূমিব্যবস্থা অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে যে খবর পাওয়া যায় তাহা যে দশম অথবা একাদশ শতকে সমতলমণ্ডল অথবা খাড়িমণ্ডল, কিংবা পুণ্ডবর্ধনভূক্তির অন্য কোনও মণ্ডল বা বিষয় সম্বন্ধে সত্য হইবে, এমন মনে করিবার কোনও কারণ নাই। এমন-কি, সেই শতকেরই বাঙলার অন্য কোনও ভুক্তি অথবা বিষয় সম্বন্ধে সত্য হইবে, তাহাও বলা যায় না। কাজেই যে-কোনও লিপিবর্ণিত যে-কোনও অবস্থা সমগ্রভাবে বাঙলাদেশ সম্বন্ধে অথবা সমগ্র প্রাচীনকাল সম্বন্ধে প্রযোজ্য না-ও হইতে পারে। বস্তুত, দেখা যায়, একই সময়ে বাঙলার বিভিন্ন স্থানে একই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা, রীতি ও পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এইজন্যই সাক্ষ্যপ্রমাণ উল্লেখ করিবার সময় ইচ্ছা করিয়াই আমি লিপিবর্ণিত স্থান ও কালের উল্লেখ সর্বত্রই করিয়াছি; এবং সেই স্থান ও কালেই বর্ণিত বিষয় প্রযোজ্য, এইরূপ ইঙ্গিত করিয়াছি। তারপর বিশেষ কোনও নিয়ম বা পদ্ধতি কতটুকু অন্য কাল ও অন্য স্থান সম্বন্ধে প্রযোজ্য, কী পরিমাণে সমগ্র বাঙলাদেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য তাহা লইয়া পাঠক অনুমান যদি করিতে চান তাহাতে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কিছু নাই।
৪. এই গ্রন্থের যুক্তিপর্যায়
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
চতুর্থ পরিচ্ছেদ । এই গ্রন্থের যুক্তিপর্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা
সমাজবিন্যাসের ইতিহাস বলিতে হইলে প্রথমেই বলিতে হয় নরতত্ত্ব ও জনতত্ত্বের কথা এবং তাহারই সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিজড়িত ভাষাতত্ত্বের কথা। সেইজন্য বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা বাঙালীর নরতত্ত্বের কথা, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর ভাষার কথা, বাঙালীর জন, ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্পষ্ট উষাকালের কথা। বাঙালীর আর্যত্ব কতখানি? পণ্ডিতেরা আর্যভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর যে একাধিক তরঙ্গের কথা বলেন, যদি তাহা সত্য হয়, তাহা হইলে সেই আর্যত্ন কি ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীদের না পামীর মালভূমি ও তবলামাকান মরুভূমি হইতে আগত আলপাইন আর্যভাষীদের নর্ডিক না প্রাচ্য আর্যভাষীদের, না আর কাহারও? আর্যপূর্ব জনদের কাহারা বাঙলাদেশের অধিবাসী ছিলেন; এই আর্যপূর্ব বাঙালীদের মধ্যে নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, বা ভূমধ্যীয় নরগোষ্ঠীর আভাস কতটুকু দেখা যায়, কোথায় কোথায় দেখা যায়? মোঙ্গোলীয় ও ভোট-চীন নরগোষ্ঠীর কিছু আভাস বাঙালীর রক্তে, বাঙালীর দেহগঠনে আছে কি? থাকিলে কতটুকু এবং বাঙলার কোন কোন জায়গায়? আর্য ও আর্যপূর্ব জাতিদের রক্ত ও দেহগঠন বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠনে কতটুকু, কী পরিমাণে সহায়তা করিয়াছে? ঐতিহাসিক কালে ভারতবর্ষের বাহিরের ও ভিতরের অন্যান্য প্রদেশের কোন কোন নরগোষ্ঠীর লোক বাঙলাদেশে আসিয়াছে এবং বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠন কতখানি রূপান্তরিত করিয়াছে? বাঙলাদেশে যে বর্ণবিভাগ দেখা যায় তাহার সঙ্গে নরতত্ত্বের সম্বন্ধ কতটুকু?
ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ইত্যাদি বর্ণের লোকেরা কোন নরগোষ্ঠী? সমাজে জলচল ক্ষুদ্রবর্ণের লোকেরা কোন নরগোষ্ঠী? জল-অচল নিম্ন বা অন্ত্যজ পর্যায়ের যে অসংখ্য লোক তাহারাই বা কোন নরগোষ্ঠী? রজক, নাপিত, কর্মকার, সূত্রধর ইত্যাদিরাই বা কে? সব প্রশ্নের উত্তর বাঙলার নরতত্ত্ব-গবেষণার বর্তমান অবস্থায় পাওয়া যাইবে না; তবু, যতটুকু নির্ধারিত হইয়াছে তাহারই বলে মোটামুটি একটা কাঠামো গড়িয়া তোলা যাইতে পারে। বাঙালীর জন-গঠনের এই গোড়াকার কথাটা না জানিলে প্রাচীন বাঙলার শ্রেণী ও বর্ণ বিভাগ, রাষ্ট্রের স্বরূপ, এক কথায় সমাজের সম্পূর্ণ চেহারাটা ধরা পড়িবে না।
তৃতীয় অধ্যায় : দেশ-পরিচয়
বাঙালীর ইতিহাসের দ্বিতীয় কথা, বাঙলার দেশ-পরিচয়। বাঙলাদেশের নদ-নদী পাহাড়প্রান্তর বনজনপদ আশ্রয় করিয়া ঐতিহাসিক কালের পূর্বেই যে সমস্ত বিভিন্ন কোম একসঙ্গে দানা বাধিয়া উঠিতেছিল তাহদের বন্ধনসূত্র ছিল পূর্বভারতের ভাগীরথী-করতোয়া লৌহিত্য-বিধৌত বিন্ধ্য-হিমালয়-বাহুবিধৃত ভূভাগ। এই সুবিস্তীর্ণ ভূভাগের জল ও বায়ু এই দেশের অধিবাসীদিগকে গড়িয়াছে; ইহার ভূমির উর্বরতা কৃষিকে ধনোৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপায় করিয়া রচনা করিয়াছে; ইহার অসংখ্য মৎস্যবহুল নদনদী, তাহাদের শাখা ও উপনদীগুলি অন্তর্বাণিজ্যের সাহায্য করিয়া ধনোৎপাদনের আর একটি উপায় সহজ ও সুগম করিয়াছে। ইহার সমুদ্রোপকূল শুধু যে বহির্বাণিজ্যের সাহায্য করিয়াছে, তাহাই নয়, দেশের কোনও কোনও উৎপন্ন দ্রব্যের স্বরূপও নির্ণয় করিয়াছে। তাহা ছাড়া, এই দেশের প্রাচীন যে রাষ্ট্র ও জনপদ-বিভাগ তাহাও কিছুটা নিণীত হইয়াছে বাঙলার নদ-নদীগুলির দ্বারা। বাঙলার এই নদ-নদীগুলি, এই বন ও প্রান্তর, ইহার জলবায়ুর উষ্ণ জলীয়তা, ইহার ঋতু-পর্যায়, ইহার বিধৌত নিম্নভূমিগুলি, বনময় সমুদ্রোপকূল সমস্তই এই দেশের সমাজবিন্যাসকে কমবেশি প্রভাবান্বিত করিয়াছে। কাজেই বাঙলাদেশের সত্য ভৌগোলিক পরিচয়ও বাঙালীর ইতিহাসেরই কথা।
চতুর্থ অধ্যায় : ধনসম্বল
জাতি এবং দেশ হইতেছে সমাজ-রচনার ঐতিহ্য ও পরিবেশ। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, সমাজ-সৌধের বস্তুভিত্তি হইতেছে ধন। কাজেই প্রাচীন বাঙলার ধনসম্বল কী ছিল, ধনোৎপাদনের কী কী উপায় ছিল, কী কী ছিল উৎপন্ন বস্তু, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি কিরূপ ছিল এইসব তথ্য বাঙালীর ইতিহাসের তৃতীয় কথা। এই তিন কথা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের বস্তুভিত্তি এবং এই ভিত্তির উপরই গড়িয়া উঠিয়াছিল প্রাচীন বাঙালীর সমাজবিন্যাস।
পঞ্চম অধ্যায়; ভূমিবিন্যাস
এইমাত্র বলিলাম, প্রাচীন বাঙলায় কৃষি ছিল ধনোৎপাদনের অন্যতম প্রথম ও প্রধান উপায়। কৃষির সঙ্গে দেশের ভূমিব্যবস্থা জড়িত। এই ভূমিব্যবস্থার উপরই দেশের অগণিত জনসাধারণের মরণ বাচন নির্ভর করিত, এখনও যেমন করে। ভূমি কয় প্রকার ছিল, ভূমির উপর রাজার অধিকারের স্বরূপ কী ছিল, প্রজার অধিকারই বা কতটুকু ছিল, ভূমির মূলগ্রাহী কে ছিলেন, ভূমিদানের প্রেরণা কী ছিল, ভূমির সীমানা নির্দেশের ৬ায়ক ছিল। রাজস্ব কিরূপ ছিল, প্রজার দায়িত্ব কী ছিল, খাসপ্রজা, নিম্নপ্রজা, ভূমিহীন প্রজা ইত্যাদি ছিল কিনা, এক কথায় ভূমিব্যবস্থার কথা বাঙালীর ইতিহাসের পঞ্চম এবং সমাজবিন্যাসের প্রথম কথা। –
ষষ্ঠ অধ্যায় : বর্ণবিন্যাস
খাচীন ও বর্তমান বাঙলার সমাজবিন্যাসের দিকে তাকাইলে যে জিনিস সর্বপ্রথম দৃষ্টিগোচর হয় তাহা বর্ণ-উপবর্ণের নানা স্তর-উপস্তরে বিভক্ত সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত বাঙালীর বর্ণসমাজ। পাওলাদেশে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নাই, প্রাচীনকালেও ছিল বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট প্রমাণ নাই; আল্পসংখ্যক থাকিলেও তাহদের কোনও প্রাধান্য ছিল বলিয়া মনে হয় না। ইহার কারণ কী? বাহ্মণদের প্রাধান্য বাঙলাদেশে কিভাবে কখন প্রতিষ্ঠিত হইল ঃ বৈদ্য-কায়স্থ বৃত্তিধারী লোকেরাই লা কী করিয়া কখন বর্ণশুদ্ধ হইলেন? এবং ব্রাহ্মণদের পরেই তাহদের স্থান নিণীত হইল কিরূপে? অন্যান্য সংকর পর্যায়ের বিচিত্র জাতের এবং ম্লেচ্ছ পতিত-অন্ত্যজ পর্যায়ের যে সব লোকদের কথা প্রাচীন লেখমালায় ও সাহিত্যগ্রন্থাদিতে পাওয়া যায় তাহাদের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ কিরূপ, প্রত্যেকের স্বরূপ কী, বৃত্তি কী, দায় কী, অধিকার কী ছিল? বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধ কিরূপ ছিল, রাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের স্থান কিরূপ ছিল, রাজবংশের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে লণবিন্যাসের সম্বন্ধ কী ছিল ইত্যাদি সকল কথাই বাঙালীর ইতিহাসের কথা। এই কথা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসে ষষ্ঠ অধ্যায়।
সপ্তম অধ্যায় : শ্রেণীবিন্যাস
আগে যে বাঙলার জনসাধারণের কথা বলিয়াছি তাহারা সকলেই তো কিছু কৃষক বা ক্ষেত্রকর ছিলেন না। এখনকার মতো তখনও বৃহৎ একটা চাকুরিজীবী সম্প্রদায়ও ছিল। ইঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন রাজকর্মচারী। তাহা ছাড়া, ছোট ছোট মানপ বা দোকানদার হইতে আরম্ভ করিয়া বড় বড় বণিক, শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, ব্যাপার ইত্যাদির সংখ্যাও কম ছিল না। কৃষক বা ক্ষেত্রকররা তো ছিলেনই। তাহা ছাড়া, অধ্যাপনা, দেবপূজা, পৌরোহিত্য, নীতিপাঠ, ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা প্রভৃতি নানা বৃত্তি লইয়া ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণেরও স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি ছিলেন। সকলের শেষে সমাজের নিম্নতম বর্ণস্তর শ্রেণীতে চণ্ডাল পর্যন্ত অন্যান্য অকীর্তিত লোকও ছিলেন অগণিত। প্রাচীন বাঙালী সমাজ এইসব নানা শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিল। এইসব বিভিন্ন শ্রেণীর বৃত্তি, তাহদের পরস্পর সম্বন্ধ, তাহদের দায় ও অধিকার ইত্যাদি সম্বন্ধে যে স্বল্প কথা জানা যায় তাহা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়।
অষ্টম অধ্যায় : গ্রাম ও নগরবিন্যাস
বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর অগণিত জনসাধারণ বাস করিতেন হয় গ্রামে না হয় নগরে ৷ এখনকার মতো তখনও বোধ হয় বর্তমান কালাপেক্ষাও অধিকসংখ্যক লোক গ্রামেই বাস করিতেন। জনসাধারণ বলিতে তখন প্রধানত এই অগণিত গ্রামবাসীদেরই বুঝাইত, এমন মনে করা অযৌক্তিক নয়। এক-একটা গ্রাম কী করিয়া গড়িয়া উঠিত তাহার দুই-একটি প্রমাণ পাওয়া যায়। গামের সংস্থান কিরূপ ছিল, নগরের সংস্থান কিরূপ ছিল? ইঁহাদের বিশেষ বিশেষ রূপ কী ছিল? গ্রাম ও নগর এই দুয়ের সভ্যতার পার্থক্য কিরূপ ছিল? ধর্ম ও শিক্ষা-কেন্দ্র বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির চেহারা কিরূপ ছিল? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলিবে না; তবু যতটুকু জানা যায় ততটুকু জানাই প্রাচীন বাঙলাদেশ ও বাঙালীকে জানা। এই জানার চেষ্টায় বাঙালীর ইতিহাসের অষ্টম
নবম অধ্যায় : রাষ্ট্রবিন্যাস
এই যে বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ণের বিচিত্র জনসাধারণ, ইঁহাদের দৈনন্দিন জীবনের যে বিচিত্র কর্ম, বিচিত্র দায় ও অধিকার, তাহা ইহারা নির্বিবাদে পরস্পরের স্বার্থের সংঘাত বাঁচাইয়া নির্বাহ করিতেন কী করিয়া? ক্ষেত্রকর যে হলচালনা করিতে গিয়া নিজের জমির সীমা ডিঙাইয়া প্রতিবেশীর জমি লোভ করবেন না, তাহা দেখিবে কে যে বণিক পুণ্ড অথবা চম্পাপুরী-পাটলিপুত্র হইতে গোরুর গাড়ির লহরে অথবা নদীপথে সপ্তডিঙ্গায় পণ্য সাজাইয়া চলিয়াছেন তাম্রলিপ্তি, পথে দসু তাঁহাকে হত্যা করিয়া পণ্য লুটিয়া লইবে না, এই আশ্বাস তাহাকে দিবে কে? প্রত্যেকে স্বধর্মে ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া আপন আপন রুচি ও কর্তব্যানুযায়ী জীবন যাপন করিয়া যাইতে পারবেন, এই আশ্বাস সমাজ দিতে না পারিলে সমাজবিন্যাস সম্ভব হইতে পারে না। এই আশ্বাস দিবার, প্রত্যেককে স্বধর্মে ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত রাখিবার যন্ত্রও হইতেছে রাষ্ট্র। ভিতর ও বাহিরের হাত হইতে দেশ ও রাজ্যকে রক্ষা করিবার যন্ত্রও এই রাষ্ট্র। সমাজ নিজের প্রয়োজনেই এই রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান পরিচালককে রাজা বা প্রধান বা নায়ক বলিয়া স্বীকার করে, তাহার ও র্তাহার রাজপুরুষদের এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ম-নির্দেশ মানিয়া চলে, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার ব্যয়ভার নির্বাহ করে, রাজাকে শ্রদ্ধাদান করে, এবং তাহার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বপ্রকার বাধ্যতা স্বীকার করে। ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্ব বর্ণিত রাজধর্ম, অষ্টাদশ শতাব্দীর যুরোপের সামাজিক শর্তের মূল সূত্র। প্রাচীন বাঙলায় এই রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বরূপ কী ছিল? রাষ্ট্রপ্রধান কাহারা ছিলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা কাহারা করিতেন। রাষ্ট্রের আয়ব্যয় কী ছিল? রাজস্ব কী কী ছিল, কিরূপ ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্ণ ও শ্রেণীর সম্বন্ধ কী ছিল, গ্রাম ও নগরগুলির সম্বন্ধ কী ছিল, ধনোৎপাদনে ও বন্টনে রাষ্ট্রের আধিপত্য কতটুকু ছিল? রাষ্ট্রের আদর্শ বিভিন্ন কালে কিরূপ ছিল? রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক সংস্কৃতির যোগ কিরূপ ছিল? এইসব বিচিত্র প্রশ্নের যথালভ্য উত্তর লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের নবম অধ্যায়।
দশম অধ্যায় : রাজবৃত্ত
ধনসম্বল, ভূমিবিন্যাস, বর্ণবিন্যাস, শ্রেণীবিন্যাস, গ্রাম ও নগর-বিন্যাস, রাষ্ট্রবিন্যাস প্রভৃতি সবকিছুর সঙ্গে দেশের ইতিবৃত্তকথা, অর্থাৎ বিভিন্ন পৰ্ব-বিভাগের কথা, রাষ্ট্ৰীয় উত্থান-পতনের কথা, রাজা ও রাজবংশের পরিচয, রাষ্ট্ৰীয় আদর্শের পরিণতি, বিগ্রহ ও বিপ্লব, শান্তি ও সংগ্রাম প্রভৃতির বিবরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজবিন্যাস ও রাষ্ট্রীয় ইতিবৃত্ত একে অন্যকে প্রভাবান্বিত করে, এবং দুইয়ে মিলিয়া ইতিহাসচক্রকে আরর্তিত করে। সেইজন্যই সমাজবিন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসাবে এবং অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসাবে রাজবৃত্ত কথা অবশ্য জ্ঞাতব্য– রাজা এবং রাজবংশের স্থল ও বিস্তৃত বিবরণ হিসাবে নয়, সমাজের সঙ্গে ইঁহাদের এবং বিভিন্ন রাজপর্ব ও রাষ্ট্রাদর্শের সম্বন্ধের দিক হইতে। সেইজন্যই রাজবৃত্তকথা লইয়া এই ইতিহাসের অন্যতম সুদীর্ঘ অধ্যায়।
সর্বশেষে আসিতেছে প্রাচীন বাঙালীর মানস-সংস্কৃতির কথা। সংস্কৃতির প্রয়োজন কী? মানুষ তো শুধু খাইয়া পরিয়া দেহগত জীবনধারণ করিয়া বাচিয়া থাকে না। তাহার একটা মানসগত জীবনও আছে। এই মানসগত জীবন সকল মানুষের সমান নয়। যে শ্রেণী অথবা সমাজের সামাজিক ধনসম্বল যত বেশি সেই শ্রেণী ও সমাজের মানসজীবন তত উন্নত। এই মানসজীবনের প্রকাশই সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি সকল শ্রেণী ও বর্ণের লোকদের এক নয়, এক হইতে পারে না। সংস্কৃতির মূলে আছে কায়িক শ্রম হইতে অবসর; যে শ্রেণী ও বর্ণের সামাজিক ধনসঞ্চয় বা উদকৃত্ত ধন বেশি তাহারাই সেই ধনের বলে এই শ্রেণী ও বর্ণের এবং অন্য শ্রেণী ও অন্য বর্ণের কতকগুলি লোককে ধনোৎপাদনগত কায়িক শ্রম হইতে মুক্তি দিয়া অবসরের সুযোগ দিতে পারে। সেই সুযোগে তাহারা চিন্তা, অধ্যয়ন, শিল্পচর্চা ইত্যাদি করিতে পারেন, এবং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত, নিজস্ব ও বৃহত্তর সমাজগত মানসের চিন্তা, কল্পনা, ভাব ও অনুভাবকে রূপদান করিতে পারেন। প্রাচীন বাঙলায়ও তাঁহাই হইয়াছিল; ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। যাহাই হউক, প্রাচীন বাঙলায় সংস্কৃতির রূপ আমরা দেখিতে পাই ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে, শিল্পকলায় ও নৃত্যগীতে, জ্ঞানবিজ্ঞানে, ব্যবহারিক অনুশাসন সামাজিক অনুশাসন ইত্যাদিতে। এই সংস্কৃতির অর্ধেক পুরাতন ঐতিহ্যজাত; এই ঐতিহ্যের মধ্যে থাকে জনগত, বর্ণগত রক্তের স্মৃতি, পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির স্মৃতি; বাকি অর্ধেক সমসাময়িক সমাজবিন্যাসের প্রয়োজনে গড়িয়া উঠে। কাজেই অতীতের স্মৃতি ও বর্তমানের প্রয়োজন, এই দুই বস্তুই বিশেষ দেশ ও বিশেষ কালের সংস্কৃতির মধ্যে জড়াজড়ি করিয়া মিশাইয়া থাকে। প্রাচীন বাঙলায় এই সংস্কৃতির স্বরূপটি কী, সত্যকার চেহারাটা কী তাহা জানিবার প্রয়াস লইয়াই আমার বাঙালীর ইতিহাসের শেষ কয়েকটি অধ্যায়। সুস্পষ্ট স্বরূপ হয়তো জানা যাইবে না, জানিবার যথেষ্ট উপাদানও এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয় নাই; তবু চেষ্টা করিতে দোষ নাই, মোটামুটি আভাস একটু পাওয়া যাইবে তো! তাহা ছাড়া, মানস-সংস্কৃতি প্রকাশ পায় নরনারীর দৈনন্দিন জীবনচর্যার ভিতর দিয়া, তাহদের আহার-বিহারে, বসন-বাসনে, আচার-ব্যবহারে। জনসাধারণের জীবনেতিহাস জানিতে হইলে এ সমস্ত বিষয়েরও আলোচনা অপরিহার্য।
একাদশ অধ্যায় : আহার-বিহার, বসন-বাসন, আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন জীবন
জনসাধারণের মানস-সংস্কৃতির পরিচয় শুধু ধর্মকর্ম, শিল্পকলা, সাহিত্য-বিজ্ঞানের মধ্যেই আবদ্ধ হইয়া থাকে না। শিথিলভাবে বলিতে গেলে, ইহারা মানস-সংস্কৃতির পোশাকী দিক : কিন্তু সংস্কৃতির আর-একটা আটপৌরে দিক আছে, এবং সেই দিকটাতেই জনসাধারণের জীবনচর্যার ঘনিষ্ঠতম পরিচয়। আহার-বিহার, বসন-বাসন, আমোদ-আহ্লাদ, দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখ, উৎসব-আচার-ব্যবহার প্রভৃতির মধ্যে এই পরিচয় যেমন পাওয়া যায় এমন আর কোথাও নয়। দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে দিকটা লইয়া জনসাধারণের জীবনেতিহাসের অন্যতম প্রধান, অপরিহার্য এবং অবশ্য জ্ঞাতব্য একাদশ অধ্যায়।
দ্বাদশ অধ্যায় : ধর্মকর্ম
প্রাচীন বাঙালীর মানস-সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান পরিচয় তাহদের ধর্মকর্মে। বিচিত্র ধর্মসংস্কার, বিশ্বাস, পূজা, আচার-অনুষ্ঠান, বারো মাসে তেরো পার্বণ, অসংখ্য দেবদেবী ও অন্যান্য প্রতীক লইয়াই প্রাচীন বাঙালীর জীবন; তাহার দৈনন্দিন জীবনও এইসব লইয়াই একই সঙ্গে মধুর ও দায়িত্বময়। তাহার প্রাগৈতিহাসিক কৌম বিশ্বাস, সংস্কার, পূজা, আচার, অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপর উত্তরকালে ক্রমে ক্রমে জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য প্রভৃতি আর্যধর্মের নানাপ্রকার তান্ত্রিক আচার, পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রভাব পড়িয়া যে ধর্মবিশ্বাস কর্মানুষ্ঠান প্রভৃতি বিবর্তিত হইয়াছে, তাহার সঙ্গে উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের পার্থক্য প্রচুর। সমাজবিন্যাসের উপরও এইসব বিশ্বাস-অনুষ্ঠানের প্রভাব কম পড়ে নাই। বিশেষ বিশেষ বর্ণ ও শ্রেণীতে বিশেষ বিশেষ দেবদেবীর, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসের প্রচারের মধ্যেও সমসাময়িক সমাজবিন্যাসের পরিচয় সুস্পষ্ট। ধর্মকর্মের বিবর্তন-ইতিহাসের ভিতর দিয়াও গইন জনসাধারণের জীবনের এবং সমাজবিন্যাসের ইতিহাস উজ্জ্বলতর হয়। সেইজন্য ধর্মকর্মের কথা লইয়া প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের দ্বাদশ অধ্যায়।
ত্রয়োদশ অধ্যায় : শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞান-সাহিত্য
ধর্মকর্ম শিল্পকলার মতো সমাজমানসের অভিব্যক্তি দেখা যায় সমসাময়িক সাহিত্যে, জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষায়। প্রাচীন বাঙলায় ইহাদেরও প্রধান আশ্রয় ধর্মকর্ম, ধর্মবিশ্বাস, সমাজ-সংস্কার ইত্যাদি। এইসব সমস্তই মানসোৎকর্ষের বা অপকর্যের, এক কথায় সংস্কৃতির লক্ষণ সন্দেহ নাই। ইহাদের কতক অংশ গড়িয়া উঠিয়ছিল দৈনন্দিন জীবনচর্যার এবং বৃহত্তম সমাজচর্যার বা অন্য ব্যবহারিক প্রয়োজনে, কতক একান্তই সৃষ্টির প্রেরণায়, বুদ্ধিগত, ভাবকল্পনাগত, চিস্তাগত, অভিজ্ঞতাগত মানসের আত্মপ্রকাশের যে স্বাভাবিক বৃত্তি তাহারই প্রেরণায়। এই আত্মপ্রকাশের রূপ ও রীতি বহুলাংশে সমাজবিন্যাস দ্বারা নিয়মিত হইয়া থাকে। আবার, সমাজবিন্যাসও ইঁহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এই উভয়ের ঘাতপ্রতিঘাতেই যে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি যুগে যুগে বিবর্তিত হইতে থাকে, এ তত্ত্ব বর্তমান সমাজতত্ত্বাদর্শে ও আলোচনায় স্বীকৃত। সেইজন্যই প্রাচীন বাঙলার ইতিহাসে ধর্মকর্ম-শিল্পকলার মতো শিক্ষাদীক্ষা-সাহিত্য-বিজ্ঞানের আলোচনাও সমসাময়িক সমাজবিন্যাস ও সমাজমানসের পরিচয় হিসাবেই বেশি, বিশুদ্ধ সাহিত্য বা বিজ্ঞান-মূল্যের দিক হইতে ততটা নয়। এই শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞান-সাহিত্য লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের ত্রয়োদশ অধ্যায়।
চতুর্দশ অধ্যায় : শিল্পকলা
এই ধর্মকর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত প্রাচীন বাঙলার শিল্পকলা, নৃত্যগীত ইত্যাদি। শিল্পই হউক আর নৃত্যগীতই হউক, ইঁহাদের প্রথম ও প্রধান আশ্রয় ছিল ধর্মকর্ম, ধর্মকর্মানুষ্ঠান উপলক্ষেই নৃত্যগীতের প্রচলন হইয়াছিল বেশি; মূর্তি ও মন্দির ইত্যাদি তো একান্তভাবেই ধর্মাশ্রয়ী। রাজপ্রাসাদ অভিজাত বংশীয়দের বাসগুহ ইত্যাদি ইট-কাঠ নির্মিত হইত সন্দেহ নাই; চিত্রে, মূর্তিতে গৃহ সজ্জিত হইত; কিন্তু কাল, প্রকৃতি ও মানুষের ধ্বংসলীলার হাত এড়াইয়া আজ আর তাহাদের চিহ্ন বর্তমান নাই; যে দুই-চারিটি চিহ্ন বহু আয়াসে আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই ধর্মকর্মশ্রিত। শিল্পকলা-নৃত্যগীতের দিক হইতে ইহাদের যাহা বিশুদ্ধ শিল্পমূল্য বা সংস্কৃতিমূল্য তাহা তো আছেই। ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে প্রাচীন বাঙলার শিল্পকলার একটি বিশেষ স্থানও আছে। কিন্তু বাঙালীর ইতিহাসে তাহার আলোচনার মূল্য সমাজমানসের দিক হইতেই বেশি; এবং তাহাই মুখ্য। এই শিল্পকলা-নৃত্যগীতের মধ্যে প্রাচীন বাঙালীর মন, তাঁহাদের সমাজবিন্যাস, পরিবেশ সম্বন্ধে তাঁহাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কিভাবে প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাই আমাদের প্রধান আলোচ্য | এই আলোচনা লইয়া আমাদের ইতিহাসের চতুর্দশ অধ্যায়।
পঞ্চদশ অধ্যায় : ইতিহাসের ইঙ্গিত
ইতিহাস শুধু তথ্যমাত্র নয়। যে তথ্য কথা বলে না, কার্যকারণ-সম্বন্ধের ইঙ্গিত বহন করে না, যাহার কোনও ব্যঞ্জনা নাই, শুধুই বিচ্ছিন্ন তথ্য মাত্র, যে তথ্য কোনও যুক্তিসূত্রে গ্রথিত নয়, ইতিহাসে তাহার কোনও মূল্য নাই। সমস্ত তথ্যের পশ্চাতে কার্যকারণ-পরম্পরার অমোঘ নিয়ম সর্বদা সক্রিয়। এই নিয়মটি ধরিতে পারা, দেশকালধূত নরনারীর গতি-পরিণতির প্রকৃতিটি ধরিতে পারা, সমাজের প্রবহমান ধারাস্রোতের পশ্চাতের ইঙ্গিতটি জানাই ঐতিহাসিকের কর্তব্য। কার্যকারণপরম্পরায়, যুক্তিশৃঙ্খলায় তথ্যসন্নিবেশ করিয়া যাইতে পারিলে তবেই সেই অমোঘ নিয়মটি, ইঙ্গিত ও প্রকৃতিটি জানা যায়। প্রাণহীন, নীরব, নীরস তথ্য তখন সজীব, মুখর ও সরস হইয়া উঠে। আমার তথ্যসন্নিবেশের মধ্যে ইতিহাসের সেই সজীব মুখরতা পরিস্ফুট হইবে কিনা জানি না; তবু সকল তথ্যের পশ্চাতে বাঙালীর আদি ইতিহাসের গতি-প্রকৃতির একটি সমগ্র ইঙ্গিত আমি মনন-কল্পনার মধ্যে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। সে ইঙ্গিত আলোচ্য অধ্যায়গুলির স্থানে স্থানে পাওয়া যাইবে, বিশেষভাবে পাওয়া যাইবে রাজবৃত্ত অধ্যায়ে। তবু, সর্বশেষ অধ্যায়ে ইতিহাসের ইঙ্গিতটি একটি অখণ্ড অথচ সংক্ষিপ্ত সমগ্রতায় উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি।
৫. নিবেদন
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
পঞ্চম পরিচ্ছেদ । নিবেদন
আমি কোনও নূতন শিলালিপি বা তাম্রপট্টের সন্ধান পাই নাই, কোনও প্রাচীন গ্রন্থের খবর নূতন করিয়া জানি নাই, কোনও নূতন উপাদান আবিষ্কার করি নাই। যে-সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থ বা লেখমালা সংকলিত ও সম্পাদিত হইয়াছে, অথবা সংকলন-সম্পাদনের অপেক্ষা করিতেছে নানা গ্রন্থাগার ও চিত্রশালায়, যে-সমস্ত তথ্য ও উপাদান পণ্ডিতমহলে অল্পবিস্তর পরিচিত ও আলোচিত, প্রায় তাহা হইতেই আমি সমস্ত তথ্য ও উপকরণ আহরণ করিয়াছি। কাজেই পূর্ববর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গবেষকদের সকলের কাছেই আমি ঋণী, বিশেষভাবে ঋণী এই অধ্যায়ের প্রথমেই যে সব মনীষীদের নামোল্লেখ করিয়াছি তাঁহাদের কাছে। এই ঋণ সগৌরবে ঘোষণা করিতে এতটুকু দ্বিধা আমার নাই। ইঁহারা যে কোনও দেশের গৌরব, এবং ইঁহাদেরই অকুণ্ঠ অবারিত দানের ঘোষণা এই গ্রন্থের পত্রে পত্রে ছত্ৰে ছত্রে। এই সমস্ত পূর্বাবিষ্কৃত উপাদান ও পূর্বসূরিদের রচনা আমার সম্মুখে বর্তমান না থাকিলে এই প্রয়াস অসম্ভব হইত। আমি শুধু প্রাচীন বাঙলার ও প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাস একটি নূতন কার্যকারণসম্বন্ধগত যুক্তিপরম্পরায় একটি নূতন দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়া বাঙালী পাঠকের কাছে উপস্থিত করিতেছি মাত্র। এই যুক্তিপারম্পর্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক যুক্তি ও দৃষ্টি বলিয়া আধুনিক ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, আমিও করি। আমার বিশ্বাস, এই যুক্তি ও দৃষ্টি অনুসরণ করিলে প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের যে সামগ্রিক গলতোভদ্র রূপ দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা অন্য উপায়ে সম্ভব নয়।
তাহা ছাড়া, এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া আমি প্রাচীন বাঙলা ও বাঙালীর সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনার প্রয়াসও করিতেছি না। সে সময় হয়তো এখনও আসে নাই। নূতন নূতন উপাদান প্রায়শ আবিষ্কৃত হইতেছে। বর্তমানে উপাদান সুপ্রচুর নয়, উপাদনলব্ধ সংবাদও অল্পতর। আমি শুধু কাঠামো রচনার প্রয়াস করিয়াছি, ভবিষ্যৎ বাঙালী ঐতিহাসিকরা ইহাতে রক্তমাংস যোজনা করবেন, এই আশা ও বিশ্বাসে। আরও একটু আশা এই যে, এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া বর্তমান সমাজ-বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তাঁহারা বাঙলার মধ্য ও উত্তর-পর্বের ইতিহাসও রচনা করিয়া তুলিবেন। সুযোগ ও অবসর ঘটিলে নিজের উপরও সে কর্তব্য পালনের দায়িত্ব রহিল, তাহা অস্বীকার করিতেছি না।
আমার কোনও কথাই শেষ কথা নয়। সত্যসন্ধী ঐতিহাসিকের কাছে শেষ কথা কিছু নাই; তাঁহার সব কথাই experiments with truth মাত্র। এই কাঠামো রচনার প্রয়াস সত্যে পৌঁছিবার নিম্নতম স্তর : এই স্তর যদি ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিককে সত্যে পৌঁছিতে কিছুমাত্র সহায়তা করে, তবেই আমার দেশের এবং আমার জাতির এই ইতিহাস-রচনা সার্থক বলিয়া মনে করিব |
০২. ইতিহাসের গোড়ার কথা
১. জনতত্ত্বের ভূমিকা
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
প্রথম পরিচ্ছেদ – জনতত্ত্বের ভূমিকা
জনতত্ত্বের ভূমিকা
একদা রবীন্দ্রনাথ ভারততীর্থকে অগণিত জাতির মিলনক্ষেত্র কল্পনা করিয়া বলিয়াছিলেন,
কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা,
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
ভারততীর্থের অন্যতম প্রান্তিক দেশ বঙ্গভূমি সম্বন্ধেও এ কথা সমান প্রযোজ্য। গঙ্গা-করতোয়া-লৌহিত্যবিধৌত, সাগর-পর্বতষ্কৃত, রাঢ়-পুণ্ড-বঙ্গ-সমতট এই চতুর্জনপদসম্বদ্ধ বাঙলাদেশে প্রাচীনতম কাল হইতে আরম্ভ করিয়া তুকী অভু্যদয় পর্যন্ত কত বিভিন্ন জন, কত বিচিত্র রক্ত ও সংস্কৃতির ধারা বহন করিয়া আনিয়াছে, এবং একে একে ধীরে কোথায় কে কীভাবে বিলীন হইয়া গিয়াছে ইতিহাস তাহার সঠিক হিসাব রাখে নাই। সজাগ চিত্তের ও ক্রিয়াশীল মননের রচিত কোনও ইতিহাসে তাহার হিসাব নাই এ কথা সত্য, কিন্তু মানুষ তাহার রক্ত ও দেহগঠনে, ভাষায় ও সভ্যতার বাস্তব উপাদানে এবং মানসিক সংস্কৃতিতে তাহা গোপন করিতে পারে নাই। সকলের উপর এই বিচিত্র রক্ত ও সংস্কৃতির ধারা তাহার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রাখিয়া গিয়াছে বাঙালীর প্রাচীন সমাজবিন্যাসের মধ্যে রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসে সে ইঙ্গিত কিছুতেই ধরা পড়িবার কথা নয়।
বাঙলাদেশে আজ জনতত্ত্ব-গবেষণার মাত্র শৈশবাবস্থা। এ কথা অবশ্য সকলেই জানেন, বাঙালী এক সংকর জন(১), কিন্তু কথাটা ঐখানেই শেষ হইয়া যায় না, বরং ঐখানেই কথার আরও । অথচ, কী কী মূল উপাদানের জৈব সমন্বয়ের ফলে বাঙালী আজ এক সংকর জনে পরিণত হইয়াছে, এ কথা কমবেশি নিশ্চয় করিয়া বলিবার মতন যথেষ্ট উপকরণ দেশের সর্বত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত থাকিলেও নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি সেদিকে আজ পর্যন্ত বিশেষ আকৃষ্ট হয় নাই । কেন হয় নাই তাহার কারণ কষ্টবোধ্য না হইলেও এখানে তাহার আলোচনা অবান্তর । বাঙালীর জনতত্ত্ব-নিরূপণ শুধু নৃতাত্ত্বিকের কাজ নয় ; তাহার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকের জ্ঞান ও দৃষ্টির একত্র মিলন না হইলে বাঙালীর জনরহস্য উন্মোচন করা প্রায় অসম্ভব বলিলেই চলে। যে জন যত বেশি সংকর সে জনের ক্ষেত্রে এ কথা তত বেশি প্রযোজ্য ।
বাঙালীর জনতত্ত্ব নিরূপণের একতম এবং প্রধানতম উপায় বাঙলাদেশের আচণ্ডাল সমস্ত বর্ণের এবং সমস্ত শ্রেণীর জনসাধারণের, বিশেষভাবে প্রত্যন্তশায়ী জনপদবাসীদের সকলের রক্ত ও দেহগঠনের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ, এক কথায় নরতত্ত্বের পরিচয় । আমাদের দেশের নৃতত্ত্ব গবেষণায় রক্তবিশ্লেষণ এখনও সাধারণভাবে পণ্ডিতদের দৃষ্টির পরিধির মধ্যে ধরা দেয় নাই । দুই-একজন একটু-আধটু পরীক্ষা আরম্ভ করিয়াছেন মাত্র। দেহগঠনের বিশ্লেষণেরও এ পর্যন্ত যাহা স্বীকৃত ও অনুসৃত হইয়াছে তাহা শুধু নরমুণ্ড, নরকপাল ও নাসিকার পরিমিতি ও পরস্পর অনুপাত, এবং চুল, চোখ ও চামড়ার রং আশ্রয় করিয়া। যুরোপে, বিশেষ করিয়া জার্মানী ও অস্ট্রিয়ায়, গায়ের চামড়ার উপাদানবৈশিষ্ট্য, কেশমূল, কেশবৈশিষ্ট্য, নখবৈশিষ্ট্য, হাত ও পায়ের তালু প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা গুণ ও বৈশিষ্ট্য লইয়া যে সব আলোচনা হইয়াছে আমাদের দেশের নরতত্ত্ব গবেষণায় আজ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদেও তাহা অল্পই স্থান পাইয়াছে। নরমুণ্ড, কপাল ও নাসিকার পরিমিতি ও পরস্পর অনুপাত বিশ্লেষণ যাহা হইয়াছে তাহাও যথেষ্ট নয়। বহুদিন আগে রিজলি সাহেব বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানের জনসাধারণের কিয়দংশের পরিমিতি গণনা করিয়াছিলেন ; আজ পর্যন্ত নৃতত্ত্ববিদেরা সাধারণত সেই গণনার উপরই নির্ভর করিয়া আসিয়াছেন । সাম্প্রতিক কালে ফন আইকস্টেডট্র, জে এইচ. হাটন বিরজাশংকর গুহ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, রমাপ্রসাদ চন্দ, শরৎচন্দ্র রায়, হারাণচন্দ্র চাকলাদার, মীনন্দ্রনাথ বসু, তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত কিছু কিছু নূতন পরিমিতি গ্রহণ করিয়াছেন, কিন্তু লোকসংখ্যার অনুপাতে তাহা খুবই অল্প, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তাহা ছাড়া, যে সব নিদর্শন আহরণ ইহারা করিয়াছেন, সর্বত্র সেগুলির প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করা যায় না, অর্থাৎ সমাজের সকল বর্ণ ও শ্রেণী-স্তরের ও দেশের সকল স্থানের জনসাধারণের মধ্য হইতে নিদর্শন নির্বাচন সর্বত্র যথার্থ ও যথেষ্ট হইয়াছে ; বর্ণ, শ্রেণী ও স্থানের ইতিপরম্পরাগত মূল্য স্বীকৃত হইয়াছে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। তাহা ছাড়া, পরিমিতিগণনায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যে ব্যক্তিগত ভুল থাকার সম্ভাবনা, তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তবু, যতটুকু হইয়াছে, যেভাবে হইয়াছে তাহা হইতে কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এবং বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতি-বিকাশের ইতিহাসের সাহায্যে সেই ইঙ্গিতগুলি ফুটাইয়া তোলা হয়তো অসম্ভব নয়।
বাঙালীর জনতত্ত্ব নিরূপণের কিছুটা সহায়ক উপায়, বাঙলা ভাষার বিশ্লেষণ। অবশ্য এ কথা সত্য যে ভাষাবিশ্লেষণের সাহায্যে নরতত্ত্ব ঠিক নির্ণয় করা চলে না ; কারণ মানুষ নানা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অথবা ধর্মগত কারণে ভাষা বদলায় ; এক জন অন্য জনের ভাষা গ্রহণ করে এবং সেই ভাষাই দুই-তিন পুরুষ পরে নিজেদের জাতীয় ভাষায় পরিণতি লাভ করে ; ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। কাজেই ভাষার উপর নির্ভর করিয়া নরতত্ত্ব নির্ণয়ের চেষ্টা স্বভাবতই অযৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পস্থার বিরোধী। তবে জননির্ণয়ে ভাষা-বিশ্লেষণ যে অন্যতম সহায়ক এ কথাও একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় না। কোনও জনের ভাষা বিশ্লেষণ করিয়া যদি দেখা যায় সেই ভাষার জীবনচর্যার মূল শব্দগুলি কিংবা পদরচনারীতি কিংবা পদভঙ্গি অথবা মানুষ ও স্থান ইত্যাদির নাম অন্য কোনও জনের ভাষা হইতে গৃহীত বা উদ্ভূত, তখন স্বভাবতই এ অনুমান করা চলে যে, সেই পূর্বোক্ত জনের সঙ্গে শেষোক্ত জনের রক্তে সংমিশ্রণ না হোক, মেলামেশা ঘটিয়াছে। এই মেলামেশা নানা সামাজিক ও অন্যান্য কারণে সমাজ-কাঠামোর সকল স্তরে নাও হইতে পারে, যে যে স্তরে হইয়াছে সেখানেও সর্বত্র সমভাবে হইয়াছে এ কথাও বলা যায় না। যাহাই হউক, ভাষাবিশ্লেষণের ইঙ্গিত নরগোষ্ঠী নির্ধারণে না হউক, জন-নিরূপণে অনেকখানি সাহায্য করিতে পারে ; আর সেই ইঙ্গিতের মধ্যে যদি নরতত্ত্ব-বিশ্লেষণলব্ধ ইঙ্গিতের সমর্থন পাওয়া যায়, তাহা হইলে পূরক সাক্ষ্য হিসাবে জনতত্ত্ব নির্ণয়ের কাজেও লাগিতে পারে।
বাঙলাদেশ ও বাঙলার সংলগ্ন প্রত্যন্ত দেশগুলির ভাষার বিশ্লেষণ অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। আচার্য গ্রিয়ার্সন হইতে আরম্ভ করিয়া সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় পর্যন্ত কয়েকজন খ্যাতনামা পণ্ডিত বাঙলা ভাষার জন্ম ও জীবনকথা নিরূপণ করিতে সার্থক প্রয়াস করিয়াছেন। ফরাসী পণ্ডিত জ্যাঁ পশিলুস্কি, জুল ব্লখ ও সিলভ্যাঁ লেভি এবং তাঁহাদের অনুসরণ করিয়া সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় আর্যপূর্ব ও দ্রাবিড়পূর্ব ভারতীয় ভাষা ও জন সম্বন্ধে যে মূল্যবান গবেষণার সূত্রপাত করিয়া দিয়াছেন, তাহাও প্রাচীন বাংলার ভাষা ও জন সম্বন্ধে নূতন আলোকপাত করিয়াছে, এবং তাহার ফলে বাঙলার জন-নিরূপণ-সমস্যা সহজতর হইয়াছে ।
বাঙালীর জনতত্ত্ব নিরূপণের অন্যতম সহায়ক উপায়, প্রাচীন ও বর্তমান বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতির বিশ্লেষণ। যেমন ভাষায় তেমনই বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতিতেও বিভিন্ন জনের সংমিশ্রণের ইতিহাস লুক্কায়িত থাকে। প্রত্যেক জনের ভিতর এই দুই বস্তু একটা রূপ গ্রহণ করে, এবং নানা উপায় ও উপকরণ, রীতি ও অনুষ্ঠান, আদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়া তাহা আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে। কালচক্রে আবর্তে সেই জন যখন অন্য জনের দ্বারা পরাভূত অথবা মিত্র বা শক্ররূপে পরস্পরের সম্মুখীন হয়, একের সঙ্গে অন্যের আদান-প্রদান ঘটে তখন কোনও জনই নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে অন্যের প্রভাব হইতে মুক্ত রাখিতে পারে না। ব্যক্তির জীবনে সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মে যাহা ঘটে জনের জীবনেও তাঁহাই। অবশ্য, অধিকতর পরাক্রান্ত ও বীর্যবান যে জন সে প্রভাবান্বিত বেশি করে, নিজে প্রভাবান্বিত হয় কম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্তরে এই নৈকট্যের ফলে কমবেশি আদান-প্রদান চলিতেই থাকে এবং একটা সমন্বয়ও সঙ্গে সঙ্গে চলিতে থাকে। জীবধর্মের নিয়মই এইরূপ । আঘাত হইলেই প্রত্যাঘাতও অনিবার্য এবং দুইয়ে মিলিয়া একটা সমন্বিত গতিও সমান অনিবার্য। বাঙলাদেশে প্রাচীনকালে, এবং কতকটা বর্তমানেও, যে সমন্বিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি রূপ দেখিতে পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করিলে বিভিন্ন জনের বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতির কিছু কিছু পরিচয় সহজেই ধরা পড়ে, এবং ভাষা ও নৃতত্ত্ব বিশ্লেষণের সাহায্যে তাহা হইতে জন-নির্ণয়ের কাজটাও কিছুটা সহজ হয়। এ কথা অবশ্যই সত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণ একক কখনোই জননির্দেশক হইতে পারে না। কিন্তু তাহা যে ইঙ্গিত দেয়, ভাষা ও নৃতত্ত্বের ইঙ্গিতের সঙ্গে তাহা যোগ করিলে জনতত্ত্বের স্বরূপ তাহাতে অল্পবিস্তর ধরা পড়িতে বাধ্য।
এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের কাজ আমাদের দেশে খুব যে অগ্রসর হইয়াছে তাহা বলা যায় না । সংস্কৃতি, বিশেষভাবে ধর্ম ও মূর্তিতত্ত্ব এবং আচার-অনুষ্ঠানের বিশ্লেষণ কিছু কিছু যদি বা হইয়াছে, বাস্তব সভ্যতার বিশ্লেষণ একেবারেই হয় নাই। এক্ষেত্রে ভাষা-বিশ্লেষণের সাহায্য অপরিহার্য। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ যাহা হইয়াছে তাহার মধ্যে সমাজের উচ্চ ও নিম্নস্তরের লোকাচার ও লোকধর্ম অল্পই স্থান পাইয়াছে এবং পুরাণানুমোদিত ধর্মের স্থানও যথেষ্ট হয় নাই ; অথচ জনতত্ত্বের অনেক নিশানা ঐ গুহাগুলির মধ্যে নিহিত । এই সমস্ত উপায় ও উপকরণ সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য জানিবার উপায় নাই এবং জন ও ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে সব প্রশ্ন এই উপলক্ষে মনকে অধিকার করা সম্ভব, তাহার সবকিছুর উত্তর পাওয়া যাইবে, তাহাও বলা যায় না। তবে মোটামুটি কাঠামোটা ধরা পড়িতে পারে, এই আশা করা যায়। বাঙালীর ইতিহাসের জন্য বাঙলাদেশের নরতত্ত্ব ও তৎসংলগ্ন অন্যান্য সমস্যা সম্বন্ধে যে সব আলোচনা-গবেষণা ইত্যাদি হইয়াছে তাহার বিশদ ও বিস্তারিত পরিচয় ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন এখানে কিছু নাই। এই আলোচনা ও গবেষণার মোটামুটি ফলাফল একত্র করিতে পারিলে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের ফলাফলের সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে পারিলেই ইতিহাসের প্রয়োজন মিটিতে পারে।
ভারতবর্ষে বায়ানা নামক স্থানে প্রস্তরীভূত নরমুণ্ডের কঙ্কাল, দক্ষিণ ভারতে আদিত্যনল্পরে প্রাপ্ত কতকগুলি মুণ্ড-কঙ্কাল, মহেন-জো-দড়ো ও হরপ্পায় প্রাপ্ত কতকগুলি নরকঙ্কাল এবং তক্ষশিলার ধর্মরাজিক বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত কয়েকটি বৌদ্ধভিক্ষুর দেহাবশেষ ভারতীয় নরতত্ত্বজিজ্ঞাসার মীমাংসায় যে পরিমাণে সাহায্য করিয়াছে, বাঙলাদেশের জননির্ণয়ে তেমন সাহায্য পাইবার উপায় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। বস্তুত, এ যাবৎ বাঙলাদেশের কোথাও প্রাগৈতিহাসিক বা ঐতিহাসিক কোনও যুগেরই কোনও নরকঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় নাই। প্রাগৈতিহাসিক লৌহ অথবা প্রস্তর-যুগের বিশেষ কোনও বাস্তবাবশেষও বাঙলাদেশে এ পর্যন্ত এমন কিছু পাওয়া যায় নাই যাহার ফলে সেই যুগের সভ্যতা এবং সেই সূত্রে নরতত্ত্বনির্ণয়ের ইঙ্গিত কতকটা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যাহা আমাদের নাই তাহা লইয়া দুঃখ করিয়াও লাভ নাই। যতটুকু যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা লইয়াই একটা হিসাব-নিকাশ আপাতত করা যাইতে পারে।
——————
(১) এই নিবন্ধে জন সাধারণত ইংরাজী ‘people’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে , caste বুঝাইতে ‘বর্ণ’ ও বাংলা চলতি ‘জাত’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। ইংরাজি ‘race’ ও ‘people’ এই দুইটি শব্দ লইয়া নানাপ্রকার বিভ্রমের সৃষ্টি ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুর্লভ নয় ।
২. বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
বাঙলার বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর জনসাধারণের দেহগঠনের, বিশেষভাবে কেশবৈশিষ্ট্য, চোখ ও চামড়ার রং, নাসিকা, কপাল ও নরমুণ্ডের আকৃতি ইত্যাদির পরিমিতি গ্রহণ করিয়া এ পর্যন্ত যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা সংক্ষেপে জানিয়া লওয়া যাইতে পারে। সকলের পরিমিতি একই মানদণ্ড অনুসারে গৃহীত হয় নাই; পণ্ডিতদের মধ্যে পরিমিতি গণনার যে বিভিন্নতা দেখা যায় ইহা তাহার অন্যতম কারণ। তবে, মোটামুটি বৈশিষ্ট্যগুলি ধরিতে পারা খুব কঠিন নয়। সর্বত্রই প্রধান প্রধান ধারার কথাই উল্লেখ করা সম্ভব; উপধারাগুলির ইঙ্গিতমাত্র দেওয়া চলে। অথচ প্রধান প্রধান ধারার সঙ্গে উপধারা মিলিয়া এক হইয়াই বাঙালীর জন-সাংকর্যের সৃষ্টি হইয়াছে, এ কথা ভুলিলে চলিবে না।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ একটি উপপুরাণ; ইহার তারিখ আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক; তুর্কি-বিজয়ের অব্যবহিত পরেই রাঢ়দেশে ইহা রচিত হইয়াছিল এমন অনুমান করিলে খুব অন্যায় হয় না। ব্রাহ্মণ-বর্ণ বাদ দিয়া সমসাময়িক বাঙলাদেশের জনসাধারণ যে ছত্রিশটি জাত-এ বিভক্ত ছিল, তাহার একটু পরিচয় এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। গ্রন্থটির রচয়িতা ব্রাহ্মণেতর শূদ্রবর্ণের লোকদিগকে তদানীন্তন বর্ণবিভাগানুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন :
১. উত্তম সংকর বিভাগ : করণ (সৎশূদ্র), অম্বষ্ঠ (বৈদ্য), উগ্র, মাগধ, গান্ধিক, বণিক, শান্থিক, কংসকার, কুম্ভকার, তন্তুবায়, কর্মকার, গোপ, দাস (চাষী), রাজপুত্র, নাপিত, মোদক, বারজীবী, সূত (সূত্রধর), মালাকর, তামুলী ও তৌলিক। (২০)
২. মধ্যম সংকর বিভাগ : তক্ষণ, রজক, স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর, তৈলকারক, ধীবর, শোণ্ডিক, নট, শাবাক (শাবার), শেখর ও জালিক। (১২)
৩. অন্ত্যজ বা অধম সংকর (বর্ণাশ্রম-বহিস্কৃত) : মলেগ্রহী, কুড়ব, চণ্ডাল, বরুড়, চর্মকার, ঘণ্টজীবী বা ঘট্টজীবী, ডোলাবাহী, মল্ল ও তক্ষ। (৯)
ইহা ছাড়া তিনি অবাঙালী ও বৈদেশিক ম্লেচ্ছ কয়েকটি কোমের নামও করিয়াছেন স্বতন্ত্র বিভাগের অধীনে, যথা, দেবল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ, গণক-গ্রহবিপ্ৰ, বাদক, পুলিন্দ, পুককশ, খশ, যবন, সুহ্ম, কম্বোজ, শবর, খর ইত্যাদি। উপরের তালিকা হইতে দেখা যাইবে, বৃহদ্ধর্মপুরাণ যদিও বলিতেছেন ছত্রিশটি জাত বা বর্ণ-উপবর্ণের কথা, নাম করিবার সময় করিতেছেন একচল্লিশটির। পাচটি যে পরবর্তী কালের যোজনা, এ অনুমান সেই হেতু অসংগত নয়। এখনও আমরা ছত্রিশ জাত-এর কথাই তো প্রসঙ্গত বলিয়া থাকি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডও খুব সম্ভব বাঙলাদেশের রচনা এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণের প্রায় সমসাময়িক। এই পুরাণেও সমসাময়িক বাঙলার বিভিন্ন জাত-এর একটা অনুরূপ তালিকা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেরই বর্ণবিন্যাস অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যাইবে; এখানে বর্তমান প্রয়োজনে সে তালিকার আর কোনও প্রয়োজন নাই।
বর্ণ ও জনের দিক হইতে এই বিভাগ যে কৃত্রিম এ কথা অনস্বীকার্য, তাহা ছাড়া বর্ণ তো কিছুতেই জন-নির্দেশক হইতে পারে না। আর, একটু মনোযোগ করিলেই দেখা যাইবে, ইহার প্রথম দুইটি বিভাগ ব্যবসায়-কর্মগত এবং তৃতীয় ও চতুর্থ বিভাগ দুইটি কতকটা জনগত। প্রথম বিভাগটি জলচল ও দ্বিতীয় বিভাগটি জল-অচল বর্ণের বলিয়া অনুমেয়; কাজেই কি কর্মবিভাগ কি জনবিভাগ, কোনও দিক হইতেই ইহার মধ্যে ঐতিহাসিক যুক্তি হয়তো মিলিবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, স্বর্ণকার ও স্বর্ণবণিক কেনই বা মধ্যম সংকর, আর গন্ধবণিক ও কংসবণিক কেনই বা উত্তম সংকর, অথবা তৈলকার কেনই বা মধ্যম সংকর। বস্তুত, বর্ণবিভাগ যেখানে ব্যবসায়-কর্মগত সেখানে প্রত্যেক বর্ণের মধ্যেই বিভিন্ন জনের বর্ণ আত্মগোপন করিয়া থাকিবেই; এই বর্ণগুলি সেইজন্যই সংকর এবং স্মৃতি ও পুরাণে বারবার যে বর্ণসংকর ও জাতিসংকরের কথা বলা হইয়াছে ইহার ইঙ্গিত ইতিহাস ও নরতত্ত্বের দিক হইতে নিরর্থক ও অযৌক্তিক নয়। রাহ্মণবর্ণের মধ্যে সাংকর্যের কথা যে বলা হয় নাই তাহার কারণ হয়তো এই যে, এইসব পুরাণ ও স্মৃতি প্রায়শ তাহাদেরই রচনা; অথচ নরতত্ত্বের দিক হইতে দেখা যাইবে এই জাতিসাংকর্য অম্বষ্ঠ ও করণদের সম্বন্ধে যতখানি সত্য ঠিক ততখানি সত্য ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধেও। নরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই কথাটা ভালো করিয়া ধরা পড়িবে এবং তখন দেখা যাইবে, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকেরা যে পরিমাণে সংকর, বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম এবং মধ্যমে সংকর বিভাগের অধিকাংশ বর্ণই সেই পরিমাণে এবং প্রায় একই বৈশিষ্ট্যে সংকর।
বাঙালী ব্রাহ্মণদের দেহদৈর্ঘ্যও মধ্যমাকৃতি; মুণ্ডের আকৃতিও মাধ্যমিক (mesocephalic), অর্থাৎ গোলও নয়, দীর্ঘও নয়; নাসিকা তীক্ষ্ণ ও উন্নত। বিরজাশংকর গুহ মহাশয় রাঢ়ীয় বাহ্মণদের যে পরিমিতি গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতে এই বৈশিষ্ট্যগুলি ধরা পড়িয়ছিল। কিন্তু, সাম্প্রতিক কালে যাহারা এই বর্ণের মুণ্ডাকৃতি বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহারা মনে করেন যে, উত্তর বা দক্ষিণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র বা বৈদিক—সকল পর্যায়ের ব্রাহ্মণদের মধ্যেই গোল মাথার (brachycephalic) একটা সুস্পষ্ট ধারা একেবারে অস্বীকার করা য়ায় না; কায়স্থদের মধ্যেও তাহাই সঙ্গে সঙ্গে এই তিন পর্যায়ের ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার চ্যাপটা বিস্তৃত নাসার (platyrhine) একটা অস্পষ্ট ধারাচিহ্নও অনস্বীকার্য, যদিও গোল এবং মধ্যমাকৃতির মুণ্ড ও উন্নত সুগঠিত নাসাই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই বিশ্লেষণের পরেও এ কথা বলা প্রয়োজন যে, ব্রাহ্মণদের মধ্যে দীর্ঘ মস্তিষ্কাকৃতি(dococephaic) স্বল্প হইলেও একটা অনুপাত ধরা পড়ে। এ কথা সাধারণভাবে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিমিতিবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও সত্য; কারণ, আগেই বলিয়াছি, প্রধান ধারার উল্লেখই সম্ভব, উপধারাগুলির ইঙ্গিত দেওয়া যায় মাত্র।
ব্রাহ্মণদের দেহগঠন সম্বন্ধে আমরা যাহা জানি, বাঙালী কায়স্থদের দেহবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও তাহা সত্য। বস্তুত, মুণ্ড ও নাসাকৃতির দিক হইতে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের মোটামুটি কোনও পার্থক্যই নৃতত্ত্ববিদের চোখে ধরা পড়ে না; নরতত্ত্বের দিক হইতে ইহারা সকলেই একই নরগোষ্ঠী। রাহ্মণদের মতো ইহারাও মধ্যমাকৃতি, ইহাদেরও চুলের রং কালো, চোখের মণি মোটামুটি পাতলা হইতে ঘন বাদামী যাহা সাধারণ দৃষ্টিতে কালো বলিয়াই মনে হয়। গায়ের রং পাতলা বাদামী হইতে আরম্ভ করিয়া পাতলা গৌর। কাহারও কাহারও মতে রাঢ়ীয় কায়স্থদের মধ্যে দীর্ঘ অনুন্নত করোটির প্রাধান্য দেখা যায়, মূধ্যমাকৃতির বৈশিষ্ট সেখানে কম। কিন্তু এই কমবেশি যেহেতু মানদণ্ডনির্ভর এবং যেহেতু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানদণ্ড ব্যবহার করিয়া পরিমিতি গ্রহণ করা হইয়াছে, সেই হেতু শেষোক্ত মত সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না।
বাহ্মণেতর অন্যান্য যে সমস্ত জাতির দেহবৈশিষ্ট্য-পরিমিতি গ্রহণ করা হইয়াছে, তাঁহাদের মধ্যে কায়স্থ, গোয়ালা, কৈবর্ত, পোদ, বাগদী, বাউরী, চণ্ডাল, মালো, মালী, মুচি, রাজবংশী, সদগোপ, বুনা, বাঁশফোঁড়, কেওড়া, যুগী, সাঁওতাল, নমঃশূদ্র, ভূমিজ, লোহার মাঝি (বেদে), তেলি, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, ময়রা, কলু, তত্ত্ববায়, মাহিষ্য, তাম্লী, নাপিত এবং রজকই প্রধান। ইহা ছাড়া যশোহর ও খুলনা অঞ্চলের নলুয়া (মুসলমান) এবং পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের কিছু কিছু পরিমিতিও গণনা করা হইয়াছে। কিন্তু সমস্ত জাত-এরই পরিমিতি-গণনা সমসংখ্যায় হইয়াছে এবং দেশের সর্বত্র সমভাবে বিস্তৃত হইয়াছে, এ কথা বলা যায় না। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও পাদদের পরিমিতি গণনা করিয়াছেন বিরজাশংকর গুহ মহাশয়। পশ্চিম বাঙলার কয়েকটি জেলার সাঁওতাল, ভূমিজ, বাউর, বাগদী, লোহার মাঝি, তেলি, সুবর্ণ ও গন্ধ-বণিক, ময়রা, কলু, তন্তুবায়, মাহিষ্য, তামলী, নাপিত, রজক ইত্যাদি গণনা করিয়াছেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়; পারেন্দ ব্রাহ্মণদের পরিমিতি লইয়াছেন তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং হারাণচন্দ্র চাকলাদার লইয়াছেন কলিকাতার ব্রাহ্মণ ও বীরভূমের মুচিদের। রিজলি গণনা করিয়াছেন সদগোপ, রাজবংশী, মুচি, মালী, মালো, কৈবর্ত, গোয়ালা, চণ্ডাল, বাউরী, বাগদী এবং পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের, কিন্তু অমুসলমান নিদর্শনগুলি কোথা হইতে আহৃত তাহা বলেন নাই। মীনেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় গণনা করিয়াছেন উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বাঙলার আটটি জেলার, বুনা, নলুয়া (মুসলমান), বাঁশফোঁড়, মুচি, রাজবংশী, মালো (এই দুই বর্ণেরই ব্যবসা মাছ ধরা ও মাছ বিক্রি), কেওড়া ও যুগীদের। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদগোপ, কৈবর্ত, রাজবংশী, পোদ এবং বাগদীদের পরিমিতি গণনা করিয়াছেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। মোটামুটিভাবে এইসব বর্ণ ও শ্রেণীগুলির মধ্যে বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজ—এই বিভাগ তিনটির প্রতিনিধিদের অনেকেরই সন্ধান মিলিবে। নমঃশূদ্রবর্ণের যে অসংখ্য জনসাধারণ মধ্য ও বর্তমান যুগের একটি বলিষ্ঠ বর্ণ ও শ্রেণী-স্তর তাহাদের দেহগঠনের পরিমিতি যাহারা গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে হাটন ও রিজলির নাম করিতেই হয়।
ইঁহাদের সকলের সম্মিলিত বিশ্লেষণ হইতে দেহগঠন, চোখ ও চামড়ার রং, কেশ-বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্বন্ধে কতকগুলি তথ্য সহজেই ধরা পড়ে। ইহাদের মধ্যে সর্বাগ্রে নমঃশূদ্রদের কথা বলিতেই হয়, কারণ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকদের সঙ্গে নরতত্ত্বের দিক হইতে ইহাদের কোনও পার্থক্য নাই এ কথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়। উচ্চবর্ণের লোকদের মতো ইহারাও দৈর্ঘ্যে মধ্যমাকৃতি, মুণ্ডের গঠন মাধ্যমিক, এবং নাসা তীক্ষ্ণ ও উন্নত; ইহাদের চোখ ও চামড়ার রঙও মোটামুটিভাবে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থদেরই মতো, অথচ স্মৃতিশাসিত হিন্দুসমাজে ইহাদের স্থান এত নিচে যে নরতত্ত্বের পরিমিতি-গণনার মধ্যে তাহার কোনও যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। সে যুক্তি হয়তো পাওয়া যাইবে জাত-সংঘর্ষের ইতিহাসের মধ্যে অথবা রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে।
ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ও নমঃশূদ্রদের ছাড়া আর যে সব বর্ণের উল্লেখ আগে করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে গান্ধিক বণিক, সদগোপ ও গোয়ালা (গোপ), কৈবর্ত (চাষী ও মাহিষ্য), নাপিত, ময়রা (মোদক), বারুই (বারজীবী অর্থাৎ পানের বরজ যাহার উপজীবিকা), তামূলী (তাম্বুলী-যে পান বিক্রয় করে) এবং যুগী (তন্তুবায়) নিঃসন্দেহেই বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম সংকর পর্যায়ভুক্ত, এবং কলু বা তেলি (তৈলকারক), রজক, সুবর্ণবণিক এবং মালী মধ্যম সংকর পর্যায়ভুক্ত। চণ্ডাল বা চাঁড়াল, মুচি (চর্মকার), দুলিয়া (ডোলাবাহী), মালো, কেওড়া, মল্ল, ধীবর, প্রভৃতি অন্ত্যজ পর্যায়ের।
এইগুলি ছাড়া আরও কয়েকটি জাতের লোকদের সম্বন্ধে এবং উল্লিখিত জাতগুলি সম্বন্ধেও অতিরিক্ত কিছু কিছু পরিমিতি-গণনা বিভিন্ন নৃতত্ত্ববিদেরা করিয়াছেন। এইসব নরতত্ত্বগত পরিমিতি-গণনায় যাহা পাওয়া যায় তাহা বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, উচ্চবর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ-বর্ণের বাঙালী দেহ-দৈর্ঘ্যের দিক হইতে মধ্যমাকৃতি; নমঃশূদ্রেরাও তাহাই। উত্তম সংকর বিভাগের বাঙালীও সাধারণত মধ্যমাকৃতি, কিন্তু খর্বতার দিকেও একটা ঝোঁক খুব স্পষ্ট। মালী ছাড়া মধ্যম সংকর বর্ণের লোকেরাও তদনুরূপ; মালীরা খর্বাকৃতি। অন্ত্যজ পর্যায়ের বা বর্তমানের তথাকথিত অস্পৃশ্য জাতের লোকেরা সাধারণত খর্বাকৃতি; কিন্তু ইহাদের মধ্যেও কোনও কোনও জাত স্পষ্টতই মধ্যমাকৃতি এবং অনেক জাতের মধ্যেই মধ্যমাকৃতির দিকে ঝোঁক কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। মুণ্ডাকৃতির দিক হইতে দেখিতে গেলে, সাধারণ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চবর্ণ এবং নমঃশূদ্ররা যেমন গোলাকৃতি, উত্তম সংকর পর্যায়ের অধিকাংশ বর্ণ তেমনই। আবার কোনও কোনও নিম্ন উপবর্ণের মধ্যে, যেমন পশ্চিম বাঙলার ভূমিজ ও সাঁওতালদের মধ্যে গোলের দিকেও একটু ঝোঁক উপস্থিত। এই ধরনের ঝোঁক, অবশ্য কিছু কিছু অন্য বর্ণের মধ্যেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। তেমনই আবার কতকগুলি বর্ণের মধ্যে দৈর্ঘ্যের দিকে ঝোঁক অত্যন্ত স্পষ্ট, যেমন মাহিষ্য, নাপিত, ময়রা, সুবর্ণবণিক, মুচি, বুনা, বাগদী, বেদে, পশ্চিম বঙ্গের মুসলমান প্রভৃতিদের মধ্যে। কতগুলি বর্ণ তো স্পষ্টতই দীর্ঘমুণ্ডাকৃতি, যেমন উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গের নাসাকৃতির দিক হইতে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ও নমঃশূদ্র বর্ণের লোকেরা সকলেই সাধারণত তীক্ষ্ণ ও উন্নতনাসা। সুবর্ণবণিকদের মধ্যে তীক্ষ্ণ ও উন্নত নাসা হইতে চ্যাপটা পর্যন্ত সব ধারাই সমভাবে বিদ্যমান; পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যেও তাহাই। ময়রাদের নাসাকৃতি মধ্যম কিন্তু তীক্ষ্ণতার দিকে ঝোঁক স্পষ্ট। উত্তম ও মধ্যম সংকর পর্যায়ের, এমন-কি অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ পর্যায়ের অধিকাংশ বর্ণেরই নাসাকৃতি মধ্যম, তবে কোনও কোনও বর্ণের কোমদের মধ্যে, যেমন গন্ধবণিক, নাপিত, তেলি, কলু, মালো প্রভৃতির চ্যাপটার দিকেঝোঁক সহজেই ধরা পড়ে। আবার কতগুলি বর্ণের নাসাকৃতি একেবারেই চ্যাপটা, যেমন, বেদে ভূমিজ, বাগদী, বাউর, তামলী, তন্তুবায়, রজক, মালী, মুচি, বাশফেড়, মাহিষ্য প্রভৃতি। সাঁওতালদের নাসিকাকৃতিও চ্যাপটা, কিন্তু মধ্যমাকৃতির দিকে ঝোঁক আছে।
কয়েকটি ধারণা এইবার মোটামুটি কিছুটা স্পষ্ট হইল। সাধারণভাবে বলা যায়, বাঙালীর চুল। কালো, চোখের মণি পাতলা হইতে ঘন বাদামী, বা কালো, গায়ের রং সাধারণত পাতলা হইতে ঘন বাদামী, নিম্নতম শ্রেণীতে চিকণ ঘনশ্যাম পর্যন্ত দেহ-দৈর্ঘ্যের দিক হইতে বাঙালী মধ্যমাকৃতি, খর্বতার দিকে বোকও অস্বীকার করা যায় না। বাঙালীর মুণ্ডাকৃতি সাধারণত দীর্ঘ উচ্চবর্ণস্তরে গোলের দিকে বেশি ঝোঁক। নাসাকৃতিও মোটামুটি মধ্যম, যদিও তীক্ষ্ণ ও উন্নত নাসাকৃতি উচ্চতর বর্ণের লোকদের ভিতর সচরাচর সুলভ।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর উচ্চ ও নিম্নজাতের এবং বাঙালী মুসলমানদের কিছু কিছু রক্তবিশ্লেষণ কোথাও কোথাও হইয়াছে। মিসেস ম্যাকফারলেন, রবীন্দ্রনাথ বসু, মীনেন্দ্রনাথ বসু, শশাঙ্কশেখর সরকার, অনিল চৌধুরী, মাখনলাল চক্রবর্তী প্রভৃতি কয়েকজন তাঁহাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করিয়াছেন। ইঁহাদের সম্মিলিত গবেষণার ফল মোটামুটি বাঙালীর জন-সাংকর্যের ইঙ্গিত সমর্থন করে। ডক্টর ম্যাকফারলেনের মতে, বর্ণ, বর্ণেতর ও অস্পৃশ্য বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে যে রক্তবৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যেও তাঁহাই। বাঙালী মুসলমানেরা যে বাঙালী হিন্দুদেরই সমগোত্রীয় ইহা তাহার আর একটি প্রমাণ।
কিন্তু এতক্ষণ বাঙালী জাতির দেহ-গঠনের যে সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হইল, তাহা আসিল কোথা হইতে? এ প্রশ্নের উত্তর পাইতে হইলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতবর্ষে যে সব জন ছিল ও পরে যে সব জন একের পর এক এদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছে, প্রবহমান রক্তস্রোতে নিজেদের রক্ত মিশাইয়াছে, মৈত্রী ও বিরোধের মধ্য দিয়া একে অন্যের নিকটতর হইয়াছে, তাঁহাদের হিসাব লইতে হয়। কিন্তু তাহা করিবার আগে একটি সুপ্রচলিত মতবাদ সম্বন্ধে একটু বিচারের অবতারণা করা প্রয়োজন। এই মতটি নরতাত্ত্বিক হার্বার্ট রিজলির।
বাঙলাদেশের উচ্চবর্ণগুলির ভিতর এবং অন্যান্য বর্ণের ভিতরও চওড়া নাসিকাকৃতি এবং গোল মুন্ডাকৃতির একটা সুস্পষ্ট ধারা বিদ্যমান, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে। বাঙালীর এইসব বৈশিষ্ট্যের যুক্তি খুঁজিতে গিয়া বহুদিন আগে রিজলি সাহেব বলিয়াছিলেন, বাঙালীরা প্রধানত মোঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে উৎপন্ন। তিব্বত-চৈনিক গোষ্ঠীর চীনা, বর্মী, ভোটিয়া, নেপালী প্রভৃতি জনের লোকেরা তো আমাদের সুপরিচিত। ইহারা খর্বকায়, স্বল্পশ্মশ্রু এবং পীতাভবর্ণ। ইহাদের করোটি প্রশস্ত, নাসাকৃতি সাধারণত চ্যাপ্টা। আর, রিজলি যাহাদের বলিয়াছেন দ্রাবিড় সেই নরগোষ্ঠী তাহার মতে সিংহল হইতে গঙ্গার উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহারা কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, ইহাদের মুন্ডাকৃতি দীর্ঘ, নাসাকৃতি চ্যাপ্টা। রিজলি মনে করেন, এই দুই নরগোষ্ঠীর মিশ্রণে উৎপন্ন মোঙ্গোল-দ্রাবিড় নরগোষ্ঠী বিহার হইতে আরম্ভ করিয়া আসাম পর্যন্ত এবং উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহাদের মাথা গোল হইতে মধ্যমাকৃতি, নাসা মধ্যম হইতে চ্যাপ্টা। ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের ভিতর উন্নত ও সুগঠিত নাসার প্রাধান্য দেখা যায়। মোঙ্গলীয়দের মাথা প্রশস্ত (অর্থাৎ চওড়া, brachycephalic); কিন্তু তাহাদের নাক চ্যাপ্টা; বাঙালীদের প্রশস্ত মুন্ডের ধারা মোঙ্গালীয় শোণিতের দান, আর বাহ্মণ-কায়স্থদের উন্নত সুগঠিত নাসা ভারতীয় আর্যরক্তের দান, ইহাই হইতেছে রিজলির মত। এই মত অনুসরণ করিয়া তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর পর্যন্ত সমস্ত পূর্ণভারতে মোঙ্গোলীয় প্রভাব উপস্থিত; দ্রাবিড় বলিয়া একটি নরগোষ্ঠী আছে এবং ইহাদের মাথা দীর্ঘ– এই দুই নরগোষ্ঠীর সাংকর্যে বাঙালীর উৎপত্তি। কাজেই বাঙালীর মুন্ডাকৃতি মধ্যম এবং তাহার মধ্যে দুই প্রান্তের গোল ও দীর্ঘ দুই ধারাই বর্তমান। উচ্চবর্ণের লোকদের মধ্যে যে উন্নত সুগঠিত নাসামান দেখা যায় তাহা ভারতীয় আর্যরক্তের দান।
রিজলির মত যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য মনে না করিবার কারণ অনেক। প্রথমত, দ্রাবিড় কোনও নরগোষ্ঠীর নাম নয়, এমন কি জনের নামও নয়, ভাষাতাত্ত্বিক শ্রেণীবিভাগের অন্যতম নাম মাত্র। দ্বিতীয়ত, গঙ্গাতট হইতে আরম্ভ করিয়া সিংহল পর্যন্ত দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত নাই; মধ্যভারতের জঙ্গলময় আটবী ও পার্বত্য ভূমিতে অস্ট্রিক-ভাষাভাষী লোকের বাস এখনও বিদ্যমান। তৃতীয়ত, রিজলি যে সব তথাকথিত দ্রাবিড় উপজাতিদের নাম করিয়াছেন, মস্তিষ্কাকৃতির দিক হইতে তাহারা সকলেই মোটামুটি দীর্ঘমুণ্ড হইলেও প্রত্যেক সমাজের উচ্চতম কোমগুলিতে গোল মুণ্ডাকৃতিরও কিছু অভাব নাই। নাসাকৃতিও মোটামুটি উন্নত ও তীক্ষ্ণ হইতে একেবারে চ্যাপটা পর্যন্ত। কাজেই দ্রাবিড় ভাষাভাষী বিচিত্র জন লইয়া সমগ্র সমষ্টিটাকেই দ্রাবিড় বলাটা খুব যুক্তিসংগত নয়। চতুর্থত, রিজলি যাহাঁদের বলিয়ছিলেন দ্রাবিড়, নরতত্ত্বের বিশ্লেষণে তাঁহাদের মধ্যে অন্তত দুইটি বিভিন্ন জনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে : ১. আদি-নিগ্রোবটু : ইহাদের মাথা দীর্ঘ ও উচ্চ, নাক তীক্ষ্ণ ও সুউচ্চ, ২ আদি-অষ্ট্রেলীয় : ইহাদের মাথা দীর্ঘ ও অনুচ্চ, নাক মধ্যম। ইহাদের সঙ্গে বাঙালীর জনতত্ত্বের সম্বন্ধ কী এবং কোথায়, এবং থাকিলে কতটুকু সে আলোচনা পরে করা যাইবে। আপাতত এইটুকু বলা চলে, রিজলি কথিত দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের কাছে অগ্রাহ্য। রিজলি কথিত মোঙ্গলীয় প্রভাব সম্বন্ধে প্রথমেই বলিতে হয়, বাঙলার ও ভারতের পূর্ব ও উত্তর-শায়ী প্রত্যন্তদেশগুলির সকল ভোট-চৈনিক গোষ্ঠীর লোকেরাই গোলমুণ্ডাকৃতি নয়। দ্বিতীয়ত, আর্যদের ভারতীগমনের পূর্বে আর্যভাষা বিস্তৃতিলাভের আগে, বাঙলা, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর পর্যন্ত মোঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর লোকেরা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, ইতিহাসে এমন কোনও প্রমাণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। দীর্ঘকরোটি কোচ, পলিয়া, বা উত্তর-বাঙলার বাহে, রাজবংশী প্রভৃতি ভোট-চৈনিক গোষ্ঠীর লোকেরা হিমালয় অঞ্চল বা ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা হইতে আসিয়া ঐতিহাসিক যুগেই উপনিবিষ্ট হইয়াছে। তৃতীয়ত, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এইসব মোঙ্গোলীয়ের বেশির ভাগই দীৰ্ঘমুণ্ড; কাজেই, বাঙালীর মধ্যে যে গোল মুণ্ডাকৃতি দেখা যায় তাহা এইসব মোঙ্গোলীয় জাতির প্রভাবের ফলে হইতেই পারে না। উত্তরের লেপচা, ভোটানী, চট্টগ্রামের চাকমা প্রভৃতি লোকেরা গোলমুণ্ড বটে, কিন্তু ইহাদেরই রক্তপ্রভাবে যদি বাঙালীর মাথা গোল হইত তাহা হইলে স্বভাবতই এইসব দেশের কাছাকাছি দেশখণ্ডগুলিতেই গোলমুণ্ড, প্রশস্তনাস বাঙালীদের দেখা যাইত, কিন্তু যথার্থ তথ্য এই যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলি বেশি দেখা যায় দক্ষিণে, পূর্বে ও উত্তরে নয়। চতুর্থত, মোঙ্গোলীয় জাতির লোকদের বঙ্কিম চক্ষু, শক্ত চুল, অক্ষিকোণের মাংসের পর্দা, উন্নত গণ্ডাস্থি, কেশস্বল্পতা, চ্যাপটা নাসাকৃতি এবং পীতাভ বর্ণ বাঙলাদেশে আমরা আরও বেশি করিয়া গভীর ও ব্যাপকভাবে পাইতাম, যদি যথার্থই মোঙ্গোলীয় প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে থাকিত। পঞ্চমত, বিরজাশংকর গুহ মহাশয় বাঙলার উত্তর ও পূর্ব-প্রান্তশায়ী মোঙ্গোলীয় অধিবাসীদের পরিমিতি গণনা করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গারো, খাসিয়া, কুকী, এমন কি মৈমনসিংহের উত্তরতম প্রান্তের গারোদের এবং অন্যান্য কোমের লোকদের মুণ্ডাকৃতি মধ্যম, খুব বড় জোর গোলের দিকে একটু ঝোঁক আছে। কাজেই বাঙালীদের মধ্যে যে গোলমুন্ডের দিকে ঝোঁক তাহা মোঙ্গোলীয় জনদের গোলমুণ্ড অথবা মধ্যমমুণ্ডের প্রভাবের ফল হইতে পারে না। এইসব নানা কারণে রিজলির মোঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সাংকর্যের মত এখন আর গ্রাহ্য নয়।
কিন্তু, রিজলি বাঙালীর জনতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যনির্দেশে খুব ভুল কিছু করেন নাই; ভুল করিয়াছিলেন সেই বৈশিষ্ট্যের মূল অনুসন্ধানে। মূল যে মোঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সংমিশ্রণের মধ্যে নাই, এ বিষয়ে নরতত্ত্ববিদেরা এখন আর কিছু সন্দেহ করেন না; সেই মূলের সন্ধান পাওয়া যায় ভারতীয় নরতত্ত্বের নব-নির্ণত ইতিহাসের মধ্যে। কাজেই, তাহার পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক নয়। এই নব-নির্ণীত ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ ও নির্দোষ নয়, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভারতীয় নরতত্ত্বের এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর জনরহস্যের কাঠামোটা আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়িতে বাধে না।
৩. ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান
ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান
নৃতত্ত্ববিদেরা মনে করেন ভারতীয় জনসৌধের প্রথম স্তর নেগ্ৰিটো বা নিগ্রোবটু জন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এবং মালয় উপদ্বীপে যে নেগ্ৰিটো জনের বসবাস ছিল এ তথ্য বহু পুরাতন। কিছুদিন আগে হাটন, লাপিক ও বিরজাশংকর গুহ মহাশয় দেখাইয়াছিলেন যে, আসামের অঙ্গামি নাগাদের মধ্যে এবং দক্ষিণ ভারতের পেরাম্বকুলম এবং আন্নামালাই পাহাড়ের কাদার ও পুলায়ানদের ভিতর নিগ্রোবটু রক্তপ্রবাহ স্পষ্ট। ভারতীয় নিগ্রোবটুদের দেহবৈশিষ্ট্য কিরূপ ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় কম, কারণ বহুযুগ পূর্বেই ভারতবর্ষের মাটিতে তাহারা বিলীন হইয়া গিয়াছিল। তবে বিহারের রাজমহল পাহাড়ের আদিম অধিবাসীদের কাহারও কাহারও মধ্যে কখনও কখনও যে ধরনের ক্ষুদ্রকায়, কৃষ্ণাভ ঘনশ্যাম, উর্ণাবৎ কেশযুক্ত, দীৰ্ঘমুণ্ডাকৃতির দেহবৈশিষ্ট্য দেখা যায়, কাদারদের মধ্যে যে মধ্যমাকৃতি নরমুণ্ডের দর্শন মেলে, তাহা হইতে এই অনুমান করা যায় যে, ভারত ও বাঙলার নিগ্রোবটুরা দেহগঠনে কতকটা তাহাদের প্রতিবাসী নিগ্রোবটুদের মতনই ছিল; বিশেষভাবে মালয় উপদ্বীপে সেমাং জাতির দেহগঠনের সঙ্গে তাঁহাদের সাদৃশ্য ছিল বলিয়া গুহ মহাশয় অনুমান করেন। বাঙলার পশ্চিম প্রান্তে রাজমহল পাহাড়ের বাগদীদের মধ্যে, সুন্দরবনের মৎসশিকারী নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে, মৈমনসিংহ ও নিম্নবঙ্গের কোনও কোনও স্থানে কচিৎ কখনও, বিশেষভাবে সমাজের নিম্নতম স্তরের লোকদের ভিতর, যশোহর জেলার বাঁশফোঁড়দের মধ্যে মাঝে মাঝে যে কৃষ্ণাভ ঘনশ্যামবর্ণ, প্রায় উর্ণাবৎ কেশ, পুরু উল্টানো ঠোঁট, খর্বকায়, অতি দাপট নাকের লোক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা তো নিগ্রোবটু রক্তেরই ফল বলিয়া মনে হয়। নিগ্রোবটুদের এই বিস্তৃতি হইতে অনুমান করা চলে যে, এখন তাঁহাদের অবশেষ প্রমাণসাপেক্ষ হইলেও এক সময়ে এই জাতি ভারতবর্ষে এবং বাঙলার স্থানে স্থানে সুবিস্তৃত ছিল। কিন্তু বিচিত্র জনসংঘর্ষের আবর্তে তাহারা টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। জার্মান পণ্ডিত ফন আইকস্টেডট্র কিন্তু ভারতবর্ষে নিগ্রোবটুদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, এ দেশে সন্ধানসম্ভাব্য আদিমতম স্তরে নিগ্রোবটুসম অর্থাৎ কতকটা ঐ ধরনের দেহলক্ষণবিশিষ্ট একটি নরগোষ্ঠীর বিস্তার ছিল, কিন্তু তাহারা যে নেগ্ৰিটো বা নিগ্রোবটু নরগোষ্ঠীরই লোক, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।
নিম্নবর্ণের বাঙালীর এবং বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ভিতর যে জনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, নরতত্ত্ববিদেরা তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অষ্ট্রেলীয় (proto-Austroloid)। তাঁহারা মনে করেন যে, এই জন এক সময় মধ্য-ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ-ভারত, গলে হইতে একেবারে অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মোটামুটিভাবে ইহাদের দেহ বৈশিষ্ট্যের স্তরগুলি ধরা পড়ে ভারতবর্ষে, বিশেষভাবে মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের আদিম আধিবাসীদের মধ্যে, সিংহলের ভেড্ডাদের মধ্যে এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে। এই তথ্যই বোধ হয় আদি-অষ্ট্রেলীয় নামকরণের হেতু যাহা হউক, মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের আদিম আধিবাসীরা যে খর্বকায়, কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘমুণ্ড, প্রশস্তনাস, তাম্ৰকেশ এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বংশধর এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। পশ্চিম-ভারতে এবং উত্তর-ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশে যে সব লোকের স্থান হিন্দু সমাজবিন্যাসের প্রান্ততম সীমায় তাহারা, মধ্য-ভারতের কোল, ভীল, করোয়া, খারওয়ার, মূল ভূমিজ, মালপাহাড়ী প্রভৃতি লোকেরা, দক্ষিণ-ভারতের চেঞ্চু, কুরুব, য়েরুব প্রভৃতি লোকেরা, সকলেই সেই আদি অষ্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর লোক। বেদে যে নিষাদদের উল্লেখ আছে, বিষ্ণু-পুরাণে যে নিষাদদের বর্ণনা করা হইয়াছে অঙ্গার-কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, চ্যাপটামুখ বলিয়া, ভাগবত পুরাণ যাহাদের বর্ণনা করিয়াছে কাককৃষ্ণ, অতি খর্বকায়, খর্ববাহু, প্রশস্তনাস, রক্তচক্ষু এবং তাম্রকেশ বলিয়া, সেই নিষাদরাও আদি-অষ্ট্রেলীয়দেরই বংশধর বলিয়া অনুমান করিলে অন্যায় হয় না। পুরাণোক্ত ভীল্ল-কোল্লরাও তাহাই। বর্তমান বাঙলা দেশের, বিশেষভাবে রাঢ় অঞ্চলের সাঁওতাল, ভূমিজ মুণ্ডা, বাঁশফোঁড়, মালপাহাড়ী প্রভৃতিরা যে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এ অনুমান নরতত্ত্ববিরোধী নয়। এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে পূর্বতন নিগ্রোবটুদের কোথায় কোথায় কতখানি রক্তমিশ্রণ ঘটিয়াছিল তাহা বলা কঠিন, তবে কোথাও কোথাও কিছু কিছু যে ঘটিয়াছিল তাহা অনস্বীকার্য। তাহা না হইলে মধ্য-ভারতের, দক্ষিণ-ভারতের এবং বাঙলাদেশের আদি অষ্ট্রেলীয়দের মধ্যে দেহ-বৈশিষ্ট্যের যে পার্থক্য দেখা যায়, তাহার যথেষ্ট ব্যাখ্যা খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। এ প্রসঙ্গে বলা উচিত, ফন আইকস্টেডট মোটামুটি এই আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর যে অংশ মধ্য ও পূর্ব-ভারতবর্ষের অধিবাসী তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন ‘কেলিড্’ এবং সিংহলীয় অংশের ‘ভেডিড্’। ‘কোলিড্’ বা ‘কোলসম’ নামকরণ ভারতীয় ঐতিহ্যের সমর্থক; সেই কারণে আইকস্টেডটের এই নামকরণ গ্রহণযোগ্য।
ভারতবর্ষের জনবহুল সমতল স্থানগুলিতে যে জনের বাস তাঁহাদের মধ্য হইতে পূর্বোক্ত আদিম আধিবাসীদের দেহলক্ষণগুলি বাদ দিলে কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয়। এই জনের লোকেরা দেহদৈর্ঘ্যে মধ্যমাকৃতি, ইহাদের মুণ্ডাকৃতি দীর্ঘ ও উন্নত, কপাল সংকীর্ণ মুখ খর্ব এবং গণ্ডাস্থি উন্নত, নাসিকা লম্বা ও উন্নত কিন্তু নাসামুখ প্রশস্ত, ঠোঁট পুরু এবং মুখগহুর বড়, চোখ কালো এবং গায়ের চামড়া সাধারণত পাতলা হইতে ঘন বাদামী। দক্ষিণ-ভারতের অধিকাংশ লোক এবং উত্তর ভারতের নিম্নতর শ্রেণীর প্রায় সকলেই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দীৰ্ঘমুণ্ড জনের বংশধর, এবং এই দীর্ঘমুণ্ড জনেরাই ভারতীয় জনপ্রবাহে যে দীর্ঘমুণ্ডধারা বহমান তাহার উৎস। বাঙলাদেশেও উত্তম ও মধ্যম সংকর এবং অন্ত্যজ পর্যায়ে যে দীর্ঘমুণ্ডের ধারাচিহ্ন দেখা যায়, তাহাও মূলত এই নরগোষ্ঠীরই দান। এই গোষ্ঠীর আদি বাসস্থান কোথায় এবং বিস্তৃতি কোথায় ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই, তবে বিরজাশংকর গুহ মহাশয় প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, এক সময় এই দীর্ঘমুণ্ডগোষ্ঠী উত্তর-আফ্রিকা হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতের উত্তর-পশ্চিম দেশগুলি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; পরে নব্যপ্রস্তর যুগে ইহারা ক্রমশ মধ্য, দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃতি লাভ করে এবং এইসব দেশে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে ইহাদের কিছু রক্তসংমিশ্রণ ঘটে।
এই সদ্যকথিত জন ছাড়া আরও দুইটি দীর্ঘমুণ্ড জন কিছু পরবর্তীকালেই ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। এই দুই জনের কিছু কিছু কঙ্কালাবশেষ পাওয়া গিয়াছে সিন্ধু নদীর উপত্যকায়। মাকরান, হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োর নিম্নস্তরে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলি হইতে মনে হয় ইহাদের মধ্যে একটির দেহগঠন ছিল সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ, মগজ বড়, ভূ-অস্থি স্পষ্ট, কানের পিছনের অস্থি বৃহৎ। এইসব দেহলক্ষণ পাঞ্জাবের সমরকুশল, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ কোনও কোনও শ্রেণী ও বর্ণের ভিতর এখনও দেখা যায়। কিন্তু এই জন পাঞ্জাব অতিক্রম করিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে আর অগ্রসর হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। দ্বিতীয় দীর্ঘমুন্ড জনের পরিচয়ও মহেন-জো-দড়োর কোনও কোনও কঙ্কালাবশেষ হইতেই পাওয়া যায়। এই জনের লোকদের দেহগঠন তত সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ নয়, বরং ইহারা দৈর্ঘ্যেও একটু খর্ব, কিন্তু মুখাবয়ব তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট, নাসিকা তীক্ষ্ণ ও উন্নত, কপাল ধনুকের মতো বঙ্কিম। ইহাদের মধ্যে ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর দেহলক্ষণের সাদৃশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট, এবং অনুমান করা যায়, সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার যে পরিচয় হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োতে আমরা পাইয়াছি তাহা ইহাদেরই সৃষ্টি। উত্তর-ভারতে সর্বত্র সকল বর্ণের মধ্যেই, বিশেষভাবে উচ্চবর্ণের লোকদের ভিতর, এই দীর্ঘমুণ্ড নরবংশের রক্তধারা প্রবহমান এবং এই রক্তপ্রবাহের তারতম্যের ফলেই উত্তর-ভারত ও দক্ষিণ-ভারতের লোকদের মধ্যে এ ধারার কিছুটা অস্তিত্ব অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বাঙলাদেশে এই দীর্ঘমুণ্ড জনের রক্তপ্রবাহের ধারা কতখানি আসিয়া পৌঁছিয়াছিল তাহা নিশ্চয়ই করিয়া বলা যায় না; কতকটা স্রোতস্পর্শ যে লাগিয়াছিল সে সম্বন্ধে সন্দেহ কী?
উপরোক্ত দীর্ঘমুণ্ড জনেরা যে জনস্তর গড়িয়া তুলিয়াছিল, উত্তর-পশ্চিম হইতে তাহার উপর এক গোলমুণ্ড জন আসিয়া নিজেদের রক্তপ্রবাহ সঞ্চারিত করিল। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইহাদের সঙ্গে গোলমুন্ড মোঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর কোনই সম্বন্ধ নাই। এই জনের সর্বপ্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হইয়াছে হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োতে প্রাপ্ত মুণ্ডকঙ্কাল হইতে। ইহাদের সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের দীনারায় এবং কতকাংশে আর্মানীয় জাতির সম্বন্ধ সুস্পষ্ট। এই জাতিই লাপোং, রিজলি, লুসসান ও রমাপ্রসাদ চন্দ-কথিত অ্যালপাইন (Homo Alpinus) নরগোষ্ঠী, বিরজাশংকর গুহ কথিত অ্যালপো-দীনায়ীয় নরগোষ্ঠী, ফন আইকস্টেডট কথিত পশ্চিম ও পূর্ব ‘ব্র্যাকিড’ বা গালমুণ্ড নরগোষ্ঠী। বাঙলাদেশের উচ্চবর্ণের ও উত্তম সংকর বর্ণের জনসাধারণের মধ্যে যে গোল ও মধ্যম মুণ্ডাকৃতি, তীক্ষ্ণ ও উন্নত এবং মধ্যম নাসাকৃতি ও মাধ্যমিক দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অনেকাংশে এই নরগোষ্ঠীরই দান। বস্তুত, বাঙলাদেশের যে জন ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানত অ্যালপাইন ও আদি-অষ্ট্রেলীয়, এই দুই জনের লোকদের কীর্তি। পরবর্তী কালে আগত আর্যভাষাভাষী আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ ও সংস্কৃতি তাহার উপরের স্তরের একটি ক্ষীণ প্রবাহ মাত্র, এবং এই প্রবাহ বাঙালীর জীবন ও সমাজবিন্যাসের উচ্চতর স্তরেই আবদ্ধ; ইহার ধারা বাঙালীর জীবন ও সমাজের গভীর মূলে বিস্তৃত হইতে পারে নাই। যাহাই হোক, পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল্পস পর্বত, দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বদেশবাসী এই অ্যালপাইন জনের বংশধরেরা বর্তমান ভারতবর্ষে ছড়াইয়া আছে নানা স্থানে—গুজরাটে, কর্ণাটে, মহারাষ্ট্রে, কুর্গে, মধ্যভারতে, বিহারে নাগর ব্রাহ্মণদের মধ্যে, বাঙলায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য এবং উপরের বর্ণস্তরের সকল লোকদের মধ্যে। সর্বত্র সমানভাবে একই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নাই, এ কথা সত্য, কিন্তু ভারতবর্ষে গোলমুণ্ড, উন্নতনাস মানুষের রক্তধারা যেখানে যে পরিমাণে আছে তাহার মূলে এই গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী উপস্থিত। ফন আইকস্টেডটের মতে এই নরগোষ্ঠীর তিন শাখা : পশ্চিম ব্র্যাকিড, যাহাদের বংশধর বর্তমান মহারাষ্ট্র ও কুর্গের অধিবাসীরা, গাঙ্গেয় উপত্যকার দীর্ঘদেহ ব্র্যাকিডরা এবং বাঙলা ও উড়িষ্যার পূর্ব ব্র্যাকিডরা। এই তিন শাখাই, তাঁহার মতে, আর্যভাষী ‘ইণ্ডিড’ নামক বৃহত্তর নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু যে জন বিশিষ্ট ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্মদাতা এবং যাহারা পূর্বতন ভারতীয় সংস্কৃতির আমূল রূপান্তর সাধন করিয়া তাহাকে নবকলেবর নবরূপ দান করিয়াছিল, তাহারা এই অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী হইতে পৃথক। এই নূতন জনের নরতত্ত্ববিদ্দত্ত নাম হইতেছে আদি-নর্ডিক (proto-Nordic) | এই আদি-নর্ডিক জনই বৈদিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃষ্টিকর্তা ভারতবর্ষে ইহাদের সুপ্রাচীন কোনও কঙ্কালাবশেষ আবিষ্কৃত হয় নাই; তবে, তক্ষশীলার ধর্মরাজিকা বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে কয়টি নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতে অনুমান হয়, ইহাদের মুখাবয়ব দীর্ঘ সুদৃঢ় ও সুগঠিত নাসিকা সংকীর্ণ ও সুউন্নত, মুণ্ডাকৃতি দীর্ঘ হইলেও গোলের দিকে ঝোঁক সুস্পষ্ট এবং নিচের দিকে চোয়াল দৃঢ় মাথার খুলি এবং মুখাবয়ব হইতে মনে হয়, ইহাদের দেহ ছিল খুব বলিষ্ঠ ও দৃঢসংবদ্ধ। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, হিন্দুকুশ পর্বতের কাফীর প্রভৃতি কোমের লোকেরা, পঞ্জাব ও রাজপুতনার উচ্চশ্রেণীর ও বর্ণের লোকেরা ইহাদেরই বংশধর, যদিও শেষোক্ত দুই স্থানে পূর্বতন দীর্ঘমুণ্ড জাতির সঙ্গে ইহাদের সংমিশ্রণ একটু বেশি ঘটিয়াছে বলিয়া মনে হয়। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সর্বত্রই ইহাদের ধারাচিহ্ন পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা সর্বত্র খুব বলিষ্ঠ ও বেগবান নয়। উত্তর-যুরোপের নর্ডিক জাতির সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই, তবে পার্থক্যও আছে, বিশেষভাবে চুল ও গায়ের রঙে। ভারতীয় নর্ডিক জাতির চুলের রং সাধারণত ঘন বাদামী হইতে ঘনকৃষ্ণ এবং চামড়া বাদামী হইতে রক্তিম গৌর। উত্তর-য়ুরোপের নর্ডিকদের চামড়া রক্তিম শ্বেত এবং কেশ পাতলা বাদামী হইতে শ্বেতোপম। এই পার্থক্য কতকটা জলবায়ু-নির্ভর সন্দেহ নাই, কিন্তু মূলত কতকটা পূর্বাপর ইতিহাসগত তাহাও অস্বীকার করা যায় না। সম্ভবত, বৈদিক আর্যসভ্যতার নির্মাতা নর্ডিকেরাই আদি-নর্ডিক, এবং ইহারাই পরবর্তীকালে উত্তরে যুরোপখণ্ডে গিয়া ক্রমশ নুতন দেহলক্ষণ উদ্ভব করিয়াছিল। ফন আইকস্টেডট এই বলিষ্ঠ ও দুর্জয় নরগোষ্ঠীর নামকরণ করিয়াছেন ‘ইন্ডিড’। যাহাই হউক, ইহাদেরই আর্যভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কালে বহু শতাব্দী ধরিয়া ধীরে ধীরে বাঙলাদেশে সঞ্চারিত হইয়া পূর্বতন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করিয়া নূতনরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠনে এই আদি-নর্ডিক জনের বক্ত ও দেহগঠন বৈশিষ্ট্যের দান অত্যন্ত অল্প; সে ধারা শীর্ণ ও ক্ষীণ, এত শীর্ণ ও ক্ষীণ যে বাঙলাদেশের ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তাহা খুব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সত্ত্বেও সহসা ধরা পড়ে না। বর্তমান যুক্তপ্রদেশ, রাজপুতনা বা পঞ্জাবের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নরতত্ত্বের দিক হইতে বাঙালী ব্রাহ্মণের কোনও সম্বন্ধই যে প্রায় নাই তাহার কারণ এই তথ্যের মধ্যে নিহিত। ঐসব দেশের ব্রাহ্মণেরা যে সামাজিক ক্ষেত্রে বাঙালী ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বের দাবি সম্পূর্ণ স্বীকার করেন না তাহার অন্যতম কারণ এই জনপার্থক্য নয় কি?
ইহা ছাড়াও আর একটি খর্বদেহ দীৰ্ঘমুন্ড জাতির অস্তিত্ব অনুমান করিয়াছেন নরতত্ত্ববিদ ফিশার সাহেব, এবং ইহাদের নামকরণ করিয়াছেন প্রাচ্য বা Oriental বলিয়া। ইহারা পাতলা গৌর, কিন্তু ইহাদের চুল ও চোখ কৃষ্ণবর্ণ এবং নাসিকা দীর্ঘ ও উন্নত। উত্তর আফগানিস্তানের বাদক্ষীরা, দীর্ হইতে খাইবার গিরিবর্ত্ম পর্যন্ত যে সব লোক বাস করে, চিত্রল হইতে হিমালয়ের সানুদেশ ধরিয়া নেপালের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত যে সব পার্বত্য জনের বাস, ইহারা সকলেই কমবেশি সেই প্রাচ্য জনের বংশধর। পঞ্জাবের হিন্দুসমাজের কোনও কোনও শ্রেণীতে এবং মুসলমানদের উচ্চশ্রেণীতে এই জনের শীর্ণ প্রবাহ কিছুটা ধরা পড়ে, কিন্তু বাঙলাদেশে ইহাদের রক্তধারা আসিয়া পৌঁছিতে পারে নাই, এমন-কি পর্বতশায়ী উত্তরাংশেও নয়। ফন্ আইকস্টেডট এই নরগোষ্ঠীর নামকরণ করিয়াছেন ‘উত্তর-ইন্ডিড’ বলিয়া; এবং ডেনিকার ও জিউফ্রিডা-রাগ্গেরী ইহাদেরই বোধ হয় বলিয়াছেন ‘ইন্দো-আফগানীয়’।
মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাররবর্ষের ঘনিষ্ঠতম পরিচয় পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে। এইসব মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ছড়াইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু ভারতবর্ষের জনপ্রবাহে ইহাদের স্পর্শ গভীরভাবে কোথাও লাগে নাই, একমাত্র আসাম, উত্তরের হিমালয়শায়ী নেপাল-ভোটান এবং পূর্ব প্রান্তে ব্ৰহ্মদেশশায়ী প্রত্যন্ত জনপদ ও অরণ্যবাসী লোকদের মধ্যে ছাড়া। চৈনিক তুর্কীস্থানের তুকী-ভাষাভাষী অথবা খিরগিজ, উজবেক প্রভৃতি লোকদের মতো যথার্থ মোঙ্গোলীয় জন বা কোম আজ পর্যন্ত ভারতীয় নরতত্ত্বের বহির্ভূত। তবে উত্তরে হিমালয়সানুদেশবাসী লিম্বু লেপচা, রংপা প্রভৃতি কোমের লোকদের মধ্যে তিব্বতী রক্তধারা সুস্পষ্ট। ইহাদের দেহাকৃতি মধ্যম হইতে দীর্ঘ, মুণ্ডাকৃতি গোল, গণ্ডাস্থি উন্নত এবং নাসিকাকৃতি দীর্ঘ ও চ্যাপটা। নেপালেও এই রক্তধারার প্রভাব ধরা পড়ে, তবে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ক্রমশ ক্ষীয়মাণ।
আসামের উত্তর-পূর্বপ্রান্তশায়ী পার্বত্য দেশগুলিতে আবার একটি পৃথক মোঙ্গোলীয় রক্তধারার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহাদের মুণ্ডাকৃতি ঠিক গোল নয়, গোলের ঠিক উল্টা অর্থাৎ দীর্ঘ, এবং অক্ষিপুট সম্মুখীন। ইহারা যে মোঙ্গোলীয় তাহার প্রমাণ ইহাদের চ্যাপটা নাক, উন্নত গণ্ডাস্থি, বঙ্কিম চক্ষু, উদ্দণ্ড কেশ, কেশবিহীন দেহ ও মুখমণ্ডল। দক্ষিণ-পশ্চিম চীন হইতে ইহারা ক্রমশ ব্ৰহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ ও পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; পথে উত্তর-পূর্ব আসামে এবং উত্তর ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, বোদো বা মেচ প্রভৃতি লোকদের ক্তিতর, কোচ, পালিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকদের ভিতর ইহাদের একটি ধারাপ্রবাহ ধরা পড়িয়া গিয়াছে। আসামে এই ধারা সর্বত্রই, সমাজের সকল স্তরেই প্রবহমান, তবে উচ্চবর্ণগুলির ভিতর গোলমুন্ড অ্যালপাইন এবং কিছু পরিমাণে দীর্ঘমুণ্ড আদি-নর্ডিক ধারাও সুস্পষ্ট; এই শেষোক্ত দুই ধারাই আসামের হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাধুত ধারাটির একটি প্রবাহ ঐতিহাসিক কালে বাঙলাদেশে আসিয়া ঢুকিয়া পড়ে, এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এইভাবেই খানিকটা মোঙ্গোলীয় প্রভাব আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, কিন্তু তাহা সাধারণত সমাজের নিম্নস্তরে।
ব্ৰহ্মদেশে যে মোঙ্গোলীয় জনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তাহারা খর্বদেহ, তাঁহাদের মণ্ডাকৃতি গোল,—দীর্ঘ নয়, এবং চামড়ার রং আরও ঘোর। দীর্ঘমুণ্ড অহোমীয় মোঙ্গোলীয়দের সঙ্গে ইহাদের আত্মীয়তা থাকিলেও ইহারা একগোত্রীয় নয়; বরং ব্রহ্মদেশীয় গোলমুণ্ড মোঙ্গোলীয়দের সঙ্গে সমগোত্রীয়তা আছে ত্রিপুরা জেলার চাকমাদের, টিপরাইদের এবং আরাকানের এবং চট্টগ্রামাঞ্চলের মগদের। বাঙলাদেশের অন্যত্র কোথাও এই ব্ৰহ্ম-মোঙ্গোলীয় প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না এবং বাঙলার জনগণের রক্তপ্রবাহে ইহারা বিশেষ কোনও চিহ্ন রাখিয়া বায় নাই।
ভারতবর্ষের নরগোষ্ঠীপ্রবাহ সম্বন্ধে উপরে যাহা বলা হইল, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকেরা
ইতিহাসের গোড়ার কথা। ৩৫
মোটামুটি তাহা স্বীকার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে লাইপত্সিগ স্যাক্সন ইনস্টিটিউটের ভারতীয় নৃতত্ত্বাভিযানের নেতা ব্যারন ফন আইকস্টেডট সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়িয়া যে সুবিস্তৃত শারীর পরিমিতি গণনা করিয়াছেন, তাহার ফলে ভারতীয় নরগোষ্ঠীপ্রবাহে কিছু নতুন আলোকপাত হইয়াছে। ফন আইকস্টেডটের বিশ্লেষণ ও মতামত আমাদের দেশে বহুলপ্রচারিত নয়; অথচ নানা কারণে তাঁহার মতামত আলোচিত হইবার দাবি রাখে। প্রথমত, ভারতীয় নরতত্ত্ব জিজ্ঞাসায় তিনিই বোধহয় সর্বপ্রথম সমস্ত ভারতবর্ষ তাহার গণনা ও বিশ্লেষণের বিষয়ীভূত নিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, তিনিই সকলের চেয়ে বেশি সংখ্যায় পরিমিতি লইয়াছেন। তৃতীয়ত, সমস্ত পরিমিতি একই মানদণ্ডানুযায়ী গৃহীত হইয়াছে; এবং চতুর্থত, যে বিচার পদ্ধতি অনুযায়ী পরিমিতি বিশ্লেষিত হইয়াছে তাহা একান্ত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। পূর্বতন সকল মতামত বিচার করিয়া এবং সুবিস্তৃত ও সুগভীর গবেষণার ফলে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, তাহার সংক্ষিপ্ত একটু পরিচয় লওয়া এ প্রসঙ্গে অবাস্তর নয়। তিনি বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর যে নামকরণ করিয়াছেন, তাহা অনন্যপূর্ব না হইলেও একটু অসাধারণ। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিবেচনা করিলে দেখা যাইবে, নামকরণ যাহাই হোক, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর যে যে বিশিষ্ট দেহলক্ষণের উপর এই নামকরণের নির্ভর সেই দেহলক্ষণ সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা খুব বেশি নাই। শ্রেণীনির্ধারণ সম্বন্ধে মতের বিভিন্নতা অবশ্যই লক্ষণীয়।
ফন আইকস্টেডটের মতে ভারতবর্ষে মোটামুটি তিনটি নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ উপস্থিত। প্রত্যেক গোষ্ঠীতেই কয়েকটি শাখাগোষ্ঠী সংলগ্ন।
১. ভেড্ডিড্ বা ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠী—উত্তর-দক্ষিণাত্যের পাতলা রং ও বলিষ্ঠ গড়নের উত্তর-গোণ্ডীয় গোষ্ট্ৰীয় লোকেরা এবং দক্ষিণ ভারতের ঘোরকৃষ্ণ ‘মেলিড্’ ও সিংহলের ভেড্ডারা এই ভেড্ডিড্ বা ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠীর শাখা। লক্ষণীয় যে, কোল-মুণ্ডা নরগোষ্ঠীকে ফন আইকস্টেডট। বৃহত্তর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করিতেছেন না।
২. ‘মেলানিড্’ বা ‘ভারতীয় মেলানিড্’–এই নরগোষ্ঠীর প্রধান বাসস্থান দক্ষিণ ভারতের সমতল প্রদেশ, এবং বর্তমান তামিলভাষী লোকেরা ইহাদের বংশধর। উত্তরে হোদের মধ্যে এই ‘মেলানিড্’ রক্তস্পর্শ সুস্পষ্ট এবং আরও উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকায় ইহাদের কোনও কোনও ক্ষুদ্রতর শাখার দর্শন দুর্লভ নয়, বিশেষত, তথাকথিত নিম্নজাতদের ভিতর। কোলীয়রাও ইহাদেরি একটি সুবৃহৎ শাখা। এই হিসাবে ফন আইকস্টেডট কোল-মুণ্ডা নরগোষ্ঠীকে বর্তমান দ্রাবিড়ভাষী মেলানিড্ নরগোষ্ঠীর আত্মীয় বলিয়া মনে করিতেছেন; কোল-মুণ্ডা খাসিয়ারা যে আন পৃথক নরগোষ্ঠীর লোক তাহা বলিতেছেন না। তাহা ছাড়া, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিকেরা বর্তমান দ্রাবিড়ভাষী লোকদের যে সব দেহলক্ষণসমূহের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহাদের সঙ্গে ভারতবহির্ভূত মিশর-এশীয় বা ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর আত্মীয়তার সন্ধান পাইতেছেন, মোটামুটি সেই দীর্ঘমুণ্ড উন্নতনাস নরগোষ্ঠীর লোকদেরই তিনি বলিতেছেন ভারতীয় ‘মেলানিড্’।
৩. ‘ইন্ডিড্’’ বা ভারতীয় নরগোষ্ঠী—ইহাদের প্রধানত তিন শাখা : ক. যথার্থ ‘ইন্ডিড্’; ইহারাই মোটামুটি যাহাদের আগে বলা হইয়াছে আদি-নর্ডিক; খ উত্তর ‘ইন্ডিড্’; অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ফিশাল যাহাদের বলিয়াছেন প্রাচ্য বা ‘ওরিয়েন্টাল’; এবং গ. ‘ব্র্যাকিড’; ইহারা আর-একটি গালমুণ্ড নরগোষ্ঠী অর্থাৎ মোটামুটিভাবে আগে যাহাদের বলা হইয়াছে অ্যালপাইন বা আল্পো-দীনারীয়। এই ‘ব্র্যাকিড’দের আবার তিন উপধারা; অ. মহারাষ্ট্র দেশের ‘পশ্চিম ব্রাকিড্’; আ. বাঙলা ও উড়িষ্যার ‘পূর্ব ব্র্যাকিড’, এবং ই. গাঙ্গেয় উপত্যকার ‘দীর্ঘদেহ ব্র্যাকিড্’। যথার্থ ‘ইন্ডিড’দের বিস্তার বিনশন-প্রয়াগধৃত আর্যাবর্তে বা মধ্যদেশে, দক্ষিণ-ভারতের কেরল ভূমিতে এবং মিশ্রিতরূপে সিংহল দ্বীপেও।
ফন আইকস্টেডট আরও বলেন যে, দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পশ্চিমাংশের কোনও কোনও অধিবাসীদের ভিতর আদি মোঙ্গোলীয় রক্তপ্রভাব সুস্পষ্ট, এবং তাহা বোধ হয় অপেক্ষাকৃত আধুনিক কোলভাষী লোকদের রক্তধারা দ্বারা স্পষ্ট। এই আদি-মোঙ্গোলীয় প্রভাব ভারতবর্ষের সর্বত্র সমভাবে বিস্তৃত নয়, তবে এখানে-ওখানে আকীর্ণ চিহ্ন পৃথক পৃথক ভাবে নানা স্থানে ধরা পড়ে। ইহা হইতে তিনি অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষে এই মোঙ্গোলীয় প্রভাব খুব সুপ্রাচীন নয়।
দক্ষিণ-ভারতের অধিবাসীরা, তাঁহার মতে, নৃতত্ত্বের দিক হইতে অধিকতর সমন্বিত এবং সমন্বয়ের মূল ভিত হইতেছে সুবিস্তৃত আদিমতম নেগ্রিড রক্তপ্রবাহ। এই সমন্বিত নরগোষ্ঠীই ফন আইকস্টেডট-কথিত ‘মেলানিড্’ নরগোষ্ঠী এবং তাহাদেরই বংশধর বর্তমান মধ্যস্তরের তামিল। উচ্চ ও নিম্নস্তরে এই সমন্বয়ের সমগ্র ও সুস্পষ্ট রূপটি ধরা পড়ে না, কারণ উভয় স্তরেই অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক বা প্রাচীনতর কালের অন্য নরগোষ্ঠীর রক্তস্পর্শ লাগিয়াছে; উচ্চস্তরে বোধহয় ‘ইন্ডিড’দের এবং নিম্নস্তরে ‘মালিড’দের। এই ‘মালিডা’রা পর্বতবাসী ভেড্ডিড নরগোষ্ঠীর সঙ্গে কমবেশি আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ। ইহাদের কাহারও মধ্যেই অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের নিগ্রোবটু রক্তস্পর্শের চিহ্নমাত্র নাই, যদিও আদিমতম নিগ্রোবটু রক্তম্পর্শের কমবেশি প্রভাব সকলের মধ্যেই আছে, তবে সে প্রভাবও বহুদিন আগেই শুকাইয়া উবিয়া গিয়াছে।
সংখ্যায় ও বিস্তৃতিতে ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষ বলিষ্ঠ নরগোষ্ঠী হইতেছে ‘ইণ্ডিড্’রা। ফন আইকস্টেডটের মতে ইহারাই প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারী এবং দ্রাবিড় ও বিশিষ্ট “ভারতীয়” আত্মিক সাধনার যথার্থ প্রতিনিধি। ‘ইণ্ডিড’ নরগোষ্ঠীর উত্তর-পশ্চিমাংশ বারবার মধ্য এশিয়ার নানা জন ও কোম দ্বারা আক্রান্ত ও পর্যুদস্ত হইয়াছে; আর্যভাষা কিন্তু তাহাতে কখনও শিথিলমূল হয় নাই, বরং তাহার প্রতাপ বরাবরই অম্লান ও অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু আর্যভাষীদের বাস্তব সভ্যতা ও মানস-সংস্কৃতি বারবার রূপান্তর ও সমন্বয় লাভ করিয়াছে। আর্যভাষাকে আশ্রয় করিয়া কিছু নর্ডিক রক্তপ্রবাহ, পরবর্তীকালে কিছু শক ও হুন রক্তপ্রবাহ এবং আরও পরবর্তীকালে মুসলমান অভিযান আশ্রয় করিয়া কিছু ওরিয়েন্টাল বা প্রাচ্য নরগোষ্ঠীর রক্তধারা ‘ইণ্ডিড্’ প্রবাহে সঞ্চারিত হইয়াছে। মূলে এই ‘ইণ্ডিড্’ নরগোষ্ঠী আদিমতম ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অতি প্রাচীনকাল হইতেই উত্তর হইতে ‘ইণ্ডিড্’দের দক্ষিণমুখী চাপে ক্রমশ ‘মেলানিড্’ নরবংশের সৃষ্টি এবং ভেড্ডিডদের চাপে ক্রমশ ‘মালিড’দের।
‘ইণ্ডিড্’ ও ‘মেলানিড’ নরগোষ্ঠী ও তাঁহাদের ভাষা সম্বন্ধে ফন আইকস্টেডটের উক্তি উদ্ধারযোগ্য। আমার মনে হয়, দ্রাবিড়ভাষীদের নরতত্ত্ব সম্বন্ধে একান্ত সাম্প্রতিক কালেও নরতাত্ত্বিকদের মধ্যে যে জিজ্ঞাসা বর্তমান তাহার একটা সন্তোষজনক মীমাংসা এই উক্তির মধ্যে পাওয়া যায়
The originally Dravidian Indids, whose descendants adopted the Aryan language, pushed over the Melanids, who in their turn adopted Dravidian idioms for which they are now the typical representatives. So, race and language do no more in India in anyway coincide. Races remained, but languages were shoven southward… The disturbing results of the idea of a Dravidian “race” are therefore easy to understand. The Dravida speakers of today are no more the same as four millenniums ago. At that time they were of Indid race, today they are prevailingly of Melanid race.
এই সুদীর্ঘ জাতিপ্রবাহের ইতিহাস আলোচনায় একটি তথ্য সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। সেটি এই; নরতত্ত্বের দিক হইতে বাঙলার জনসমষ্টি মোটামুটি দীর্ঘমুণ্ড, প্রশস্তনাস আদি-অষ্ট্রেলীয় বা কোলিড়, দীৰ্ঘমুণ্ড, দীর্ঘ ও মধ্যোন্নতনাস মিশর-এশীয় বা ‘মেলানিড্’, এবং বিশেষভাবে গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন বা ‘পূর্ব ব্র্যাকিড়, এই তিন জনের সমন্বয়ে গঠিত। নিগ্রোবটু রক্তেরও স্বল্প প্রভাব উপস্থিত, কিন্তু তাহা সমাজের খুব নিম্নস্তরে এবং সংকীর্ণ স্থানগণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। মোঙ্গোলীয় রক্তের কিছুটা প্রভাবও আছে, কিন্তু তাহাও উত্তর ও পূর্ব দিকে সংকীর্ণ স্থানগণ্ডির সীমা অতিক্রম করে নাই। আদি-নর্ডিক বা খাটি ‘ইণ্ডিড্’ রক্তপ্রবাহও অনস্বীকার্য, কিন্তু সে ধারা অত্যন্ত শীর্ণ ও ক্ষীণ। মোটামুটিভাবে ইহাই বাঙলাভাষাভাষী জন-সৌধের চেহারা, এবং এই জন-সৌধের উপরই বাঙালীর ইতিহাস গড়িয়া উঠিয়াছে। এই বিচিত্র সংকর জন লইয়াই বাঙলার ও বাঙালীর ইতিহাসের সূত্রপাত।
বাঙালীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ এবং উত্তর-ভারতের বিভিন্ন বর্ণের এবং জনের উপরোক্ত নরতাত্ত্বিক বিবরণের তুলনামূলক আলোচনা হইতে বাঙালীর বিভিন্ন বর্ণ বা জাত সম্বন্ধে মোটামুটিভাবে এখন কতকগুলি ইঙ্গিত ধরিতে পারা যায়। খুব সংক্ষেপে প্রধান ও অপ্রধান কয়েকটি বর্ণ সম্বন্ধে সে ইঙ্গিত বিবৃত করিলেই সমগ্র চেহারাটি পরিষ্কার হইবে।
ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের সম্বন্ধেই আগে বলা যাইতে পারে। বাঙলাদেশে ব্রাহ্মণরাই একমাত্র জাত যাহাদের সঙ্গে পঞ্জাবের ব্রাহ্মণদের এবং উত্তর-ভারতের অন্যান্য উচ্চবর্ণের সঙ্গে খানিকটা মিল আছে; কিন্তু তাহা অপেক্ষাও বাঙালী ব্রাহ্মণদের বেশি নরতাত্ত্বিক আত্মীয়তা দেখা যায় বাঙালী বৈদ্য ও কায়স্থদের সঙ্গে বস্তুত, বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ জনতত্ত্বের দিক হইতে একই গোষ্ঠীর লোক বলিলে কিছু অবৈজ্ঞানিক কথা বলা হয় না। জনতত্ত্বের দিক হইতে বলিতে পারা যায়, যে সব জাত (অর্থাৎ বৈদ্য-কায়স্থ, বৃহদ্ধর্মপুরাণের করণ ও অম্বষ্ঠ) দেহবৈশিষ্ট্যে ব্রাহ্মণদের যত সন্নিকটে, বাঙলাদেশে সেই সব জাত-এর সামাজিক কৌলীন্য তত বেশি। বাঙালী ব্রাহ্মণদের (এবং কায়স্থ-বৈদ্যদের) সঙ্গে পূর্ব-ভারতীয় আদিমতম অধিবাসীদের (যেমন, ছোটনাগপুর অঞ্চলের সাঁওতালদের, উত্তরাঞ্চলের গারো-খাসিয়াদের, নিম্নবঙ্গের রাজবংশী-বুনা ইত্যাদিদের), কিংবা নিম্নতম বর্ণ ও শ্রেণীর লোকদের (পোদ-বাগদী প্রভৃতি) রক্তসংমিশ্রণ বেশি ঘটিয়াছে, এমন প্রমাণ নাই। ঘটে যে নাই তাহার খানিকটা প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে এবং ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের, বিশেষভাবে ব্রাহ্মণদের, সামাজিক আচার-ব্যবহারে। নির্বিচার আন্তর্বিবাহ ও আন্তর্ভোজনে একটি আপত্তি বরাবরই তাঁহাদের ছিল, যদিও সেই আপত্তি সুপ্রাচীন কালে সর্বত্র সব সময় খুব কার্যকরী হয় নাই। আর এইসব আপত্তি ও সংস্কার তো খুবই ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিয়াছিল, একদিনেই তাহা কার্যকরী করা সম্ভব হয় নাই। সেই হেতুই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বৈদ্য-কায়স্থদের একটা জনতাত্ত্বিক আত্মীয়তা সহজেই লক্ষ করা যায়। বাঙলার অন্য কোনও বর্ণ বা জাত-এর সঙ্গে সেই আত্মীয়তার প্রমাণ নাই। আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নাই, বাঙালী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে গাঙ্গেয় ভারতের ব্রাহ্মণদের জনতাত্ত্বিক আত্মীয়তা বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের জনতাত্ত্বিক আত্মীয়তা অপেক্ষা কম; বরং বাঙালী ব্রাহ্মণদের আত্মীয়তা মধ্যভারতীয় অব্রাহ্মণদের সঙ্গে বেশি। উচ্চতম বর্ণের বিহারীদের সঙ্গে বাঙলার উচ্চতম বর্ণের লোকদের কিছুটা আত্মীয়তা আছে। বাঙলা-বিহারের ভৌগোলিক নৈকটে এবং ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে সে মিল থাকা তো খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু সে মিলও বাঙালী বৈদ্য-কায়স্থদের সঙ্গে মিলের চেয়ে অনেক কম। এইসব কারণে মনে হয়, বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বর্ণের লোকেরা একটি বিশেষ ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, এবং জনতত্ত্বের দিক হইতে তাহারা একই গোষ্ঠীবদ্ধ। বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত উত্তম সংকর বর্ণের অনেক বর্ণই এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, এই অনুমানও বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গে করা চলে। অন্তত, বাঙালী কায়স্থরা যে বাঙালী সদগোপ ও কৈবর্তদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ, ইহা তো নরতাত্ত্বিক পরিমিতি-গণনা হইতেই ধরা পড়ে; সদগোপদের সঙ্গে কায়স্থদের তো কোনই পার্থক্য নাই। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তো বলেন, কায়স্থ, সদগোপ ও কৈবৰ্তরাই যথার্থই বঙ্গজন-প্রতিনিধি। বস্তুত, বাঙলাদেশের সমস্ত বর্ণের (বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত উত্তম ও মধ্যম সংকর বর্ণের) সঙ্গে কায়স্থদের আত্মীয়তাই সবচেয়ে বেশি। বাঙলার বাহিরে এক বিহারে কিছুটা ছাড়া অন্যত্র কোনও বর্ণের সঙ্গেই ইহাদের বিশেষ কোনও মিল নাই, এবং এই তথ্য সদগোপ ও কৈবর্তদের সম্বন্ধেও সত্য কায়স্থ, সদগোপ ও কৈবর্তদের সঙ্গে (সদগোপ ও কৈবৰ্তরা ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ-কথিত সংশুদ্ৰ) সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া বা বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত অন্ত্যজ বর্ণের লোকদের কোনই রক্তসংমিশ্রণ ঘটে নাই, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়; তেমনই নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, ছোটনাগপুর অঞ্চলের সাঁওতাল প্রভৃতিদের সঙ্গে বাঙলার পোদ্, বাগ্দী, বাওড়ী প্রভৃতি উপবর্ণের লোকদের সুপ্রচুর রক্তসংমিশ্রণ ঘটিয়াছে।
নমঃশূদ্রদের সম্বন্ধে নরতাত্ত্বিক পরিমিতি-গণনার ফলাফল একটু চাঞ্চল্যকর। এ তথ্য অন্যত্রও উল্লেখ করিয়াছি যে, দেহবৈশিষ্ট্যের দিক হইতে ইহারা উত্তর-ভারতের বর্ণব্রাহ্মণদের সমগোত্রীয়; বস্তুত, উত্তর-ভারতের বর্ণ-ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাঙালী ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের চেয়েও বাঙালী নমঃশূদ্রদের আত্মীয়তা বেশি। অথচ এই নমঃশূদ্রেরা আজ সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে! আমরা তাঁহাদের চণ্ডাল বা চাঁড়াল বলিয়া জানি, এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ রচনার কালেই ইহারা অন্ত্যজশ্রেণীভুক্ত। এই সামাজিক তথ্যের সঙ্গে নরতত্ত্বপ্রমাণগত তথ্যের যুক্তির ও ইতিহাস-সম্মত ব্যাখ্যার কোনও সম্বন্ধ এখনও কিছু খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।
যাহাই ইউক উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবৃতি বাঙলার বিভিন্ন জেলার বিচিত্র বর্ণসমূহের ভিতর আপেক্ষিক সূক্ষ্ম ও স্থল পার্থক্য, একই বর্ণের মধ্যে দেহপরিমিতির ভেদবৈচিত্র্য ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিচার করিলে বলিতেই হয়, এ সমস্তই বিচিত্র জন-সাংকর্যের দ্যোতক। জন-সাংকর্যের নরতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যের জৈব মিশ্রণের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত আর কী হইতে পারে। বস্তুত, স্মরণাতীত কাল হইতে এই ধরনের জন-সাংকর্যের দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের অন্যত্র খুব সুলভ নয়। এই মিশ্রণ এত গভীর ও ব্যাপক যে, নরতত্ত্বের দিক হইতে কোনও বিশিষ্ট বর্ণ, যত উচ্চ বা নিম্নই হউক না কেন, বা কোনও বিশিষ্ট স্থানে অধিবাসীদের একান্তভাবে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিবার উপায় নাই।
৪. ঐতিহাসিক কালে বাঙলার জনপ্রবাহ
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঐতিহাসিক কালে বাঙলার জনপ্রবাহ
ঐতিহাসিক কালে বাঙলার জনপ্রবাহ
জনপ্রবাহ তো একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা; সে ধারা কখনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসিয়া ঠেকিয়া যাইতে পারে না এবং তাহার ইতিহাস কোথাও শেষ হইয়া যায় না। সেই ধারা আজও বহমান। কাজেই প্রাচীন বাঙলাদেশে ঐতিহাসিক কালে সেই চিরবহমান ধারায় আরও কোনও কোনও জনের রক্তস্পর্শ লাগিয়াছে কি না, লাগিলে কতটুকু লাগিয়াছে এবং সেই প্রবহমান ধারাকে কিভাবে কতটুকু রূপান্তরিত করিতে পারিয়াছে বা পারে নাই, তাহার পরিচয়ও এই সঙ্গেই লওয়া প্রয়োজন |
খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকে গ্ৰীক ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বিদ টলেমি (Ptolemy) তাঁহার ‘ইণ্ডিকা’-গ্রন্থে গঙ্গার পূর্বশায়ী দেশগুলির পরিচয় দিতে গিয়া মুরুণ্ড (Murandool) নামে এক জনপদের উল্লেখ করিয়াছেন। পঞ্জাব অঞ্চলে এক মুরুণ্ড উপকোমের উল্লেখ গ্রীক ঐতিহাসিকেরা একাধিকবার করিয়াছেন; ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই মুরুণ্ডেরা সুপরিচিত। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে এই মুরুণ্ডদের উল্লেখ আছে কুষাণবংশীয় দেবপুত্রশাহী-শাহনুশাহী এবং শকদের সঙ্গে। ইহা হইতে অনুমান হয় যে এই মুরুণ্ডরা জন হিসাবে শক-কুষাণদেরই সমগোত্রীয়। শক-কুষাণেরা এক মিশ্র জন। পূর্ব-ভারতে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে যে মুরুণ্ডদের কথা টলেমি বলিতেছেন তাহারা পঞ্জাবের মুরুণ্ডদেরই একটি শাখা হওয়া বিচিত্র নয়। তবে, এই মুরুণ্ডরা বাঙলাদেশে নূতন কোনও রক্তপ্রবাহ বহন করিয়া আনে নাই, তাহা কতকটা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।
বাঙলার বাহিরের অনেক রাজবংশের পরাক্রান্ত রাজারা সৈন্যসামন্ত লইয়া বহুবার বাঙলাদেশ আক্রমণ করিয়াছেন, কমবেশি অংশ-জয় করিয়াছেন, এবং তাহার পর বিজয়গর্ব লইয়া, বহুবিধ ঐশ্বর্য লইয়া স্বদেশ ফিরিয়া গিয়াছেন। সৈন্যসামন্ত ইত্যাদি সঙ্গে যাহারা আসিয়াছিল, তাহাদের অধিকাংশ বিজেতা প্রভুর সঙ্গেই ফিরিয়া গিয়াছে। কিছু যাহারা হয়তো স্থায়ী বাসিন্দারূপে থাকিয়া গিয়াছে তাহারা জনসমুদ্রে জলবিন্দুবৎ কোথায় যে বিলীন হইয়া গিয়াছে, তাহার কোনও হিসাব নাই। ইহারা ছাড়া, পাল ও সেন রাজাদের পট্টোলীগুলিতে এবং সমসাময়িক বাঙলার অন্যান্য লিপিতে দেখা যায়, অনেক অবাঙালী ভারতীয় কোম-উপকোমের উল্লেখ। ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলীগুলিতে দান-বিক্রয় যাহাদের নিকট বিজ্ঞাপিত করা হইতেছে, সেখানে বিভিন্ন রাজকর্মচারী, স্থানীয় মহত্তর, গৃহস্থ, কুটুম্ব ইত্যাদির পরই নাম করা হইতেছে নানা কোম ও উপকোমের। দৃষ্টান্তস্বরূপ মদনপালের মন্হলি পট্টোলীর তালিকাটি উদ্ধার করা যাইতে পারে; রাজকর্মচারীদের পরেই তালিকাগত করা হইয়াছে “গৌড়-মালব-চোড়-খস-তৃণ-কুলিক-কর্ণাট— লাট-ভট্ট” প্রভৃতি রাজসেবকদের। ইহাদের মধ্যে মালব, চোড়, খস, তৃণ, কুলিক, কর্ণাট, লাট সকলেই অবাঙালী; হুণেরা তো মূলত অ-ভারতীয়, কিন্তু ইতিপূর্বেই তাহারা অন্তত চার-পাঁচ শত বৎসর ধরিয়া এ দেশে বাস করিয়া ভারতীয় বনিয়া গিয়াছে। আমার ধারণা—অন্যত্র এ ধারণার কারণ বলিতে চেষ্টা করিয়াছি—এইসব অবাঙালী কোমের লোকেরা বাঙলাদেশে আসিয়াছিল বেতনভুক সৈনিকরপে, না-হয় রাজ-সরকারে একান্ত নিম্নস্তরের কর্মচারী রূপে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এই রকম কয়েকটি ভিন-প্রদেশী কোমের খবর পাইতেছি, যথা, খস, যবন, কম্বোজ, খর, দেবল বা শাকদ্বীপী, ব্রাহ্মণ। যে ভাবেই হউক এইসব লোকেরা ক্রমশ বাঙলাদেশেরই বাসিন্দা হইয়া গিয়াছিল এবং এ দেশেরই বিশাল জনসমুদ্রে নিজেদের বিলীন করিয়া দিয়াছিল। বাঙলাদেশের জনপ্রবাহের বেগবান ধারায় কবেই ইহারা নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। কর্ণাট হইতে কল্যাণের চালুক্য রাজবংশ, তামিলভূমি হইতে চোল রাজবংশ একাদশ শতকে বাঙলাদেশে সার্থক বিজয়াভিযান প্রেরণ করিয়াছিল; যে সব সৈন্যসামন্ত এইসব অভিযানের সঙ্গে আসিয়াছিল, তাহাদের কিছু কিছু এই দেশে থাকিয়া যাওয়া অসম্ভবও নয়। ইহাদের আগে মালবরাজ যশোধৰ্মাও এক অভিযানে পূর্ব-ভারতে আসিয়াছিলেন। প্রতিহারবংশীয় রাজারাও বাঙলাদেশে একাধিক বিজয়াভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন। শৈলবংশীয় রাজারাও এক সময়ে এ দেশে এক সমরাভিযান পাঠাইয়াছিলেন। এইসব বিচিত্র সেনাবাহিনীর কিছু কিছু অংশ হয়তো পশ্চাতে থাকিয়া গিয়াছিল এবং তাহারাই যে পরবর্তীকালে মালব, চোড় (চোল), কর্ণাট, লাট, প্রভৃতি নামে রাজসেবক হইয়া পাল ও সেন-লিপিগুলিতে দেখা দেয় নাই, তাহা কে বলিবে? হুণ, খস ইত্যাদিরাও হয়তো এইভাবেই আসিয়া থাকিবে। খসেরা তো হিমালয়ের সানুদেশের পার্বত্য জন; ভোট-চৈনিক রক্তের প্রভাব ইহাদের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। ধর্মপালের খালিমপুর লিপিতে বাঙলাদেশের মন্দিরে লাটদেশীয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের উল্লেখ আছে। আদি-মধ্যযুগের দু-একটি লিপিতে বাঙলার বাহিরের ভিন্ন-প্রদেশাগত ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের উল্লেখ আছে। অন্যান্য বর্ণের লোকেরাও নিশ্চয়ই নানা কাজে এ দেশে আসিয়াছিল এবং অনেকেই কালক্রমে এ দেশেরই বাসিন্দা হইয়া গিয়াছিল। ইহাদের মধ্যে অন্ধ্ররাও পাল আমলে, বোধ হয় তাহারও আগে, বাঙলাদেশে আসিয়াছিল। একটু অন্য প্রসঙ্গে লিপিগুলিতে ইহাদেরও নাম পাওয়া যায় একেবারে চণ্ডালদের সঙ্গে। কেন যে সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে চণ্ডালদের সঙ্গে ইহাদের স্থান নির্ণীত হইয়াছিল, তাহা বোঝা যায় না। যাহাই হউক, যে ভাবেই আসিয়া থাকুক, এবং সমাজের যে স্তরেই থাকুক, অগণিত জনপ্রবাহের মধ্যে ইহারা সংখ্যায় এত স্বল্প এবং ইহাদের প্রত্যেকের ধারা এত ক্ষীণ যে, জনতত্ত্বের দিক হইতে আজ আর তাদের পৃথক করিয়া চিনিয়া লইবার উপায় নাই, বিরাট বেগবান প্রবাহের মধ্যে তাহারা একবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছে। তাহা ছাড়া ইহারা সকলেই তো পূর্ববর্ণিত কোনও না কোনও বৃহত্তর জনের অঙ্গীভূত ছিল এবং সে সব জাতি ঐতিহাসিক যুগের পূর্বেই বাঙলাদেশে তাহাদের রক্তপ্রবাহ সঞ্চার করিয়া গিয়াছিল; যাহারা পারে নাই, তাহাদের ঐতিহাসিক বংশধরেরা পরবর্তী কালে যে স্বল্প সংখ্যায় বাঙলাদেশে আসিয়াছিল, যে ক্ষীণ ধারা সঙ্গে আনিয়াছিল, তাহাতে সুস্পষ্ট নিদর্শন আঁকিয়া দেওয়া সম্ভব ছিল না।
রাজা-রাজকুমারেরা অনেক সময় ভারতবর্ষেরই ভিনপ্রদেশী রাজকুমারীদের বিবাহ করিয়া আনিতেন; বাঙালী পাল-রাজারাই করিতেন, কর্ণাট-দেশাগত সেন-রাজারা তো করিতেনই। পুরুষানুক্রমে কয়েক পুরুষ ধরিয়া এইরূপ হইয়াছে, এমন দৃষ্টান্তও আছে। রাজারাজড়ার তো কানও বর্ণ নাই; কাজেই মহিষী নির্বাচন করিতে গিয়া জন-বর্ণ দেখিবারও প্রয়োজন হইত না, রাজবংশ হইলেই চলিত; এখনও তো তাহাই চলে। বিশেষত, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক কারণ থাকিলে তো কথাই নাই। কিন্তু ই ধরনের দৃষ্টান্তও বিরাট জনগণপ্রবাহে জলবিন্দুবৎ; কাজেই, মুষ্টিমেয় ভিন্নপ্রদেশাগত নারীও বিশাল জনসমুদ্রে বিলীন হইয়া গিয়াছেন। ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম।
সদ্যোবর্ণিত এইসব দৃষ্টান্ত ছাড়া বাঙলার ইতিহাসে কয়েকটি রাজবংশের পরিচয় আছে যাহারা বিভিন্ন প্রদেশ হইতে বাঙলায় আসিয়া নিজেরা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিয়া এ দেশের কমবেশি অংশে রাজত্ব করিয়াছেন, পুরুষানুক্রমে বসবাস করিয়াছেন এবং এই দেশেরই বিরাট জনগণপ্রবাহে কালক্রমে বিলীন হইয়া গিয়াছেন। তুর্কী বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাঙলাদেশে এই রকম তিন-চারিটি প্রধান প্রধান রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধে খড়গ নামে একটি রাজবংশ সমতট অঞ্চলে প্রায় তিন-চার পুরুষ রাজত্ব করিয়াছিলেন; খড়েগাদ্যম, জাতখড়গ, দেবখড়গ ও রাজ-রাজভট—এই চারিজন রাজার নাম আমরা জানি। খড়গ—এই উপান্ত নামটি কেমন যেন সন্দেহজনক এবং ভিনপ্রদেশী অবাঙালীর নাম বলিয়াই মনে হয়, অথচ ইহারা কোথা হইতে আসিয়াছিলেন জানিবার উপায় নাই। তিন পুরুষ ধরিয়া ইহারা অন্তত উপান্ত নামে নিজেদের জনপরিচয় অক্ষুঃ রাখিয়াছিলেন, কিন্তু চতুর্থ পুরুষে তাহা পরিত্যাগ করিয়া একেবারে যেন দেশি বাঙালী বনিয়া গিয়াছিলেন। দশম শতকে কাম্বোজাখা নামে আর এক রাজবংশ গৌড়ে কিছুদিন রাজত্ব করিয়াছিলেন। দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে প্রাপ্ত একটি স্তম্ভলিপিতে ইহারা “কাম্বোজাম্বয়জ গৌড়পতি” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন; ইরদা তাম্রপট্টেও ইহাদের উল্লেখ আছে। এই কাম্বোজাম্বয়জ রাজারা কাহারা? কোথা হইতে ইহারা আসিয়াছিলেন? দেবপালের মুঙ্গের-শাসনে এক কাম্বোজের উল্লেখ আছে, কিন্তু সেই কাম্বোজদেশ যে উত্তর-পশ্চিমের গান্ধার দেশের সংলগ্ন দেশ, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু বাণগড় স্তম্ভলিপি ও ইরদাপট্টের কাম্বোজ যে মুঙ্গের-শাসনের কাম্বোজ, আমার তাহা মনে হয় না। বহুদিন আগে রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলিয়াছিলেন এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাহা সমর্থন করিয়াছিলেন যে, এই কাম্বোজরা তিব্বত, ভোটান প্রভৃতি হিমালয়ের সানুদেশেরকোনও মোঙ্গোলীয় জনের শাখা এবং বর্তমান উত্তরবঙ্গের কোচ-পলিয়া-রাজবংশীয়দের পূর্বপুরুষ। সুনীতিবাবু কাম্বোজের সঙ্গে কোচ শব্দের একটা শব্দতাত্ত্বিক যোগও অনুমান করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি এই মত এখন পরিত্যাগ করিয়াছেন; কেন করিয়াছেন, জানি না। আসামের পূর্বতম প্রান্তে চীনদেশের সীমায় য়ুনান প্রদেশকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত প্রাচ্য ভৌগোলিক ও ব্যবসায়ীরা গান্ধার বলিয়াই অভিহিত করিতেন; ত্রয়োদশ শতকেও রসিদ-উদ-দীন এই দেশকে গান্ধার বলিয়াই উল্লেখ করিয়াছেন। এই গান্ধারেরই সংলগ্ন এক কাম্বোজদেশ যে ছিল না, কে বলিবে? বিশেষত, পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী চম্পাভূমি সংলগ্ন কম্বুজদেশ যখন পূর্ব হতেই এত সুপরিচত? তাহা ছাড়া, ব্ৰহ্মদেশের পেগু শহরের নিকটস্থ পঞ্চদশ শতকের সুদীর্ঘ কল্যাণী শিলালিপিতে রাজা ধৰ্ম্মচেতি ঐ দেশে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও ধর্মসংস্কারের যে বিবরণ উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন, তাহাতে কম্বোজ সঙ্ঘ নামে এক বৌদ্ধ ধর্মগোষ্ঠীর উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহারা যে সেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাম্বোজদের সঙ্গে সম্পূক্ত, এ কথা সহজে বিশ্বাস করা যায় না। আমার তো মনে হয়, আসামের পূর্ব-সীমান্তের গান্ধার সংলগ্ন একটা কম্বোজ দেশ ছিল, এবং বাঙলার কাম্বোজরাজবংশ সেই দেশ হইতে আগত। যদি তাহা হয়, তাহা হইলে ইহারা মোঙ্গোলীয় পরিবার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, এই অনুমান অসংগত নয়, এবং বাণগড় শিলালিপির সাক্ষ্য স্বীকার করিলেও ইহারা যে এ দেশে আসিয়া এ দেশের শৈবধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন তাহাও স্বীকার করিতে হয়। বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বাঙলাদেশে যে সব অবাঙালী জনের নাম করা হইয়াছে তাঁহাদের মধ্যে কম্বোজ অন্যতম। ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা হইতে একাধিক মোঙ্গোলীয় জন যে প্রাচীনকালে বাঙালীর জনপ্রবাহে রক্তধারা মিশাইয়াছে, এ কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। বস্তুত, বাঙলা ও আসামের প্রাচীন ইতিহাসে ঐ অঞ্চল হইতে একাধিক সমরাভিযান ব্ৰহ্মপুত্র-করতোয়া অতিক্রম করিয়া বাঙলাদেশে বিস্তৃত হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার স্বল্পকালস্থায়ী উত্তরবঙ্গ ও কর্ণসুবর্ণাধিকার তাহার একটিমাত্র দৃষ্টান্ত।
আর এক বর্মণ রাজবংশ একাদশ ও দ্বাদশ শতকে পূর্ববঙ্গে প্রায় পাঁচ-ছয় পুরুষ ধরিয়া রাজত্ব করিয়াছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন, এই বর্মণেরা বাঙলার দক্ষিণে কোনও প্রদেশ, সম্ভবত উড়িষ্যা বা অন্ধ্রদেশ হইতে আগত। কিন্তু যে ভিনপ্রদেশাগত রাজবংশ বাঙলাদেশে আসিয়া প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং বাঙালীর সমসাময়িক সমাজবিন্যাসকে আমূল বদলাইয়া স্মৃতি-শাসনের রূপান্তর ঘটাইয়া সমাজের উচ্চস্তরে নূতন এক সমাজবিন্যাস গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, সেই সেন রাজবংশের কথা এই প্রসঙ্গে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই সেন রাজারা নিজেদের পরিচয় দিয়াছেন “কর্ণাট-ক্ষত্ৰিয়” বলিয়া। তাহারা যে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটদেশ হইতে আসিয়াছিলেন, এ কথা আজ সর্বজনবিদিত। কর্ণাটদেশবাসী চালুক্য রাজবংশ একাদশ শতকে বাঙলা ও বিহারে একাধিক সমরাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন; এইসব অভিযানের সঙ্গে যে সব সৈন্যসামন্তরা আসিয়াছিলেন, তাঁহারাই যে পরবর্তী কালে তিরহুত ও নেপালে “কর্ণাটক” রাজবংশ, রাঢ়ে ও বঙ্গে “কর্ণাটক-ক্ষত্ৰিয়” রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এ অনুমান ইতিহাসসম্মত। সেন রাজারা সাধারণত বৈবাহিক আদান-প্রদান ভিনপ্রদেশের রাজবংশের সঙ্গেই করিতেন—রাজারাজড়া তো তাহা করিয়াই থাকেন; কিন্তু এ কথাও সত্য যে, দুই শত বৎসরে তাঁহারা একেবারে বাঙালী বনিয়া গিয়াছিলেন এবং বাঙালীর জনপ্রবাহ নিজেদের বিলীন করিয়া দিয়াছিলেন। কর্ণাটদেশের উচ্চবর্ণের লোকেরা তো জন হিসাবে মোটামুটি গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন পরিবারভুক্ত; উচ্চবর্ণের বাঙালীরাও তাহাই। কাজেই, কর্ণাট-ক্ষত্রিয় সেন রাজবংশ বাঙলাদেশে এমন নূতন কোনও রক্তধারা বহন করিয়া আনেন নাই যাহা বাঙলাদেশে ছিল না; আনিলেও সে ধারা এত ক্ষীণ ও শীর্ণ যে, বেগবান স্রোতপ্রবাহে কোথায় যে তাহা মিশিয়া গিয়াছে, আজ আর তাহা ধরা পড়িবার উপায় নাই।
তুর্কীবিজয়ের পরও বাঙলাদেশে এই ধরনের শীর্ণ রক্তধারার স্পর্শ কিছু কিছু লাগিয়াছে। ভারতবর্ষের বাহির হইতে যেটুকু আসিয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত দুই-চারিটি দেওয়া যায়। কিছু কিছু আরবী মুসলমান পরিবার বাণিজ্যব্যপদেশে বাঙলাদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছে; নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবং বাঙলার অন্যান্য জেলায়ও স্বল্পসংখ্যায় ইহাদের দর্শন মেলে। শতাব্দীর পর শতাব্দীর আবর্তে ইহারা বাঙালী মুসলমানদের সঙ্গে এক হইয়া গিয়াছে। নেগ্রিটো-রক্তসম্পৃক্ত হাবসীদের কথাও বলা যায়; বাঙলাদেশে প্রায় পাঁচ-ছয়জন হাবসী সুলতান বহুদিন ধরিয়া রাজত্ব করিয়াছেন। তাহা ছাড়া দিল্লী-আগ্রার অনুকরণে এ দেশেও হাবসী প্রহরী রাখার চলন কিছু কিছু ছিল। ইহারাও বাঙালীর রক্তেই নিজেদের রক্ত মিশাইয়াছে; তাহার কচিৎ নিদর্শন হঠাৎ চোখে পড়িয়া যায় বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের উচ্চস্তরেও। কৃষ্ণবর্ণ, প্রশস্ত নাসা, উর্ণাবৎ রুক্ষ কেশ, পুরু উলটানো ঠোঁট দেখিয়া হঠাৎ চমক লাগিয়া যায়। আরাকানী মগ প্রভাবও উল্লেখ করা যায়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুর উৎপাতে বাঙলার সমুদ্র উপকূলশালী জেলাগুলি পর্যুদস্ত হইয়াছিল; ইহারা চুরি-ডাকাতি করিয়া মেয়ে ধরিয়া লইয়া আসিত আরাকান প্রভৃতি অঞ্চল হইতে এবং এ দেশ হইতে বাহিরে লইয়া যাইত। এইসব মেয়ে বিক্রয় করাই ছিল ইহাদের ব্যাবসা। বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি স্থান ছিল এই ব্যাবসার কেন্দ্র। এইভাবে কিছু কিছু মগরক্তও বাঙালীর রক্তপ্রবাহে সঞ্চারিত হইয়াছে। ভরার মেয়ে র যে গীত ও প্রবাদ-কাহিনী আমাদের দেশে প্রচলিত তাহা বোধহয় নিরর্থক স্বপ্নকল্পনা মাত্র নয়। এইভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া বাঙলাদেশে জাতি-সমন্বয় চলিয়াছে, চলিতেছে এবং সমগ্র জীবনপ্রবাহকে সমন্বিত গতি ও রূপ দান করিতেছে।
৫. জন ও ভাষাতত্ত্ব
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – জন ও ভাষাতত্ত্ব
জন ও ভাষাতত্ত্ব
এ পর্যন্ত বাঙালীর জনতত্ত্ব বিশ্লেষণ করিয়া যাহা পাওয়া গেল ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণের মধ্যে তাহার সমর্থন কতটুকু পাওয়া যায়, তাহা এখন দেখা যাইতে পারে। এ চেষ্টা আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় একাধিকবার সার্থকভাবেই করিয়াছেন; তবু মনে হয়, জনতত্ত্ববিশ্লেষণ লব্ধ তথ্যের দিকে দৃষ্টি আর-একটু সজাগ রাখিয়া বাঙলাদেশের জন ও ভাষাপ্রবাহের আলোচনা এবং পরস্পর সম্বন্ধ-নির্ণয়ের অবকাশ এখনও যথেষ্ট আছে। বস্তুত, পশিলুস্কি, ব্লক, লেভি, বাগচী ও চট্টোপাধ্যায় মহাশয় যেদিকে গবেষণার সূত্রপাত করিয়াছেন, সেদিকে সমস্ত সম্ভাবনা এখনও নিঃশেষিত হয় নাই। বাঙলাদেশের ভৌগোলিক সংস্থান ও গ্রাম্য জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটির জ্ঞান লইয়া প্রবোধবাবু ও সুনীতিবাবুর ইঙ্গিতগুলি ফুটাইয়া তোলার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে এবং আমার বিশ্বাস সেই ফলাফলগুলি জনতত্ত্ব গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে যোগ করিলে বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক রহস্য উদঘাটিত হইবে।
ভারতবর্ষ ও পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জগুলির বিচিত্র ভাষার সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত গবেষণার ফলে আজ এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, আনাম, মালয়, তালৈঙ, খাসিয়া, কোল (অথবা মুণ্ডা), সাঁওতাল, নিকোবর, মালাক্কা প্রভৃতি ভূমির বিচিত্র বিভিন্ন অধিবাসীরা যে সব ভাষায় কথা বলে, তালৈ ও খুমের গোষ্ঠীর প্রাচীন সাহিত্য যে সব ভাষায় রচিত সেই ভাষাগুলি একই পরিবারভুক্ত। এই সুবৃহৎ ও সুবিস্তৃত ভাষা-পরিবারের পুরাতন নাম অস্ট্রো-এশীয়, আধুনিক নামকরণ অস্ট্রিক একটু মনঃসংযোগ করিলেই ধরা পড়িবে, এইসব অধিবাসীরা সকলই জন হিসাবে একই গোষ্ঠীর নয়; আনাম বা মালয়-মালাক্কা অঞ্চলে অষ্ট্রেলয়েড রক্তের সঙ্গে মোঙ্গোলীয় রক্তের বহুল সংমিশ্রণ হইয়াছে, অথচ কোল অথবা সাঁওতালদের মধ্যে মোঙ্গোলীয় প্রবাহ নাই, কিন্তু আদি-অষ্ট্রেলয়েড রক্তে অন্য জাতির রক্তপ্রবাহ কমবেশি সঞ্চারিত হইয়াছে। খাসিয়াদের তো মোটামুটি মোঙ্গোলীয় রক্তবহুলই বলা চলে। ইহা হইতে স্বতঃই অনুমান হয় ঐ সব ভূখণ্ডে সন্ধান-সম্ভাব্য আদিমতম স্তরে সর্বত্রই অস্ট্রিক ভাষার প্রচলন ছিল এবং যাহাদের মধ্যে ছিল তাহাদের পরিচয় যতটা পাওয়া যায়, তাহা হইতে দেখা যাইবে, ইহারা প্রায় সকলেই আদি-অষ্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, যেমন মুণ্ডা, কোল ও সাঁওতালেরা, ভূমিজ ও শবরেরা, মালয় ও আনাম অঞ্চলের অধিবাসীরা, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের লোকেরা। পরবর্তী কালে ইহাদের মধ্যে কমবেশি অন্য জনের রক্তসংমিশ্রণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই হইয়াছে, এমনকি অনেক জায়গায় নূতন কোনও জন তাহাদের একেবারে আত্মসাৎ হয়তো করিয়া ফেলিয়াছে, যেমন করিয়াছে মালয়ে, আনামে, নিম্ন ব্রহ্মে যেখানে তালৈ ভাষাভাষী লোকের বাস, প্রভৃতি জায়গায়; কিন্তু পুরাতন জনের ভাষা তাহারা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে এবং নানা জন বিবর্তনের ভিতর দিয়াও সেই ভাষাপ্রবাহ আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। উপরোক্ত তথ্য হইতে আর একটি তথ্য ধরা পড়ে যে, এই অস্ট্রিক ভাষা এক সময় মধ্য ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া সাঁওতাল-ভূমি, আসাম, নিম্ন ব্রহ্ম, মালয়, আনাম,নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি সমস্ত ভূখণ্ডে বিস্তৃত ছিল। লক্ষণীয় ইহাই যে, এই সমস্ত ভূখণ্ডই এক সময়ে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বাসভূমির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বলিয়াছি, উপরোক্ত ভাষাগুলি সবই অস্ট্রিক পরিবারের; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এ কথাও বলা উচিত ছিল যে, এক পরিবারভুক্ত হইলেও ইহাদের মধ্যে আত্মীয়তার তারতম্য আছে; যেমন, তালৈঙ, মন-খমরের সঙ্গে কোলগোষ্ঠীর আত্মীয়তা বেশি, খাসিয়াদের সঙ্গে নিকোবরীর। কোল-মুণ্ডা খুব সম্পন্ন গোষ্ঠী; সাঁওতাল, মুণ্ডার, ভূমিজ, হো, কোড়ো, অসুরী, খাড়িয়া, জুয়াং, শবর, গদব প্রভৃতি সকল বুলিই এই গোষ্ঠীর এবং মধ্য-ভারতের পূর্বভাগ জুড়িয়া এইসব বুলিভাষী লোকদের বাস। আশ্চর্যের বিষয়, ইহারা সকলেই আদি-অষ্ট্রেলীয়। এই কারণেই অনুমান হয়, আদি-অষ্ট্রেলীয়দের ভাষাই হয়তো ছিল যাহাকে আমরা এখন বলিতেছি অস্ট্রিক যাহা হউক, এই ভূখণ্ডের দক্ষিণেই দ্রাবিড়ভাষী জনপদ এবং তাহার ফলে বলবত্তর দ্রাবিড়ভাষা কোলভাষার ভূখণ্ডে কোথাও কোথাও ঢুকিয়া পড়িয়াছে। অথচ, এ কথা আজকাল সর্বজনস্বীকৃত যে, দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে মুণ্ডার কোনওসম্বন্ধই নাই। আবার অন্যদিকে, উত্তরে, হিমালয়ের সানুদেশে এমন কতগুলি বুলি আজও প্রচলিত যেগুলি ভোট-বর্মী গোষ্ঠীর ভাষা হইলেও তাঁহাদের এমন কতগুলি লক্ষণ আছে যাহা মুণ্ডা ভাষারই বিশিষ্ট লক্ষণ। এই লক্ষণগুলি যে সেইসব দেশে এক সময়ে বহুল প্রচারিত মুণ্ডা বা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষার লুপ্তাবশেষ, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। শতদ্রু উপত্যকর কনবার বুলি হইতে আরম্ভ করিয়া নেপালের কনায়ী, বুনান, রংকস, দারমিয়া, চৌদাংসী বিয়াংসী, ধীমাশ প্রভৃতি বুলি পর্যন্ত প্রত্যেকটিতেই এই লুপ্তাবশেষ ধরা যায়। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, অস্ট্রিক ভাষার বিস্তৃতি শুধু পূর্বোক্ত দেশগুলিতেই নয়, এক সময় উত্তর-ভারতের অনেক স্থলেই ছিল। পরবর্তী যুগে দ্রাবিড় ও আর্যভাষা পশ্চিম দিকে এবং ভোট-বর্মী ভাষা পূর্বদিকে এই ভাষাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া অধিকাংশ স্থলেই ইহকে গ্রাস করিয়া একেবারে হজম করিয়া ফেলিয়াছে; যে সব ক্ষেত্রে তাহা পারে নাই, বা নানা প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণে তাহা সম্ভব হয় নাই, সেই সব স্থানেই কোনও মতে দ্বীপের মতন আশ্রয়ের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক লোকের বুলিতে আবদ্ধ হইয়া নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে।
উত্তর ও পূর্ব ভারতের সর্বত্র (কাশ্মীরে, গুজরাতে, মহারাষ্ট্রে, কর্ণাটে, বিহারে, উড়িষ্যায়, বাঙলায়, আসামে, হিন্দুস্থানে, রাজপুতনায়, পঞ্জাবে, সীমান্তপ্রদেশে, বিশেষভাবে গাঙ্গেয় উপত্যকায় সর্বত্র) আর্যভাষার প্রবল প্রতাপ। এই আর্যভাষাই আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহন। এই আর্যভাষার প্রধান রূপ সংস্কৃত, যাহা প্রাকৃতজনের মধ্যে প্রাকৃত। এই প্রাকৃত-সংস্কৃতের অপভ্রংশ হইতে বর্তমান উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের প্রাদেশিক ভাষাগুলির উৎপত্তি।। বাঙলাভাষা তাহার মধ্যে অন্যতম। এখন, যদি এ কথা প্রমাণ করা যায় যে, এই প্রাকৃত-সংস্কৃতের ভিতর অস্ট্রিক ভাষার শব্দ ও পদরচনারীতির প্রভাব আছে (হয় তাহা নিছক অস্ট্রিকরূপে, অথবা সংস্কৃতকরণের ছদ্মবেশে) তাহা হইলে বুঝিতে হইবে আর্যভাষাভাষী লোকদের আদিমতর স্তরে অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকের বাস ছিল এবং এ তথ্যও ধরা পড়িবে যে, অস্ট্রিকভাষী লোকের যে বিস্তৃতি আমরা আগে দেখিয়াছি তাহাপেক্ষাও তাঁহাদের বিস্তৃতি আরও ব্যাপক আরও গভীর ছিল। ঠিক এই তথ্যটাই সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে প্রয়াস করিয়াছেন, পশিলুস্কি-ব্লক-লেভী বাগচী-স্টেন কোনো-চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পণ্ডিতেরা। তাঁহাদের সুবিস্তৃত ও সুগভীর গবেষণার সকল কথা বলিবার প্রয়োজন নাই; অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাহ দেখিয়া লইতে পরিবেন। আপাতত এ কথা বলিলেই ইতিহাসের প্রয়োজন মিটিতে পারে-যে, প্রাকৃতে-সংস্কৃতে হয় অস্ট্রিকরূপে না-হয় সংস্কৃত-প্রাকৃতের ছদ্মবেশে, বিশুদ্ধ প্রাকৃত-সংস্কৃত ভাষায় ও প্রাদেশিক ভাষাগুলিতে এমন অসংখ্য শব্দ ঋগ্বেদ হইতে আরম্ভ করিয়া আজ পর্যন্ত প্রচলিত আছে, এমন ব্যাকরণ ও পদরচনারীতি আছে যাহা মূলে অস্ট্রিক ভাষা হইতে গৃহীত, এবং এই গ্রহণ সুপ্রাচীন কাল হইতে আরম্ভ করিয়া অপেক্ষাকৃত আধুনিক কাল পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, বাঙালীর ইতিহাসে এমন কতগুলি শব্দ ও রীতির উদ্ধার করা যাইতে পারে, যাহা একান্তভাবে না হউক অন্তত বহুলভাবে বাঙলাদেশে এবং বাঙলার সংলগ্ন দেশগুলিতেই প্রচলিত। সব নির্ধারিত শব্দ উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তাহার তালিকা উল্লিখিত পণ্ডিতদের রচনায় পাওয়া যাইবে; আমি শুধু সেইসব শব্দই উদ্ধার করিতেছি যেগুলির সঙ্গে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ ও প্রায় অবিচ্ছেদ্য।
আসামে ও বাঙলাদেশে এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি, চার কুড়িতে (বিশ বা বিংশ নয়) এক পণ, অর্থাৎ ৮০টায় এক পণ গণনার রীতি প্রচলিত আছে। হাটে বাজারে পান, সুপারি, কলা, বাঁশ, কড়ি এমনকি ছোট মাছ ইত্যাদি দ্রব্যও এখনও এইভাবেই গণনা করিয়া ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। এই কুড়ি শব্দটি এবং এই গণনারীতিটি— দুইই অস্ট্রিক। সাঁওতালী ভাষায় উপুণ বা পুণ বা পণ কথাটির অর্থ ৮০ এবং সঙ্গে সঙ্গে ৪-ও। মূল অর্থ চার। অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের ভিতর কুড়ি শব্দ মানবদেহের কুড়ি অঙ্গুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত; কুড়িই তাঁহাদের সংখ্যাগণনার শেষ অঙ্ক এবং কুড়ি লইয়া এক মান। কাজেই এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি, চার কুড়িতে (৪x২০=৮০) এক গুণ। এই অর্থে আশিও পণ, চারও পণ। এই পণও তাহা হইলে অস্ট্রিক শব্দ। আবার কুড়ি গোণ্ড বা গণ্ডতে এক পণ (=৮০), এ-ও অস্ট্রিক ভাষারই গণনা। অর্থাৎ এক গোণ্ড বা গণ্ডতে চার সংখ্যা; প্রত্যেক কুড়িতে (৪x৫) পাঁচটি গোণ্ড। এই গোণ্ড বা গণ্ডই বাঙলায় গণ্ডা যাহা চার সংখ্যার সমান। চার কুড়িতে এক গণ্ডা। এই গণ্ড হইতেই খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয় শতকের প্রাকৃত মহাস্থান শিলালিপির গণ্ডকমুদ্রা। ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এই গণ্ডকমুদ্রার প্রচলন বাঙলাদেশে ছিল। গণ্ডক শব্দের অভিধানগত অর্থই হইতেছে; ভাগ, একপ্রকার গণনানীতি, চার সংখ্যার এক মান ধরিয়া গণনার রীতি, চার কুড়ি মূল্যের একপ্রকার মুদ্রা। দেখা গেল, এই সমস্ত গণনা পদ্ধতিটাই অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের। আর কুড়ি মুদ্রা যেখানে গণনাক্রমে এতটা স্থান অধিকার করিয়া আছে, সেখানে ইহা তো সহজেই অনুমেয় যে, এই গণনাপদ্ধতি আদিম ভারত ও বৃহত্তর ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যসমৃদ্ধ সভ্যতার সৃষ্টি। বাঙলা গুড়ি বা গুড়া ও গুটি, এই শব্দগুলিও গেণ্ড বা গণ্ডা শব্দ হইতে উদ্ভূত।
বাঙলা খাঁ খাঁ (করে ওঠা), খাঁখার (দেওয়া), বাঁখারি (বাখারি বা চেড়া বাঁশ), বাদুর, কানি (ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা), জাং (জঙ্ঘা), ঠেঙ্গ (গোড়ালি হইতে হাঁটু পর্যন্ত পায়ের অংশ), ঠোঁট, পাগল, বাসি, ছাঁচ, ছাঁচতলা, ছোচ্ঞা, কলি (চুন), ছোট, পেট, খোস (পুরাতন বাঙলায় কচ্ছু), ঝোড় বা ঝাড়, ঝোপ, পুরাতন বাঙলায় চিখিল (কাদা), ডোম (প্রাচীন বাঙলার ডোম্ব-ডোম্বী), চোঙ্, চোঙ্গা, মেড়া (=ভেড়া), বোয়াল (মাছ), করাত, দা’ বা দাও, বাইগণ (বেগুন=সংস্কৃত বাতিঙ্গন, বাতিগণ), পগার (জলময় গর্ত বা প্রণালী), গড়, বরজ (পানের), লাউ, লেবু-লেম্বু, কলা, কামরাঙ্গা, ডুমুর প্রভৃতি সমস্ত শব্দই মূলত অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। বাঙলার প্রাচীন জনপদবিভাগের মধ্যে পুণ্ড-পৌণ্ড, তামলিত্তি-তাম্রলিপ্তি-দামলিপ্তি এবং বোধ হয় গঙ্গা (নদী) ও বঙ্গ—এই দুটি নামও এই একই অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষার দান। কপোতাক্ষ ও দামোদর, অন্তত এই দুটি নদীর নামও কোল কব-দাক্ এবং দাম-দাক্ হইতে গৃহীত। কোল দা বা দাক্-জল এবং দা বা দাক্ হইতেই সংস্কৃত উদক। অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকেরা নিজেদের ভাষার কথা দিয়াই দেশের পাহাড় পর্বত নদনদী গ্রাম জনপদ ইত্যাদির নামকরণ করিয়াছিল, এই অনুমানই তো যুক্তি ও ইতিহাস সম্মত। তাহার কিছু কিছু চিহ্ন এখনও বাঙলা বুলিতে লাগিয়া আছে, যেমন শিয়ালদহ বা শিয়াল-দা, ঝিনাইদহ বা ঝিনাই-দা, বাঁশদহ বা বাঁশ দা (দহ=জলভরা গর্ত, নদীগর্ভের গর্ত); মুণ্ডা ঢেঙ্কি=বাঙলা টেকি, মুণ্ডা মোটো-বাঙলা মোটা। লেভি সাহেব তো বলেন, পুলিন্দ-কুলিন্দ, মেকল-উৎকল, উণ্ড্র-পুণ্ড্র-মুন্ডর, কোসল-তোসল, অঙ্গ-বঙ্গ, কলিঙ্গ-তিলিঙ্গ এবং সম্ভবত তক্কোল-কক্কোল, অচ্ছ-বচ্ছ, এই ধরনের জাতিবাচক যমজ নামকরণ পদ্ধতিটাই অস্ট্রিক। তাহার বচনটি উদ্ধৃতির যোগ্য—
Pulinda-Kulinda/ Mekala-Utkala (with the group Udra-Pundra-Munda), Kosala-Tosala, Anga-Vanga, Kalinga-Tilinga form the links of a long chain which extends from the eastern confines of Kashmir up to the centre of the peninsula. The Skeleton of the “ethnical system” is constituted by the hights of the central plateau; it participates in the life of all the great rivers of India except the Indus in the west and Kaveri in the south. Each of these groups forms a binary whole, each of these binary resites is united with another member of the system. In each ethnic pair the twin bears the same name, differentiated only by the initial K and T; K and P : zero and V, or M or P. This process of formation is foreign to Indo-European; it is foreign to Dravidian; it is on the contrary characteristic of the vast family of languages which are called Austro-Asiatic, and which cover in India the group of the Munda languages, often called also Kolarian.
“আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প” (অষ্টম শতক) নামক গ্রন্থে এই ভাষাগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একটি মন্তব্য আছে এবং সম্ভবত প্রচলনস্থান সম্বন্ধেও একটু ইঙ্গিত আছে। তাহা এই প্রসঙ্গে উদ্ধার করা যাইতে পারে। এই গ্রন্থের কামরাঙ্গা ফলের উৎপত্তিস্থান ছিল কর্মরঙ্গাখাদ্বীপে (-যুয়ানচোয়াঙের কামলঙ্ক, চীনা গ্রন্থের লংকীয়া, লংকীয়া-সু), নাড়িকের দ্বীপে (নারিকেল দ্বীপ), বারুসকদ্বীপে (বর্তমান, বারোস), নগ্নদ্বীপ (বর্তমান, নিকোবর) বলিদ্বীপে এবং যবদ্বীপে। এইসব দ্বীপের ভাষা, ‘র’-কার-বহুল, অস্ফুট, অব্যক্ত (অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য?) এবং নিষ্ঠুর (কর্কশ, রূঢ়)।
কর্মরঙ্গাখাদ্বীপেযু নাড়িকের সমুদ্ভবে।
দ্বীপে বারুসকে চৈব নগ্ন বলি সমুদ্ভবে।।
যবদ্বীপে বা সত্ত্বেষু তদন্যদ্বীপসমুদ্ভবা।
বাচ রকারবহুলা তু বাচা অস্ফুটাং গতা।।
অব্যক্তা নিষ্ঠুরা চৈব সক্রোধপ্রেতযোনীষু।
যে বৈশিষ্ট্যের কথা “মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পে”র লেখক উল্লেখ করিয়াছিলেন, আর্যভাষার দৃষ্টিভঙ্গী হইতে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা সম্বন্ধে তাহা বলা কিছু অযৌক্তিক নয়। অস্ট্রিক ভাষায় ল’ ও ‘র’র বাহুল্য সত্যই লক্ষ করিবার মতো। এই অসুর ভাষাভাষী লোকদেরই ঋগ্বেদে অসুর বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে বলিয়া মনে করিলে অন্যায় হয় না।
“আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প” গ্রন্থের আর একটি সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থকারের মতে বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, গৌড় ও পুণ্ডের লোকেরা অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গের লোকেরা অসুর ভাষাভাষী : “অসুরানাং ভবেৎ বাচা গৌড়পুণ্ড্রোদ্ভবা সদা”। কোল-মুণ্ডা গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান বুলির নাম এখনও অসুর বুলি; কাজেই এই বুলিই একসময় গৌড়ে-পুণ্ডে বহুলপ্রচলিত ছিল, এ অনুমান সহজেই করা চলে। মধ্য-ভারতের পূর্বখণ্ডে যে সব লোকেরা অসুর বুলিতে কথা বলিত তাহারা আদি-অষ্ট্রেলীয় পরিবারের লোক, সে সম্বন্ধে সন্দেহ বোধ হয় নাই। গৌড়-পুণ্ডের আদিমতম স্তরেও এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বিস্তৃতি ছিল, এ কথাও নরতত্ত্ববিশ্লেষণ হইতে আগেই জানা গিয়াছে। ভাষার সাক্ষ্য হইতেও তাহা অনেকটা পরিষ্কার হইল। “মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে”র গ্রন্থকার তাহা পরিষ্কার করিয়াই বলিলেন। আসামেও যে প্রাচীনতর কালে এই অসুর-ভাষাভাষী লোকের বিস্তৃতি ছিল, তাহা অনুমানেরও একটু কারণ আছে। কামরূপের বর্মণ রাজবংশের আদিপুরুষ সকলেই অসুর বলিয়া পরিচিত; অন্তত, সপ্তম শতকের রাজারা তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের অসুর বলিয়াই জানিতেন এবং মহিরাঙ্গ অসুর, দানবাসুর, হটকাসুর, সম্বরাসুর, রত্নাসুর, নরকাসুর প্রভৃতি পূর্বপুরুষদের বংশধর বলিয়াই নিজেদের পরিচয় দিয়াছেন। ইহারা অসুর ভাষাভাষী ছিলেন বলিয়াই কি ইহাদের নামে তাহার চিহ্ন থাকিয়া গিয়াছে।
আর-একটি প্রাচীনতর সাক্ষ্য উদ্ধৃত করিয়াই এই অস্ট্রিক আদি অষ্ট্রেলীয় প্রসঙ্গ শেষ করিব। জৈনদের “আচারাঙ্গসূত্র” গ্রন্থে উল্লেখ আছে, মহাবীর (খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক) যখন পথহীন লাঢ় (রাঢ়দেশ), বজ্জভূমি ও সুব্ভভূমিতে (মোটামুটি, দক্ষিণ-রাঢ়) প্রচারোদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন, তখন এইসব দেশের অধিবাসীরা তাহাকে আক্রমণ করিয়াছিল। কতকগুলি কুকুরও সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাকে কামড়াইতে আরম্ভ করে, কিন্তু কেহই এই কুকুরগুলিকে তাড়াইয়া দিতে অগ্রসর হয় নাই। বরং লোকেরা সেই জৈন ভিক্ষুকে আঘাত করিতে আরম্ভ করে এবং ছু ছু (খুক্খু) বলিয়া চীৎকার করিয়া তাহাকে কামড়াইবার জন্য কুকুরগুলিকে লেলাইয়া দেয়। বাঙলাদেশে এখনও লোকে কুকুর ডাকিবার সময় চু চু বা তু তু বলে। অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীতে কুকুরের প্রতিশব্দ হইতেছে ছক্ (খ্মের), ছ্যুকে (কোন্ টু), ‘ছো’ (প্রাচীন খ্মের), ‘ছো’ (আনাম, সেদাং, কাসেং), ‘অছো’ (তারেং), ‘ছু’ (সেমাং), ‘ছুও’, ‘ছু-ও’ (সাকেই)। এই তথ্য হইতে বাগচী মহাশয় মনে করেন যে, বাংলা চু চু বা তু তু মূলত অস্ট্রিক প্রতিশব্দ হইতেই গৃহীত এবং চু চু বা তু তু বলিতে কুকুরার্থক বাঙলা দেশজ শব্দ; ওটা শুধু ধ্বন্যাত্মক ডাক মাত্র নয়, চু চু বা তু তু বলিতে কুকুরই বুঝায়। এ অনুমান সত্য হইলে রাঢ়ে-সুহ্মে খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা প্রচলিত ছিল, তাহাও স্বীকার করিতে হয়। আর, ছিল যে তাহার অন্য প্রমাণ, এই দুই ভূখন্ডে এখনও অস্ট্রিকভাষাভাষী পরিবারভুক্ত অনেক সাঁওতাল ও কোলদের বাস দেখিতে পাওয়া যায়।
অস্ট্রিক ভাষা হইতে যেমন, ঠিক তেমনই দ্রাবিড় ভাষা হইতেও আর্যভাষা সংস্কুতে-প্রাকতেঅপভ্রংশে অনেক শব্দ, পদরচনা ও ব্যাকরণ-রীতি ইত্যাদি ঢুকিয়া পড়িয়াছে। আর্যভাষাভাষী লোকেরা যে দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের সংস্পর্শে আসিয়াছিল, এই তথ্য তাহার প্রমাণ। সংস্কৃত ভাষা বিকাশের বিভিন্ন স্তরে এবং প্রাকৃত-অপভ্রংশ হইতে উদ্ভূত বাঙলা ভাষায় এই দ্রাবিড় স্পর্শ কোন দিকে কতখানি লাগিয়াছে, তাহার ইঙ্গিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় দিয়াছেন কতকটা বিস্তৃতভাবেই। এখানে তাহার সকল কথা বলিবার প্রয়োজন নাই; অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাহা দেখিয়া লইতে পারেন। তাহার বহু শ্রম ও বহু মনন-লব্ধ গবেষণার ফলাফল আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; এই গৌরব সমগ্র বাঙালী জাতির। বক্ষ্যমাণ বিষয়ে তাহার বক্তব্য এই;
ls there any evidence about the class of speech that prevailed in Bengal before the coming of the Aryan tongue 2 There is, of course, the preserve of Kol and Dravidian (the Santals, the Malers, the Oraons) in the western fringes of the Bengali area, and of the Boda and Mon-Khmer speakers in the northern and eastern frontiers. There are, again, some unmistakably Dravidian affinities in Bengali phonetics, morphology, syntax and vocabulary; but these agreements with Dravidian are not confined to Bengali alone but are found in other NIA (New Indo-Aryan) also. Apart from that, local nomenclature in Bengal may be expected to throw some light on the question. The study of Bengali toponomy is rendered extremely difficult from the fact that old names, when they were not Sanskrit, have suffered from mutilation to such an extent that it is often impossible to reconstruct their original forms; especially when they are non-Aryan. Fortunately for us Bengal inscriptions, from the 5th century onwards, like the inscriptions found elsewhere in India, and occasionally works written in pre-Moslem Bengal, have preserved old forms of some scores of these names. But it is a pity that generally there was an attempt to give these names a Sanskrit look.
তৎসত্ত্বেও এইসব লিপি হইতে অসংখ্য নাম ও প্রমাণ উদ্ধার করিয়া সুনীতিবাবু দেখাইয়াছেন যে নামগুলিতে দ্রাবিড় প্রভাব সুস্পষ্ট। তাহার সুদীর্ঘ তালিকা উদ্ধার করিতে গেলে প্রসঙ্গের বিস্তৃতি বাড়িয়া যাইবার আশঙ্কায় আমি আর তাহা করিলাম না। তিনি আরও বলেন,
In the formation of these names, we find some words which are distinctly Dravidian; e.g.-jola, jota, joti-jotika etc.; hitti, hitthi-vithi, -hist (h)i etc.; -gadda, -gaddi; pola-vola and probably also, -handa. -vada, -kunda, -kundi, and cavati, cavada etc.; and besides there are many others which have a distinct non-Aryan look. The last word, as in Pindara-viti-jotika, Uktara-yota (jota), Dharmmavo-jotika, Nada-joti, Camyala-joti, Sik (ph)-gadi-joti, meaning channel, water-course, river, water, is found in modern Bengal place-names. …An investigation of place-names in Bengal, as in other parts of Aryan India, is sure to reveal the presence of non-Aryan speakers, mostly Dravidian, all over the land before the establishment of the Aryan tongue.
এই প্রসঙ্গে অসংখ্য প্রাচীন ও বর্তমান বাঙলাদেশের স্থানের নাম, নামের উপান্ত ‘ড়া’ (বাঁকুড়া হাওড়া রিষড়া, বগুড়া), গুড়ি (শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি), জুলি (নয়নজুলি), জোল, (নাড়াজোল), জুড় (ডোমজুড়), ভিটা, কুণ্ডু প্রভৃতি শব্দ উদ্ধার করিয়া তিনি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করিয়াছেন যে, ইহারা দ্রাবিড় ভাষার।
কিন্তু, নরতত্ত্ববিদের কাছে এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের সমস্যা বড় জটিল। সাম্প্রতিক নরতাত্ত্বিক পরিভাষায় দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর কোনও অস্তিত্বই নাই। দ্রাবিড় ভাষার নাম; নরগোষ্ঠীর নয়। প্রাক্-আর্য যুগে এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোক কাহারা ছিল? ঐতিহাসিক যুগে দামিল-দ্রমিল-তামিল জাতির লোকদের ভাষা দ্রাবিড় সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহারা কাহাদের বংশধর?
পূর্বে নরতত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা গিয়াছে, আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর পর একে একে তিনটি দীর্ঘমুণ্ড জাতি ভারতবর্ষের জনপ্রবাহে বাপাইয়া পড়িয়াছিল। ইহাদের মধ্যে দ্বিতীয় ধারাটি পাঞ্জাব অতিক্রম করিয়া পূর্বে বা দক্ষিণে বোধ হয় আর অগ্রসর হইতে পারে নাই। প্রথম ধারাটি মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল এবং সেখানে পূর্বতন আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে তাঁহাদের খানিকটা সংমিশ্রণও এবং এই ধারাটিই হরপ্পা, মহেন-জো-দড়োর প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার জননী। ইহার বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল উত্তর-ভারতের সর্বত্র. তবে উত্তর-পূর্ব ভারতে গঙ্গা-যমুনার উপত্যকায় পূর্বতন আদি-অষ্ট্রেলীয় কোল-মুণ্ডা-শবর-নিষাদ-অসুরদের বিস্তৃতি ও প্রতাপ প্রবলতর থাকায় ইহারা বিন্ধগিরি অতিক্রম করিয়া দক্ষিণ-ভারতে ছড়াইয়া পড়িতে বাধা হয়। পরবর্তী কালে অ্যালপো-দীনারীয় ও আদি-নর্ডিক আর্যভাষাভাষী জাতির বিভিন্ন তরঙ্গাঘাতে উত্তর ভারত হইতেও ইহারা ক্রমশ স্তরে স্তরে পূর্বে ও দক্ষিণে ছড়াইয়া পড়িতে বাধ্য হয়। এই প্রথম ও তৃতীয় ধারার দীৰ্ঘমুণ্ড দুইটি নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে যে জন গড়িয়া উঠে তাহারাই খুব সম্ভব দ্রাবিড়ভাষাগোষ্ঠীর বর্তমান তামিল-তেলুগু-মালয়ালী-ভাষাভাষী লোকদের পূর্বপুরুষ। তবে, সিন্ধুনদের নিম্ন-উপত্যকায় বেলুচিস্থানের দ্রাবিড়ভাষী ব্রাহুইদের অস্তিত্ব হইতে অনুমান হয়, এই দ্রাবিড় ভাষা ছিল সিন্ধু উপত্যকাস্থিত তৃতীয় ধারার দীর্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠীর ভাষা; অবশ্য এই অনুমান যথেষ্ট সিদ্ধ বলিয়া কিছুতেই গণ্য হইতে পারে না। যাহাই হউক, বাঙলাদেশে দ্রাবিড় ভাষার প্রচলনের দায়িত্ব প্রধানত এই দুই ধারার দীর্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠী দুইটির।
অ্যালপো-দীনারায় জাতির লোকেরা আর্যভাষাভাষী, কিন্তু তাঁহাদের ভাষার স্বরূপ কী ছিল, তাহা সঠিক বলিবার উপায় প্রায় নাই বলিলেই চলে। গ্ৰীয়ার্সন সাহেব গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যভারত, উড়িষ্যা, কতকাংশে বিহার, বঙ্গদেশ ও আসামের outer Aryans বা বেদ বহির্ভূত যে সব আর্যভাষাভাষী লোকদের কথা বলেন এবং বৈদিক আর্যভাষা হইতে উদ্ভূত সিন্ধু-গঙ্গা উপত্যকার হিন্দী, রাজস্থানী প্রভৃতি ভাষা হইতে পৃথক গুজরাতী, মারাঠী, ওড়িয়া, বাঙলা, অহমীয়া প্রভৃতি আর্যভাষার যে কথা ইঙ্গিত করেন তাহা যদি সত্য হয় তাহা হইলে বাঙলা, মারাঠী, ওড়িয়া, গুজরাতী, অহমীয়া ইত্যাদি ভাষার মূল, প্রধান ও বিশিষ্ট রূপই যে অ্যালপো-দীনারায় জাতির ভাষারূপ তাহা অস্বীকার করিবার উপায় থাকে না। কারণ, গ্ৰীয়ার্সনের এই “Outer Aryans” যে অ্যালপাইন জাতিরই অন্যতম শাখা রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বহুদিন আগেই তাহা সুপ্রমাণ করিয়াছেন এবং নরতত্ত্ববিদেরা প্রায় সকলেই তাহা স্বীকার করেন।
মোঙ্গোলীয় ভোট-ব্রহ্ম ভাষার প্রভাব প্রাচীন অথবা বর্তমান বাঙলায় প্রায় নাই বলিলে খুব অযৌক্তিক হয় না। নরতত্ত্বের দিক হইতে মোঙ্গোলীয় রক্তপ্রবাহ বাঙালীর মধ্যে যেমন ক্ষীণ ও শীর্ণ মোঙ্গোলীয় ভাষা-প্রভাবও তাহাই। তবে উত্তরতম ও পূর্বতম প্রান্তের মোঙ্গোলস্পষ্ট লোকদের ভিতর চলতি বুলিতে কিছু ভোট-ব্রহ্ম শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। আর, অন্তত একটি নদীর নাম যে ভোট-ব্রহ্ম ভাষা হইতে গৃহীত তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায়; এই নদীটি দিস্তাং বা তিস্তা যাহার পরবর্তী সংস্কৃত রূপ ত্রিস্রোতা।
যাহা হউক, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও বেদ বহির্ভূত আর্যভাষা প্রবাহের উপর তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসিয়া ভাঙিয়া পড়িল বৈদিক আর্যভাষা প্রবাহের প্রবল স্রোত। একদিনে নয়, দু-দশ বৎসরে নয়, শত শত বৎসর ধরিয়া এবং কালে কালে ক্রমে ক্রমে এই ভাষা সমস্ত পূর্বতন ভাষা-প্রবাহকে আত্মসাৎ করিয়া তাহাদের নবরূপ দান করিয়া, তাঁহাদের সংস্কৃতিকরণ সাধন করিয়া নিজের এক স্বতন্ত্র রূপ গড়িয়া তুলিল। তাহার ফলে যে সংস্কৃত ভাষার বিকাশ হইল তাহাতে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় শব্দ, পদবচনারীতি, ব্যাকরণ পদ্ধতি সমস্তই কিছু কিছু ঢুকিয়া পড়িল। সাম্প্রতিক কালে শব্দ ও ভাষাতাত্ত্বিকেরা তাহা অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিতেছেন। বাঙলাদেশেও তাহার প্রচলন হইল, কিন্তু দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শতকের সংস্কৃত লিপিগুলিতে দেখা যাইবে, সেই সংস্কৃত ভাযায়ও এমন সব শব্দের দেখা পাওয়া যাইতেছে, এমন ব্যাকরণ বৈশিষ্ট্যের দর্শন মিলিতেছে যাহা বাঙলার বাহিরে দেখা যায় না; ‘বরজ’, ‘ডালিম্ব’ (সংস্কৃত দাড়িম্ব নয়), লগ্গাবয়িত্বা (লাগাইয়া অর্থে) ইত্যাদি তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র।
একান্তভাবে ভাষার দিক হইতে এই আর্যীকরণ সম্বন্ধে সুনীতিকুমার যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্ধারযোগ্য। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই উদ্ধৃতির ভিতর আর্য বা অনার্য বলিতে তিনি আর্য ভাষা ও অনার্য ভাষাকেই বুঝাইতেছেন; যেখানে আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী বলিতেছেন, সেখানেও আমি আর্য বা অনার্য ভাষাভাষী নরগোষ্ঠী হিসাবেই বুঝিতেছি, কারণ, আমি আগেই বলিয়াছি, নরতত্ত্বের দিক হইতে আর্য-নরগোষ্ঠী বা দ্রাবিড়-নরগোষ্ঠী— এই ধরনের কথা ব্যবহার করা অযৌক্তিক। অ্যালপো-দীনারায় নরগোষ্ঠীর লোকেরাও আর্যভাষাভাষী, আবার আদি-নর্ডিকেরাও তাহাই; আর দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের মধ্যে যে বিভিন্ন জন বিদ্যমান, সে ইঙ্গিতও আগেই করিয়াছি। এই কথাটা যাহাতে আমরা বিস্মৃত না হই সেই জন্য বন্ধনীর ভিতর আমি তাহা উল্লেখ করিয়া দিতেছি।
“ভারতবর্ষের সু-সভ্য, অর্ধ-সভ্য ও অ-সভ্য, সব রকমের অনার্য [ভাষাভাষী] আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে আর্য [ভাষী]দের প্রথম সংস্পর্শ হয়তো বিরোধময়ই হইয়াছিল। কিন্তু অনার্য [ভাষাভাষী] ভারতে আর্য [ভাষী]দের উপনিবেশ স্থাপিত হইবার পর হইতেই উভয় শ্রেণীর মানুষ—অনার্য [ভাষী] ও আর্য [ভাষী]–পরস্পরের প্রতিবেশ-প্রভাবে পড়িতে থাকে। আর্য [ভাষী]রা বিদেশ হইতে আগত এবং পার্থিব সভ্যতায় তাহারা খুব উচ্চে ছিল না। আর্য [ভাষী]দের ভাষা আসিয়া দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক ভাষাগুলিকে হীনপ্রভ করিয়া দিল; উত্তর-ভারতের কোল ও দ্রাবিড় [ভাষী] অনার্য ভাষীদের মধ্যে ঐক্যবিষয়ক ভাষার অভাব ছিল, আর্য [ভাষী] নরগোষ্ঠীর বিজেতৃ-মর্যাদা লইয়া আর্যভাষা সে অভাব পূর্ণ করিল। …আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠীর] ভাষা ও আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠীর] ধর্ম—বৈদিক ধর্ম ও বৈদিক হোম-যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান—অনার্য [ভাষী]রা শিরোধার্য করিয়া লইল; অনার্যা[ভাষী] আর্য[ভাষী]র পুরোহিত-ব্রাহ্মণের শিক্ষাও মানিল। কিন্তু অনার্যা[ভাষী] নরগোষ্ঠীর ধর্ম মরিল না, তাঁহাদের ইতিহাস-পুরাণও মরিল না; ক্রমে অনার্যা[ভাষী] নরগোষ্ঠীর ধর্ম ও অনুষ্ঠান পৌরাণিক দেবতাবাদে পৌরাণিক পূজাদিতে, যোগচৰ্যায়, তান্ত্রিক মতবাদে ও অনুষ্ঠানে আর্যভাষীদের বংশধরদিগের দ্বারাও গৃহীত হইল। আর্য ও অনার্য ভাষা[ভাষী] নরগোষ্ঠী] এই টানা ও পড়িয়ান মিলাইয়া হিন্দু-সভ্যতার বস্ত্রবয়ন করা হইল।
“উত্তর-ভারতের গঙ্গাতীরের আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠীর] সভ্যতার পত্তন এইরূপে হইল। এই সভ্যতায় আর্য[ভাষী নরগোষ্ঠী] অপেক্ষা অনার্যা[ভাষী নরগোষ্ঠী]র দানই অনেক বেশি–কেবল আর্য[ভাষী]দের ভাষা ইহার বাহন হইল। আর্য[ভাষী]দের আগমনের সময় হইতেই হইতেছিল; গঙ্গাতীরবর্তী দেশসমূহে ইহা আরও অধিক পরিমাণে হইল।. বাঙলাদেশে আর্য-ভাষা লইয়া যখন উত্তর-ভারতের—বিহার ও হিন্দুস্থানের—লোকেরা দেখা দিল, যখন উত্তর-ভারতের মিশ্র আর্য-অনার্য[ভাষী নরগোষ্ঠী] সৃষ্ট ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন মতবাদ বাঙলাদেশে আসিল, তখন উত্তর-ভারতে মোটামুটি এক সংস্কৃতি ও এক জাত হইয়া গিয়াছে। রক্তের বিশুদ্ধি বোধহয় তখন কোনও আর্যভাষী বংশীয়ের ছিল না।”
ভাষা-বিশুদ্ধিও যে ছিল আর্যভাষী নরগোষ্ঠীর তাহাও তো মনে হয় না।
৬. জনপ্রবাহ ও বাস্তব সভ্যতা
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – জনপ্রবাহ ও বাস্তব সভ্যতা
জনপ্রবাহ ও বাস্তব সভ্যতা
সংক্ষেপে জনতত্ত্ব ও ভাষাপ্রসঙ্গ লইয়া বাঙালীর গোড়াপত্তনের কথা বলা হইল। এইবার বাস্তব সভ্যতার উপাদান-উপকরণ এবং তাহার সঙ্গে বাঙালীর ও বাঙলাদেশের সম্বন্ধের একটা দিগদর্শন করিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে।
ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। এই কৃষিই আমাদের প্রধান ধনসম্বল; এবং উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যপাদ পর্যন্ত যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারা আমাদের দেশে চলিয়া আসিয়াছে তাহাকে যদি একান্তভাবে কৃষি-সভ্যতা ও সংস্কৃতি আখ্যা দেওয়া যায় তাহা হইলে খুব অন্যায় হয় না। বারিবহুল নদনদীবহুল সমতলপ্রধান বাঙলাদেশে উত্তর ভারতের অন্য প্রদেশাপেক্ষা কৃষির এক সমৃদ্ধতর রূপ দেখা যায়। এই কৃষিকার্য যে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অষ্ট্রেলীয় লোকেরাই আমাদের দেশে প্রচলন করিয়াছিলেন, তাহা অনুমান করিবার কারণ আছে। পুশিলুস্কি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করিয়াছেন যে, ‘লাঙ্গল’ কথাটাই অস্ট্রিকভাষীদের ভাষা হইতে গৃহীত। আনামীয় ভাষায় এই লাঙ্গল শব্দের মূলের অর্থ ‘চাষ করা’ এবং ‘চাষ করিবার যন্ত্র’ দুই বস্তুকেই বুঝায়। খুব প্রাচীনকালেই লাঙ্গল শব্দটি আর্যভাষায় গৃহীত হইয়াছিল। ইহার অর্থ বোধহয় এই যে, আর্যভাষীরা চাষকার্য জানিতেন না এবং সেইহেতু যে যন্ত্রদ্বারা চাষ করা হয় সে যন্ত্রের সঙ্গেও তাঁহাদের পরিচয় ছিল না। এই দুইই তাঁহারা পাইয়াছিলেন মূলত অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের নিকট হইতে। তীক্ষ্ণমুখ কাষ্ঠদণ্ড যন্ত্রের সাহায্যে প্রধানত যে বস্তুর চাষ এই অস্ট্রিকভাষী লোকেরা করিত তাহা ধান, এবং এই ধানই ছিল তাঁহাদের প্রধান খাদ্যবস্তু। অস্ট্রিকভাষী লোকেদের ভিতর যে কৃষিসভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে মনে হয়, সমতলভূমিতে ও স্তরে স্তরে পাহাড়ের গা কাটিয়া চাষের ব্যবস্থা করিয়া তাহারা বন্য ধানকে লোকালয়ের কৃষিবস্তু করিয়া লইয়াছিল এবং তাহাই ছিল তাঁহাদের প্রধান উপজীব্য। অস্ট্রিকভাষী লোকদের বিস্তৃতি ভারতবর্ষে যে যে স্থানে ছিল সর্বত্রই এই ধানচাষেরও প্রচলন হইয়াছিল; তবে বারিবহুল নদনদীবহুল সমতলভূমিতেই যে ধান বেশি জন্মাইত, ইহা তো খুবই স্বাভাবিক। সেইজন্যই আসামে, বাঙলাদেশে, ওড়িশায়, দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রশায়ী সমতল দেশগুলিতে তাহা প্রসারলাভ করিয়াছিল বেশি; উত্তর ভারতে তত নয়। এখনও তাহাই। পরবর্তী কালে দ্রাবিড়ভাষী দীর্ঘমুণ্ড লোকেরা ভারতবর্ষে যব ও গমচাষের প্রচলন করে এবং যব ও গম উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমশ বিহার পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়ে। যব ও গম ধানের মতো তত বারিনির্ভর নয়; উত্তর ভারতে এই দুই বস্তুর চাষের বিস্তৃতি অনেকটা সেই কারণেই। জন-বিস্তৃতি ও জলবায়ুর কারণ দুটি একত্র করিলেই বুঝা যাইবে, উত্তর ভারতের লোকেরা কেন আজ পর্যন্তও সাধারণত রুটিভুক এবং বাঙলা-আসাম-ওড়িশা ও দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রশায়ী সমতলভূমির লোকেরা কেন ভাত-ভুক।
ধান ছাড়া অস্ট্রিকভাষী লোকেরা কলা, বেগুন, লাউ, লেবু, পান (বর), নারিকেল, জাম্বুরা (বাতাবি লেবু), কামরাঙ্গা, ডুমুর, হলুদ, সুপারি, ডালিম ইত্যাদিরও চাষ করিত। এই কৃষিদ্রব্যের নামের প্রত্যেকটিই মূলত অষ্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষা হইতে গৃহীত, এবং ইহার প্রত্যেকটিই বাঙালীর প্রিয় খাদ্যবস্তু। এইসব শব্দের সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশ ও বাঙলা রূপ লইয়া যে সব সুবিস্তৃত বিচার ও গবেষণা হইয়াছে তাহার মধ্যে ইতিহাসের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আমি সেই শব্দতাত্ত্বিক আলোচনার বিস্তৃত পুনরুক্তির অবতারণা এখানে আর করিলাম না। কিন্তু চাষবাসের সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ হইলেও গো-পালন ইহারা জানিত বলিয়া মনে হয় না। বস্তুত, অস্ট্রিকভাষী লোকদের মধ্যে আজও গো-পালনের প্রচলন কম; যাহাদের মধ্যে আছে তাহারা পরবর্তী কালে আর্যভাষীদের নিকট হইতে তাহা গ্রহণ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। যতদূর সম্ভব, গো-পালন আর্যভাষীদের সঙ্গে জড়িত।
তবে, তুলার কাপড়ের ব্যবহারও অস্ট্রিকভাষীদের দান ৷ কর্পাস (কার্পাস) শব্দটিই মূলত অষ্টিক। তাঁতী বা তত্ত্ববায়েরা যে প্রাচীন ও বর্তমান বাঙালী সমাজের নিম্নতর স্তরের ইহার মধ্যে কি তাহার কিছুটা কারণ নিহিত? পট (পট্টবস্ত্র, বাঙলা পট্, পাট), কর্পট (= পট্টবস্ত্র) এই দুটি শব্দও মূলত অস্ট্রিক ভাষা হইতে গৃহীত। মেড়া বা ভেড়ার সঙ্গে ইহারা পরিচিত ছিল। ভেড়ার লোম কি ইহারা কাজে লাগাইত? ‘কম্বল’ কথাটি কিন্তু মূলত অস্ট্রিক, এবং আমরা যে অর্থে কথাটি ব্যবহার করি, সেই অর্থেই এই ভাষাভাষী লোকেরাও করে।
বুঝা গেল, অস্ট্রিকভাষী আদি অষ্ট্রেলীয়েরা ছিল মূলত কৃষিজীবী। কিন্তু ইহাদের সবারই জীবিকা ছিল কৃষিকার্য, এ কথা বলা যায় না। কতকগুলি শাখা অরণ্যচারীও ছিল। এই অরণ্যচারী নিখাদ ও ভীল, কোল শ্রেণীর শবর, মুণ্ডা, গদব, হো, সাঁওতাল প্রভৃতিরা প্রধানত ছিল পশুশিকারজীবী এবং পশু-শিকারে ধনুর্বাণই ছিল তাঁহাদের প্রধান অস্ত্রোপকরণ। বাণ, ধনু বা ধনুক, পিনাক -এই সব-কটি শব্দই মূলত অস্ট্রিক। ইহারা যে সব পশুপক্ষী শিকার করিত, অনুমান করা। তাঁহাদের মধ্যে হাতি, মেড়া (ভেড়া), কাক, কর্কট (কাঁকড়া) এবং কপোতের (যাহার অর্থ – পায়রাই নয়, যে কোনও পক্ষী) নাম করা যাইতে পারে। গজ, মাতঙ্গ, গণ্ডার (হস্তী অর্থে) এবং কপোত মূলত অস্ট্রিক ভাষা হইতে গৃহীত। অন্যান্য অস্ত্রোপকরণের মধ্যে দা ও করাতের নামোল্লেখ করা যায়; ইহারাও অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষালব্ধ বলিয়া শব্দতাত্ত্বিকেরা অনুমান করেন।
গমুদ্রতীরশায়ী দেশ, দ্বীপ ও উপদ্বীপবাসী অষ্ট্রিকভাষী মেলানেশীয়, পলিনেশীয় প্রভৃতি লোকেরা জলপথে যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য গুঁড়ি কাঠের একপ্রকার লম্বা ডোঙা (এই কথাটিও অস্ট্রিক) এবং লম্বা লম্বা খণ্ড খণ্ড গুঁড়িকাঠ একত্র করিয়া ভাসমান ভেলার আকারে বড় বড় নৌকা তৈয়ারি করিত, এ তথ্য জনতত্ত্ববিদেরা আবিষ্কার করিয়াছেন। গুঁড়িকাঠের তৈরি ডিঙ্গা, ছোট নৌকা এখনও নদীখালবিলবহুল নিম্ন, পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে বহুল প্রচলিত। যাহাই হউক, এইসব ডোঙ্গা, ডিঙ্গা ও ভেলায় চড়িয়াই প্রাচীন অস্ট্রিকভাষী লোকেরা নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াত করিত এবং এইভাবেই তাহারা একটা বৃহৎ সামুদ্রিক বাণিজ্যও গড়িয়া তুলিয়ছিল। বস্তুত, বাঙলা তথা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অস্ট্রিকভাষী জাতিদের দানের এত প্রাচুর্য দেখিয়াই লেভি সাহেব বলিয়াছিলেন :
We must know whether the legends, the religion and the philosophical thoughts of India do not owe anythingtothis past. India had been too exclusively examined from the Indo-European stand-point. It ought to be remembered that India is a great maritime country… the movement which carried the Indian colonisation (in historical times) towards the Far East was far frominaugurating a new route. Adventurers, traffickers and missionaries profited by the technical progress of navigation and followed under better conditions of comfort and efficiency, the way traced from time immemorial, by the mariners of another race, whom Aryan or Aryanised India despised as savages.
নির্মলকুমার বসু মহাশয় আর-একটি জনগত তথ্যের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। এই প্রসঙ্গে তাহার উল্লেখ অযৌক্তিক নয়। আসামে, বাঙলাদেশে, ওড়িশায়, দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র, গুজরাতে, মহারাষ্ট্রে সকল স্থানেই লোকেরা সাধারণত রান্নার কাজে সরিষা, নারিকেল অথবা তিলতৈল ব্যবহার করিয়া থাকে। সেলাইবিহীন উত্তর ও নিম্নবাস (সাধারণত ধুতি, চাদর, উড়ুনি, উত্তরীয় ইত্যাদি) ব্যবহারই এইসব দেশের জনসাধারণের পরিধেয়। আর, যে পাদুকার ব্যবহার ইহারা করে তাহার পশ্চাদ্ভাগ উন্মুক্ত। বিহারের পশ্চিম প্রান্ত হইতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত ভূখন্ডের অধিবাসীরা কিন্তু পরিবর্তে ব্যবহার করে ঘৃত বা কোন প্রকার জান্তব চর্বি, সেলাই-করা জামাকাপড় এবং বদ্ধ-গোড়ালি পাদুকা। এই পার্থক্যের মধ্যে জন-পার্থক্যের ইঙ্গিত যে আছে তাহা একেবার উড়াইয়া দেওয়া যায় না, কারণ, জলবায়ুর পার্থক্যদ্বারা ইহার সবটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
এ পর্যন্ত অস্ট্রিকভাষী আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সম্বন্ধে যাহা বলা হইলে তাহা হইতেই বুঝা যাইবে, ইহাদের মধ্যে যে সব শ্রেণী সভ্য তাহারা যে বাস্তব সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়ছিল তাহা গ্রামীণ, একান্তভাবে গ্রামকেন্দ্রিক। কৃষিজীবী বলিয়া খাদ্যাভাব ইহাদের মধ্যে বড় একটা ছিল না এবং লোকসমৃদ্ধিও যথেষ্ট ছিল, এ অনুমানও করা যাইতে পারে। বর্তমান অস্ট্রিকভাষী লোকদের সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয় যে, ইহাদের কোনও কোনও প্রাগ্রসর শাখার সমাজবন্ধন নিজেদের গ্রাম অতিক্রম করিয়াও বিস্তৃত হইত। মুণ্ডাদের মধ্যে কয়েকটি গ্রাম মিলিয়া গ্রামসঙ্ঘের মতো একটা সমাজ বন্ধন এখনও দেখা যায়। শরৎকুমার রায় মহাশয় তো মনে করেন, “পঞ্চায়েত প্রথা সম্ভবত ভারতে প্রথম ইহাদেরই প্রবর্তিত। পঞ্চায়েতকে ইহারা সত্যসত্যই ধর্মাধিকরণ জ্ঞানে মান্য করে। এখনও আদালতে সাক্ষ্য দিবার পূর্বে মুণ্ড সাক্ষী তাহার জাতি-প্রথা অনুসারে পঞ্চের নাম লইয়া এই বলিয়া শপথ করে, ‘সিরমারে-সঙ্গরোঙ্গ ওতেরে পঞ্চ’, অর্থাৎ আকাশে সূর্য-দেবতা পৃথিবীতে পঞ্চায়ত।” তিনি এ কথাও বলেন যে, “ইহাদের মধ্যে কোন কোন জাতির কিংবদন্তী আছে যে, এক সময়ে ভারতে ইহাদের ক্ষুদ্র বা বৃহৎ গণতন্ত্র(?)” রাজ্য ছিল। রাজশক্তির চিহ্নস্বরূপ মুণ্ডা, ওঁরাও প্রভূতি জাতির প্রত্যেক গ্রামসঙ্ঘ ও গ্রামে এখনও বিভিন্ন চিহ্ন-অঙ্কিত পতাকা সযত্নে ও সসম্মানে রক্ষিত হয়। মধ্যপ্রদেশে দ্রাবিড় [ভাষী] পূর্ব গন্দ জাতির শক্তিশালী সমৃদ্ধ রাজ্য আধুনিক কাল পর্যন্ত ছিল। গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় রাজ্যাধিকারের কিংবদন্তী মুণ্ডা প্রভৃতি কয়েকটি জাতির মধ্যে এখনও বর্তমান।”
অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের বাস্তব সভ্যতার কিছুটা আভাস পাওয়া গেল এবং সে সভ্যতা বাঙলাদেশে কতখানি বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল তাহারও খানিকটা ধারণা ইহার ভিতর পাওয়া গেল। দীর্ঘমুণ্ড দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকদের বাস্তব সভ্যতার উপাদান-উপকরণ আরও প্রচুর। মিশর হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতবর্যের উত্তর ও দক্ষিণ পর্যন্ত এক দীৰ্ঘমুণ্ড জন এবং পরবর্তী কালে ভূমধ্যজন সম্পৃক্ত আর এক দীৰ্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠী, এই দুই জনের রক্তধারার সংমিশ্রণে ভারতবর্ষে সিন্ধুনদের উপত্যকা হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত পর্যন্ত এবং উত্তর ভারতেও প্রায় সর্বত্রই এক বিরাট নরগোষ্ঠী গড়িয়া উঠিয়াছিল। দক্ষিণ ভারতের কোনও কোনও স্থানে, উত্তর ভারতের ২-৪টি স্থানে আকস্মিক আবিষ্কারে, রামায়ণ-মহাভারত -পুরাণকাহিনীতে, কিন্তু বিশেষভাবে হরপ্পা, মহেন্-জো-দড়ো এবং নাল প্রভৃতি নিম্ন-সিন্ধু উপত্যকার একাধিক স্থানের প্রাচীনতম ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এই নরগোষ্ঠীর বাস্তব সভ্যতার যে চিত্র আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে উন্মুক্ত হইয়াছে তাহা আজ সর্বজনবিদিত। সাম্প্রতিক কালে এ সম্বন্ধে আলোচনা-গবেষণাও হইয়াছে প্রচুর। তাহার বিস্তৃত আলোচনার স্থান এখানে নয়, প্রয়োজনও কিছু নাই। তবু এই নরগোষ্ঠীর সভ্যতার উপাদান-উপকরণের মোটামুটি একটু পরিচয় লইলে ভারতবর্ষের এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙলাদেশের সভ্যতার অন্যতম মূল সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা করা যাইবে।
নব্যপ্রস্তরযুগের এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকেরাই ভারতবর্ষের নাগর-সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা। আর্যভাষায় ‘উর’, ‘পুর’, ‘কুট’ প্রভৃতি নগর-জ্ঞাপক যে সব শব্দ আছে সেগুলি প্রায় সবই দ্রাবিড় ভাষা হইতে উদ্ভূত। রামায়ণে স্বর্ণলঙ্কার বিবরণ, মহাভারতে ময়দানবের গল্প, মহেন-জো-দড়ের নগরবিন্যাসের উন্নত ও সমৃদ্ধ রূপ, ভারতের বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ—সমস্তই প্রাক-আর্যভাষী দীর্ঘমুণ্ড দ্রাবিড়ভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর নগর-নির্ভর সভ্যতার দিকে ইঙ্গিত করে, এ কথা কতকটা নিঃসংশয়ে অনুমান করা চলে। নগর-নির্ভর সভ্যতা জটিল; এই সভ্যতার উপাদান-উপকরণও বহুল এবং জটিল হইতে বাধ্য। বিচিত্র খনিজ বস্তুর ব্যবহার তাহার অন্যতম প্রমাণ। এই গোষ্ঠীর লোকেরা সোনা, রূপা, সীসা, ব্রোঞ্জ ও টিনের ব্যবহার জানিত; শিলাজতু, নানাপ্রকারের পাথর, জাস্তব হাড়, পোড়ামাটি ও নানাপ্রকার খনিজ ও সামুদ্রিক দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের বিচিত্র প্রয়োজনে অলংকরণে, বিচিত্র রূপে ও রচনায় ব্যবহার করিত। বর্শা, ছুরি, খড়গ, কুঠার, তীর, ধনুক, মুষল, বঁটুল, তরবারি, তীরের ফলা ইত্যাদি ছিল ইহাদের অস্ত্রোপকরণ। পাথরের হলমুখ, চকমকি পাথরের ছুরি ও। কুঠার, নানাপ্রকার ধাতু ও মাটির থালাবাটি ইত্যাদি বিচিত্র রূপের নিত্যব্যবহার্য গৃহোপকরণ, মাটির তৈয়ারি নানাপ্রকারের খেলনা, তামা ও ব্রোঞ্জের দেহসজোপকরণ, খেলার জন্য গুটি ও পাশা ইত্যাদি অসংখ্য, বিভিন্ন ও বিচিত্র উপাদান এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য। গোরুর গাড়িও এই সভ্যতারই দান বলিয়া মনে হয়। সুতাকাটা, কাপড় বোনা তো ইহারা জানিতই। যব ও গম, মাছ, মেষ, শূকর ও কুকুট মাংস ছিল ইহাদের প্রিয় খাদ্যবস্তু; বৃহৎ বৃষ (কুকুদ্বান্), গরু, মহিষ, মেষ, হাতি, উট, শূকর, ছাগল, কুক্কুট বা মুরগি, কুকুর ও ঘোড়া (?) ছিল ইহাদের গৃহপালিত জন্তু। ইহাদের বিলাসদ্রব্যের প্রাচুর্য এবং আরাম উপভোগের উপকরণের যে পরিচয়, নানাপ্রকার হস্ত ও কারু শিল্পের যে পরিচয় সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষে এবং রামায়ণ-মহাভারতের নানা গল্পের মধ্যে পাওয়া যায় তাহাতেও এক সমৃদ্ধনগর-নির্ভর সভ্যতার দিকে ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। তাম্র-প্রস্তরযুগের চিত্রকলার, জ্যামিতিক রেখাঙ্কন এবং অলংকরণের, মাটির পুতুল ও খেলনায় চারুকলার যে রূপের সঙ্গে আমার পরিচিত তাহারও কিছুটা এই দ্রাবিড়ভাষী দীৰ্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠীরই সৃষ্টি, এ কথা মনে করিবারও যথেষ্ট কারণ আছে। ছোটবড় রাস্তা, জলনিঃসরণের প্রণালী, বড়-ছোট একাধিক তলাবিশিষ্ট ইটকাঠের বাড়ি, দুর্গ, সিঁড়ি, খিলানযুক্ত দরজা, জানালা, স্নানাগার, কুপ, জলকুণ্ড, প্রাঙ্গণ, পূজামন্দির, মৃতদেহ-সৎকার-স্থান প্রভৃতি নগরবিন্যাসের যাহা কিছু অত্যাবশ্যক উপাদান, তাম্র-প্রস্তরযুগীয় দীর্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠীর চিত বাস্তব সভ্যতায় তাহার কিছুরই যে অভাব ছিল না হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষ তাহা প্রমাণ করিয়াছে।
তামা, লোহা, ব্রোঞ্জ, সোনা, কাঠ ইত্যাদির ব্যবহার এবং এ সব বস্তুর সাহায্যে যে কারুশিল্প ইহারা জানিত তাহার একটু পরোক্ষ প্রমাণ ভাষাতত্বের মধ্যেও পাওয়া যায়। বাঙলা কামার (পরবর্তী সংস্কৃত কর্মকার) তো দ্রাবিড় ভাষার ‘কর্মার’ শব্দ হইতেই গৃহীত। চারুশিল্পের সঙ্গে পরিচয়ের প্রমাণ, ‘রূপ’ ও ‘কলা’ এই দুইটি দ্রাবিড় শব্দ। মৃৎপাত্র যে তৈরি করিত তাহার নাম হইতেছে ‘কুলাল’; বানর, গণ্ডার ও ময়ূরের সঙ্গে পরিচয়ের প্রমাণ ‘কপি’, ‘মৰ্কট’, ‘খড়্গ’ (জন্তু অর্থে) ও ‘ময়ূর’ প্রভৃতি দ্রাবিড় ভাষার শব্দ। চালের যে ক’টি শব্দ আছে সংস্কৃত ভাষায়, তাহার মধ্যে অন্তত দুইটি, ‘তণ্ডুল’ ও ‘ব্রীহি’, দ্রাবিড় ভাষা হইতে গৃহীত। লক্ষণীয় ইহাই যে, এই প্রত্যেকটি শব্দই ঋগ্বেদ ও ব্রাহ্মণ হইতে আহৃত। আর্য সভ্যতার প্রথম স্তরের ইতিহাসেই দ্রাবিড় সভ্যতার বাস্তব উপকরণগত এইরূপ অনেক শব্দ ঢুকিয়া পড়িয়াছে। পরবর্তী কালে সংস্কৃতে ও প্রাকৃতে বস্তুবাচক আরও কত অসংখ্য শব্দ যে ঢুকিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। এইসব বস্তুর সঙ্গে যদি পূর্ব হইতেই আর্যভাষীদের পরিচয় থাকিত তাহা হইলে হয়তো তাহাদের ভাষায় সেইসব বস্তুর নামও থাকিত; ছিল না বলিয়াই হয়তো এমন ভাষাভাষী লোকদের নিকট হইতে তাহা ধার করিয়া আত্মসাৎ করিয়া লইতে হইয়াছে যাহাদের মধ্যে সেইসব বস্তু ছিল এবং সেইহেতু তাঁহাদের নামও ছিল, এবং যাহাদের সঙ্গে আর্যভাষীদের পাশাপাশি বাস করিতে হইয়াছে, কখনও শত্রুভাবে, কখনও মিত্রভাবে। এইসব বস্তুবাচক অসংখ্য শব্দের ইতিহাসের মধ্যে দ্রাবিড়ভাষাভাষীজনদের উন্নত বাস্তব সভ্যতার ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট।
দ্রাবিড়ভাষাভাষী বিভিন্ন দীর্ঘমুণ্ড নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ বাঙলাদেশে কতখানি সঞ্চারিত হইয়াছে বা হয় নাই, তাহার ইঙ্গিত আগেই করা হইয়াছে। কিন্তু তাঁহাদের ভাষা ও বাস্তব সভ্যতার চলমান প্রবাহ যে বাঙলার ভাষা ও সভ্যতার প্রবাহে স্রোতধারা সঞ্চার করিয়াছে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার উপায় নাই। বাঙলাদেশে এই ভাষা প্রভাবের ও সভ্যতার বাহন যতদূর অনুমান করা যায়, দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকেরা নিজেরা ততটা নয় যতটা আর্যভাষীরা নিজেরা। বাঙলাদেশের আর্যীকরণের আগে অ্যালপো-দীনারায় ও আদি নর্ডিক লোকেরা যতটা দ্রাবিড়ভাষীদের ভাষা ও বাস্তব সভ্যতা আত্মসাৎ করিয়াছিল, তাহারই অনেকখানি অংশ আর্যীকরণের সঙ্গে সঙ্গে বাঙলাদেশে সঞ্চারিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। তবে, প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাগে নাই এমন কথাও জোর দিয়া বলা যায় না। বাঙলা ভাষার কিছু কিছু শব্দ ও পদরচনারীতি এবং ব্যাকরণপদ্ধতিতে যে দ্রাবিড় প্রভাব সুস্পষ্ট তাহা তো আগেই বলা হইয়াছে; বাস্তব সভ্যতায় এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ প্রভাব এতটা সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র না হইলেও সাধারণভাবে ইহার অস্তিত্ব অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র না হইবার কারণ, আর্যভাষী অ্যালপো-দীনারায় ও আদি-নর্ডিক লোকেরা সেই প্রভাবকে একান্তভাবে আত্মসাৎ করিয়া ফেলিয়াছিল এবং আজ আমরা তাহাকে আর্যভাষী লোকদের সভ্যতার অঙ্গীভূত করিয়াই দেখি। তবু মনে হয়, বাঙালীর টাটকা ও শুকনা মৎস্যাহারে অনুরাগ, মৃৎশিল্প ও অন্যান্য কারুশিল্পে দক্ষতা, চারুশিল্পের অনেক জ্যামিতিক নকশা ও পরিকল্পনা, নগর-সভ্যতার যতটুকু সে পাইয়াছে তাহার অভ্যাস ও বিকাশ, বিলাসোপকরণের অনেক সামগ্ৰী, জলসেচনে উন্নততর চাষের অভ্যাস প্রভৃতি দ্রাবিড়ভাষাভাষী নরগোষ্ঠী প্রবাহেরই ফল। মহেন-জো-দড়োর ও হরপ্পার দীর্ঘমুণ্ড লোকেরা যে মৎস্যাহারী ছিল তাহার প্রমাণ সুবিদিত। বৈদিক আর্যেরা ছিলেন মাংসাহারী; কিন্তু পরবর্তীকালে নানা কারণে, বিশেষত বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর অহিংসাবাদের অভ্যুদয়ে, প্রাণিহত্যা এবং সঙ্গে সঙ্গে মাংসাহারের এবং মৎস্যাহারের প্রতি একটা বিরাগ আর্যভাষাভাষী লোকেদের মধ্যে ছড়াইয়া পড়ে এবং আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দ্রাবিড়ভাষী লোকদের দেশেও তাহা সংক্রামিত হয়। বাঙলাদেশে এই সংস্কৃতির বিস্তার অপেক্ষাকৃত কম হইয়াছিল বলিয়া এ দেশে মৎস্যাহারের প্রতি বিরাগ উৎপাদন ততটা সম্ভব হয় নাই। অবশ্য, এ দেশে নদনদীবহুল জলবায়ু এবং মাছের সহজলভ্যতা এই অনুরাগের আর একটি প্রধান কারণ, এ কথাও অস্বীকার করা যায় না। তাহা ছাড়া, আগে হইতেই অস্ট্রিকভাষাভাষী লোকদের ভিতরও মৎস্যাহারের প্রচলন ছিল বলিয়া মনে হয়।
অ্যালপো-দীনারায় নরগোষ্ঠীর বাস্তব সভ্যতার রূপ যে কী ছিল, তাহা বলিবার কিছু উপায় নাই। নানা কারণে মনে হয়, বৈদিক আর্যভাষীদের ভাষা ও সভ্যতা হইতে তাহার এক পৃথক অস্তিত্ব ছিল। পূর্ব ভারতের অ্যালপো-দীনারায় অবৈদিক আর্যভাষীদিগকে বৈদিক আর্যভাষীরা ঘূণার চক্ষেই দেখিত এবং তাঁহাদের অভিহিত করিত ব্রাত্য বলিয়া। এই ব্রাত্য অবৈদিক আর্যদের ভিতর হইতেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদ্ভব বলিয়া অনুমান করিলে ইতিহাস অসম্মত কিছু বলা হয় না। আর, যেহেতু ইহারাও ছিল আর্যভাষী, সেই হেতু যে নিজেদের ধর্মানশাসনগুলিতে বলিত ‘আর্যসত্য’ তাহাতেও কিছু অন্যায় হয় নাই। “ব্রাত্যষ্টোম” যজ্ঞ করিয়া ইহাদের শুদ্ধিসাধন করিয়া নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করিবার একটা কৌশল বৈদিক আর্যেরা আবিষ্কার করিয়াছিলেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ইহারা যে (বৈদিক ভাবে ও ধ্যানে, অর্থাৎ বৈদিক ধর্মে) ‘অ-দীক্ষিত’ তাহা বলিতেও ছাড়েন নাই। এই তথ্য হইতে মনে হয়, এই অ্যালপো-দীনারায় অবৈদিক আর্যভাষীদের স্বতন্ত্র একটা বাস্তব সভ্যতার রূপও ছিল; কিন্তু তাহা অনুমান করিবার উপায় আজ কিছু অবশিষ্ট আর নাই।
বৈদিক আর্যভাষীদের বাস্তব সভ্যতা ছিল একান্তই প্রাথমিক স্তরের। খড়, বাঁশ, লতাপাতার স্বল্পকালস্থায়ী কুঁড়েঘরে অথবা পশুচর্মনির্মিত তাবুতে ইহারা বাস করিত; গো-পালন জানিত, পশুমাংস পোড়াইয়া তাহাই আহার করিত এবং দলবদ্ধ হইয়া এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইত। যাযাবরত্ব ত্যাগ করিয়া এ দেশে আসিয়া যথাক্রমে কৃষি অর্থাৎ গ্রাম-সভ্যতা এবং নগর-সভ্যতার সঙ্গে ধীরে ধীরে তাঁহাদের পরিচয় ঘটিল এবং ক্রমে তাহারা দুই সভ্যতাকেই একান্তভাবে আত্মসাৎ করিয়া নিজস্ব এক নূতন সভ্যতা গড়িয়া তুলিল। এই সভ্যতার বাহন হইল আর্যভাষা। এই দুই সভ্যতার সমন্বিত আর্যীকরণই হইল আর্যভাষীদের বিরাট কীর্তি; অথচ বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে তাঁহাদের একান্ত নিজস্ব কিছু তাহাতে বিশেষ নাই।
বাঙলাদেশ ও বাঙালীর বাস্তব সভ্যতার রূপ শুধু প্রাচীনকালেই নয়, উনবিংশ শতক পর্যন্ত একান্তভাবেই গ্রামীণ, এ কথা সকলেই স্বীকার করবেন। দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকদের উদ্ভূত নগর-সভ্যতার স্পর্শ বাঙলাদেশে খুব কমই লাগিয়াছে; সেইজন্যই সুদীর্ঘ শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঙালীর ইতিহাসে নগরের প্রাধান্য নাই বলিয়াই চলে। উত্তর ভারতে রাজগৃহ, পাটলীপুত্র, সাকেত, শ্রাবস্তী, হস্তিনাপুর, পুরুষপুর, শাকল, অহিচ্ছত্র, কান্যকুব্জ, তক্ষশীলা, উজ্জয়িনী, বিদিশা, কৌশম্বী প্রভৃতি, দক্ষিণ ভারতের অসংখ্য সামুদ্রিক বাণিজ্যের বন্দর, পুর, নগর প্রভৃতি ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে স্থান অধিকার করিয়া আছে, বাঙলাদেশে বাঙলার ইতিহাসে নগর নগরী সে স্থান অধিকার করিয়া নাই। বস্তুত বাঙলাদেশে নগরের সংখ্যা কম এবং বাঙালীর সমাজবিন্যাসে নগরের প্রাধান্যও কম। এ কথা অন্যত্র আরও পরিষ্কার করিয়া বলিবার সুযোগ হইবে; এখানে এইটুকু বলিলেই চলিতে পারে যে, নগর-সভ্যতার স্পর্শ বাঙলাদেশে যে যথেষ্ট লাগে নাই, তাহার কারণ বাঙলাদেশ চিরকালই ভারতের একপ্রান্তে নিজের কৃষি ও গ্রামীণ সভ্যতা লইয়া পড়িয়া থাকিয়াছে। সর্বভারতীয় প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে তাহার যোগ আর্যভাষা ও আর্যসভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে অবলম্বন করিয়াই এবং সেই সূত্রে যে দ্রাবিড় ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির যতটুকু প্রবাহম্পর্শ পাইয়াছে, তাহাই বোধহয় তাহার দ্রাবিড়ী উপাদান এবং সে উপাদান তাহার মূল অষ্টিক উপাদানকে একান্তভাবে বিলোপ করিতে পারে নাই। ঐতিহাসিক কালেও দক্ষিণ হইতে নানা সমরাভিযান এবং আদান-প্রদানের ফলে বাঙলাদেশে কিছু কিছু দক্ষিণী দ্রাবিড় প্রভাব আসিয়াছে, সন্দেহ নাই; বাঙলাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে তাহার কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায় ভাষায়, বাস্তব সভ্যতার কিছু কিছু উপাদান-উপকরণে এবং মানস-সংস্কৃতিতে। তাহা স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইবার স্থান এখানে নয়।
৭. জনপ্রবাহ ও মানস-সংস্কৃতি
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
সপ্তম পরিচ্ছেদ – জনপ্রবাহ ও মানস-সংস্কৃতি
জনপ্রবাহ ও মানস-সংস্কৃতি
বাস্তব সভ্যতার উপাদান-উপকরণ এবং তাহার সঙ্গে জনপ্রবাহের সম্বন্ধের কিছু আভাস লইতে চেষ্টা করা গেল। এইবার মানস-সংস্কৃতি এবং জনপ্রবাহের খানিকটা সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা করা যাইতে পারে।
অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অষ্ট্রেলীয়দের কথাই সর্বাগ্রে বলিতে হয়, কারণ ভারতীয় নিগ্রোবটুদের মানস-সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রায় কিছুই আমরা জানি না। অস্ট্রিক ভাষাভাষী প্রাচীন ও বর্তমান জনদের সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় এবং অনুমান করা যায়, তাহাতে মনে হয়, ইহারা অতি সরল ও নিরীহ প্রকৃতির লোক ছিল। ঐতিহাসিক যুগে ইহাদের বিবর্তন ও পরিবর্তনের গতি ও প্রকৃতি দেখিয়া মনে হয়, ইহাদের মধ্যে দৃঢ়তা ও সংহতির কিছু অভাব ছিল; সহজেই ইহারা পরের নিকট বশ্যতা স্বীকার করিত এবং আত্মসমর্পণ করিয়াই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখিত। বারবার অধিকতর পরাক্রান্ত জাতির নিকট রাষ্ট্ৰীয় ও অর্থনৈতিক বশ্যতা স্বীকার করিয়াও যে ইহারা নিজেদের জনগত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি আজও বজায় রাখিতে পারিয়াছে, তাহাতে মনে হয় এই বশ্যতা স্বীকার করিয়াও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখাই ইহাদের প্রাণশক্তির মূল। বর্তমান শবর বা সাঁওতাল, ভূমিজ বা মুণ্ডা প্রভৃতির জীবনাচরণ একটু মনোযোগ দিয়া দেখিলে মনে হয়, ইহারা কিছুটা কল্পনাপ্রবণ, দায়িত্বহীন, অলস, ভাবুক এবং কতকটা কামপরায়ণও বটে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া এত বিবর্তন-পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু ইহাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য তাহাতে বিশেষ বদলাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না।
এই অস্ট্রিক ভাষী আদি-অষ্ট্রেলীয়েরা মানুষের একাধিক জীবনে বিশ্বাস করিত, এখনও করে। কাহারও মৃত্যু হইলে তাহার আত্মা কোনও পাহাড় অথবা গাছ অথবা কোন জন্তু বা পক্ষী বা অন্য কোনও জীবকে আশ্রয় করিয়া বাঁচিয়া থাকে, ইহাই ছিল ইহাদের ধারণা; পরবর্তী কালে এই ধারণাই হিন্দু পুনর্জন্মবাদ ও পরলোকবাদে রূপান্তরিত হয়। মৃতদেহ ইহারা কাপড় অথবা গাছের ছালে জড়াইয়া বৃক্ষস্কন্ধে অথবা ডালে ঝুলাইয়া রাখিত, বা মাটির নীচে কবর দিয়া তাহার উপর বড়ো বড়ো পাথর সোজা করিয়া পুঁতিয়া দিত, অথবা স্ত্রীলোক হইলে কবরের উপর লম্বালম্বি করিয়া শোয়াইয়া দিত (গন্দ, কোরক, খাসিয়া প্রভৃতিরা এখনও ঠিক যেমনটি করে), মৃতব্যক্তিকে মাঝে মাঝে আহার্যও দান করিত, যেমন এখনও করে। এইসব বিশ্বাস ও রীতিই পরবর্তী কালে হিন্দুসমাজে গৃহীত হইয়া শ্ৰাদ্ধাদি কার্যে মৃতের উদ্দেশে পিণ্ডদান ইত্যাদি ব্যাপারে রূপান্তরিত হইয়াছে। লিঙ্গ-পূজাও ইহাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে হয়। ‘লিঙ্গ’ শব্দটিও তো অস্ট্রিক ভাষার দান, এবং কোনও কোনও নৃতত্ত্ববিদ খাসিয়াদের সমাধির উপর যে দীর্ঘাকার পাথর দাঁড় করানো এবং শোয়ানো থাকে তাহাকে যথাক্রমে লিঙ্গ ও যোনি বলিয়া অনুমানও করিয়াছেন। বস্তুত, পলিনেশীয় ভাষায় এখনও ‘লিঙ্গ’ তাহার সুপরিচিত অর্থেই ব্যবহৃত হয় এবং তাহার তুষ্টিবিধানের চেষ্টাও সুবিদিত। পশিলুস্কি এই সম্বন্ধে বলিতেছেন :
The phallic cults, of which we know the importance in the ancient religions of Indo-China, are generally, considered to have been derived from Indian Saivism. It is more probable that the Aryans; have borrowed from the aborigines of India the cult of Linga as well as the name efthe idol. These popular practices despised by the Brahmanas were ill-known in old times. If we try to know them better, we will probably be able to see clearly why so many non-Aryan words of the family of Linga have been introduced into the language of the conquerors.
অস্ট্রিকভাষীরা বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফলমূল, ফুল কোনওবিশেষ স্থান, বিশেষ বিশেষ পশু, পক্ষী ইত্যাদির উপর দেবত্ব আরোপ করিয়া তাহার পূজা করিত। এখনও খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি কোমের লোকেরা তাহা করিয়া থাকে। বাঙলাদেশে পাড়াগায়ে গাছপূজা তো এখনও বহুলপ্রচলিত, বিশেষভাবে শেওড়াগাছ ও বটগাছ; আর, পাথর ও পাহাড়-পূজাও একেবারে অজ্ঞাত নয়। বিশেষ বিশেষ ফল-ফুল-মূল সম্বন্ধে যে সব বিধি-নিষেধ আমাদের মধ্যে প্রচলিত, যে সব ফল-মূল আমাদের পূজাচনায় উৎসর্গ করা হয়, আমাদের মধ্যে যে নবান্ন উৎসব প্রচলিত, আমাদের ঘরের মেয়েরা যে সব ব্রতানুষ্ঠান প্রভৃতি করিয়া থাকেন, ইত্যাদি, বস্তুত, আমাদের দৈনন্দিন অনেক আচার-অনুষ্ঠানই এই আদিম অস্ট্রিক-ভাষাভাষী জনদের ধর্মবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, ইহাদের অনেকগুলিই কৃষি ও গ্রামীণ সভ্যতার স্মৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। আমাদের নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের গুচ্ছ, দূর্বা, কলা, হলুদ, সুপারি, নারিকেল, পান, সিন্দূর, কলাগাছ প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়িয়া আছে। লক্ষণীয় এই যে, ইহার প্রত্যেকটিই অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। বাঙলাদেশে, বিশেষভাবে পূর্ববাঙলায়, এক বিবাহ ব্যাপারেই ‘পানখিলি’, ‘গাত্রহরিদ্রা’, ‘গুটিখেলা’, ‘ধান ও কড়ির স্ত্রী-আচার’ প্রভৃতি যে সব অবৈদিক, অস্মার্ত ও অব্রাহ্মণ্য, অপৌরাণিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখা যায় তাহাও তো এই কৃষি-সভ্যতা ও কৃষি-সংস্কৃতির স্মৃতিই বহন করে। ধান্যশীর্ষপূর্ণ যে লক্ষ্মীর ঘটের পূজা বাঙলাদেশে প্রচলিত তাহার অনুরূপ পূজা তো এখনও ওঁরাও-মুণ্ডাদের মধ্যে দেখা যায়; ইহাদের ‘সরণা’ দেবীর মাথায় ধান্যশীর্যের জটার কল্পনা সুপ্রাচীন। শ্রাদ্ধাদি ব্যাপারে অথবা অন্য কোনও শুভ কাজের প্রারম্ভে ‘আভ্যুদয়িক’ নামে পিতৃপুরুষের যে পূজা আমরা করিয়া থাকি, তাহাও তো আমরা এই অস্ট্রিক ভাষী লোকদের নিকট হইতেই শিখিয়াছি বলিয়া মনে হয়। এই ধরনের পিতৃপুরুষের পূজা এখনও সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, শবর, ভূমিজ, হো ইত্যাদির মধ্যে সুপ্রচলিত। শরৎকুমার রায় মহাশয় তো বলেন, ভারতে শক্তিপূজার প্রবর্তন সম্ভবত ইহারাই প্রথম করে। ওঁরাও প্রভৃতি জাতির চাণ্ডী নামক দেবতার সহিত হিন্দু চণ্ডীদেবীর সাদৃশ্য দেখা যায়। অর্ধরাত্রে উলঙ্গ হইয়া ওঁরাও অবিবাহিত যুবক-পূজারী চাণ্ডী স্থানে গিয়া চাণ্ডীর পূজা করে।
বাঙলাদেশে হোলি বা হোলাক উৎসব এবং নিম্নশ্রেণীর মধ্যে চড়ক-ধর্মপূজার মিশ্রিত সমন্বিত রূপ বিশ্লেষণ করিলে এমন কতকগুলি উপাদান ধরা পড়ে যাহা মূলত আর্যপূর্ব আদিম নরগোষ্ঠীদের মধ্যে এখনও প্রচলিত। নিম্নশ্রেণী ও নিম্নবর্ণের অনেক ধর্মানুষ্ঠান সম্বন্ধেই এ কথা বলা যাইতে পারে।
দ্রাবিড়ভাষী লোকদের মানসপ্রকৃতিও ইহাদে র প্রাচীন সাহিত্য ও শিল্পকলা এবং প্রাগৈতিহাসিক তাম্র-প্রস্তর যুগের ধ্বংসাবশেষ হইতেই কিছু কিছু অনুমান করা যায়। মনে হয়, ইহারা খুব কর্মঠ ও উদ্যমশীল, সংঘশক্তিতে দৃঢ়, শিল্প-সুনিপুণ এবং কতকটা অধ্যাত্মরহস্যসম্পন্ন প্রকৃতির লোক ছিল। প্রাচীন তামিল সাহিত্য যদি প্রামাণিক হয় তাহা হইলে ইহাদের প্রকৃতিতে ভাবুকতার এবং সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিরও অস্তিত্ব স্বীকার করিতে হয়। ইহাদের মধ্যে
সভ্যতার উন্নতির সহিত শ্রেণীবিভাগের বৃদ্ধি পাইয়াছিল। দ্রাবিড় সমাজের শ্রেণীবিভাগের সর্বোচ্চ ছিল ‘মাল্লের’ বা রাজা, তারপর পর্যায় অনুসারে ‘বল্লাল’ বা সামন্ত রাজা [বল্লালসেনের নামের বল্লালের সঙ্গে এই বল্লাল কথাটির কি কোন অর্থগত সম্বন্ধ আছে?], তারপর ‘বেল্লাল’ বা ক্ষেত্রস্বামী বা কৃষক, তারপর ‘বণিত’ বা ব্যবসায়ী। এইসব শ্রেণী ছিল উচ্চ বা ‘মলোর’, তারপর শ্রমজীবী বা ‘বিলইবলার’, আর সর্বনিম্নে দাস জাতি বা ‘আদিওর’। প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে আবার বহু বিভাগ ছিল। উচ্চ-নীচ ভেদ প্রবণতা দ্রাবিড়ভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হইয়াছিল। উহাদের অস্পৃশ্যতাবোধ ক্রমে ভারতের বর্তমান বংশগত অনমনীয় জাতিভেদ-প্রথায় পরিণত হইল। সম্ভবত দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর মধ্যে হঠযোগের প্রচলন হওয়ায় এই অস্পৃশ্যতাবোধ আরও প্রবল হইয়াছিল। পরিশেষে ইহারা যখন আর্যনর্ডিক নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসিল, তখন দেখিল আর্যেরা শুচিপ্রবণতার জন্য অপরিচ্ছন্ন দ্রাবিড়পূর্ব নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শ বর্জনের প্রচেষ্টা করিতেন। তাহাতে এই দ্রাবিড়দের বাহ্য শুচিবোধ আরও উত্তেজিত হইল।
শরৎচন্দ্র রায় মহাশয়ের এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ স্বীকার না করিয়াও বলা যাইতে পারে, দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকদের অস্পৃশ্যতাবোধ এবং শ্রেণী-পার্থক্যবোধ পরবর্তী কালে আর্যভাষী সমাজে বেশ খানিকটা সঞ্চারিত হইয়াছিল। যোগধর্ম ও আনুষঙ্গিক সাধনপদ্ধতি যে ইহাদের কাহারও কাহারও মধ্যে প্রচলিত ছিল তাহা তো প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু-সভ্যতাই অনেকটা প্রমাণ করিয়াছে।
আর্য এবং পরবর্তী পৌরাণিক হিন্দুধর্মে মূর্তিপূজা, মন্দির, পশুবলি, অনেক দেবদেবী, যথা, শিব ও উমা, শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু ও শ্ৰী প্রভৃতি যে স্থান অধিকার করিয়া আছে তাহার মূলে দ্রাবিড়ভাষী লোকদের প্রভাব অনস্বীকার্য। যাগযজ্ঞও, যতদূর জানা যায়, ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর মধ্যেই যেন বেশি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিশরে, আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের সুপ্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যজ্ঞবেদীর নিদর্শন কিছু কিছু মিলিয়াছে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অরণি ও ব্রীহি, যজ্ঞের যে দুটি প্রধান উপাদান, এই দুইটি শব্দই সম্ভবত মূলত দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে সম্পূক্ত। অবশ্য ইহাও হইতে পারে, যাগযজ্ঞ ভারতীয় আর্যভাষী আদি-নর্ডিকদের উদ্ভূত ধর্মানুষ্ঠান; কিন্তু যেহেতু ভারতের অন্যান্য নর্ডিক নরগোষ্ঠীর মধ্যে তাহার প্রচলন দেখা যায় না, সেই হেতু অনুমান একান্ত অসংগত না-ও হইতে পারে যে, ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসিয়াই আবেস্তীয় আর্যভাষী ও ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীরা এই যাগযজ্ঞের পরিচয় লাভ করিয়াছিল এবং ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীরা ভারতবর্ষে আসিবার আগেই তাহা হইয়াছিল, এমনও অসম্ভব নয়। পশুবলি যে ভূমধ্য-নরগোষ্ঠী-সম্পূক্ত প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধুতীরবাসী লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, মহেন-জো-দড়োর ধবংসাবশেষ তাহা কতকটা প্রমাণ করিয়াছে। এই মহেন-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই লোকের বাসের অনুপযোগী ক্ষুদ্রবৃহৎ এমন কয়েকটি গৃহ আবিষ্কৃত হইয়াছে যেগুলিকে কতকটা নিঃসংশয়েই মন্দির বা পূজাস্থান ইত্যাদি বলা যায়। কেহ কেহ তাহা স্বীকারও করিয়াছেন। এক্ষেত্রেও আশ্চর্য এই যে, ‘পূজন বা ‘পূজা’, এবং ‘পুষ্প’ (এই শব্দ দুইটি ঋগ্বেদেই আছে)—এই দুটি শব্দই দ্রাবিড়ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। লিঙ্গপূজা এবং মাতৃকাপূজা যে সিন্ধুতীরের প্রাগৈতিহাসিক লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, তাহাও প্রমাণ করিয়াছে হরপ্পা-মহেন-জো-দড়োর ধবংসাবশেষ। অবশ্য এই দুটি পূজা সর্পপূজার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অনেক আদিম অধিবাসীদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, তবু ভারতবর্ষে ইহার যে রূপ আমরা দেখি তাহা যে আর্যভাষীরা ভারতীয় আর্যপূর্ব ও অনার্য লোকদের সংস্পর্শে আসিয়া ক্রমশ গড়িয়া তুলিয়াছিল, এই অনুমানই যুক্তিসংগত বলিয়া মনে হয়। লিঙ্গপূজাই ক্রমশ শিবের সঙ্গে জড়িত হইয়া শিবলিঙ্গ ও শক্তি-যোনি পূজায় রূপান্তরিত হয় এবং মাতৃকাপূজা ও সর্পপূজা ক্রমশ যথাক্রমে শক্তিপূজায় ও মনসাপূজায়। দ্রাবিড়ভাষীদের আণ-মন্দি=পুং বানর-দেবতার ক্রমশ বৃষকপি এবং পরবর্তী কালে হনুমান-দেবতায় রূপান্তর অসম্ভব নয়। তেমনই অসম্ভব নয় দ্রাবিড়ভাষীদের বিণ্ বা আকাশ-দেবতার রূপান্তর বিষ্ণুতে, এবং তাহা সুপ্রাচীন কালেই হয়তো হইয়াছিল। বৈদিক বিষ্ণুর যে রূপ আমরা দেখি তাহাতে যেন দ্রাবিড়ভাষীদের আকাশ-দেবতার স্পর্শ লাগিয়া আছে। শিব সম্বন্ধে এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। শ্মশান-প্রান্তর-পর্বতের রক্ত-দেবতা একান্তই দ্রাবিড়ভাষীদের শিবন যাহার অর্থ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু যাহার অর্থ তাম্র; ইনিই ক্রমে রূপান্তরিত হইয়া আর্যদেবতা রুদ্রের সঙ্গে এক হইয়া যান। পরে শিবন=শিব, শেম্বু-শম্ভূ, রুদ্র-শিব এবং মহাদেবে রূপান্তর লাভ করেন। এই ধরনের সমন্বিত রূপ পৌরাণিক অনেক দেবদেবীর মধ্যেই দেখা যায়, এ কথা ক্রমশ পণ্ডিতদের মধ্যে স্বীকৃতি লাভ করিতেছে। দৃষ্টান্তবাহুল্যের আর প্রয়োজন নাই। এই সমন্বিত রূপই আর্যভাষীদের মহৎ কীর্তি এবং ভারতীয় ঐতিহ্যে তাঁহাদের সুমহান দান।
মহেন্-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষ হইতে মনে হয় সেখানকার লোকেরা মৃতদেহ কবরস্থ করিত, কেহ কেহ আবার খানিকটা পোড়াইয়া শুধু অস্থিগুলি কবরস্থ করিত।
অ্যাল্পো-দীনারায় নরগোষ্ঠীর মানস-সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছুই বলিবার উপায় নাই। তবে, মহেন-জো-দড়োর উপরিতম স্তরের ধ্বংসাবশেষ হইতে মনে হয়, ইহারা মৃতদেহ বা শব (এটি দ্রাবিড়গোষ্ঠীর শব্দ) আগে পোড়াইয়া ভস্মশেষ একটি পাত্রে রাখিয়া তাহা কবরস্থ করিত। আগেই বলিয়াছি, আর্যভাষী নর্ডিকেরা ইহাদের ভাষাজ্ঞাতি অ্যালপো-দীনারায় লোকদের প্রীতির চক্ষে তো দেখিত না, বরং ‘ব্রাত্য’ বা পতিত বলিয়া ঘৃণা করিত। এই ‘ব্রাত্য’রাও অন্যদিকে বৈদিক আর্যভাষীদের যাগযজ্ঞ, আচারানুষ্ঠান প্রভৃতিকে প্রীতির চক্ষে দেখিত না। এককথায় এই দুই গোষ্ঠীর মানস-সংস্কৃতি একেবারেই বিভিন্ন ছিল, এ অনুমান কতকটা নিঃসংশয়েই করা যায়।
ভারতীয়, তথা বাঙলাদেশের মানস-সংস্কৃতিতে মোঙ্গোলীয় ভোটত্ৰহ্ম বা চৈনিক বা অন্য কোনও নরগোষ্ঠীর স্পর্শ বিশেষ কিছু লাগে নাই। লাগিলেও তাহা এত ক্ষীণ যে, আজ আর তাহা ধরিবার কোনও উপায় নাই।
বাঙলাদেশে, শুধু বাঙলাদেশেই বা কেন, সমগ্র উত্তর ভারতেই আজ বিশুদ্ধ নিগ্রোবটু অবলুপ্ত; বহুদিন আগেই তাহারা কোথায় যে বিলীন হইয়া গিয়াছে আজ আর তাহা বুঝিবারও উপায় নাই।
অস্ট্রিক, মিশ্র অস্ট্রিক ও নেগ্ৰিটো; দ্রাবিড়, মিশ্র দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক; মিশ্র নেগ্রিটো ও দ্রাবিড় এবং মিশ্র অস্ট্রিক-নেগ্রিটো-দ্রাবিড়, এইসব জনগণ, যখন উত্তর-ভারতের অনার্য জনরূপে নিজ মিশ্র ধর্ম ও সংস্কৃতি লইয়া বাস করিতেছে, যখন দেশ ছিল খণ্ড, ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত, এবং দেশে কোনও ঐক্য-বিধায়িনী কেন্দ্রাভিমুখী শক্তিও ছিল না— এমন সময়ে ধীরে ধীরে প্রচণ্ড শক্তিশালী, একান্তরূপে কৰ্মী, অপূর্ব কল্পনাশীল, disciplined বা শৃঙ্খলাসম্পন্ন, সুদৃঢ়রূপে সংঘবদ্ধ, গুণগ্রাহী কিন্তু আত্মসমাহিত, বাস্তবে সভ্যতায় কিঞ্চিৎ পশ্চাৎপদ অথচ নুতন বস্তু উপযোগী হইলে গ্রহণ করিতে সদা-চেষ্টিত, এমন আর্য [ভাষী] জাতি ভারতে দেখা দিল। আর্য ভাষীরা আসিয়া খণ্ড ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত ভারতকে এক ধর্মরাজ্যপাশে, এক ভাষা ও এক সংস্কৃতির গ্রন্থিতে বাঁধিয়া দিল। …ভারতবর্ষে তাঁহারা বৈদিকধর্ম ও দেবতাবাদ এবং বেদের কিছু কিছু মন্ত্র বা সুক্ত লইয়া আসিল; তাহারা আনিল তাঁহাদের নিজস্ব সংস্কৃতি; সেই সংস্কৃতিতে বাবিল ও আসুরীয় এবং পশ্চিম-এশিয়ার অন্য সভ্য (ভূমধ্য) নরগোষ্ঠীর প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।
৮. মন্তব্য – ইতিহাসের গোড়ার কথা
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
অষ্টম পরিচ্ছেদ – মন্তব্য
মন্তব্য
শতাব্দী পর শতাব্দীর বিরোধ-মিলনের মধ্য দিয়া এমন করিয়া ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বুকে আর্যভাষী আদি-নর্ডিকেরা এক সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিল। সে জনের রক্তবিশুদ্ধতা আর রহিল না; তাহার রক্তে বিচিত্র রক্তধারার স্রোতধ্বনি রণিত হইতে লাগিল, কোথাও ক্ষীণ, কোথাও উচ্চগ্রামে। এই সমন্বিত জনের নাম ভারতীয় জন। সে ধর্মও আর বেদ-ব্ৰাহ্মণের ধর্ম রহিল না। তাহার মধ্যে বিভিন্ন বিচিত্র পূর্বতন ধর্মের আদর্শ, আচার, অনুষ্ঠান সব মিলিয়া মিশিয়া এক নূতন ধর্ম গড়িয়া উঠিল; তাহার নাম পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। সে সভ্যতাও বৈদিক আর্যভাষীর সভ্যতা থাকিল না; বিচিত্র পূর্বতন সভ্যতার উপাদান উপকরণ আহরণ করিয়া তাহার এক নূতন রূপ ধীরে ধীরে পৃথিবীর দৃষ্টির সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল। এই নূতন সমন্বিত সভ্যতার নাম ভারতীয় সভ্যতা। আর সেই সংস্কৃতিই কি বেদ-ব্ৰাহ্মণের সংস্কৃতি থাকিতে পারিল? তাহার মানসলোকে কত যে পূর্বতন জন ও সংস্কৃতির সৃষ্টি-পুরাণ, দেবতাবাদ, ভয়-বিশ্বাস, ভাব-কল্পনা, স্বভাব-প্রকৃতি, ইতিকাহিনী, ধ্যানধারণা আশ্রয়লাভ করিল তাহার ইয়ত্তা নাই। সকলকে আশ্রয় দিয়া, সকলের মধ্যে আশ্রয় পাইয়া, সকলকে আত্মসাৎ করিয়া, সকলের মধ্যে বিস্তৃত হইয়া এই সংস্কৃতিও এক নূতন সমন্বিত রূপ লাভ করিল; তাহার নাম ভারতীয় সংস্কৃতি। আজ আবার গত সাতশত বৎসর ধরিয়া আর এক বৃহৎ সমন্বয় চলিতেছে এবং তাহার ফলে আমাদের এই বৃহৎ দেশখণ্ডে আর এক নূতন জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি রূপ লাভ করিতেছে।
এই সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা এবং সংস্কৃতিও একটি চলমান প্রবাহ। এই প্রবাহ আজও চলিতেছে। পরবর্তী কালে ইতিহাসের আবর্তচক্রে বারবার নূতন নূতন জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিচিত্ররূপে তাঁহাদের বিরোধ-মিলন ঘটিয়াছে, আজও ঘটিতেছে। ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। চলমান প্রবাহ, বিরুদ্ধ প্রবাহ, সমন্বিতপ্রবাহ—ইহাই জীবনের গতিধর্ম। এই গতিধর্ম স্মৃতি ঐতিহ্যবহ; এই ধর্মই জীবনীশক্তি, প্রাণশক্তি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই ধর্মের বিকাশের দিকে তাকাইয়া বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হইয়াছে;
রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত যারা এসেছিল সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে, কেহ নহে নহে দূর—
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তারি বিচিত্র সুর।
যাহাই হউক, যে সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা এইমাত্র বলিলাম, তাহার জন্মনীড় হইল উত্তর-ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশ। তাঁহাদের বাহন হইল আর্যভাষা। এই আর্যভাষাকে আশ্রয় করিয়া ধীরে ধীরে গাঙ্গেয় প্রদেশের ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবাহ বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতে। আদিমতম স্তরে, আদি-অষ্ট্রেলীয়, তারপর দীর্ঘমুণ্ড ভূমধ্য-নরগোষ্ঠী, গোলমুণ্ড অ্যালপো-দীনারায় নরগোষ্ঠী এবং সর্বশেষে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশের মিশ্র আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর ক্ষীণ ধারা— এই কয়েকটি ধারার মিলনে বাঙালী জনের সৃষ্টি। অ্যালপো-দীনারায় প্রবাহপূর্ব আদিম-বাঙালী মুখ্যত অনার্য; আর্য-প্রবাহ প্রথম আনিল অ্যালপো-দীনারীয় জাতিই। তারপর দ্বিতীয় প্রবাহ ক্ষীণ ধারায় আনিল আদি-নর্ডিকেরা, কিন্তু উত্তর ভারতের সেই প্রবাহ মিশ্রিত হইয়া গিয়াছিল। যাহাই হউক, উত্তর ভারতের মিশ্র আদি-নর্ডিকদের এবং কিয়ৎপরিমাণে অ্যালপো-দীনারীয়দের আর্যভাষাই সৃজ্যমান বাঙালী জনকে একটা নূতন মানসরূপ দান করিল; আদিম বাঙালীর আদি-অষ্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় মন ও প্রকৃতির উপর ব্রাত্য অ্যালপো-দীনারায় এবং মিশ্র আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর মন ও প্রকৃতির চন্দনানুলেপন পড়িল এবং তাহাই বাঙালীকে, বাঙালী চরিত্রকে একটা ফুটতর বৈশিষ্ট্য দান করিল। এই বিবর্তন-পরিবর্তন একদিনে হয় নাই, হাজার বৎসরেরও (খ্ৰীষ্টপূর্ব তাহা ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতে খ্ৰীষ্টপরবর্তী ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত মোটামুটি) অধিককাল ধরিয়া তাহা চলিয়াছিল। কিন্তু সে তথ্য এবং তথ্যগত বিবরণ ইতিবৃত্তের কথা; এ অধ্যায়ে তাহার স্থান নাই।
এই অধ্যায়ে আমি যাহা বলিতে চেষ্টা করিলাম, যে ভাবে অস্ফুট অপরিস্তুত ঐতিহাসিক উষাকালের রেখাচিত্র আঁকিতে, যে সব ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করিলাম, ঐতিহাসিকেরা সকল ক্ষেত্রে তাহা স্বীকার করিবেন, আমি তাহা আশা করি না। সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট পাথুরে প্রমাণ না পাইলে সাধারণত ইতিহাসের দাবি মেটে না; অথচ যে প্রাগৈতিহাসিক কালের কাহিনী এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সেই কালের ঐতিহাসিক-গ্রাহ্য প্রমাণ সুদুর্লভ। তবু, মানুষের জানিবার আকাঙক্ষা দুর্নিবার, সেই আগ্রহে মানুষ নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবন করে; নরতত্ত্ব, জনতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এবং প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব তাহা কয়েকটি উপায় মাত্র। এইসব উপায়ের সাহায্যে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা এ পর্যন্ত যে সব নির্ধারণে পৌঁছিয়াছেন, তাহাই বিচার ও বিশ্লেষণ করিয়া, কিছু রাখিয়া কিছু ছাঁটিয়া, কিছু বাছিয়া, নানা ইঙ্গিতগুলি ফুটাইয়া আমার এই রেখাচিত্র। ঐতিহাসিক কালে বাঙলার ও বাঙালীর যে ইতিহাস আমাদের চোখের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়, তাহার সকল তথ্য, সকল ইঙ্গিত, সকল ভাব-কল্পনা, ধ্যান-ধারণা, উপাদান-উপকরণ, আচার-অনুষ্ঠান, গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি ঐতিহাসিক কালের তথ্য-প্রমাণের মধ্যে পাওয়া যায় না, সে তথ্য ও প্রমাণ ঐতিহাসিক কাল অতিক্রম করিয়া প্রাগৈতিহাসিক কালের মধ্যে বিস্তৃত। বাঙালীর ইতিহাস বলিতে বসিয়া সেইজন্য সেই অস্ফুট কাল সম্বন্ধে এই সুদীর্ঘ প্রস্তাবের অবতারণা করিতে হইল। শুধু প্রাচীন নয়, আজিকার বাঙালীরও এই ক্ষীণালোকদীপ্ত উষার ইতিহাস যতটুকু সাধ্য জানা প্রয়োজন। এই ইতিহাস বাদ দিলে বাঙালীর ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না; এই কারণেই আমি এমনভাবে এমন ইঙ্গিতে এই ইতিহাস উপস্থিত করিলাম যাহার ফলে বাঙালীর এবং বাঙলার জীবন-প্রবাহের মূল উৎস আমাদের হৃদয়মনের নিকটতর হইতে পারে। “আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো।” এই অধ্যায় সেই ‘সকালবেলায় সল্তে পাকানো।’
৯. সংযোজন – ইতিহাসের গোড়ার কথা
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
সংযোজন
১. বাঙালীর ইতিহাসে নরগোষ্ঠী ও জন
ভারতবাসীর ও বাঙালীর নরগোষ্ঠীগত আলোচনা ইতিমধ্যে আর বেশি অগ্রসর হয়নি; বস্তুত পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিষয়ে গবেষণা আলোচনা-বিশ্লেষণে উৎসাহ ও ঔৎসুক্যে যেন একটু ভাটা পড়েছে বলে মনে হয়। যা হোক, এ বিষয়ে যারা আরও জানতে আগ্রহী তারা শ্ৰীযুক্ত অতুল সুর রচিত ‘বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ (জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৯৭৭) বইখানা পড়তে পারেন। এই ছোট বইখানাতে সাম্প্রতিকতম জ্ঞাতব্য সমস্ত তথ্যই সুশৃঙ্খলায় সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই লেখকের বই ‘বাঙলার সামাজিক ইতিহাস’ (কলকাতা, ১৯৭৬) বইখানাও পাঠকদের কাজে লাগতে পারে বলে আমার ধারণা।
নরগোষ্ঠীর প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি একটু অন্য কারণে। এ ব্যাপারে আমার চিন্তা বেশ কিছু দিন যাবৎ একটু অন্য খাতে বইছে, এবং আমারই মতো অনেকের, অন্তত র্যারা মানুষের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের। Race অর্থাৎ নরগোষ্ঠী প্রাণীবাচক (zoological) শব্দ, সংস্কৃতিবাচক নয়। এ অর্থে বিশুদ্ধ কোনও ‘race’ বা নরগোষ্ঠীর কোথাও কিছু অস্তিত্ব কখনও ছিল এমন তথ্য কারও জানা নেই। রক্তের গুণাগুণের এবং কতকগুলো বিশেষ শারীরসাদৃশ্যর উপর নির্ভর করে নৃতাত্ত্বিকেরা পৃথিবীর যাবতীয় মানুষকে কয়েকটি বিভিন্ন নরগোষ্ঠীতে ভাগ করেছেন এবং বিভিন্ন পণ্ডিতেরা বিভিন্ন নামে তাদের চিহ্নিত করেছেন। বিশুদ্ধ ভূমধীয়, অ্যালপীয় বা আদি-অষ্ট্রেলয়েড় বা ভেড়িড় বা ইন্ডিডের কোথাও কেউ সাক্ষাৎ পেয়েছেন, এমন জানা নেই। নামকরণ ক্রিয়াটি যে সাদৃশ্যের তারতম্য-নির্ভর, তা সহজেই অনুমেয়, অর্থাৎ, যে সব মানবগোষ্ঠীর শারীর-পরিমিতি গণনা করা হয়েছে, বা রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে তারা সভ্য সমাজ থেকে যত দূরেই হোক, যত বন্য, যত আদিমই হোক না কেন, তাদের কারও মধ্যেই রক্তের অবিমিশ্র বিশুদ্ধতা তখন আর ছিল না, অল্পবিস্তর সংমিশ্রণ সর্বত্রই ঘটেছে। এই সংমিশ্রণই তারতম্যের হেতু। যা হোক, একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মানব সমাজে বিশুদ্ধ race-এর অস্তিত্ব একান্তই প্রকল্পিত (hypothetical); এর বাস্তব অস্তিত্ব কখনও কোথাও কিছু ছিল, এমন কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, নরগোষ্ঠীগত গবেষণা-আলোচনাদির সার্থকতা নিশ্চয়ই আছে, কারণ পৃথিবীর কোথায়, কোন সমাজে কোন নরগোষ্ঠীর কতটা বিস্তৃতি, কতটা প্রভাব তা ঐতিহাসিকের ও সমাজবিজ্ঞানীর জানা প্রয়োজন, দেশকালকৃত মানব-সমাজকে বোঝবার জন্যই। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন, কোথায় কখন কোন নরগোষ্ঠী বাস্তব, ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন-পরিবেশের প্রভাবে কিভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়ে নূতন রূপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রধানত এই রূপান্তরই নরগোষ্ঠী থেকে জন-এ রূপান্তর, race থেকে people-এ। এবং জন বা people-রচনার সূচনা থেকেই যথার্থ ইতিহাসের ভিত্তি রচনার সূত্রপাত।
জন সাংস্কৃতিক শব্দ, প্রাণীবাচক নয়। যে কোনও raceবা নরগোষ্ঠীর বেশ কিছু সংখ্যক লোক কোনও একটা স্থানে স্থিত হয় কোনও এক কালে; তখন সেই কাল ও স্থানের প্রয়োজন-পরিবেশ, ব্যবহারিক-প্রতিবেশিক রীতিপদ্ধতি ইত্যাদি অনুযায়ী বিশেষ এক জীবনচর্যায় তাদের অভ্যস্ত হতে হয়; কখনও কখনও নিজস্ব নরগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যতর নরগোষ্ঠীর সম্মুখীনও হতে হয়, ক্রমে ক্রমে রক্ত ও ভাষার মিশ্রণও ঘটে। স্থান ও কালের সাংস্কৃতিক প্রভাবে নরগোষ্ঠী তখন জন-এ বা people এ বিবর্তিত-পরিবর্তিত হয়, নরগোষ্ঠীগত পার্থক্য তখন বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতীয় ধ্যানধারণায় নরগোষ্ঠীর ধারণা নেই বললেই চলে, কিন্তু জন-এর ধ্যানধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাচীন। প্রাচীন পুরাণ গ্রন্থে, বিশেষ ভাবে মার্কণ্ডেয় পুরাণে, ভারতবর্ষের জন-সমূহের একটি তালিকা আছে; হয়ত তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু সুদীর্ঘ। লক্ষণীয় এই যে, সর্বত্রই নামগুলি দেওয়া হয়েছে বহুবচনে, অর্থাৎ people অর্থে, যেমন মগধাঃ, অঙ্গাঃ ইত্যাদি। অঙ্গজন ও মগধজনের লোকেরা যেখানে বাস করেন সেই স্থানের নাম অঙ্গজনপদ, মগধ জনপদ। এই জন ও জনপদ রচনা ঋগ্বেদ রচনার কাল থেকেই, হয়ত তার আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল, কিন্তু তার কোনও লিখিত প্রমাণ নেই।
প্রাচীন বঙ্গদেশেও এই জনদের কথাই লিখিত ইতিহাসের আদিতম পর্বে। বঙ্গাঃ, রাঢ়াঃ, সুহ্মাঃ, পুণ্ড্রাঃ এদের নিয়েই বাঙালীর ইতিহাসের কথা শুরু। এদের আগে ছিল কোন জনেরা, তা আমাদের জানা নেই; অনুমান করা যেতে পারে শবর ও নিষাদ জনেরা, কোল্প-ভিল্ল-কিরাত জনেরা। এদের কে কোন নরগোষ্ঠীর বা raceর, এ-প্রশ্নের উত্তর প্রাচীন কোনও সাক্ষ্য প্রমাণে নেই।
২. বাঙালীর প্রাক ও আদি ইতিহাস
[এই অনুচ্ছেদটি নাতিদীর্ঘ একটি অধ্যায় বলেও গণিত হতে পারতো, কিন্তু যেহেতু প্রাক ও আদি ইতিহাস ইতিহাসেরই গোড়ার কথা, সেই হেতু অনুচ্ছেদটিকে দ্বিতীয় অধ্যায়েই সংযোজন করা হলো। ]
মূল গ্রন্থটি যখন রচিত ও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন সৃজ্যমান বাঙালীর প্রাক ও আদি ইতিহাসের কোনও তথ্যই আমাদের জানা ছিল না বললেই চলে। গত পঁচিশ বৎসরে পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙলাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার যা হয়েছে তা গুণে ও পরিমাণে সুপ্রচুর। বাঙলাদেশের আবিষ্কার প্রধানত ঐতিহাসিক কাল সংক্রান্ত, এবং সে আবিষ্কারের ফলে পঞ্চম খ্ৰীষ্ট শতাব্দী থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালীর ইতিহাসের প্রচুর নূতন তথ্য ও তার অর্থনির্দেশ আমাদের গোচরে এসেছে। এ গ্রন্থের এই পরিশিষ্টে যথাস্থানে তা উল্লিখিত হবে, অবশ্যই যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ততায়।
তবে বিস্ময়কর আবিষ্কার ঘটেছে পশ্চিম বঙ্গে, এবং সে আবিষ্কার অনুসরণ করে নূতন নূতন অনুসন্ধান আজও চলছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই যা পাঠকসাধারণের এবং বিশেষজ্ঞদের গোচরে এসেছে তার যোগফল বাঙালীর ইতিহাসে নূতন একটি অধ্যায় রচনার সূচনা করেছে, এমন একটি অধ্যায় যার শুরু খ্ৰীষ্টপূর্ব একহাজার বৎসরেরও আগে এবং যাকে বাঙালীর বাস্তব ইতিহাসের প্রাক উষা অধ্যায় বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এ অধ্যায় পরম্পরাগত শ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, সাহিত্যধৃত অস্পষ্ট স্মৃতি বা কাহিনীর উপরও নয়; এ অধ্যায় প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বাঙালী কৃষি-সমাজের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব উপাদান-উপকরণের উপর।
প্রাচীন রাঢ়দেশের কেন্দ্রভূমি বর্তমান বীরভূম ও বর্ধমান জেলা। এই দুই জেলার প্রাণপ্রবাহ ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর-কোপাই-অজয়-কুকুর-দামোদর নদনদীমালা। এই দুই জেলার সংলগ্ন সুবর্ণরেখা ও কংসাবতী বিধৌত মেদিনীপুর, বাকুড়া ও পুরুলিয়া। এই নদনদীগুলির প্রত্যেকটিরই উৎসস্থল বিন্ধা-শুক্তিমান কুলাচল দুটির পূর্বতম বিস্তৃতি ছোটনাগপুর-ওড়িশার নিম্নশায়ী পাহাড়গুলি। শীতে ও গ্রীষ্মে এই নদনদীগুলি শীর্ণকায়া, ক্ষীণধারা, কিন্তু বর্ষায় স্ফীতকায়া, খরস্রোতা, দুর্বার, ভীষণা ও দুকুলপ্লাবিনী। হাজার হাজার বছর ধরে প্রতি বর্ষার দুর্বার খরস্রোত ছোটনাগপুর-ওড়িশার পাহাড়গুলি থেকে ছোটবড় কাকর মেশানো লাল-গেরুয়া মাটি বয়ে এনে ঢেলে দিয়েছে নদীগুলির তীরে তীরে, প্লাবনের স্রোত সেই মাটিকে ঠেলে নিয়ে গেছে দূরে দূরান্তরে, কোথাও বেশি, কোথাও কম; যত দূরে তত কম, যত কাছে তত বেশি। বীরভূম, বর্ধমান, বাকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের ইহাই ভূপ্রকৃতি; পশ্চিম বঙ্গের ইহাই পুরাভূমি। এই ভূমি কঠিন, রুক্ষ, প্রান্তর জুড়ে কাকর-লালমাটির ঢেউ, কোথাও কোথাও ছোটবড় পাথর-স্তুপের উৎক্ষেপ। জৈন আচারঙ্গ সূত্রের একটি কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহাবীর জিন এসেছিলেন রাঢ়দেশের কোনও এক অঞ্চলে, যে অঞ্চলের নাম বলা হয়েছে বজ্রভূমি। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ভূমি যথার্থতই বজ্রভূমি।
অথচ, কিছু কিছু অংশ বাদ দিলে এই বজ্রভূমি আজও উর্বরা, শস্যপ্ৰসূ। গত পনেরো-বিশ বৎসরের প্রত্নানুসন্ধান ও উৎখননের ফলে আমরা আজ যেন জেনেছি, এই ভূমির প্রাণদাত্রী নদনদীগুলির তীরে তীরেই বাঙালীর প্রাচীনতম সংস্কৃতির অভ্যুদয় ঘটেছিল, বাঙালীর চাষবাস, ধান্য শস্যোৎপাদন, ঘরবাড়ি নির্মাণ, জীবনোপায়ের নানা পথ। এ জানা সম্ভব হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে ও বিভাগীয় অধিকর্তা, আমার প্রাক্তন ছাত্রদের অন্যতম পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের কৃতিত্বে। উৎখননের যত দোষক্ৰটি থাকুক, তার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার সঙ্গে যতোমত-পার্থক্যই পণ্ডিতদের থাকুক, পরেশচন্দ্রই বাঙালীর ইতিহাসে এই নূতন অধ্যায় যোজনার প্রথম ও প্রধান নায়ক।
বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের অদূরেই অজয়তীরবর্তী বনকাটি গ্রাম। প্রায় তারই সংলগ্ন ইলামবাজার, একটু দূরেই অধুনা বিখ্যাত পাণ্ডুরাজার টিবি। প্রত্নানুসন্ধানের ফলে এই বনকাটিতে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রত্নাশ্মীয়পর্বসুলভ অশ্মীভূত কাঠের এবং স্ফটিকে তৈরী অনেক ছোটবড় কারুযন্ত্র। দামোদর নদের তীরে বীরভনপুর গ্রাম। এই গ্রামের একটি স্থানে উৎখননের ফলে অসংখ্য স্ফটিক ও অন্যান্য গুড়ো পাথরের তৈরী ক্ষুদ্রাশ্মীয় কারুযন্ত্র পাওয়া গেছে, তিনফুট মাটির নীচে। তারও নীচে নবাশ্মীয় পর্বের সমভূমিতে গোচর হয়েছে কয়েকটি গর্ত; গর্তগুলি যে বাশের বা কাঠের বা পাথরের খুঁটির তা সহজেই অনুমেয়। এ অনুমানেও বাধা নেই যে, খুঁটির উপর একটি চালও ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এখানে ক্ষুদ্রাষ্ট্ৰীয় যন্ত্রপাতি নির্মাণের একটি কারখানা ছিল। যাই হোক, প্রত্নানুসন্ধানের ফলে জানা গেছে যে, এই উৎখনিত স্থানটির আশে পাশে প্রায় এক বর্গমাইল জুড়ে একটি ক্ষুদ্রাশ্মীয়পর্বের প্রত্নস্থান বিস্তৃত।
স্ফটিক ও অন্যান্য পাথরের তৈরী এই ধরনের ক্ষুদ্রাষ্ট্ৰীয় কারুযন্ত্র পূর্বোক্ত পুরাভূমি নানা জায়গা থেকেই পাওয়া গেছে, কোথাও পরবর্তী কালের কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের সঙ্গে, কোথাও বা কোনও অনুষঙ্গ ছাড়াই। ক্ষুদ্রাশ্মীয় কারুষন্ত্রের ব্যবহার মানব ইতিহাসের নবাশ্মীয় পর্বের সঙ্গেই জড়িত, সন্দেহ নেই, কিন্তু টুকরোটাকরা এই সব বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু তথ্যাদি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে এখনও এমন কিছু আবিষ্কৃত হয়নি, একমাত্র বীরভানপুর গ্রাম ছাড়া, যার ফলে আমরা প্রাগৈতিহাসিক নবাশ্মীয় পর্বের বঙ্গীয় সমাজের মোটামুটি একটা ধারণা করতে পারি। এ পর্বের যা যা বিশিষ্ট লক্ষণ, যেমন শস্যোৎপাদনের প্রবর্তনা, বন্যপশুকে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করা, ইত্যাদির কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
আপেক্ষিক ভাবে সুস্পষ্ট ও কতকটা সুসংবদ্ধ রূপ প্রথম ধরা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যাকে বলেন তাম্রশীয় পর্ব বা পর্যায়, সেই কাল থেকে। পশ্চিমবঙ্গে সেই পর্বের সূচনা খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রায় ১৩০০-১২০০ বৎসর থেকে। নবাশ্মীয় পর্বের যে দু’চারটি লক্ষণ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি এই তাম্রাশ্মীয় পর্বেও লক্ষ্য করা যায়; সেজন্য কোনও কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক এই পর্বকে নবাশ্মীয়-তাম্রাশ্মীয় পর্ব বা পর্যায় বলেও চিহ্নিত করে থাকেন। এই হচ্ছে মানুষের সামাজিক ইতিহাসের সেই পর্ব যখন সে যন্ত্রপাতি নির্মাণে শুধু পাথর মাত্র আর ব্যবহার করছেনা সঙ্গে সঙ্গে এবং ক্রমবর্ধমান পরিমাণে ধাতুও ব্যবহার করছে, এবং সে ধাতু হচ্ছে তাম্র বা তামা এবং মিশ্রধাতু ব্রোঞ্জ। এই দুই ধাতুনির্মিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলেই সমাজের একটি নূতন রূপ দেখা দেয়; সে রূপের প্রধান লক্ষণ চাষের প্রবর্তনা, স্থায়ী বসতি ও বাস্তুনির্মাণ, গৃহপশু পালন, সমাজ-নির্মাণ। এই নুতন রূপটি প্রথম ধরা পড়েছে পাণ্ডুরাজার ঢিবি উৎখননের ফলে। এই রূপই বাঙালীর আদি-ইতিহাসের রূপ।
পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননের পদ্ধতি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ যে আছে, সে সম্বন্ধে আমি একেবারে অনবহিত নয়। তবু, আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমার ধারণা হয়েছে, এই উৎখনন নির্গত প্রত্নতথ্যাদি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং তার আশ্রয়ে বাঙালীর আদি-ইতিহাসের একটা কাঠামো দাড় করানো কঠিন নয়।
যে কোনও প্রত্নোৎখননের নিম্নতম স্তর প্রাসঙ্গিক প্রত্নেতিহাসের আদিতম বা প্রথম স্তর। পাণ্ডুরাজার ঢিবির এই আদিতম স্তর বালিময় পলিমাটির স্তর। এই স্তরের উপর পাওয়া গেছে নানা প্রকারের মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের টুকরোটাকরা যার ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ছোট ছোট টুকরো। সবচেয়ে উল্লেখ্য হচ্ছে, নরকঙ্কাল সমেত কয়েকটি শবসমাধি। এই কঙ্কালগুলির উপরাধ পাওয়া যায়নি, কিন্তু শবদেহগুলি যে পূর্বশিরে শায়িত ছিল, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এই স্তরটি ঢাকা পড়েছে একটি শ্বেত-হরিদ্রাভ পাতলা বালির আস্তরণে; উৎখনক অনুমান করেছেন, আস্তরণটি অজয়ের কোনও প্লাবনের পলিমাটি। আস্তরণটির উপর পাওয়া গেছে কিছু কাঠকয়লার টুকরো, কয়েকটি ক্ষুদ্রাশ্মের তৈরী কারুযন্ত্র এবং শ্বেতাভ চিত্ররেখাঙ্কিত ঘনধুসর রঙের মৃৎপাত্রের কয়েকটি টুকরো।
পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় স্তরে আহৃত প্রত্নবস্তু ও প্রত্নতথ্য অর্থবহ। এ স্তরে যে সব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে নানা আকৃতি-প্রকৃতির ক্ষুদ্রাশীয় কারুযন্ত্র, চিত্রিত এবং ছিদ্রকৃত লাল ও কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, জলনালীযুক্ত মৃৎজলপাত্র, তামার তৈরী নানা অলংকার (তার ভেতর আছে পেচানো সর্পিল বালা, আংটি ও কাজল লাগাবার কাঠি) তামার মাছ ধরবার বঁড়শি ইত্যাদি। মৃৎপাত্রগুলির রং, গড়ন ও অলংকরণ, এগুলির আকৃতি-প্রকৃতি এবং তামার ব্যবহার, এসব লক্ষণ সন্দেহের কোনও অবকাশ রাখে না যে, রাঢ়ের এই অঞ্চল তখন মানব-সভ্যতার তাম্রাশ্মীয় পর্বে উন্নীত হয়েছে। তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় এই স্তরে বাস্তুনির্মাণের যে নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভেতর। সরলরেখায় সুবিন্যস্ত অনেকগুলি গৃহতল এখানে গোচর হয়েছে; এই গৃহতল তৈরী করা হয়েছে গেরুয়া কাকর মাটি দিয়ে এবং তার উপর খুঁটি পোতার গর্তের চিহ্ন সুস্পষ্ট। একটি সরু বাধানো গলির কিছুটা চিহ্ন এখনও আছে; আর আছে একটি বিস্তৃত শব-সমাধিস্থান যেখানে পূর্ব-পশ্চিমশায়ী করে মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হতো। এই স্তরেই পাওয়া গেছে কিছু মাটির বড় বড় তাল যার উপর ছাপ লেগে আছে নলখাগড়ার, আর পাওয়া গেছে পোড়ামাটির টালির বড় বড় টুকরো। এ অনুমানে বাধা নেই যে, এই স্তরের মানুষ যে-ঘরে বাস করতো তার বেড়া ছিল নলখাগড়ার যার উপর থাকতো মাটির আস্তরণ, আর চাল ছিল পোড়ামাটির টালির। উত্তর ভারতবর্ষের অন্যত্র তাম্রাশ্মীয় যুগের যে সব লক্ষণ দেখা যায়, এই স্তরেও তার বেশ কিছু লক্ষণ স্পষ্টতই ধরা পড়েছে।
যে শব-সমাধিস্থানটির কথা এই মাত্র বলা হলো তার সমস্তর থেকে কুড়িয়ে নেয়া এক খণ্ড কাঠকয়লা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বীক্ষণাগারে পাঠানো হয়েছিল, তেজস্ক্রিয়অঙ্গারক পরীক্ষা করে তার তারিখ নির্ণয়ের জন্য। সে পরীক্ষায় যে-তারিখ নির্ণত হয়েছে তা হচ্ছে খ্ৰীষ্টপূর্ব ১২১০±১২০, অর্থাৎ ১২০ বৎসর কম বা বেশি খ্ৰীষ্টপূর্ব ১০১২ বৎসর। আদি-ইতিহাসের যুক্তিতেও এ তারিখ সম্বন্ধে আপত্তি করবার কিছু নেই। এর অর্থ এই যে, পাণ্ডুরাজার ঢিবির আদিস্তরের তারিখ আনুমানিক আরও দুশ বছর আগে, অর্থাৎ খ্ৰীষ্টপূর্ব ১২৫০/১২০০। অনুমান করা চলে, এই অঞ্চলেই এই সময়ে মানুষের প্রথম সমাজ-রচনার সুষ্ঠু প্রকাশ এবং সংস্কৃতির পথে প্রথম পদক্ষেপ।
এই উৎখননের তৃতীয় স্তরে বাস্তব সংস্কৃতির যে সব উপাদান উপকরণ পাওয়া গেছে তা মোটামুটি দ্বিতীয় স্তরেরই মতো। বস্তুত, আমার দৃষ্টিতে দ্বিতীয় ও তথাকথিত তৃতীয় স্তরে ভেদ কিছু আছে, এমন মনে হয় না। জলনালীযুক্ত মৃৎজলপাত্র, একপদী মৃৎভাণ্ড, নানা আকৃতি-প্রকৃতির চিত্রিত ও নকশাযুক্ত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, লোহিত ও কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভাঙ্গা টুকরো, তামার তৈরী অলংকারাদি এবং প্রচুর ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতিও পাওয়া গেছে। তা ছাড়া পাওয়া গেছে পশুর হাড় বা শিং-এর তৈরী কিছু যন্ত্র, কিছুটা বড় সূচ জাতীয়। এ ধরনের সূচ দ্বিতীয় স্তরেও কিছু পাওয়া গেছে; কিন্তু এই তৃতীয় স্তরে এমন সংখ্যায় পাওয়া গেছে যাতে সন্দেহ হয়, এখানে এ ধরনের যন্ত্র-নির্মাণের ছোটখাটাে একটা কারখানাই বুঝি বা ছিল। পোড়ামাটির তৈরী একটি নারীমূর্তির দেহের কিয়দংশ এবং দুটি বিজাতীয় পুরুষ-মূর্তির মাথাও পাওয়া গেছে এই স্তর থেকেই। রান্নার উনুনের নিদর্শনও আছে। কিন্তু তৃতীয় স্তরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও অর্থবহ আবিষ্কার হচ্ছে একদিকে মসৃণ তীক্ষাগ্র নবাশ্মীয় কয়েকটি cells এবং অন্যদিকে লোহার তৈরী ছোট কয়েকটি ফলা ও তীক্ষাগ্র সূচ। খুব তুচ্ছ পরিমাণে হলেও এই স্তরে লোহার এই ব্যবহার একটু বিস্ময়কর, বোধ হয়, সন্দেহজনক। এই তৃতীয় স্তরেই অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রচুর ছাই-এর চাপ উৎখনকদের গোচরে এসেছে। এ থেকে তারা অনুমান করেছেন, কোনও এক সময়ে বড় একটা অগ্নিকাণ্ডে এখানকার অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল; ছাইয়ের চাপ সেই অগ্নিদাহের। বিস্ময়ের কথা এই যে, এই ছাই-এর চাপের উপরই পাওয়া গেছে আরও প্রচুর লোহার তৈরী যন্ত্রপাতি এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যাচ্ছে একেবারে নূতন ধরনের মৃৎপাত্রশিল্পের প্রচুর নিদর্শন, যা সাধারণত পাওয়া যায় ৬০০–২৫০ খ্ৰীষ্টপূর্ব কালের ভূগর্ভ স্তরে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অগ্নিদাহের পর জায়গাটি পরিত্যক্ত হয়েছিল; পরে ৬০০-২৫০ খ্ৰীষ্টপূর্ব তারিখের ভেতর কোনও নূতন আগন্তুকেরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন; মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষগুলি তাদেরই সংস্কৃতির পরিচায়ক। কিন্তু লোহার যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র যা তৃতীয় স্তরে পাওয়া গেছে তা নিয়ে এ ধরনের কোনও সন্দেহ নেই, অন্তত উৎখনকদের মনে; তাদের দৃঢ় ধারণা, খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ১০০০ বৎসরের কাছাকাছি, তৃতীয় স্তরে একই সঙ্গে ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতি, তামার অলংকারাদি এবং লোহার যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র একই সঙ্গে ব্যবহৃত হতো। উল্লেখ প্রয়োজন যে, লোহার অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে বাটসহ তীক্ষ্ণমূখ একটি ছোট তরোয়াল, নাতিক্ষুদ্র তীরের শিরাগ্র এবং একটি নাতিক্ষুদ্র bar celt | ব্যক্তিগতভাবে আমি এ সম্বন্ধে উৎখনকদের মতামতে গভীর সন্দিহান। আমার ধারণা, তৃতীয় স্তরের লৌহ-অভিজ্ঞান যা কিছু সমস্তই কিছুটা পরবর্তী কালের; নূতন ধরনের মৃৎপাত্র নিয়ে যে সব নূতন আগন্তুক এসেছিল এখানে নূতন বসতি স্থাপন করতে তারাই নিয়ে এসেছিল লোহার ব্যবহার, লোহার যন্ত্রপাতি, লোহার অস্ত্রশস্ত্র। এবং এ ব্যাপারটা খ্ৰীষ্টপূর্ব ৭০০ শতকের আগে ঘটেছিল বলে একেবারেই আমার মনে হয় না।
আমার সন্দেহের প্রথম কারণ, পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননের চতুর্থ স্তরে লোহার তৈরী কোনও যন্ত্রপাতি, কোনও অস্ত্রশস্ত্ৰ-নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়নি, যা, উৎখনকের যুক্তিতে, পাওয়া উচিত ছিল। অন্তত পরেশচন্দ্রের বিবরণে তার কোনও উল্লেখ নেই। তৃতীয় স্তরে লোহা ব্যবহারের প্রচলন থাকলে চতুর্থ স্তরে তার অভিজ্ঞান আরও অনেক বেশি থাকবার কথা; বস্তুত তা নেই। সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ, ভারতবর্ষে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে লোহার ব্যবহারের সূচনা ও বিস্তৃতির দীর্ঘ ইতিহাস এবং অন্যদিকে মানব-সংস্কৃতির বিকাশে লোহা-ব্যবহারের প্রভাব ও প্রতিপত্তির ইতিহাস। এই উভয় ইতিহাসের আলোচনার স্থান এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট্রের পরিমিত সীমার মধ্যে সম্ভব নয়; হয়ত প্রয়োজনও নেই। শুধু এটুকু বলাই বোধ হয় যথেষ্ট যে, পশ্চিম এশিয়া থেকে শুরু করে লোহার ব্যবহার তক্ষশীলা ভেদ করে (খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ১১০০/১০০০), পশ্চিম যুক্ত-প্রদেশের আত্রাঞ্জিখেরা হয়ে (আনুমানিক ৯০০), বিহার ছুয়ে (আনুমানিক ৮০০/৭০০) রাঢ়দেশে পৌছুতে আনুমানিক খ্ৰীষ্টপূর্ব ৭০০’র আগে হবার কথা নয়। অবশ্য আমি অবহিত আছি যে, ছোটনাগপুর অঞ্চলে আকরিক লৌহবালুকা থেকে লোহা গলাবার আদিম একটা পদ্ধতি স্থানীয় আদিম অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই ঢিবির তৃতীয় স্তরে পাওয়া লৌহ যন্ত্রগুলির লোহা এই আদিম পদ্ধতির লোহা বলে মনে হয় না। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু এই স্তরে লোহা ব্যবহারের যে তারিখ (খ্ৰীষ্টপূর্ব ১০০০) পরেশচন্দ্র ধার্য করতে চান সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রয়ে গেল। আমার সন্দেহের তৃতীয় কারণ, বোলপুর সন্নিহিত মহিষদলে লোহা ব্যবহারের তারিখ; তেজস্ক্রিয়-অঙ্গারক পরীক্ষায় এখানকার যে তারিখ নির্ণীত হয়েছে তা খ্ৰীষ্টপূর্ব ৭০০’র আগে নয়।
যাই হোক, পাণ্ডুরাজার ঢিবির চতুর্থ স্তরের উৎখনন বিবরণ পড়ে আশঙ্কা হয়, এখানকার ভূমিস্তর একাধিকবার বেশ আবর্তিত হয়েছে; কখন হয়েছে বলা কঠিন; এই স্তরের দুই পর্যায়ে যে সব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তা একই সংস্কৃতির লক্ষণে চিহ্নিত, এমন মনে হয় না। ত্রিকোণাকৃতি পোড়ামাটির বাটি, সাধারণ মৃৎভাণ্ড, লাল রঙের মৃৎপাত্র, মুদ্রিত অথবা খোদিত নানা নকশাযুক্ত মৃৎভাণ্ড, জলের ঝাঁঝরি, কয়েকটি পোড়ামটির পশু ও স্ফীতবক্ষ নারীমূর্তি, সুবিন্যস্ত একসারি মাছ ও তার উপর তির্যক রেখায় খোদাই করা একটি মৃৎভাণ্ড প্রভৃতির ভগ্নাবশেষ এই স্তর থেকে আহত হয়েছে। এ সমস্তই অল্পবিস্তর পরিচিত ঐতিহাসিক কালের; এই সব বস্তু আদি ইতিহাসের লক্ষণে চিহ্নিত নয়, এবং সে-ঐতিহাসিক কাল মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০/২৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত। চতুর্থ স্তরের একটি গর্তে কালো steatite পাথরের একটি গোল শীলমোহর পাওয়া গেছে; এই প্রত্নদ্রব্যটি নিঃসন্দেহে মূল্যবান। শীলমোহরটির উপর তিনভাগে বিভক্ত তিনটি উচ্চাবচ (relief) চিত্র যার বিষয় উদ্ধার করতে আমি অপারগ। পরেশচন্দ্র এই চিত্রগুলির একটা বর্ণনা দিয়েছেন; সে-বর্ণনা আমি ছবির সঙ্গে ঠিক মেলাতে পারছিনে। জনৈক ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক বলেছেন, শীলমোহরটির উৎস প্রাচীন মিনোয়া (Minoan) সংস্কৃতি। এ উৎস আমি দেখতে পাচ্ছিনে, সখেদে তা স্বীকার করছি। এই শীলমোহরটির এবং একটি মৃৎফলকের অভিজ্ঞান, তমলুকে প্রাপ্ত কয়েকটি মৃৎভাণ্ডের ভগ্নাবশেষ,চব্বিশ পরগণা জেলার হরিনারায়ণপুর ও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত কয়েকটি শীলমোহর ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের মধ্যে পরেশচন্দ্র প্রাচীন ক্রিটিয় (cretan) ও মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির লক্ষণ লক্ষ করেছেন এবং তা থেকে অনুমান করেছেন, পাণ্ডুরাজার ঢিবির এবং বাঙালীর আদি-ইতিহাসের সংস্কৃতি ও জীবনচর্য প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর ছিল এবং সে-ব্যবসাবাণিজ্য বৈদেশিক, ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে। এ অনুমান যথার্থ কি অযথার্থ, তা বলা আমার পক্ষে আপাতত কঠিন, যেহেতু আমি পরেশচন্দ্র কথিত সাদৃশ্যগুলি সম্বন্ধে কিছুটা সন্দিহান, এবং এই অনুমিত সাদৃশ্য ছাড়া এ পর্বে এ ধরনের বিস্তৃত বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্য কোনও প্রমাণ এখনও দেখতে পাচ্ছিনে।
প্রাচীন রাঢ়ের, বিশেষভাবে পূর্বোক্ত নদনদীগুলির তীরে তীরে নানা জায়গায় তাম্রাশ্মীয়-নবাশ্মীয় পর্বের নানা প্রত্ন-নিদর্শন পাওয়া গেছে, কিন্তু পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননই এই সব আবিষ্কারের সূচনায়। বস্তুত, এই ঢিবিই বাঙালীর আদি ইতিহাসের কুঞ্চিকা। এই কারণেই এই উৎখননের বিবরণ একটু সবিস্তারেই বলতে হলো।
এই উৎখনন-বিবরণের পরই বলতে হয় বোলপুর সন্নিহিত কোপাই-তীরবর্তী মহিষদল গ্রামে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের উৎখননের কথা। এখানকার প্রথম স্তর একান্তই তাম্রাশ্মীয়। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যেমন, এখানেও সেই মাটির আস্তরণযুক্ত নলখাগড়ার দেয়ালওয়ালা ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, পাথরের ধারালো ফলার যন্ত্রপাতি, তামার তৈরী চ্যাপ্টা cell, কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, লাল মৃৎপাত্রের টুকরো, নালিযুক্ত জলপাত্র। তা ছাড়া উল্লেখ্য হচ্ছে, এখানে পাওয়া গেছে বেশ কিছু পরিমাণে পোড়া ধান-চালের অঙ্গার। তেজস্ক্রিয় অঙ্গর পরীক্ষায় এই স্তরের তারিখ নির্ণত হয়েছে খ্ৰীষ্টপূর্ব ১৩৮০ থেকে ৮৫৫’র ভেতর। দ্বিতীয় স্তরেও একই ধরনের মৃৎপাত্র নিদর্শন, তবে এই স্তরের পাত্রগুলির প্রকৃতি একটু স্থূল। কিন্তু এই স্তরের বিশিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে লোহার আবির্ভাব। এই স্তরেও তেজস্ক্রিয় অঙ্গার পরীক্ষা হয়েছে; তারিখ পাওয়া গেছে খ্ৰীষ্টপূর্ব মোটামুটি ৭০০।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব সংস্থা অজয়-কুন্নুর-কোপাইর অববাহিকার, নানা প্রত্নস্থানে প্রচুর প্রত্নানুসন্ধান করেছেন। বসন্তপুর, রাজার ডাঙ্গা, গোস্বামীখণ্ড, মঙ্গলকোট, গঙ্গাডাঙ্গা, কীর্ণহার, চণ্ডীদাস-নানুর, বেলুটি, সুপুর, মন্দিরা, শালখানা, সুরথরাজার ঢিবি, যশপুর প্রভৃতি নানা জায়গায় প্রত্নানুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে তা প্রায় সবই তাম্রাশ্মীয় পর্বের এবং মোটামুটি পাণ্ডুরাজার টিবি ও মহিষদলের সাংস্কৃতিক জীবনের সমর্থক। বস্তুত, সন্দেহের কোনও কারণ নেই যে, এই অঞ্চলেই ইতিহাসের তাম্রাশ্মীয় পর্বের বাঙালী বসতিস্থাপন করে বাস্তু তৈরী করে শস্যোৎপাদন, পশুপালনে এবং সমাজগঠনে প্রথম অভ্যস্ত হয়েছিল।
১৯৭৪-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব-সংস্থা বর্ধমান শহর থেকে ২৮/২৯ কিলোমিটার উত্তরে বড়বেলুন গ্রামের বানেশ্বরডাঙ্গায় কিছু প্রত্নোৎখনন করেছিলেন। এই খননেরও প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে তাম্রাশ্মীয় পর্বের বাস্তব সভ্যতার নানা নিদর্শন পাওয়া গেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডক্টর শ্রীমতী অমিতা রায়ের সৌজন্যে এবং পরেশচন্দ্রের অনুগ্রহে পরেশচন্দ্রেরই রচিত এই খননের একটি সংক্ষিপ্ত (অপ্রকাশিত) বিবরণ আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। তাতে দেখতে পাচ্ছি, এখানে প্রাপ্ত নানা আকৃতি-প্রকৃতির মৃৎপাত্রাবশেষ প্রাচুর্য যেন পাণ্ডুরাজার ঢিবির চেয়েও বেশি। ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতির ভগ্নাংশ, হাড় ও তামার তৈরী দ্রব্যাদি এবং ঘরবাড়ির ধবংসাবশেষও পাওয়া গেছে, যেমন পাওয়া গেছে এই পর্বে পাণ্ডুরাজার টিবি ও মহিষদলে। কিছু কিছু অভিজ্ঞান থেকে মনে হয়, এই পর্বে এখানকার মানুষ ধান চাষ করতো, মাছ এবং পশু শিকারও করতো; প্রচুর মাছ ও পশুর কাটা ও হাড় পাওয়া গেছে এই প্রত্নস্থানের প্রথম দুই স্তরেই। তৃতীয় স্তরে পাওয়া গেছে লোহা ব্যবহারের কিছু অভিজ্ঞান | চতুর্থ স্তরে ঐতিহাসিক পর্ব শুরু হয়ে গেছে।
১৯৭৫-৭৬-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ডক্টর অমিতা রায়-এর নেতৃত্বে এক বিস্তৃত প্রত্নানুসন্ধানাভিযান চালিয়েছিলেন ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর ও অজয়-কুন্নুর-দামোদরের অববাহিকার নানা অঞ্চলে। আমার প্রাক্তন ছাত্রী অমিতা রায় এই অভিযানের যে-প্রতিবেদন রচনা করেছেন তার একটি প্রতিলিপি তিনি আমায় ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন রাঢ়ের বিস্তৃত অংশে বাঙালীর আদি-ইতিহাসের চেহারাটা কী ছিল তার একটা মোটামুটি সামগ্রিক পরিচয় এ-যাবৎ অপ্রকাশিত এই প্রতিবেদনটিতে পাওয়া যায়।
পাণ্ডুরাজার ঢিবি, বানেশ্বরভাঙ্গা, মহিষদল, ভরতপুর ও অন্যান্য প্রত্নস্থান থেকে আদি-ইতিহাসের যে-চিত্র দৃষ্টিগোচর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযানের আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু সমস্তই সে-চিত্রকে আরও স্ফুটতর করেছে। তবে, এ অভিযান থেকে মনে হচ্ছে, ময়ূরাক্ষী বক্রেশ্বর-কোপাই-অজয়-কুকুর-দামোদরবিধৌত রাঢ়দেশেও তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির বিস্তার সর্বত্র সমান নয়। ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বরের উপর দিকের প্রবাহে, অর্থাৎ বীরভূম জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে এ সংস্কৃতির বিস্তার অপেক্ষাকৃত কম, মধ্য ও দক্ষিণাংশে বেশি, এবং পূর্বদিকে, অর্থাৎ বক্রেশ্বর-অজয়-দামোদরের সংযোগ স্থলের দিকে এগিয়ে গেলে মনে হয়, তাম্রাশ্মীয় পর্বের লোকেরা যেন ক্রমশ সেইদিকেই বিস্তৃত হতে থাকে। যাইহোক, এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে, তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল এই ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর-অজয়-কুমুর-দামোদরের অববাহিকা অঞ্চল। এই উর্বর, শস্যপ্রসূ অঞ্চলের সঙ্গে জলপথে ও স্থলপথে দেশের ও বিদেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল, এ সম্বন্ধেও সন্দেহ নেই, এবং এই কারণেই এই অঞ্চলে এতগুলি তাম্রাশ্মীয় প্রত্নস্থান ইতস্তত প্রকীর্ণ। এই অঞ্চলে নবাশ্মীয় celts অনেকগুলির প্রত্নস্থান থেকেই পাওয়া গেছে, কিন্তু নবাশ্মীয় প্রাথমিক কৃষি-সংস্কৃতি থেকে কী করে তাম্রাশ্মীয় পর্বের বিবর্তিত বিস্তৃত কৃষি-সংস্কৃতির উদ্ভব হলো তার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান আজও আমাদের জানা নেই। পাণ্ডুরাজার ঢিবির প্ৰথম স্তরের প্রত্নবস্তুর মধ্যেও এ সম্বন্ধে যা অভিজ্ঞান পাওয়া যায়, তা খুব স্পষ্ট ও পরিষ্কার নয়; সেখানে নবাশ্মীয় ও তাম্রাশ্মীয় অভিজ্ঞান এমনভাবে মিশে আছে যে, তা থেকে সুস্পষ্ট কোনও ধারণা করা যায় না |
তাম্রাশ্মীয় পর্বের প্রধান লক্ষণ যে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র, অমিতা রায়-এর অভিযানের পর এ সম্বন্ধে আর সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে, এই ধরনের মৃৎপাত্রের বিস্তৃতি এ অঞ্চলের সর্বত্র সমান নয়। যা হোক, তার এ অনুমান হয়ত যথার্থ যে, তাম্রাশ্মীয় এই সংস্কৃতিই গামা-সমাজ সংঘটন ও উন্নততর, বিস্তৃততর কৃষিকর্মের দ্যোতক। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সংস্কৃতির সঙ্গে নাড়ীর যোগ ছিল গাঙ্গেয় ভারত, মধ্যভারত ও রাজস্থানের তালাশ্মীয় সংস্কৃতির। কিন্তু, এমনও তো হতে পারে যে, এই যোগাযোগটা ঘটেছিল গাঙ্গেয় ভারতের মাধ্যমে নয়, ওড়িশার মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে অমিতা রায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিছু কিছু ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতি এবং কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের প্রতি, যা পাওয়া গেছে বীরভূম-বর্ধমানে নয়, পাওয়া গেছে কংসাবতী-বিধৌত মেদিনীপুর-ধাকুড়া-পুরুলিয়ায়, অর্থাৎ যার ইঙ্গিত ওড়িশামুখী।
মহিষদল-উৎখননের প্রথম স্তরে তামার তৈরী ভাঙা একটি কুড়োল মতো জিনিস পাওয়া গেছে। ঠিক এই ধরনের তামার তৈরী কুড়ালোপম প্রত্নবস্তু কিছু কুড়িয়ে পাওয়া গেছে মেদিনীপুর-ধাকুড়া-পুরুলিয়ার নানা প্রত্নস্থান থেকে। ইতিহাসের আদিপর্বে এই অঞ্চলে তামার তৈরী যন্ত্র, অস্ত্র প্রভৃতির ব্যবহার প্রচলিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই, কিন্তু এর পূর্বাপর – কী, এই বিশিষ্ট ধাতুশিল্পটির কী স্থান ছিল এই অঞ্চলের সমসাময়িক জীবনে, সে সম্বন্ধে কোনও ধারণা করবার উপায় এখনও নেই।
অমিতা রায়-এর অভিযান-প্রতিবেদন থেকে একটি তথ্য যেন কিছুটা স্পষ্টতর হয়ে ধরা পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর-অজয় অঞ্চলে তাম্রাশ্মীয় পর্বের এবং লোহা ব্যবহারকারী লোকদের পর নিরবচ্ছিন্ন জনবসতি আর যেন নেই। যে কারণেই হোক, এ অঞ্চল থেকে মানুষ যেন অন্যত্র সরে গেছে। কিন্তু অজয়-কুনুর-দামোদর- ভাগীরথী অঞ্চলের আদি-ঐতিহাসিক চিত্রটা যেন বেশ অন্য প্রকারের। এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে বেশ একটু লক্ষণীয় বৈষয়িক সমৃদ্ধি যেন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। পাণ্ডুরাজার ঢিবির তৃতীয় স্তরেই তা কিছুটা দেখা গেছে, কিন্তু তা স্পষ্টতর হয়েছে অজয়-কুমুর-ভাগীরথীর সংযোগস্থলের প্রত্নস্থানগুলিতে। এ অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, লৌহ-ব্যবহার-চিহ্নিত সমৃদ্ধ জনবসতি নিরবচ্ছিন্নতায় ঐতিহাসিক কালে এসে মিশে গেছে। খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ৩০০ নাগাদ এই অঞ্চল যে সমসাময়িক উত্তর-ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এ সম্বন্ধে সন্দেহের আর কোনও অবকাশ নেই। যে সব প্রত্নবস্তু এ অঞ্চলের প্রত্নস্থানগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে, যেমন, উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, নানা চিহ্নে মুদ্রিত মুদ্রা, ছোটবড় bead ও অন্যান্য শিল্পদ্রব্য, তার ভেতরই সে-সাক্ষ্য নিহিত। বস্তুত, খ্ৰীষ্টপূর্ব মোটামুটি ৩০০ থেকে শুরু করে খ্ৰীষ্ট-পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে পূর্ব বীরভূম (যেমন, কোটাসুর গ্রাম) থেকে শুরু করে সমুদ্রশায়ী মেদিনীপুর, (যেমন, তাম্রলিপ্ত বা তমলুক), নিম্নগাঙ্গেয় ২৪ পরগণা (যেমন, চন্দ্রকেতুগড়), ভাগীরথীঘৃত মুর্শিদাবাদ (যেমন, চিরুটি), গাঙ্গেয় উত্তরবঙ্গ (যেমন, মহাস্থান গড়) পর্যন্ত যে একটি বিস্তৃত সমৃদ্ধ সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ গত ২৫/৩০ বৎসরের মধ্যে আহৃত হয়েছে, কিছু উৎখননের ফলে, অধিকাংশ প্রত্নানুসন্ধানের ফলে। কোটাসুর, চন্দ্রকেতুগড় ও মহাস্থানে প্রাপ্ত আরোপিত অলংকরণযুক্ত পোড়ামাটির শিল্পদ্রব্য, অজয় কুন্নুর-ভাগীরথীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে এবং নিম্নগাঙ্গেয় ২৪ পরগণা, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব-বীরভূমের বহু প্রত্নস্থলে প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণচিকণ মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, চিহ্নমুদ্রিত মুদ্রা, ঢালাই করা তাম্রমুদ্রা, পোড়ামাটির ঝাঝরা, ধূসর মৃৎপাত্রের টুকরো, নানা রকমের পোড়ামাটির নরনারী ও পশুমূর্তি, খেলনা, কুণ্ডলীকৃত নকশাযুক্ত মৃৎপাত্র প্রভৃতি প্রত্নদ্রব্যের মধ্যেই সে প্রমাণ সোচ্চারে বিদ্যমান। এ অনুমানে বোধ হয় বাধা নেই যে, এই সমৃদ্ধ সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল প্রধানত মৌর্যযুগে বঙ্গদেশ মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রভাব-পরিধির অন্তর্ভুক্ত হবার সময় থেকে এবং এর মূলে ছিল ক্রমবর্ধমান লৌহ-যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং ধানচাষের বিস্তার। এর প্রস্তুতি-পর্বের শুরু অবশ্য তাম্রাশ্মীয় পর্ব থেকেই, বিশেষভাবে লোহার যন্ত্রপাতির প্রচলন (খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ৭০০/৬০০) থেকে।
০৩. দেশ-পরিচয়
০১. যুক্তি – দেশ-পরিচয়
দেশ ও জাতির বাস্তব ইতিহাস জানিতে হইলে সর্বাগ্রে দেশের যথার্থ ভৌগোলিক পরিচয় লওয়া প্ৰয়োজন। মহাকালের কোনও রূপ নাই; কাল অনন্ত, অব্যয় এবং অরূপ। দেশের আধারকে আশ্রয় করিয়া, অসংখ্য বস্তু ও প্রাণীরূপ পাত্রকে অবলম্বন করিয়া। তবে সেই কাল নিজের সীমায়িত রূপ প্রকাশ করে। দেশ এবং পাত্র নিরপেক্ষ কালের কোনও রূপের কল্পনা অ্যাবসট্রাক্ট কল্পনা মাত্র, তাহার বস্তুগত ভিত্তি নাই; দেশ এবং পাত্র, অর্থাৎ দেশান্তৰ্গত বস্তু ও প্রাণী-জগৎ কালকে তাহার বস্তুপ্রতিষ্ঠা দান করে। তখনই সম্ভব হয়। কালের বাস্তব স্বরূপ উপলব্ধি করা। তাই, ইতিহাসের অর্থই হইতেছে কাল, দেশ ও পাত্রের যথাযথ বর্ণনা এবং এই ত্রয়ীর সম্মিলিত রূপ ও তারহার ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করা। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এই ত্রয়ীর তৃতীয়টির, অর্থাৎ পাত্রের (দেশান্তর্গত প্রাণিজগতের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ প্রাণী সেই মানুষের) আদি কথা বলিয়াছি। এই মানুষকে লইয়াই তো মানুষের গর্ব, এবং মনুষ্যসমাজের কথাই ইতিহাসের কথা; কাজেই পরবর্তী সকল অধ্যায়ে তাহাদের কথাই সবটুকু জুড়িয়া থাকিবে। বর্তমান অধ্যায়ে ত্রয়ীর দ্বিতীয়টির অর্থাৎ দেশের বাস্তব বিবরণের কথা বলিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে; কারণ দেশই হইতেছে মানুষের ইতিহাসের ভিত্তি ও পরিবেশ। দেশের বস্তুগত রূপ বহুল পরিমাণে দেশান্তর্গত মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র, সাধনা-সংস্কৃতি, আহার-বিহার, বসন-ব্যাসন, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি নির্ণয় করে। কাজেই, বাংলাদেশের মানুষের কর্মকৃতির কথা বলিবার আগে বাঙলাদেশের বস্তুগত ভৌগোলিক পরিচয় লওয়া অযৌক্তিক হইবে না।
০২. সীমানির্দেশ – দেশ-পরিচয়
কোনও স্থান বা দেশের রাষ্ট্ৰীয় সীমা এবং উহার ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সীমা সর্বত্র সকল সময় এক না-ও হইতে পারে রাষ্ট্ৰীয় সীমা পরিবর্তনশীল; রাষ্ট্ৰীয় ক্ষমতার প্রসার ও সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে, কিংবা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রসীমা প্রসারিত ও সংকুচিত হইতে পারে, প্রায়শ হইয়াও থাকে , প্রাচীনকালে হইতো, এখনও হয়। প্রাকৃতিক সীমা, যেমন নদনদী, পাহাড়পর্বত, সমুদ্র ইত্যাদি কখনও কখনও রাষ্ট্ৰসীমা নির্ধারণ করে সন্দেহ নাই; প্রাচীন ইতিহাসে তাঁহাই ছিল সাধারণ নিয়ম। কিন্তু, বর্তমান কালে রাষ্ট্রসীমা অনেক সময়ই প্রাকৃতিক সীমাকে অবজ্ঞা করিয়া চলে; বর্তমান যন্ত্র-বিজ্ঞান রাষ্ট্রকে সেই অবজ্ঞার শক্তি দিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান বাঙলাদেশের পশ্চিম ও পশ্চিম-দক্ষিণ সীমা কোনও প্রাকৃতিক সীমাদ্বারা নির্দিষ্ট হয় নাই। কোথায় যে বাঙলাদেশের শেষ, কোথায় যে বিহারের আরম্ভ, কোথায় যে মেদিনীপুর শেষ হইয়া ওডিশার আরম্ভ, কোথায় যে ত্রিপুরা, মৈমনসিং জেলা শেষ হইয়া শ্ৰীহট্ট জেলার আরম্ভ, বলা কঠিন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সীমা প্রধানত নির্নীত হয়। ভূ-প্রকৃতিগত সীমাদ্বারা, এবং তাহা সাধারণত অপরিবর্তনীয়। দ্বিতীয়ত এক-জনত্বদ্বারা, এবং তৃতীয়ত ভাষার একত্ব দ্বারা। সাধারণত দেখা যায়, বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সীমার আবেষ্টনীর মধ্যেই জাতি ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য গড়িয়া উঠে। অন্তত, প্রাচীন বাঙলায় তাহাই হইয়াছিল। জন ও ভাষার ওই একত্ব-বৈশিষ্ট্য বাঙলাদেশে নিঃসন্দেহে একদিনে গড়িয়া উঠে নাই। প্রাগৈতিহাসিক কাল হইতে আরম্ভ করিয়া এই একত্ব দানা বাঁধিতে বাঁধিতে একেবারে প্রাচীনযুগের শেষাশেষি আসিয়া পৌঁছিয়াছে; বস্তুত, মধ্যযুগের আগে তাহার পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় নাই। বাঙলার বিভিন্ন জনপদরাষ্ট্র তাহাদের প্রাচীন পুণ্ড্র-গৌড়-সুহ্ম-রাঢ়-তাম্রলিপ্তি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল ইত্যাদির ভৌগোলিক ও রাষ্ট্ৰীয় স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করিয়া এক অখণ্ড ভৌগোলিক ও রাষ্ট্ৰীয় ঐক্য-সম্বন্ধে যখন আবদ্ধ হইল, যখন বিভিন্ন স্বতন্ত্র নাম পরিহার করিয়া এক বঙ্গ বা বাঙলা নামে অভিহিত হইতে আরম্ভ করিল, তখন বাঙলার ইতিহাসের প্রথম পর্ব অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। প্রাচ্যদেশীয় প্রাকৃত ও মাগধী প্রাকৃত হইতে স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়া, অপভ্রংশ পর্যায় হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বাঙলা ভাষা যখন তাহার যথার্থ আদিম রূপ প্রকাশ করিল, তখন আদিপর্বশেষ না হইলেও প্রায় শেষ হইতে চলিয়াছে। এই জন ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য লইয়াই বর্তমান বাঙলাদেশ, এবং সেই দেশ চতুর্দিকে বিশিষ্ট ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সীমাদ্বারা বেষ্টিত। বর্তমান রাষ্ট্রসীমা এই প্রাকৃতিক ইঙ্গিত অনুসরণ করে নাই সত্য, কিন্তু ঐতিহাসিককে সেই ইঙ্গিতই মানিয়া চলিতে হয়, তাহাই ইতিহাসের নির্দেশ।
উত্তর সীমা
বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সীমায় সীমিত, জাতি ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য লইয়া আজিকার যে বাঙলাদেশ এই দেশের উত্তর-সীমায় সিকিম এবং হিমালয়-কিরীটি কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্ৰ-তুষারময় শিখর; তাহারই নিম্ন উপত্যকায় বাঙলার উত্তরতম দাৰ্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা। এই দুই জেলার পশ্চিমে নেপাল, পূর্বে ভোটান রাজ্যসীমা। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আমলেই দেখিতেছি, নেপাল তাঁহার রাজ্যের পূর্বতম অংশের উত্তরতম প্রত্যন্ত দেশ। দাৰ্জিলিং-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার এই তিনটি জেলাই প্রধানত পার্বত্য কোম্যদ্বারা আধুষিত; কোচ, রাজবংশী, ভোটিয়া–ইহারা সকলেই ভোট-ব্ৰহ্ম জনের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা। কিন্তু, উত্তর-পূর্ব দিকে রংপুর-কোচবিহারের বর্তমান রাষ্ট্রসীমা কিছু প্রাকৃতিক সীমা নয়, সে-সীমা একেবারে ব্ৰহ্মপুত্ৰনদ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই নদই প্রাচীনকালে পুণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপ রাজ্যের যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম সীমা নির্দেশ করিত। সত্য, কামরূপের রাষ্ট্ৰসীমা কখনও কখনও করতোয়া অতিক্রম করিয়া বাঙলার উত্তরতম জেলাগুলি—রংপুর-কোচবিহার-জলপাইগুড়ি–অতিক্ৰম করিয়া উত্তর বিহারের প্রাচীন কোশনদী স্পর্শও হয়তো করিত; তৎসত্ত্বেও ব্ৰহ্মপুত্ৰই (এবং কখনও কখনও হয়তো করতোয়া) যে ছিল মোটামুটি কামরূপ রাজ্যসীমা, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। ঐতিহাসিক কালের অধিকাংশ পর্বেই ব্ৰহ্মপুত্রের উত্তর ও দক্ষিণ উপত্যকাভূমিতে কামরূপের রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক প্রভুত্ব বিস্তৃত ছিল। এই হিসাবে বর্তমান গোয়ালপাড়া জেলার অধিকাংশই পুণ্ড্রবর্ধনের সীমাভুক্ত ছিল এই অনুমান অসংগত নয়; মধ্যযুগে তো উত্তর ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমতম প্রান্ত বাঙলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলই।
পূর্ব সীমা
বাঙলার পূর্ব সীমায় উত্তরে ব্ৰহ্মপুত্র নদ, মধ্যে গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়াপাহাড়; দক্ষিণে লুসাই, চট্টগ্রাম ও আরাকান শৈলমালা। গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়াশৈলশ্রেণীর বিন্যাস দেখিলে স্পষ্টতই বুঝা যায়, বাঙলার সীমা এই পার্বত্যদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। গোয়ালপাড়া জেলার মতো শ্ৰীহট্ট এবং কাছাড় জেলার কিয়দংশের লোকও বাঙলা ভাষাভাষী, এবং সামাজিক স্মৃতিশাসন, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিও বাঙলা-ভাষাভাষীর; জন এবং জাতও বাঙালীর এবং বাঙলার! তাহা ছাড়া, বরাক ও সুরমানদীর উপত্যকা তো মেঘনা-উপত্যকারই (মৈমনসিং-ত্রিপুরা-ঢাকা) উত্তরাংশ মাত্র। এই দুই উপত্যকার মধ্যে প্রাকৃতিক সীমা কিছু নাই বলিলেই চলে, এবং এই কারণেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে পূর্ব বাঙলার এই কয়টি জেলার–বিশেষভাবে ত্রিপুরা ও পূর্ব মৈমনসিং জেলার-সংস্কার ও সংস্কৃতি এত সহজে শ্ৰীহট্ট-কাছাড়ে বিস্তারলাভ করিতে পারিয়াছিল। এখনও শ্ৰীহট্ট-কাছাড়ের হিন্দু-মুসলমানের সমাজ ও সংস্কৃতি বাঙলার পূর্বতম জেলাগুলির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। শুধু তাঁহাই নয়, লৌকিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনও বাঙলার এই জেলাগুলির সঙ্গে। সিলেট-সরকার আকবরের আমলে সুবা বাঙলার অন্তর্গত ছিল : ১৮৭৪ খ্ৰীষ্টাব্দে এই দুই জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। শ্ৰীহট্টের দক্ষিণে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী এই দুই জেলা হইতে শ্ৰীহট্টকে পৃথক করিয়াছে। ত্রিপুরার উত্তরে ও পূর্বে ত্রিপুরা-শৈলমালা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা হইতে পৃথক করিয়াছে; দক্ষিণ ত্রিপুরার সঙ্গে নোয়াখালি এবং সমতল চট্টগ্রামের যোগাযোগ। যাহা হউক, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাঙলাদেশকে যে লুসাই জেলা এবং ব্ৰহ্মদেশ হইতে পৃথক করিয়াছে, তাহা সুস্পষ্ট। এইসব কারণেই এই দুটি শৈলশ্রেণী বাঙলার পূর্ব-দক্ষিণ সীমা-নির্দেশক।
পশ্চিম সীমা
বাঙলার বর্তমান পশ্চিম-সীমা পূর্ব-সীমাপেক্ষাও অধিক খবীকৃত হইয়াছে। উত্তর প্রান্তে মালদহ ও দিনাজপুর জেলার উত্তর ও পশ্চিম সীমাই আধুনিক বাঙলার সীমা নির্দেশ করিতেছে। অথচ প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই সীমা দক্ষিণে গঙ্গার তট বাহিয়া একেবারে বর্তমান দ্বারভাঙ্গা জেলার পশ্চিম সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দ্বারভাঙ্গা তো দ্বার:বঙ্গ (বা বঙ্গের দ্বার) শব্দেরই আধুনিক বিকৃত রূপ। পূর্ণিয়া সরকার তো আকবরের আমলেও বাঙলা সুবার অন্তর্গত ছিল। তাহা ছাড়া, কি ভূমি-প্রকৃতিতে কি প্রাচীন ভাষায় উত্তর-বিহার ও মিথিলার সঙ্গে উত্তর বঙ্গ বা গৌর-পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর পার্থক্য অল্পই ছিল। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে মিথিলাই তো ছিল অন্যতম বিদ্যা ও সংস্কৃতির কেন্দ্ৰ যাহাকে বাঙলার পণ্ডিতেরা পরমতীৰ্থ বলিয়া মনে করিতেন। মৈথিল কবি বিদ্যাপতি বাঙালীরও পরমপ্রিয় কবি। উত্তর-বঙ্গের এবং শ্ৰীহট্টের কোথাও কোথাও বহুদিন পর্যন্ত মৈথিল স্মৃতির প্রচলন ছিল, এখনও আছে; বাচস্পতি মিশ্রের স্মৃতি এখনও শ্ৰীহট্টের কোনও কোনও টোলে পঠিত হইয়া থাকে, প্রচুর প্রাচীন পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায়। শ্ৰীহট্ট সাহিত্য-পরিষদ-গ্ৰন্থাগারে বাচস্পতি মিশ্রের স্মৃতিগ্রন্থের অনেকগুলি পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে। এই দুই ভূমির, অর্থাৎ উত্তর-বঙ্গ ও উত্তর-বিহারের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান রচিত হইয়াছে মধ্যযুগে। প্রাচীনকালে এই ব্যবধান ছিল না; এই দুই ভূমি একই ভূমি বলিয়া গণ্য হইত, এমন মনে করিবার ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান। এই দুই ভূমির মধ্যে প্রাকৃতিক ব্যবধানও কিছু নাই, ভূ-প্রকৃতিরও কিছু বিভিন্নতা নাই! উত্তর-বিহারের দক্ষিণ সীমা ধরিয়া, রাজমহল পাহাড়ের ভিতর দিয়া, মালদহের পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমা ঘেষিয়া গঙ্গা বাঙলাদেশে আসিয়া ঢুকিয়ছে। লাজমহল ও গঙ্গার দক্ষিণে বর্তমান সাঁওতাল পরগণা প্রাচীন উত্তর-রাঢ়ের উত্তর-পশ্চিমতম অংশ; ভবিষ্যপুরাণে এই ভূমিকে বলা হইয়াছে অজলা, ঊষর, জঙ্গলময় ভূমি, যেখানে কিছু কিছু লৌহ-আকর আছে, যেখানে তিনভাগ জঙ্গল, একভাগ গ্রাম, স্বল্পভূমি মাত্র উর্বর। ভবদেব ভট্টর একাদশ শতকীয় লিপিতেও এই ভূমিকে বলা হইয়াছে ঊষর ও জঙ্গলময়। ইহাই য়ুয়ান-চোয়াঙ বর্ণিত কজঙ্গল। সপ্তম শতকে রাজা জয়নাগের (রাজধানী কর্ণসুবর্ণ?) বপ্লঘোষবাট পট্টোলীতে ঔদুম্বরিক বিষয় নামে একটি ক্ষুদ্র জনপদের উল্লেখ আছে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ মুরশিদাবাদ-বীরভূম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজমহল (তদানীন্তন আকমহল) এই ঔদম্বর সরকারের অন্তর্গত ছিল। বস্তুত, রাজমহল ও সাঁওতাল পরগনার কিয়দংশ যে বাঙলার অন্তৰ্গত ছিল, এ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিতে পারে না। বাঁকুড়ার পশ্চিম-সীমায় মানভূম জেলা বর্তমান বিহারের অন্তৰ্গত; অথচ, এই মানভূম প্রাচীন মল্লভূমি-মালভূমেরই অন্তর্গত। বাঁকুড়া ও মানভূমের ভিতর কোনও প্রাকৃতিক সীমা নাই; সেই সীমা মানভূম অতিক্রম করিয়া একেবারে ছোটনাগপুরের শৈলশ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এই শৈলশ্রেণীই এই দিকে প্রাচীন বাঙলার সীমা। ভাষায়, ভূ-প্রকৃতিতে, সমাজ ও কৌমবিন্যাসে সঁওতাল পরগনার সঙ্গে যেমন উত্তর বীরভূমের, তেমনই মানভূমের সঙ্গে বাঁকুড়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দক্ষিণে মেদিনীপুরের পশ্চিম-দক্ষিণ সীমায় বালেশ্বর জেলা ওড়িশার অন্তর্গত, এবং সিংহভূম বিহারের। এই দুইটি জেলারই কতকাংশ মেদিনীপুর জেলার যথাক্রমে কঁাথি, সদর ও ঝাড়গ্রাম মহকুমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে যুক্ত-ভাষায়, ভূ-প্রকৃতিতে, সামাজিক সংস্কৃতিতে এবং কৌমবিন্যাসে। সম্প্রতি মেদিনীপুর সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত মহারাজ শশাঙ্কের যে তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার হইয়াছে তাহাতে দেখা যাইতেছে, উৎকলদেশও সপ্তম শতকে দণ্ডভুক্তির (বর্তমান দাতনের) অন্তর্গত ছিল। যে কোনও প্রাকৃতিক ভূমি-নকশা বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে রাজমহল হইতে এক অনুচ্চ শৈলশ্রেণী এবং গৈরিক পার্বত্যভূমি দক্ষিণে সোজা প্রসারিত হইয়া একেবারে ময়ূরভঞ্জ-কেওঞ্জর-বালেশ্বর স্পর্শ করিয়া সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে। এই শৈলমালা এবং গৈরিক মালভূমিই সঁওতাল পরগনা, ছোটনাগপুর, মানভূম, সিং ভুম এবং ময়ূরভঞ্জ-বালেশ্বর-কেওজরশৈলমালার অরণ্যময় গৈরিক উচ্চভূমি এবং বাঙলার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পশ্চিম সীমা। বাঙলার ভাষা, সমাজবিন্যাস, জন ও কেমবিন্যাস এবং উত্তর-রাঢ় ও পশ্চিম-দক্ষিণ মেদিনীপুরের ভূ-প্রকৃতি এই সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত।
দক্ষিণ সীমা
বাঙলার দক্ষিণ-সীমায় বঙ্গোপসাগর এবং তাহারই তট ঘিরিয়া মেদিনীপুর-চব্বিশ পরগণা-খুলনাবরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা-ত্রিপুরার দক্ষিণতম প্রান্ত (অর্থাৎ চাঁদপুর) নোয়াখালি-চট্টগ্রামের সমতটভূমির সবুজ বনময় অথবা শস্যশ্যামল আস্তরণ। এই আস্তরণ অসংখ্য ক্ষুদ্রবৃহৎ নদনদী-খাটিখাড়ি-খালনালা-বিল, জলা-হাওর (হায়র-সায়র=সাগর) ইত্যাদিতে সমাচ্ছন্ন। এই জেলাগুলির অধিকাংশ নিম্নভূমি ক্রমশ গড়িয়া উঠিয়াছে অসংখ্য নদনদীবাহিত পলিমাটি এবং সাগরগর্ভতাড়িত বালুকারাশির সমন্বয়ে, প্রাগৈতিহাসিক কালে,–এবং বোধহয় কতকটা ঐতিহাসিক কালেও।
সূত্ৰ-সংক্ষিপ্ততায় এখন এইভাবে বোধহয় বাঙলার সীমা-নির্দেশ করা চলে : উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ধুত নেপাল, সিকিম ও ভোটান রাজ্য; উত্তর-পূর্বদিকে ব্ৰহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা; উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবতী সমভূমি; পূর্বদিকে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে রাজমহল-সাঁওতাল পরগনা-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূম-কেওঞ্জের-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই প্রাকৃতিক সীমা বিধৃত ভূমিখণ্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাঙলার গৌড়-পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী-রাঢ়-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ, ভাগীরথী–করতোয়া-ব্ৰহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা এবং আরও অসংখ্য নদনদীবিধৌত বাঙলার গ্রাম, প্রান্তর, পাহাড়, কান্তার। এই ভূখণ্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালীর কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নিৰ্মভূমি। একদিকে সু-উচ্চ পর্বত, দুইদিকে কঠিন শৈলভূমি, আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য—ইহাই বাঙালীর ভৌগোলিক ভাগ্য। আজ হিমালয় আমাদের নামমাত্রই; সমুদ্রও বুঝি নামমাত্র; তাম্রলিপ্তি সত্যই সকরুণ স্মৃতি। সাম্প্রতিক বাঙলার উত্তরে তরাই বনভূমি, দক্ষিণে সুন্দরবন ও তৃণান্তীর্ণ জলাভূমি। এই দুইয়ে মিলিয়া যেন বাঙলাদেশকে। উষ্ণ জলীয়তার ক্লান্ত অবসাদে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। বিংশ শতাব্দীর এক বাঙালী কবির লেখনীতে এই ভৌগোলিক ভাগ্য সুন্দর কাব্যময় রূপ গ্রহণ করিয়াছে। কবিতাটি সমগ্ৰ উদ্ধৃতির দাবি রাখে :
হিমালয় নাম মাত্র,
আমাদের সমুদ্র কোথায়?
টিমটিম করে শুধু খেলো দুটি বন্দরের বাতি।
সমুদ্রের দুঃসাহসী জাহাজ ভেড়ে না সেথা;
—তাম্রলিপ্তি সকরুণ স্মৃতি।
দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন আছে বটে সমতল সবুজ খেতের,
কত উগ্ৰ নদী সেই স্বপনেতে গেল মাজে হেজে;
একা পদ্মা মরে মাথা কুটে।
উত্তরে উত্তুঙ্গ গিরি
দক্ষিণেতে দুরন্ত সাগর
যে দারুণ দেবতার বর,
মাঠভরা ধান দিয়ে শুধু
গান দিয়ে নিরাপদ খেয়া-তরণীর
পরিতৃপ্ত জীবনের ধন্যবাদ দিয়ে
তারে কভু তুষ্ট করা যায়!
ছবির মতন গ্রাম
স্বপনের মতন শহর
যতো পারো গড়ো,
অৰ্চনার চূড়া তুলে ধরো
তারাদের পানে;
তবু জেনো আরো এক মৃত্যুদীপ্ত মানে
ছিলো এই ভূখণ্ডের,
—ছিলো সেই সাগরের পাহাড়ের দেবতার মনে।
সেই অর্থ লাঞ্ছিত যে, তাই,
আমাদের সীমা হল
দক্ষিণে সুন্দরবন
উত্তরে টেরাই!
[‘ভৌগোলিক’]—প্রেমেন্দ্ৰ মিত্র
০৩. নদনদী
বাঙলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাঙলার ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী। এই নদনদীগুলিই বাঙলার প্রাণ; ইহারাই বাঙলাকে গড়িয়াছে, বাঙলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে। যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদনদীগুলিই বাঙলার আশীৰ্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় কখনও কখনও বোধহয় বাঙলার অভিশাপাও। এইসব নদনদী উচ্চতর ভূমি হইতে প্রচুর পলি বহন করিয়া আনিয়া বঙ্গের ব-দ্বীপের নিম্নভূমিগুলি গড়িয়াছে, এখনও সমানে গড়িতেছে; সেই হেতু বদ্বীপ-বঙ্গের ভূমি কোমল, নরম ও কমনীয়; এবং পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ববঙ্গের কিয়দংশ ছাড়া বঙ্গের প্রায় সবটাই ভূতত্ত্বের দিক হইতে নবসৃষ্টভূমি (new alluvium)। এই কোমল, নরম ও নমনীয় ভূমি লইয়া বাঙলার নদ-নদীগুলি ঐতিহাসিক কালে কত খেলাই না খেলিয়াছে; উদাম প্ৰাণলীলায় কতবার যে পুরাতন খাত ছাড়িয়া নূতন খাতে, নূতন খাত ছাড়িয়া আবার নূতনতর খাতে বর্ষা ও বন্যার বিপুল জলধারাকে দুরন্ত অশ্বের মতো, মত্ত ঐরাবতের মতো ছুটাইয়া লইয়া গিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। এই সহসা খাত পরিবর্তনে ক’ত সুরম্য নগর, কত বাজার-বন্দর, কত বৃক্ষশ্যামল গ্রাম, শস্যশ্যামল প্রান্তর, কত মঠ ও মন্দির, মানুষের কত কীর্তি ধ্বংস করিয়াছে, আবার নূতন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছে, কত দেশখণ্ডের চেহারা ও সুখ-সমৃদ্ধি একেবারে বদলাইয়া দিয়াছে তাহার হিসােবও ইতিহাস সর্বত্র রাখিতে পারে নাই। প্রকৃতির এই দুরন্ত লীলার সঙ্গে মানুষ সর্বদা আঁটিয়া উঠিতে পারে নাই, অনেক সময়ই হার মানিয়াছে; তাহার উপর আবার দূরদৃষ্টিহীন মানুষের দুবুদ্ধি সাময়িক লোভ ও লাভের হিসাব বড় করিয়া দেখিতে গিয়া জল-নিকাশের এবং প্রবাহের এইসব স্বাভাবিক পথগুলির সঙ্গে যথেচ্ছাচারের ত্রুটি করে নাই; এখনও তাহার বিরাম নাই। তাহার ফলে এইসব নদনদী বন্যায় মহামারীতে দেশকে ক্ষণে ক্ষণে উজাড় করিয়া দিয়া, অথবা সুবিস্তৃত দেশখণ্ডকে শস্যহীন শ্মশানে পরিণত করিয়া মানুষের উপর প্রতিশোধ লইতে ত্রুটি করে নাই। প্রাচীনকালে এই নদনদীগুলির প্রবাহপথের এবং দুরন্ত প্রাণলীলার সঠিক এবং সুস্পষ্ট ইতিহাস আমাদের কাছে উপস্থিত নাই; পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতক হইতে নদনদীগুলির ইতিহাস যতটা সুস্পষ্ট ধরিতে পারা যায় নানা দেশী-বিদেশী বিবরণের এবং নকশার সাহায্যে, প্রাচীন বাঙলা সম্বন্ধে তাহা কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে নদনদীগুলির প্রবাহপথের যে চেহারা, তাহাদের যে আকৃতিপ্রকৃতি এখন আমাদের দৃষ্টি ও বুদ্ধি-গোচর, প্রাচীন বাঙলায় সেই চেহারা, সেই আকৃতি-প্রকৃতি অনেকেরই ছিল না। অনেক পুরাতন পথ মরিয়া গিয়াছে, প্রশস্ত খরতোয়া নদী সংকীর্ণ ক্ষীণস্রোতা হইয়া পড়িয়াছে; অনেক নদী নূতন খাতে নূতনতর আকৃতি-প্রকৃতি লইয়া প্রবাহিত হইতেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুরাতন নামও হারাইয়া গিয়াছে, নদীও হারাইয়া গিয়াছে; নূতন নদীর নূতন নামের সৃষ্টি হইয়াছে! এইসব নদনদীর ইতিহাসই বাঙলার ইতিহাস। ইহাদেরই তীরে তীরে মানুষ-সৃষ্ট সভ্যতার জয়যাত্ৰা; মানুষের বসতি, কৃষির পত্তন, গ্রাম, নগর, বাজার, বন্দর, সম্পদ, সমৃদ্ধি, শিল্প-সাহিত্য, ধর্মকর্ম সবকিছুর বিকাশ। বাঙলার শস্যসম্পদ একান্তই এই নদীগুলির দান। উচ্ছ্বলিত উচ্ছ্বসিত উদ্দাম বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙিয়া যায়, মানুষ গৃহহীন পশুহীন হয়; আবার এই বন্যাই তাহার মাঠে মাঠে সোনা ফলায় পলি ছড়াইয়া , এই পলিই সোনার সারমাটি। বাঙালী তাই এই নদীগুলিকে ভয়ভক্তি যেমন করিয়াছে, ভালোও তেমনই বাসিয়াছে; রাক্ষসী কীর্তিনাশা বলিয়া গাল যেমন দিয়াছে, তেমনি ভালোবাসিয়া নাম দিয়াছে ইছামতী, ময়ূরাক্ষী, কবতাক্ষ (কপোতাক্ষ), চুর্ণী, রূপনারায়ণ, দ্বারকেশ্বর, সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, মধুমতী, কৌশিকী, দামোদর, অজয়, করতোয়া, ত্রিস্রোতা, মহানন্দা, মেঘনা (মেঘনাদ বা মেঘানন্দ), সুরমা, লৌহিত্য (ব্ৰহ্মপুত্ৰ)। বস্তুত, বাঙলার, শুধু বাঙলারই বা কেন, ভারতবর্ষের নদীগুলির নাম কী সুন্দর অর্থ ও ব্যঞ্জনাময়।
বাঙলার এই নদীগুলি সমগ্র পূর্ব-ভারতের দায় ও দায়িত্ব বহন করে। উত্তর ভারতের প্রধানতম দুইটি নদীর-গঙ্গা ও ব্ৰহ্মপুত্রের—বিপুল নদীজলধারা, পলিপ্রবাহ, এবং পূর্ব-যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও আসামের বৃষ্টিপাতপ্রবাহ বহন করিয়া সমুদ্রে লইয়া যাইবার দায়িত্ব বহন করিতে হয় বাঙলার কমনীয় মাটিকে। সেই মাটি সর্বত্র এই সুবিপুল জলপ্রবাহ বহন করিবার উপযুক্ত নয়। এই জলপ্রবাহ নূতন ভূমি যেমন গড়ে, মাঠে যেমন শস্য ফলায়, তেমনই ভূমি ভাঙেও, শস্য বিনাশও করে। বাঙালী ক্ৰোধাভরে পদ্মাকে বলিয়াছে কীর্তিনাশা, পদ্মা বাঙালীর অনেক কীর্তিই নষ্ট করিয়াছে সত্য-করিবে না-ই বা কেন? গঙ্গা-ব্ৰহ্মপুত্র-মেঘনার সুবিপুল জলধারা নিম্নতম প্রবাহে সে একা বহন করে, তাহাতে আসিয়া নামে প্রচুর বৃষ্টিপ্রবাহ, নিম্নভূমির সাগরপ্রমাণ বিল-হাওরের অগাধ জলরাশি। দুৰ্দম মত্ততার অধিকার তাহার না। থাকিলে থাকিবে কাহার? এবং, সেই মত্ততা নরম নমনীয় নূতন মাটির উপর। ফল যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে ও হইতেছে। অথচ, এই মেঘনা-পদ্মাই তো আবার স্বর্ণশস্যের আকার; এই পদ্মার দুই তীরেই তো বাঙলার ঘনতম মনুষ্য বসতি, সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যের লীলা। মানুষ যদি পদ্মা-মেঘনাকে বশে আনিতে না পারিয়া থাকে, সে যদি আপন দুবুদ্ধিবশে ইহাদের মত্ততাকে আরও নির্মম আরও দুরন্ত করিয়া থাকে, তবে সেই দোষ পদ্মা-মেঘনার নয়। কিন্তু, ইতিহাস আলোচনায় এসব জল্পনা হয়তো অবান্তর!
উপাদান
বাঙলার ভূ-প্রকৃতিতে নদীর খাত যুগে যুগে পরিবর্তিত হওয়া, পুরাতন নদী মজিয়া মরিয়া যাওয়া, নূতন নদীর সৃষ্টি কিছুই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। ষোড়শ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া উনবিংশ শতকের শেষ, এই চারি শতাব্দীর মধ্যে বাঙলার প্রধান-অপ্রধান ছোটবড় কত নদনদী যে কতবার খাত বদলাইয়াছে, কত পুরাতন নদী মরিয়াছে, কত নূতন নদীর সৃষ্টি হইয়াছে তাহার কিছু কিছু হিসাব পাওয়া যায় বাঙলার সমসাময়িক ভূমি-নকশায়। বর্তমান বাঙলায় নদীগুলির যে প্রবাহপথ, আকৃতি-প্রকৃতি এখন আমরা দেখিতেছি, একশত বৎসর পূর্বেও এইসব নদনদীর এই প্রবাহপথ, আকৃতি-প্রকৃতি ছিল না। ষোড়শ ও অষ্টাদশ শতকের মধ্যে Jao de Barros (1550), Gastaldi (1561), Hondivs (1614), Cantelli da Vignolla (1683), Van den Broucke (1660), G. Delisle(1720-1740), Izzak Tirion (1730), F. de Witt (1726), de l’ Auville (1752), Thornton, Rennel (1764-1776) প্রভৃতি পর্তুগীজ, ডাচ ও ইংরাজ বণিক রাজকর্মচারী ও পণ্ডিতেরা বাঙলা ও ভারতবর্ষের অনেকগুলি নকশা রচনা করিয়াছিলেন। মধ্যযুগে বাঙলার নদনদী ও জনপদগুলির ক্রমপরিবর্তমান আকৃতি, পুরাতন নদীর মৃত্যু, নূতন নদীর জন্ম-সমস্তই এই নকশাগুলিতে ধরিতে পারা যায়। আমাদের চোখের উপর এই পরিবর্তন এখনও চলিতেছে; যমুনার খাতে ব্ৰহ্মপুত্রের নূতনতর প্রবাহ, ভৈরব, কুমার প্রভৃতি নদীর আসন্ন মৃত্যু ইত্যাদি তো সমসাময়িক কালের কথা। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক হইতে নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়া নদনদীগুলির-এবং সঙ্গে সঙ্গে জনপদগুলিরও-ক্রমপরিণতি এখন অনেকটা স্পষ্ট। শুধু নকশাগুলিতেই নয়, ইবন বতুতা (1328-1354), বারনি (চতুর্দশ শতক), রালফ ফিচ (Ralph Fitch, 1583-91), Fernandes (1598), Fonseca (1599) প্রভৃতি বিদেশী পর্যটকদের বিবরণী, বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’,মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’, বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল’, কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, গোবিন্দদাসের ‘কড়চা’, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ জাতীয় সাহিত্যগ্রন্থ এবং মুসলমান লেখকদের সমসাময়িক ইতিহাসেও এই পরিবর্তনের চেহারা ধরিতে পারা কঠিন নয়। সাম্প্রতিক কালে নদীমাতৃক বাঙলার এই ক্রমপরিবর্তমান আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে আলোচনাও যথেষ্ট হইয়াছে। কাজেই এখানে সে-সব কথার পুনরালোচনা করিয়া লাভ নাই। যোড়শ শতকের পরেই শুধু নয়, আগেও বাঙলার প্রধান প্রধান নদনদীগুলি যুগে যুগে এই ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়া গিয়াছে, এমন অনুমান কিছুতেই অসংগত নয়; তাহার কিছু কিছ প্রমাণও আছে। কারণ, প্রাচীন সাহিত্যে, টলেমির নকশায় ও প্রাচীন লিপিমালায় বাঙলার দুই-চারিটি নদনদীর প্রবাহপথ সম্বন্ধে যে-ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহা বর্তমান প্রবাহপথ তো নয়ই, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের প্রবাহপথের সঙ্গেও তাহার মিল নাই। অষ্টাদশ শতকে রেনেলের, সপ্তদশ শতকে ফান ডেন ব্রোকের এবং ষোড়শ শতকে জাও ডি বারোসের নকশায় নদনদীগুলির গতিপথ অনেকটা পরিষ্কার দেখানো হইয়াছে। এই তিন নকশার তুলনামূলক আলোচনা করিয়া পশ্চাৎক্রম অনুসরণ করিলে হয়তো মধ্যযুগপূর্ব বাঙলার নদনদীর চেহারা ধরিতে পারা খানিকটা সহজ হইবে। টলেমির নকশা (দ্বিতীয় শতক) নানা দোষে দুষ্ট, ঐতিহাসিকদের কাছে তাহা অজ্ঞাত নয়। সুতরাং সেই নকশার উপর খুব বেশি নির্ভর করা চলে না; তবু কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া একেবারে অসম্ভব না-ও হইতে পারে।
গঙ্গা ভাগীরথী
গঙ্গা ভাগীরথী লইয়াই আলোচনা আরম্ভ করা যাইতে পারে। রাজমহলের সোজা উত্তর পশ্চিমে গঙ্গার তীর প্রায় ঘেষিয়া তেলিগড় ও সিক্রিগলির সংকীর্ণ গিরিবর্ত্ম–বাঙলার প্রবেশপথ। এই পথের প্রবেশদ্বারেই যেন লক্ষ্মণাবতী-গৌড়, পাণ্ডুয়া, টাণ্ডা, রাজমহল মধ্যযুগে বহুদিন একের পর এক বাঙলার রাজধানী ছিল তাহা অনুমান করা কঠিন নয়; সামরিক ও রাষ্ট্ৰীয় কারণেই তাহা প্রয়োজন হইয়াছিল। এই গিরিবর্ত্ম। দুইটি ছাড়িয়া রাজমহলকে স্পর্শ করিয়া গঙ্গা বাঙলার সমতল ভূমিতে আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে। ফান ডেন ব্রোকের (১৬৬০) নকশায় দেখিতেছি, রাজমহলের কিঞ্চিৎ দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া, মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের মধ্যে গঙ্গার তিনটি দক্ষিণ-বাহিনী শাখার জল কাশিমবাজারের একটু উত্তর হইতে একত্র বাহিত হইয়া সোজা দক্ষিণবাহিনী হইয়া চলিয়া গিয়াছে সমুদ্রে, বর্তমান গঙ্গাসাগর-সংগমতীর্থে। কিঞ্চিদধিক এক শতাব্দী পর রেনেলের নকশায় দেখিতেছি, রাজমহলের দক্ষিণ পূর্বে তিনটি বিভিন্ন শাখা একটি মাত্র শাখায় রূপান্তরিত এবং তাঁহাই (সুতি হইতে গঙ্গাসাগর) দক্ষিণবাহিনী গঙ্গা। যাহাই হউক, রেনেল কিন্তু এই দক্ষিণবাহিনী নদীটিকে গঙ্গা বলিতেছেন না; তিনি গঙ্গা বলিতেছেন। আর একটি প্রবাহকে, যে প্রবাহটি অধিকতর প্রশস্ত, জীবন্ত এবং দুৰ্দম, যেটি পূর্ব দক্ষিণবাহিনী হইয়া বর্তমান বাঙলার হৃদয়দেশের উপর দিয়া তাহাকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া বহু শাখায় বিভক্ত হইয়া সমুদ্রে অবতরণ করিয়াছে, আমরা যাহাকে বলি পদ্মা। ফান ডেন ব্রোক এবং রেনেল দুজনের নকশাতেই দেখিতেছি গঙ্গার সুবিপুল জলধারা বহন করিতেছে পদ্মা; দক্ষিণবাহিনী
নদীটি ক্ষীণতরা।
ছোট গঙ্গা বড় গঙ্গা
ফান ডেন ব্রোক বা রেনেল যে-নামেই এই দুইটি নদীকে অভিহিত করুন না কেন, দেশের ঐতিহ্যে এই নদীদুটির নাম কী ছিল দেখা যাইতে পারে। ফান ডেন ব্রোকের আড়াই শত বৎসর আগে কবি কৃত্তিবাসের কাল (১৩২০ শক=১৪১৫-১৬ খ্ৰী)। কৃত্তিবাসের পিতৃভূমি ছিল বঙ্গে (পূর্ব-বাঙলায়) , তাহার পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা বঙ্গ (ভাগ) ছাড়িয়া গঙ্গাতীরে ফুলিয়াগ্রামে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন, যে ফুলিয়ার দক্ষিণের পশ্চিমে বহে গঙ্গা তরঙ্গিণী। নিঃসন্দেহে পূর্বোক্ত দক্ষিণবাহিনী নদী আমরা যাহাকে বলি ভাগীরথী (বর্তমান হুগলীনদী) তাহার কথাই কৃত্তিবাস বলিতেছেন। কিন্তু, এই গঙ্গা ছোট গঙ্গা। কারণ, এগারো, পার হইয়া কৃত্তিবাস যখন বারো বৎসরে প্রবেশ করিলেন তখন ‘পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড়ো গঙ্গাপার, এবং সেখানে নানা বিদ্যা অর্জন করিয়া তদানীন্তন গৌড়েশ্বর রাজা কংস বা গণেশের সভায় রামায়ণ রচনা করিলেন। নিশ্চিত যে, এই বড় গঙ্গাই পদ্মা। এই কথার আরও সমর্থন পাওয়া যায় কৃত্তিবাস রামায়ণের অন্যতম একটি পুঁথিতে। কৃত্তিবাস নিজ বাল্যজীবনের কথা বলিতেছেন;
পিতা বনমালী মাতা মাণিক [মেনকা] উদরে।
জনম লভিল ওঝা ছয় সহোদরে॥
ছোটগঙ্গা বড়গঙ্গা বড় বলিন্দা [নিঃসন্দেহে, বরেন্দ্র-বরেন্দ্রী] পার।
যথা তথা কর্যা বেড়ায় বিদ্যার উদ্ধার॥
রাঢ়ামধৈ [রাঢ় মধ্যে?] বন্দিনু আচার্য চূড়ামণি।
যার ঠাঁই কৃত্তিবাস পড়িলা আপনি ॥
স্পষ্টতই গঙ্গার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ববাহিনী দুই প্রবাহকেই কৃত্তিবাস যথাক্রমে ছোটগঙ্গা ও বড়গঙ্গা বলিতেছেন, এবং তদানীন্তন ভাগীরথী-পথের সুন্দর বিবরণ দিতেছেন। সে কথা পরে উল্লেখ করিতেছি। আপাতত এইটুকু পাওয়া গেল যে, পঞ্চদশ শতকের গোড়াতেই পদ্মা বৃহত্তরা নদী, উহাই বড়গঙ্গা। কিন্তু যত প্রশস্ততরা, যত দুৰ্দমা দুর্দান্তই হোক না কেন, ঐতিহ্যমহিমায় কিংবা লোকের শ্রদ্ধাভক্তিতে বড়গঙ্গা ছোটগঙ্গার সমকক্ষ হইতে পারে নাই। হিন্দুর স্মৃতি ঐতিহ্যে গঙ্গার জলই পাপমোচন করে, পদ্মার নয়। গঙ্গা স্নিগ্ধ, পাপহরা, পদ্মা কীর্তিনাশা; পদ্মা ভীষণা ভয়ংকরী উন্মত্তা।
গঙ্গা-ভাগীরথীই যে প্রাচীনতরা এবং পুণ্যতোয়া নদী, ইহাই যে হিন্দুর পরম তীর্থ জাহ্নবী, এই সম্বন্ধে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য এবং লিপিমালা একমত। পদ্মাকে গঙ্গা কখনও কখনও বলা হইয়াছে, কিন্তু ভাগীরথী-জাহ্নবী একবারও বলা হয় নাই। বাঙলাদেশের গ্রন্থ ও লিপিই এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করিতেছি। ধোয়ীর পবনদূতে ত্ৰিবেণীসংগমের ভাগীরথীকেই বলা হইয়াছে গঙ্গা; লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর পট্টোলীতে বর্ধমানভুক্তির বেতডড চতুরকের (হাওড়া জেলার বেতড়) পূর্ববাহিনী নদীটির নাম জাহ্নবী; বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতে গঙ্গা-ভাগীরথীকেই বলা হইয়াছে ‘সুরসরিৎ (স্বৰ্গনদী বা দেবনদী); রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপিতে উত্তর-রাঢ় পূর্বসীমায় গঙ্গাতীরশায়ী, যে-গঙ্গার সুগন্ধ পুষ্পবাহী জল অসংখ্য তীর্থঘাটে ঢেউ দিয়া দিয়া প্রবাহিত হইত “The Ganga whose waters bearing fragrant flowers dashed against the bathing places”। এই সব bathing places তীর্থঘাট, এবং পুষ্প স্নানপূজার ফুল, সন্দেহ কি! এই পূজা, ভাগীরথীরাই ভাগ্যে জোটে, পদ্মার নয়!
পদ্মা বা বড়গঙ্গার কথা পরে বলার সুযোগ হইবে; ভাগীরথী বা ছোটগঙ্গার কাহিনী আগে শেষ করিয়া লই। যাহাই হউক, পঞ্চদশ শতকে ভাগীরথী সংকীর্ণতোয়া সন্দেহ নাই, কিন্তু তখন তাহার প্রবাহ আজিকার মতো ক্ষীণ নয়; সাগরমুখ হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে চম্পা-ভাগলপুর পর্যন্ত সমানে বড়ো বড়ো বাণিজ্যতরীর চলাচল তখনও অব্যাহত। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় এই পথের দুই ধারের নগর বন্দরের এবং পূর্ব ও পশ্চিমাগত শাখা-প্রশাখা নদীগুলির সুস্পষ্ট পরিচয় ‘আছে। নকশা খুলিলেই তাঁহাদের পরিচয় পাওয়া যাইবে, এবং ভাগীরথীই যে সংকীর্ণতর হওয়া সত্ত্বেও প্রধানতর প্রবাহ তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইবে। সাম্প্রতিক কালে বহু প্রমাণ-প্রয়োগের সাহায্যে এই প্রবাহের ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। ফান ডেন ব্রোকের কিঞ্চিদধিক দেড়শত বৎসর আগে বিপ্রদাস পিপিলাই তাহার ‘মনসামঙ্গলে এই প্ৰবাহপথের যে বিবরণ দিতেছেন তাহা সুপরিচিত নয়। কাজেই, এখানে তাহা উল্লেখ করা যাইতে পারে। বিপ্রদাসের চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী রাজঘাট, রামেশ্বর পার হইয়া সাগরমুখের দিকে অগ্রসর হইতেছে; পথে পড়িতেছে, অজয়নদী, উজানী, শিবানদী (বর্তমান শিয়ালনালা), কাটোয়া, ইন্দ্ৰাণী,নদী, ইন্দ্ৰঘাট, নদীয়া, ফুলিয়া, গুপ্তিপাড়া, মির্জাপুর, ত্ৰিবেণী, সপ্তগ্রাম (সপ্তগ্রাম যে গঙ্গা-সরস্বতী-যমুনাসংগমে বিপ্রদাস তাহাও উল্লেখ করিতে ভুলেন নাই), কুমারহাট, ডাইনে হুগলী, বামে ভাটপাড়া, পশ্চিমে বোরো, পূর্বে কাকিনাড়া, তারপর মূলাজোড়া, গাঙুলিয়া, পশ্চিমে পাইকপাড়া, ভদ্ৰেশ্বর, ডাইনে চাঁপদানি, বামে ইছাপুর, বাকিবাজার, (ডাইনে) নিমাইতীর্থ (বর্তমান বৈদ্যবাটি?), চানক, মাহেশ, (বামে), খড়দহ, শ্ৰীপাট, ডাইনে রিসিাড়া (রিষড়া), বামে সুকচর, পশ্চিমে কোন্নগর, ডাইনে কোতরং, বামে কামারহাটি, পূর্বে আড়িয়াদহ (এড়েদহ), পশ্চিমে ঘুষুড়ি, তারপর পূর্বকূলে চিত্রপুর (চিৎপুর), কলিকাতা, (পশ্চিমকুলে) বেতড় (দ্বাদশ শতক লিপির বেতডড চতুরক), তারপর (বামে) কালীঘাট, চুড়াঘাট, বারুইপুর, ছত্রভোগ, বদরিকাকুণ্ড, হাথিয়াগড়, চৌমুখী, শতমুখী এবং সর্বশেষে সাগরসংগমতীৰ্থ যেখানে “তীৰ্থকার্য শ্ৰাদ্ধ কৈল পবিত্ৰ তৰ্পণ। তাহার মেলান ডিঙ্গা সংগমে প্রবেশে। তীৰ্থকার্য কৈল রাজা পর[ম] হরিষে।” সাগর-সংগমের নিকট গঙ্গা তো সত্যই চারিমুখে শতমুখে কেন, অসংখ্য খাল-নালায় শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত। মহাভারতের বনপর্বের তীর্থযাত্ৰা অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, যুধিষ্ঠির পঞ্চশতমুখী গঙ্গার সাগরসংগমে তীর্থস্নান করিয়াছিলেন। যাহা হউক, বিপ্রদাসের উপরোক্ত বর্ণনার সঙ্গে ফান ডেন ব্রোকের নকশার বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রেই এক। নদীয়া, মির্জাপুর, ত্রিবেণী (Tripeni), সপ্তগ্রাম (Coatgam), হুগলি (Oegli, পর্তুগীজ বণিকদের Ogulium), কলিকাতা (ফান ডেন ব্ৰোক Collecate এবং Calcutta নামে প্রায় সংলগ্ন দুইটি বন্দরের নাম করিতেছেন–একটি বিপ্রদাসের কলিকাতা এবং অপরটি কালীঘাট বলিয়া মনে হয়) প্রভৃতি নাম পাওয়া যাইতেছে। লক্ষণীয় এই পঞ্চদশ শতকেই বিপ্রদাস হুগলী ও কলিকাতার উল্লেখ করিতেছেন, এবং ইহাই হুগলী ও কলিকাতার সর্বপ্রাচীন উল্লেখ। তবে, সন্দেহ হয়, বিপ্রদাসের মূল-তালিকায় পরবর্তী কালের গায়েনরা হুগলী, কলিকাতা প্রভৃতি নাম সংযোগ করিয়া দিয়াছিলেন; মূল তালিকায় এ-দুটি নাম ছিল, কিনা, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। পঞ্চদশ শতকে কলিকাতার উল্লেখ সত্যই যথেষ্ট সন্দেহজনক! ১৪৯৫-র (বিপ্রদাসের) পরে এবং ১৬৬০-র (ফান ডেন ব্রোকের) আগে বরা(হ)নগর, চন্দননগর প্রভৃতি বন্দর গড়িয়া উঠিয়াছে; শুধু যে ফান ডেন ব্রোকই ইহাদের উল্লেখ করিয়াছেন তাহা নয়, জাও ডি ব্যারোসের নকশায়ও অগ্রপাড়া (Agrapara), বরাহনগরের (Baranagar) উল্লেখ পাইতেছি, সপ্তগ্রামের (সাতগাঁও—Satigam) সঙ্গে, ইতিহাসের তথ্য তাহাই।। হুগলীও ব্রোকের সময় ফাঁপিয়া উঠিয়াছে।
আদিগঙ্গা
যাহাই হউক, বিপ্রদাস ও ফান ডেন ব্রোকের নিকট হইতে কয়েকটি প্রধান প্রধান তথ্য পাওয়া গেল। প্রথমত, ভাগীরথীর বর্তমান প্রবাহই, অন্তত কলিকাতা পর্যন্ত, পঞ্চদশ-সপ্তদশ শতকের প্রধানতম প্রবাহ; দ্বিতীয়ত, ত্ৰিবেণী বা মুক্তবেণীতে সরস্বতী-ভাগীরথী-যমুনাসংগম; তৃতীয়ত, কলিকাতা ও বেতড়ের দক্ষিণে বর্তমানে আমরা যাহাকে বলি আদিগঙ্গা, সেই আদিগঙ্গার খাতেই ভাগীরথীর সমুদ্রযাত্রা; অন্তত বিপ্রদাসের চাঁদ সওদাগর সেই পথেই যে গিয়াছিলেন তাহা নিঃসন্দেহ। সপ্তদশ শতকে ফান ডেন ব্রোকের নকশায় দেখা যায়, তখনও আদিগঙ্গার খাত খুব প্রশস্ত, কিন্তু সেই খাতে কোনও গ্রাম-নগর-বন্দরের উল্লেখ নাই। হইতে পরে, এই খাতে বৃহৎ নৌকা চলাচল বিশেষ আর হইতেছে না। এই অনুমানের কারণ, এক শত বৎসর পরে রেনেলের নকশায় দেখিতেছি, আদিগঙ্গার কোনও চিহ্নই নাই, অর্থাৎ এই এক শতকের মধ্যে আদিগঙ্গা তাহার বর্তমান আকৃতিতে পরিণত হইয়া গিয়াছৈ। ইহাই বোধ হয় ইতিহাসগত; কারণ, শোনা যায়, নবাব আলীবর্দীর আমলে কলিকাতা-বেতড়ের দক্ষিণে বর্তমান ভাগীরথী প্রবাহের প্রবর্তন হইয়াছিল। আদিগঙ্গা পলি পড়িয়া চলাচলের অযোগ্য হইলে আলীবর্দী নাকি বর্তমান সোজা দক্ষিণবাহী প্রবাহটির মুখ খুলিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু, আলীবর্দী নূতন প্রবাহপথ কাটিয়া বাহির করেন নাই; এ-পথ আদিগঙ্গা অর্থাৎ পঞ্চদশ শতক অপেক্ষাও পুরাতন, এবং বোধ হয় সরস্বতীর প্রাচীনতর খাতের দক্ষিণতম অংশ।
গঙ্গার প্রাচীনতম প্রবাহ
পঞ্চদশ শতকের (বিপ্রদাসের) আগে ভাগীরথী অন্তত আংশিকত এই সরস্বতীর খাত দিয়াই সমুদ্রে প্রবাহিত হইত, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে। আনুমানিক ১১৭৫ খ্ৰীষ্টাব্দে, কলিকাতার দক্ষিণে উলুবেড়িয়া-গঙ্গাসাগরখাতে ভাগীরথী প্রবাহিত হইত, এমন লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। পুরাণে, বিশেষত মৎস্য ও বায়ুপুরাণে উল্লিখিত আছে যে, তাম্রলিপ্ত দেশের ভিতর দিয়া গঙ্গা প্রবাহিত হইত; এবং সম্ভবত সমুদ্রসন্নিকট গঙ্গার তীরেই ছিল তাম্রলিপ্তির সুবৃহৎ বাণিজ্যকেন্দ্র। এ সম্বন্ধে মৎস্য পুরাণের উক্তিকে পৌরাণিক উক্তির প্রতিনিধি বলিয়া ধরা যাইতে পারে। হিমালয়-উৎসারিত পূর্ব-দক্ষিণবাহী সাতটি প্রবাহকে এই পুরাণে গঙ্গা বলা হইয়াছে; এই সাতটির মধ্যবর্তী প্রবাহটির ভাগীরথী নামকরণ-প্রসঙ্গে ভাগীরথী-কর্তৃক গঙ্গা আনয়নের সুবিদিত। গল্পটিই এইখানে বিবৃত করা হইয়াছে। এই পুরাণে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, কুরু, ভরত, পঞ্চাল, কৌশিক ও মগধ দেশ পার হইয়া বৈন্ধ্যশৈলশ্রেণীগাত্রে (রাজমহল—সঁওতালভূমি-ছোটনাগপুরমানভূম-ধলভূম শৈলমূলে) প্রতিহত হইয়া ব্রহ্মোত্তর (উত্তর-রাঢ়), বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্ত (সুহ্ম) দেশের ভিতর দিয়া ভাগীরাহী প্রবাহিত হইত। প্রাচীন বাঙলায় ভাগীরথীর প্রবাহপথের ইহার চেয়ে সংক্ষিপ্ত সুন্দর সুস্পষ্ট বিবরণ আর কী হইতে পারে? একটু পরেই আমি দেখাইতে চেষ্টা করিব, উত্তর, দক্ষিণ বিহারের ভিতর দিয়া রাজমহলের নিকট বাঙলাদেশে প্রবেশ করিয়া রাজমহল-সাঁওতালভূমি-ছোটনাগপুর-মালভূমি-ধলভূমের শৈলভূমিরেখা ধরিয়া যে অগভীর ঝিল ও নিম্ন জলাভূমি সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত সেই ভূমিরেখাই ভাগীরথীর সন্ধান-সম্ভাব্য প্রাচীনতম খ্যাত। যাহাই হউক, পুরাণ-বৰ্ণনা হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, এক্ষেত্রে ভাগীরথী-প্রবাহের কথা ইঙ্গিত করা হইতেছে, এবং ইহাকেই বলা হইতেছে গঙ্গার প্রধান প্রবাহ। এই প্রবাহ উত্তর-রাঢ় দেশের ভিতর দিয়া দক্ষিণবাহী, এবং তাহার পূর্বে বঙ্গ, পশ্চিমে তাম্রলিপ্ত, এই ইঙ্গিতও যেন মৎস্যপুরাণে পাওয়া যাইতেছে, ইহাই তো ইতিহাস-সম্মত। ভগীরথী-কর্তৃক গঙ্গা আনয়নের গল্প রামায়ণেও আছে, এবং সেখানেও গঙ্গা বলিতে রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহকেই যেন বুঝাইতেছে। যুধিষ্ঠির গঙ্গাসাগর-সংগমে তীর্থস্নান করিতে আসিয়াছিলেন, এবং সেখান হইতে গিয়াছিলেন কলিঙ্গদেশে। রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহই যে যথার্থত ভাগীরথী ইহাই রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের ইঙ্গিত, এবং এই প্রবাহের সঙ্গেই সুদূর অতীতের সূর্যবংশীয় ভগীরথ রাজার স্মৃতি বিজড়িত। উইলিয়াম উইলকক্স সাহেব এই ভগীরথী-ভাগীরথী কাহিনীর যে পৌর্তিক ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহা ইতিহাস-সম্মত বলিয়া মনে হয় না। পদ্মা-প্রবাহ অপেক্ষা ভাগীরথী-প্রবাহ যে অনেক প্রাচীন এ-সম্বন্ধেও কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। যাহা হউক, জাও ডি ব্যারোসের (১৫৫০) এবং ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) পুরাণোক্ত প্রাচীন প্রবাহপথের ইঙ্গিত বর্তমান বলিয়া মনে হয়। এই দুই নকশার তুলনামূলক আলোচনা করিলে দেখা যাইবে, সপ্তদশ শতকে জাহানাবাদের নিকটে আসিয়া দুইভাগে বিভক্ত হইয়া দামোদরের একটি প্রবাহ (ক্ষেমানন্দ-কথিত বাকা দামোদর) উত্তর-পূর্ববাহিনী হইয়া নদীয়া-নিমতার দক্ষিণে গঙ্গায়, এবং আর-একটি প্রবাহ দক্ষিণবাহিনী হইয়া নারায়ণগড়ের নিকট রূপনারায়ণ-পত্রিঘাটার সঙ্গে মিলিত হইয়া তম্বোলি বা তমলুকের পাশ দিয়া গিয়া সমুদ্রে পড়িতেছে। আর, মধ্য ভূখণ্ডে ত্ৰিবেণী-সপ্তগ্রামের নিকট হইতে আর-একটি প্রবাহ (অর্থাৎ সরস্বতী) ভাগীরথী হইতে বিযুক্ত হইয়া পশ্চিম দিকে দক্ষিণবাহিনী হইয়া কলিকাতা-বেতড়ের দক্ষিণে পুনর্বার ভাগীরথীর সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে।
সরস্বতী
এক শতাব্দী আগে, ষোড়শ শতকে জাও ডি ব্যারোসের নকশায় দেখিতেছি, সরস্বতীর একেবারে ভিন্নতর প্রবাহপথ। সপ্তগ্রামের (Satigam) নিকটেই সরস্বতীর উৎপত্তি, কিন্তু সপ্তগ্রাম হইতে সরস্বতী সোজা পশ্চিমবাহিনী হইয়া যুক্ত হইতেছে দামোদর-প্রবাহের সঙ্গে, বাকা দামোদর সংগমের নিকটেই। এই বাঁকা দামোদরের কথা বলিয়াছেন। সপ্তদশ শতকের (১৬৪০) কবি ক্ষেমানন্দ তাহার ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে সে কথা পরে উল্লেখ করিয়াছি। যাহাই হউক, দামোদর বর্ধমানের দক্ষিণে যেখান হইতে দক্ষিণবাহী হইয়াছে সেইখানে সরস্বতীর সঙ্গে তাহার সংযোগ-ইহাই জাও ডি ব্যারোসের নকশার ইঙ্গিত। আমার অনুমান, এই প্রবাহপথই গঙ্গা-ভাগীরথীর প্রাচীনতর প্রবাহপথ, এবং সরস্বতীর পথ ইহার নিন্ন অংশ মাত্র। তাম্রলিপ্ত হইতে এই পথে উজান বহিয়াই বাণিজ্যপোতগুলি পাটলিপুত্র-বারাণসী পর্যন্ত যাতায়াত করিত। এবং এই নদীতেই পশ্চিম দিকে ছোটনাগপুর-মানভূমের পাহাড় হইতে উৎসারিত হইয়া স্ব-স্বতন্ত্র অজয়, দামোদর, রূপনাৱায়ণ প্রভৃতি নদ তাহাদের জলস্রোত ঢলিয়া দিত।
অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ
ইহাই প্রাচীন বাঙলার গঙ্গা-ভাগীরথীর নিম্নতর প্রবাহ। এখনও ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ, শিলাই, দ্বারকেশ্বর প্রভৃতি নদনদী ভাগীরথীতে জলধারা মেশায় সত্য, কিন্তু ইহাদের ভাগীরথীসংগমস্থান ভাগীরথীপ্রবাহপথের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পূর্বদিকে সরিয়া আসিয়াছে; এবং ইহাদের বিশেষভাবে দামোদর এবং রূপনারায়ণের, প্রবাহপথও নিম্নপ্রবাহে ক্রমশ অধিকতর দক্ষিণবাহী হইয়াছে। বর্ধমানের দক্ষিণে দামোদরের প্রবাহপথের পরিবর্তন খুব বেশি হইয়াছে। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) দেখা যায় বর্ধমানের দক্ষিণ-পথে দামোদরের একটি শাখা সোজা উত্তর পূর্ববাহী হইয়া আম্বোনা (Ambona)-কালনার কাছে ভাগীরথীতে পড়িতেছে। ক্ষমানন্দ বা ক্ষেমানন্দ দাসের (কেতকাদাসের) ‘মনসামঙ্গলে’ (১৬৪০ আনুমানিক) এই শাখাটিকেই বুঝি বলা হইয়াছে “বাঁকা দামোদর”। এই বাঁকা নদীর তীরে তীরে যে-সব স্থানের নাম কেতকাদাস-ক্ষমানন্দ করিয়াছেন তাহার তালিকা এই; কুঝাটি বা ওঝটি, গোবিন্দপুর, গঙ্গাপুর, দেপুর, নেয়াদা বা নর্মদাঘাট, কেজুয়া, আদমপুর, গোদাঘাট, কুকুরঘাটা, হ্রাসনহাটি, নারিকেলডাঙ্গ, বৈদ্যপুর ও গহরপুর; গহরপুরের পরেই বাঁকা দামোদর “গঙ্গার জলে মিলি”য়া গেল। দামোদরের দক্ষিণবাহী প্রবাহপথেই যে এক সময় সরস্বতীর প্রবাহপথ ছিল আমার এ অনুমান আগেই লিপিবদ্ধ করিয়াছি। জাও ডি ব্যারোসের নকশার ইঙ্গিত তাঁহাই। পরে সরস্বতী এই পথ পরিত্যাগ করিয়া সোজা দক্ষিণবাহী হইয়া রূপনারায়ণ-পত্ৰঘাটার প্রবাহপথে কিছুদিন প্রবাহিত হইত। বস্তুত রূপনারায়ণের নিম্নপ্রবাহ একদা-সরস্বতীরই প্রবাহপথ বলিয়া মনে হয়। যাহাই হউক অষ্টম শতকের পরেই সরস্বতী-ভাগীরথীর এই প্রাচীনতর প্রবাহপথের মুখ এবং নিম্নতম প্রবাহ শুকাইয়া যায়, এবং তাহার ফলেই তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হয়। অষ্টম হইতে চতুৰ্দশ শতকের মধ্যে কোনও সময় সরস্বতী তাহার প্রাচীনতর পথ পরিত্যাগ করিয়া বর্তমানের খাত প্রবর্তন করিয়া থাকিবে এবং সেই খাতেও কিছুদিন ভাগীরথীর প্রবলতর স্রোত চলাচল করিয়া থাকিবে। চতুর্দশ শতকের গোড়াতেই সপ্তগ্রামে মুসলমানদের অন্যতম রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, এ তথ্য সুবিদিত। কিন্তু দশম শতক হইতে নিম্নপ্রবাহে কলিকাতা-বেতড় পর্যন্ত ভাগীরথীর বর্তমান পথই প্রধানতম পথ এবং আরও দক্ষিণে আদি গঙ্গার পথ। আলীবর্দীর সময়ে আদিগঙ্গা পরিত্যক্ত হইয়া মধ্যযুগের সরস্বতীর পরিত্যক্ত পথেই গঙ্গা-ভাগীরথীর পথ প্রবর্তিত হয়। বিপ্রদাসের চাঁদ সদাগর ত্রিবেণীর পরেই সরস্বতীতীরে সপ্তগ্রামের সুদীর্ঘ বর্ণনা দিয়াছেন। ১৪৭৫ খ্ৰীষ্টাব্দে সপ্তগ্রাম সমৃদ্ধিশালী বন্দর-নগর, তাহার বর্ণনাই তাহা প্রমাণ করিতেছে। কিন্তু সপ্তগ্রাম ছাড়িয়া চাঁদ সওদাগর সরস্বতীর পথে আর অগ্রসর হইতেছেন না; তিনি বর্তমান ভাগীরথীর প্রবাহে ফিরিয়া আসিতেছেন; কারণ, সপ্তগ্রামের পরেই উল্লেখ পাইতেছি কুমারহাট এবং হুগলীর। মনে হয় ১৪৯৫ খ্ৰীষ্টাব্দেই সরস্বতীর পথে বেশিদূর আর অগ্রসর হওয়া যাইতেছে না, এবং সেই পথে বৃহৎ বাণিজ্যতরী চলাচল বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ১৭৬০ খ্ৰীষ্টাব্দে দেখিতেছি। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় Olegli বা হুগলী খুব ফাপিয়া উঠিয়াছে; তখনও Tripeni (ত্রিবেণী), Coatgam (সাতগা) বিদ্যমান, কিন্তু উভয়েই মুমূর্ষ। ইহাই ইতিহাসগত। কারণ আগরপাড়া (Agrapara), বরাহনগর (Bernagar) ইত্যাদির উল্লেখ ব্যারোসের নকশাতে দেখিতেছি (১৫৫০); তাহার নকশায় কিন্তু হুগলীর উল্লেখ নাই। ১৫৬৫ খ্ৰীষ্টাব্দে ফ্রেডরিক সাহেব স্পষ্ট বলিতেছেন, বাতোর (Bator) বা বেতড়ের উত্তরে সরস্বতীর প্রবাহ অত্যন্ত অগভীর হইয়া পড়িয়াছে, সেইজন্য ছোট ছোট জাহাজও যাওয়া আসা করিতে পারে না। নিশ্চয়ই এই কারণে পর্তুগীজেরা ১৫৮০ খ্ৰীষ্টাব্দে সপ্তগ্রামের পরিবর্তে হুগলীতেই তাহাদের বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। ইহার পর ১৬৬০ খ্ৰীষ্টাব্দে ফান ডেন ব্রোক Olegi খুব মোটা মোটা অক্ষরে উল্লেখ করিবেন তাহা মোটেই আশ্চর্য নয়!
যমুনা
ত্ৰিবেণী-সংগমের অন্যতম নদী যমুনা, এ-কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। এই যমুনা এখন খুজিয়া বাহির করা আয়াসসাধ্য, কিন্তু পঞ্চদশ শতকে বিপ্রদাসের কালে “যমুনা বিশাল অতি”। ত্ৰিবেণী-সপ্তগ্রামের বর্ণনাপ্রসঙ্গে বিপ্রদাস বলিতেছেন, “গঙ্গা আর সরস্বতী যমুনা বিশাল অতি, অধিষ্ঠান উমা মাহেশ্বরী”। রেনেলের নকশায় যমুনা অতি ক্ষীণা একটি রেখা মাত্ৰ।
গঙ্গার উত্তর প্রবাহ
গঙ্গা-ভাগীরথীর দক্ষিণ বা নিম্ন প্রবাহ ছাড়িয়া এইবার উত্তর প্রবাহের কথা একটু বলা যাইতে পারে। এ-সম্বন্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ অত্যন্ত কম; অনেকটা অনুমানের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নাই। প্রাচীন গৌড়ের প্রায় পঁচিশ মাইল দক্ষিণে এখন ভাগীরথী ও পদ্মা দ্বিধাবিভক্ত হইতেছে, কিন্তু প্রাচীন বাঙলায়, অন্তত সপ্তদশ শতকপূর্ব বাঙলায় গৌড়-লক্ষ্মণাবতী ছিল গঙ্গার পশ্চিম তীরে, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে। বস্তুত, ডি ব্যারোস (১৫৫০) এবং গ্যাসটান্ডির (Gastaldi, ১৫৬১) নকশা দুটিতেই গৌড়ের (Gorij : গ্যাসটান্ডির নকশায় Gaur) অবস্থান গঙ্গা ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে, এবং রাঢ় (জাও ডি ব্যারোসের নকশার Rara) দেশের উত্তরে স্বল্প উত্তর-পশ্চিমে। মুসলমান ঐতিহাসিকদের বিবরণ হইতেও মনে হয়, গৌড় ভাগীরথীর পশ্চিম তীরেই অবস্থিত ছিল। রাজমহল পার হইয়া গঙ্গা খুব সম্ভবত তখন খানিকটা উত্তর ও পূর্ব বাহিনী হইয়া গৌড়কে পশ্চিম বা ডাইনে রাখিয়া রাঢ় দেশের মধ্য দিয়া দক্ষিণবাহিনী হইত। বর্তমান কালিন্দী ও মহানন্দা খুব সম্ভব এই উত্তর ও পূর্ব প্রবাহ-পথের প্রাচীন স্মৃতি বহন করে। যাহা হউক, ইহা হইতেছে আনুমানিক দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ হইতে ষোড়শ শতকের কথা; কিন্তু সপ্তদশ শতকেই গঙ্গা-ভাগীরথী এইপথ পরিত্যাগ করিয়া বর্তমান পথ প্রবর্তন করিয়াছে। দ্বাদশ-এয়োদশ শতকেরও আগে গঙ্গা-ভাগীরথীর উত্তর-প্রবাহের প্রাচীনতর পথ বোধ হয় ছিল, এবং এ পথটি বর্তমান প্রবাহপথের পশ্চিমে। পূর্ণিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া রাজমহল-সাঁওতাল পরগনা-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূমের নিম্নভূমি ঘেষিয়া দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিল ও নিম্ন জলাভূমিময় এক সুদীর্ঘ দক্ষিণবাহী রেখা চলিয়া গিয়াছে। এই রেখা এখনও বর্তমান। এই রেখাই গঙ্গা-ভাগীরথীর প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিদেৰ্শক বলিয়া আমার ধারণা। ইহারই নিম্নতর প্রবাহে আমি ইতিপূর্বে দামোদর-সরস্বতী-রূপনারায়ণের কিয়দংশের প্রবাহপথের ইঙ্গিত করিয়াছি। এই সমগ্র প্রবাহপথ সম্বন্ধে আমার ধারণা যে নিছক কল্পনামাত্র নয় তাহা মৎস্যপুরাণোক্ত গঙ্গার প্রবাহপথের বর্ণনা হইতেই স্পষ্ট বুঝা যায়। মৎস্যপুরাণে আছে কৌশিক (৷রা বিহার) ও মগধ (দক্ষিণ-বিহার) পার হইয়া গঙ্গা বিন্ধ্যপর্বতের গাত্রে (রাজমহল-সাঁওতালভূম-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূম শৈলমূলে) প্রতিহত হইয়া ব্রহ্মোত্তর অর্থাৎ মোটামুটি উত্তর-রাঢ়, বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্ত দেশের ভিতর দিয়া প্রবাহিত হইত। ভাগীরথীর পূর্বতীর বঙ্গে, পশ্চিম তীরে তাম্রলিপ্তি, উত্তরতর প্রবাহে উত্তর-রাঢ়।
গঙ্গা ভাগীরথীর প্রবাহপথের প্রাচীন ইতিহাস এখন এইভাবে নির্দেশ করা যাইতে পারে : ১. ঐতিহাসিক কালের সন্ধান সম্ভাব্য প্রাচীনতম পথ; পূর্ণিয়ার দক্ষিণে রাজমহল পার হইয়া গঙ্গা রাজমহল—সঁওতালভূমি-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূমের তলদেশ দিয়া সোজা দক্ষিণবাহিনী হইয়া সমুদ্রে পড়িত; এই প্রবাহেই ছিল অজয়, দামোদর এবং রূপনারায়ণের সংগম। এই তিনটি নদীই তখন নাতিদীর্ঘ। এবং এই প্রবাহেরই দক্ষিণতম সীমায় তাম্রলিপ্তি বন্দর; ২৭ ইহার পরের পর্যয়েই গঙ্গার পূর্বদিক যাত্রা শুরু হইয়াছে। রাজমহল হইতে গঙ্গা-ভাগীরথী। খুব সম্ভবত বর্তমান কালিন্দী ও মহানন্দার খাতে উত্তর ও পূর্ববাহিনী হইয়া গৌড়কে ডাইনে রাখিয়া পরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমবাহিনী হইয়া সমুদ্রে পড়িয়াছে। কিন্তু এই প্রবাহ ১নং খাতের আরও পূর্বদিকে সরিয়া আসিয়াছে। তবে, তখনও দামোদর এবং রূপনারায়ণ-পত্ৰঘাটার জল ভাগীরথীতে পড়িতেছে এবং তাম্রলিপ্তি বন্দরও জীবন্ত। অর্থাৎ, এই পর্যায় অষ্টম শতকের আগেই; ৩, তৃতীয় পর্যায়েও গৌড় গঙ্গার পশ্চিম তীরে; কিন্তু তাম্রলিপ্তি বন্দর পরিত্যক্ত হইয়াছে, অর্থাৎ দামোদর-রূপনারায়ণ-পত্রিঘাটার এবং কিছুদিনের জন্য সরস্বতীরও জল লইয়া ভাগীরথীর যে পশ্চিমতর প্রবাহ তাহা পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং কলিকাতা বেতড় পর্যন্ত ভাগীরথীর বর্তমান প্রবাহপথের এবং বেতড়ের দক্ষিণে আদিগঙ্গা পথের প্রবর্তন হইয়াছে। এই পথেরই পরিচয় বিপ্রদাস (১৪৯৫) হইতে আরম্ভ করিয়া ফান ডেন ব্রোক (১৬৬০), দ্য ল’ অভিল (de l’Auvile, 1752), এফ ডি হ্বিট (F. de Witt, 1726), ইজাক টিরিয়ান (Izaak Tirion, 1730), থর্নটন (Thornton) প্রমুখ সকলেরই নকশায় পাওয়া যাইতেছে। আলীবর্দীর সময়ে (অর্থাৎ মোটামুটি ১৭৫০) আদিগঙ্গা পরিত্যক্ত হওয়াতে বেতড়ের দক্ষিণে পুরাতন সরস্বতীর খাতে কী করিয়া ভাগীরথীকে প্রবাহিত করা হয়, তাহা তো আগেই বলিয়াছি। তাই বোধ হয়, রেনেলের নকশায় (১৭৬৪-৭০) আদিগঙ্গার কোনও চিহ্নই প্রায় নাই। কর্নেল টলি (Tolly) সাহেব এই খাতের খানিকটা অংশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছিলেন (১৭৮৫) : তাহার নামানুসারেই Tolly’s Nullah এবং Tolygunje যথাক্রমে এই খাত এবং বামতীরের পল্লীটির বর্তমান নামকরণ।
পদ্মা
ভাগীরথী বা ছোটগঙ্গার কথা বলা হইল; এইবার বড়গঙ্গা বা পদ্মার কথা বলা যাইতে পারে। রেনেল সাহেব তো ইহাকেই গঙ্গা বলিয়াছেন। আগেই বলিয়াছি, পদ্মা অর্বাচীনা নদী; কিন্তু পদ্মাকে যতটা অর্বাচীনা পণ্ডিতেরা সাধারণত মনে করিয়া থাকেন ততটা অর্বাচীনা হয়ত সে নয়। রাধাকমল মুখোপাধ্যায় মহাশয় তো মনে করেন ষোড়শ শতক হইতে গঙ্গার পূর্বািযাত্রার অর্থাৎ পদ্মার সূত্রপাত। ইহা ইতিহাস-বিরুদ্ধ বলিয়াই মনে হয়। রেনেল ও ফার্ন ডেন ব্রোকের নকশায় পদ্মা বেগবতী নদী। সিহাবুদ্দিন তালিস (১৬৬৬) ও মির্জা নাথনের (১৬৬৪) বিবরণীতে দেখিতেছি গঙ্গা-ব্ৰহ্মপুত্রের সংগমের উল্লেখ, ইছামতীর সংগমে, ইছামতীর তীরে যাত্রাপুর এবং তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে ডাকচার, এবং ঢাকার দক্ষিণে গঙ্গা-ব্ৰহ্মপুত্রের সম্মিলিত প্রবাহের সমুদ্রযাত্ৰা— ভলুয়া এবং সন্দীপের পাশ দিয়া। যাত্রাপুর হইতে ইছামতী বাহিয়া পথই ছিল তখন ঢাকায় যাইবার সহজতম পথ, এবং সেই পথেই টেভারনিয়ার (১৬৬৬) এবং হেজেস (১৬৮২) যাত্রাপুর হইয়া ঢাকা গিয়াছিলেন। কিন্তু তখন সর্বত্র গঙ্গার এই প্রবাহের পদ্মা নামকরণ দেখিতেছি না। এই নামকরণ দেখিতেছি। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে (১৫৯৬-৯৭), মির্জা নাথনের ‘বহারিস্তান-ই ঘায়বি’ গ্রন্থে, ত্রিপুরা রাজমালায় এবং চৈতন্যদেবের পূর্ববঙ্গ ভ্ৰমণপ্রসঙ্গে। আবুজ ফজলের মতে কাজিহাটার কাছে গঙ্গা দ্বিধাবিভক্ত হইয়াছে; একটি প্রবাহ পূর্ববাহিনী হইয়া পদ্মাবতী নাম লইয়া চট্টগ্রামের কাছে গিয়া সমুদ্রে পড়িতেছে। মির্জা নাথন বলিতেছেন, করতোয়া বালিয়ার কাছে একটি বড় নদীতে আসিয়া পড়িতেছে; এই বড় নদীটির নাম অন্যত্র বলা হইয়াছে পদ্মাবতী। ত্রিপুরারাজ বিজয়মাণিক্য ১৫৫৯ খ্ৰীষ্টাব্দে ত্রিপুরা হইতে ঢাকায় আসিয়া ইছামতী বাহিয়া যাত্ৰাপুরে আসিয়া পদ্মাবতীতে তীর্থস্নান করিয়াছিলেন। চৈতন্যদেবও (জন্ম ১৪৮৫) ২২ বৎসর বয়সে পূর্ববঙ্গ ভ্ৰমণে আসিয়া পদ্মাবতীতে তীৰ্থস্নান করিয়াছিলেন, কোনও কোনও চৈতন্য-জীবনীতে এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকেই পদ্মা এবং ইছামতী প্রসিদ্ধা নদী, তাহার কিছু তীৰ্থমহিমাও আছে, এবং ঢাকা পার হইয়া চট্টগ্রামের নিকটে তাহার সাগরমুখ—এ তথ্য তাহা হইলে অনস্বীকার্য। ষোড়শ শতকের জাও ডি ব্যারোস এবং সপ্তদশ শতকের ফান ডেন ব্রোকের নকশায়ও এই তথ্যের ইঙ্গিত পাওয়া কঠিন নয়। পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় কৃত্তিবাস যে এই পদ্মাবতীকেই বলিতেছেন বড়গঙ্গা তাহা তো আগেই দেখিয়াছি। চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতা (১৩৪৫-৪৬) চীন দেশ যাইবার পথে সমুদ্রতীরবর্তী চট্টগ্রামে (Chhadkawan-চাটগা) নামিয়াছিলেন। তিনি চট্টগ্রামকে হিন্দুতীর্থ গঙ্গানদী এবং যমুনা (Jaun) নদীর সংগমস্থল বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। যমুনা বা Jaun বলিতে বতুতা ব্ৰহ্মপুত্রই বুঝাইতেছেন, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। তিনি বলিতেছেন,
“The first town of Bengal, which we entered, was Chhadkawan (Chittagong), situated on the shore of the vast ocean. The river Ganga, to which the Hindus go in pilgrimage and the river Jaun (Jamuna) have united mear it before falling into the sea.”
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, অন্তত চতুর্দশ শতকেও গঙ্গার পদ্মাবতী-প্রবাহ চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং তাহার অদূরে সেই প্রবাহ ব্ৰহ্মপুত্র-প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হইত। তটভূমি প্রসারের সঙ্গে চট্টগ্রাম এখন অনেক পূর্ব-দক্ষিণে সরিয়া গিয়াছে, ঢাকাও এখন আর গঙ্গা-পদ্মার উপরে অবস্থিত নয়। পদ্মা এখন অনেক দক্ষিণে নামিয়া গিয়াছে; ঢাকা, এখন পুরাতন গঙ্গা-পদ্মার খাত অর্থাৎ বুড়ীগঙ্গার উপর অবস্থিত; আরও পদ্মা-ব্ৰহ্মপুত্রের (যমুনা) সংগম এখন গোয়ালন্দের অদূরে। এই মিলিত প্রবাহ আরও পূর্ব-দক্ষিণে গিয়া চাঁদপুরের অদূরে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হইয়া সন্দ্বীপের (স্বর্ণদ্বীপ= সোনাদ্বীপ=সন্দ্বীপ) নিকট গিয়া সমুদ্রে পড়িয়াছে। বস্তুত, সমতটীয় বাঙলায়, বিশেষত, তাহার পূর্বাঞ্চলে বরিশাল হইতে আরম্ভ করিয়া চাদপুর পর্যন্ত পদ্মা-ব্ৰহ্মপুত্র-মেঘনা যে কী পরিমাণে ভাঙাগড়া চালাইয়াছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া, তাহা জাও ডি ব্যারোস হইতে আরম্ভ করিয়া রেনেল পর্যন্ত নকশাগুলো বিশ্লেষণ করিলে খানিকটা ধারণাগত হয়। কিন্তু তাহা আলোচনার স্থান। এখানে নয়। প্রাচীন বাঙলায় গঙ্গার এই পূর্ব-প্রবাহের অর্থাৎ পদ্মা বা পদ্মাবতীর আকৃতি-প্রকৃতি কী ছিল তাঁহাই আলোচ্য। পঞ্চদশ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া উনবিংশ শতক পর্যন্ত পদ্মার প্রবাহপথের অদলবদল বহু আলোচিত; কাজেই, এখানে তাহার পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই।
গড়াই : মধুমতী : শিলাইদহ
চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতার বিবরণের আগে বহুদিন এই প্রবাহের কোনও সংবাদ পাওয়া যাইতেছে না। দশম শতকের শেষে একাদশ শতকের গোড়ায় চন্দ্ৰবংশীয় রাজারা বিক্রমপুর-চন্দ্ৰদ্বীপ-হরিকেল অর্থাৎ পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের অনেকাংশ জুড়িয়া রাজত্ব করিতেন। এই বংশের মহারাজাধিরাজ শ্ৰীচন্দ্র তাহার ইদিলপুর পট্টোলী দ্বারা “সতীট-পদ্মাবতী বিষয়ের অন্তর্গত ‘কুমারতালিক মণ্ডলে একখণ্ড ভূমিদান করিয়াছিলেন। সতট-পদ্মাবতী বিষয় পদ্মানদীর দুই তীরবর্তী প্রদেশকে বুঝাইতেছে, সন্দেহ নাই; পদ্মাবতীও নিঃসন্দেহে আবুল ফজল-ত্রিপুরা রাজমালা চৈতন্যজীবনী উল্লিখিত পদ্মাবতী, তাহাতেও সন্দেহের অবকাশ নাই। কুমারতালক মণ্ডলের উল্লেখ আরও লক্ষণীয়। কুমারতালক এবং বর্তমান গড়াই নদীর অদূরে ফরিদপুরের অন্তর্গত কুমারখালি দুইই কুমার নদীর ইঙ্গিত বহন করে তাহা নিঃসন্দেহ। বর্তমান কুমার বা কুমার নদী পদ্মা-উৎসারিত মাথাভাঙ্গা নদী হইতে বাহির হইয়া বর্তমান গড়াইর সঙ্গে মিলিত হইয়া বিভিন্ন অংশে গড়াই, মধুমতী, শিলা(ই)দহ, বালেশ্বর নাম লইয়া হরিণঘাটায় গিয়া সমূদ্র পড়িয়াছে।
কুমার
এ অনুমান যুক্তিসংগত যে, এই সমস্ত প্রবাহটিরই যথার্থ নাম ছিল কুমার এবং কুমারই পরে বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন নামে পরিচিত হইয়াছে। তবে শিলা(ই)দহ নামটি পুরাতন বলিয়াই যেন মনে হয়। ফরিদপুরে প্রাপ্ত ধর্মদিত্যের একটি পট্রেলীতে শিলাকুণ্ড নামে একটি জলাশয়ের উল্লেখ আছে। শিলাকুণ্ড ও শিলা(ই)দহ একই নাম হইতেও পারে; দুয়েরই অর্থ প্রায় এক। এই কুমার নদীর সাগর-মোহনার মুখ (হরিণঘাটা) বা কৌমারকই বোধ হয় (দ্বিতীয় শতকের।) টলেমির গঙ্গার পঞ্চমুখের তৃতীয় মুখ কাম্বেরীখন (Kamberikhon)। যাহা হউক, সাতট-পদ্মাবতী বিষয়ের উল্লেখ হইতে বুঝা যাইতেছে যে, দশম-একাদশ শতকেই পদ্মা বা পদ্মাবতীর প্রবাহ ইদিলপুর-বিক্রমপুর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং ঐদিক দিয়াই বোধ হয় সাগরে প্রবাহিত হইত। কুমারতািলক মণ্ডলের (যে মণ্ডল কুমার নদীর তল বা অববাহিকা, নদীর দুই ধারের নিম্নভূমি) উল্লেখ হইতে অনুমান হয় কুমার নদীও। তখন বর্তমান ছিল এবং পদ্মাবতীর সঙ্গে তাহার যোগও ছিল। সাত ‘শত বৎসর পর রেনেলের নকশায় তাহা লক্ষ্য করা যায়, এবং গড়াই-মধুমতী-শিলা(ই)দহ-বালেশ্বর যদি কুমারের সঙ্গে অভিন্ন না হয় তাহা হইলে সে যোগ এখনও বর্তমান।
ইদিলপুর পট্টোলীর প্রায় সমসাময়িক একটি সাহিত্যগ্রন্থেও বোধ হয় গুহ্য রূপকছলে পদ্মানদীর উল্লেখ আছে। দশম-দ্বাদশ শতকের বিজযান বৌদ্ধধর্ম-সাধনার গুহা আচার-আচরণ সম্বন্ধে প্রাচীনতম বাঙলা ভাষায় যে-সমস্ত পদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয়ের কল্যাণে আজ সুপরিচিত হইয়াছে, তাহার মধ্যে একটি পদের প্রথম চার লাইন এইরূপ :
বাজণাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ।
অদঅ বঙ্গালে ক্লেশ লুড়িউ৷।
আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী।
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী৷ [৪৯ নং পদ, ভুসুকু সিদ্ধাচার্যের রচনা]
সিদ্ধাচার্য ভুসুকু একাদশ শতকের মধ্যভাগের লোক। ডক্টর শহীদুল্লাহ মনে করেন, ভুসুকু তাহার গুরু দীপংকর-অতীশ-শ্ৰীজ্ঞানের পঞ্চাশিয্যের অন্যতম এবং “এই বাঙ্গাল দেশেরই এক প্রাচীন কবি।” উদ্ধৃত লাইন চারিটির আপাত অর্থ এই : ‘পদ্মাখালে বজ্রনৌকা পাড়ি বহিতেছে। অদ্বয়-বঙ্গালে ক্লেশ লুটিয়া লইল। ভুসু, তুই আজ (যথার্থ) বঙ্গালী হইলি। চণ্ডালীকে তুই নিজ ঘরণী করিয়া লইয়াছিস।’ এখানে পদ্মাখাল, বঙ্গ, বঙ্গালী প্রভৃতি শব্দের এবং সমস্ত পদটির সহজিয়া মতানুগত গুহ্য অর্থ তো আছেই, তবে সেই গুহ্য অর্থ গড়িয়া উঠিয়াছে কয়েকটি বস্তুসম্পর্কগত শব্দকে অবলম্বন করিয়া। ভুসুকু বাঙ্গালী অর্থাৎ পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গবাসী ছিলেন। ১০২১-২৫ খ্ৰীষ্টাব্দে রাজেন্দ্ৰচোল দক্ষিণ-রাঢ়ের পরেই বঙ্গাল দেশ জয় করিয়াছিলেন, অর্থাৎ ভাগীরথীর পূর্বতীরে বর্তমান দক্ষিণবঙ্গই বঙ্গলদেশ এবং এই বঙ্গালদেশ অন্তত বিক্রমপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি যখন বঙ্গালী এবং বঙ্গালদেশের সঙ্গে পদ্মাখালের কথা বলিতেছেন, তখন পঁউআ খাঁল এবং পদ্মাবতী নদী যে এক এবং অভিন্ন, এ কথা স্বীকার করিতে আপত্তি হইবার কারণ নাই। তাহা হইলে, ইদিলপুর লিপি এবং ভুসুকুর এই পদটিই পদ্মা বা পদ্মাবতী নদীর প্রাচীনতম নিঃসংশয় ঐতিহাসিক উল্লেখ। তবে, পদ্মা তখনও হয়তো এত বড় নদী হইয়া উঠে নাই; বোধ হয় খালোপমই ছিল।
দশম-একাদশ শতকে পদ্মার উল্লেখ দেখা গেল। কিন্তু পদ্মা যে গঙ্গা-ভাগীরথীর অন্যতম। শাখা তাহা খুব প্রাচীন লোকস্মৃতির মধ্যেও বিধৃত হইয়া আছে। দক্ষিণবাহী গঙ্গা-ভাগীরথী হইতে পদ্মার উৎপত্তিকাহিনী বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, দেবী ভাগবত, মহাভাগবত-পুরাণ এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডে বর্ণিত হইয়াছে। ইহাদের একটিও অবশ্য খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতকের আগের রচিত গ্রন্থ নয়, কিন্তু কাহিনীগুলির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বর্যাত্রায় প্রবাহপথ অর্থাৎ পদ্মা দশম-একাদশ শতক হইতেও প্রাচীন। তবে, তখন বোধ হয় পদ্মা এত প্রশস্ত ও বেগবতী নদী ছিল না, হয়তো ক্ষীণতোয়া সংকীর্ণ ধারাই ছিল। তাহা না হইলে কামরূপ হইতে সমতট যাইবার পথে য়ুয়ান-চোয়াঙকে এই নদীটি পার হইতে হইত এবং তাহার বিবরণীতে আমরা নদীটির উল্লেখও পাইতাম। এই অনুল্লেখ হইতে মনে হয় পদ্মা তখন উল্লেখযোগ্য নদী ছিল না। তাহা ছাড়া, ষষ্ঠ শতকে পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি হিমবচ্ছিখর হইতে দ্বাদশ শতকে সমুদ্রতীর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল; পদ্মা আজিকার মতন ভীষণা প্রশস্ত হইলে হয়তো একই ভুক্তি পদ্মার দুই তীরে বিস্মৃত হইত না। জ্যোতির্বেত্তা ও ভৌগোলিক টলেমি (Ptolemy, 150 AD.) তাঁহার আন্তর্গাঙ্গেয় (India intra-Gangem) ভারতবর্ষের নকশা ও বিবরণীতে তদনীন্তন গঙ্গা-প্রবাহের সাগরসংগমে পাঁচটি মুখের উল্লেখ করিয়াছেন। টলেমির নকশা ও বিবরণ নানা দোষে দুষ্ট এবং সর্বত্র সকল বিষয়ে খুব নির্ভরযোগ্যও নয়। তবু, তাহার সাক্ষ্য এবং পরবর্তী ঐতিহাসিক উপাদানের উপর নির্ভর করিয়া কিছু কিছু অনুমান ঐতিহাসিকেরা করিয়াছেন, এবং এইসব মোহনা অবলম্বনে প্রাচীন ভাগীরথী-পদ্মার প্রবাহ-পথেরও কিছু আভাস দিয়াছেন। এ-সম্বন্ধে জোর করিয়া কিছু বলা শক্ত; তবে মোটামুটি মতামতগুলির উল্লেখ করা যাইতে পারে। পশ্চিম হইতে পূর্বদিকে যথাক্রমে এই মোহনাগুলির নাম : ১. Kambyson; তারপর Poloura নামে নগর; ২. Mega (great); ৩. Kamberj-khon; তারপর Tilogrammon নামে এক নগর; ৪. Pseudostomon (false mouth); এবং সর্বশেষে পূর্বতম মোহনা ৫. Antibole (thrown back)৷ নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় এই মোহনাগুলিকে যথাক্রমে ১, তাম্রলিপ্ত-নিকটবর্তী গঙ্গাসাগর মুখ, ২০ আদিগঙ্গা বা রায়মঙ্গল-হরিয়াভাঙ্গা মুখ, ৩। কুমার-হরিণঘাটা মুখ, ৪. দক্ষিণ সাহাবাজপুর মুখ, এবং ৫. সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম-মধ্যবর্তী আড়িয়াল খা নদীর নিম্নতম প্রবাহমুখ বলিয়া মনে করেন। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মহাশয় মনে করেন, ১৯ কালিদাস-কথিত কপিশা বা বর্তমান কাসাইর মুখ, ২০ ভাগীরথীর সাগরমুখ, ৮। কুমার-কুমারক-হরিণঘাটা মুখ, ৪. পদ্মা-মেঘনার সম্মিলিত প্রবাহমুখ, এবং ৫ বুড়িগঙ্গা মুখই।থাক্রমে টলেমি-কথিত গঙ্গর পঞ্চমুখ। এই দুই মতের মধ্যে ১ ও ২ নং ছাড়া আর কোথাও গুণ মূলগত বিশেষ কিছু পার্থক্য নাই; ২নং মুখের পার্থক্যও খুব মূলগত নয়। ৩, ৪, ও ৫ নং মুখ সম্বন্ধে যদি সদ্যোক্ত মত দুইটি সত্য নয় তাহা হইলে স্বীকার করিতেই হয় টলেমির সময়েই অন্তত ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চল পর্যন্ত গঙ্গার পূর্ব-দক্ষিণবাহী প্রবাহপথ অর্থাৎ পদ্মার প্রবাহপথের অস্তিত্ব ছিল। খুব অসম্ভব নাও হইতে পারে, তবে এ-সম্বন্ধে জোরােকরিয়া কিছু বলা যায় না।
ধলেশ্বরী : বুড়ীগঙ্গা
পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধেও নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না। ফান ডেন ব্রোকের (১৬৬০) নকশায় দেখা যাইতেছে পদ্মার প্রশস্ততর প্রবাহের গতি ফরিদপুর-বাখরগঞ্জের ভিতর দিয়া দক্ষিণ শাহাবাজপুরের দিকে। কিন্তু ঐ নকশাতেই প্রাচীনতর পথটিরও কিছুটা ইঙ্গিত বোধ হয় আছে। এই পথটি রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে চলনবিলের ভিতর দিয়া ধলেশ্বরীর খাত দিয়া ঢাকার পাশ দিয়া মেঘনা-খাড়িতে গিয়া সমুদ্রে মিশিত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়ীগঙ্গা বলা হয়, তাহা এই কারণেই; ঐ বুড়ীগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত। কিন্তু তাহারও আগে কোন পথে পদ্মা প্রবাহিত হইত–সে-সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন।
জলাঙ্গী : চন্দনা
পদ্মার প্রধান প্রবাহ ছাড়া উৎসারিত আরও কয়েকটি নদীর প্রবাহপথে ভাগীরথী-পদ্মার জল নিষ্কাশিত হয়। ইহাদের ভিতর জলাঙ্গী এবং চন্দনা নদী দুইটি পদ্মা হইতে ভাগীরথীতে প্রবাহিত; এবং দুইটি নদীই ফান ডেন ব্রোকের নকশায় দেখানো আছে। চন্দনা তদানীন্তন যশোহরের পশ্চিম দিক দিয়া প্রবাহিত হইত। পদ্মা হইতে সমুদ্রে প্রবাহিত প্রাচীন নদীগুলির মধ্যে কুমারই প্রধান এবং প্রাচীনতম। কিন্তু কুমার এখন মরণোম্মুখ।
ভৈরব : মধুমতী : আড়িয়ল খাঁ
মধ্যযুগে এই নদীগুলির মধ্যে ভৈরবও ছিল অন্যতম; সেই ভৈরবও মরণোম্মুখ। বর্তমানে সাগরগামী পদ্মাশাখার মধ্যে মধুমতী ও আড়িয়ল খাঁই প্রধান। ধলেশ্বরী-বুড়ীগঙ্গা যেমন পদ্মার উত্তরতম প্রবাহপথের স্মারক, আড়িয়ল খাঁ (মির্জা নাথনের অণ্ডল খাঁ) তেমনই দক্ষিণতম প্রবাহপথের দ্যোতক। যাহা হউক-মধুমতী ও আড়িয়ল খাঁ, এই দুইটি নদীর অস্তিত্ব সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের নকশাগুলিতেই দেখা যাইতেছে, যদিও বর্তমানে প্রবাহপথ অনেকটা পরিবর্তন হইয়াছে।
বাংলা খাড়ি : ভাটি
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া ভাগীরথী-পদ্মার বিভিন্ন প্রবাহপথের ভাঙা-গড়ার ইতিহাস অনুসরণ করিলেই বুঝা যায়, এই দুই নদীর মধ্যবর্তী সমতটীয় ভূভাগে, অর্থাৎ নদী দুইটির অসংখ্য খাড়ি-খাড়িকাকে লইয়া কি তুমুল বিপ্লবই না চলিয়াছে। যুগের পর যুগ। এই দুইটি নদী এবং তাহাদের অগণিত শাখাপ্রশাখা-বাহিত সুবিপুল পলিমাটি ভাগীরথী-পদ্মা মধ্যবর্তী খাড়িময় ভূভাগকে বারবার তছনছ করিয়া বারবার তাহার রূপ পরিবর্তন করিয়াছে। পদ্মার খাড়িতে ফরিদপুর অঞ্চল হইতে আরম্ভ করিয়া ভাগীরথীর তীরে ডায়মণ্ড হারবারের সাগরসংগম পর্যন্ত বাখরগঞ্জ, খুলনা, চব্বিশ-পরগনার নিম্নভূমি ঐতিহাসিক কালেই কখনও সমৃদ্ধ জনপদ, কখনও গভীর অরণ্য, অথবা অনাবাসযোগ্য জলাভূমি, কখনও বা নদীগর্ভে বিলীন, আবার কখনও খাড়ি-খড়িকা অন্তৰ্হিত হইয়া নূতন স্থলভূমির সৃষ্টি। ফরিদপুর জেলায় কোটালিপাড়া অঞ্চল ষষ্ঠ শতকের একাধিক তাম্রপট্টোলীতে নব্যাবকাশিকা বলিয়া অভিহিত হইয়াছে; নব্যাবকাশিকা সেই ভূমি, যে ভূমি (বা অবকাশ) নূতন সৃষ্ট হইয়াছে। ষষ্ঠ শতকে নব্যাবকাশিক সমৃদ্ধ জনপদ এবং নৌ-বাণিজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ কেন্দ্ৰ, অথচ আজ এই অঞ্চল নিম্ন জলাভূমি। পট্রেলীগুলি হইতে মনে হয়, নৌকান্দ্বারাই এইসব অঞ্চলে যাওয়া-আসা করিতে হইত। আশ্চর্যের বিষয় এই, ত্ৰয়োদশ শতকের প্রথম পাদে সেনরাজ বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য-পরিষৎলিপিতে বঙ্গের নাব্য অঞ্চলে রামসিদ্ধি পাটক নামে একটি গ্রামের উল্লেখ আছে। এই গ্রাম বাখরগঞ্জ জেলার গৌরনদী অঞ্চলে। এই নাব্য অঞ্চলেরই অন্তর্ভুক্ত বিনয়তিলক গ্রামের পূর্ব সীমায় ছিল সমুদ্র। শ্ৰীচন্দ্রের (দশম-একাদশ শতক) রামপাল পটোলীতে নানা মণ্ডলের উল্লেখ আছে; কেহ কেহ। মনে করেন। ইহার যথার্থ পাঠ নাব্যমণ্ডল, এবং ঐ পট্টোলীর নাব্যমণ্ডলান্তৰ্গত নেহকাণ্ঠি গ্রাম বাখরগঞ্জ জেলার বর্তমান নৈকাঠি গ্রাম। এই অনুমান মিথ্যা নয় বলিয়াই মনে হয়। যাহাই হউক, প্রাচীন বাঙলার নব্যাবকাশিকা নবসৃষ্ট ভূমি এবং ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ অঞ্চল নাব্য অর্থাৎ নৌ-যাতায়াতলভ্য এবং তাহার পূর্ব-সীমায় সমুদ্র। খুলনায় নিন্ন অঞ্চলে তো ভাঙাগড়া মধ্যযুগে এবং খুব সাম্প্রতিক কালেও চলিয়াছে, এখনওঁ চলিতেছে। মধ্যযুগে মুসলমান ঐতিহাসিকেরা, তারনাথ প্রভৃতি বৌদ্ধ লেখকেরা, ময়নামতীর গানের রচয়িতা প্রভৃতিরা ভাগীরথীর পূর্বতীর হইতে সুবা বাঙলার পূর্বদিকে বেঙ্গলা (Bengala=ঢাকার বাঙ্গালাবাজার?) পর্যন্ত, বোধ হয়। চট্টগ্রাম পর্যন্ত সমস্ত নিম্নাঞ্চলটাকে বাটি বা ভাটি নামে অভিহিত করিয়াছেন। আবুল ফজল বাটি বা ভাটি বলিতে সুবা বাঙলার পূর্বাঞ্চল বুঝিয়াছেন। মানিকচন্দ্র রাজার গানেও “ভাটি হইতে আইল বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি”—এই ভাটিরও ইঙ্গিত সমুদ্রশায়ী এইসব খাড়ি-খাড়িকাময় নিম্নভূমির দিকে, অর্থাৎ, বঙ্গালভূমির দক্ষিণ অঞ্চলের দিকে। এই ভাটিরই কিয়দংশ প্রাচীন বাঙলার সমতট, এইরূপ অনুমান বোধ হয় খুব অসংগত নয়। অর্থের দিক হইতে সমতট হইতেছে সেই ভূমি যে ভূমি (সমুদ্র) তাঁটের সঙ্গে সমান, অর্থাৎ জোয়ারের জল যে-পর্যন্ত প্রবেশ করে; ভাটি অর্থও প্রায় তাহাই।
সুন্দরবন
কিন্তু, সবচেয়ে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটিয়াছে বর্তমান সুন্দরবন অঞ্চলে, চব্বিশ পরগনা-খুলনা–বাখরগঞ্জের নিম্নভূমিতে; এবং সমস্ত পরিবর্তনটাই ঘটিয়াছে মধ্যযুগে। কারণ এই অঞ্চলের পশ্চিম দিকটায় অর্থাৎ চব্বিশ পরগনা জেলার নিম্নাঞ্চলে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সমানে সমৃদ্ধ-ঘনবসতিপূর্ণ জনপদের চিহ্ন প্রায়ই আবিষ্কৃত হইয়াছে ও হইতেছে। জয়নগর থানায় কাশীপুর গ্রামের সূর্যমূর্তি (আনুমানিক ষষ্ঠ শতক); ডায়মণ্ড হারবারের প্রায় ২০ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বকুলতলা গ্রামে প্রাপ্ত লক্ষণ সেনের পটোলী (দ্বাদশ শতক) এবং ১৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে মলয় নামক স্থানে প্রাপ্ত জয়নাগের তাম্র-পট্টেলী (সপ্তম শতক) , রাক্ষসখালি দ্বীপে প্রাপ্ত ডোম্মন পালের পট্টোলী (দ্বাদশ শতক); ঐ দ্বীপেই প্রাপ্ত লিপিউৎকীর্ণ এক-ঝাঁক মাটির শীলমোহর (একাদশ শতক); খাড়ি পরগনায় প্রাপ্ত অসংখ্য পাথরের মূর্তি, ২/৪ টি ভগ্ন মন্দির, কালীঘাটে প্রাপ্ত গুপ্তমুদ্রা, ইত্যাদি সমস্তই চব্বিশ পরগনা (জেলার নিম্নভূমিতে প্রাচীন বাঙলার এক বা একাধিক সমৃদ্ধ জনপদের ইঙ্গিত করে। সেন রাজাদের ও ডোম্মনপালের আমলে খাড়িমণ্ডল ও খাড়িবিষয় পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত একটি প্রসিদ্ধ৷ বিভাগই ছিল। অথচ, আজ এইসব অঞ্চল প্রায় পরিত্যক্ত; কিছুদিন আগে তো সমস্তটা জুড়িয়া গভীর অরণ্যই ছিল। এখনও বহু অংশেই অরণ্য; কিছু কিছু অংশে মাত্র নূতন আবাদ ও বসতি হইতেছে। খুলনার দিকে এবং বাখরগঞ্জের কিয়দংশে তো এখনও গভীর অরণ্য। রালফ ফিচ (FRalph Fitch, 1583-91) বলিতেছেন, Bengala দেশ ব্যাঘ, বন্য-মহিষ ও বন্য-মুরগী (হাঁস) অধ্যুষিত বনময় জলাভূমি। ধৰ্মপালের খালিমপুর লিপি, দেবপালের নালন্দা লিপি এবং লক্ষণ সেনের আনুলিয়া লিপিতে ব্যাঘ্রতটী মণ্ডল নামে পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত একটি স্থানের উল্লেখ আছে। নামটির বুৎপত্তিগত অর্থ ধরিলে (যে সমুদ্রতট ব্যাঘ্র দ্বারা অধ্যুষিত) মনে হয়, চব্বিশ পরগনা, খুলনা, বাখরগঞ্জের দিকেই যেন স্থানটির ইঙ্গিত। এ অনুমান সত্য হইলে স্বীকার করিতে হয় নবম-দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ-বঙ্গের অন্তত কিয়দংশ গভীর অরণ্যময় ছিল। ব্যাঘাতটি বাগডী হইলেও হইতে পারে, না-ও হইতে পারে।
আকবরের আমলে ঈশা খাঁ আফগান ভাটি অঞ্চলের সামন্তপ্ৰভু ছিলেন; সেই সময়ে মাহমুদবাদ ও খলিফতাবাদ সরকারের অন্তর্গত ছিল বর্তমান ফরিদপুর, যশোর এবং নোয়াখালি জেলার কিয়দংশ, এবং এই দুই সরকারান্তৰ্গত বহুলাংশ গভীর অরণ্যময় ছিল। খান জাহান আলীর আমলে (যোড়শ শতকে) যশোর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে গভীর অরণ্য; তিনি সুন্দরবনের অনেক অংশে নূতন আবাদ করাইয়াছিলেন। য়ুসুফ সাহ, সৈয়দ হোসেন সাহ, নসরৎ শাহ (১৪৯৪, ১৪৯৪, ১৫২০) প্রভৃতি সুলতানেরাও এইসব অরণ্যে কিছু কিছু নূতন আবাদ করাইয়াছিলেন, প্রধানত ফরিদপুর ও যশোরে। এই দুই জেলার অনেক অংশ ফতেহাবাদ সরকারের অন্তর্গত ছিল; বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গলে’ ফতেহাবাদের উল্লেখ আছে। (পঞ্চদশ শতক)। জেসুইট্ পাদ্রী ফারনানডিজ (Fernandus, 1598) হুগলী হইতে শ্ৰীপুর (খুলনা জেলায় ইছামতীর তীরে, বর্তমান টাকির উলটা দিকে) হইয়া চট্টগ্রামের সমস্ত পথটাই ব্যাখ্রসংকুল বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। এক বৎসর পর ফনসেকা (Fonseca 1599) ৰাকলা হইতে সপ্তগ্রামের (সাতগাঁ=Chandeecan) পথ বানর ও হরিণ-আধুষিত বনময় ভূমি বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন। পূর্বোক্ত ফিচ সাহেব (১৫৮৩-৯১) বলিতেছেন, বাকলা বন্দরের পাশ ঘিরিয়াই জঙ্গল। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে প্রতাপাদিত্য যশোরে সুন্দরবন অঞ্চলেই নিজ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ত্ৰয়োদশ শতকের পর কোনও সময় চব্বিশ-পরগনা জেলার নিম্নভূমি কোনও অজ্ঞাত অনির্ধারিত কারণে পরিত্যক্ত হয়। এই কারণ কোনও প্রাকৃতিক কারণ হইতে পারে, কোনও রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কারণও হইতে পারে। তাহার পর হইতেই এই অঞ্চল গভীর অরণ্যময়। যশোর-খুলনা ও ফরিদপুর-বাখরগঞ্জের কিছু কিছু নিম্নভূমি হিন্দু আমলেই ধীরে ধীরে ক্রমশ সমৃদ্ধ জনপদ গড়িয়া উঠিতেছিল, এবং নূতন নূতন আবাদ তথাকথিত পাঠান আমলেও নূতন জনপদ গড়িয়া তুলিতেছিল, কিন্তু প্রকৃতির তাণ্ডব এবং মানুষের ধ্বংসলীলা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকেই ইহার উপর যবনিকা টানিয়া দেয়। ১৫৮৪ খ্ৰীষ্টাব্দের প্রবল বন্যায়। ফতেহাবাদ সরকারে অসংখ্য ঘরবাড়ি, নৌকা এবং দুই লক্ষ লোক নষ্ট হইয়া যায়। ইহার উপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হয় মগ ও পর্তুগীজ জলদসু্যদের উন্মত্ত হত্যা ও লুণ্ঠনালীলা; তাহার ফলে বাখরগঞ্জ এবং খুলনার নিম্নভূমি একেবারে জনমানবহীন গভীর অরণ্যে পরিণত হইয়া গেল। রেনেলের নকশায় (১৭৬১) দেখা যাইবে, বাখরগঞ্জ জেলার সমস্ত দক্ষিণাঞ্চলে জুড়িয়া লেখা আছে “মগদের অত্যাচারে পরিত্যক্ত জনমানবহীণ” (“Country depopulated by the Maghs”)।
লৌহিত্য বা ব্রহ্মপুত্র : লক্ষ্যা
পদ্মার পূর্ব-দক্ষিণতম প্রবাহে উত্তর হইতে লৌহিত্য বা ব্ৰহ্মপুত্র আসিয়া মিলিত হইয়াছে। ব্ৰহ্মপুত্র অতি প্রাচীন নদ এবং তাহার তীর্থ-মহিমাও নেহাৎ অর্বািচীন নয়। ততটা না হউক, ব্ৰহ্মপুত্রও পদ্মা-ভাগীরথীর ন্যায় অন্তত কয়েকবার খাত পরিবর্তন করিয়া যমুনা-পদ্মার পথে বর্তমান খাত গ্ৰহণ করিয়াছে এবং চাদপুরের দক্ষিণে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হইয়া সমুদ্রে অবতরণ করিয়াছে। গারো পাহাড়ের পশ্চিমের মোড় পর্যন্ত উত্তর-প্রবাহে লৌহিত্যের খাত পরিবর্তনের প্রমাণ বিশেষ কিছু নাই; পাবর্ত্যপথ, খাত পরিবর্তনের সুযোগও কম। কিন্তু গারো পাহাড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ মোড় ঘুরিয়াই লৌহিত্য ঐ পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণ তলভূমি ঘেষিয়া, দেওয়ানগঞ্জের পাশ দিয়া, শেরপুর-জামালপুরের ভিতর দিয়া, মধুপুর গড়ের পাশ দিয়া, মৈমনসিংহ জেলাকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া, বর্তমান ঢাকা জেলার পূর্বাঞ্চল ভেদ করিয়া, সুবর্ণগ্রাম বা সোনার গার দক্ষিণ-পশ্চিমে লাঙ্গলবন্দের পাশ দিয়া ধলেশ্বরীতে প্রবাহিত হইত। এই খাত এখনও বর্তমান, কিন্তু বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে প্রায় মৃত বলিলেই চলে। এই খাতই প্রাচীন এবং ব্ৰহ্মপুত্রের যাহা কিছু তীৰ্থমহিমা তাহা এই খাতেরই; এখনও জামালপুর-মৈমনসিংহ-লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী-স্নান পূর্ব-বাঙলার অন্যতম প্রধান ধর্মোৎসব। ফান ডেন ব্রোক (১৬৬০), ইজাক টিরিয়ান (১৭৩০) এবং থর্নটনের নকশায় Salhet (Sylhet) বা শ্ৰীহট্টকে কেন যে এই প্রবাহপথের পশ্চিমে দেখান হইয়াছে তাহা বলা শক্ত; শ্ৰীহট্টের অবস্থিতি সম্বন্ধে বোধ হয়। ইহাদের সুস্পষ্ট জ্ঞান কিছু ছিল না। রেনেল (১৭৬৪-১৭৭৬) কিন্তু শ্ৰীহট্টের অবস্থিতি ঠিক দেখাইয়াছেন। যাহা হউক, ঢাকা জেলার উত্তরে এই ব্ৰহ্মপুত্র প্রবাহেরই ডান দিক হইতে একটি শাখা-প্রবাহ নিৰ্গত হইয়াছে; ইহার নাম লক্ষ্যা (শীতললক্ষ্যা বা শীতলক্ষ্যা), বা ফান ডেন ব্রোকের Lecki। লক্ষ্যা ব্ৰহ্মপুত্রের পশ্চিম দিক দিয়া ব্ৰহ্মপুত্রেরই সমান্তরালে প্রবাহিত হইয়া বর্তমান ঢাকার দক্ষিণে (ব্ৰহ্মপুত্ৰ-ধলেশ্বরী-সংগমের কিঞ্চিৎ দক্ষিণে) নারায়ণগঞ্জের নিকটে ধলেশ্বরীর সঙ্গে আসিয়া মিলিত হইত। লক্ষ্যার এই প্রবাহ এখনও বর্তমান, কিন্তু ধারা ক্ষীণ, অথচ ফান ডেন ব্রোকের আমলে এবং তারপরে উনবিংশ শতকের গোড়ায়ও লক্ষ্যা প্রশস্ত বেগবতী নদী। লক্ষ্যার কথা ছাড়িয়া ব্ৰহ্মপুত্রের মূল প্রবাহে ফিরিয়া আসা যাইতে পারে। ফান ডেন ব্রোক, ইজাক টিরিয়ান, থর্নটন, রেনেল ইত্যাদি সকলের নকশা আলোচনা করিলে নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে, সপ্তদশ শতকে ফান ডেন ব্রোকের আগেই ব্ৰহ্মপুত্র এই খাত পরিত্যাগ করিয়াছিল। কারণ, এই নকশাগুলিতে দেখা যায় ব্ৰহ্মপুত্র আর ধলেশ্বরীতে প্রবাহিত হইতেছে না; বর্তমান ঢাকা জেলার সীমায় পৌছবার অব্যবহিত পূর্বে মৈমনসিংহের ভিতর দিয়া আসিয়া পূর্ব-দক্ষিণতম কোণে ভৈরব-বাজার বন্দরের নিকট উত্তরাগত সুরমা-মেঘনার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের মিলন ঘটিতেছে। এবং উভয়ের সম্মিলিত ধারা চাদপুরের দক্ষিণে সন্দ্বীপের উত্তরে গিয়া সমুদ্রে পড়িতেছে। ভৈরববাজারের নিকট হইতে সমুদ্র পর্যন্ত এই ধারা রেনেলের সময়েও মেঘনা (Megna) নামেই খ্যাত। ব্ৰহ্মপুত্রের সদ্যোক্ত প্রবাহই তাহার পূর্বতম প্রবাহ; কিন্তু ব্ৰহ্মপুত্র এই প্রবাহও পরিত্যাগ করে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি কোনও সময়ে; জলপ্রবাহ এখনও বিদ্যমান। কিন্তু ধারা ক্ষীণ এবং গ্ৰীষ্মে মৃতপ্রায়। মেঘনা প্রধানত তাহার নিজের জলরাশিই সমুদ্রে নিষ্কাশিত করে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি হইতে ব্ৰহ্মপুত্রের অন্যতম শাখা যমুনা প্রবলতর হইয়া উঠে, এবং বর্তমানে মৈমনসিংহের উত্তর-পশ্চিমতম কোণে ফুলছড়ির নিকট হইতে উৎসারিতা, বগুড়া-পাবনার পূর্বসীমা-বাহিতা এই যমুনাই ব্ৰহ্মপুত্রের বিপুল জলরাশি বহন করিয়া আনিয়া এখন গোয়ালন্দের কাছে পদ্মাপ্রবাহে ঢালিয়া দিতেছে।
সপ্তদশ শতক হইতে লৌহিত্য-ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ-ইতিহাস সুস্পষ্ট; তাহার আগেকার ইতিহাসও কতকটা ধরিতে পারা কঠিন নয়, এবং দেওয়ানগঞ্জ-জামালপুর লাঙ্গলবন্দ-ধলেশ্বরীর পথে সে ইঙ্গিতও কিছু পাওয়া যাইতেছে। এ পথ চতুর্দশ-ষোড়শ শতকের হইতে পারে, প্রাচীনতরও হইতে পারে। কিন্তু তারও আগে এই পথের ইতিহাস কোথাও পাইতেছি না। লৌহিত্য-ব্রহ্মপুত্রের উল্লেখ পুরাণে, প্রাচীন সাহিত্যে (যথা, মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে) এবং লিপিমালায় একেবারে অপ্রাচর নয়, এবং তাঁহা সুবিদিত। সুতরাং এখানে তাহার পুনরুল্লেখ নিম্প্রয়োজন। প্ৰাচীন কামরূপরাজ্য ছিল এই লৌহিত্যের তীরে। গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত একবার লৌহিত্যতীরে কামরূপরাজ সুস্থিতবৰ্মনের নিকট পরাজিত হইয়াছিলেন (ষষ্ঠ শতকের শেষাশেষি)। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এইসব প্রাচীন উল্লেখ সাধারণত লৌহিত্যের উত্তর-প্রবাহ সম্বন্ধে। দক্ষিণ-প্রবাহে যেখানে বারবার খাত পরিবর্তন হইয়াছে সে-সম্বন্ধে কোনও প্রাচীন ঐতিহাসিক উল্লেখ এখনও পাওয়া যাইতেছে না।
সুরমা-মেঘনা
মেঘনা সম্বন্ধে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত। খাসিয়া-জৈন্তিয়া শৈলমালা হইতে মেঘনার উদ্ভব, কিন্তু উত্তর-প্রবাহে মেঘনা সুরমা নামেই খ্যাত এবং এই নামটি প্রাচীন। সুরমা শ্ৰীহট্ট জেলার ভিতর দিয়া মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ মহকুমার পূর্বসীমা স্পর্শ করিয়া আজমিরিগঞ্জ বন্দর ও অদূরবর্তী বানিয়াচঙ্গ গ্রাম বাম তীরে রাখিয়া ভৈরব-বাজারে এক সময় ব্ৰহ্মপুত্রের সঙ্গে আসিয়া মিলিত হইতো। নিম্নতর প্রবাহের কথা ব্ৰহ্মপুত্র প্রসঙ্গেই বলিয়াছি। সুরমা যেখান হইতে পশ্চিমা গতি ছাড়িয়া দক্ষিণা গতি লইয়াছে (বর্তমান মাকুলি স্টীমার স্টেশনের নিকট) সুরমা সেখান হইতে মেঘনা নামও লইয়াছে। রেনেলের নকশায় এই পথ সুস্পষ্ট দেখান আছে; আজমিরিগঞ্জ-বানিয়াচঙ্গও বাদ পড়ে নাই। এই নদীপথের উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হইয়াছে, ঐতিহাসিক প্রমাণ এমন কিছু নাই। মেঘনার নিম্ন-প্রবাহের দুই তীরে সমৃদ্ধ জনপদের পরিচয় চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতার বিবরণেই পাওয়া যায়; ১৫ দিন ধরিয়া মেঘনার পথে তিনি গিয়াছিলেন; দুই ধারে ঘনবসতিময় গ্রাম, ফলের উদ্যান, মনে হইয়াছিল যেন কোনো বাজারের মধ্য দিয়া যাইতেছেন। মেঘনা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি অনুমানের উল্লেখ এ প্রসঙ্গে হয়তো অবাস্তর হইবে না। চলিত লোকবচনে ও স্মৃতিতে এই উৎপত্তি মেঘনাদ বা মেঘানন্দ শব্দ হইতে। কিন্তু টলেমি খ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে গঙ্গার অন্যতম মুখের নাম করিয়াছেন Mega (=great) <sal RTT। এই Mega=Megna (Megna=great), নদী হইতে মেঘনাদ=মেঘান্দ= মেঘনা নামের উৎপত্তি একেবারে ইতিহাস-বিরুদ্ধ না-ও হইতে, পারে। তবে, ইহা একান্তই অনুমান।
করতোয়া : তিস্তা : পুনর্ভবা : মহানন্দা : আত্রাই
উত্তরবঙ্গের নদনদীগুলির কথা এইবার বলা যাইতে পারে। উত্তর-বঙ্গের সর্বপ্রধান নদী করতোয়া। এই নদীর ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং ইহার তীর্থমহিমা বহুখ্যাত। পুরাণে বারবার করতোয়া-মাহাত্ম্য কীর্তিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া, “করতোয়া-মাহাত্ম্য নামে একখানা সুপ্রাচীন পুঁথি এখনও করতোয়ার তীর্থমহিমা ঘোষণা করে। লঘুভারতে’ বলা হইয়াছে, “বৃহৎ পরিসরা পুণ্য করতোয়া মহানদী”; মহাভারতের বনপর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায়েও করতোয়া পুণ্যতোয়া বলিয়া কথিত হইয়াছে, এবং গঙ্গাসাগরসংগম তীর্থের সঙ্গে একত্র উল্লিখিত হইয়াছে। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী প্রাচীন পুন্দনগল (=পুণ্ড্রনগর=বর্তমান মহাস্থানগড়, বগুড়ার অদরে) এই করতোয়ার উপরই অবস্থিত ছিল। খুব প্রাচীন কালেও যে করতোয়া বর্তমান বগুড়া জেলার ভিতর দিয়া প্রবাহিত হইত। তাহা মহাস্থানের অবস্থিতি এবং ‘করতোয়া-মাহাত্ম্য হইতেই প্রমাণিত হয়। সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ পুণ্ড্রবর্ধন হইতে কামরূপ যাইবার পথে বৃহৎ একটি নদী অতিক্রম করিয়াছিলেন; তিনি এই নদীটির নাম করেন নাই, কিন্তু টাং-সু (Tang-shu) গ্রন্থের মতে এই নদীর নাম ক-লো-তু বা Ka-to-tu । Wattersসাহেব Ka-to-tuকে ব্ৰহ্মপুত্র বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। নিঃসন্দেহে ইহা ভুল। Ka-lo-tu স্পষ্টতই করতোয়া; এই নদীই যে সপ্তম শতকে পুণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপের মধ্যবর্তী সীমা, এ খবরও টাং-সু গ্রন্থে পাওয়া যাইতেছে। সন্ধ্যাকর নদীর “রামচরিতের কবি-প্রশস্তিতেও এই তথ্যের আংশিক সমর্থন পাওয়া যাইতেছে; সেখানে স্পষ্টই বলা হইতেছে, বরেন্দ্রীদেশ (লিপিমালার বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রীমণ্ডল) গঙ্গা ও করতোয়ার মধ্যবর্তী দেশ। যাহা হউক, এইসব উল্লেখ এবং লিপিমালার যে-সব গ্রাম ও নগর বরেন্দ্রীর অন্তর্গত বলা হইয়াছে (যেমন বায়ীগ্রাম=বৈগ্রাম বর্তমান দিনাজপুর জেলায় হিলির। নিকটে; কোলঞ্চ = ক্রোড়ঞ্জ, বোধহয় দিনাজপুর জেলায়; কান্তাপুর-কান্তনগর, বর্তমান দিনাজপুর জেলায়; নাটারি=নাটোর, বর্তমান রাজশাহী জেলায়; পদুবন্ধা-পাবনা? ইত্যাদি) তাহাদের অবস্থিতি বিশ্লেষণ করিলে সন্দেহ করিবার কারণ থাকে না যে, সপ্তম শতকে বরেন্দ্রীর পূর্বদিক ঘিরিয়া, প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের পূর্ব-সীমা দিয়া, করতোয় প্রবাহিত হইত। ‘করতোয়া-মাহাত্ম্য পাঠে মনে হয়, এক সময় করতোয়া স্ব-স্বতন্ত্র নদী হিসাবে গিয়া সাগরে পড়িত, কিন্তু তাহার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই। লোকস্মৃতি সাগর বলিতে বোধহয় কোন বৃহৎ জলস্রোতকেই বুঝিয়া ও বুঝাইয়া থাকিবে। অন্তত, মধ্যযুগে করতোয়ার জল নিঃশেষিত হইতেছে প্রশস্ত পদ্মা-ধলেশ্বরী সংগমে। কিন্তু এ সম্বন্ধে যাহা বক্তব্য তাহা পরে বলিতেছি।
করতোয়া ভোটান-সীমান্তেরও উত্তরে হিমালয় হইতে উৎসারিত হইয়া দাৰ্জিলিং-জলপাইগুড়ি জেলার ভিতর দিয়া বাঙলাদেশে প্রবেশ করিয়াছে। এই উত্তরতম প্রবাহে ইহার নাম করতোয়া নয়, দিস্তাং বা তিস্তা, যাহার সংস্কৃতিকরণ হইয়াছে ত্রিস্রোতা। জলপাইগুড়ি হইতে তিস্তার (ফান ডেন ব্রোকের নকশায়—Tiesta) তিনটি স্রোত তিন দিকে প্রবাহিত হইয়াছে; দক্ষিণবাহী পূর্বতম স্রোতের নাম করতোয়া; দক্ষিণবাহী মধ্যবর্তী স্রোন্তোধারার নাম আত্রাই; দক্ষিণবাহী পশ্চিমতম স্রোতের নাম পূর্ণভবা বা পুনর্ভবা। পুনর্ভবা উনবিংশ শতকে আইয়রগঞ্জের নিকটে মহানন্দার সঙ্গে মিলিত হইত, এবং মহানন্দা রামপুর-বোয়ালিয়ার নিকটে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হইত। কিন্তু, তাহার আগে এক সময় মহানন্দা (এবং পুনর্ভবা) লক্ষ্মণাবতী গৌড়ের ভিতর দিয়া আসিয়া করতোয়ায় নিজ প্রবাহের জল নিষ্কাশিত করিত, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। রেনেলের নকশায় সে পরিচয় পাওয়া যাইতেছে; কিন্তু ফান ডেন ব্রোকের আমলে মহানন্দার গতি আরও পশ্চিমে। আত্রাই (তঙ্গন-আত্রাই) তিস্তা হইতে নিৰ্গত হইয়া সোজা দক্ষিণবাহী হইয়া চলনবিলের ভিতর দিয়া জাফরগঞ্জের নিকট করতোয়ার সঙ্গে মিলিট হইত। ফান ডেন ব্রোক, ইজাক টিরিয়ন, থর্নটন সকলের নকশাতেই আত্রাই-করতোয়া-সংগম সুস্পষ্ট দেখান আছে। এই নকশাগুলিতেই দেখা যায়, আত্রাইর ছোট একটি শাখা পশ্চিমবাহী হইয়া গিয়া পদ্মায় পড়িয়াছে; কিন্তু তাঙ্গন-আত্রাই পথই প্রধান প্রবেশপথ।
দেখা যাইতেছে, তিস্ত হইতে নিৰ্গত দুইটি স্রোতই উত্তর-বঙ্গের বিভিন্ন অংশ ঘূরিয়া প্লাবিত করিয়া তাহাদের জলরাশি শেষ পর্যন্ত ঢালিয়া দিত তৃতীয় স্রোতটিতে, অর্থাৎ করতোয়ায়; তাহা ছাড়া, সে নিজের এবং উত্তরতম প্রবাহ তিস্তার সমস্ত জলধারা তো বহন করিতই। এইসব কারণেই ষোড়শ শতকের শেষাশেষি পর্যন্ত করতোয় ছিল অত্যন্ত বেগবতী। নদী। সপ্তদশ শতকের গোড়াতে মির্জা নাথনের বিবরণী (১৬০৮) পড়িলে মনে হয়, শাহজাদপুরের (পাবনা) দক্ষিণে করতোয় বক্র, সংকীর্ণ ও ক্ষীণতেীয়া হইতে আরম্ভ করিয়াছে। আজ করতোয়া মৃতপ্রায়; আত্রাই-পুনর্ভবারও একই দশা! কিন্তু সপ্তদশ শতকেও অবস্থা তত খারাপ হয় নাই। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) আত্রাই ও করতোয়া দুয়েরই আকৃতি প্রশস্ত। টেভারনিয়ার ১৬৬৬ খ্ৰীষ্টাব্দে উত্তরগত একটি বড় নদীর নাম করিতেছেন Chativor; এই Chativor তো করতোয়া বলিয়াই মনে হয়। তাহা ছাড়া, জাও ডি ব্যারোস (১৫৫০) এবং কান্তেল্লি দা ভিনোলা (১৬৬৩) এই দুইজন তাহাদের নকশায় উত্তর হইতে সোজা দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত লম্ববান একটি নদী দেখাইতেছেন; ইহার নাম কাওরা (Calor)। কাওরকেও করতোয়া বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। ইহাদের নকশা যথাযথ নয় এবং হয়তো সর্বত্র সর্বথা নির্ভরযোগ্যও নয়; তবু সমসাময়িক বাঙলার নদনদীবিন্যাসের আভাস এইসব নকশায় খানিকটা নিশ্চয়ই পাওয়া যায়।
হয়তো ইহাদের কাছে মনে হইয়াছিল, অথবা লোকস্মৃতিতে বা লোকমুখে ইহারা শুনিয়াছিলেন যে করতোয়া সাগরগামিনী নদী। Caor যে করতোয় তাহা একটি পরোক্ষ প্রমাণ ডি ব্যারোস নিজেই দিতেছেন। তাহার নকশায় দেখিতেছি করতোয় Reino de Comotah বা কামতা রাজ্যের ভিতর দিয়া প্রবাহিত। কামত বর্তমান রংপুর-কোচবিহার। করতোয়া-আত্রাইর সম্মিলিত প্রবাহ এক সময় হয়ত ব্ৰহ্মপুত্রে গিয়া মিশিত। এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু নাই; তবে হাণ্টার সাহেব শুনিয়াছিলেন, করতেঁায়াবাসীরা করতোয়াকে ব্ৰহ্মপুত্র বলিয়াই জানিত। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় করতোয়া ব্ৰহ্মপুত্রে গিয়া পড়িতেছে বলিয়া যেন মনে হয়। যাহাই হউক, বুঝা যাইতেছে সপ্তদশ শতকে করতোয় (এবং আত্রাইও) উল্লেখযোগ্য নদী। অষ্টাদশ শতকে রেনেলের নকশায়ও আত্রাই এবং করতোয়ার সেই মোটামুটি সমৃদ্ধ রূপ দৃষ্টিগোচর হইতেছে, এবং করতোয়া তদানীন্তন রংপুর-দিনাজপুরের ভিতর দিয়া সোজা দক্ষিণবাহী হইয়া, পুঁটিয়ার (Pootyah) কিঞ্চিৎ উত্তর হইতে পদ্মার সঙ্গে প্রায় সমান্তরালে, পূর্ব-দক্ষিণবাহিনী হইয়া পদ্মা-ব্ৰহ্মপুত্রের সংগমস্থানের নিকটে, পদ্মায় গিয়া পড়িতেছে। কিন্তু ১৭৭৭ খ্ৰীষ্টাব্দের হিমালয় সানুর বিরাট বন্যায় আত্রাই-করতোয়ার সমৃদ্ধি বিনষ্ট হইয়া গেল। উত্তর-প্রবাহে যে-তিস্তা এই নদী দুইটির সমৃদ্ধির মূলে সেই তিস্তা এই বিরাট বন্যার বিপুল জলরাশি বহন করিতে না পারিয়া পূর্ব-দক্ষিণ দিকে একটি প্রায় অবলুপ্ত, প্রাচীন সংকীর্ণ-নদীর খাত ভাঙিয়া সবেগে ফুলছড়িঘাটে ব্ৰহ্মপুত্রে গিয়া বিপুল জলরাশি ঢালিয়া দিল। সেই সময় হইতে তিস্তা ব্ৰহ্মপুত্ৰমুখী; সে আর পুনর্ভবা-আত্রাই-করতোয়ায় হিমালয় নদীমালার জল প্রেরণ করে না।
এবং, আজ যে এই নদী তিনটি, বিশেষভাবে করতোয়া, ক্ষীণা হইতে ক্ষীণতরা হইতেছে তাহার কারণও তাঁহাই। তবু, উনবিংশ শতকের গোড়ায়ও করতোয়ার কিছু খ্যাতি-সমৃদ্ধি ছিল বলিয়া মনে হয়; ১৮১০ খ্ৰীষ্টাব্দে জনৈক যুরোপীয় লেখক বলিতেছেন, করতোয়া “was a very considerable river, of the greatest celebrity in Hindu fable”।
উত্তরবঙ্গের আর একটি প্রসিদ্ধ ও সুপ্রাচীন নদী কৌশিকী (বা বর্তমান কোশী)। এই কোশী উত্তর-বিহারের পূর্ণিয়া জেলার ভিতর দিয়া সোজা দক্ষিণবাহী হইয়া গঙ্গায় প্রবাহিত হয়। অথচ, এই নদী এক সময় ছিল পূর্ববাহী এবং ব্ৰহ্মপুত্রগামী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া সমস্ত উত্তরবঙ্গ জুড়িয়া ধীরে ধীরে খাত পরিবর্তন করিতে করিতে কোশী আজ পূর্ব হইতে একেবারে পশ্চিমে সরিয়া গিয়াছে। কোশী প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলার নদী-বিন্যাসের ইতিহাসে এক বিরাট বিস্ময়। কোশী (এবং মহানন্দার) এইরূপ বিস্ময়কর খাত পরিবর্তনের ফলেই গৌড়-লক্ষ্মণাবতী-পাণ্ডুয়া অঞ্চল নিম্ন জলাভূমিতে পরিণত হইয়া অস্বাস্থ্যকর এবং অনাবাসযোগ্য হইয়া উঠে, বন্যার প্রকোপে বিধ্বস্ত হয়, এবং অবশেষে পরিত্যক্ত হয়। কোচবিহার হইতে হুগলীর পথে রালফ ফিচু (১৫৮৩-৯১) গৌড়ের ভিতর দিয়া আসিয়াছিলেন; এই পথে
we found but few villages but almost all wilderness, and saw many buffes, swine and deere, grasse longer than a man, and very many tigers.
সমস্ত উত্তরবঙ্গ জুড়িয়া অসংখ্য মরা নদীর খাত, নিম্ন জলাভূমি এখনও দৃষ্টিগোচর হয়; স্থানীয় লোকেরা ইহাদের বলে বুড়ি কোশী বা মরা কোশী। মালদহের উত্তরে ও পূর্বে যেসব ঝিল ইত্যাদি এখনও দেখা যায় সেগুলি এই কোশী ও মহানন্দার খাত হওয়া অসম্ভব নয়।
দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতকের আগে প্রাচীন বাঙলার নদনদীগুলির যে পরিচয় পাওয়া গেল তাহার মধ্যে দেখিতেছি গঙ্গা-ভাগীরথী, পদ্মা-পদ্মাবতী, করতোয় এবং লৌহিত্য-ব্রহ্মপুত্ৰই প্রধান। গঙ্গা-ভাগীরথীর ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত অজয় দামোদর, সরস্বতী ও যমুনা প্রসিদ্ধা নদী। পশ্চিম হইতে সমুদ্রবাহিনী কপিশা বা কাসাইও প্রাচীন নদী। পদ্মা প্রবাহও যে কম প্রাচীন নয় তাহাও দেখা গিয়াছে এবং তাঁহারই শাখা কুমারনদীর নিঃসংশয় উল্লেখ টলেমির বিবরণীতেই পাওয়া যাইতেছে। করতোয়াও সুপ্রাচীন প্রবাহ; কোশী-মহানন্দা–আত্রাই-পুনর্ভবার খুব প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে না, কিন্তু ইহারাও সুপ্রাচীন বলিয়াই মনে হয়–অন্তত, কোশী-মহানন্দার প্রাচীন প্রবাহপথের ইঙ্গিত মিলিতেছে। ত্রিস্রোতা নামটিও প্রাচীন ঐতিহা-স্মৃতিবহ। লৌহিত্যের উল্লেখও খুব প্রাচীন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া এইসব নদনদীর প্রবাহপথের কতকটা ইতিহাস এইখানে ধরিতে চেষ্টা করা হইয়াছে। বাঙলাদেশ ও বাঙালীর ইতিহাস আলোচনা কালে এই কথা সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন যে, মধ্যযুগে এইসব নদনদীর প্রবাহপথ বারবার যেমন পরবর্তিত হইয়াছে, প্রাচীন কালেও সেইরূপ হইয়াছে, বিশেষত, পদ্মা ও গঙ্গার নিন্ন প্রবাহে, নিম্ন-বঙ্গের সমস্ত তািট জুড়িয়া, এমনকি উত্তর ও পূর্ববঙ্গেও। বর্তমানেও এই ভাঙা-গড়া চলিতেছে।
০৪. যাতায়াত ও বাণিজ্যপথ
(* এই প্রসঙ্গে ধনসম্বল অধ্যায়ে নৌ-শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিবরণ দ্রষ্টব্য।)
সাধারণভাবে এবং সংক্ষিপ্ত উপায়ে দেশ-পরিচয় লিখিতে বসিয়া গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে বা নগর হইতে নগরান্তরে যাতায়াতের পথের উল্লেখ করিয়া লাভ নাই। যে সব গ্রামের উল্লেখ প্রাচীন বাঙলার লিপিগুলিতে পাওয়া যায় সেগুলি একটু বিশ্লেষণ করিলে প্রায়ই দেখা যায়, গ্রামের প্রান্তসীমায় রাজপথের উল্লেখ; অনেক সময় এই পথগুলিই এক বা একাধিক দিকে গ্রামসীমা অথবা কোনও ভূমিসীমা নির্দেশ করে, এবং সেই হিসাবেই পথগুলির উল্লেখ। অনুমান করিতে বাধা নাই, এই পথগুলিই গ্রাম হইতে গ্রামে ও নগরে বিস্তৃত ছিল। এই রকম দু-একটি পথের উল্লেখ পরবর্তী গ্রাম ও নগর অধ্যায়ে করা হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, দামোদর দেবের চট্টগ্রাম লিপিতে কামনপিণ্ডিয়া গ্রামের ডাম্বারডাম পল্লীর একখণ্ড ভূমির পূর্বদিকে এ রাজপথের উল্লেখ আছে। কিছুদিন আগে ধনোরার অদূরে দুইটি বাধান রাজপথের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। জঙ্গল কাটিয়া অথবা মাটি ভরাট করিয়া নূতন নূতন গ্রাম ও নগর পত্তনের –সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের যাতায়াত পথ ক্রমশ বিস্তৃত হইয়াছে, এই অনুমান করা চলে। এইসব সাধারণ স্থলপথ ছাড়া নদীমাতৃক দেশের অসংখ্য নদনদী, খাটা-খাটিকা, খাল-বিল, যানিকা-স্রোতিকা ইত্যাদি বাহিয়া জলপথে তো ছিলই। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে যত লিপি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহার প্রায় প্রত্যেকটিতেই এইসব জলস্রোতের উল্লেখ সুপ্রচুর। ইহাদের প্রেক্ষাপটে যখন সঙ্গে সঙ্গে লিপিগুলিতে দেখা যায়, এবং সমসাময়িক ও প্রাচীনতর। সাহিত্যে পড়া যায় নৌসাধনোদ্যত, সমুদ্রাশ্রয়ী বাঙালীর কথা, তাহাদের অসংখ্য নৌবাটি, নৌবিতান, নৌদণ্ডক, নাবাতক্ষেণী, প্রভৃতির কথা গুঢ় অধ্যাত্ম-সংগীতে (যেমন, চর্যাপদে) নদনদী, নৌকা, নৌকার নানা উপাদান (যথা, দাড়, হাল, মাস্তুল, পাল, লাগি, নোঙরের কাছি) ইত্যাদির উপমা, তখন সহজেই মনের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে, জলপথে নৌকাযোগে যাতায়োতই ছিল স্থলপথে যাতায়াত অপেক্ষা প্রশস্ততর। লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, এই নৌকা যাতায়াত পূর্ববঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধনে এবং সমতটে, অর্থাৎ নদনদীবহুল নিম্নাশায়ী দেশগুলিতেই বেশি ছিল।
এইসব সাধারণ যাতায়াত পথ ছাড়া দেশের প্রান্ত হইতে প্ৰান্ত পর্যন্ত এবং দেশেরও সীমা অতিক্রম করিয়া দেশান্তরে যে সব স্থল ও জলপথ বিস্তৃত ছিল, যে সব পথ বাহিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী অসংখ্য নরনারী তীর্থযাত্রা, দেশভ্রমণ ও বিচিত্রকর্ম উপলক্ষে-সর্বোপরি শ্রেষ্ঠী, বণিক ও সার্থিবাহের দল ব্যাবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে— দেশের বিভিন্ন গ্রামে, নগরে, তীর্থে এবং বাণিজ্যকেন্দ্রে, দেশান্তরের নগরে-বন্দরে যাতায়াত করিত, দেশ-পরিচয় প্রসঙ্গে সেইসব সুদীর্ঘ সুপ্রিশস্ত বহুজনপদলাঞ্ছিত পথগুলির বিবরণই উল্লেখযোগ্য। এইসব পথ দেশের শুধু যাতায়াত পথ নয়, বাণিজ্যপথও বটে এবং এইসব পথ বাহিয়াই বাঙলাদেশে লক্ষ্মীর আনাগোনা। এইসব বহু পথই বর্তমান রেলপথগুলির পূর্ব পর্যন্ত শুধু লক্ষ্মীর নয়, সরস্বতীরও আনাগোনার পথ ছিল; রেলপথগুলি সাধারণত সেইসব সুপ্রাচীন পথ বাহিয়াই প্রতিষ্ঠিত। জীবনধারণের প্রয়োজনে জীবনবিকাশের প্রেবণায় মানুষ সুপ্রাচীন দুৰ্গম বনজঙ্গল কাটিয়া, পাহাড় ভাঙিয়া, নদী ডিঙাইয়া, যে সব পথের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে সে সব পথ একদিনে নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় না। মানুষের ব্যবহারের মধ্যে, তাহার স্মৃতি ও সংস্কারের মধ্যে, নূতন পথের মধ্যে সেইসব প্রাচীন পথ বাচিয়া থাকে। পৃথিবীতে সর্বত্রই তাহা ঘটিয়াছে, বাঙলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। নদ-নদী-প্রবাহ সুপ্রাচীন কালে জলপথ নির্ণয় করিত, এখনও করে; নদীর খাত যখন বদলায় সঙ্গে সঙ্গে পথও বদলায়; খাত মরিয়া গেলে নূতন খাতে জলপ্রবাহ ছুটিয়া চলে, জলপথও তাহার অনুসরণ করে। সমুদ্রস্রোত ও বিভিন্ন ঋতুর বায়ুপ্রবাহ প্রাচীনকালে সমুদ্রপথ নির্ণয় কল্পিত; বাষ্প-জাহাজ-পর্বের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্ৰ পৃথিবীতে ইহাই ছিল নিয়ম। বাঙলাদেশেও তাহার ব্যত্যয় ঘটে নাই।
দুঃখের বিষয়, প্রাচীন বাঙলার আন্তবাণিজ্যের স্থলপথের বিবরণ স্বল্প। লিপিগুলিতে, বিদেশী পর্যটকদের বিবরণীতে এবং কিছু সমসাময়িক সাহিত্যে কয়েকটি মাত্র প্রাস্তাতিপ্রান্ত সুদীর্ঘ পথের ঈঙ্গিত ধরিতে পারা যায়। বিদেশী পর্যটক ও ঐতিহাসিকেরা বৈদেশিক বাণিজ্য সম্বন্ধেই কৌতুহলী ছিলেন এবং সেইসব বাণিজ্যপথের বিবরণই তাহারা যাহা কিছু রাখিয়া গিয়াছেন। তবু, ফাহিয়ান্ বা য়ুয়ান-চোয়াঙের মতো পর্যটক র্যাহারা বাঙলার এক জনপদ হইতে অন্য জনপদ কিছু কিছু ঘোরাঘুরি করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহারা প্রসঙ্গত অন্তর্দেশের পথের ইঙ্গিতও দিক, রাখিয়া গিয়াছেন। ইৎসিঙের বিবরণে, সোমদেবের কথাসরিৎসাগরের মতো গ্রন্থে, ২/৪টি জগতকের গল্পে, লিপিমালায় ২/১টি আকস্মিক উল্লেখও এই জাতীয় পথের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এইসব পথ শুধু অন্তর্বঙ্গপথ নয়; বরং এইসব পথ বাহিয়াই বাঙলাদেশে প্রাচীনকালে সুবিস্তৃত ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সকল প্রকার যোগরক্ষা করিত।
আন্তর্দেশিক স্থলপথ
সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগরে’ পুণ্ড্রবর্ধন হইতে পাটলিপুত্র পর্যন্ত একটি সুবিস্তৃত পথের উল্লেখ আছে। ইৎসিঙ (সপ্তম শতকের তৃতীয় পদের শেষাশেষি)। তাম্রলিপ্তি হইতে বুদ্ধগয়া পর্যন্ত পশ্চিমাভিমুখী একটি পথের ইঙ্গিত দিতেছেন। হাজারিবাগ জেলায় দুধপানিপাহাড়ের আনুমানিক অষ্টম শতকের একটি শিলালিপিতে অযোধ্যা হইতে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ পথের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। য়ুয়ান-চোয়াঙ (সপ্তম শতকের দ্বিতীয় পাদ) বারাণসী, বৈশালী, পাটলিপুত্র, বুদ্ধগয়া, রাজগৃহ, নালন্দা, অঙ্গ-চম্পা প্রভৃতি পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়াছিলেন কজঙ্গলে। আমি এই গ্রন্থেই অন্যত্র দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, কাজঙ্গল দেশ অংশত বর্তমান উত্তর-রাঢ়, বাঁকুড়া-বীরভূমের উত্তর-পশ্চিম প্রাস্তবতী অনুর্বর জাঙ্গলময় প্রদেশ। কজঙ্গল হইতে তিনি গিয়াছেন পুণ্ড্রবর্ধনে (উত্তরবঙ্গ=বগুড়া-রাজশাহী-রংপুর-দিনাজপুর), পুণ্ড্রবর্ধন হইতে পথে এক প্রশস্ত নদী পার হইয়া কামরূপ; কামরূপ হইতে সমতট (ত্রিপুরা, ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, ২৪ পরগনার নিম্নভূমি); সমতট হইতে তাম্রলিপ্তি (দক্ষিণ পূর্ব মেদিনীপুর); তাম্রলিপ্তি হইতে কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ জেলার কানসোনা); এবং কর্ণসুবর্ণ হইতে ওড্র, কঙ্গোব্দ, কলিঙ্গ। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতে তাহা হইলে মোটামুটি আন্তর্দেশিক পথগুলির একটু ইঙ্গিত পাইতেছি। কজঙ্গল বা উত্তর-রাঢ় অঞ্চল হইতে একটি পথ ছিল পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত বিস্তৃত। চম্পা (বর্তমান ভাগলপুর জেলা) হইতে তিনি আসিয়াছিলেন কজঙ্গলে। ভাগলপুর হইতে বর্তমানে যে রেলপথ রাজমহলপাহাড়ের ভিতর দিয়া নানা শাখা-প্রশাখায় দক্ষিণমুখী হইয়া চলিয়া গিয়াছে সিউড়ি-রানীগঞ্জ-বাকুড়া-বিষ্ণুপুর-পুরুলিয়ার দিকে এই পথই ছিল য়ুয়ান-চোয়াঙের পথ। কজঙ্গল হইতে উত্তরমুখী হইয়া এই পথ ধরিয়াই য়ুয়ান-চোয়াঙ রাজমহল বা রাজমহলের কিছুটা দক্ষিণে গঙ্গা অতিক্রম করিয়া পরে পূর্বমুখী হইয়া পুণ্ড্রবর্ধনে গিয়াছিলেন। এখন ই-আই-আর পথের বর্ধমান–রানীগঞ্জ–সিউড়ি হইতে রওয়ানা হইয়া লালগোলাঘাটে গঙ্গা পার হইয়া এ বি-আর পথে উত্তরবঙ্গে যাওয়া যায়, এবং সেখান হইতে সোজা রেলপথ ধরিয়া কামরূপ। এই রেলপথও প্রাচীন রাজপথই অনুসরণ করিয়াছে। কিন্তু কামরূপ হইতে সমতটের পথ এখন বর্তমান কালে আর খুব পরিষ্কার ধরিতে পারা যায় না; ধলেশ্বরী–যমুনা-পদ্মা এই পথকে এমনভাবে ভাঙিয়া বঁকাইয়া দিয়াছে যে, তাহার রেখা কল্পনায় আনা হয়তো যায়, কিন্তু সুস্পষ্ট ধরিতে পারা কঠিন। য়ুয়ান-চোয়াঙ বোধহয় স্থলপথে পদব্রজেই আসিয়াছিলেন, বিবরণী পাঠে এই কথাই মনে হয়। বর্তমান ভূমি-নকশা অনুযায়ী অন্তত দুইবার তাহার দুইটি সুপ্রশস্ত নদী, যমুনা ও পদ্মা, অতিক্রম করা উচিত, কিন্তু তাহার উল্লেখ বিবরণীতে কিছু নাই। মনে হয়, যমুনা বা পদ্মার আজিকার কিংবা মধ্যযুগের মতো প্রশস্ত অস্তিত্ব তখন ছিল না। অথচ, এখন এই দুইটি নদীই এ-বি-আর পথের গতি নির্ণয় করিতেছে। গৌহাটিতে ব্ৰহ্মপুত্র পার হইয়া এক পথ বগুড়াসান্তাহার-ঈশ্বরদী (পদ্মা) ছুইয়া কলিকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত; আর-এক পথ জগন্নাথগঞ্জ (যমুনা) সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদী (পদ্মা) হইয়া কলিকাতা। দুটি পথই বাকিয়া চুরিয়া নদনদী এড়াইয়া অতিক্রম করিয়া বিস্তৃত। যাহাই হউক, সমতট হইতে ভাগীরথী পার হইয়া তমলুকের পথে তো এখনও বি-এন-আর পথ সোজা চলিয়া গিয়াছে, এবং ভাগীরথীতীর হইতে উত্তরাভিমুখী মুর্শিদাবাদ (কর্ণসুবর্ণ) ছাড়াইয়া ই-আই-আর পথের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা এখনও বিস্তৃত। মুর্শিদাবাদ হইতে ওড্র বা উড়িশা পর্যন্তও ই-আই-আর ও বি-এন-আর পথে প্রাচীন রাজপথের ইশারা সহজেই পাওয়া যায়। প্রাচীন বাঙলার বিভিন্ন জনপদ যে সব সুদীর্ঘ পথগুলির দ্বারা পরস্পরযুক্ত ছিল সেইসব পথের ইঙ্গিত য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ হইতে পাওয়া গেল। এইসব পথ তিনি নিজে আবিষ্কার করেন নাই। তাহার বহু আগে হইতেই বহু যানের চক্রপোষণে, বহু পশু ও বহু মানুষের পদতাড়নায় এইসব পথ প্রশস্ত হইয়াছিল; তাহার পরেও বহুকাল পর্যন্ত এইসব পথ ক্রমাগত ব্যবহৃত হইয়া আজিকার রেলপথে বিবর্তিত হইয়াছে। কোথাও রেলপথ প্রাচীন পথকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে, কোথাও প্রাচীন পথ রেলপথগুলির পাশাপাশি চলিয়াছে। বস্তুত, ভারতবর্ষের কোনো রেলপথই নূতন সৃষ্ট নবাবিষ্কৃত পথ নয়, প্রত্যেকটিই প্রাচীন পথের নিশানা ধরিয়া চলিয়াছে।
বহির্দেশীয় স্থলপথ
অন্তর্দেশের পথ ছাড়িয়া দেশ হইতে দেশান্তরের পথগুলির ইঙ্গিত এইবার ধরিতে চেষ্টা করা যাইতে পারে। উল্লিখিত বিবরণ হইতে বুঝা যাইবে, বাঙলাদেশ হইতে তিনটি প্রধান পথ পশ্চিম দিকে বিস্তৃত ছিল। একটি পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ হইতে মিথিলা বা উত্তর-বিহার ভেদ করিয়া (বর্তমান বি–এন–ডব্লিউ–আর এই পথ অনুসরণ করিয়াছে) চম্পা (ভাগলপুর) হইয়া পাটলিপুত্রের ভিতর দিয়া বুদ্ধগয়া স্পর্শ করিয়া (অথবা, পাটনা-আরা হইয়া) বারাণসী-অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; সেখান হইতে একেবারে সিন্ধু–সৌরাষ্ট্র— গুজরাতের বন্দর পর্যন্ত। বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষায় গৌড় হইতে গুজরাত পর্যন্ত বাণিজ্য-পথের ইঙ্গিত আছে। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী ও ‘কথাসরিৎসাগরের গল্প হইতে এই পথের আভাস পাওয়া যায়। দ্বিতীয় পথটিরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতেই। এই পথটি তাম্রলিপ্তি হইতে উত্তরাভিমুখী হইয়া কৰ্ণসুবর্ণের ভিতর দিয়া রাজমহল-চম্পা স্পর্শ করিয়া পাটলিপুত্রের দিকে চলিয়া গিয়াছে। তৃতীয় পথটির আভাস পাওয়া যাইতেছে ইৎসিঙের বিবরণ এবং পূর্বোল্লিখিত হাজারীবাগ জেলার দুধপানিপাহাড়ের আনুমানিক অষ্টম শতকীয় লিপিটিতে। এই পথ তাম্রলিপ্তি হইতে সোজা উত্তর-পশ্চিমাভিমুখী হইয়া বুদ্ধগয়ার ভিতর দিয়া অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই তিনটি পথ আশ্রয় করিয়াই প্রাচীন বাঙলাদেশ উত্তর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষা করিত। বাঙলা ও উত্তর ভারতের যে-কোনও বর্তমান রেলপথের নকশা খুলিলেই দেখা যাইবে এই রেলপথগুলি সেইসব প্রাচীন পথই অনুসরণ করিয়াছে।
উত্তর-পূর্বমুখী পথ
বাঙলার পূর্বদিকে কামরূপ রাজ্য, উত্তরে চীন ও তিব্বত। উত্তরবঙ্গ ও কামরূপের ভিতর দিয়া বাঙলাদেশ এই উত্তরশায়ী দেশদুটির সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষা করিত। এই পথের বিবরণ পাওয়া যায়। য়ুয়ান-চোয়াঙ এবং কিয়া-তানের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে, চীন-রাজদূত, চাঙি-কিয়েনের প্রতিবেদনে, এবং বোধহয় মুহম্মদ ইবন বখতিয়ারের আসাম-তিব্বত অভিযান সংক্রান্ত সুবিখ্যাত শিলালিপিটিতে। ‘তবকাত-ই নাসিরী’ গ্রন্থেও বোধহয় কামরূপের ভিতর দিয়া তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত এই পথের উল্লেখ আছে। এই সাক্ষ্যগুলি বিশ্লেষণ করিলে পথটির আভাস স্পষ্ট হইতে পারে। পুণ্ড্রবর্ধন হইতে কামরূপ এবং কামরূপ হইতে সমতট পর্যন্ত দুইটি সুদীর্ঘ পথ যে ছিল, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী এ-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রাখে না; ইতিপূর্বেই তাহা বিশ্লেষণ করিয়া দেখানো হইয়াছে। এই দুই পথ দিয়া প্রাচীন কামরূপ এবং সুবর্ণকুড্যকের সমৃদ্ধ ৭। সুচারু বস্ত্ৰশিল্প, অগুরু, চন্দন, হাতি প্রভৃতি বাঙলাদেশে আমদানি হইত, এবং বাঙলার সামূদ্রিক বন্দর ও আন্তর্দেশিক বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি হইতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ও ভারতবর্যের বাহিরে রপ্তানি হইত। কিন্তু কামরূপই পূর্বাভিমুখী এই পথের শেষ সীমা নয়।
উত্তর ব্ৰহ্ম-মণিপুরী কামরূপ আফগানিস্থান পথ
য়ুয়ান-চোয়াঙের অন্তত সাত শত বৎসর আগে চাঙ-কিয়েন (Chang Kien) নামে এক চৈনিক রাজদূতের প্রতিবেদনে দক্ষিণ-চীন হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর-ব্ৰহ্ম ও মণিপুরের ভিতর দিয়া কামরূপ হইয়া আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত এক সুদীর্ঘ প্রান্তাতিপ্রান্ত পথের ইঙ্গিত ধরিতে পারা যায়। চাঙ-কিয়েন (খ্ৰীঃ পূঃ ১২৬) ব্যাকট্রিয়ার বাজারে দক্ষিণ-চীনের যুন্নান এবং সজেচোয়ান প্রদেশেজাত রেশমী বস্ত্র এবং সূক্ষ্ম বাঁশ দেখিতে পাইয়া খোজ লইয়া জানিয়াছিলেন, এই সমস্ত দ্রব্য আসিত চীন হইতে আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত উত্তর ভারতবর্ষ জুড়িয়া লম্বমান সুদীর্ঘ পথ বাহিয়া, সার্থবাহাদলের পশু ও শকটবাহিনী ভর্তি হইয়া। সজেচেয়ান হইতে কামরূপ পর্যন্ত এই পথের খবর য়ুয়ান-চোয়াঙ সপ্তম শতকেও শুনিয়াছিলেন কামরূপবাসীদের নিকট হইতে; কঠিন পার্বত্য পথ দুই মাসে অতিক্রম করিতে হইত, এ-খবরও য়ুয়ান-চোয়াঙ পাইয়াছিলেন। নবম শতাব্দীর গোড়ায় কিয়া-তান (৭৮৫-৮০৫ খ্ৰী) নামে আর একজন চীনা পরিব্রাজক টঙ্কিন শহর হইতে কামরূপ পর্যন্ত আর-একটি পথের খবর বলিতেছেন। কামরূপে আসিয়া এই পথটি চাঙ-কিয়েন বর্ণিত পথের সঙ্গে মিলিত হইয়া কজঙ্গল এবং সেখান হইতে মগধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কাজঙ্গল হইতে পুণ্ড্রবর্ধন হইয়া কামরূপের যে পথের কথা কিয়া-তান বলিতেছেন সেই পথই সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙের পথ ছিল।
চাঙ-কিয়েন বর্ণিত পথটির এবং অন্য আর-একটি পথের আরও ইঙ্গিত অন্য দুইটি সাক্ষ্য হইতে পাওয়া যায় বলিয়া মনে হয়। ‘তবাকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে বর্ণিত আছে, মুহম্মদ ইবন। বখতিয়ার নুদিয়া জয় ও ধ্বংস করিয়া, গৌড় বা লক্ষ্মণাবতীতে নিজ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়া তিব্বত জয়ে অগ্রসর হইয়াছিলেন। পথে তাহাকে একটি সুপ্ৰশস্ত খরস্রোতা নদী (খরতোয়া=করতোয়া?) পার হইতে হয়; সেই নদীর কূল ধরিয়া দশ দিনের পথ চলার পর তিনি ২০টি পাষাণনির্মিত খিলানযুক্ত একটি সেতু পার হন। সেই সেতু পার হইয়া আরও ১৬ দিনের পথের পর একটি প্রাকারবেষ্টিত দুৰ্গরক্ষিত নগর দেখিতে পান এবং সংবাদ পান যে, সেখান হইতে ২৫ ক্রোশ দূরে করবত্তন, করপত্তন বা করমন্বত্তন নামে একটি জায়গায় ৫০,০০০ তুরুস্ক (? ) সৈন্য আছে; সেখানে বহু ব্ৰাহ্মণের বাস, এবং সেখানকার বাজারে প্রতিদিন সকালবেলা ১,৫০০ টাঙ্গন (টাটু) ঘোড়া বিক্রয় হয়। লক্ষ্মণাবতীতে যে সব ঘোড়া দেখিতে পাওয়া যায় সে সমস্তই সেই বাজারে কেনা। ঐ দেশের পথ-ঘাট পার্বত্যদেশ ভেদ করিয়া বিলম্বিত। তিব্বত হইতে কামরূপ পর্যন্ত এই পার্বত্য পথে ৩৫টি গিরিবর্তু আছে এবং সেইসব গিরিবর্ক্সের ভিতর দিয়াই লক্ষ্মণাবতী পর্যন্ত ঘোড়াগুলিকে আনা হয়। এই বিবরণ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। প্রাকারবেষ্টিত দুৰ্গরক্ষিত নগরটি কোন নগর তাহা নির্ণীত হয় নাই। করবত্তন, করপত্তন বা করমবত্তন কোন স্থান নির্দেশ করে, তাহাও বলা যায় না। কেহ কেহ। বলেন, করমন্বত্তনের ঘোড়ার হাট দিনাজপুর জেলার নেকদমার হাট; সেই হাটে নাকি এখনও বহু ঘোড়া বিক্রয় হয়, এবং সে সব ঘোড়া তিব্বত-ভোটানের টাটু ঘোড়া। কিন্তু করমত্তন হাট দিনাজপুর জেলায় হওয়া একটু কঠিন। গৌড় হইতে দিনাজপুর জেলার যে-কোেনও স্থান ২৬ দিনের পথ হইতে পারে না, দশ সহস্র সৈন্য লইয়া হাঁটিলেও নয়। তাহা ছাড়া, অন্য যুক্তিও আছে; তাহা এখনই বলিতেছি। যাহাই হউক, বখতিয়ার তিব্বত পর্যন্ত অগ্রসর হইতে পারেন। নাই; মধ্যপথেই পর্যুদস্ত হইয়া নানাভাবে লাঞ্ছিত হইয়া তীহাকে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছিল। মিনহাজ তাহার বিস্তৃত বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন। মিনহাজের বিবরণ সব বিশ্বাসযোগ্য না হইলেও বখতিয়ার যে কামরূপের ভিতর দিয়া ব্যর্থ একটা উত্তরাভিযান চালাইয়াছিলেন তাহা বর্তমান গৌহাটির নিকটে ব্ৰহ্মপুত্রের তীরে কানাই-বরিশীবোয়া-নামক স্থানে পাষাণাগাত্রে খোদিত একটি শিলালিপিতেই সুপ্ৰমাণ। এই লিপিটির পাঠ এইরূপ :
শাকে ১১২৭ [= ১২০৬, ২৭শে মার্চ, আনুমানিক]
শাকে তুরগ যুগ্মেশে মধুমাস ত্রয়োদশে।
কামরূপং সমাগত্য তুরস্কাঃ ক্ষয়মাযযুঃ।
লিপিটির নিকটেই পাথরের খিলানযুক্ত একটি সেতু আছে। এই সেতুই কি মিনহাজ। কথিত ৩২-খিলান-যুক্ত পাষাণ-সেতু? এই সেতু পার হইয়া আরও ১৬ দিনের পথ হাঁটিয়া বখতিয়ার যেখানে পৌঁছিয়াছিলেন সেখান হইতেও আরও ২৫ ক্রোশ দূরে করমবত্তনের হাট। কাজেই করমবত্তন দিনাজপুর জেলায় হইতেই পারে না। বরং মনে হয়, শিলালিপি ও মিনহাজ। কথিত সেতু, প্রাকারবেষ্টিত দুৰ্গরক্ষিত নগর এবং করমবত্তনের হাট সমস্তই কামরূপসীমা হইতে তিব্বতের সুদুৰ্গম পার্বত্য পথে অবস্থিত ছিল। এই পথে অসংখ্য গিরিবর্তু ছিল, এ খবর মিথ্যা। না-ও হইতে পারে। যাহাই হউক, কামরূপ হইতে তিব্বত পর্যন্ত একটি দুৰ্গম গিরিপথ ছিল এ বিষয়ে সন্দেহের অবসর কম। কামরূপে আসিয়া এই পথ চাঙ-কিয়েন কথিত চীন-ভারত-আফগানিস্তান প্রান্তাতিপ্রান্ত সুদীর্ঘ পথের সঙ্গে মিলিত হইত হইতে পারে, এই পথ দিয়াও বৌদ্ধ পণ্ডিত ও পরিব্রাজকেরা এবং তিব্বতী দূতেরা মগধ ও বঙ্গদেশ হইতে তিব্বতে যাতায়াত করিতেন। গৌহাটি শহরের নিকট ব্ৰহ্মপুত্র পার হইয়া সোজা পঁচিশ মাইল উত্তরে একটি জায়গায় এখনও বৈশাখী পূর্ণিমায় এক বিরাট মেলা বসে; সেই মেলায় বহু তিব্বতী ব্যবসায়ী কম্বল, ভেড়া, ঘোড়া ইত্যাদি বিক্রয়ের জন্য লইয়া আসে।
কিন্তু তিব্বতের সঙ্গে যোগাযোগের আর-একটি পার্বত্য পথ বোধহয় ছিল। এই পথ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি-দার্জিলিং অঞ্চল হইতে সিকিম, ভোটান পার হইয়া হিমালয় গিরিবর্ক্সের ভিতর দিয়া তিব্বতের ভিতর দিয়া চীনদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পেরিপ্লাস গ্রন্থে (প্রথম শতক) বোধহয় এই পথের একটু ইঙ্গিত আছে। খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকে চীনদেশ হইতে যে রেশম ও রেশমজাত দ্রব্যাদি বঙ্গদেশে আসিত তাহা পূর্বোক্ত কামরূপের পথ বা এই সদ্যোক্ত পথ বাহিয়া আসিত বলিয়াই তো মনে হয়। এখনও কালিমপং বা গ্যাংটকের বাজারে যে সব পার্বত্য টাটু ঘোড়া, কম্বল, কঁচা হলুদ, কঁচা সোনার অলংকার, নানা বর্ণের পাথর ইত্যাদি বিক্রয় হয় তাহা vায় সমস্তই আসে তিব্বত ও ভোটান হইতে; ঐ দেশীয় লোকেরাই তাহা লইয়া আসে।
কামরূপ হইতে তিব্বতের পথে বা জলপাইগুড়ি-দাৰ্জিলিং হইতে তিব্বতের পথ ইহার (কানওটাই এখন আর বহুলব্যবহৃত নয়। পার্বত্য প্রদেশের লোকেরাই শুধু এই পথ ব্যবহার করিয়া থাকে বঙ্গ ও আসামের সমভূমিতে আসিবার প্রয়োজনে। কম্বল, ঘোড়া, সোনা, পাথর ইত্যাদির বিনিময়ে লবণ, বিলাসদ্রব্য ইত্যাদি কিনিবার জন্য। কামরূপ হইতে উত্তর-পূর্ব আসাম ৩। মণিপুরের ভিতর দিয়া, উত্তর ব্রহ্মের ভিতর দিয়া যে-পথ দক্ষিণ-পূর্ব চীনে চলিয়া গিয়াছে, (যা পথের কথা চাঙ-কিয়েন বলিয়াছেন সেই পথে লোক-যাতায়াত বরাবরই কিছু কিছু ছিল; মধ্যযুগেও ছিল, এবং বর্তমান যুগেও আছে। আসামে ও বাঙলায় গোপনে আফিম আমদানী তো এই পথেই হইয়া থাকে। কিন্তু গত ভারত-ব্ৰহ্ম-চীন-জাপান যুদ্ধের তাগাদায় এই পথ পুনরুজ্জীবিত হইয়াছে।
ত্রিপুরা-মণিপুর পথ
ব্রহ্মদেশ হইতে পূর্বাভিমুখী আর-একটি স্থলপথের উল্লেখ করিতেই হয়। এ পথটি পূর্ব বাঙলার ত্রিপুরা জেলার লালমাই-ময়নামতী (প্রাচীন পট্টিকের রাজ্য) অঞ্চল হইতে আরম্ভ করিয়া সুরমা এ কাছাড় উপত্যকার (বর্তমান, শ্ৰীহট্ট-শিলচর) ভিতর দিয়া, লুসাই পাহাড়ের উপর দিয়া, মনিপুরের ভিতর দিয়া, উত্তর ব্ৰহ্মদেশ ভেদ করিয়া, মধ্য ব্ৰহ্মদেশে পাগান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পট্টিকেরা রাজ্যের সঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ব্ৰহ্মদেশের পাগান রাষ্ট্রের খুব ঘনিষ্ঠ বৈবাহিক ও রাজনৈতিক সম্বন্ধ বিদ্যমান ছিল। এই দুই রাজ্যের সংযোগ ছিল এই সদ্যোক্ত পথে। এই পথের সংবাদও স্থানীয় লোক ছাড়া আর সকলেই ভুলিয়া গিয়াছিল, অথচ মধ্যযুগে মণিপুর-ব্ৰহ্মযুদ্ধের সৈন্যসামন্ত তো এই পথ দিয়াই যাওয়া-আসা করিয়াছে। চোরাই ব্যাবসাও বরাবরই এই পথে চলিত। আজ প্রয়োজনের তাড়নায় সেই পথ আবার বহুজনের পদচারণে প্রশস্ত হইয়াছে।
চট্টগ্রাম-আরাকান পথ
আর একটি পথের প্রতি একান্ত সাম্প্রতিক কালের দৃষ্টি পড়িয়াছে। এই পথ দক্ষিণশায়ী চট্টগ্রাম হইতে আরাকানের ভিতর দিয়া নিম্ন-ব্ৰহ্মের প্রোম বা প্রাচীন শ্ৰীক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত। আনুমানিক নবম-একাদশ শতকে আরাকানে চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের আধিপত্য সুবিদিত। চট্টগ্রামের সঙ্গে ইহাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও সমান সুপরিচিত। মধ্যযুগে আরাকান মুসলমান রাজসভায় বাঙলা সাহিত্যের প্রচুর সমৃদ্ধি দেখা গিয়াছিল; এই সাহিত্যের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ। আজ প্রয়োজনের তাড়নায় এই চট্টগ্রাম-আরাকান-প্রোম পথও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। অবশ্য এই পথের সমান্তরালবাহী সমুদ্রকুলশায়ী জলপথ তো সঙ্গে সঙ্গে ছিলই।
তাম্রলিপ্তি হইতে দক্ষিণমুখী পথ
আর একটি স্থলপথের উল্লেখ করিলেই স্থলপথ বৃত্তান্ত শেষ হইবে। এই পথটি তাম্রলিপ্তি-তমলুক হইতে, কর্ণসুবর্ণ হইতে, সোজা দক্ষিণবাহী হইয়া বাঙলাদেশকৈ দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করিয়াছে। য়ুয়ান-চোয়াঙ এই পথ ধরিয়াই কর্ণসুবর্ণ হইতে ওড্র, কঙ্গোব্দ, কলিঙ্গ, দক্ষিণ-কৌশল, অন্ধ হইয়া দ্রাবিড়, চোল, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে গিয়াছিলেন। পাল ও সেন রাজারা এই পথেই দক্ষিণ দেশ আক্রমণে অগ্রসর হইয়াছিলেন। পশ্চিম-চালুক্যবংশীয় বিক্ৰমাদিত্য, চোলরাজ, রাজেন্দ্ৰচোল, এবং পূর্ব-গঙ্গােবংশের রাজারা এই পথেই বঙ্গদেশ আক্রমণে সৈন্যচালনা করিয়াছিলেন। এই পথেই চৈতন্যদেব নীলাচল এবং দক্ষিণ-ভারতে গিয়াছিলেন। এই পথেই বর্তমান কালের বি-এন-আর এবং মাদ্রাজ-রেলপথ বিস্তৃত।
আন্তর্দেশীয় নদীপথ
স্থলপথের কথা বলা হইল। এইবার আস্তর্দেশিক নদী ও সামুদ্রিক জলপথের কথা বলা যাইতে পারে। এ সম্বন্ধে সর্বপ্রাচীন সাক্ষ্য কয়েকটি জাতক-কাহিনী হইতে পাওয়া যায়। “শঙ্খজাতক’, ‘সমুন্দবাণিজজাতক’, ‘মহাজনকজাতক’ ইত্যাদি গল্পে দেখা যায়, মধ্যদেশের বণিকরা বারাণসী বা চম্পা হইতে জাহাজে করিয়া গঙ্গা-ভাগীরথীপথে তাম্রলিপ্তি আসিত এবং সেখান হইতে বঙ্গসাগরের কূল ধরিয়া সিংহলে, অথবা উত্তাল সমুদ্র অতিক্রম করিয়া যাইত সুবৰ্ণভূমিতে (নিম্ন-ব্ৰহ্মদেশ)। সুবৰ্ণভূমির পথে বহুদিন বণিকেরা কুলভূমির চিহ্ন পর্যন্ত দেখিতে পাইত না। মেগাস্থিনিসের বিবরণ হইতে সম্ভবত স্ট্রাবো। এই তথ্য আহরণ করিয়াছিলেন যে, ভাগীরথী-গঙ্গার উজান বাহিয়া সাগরমুখের বন্দর হইতে বাণিজ্যতরীগুলি প্রাচ্য ও গঙ্গারাষ্ট্রের তদানীন্তন রাজধানী পাটলিপুত্র পর্যন্ত যাওয়া-আসা করিত। নদীপথে গঙ্গা-ভাগীরথী বাহিয়াই বঙ্গদেশের সঙ্গে উত্তর-ভারতের যোগাযোগ ছিল। এ পথ প্রাগৈতিহাসিক পথ, এবং রেলপথে দ্রুত বাণিজ্য-সম্ভার যাতায়াতের সূত্রপাতের আগে বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াত এই পথেই ছিল বেশি।
উনবিংশ শতকেও বাঙালী এই নৌকাপথে কাশীধামে যাওয়া-আসা করিত, এই স্মৃতি এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। প্রাচীন বাঙলার অন্য দুইটি প্রধানতম নদনদী করতোয়া এবং ব্ৰহ্মপুত্র বা লৌহিত্যপথে বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াতের সাক্ষ্য বড় একটা পাওয়া যায় না। তবে, কামরূপ হইতে কর্ণসুবর্ণ এক জলপথের ইঙ্গিত বোধহয় পাওয়া যায়। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতে হর্ষবর্ধন-ভাস্করবর্ম সংবাদ প্রসঙ্গে। কিন্তু, এই জলপথ কি ব্ৰহ্মপুত্ৰ-ভাটি এবং গঙ্গা-উজান বাহিয়া, না কামরূপ হইতে স্থলপথে উত্তরবঙ্গের ভিতর দিয়া, তাহার পর কোশী বা মহানন্দার ভাটি বাহিয়া গঙ্গাতীরস্থ কর্ণসুবর্ণ পর্যন্ত, তাহা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। যাহা হউক, এ কথা অনুমান করিতে কিছুমাত্র কল্পনার আশ্রয় লইতে হয় না যে, উত্তর-আসামের রেশমজাতীয় বস্ত্রসম্ভার, বাঁশ, কাঠ, চন্দনকাঠ, পান, গুবক বা সুপারি, তেজপাতা ইত্যাদি ব্ৰহ্মপুত্র-সুরমা-মেঘনা বাহিয়াই বাঙলাদেশে আসিত। বাঁশ, কাঠ, ঘর ছাইবার খড় ইত্যাদি তো এখনও ভাটির স্রোতে ভেলায় ভাসাইয়া বাঙলাদেশে আনা হয়। পাট এবং ধান-চাল তো আজও নৌকাপথেই আমদানি-রপ্তানি হয় বেশি, বিশেষত পূর্ব-বাঙলার বিভিন্ন স্থানে এবং আসামের ও সুরমা উপত্যকা অঞ্চলে। করতোয়া যে এক সময় খুবই প্রশস্ত ও খরস্রোতা নদী ছিল এবং সোজা গিয়া সমুদ্রে পড়িত এ কথা তো আগেই বলিয়াছি। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে যোগাযোগ এই নদীপথেই ছিল, সন্দেহ করিবার কারণ নাই। এ কথাও আগে বলিয়াছি যে, এই নদীমাতৃক দেশে স্থলপথ অপেক্ষা নদীপথেই যাতায়াত ও বাণিজ্য প্রশস্ততর ছিল। লিপি এবং সমসাময়িক সাহিত্যেই যে শুধু সে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহাই নয়; মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে এবং উনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি পর্যন্ত লোকের অভ্যাস ও সংস্কারের মধ্যেও তাহার আভাস ও ইঙ্গিত সুস্পষ্ট।
বহির্দেশীয় সমুদ্রপথ : বঙ্গ-সিংহল পথ
নদীপথে আন্তর্দেশিক বাণিজ্য অপেক্ষা প্রাচীন বাঙলার সামুদ্রিক বাণিজ্য এবং বাণিজ্য-পথের সাক্ষ্য-প্রমাণ অনেক বেশি পাওয়া যায়। জাতকের গল্পে তাম্রলিপ্তি হইতে সিংহল ও সুবর্ণদ্বীপ যাত্রার কথা বলিয়াছি। দক্ষিণ-ভারত ও সিংহলের পথের কথাই আগে বলা যাক। সিংহলী ইতিগ্ৰন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশে’ উল্লিখিত লাঢ়দেশী রাজপুত্র বিজয়সিংহ কর্তৃক সমুদ্রপথে সিংহেলগমন এবং দ্বীপটি অধিকার ইত্যাদির গাল্পৈতিহ্য বাঙালী কবি সত্যেন্দ্রনাথের কল্যাণে সুপরিচিত। কিন্তু এই লাঢ়দেশ কি প্রাচীন বাঙলার রাঢ় জনপদ, না প্রাচীন গুজরাত বা লাটদেশ, এই লইয়া পণ্ডিতমহলে মতভেদ আছে, এবং এই সম্পৰ্কীয় আলোচনা নানা ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক এবং শব্দতাত্ত্বিক বিতর্কে কণ্টকিত। কিন্তু এ সাক্ষ্য ছাড়াও এই সম্বন্ধে অন্য প্রাচীন সাক্ষা বিদ্যমান। পেরিপ্লাসের সাক্ষ্য আগে উল্লেখ করিয়াছি। এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, লগদেশের সঙ্গে দক্ষিণ ভারত ও সিংহলের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য-সম্বন্ধ ছিল। সমুদ্রমুখে গঙ্গাবন্দর হইতে বাণিজ্যসম্ভার কোলণ্ডিয়া (Colandia) নামক এক প্রকার জাহাজ বোঝাই হইত এবং সেই জাহাজগুলি দক্ষিণ ভারতে ও সিংহলে যাতায়াত করিত। প্লিনিও এই সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন, আগে প্রাচ্যদেশ হইতে সিংহলে যাইতে ২০ দিন লাগিত, পরে (অর্থাৎ, প্লিনির সময়ে এবং কিছু আগে) লাগিত মাত্ৰ সাতদিন (‘a seven days’ sail according to the rate of speed of ourships’)। চতুর্থ শতকে ফাহিয়ান যখন তাম্রলিপ্তি হইতে এক বাণিজ্য-জাহাজ চড়িয়া সিংহলে যান। তখন লাগিয়াছিল চৌদ্দ দিন ও রাত্রি। সিংহল তো খ্রীষ্টপূর্বকাল হইতেই বৌদ্ধধর্মের এক বিশিষ্ট কেন্দ্ৰ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, এবং কালক্রমে এই হিসাবে এই দ্বীপটির খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা বাড়িয়াই চলিয়াছিল। ফাহিয়ানের পর হইতেই বহু চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক সিংহলে-বাঙলাদেশে আসা-যাওয়া করিতেন এবং তাহা সদ্যোক্ত সমুদ্রপথেই। সপ্তম শতকে ইৎসিঙের বিবরণী পাঠে জানা যায়, ঐ সময় অসংখ্য চীনদেশীয় বৌদ্ধশ্রমণ সিংহল হইতে বাঙলায় এবং বাঙলা হইতে সিংহলে ঐ পথে যাতায়াত করিয়াছিলেন। বোধহয়, ঐ সূত্র ধরিয়াই মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং কিছু কিছু নাগরী লিপির বৌদ্ধধর্মগ্রন্থও সিংহলে প্রসারলাভ করিযাছিল। অষ্টম শতকের পর বৈদেশিক বাণিজ্যে বাঙলাদেশের প্রতিষ্ঠা ক্ষুঃ হওয়ার পরে বহুদিন এই পথের কথা আর শোনা যায় না; তবে মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্য পাঠ করিলে মনে হয়, তখন এই পথ ধরিয়া অর্থাৎ সমুদ্রোপকূল বাহিয়া সিংহল গুজরাত পর্যন্ত সমুদ্রপথ পুনরুজজীবিত হইয়াছিল, অথবা এইসব পথের সুপ্রাচীন স্মৃতি প্রচলিত গল্প কাহিনীর মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল, যেমন ‘মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে। সিংহল হইতে মালয়, নিম্ন-ব্ৰহ্ম, সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ, চম্পা, কম্বোজের সমুদ্রপথ তো ছিলই, এবং তাহার প্রমাণও সুপ্রচুর।
তাম্রলিপ্তি-আরাকান-ব্ৰহ্ম-মালয়-যবদ্বীপ-সুবর্ণদ্বীপ পথ
তাম্রলিপ্তি হইতে নিম্ন-ব্ৰহ্মদেশ বা সুবৰ্ণভূমির দ্বিতীয় সমুদ্রপথের ইঙ্গিত যে “মহাজনকজাতকের গল্পে পাওয়া যাইতেছে, সে কথা ইতিপূর্বে বলিয়াছি। এই পথ সম্ভবত ছিল চট্টগ্রাম-আরাকানের সমুদ্রোপকূল বাহিয়া। একাদশ শতকে এবং পরে মধ্যযুগে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরাকানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের আনাগোনা যে এই পথেই অনেকটা হইত। তাহা কতকটা অনুমান করা চলে। মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যেও বাঙলার সঙ্গে নিম্ন-ব্রহ্মের সামুদ্রিক বাণিজ্যের এবং এই বাণিজ্যপথের সুদূর স্মৃতি ধরিতে পারা কঠিন নয়। ‘সুপারগ জাতক’ নামে আর-একটি জাতকের গল্পেও পূর্ব ভারতের বণিকদের সুবৰ্ণভূমিতে যাত্রার কথা আছে। মধ্যযুগে চীন বণিক ও পরিব্রাজকেরা (যেমন, মা-হুয়ান), আরব বণিকেরা এবং পরে পর্তুগীজ বণিকেরা সপ্তগ্রাম ও চেহাটি-গান বা চট্টগ্রাম হইতে এই সমুদ্রোপকূল বাহিয়াই আরাকান ও নিম্ন-ব্ৰহ্মদেশে যাওয়া-আসা করিতেন, এমন প্রমাণ একেবারেই দুর্লভ নয়। ইৎসিঙ সপ্তম শতকেই বলিতেছেন, হিউয়েন-ত নামে একজন চীন পরিব্রাজক মালয় উপদ্বীপের সমুদ্রকুলবর্তী কেন্ডা (Keddah) হইতে সোজা তাম্রলিপ্তি গিয়াছিলেন। এই পথটির আভাস বোধহয় খ্ৰীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতক হইতে পাইতেছি। মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের যে লিপিটি মালয় উপদ্বীপে পাওয়া গিয়াছে সেই লিপিটিতে দেখিতেছি, বুদ্ধগুপ্ত রক্তমৃত্তিকা হইতে সমুদ্রপথে গিয়াছিলেন মালয়ে, বাণিজ্যব্যাপদেশে। এই রক্তমৃত্তিকা মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি (য়ুয়ান-চোয়াঙের লো-টো-মো-চিহ) বা চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গামাটিও হইতে পারে; শেষেরটি হওয়াই অধিকতর সম্ভব। নবম শতকের মাঝামাঝি দেবপালের নালন্দা লিপিতেও বঙ্গসাগর বাহিয়া এক সমুদ্রপথের ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে। তখন তাম্রলিপ্তি বন্দর অবলুপ্ত; বাঙলার আর কোনও সামুদ্রিক বন্দরের উল্লেখও পাইতেছি। না। কাজেই, এই পথ সমুদ্রতীর বাহিয়া, না কোনাকুনি বঙ্গোপসাগর বাহিয়া, ওড়িশার কোনো বন্দর হইয়া, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতেছে না।
তাম্রলিপ্তি-পলৌরা-মালয়-সুবর্ণভূমি পথ
তৃতীয় আর-একটি পথের কথাও বলিতে হয়। এই পথের সর্বপ্রাচীন সংবাদ দিতেছেন ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বেত্তা টলেমি। তাম্রলিপ্তি হইতে যাত্ৰা করিয়া জাহাজগুলি সোজা আসিত ওড়িশা দেশের পলৌরা (Paloura) বন্দরে, এবং সেখান হইতে কোনাকুনি বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়া যাইত মালয়, যবদ্বীপ, সুমাত্রা প্রভৃতি দ্বীপ-উপদ্বীপগুলিতে।
০৫. ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু : লোক-প্রকৃতি
নদনদী ও পাহাড়-পর্বত মিলিয়া বাঙলার ভূ-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে, এবং তোহা ইতিহাস আরম্ভ হইবার পূর্বেই। ঐতিহাসিক কালেও ভূ-প্রকৃতির কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছে, সন্দেহ নাই, বিশেষত নবগঠিত ভূমিতে—” new alluvium-এ। নদীর পলি পড়িয়া, বন্যার দ্বারা তাড়িত মাটি উচ্চভূমিতে বাধা পাইয়া, কিংবা ভূমিকম্প বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নূতন ভূমির সৃষ্টি বা পুরাতন ভূমি পরিত্যক্ত হয়। বাঙলাদেশেও তাহা হইয়াছে; নূতন ভূমির সৃষ্টি হইয়াছে অল্পবিস্তর, কিন্তু তাহাতে প্রাগৈতিহাসিক কালের নবগঠিত ভূমি বা new alluvium-ই প্রসারিত হইয়াছে। পুরাতন ভূমি পরিত্যক্তও হইয়াছে, বিনষ্ট হইয়াছে— সাধারণত নদীর প্রবাহপথের পরিবর্তনের ফলে; কিন্তু তাহাতে ভূ-প্রকৃতির মৌলিক কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই, পুরাভূমিতেও (old alluvium) নয়, নবভূমিতেও (new alluvium) নয়।
পশ্চিমাংশের পুরাভূমি এবং নবভূমি
ভূ-প্রকৃতির দিক হইতে বাঙলাদেশের চারিটি বিভাগ সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। পশ্চিম বাঙলার একটা সুবৃহৎ অংশ পুরাভূমি। রাজমহলের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া এই পুরাভূমি প্রায় সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজমহল, সাঁওতালভূম, মানভূম, সিংহভূম, ধলভূমের পূর্বশায়ী মালভূমি এই পুরাভূমির অন্তর্গত; তাহারই পূর্বদিক ঘেষিয়া মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান–বাঁকুড়া-মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশের উচ্চতর গৈরিকভূমি; ইহাও সদ্যোক্ত পুরাভূমির অন্তর্গত। মালভূমি অংশ একান্তই পার্বত্য, জাঙ্গলময়, অজলা এবং অনুর্বর। এখনও এই অংশে গভীর শালবন, পার্বত্য আকর ও কয়লার খনি এবং ইহা সাধারণত অনুর্বর। প্রাচীন উত্তর-রাঢ়ের অনেকখানি অংশ, দক্ষিণ-রাঢ়ের পশ্চিমাংশ এবং তাম্রলিপ্তি রাজ্যেরও কিয়ৎ-পশ্চিমাংশ এই মালভূমি এবং উচ্চতর গৈরিক ভূমির অন্তর্গত। দক্ষিণ-রাঢ়ের রাণীগঞ্জ-আসানসোলের পার্বত্য অঞ্চল, বাঁকুড়ার শুশুনিয়াপাহাড় অঞ্চল, বনবিষ্ণুপুর রাজ্য, মেদিনীপুরের শালবনী-ঝাড়গ্রাম-গোপীবল্লভপুর অঞ্চল সমস্তই এই পুরাভূমিরই নিম্ন অংশ। এইসব পার্বত্য ও গৈরিক অঞ্চল ভেদ করিয়াই ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী (শিলাই), কপিশা (কসাই), সুবর্ণরেখা প্রভৃতি নদনদী সমতল ভূমিতে নামিয়া আসিয়াছে। এখনও ইহারা ইহাদের জলস্রোতে পার্বত্য লাল মাটি বহন করিয়া আনে। সমতলভূমি এই নদনদীগুলির জল পলিতে উর্বর। এই উর্বর সমতলভূমি নবগঠিত ভূমি, সদ্যোক্ত নদনদীগুলি এবং ভাগীরথী-প্রবাহদ্বারা সৃষ্ট ভূমি। মুর্শিদাবাদের বহুলাংশ, বর্ধমানের পূর্বাংশ, বাঁকুড়ার স্বল্প অংশ, হুগলি-হাওড়া এবং মেদিনীপুরের পূর্বাংশ এই নবসৃষ্ট ভূমি—বৃক্ষশ্যামল, শস্যবহুল।
কজঙ্গল
পশ্চিমবঙ্গের এই যে ভূ-প্রকৃতি ইহার প্রাচীন সমর্থন কিছু কিছু পাওয়া যায়। ভট্ট ভবদেব রাজা হরিবর্মদেবের মন্ত্রী ছিলেন (একাদশ শতক)। তিনি তাহার ভুবনেশ্বর শিলালিপিতে রাঢ়দেশের অজলা জাঙ্গলময় প্রদেশের উল্লেখ করিয়াছেন। ভবিষ্য-পুরাণের ব্ৰহ্মখণ্ড অংশে রাঢ়ীখণ্ডজঙ্গল নামে এক দেশের উল্লেখ আছে। বৈদ্যমাথ, বক্ৰেশ্বর, বীরভূম ও অজয় নদ এই দেশের অন্তর্গত; ইহার তিনভাগ জঙ্গল, একভাগ গ্রাম ও জনপদ, অধিকাংশ ভূমি উষর, স্বল্পমাত্র ভূমি উর্বর। এখানে কোথাও কোথাও লৌহ আকর আছে। আমি অন্যত্র দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, “ভবিষ্যপুরাণ ও ভবদেবভট্ট-কথিত এই দেশের একাংশে য়ুয়ান চোয়াঙ-রামচরিত-বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ প্রভৃতি কথিত কয়ঙ্গল—কজঙ্গল—কজাঙ্গল-ক-চু-ওয়েন-কি-লো। বর্তমান কঁকজোল এই ভূখণ্ডের স্মৃতিমাত্র বহন করে। য়ুয়ান-চোয়াঙ চম্পা হইতে কজঙ্গল গিয়াছিলেন। এই দেশের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু সম্বন্ধে তাহার কিছু বক্তব্য আছে। তিনি বলিতেছেন (সপ্তম শতক), এই স্থানের উত্তরসীমা গঙ্গা হইতে খুব বেশি দূরে নয়; ইহার দক্ষিণের বনপ্রদেশে বন্য হন্তী প্রচুর। তাহার সময়ে এই রাজ্য পররাষ্ট্রের অধীন, রাজধানীতে লোক ছিল না এবং লোকেরা গ্রামে এবং নগরেই বাস করিত। তাহারা স্পষ্টাচারী (straight forward), গুণবান এবং বিদ্যাচর্চার প্রতি ভক্তিমান ছিল। দেশটি সমতল, ভূমি জলীয় এবং সুশস্যপ্রসু, বায়ু উষ্ণ। য়ুয়ান-চোয়াঙের বর্ণনা হইতে মনে হয়, তিনি কাজঙ্গলের যে অংশে দামোদর-অজয়-ভাগীরথী উপত্যকা সেই অংশের উপত্যক-ভূমির কথা বলিতেছেন, যে অংশে বৈদ্যনাথ-বক্ৰেশ্বর-বীরভূম সেই অংশের কথা নয়। দক্ষিণের বনপ্রদেশ বনবিষ্ণুপুর অঞ্চল বলিয়াই তো মনে হইতেছে। দামোদর-অজয়-ভাগীরথী উপত্যকার ভূমি সমতল, জলীয়, সুশস্যপ্রসূ এবং বায়ু উষ্ণ।
তাম্রলিপ্তি
য়ুয়ান-চোয়াঙ তাম্রলিপ্তি রাজ্যেও গিয়াছিলেন, এবং তাহার বর্ণনাও রাখিয়া গিয়াছেন। তাম্রলিপ্তির ভূমিও সমতল এবং জলীয়; বায়ু উষ্ণ; ফুল ফল শস্য প্রচুর। লোকের আচার-ব্যবহার রূঢ়, কিন্তু তাহারা খুব সাহসী। এই দেশে স্থল ও জলপথের সমন্বয়, এবং ইহার রাজধানী তাম্রলিপ্তির বন্দর সমুদ্রের একটি খাড়ির উপর অবস্থিত। এক্ষেত্রেও য়ুয়ান-চোয়াঙ মেদিনীপুরের পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ অংশের কথা বলিতেছেন, পশ্চিমের পার্বত্য অংশের কথা নয়।
কর্ণসুবর্ণ, পুরাভূমি বা রাঙ্গামাটির বিস্তৃতি
য়ুয়ান-চোয়াঙ তাম্রলিপ্তি হইতে গিয়াছিলেন কর্ণসুবর্ণ রাজ্যে। কর্ণসুবর্ণ তাঁহার সময়ে লোকবহুল জনপদ, এবং জনসাধারণের আর্থিক সমৃদ্ধিও তিনি লক্ষ করিয়াছিলেন। ভূমি ছিল সমতল এবং জলীয়, ফল ফুল শস্য ছিল প্রচুর; কৃষিকর্ম ভালো; বায়ু নাতিশীতোষ্ণ। জনসাধারণ সুচরিত্র এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের পোষক। য়ুয়ান-চোয়াঙের কর্ণসুবর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলার কানসোনা বলিয়া অনুমিত হইয়াছে। এই অনুমানের সমর্থন চীন পরিব্রাজকের বিবরণীতেই পাওয়া যায়। কর্ণসুবর্ণের রাজধানীর সন্নিকটেই তিনি লো-টো-মো-চিহ্ন নামক এক সুবৃহৎ বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ এবং বর্ণনা করিয়াছেন। লো-টো-মো-চিহ্ন (=রাত্তমত্তি=রক্তমৃত্তিকা) বর্তমান রাঙ্গামাটি; রাঙ্গামাটি মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত। রাঙ্গামাটি নামটি অর্থব্যঞ্জক। এই রাঙ্গামাটি সমতলভূমি হইলেও রাজমহল-সঁওতালভূমের পার্বত্য গৈরিক মাটি এই ভূমির নিম্ন ও উপরিস্তরে অপ্রতুল নয়। পুরাভূমি বা old alluvium-র কিছু কিছু চিহ্ন যে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে তাহার ইঙ্গিত রাঙ্গামাটি, লালবাগ প্রভৃতি নামের স্মৃতির মধ্যে পাওয়া যায়। বাঙলার অন্যত্রও যেখানে-যেখানে স্থান-নামের সঙ্গে রাঙ্গা, লাল, রং প্রভৃতি শব্দ জড়ির সেইসব স্থান লক্ষণীয়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ঘেষিয়া রাঙ্গামাটি জনপদ এখনও বিদ্যমান। হয়তো ইহাই মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের রক্তমৃত্তিকা। কুমিল্লা শহরের পঁাচ মাইল পশ্চিমে লালমাটি বা লালমাইপাহাড় (ইহাই কি শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল ও ধুল্লা লিপির রোহিতাগিরি?)। রেনেলের নকশায় দেখা যাইবে, ব্ৰহ্মপুত্রের উত্তর প্রবাহের পশ্চিমে (রংপুর জেলা), উত্তরে (গোয়ালপাড়া-কামরূপ জেলা), এবং দক্ষিণে (গোয়ালপাড়া কামরূপ জেলা) একাধিক রাঙ্গামাটির উল্লেখ ও পরিচয় (Rangamata, Rangamaty, Rangamati= রাঙামাটি, সন্দেহ থাকিতে পারে না)। ইহার কিছু সমর্থন করতোয়ামাহাত্ম্য গ্রন্থেও পাওয়া যায়—“পশ্চিমে করতোয়ায়া লোহিনী যাত্র মৃত্তিকা”। বর্তমান রংপুর জেলার রংপুর নামও এই রাঙ্গামাটির স্মৃতিবহ বলিয়া আমি মনে করি। ব্লাঙ্গাপুর=বিদেশী Fungpour (যেমন,রেনেলের নকশায়)=রঙ্গপুর=বংপুর হওয়া একেবারে অসম্ভব কিছুই নয়। তাহা ছাড়া, আমিনগাও-এর পথে রাঙ্গিয়া রেল স্টেশন, তেজপুরের পথে রাঙ্গাপাড়া স্টেশন, রাঙ্গাগ্রাম প্রভৃতি সমস্তই রেনেলের রাঙ্গামাটির সমর্থক; কারণ এগুলি সমস্তই ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্বে, উত্তরে এবং দক্ষিণে। রংপুরের দক্ষিণ পশ্চিমে বরেন্দ্রী, মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ। বরেন্দ্রীর মাটি লাল, এবং তোহা একান্তই পুরাভূমি। এই পুরাভূমির বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন রেখা চলিয়া গিয়াছে রাজমহলের নিকট গঙ্গা পার হইয়া ধলভূম-মানভূম-সিং ভুম ধরিয়া সমুদ্রতীর পর্যন্ত। উত্তর-রাঢ় ও দক্ষিণ-রাঢ়ের পশ্চিমাংশ এবং মুর্শিদাবাদ এই পুরাভূমির বিস্তৃতাংশ। পূর্ব দক্ষিণ দিকে এই পুরাভূমির গারোপাহাড় (মধুপুরগড় সহ), পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম হইয়া সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
য়ুয়ান চোয়াঙের কজঙ্গল-তাম্রলিপ্তি-কর্ণসুবর্ণবিবরণ পড়িয়া মনে হয়, এই পরিব্রাজক পশ্চিম বঙ্গের সমতল ভূমির ভূখণ্ডের সঙ্গেই পরিচিত হইয়াছিলেন। এই সমতলভূমির পশ্চিমাঞ্চলের উত্তর অংশেই “ভবিষ্যপুরাণ’ কথিত বৈদ্যনাথ-বক্রেশ্বর-বীরভূম-ধূত, উষর ও জাঙ্গলময় যে রাটখণ্ডজঙ্গলভূমি সেই ভূখণ্ডের সঙ্গে তাহার পরিচয় হয় নাই। কিংবা ভবদেব ভট্ট রাঢ় দেশের যে অজলা জঙ্গলময় (=জঙ্গলময় হইতে পারে, আবার জাঙ্গল=জাঙ্গাল=উচ্চ বাধ্যভূমিময়) ভূমির কথা বলিতেছেন তাহার পরিচয়ও তিনি পান নাই। কাজঙ্গল-তাম্রলিপ্তি-কর্ণসুবর্ণ-এই তিনটি রাজ্যেরই যে সমতলভূমি জলীয় এবং ফলমূল-শস্যপ্রসূ যাহার জলবায়ু উষ্ণ অথবা নাতিশীতোষ্ণ, এবং যে ভূমি লোকবহুল সেই ভূমিভাগের সঙ্গেই তাঁহার পরিচয় ঘটিয়াছিল। তিনি আসিয়াছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী এবং উৎসুক শিক্ষার্থী হিসাবে; বৌদ্ধধর্মসংঘ ও বিহারগুলির পরিচয়লাভ, পণ্ডিত ও ধর্মগুরুদের অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচয়লাভই তাহার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এইসব বৌদ্ধবিহার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্ৰ সাধারণত সহজগম্য এবং লোকালয়প্রধান স্থানেই অবস্থিত ছিল। সুপরিচিত, বহুজনপদচিহ্নিত পথ ধরিয়াই তিনি সে-সব স্থানে গিয়াছিলেন। কাজেই উষর, অনুর্বর ও জঙ্গলময়, এবং সেইহেতু গ্রাম ও নগরবিরল, জনবিরল স্থানগুলিতে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন তাঁহার হয় নাই।
উত্তরবঙ্গের পুরাভূমি ও নবভূমি, বরিন্দ্-বরেন্দ্রী
পূর্বোক্তি পুরাভূমির একটি রেখা রাজমহলের উত্তরে গঙ্গা পার রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুরের ভিতর দিয়া, ব্ৰহ্মপুত্র পার হইয়া ঐ নদীর দুই তীরে বিস্তৃত হইয়া আসামের শৈলশ্রেণী স্পর্শ করিয়াছে। এই পুরাভূমিরেখার মাটি পার্বত্য গৈরিক স্থূল বালিময়। রংপুর-গোয়ালপাড়া-কামরূপেই এই রেখার বিস্তৃতি বেশি; রেনেলের নকশায় তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। উত্তর-বঙ্গের রাঙ্গামাটি প্রসঙ্গ আগেই বলিয়াছি। তাহা ছাড়া বগুড়া-রাজশাহীর উত্তর, দিনাজপুরের পূর্ব, এবং রংপুরের পশ্চিম স্পর্শ করিয়া এই রেখার একটি বিস্তৃত স্ফীতি— উচ্চ গৈরিক ভূমি—দেখিতে পাওয়া যায়; ইহাই মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ, বরেন্দ্ৰভূমির কেন্দ্ৰবিন্দু। এই বরিন্দের উত্তরে হিমালয়ের তরাই পর্বতসানুর অস্বাস্থ্যকর জলীয় নিম্নভূমিতে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা, পূর্ণিয়ার কিয়দংশ। বরেন্দ্রীর কেন্দ্রবিন্দু বরিন্দের গৈরিক ভূমি অনুর্বর, পুরাভূমি; কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ ঘিরিয়া তাঙ্গন-আত্রাই, মহানন্দা-কোশী, লম্বা করতোয়ার জল ও পলিমাটি-দ্বারা গঠিত নবভূমি। উপরোক্ত পুরাভূমিরেখাটুকু ছাড়া নবভূমির বাকি সবটাই সমতল-ভূমি, সুশস্যপ্ৰসূ, জলীয় এবং শ্যামল। বরিন্দ জনবিরল, এমনকি মালদহ-রংপুরের পুরাভূমিরেখাও অপেক্ষাকৃত জনবিরল, এবং মাটির রং গৈরিক; ঘন লোকবসতি সাধারণত পদ্মা-আত্রাই-করতোয়ার সমতলভূমিতেই দেখা যায়। প্রাচীন কালেও পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর সমৃদ্ধ জনপদগুলি সমস্তই এই নদনদীপ্লাবিত সমতলভূমিতে।
‘রামচরিতে” বরেন্দ্রভূমির যে শস্যসমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়, যে ঐশ্বর্যবিবরণ পড়া যায় এবং যাহার কথা ধনসম্বল অধ্যায় প্রসঙ্গে এবং অন্যত্র নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হইয়াছে সেই সমৃদ্ধি সাধারণত এই সমতলভূমির। তাহা হওয়াই স্বাভাবিক। নদনদী বাহিয়াই বাঙলার প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি-সমৃদ্ধির জয়যাত্রা, এবং সমতলভূমিতে নদনদীর তীরেই গ্রাম-নগর-বন্দরের পত্তন, মানুষের ঘনতম বসতি, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের বিস্তার।
পুণ্ড্রবর্ধন
বরেন্দ্রভূমি প্রাচীন পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধনেরই এক সুবৃহৎ অংশ, এমনকি কখনও কখনও সমার্থকও। য়ুয়ান-চোয়াঙ ভ্ৰমণ-ব্যাপদেশে পুণ্ড্রবর্ধনেও আসিয়াছিলেন। তখন এই দেশে সমৃদ্ধ, জনবহুল, প্রতি জনপদে দীঘি, আরাম-কানন, পুষ্পেপাদ্যান ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; ভূমি সমতল এবং জলীয়, শস্যসম্ভার সুপ্রচুর, জলবায়ু মৃদু। জনসাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবান। আগে বলিয়াছি, উত্তরবঙ্গ এবং ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া ও কামরূপ জেলার ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু প্রায় একই প্রকার; সেখানেও একই ভূমির বিস্তার। য়ুয়ান-চোয়াঙের কামরূপ-বিবরণ সেই জন্যই পুণ্ড্রবর্ধনের সঙ্গে একেবারে হুবহু মিলিয়া য়ায়। সেখানেও ভূমি সমতল এবং জলীয়, শস্যসম্ভার নিয়মিত এবং জলবায়ু মৃদু। কামরূপের লোকেরা খর্ব ও কৃষ্ণকায়; সদাচারী হওয়া সত্ত্বেও তাহাদের প্রকৃতি হিংস্র। বিদ্যাথী হিসাবে তাহারা খুব অধ্যবসায়ী এবং তাহাদের ভাষা মধ্যদেশ হইতে পৃথক। এই দেশের দক্ষিণ-পূর্ব বনভূমিতে (গারো ও খাসিয়া-পাহাড়ে?) যুথবদ্ধ হইয়া বন্যহন্তী উৎপাত করিয়া চরিয়া বেড়ায় (এখনও করে); তাহার ফলে এখান হইতে যুদ্ধের প্রয়োজনে হস্তী যথেষ্ট পাওয়া যায়।
রাঢ়-পুণ্ড্রের যোগাযোগ
পশ্চিম-বাঙলার যেমন উত্তরবঙ্গেও তেমনই, য়ুয়ান-চোয়াঙের পরিচয় পুণ্ড্রবর্ধনের সমতল ভূমির সঙ্গে। কেন্দ্ৰভূমি বরিন্দের সঙ্গে বোধহয় তাহার পরিচয় ঘটে নাই। যাহাই হউক, রাঢ় এবং উত্তরবঙ্গের ভূ-প্রকৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা ও ভাগীরথীর ইতিহাস একত্রে স্মরণ ও বিশ্লেষণ বীরভূম-বর্ধমানের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। ভাগীরথী যখন গৌড়কে ডাইনে রাখিয়া উত্তরহইয়া পরে দক্ষিণবাহী হইত, পদ্মা যখন আরও সোজা পূর্ববাহী ছিল তখন তো পুণ্ড্রবরেন্দ্রীর কিছুটা অংশ (মালদহ জেলা) রাঢ়ভূমির সঙ্গে যুক্তই ছিল। কিন্তু ইহার পরও গঙ্গা বরেন্দ্ৰ-পুণ্ড্র এবং রাঢ়ভূমির মধ্যে কখনও খুব বড় বাধা হইয়া দেখা দেয় নাই। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্বন্ধের একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রাচীন বাঙলার এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে বরাবরই ছিল। আজ উত্তর-বাঙলার সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগ পূর্ব-বাঙলার বেশি, কিন্তু প্রাচীন কালে তাহা ছিল না বলিলেই চলে। দিনাজপুর-রাজশাহী-মালদহের লোকভাষার প্রকৃতিও রাঢ়ের পূর্বাঞ্চলের লোকভাষা-প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ। কিন্তু তাহা আলোচনার স্থান। এখানে নয়। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, মোটামুটিভাবে পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী এবং রাঢ়-তাম্রলিপ্তিই বাঙলাদেশের প্রাচীনতর পলিভূমি।
পূর্ববঙ্গের পুরাভূমি ও নবভূমি, মধুপুরগড়, নবভূমির দুই ভাগ
পূর্ব-বাঙলা একান্তই নবভূমি এবং এই নবভূমি পদ্মা-ব্ৰহ্মপুত্র এবং সুরমা-মেঘনার সৃষ্টি। এই নবভূমির উত্তরে, পূর্বে এবং পূর্ব-দক্ষিণে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া–ত্রিপুরা-চট্টগ্রামের শৈলশ্রেণী;; ইহাদের অব্যবহিত সানু ও তলদেশ পার্বত্য না হইলেও কোথাও কোথাও গৈরিক বালুকাময়, কখনও কখনও বালির শক্ত স্তরময়, যেমন চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা-শ্ৰীহট্ট-কাছাড় জেলার কোনও কোনও স্থানে। চট্টগ্রামের পার্বত্য-চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য-ত্রিপুরা অঞ্চল, কাছাড় জেলার উত্তরাংশ ও দক্ষিণাংশে হালিয়াকান্দি অঞ্চল, এবং শ্ৰীহট্ট জেলার পূর্বাঞ্চলকে মোটামুটি পুরাভূমির অন্তর্গতই বলিতে হয়। তাহা ছাড়া, ঢাকা ও মৈমনসিংহ জেলার বিস্তৃত একটি অংশ জুড়িয়া গৈরিক পার্বত্য গজারী-বনময় একখণ্ড পুরাভূমির স্ফীতি দেখিতে পাওয়া যায়-ইহা মধুপুরগড় নামে খ্যাত। ঢাকা জেলার ভাওয়ালের গড়ও তাঁহাই। মধুপুরগড়ের উপরের স্তরের মাটি যেন লাল কাদা-জমানো-মাটি, কিন্তু তাহার নিচের স্তরেই লাল বালি; এই বালি ও অজয়-বরাকর উপত্যকার লাল বালি একই গৈরিক পার্বত্য মাটি। পূর্ব-বাঙলার অন্য সমস্ত ভূমিই জলীয় সমতল ভূমি অর্থাৎ নবগঠিত ভূমি এবং সর্বত্র খালবিল ও সুবিস্তীর্ণ জলাভূমিদ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু তাহা হইলেও এই নবগঠিত ভূমির দুইটি বিভাগ সুস্পষ্ট। ইহারই মধ্যে মৈমনসিং, ঢাকা, ফরিদপুর, সমতল-ত্রিপুরা ও শ্ৰীহট্টের বহুলাংশের গঠন পুরাতন (old formation), এবং খুলনা, বাখরগঞ্জ, সমতল-নোয়াখালি ও সমতল-চট্টগ্রামের গঠন (new formation)। শ্ৰীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড অঞ্চলে প্রাপ্ত নিধনপুর তাম্রপটোলী (সপ্তম শতক), ভাটোরায় প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবের পট্টোলী (একাদশ শতক), বন্দরবাজারে প্রাপ্ত লোকনাথের মূর্তি (দশম-একাদশ শতক), ত্রিপুরা জেলার প্রাপ্ত লোকনাথের পট্টোলী (অষ্টম শতক) এবং তৎপরবর্তী অগণিত লিপি ও মূর্তি, ফরিদপুরে প্রাপ্ত ধর্মাদিত্য-গোপচন্দ্ৰ ইত্যাদির পট্টোলী (ষষ্ঠ-সপ্তম শতক), ঢাকা জেলায় প্রাপ্ত অসংখ্য মূর্তি ও লিপি এইসব ভূখণ্ডে প্রাচীনকাল হইতেই বহুদিন স্থিত সমৃদ্ধ সভ্যতা এবং জনাবাসের দ্যোতক। এইসব ভূখণ্ড পুরাতন গঠন, এবং ইহাদের অবলম্বন করিয়াই প্রাচীন বাঙলার সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্বাঞ্চলে বিস্তারলাভ করিয়াছিল। এইসব ভূখণ্ডের তুলনায় খুলনা-বাখরগঞ্জ-নোয়াখালি-সমতল চট্টগ্রাম নূতন, এবং লক্ষণীয় এই যে, এইসব ভূখণ্ডে বাঙলার প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বড় একটি চিহ্ন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। চট্টগ্রামে বহু মূর্তি এবং কয়েকটি লিপি, নোয়াখালিতে দু-একটি মূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে, কিন্তু তাহার একটিও নবগঠিত সমতলাংশে নয়।
মধ্য বা দক্ষিণ বঙ্গের নবভূমি
মধ্য বা দক্ষিণ-বঙ্গে পুরাভূমির অস্তিত্ব কোথাও নাই; এই ভূমি একেবারে পদ্মা-ভাগীরথী-মধুমতীর সৃষ্টি, এবং বাঙলার নবভূমির অন্তর্গত; শতাব্দীর পর শতাব্দীর পলিমাটি জমিয়া জমিয়া এই ভূখণ্ডকে এক ধারে বন্যা ও অন্য ধারে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার উর্ধের্ব উৎক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছে। খাড়িমণ্ডল-ব্র্যাঘাতটী-সমতট প্রভৃতি নাম লক্ষণীয়। নদীয়া জেলার কিয়দংশ, যশোহর, খুলনা, এবং চব্বিশ-পরগনা এই ভূখণ্ডের অন্তর্গত। সমতট অবশ্যই সমতল-ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল—তাহার একাধিক লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান-কিন্তু সমতল ত্রিপুরাও তো ফরিদপুরের মতো নবভূমিরই অংশ। তবে ইহাদের মধ্যে নদীয়া-যশোর, এবং বোধহয় চব্বিশ-পরগনা ফরিদপুর-ঢাকা-ত্রিপুরার মতো পুরাতন গঠন, আর, খুলনা-বাখরগঞ্জ সমতল নোয়াখালি বা সমতল-চট্টগ্রামের মতো নূতন গঠন। চব্বিশ-পরগনার গাঙ্গেয় অঞ্চল তো সুপ্রাচীন জনাবাস ও সভ্যতার কেন্দ্ৰই ছিল।
সমতট
য়ুয়ান-চোয়াঙ সমতটেও আসিয়াছিলেন। তিনি বলিতেছেন, এই সমতট সমুদ্র-তীরবর্তী দেশ; ইহার ভূমি জলীয় এবং সমতল। ইহার শস্যসম্ভার বা জনসমৃদ্ধি সম্বন্ধে তিনি কিছুই বলেন নাই। য়ুয়ান-চোয়াঙের সমতট তদানীন্তন যশোর-ফরিদপুর-ঢাকা অঞ্চল বলিয়াই যেন মনে হয়; অন্তত খুলনা-বাখরগঞ্জের ভূখণ্ড যে নয় এ অনুমান বোধহয় করা চলে। তখন বোধহয় এইসব অঞ্চল ভালো করিয়া গড়িয়াই উঠে নাই। আগেই দেখিয়াছি, ষষ্ঠ শতকে ফরিদপুরের কোটালিপাড়া অঞ্চল নূতন সৃষ্ট হইয়াছে মাত্র, তখনও তাহার নাম ‘নব্যারকাশিকা’, এবং সম্ভবত এই জনপদ তখন প্রায় সমুদ্রতীরবর্তী। বাখরগঞ্জের ‘নাব্য’ অঞ্চল তাহার অনেক পরের সৃষ্টি। ঐতিহাসিক কালে নূতন ভাঙাগড়া উলট-পালট বাঙলার এই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেই বেশি হইয়াছে।
জলবায়ু, বসন্ত বায়ু, বৰ্ষা ও হেমন্তের বাঙলা
জলবায়ু সম্বন্ধে য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য ভূ-প্রকৃতি প্রসঙ্গে কিছু কিছু জানা গিয়াছে; মোটামুটি একটা ধারণা তাহা হইতেই পাওয়া যায়। বাঙলার জলবায়ু এখনও নাতিশীতোষ্ণ; তবে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষত বীরভূমে, বর্ধমানের পশ্চিমাংশে এবং কতকটা মেদিনীপুরেও, গ্ৰীষ্মের তাপ প্রখরতার; অন্যত্র গ্ৰীষ্মের বায়ু উষ্ণ জলীয়। য়ুয়ান-চোয়াঙ তাহা লক্ষ্য ও বিবরণীবদ্ধ করিতে ভোলেন নাই। কিন্তু বাঙলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য হইতেছে। পূর্ব ও উত্তর-বঙ্গের বারিপাতবাহুল্য। এই বারিপাত ভারত-মহাসাগরবাহিত মৌসুমীবায়ুসঞ্জাত। এই বায়ু হিমালয়, গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়াপাহাড়ে প্রতিহত হইয়া সমগ্ৰ উত্তর ও পূর্ব-বাঙলাকে, বিশেষভাবে, দাৰ্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, রংপুর, পাবনা, বগুড়া, মৈমনসিং, শ্ৰীহট্ট, ফরিদপুর, বরিশালকে অবিরল বারিপাতে ভাসাইয়া দেয়। আর-একটি বায়ু-প্রবাহ বসন্তের। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের দক্ষিণা বাতাসের বৃপকচ্ছলে এই প্রবাহের কিঞ্চিৎ আভাস বোধহয় ধোয়ী কবির ‘পবনদূতে’ পাওয়া যায়। লক্ষণসেন যখন দিগ্বিজয়-উদ্দেশে দক্ষিণ-ভারতে গমন করেন তখন কুবলয়াবতী নামে মলয়পৰ্বতের এক গন্ধৰ্ব্বনারী তাহার প্রতি প্রেমাকৃষ্ট হন; বসন্তাগমে কুবলয়াবতী লক্ষণসেনের বিরহ সহ্য করিতে না পারিয়া বসন্ত পবনকে দূত করিয়া প্রেরণ করেন। এই বসন্ত পবন উত্তর-পূর্ববাহী, এবং যেহেতু ইহা মলয়পৰ্বত স্পর্শ করিয়া আসে সেই হেতু কাব্যসাহিত্যে বসন্তের বাতাসের নাম মলয় পবন। কুবলয়াবতী পবনদূতকে মলয় পর্বত হইতে উত্তর-পূর্ববাহী হইয়া গৌড়ে লক্ষণসেন-সমীপে যাইতে আদেশ করিয়াছিলেন; দূত সে আদেশ পালন করিয়াছিল, তবে পথে হয়তো বিভ্রান্ত হইয়া অনেক বিপথ বিদিক ঘুরিয়া তবে রাজধানী বিজয়পুরে আসিয়া পৌছিয়াছিল। যাহা হউক, এই কাহিনীতে বাঙলার বসন্তকালীন পবন-প্রবাহের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। সংকলনকর্তা শ্ৰীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত-নামক সংকলন-গ্রন্থে বিভিন্ন বাঙালী কবির রচিত বায়ু প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক বর্ণনাময় কতকগুলি শ্লোক উদ্ধৃত আছে। দক্ষিণ-বায়ুর বর্ণনা প্রসঙ্গে দক্ষিণাপথের বিভিন্ন দেশের তরুণীদের আশ্রয়ে দুইজন অজ্ঞাতনামা কবি বেশ রোম্যান্টিক কবি-কল্পনার পরিচয় দিয়াছেন। বারিবাহী মৌসুমী বায়ুর কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক উল্লেখ ও বর্ণনা পাওয়া যাইতেছে না; তবে, রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপিতে বাঙলাদেশের অবিরল বারিপাতের একটু সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে। বাঙলাদেশ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, এই দেশে বারিপাতের কখনও বিরাম ছিল না। (Vangaladesa where the rain water never stopped) বর্ষার অবিরল বৃষ্টিপাত তো এখনও পূর্ব ও দক্ষিণ-বঙ্গের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য। একাদশ-দ্বাদশ শতকের বাঙলার বর্ষার একটি বাস্তব সুন্দর ছবি আঁকিয়াছেন কবি যোগেশ্বর (ইনি বাঙালী ছিলেন, এতটুকু সন্দেহ নাই), এবং ছবিটি গ্রাম্য নায়ক তথা কৃষক যুবকের সুখস্বপ্নেরও। উদ্ধার-লোভ সংবরণ করা কঠিন।
ব্রীহিঃ স্তম্বকারিঃ প্রভূত পয়সঃ প্রত্যাগতা ধেনবঃ
প্রত্যুজ্জীবিতমিক্ষুণা ভূশমিতি ধ্যায়ন্ত্রপেতানাধীঃ।
সান্দ্রোশীর কুটুম্বিনী স্তনভর ব্যালুপ্তঘর্মক্লমো।
দেবে নীরমুদারমুজ্ঝতি সুখং শেতে নিশাং গ্রামণীঃ৷ সিদুক্তিকর্ণামৃত, ২/৮৪/৩]
প্রচুর জল পাইয়া ধান চমৎকার গজাইয়া উঠিয়াছে, গোরুগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে; ইক্ষুর সমৃদ্ধিও দেখা যাইতেছে; [কাজেই] অন্য কোনও ভাবনা আর নাই; ঘর্মক্লান্তিমুক্ত স্ত্রীও ঘরে এই অবসরে উশীর প্রসাধন করিতেছে; বাহিরে আকাশ হইতে জল ঝরিতেছে প্রচুর, গ্রাম্য যুবক সুখে শুইয়া আছে।
প্রাচ্যদেশ বাঙলাদেশ যে প্রচুর জল এবং প্রচুর বারিপাতেরই দেশ, তাহা তো পাল-লিপির প্রসিদ্ধ ‘দেশে প্রাচি প্রচুর পয়সি স্বচ্ছমাপীয় তোয়ং’ পদেই প্রমাণ। আর, ‘গুরু-গভীর ঘন বর্ষায়’ মেদুর আকাশকে ‘মেঘৈর্মেদুরমম্বরম’ বলিয়া বাঙালী কবি জয়দেব যে অভিনন্দন জানাইয়াছেন, এবং তার শ্যাম মহিমাকে যে চিত্রে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন, তাহা তো বাঙালীর একান্তই সুপরিচিত এবং তাহা বাঙলাদেশ সম্বন্ধেই প্রযোজ্য বলিয়া মনে হয়।
যে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ কাব্য-সংকলন গ্ৰন্থ হইতে বর্ষার বাঙলার উপরোক্ত চিত্রটি উদ্ধার করা হইয়াছে, সেই গ্রন্থ হইতেই হেমন্তের বাঙলার আর একটি ছবি উদ্ধারের লোভ সংবরণ করা গেল না; এটি একটি অজ্ঞাতনামা (বোধহয় বাঙালী) কবির রচনা, এবং ধান্য ও ইক্ষুসমৃদ্ধ বাঙলার অগ্রহায়ণ-পৌষের অনবদ্য, মধুর বাস্তব চিত্র।
শালিচ্ছেদ-সমৃদ্ধ হালিকগৃহাঃ সংসৃষ্ট-নীলোৎপল
স্নিগ্ধ-শ্যাম-যব-প্ররোহ-নিবিড়ব্যাদীর্ঘ-সীমোদেরাঃ।
মোদন্তে পরিবৃত্ত-ধেন্বনডুহচ্ছাগাঃ পলালৈনবৈঃ
সংসত্তা-ধ্বনিদিষ্ণু যন্ত্রমুখরা গ্ৰাম্য গুড়ামোদিনঃ৷ [সদুক্তিকর্ণামৃত, ২/১৩৬/৫]
কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধান্যে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে। [আঁটি আঁটি কাটা ধান আঙিনায় স্তুপীকৃত হইয়াছে—পৌষ মাসে এখনও যেমন হয়]; গ্রাম সীমান্তের ক্ষেতে যে প্রচুর যব হইয়াছে তাহার শীষ নীলোৎপলের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম; গোরু, বলদ ও ছাগগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নূতন খড় পাইয়া আনন্দিত; অবিরত ইক্ষুযন্ত্র ধ্বনিমুখর [আখ মাড়াই কলের শব্দে মুখরিত] গ্রামগুলি [নুতন ইক্ষু] গুড়ের গন্ধে আমোদিত।
লোক-প্রকৃতি
লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য হইতে ইতিপূর্বেই পাওয়া গিয়াছে। কজঙ্গলের লোকেরা স্পষ্টাচারী, গুণবান এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান; পুণ্ড্রবর্ধনের লোকেরাও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবান। কামরূপের লোকেরা সদাচারী হওয়া সত্ত্বেও হিংস্র৷ প্রকৃতির; তাম্রলিপ্তির লোকেরা বুঢ়াচারী কিন্তু তাহারা কর্মঠ ও সাহসী; সমতটের লোকেরা কর্মঠ; কর্ণসুবর্ণের লোকেরা ভদ্র ও সচ্চরিত্র এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুপোষক; তাম্রলিপির লোকেরাও জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুরাগী। কিন্তু লোক-প্রকৃতির ব্যক্তিগত বিবরণ যথেষ্ট বস্তুগত ও প্রামাণিক সাক্ষ্য বলিয়া গ্রহণ করা কঠিন। প্রথমত, এ ব্যাপারে দর্শক বা পর্যবেক্ষকের ব্যক্তিগত লুচি-অরুচির প্রশ্ন অনিবার্য; দ্বিতীয়ত, দুই-একটি বিচ্ছিন্ন, প্রসঙ্গবৰ্জিত উদাহরণ হইতে সাধারণভাবে কয়েকটা মন্তব্যে পৌঁছানও এইসব লেখক ও পর্যবেক্ষকের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়! তৎসত্ত্বেও বিদেশী ও ভিনাপ্রদেশী লােকেরা বিভিন্ন সময়ে বাঙালীর লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কী কী বিভিন্ন ধারণা পোষণ করিতেন তাহার একটু হিসাব লওয়া হয়তো নিরর্থক নয়।
গৌড়-বঙ্গ
‘কামসূত্র’-রচয়িতা বাৎস্যায়ন (তৃতীয়-চতুর্থ শতক) বলিতেছেন, তাহার সময়ে প্রাচ্যদেশের লোকেরা মধ্যদেশের জনসাধারণ অপেক্ষা যৌন ও মিথুন ব্যাপারে অনেক বেশি শিষ্ট ছিল। প্রাচ্যদেশের অন্যান্য অনেক বিভাগের সঙ্গে গৌড় ও বঙ্গ এই দুইটি বিভাগ তিনি জানিতেন; কাজেই তাহার এই মন্তব্য গৌড়-বঙ্গ সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই প্রযোজ্য। কদৰ্যতম যৌন অনাচার হইতে তাহারা মুক্ত ছিল; তবে এই দেশেরই রাজান্তঃপুরের–সব দেশে-কালেই যেমন হইয়া থাকে-মহিলারা তাহাদের কামবাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য নানারূপ কৌশল অবলম্বন করিতেন। গৌড়বাসীরা সুপুরুষ ছিল, এ সাক্ষ্য বাৎস্যায়ন দিতেছেন, এবং গৌড়-নারীরা যে মৃদুভাষিণী, মৃদু-অঙ্গা এবং অনুরাগবতী ছিলেন তাহাও বলিতেছেন। তাহা ছাড়া তিনি একটি কৌতুহলোদ্দীপক খবরও দিতেছেন; তাহা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে। গৌড়-পুরুষেরা আঙুলের সৌন্দর্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং মহিলারা নাকি তাহাতে খুব আকৃষ্ট হইতেন। গৌড়দেশের বিভিন্ন নাগরিক এবং বিদগ্ধ নারীদের নানাপ্রকার কাম এবং বিলাস লীলার বিবরণ পড়িলে বাঙলার নগর-সভ্যতা তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম শতকে যৌনব্যাপারে খুব যে নীতি ও সংযমপরায়ণ ছিল, অবশ্য বর্তমান আদর্শে, তাহা তো মনে হয় না। কিন্তু এ প্রসঙ্গ গ্রন্থের অন্যত্র আলোচিত হইয়াছে।
গৌড়বাসী সম্বন্ধে আরও খবর পাওয়া যাইতেছে। বাঙালীদের বিদ্যাচর্চায় অনুরাগের সাক্ষ্য য়ুয়ান-চোয়াঙের নিকট হইতে আগেই পাওয়া গিয়াছে। তাহা ছাড়া, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণে, নানা তিব্বতী গ্রন্থে, অসংখ্য ভিনাপ্রদেশের লিপিমালা এবং সাহিত্যগ্রন্থ হইতে অনবরতই দেখা যাইতেছে, এখনকার মতো প্রাচীন কালেও বাঙালী ছাত্র ও শিক্ষকরূপে ভারতবর্ষের সর্বত্র এবং ভারতবর্ষের বাহিরে যাতায়াত করিত। কবি ক্ষেমেন্দ্র তাহার “দেশোপদেশ’ গ্রন্থে কাশ্মীরে গৌড়দেশের ছাত্রদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিতেছেন, এইসব ছাত্রর দেহ এত ক্ষীণ যে, হস্তম্পর্শেই ইহাদের দেহ ভাঙিয়া পড়িবে বলিয়া যেন মনে হয়, কিন্তু কাশ্মীরের জল-হাওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই তাঁহাদের প্রকৃতি উদ্ধত হইয়া উঠে, এবং স্বল্পমাত্র উত্তেজনাতেই একেবারে সহসা মারমুখী হইয়া উঠে। একবার এইরূপ একটু উত্তেজনার ফলে তাহারা এক দোকানদারকে জিনিসের দাম দিতে অস্বীকার করে এবং মুহুর্তমধ্যেই ছুরিকাঘাতে উদ্যত হয়। গৌড়বাসীর এই অচির-ক্ৰোধপরায়ণতা এবং কলহপ্রিয়তা ‘মিতাক্ষরা’-লেখক বিজ্ঞানেশ্বরও বেশ লক্ষ করিয় ছিলেন।
সুহ্ম-রাঢ়
কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যে (আনুমানিক পঞ্চম শতক) রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে সুহ্মদের উল্লেখ আছে; কবি বলিতেছেন, বেতসলতা যেমন অবনত হইয়া নদীর স্রোতাবেগ হইতে আত্মরক্ষা করে, সুহ্মদেশীয় লোকেরা অবনত হইয়া উদ্ধত-উচ্ছেদকারী সেই রঘুর হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিয়াছিল। কবির এই উক্তির মধ্যে সুহ্মদেশীয়দের লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত আছে কিনা বলা শক্ত, কারণ টীকাকার মল্লিনাথ, বৈতসীবৃত্তি সম্বন্ধে এ প্রসঙ্গে কৌটিল্যের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছেন; “বলীয়সাভিযুক্তো দুর্বলঃ সর্বত্ৰানুপ্রাণতো বেতসধৰ্মমাতিষ্ঠেৎ৷”। সুহ্মেরা রঘু সম্বন্ধেই এইরূপ বৈতসীবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলেন, না দুর্বল বলিয়া এইরূপ বৃত্তিই ছিল জনসাধারণের প্রকৃতি, তাহা বলা কঠিন।
মহাবীর ও তাহার কয়েকজন শিষ্যকে ধর্মপ্রচারোদ্দেশে পথহীন লাঢ়দেশে, বজ্র (ব্ৰহ্ম?) ও সুহ্মভূমিতে, ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছিল (আনুমানিক ষষ্ঠ শতক, খ্ৰীষ্টপূর্ব)। এই গল্পটি জৈনদের ধর্মগ্রন্থ ‘আচারাঙ্গসূত্রে’ বর্ণিত আছে। অন্যত্র তাহা সবিস্তারে উল্লেখ করিয়াছি। এই উপলক্ষে, এই কাহিনীটিতে রাঢ়বাসীদের বৃঢ় আচরণের এবং বজ্জভূমিবাসীদের কুখাদ্য ভক্ষণের প্রতি ইঙ্গিত আছে। তাহা ছাড়া, ‘আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প’ (অষ্টম শতক) গ্রন্থে গৌড় ও পুণ্ড্রের ভাষাকে অসুরভাষা বলা হইয়াছে, সে কথাও আগে অন্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি। মহাভারতে সমুদ্রতীরবাসী বঙ্গদের স্লেচ্ছ এবং ভাগবত-পুরাণে সুহ্মদের ‘পাপ’ কোম বলা হইয়াছে। ‘বোধায়ন ধর্মসূত্রে’ বলা হইয়াছে, মধ্যদেশ বা আর্যবর্ত হইতে বঙ্গদেশে গেলে ফিরিয়া আসিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়; এই দুই দেশ অশিষ্টভূমির অন্তর্গত এবং লোকেরা ‘সংকীর্ণ-যোনয়ঃ’। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এই সমস্ত উক্তি আর্যভাষাভাষী, আর্য-সংস্কৃতিসম্পন্ন লোকদের; গোঁড়-পুণ্ড্র-বঙ্গের অনার্য বা আর্যপূর্ব লোকদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে ইহাদের জ্ঞানও ছিল না, শ্রদ্ধা-ভক্তিও ছিল না; তাহারা সেই সুপ্রাচীনকালে ইহাদের অবজ্ঞার চোখেই দেখিতেন। কিন্তু আশ্চর্য এই, রাঢ়দেশবাসী মুকুন্দরামও “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যে রাঢ়দেশবাসীকে একটু বুঢ়া এবং হিংস্র প্রকৃতির লোক বলিয়াছেন। রাঢ়দেশের লোকেরা যে একটু বুঢ়া এবং অশিষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাহা ঘনরামের ‘ধর্মমঙ্গলে’র একটি পদেও সুস্পষ্ট। মুকুন্দরাম লিখিয়াছেন :
অক্ষটি হিংশক রাড় চৌদিকে পশুর হাড়।
কৃতাঞ্জলি বীর কহে হই গ চোয়াড়।
লোকে না পরস করে সাভে বলে রাড় ॥
ঘনরাম লিখিয়াছেন :
জাতি রাঢ় আমি রে, করমে রাঢ় তু।
দক্ষিণ-রাঢ়ের ব্রাহ্মণেরা যে দাম্ভিক প্রকৃতিক লোক ছিলেন তাহার একটু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্ৰবোধচন্দ্ৰোদয়’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে। কৃষ্ণমিশ্র এই ব্ৰাহ্মণদের একটু ব্যঙ্গই করিয়াছেন। অহংকাররূপী ব্ৰাহ্মণের যে চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন তাহা উজ্জ্বল এবং উপভোগ্য। জন্মদেশ, জনপদ এবং নগরের, পিতার এবং নিজের অহংকৃত পরিচয়ের পর ব্ৰাহ্মণ-অহংকার বলিতেছেন,
নাম্মাকং জননী তথোজ্জলকুলা সচ্ছেত্রিয়ানাং পুনর
বুঢ়া কাচন কন্যক খলু ময়া তেনাস্মি ততোধিকঃ।
অস্মচ্ছ্যালকভাগিনেয়দুহিতা মিথ্যাভিশপ্ত যতস
তৎসম্পর্কবাশান্ময়া স্বগৃহিণী প্রেয়স্যপি প্রোজ্ঝিতা ॥
ব্ৰাহ্মণ-অহংকারের আত্মশ্লাঘার প্রতি শ্লেষ সত্যই উপভোগ্য!
কবি ধোয়ীও দক্ষিণ-রাঢ়ের (সুহ্মদেশের) প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়াছেন, “রসময় সুহ্মদেশঃ।”
রাজশেখরের ‘কর্পূরমঞ্জরী’ গ্রন্থে হরিকেল (চন্দ্ৰদ্বীপ-শ্ৰীহট্ট-ত্রিপুরা-মৈমনসিং অঞ্চল, হয়তো চট্টগ্রাম অঞ্চলও) দেশের নারীদের খুব স্তুতিবাদ করা হইয়াছে, এবং রাঢ় ও কামরূপের নারীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতরা বলা হইয়াছে। রাজশেখর গৌড়াঙ্গানাগণের বেশভূষার বর্ণনা করিয়া যে তুতিবাদ করিয়াছেন ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে (১২০৬) তাহা উদ্ধৃত হইয়াছে। এই গ্রন্থেই কোনও এক অজ্ঞাত কবির রচিত (পূর্ব) বঙ্গীয় নারীদের সাজ-সজ্জা বর্ণনার একটি শ্লোক উদ্ধার করা হইয়াছে। অন্য আর একজন কবি বাঙলার গ্রাম্য তরুণীর বর্ণনা দিয়া আর একটি শ্লোক বাধিয়াছেন, তাহাও এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই সব শ্লোক অন্যত্র উদ্ধার ও আলোচনা করিয়াছি (আহার-বিহার, বসন-ব্যাসন, দৈনন্দিন জীবন প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য)।
প্রাচীন বাঙলার ফলফুল বৃক্ষলতা-শস্যসম্ভারের এবং অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্য ইত্যাদির পরিচয় দেশ-পরিচয়েরই অংশ; ধনসম্বল অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে সবিস্তার উল্লেখ করা হইয়াছে। ধান, যুব, পাট, ইক্ষু, সরিষা, আম, মহুয়া, কাঁটাল, নানাবিধ বস্ত্ৰ-সম্ভার, ধাতুদ্রব্য, খনিজ দ্রব্য, লবণ, পান, গুবাক, নারিকেল, বাঁশ, মাছ, ডালিম, ডুমুর (পর্কটী), খেজুর, পিপ্পল, এলাচ ইত্যাদি শস্য ও দ্রব্যসম্ভার কোথায় কী উৎপাদিত হইত। তাহাও সেই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হইয়াছে। জীবজন্তু সম্বন্ধেও একই কথা। বর্তমান ও পূর্বোক্ত অধ্যায়েই ব্যাঘু, হন্তী, হরিণ, ঘোড়া, বানর, গোরু, ভেড়া, ছাগল, কুকুট, বরাহ, নানা প্রকারের মাছ ইত্যাদির কথাও বলা হইয়াছে।
০৬. জনপদ বিভাগ, বাঙলা নামের উৎপত্তি
আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাঙলাদেশ। মুঘল আমলে এই দেশ সুবা বাঙলা নামে পরিচিত ছিল। আবুল ফজল তাহার ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাঙলা-বাঙ্গালা নামের ব্যাখ্যাও দিয়াছেন। বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আলী (সংস্কৃত আলি, পূর্ববঙ্গীয় আইল) যুক্ত হইয়া বাঙ্গাল বা বাঙ্গালা শব্দ নিম্পন্ন হইয়াছে, ইহাই আবুল ফজলের ব্যাখ্যা। আল শুধু শস্যক্ষেত্রের আলি নয়, আল ছোটবড় বাঁধও বটে। এই নদীমাতৃক বারিবহুল দেশে বৃষ্টি, বন্যা এবং জোয়ারের স্রোত ঠেকাইবার জন্য ছোটবড় বাঁধ বাঁধা ছিল কৃষি ও বাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য। যে-সব ভূখণ্ডের বারিপাত কম, ভূমি সাধারণত উষর, সেখানেও বর্ষার জল ধরিয়া রাখিবার জন্য ছোটবড় বাঁধ বাঁধা প্রয়োজন হইত, এখনও হয়, যেমন বীরভূম অঞ্চলে। প্রাচীন লিপিতে এই ধরনের বাঁধের পুনঃপুন উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, যেমন, বিশ্বরূপসেনের মদনপাড়া লিপিতে এবং অন্যান্য অসংখ্য লিপিতে। এ-রকম দুটি চারটি বৃহৎ বাঁধ এখনও প্রাচীন অভ্যাসের স্মৃতি বহন করিতেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ রংপুর-বগুড়ার ভীমের (কৈবর্তরাজ ভীমের?) জাঙ্গাল বা ভীমের ডাইঙ্গ, বীরভূমের সিউড়ি অঞ্চলের দুই চারটি বাধের উল্লেখ করা যায়। আমার অনুমান, আবুল ফজলের ব্যাখ্যার অর্থ এই যে বঙ্গদেশ আল বা আলিবহুল, যে বঙ্গদেশের উপরিভূমির বৈশিষ্ট্যই হইতেছে আল সেই দেশই বাঙ্গালা বা বাঙলাদেশ। এই আলগুলিই আবুল ফজলের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল; তাহার ব্যাখ্যা পড়িলে এই কথাই মনে হয়। Gastaldi (1560), Hondivs (1613), Hermann Moll (1710), Van den Broucke (1660), Izzak Tirion (1730), F. de Witt (1726) প্রভৃতির নকশায়, মধ্যযুগের যুরোপীয় পর্যটকদের বিবরণীতে, সর্বত্রই এই দেশের নাম পাইতেছি Bengala, এবং ইহারা দক্ষিণের সাগরটির নাম Golfo of Bengalবা Gulf of Bengal বলিয়া। মধ্যযুগের বাঙলা-বাঙ্গালা-Bengala একই নাম। Marco Polo এই দেশের নাম বলিতেছেন। Bengala, যদিও তাহার অবস্থিতিনির্দেশ স্পষ্টই ভ্ৰমাত্মক। যাহাই হউক, বাঙ্গালা-Bengala-Bangala-বাঙলা নাম বর্তমান বঙ্গদেশের মোটামুটি প্রায় সমস্তটারই; কোনও কোনও দিকে বর্তমান সীমা অতিক্রমও করিয়াছে, মধ্যযুগীয় সাক্ষ্যে তাহা সুস্পষ্ট। কিন্তু প্রাচীন বাঙলায় বঙ্গ বঙ্গাল বলিতে যে দেশখণ্ড বুঝাইত তাহা বর্তমান বঙ্গ বা বাঙলাদেশের সমার্থক নয়; তাহার একটি অংশ মাত্র। প্রাচীন বাঙলাদেশ যে-সব জনপদে বিভক্ত ছিল বঙ্গ ও বঙ্গাল তাহার দুইটি বিভাগ মাত্র। এই দুইটি বিভাগের নাম হইতেই বর্তমান এবং মধ্যযুগীয় সমগ্র বাঙলাদেশ নামটির উৎপত্তি। কাজেই, প্রাচীন বাঙলার জনপদ-বিভাগের কথা বলিতে গিয়া সর্বাগ্রে এই বিভাগ দুইটির কথাই বলিতে হয়।
কিন্তু তাহার আগে জনপদ-বিভাগ সম্বন্ধে সাধারণ দু’একটি কথা বলিয়া লওয়া দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রাচীনতর সাক্ষ্যে, জনপদগুলির নাম যেভাবে আমরা পাই, তাহা ঠিক জনপদ বা স্থানের নাম নয়-কোমের নাম যথা-বঙ্গাঃ, রাঢ়াঃ, পুণ্ড্রাঃ, গৌড়াঃ, অর্থাৎ বঙ্গ জনাঃ, গৌর জানাঃ, পুণ্ড্র জনাঃ, রাঢ়া জনাঃ, বঙ্গ-গৌড়-পুণ্ড্র-রাঢ় কোম (tribe অর্থে)। এইসব জনাঃ বা কোম যে-সব অঞ্চলে বাস করিত, পরে তাহাদের, অর্থাৎ সেই সেই অঞ্চলের নাম হইল বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ড্র ইত্যাদি। এইভাবে বহুবচনে জনবাচক অর্থে এইসব নামের ব্যবহার একাদশ-দ্বাদশ শতকের সাক্ষ্যপ্রমাণেও দেখা যায়। দু-এক ক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রমও আছে, যেমন সুবভি বা সুহ্মভূমি, বজজ বা বজ্রভূমি (ব্ৰহ্মভূমি?)। দ্বিতীয়ত, জন হইতে বা জনকে কেন্দ্ৰ করিয়া গঠিত এক-একটি জনপদে এক এক সময়ে এক-একটি রাষ্ট্র বা রাজবংশের আধিপত্য স্থাপিত হইয়াছে, এবং অনেক সময়ে তাহাদের রাষ্ট্ৰীয় আধিপত্য সংকোচ বা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জনপদটির সীমাও সংকুচিত বা বিস্তারিত হইয়াছে। পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্রদের জনপদকে কেন্দ্ৰ করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্য (সপ্তম শতক) এবং পরে পাল ও সেন রাজাদের আমলে পুণ্ড্র-পৌণ্ড্রবর্ধনভূক্তি বা পৌণ্ড্রভুক্তি। এই ভুক্তিটি এক সময় হিমালয়-শিখর হইতে আরম্ভ করিয়া (দামোদরপুর লিপি, পঞ্চম শতক) সমূদ্র পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। (খাদশ শতকে বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষদ লিপি দ্রষ্টব্য)। ১২৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দের মোহার লিপি অনুসারে ত্রিপুরা জেলাও এই ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ প্রাচীন পুণ্ড্র বা পীেণ্ড জনপদ গড়িয়া উঠিয়াছিল বগুড়া-দিনাজপুর-রাজশাহী-রংপুর জেলাকে কেন্দ্ৰ করিয়া। বর্ধমান রাঢ়দেশের একটি অংশমাত্র ছিল, অথচ এক সময় এই বর্ধমান রাষ্ট্রবিভাগে রূপান্তরিত হইয়া বর্ধমানভুক্তি নাম লইয়া শুধু উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ন্দেশকেই নয়, দণ্ডভুক্তিমণ্ডলকেও গ্রাস করিয়াছিল। দণ্ডভুক্তি মেদিনীপুর জেলার বর্তমান দাতন অঞ্চল; এই অঞ্চল সপ্তম শতকে তাম্রলিপ্তি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ হইতে তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। সুহ্মদেশ মোটামুটি দক্ষিণ-রাঢ়ের সমার্থক; মহাভারতে তাম্রলিপ্তিকে সুহ্মদেশ হইতে পৃথক বলা হইয়াছে; অধিকাংশ প্রাচীন সংক্ষ্যের ইঙ্গিতও তাঁহাই। কিন্তু ‘দশকুমার-চরিত’ গ্রন্থে দামলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তকে সুহ্মের অন্তর্ভুক্ত বলা হইয়াছে। জৈন প্রজ্ঞাপনায় তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্তকে আবার বঙ্গের অন্তর্ভুক্তও বলা হইয়াছে, অথচ প্রাচীন সাক্ষের সর্বত্রই ইঙ্গিত এই যে, বঙ্গ ভাগীরথীর পূর্ব-তীরে। এই দৃষ্টান্ত হইতে সহজেই বুঝা যায়, রাষ্ট্র-পরিধির বিস্তার ও সংকোচের সঙ্গে সঙ্গে এক এক সময় এক এক জনপদের সীমাও বিস্তারিত ও সংকুচিত হইয়াছে, সব জনপদের সীমা সকল সময় এক থাকে নাই। আসল কথা, প্রাকৃতিক সীমা ও রাষ্ট্রসীমা সর্বত্র সকল সময় এক হয় না, প্রাচীন বাঙলায় হয় নাই। জনপদ বৃত্তান্ত পাঠের সময় এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন। এই জনপদ কথা বলিবার সময় সেইজন্য প্রাকৃতিক সীমা-নির্ধারণর চেষ্টাই প্রথম কর্তব্য, যদিও তোহা সহজসাধ্য নয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রায়শ সুদূর্লভ। দ্বিতীয় কর্তব্য, বিভিন্ন সময়ে নির্দিষ্ট জনপদের রাষ্ট্রসীমার বিস্তার ও সংকোচ, এবং তাহার বিভিন্ন রাষ্ট্রগত ও সংস্কৃতিগত বিভাগের নির্দেশ। এ কাজ অত্যন্ত কঠিন; কারণ এ ক্ষেত্রেও সাক্ষ্য-প্রমাণ সুলভ নয়। তবু, যতটা সম্ভব মোটামুটি একটা ধারণা গড়িয়া তোলার চেষ্টা করা যাইতে পারে। তৃতীয়ত, খুব প্রাচীন কাল হইতেই নানা প্রসঙ্গে বাঙলার বিভিন্ন জনপদের উল্লেখ প্রাচীন গ্রন্থাদি এবং লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। এইসব উল্লেখ সুবিদিত এবং বহু আলোচিত। কাজেই, এ প্রসঙ্গে তাহার পুনরালোচনার কিছু প্রয়োজন নাই। যে সব উল্লেখ্য, যে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ জনপদগুলির সীমা ও অবস্থিতি নির্ণয়ের সহায়ক, শুধু তাহাদের উল্লেখ ও আলোচনাই এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তাহা ছাড়া, প্রাচীনতর উল্লেখ যাহা পাইতেছি তাহা সমস্তই আর্যভাষাভাষী আর্য-সংস্কৃতিসম্পন্ন লোকদের গ্রন্থ হইতে, যাহারা আর্যপূর্ব বা অনার্য ভাষা ও সংস্কৃতির উপর শ্রদ্ধাবান ছিলেন না এমন লোকদের নিকট হইতে, এ কথাও মনে রাখা দরকার।
বঙ্গ, বঙ্গের পশ্চিম সীমা
বঙ্গ অতি প্রাচীন দেশ। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে বোধহয় সর্বপ্রথম এই দেশের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়; “বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ” পদে বঙ্গজনদের বগধদের সঙ্গে যুক্ত করা হইয়াছে। বগধ বোধহয় মগধ, এই অনুমান অনৈতিহাসিক না-ও হইতে পারে। এই গ্রন্থের ঋষিরা বঙ্গকে মগধের প্রতিবেশী জনপদ বলিয়াই জানিতেন বলিয়া মনে হয়। বোধায়নের ‘ধর্মসূত্রে’ বঙ্গ জনপদটিকে কলিঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে, এমন অনুমান করিলে ভুল হয় না; আরট্র, পুণ্ড্র, সৌবীর, বঙ্গ ও কলিঙ্গাজনেরা একেবারে বৈদিক সংস্কৃতিবহির্ভূত, এবং তাহাদের দেশে যাতায়াত করিলে ফিরিয়া আসিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, বোধায়ন এইরূপ নির্দেশ দিয়াছেন। মহাভারতে দেখিয়াছি, ভীম দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া মুদগগিরি (মুঙ্গের) রাজকে হত্যা করিয়া কোশীনদী-তীরবর্তী পুণ্ড্ররাজকে পরাজিত করেন; তাহার পর, পর পর তিনি বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কৰ্কট, সুহ্ম, প্রসুহ্ম রাজাদের এবং অনেক স্লেচ্ছ কোমদের পরাভূত করেন। মহাভারতের আদিপর্বে বঙ্গজনপদের উল্লেখ করা হইয়াছে অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুহ্মজনদের সঙ্গে; সভাপর্বে পুণ্ড্রদের সঙ্গে! ‘রামায়ণে’ও অন্যান্য জনদের সঙ্গে বঙ্গজনদের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়; সকলেই অযোধ্যার অভিজাত-বংশীয়দের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন, এইরূপ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সিংহলী মহাবংশ’ গ্রন্থে বঙ্গাজনেরা লাল (রাঢ়)-জনপদের সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। ‘প্রজ্ঞাপনা’-নামক একটি জৈন উপাঙ্গে বঙ্গজনদের সঙ্গে লাল (রাঢ়)-জনদের উল্লেখ করিয়া উভয়কেই আর্য বলা হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্তিকে বঙ্গ জনদের অধিকারে বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। ‘মহাভারতের উল্লেখ হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, বঙ্গ পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্ত ও সুহ্মের সংলগ্ন দেশ, এবং প্রত্যেকটি দেশই স্ব-স্বতন্ত্র; কিন্তু জৈন উপাঙ্গটির ইঙ্গিত হইতে মনে হয়, কোনও সময়ে তাম্রলিপ্ত বোধ হয় বঙ্গের অধিকারভুক্ত হইয়া থাকিবে। বঙ্গের উল্লেখ গুন্টুর জেলার নাগাৰ্জনীকোণ্ড (খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয় শতক) শিলালিপিতে, রাজা চন্দ্রের (চতুর্থ শতক) মেহেরৌলি স্তম্ভলিপি এবং বাতাপীর (বাদামী) চালুক্যরাজ পুলকেশীর মহাকুট স্তম্ভলিপি (সপ্তম শতক)-কেও দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু ইহাদের একটিতেও বঙ্গের অবস্থিতি-নির্দেশ পাওয়া যায় না। কালিদাসের (চতুর্থ শতক?)। “রঘুবংশে এই নির্দেশ দেন। অনেকটা স্পষ্ট। এই কাব্যের চতুর্থ সর্গে রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে পর পর পাঁচটি শ্লোক আছে। প্রথম দুইটি শ্লোকে তালীবিনশ্যাম উপকূলে সুহ্ম-জনপদের পরাজয়ের কথা আছে; তারপরেই তিনি নৌ-সাধনোদ্যত বঙ্গজনদের পরাভূত করিয়া ‘গঙ্গাস্রোতহস্তরে জয়স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন। বঙ্গজনদের উৎখাত এবং প্রতিরোপিত করিয়া পরে তিনি কপিশা (কসাই)-নদী পার হইয়া উৎকলাদিগের প্রদর্শিত পথে কলিঙ্গ অভিমুখে গিয়াছিলেন। টীকাকার মল্লিনাথ ‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু, পদটির টাকা করিয়াছেন ‘গঙ্গায়াঃ প্রবাহনাম দ্বীপেযু; এবং আধুনিক ঐতিহাসিকেরাও ‘গঙ্গাস্রোতের মধ্যে এই অর্থই করিয়াছেন। এই অর্থ মানিয়া লইলে স্বীকার করিতে হয়, কালিদাসের সময়েও তাম্রলিপ্তি বঙ্গজনপদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং রঘু সুহ্ম অর্থাৎ মোটামুটি দক্ষিণ রাঢ় জয় করিয়া বঙ্গ জয় করেন, এবং কপিশা পার হইয়া উৎকলে যান। কিন্তু মহোদধির তালীবিনশ্যামোপকণ্ঠে উপনীত হইয়া সুহ্ম জয়ের উল্লেখ হইতে আমার মনে হয়, তদানীন্তন তাম্রলিপ্তি সুহ্মদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ ‘দশকুমারচরিত’ গ্রন্থে দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) সুহ্মের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। তাহা হওয়াই স্বাভাবিক; উভয়েই গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিমান্ত সংলগ্ন দেশ, এবং তাম্রলিপ্তিই যথার্থতি সমুদ্রতীরবর্তী তালীবনশ্যাম ভূখণ্ড বলিয়া বর্ণিত হওয়া যুক্তিযুক্ত। তাহা হইলে, বঙ্গ গঙ্গাস্রোতের বামে বা পূর্বদিকে হওয়া উচিত; আমার মনে হয়, ‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু’ বলিয়া কালিদাস গঙ্গাস্রোতের অপর দিকে বুঝাইতে চাহিয়াছেন; অন্তরেষু। অর্থাৎ পার হইয়া। পরবর্তী সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে গঙ্গা-ভাগীরথীই যে বঙ্গের পশ্চিম সীমা, এই ইঙ্গিত বারবার পাওয়া যায়। বঙ্গ-জয়ের পর রঘু আবার পশ্চিমদিকে ফিরিয়া সুহ্মের ভিতর দিয়া, কপিশা পার হইয়া উৎকল-কলিঙ্গে গিয়াছিলেন।
উপবঙ্গ বঙ্গ, প্রবঙ্গ, অনুত্তর-বঙ্গ
‘বৃহৎসংহিতা’য় উপবঙ্গ-নামে একটি জনপদের উল্লেখ আছে। আনুমানিক ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে রচিত ‘দিগ্বিজয়-প্রকাশ’-নামক গ্রন্থে উপবঙ্গ বলিতে যশোর ও তৎসংলগ্ন কয়েকটি কাননময় অঞ্চলের দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে (উপবঙ্গে যশোরাদ্যাঃ দেশাঃ কাননসংযুক্তাঃ)। ‘মনোরথপুরণি এবং অপাদান’-নামক পালি বৌদ্ধগ্রন্থে বঙ্গান্তপুত্ত এবং বঙ্গীশ এই দুইটি অভিধান হইতে মনে হয়, বঙ্গ শব্দটির সঙ্গে এই দুইটি অভিধার কোনও প্রকার যোগ ছিল, কিন্তু তাহাতে বঙ্গ, উপবঙ্গ, বঙ্গান্তদেশের অবস্থিতির কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। প্রবঙ্গ-নামেও আর একটি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রবঙ্গ পরবর্তীকালের অনুত্তর বঙ্গ বা দক্ষিণ-বঙ্গের মতো বঙ্গেরই একটি অংশ হয়তো ছিল; কিন্তু ইহারও অবস্থিতি সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত আমাদের জানা নাই।
গুপ্ত আমলে বঙ্গের দুইটি বিভাগ ছিল বলিয়া মনে হয়। সমাচার দেবের ঘুগ্রহাটি লিপিতে দেখিতেছি, সুবর্ণবীথিতে একজন উপরিকের শাসনকেন্দ্র ছিল। এই সুবর্ণবীথি নব্যাবকাশিকার ছিল বলিয়া মনে হয়। নব্যাবকাশিকা যে ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলের (ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের।) न्म ভূমি তাহা তো আগেই বলিয়াছি। ঢাকা জেলার বর্তমান সুবর্ণগ্রাম (সোনার গাঁ), সোনারাং, সোনাকান্দি প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে প্রাচীন সুবর্ণবীথির একটি অর্থগত যোগ আছে, এ অনুমান বোধহয় সংগত। সুবর্ণবীথির অন্তর্গত ছিল বারকমণ্ডল, এবং লিপিতে উল্লেখ করা হইয়াছে বারকমণ্ডল ছিল প্রাক-সমুদ্রশায়ী। বারকমণ্ডল-মধ্যবর্তী খুঁবিলাটি বর্তমান ফরিদপুর শহরের নিকটবর্তী ধুলট।
পাল ও সেন আমলে বঙ্গ পুণ্ড্রবর্ধনভূমির অন্তর্গত বলিয়া বার বার বলা হইয়াছে, কিন্তু গুপ্ত আমলে বঙ্গ এবং পুণ্ড্রবর্ধন দুই পৃথক রাষ্ট্রবিভাগে ছিল বলিয়া মনে হয়।
পাল ও সেন আমলের লিপিগুলিতে বঙ্গের উল্লেখ বারবার পাওয়া যায়। প্রতিহাররাজ ভোজদেবের গওআলিয়র প্রশস্তিতে দ্বিতীয় নাগভট কর্তৃক বঙ্গপতিকে (ধর্মপাল) পরাভূত করিবার কথা উল্লিখিত আছে (নবম শতক)। পালরাজ রামপালের মন্ত্রীপুত্র কুমারপালের প্রধানামাত্য বৈদ্যদেবের কমীেলি লিপিতে (একাদশ শতক) অনুত্তর-বঙ্গের সমরবিজয়-ব্যাপারের উল্লেখ আছে; সেই প্রসঙ্গে ‘নৌবাটহীহীরব এবং কিঞ্চোৎ-পাতুক-কেনিপাত-পতন-গ্ৰীতসপিতৈঃ শীকরৈঃ’ পদ দুইটির উল্লেখ হইতে অনুত্তর-বঙ্গ যে দক্ষিণ-বঙ্গ এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না। মনে হয়, একাদশ শতকের শেষাশেষি বঙ্গের দুইটি বিভাগ কল্পিত হইয়াছিল; একটি বঙ্গের উত্তরাঞ্চল, আর একটি অনুত্তর বা বঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল। অনুমান হয়, বঙ্গের উত্তরাঞ্চলের উত্তর সীমা ছিল পদ্মা এবং সমুদ্রশায়ী খােলনোলা সমাকীর্ণ দক্ষিণাঞ্চল ছিল অনুত্তর-বঙ্গ। অথবা এমনও হইতে পারে, অনুত্তর-বঙ্গ কোনও বিশিষ্ট স্থানের নাম (proper name) নয়, দক্ষিণ ও পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণনাত্মক নাম মাত্র। যাহাই হউক, কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন এই দুই সেনরাজের আমলে বঙ্গের অন্তত দুইটি বিভাগের নাম পাওয়া যাইতেছে; একটি বিক্রমপুর-ভাগ, অপরটি নাব্য (ভাগ) বা নাব্য (?) মণ্ডল। চন্দ্র ও সেন রাজাদের অনেক লিপিই তো বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার হইতে উৎসারিত। কেশব সেনের ইদিলপুর লিপি ও বিশ্বরূপ সেনের মদনপাড়া লিপিতে বিক্রমপুর-ভাগ পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য-পরিষদ-লিপিতে পাইতেছি নাব্যভাগের উল্লেখ; তাহাও পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি বঙ্গ বিভাগের অন্তৰ্গত, এবং সেই পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির এবং নাব্যভাগের পূর্বতম সীমায় সমুদ্র, তাহা সাহিত্য-পরিষদের লিপিটিতে উল্লিখিত হইয়াছে। এই লিপিটির নাব্যভাগের অন্তর্গত রামসিদ্ধি পাটক বাখরগঞ্জ জেলার গৌরনদী অঞ্চলের একটি গ্রাম। চন্দ্ররাজ শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-পট্টোলীর নাব্যমণ্ডল এবং তদন্তর্ভুক্ত নেহকাঠি যথাক্রমে নাব্যমণ্ডল এবং নৈকাঠি (বাখরগঞ্জ জেলা) হওয়াও কিছুই বিচিত্র নয়। এই প্রসঙ্গে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ফরিদপুর লিপির নব্যাবকাশিকার সঙ্গে নাব্যের সম্ভাব্য সম্বন্ধেরও উল্লেখ করা যাইতে পারে। যাহাই হউক, এইসব লিপিপ্রমাণ হইতে বুঝা যাইতেছে, বাখরগঞ্জ জেলা এবং আরও পূর্বদিকে সমুদ্র পর্যন্ত অঞ্চল সমস্তটাই নাব্য নামে পরিচিত হইয়াছিল, এবং বর্তমান বিক্রমপুর পরগনার সমগ্র এবং ইদিলপুর পরগনার কিয়দংশ লাইয়া ছিল বিক্রমপুর-ভাগ (কেশব সেনের ইদিলপুর লিপি)। সেন লিপিতে বঙ্গ তো শুধু বঙ্গ নয়, সে যে ‘মধুক্ষীরক বঙ্গ-প্রচুর পয়ঃ যে দেশে সে দেশকে কবি মধুক্ষীরক বালিবেন, আশ্চর্য কি?
বঙ্গের অবস্থিতি সম্বন্ধে বাৎস্যায়ন-কামসূত্রের টীকাকার যশোধর তাহার ‘জয়মঙ্গল’ নামীয় টীকায় বলিতেছেন : “বঙ্গা লৌহিত্যাৎ পূর্বেন’ অৰ্থাৎ বঙ্গ লৌহিত্যের পূর্বদিকে। যশোধরের এই উক্তি বিশ্বাস করা কঠিন। প্রথমত, প্রাচ্যদেশগুলি সম্বন্ধে যশোধরের জ্ঞান অত্যন্ত সীমাবদ্ধ; কতকগুলি অত্যন্ত মারাত্মক রকমের ভুল তাহার টীকায় দেখা যায় এবং সেগুলি ইতিপূর্বেই পণ্ডিতদের লক্ষ্যগোচর হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, ইতিপূর্বেই আমরা দেখিয়াছি, সমস্ত বিক্রমপুর পরগনা এবং ফরিদপুর-বাখরগঞ্জেরও কিয়দংশ বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এবং এই সমস্ত ভূখণ্ডই ব্ৰহ্মপুত্রের পশ্চিম দিকে। বর্তমান যমুনাও যদি ব্ৰহ্মপুত্রের প্রাচীনতর কোনও প্রবাহপথ হইয়া থাকে তাহা হইলেও ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ প্রাচীন বঙ্গ বহির্ভূত হইয়া পড়ে। কাজেই যশোধরের উক্তি অবিশ্বাস্য বলিয়া মনে হয়।
হরিকেল, হরিকেলি, হরিকোলা
কোষকার হেমচন্দ্ৰ তাঁহার ‘অভিধান-চিন্তামণি’তে (দ্বাদশ শতক) বঙ্গ ও হরিকেলি-জনপদ এক ও সমাৰ্থক বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন; “চম্পাস্তু অঙ্গা বঙ্গাম্ভ হরিকেলিয়াঃ”। প্রাচ্যদেশের পূর্বতম সীমায় হরিকেল, দুই চীন পরিব্রাজকের (সপ্তম শতক) বিবরণীতে এই খবর জানা যায়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প গ্রন্থে বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল তিনটি স্ব-স্বতন্ত্র কিন্তু প্রতিবেশী জনপদ বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে; এই তিনটি জনপদেই অসুর বুলি প্রচলিত ছিল, তাহাও বলা হইয়াছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত ‘রুদ্রাক্ষ মাহাত্য’ (ত্ম্য) এবং ‘রূপচিন্তামোণিকোষ’ (‘রূপচিন্তামণিকোষ’; পঞ্চদশ শতক) নামক দুইটি পাণ্ডুলিপিতে শ্ৰীহট্ট এবং হরিকোলা-নামক জনপদ দুইটিকে এক এবং সমার্থক বলা হইয়াছে। রাজশেখরের ‘কর্পূরমঞ্জুরী-গ্রন্থে (নবম শতক) হরিকেলি-জনপদের নারীদের খুব স্তুতিবাদ করা হইয়াছে, এবং তাহারা পূর্বদেশবাসিনী তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে। ‘ডাকার্ণব’-গ্রন্থে বর্ণিত চৌষট্টিটি তান্ত্রিক পীঠের একটি পীঠ হারিকেল, এবং এই হরিকেল টিক্কর, খাড়ি, রাঢ় এবং বঙ্গালদেশ হইতে পৃথক। হরিকেলদেশে বৌদ্ধ দেবতা লোকনাথের একটি মন্দিরও বোধহয় ছিল। টিক্কর ‘রামচরিত’ কাব্যের ঢেক্করীয়-ঢেকুরী, কাটোয়ার কাছে, বর্ধমান জেলায়। শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতে শ্ৰীচন্দ্রের পিতা ত্ৰৈলোক্যচন্দ্ৰদেবকে আগে হরিকেল এবং পরে চন্দ্ৰদ্বীপেরও (বাখরগঞ্জ) রাজা বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে। অনুমান হয়, হরিকেল চন্দ্ৰদ্বীপ বা বাখরগঞ্জ অঞ্চলের সংলগ্ন ছিল। কান্তিদেবের চট্টগ্রাম-লিপিতে হরিকেলকে একটি মণ্ডল বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এইসব সাক্ষ্য প্রমাণ হইতে মনে হয়, হরিকেল সপ্তম-অষ্টম শতক হইতে দশম-একাদশ শতক পর্যন্ত বঙ্গ (চন্দ্ৰদ্বীপ ও বঙ্গে) এবং সমতটের সংলগ্ন কিন্তু স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল, কিন্তু ত্ৰৈলোক্যচন্দ্রের চন্দ্ৰস্বীপ অধিকারের-পর হইতেই হরিকেলকে মোটামুটি বঙ্গের অর্ন্তভুক্ত বলিয়া গণনা করা হয়। “ডাকার্ণব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি-দুইটির সাক্ষ্য একত্ৰ করিলে হরিকেল বা হরিকোলা যে শ্ৰীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাহা স্বীকার করিতে আপত্তি হইবার কারণ নাই। আর কাস্তিদেবের লিপি সাক্ষ্যে মনে হয়, সমসাময়িক কালে চট্টগ্রামও হরিকেল-অন্তর্ভুক্ত থাকা কিছু বিচিত্র নয়। শ্ৰীহট্ট চৌষট্টি তান্ত্রিক পীঠের অন্যতম পীঠ। দ্বাদশ শতকে গুজরাতে বসিয়া হেমচন্দ্র যখন তাহার অভিধান লিখিতেছিলেন তখন তাহার পক্ষে বঙ্গ এবং হরিকেল সমার্থক বলা হয়তো খুব অন্যায় হয় নাই। তাহা ছাড়া, তাহার উক্তি একটু শিথিলভাবেই প্রযোজ্য, কারণ, চম্পা অঙ্গদেশের একটি অংশ মাত্র, অবশ্য কেন্দ্রীয় অংশ, অথচ তিনি বলিতেছেন, ‘চম্পাস্তু অঙ্গাঃ’। হরিকেলও সেই হিসাবে বঙ্গের অংশ মাত্র, অবশ্যই রাজা ত্ৰৈলোক্যচন্দ্র দেবের রাজ্যের আদিকেন্দ্র; সে ক্ষেত্রেও তিনি বলিতেছেন, “বঙ্গাস্তু হরিকেলিয়াঃ”। একটু শিথিলভাবে বলা, সন্দেহ কী!
চন্দ্ৰদ্বীপ
এইমাত্র আমরা শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতে ত্ৰৈলোক্যচন্দ্রদেবের প্রসঙ্গে চন্দ্ৰদ্বীপের উল্লেখ দেখিয়াছি (দশম-একাদশ শতক)। ১০১৫ খ্ৰীষ্টাব্দের একটি পাণ্ডুলিপিতেও চন্দ্রদ্বীপের তারামূর্তি ও মন্দিরের ইঙ্গিত আছে। বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য-পরিষদ-লিপিতেও বোধহয় চন্দ্রদ্বীপের উল্লেখ আছে (ত্ৰয়োদশ শতক); এই চন্দ্ৰদ্বীপের ঘাঘরকাট্টিপাটক নিশ্চয়ই ঘাঘরনদীর তীরবর্তী ঘাঘরকাটি-নামক কোনও গ্রাম (বরিশাল জেলার ঝালকাটি প্রভৃতি কাটি-পদান্ত নাম লক্ষণীয়); এই ঘাঘরনদীর তীরেই ফুল্লশ্ৰীগ্রামে মনসার পাঁচালীর কবি বিজয়গুপ্তের (পঞ্চদশ শতক) বাসভূমি ছিল।
“পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূর্বে ঘণ্টেশ্বর।
মধ্যে ফুল্লশ্ৰী গ্রাম পণ্ডিত-নগর।
স্থানগুণে যেই জন্মে সেই গুণময়।
হেন ফুল্লশ্ৰী গ্রামে বসতি বিজয়৷”
মধ্যযুগে চন্দ্ৰদ্বীপ সুপ্রসিদ্ধ স্থান। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের বাকলা পরগনার বাকলা সরকার (বর্তমান বাখরগঞ্জ জেলায়) আর চন্দ্ৰদ্বীপ একই স্থান বলিয়া বহুদিনই স্বীকৃত হইয়াছে। এই চন্দ্ৰদ্বীপ বা বাখরগঞ্জ অঞ্চল যে অন্তত ত্ৰয়োদশ শতকে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাহা তো আগেই দেখিয়াছি।
সমতট
সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে (চতুর্থ শতক) ডবাক-নেপাল–কর্তৃপুর-কামরূপের সঙ্গে, এবং বরাহমিহিরের (ষষ্ঠ শতক) ‘বৃহৎ-সংহিতায় পুণ্ড্র-তাম্রলিপ্তক–বর্ধমান-বঙ্গের সঙ্গে, সমতট-নামে একটি জনপদের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যাইতেছে। সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী পাঠে মনে হয়, সমতট ছিল কামরূপের দক্ষিণে। এই শতকেরই শেষাশেষি ইৎসিঙ সমতট রাজভটি-নামে এক রাজার উল্লেখ করিতেছেন; রাজভটি এবং আম্রফপুর পট্টোলীর (সপ্তম শতক) রাজরাজীভট্ট একই ব্যক্তি বলিয়া বহুদিন পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত হইয়াছেন। রাজরাজ্যভট্টের অন্যতম রাজধানী ছিল কর্মান্ত বা ত্রিপুরা জেলার বড়োকামতা। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী পাঠে মনে হয়, মধ্য-বাঙলার অন্তত কিয়দংশ এই সমতটের অংশ ছিল। অথচ, বর্তমান ত্রিপুরাও যে সমতটেরই অংশ ছিল, সপ্তম হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ শতক পর্যন্ত, তাহা অনস্বীকার্য; এ সম্বন্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সুপ্রচুর। সপ্তম শতকের কথা বলিয়াছি। দশম শতকে প্রথম মহীপালের রাজত্বের তৃতীয় সম্বৎসরে নির্মিত এবং ত্রিপুরা জেলার বাঘাউরাগ্রামের প্রাপ্ত মূর্তিলিপি, আনুমানিক একাদশ-দ্বাদশ শতকের একটি চিত্রিত পাণ্ডুলিপিতে “চম্পিতলা লোকনাথ সমতটে অরিষষ্টান”-উক্তি (চম্পিতলা বর্তমান ত্রিপুরায়), ১২৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দের দামোদর দেবের অপ্রকাশিত মোহার পটোলী ইত্যাদির সাক্ষোর ইঙ্গিত হইতে মনে হয়, ত্রিপুরা জেলাই ছিল সমতটের প্রধান কেন্দ্ৰ।
পট্টিকেরা
এই কেন্দ্ৰস্থলটি যে একাদশ হইতে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত পট্টিকেরা-রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’র একটি পাণ্ডুলিপিতে (১০১৫ খ্ৰীষ্টাব্দ; চুণ্ডাদেবীর ছবির নিচে “পট্টিকেরে চুণ্ডাবর ভবনে চুণ্ডা”-পরিচয় দ্রষ্টব্য; এই চুণ্ডাবর ভবন ও চুণ্ডাদেবীর সঙ্গে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার চুন্টটাগ্রামের একটু যোগ আছে বলিয়া মনে হইতেছে), ব্ৰহ্মদেশীয় রাজবৃত্ত হিমনান গ্রন্থে, এবং ১২২০ খ্ৰীষ্টাব্দের রণবঙ্কমল্ল শ্ৰীহরিকালদেবের একটি লিপিতে। কিন্তু, অন্তত দ্বাদশ শতকে সমতটের পশ্চিম সীমা বোধহয় মধ্য-বঙ্গ অতিক্রম করিয়া একেবারে বর্তমান চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা (প্রাচীন খাড়িমণ্ডল) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিজয়সেনের বারাকপুর পট্রেলীতে দেখিতেছি, খাড়িমণ্ডলের ভূমির পরিমাপ করা হইতেছে। ‘সমতাটিয় নলেন। সেন-লিপিগুলিতে ভূমিপরিমাপের যে অভ্যাসের পরিচয় আমরা পাই তাহাতে মনে হয়, যে ভূখণ্ড যে জনপদের অন্তর্ভুক্ত সেই জনপদে ব্যবহৃত নলেই ভূখণ্ডের পরিমাপ করা হইত। সেইজন্য মনে হয়, খাড়িমণ্ডল তখন সমতটেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরূপ হওয়া কিছুতেই অস্বাভাবিক নয়, অসম্ভব তো নয়ই। সমতটের অর্থই হইতেছে তটের সঙ্গে যাহা সমান, অর্থাৎ সমুদ্রশায়ী নিম্নদেশ। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীর হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে মেঘনা-মোহনা পর্যন্ত সমুদ্রশায়ী ভূখণ্ডকেই বোধহয় বলা হইত সমতট, যাহা মুসলমান ঐতিহাসিকদের এবং মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যের ভাটি, তারনাথের বাটি। যাহা হউক ত্রিপুরা ও মধ্য-বঙ্গ –যে বঙ্গেরই অন্তর্ভুক্ত, তাহা তো আমরা আগেই দেখিয়াছি।
নারায়ণপালদেবের ভাগলপুর-শাসনে সৎসমতটজন্মা শুভদাসপুত্ৰ শ্ৰীমান সংখদাস নামে এক শিল্পীর উল্লেখ আছে; সৎসমতট কোন জায়গা তাহা নির্ণয় করা কঠিন, তবে নিশ্চয়ই সমতট-সম্পূক্ত কোনও স্থান। অথবা, সৎ শুধু সমতটের একটি বিশেষণ মাত্র।
বঙ্গাল
একাদশ শতক হইতে প্রাচীন বঙ্গের একটি বিভাগের নূতন একটি নাম পাইতেছি, বঙ্গাল। বিজ্জল কলচুর্যের অবলুর লিপি, রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপি এবং আরও কয়েকটি দক্ষিণী লিপিতে প্রথম বঙ্গালদেশের নামের উল্লেখ দেখিতেছি। অবলুর লিপি এবং আরও অন্তত দুটি দক্ষিণী লিপিতে বঙ্গ ও বঙ্গাল দুটি জনপদই একই সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। এ অনুমান স্বাভাবিক যে, বঙ্গ ও বঙ্গল একাদশ শতকে দুই পৃথক জনপদ ছিল। পরেও ইহাদের পৃথকভাবেই গণ্য করা হইত। নয়চন্দ্র সূরীর “হাম্মির মহাকাব্য (পঞ্চদশ শতক) এবং সামশ-ই-সিরাজ আফিফা -র তারিখ-ই-ফিরুজস্যহী”-গ্রন্থেও এই দুই জনপদকে পৃথক ভাবে গণ্য করা হইয়াছে। কিন্তু, এই একাদশ শতকেরই রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপি পাঠে মনে হয়, চোল সৈন্য দণ্ডভুক্তি (তাম্রলিপ্তি অঞ্চল, বর্তমান দাতন) ও তককণ লাঢ় (দক্ষিণ-রাঢ়) জয় করিবার পর বঙ্গালদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্ৰকে পলায়নপর করেন; বঙ্গের কোনও উল্লেখ এই লিপিতে নাই। স্বতঃই অনুমান হয়, দক্ষিণ-রাঢ়ের পরই ছিল, বঙ্গলদেশ, এবং এই দুই দেশের মধ্যসীমা ছিল বোধহয় গঙ্গা-ভাগীরথী। রাজা গোবিন্দচন্দ্ৰ যে বংশের রাজা সেই বংশ যে হরিকেল-ত্রিপুরা চন্দ্ৰদ্বীপের অধিপতি ছিলেন, এ তথ্য ঐতিহাসিকদের কাছে সুবিদিত। বিক্রমপুর অঞ্চলেও গোবিন্দ চন্দ্রের অন্তত দুইটি লিপি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে এবং এই অঞ্চলও গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যভুক্ত ছিল। দেখা যাইতেছে, একাদশ শতকে বঙ্গালদেশ বলিতে প্রায় সমস্ত পূর্ব-বঙ্গ এবং দক্ষিণ-বঙ্গের সমুদ্রতটশায়ী সমস্ত দেশখণ্ডকে বুঝাইত। ইহার সম্পূর্ণ না হউক কতক অংশকে যে সমতট বলা হইত, তাহা তো আগেই দেখিয়াছি। চন্দ্ৰদ্বীপ-হরিকেলও তখন বঙ্গালদেশেরই অংশ। দ্বাদশ শতকে না হউক, ত্ৰয়োদশ শতকে এইসব অংশই আবার বঙ্গের। বিক্রমপুর এবং নাব্যভাগের অন্তর্গত। মানিকচন্দ্র রাজার গানের “ভাটি হইতে আইল বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি” পদে অনুমান হয়, ভাটি ও বঙ্গাল বা বাঙ্গালদেশ এক সময়ে প্রায় সমার্থকই ছিল। কিন্তু বঙ্গাল বা বাঙ্গালদেশের কেন্দ্ৰস্থান বোধহয় ছিল পূর্ববঙ্গে। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষদ -লিপিতে রামসিদ্ধি পাটকের দক্ষিণে বাঙ্গালবড়া-নামে একখণ্ড ভূমির উল্লেখ আছে। রামসিদ্ধি পাটক যে বর্তমান বাখরগঞ্জ জেলার গৌরনদী অঞ্চলের একটি গ্রাম তাহা এখন স্বীকৃত এবং আগেই তাহা উল্লেখও করিয়াছি। বাঙ্গালিবাড়াও বাখরগঞ্জ জেলার কোনও স্থান হওয়াই স্বাভাবিক। Gastaldi-র (১৫৬১) নকশায় Bengala-র অবস্থিতি যেন এই অঞ্চলেই দেখান হইয়াছে; কিন্তু ষোড়শ শতক হইতে যতো নকশা প্রায় প্রত্যেকটিতেই দেখিতেছি Bengala-র অবস্থান আরও পূর্বদিকে। এই Bengala-বন্দর যে কোন বন্দর তাহা বলা কঠিন; কেহ বলেন চট্টগ্রাম, কেহ বলেন প্রাচীন ঢাকা। ঢাকা শহরে বাঙ্গালাবাজার এখনও প্রসিদ্ধ পল্লী ও বাজার; বাঙ্গালাবাজার মধ্যযুগীয় Bengala-বন্দরের স্মৃতি বহন করা অসম্ভব নয়। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-গ্রন্থে (সংকলন কাল ১২০৬; সংকলন-কর্তা শ্ৰীধর দাস) জনৈক অজ্ঞাতনামা বঙ্গল=বাঙ্গাল=পূর্ববঙ্গীয় কবির রচিত একটি গঙ্গাস্তোত্র স্থান পাইয়াছে। এই কবি নিজের বাণীকে গঙ্গার সহিত উপমিত করিয়াছেন। উপমাচাতুর্যে স্তোত্রটি এত সুন্দর যে, বঙ্গ-বাঙ্গাল প্রসঙ্গে ইহা উদ্ধৃত করিবার লোভ সংবরণ করা কঠিন :
ঘনরসময়ী গভীরা বক্রিম-সুভগোপজীবিত কবিভিঃ।
অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গাল-বাণী চ।—বঙ্গালস্য। (সদুক্তিকর্ণামৃত, ৫।৩১৷২)
পুণ্ড্র
পুণ্ড্রজনদের সর্বপ্রাচীন উল্লেখ ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণে, এবং তারপরে বোধায়ন-ধর্মসূত্রে। প্রথমোক্ত গ্রন্থের মতে ইহারা আর্যভূমির প্রাচ্য-প্রত্যন্তদেশের দস্যু কোমদের অন্যতম; দ্বিতীয় গ্রন্থের মতে ইহারা সংকীর্ণযোনী, অপবিত্র; বঙ্গ এবং কলিঙ্গাজনদের ইহারা প্রতিবেশী। ‘ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণের শুনঃশেপ-আখ্যানের এই উল্লেখে দেখা যায়, পুণ্ড্রারা অন্ধ, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব কোমদের সংলগ্ন এবং আত্মীয় কোম। এই ধরনের একটি গল্প ‘মহাভারতের আদিপর্বে আছে, একাধিক পুরাণেও আছে; সেখানে কিন্তু পুণ্ড্রারা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এবং সুহ্মদের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি। মানবধর্মশাস্ত্ৰে পুণ্ড্রদের বলা হইয়াছে ব্রাত্য ক্ষত্রিয়, যদিও “মহাভারতের সভাপর্বে বঙ্গ ও পুণ্ড্র উভয় কোমকেই শুদ্ধজাত ক্ষত্ৰিয় বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। কৰ্ণ, কৃষ্ণ এবং ভীমের যুদ্ধ এবং দিগ্বিজয় প্রসঙ্গেও মহাভারতে পুণ্ড্রকৌমের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কৰ্ণ সুহ্ম, বঙ্গ এবং পুণ্ড্রদের পরাজিত করিয়াছিলেন এবং বঙ্গ ও অঙ্গকে একটি শাসন-বিষয়ে পরিণত করিয়া নিজে তাহার অধ্যক্ষ হইয়াছিলেন। কৃষ্ণও একবার বঙ্গ ও পুণ্ড্রদের পরাজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু, ভীমের দিগ্বিজয়ই সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি মুদগগিরির (মুঙ্গের) রাজাকে নিহত করিয়া প্রতাপশালী পুণ্ড্ররাজ ও কোশীনদীর তীরবর্তী অন্য একজন ভূপালকে পরাভূত করেন, এবং তাহার পর বঙ্গরাজকে আক্রমণ করেন। যাহাই হউক, উপরোক্ত উল্লেখগুলি হইতে বুঝা যাইতেছে, পুণ্ড্রদের জনপদ অঙ্গ, বঙ্গ এবং সুহ্ম কোমদের জনপদের সংলগ্ন, এবং হয়তো ইহারা সকলেই একই নিবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, এই জনপদের অবস্থান মুদগগিরি বা মুঙ্গেরের পূর্বদিকে এবং কোশীতীর-সংলগ্ন। জৈনদের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ ‘কল্পসূত্রে গোদাসগণ-নামীয় জৈন সন্ন্যাসীদের তিন-তিনটি শাখার উল্লেখ আছে; তাম্রলিপ্তি শাখা, কোটিবর্ষ শাখা, পুণ্ড্রবর্ধন শাখা। এই তিনটি শাখার নামই বাঙলার দুইটি জনপদ এবং একটি নগর হইতে উদ্ভূত। কোটিবর্ষ পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত প্রসিদ্ধ নগর। খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের মহাস্থান-ব্ৰাক্ষী লিপিতে এক পুন্দনগল বা পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ আছে। এই পুন্দনগলই বোধহয় ছিল তদানীন্তন পুণ্ড্রের রাজধানী বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থান, যাহার পুরাতন ধ্বংসাবশেষ ঘেষিয়া এখনও করতোয়ার ক্ষীণধারা বহমান। এই করতোয়ারই তীৰ্থমহিমা ‘মহাভারতে’র বনপর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে উল্লিখিত হইয়াছে। ‘লঘুভারতে’র কথায় “বৃহৎপরিসরা পুণ্যা করতোয়া মহানদী”।
পুণ্ড্রবর্ধন
এইসব প্রাচীন সাক্ষ্য পরবর্তী সাক্ষ্যদ্বারাও সমর্থিত হইতেছে। ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্ড্র পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে রূপান্তরিত হইয়াছে, এবং গুপ্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান ভুক্তিতে পরিণত হইয়াছে। ধনাইদহ, বৈগ্রাম, পাহাড়পুর এবং দামোদরপুর, তাম্রপটোলী কয়টিতে এবং য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণে এই পুণ্ড্রবর্ধন নামই পাওয়া যাইতেছে। উপরোক্ত পট্টোলীগুলিতে অ্যালিখিত বিভিন্ন স্থানের নাম হইতে এ তথ্য আজ নিঃসংশয় যে, তদানীন্তন পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি অন্তত বগুড়া-দিনাজপুর এবং রাজশাহী জেলা জুড়িয়া বিস্তৃত ছিল। মোটামুটি সমস্ত উত্তরবঙ্গই বোধহয় ছিল পুণ্ড্রবর্ধনের অধীন, একেবারে রাজমহল-গঙ্গা-ভাগীরথী তীর হইতে আরম্ভ করিয়া করতোয়া পর্যন্ত। কারণ, য়ুয়ান-চোয়াঙ কাজঙ্গল হইতে আসিয়াছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনে এবং করতোয়া পার হইয়া— গিয়াছিলেন কামরূপ। কজঙ্গল এবং করতোয়া-মধ্যবর্তী ভূভাগই তাহা হইলে পুণ্ড্রবর্ধন; উত্তরে ‘হিমবচ্ছিখর’; দক্ষিণে সীমা কালে কালে বিভিন্ন।
পরবর্তীকালে পৌণ্ড্রভুক্তি, পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্রবর্ধনভূক্তির রাষ্ট্রসীমা উত্তরোত্তর বাড়িয়াই গিয়াছে। ধর্মপালের (অষ্টম শতক) খালিমপুর-লিপিতেই দেখিতেছি পুণ্ড্রবর্ধনান্তর্গত ব্যাঘ্রতটীমণ্ডলের উল্লেখ। এই ব্যাঘ্রতটীমণ্ডল যে দক্ষিণ-সমুদ্রতীরবর্তী ব্যাঘ্ৰ্যাধুষিত বনময় প্রদেশ হওয়া অসম্ভব নয়, সে কথা আগেই বলিয়াছি। সেন-আমলে দেখিতেছি পুণ্ড্রবর্ধনের দক্ষিণতম সীমা পশ্চিম দিকে খাড়িবিষয়—খাড়িমণ্ডল (বর্তমান খাড়ি পরগনা, ২৪ পরগনা), অন্যদিকে ঢাকা-বাখরগঞ্জের সমুদ্রতীর পর্যন্ত। বঙ্গের নাব্য এবং বিক্রমপুর ভাগও তখন পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত। সদ্যোক্ত খাড়ি নিশ্চয়ই ভাগীরথীর পূর্ব তীরের (পূর্ব) খাড়ি বা ১১৯৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ডোম্মনপালের পট্টোলীর পূর্ব-খাটিকা। কারণ, লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর-পট্টোলীতে পশ্চিম-খাটিকারও উল্লেখ পাইতেছি; এই পশ্চিম-খাটিকা বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত, ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে। রাঢ়দেশের কোনও অঞ্চল বোধহয় কখনও পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। পশ্চিম-খাটিকার অন্তর্গত বেতডচতুরক। বর্তমান হাওড়া, জেলার বেতড়ে পরিণত হইয়াছে। বেতড় ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে।
বরেন্দ্র, বরেন্দ্রী
পুণ্ড্রবর্ধনের কেন্দ্র বা হৃদয়স্থানের একটি নূতন নাম পাইতেছি। দশম শতক হইতে; এ নাম বরেন্দ্র অথবা বরেন্দ্রী। ৯৬৭ খ্ৰীষ্টাব্দের একটি দক্ষিণী লিপিতে ‘বারেন্দ্ৰদ্যুতিকারিণী এবং ‘গৌড়চূড়ামণি নামক জনৈক ব্ৰাহ্মণের উল্লেখ আছে। কিন্তু প্ৰসিদ্ধতম উল্লেখ সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিত’ কাব্যের কবি-প্রশস্তিতে, এবং গায়াড় তুঙ্গদেবের তালচের পট্টোলীতে। কবি সন্ধ্যােকর বরেন্দ্রীকে পালরাজাদের জনকভূ অর্থাৎ পিতৃভূমি বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন, এবং গঙ্গা-করতোয়ার মধ্যে সিলিমপুর-শিলালিপি, তৰ্পণদীঘি এবং মাধ্যাইনগর-পট্টোলী তিনটিতে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে যে, বরেন্দ্রী পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেন রাজাদের পট্টোলীগুলিতে বরেন্দ্রীর অন্তর্গত স্থানগুলির অবস্থিতি হইতে এ অনুমান নিঃসংশয়ে করা যায় যে, বর্তমান বগুড়া-দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা, এবং হয়তো পাবনাও (পদুম্বা?) প্রাচীন বরেন্দ্রীর বর্তমান প্রতিনিধি৷ বরেন্দ্রীই মধ্যযুগীয় মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ, তবে বরিন্দ প্রাচীন বরেন্দ্রী অপেক্ষা সংকীর্ণতর বলিয়া মনে হয়। ‘তবাকাত-ই-নাসিরী”-গ্রন্থে গঙ্গার পর্বতীরবর্তী এবং লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের একটি অংশ মাত্র বলা হইয়াছে। এই গ্রন্থের মতে লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের দুই বিভাগ গঙ্গার দুই তীরে; পশ্চিমে রাল (=রাঢ়), পূর্বে বরিন্দ (=বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্র)। প্রাচীন বাঙলার আর একটি বিভাগে লক্ষ্মণসেনের বংশধরেরা তখনও (অর্থাৎ, ১২৪২-৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দের মিনহাজের লক্ষ্মণাবতী প্রবাসকালে) রাজত্ব করিতেছিলেন; এই বিভাগটির নাম বঙ্গ (=বঙ্গ)। যাহা হউক, মধ্যযুগীয় সাহিত্য, ইতিহাস এবং কুলজী গ্রন্থে বরেন্দ্র-বরেন্দ্রীর উল্লেখ প্রচুর; লোকস্মৃতিতেও বরেন্দ্র এবং বরেন্দ্রীর ঐতিহ্য বরাবর জাগরূক ছিল। ইহাদের ইঙ্গিতেও বরেন্দ্রী উত্তরবঙ্গের কেন্দ্ৰস্থলে।
রাঢ়া
রাঢ়া-জনপদের প্রাচীনতম উল্লেখ পাইতেছি প্রাচীন জৈনগ্রন্থ ‘আয়ারাঙ্গ’ বা ‘আচারাঙ্গ’ সূত্রে মহাবীর তাঁহার কয়েকজন শিষ্যসহ রাঢ়া-জনপদে আসিয়াছিলেন বা ধর্মপ্রচারের জন্য (খ্ৰীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক); এই জনপদ তখন পথবিহীন, আচারবিহীন, এবং লোকেরাও একটু নিষ্ঠুর ও রূঢ় প্রকৃতির। তাঁহারা এইসব অহিংস যতিদের পিছনে কুকুর লেলাইয়া দিয়াছিল। জৈন ‘প্রজ্ঞাপনা’-গ্রন্থে রাঢ় ও বঙ্গজনদের একত্র গ্রথিত করিয়া উভয়কেই আর্য বলা হইয়াছে। কোটিবর্ষ (বা পরবর্তী কোটিবৰ্ষ) ছিল তাঁহাদের রাজধানী। কোটিবর্ষ দিনাজপুর জেলায়, এবং দামোদরপুর-পট্টেলীর (পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক) মতে কোটিবর্ষ পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত; পাল-আমলেও তাঁহাই। ‘আচারাঙ্গ সূত্রে রাঢ়া-জনপদের দুইটি বিভাগ : বজ্জ বা বজাতৃভূমি, সুবভি বা সুহ্মভূমি। বজ্রভূমিতে জৈন সন্ন্যাসীদের অপরিস্কৃত নিকৃষ্ট খাদ্য খাইয়া দিন কটাইতে হইয়াছিল। সিংহলী পালিগ্রন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ-কথিত বিজয়সিংহের কাহিনী সুবিদিত। বঙ্গরাজ সীহরাহু (সিংহবাহু) লাড়দেশে সীহপূর-নামে এক নগরের পত্তন করিয়াছিলেন বলিয়া এই কাহিনীতে উল্লিখিত আছে। কেহ কেহ বলেন, এই লাড়দেশ কাথিয়াবাড়ি অঞ্চলের প্রাচীন লাটদেশ, এবং সীহপুর বর্তমান সীহোর। কাহারও মতে লাড়দেশ প্রাচীন লাঢ় বা রাঢ়-জনপদ এবং সীহপুর বর্তমান হুগলী জেলার সিঙ্গুর। সীহবাহু লাড়দেশে নগর পত্তন করিবার সময় বঙ্গ-জনপদেরই রাজা ছিলেন। বঙ্গের সঙ্গে লাড়ের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ এবং নৈকট্য দেখিয়া মনে হয়, লাড়দেশে বঙ্গের রাঢ়দেশ হওয়া অসম্ভব নয়। রাজশেখরের ‘কর্পূরমঞ্জরী-গ্রন্থে রাঢ়া-জনপদের সৌন্দর্যের উল্লেখ আছে; হলায়ুধের অভিধান-গ্রন্থেও অনুরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়।
সুহ্মভূমি
রাঢ়-জনপদের বিভাগের মধ্যে সুবভ=সুহ্মবিভাগ সমধিক প্রসিদ্ধ এবং সম্ভবত প্রাচীন। সুহ্ম-জনদের উল্লেখ আছে ‘মহাভারতে, কর্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে। কর্ণদেব সুহ্ম, পুণ্ড্র ও বঙ্গজনদের যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন। ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গেও ভীমকর্তৃক মুদগগিরি, পুণ্ড্র, বঙ্গ, তাম্রলিপ্তি, এবং সুহ্মজন ও রাজাদের পরাজয়ের কথা আছে। ‘দশকুমারচরিত’-গ্ৰন্থ কিন্তু সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তিকে পৃথক জনপদ বলিতেছে না, বরং তাম্রলিপ্তিকে সুহ্মের অন্তৰ্গত বলিয়া বলিতেছে। রঘুবংশে রঘুর দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে মহোদধির তালিবনশ্যামপকণ্ঠে সুহ্মদের পরাজয়ের উল্লেখ আছে। এই শ্লোকদ্বয়ের পূর্বেই আর একটি শ্লোক আছে
সে সেনা মহতীং কর্যন পূর্বসাগর গামিনীম।
বভৌ হরজটাভ্ৰষ্টাং গঙ্গামিব ভাগীরথঃ। (৪।৩২)
এই শ্লোকটির ব্যঞ্জনা হইতে মনে হয়, রঘু গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূল বাহিয়া দক্ষিণসাগরের দিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন, এবং ইহারই দক্ষিণ অংশের ভূভাগ সুহ্ম-নামে পরিচিত ছিল। ধোয়ী কবির ‘পবনদূতেও গঙ্গা-তীরবর্তী সুহ্মের উল্লেখ আছে এবং এই দেশে গঙ্গা-যমুনা সংগমে ত্রিবেণী অতিক্ৰম করিয়া লক্ষণসেনের রাজধানী বিজয়পুরের পথের ইঙ্গিত আছে। এই গঙ্গা-যমুনা সংগম ও ত্ৰিবেণী বর্তমান হুগলী জেলায়। এইসব সাক্ষ্য-প্রমাণ হইতে অনুমান করা চলে যে, গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী দক্ষিণতম ভূখণ্ড, অর্থাৎ বর্ত