- বইয়ের নামঃ কথা অমৃতসমান
- লেখকের নামঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০১. নৈমিষারণ্য
কথা অমৃতসমান – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী (১ম খণ্ড)
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৩, অগ্রহায়ণ ১৪২০
ধর্মে চার্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতষভ।
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন কুচিৎ।
—ধর্মশাস্ত্র বলুন কিংবা অর্থশাস্ত্রই বলুন, কামশাস্ত্রই বলুন অথবা মুক্তির শাস্ত্রই বলুন–যা এই মহাভারতে আছে, তা অন্যত্রও আছে; আর যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও নেই।
মহাভারত মানে মহা-ভারত। যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও নেই। আর আর এখানে যা আছে, তা অন্য কোথাও নিশ্চয়ই আছে। আমরা এই নিরিখেই গ্রন্থটাকে দেখতে চেয়েছি–তারা সবাই অন্য নামে আছেন মর্ত্যলোকে। আজকের এই সর্ব-সমালোচনামুখর, ঈর্ষাসূয়ায় হন্যমান শতাব্দীর মধ্যে দাঁড়িয়ে শত শত শতাব্দী-প্রাচীন আরো এক সাসূয় সমাজের কথা বলতে লেগেছি, যদিও সেখানে প্রাতিপদিক বিচলনের সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ বার বার নিনাদিত হয় এবং সেটা ধর্ম–সে ধর্ম একদিকে নীতি এবং নৈতিকতা, অন্যদিকে সেটা ‘জাস্টিস’, শৃঙ্খলা, ‘অরডিন্যান্স’ এমন কী আইনও। মহাভারত অন্যায় এবং অধর্মকে সামাজিক সত্যের মতো ধ্রুব বলে মনে করে, কিন্তু সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য অহরহ সচেতন করতে থাকে প্রিয়া রমণীর মতো। আমরা সেই মহা-ভারতকথা বলেছি এখানে, যা শতাব্দীর প্রাচীনতম আধুনিক উপন্যাস।
.
লেখক পরিচিতি
এখনকার বাংলাদেশের পূর্ব-প্রারন্ধের মতো পাক-চক্র ছিল এক। লেখকের জন্ম সেখানে পাবনা জেলার গোপালপুর গ্রামে, ১৯৫০ সালে। কলকাতায় প্রবেশ ৫৭ সালে। শিক্ষাগত উপাধিগুলি ব্যাধির মতো সামনে-পিছনে আসতে চাইলেও বর্তমান লেখক সেগুলিকে মহাভারত-পাঠের সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যে আস্বাদন মহাভারতের স্বাধ্যায়-অধ্যয়নের মধ্যে আছে, তার প্রতিপদ-পাঠ বুঝতে গেলে অন্যান্য জাগতিক বিদ্যার প্রয়োজন হয়। লেখকের জীবন চলে শুধু মাধুকরী বিদ্যায়, সাংগ্ৰাহিক আস্বাদনে। লেখালেখির জীবনে এসে পড়াটা একেবারেই আকস্মিক ছিল। প্রবীণ সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী তার লেখক জীবনের পরিণতি ঘটিয়েছেন বাঁচিক তিরস্কারে এবং বাঁচিক পুরস্কারে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম লেখা এবং আনন্দ থেকে তাঁর প্রথম বই এককালে শিহরণ জাগাত লেখকের মনে। এখন। শিহরণের বিষয়–মহাভারত-পুরাণের অজ্ঞান তমোভেদী এক-একটি বিচিত্র শব্দ। গুরুদাস কলেজে অধ্যাপনা-কাল শেষ করে এখন। মহাভারত-পুরাণের বিশাল বিশ্বকোষ রচনায় ব্যস্ত আছেন লেখক।
.
সিন্ধু-বিন্দু
২০১০ সালে পুজোর পর প্রখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেছি। সে আড্ডায় অবধারিতভাবে মহাভারতের প্রসঙ্গ চলে আসে। নানা কথার মধ্যে হঠাৎই ঋতু বলে –তুমি আমাদের জন্য লিখতে আরম্ভ করো ‘রোববার’-এ। আমি এই কাগজের সম্পাদনার দায়িত্বে আছি। তুমি নিশ্চিন্তে লেখো। মহাভারত বুঝিয়ে দাও আমাদের। আমি বলেছিলাম, মহাভারত কখনো নিশ্চিন্তে লেখা যায় না। এই মহাকাব্যের বিশালতা এবং গভীরতা দুটোই এত বেশী যে, আমি যেভাবে মহাভারত বোঝাতে চাই, সেটা বোঝাতে গেলে জীবন কেটে যাবে। ঋতু বলল– লেখার মতো করে লেখো, ভেবে নাও তোমার চোখের বাইরে বসে-থাকা শত শত পাঠকের আকুল জিজ্ঞাসা। তাদের ছোট করে দেখো না। তাদের প্রশ্ন তুমি তৈরী করবে, তুমিই উত্তর দেবে।
ঋতুর কথা আমি মেনেছি। রোববারে আমার ‘কথা অমৃতসমান’ চলছে, কিন্তু এরই মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠক আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বিশ্বময় নিজেকে ছাড়িয়ে দিয়ে। ঋতুকে বলেছিলাম আমি আগেও মহাভারত-কথা লিখতে আরম্ভ করেছিলাম তৎকালীন বর্তমান পত্রিকার সম্পাদক বরুশ সেনগুপ্ত-মশায়ের অনুরোধে। সাড়ে তিন বছর ফি-হপ্তায় লিখে আমি পাণ্ডবদের জতুগৃহ-দাহ পর্যন্ত এগোতে পেরেছিলাম। তদবধি ভেবেছি–আমাকে তিনি অশেষ করেননি, এমন লীলা আমার ক্ষেত্রে হবেও না। কাজেই আবার নতুন করে মহাভারতকে পাকড়ে ধরা কী ঠিক হবে? ঋতু বলেছিল-তোমরাই কীসব বলল না–যারা বিদ্যে লাভ কস্তুতে চায়, যারা খুব টাকা-পয়সা পেতে চায়, তারা নিজেদের অজর, অমর মনে করে। তুমি তাই ভেবে লেখা আরম্ভ করো।
ঋতুকে আমি ফেলতে পারিনি। ‘কথা অমৃতসমান’ আরম্ভ করেছিলাম ‘রোববার’-এ। এখনও চলছে, আমিও চলেছি। এরই মধ্যে একটা নতুন প্রয়োজন দেখা দিল। একদিন ‘দেজ পাবলিশিং’-এর নব্যযুবক অপু সুধাংশুদের যোগ্য উত্তরাধিকারী, আমার কাছে এসে কথা অমৃতসমান’ছাপতে চাইল বই আকারে। আমি বললাম–শর্ত আছে। এখন ‘রোববারে’ যে লেখা চলছে, সেটা আমার আগের লেখার ‘কনটিনিউয়েশন’। কাজেই মহাভারত নিয়ে যদি এই বই ছাপতে চাও, তবে আগে বরুণদার দপ্তরী লেখাটা ছাপতে হবে। অপু বলল–তাই দিন-আমরা তিন-চার খণ্ডে ‘কথা অমৃতসমান’ বার করবো। ওর এই সাহসটা আমার ভাল লেগেছিল। এখন লেখকদের ওপর হুলিয়া আছে–লেখা পুরো শেষ করুন, তবে ছাপাবো। এটা কী সমরেশদার ‘দেখি নাই ফিরে’-র ফলশ্রুতি কীনা কে জানে! লেখকের বুঝি মরেও শান্তি নেই। তবে কিনা মহাভারত তো সত্যিই আয়ু-শেষ-করা মহাকাব্য। ধন-জন, মান-যশ, আশা-আকাঙ্ক্ষার আকস্মিক ছেদে যে শান্তরসের বৈরাগ্য তৈরী হয়, সেই তো মহাভারতের চরম প্রতিপাদ্য তত্ত্ব। কাজেই মহাভারতের কথা শেষ না হতেই আমিও যে ঋতুর মতো কোথাও চলে যাবো না, এ-কথা জোর দিয়ে কে বলতে পারে? এখানে অপু সাহস দেখিয়েছে প্রকাশক হিসেবে।
আমি যে সেই বরুণদার সময় থেকে মহাভারতের বারুণী নিয়ে বসে আছি, তার একটা কারণ আছে। আমার মনে হয়েছে–মহাভারতকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং তা এমন করেই যাতে মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে বুঝতে পারে যে, মহাভারত এক চলমান জীবনের কথা বলে। এটা ইলিয়াড-ওডিসির মতো সামান্য মহাকাব্য নয়। মহাভারতীয় ঘৃণা, মান, অপমান, ভালবাসা, লজ্জা, ভয় এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতেও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এটা তো ঠিকই যে, মহাভারতের মূল কাহিনীটাই যদি ধরি শুধু, তাহলেও সেখানে বৈচিত্র্য কিছু কম নেই। অথচ সে বৈচিত্র্য কল্পনার মতো বায়ুভূত নিরালম্ব নয়। গ্রামে-গঞ্জে তিন পুরুষ আগে জমির উত্তরাধিকার নিয়ে শরিকি বিবাদ যারা দেখেছেন, তারা বুঝবেন-মহাভারতের কাহিনী কোনো অমূলক অবাস্তব থেকে উঠে আসেনি। ভারতবর্ষের আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী যারা হতেন, সেখানে কাকা, ভাই কিন্তু জম্মজাত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত। এই বাস্তব থেকে মহাভারতের কাহিনী আরম্ভ হয়। অথচ উপপাদ্য জায়গাগুলিতে এমন সব কাহিনী একের পর এক আসতে থাকে, যা আজিও হইলেই হইতে পারিত। অর্থাৎ সেখানেও বাস্তব। মহাভারত কখনোই শুধু কাহিনী বলে না, সে তার সমসাময়িকতার সঙ্গে প্রাচীন পরম্পরাও উল্লেখ করে বলে কথা প্রসঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, জাতিতত্ত্ব, বর্ণব্যবস্থা, স্ত্রীলোকের। সামাজিক অবস্থান, নীতি-অনীতি এমনকি যৌনতার কথাও পরিষ্কারভাবে জানায়। ফলত মহাভারতের কাহিনী একসময় এক বিরাট ইতিহাস হয়ে ওঠে।
একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এই গ্রন্থের মধ্যে যে নীরসিংহী কথাকথা আরম্ভ হয়েছে, তার প্রয়োজন শুধু এইটুকুই যে, আমরা মহাভারতের নায়ক-প্রতিনায়কদের তাদের গ্রাহ্য-বর্জ্য বৃহত্তর সমাজ এবং রাজনৈতিক, পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণ করিয়ে নিতে চাই। এটা করতে গিয়ে আমি কখনো ‘দিলোত’-দের (dilettante) পথে চলিনি, অবশ্য এমনও মহান ভ্রান্তিতেও আমি বিশ্বাস করিনা যে, একবিংশ শতাব্দীর পরিখালিত সংস্কারে আমার সাংস্কৃতিক মানস দিয়ে তৎকালীন ‘বিরাট’ এবং ‘বিশাল’-এর সমালোচনা করবো। বরঞ্চ মহাভারতের অন্তর্গত প্রমাণ দিয়েই আমি সেই সমাজের অন্তর্বেদনা, সুখ এবং আধুনিকতার কথা আমি ধরতে চেয়েছি কখনো মহাভারতীয় মূলকে অতিক্রম না করে।
এটা ঠিক যে, ইনটারটেক্সচুয়ালিটি নিশ্চয়ই আমার কাছে খুব বড়ো একটা ব্যাপার, কেননা এটা মহাভারত, এবং এটাও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, মহাভারতের মধ্যে মাঝে-মাঝেই যে প্রক্ষেপগুলি ঘটেছে, সেটা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের পরম্পরা বোঝার পক্ষে আরো বেশী সুবিধে দেয়, কাজেই মহাভারতকে যাঁরা কলোনিয়াল ‘হ্যাংইওভারে’ পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাদের চেষ্টা-পরিশ্রমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল, কিন্তু তাদের মানসিকতা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত প্রক্ষেপ যা কিছু এখানে ঘটেছে, তার প্রাচীনত্বের বিচার করাটা অতটা সহজ নয়, যতটা পূর্বাহ্নেই সংকল্পিত গবেষককুল মনে করেন। আর ওই যে এক প্রবাদ–তাতে মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয় না’–এই প্রবাদটা চিরকালীন মানুষের এই মানসটুকু বুঝিয়ে দেয় যে, প্রক্ষেপবাদিতার পঙ্কবাদী পণ্ডিতেরা ব্যবচ্ছিন্ন বুদ্ধিতে ভারতবর্ষের এক বিরাট সময়কে শুধু কাটাছেঁড়া করেই পণ্ডিতমানিতা প্রকাশ করেন, কিন্তু তাতে লেখনীর বামতা তৈরী হয়। কবিজনোচিত বেদনাবোধ সেখানে পদে-পদে নিগৃহীত হয়। আমরা এই নৌকায় সাগর পাড়ি দিতে চাই না।
মহাভারত যেহেতু একটা বৃহৎ সময় ধরে আমাদের প্রাচীনদের চলার ইতিহাস, তাই মহাভারত বুঝতে গেলে প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে তার রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, জাতি-বর্ণ, ভোজনাভ্যাস এবং ভোজ্য সবই জানতে হয়। আমরা সেই সর্বত্রিক দিগন্দার্শনিকতার মধ্যে মহাভারতের কাহিনী প্রবেশ করিয়েছি মণিমালার মধ্যে সুতার মতো। অথবা কাহিনীর মধ্যে তার পারিপার্শ্বিক নিয়ে এসেছি ব্যক্তিচিত্রের পিছনে ক্যাম্পাসের মতো। তপোবনবাসিনী শকুন্তলার ছবি আঁকতে গেলে তার পূর্ণকুটীরে পাশ দিয়ে সৈকত-লীন-হংস-মিথুনা স্রোতোবহা মালিনী’ নদীকে আঁকতেই হবে। আঁকতে হবে কুটীরের পাশে বড়ো গাছের ডালে শুকোতে দেওয়া ঋষিদের বলবাস আর আঁকতে হবে। অদুরে অলসে দাঁড়িয়ে থাকা এক কৃষ্ণসার মৃগ, যার বাম চোখে হরিণী তার শি দিয়ে চুলকে দিচ্ছে সান্নিধ্যের প্রশ্রয়ে-শৃঙ্গে কৃষ্ণমৃগস্য বামনয়নং কয়মানাং মৃগী। এমন লিখেছেন কবি কালিদাস।
তার মানে, আমাদের বিশ্বাস-মহাভারতে কৌরব-পাণ্ডবদের জীবন-চর্যা দেখাতে গেলে মথুরা-মগধ থেকে আরম্ভ করে পঞ্চাল-কেকয়দের কথাও বলতে হবে। বলতে হবে অনন্ত প্রান্তিক জীবনের কথাও। আমরা সেইভাবেই কথা আরম্ভ করেছি। এর শেষ কোথায় জানি না। তবে আমার মাথার ওপর সেই ত্রিভঙ্গিম প্রাণারাম মানুষটি আছেন, আমার আয়ু এবং আমার অক্ষয়-গতি সবটাই নির্ভর করছে সেই অক্ষর-পুরুষের ওপর। তার বাঁশীর সুর যতদিন শুনতে পাবো, ততদিনই হয়তো চলবে এই মহাভারতী লেখনী।
আমার এই গ্রন্থের মধ্যে সহায়িকার গ্রন্থি আছে অনেক। কেউ সেইকালে আমার হিজিবিজি সাপ্তাহিকী লেখা পুনরায় কপি করে সাজিয়ে দিয়েছেন, যেমন তাপসী মুখোপাধ্যায়। তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন, তবে শিষ্যাও। প্রাথমিক প্রুফ দেখে দিয়েছেন–আমার ছাত্রী সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশেষে সম্পূর্ণ গ্রন্থটির শব্দ এব শৈলী-পরিবর্তনের দায়িত্ব থেকে পূর্ণ গ্রন্থটির পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন আমার স্ত্রী সুষমা। চাকরী ছাড়ার পর তিনি কাজ পাচ্ছিলেন না, কিন্তু এই গ্রন্থ ক্ষেত্রে তিনি আমার অকাজ পেয়েছেন প্রচুর–আমার নাতি ঋষভ ভাদুড়ীর প্রচুর লাফালাফি সেই অকাজ বাছাইতে সাহায্য করেছে বলে তার কাছে শুনতে পাই। প্রবীণ শ্রদ্ধেয় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রন্থের প্রচ্ছদ সৃষ্টি করেছেন, তাকে আমার প্রণাম। অবশেষে সেই অপুদে’জ পাবলিশিং-এর নব্য যুবক-তাকে অশেষ স্নেহ জানাই ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার জন্য, ওপারে নিয়ে যাবার জন্য তার গতির ওপর আমার ঠাকুর কৃষ্ণের আশীর্বাদ থাকুক।
—নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
.
.
০১.
নৈমিষারণ্য। ইতিহাস-পুরাণ খুললেই দেখবেন নৈমিষারণ্য। মহর্ষিদের তপোবন। সেখানে বারো বচ্ছর ধরে যজ্ঞ হবে এবং সেই যজ্ঞ চলছে। মহাভারত বলবে–এটি কুলপতি শৌনকের আশ্রম। শুধু মহাভারত কেন আঠারোটা মহাপুরাণের বেশির ভাগটার আরম্ভেই সেই একই কথা–নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনকের তত্ত্বাবধানে বারো বচ্ছরের যাগ-যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছে। নানা দেশ থেকে নানা মুনি-ঋষি এসেছেন এখানে। যজ্ঞ চলছে। ঋগবেদের ঋত্বিক ঋক-মন্ত্রে দেবতার আহ্বান করছেন। সামবেদীরা সাম-গান করছেন। যজুর্বেদের পুরোহিত অধ্বর্যু–ইন্দ্রায় বৌষট, অগ্নয়ে স্বাহা–করে আগুনে আহুতি দিচ্ছেন। আর অথর্ব-বেদের পুরোহিত ‘ব্রহ্মা’ এই বিশাল যজ্ঞের সমস্তটার ওপর দৃষ্টি রাখছেন। কিন্তু সবার ওপরে আছেন কুলপতি শৌনক। বারো বচ্ছরের যজ্ঞ। সোজা ব্যাপার তো নয়। সমস্ত দায়টাই তাঁর। তিনি কুলপতি। মহাভারতের ভাষায়–নৈমিষারণ্যে শৌনক্য কুলপতের্দ্বাদশবার্ষিকে সত্রে।
পিতৃকুল, মাতৃকুল, পক্ষিকুল, এমনকি কুলগুরু এরকম অনেক কুলের কথা শুনেছি, কিন্তু কুলপতি কথাটা তো শুনিনি। বাবা-টাবা গোছের কেউ হবে বুঝি। পণ্ডিতেরা বলবেন– শুনেছ, মনে নেই। এমনকি এই ঘোর কলিযুগে কুলপতি তুমি দেখেওছ। খেয়াল করে দেখো–কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলে, রাজার সঙ্গে শকুন্তলার তখনও দেখা হয়নি। ঋষি বালকেরা রাজাকে মহর্ষি কণ্বের খোঁজ দিয়ে বলল, এই তো মালিনী নদীর তীরে কুলপতি কণ্বের আশ্রম দেখা যাচ্ছে–এষ খলু কাশ্যপস্য কুলপতেরনুমালিনীতীরম আশ্রমো দৃশ্যতে।
যখন এসব পড়েছিলুম, তখন সিদ্ধবাবা, কাঠিয়াবাবা প্রমুখের সাম্যে কাশ্যপ-কণ্বকেও একজন মুনি-বাবাই ভেবেছিলুম। পরে সত্যিকারের পড়াশুনোর মধ্যে এসে দেখেছি–কুলপতি শব্দটার অর্থ নৈমিষারণ্যের মতোই বিশাল। এবং সত্যি কথা, কুলপতি গোছের মানুষ আমি দেখেওছি। কুলপতি হলেন এমনই একজন বিশাল-বুদ্ধি অধ্যাপক ঋষি, যিনি নিজের জীবনে অন্তত দশ হাজার সংযমী বৈদিককে খাইয়ে-পরিয়ে লেখা-পড়া শিখিয়েছেন–মুনীনাং দশ-সাহস্রম্ অন্নদানাদিপোষণাৎ। অধ্যাপয়তি বিপ্রর্ষিঃ– তা দশ হাজার না হলেও অনেক ছাত্রকে বাড়িতে রেখে, খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করে পড়াশুনোর সুযোগ করে দিয়েছেন–এমন অনেক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতকে আমি দেখেছি এবং অনেক অব্রাহ্মণ বিশাল-বুদ্ধি মানুষও আমি দেখেছি, যাঁরা এই কুলপতির গোত্রে পড়তে পারেন।
শৌনক এই মাপেরই মানুষ। হয়তো আরও বড়। কারণ বৃহদ্দেবতার মতো বৈদিক গ্রন্থ তাঁরই রচনা। মহাভারত কিংবা অন্যান্য পুরাণের আরম্ভে কুলপতি শৌনককে আমরা দেখেছি, তিনি হয়তো বৃহদ্দেবতার লেখক নন, কিন্তু তিনি যে বিশাল এক মহর্ষি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ তা নইলে সমস্ত পুরাণকারই এই নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনকের নাম ব্যবহার করতেন না।
কুলপতি কণ্বের আশ্রম যেমন মালিনীর তীরে, কুলপতি শৌনকের আশ্রমও তেমনই গোমতীর কোলঘেঁষা। গোটা ভারতে নৈমিষারণ্যের মতো এত বিশাল এবং এত সুন্দর তপোবন বোধহয় দ্বিতীয়টি ছিল না। এখনকার উত্তরপ্রদেশের লখনউ ছেড়ে মাইল পাঁচেক উত্তর-পশ্চিমে গেলেই দেখা যাবে তির-তির করে বয়ে যাচ্ছে গোমতী নদী। বর্ষাকালের জলোচ্ছ্বাস যাতে তপোবনের নিরুদ্বেগ শান্তি বিঘ্নিত না করে, তাই নৈমিষারণ্যের তপোবন গোমতী নদী থেকে একটু তফাতে, বাঁ-দিকে।
জায়গাটাও ভারি সুন্দর। ময়ূর কোকিল আর হাঁসের ছড়াছড়ি। গরু আর হরিণ একই সঙ্গে চরে বেড়াচ্ছে, অথচ বাঘ-সিংহের হিংসা নেই। শান্ত আশ্রম–শান্তস্বভাবৈর্ব্যাঘ্রাদ্যৈরাবৃতে নৈমিষে বনে। এই নৈমিষারণ্যে এলে কোটি-তীর্থ ভ্রমণের পুণ্য হয়। ‘নিমিষ’ মানে চোখের পলক। পুরাণ কাহিনীতে শোনা যায়, গৌরমুখ মুনি নাকি এখানে এক নিমেষে দুর্জয়-দানবের সৈন্য-সামন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন–যতম্ভ নিমিষেণেদং নিহতং দানবং বলম– সেই থেকেই এই জায়গার নাম নৈমিষারণ্য। সুপ্রতীকের ছেলে দুর্জয় রাজত্ব করতেন এই অঞ্চলে। অসামান্য তাঁর শক্তি। তিনি একদিন শুনলেন যে, তাঁরই রাজ্যের অধিবাসী গৌরমুখ মুনির কাছে নাকি চিন্তামণি আছে। সেই চিন্তামণির কাছে যা চাইবে তাই পাবে। দুর্জয় দানব মণিটি চেয়ে পাঠালেন। মুনি দেখলেন–ওই মণি অপাত্রে পড়লে পৃথিবী এবং মানুষের ক্ষতি হবে অনেক। তিনি মণি দিলেন না।
কিন্তু দানব দুর্জয় মুনির এই পরার্থচিন্তা মানবেন কেন? তিনি সসৈন্যে মুনির আশ্রমে রওনা দিলেন মণির দখল নিতে। দুর্জয়কে দেখতে পেয়েই বিরক্ত গৌরমুখ চোখের নিমেষে পুড়িয়ে দিলেন তাঁর সৈন্যবাহিনী এবং স্বয়ং দানবকেও। দুর্জয়ের সেই ভস্মপীঠের ওপরেই গজিয়ে উঠল ঘন বন, যার নাম নৈমিষারণ্য।
এখন ওঁরা বলেন, নিমখারবন বা নিমসর। নিমসর নামে একটা রেল-স্টেশনও আছে ওখানে। নৈমিষারণ্য থেকে নিমখারবন বা নিমসর কী করে হল, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে তা বোঝানো মুশকিল। তবে গোমতী নদী, যেমন নব-নব জলোচ্ছ্বাসে প্রতিদিন কূল ভেঙে নতুন চর তৈরি করে, তেমনই সাধারণের ভাষাও বহতা নদীর মতো নৈমিষারণ্য নামটিও ভেঙে-চুরে নতুন নাম তৈরি করেছে। প্রথম কথা, সাধারণ মানুষ ‘অরণ্য’ বলে না, বলে ‘বন’। এমনকি সাধারণ জনে এটাও খেয়াল করেনি যে, নৈমিষারণ্য দুটো শব্দের সন্ধি–নৈমিষ+অরণ্য। তাঁরা শুধু শেষের ‘ণ্য’টাকে ছেঁটে দিয়ে প্রথমে বলতে আরম্ভ করেছিলেন নৈমিষার-বন, যেন নৈমিষার একটা কথা। আপনারা হয়তো জানেনই যে, ‘ষ’ বর্ণটাকে উত্তরভারতে অনেকই ‘খ’ উচ্চারণ করেন। ‘সহস্ৰশীর্ষা’ পুরুষঃ এই মন্ত্রটাকে বৈদিকরা অনেকেই ‘পুরুখঃ’ বলেন। কবিরা ‘অনিমিষে’ শব্দটাকে কাব্যি করে বলেছেন ‘রইব চেয়ে অনিমিখে’। ফলে নৈমিষার-বন থেকে প্রথমে নৈমিখার-বন, আর তার থেকে নিমখার-বন শব্দটা বলতে আর কত সময় লাগবে। ছোট শব্দটা অর্থাৎ ‘নিমসর’ আরও সোজা। অর্থাৎ বনটাকেও ছেঁটে দিন। থাকে নৈমিষার। তার থেকে সোজা করে নিমসর।
এই নিমসর, নিমখারবন বা নৈমিষারণ্যেই কুলপতি শৌনকের বারো বচ্ছরের যজ্ঞ-প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। কম কথা তো নয়। এক একটি বিশেষ বৈদিক ক্রিয়াকলাপের জন্য একাধিক মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণ নিযুক্ত হয়েছেন। দিনভর ঋক-মন্ত্রের উচ্চারণ, সামগান, যজ্ঞ-হোম, অগ্নি-সমিন্ধন, সোম-রস-নিষ্কাসন, আহুতি– এত সব চলছে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত প্রক্রিয়ায় শান্ত-সমাহিত ঋষিরাও হাঁপিয়ে ওঠেন। তার ওপরে নিজেদের বিশেষ বৈদিক কর্মটি সাঙ্গ হওয়ার পর তাঁদের অবসরও জুটে যায় অনেক। তবু তো তখন অন্য মুনি-ঋষিদের সঙ্গে গল্প জোড়া চলে না। কেন না, একজনের কাজ শেষ হলে অন্যজনের বৈদিক ক্রিয়া-কলাপ আরম্ভ হয়।
তবে হ্যাঁ, দৈনন্দিন যজ্ঞক্রিয়ার পৌনঃপুনিকতা, ঋষিদের একঘেয়েমি অথবা তাঁদের অবসরের কথাগুলি মহাভারতে লেখা নেই। মহাভারতের কবির এসব কথা লেখা চলে না। মহাকাব্যের আরম্ভে তিনি শুধু জয়-শ্লোকটি উচ্চারণ করেই লিখে ফেলেছেন–বারো বচ্ছরের চলমান যজ্ঞ-ক্রিয়ার মধ্যেই এক পৌরাণিক এসে উপস্থিত হয়েছেন নৈমিষারণ্যে, শৌনকের তপোবনে। যে সে পৌরাণিক নন, একেবারে পৌরাণিকোত্তম লোমহর্ষণের পুত্ৰ উগ্রশ্রবা।
সেকালে লোমহর্ষণের মতো কথক ঠাকুর দ্বিতীয় ছিলেন না। জাতের বিচারে তিনি বামুনদের থেকে সামান্য খাটো, কেন না তাঁর জন্ম হয়েছিল বামুন-মায়ের গর্ভে কিন্তু তাঁর বাবা ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় কুলের যুদ্ধ-গৌরব আর বামুন-মায়ের শুদ্ধশীল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য-ভাবনা এই সংকর-জন্মা ছেলেটির মনে এমন এক মিশ্ৰক্ৰিয়া তৈরি করেছিল যে, সে শুধু গল্প বলাই শিখেছে, গল্প বলাই তার প্রথম প্রেম। ক্ষত্রিয় হয়েও যার বাবা বামুনের ঘরের মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছিল, সেই ভালবাসার মধ্যেও গল্প ছিল, স্বপ্ন ছিল। গল্প আর স্বপ্নের মিলনেই সূত-জাতির জন্ম। লোমহর্ষণ সেই সূত-জাতির লোক।
সূতজাতি নাকি ভারতের প্রথম বর্ণসংকর। শোনা যায় রাজা পৃথু, যাঁর নামে এই পৃথিবী শব্দটি, সেই পৃথুর যজ্ঞে দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির জন্য যে ঘৃতাহুতি প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেই ঘিয়ের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের ঘৃতাহুতি মিশে যায়। এদিকে আহুতি দেওয়ার সময় বৃহস্পতির ঘৃতাহুতি হাতে নিয়ে ইন্দ্রের উদ্দেশে মন্ত্র উচ্চারিত হয়। ইন্দ্র হলেন দেবতাদের রাজা, ক্ষত্রিয়ত্বই রাজার সংজ্ঞা। ফল যা হওয়ার তাই হল, এই হবির্মিশ্রণের ঘটনা থেকেই সূত জাতির উৎপত্তি। পৃথিবীর প্রথম বর্ণসংকর–সূত্যায়ামভবৎ সূতঃ প্রথমং বর্ণবৈকৃতম্। ক্ষত্রিয় পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণ-কন্যার গর্ভে তাঁর জন্ম। রাজাদের সারথিবৃত্তি অথবা তাঁদের মন্ত্রিসভায় একজন মাননীয় মন্ত্রী হওয়াটা তাঁর কাছে মুখ্য কোনও কাজ নয়। তার প্রধান কাজ- রাজা, মুনি-ঋষিদের বংশগৌরব কীর্তন করা, সৃষ্টি-প্রলয়-মন্বন্তরের বিচিত্র কথা শোনানো। আর ঠিক এই কাজেই সূত লোমহর্ষণের ভারত-জোড়া নাম।
লোমহর্ষণের আসল নাম কী ছিল, তাও বোধহয় সবাই ভুলে গেছে। তাঁর কথকতা, গল্প বলার ঢঙ ছিল এমনই উঁচু মানের যে তাঁর কথকতার আসরে শ্রোতাদের গায়ের লোম খুশিতে খাড়া হয়ে উঠত। তাই তাঁর নামই হয়ে গেল লোমহর্ষণ। লোমানি হর্ষয়াঞ্চক্রে শ্রোতৃণাং যঃ সুভাষিতৈঃ। স্বয়ং ব্যাসের তিনি প্রিয় শিষ্য। ব্যাস মহাকাব্য লিখেছেন, অষ্টাদশ পুরাণ লিখেছেন। তিনি লেখক–লেখার ‘অডিও-এফেক্ট’ তাঁর ভাল জানা নেই। যেদিন তিনি দেখলেন–তাঁরই লেখা জমিয়ে গল্প করে যে মানুষ শ্রোতাদের লোম খাড়া করে দিতে পারেন, সেদিনই বোধহয় তিনি এই সূতজাতীয় মেধাবী মানুষটির নাম দিয়েছিলেন লোমহর্ষণ এবং তাঁকে শিষ্যত্ব বরণ করে তাঁর মহাকাব্যের রসে দীক্ষা দিয়েছিলেন- শিষ্যো বভুব মেধাবী ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতঃ।
সেই লোমহর্ষণের ছেলে এসে উপস্থিত হয়েছেন শৌনকের আশ্রমে। উগ্রশ্রবা তাঁর নাম। কথকতায় লোম খাড়া করার ক্ষমতা তাঁরও আছে। লোকে তাঁকে যত না উগ্রশ্রবা নামে জানে, তার থেকে বেশি জানে–সে বাপকা বেটা– অর্থাৎ ভাবটা এই– আরে ও হচ্ছে লোমহর্ষণের ছেলে লৌমহর্ষণি, সূতের ছেলে সৌতি। আসলে লোমহর্ষণের কথকতা শুনলে যেমন শ্রোতার লোম খাড়া হয়ে ওঠে, তেমনই তাঁর ছেলেরও সেই ক্ষমতা আছে। এই জন্যই তাঁকে সবাই– লোমহর্ষণি বলেই বেশি ডাকে। মহাভারত তাই বলেছে– লোমহর্ষণপুত্রঃ উগ্রশ্রবাঃ সৌতিঃ। বাপের সুবাদে উগ্রশ্রবা সৌতিও ব্যাসের সঙ্গ পেয়েছেন। ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নের তিনি বড় স্নেহভাজন।
লৌমহর্ষণ উগ্রশ্রবা যখন শৌনকের আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন হয়তো সূর্য অস্ত গেছে। সারাদিন যজ্ঞক্রিয়ার পর তখন ঋষিদের অনন্ত অবসর। সবাই একসঙ্গে বসে আছেন, কথা দিয়ে কথা বাড়াচ্ছেন। ব্রহ্মচারী বালকেরা সমিৎ কুড়িয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এই অবসর আর প্রশান্তির মধ্যেই লৌমহর্ষণি উগ্রশ্রবা তপোবনে প্রবেশ করেছেন।
লৌমহর্ষণিকে দেখে ঋষি-মুনিরা সব একেবারে হই-হই করে উঠলেন। সবাই মনে মনে একেবারে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। অনন্ত অবসর, অথচ বৃথা কাল না যায়– কেন হ্যবসরঃ কালো যাপনীয়ো বৃথা ন হি–কথক ঠাকুরের আগমন এই অবসর সফল করার একমাত্র উপায়। কথক ঠাকুর উগ্রশ্রবা সৎ-প্রসঙ্গ আর ধর্মকথা যতই বলুন, তার মধ্যে প্রধান আকর্ষণ হল গল্প। রাজা-রাজড়ার গল্প, ঋষি-মুনি অথবা ভগবানের বিচিত্র কাহিনী, লীলা প্রসঙ্গ। দিনভর বৈদিক ক্রিয়া-কলাপে ব্যস্ত ঋষিরা গল্প শোনার আনন্দে সবাই মিলে একেবারে ঘিরে ধরলেন সৌতি উগ্রশ্রবাকে–চিত্রা শ্রোতুং কথাত্ৰস্ত পরিবব্ৰুস্তপস্বিনঃ।
সৌতি সমবেত মুনি-ঋষিদের হাত-জোড় করে নমস্কার জানালেন। বললেন, ঠাকুরদের সব কুশল তো? আপনাদের ধর্ম-কর্ম-তপস্যা ঠিক মতো চলছে তো?
ঋষিরা কুশল বিনিময় করলেন উগ্রশ্রবা সৌতির সঙ্গে। এই বিশাল যজ্ঞ চলা-কালীন যদি কোনও পৌরাণিক এসে পড়েন– এই রকম একটা প্রত্যাশার ভাবনা ঋষিদের মনে ছিল বলে তাঁরা একটা বিশেষ আসন ঠিক করেই রেখেছিলেন। মুনিরা সবাই উগ্রশ্রবাকে ঘিরে বসে পড়লে তিনিও তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। এত দূরের পথ বেয়ে এসেছেন, জল-মিষ্টি খেয়ে তিনি খানিক জিরোলেন। ঋষি-ব্রাহ্মণেরা যখন দেখলেন–তাঁর শ্রান্তি আর নেই, তিনি বেশ আরাম করে জমিয়ে বসেছেন নিজের আসনে–সুখাসীনং ততস্তং বৈ বিশ্রান্তমুপলক্ষ্য চ– তখন তাঁরা বললেন, কোত্থেকে আসছ, সৌতি? এতদিন কোথায় কোথায় ঘুরলে?
উগ্রশ্রবা লৌমহর্ষণি বুঝলেন, ঋষিরা গল্প শোনার জন্য একেবারে মুখিয়ে আছেন। ঋষীণাং ভাবিতাত্মনাম। তিনি বললেন–পরীক্ষিতের ছেলে মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ চলছিল, ঠাকুর। আমি সেইখানেই ছিলাম। সেখানে মহর্ষি বৈশম্পায়ন ব্যাসের বলা মহাভারতের কথা শোনালেন সবিস্তারে। এতদিন সেই সব ভারত-কাহিনীই শুনলাম বসে বসে। তারপর সর্পষজ্ঞ সেরে এ তীর্থ সে তীর্থ ঘুরে পৌঁছলাম সমন্তপঞ্চকে, সেই যেখানে কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ হল–গতবানস্মি তং দেশং যুদ্ধং যত্রাভবৎ পুরা। সব দেখার পর মনে হল–একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই। তাই চলে এলাম।
এই দুটো কথা থেকেই উগ্রশ্রবা সৌতির গল্প বলার ক্ষমতা বোঝা যায়। উম্মুখ শ্রোতার কানে দুটো অব্যর্থ শব্দ সে ঢেলে দিয়েছে। এক জনমেজয়ের সপর্যজ্ঞ, দুই কুরু-পাণ্ডবের মহাযুদ্ধ। নৈমিষারণ্যের ব্রতক্লিষ্ট ঋষিরা অনেক দিন থেকেই জানতেন যে, মহান কৌরব-কুলে এক বিরাট জ্ঞাতি-বিরোধ ধুমিয়ে উঠছে কতকাল ধরে। কখনও কৌরবদের অবস্থা ভাল, কখনও পাণ্ডবদের–এই রকমই চলছিল। কিন্তু মাঝখানে এত বড় যুদ্ধ ঘটে গেছে, পরীক্ষিত রাজা হয়েও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি– এই সব খবর তাঁরা সবিস্তারে জানেন না। আর জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞটা তো একেবারেই নতুন খবর। অতএব উগ্রশ্রবা সৌতির কথার সূত্রপাতেই সমুৎসুক ঋষিদের শ্রবণেচ্ছা শানিত হল।
আর এই সৌতির নিজের বোধ-বুদ্ধিও কম নয়। বৈশম্পায়নের বলা কথা শুনেই তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি সরেজমিনে সমন্তপঞ্চকে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ পরিণতি দেখতে। জায়গাটা ভাল করে দেখা না থাকলে জ্ঞানী-গুণী ঋষি-মুনির সামনে ঘটনার বিবরণ দেবেন কী করে? তাছাড়া সমস্তপঞ্চক শব্দটা উপস্থিত ঋষি-মুনিদের কানটা খাড়া করে তুলল। কারণ, এই জায়গাটা অনেক কাহিনীর আকর। সেই সমস্তপঞ্চকে আবারও একটা নতুন ঘটনা ঘটেছে– এটা শ্রোতা ঋষিদের প্রশ্রয় উদ্রেক করার পক্ষে যথেষ্ট।
ঋষিরাও বুদ্ধিমান। তাঁরা শুধু সমন্তপঞ্চকের পরিণতি শুনে বিশাল এক উপন্যাস কাহিনীর মজা নষ্ট করতে চাইলেন না। তাঁরা বললেন, ওই যে বললে, দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাহিনী, পুরাণ-কথা। তা ব্যাসের কথা মানেই তো বেদ-উপনিষদের নির্যাস, সূক্ষ্ম তত্ত্বের কথা, যার বহিরঙ্গে ভারতের ইতিহাস, বিচিত্র উপাখ্যান– ভারতস্যেতিহাসস্য পুণ্যাং গ্রন্থার্থসংযুতাম।
আসলে ঋষিদের মনে একটা পাপবোধ কাজ করছে। তাঁরা যজ্ঞ করতে এসেছেন। তাঁদের মনটা সদা সর্বদা যজ্ঞ অথবা যজ্ঞাঙ্গীয় কাজেই ব্যাপৃত রাখার কথা। কিন্তু যজ্ঞের প্রাত্যহিক পৌনঃপুনিকতা এধং অবসর তাঁদের ঠেলে দিয়েছে অভিনব কাহিনীর সন্ধানে। কিন্তু কাহিনী, আখ্যান-উপাখ্যান যদি ব্যাসের লেখা হয়, তবে তাঁদের বিরাট সুবিধে। যে মহাকবি চতুর্বেদের বিভাগ করেছেন, অষ্টাদশ পুরাণ লিখে তবে মহাভারত লিখতে বসেছেন, তিনি যে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ উলটে দিয়ে শুধুই প্রাকৃতজনের গল্প-কথা বলে যাবেন না, সে কথা নিশ্চিত। ঋষিদের এইটাই বাঁচোয়া। যজ্ঞ-কার্যহীন একটা সময়েও তাঁরা বৃথা সময় কাটাচ্ছেন না–তাঁরা এমন একটা কাব্য-ইতিহাস শুনতে চাইছেন, যার মধ্যে পাপনাশিনী ধর্মকথাও যেমন আছে, তেমনই আছে বেদের হবির্গন্ধ এবং উপনিষদের শান্ত জ্ঞান- সূক্ষ্ণার্থন্যায়যুক্তস্য বেদার্থৈভূষিতস্য চ।
ঋষিরা বললেন– তুমি আরম্ভ করো, সৌতি। আমরা শুনতে চাই দ্বৈপায়ন ব্যাসের লেখা সেই কাহিনী। অদ্ভূত তাঁর ক্ষমতা, যিনি মহাভারতের মতো বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছেন– ব্যাসস্য অদ্ভুতকর্মণঃ। মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে গিয়ে বৈশম্পায়নের মুখে সেই কাহিনীই তো তুমি শুনে এলে– জনমেজয়স্য যাং রাজ্ঞো বৈশম্পায়ন উক্তবান্। আরম্ভ করো তুমি।
.
০২.
সৌতি উগ্রশ্রবা এবার কথক-ঠাকুরের নিয়ম-কানুন মেনে–তাঁর গাওনা যাতে ভাল হয়, যাতে নির্বিঘ্নে মহাভারতের বিচিত্র পদ-পর্বগুলি শ্রোতার সামনে একের পর এক তিনি পরিবেশন করতে পারেন, তার জন্য পরম ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করে বললেন–
শুনুন তাহলে ঋষি-ঠাকুররা। এই জগতের আদি পুরুষ ভগবান শ্রীহরিকে নমস্কার। অদ্ভুতকর্মা দ্বৈপায়ন ব্যাসের লেখা মহাভারতের কথা বলব আমি। তবে দেখুন–আমিই কিন্তু সেই প্রথম লোকটি নই যে এই কাহিনী প্রথম বলছে। আমার আগেও অন্য কবিওয়ালারা এই কাহিনী বলে গেছেন, আমার সমসাময়িকেরাও বলছেন– আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে– আবার ভবিষ্যতেও অন্য কবিরাও আমারই মতো এই মহাভারতের ইতিহাস বলবেন।
সৌতির মুখে এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই একটু টান-টান হয়ে বসতে হয়। আজকের গবেষকরা অনেক তত্ত্ব-তথ্য প্রয়োগ করে, মহাভারতের নানান জায়গা খুঁজে নানান অসামঞ্জস্য খুঁজে বার করেন। এই অসামঞ্জস্যের সূত্রগুলি হল–বিভিন্ন চরিত্রের বয়স, ঘটনার সময় অসময়, শব্দ-ব্যবহার, স্টাইল, ছন্দ সব কিছু।
সব বিচারের পর একেক পণ্ডিতের একেক রকম ব্যবচ্ছেদ-পর্ব শুরু হয় মহাভারতের শরীরে। কেউ বলবেন– ভীমের রক্তপান, সে যে একেবারে আদিম সমাজের প্রতিহিংসা-প্রবণতা। এই প্রবণতার সঙ্গে মহাভারতের পরিশীলিত ব্যাপারগুলি মেলে না। অতএব ওই পরিশীলিত অংশটুকু পরে লেখা হয়েছে, ওটা প্রক্ষেপ। আরেক পণ্ডিত বলবেন– মহাভারতের মূল ক্ষত্রিয়-কাহিনীর সঙ্গে মহাভারতের নানা ঋষির জ্ঞান-দান, নীতি-কথা মোটেই মেলে না– ওগুলি সব ব্রাহ্মণ্য সংযোজন অর্থাৎ প্রক্ষেপ। আরেক দল কড়া পণ্ডিত– যাঁরা মহাভারত অশুদ্ধ হলেই ভীষণ রেগে যান– তাঁরা আবার শুধু মহাভারতের জ্ঞাতিবিরোধ আর যুদ্ধ কাহিনীটুকুই ধরে রাখতে চান। সেটাই শুধু মহাভারতের শুদ্ধ কাহিনী। আর সব পরে সংযযাজিত এবং সেই সংযোজন নাকি ভার্গব বংশীয় ব্রাহ্মণদের তৈরি; ঘটা করে তার নাম দেওয়া হল ভার্গব-প্রক্ষেপ। পণ্ডিতদের বুদ্ধি-ব্যায়ামে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছে, তাতে দেখা যাবে মহাভারতের মূল কাহিনী মোটেই বড় নয়। শুধু জ্ঞাতিবিরোধ, মন-কষাকষি এবং যুদ্ধ, তারপর আর সবই প্রক্ষেপ।
এইসব অসামান্য গবেষকের চিন্তা-দৃপ্ত পত্ররচনা দেখলে মনে মনে যুগপৎ প্রশংসা এবং মায়া-দুয়েরই উদয় হয়। প্রশংসা এই কারণে যে, এঁদের পড়াশুনো এবং বিদ্যার বিন্যাস-কৌশল সত্যিই অপূর্ব। আর মায়া এই জন্য যে, এঁরা কোনও কিছুই আর সামগ্রিকভাবে, স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে পান না। সহজ জিনিসকে অনর্থকভাবে জটিল করে ফেলতে এঁরা এতই দক্ষ যে, প্রক্ষেপ-প্ৰক্ষেপ করতে করতে এরা মহাভারতের বিশাল আখ্যান-রসটাই আর অনুভব করতে পারেন না। এদের অবস্থা দেখলে একটা খারাপ কথা আমার মনে আসে যদিও সেটা সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রের কথা। একজন রসিক-সুজন বলেছেন- কাব্যার্থ আস্বাদন করার সময় যারা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে চিন্তা করেন, তারা আসলে শৃঙ্গারকালে রমণীর আবরণ উন্মোচনের সময় কাপড়ের দাম নিয়ে ভাবেন-নীবীমোক্ষণকালে তু বস্ত্র-মৌল্য-বিচিন্তকাঃ।
নতুন কিছু করার মতো ব্যবসায়-সম্পন্ন তথা পাটোয়ারি-বুদ্ধি-সমম্বিত এই সব পণ্ডিত-ধুরন্ধরের বক্তব্য কখনওই অকাট্য নয়; তবে তা কাটার মতো উপযুক্ত ইচ্ছা আমার কখনওই হয় না। হয় না, কারণ, আমরা জানি মহাভারতের গল্প এতই জনপ্রিয় যে, সেই জনপ্রিয়তার সুযোগে কথক-ঠাকুরদের অনেক গল্প, ঋষি-মুনিদের অনেক তত্ত্বজ্ঞান, মানুষের অনেক হৃদয়-স্পন্দন মিশে গেছে ভারত-কথার প্রবাহে। ভারত-কথা হয়ে উঠেছে মহা-ভারত।
কথক ঠাকুর সে কথা জানেন। ভারত-কথার আরম্ভেই তিনি স্বীকার করেন, আমিই কিন্তু প্রথম লোক নই যে এই কাহিনী শোনাচ্ছে। আমার আগেও কবিরা এই কথা বলেছেন, পরেও বলবেন- আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাস মিমং ভুবি। সেই প্রাচীন কাল থেকে যে কথা গঙ্গার জলধারার মতো আজও বয়ে চলেছে, সেই জল-ধারার মধ্যে কবে কখন কোন গল্পের নদী এসে মিলল, কবে কখন কোন তত্ত্বের প্রবাহ এসে প্রবেশ করল, কখন কোন স্বার্থে স্বার্থান্বেষীর নালার জল ইচ্ছে করে গঙ্গার জলে খাল কেটে বইয়ে দেওয়া হল-গবেষণা করলে সে সবই অনেকটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যেতে পারে বটে, তবে সম্পূর্ণ জলধারার। মধ্য থেকে সেই ছোট ছোট নদীর জল, নালার জল আর চেনা যাবে কি? সব রকমের জল-প্রবাহ যখন গঙ্গায় পড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তখন গঙ্গা যেমন সব জলকেই নিজের পবিত্রতার মাহাত্ম্য দান করে, তেমনই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিও মহাভারতের বিশাল শরীরে সম্পূর্ণ আত্মীকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে স্পষ্ট করে তাদের যেমন আর চেনাও যায় না, তেমনই মহাভারতের প্রাপ্য মর্যাদা থেকেও সেই প্রক্ষিপ্তাংশগুলিকে বঞ্চিত করা যায় না।
বস্তুত বিরাট সুরধুনী-ধারার মধ্য থেকে দুই অঞ্জলি জল তুলে নিয়ে যেমন নির্দিষ্ট করে বলা যায় না- এটা অমুক শাখা-নদীর জল অথবা তমুক শাখা-নদীর, তেমনই মহাভারতের মধ্যেও প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিকে আমাদের পরিশীলিত গবেষণার সূত্রে অনুমান-চিহ্নিত করা যায় মাত্র, তার বেশি কিছু করা যায় না। বলা যায় না– এটা অবশ্যই প্রক্ষিপ্ত অথবা এইটাই মূলাংশ। আমার ব্যক্তিগত মত হল, মহাভারত শুনতে হলে বা বুঝতে হলে অথবা আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল– এই ভারতকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হলে মহাভারত যেমনটি আছে, তেমন ভাবেই তাকে ধরা ভাল। এরমধ্যে কোনটা ব্রাহ্মণ্য সংযোজন কোনটা ক্ষত্রিয়-সংযোজন এইসব অপোদ্ধার পদ্ধতি নিয়ে যারা বেশি মাথা ঘামান জানতে ইচ্ছে করে তাঁরা কি ভারতের জনজীবনেও রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়েও মাথা ঘামান?
মহাভারতের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে, অথবা পরতে পরতে তার লেয়ার তৈরি করে যারা ঢাকাই পরোটায় পরিণত করেছেন, তাদের যত রাগ ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের ওপর। বিশেষত যেখানে নারীর অধিকার খর্বিত, শূদ্রেরা নিন্দিত অথবা আচার-ব্রতের জয়গান- সেই সব জায়গা পরিশীলিত গবেষকের চোখে ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মুশকিল হল- এগুলির কোন কোনটি যে পরবর্তীকালে সংযোজিত, আমিও মানি এবং এতদ্বারা নারী-শূদ্র এবং তথাকথিত নিম্নস্তরের জন-জাতির অধিকার যে বিপন্ন হয়েছে, তাও মানি, কিন্তু এগুলিকে শুধুই ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে শুধু একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ওপর জনরোষ তৈরি করারও কোনও অর্থ আছে বলে আমার মনে হয় না। যারা তা করছেন, তারা পূর্বতন অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য অন্যতর আরও এক অন্যায়ের আশ্রয় নিচ্ছেন।
তাছাড়া মনে রাখা দরকার, মহাভারতের যে অংশগুলি আধুনিক সমাজে নিন্দিত এবং প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হচ্ছে, সেগুলি যদি তর্কের খাতিরে ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলেও মেনে নেওয়া যায়– সত্যি বলতে কি আমিও তাই মানি– তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে, মহাভারতের মূল অংশ কি তাহলে ব্রাহ্মণেতর অন্য কোনও জাতির লেখা? ক্ষত্রিয় বৈশ্য বা শুদ্রের লেখা? বলতে দ্বিধা নেই–এ কথা বোধহয় গবেষণার শত সূত্রেও প্রমাণ করা যাবে না। তাহলে বলি- মহাকাব্যের প্রকৃষ্ট অংশটুকু যদি ব্রাহ্মণদের লেখা হয় এবং সংযোজনগুলিতেও যদি ব্রাহ্মণদেরই কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে সিদ্ধান্ত হয়–সমাজে মহাকবি গোছের ভাল ব্রাহ্মণও যেমন ছিলেন আবার তেমনই অকবি, স্বেচ্ছাবিহারী, স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণেরাও ছিলেন। একই জাতির একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দোষে সমগ্র ব্রাহ্মণ জাতি গালাগালি ধান কেন? মানব সমাজের মুক্তি যাদের কাছে কাম্য, তাদের কাছে নিবেদন হয় এই বিভেদ সৃষ্টির খেলা বন্ধ করুন, নয়তো ব্রাহ্মণ্য সংযোজন’–এই শব্দটির সাধারণীকরণ বর্জন করে ‘দুষ্ট ব্রাহ্মণ্য সংযোজন’ বলুন। সাধারণভাবে বললে স্বীকার করতেই হবে যে, ব্রাহ্মণরা নারী-শূদ্র বা বহু জন-জাতির প্রতি অন্যায় আচরণ যেমন করেছে, তেমনই সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাল কাজও কিছু করেছে। তার উদাহরণ দিতে পারি ভূরি ভূরি।
থাক এসব কথা। উগ্রশ্রবা সৌতি যে মুহূর্তে মহাভারতের আখ্যান আরম্ভ করেছেন, সে মুহূর্তেই তিনি জানেন–তিনি যা বলছেন, সেই কথা-কাহিনী তার পূর্বজরা হয়তো আরও একভাবে শুনেছেন এবং আরও অন্য কোনওভাবে বর্ণনাও করেছেন হয়তো ব্যাখ্যঃ কবয়ঃ কেচিৎ। তিনি জানেন- মহাভারতের কথা ভারতের মতোই বিচিত্র এবং ততোধিক বিচিত্র এক মানবগোষ্ঠীর জীবনের প্রতিফলন। তিনি জানেন–ভারতের তথাকথিত আর্য সম্প্রদায় কোনো ভাবেই রক্তের বিশুদ্ধতা টিকিয়ে রাখতে পারে না। শত কবির দর্শন মনন এবং কখনও বা স্কুল হস্তের অবলেপও ঘটেছে এখানে। একটি বিশাল জাতির ইতিহাস কখনও কোনও একক কবির মনন-সীমায় আবদ্ধ হতে পারে না। জন-জাতির শরীরে মনে যখন যে প্রভাব এসেছে, কবিরাও তা ধরে রেখেছেন মহাকাব্য-ইতিহাসের প্যানোরমায়।
হয়তো এই কারণেই-কথাটা ভেবে দেখবেন একটু–মহাভারত বিশালবুদ্ধি ব্রাহ্মণ ব্যাসের লেখা হলেও, সে কাহিনী বৈশম্পায়নের মতো এক ব্রাহ্মণের মুখে প্রাথমিকভাবে উচ্চারিত হলেও আমরা যে কথক-ঠাকুরের মুখে মহাভারতের কথা শুনছি, তিনি কিন্তু একজন সংকরজ কবি, তিনি সূত-জাতীয়। মহাভারতের বিচিত্র সংযোজন-পর্বের নিরিখে যে সাস্কর্যের সৃষ্টি হয়েছে, সেই সাক্কর্য এই সূতজাতীয় কথক ঠাকুরের মধ্যেও আছে। হয়তো সেই কারণেই কোনও ব্রাহ্মণ নয়, ক্ষত্রিয়ও নয়, কিংবা বৈশ্যও নয়, একজন সূত-জাতীয় ব্যক্তিই মহাভারতের বক্তা নির্বাচিত হয়েছেন।
সূত কাকে বলে জানেন? প্রাচীন নৃতত্তের সূত্রে দুভাবে ‘সূত’-শব্দটির ব্যাখ্যা করা যায়। যদি মনু মহারাজকে আমরা প্রাচীন নৃতত্ত্ব অথবা জাতিতত্ত্বের প্রধান ভাষ্যকার বলে মেনে নিই, তাহলে ‘সূত’ শব্দের প্রধান ব্যাখ্যা হল–ক্ষত্রিয় বীর-পুরুষ যদি ব্রাহ্মণী বিয়ে করে বসতেন তবে তাদের ছেলেদের জাতিগত উপাধি হত সূত– ক্ষত্রিয়া বিপ্রকন্যায়াং সূতো ভবতি জাতিতঃ। মহাভারতের বক্তা সূত লোমহর্ষণকে অথবা সৌতি উগ্রশ্রবাকে যদি এই ব্যাখ্যায় বিচার করি, তাহলে বোধহয় ঠিক হবে না।
বস্তুত মহাভারত বা পুরাণের যুগে সূত বলে একটা আলাদা ক্লাসই ছিল। পুরাণগুলির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে যেদিন আমরা প্রথম রাজা পেয়েছি, সেদিন থেকে আমরা সূত’কেও পেয়েছি। পুরাণ মতে এই পৃথিবীর প্রথম সার্থক রাজা হলেন পৃথু–যার নামে এই পৃথ্বী বা পৃথিবী। তা পৃথু যেদিন জন্মালেন, সেইদিনই পিতামহ ব্রহ্ম সোমযজ্ঞের আহুতি-ভূমিতে সূত এবং মাগধদের সৃষ্টি করলেন। সমাগত মুনি-ঋষিরা সূত-মাগধদের অনুরোধ করলেন মহান পৃধুর স্তব করতে
সেই যে প্রথম সূত-মাগধেরা পৃথুর স্তব করেছিলেন, তার পর থেকেই এঁরা চিহ্নিত হয়ে গেলেন রাজবংশের কীর্তি-গায়ক হিসেবে। বিভিন্ন রাজবংশের কীর্তিখ্যাতি, মুনি-ঋষিদের আশ্চর্য সব তপশ্চর্যা– সব এই সূতেরা স্মৃতিতে ধরে রাখতেন বলেই সূতেরাই ছিলেন সে যুগের ঐতিহাসিক, যাকে তৎকালীন পুরাণের ভাষায় বলা হয় পৌরাণিক’–সূতাঃ পৌরাণিকা থোক্তাঃ।
মহাভারতে দেখবেন প্রথমেই বলা হচ্ছে লোমহর্ষণ সূতের ছেলে ‘পৌরাণিক উগ্রশ্রবা এসেছেন শৌনকের আশ্রমে লোমহর্ষণপুত্র উগ্রশ্রবাঃ সৌতিঃ পৌরাণিকো নৈমিষারণ্যে। প্রাচীন সমাজের মুনি-ঋষিরা সূতদের যথেষ্ট সম্মান করতেন, কারণ তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি পড়াশুনো ছিল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতোই গভীর–পুরাণের ভাষায়–অমলপ্রজ্ঞাঃ। যদি ধরে নিই–মনুর বিধান মতো ক্ষত্রিয়-পুরুষ আর ব্রাহ্মণী সুন্দরীর মিলনে যে সূত-জাতি তৈরি হয়েছিল, কালক্রমে তারাই পৌরাণিক, ঐতিহাসিক হয়ে গেলেন, তাহলেও বলতে হবে– রাজবংশ এবং মুনিবংশের ইতিহাসই শুধু নয়, মহাভারতের মতো বিশাল এই ইতিহাস শোনানোর জন্যও নয়, কালে কালে মহাভারতের বিভিন্ন সংযোজন-পর্ব শোনাবার পক্ষে তারাই সবচেয়ে উপযুক্ত লোক– যাঁদের ভাষ্য দেওয়ার ক্ষমতা পৃথুরাজের সময় থেকেই চিহ্নিত এবং যারা জন্মগতভাবে সংকর।
সংকর বলেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের এমন বিচিত্র সংকর মহাভারতের ইতিহাস বলার ভার সূতেরই ওপর। সংকর বলেই কালে কালে ভিন্ন ভিন্ন কবির ভিন্ন ভিন্ন সংবোজন তার কাছে অচ্ছুৎ নয়, তারা সব মিলিয়ে দিতে পারেন। মহাভারতের প্রত্যেক ঘটনার ওপর, প্রত্যেক আগন্তুক তত্ত্ব এবং তথ্যের ওপর সূতের মায়া আছে। আর মায়া আছে তাদের ওপর–যারা পূর্বে তাদেরই মতো করে মহাভারতের কথা শুনিয়েছেন। সহমর্মিতা আছে তাদের ওপর যারা তার সম-সময়ে মহাভারতের আখ্যান বলে যাচ্ছেন। শুভেচ্ছা আছে তাদের জন্য যারা ভবিষ্যতে ভারত-কথার মর্যাদাতেই মহাভারত শোনাবেন- আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভুবি। আমার গর্ব আমি সেই সংকরজম্মা সূতের আশীর্বাদ-ভাগী –যে আজও মহাভারতের কাহিনী সূতের আশ্রয় নিয়ে বোঝাতে চায়। পাঠকেরা আমাকে কিছু কাল সহ্য করুন যাতে উগ্রশ্রবা সৌতির বিচিত্র কাহিনী আজকের দিনের মানসিকতায় আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
একটি কথা মহাভারতের কবির সমান হৃদয় নিয়ে বোঝা দরকার যে, মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে ব্রাহ্মণের সংযোজন যাই থাকুক, কিন্তু সেই ব্রাহ্মণের স্পর্শদোষে মহাভারতের সার্বত্রিকতা নষ্ট হয়ে যায় না। সহানুভূতি নিয়ে স্মরণ করুন মহাপ্রস্থান পর্বের সেই আশ্রিত অস্পৃশ্য কুকুরের কাহিনী। মহারাজ যুধিষ্ঠির তাকে ধর্মরূপী বুঝে সঙ্গে নিয়ে যাননি, ঘৃণিত কুকুরত্বের মর্যাদা বা অমর্যাদাতেই যে যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়-সরসতা ভোগ করেছিল। মহাভারতের শেষ, মহাপ্রস্থানের পথে একটি কুকুরেরও যে মর্যাদা বা সম্মান আছে, মহাভারতের আদিতেও তাই।
আমরা পণ্ডিত-অধ্যাপকদের কাছে শুনেছি যে, প্রাচীন কবি-নাট্যকারদের লেখার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা নাকি যে ঘটনা দিয়ে কাব্যারম্ভ করেন, কাব্য-বা নাটকের শেষেও নাকি সেই ঘটনা অথবা অনুরূপ ঘটনার সূচনা থাকে। অথবা কাব্য-নাটকের প্রথম ভাগটা যদি সমস্যা দিয়ে শুরু হয়, তবে শেষ হয় সমাধান দিয়ে। যেমন ধরুন কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তল নাটকের প্রথম অঙ্কে কণ্বমুনির আশ্রমে আমরা প্রথম শকুন্তলা-দুষ্যন্তকে মিলিত হতে দেখেছি। তারপর অনেক বাধা, অনেক ঝড়-ঝঞ্জার পর নাটক-শেষের সপ্তম। অঙ্কে মঞ্চ স্থাপিত হয়েছে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে। সেখানে আবার আমরা শকুন্তলা-দুষ্যন্তকে মিলিত হতে দেখছি। মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে যে প্রণয়-কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিল, মহর্ষি মারীচের আশ্রমে সেই প্রণয়-কুসুম ত্যাগের মাহাত্মে সুমধুর ফলে পরিণত হল। অন্য ক্ষেত্রে যদি ভগবদ্ গীতার মতো একটা দার্শনিক গ্রন্থের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করি, তাহলে দেখবেন–গীতার আরম্ভ হচ্ছে অর্জুনের বিষাদ এবং মোহে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভাই-বেরাদরকে দেখে অর্জুন একই সঙ্গে কৃপাবিষ্ট এবং মোহগ্রস্ত। তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে দার্শনিক তত্ত্ব এবং তাত্ত্বিক বিবৃতি। অধ্যায়ের শেষে দেখা যাচ্ছে আবার সেই মোহের কথা ফিরে এসেছে। কৃষ্ণের উপদেশে। অর্জুন এখন সম্পূর্ণ মোহমুক্ত। সমস্যা যা ছিল তার সমাধান হয়ে গেছে। উপদেশদীপ্ত অর্জুনের মুখে তখন সদর্প ঘোষণা শোনা যাচ্ছে আর আমার কোনও মোহ নেই, কৃষ্ণ! আমি আবার। স্ব-রূপে প্রতিষ্ঠিত–নষ্টো মোহঃ স্মৃতি লা ত্বৎপ্রসাদাৎ ময়াচ্যুত। স্থিতোস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।
মহাভারত মহাকাব্যখানিকেও এই নিরিখে দেখা যায়। এখানেও মহাকাব্যের শেষে আমরা যেমন এক অধম কুকুরের কাহিনী দিয়ে মহাপ্রস্থানের শেষ সূচনা দেখতে পাচ্ছি, তেমনই ভারতকথার আরম্ভেও উগ্রশ্রবা সৌতি এক কুকুরের কাহিনী দিয়েই শুরু করেছেন। মহাভারতের মূল আরম্ভে অধ্যায়-সূত্র ছাড়াও আরও দু-চারখানা গল্প আছে বটে, তবে মহাভারতে যেহেতু কৌরব-পাণ্ডবের বংশ বিস্তার এবং তাদের যুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে, তাই পাণ্ডবের শেষ বংশধর জনমেজয়ের কথা না বলে মহাভারতের কথায় প্রবেশই করা যায় না। জনমেজয়ই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তার সর্পযজ্ঞে ব্যাসদেবের কাছে মহাভারতের কথা শুনতে চান। অতএব মহাভারতের ঘটনা-সূচি বর্ণনা করেই সৌতি উগ্রশ্রবা জনমেজয়ের প্রসঙ্গে এসেছেন এবং জনমেজয়ের প্রসঙ্গ-মাত্রেই এসেছে একটি কুকুরের কাহিনী।
মনে রাখতে হবে একটি প্রাণী হিসেবে কুকুর যতই প্রভুভক্ত এবং মহনীয় হোক, কুকুর নিয়ে প্রাচীনদের কিছু শুচিবাইও ছিল। অবশ্য কুকুরদের দোষও কম ছিল না। কোনও জায়গায় হয়তো ঋষিরা মন দিয়ে যজ্ঞ করছেন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে যজ্ঞের ঘি খানিকটা চেটে দিয়ে গেল, অথবা মুখে করে নিয়ে গেল খানিকটা পুরোডাশ। চপলমতি কুকুরের এই অবিমৃশ্যকারিতায় ঋষিরা এতটাই পীড়িত বোধ করতেন যে, কুকুরের চেটে দেওয়া ঘি তারা অপবিত্রবোধে যজ্ঞে ব্যবহার করতেন না। স্বয়ং মনু মহারাজ আবার এতটাই শঙ্কাপ্রবণ ছিলেন যে, তিনি বলেছেন–দেশ যদি অরাজক হয়, তবে সেই অরাজকতার জন্য এতটাই অমঙ্গল দেখা দিতে পারে যে, কুকুরও যজ্ঞের ঘি চেটে দেবে, কাকও যজ্ঞের পুরোডাশ নিয়ে উড়ে পালাবে অদ্যাৎ কাকঃ পুরোডাশং শাবলিহাদ হবিস্তথা। কুকুরের এই হবিলেহন-প্রবৃত্তি, এবং সেই কারণেই তাদের ওপর ব্রাহ্মণ-সমাজের বিরক্তি–এই দুটিই প্রাচীনকালে প্রায় বাদিক স্তরে পৌঁছেছিল- এই কথাটি মনে রেখেই আমরা জনমেজয়ের প্রসঙ্গে আসছি।
পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় ভাইদের সঙ্গে মিলে এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। জনমেজয়ের ভাইরা হলেন- শ্রুতসেন, উগ্রসেন এবং ভীমসেন। তাদের যজ্ঞ চলার সময়। একটি কুকুর সেখানে উপস্থিত হল। জনমেজয়ের ভাইরা যজ্ঞস্থলে কুকুর দেখে সেটিকে যথেষ্ট মারধর করে তাড়িয়ে দিলেন। কুকুরটি কাঁদতে কাঁদতে কুকুর-মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। তার মা ছেলেকে চেটে আদর করে বলল, কাঁদছিস কেন? কে তোকে মেরেছে? সে বলল, রাজা জনমেজয়ের ভাইরা আমাকে খুব মেরেছে মা। মা-কুকুর বলল, তুই নিশ্চয়ই কোনও অন্যায় করেছিস, নইলে শুধু শুধু তারা তোকে মারবে কেন? ছেলে কুকুর বলল, না গো মা। আমি কিচ্ছুটি করিনি। আমি যজ্ঞের ঘিয়ের দিকে ফিরেও তাকাইনি, চাটিওনি সেই ঘিনাপরাধ্যামি কিঞ্চিৎ, নাবেক্ষে হবীংষি নাবলিহে ইতি। বস্তুত এই বাচ্চা কুকুরটিও জানে অথবা কুকুর-মায়ের কাছে সে প্রশিক্ষণ পেয়েছে যে, যজ্ঞের ঘি চাটতে নেই, দেবতার অগ্রভাগ লোভের দৃষ্টিতে দেখতে নেই।
কুকুর-মা ছেলের অভিযোগ শুনে রাজা জনমেজয়ের কাছে যজ্ঞস্থলেই উপস্থিত হল। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সে রাজাকে বলল, এই আমার ছেলে। একটা কোনও অপরাধ করেনি সে, না চেটেছে ঘি, না ফিরেও সেদিকে চেয়ে দেখেছে; ততো কেন তাকে মারা হল? জনমেজয় সামান্যা কুকুরীর কথার জবাব দিতে পারলেন না। লজ্জায় তার ভায়েরা মাথা নিচু করলেন। কুকুর-মা বলল, যেহেতু কোনও অন্যায় না করেও আমার ছেলে শুধু শুধু মার খেল, তার ফল ভুগতে হবে এই রাজাকে। দেখবে, এমন কোনও ভয় তোমাদের সামনে এসে উপস্থিত হবে, যা তোমরা ভাবতেও পারছ না–যৗঁদভিহতোনপকারী তস্মাদদৃষ্টং ত্বাং ভয়মাগমিষ্যতি।
এখানে দুটি-তিনটি জিনিস ভাবার আছে। এখনকার দিনে–অন্যায় না করে যদি মার খেতেন, তাহলে সেটাই হত স্বাভাবিকতা। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে তখনই, যদি নিরপরাধে মার খাওয়ার পরেও আপনি যদি ন্যায়বিচার চাইতে যান। উকিলে ছুঁলে তো ছত্রিশ ঘা, আর যদি সোজাসুজি পুলিশের কাছে যান, তবে আরও মার খাওয়ার ভয়, আর যদি গণতন্ত্রের রাজদ্বারে যান, তবে শুনবেন, এমন তো হয়েই থাকে, কী আর করা যাবে। কিন্তু সে যুগে একটি সামান্য কুকুরও কিন্তু স্বয়ং যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে খোদ রাজার বিরুদ্ধেই অভিযোগ জানিয়েছে। বলতেই পারেন- কুকুরের কথাটা রূপকমাত্র, কুকুর কী আর কথা বলে? অভিযোগ জানায়? আমাদের বক্তব্য, রূপক বলেই এই ঘটনার সামাজিক মূল্য আরও বেশি। অর্থাৎ একজন সামান্য প্রাণী-মাত্রেরও রাজার দরবারে যাওয়া এবং স্বয়ং তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনার ক্ষমতা ছিল, আজকের এই সোনার গণতন্ত্রে যা অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, যে সমাজের স্বার্থান্বেষীরা বিধান দিয়েছিলেন-শকুনের অভিশাপে গরু মরে না– এ সমাজ তার থেকে প্রগতিশীল। পরবর্তীকালে যে সময়ে উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা নিজেরা সৎ আচরণ না করে অন্যকে অভিশাপের ভয় দেখাতেন, সেই সমাজে নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরা যদি অতিষ্ঠ হয়ে উচ্চতরের প্রতি অপশব্দ উচ্চারণ করতেন, তবে শুনতে হত- শকুনের অভিশাপে গরু মরে না। কিন্তু এখানে দেখছি-শকুন না হোক, কুকুরের অভিশাপে রাজা। লজ্জিত, চিন্তিত, ব্যতিব্যস্ত-ভূশং সম্রান্তো বিষণ্ণশ্চাসীং। যজ্ঞ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা হস্তিনানগরীতে ফিরে এসেছেন এবং ভীষণভাবে চিন্তা করতে আরম্ভ করেছেন। তিনি একজন উপযুক্ত পুরোহিতের খোঁজে বেরিয়েছেন, যিনি কুকুরীর ওই অভিশাপ নিরস্ত করতে পারেন। এমনি খুঁজে পুরোহিত পাওয়া যায়নি। শেষে একদিন মৃগয়ায় বেরিয়ে একটি মুনির আশ্রম চোখে পড়ে রাজার। মুনির নাম শ্রুতবা। তার উপযুক্ত পুত্র সোমশ্ৰবাকে পৌরোহিত্যে বরণ করে নিয়ে আসেন জনমেজয়।
ঋষির পৌরোহিত্যে কুকুরীর শাপ কতটা কেটে গিয়েছিল মহাভারতের কবি তা বলেননি, কিন্তু একজন রাজা সামান্যা কুকুরীর অভিযোগ এবং আক্ষেপে কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, সেটা এযুগেও ভাবার মতো। আমাদের কাছে এই কুকুরীর বিবরণ তৃতীয় এক কারণে মূল্যবান। মহাভারতের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ্য-সংযোজনের চিহ্নে আতঙ্কিত হন, তাদের কাছে আমার নিবেদন- মহাশয়! এই কুকুরীর মর্যাদা-রক্ষার জন্য ক্ষত্রিয় রাজার দুশ্চিন্তা এবং লজ্জাবোধও কিন্তু ব্রাহ্মণদেরই সংযোজন। আমি অবশ্য এটাকে সংযোজন মনে করি না। আমি এটাকে মহাভারতের উপক্রমণিকা মনে করি। অপিচ আমি এটাকে ব্রাহ্মণ্য সংযোজনও মনে করি না, আমি এটাকে কবিওয়ালার গৌরচন্দ্রিকা মনে করি। যদি তাই হয়, তবে এটি সৌতি উগ্রশ্রবার সংযোজন অর্থাৎ অব্রাহ্মণের সংযোজন।
কথাটা অবশ্য এখানেও নয়, কথাটা হল- যা পেয়েছি প্রথম দিনে তাই যেন পাই শেষে। মহাভারতের মহাপ্রস্থানিক কুকুরের কাহিনী দিয়ে তার ভারতবংশের ইতিহাস শেষ করেছেন, সৌতি উগ্রশ্রবাও তাই আরম্ভ করেছেন এক কুকুরের কাহিনী দিয়ে। সারা মহাভারত জুড়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের ওপরে যে আপাত পক্ষপাত নিয়ে নব্য গবেষকেরা আহত বোধ করেন, তারা যেন এই মহাকাব্যের আদি এবং অন্তে সামান্য কুকুরের চরিত্র দেখে খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করেন। তথাকথিত অধম প্রাণীর প্রতি করুশার চিহ্নে যে মহাভারতের আদি এবং অন্ত চিহ্নিত, তার সমস্ত মধ্যভাগ জুড়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতি নিরঙ্কুশ পক্ষপাতই যে শুধু থাকবে না সে কথা আমি শুরুতেই জানিয়ে রাখলাম।
আজকের দিনে ফিল্মের ভাষায় আপনারা যাকে ফ্ল্যাশব্যাক বলেন, সেই ফ্ল্যাশব্যাকের কায়দাতেই মহাভারতের কাহিনীর আরম্ভ। কুরু-পাণ্ডবের বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে মহারাজ যুধিষ্ঠির খুব বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মহারাজ দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন–সারা জীবনে যা পাবার আমি পেয়েছি। ভোগ ও লাভ করেছি ইচ্ছামতো। কিন্তু সমস্ত জ্ঞাতি-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে তুমি কোথায় রাজত্ব করবে, যুধিষ্ঠির? তোমার রাজ্যের বাসিন্দা হবেন কতগুলি বিধবা আর কতগুলি সন্তানহীন মাতা।
কথাটা একেবারে মিথ্যে বলেননি দুর্যোধন। রাজ-সিংহাসনে বসে যুধিষ্ঠির মোটেই সুখ পাননি। মাত্র ছত্রিশ বছর সে কালের দিনের আন্দাজে সময়টা কিছুই নয়; মাত্র ছত্রিশ বছর রাজত্ব করে, পাণ্ডব-কৌরবের একমাত্র সন্তান-বীজ পরীক্ষিতকে সিংহাসনে বসিয়ে যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানের যাত্রা শুরু করেছেন। যখন সিংহাসনে বসেছেন পরীক্ষিতের বয়সও তখন ছত্রিশ। কারণ, পাণ্ডব-কৌরবের মহাযুদ্ধের শেষেই তার জন্ম। তারও রাজত্বকাল অতি অল্প। মাত্র চব্বিশ বছর। তিনি অকালে মারা গেলেন তক্ষক সাপের দংশনে। রাজা হয়ে বসলেন তার পুত্র জনমেজয়।
জনমেজয় পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্প-যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। সেই সর্প-যজ্ঞেই মহাভারত-কথার সূচনা। আস্তীক মুনি এসে জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের ছেদ টানলেন। যজ্ঞ স্তব্ধ হল এবং মহাভারতের কথা আরম্ভ হল। সর্পযজ্ঞে যোগদান করেছিলেন যত রাজ্যের মুনি-ঋষিরা। আর উপস্থিত ছিলেন মহামুনি ব্যাস। কুরু-পাণ্ডবের বংশধারায় ব্যাসের নিজের রক্ত আছে, মমত্ব আছে। ফলে বাণপ্রস্থে ধৃতরাষ্টের মৃত্যু, যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থানের পরেই তিনি মহাভারত রচনা করেন। রচনা করেন কৌরব-পাণ্ডববংশের পূর্ব এবং উত্তর ইতিহাস। গোটা মহাভারতটা লিখতে তার তিন বচ্ছর সময় লেগেছিল। হয়তো হাতে-কলমে লেখা যাকে বলে সেভাবে তিনি মহাভারত লেখেননি কিন্তু মহাভারতের পুরো বয়ানটা মনে মনে পুরো ছকে নিতে তার সময় লেগেছিল তিন বচ্ছর ত্রিভিবর্ষে মহাভাগঃ কৃষ্ণদ্বৈপায়নো’ব্রবীৎ। মহাভারত কীভাবে শব্দ-ছন্দ-অলংকারের পরিসরে বাঁধা পড়ল–সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু দুটি ভিন্নতর পরিস্থিতিতে মহাভারতের কথা কী ভাবে আরম্ভ হচ্ছে সেটা আগে বুঝে নিতে হবে।
মনে রাখা দরকার–উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের কথা বলছেন নৈমিষারণ্যে বসে। এখানে তিনি বক্তা। কিন্তু তিনিই আবার শ্রোতা হিসেবে ছিলেন মহারাজ জনমেজয়ের সভায়। সেখানে বক্তা ছিলেন ব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন। খেয়াল করে দেখবেন– মূল মহাভারত বলার আগে নৈমিষারণ্যে বসে উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের মূল ঘটনাগুলি সূত্রাকারে বলে গেছেন। এতে সমবেত ঋষিদের মনে বিস্তারিত কাহিনী শোনবার স্পৃহা জেগেছে। অন্যদিকে জনমেজয়ের সভায় বৈশম্পায়নও প্রথমে একই ভাবে সূত্রাকারেই মহাভারতের কথা বলেছেন এবং তাতে জনমেজয়ের বক্তব্য আপনি বিস্তারিতভাবে সব কাহিনী বলুন মহর্ষি! আমার পূর্বজ মহান পাণ্ডব-কৌরবদের কীর্তিকলাপ এত অল্প শুনে মোটেই তৃপ্তি হচ্ছে না আমার- ন হি তৃপ্যামি পূর্বেষাং শূনশ্চরিতং মহৎ। বৈশম্পায়ন বিস্তারিতভাবে কাহিনী আরম্ভ করলেন।
.
০৩.
জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের সভা এবং নৈমিষারণ্য–এই দুয়ের মধ্যে যে ভৌগোলিক দূরত্ব আছে, তার সঙ্গে আছে সময়ের দূরত্ব। ব্যাস যে কাহিনী রচনা করেছিলেন, তার শেষে ছিল ধৃতরাষ্ট্র-বিদুরের জীবন-শেষের পর্ব আর ছিল যদুবংশের ধ্বংস এবং যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থান। বৈশম্পায়ন এই পর্যন্তই মহাভারত জানেন। কিন্তু উগ্রশ্রবা সৌতি যখন মহাভারত বলছেন, তখন ক্ষীয়মাণ পাণ্ডব-বংশের অঙ্কুর পরীক্ষিতের মৃত্যু হয়ে গেছে। আর সেই প্রতিশোধে যে সর্পষজ্ঞ হয়েছিল, সেই যজ্ঞসভায় সৌতি উপস্থিত ছিলেন। ফলত পরীক্ষিতের মৃত্যু এবং জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের বিবরণ আমাদের শুনতে হবে নতুন এই কবিওয়ালার কাছে। তিনি উগ্রশ্রবা সৌতি।
মুশকিল হল– উগ্রশ্রবা সৌতি নতুন কবিওয়ালা। তিনি কেমন বলেন, কেমন তার কথকতা, সে সম্বন্ধে সমবেত ঋষিদের ধারণা নেই। সৌতি অবশ্য এসে ইস্তক থেমে থাকেননি। তিনি ঋষিদের কাছে এ কাহিনী সে কাহিনী বলে যাচ্ছেন। নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনক অভিজ্ঞ লোক। তিনি নতুন কবিওয়ালাকে স্বাগত জানিয়েছেন বটে, বসতে দিয়েছেন, ফল-মূল সেবা করতে দিয়েছেন বটে, কিন্তু মূল মহাভারতের কথকতার ব্যাপারে শৌনক এই নতুন কবিওয়ালাকে আগেই তত পাত্তা দেননি। তিনি সৌতিকে বসিয়ে রেখেই চলে গেছেন অগ্নিশরণ গৃহে- যেখানে তার বারো বছরের যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপ চলছে।
সৌতি উগ্রশ্রবা অবশ্য থেমে থাকেননি। তিনি তার কথকতার ক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। দু-চারটে উটকো কাহিনী তিনি বলে যাচ্ছেন নিতান্ত খাপছাড়া ভাবে। যদিও খাপছাড়া হলেও এগুলি অর্থহীন নয়। তিনি একবার মহাভারতের সংক্ষেপ-সূত্রগুলি বলে যাচ্ছেন, একবার জনমেজয়ের সপত্রের কথা বলছেন, একবার পরীক্ষিতের মৃত্যুর কথাও বলছেন। আবার কখনও বা সাপের কথায়, জনমেজয়ের কথার সূত্র ধরে উপমন্যর কাহিনী, উতঙ্কের কাহিনী, রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনীও বলে যাচ্ছেন। পণ্ডিতেরা মহাভারতের মূল কাহিনীর সঙ্গে বেমিল দেখে এই সব কাহিনীর মধ্যে প্রক্ষেপের গন্ধ পেয়েছেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কাহিনীগুলির মধ্যে নতুন কথক-ঠাকুরের আত্মঘোষণা দেখতে পাই। সে-কালের কবিওয়ালাকে ইতিহাস-পুরাণের তত্ত্ব-কাহিনী, লোক-কথা ভাল করে জানতে হত। একইভাবে সেকালের কথক-ঠাকুরদেরও বেদ-উপনিষদের মর্মকথাও জানতে হত। তাদের সময়েই যেহেতু ইতিহাস-পুরাণের কথকতা আরম্ভ হয়েছে, অতএব পূর্ববর্তী বেদ-উপনিষদের কল্প-কাহিনীগুলি বলে তারা কথকতার নমুনা দেখাতেন।
মহাভারতের মূল কাহিনী আরম্ভ করার আগে উগ্রশ্রবা সৌতি দেখাতে চাইছেন। তিনি পারবেন। বেদ-উপনিষদের নিগুঢ় তত্ত্ব তার জানা আছে। জানা আছে, পূর্ববর্তী কালের কাহিনীগুলিও। খেয়াল করে দেখবেন- মহাভারতের মূল কাহিনী সবিস্তারে বলার আগে তিনি যতগুলি গল্প বলেছেন তার মধ্যে উপমনু, আরুণি ইত্যাদি ঔপনিষদিক কাহিনী যেমন আছে, তেমনই আছে ইন্দ্ৰস্তুতি, অশ্বিনীকুমারের স্তুতি এবং সূর্য-বিষ্ণুর একাত্মতা। তার মানে মহাভারতের ঠিক আগের যুগের বৈদিক এবং উপনিষদীয় পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের কথক-ঠাকুর পরিচিত। কাহিনী বর্ণনার এই পরম্পরার মাধ্যমে উগ্রশ্রবা সৌতি বেদ উপনিষদের সঙ্গে মহাভারতের কাহিনীর পরম্পরা তৈরি করছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক পালাবদলের টাটকা খবরও তার কাছে পাওয়া যাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, এ সব কথা তিনি বলছেন যজ্ঞ থেকে অবসর লাভ-করা ঋষিদের কাছে। মহাভারতের মূল কাহিনী তিনি আরম্ভ করতে পারছেন না, কারণ কুলপতি শৌনক তখনও এসে পৌঁছোননি। তিনি সে সময় অগ্নিশরণ-গৃহে। অগত্যা তিনি শুধু জনমেজয়ের কাহিনী বলে যাচ্ছেন। জনমেজয়কে তিনি দেখেছেন। তিনি তার সর্পযজ্ঞে গেছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা সেখানে তিনি মহাভারত শুনেছেন। পুরুবংশের শেষ পুরুষের সঙ্গে তার একটা পরিচয় আছে এই মর্যাদাতেই তিনি এখন শুধু জনমেজয়ের কথা বলছেন। বলতে পারেন, আমরা মহাভারত শুনতে বসেছি, ওসব জনমেজয়ের গল্প শুনব কেন? আমরা বলব, একটা বিয়ে করতে গেলে মশাই আপনার মাতুল অমুক চন্দ্র অমুকের মেয়ের সঙ্গে আমার শালার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে, আপনার বন্ধুর পিতৃদেব আমার পিসেমশাই হন ইত্যাদি সম্পর্ক খুঁজে কথা জমাবার চেষ্টা করেন। আর এখানে মহাভারতের মতো একটা মহাকাব্য শুনবেন, অথচ জনমেজয়ের কথা শুনবেন না, তার দুঃখ-সুখের কথা শুনবেন না, তা কি হয়? তাছাড়া ভারতে সমাজ-সম্বন্ধ অনেক। পাশ্চাত্যের ব্যক্তি-কেন্দ্রিক সমাজ আমাদের আদর্শ নয়। আমাদের আদর্শ গোষ্ঠীতন্ত্র, গুষ্টিসুখ। এখানে একজনের পরিচয় জানতে গেলে, তার বাবার। কথা শুনতে হয়, গুরুস্থানের কথা শুনতে হয়, এমনকি সেই গুরুর অন্য শিষ্যদের কথাও। শুনতে হয়। তবে বোঝা যায় যার কথা বলছি, তিনি লোকটা কী রকম? সৌতি উগ্রশ্রবাও তাই জনমেজয়ের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। যতক্ষণ কুলপতি শৌনক অগ্নিশরণ-গৃহ থেকে সন্ধ্যা-আহ্নিক সেরে ফিরে না আসেন, ততক্ষণ আমরাও একটু জনমেজয়কে বুঝে নিই।
সৌতি উগ্রশ্রবা সপর্যজ্ঞের কথা বলতে বলেছিলেন- এই আমি উতঙ্কের চরিত্র কীর্তন করলাম। জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের অন্য কারণ এই উতঙ্ক –ময়া উতস্য চরিতমশেষমুক্তং, জনমেজয়স্য সপত্রে নিমিত্তান্তরমিদমপি। উতঙ্কের কথাটা আমরাও বলতে উদযুক্ত হয়েছি এই কারণে যে, মহারাজ জনমেজয়ের তিনি গুরুভাই। অবশ্য এখনকার দিনে শাক্ত বৈষ্ণব সমাজে যেমন গুরুভাই দেখি, তেমন গুরুভাই তিনি নন। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
উতঙ্কের গুরুর নাম বেদ। গৃহস্থ, ব্রহ্মর্ষি, মহা পণ্ডিত। জনমেজয় এই বেদকে এক সময় নিজের উপাধ্যায় হিসেবে বরণ করেন। উপাধ্যায় হিসেবে বেদ ছিলেন ভারি ভাল মানুষ। সেকালের দিনে বিদ্যা লাভ করার জন্য শিষ্যদের অসম্ভব কষ্ট করতে হত। সংযমের শিক্ষা এবং নির্বিচারে গুরুবাক্য পালন করার মধ্যে এতটাই কাঠিন্য ছিল যে, তাদের গুরুগৃহ-বাসের সময়গুলি গল্পে পরিণত হয়েছে। মহর্ষি বেদের অন্য দুই গুরু-ভাই আরুণি এবং উপমন্যর গুরু-সেবার স্তরগুলি আমাদের কাছে কল্প-কাহিনীর মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেদ যখন গুরুগৃহে ছিলেন তখন তাকেও ভার বইতে হত গোরুর মতো। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই, ক্ষুধা-তৃষ্ণার বালাই নেই। সমস্ত সময়টা শুধু গুরুর আদেশ নির্বিচারে পালন করা। এমনিভাবে চলতে চলতে শুরু একদিন প্রসন্ন হলেন, বেদকে বিদ্যা দান করলেন। গুরুর কাছে বিদায় নিয়ে বাড়িতে এসে বেদ বিয়ে করে গৃহস্থ হলেন।
মানুষ যখন ছাত্র থাকে, তখন সে যে যে কষ্ট পায়, যেভাবে কষ্ট পায়–বড় হয়ে তা দূর করার চেষ্টা করে। মহর্ষি বেদ এখন গুরু আসনে বসেছেন। তবু ছাত্রাবস্থায় গুরুর আশ্রমের দিনগুলি তাঁর স্মরণে আসে। তিনি শিষ্যদের দিয়ে কোনও কষ্ট করাতে চান না, তাদের খাঁটিয়ে নিতে চান না, এমনকি গুরুষাও করতে বলেন না- স শিষ্যান্ন কিঞ্চিদুবাচ কৰ্ম বা ক্রিয়তাং গুরুশুশ্রূষা বেতি। গুরুগৃহবাসের দুঃখ তিনি জানেন, অতএব তিনি সেই কষ্ট শিষ্যদের দিতে চান না।
মহর্ষি বেদের তিন শিষ্যের মধ্যে প্রধান ছিলেন উতঙ্ক। উতঙ্ক ব্রহ্মচারী গুরুগৃহবাসী। বেদের অন্য দুই শিষ্য দুই ক্ষত্রিয় রাজা–একজন তো জনমেজয়, অন্যজন রাজা পৌষ্য।
উতঙ্ক যখন গুরুগৃহে বিদ্যাভ্যাস করছেন, তখন এক সময় মহর্ষি বেদের প্রয়োজন হল অন্য জায়গায় যাওয়ার। সেকালের দিনে বেদের মতো ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা নিজের পড়া এবং অন্যকে পড়ানো নিয়েই দিন কাটাতেন। এর মধ্যে তাদের কাছে মাঝে মাঝে অন্যের যজ্ঞ করার নিমন্ত্রণ আসত। তারা যেতেন, যজমান ধনী হলে দক্ষিণাও পেতেন ভাল। দুধেলা গোরুও মিলত। এই দক্ষিণার টাকা আর গোরুর দুধ খেয়ে অন্য সময় তাদের কষ্টে-সৃষ্টে চলে যেত। এর মধ্যে বাড়িতে যে দু-চারজন শিষ্য থাকতেন, তাদের ভরণ-পোষণও চলত।
ব্রহ্মচারী উতঙ্কও, এইভাবেই ছিলেন গুরুর বাড়িতে। যজ্ঞের নিমন্ত্রণ পেয়ে গুরু বেদ শিষ্যকে বললেন, বাড়িতে তুমি রইলে। যদি কোনও অসুবিধে হয় একটু দেখো। যদি কোনও ঝামেলাও হয় সামাল দিও। বেদ চলে গেলেন। বাড়িতে থাকলেন তার যুবতী স্ত্রী এবং ব্রহ্মচারী উতঙ্ক। ইতিমধ্যে বেদের পত্নী ঋতুমতী হলেন। সেকালে স্ত্রীলোকের ঋতুরক্ষার একটা ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। অর্থাৎ স্ত্রী ঋতুমতী হলে ঋতুস্নানের পর যে কোনও উপায়েই তার সঙ্গমের ব্যবস্থা করতেই হবে। হয়তো সমাজে এই নিয়ম যখন চালু হয়েছিল, তখন স্ত্রীলোকের সংখ্যা ছিল অল্প এবং সন্তানের চাহিদা ছিল বেশি। তাছাড়া কামশাস্ত্রের মতে এই সময়টাতে নাকি স্ত্রীলোকের আসঙ্গলিপ্সা প্রবল হয় এবং সন্তান ধারণের পক্ষেও নাকি সময়টা যথেষ্ট উপযোগী এবং উর্বর। ফলে যেনতেন প্রকারেণ ঋতুস্নাতা স্ত্রীলোকের সঙ্গমেচ্ছা পূরণ করাটা তখন ধর্মের তাৎপর্যে গ্রহণ করা হত।
মহর্ষি বেদের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর বান্ধবীরা এসে উতষ্ককে জানাল, তোমার অধ্যাপকের স্ত্রী ঋতুমতী হয়েছেন। এদিকে তোমার অধ্যাপক বিদেশে। তুমি এমন ব্যবস্থা কর যাতে এঁর ঋতুকাল নিষ্ফল না হয়। তাছাড়া এই কারণে তোমার অধ্যাপক-পত্নীও যথেষ্ট বিষণ্ণ হয়ে আছেন এষা বিষীদতি ইতি। একেবারে শেষ বাক্যে অধ্যাপকের স্ত্রীর যে পুরুষান্তর-সংসর্গে আপত্তি নেই সেটাও জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু উতঙ্ক সংসর্গকামিনী এই রমণীর ইচ্ছা একেবারে নস্যাৎ করে দিলেন।
হয়তো দীর্ঘদিন স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেদ-পত্নীর মন এই যুবক পুরুষটির প্রতি সরস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সরসতার সুযোগ উতঙ্ক নেননি। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে, সেকালের সমাজে যারা একটা সময়ে শুরু হয়ে বসতেন, তাদের জীবনের বহুলাংশ কেটে যেত বিদ্যালাভে। ফলে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করতে তাদের দেরি হয়ে যেত। বিয়ে করার পক্ষে বয়স বেশি হয়ে গেলেও বিদ্যা এবং ব্রাহ্মণ্যের কারণে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে পেতেও তাদের অসুবিধে হত না। তাছাড়া বয়স বেশি হলেও ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ ঋষি-মুনিদের সরসতা কম ছিল না। বড় ঘরের মেয়ে, রাজার ঘরের সুন্দরী মেয়েদের তারা মন দিতে ভালবাসতেন। কবি যতই বলুন
সত্য থাকুন ধরিত্রীতে
শুষ্ক-রুক্ষ মুনির চিতে
জ্যামিতি আর বীজগণিতে-
আমরা জানি ঋষি-মুনির হৃদয় মোটেই জ্যামিতি আর বীজগণিতের তত্ত্বের মতো ছিল না। ভাগবত পুরাণের সৌভরি মুনি, অথবা রামায়ণ-মহাভারতের বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র, পরাশর ভরদ্বাজ–কেউই স্ত্রীলোকের মন নিয়ে কাঠিন্য প্রকাশ করেননি। সময়কালে সে সব কথা আসবে।
আমি যা বলছিলাম সেটা একটা সমস্যার কথা। প্রৌঢ়-বৃদ্ধ মুনি-ঋষিরা যে সব মেয়েকে বিয়ে করে আনতেন, তাদের বয়স যেহেতু কম হত, তাই তাদের নিয়ে সমস্যাও কিছু ছিল। এঁদের মধ্যে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ জানি না- এমন সতী-সাধ্বী মহিলা যথেষ্টই ছিলেন। কিন্তু সেকালের কতগুলি সাবধানবাণী থেকে কতগুলি সমস্যাও সঠিক ধরা যায়। যেমন রামায়ণ, মহাভারত বা মনু সংহিতার মতো প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে গুরুগৃহবাসী শিষ্যদের বারবার শাসন করা হয়েছে যে, তারা যেন গুরুপত্নীর সঙ্গে বেশি মেশামিশি না করে। মনু মহারাজ তো একেবারে চোখ রাঙিয়ে বলে দিয়েছেন যে, দেখ বাপু। শিষ্য যদি বিশ বছরের যুবক হন- আর গুরুর গিন্নিটি যদি হন যুবতী, তাহলে গুরু সেবার নাম করে গুরুমার গায়ে তেল মাখানো, কি স্নান। করানো, কি ঝামা দিয়ে পিঠ ঘষে দেওয়া– এ সব তো বারণই, এমনকি প্রণাম করার ছুতো করে গুরুপত্নীর পা ছোঁয়াও একেবারে বারণ।
এই বারণ-সাবধান থেকে যে কথাটা বেরিয়ে আসে, তা হল গুরুগৃহে যুবক শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নীর অধিকরণ-সামীপ্য। দূরত্বটা বহির্বাটী এবং অন্তর্বাটীর হলেও ইনিও আছেন, উনিও আছেন। এখন সমস্যাটা হল– প্রৌঢ় অথবা অতিরিক্ত বিদ্যাব্যসনী স্বামীর ঘর কতে করতে কখনও কোনও বসন্তের উতলা হাওয়ায় কোনও যুবতী গুরুপত্নী যদি একটি সমান-বয়সী শিষ্যের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন, তবে সেটা অন্যায় হলেও অস্বাভাবিক ছিল না। অন্যদিকে গুরুপত্নী-গমনের জন্য গুরুগৃহবাসী শিষ্যের অনন্ত নরকবাস নির্দিষ্ট থাকলেও যুবক শিষ্য বয়সের ধর্মে ব্রহ্মচর্য ভেঙে রমণে প্রবৃত্ত হতেন। ছোট-খাটোদের কথা ছেড়েই দিন, দেবতা বলে পরিচিত ইন্দ্ৰ গৌতম পত্নী অহল্যার রূপ-মুগ্ধ হয়ে গুরু গৌতমের সাজ নিয়েই অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। আর রামায়ণের কবি সেখানে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, অহল্যা তার স্বামীর শিষ্যটিকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবু যে তিনি ইন্দ্রের বাহুবন্ধনে শয্যাশায়িনী হয়েছিলেন, তার কারণ নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের রমণ কেমনতর, তাই দেখবার জন্য দেবরাজ-কুতূহলা। আর প্রসিদ্ধ পাণ্ডব-কৌরব বংশের উৎপত্তিই যে হয়েছিল গুরুপত্নী-গমনের ফলে- সে কথায় আমি পরে আসব।
তাই বলছিলাম– যুবক শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নীর সমানাধিকরণ যদি প্রৌঢ়-বৃদ্ধ গুরুগৃহটি হয়, তবে তাদের পারস্পরিক সরসতা অন্যায় হলেও অস্বাভাবিক ছিল না সেকালে এবং তার সামাজিক কারণ তো ছিলই। গুরুর অনুপস্থিতিতে এবং গুরুপত্নীর বান্ধবীদের তাড়নায় বেদ-শিষ্য উতঙ্ক তো রীতিমতো এক ধর্মীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ঋতু-রক্ষার কাজটা যতই ধর্মীয় হোক, উতঃ রাজি হলেন না। গুরু-পত্নীর বান্ধবীদের তিনি বললেন তোমাদের মতো মেয়েদের কথায় আমি মোটেই নাচতে রাজি নই। আমার গুরুমশাই আমাকে নানা কাজের কথা বলে তার ঘর সামলাতে বলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আমায় তিনি এটা বলে যাননি যে, দরকার হলে আমার স্ত্রীর ঋতুরক্ষার মতো অকাজটাও তুমি করে দিও ন হ্যহপাধ্যায়েন সন্দিষ্টঃ অকাৰ্য্যমপি ত্বয়া কাৰ্যমিতি।
উতঙ্ক রাজি হলেন না। গুরুপত্নীর বান্ধবীরাও সলজ্জ্বে চলে গেল। মহর্ষি বেদ ফিরে এলেন প্রবাস থেকে। বাড়িতে এসে সব কথা শুনে উতঙ্কের ওপর ভারি খুশি হলেন তিনি। ঋতু-রক্ষার ছুতোয় উতঙ্ক যে তার প্রিয়া পত্নীকে লঙ্ঘন করেননি– এই স্বস্তিটুকু তাকে আরও সুখী করে তুলল। উতষ্ককে তিনি সমস্ত বিদ্যার অধিকার দিয়ে বাড়ি যেতে বললেন।
বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পাওয়াটা যে কোনও ক্লিষ্ট ছাত্রের পক্ষে অত্যন্ত আনন্দের কথা। কিন্তু যাওয়ার আগে উতঙ্কের মনে হল যে, তিনি গুরুর কাছে পেয়েছেন অনেক, দেননি কিছুই। একে তো মহর্ষি বেদ শিষ্যদের পরিশ্রম বেশি করান না, অন্যদিকে তার সন্তুষ্টি বিধান করায় উতঙ্ককে তিনি অন্যদের থেকে তাড়াতাড়ি বিদ্যায় অধিকার দিয়েছেন। সব কিছু মিলে উতঙ্কের মনে হল–প্রতিদান না হোক, অন্তত কৃতজ্ঞতা হিসেবে। তার কিছু গুরুদক্ষিণা দেওয়া উচিত গুরুকে। উতঙ্ক বললেন, আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে আমি আপনাকে কিছু গুরুদক্ষিণা দিয়ে ধন্য হই।
মহর্ষি বেদ এতই খুশি ছিলেন উতঙ্কের ওপর যে, একবারও তিনি চাননি যে, তার শিষ্য কোনওভাবে গুরুদক্ষিণার জন্য কোথাও বিড়ম্বনা লাভ করেন। কারণ সেকালে অনেক গুরুই বিদ্যাদানের শেষ কল্পে এমন সব অকল্পনীয় গুরুদক্ষিণা চাইতেন যে, শিষ্যদের পক্ষে তা জোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ত। বস্তুত যে ছাত্র গুরুগৃহে স্নাতক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হল অথবা কঠিন কোনও বিদ্যা লাভ করল গুরুর কাছ থেকে, তার দক্ষিণা দেওয়ার ক্ষমতা ছাত্রদের হত না। তাদের টাকা-পয়সা, ঐশ্বর্য-বিত্ত এমন কিছু থাকত না যে, তাই দিয়ে গুরুদক্ষিণা মেটানো যায়। স্নাতক বা বিদ্যাবান ছাত্রেরা গুরুদক্ষিণার জন্য প্রায় সব সময়েই রাজা বা অন্যান্য বিত্তশালী লোকের দ্বারস্থ হতেন এবং বিত্তশালী লোকেরা যেহেতু প্রায় সব সময়েই বিদ্যোৎসাহী হতেন, অতএব উপায় থাকলে গুরুদক্ষিশার ব্যাপারে তারা কখনও নিরাশ করতেন না। আমরা রঘুবংশের রঘু, হরিশ্চন্দ্র এবং আরও অনেক রাজার নাম করতে পারি, যাঁরা গুরুদক্ষিণার ব্যাপারে অশেষ উদারতা দেখিয়েছেন। সেই তুলনায় মহর্ষি বেদের দক্ষিণা-কামিতা সামান্যই।
উতঙ্কের মুখে গুরুদক্ষিণার প্রস্তাব শুনে মহর্ষি বেদ প্রথমে বলেছিলেন, বৎস উতঙ্ক! আরও কিছুদিন থাকো এখানে, পরে যা হোক বলব। কিছু দিন গেল। উতঙ্ক আবার বললেন, আপনি আদেশ করুন। কী প্রিয়কার্য করব আপনার জন্য। বেদ একটু রেগেই গেলেন। বললেন, সেদিন থেকে বার বার তুমি এই ‘গুরুদক্ষিণা-গুরুদক্ষিণা করে আমায় বিরক্ত করছ। তুমি তোমার গুরুপত্নীকে জিজ্ঞাসা করে তিনি যা বলবেন, তাই এনে দাও– এষা য ব্রবীতি তদুপহরস্ব ইতি।
ব্রাহ্মণ-গুরু মহর্ষি বেদের কথা ভেবে আশ্চর্য হই। নিজেকে গুরুগৃহে কষ্ট করতে হয়েছে বলে কোনওদিন তিনি কোনও শিষ্যকে গুরুসেবার কষ্ট দেননি। অন্যদিকে আপন পরিবারের জন্য তার কত মমতা। দরিদ্র ব্রাহ্মণ স্ত্রীর সাধ-আহ্লাদ কোনওদিন পূরণ করতে পারেননি। শিষ্য পড়িয়ে আর সাংসারিক দু-এক বারের যজমানিতে তার এমন কিছু সাচ্ছল্যের উদয় হত না, যা দিয়ে তিনি পত্নীর জাগতিক সাধ আহ্লাদ পুরণ করবেন। তাই আজকে উতঙ্ক বারবার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছে, সেই সুযোগে তিনি স্বাধিকার ত্যাগ করে আপন প্রিয়া পত্নীর কাছেই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তদগচ্ছ এনাং প্রবিশ্য উপাধ্যায়ানীং পৃচ্ছ।
দরিদ্র ব্রাহ্মণের পত্নীর স্বপ্নই বা কতটুকু? তিনি বললেন, পৌষ্য রাজার ক্ষত্রিয়া পত্নী কানে যে কুণ্ডল-দুটি পরে থাকেন, সেই কুণ্ডল-দুটি তুমি রাজার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এস। উতঙ্ক চললেন পৌষ্য রাজার কাছে। মনে রাখবেন—এই পৌষ্য রাজা কিন্তু সম্পর্কে উতঙ্কের গুরুভাই। কারণ মহর্ষি বেদের অন্য দুই শিষ্য হলেন পৌষ্য এবং জনমেজয়। হয়তো পৌষ্য রাজা কোনওদিন সস্ত্রীক এসেছিলেন গুরুদর্শন করতে, আর বেদপত্নী হয়তো সেই অবসরে রাজরানির রত্নখচিত কানের দুল-দুটি দেখেছিলেন, বড় ভাল লেগেছিল, কানের দুটি কুণ্ডল মাত্র এক রমণীকে এত রমনীয় করে তোলে! গরিব ব্রাহ্মণীর সেই থেকে বড় শখ ছিল– এমন দুটি কুণ্ডল যদি তিনি পেতেন? ব্রাহ্মণ-গুরু মহর্ষি বেদকে এ কথা তিনি কোনওদিন বলতে পারেননি। বলা কি যায়? যাঁর সম্বল একটি দুগ্ধবতী গাভী আর কতগুলি শিষ্য, তিনি কোথা থেকে এই সোনার কুণ্ডল এনে দেবেন তাকে? কিন্তু বেদ বোধহয় এই শখের কথা জানতেন এবং জানতেন বলেই উতঙ্কের কাছে নিজে কিচ্ছুটি না চেয়ে প্রিয়া পত্নীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পৌষ্য রাজার বাড়ির পথ খুব সুখের হয়নি উতঙ্কের কাছে। যাই হোক নানা ঝামেলা পুইয়ে শেষ পর্যন্ত রাজার বাড়ি পৌঁছলেন তিনি। পৌষ্য ব্রাহ্মণ স্নাতক দেখামাত্রই দান দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। উতঙ্ক বললেন, আপনার স্ত্রী যে কুণ্ডল দুটি পরেন, আমি সেই দুটি চাই গুরুদক্ষিণার জন্য। পৌষ্য বললেন, তাহলে আমি কেন, আপনি আমার স্ত্রীর কাছেই কুণ্ডল দুটি প্রার্থনা করুন–প্রবিশ্যান্তঃপুরং ক্ষত্রিয়া যাচ্যতা। যাঁরা ভাবেন সেকালে স্ত্রীলোকের কোনও অধিকারই ছিল না, তাদের জানাই অন্তত স্ত্রীলোকের গয়না-গাটির ওপরে তার নিজস্ব আইনসঙ্গত অধিকার ছিল। একে বলা হত স্ত্রী-ধন। মনুসংহিতাই বলুন অথবা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র–এঁরা কেউই পুরুষকে স্ত্রীধন ব্যবহারের অনুমতি দেননি। রাজা পৌষ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন- পত্নীর কানের দুল দান করার অধিকার তার নেই। তিনি নিজেও সে কথা স্ত্রীকে বলতে পারবেন না। কাজেই স্ত্রীর কানের দুল নিতে হলে উতঙ্ককে তার কাছেই যাচনা করে নিতে হবে।
উতঙ্ক পৌষ্য-পত্নীর কাছে গেলেন। প্রথমে তার সঙ্গে সাক্ষাতে বিলম্ব হলেও পৌষ্য-রাজার ক্ষত্রিয়া পত্নী উতঙ্কের কথা শোনামাত্র তার কানের কুণ্ডল দুটি খুলে তার হাতে দিলেন। কিন্তু কুণ্ডল দুটি দেওয়ার সময় পৌষ্য-পত্নী উতঙ্ককে সাবধান করে দিয়ে বললেন, দেখুন এই দুল-দুটির ওপর নাগরাজ তক্ষকের খুব লোভ আছে। কাজেই মহর্ষি বেদের গৃহে ফিরে যাওয়ার সময় আপনি সাবধানে যাবেন। উতঙ্ক বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, দেবী! নাগরাজ তক্ষক আমার কিছুই করতে পারবে না।
নাগরাজ তক্ষকের কথায় আমি পরে আসছি। তার আগে পৌষ্য রাজার সঙ্গে উতরে কিছু উতোর-চাপান আছে, সেটা সেরে নিই। রাজমহিষীর কাছ থেকে কুণ্ডল দুটি নিয়ে উতঙ্ক পৌষ্য রাজার কাছে এসে বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি পৌষ্য, কুণ্ডল দুটি আমি পেয়েছি। পৌষ্য বললেন, এতকাল পরে এমন সৎপাত্র পেলাম, এমন গুণবান অতিথি পেলাম, তো একটু অন্ন-জল মুখে দিয়ে যাবেন না। একটু বসুন আপনি। রাজার আগ্রহ দেখে উতঙ্ক বললেন, ঠিক আছে বসছি। কিন্তু আপনার ঘরে খাবার-দাবার যা কিছু যে অবস্থায় আছে, তেমনই দেবেন। আমার তাড়া আছে খুব শীঘ্রমিচ্ছামি যথোপপন্ন অন্তমূপস্কৃতং ভবতা। পৌষ্য বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে যেমনটি আপনি চান। এই কথা বলে তার ঘরে অন্ন-পান যেমনটি যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই নিয়ে এলেন উতঙ্কের কাছে।
রাজামশাই বলে কথা। তিনি তো আর রান্নাঘরের খবর রাখেন না। ব্রাহ্মণ স্নাতক ঘরে উপস্থিত, তিনি তাড়াহুড়ো করছেন, অতএব বিনা দ্বিধায় ভাত-ডাল যেমনটি পেয়েছেন, তেমনটিই এক অনুপযুক্ত দাসীকে দিয়ে উপস্থিত করেছেন উতঙ্কের সামনে। কিছুই ভাল করে দেখেননি, আর উতষ্ক দেখতে বলেনওনি। ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল একেবারে এবং সেই ভাতের মধ্যে একটি চুলও পড়ে ছিল। রাজা পৌষ্য একটুও খেয়াল করেননি সেদিকে।
খাবারের পাত্রখানি দেখেই উতঙ্কের খুব খারাপ লাগল। চুল দেখে হয়তো ঘেন্নাও। রাগ করে বললেন, তুমি আমাকে এই রকম অপবিত্র খাবার খেতে দিলে? তুমি অন্ধ হবে জেনো অশুচ্যম্নং দদাসি, তস্মাদন্ধো ভবিষ্যসি। আসলে উতঙ্ক ভেবেছেন– রাজা ভাতের ওপর চুলটি দেখেও অন্ধের মতো তাই খেতে দিয়েছেন, অতএব অন্ধ হওয়ার অভিশাপ। রাজা ভাবলেন আচ্ছা বিপদ। উতঙ্ক নিজের তাড়াহুড়ো আছে বলে ভাত-ডাল যেমন রাঁধা আছে, তেমনই চাইলেন। আর এখন তাকেই অভিশাপ দিচ্ছেন? পৌষ্য রাজাও কিছু কম নন। তিনিও মহর্ষি বেদের শিষ্য। সৎ জীবন যাপন করেন, আপন কর্তব্যে স্থির। উতঙ্কের অন্যায় অভিশাপ শুনে তিনিও প্রতিশাপ উচ্চারণ করলেন উতঙ্কের উদ্দেশে আমার নির্দোষ অন্ন-পানে তুমিও যখন অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছ, তখন তুমিও নির্বংশ হবে।
.
০৪.
চার কত সাধারণ ঘটনা থেকে কত অসাধারণ ঘটনা ঘটে গেল। উতঙ্কের ভাবটা আমরা বুঝি। তুমি খেতে বলছ আগ্রহ করে, কিন্তু আমারও তাড়া আছে। কিন্তু তাড়া আছে বলেই তুই চুল-পড়া ঠাণ্ডা ভাত অতিথিকে খেতে দিবি? পেটে সয় না বলে নেমন্তন্ন-বাড়িতে যদি বলি– ঠিক আছে, একটা রসগোল্লা দিন, তাহলে সেই একটাই দিবি? পাত্র ভরে না দিলে যে অবহেলার মতো মনে হয়। তুই পাত্র সাজিয়ে দে, আমিও একটাই তুলে নেব। তোরও ভদ্রতা থাকল, আমারও ভদ্রতা থাকল। উতঙ্কেরও এই দশা। যেমনটি আছে দিতে বলেছেন বলে, তেমনটিই দিতে হবে! এত দূর পথ বেয়ে এসেছেন, খিদের মুখে একটু গরম ভাত, ঝরঝরে পরিষ্কার করে খেতে দিয়ে পৌষ্য যদি বলতেন, সামান্য দেরি হল, ঠাকুর! সজ্জন অতিথি ব্রাহ্মণকে ঠাণ্ডা ভাত দিই কী করে তাহলে কি উতঙ্ক মেনে নিতেন না?
আবার রাজার দিক থেকেও ব্যাপারটা দেখুন। ব্রাহ্মণ-অতিথি তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন, কারণ মহর্ষি বেদের পত্নী উতঙ্কের ফিরে আসার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন আগেই। উতঙ্কও যথেষ্ট তাড়াহুড়ো করছেন এবং যেমন ঘরে আছে তেমন খাবার প্রস্তাব তিনিই দিয়েছেন। যেখানে শীঘ্রই প্রধান গুরুত্বের বিষয়, সেখানে দেরি করলেও তো অভিশাপ জোটার কথা। কিন্তু রাজার কপাল এমনই অভিশাপ জুটেই গেল। কিন্তু তিনি যেহেতু উতঙ্ক যেমন বলেছেন, তেমনই করেছেন তাই জোরটা তার দিক থেকে বেশি। সেইজন্য প্রতিশাপ দিতে তার দেরি হয়নি। উতষ্কও সেটা বুঝেছেন; আর বুঝেছেন বলেই তিনি রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আপনি যে উলটে আমাকে শাপ দিলেন, এটা বোধহয় ঠিক নয়। আপনি যে খাবারটা আমাকে দিলেন, একটু ভাল করে দেখুন সেটা। রাজা পৌষ্য দেখলেন এবং বুঝলেন। যে দাসী এই অন্ন নিয়ে এসেছিল, সে রাজবাড়িতে কাজের অবসরে চুল খুলে বসে ছিল। রাজার তাড়া দেখে খোলা চুলেই সে অন্ন নিয়ে ছুটেছিল। মাথার ঝাঁকুনি অথবা হাওয়ায় চুল উড়ে এসে পড়েছিল উতঙ্কের খাবারে। রাজা অন্ন দেখেই নিজের অন্যায় স্বীকার করে উতঙ্ককে খুশি করার চেষ্টা করলেন। বললেন, না জেনে অন্যায় করেছি, আপনি অভিশাপ-মুক্ত করুন আমাকে। আমি যেন অন্ধ না হই।
উতঙ্ক বললেন, আমি তো মিথ্যা কথা বলি না। তবে আপনি একবার অন্ধ হয়েই আবার চোখ ফিরে পাবেন। তবে আপনিও একটু ভাবুন–আপনি যে আমায় নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দিলেন- সেটাও আর খাটবে না তো? রাজা বললেন, আপনার করুণার কথা শুনে আমার ভাল লাগল। কিন্তু আমি আমার শাপ ফিরিয়ে নিতে পারব না। সে ক্ষমতাই আমার নেই। কারণ আমার রাগ এখনও যায়নি। উতষ্ক ভাবলেন-এ তো বেশ মজা! তিনি শাপটি প্রত্যাহার করে নিলেন, আর রাজার অভিশাপটা রয়েই গেল? রাজা পৌষ্য বললেন, দেখুন ঠাকুর! আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ, দয়ার শরীর। আপনাদের মুখের কথার ধার খুব বেশি, কিন্তু হৃদয়টা ননীর মতো। একেবারে গলে যায়- নবনীতং হৃদয়ং ব্রাহ্মণস্য বাঁচি ক্ষুরো নিহিতস্তীক্ষ্ণধারঃ। আর আমরা হলাম ক্ষত্রিয় আপনাদের উলটো জাত। আমাদের মুখের কথা খুব মিষ্টি একেবারে ননী ঝরছে মুখে, গলে গলে যাচ্ছে–ক্ষত্রিয়স্য বাঙু-নবনীত। কিন্তু হৃদয়টা ক্ষুরের মতো ধারালো, তীক্ষ্ণ-কঠিন।
নাগরাজ তক্ষকের কাহিনীর আগেই উগ্রশ্রবা সৌতি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এই যে সামান্য চরিত্র-বিচারটুকু করে নিলেন, তার কারণ মহাভারতের তাবৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কুলের মধ্যে এই হৃদয়বৃত্তিগুলি আমরা দেখতে পাব। ইতিহাস পুরাণ জুড়ে ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষির সম্বন্ধে যে সামাজিক আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে পরবর্তীকালে, তার পেছনে ব্রাহ্মণের সামাজিক মর্যাদা বা সুবিধাভোগ যতবড় কারণ, তার চেয়েও বড় কারণ এই আপাত-কঠিন স্বভাব। অন্যায়, অভব্যতা দেখামাত্র, শোনামাত্র সিদ্ধান্তে পৌঁছনো এবং তা থেকে অভিশাপ পর্যন্ত গড়িয়ে। যাওয়া। কুত্রাপি এমনও দেখা যাবে, যেমন এই উতঙ্ক-পৌষ্যের কাহিনীতেও দেখা গেল যে, অপরাধ তত না থাকা সত্ত্বেও অপরাধের অনুমানমাত্রেই অভিশাপ উচ্চারিত হয়েছে ব্রাহ্মণের মুখে। লৌকিক দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণের আপাতিক এই দুঃস্বভাব অত্যন্ত কঠিন মনে হলেও লোক-ব্যবহারে এর তাৎপর্য আছে। অন্য উদাহরণ টেনে এনে কথা বাড়াব না, তাৎপৰ্যটা এই উতঙ্ক-পৌষ্যের কাহিনী থেকেই একটু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।
তৈত্তিরীয় উপনিষদের এক জায়গায় পিতাকে দেবতার মতো দেখো, মাকে দেবতার মতো দেখো, আচার্যকে দেবতার মতো সম্মান করো ইত্যাদি বাণী পড়তে হত। ছোটবেলায় এগুলো বাণীর মতোই লাগত, এখন সেটা খানিকটা উপলব্ধিতে আসে। তৈত্তিরীয়ের এই একই প্রসঙ্গে বলা আছে-কাউকে যদি কিছু দাও, তো সাহংকারে দিও না, মনে বিনয় রেখে সলজ্জে দিও। যদি দিতে হয়, তো তার মধ্যে মধ্যে যেন শ্রী থাকে সৌন্দর্য থাকে, ছিছিক্কার করে ছুঁড়েমুড়ে দিও না, দেওয়ার মধ্যে যে শ্রী অর্থাৎ ছিরি’ থাকে- হিয়া দেয়। শ্রিয়া দেয়। এর পরে আছে মোক্ষম কথাটা। তৈত্তিরীয় বলেছে- যদি দিতে শ্রদ্ধা হয়, তবেই দিও। আর দিতে যদি ইচ্ছা না হয়, যদি শ্রদ্ধা না হয়, তবে দিও না বরং, তাও ভাল- শ্রদ্ধায় দেয়ম। অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম।
এই যে শেষে নেতিবাচক কথাটা শুধু শ্রদ্ধার প্রসঙ্গে বলা হল অর্থাৎ শ্রদ্ধা না থাকলে দিও না, এই নেতিবাচক ভাবটুকু অন্যত্রও প্রযোজ্য অর্থাৎ দেওয়ার মধ্যে ‘ছিরি’ না থাকলে দিও না, অবিনয় থাকলে দিও না। রাজা পৌষ্য ব্রাহ্মণ স্নাতককে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেই খেতে দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার খেতে দেওয়ার মধ্যে সেই শ্ৰী, সেই পরিচ্ছন্নতা ছিল না। অন্ন শীতল, কেশযুক্ত। শুধুমাত্র এই নিরীক্ষণী শ্ৰীর অভাবেই উতঙ্ক আজ দুঃখিত। তবে রাজা ভুল স্বীকার করে নিতেই উতঙ্ক তাকে শাপমুক্ত করেছেন এবং রাজাকে বুঝিয়ে গেছেন যে, শাপ প্রত্যাহারের ক্ষমতা তার না থাকলেও রাজাই যেহেতু দোষী, অতএব তার শাপ উতঙ্কের গায়ে লাগবে না। যাই হোক পৌষ্য-পত্নীর কানের দুল দুটি নিয়ে উতঙ্ক পথ চলতে আরম্ভ করলেন। রাজমহিষীর কথায় নাগরাজ তক্ষক সম্বন্ধে মনে তার সাবধানতা আছে ঠিকই, তবে তত ভীত তিনি নন, যতখানি রাজমহিষী তাকে বলেছেন।
এখানে একটা কথা আমায় বলে নিতে হবে। পণ্ডিতেরা উতঙ্ক পৌষ্যের কাহিনীকে মহাভারতের মৌলাংশে স্থান দেবেন না। অর্থাৎ তাদের মতে এটা প্রক্ষেপ। কিন্তু মনে রাখতে হবে–ইতিহাসের দিক থেকে এ কাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম। মহাভারতের কথকঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবা যখন এ কাহিনী বলছেন, তখন বৌদ্ধ ধর্মের হাওয়া এসে গেছে ভালরকম। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বৌদ্ধধর্মের প্রভাব রুখবার জন্য সবরকম ভাবে চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় বৌদ্ধ-ক্ষপণকদের চোর সাজিয়ে নিন্দা করে উগ্রশ্রবা সৌতি তার নিজের কালের হাওয়া লাগিয়ে দিয়েছেন মহাভারতের গায়ে। এবারে আসল ঘটনায় আসি।
উতঙ্ক পথে নেমেই দেখতে পেলেন একজন উলঙ্গ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তার পিছন পিছন আসছেন। তাকে কখনও দেখা যাচ্ছে আবার কখনও সে লুকিয়ে পড়ছে উতঙ্কের দৃষ্টিকে কি দিয়ে। এইভাবে একসময় উতঙ্ক তাকে দেখতে পেলেন না এবং নিশ্চিন্তে কুণ্ডল দুটি একটি পুকুরের পাড়ে রেখে জলে নেমে স্নান-আহ্নিক সেরে নেবার ইচ্ছা করলেন। উতঃ পুকুরে নেমেছেন–এই অবসরে সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এসে রাজরানির কানের দুল-দুটি নিয়ে পালালেন। উতঙ্ক সন্ধ্যা-বন্দনা কোনওরকমে সেরে পুকুর থেকে উঠে দেখলেন-সন্ন্যাসী পালাচ্ছেন। উতঙ্ক তার পিছু নিলেন।
এই যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে আপনার পরিচয় হল, ইনিই কিন্তু নাগরাজ তক্ষক। তিনিই নগ্ন ক্ষপণকের বেশ ধরে রাজরানির কুণ্ডল চুরি করেছেন। বস্তুত এই চুরির দায়টা সোজাসুজি তক্ষকের ওপর চাপালেই হত। কিন্তু তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে বৌদ্ধরা কত খারাপ, চুরি-তঞ্চকতার মতো হীন কাজ তারা কী রকম নির্দ্বিধায় করে– ধর্মের বৌদ্ধিক স্তরে এটা প্রমাণ করা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পক্ষে জরুরি ছিল। সৌতি উগ্রশ্রবা সমাজের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মহাভারতের কথা বলছেন। অতএব বৌদ্ধ ক্ষপণকের ভণ্ড বেশ তিনি কাজে লাগিয়ে দিলেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য। ইতিহাসের দৃষ্টিতে এই প্রক্ষেপ তাই ভয়ঙ্কর রকমের গুরুত্বপূর্ণ।
উতঙ্ক ছুটতে ছুটতে বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীকে ধরে ফেললেন। সন্ন্যাসী সঙ্গে সঙ্গে আপন বেশ ত্যাগ করে নাগরাজ তক্ষকে পরিণত হল এবং তাকে ধরার সাধ্য হল না উতঙ্কের। সামনে একটি গর্ত দেখেই সর্পরাজ সেখানে ঢুকে পড়লেন এবং সেই গর্তের ভিতর দিয়েই সোজা চলে গেলেন পাতালে, একেবারে সটান নিজের বাড়িতে। যেন সাপ বলেই তার এত সুবিধে হল, আর মানুষ বলে উতষ্ক আর তাকে ধরতে পারলেন না। বুঝতে পারছি এখানে আরও দুটো কথা আমায় বলতে হবে।
দেখুন, আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, আরে মশাই! কী যে আপনারা বলেন? তক্ষকের দংশনে নাকি পাণ্ডব-কুলের কনিষ্ঠ পুরুষ পরীক্ষিতের মৃত্যু হল। বলি, সাপের ব্যাপারে খবর রাখেন কিছু? এই যে তক্ষক সাপ বলছেন, সর্পতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তক্ষকের কোনও বিষই নেই বলে রায় দিয়েছেন। আর আপনারা মহাভারত খুলে, ভাগবত পুরাণ খুলে বারবার বলতে থাকবেন তারপর সেই ফলের ভিতরে থাকা তক্ষক সাপের বিষের জ্বালায় পরীক্ষিত মরলেন। এটা কী কোনও যুক্তি হল?
আমরা বলি, আপনারা হাজার হাজার বছর আগের লেখা পূরাণ কথা শুনছেন, মহাভারত শুনছেন। সেটাকে কি ওইভাবে বিচার করলে চলবে? পৌরাণিকদের কথাবার্তা, ভাব-মর্ম শুধু কি এক জায়গা থেকে বুঝলেই হবে? পূর্বাপর বিচার করতে হবে না? তার ওপরে কাহিনীর খোলস আছে, আছে পৌরাণিকদের নানা আবরণ। এই তো এই উতঙ্কের কাহিনীতে এখনই শুনবেন- তক্ষক গর্তে ঢুকে পড়ার পর উতঙ্ক লাঠি-খোস্তা দিয়ে গর্তটাকে বড় করার চেষ্টা করলেন। নিজে পারলেন না, তখন দেবরাজ ইন্দ্র তার বজ্র ফাটিয়ে সেই গর্তটাকে বড় করলেন। আর সেই বিস্তৃত গর্তপথে প্রবেশ করে উতঙ্ক যখন পাতালে এসে পৌঁছলেন, তখন তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। তিনি দেখলেন- নাগলোকের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে মন্দির আছে, রাজভবন আছে, বড় বড় বিল্ডিং আছে, চিলে কোঠা আছে, এবং নাগেদের বড় বড় বাড়িতে নানারকমের ‘হুক’ পর্যন্ত সাটা আছে, এমনকি খেলার মাঠও আছে–অনেকবিধ-প্রাসাদ- হর্ম্য-বলভী-নির্যূহ-শত-সঙ্কুলম-উচ্চাবচ-ক্রীড়াশ্চর্য- স্থানাবকীর্ণমপশ্যৎ।
তক্ষকের বিষে আপনার বিশ্বাস নাই থাকতে পারি, কিন্তু সর্পরাজ্যে যে রকম ঘর-বাড়ি আর প্রাসাদ-হ-বলভী দেখলাম তক্ষককে সাপের দৃষ্টিতে দেখলে এগুলিও তাহলে বিশ্বাস করা যায় না। তাই বলছিলাম, পুরাণকারদের কথা-বার্তা, ভাবনা-চিন্তা অত হঠাৎ সিদ্ধান্তের জিনিস নয়। তার পিছনে আমাদেরও একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। যে কথাটা প্রথমেই মনে রাখা দরকার, সেটা হল– দেবতা, অসুর, যক্ষ-রক্ষ, গন্ধর্ব-কিন্নর, হনুমান, জাম্ববান অথবা সৰ্পনাগ–এঁদের অন্তরীক্ষ লোকের কোনও বাসিন্দা ভাবার কোনও কারণ নেই। আমি অবশ্যই পরম ঈশ্বর, ব্ৰহ্ম বা অন্তর্যামী পরমাত্মা সম্বন্ধে কোনও কথা বলছি না। কিন্তু মহাভারত-পুরাণ এবং ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র থেকেও দেবতা-রাক্ষস অথবা নাগ-সর্পদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা যাবে। এঁদের ঠিকানার জন্য অলৌকিক কোনও স্বর্গ অথবা পৃথিবীর গভীরে কোনও পাতাল-প্রবেশের দরকার নেই– এঁরা সবাই এই সুন্দরী পৃথিবীর চিরকালের বাসিন্দা। স্বর্গ, নরক, গন্ধর্বলোক, নাগলোক- এগুলির ভৌগোলিক অবস্থান, পরে সময়মতো নির্ণয় করে দেখাব। কিন্তু এখন জেনে নিন তক্ষক এবং অন্যান্য নাগের কথা।
আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যাদের আমরা দেবতাদের বিরোধী গোষ্ঠী হিসেবে পেয়েছি। ঋগবেদে তাদের নাম দাস বা দস্য। মহাকাব্যের পূর্ব যুগ থেকেই এই বিরোধী গোষ্ঠীকে আমরা অসুর-রাক্ষস নাম দিয়েছি এবং দেবতাদের সঙ্গে তাদের চিরন্তনী শত্রুতা সর্বজনবিদিত। মহাকাব্যের যুগে প্রধানত মহাভারতের যুগেই অসুর-রাক্ষসদের আর তত দেখতে পাবেন না, আস্তে আস্তে চতুবর্ণ-বিভাগে তারা স্থান করে নিতে পেরেছেন। আর্যরা যখন সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের উত্তরখণ্ডে ছড়িয়ে পড়তে থাকলেন, তখন এই নাগদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। নাগেরা অবশ্যই আরণ্যক গোষ্ঠী, বনে-জঙ্গলেই তাদের বাস ছিল, গঙ্গা, যমুনা, নর্মদার মতো নদীর ধারেও তাদের বসতি দেখা যাচ্ছে।
প্রথম দিকে নাগ জন-জাতিরা তাদের এই নতুন শত্রুদের তত আমল দেননি, কিন্তু আর্যরা যখন শহর গড়ার দিকে মন দিলেন, তখন এদের বসতির ওপর আর্যদের হাত পড়ল, আর সেই থেকেই শত্রুতার শুরু। মহাভারত আলোচনার পরবর্তী সময়ে দেখবেন– অর্জুন যখন পাণ্ডবদের রাজধানী বানানোর জন্য খাণ্ডব-বন পুড়িয়ে দিলেন, তখন সেখান থেকে তক্ষক-নাগকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। এই তক্ষক আর কেউ নয়, কোনও সাপ তো নয়ই, প্রাচীন নাগগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান। পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলি- ওই যে হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, তক্ষশিলার নাম শোনেন-কুরু-পাণ্ডবদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের রমরমা হওয়ার আগে এইসব জায়গায় নাগ-জনজাতিরই রাজত্ব ছিল। যমুনার মধ্যে বিষধর কালীয়-নাগের মাথায় কৃষ্ণের নন-কুর্দন নাগ-জনজাতির পরাজয় যতটুকু সূচনা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি সূচনা করে তার পূর্বাধিপত্য।
ভাগবত পুরাণ অথবা ২য়/৩য় শতাব্দীর বিখ্যাত ভাসের নাটক- যাই খুলুন, দেখবেন যমুনার জল কেউ স্পর্শ করে না, তাতে নাকি কালীয়-নাগের বিষ মেশানো আছে। আসলে এখানে যমুনা বলতে আমরা যমুনা নদী বুঝি না, যমুনার উপকূলবর্তী অঞ্চল বুঝি। ঠিক যেমন ‘আমি দক্ষিণেশ্বরে থাকি’ বললে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির বোঝায় না, তার কাছাকাছি অঞ্চল বোঝায়, তেমনই এইসব জায়গাতেও মুখ্যার্থের বাধা হয়। আসলে কালীয় কিংবা বাসুকি কেউই যমুনার জলে বা সাগরের জলে থাকেন না; তাদের জায়গা পণ্ডিতদের মতে জলা জায়গা, বন-জঙ্গল অরণ্যভূমি। কৃষ্ণ কালীয়কে তাড়িয়ে দিয়ে যমুনার জলকে বিষমুক্ত করেছিলেন বলে যে মাহাত্ম আছে, তা আসলে নাগ জন-জাতির আরেক প্রধানকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা।
এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মতামত ব্যক্ত করে আরও দশ পাতা লেখা যায়, কিন্তু তাতে মূল ঘটনার খেই হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। এখানে শুধু এইটুকু মাথায় রাখতে হবে যে, খাণ্ডবদাহের সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের সঙ্গে তক্ষকের শত্রুতা শুরু হয়। এবং পরিক্ষীণ পাণ্ডব-বংশের শেষ পুরুষ পরীক্ষিতের ওপর প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে এই পালার শেষ সূচনা হয়। ধাতু-প্রত্যয় নিষ্পন্ন করে বাননটা পরীক্ষিত’, ‘পরীক্ষিত’ অনেক রকম হয়। আমরা চালু বানান পরীক্ষিতই বলব।
তক্ষক কি কালীয়, বাসুকি কি অনন্ত–এঁদের ঘরবাড়ি মানুষের মতোই, ভাষাও যথেষ্ট সংস্কৃত এবং আর্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এঁদের ওঠাবসা বিয়ে-থাও যথেষ্ট হয়েছে। আপাতত তক্ষক আর উতঙ্কের বৃত্তান্তে দেখব– উতঙ্ক বড় বড় নাগগোষ্ঠীর প্রধানদের মনোরম-স্তুতি রচনা করেছেন এবং নাগরাজ তক্ষক পৌষ্য-পত্নীর দুল দুটি ফিরিয়েও দিয়েছেন। উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উপস্থিত হয়েছেন এবং তার আশীর্বাদও পেয়েছেন। কিন্তু তক্ষক তার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে এবং তাকে যে পরিমাণ হেনস্তা করেছে, তাতে তার ক্রোধ চূড়ান্ত হয় এবং তিনি তার গুরুভাই হস্তিনাপুরের রাজা জনমেজয়ের কাছে উপস্থিত হয়েছেন তক্ষকের ওপর প্রতিশোধ তুলতে ক্রুদ্ধঃ তক্ষক প্রতিচিকীর্ষমাণো হস্তিনাপুরং প্রস্থে। অন্য রাজা বাদ দিয়ে জনমেজয়ের কাছে তার যাওয়ার কারণও ছিল। কারণ একটাই। জনমেজয়ও তক্ষকের শত্রু। তক্ষক তার পিতা পরীক্ষিতকে মেরেছেন।
উতঙ্ক হস্তিনাপুরের রাজসভায় পৌঁছনোর আগে আগেই জনমেজয় তক্ষশিলা জয় করে ফিরে এসেছেন। গবেষকরা এমনও মনে করেন যে, জনমেজয়ের তক্ষশিলা-অভিযানও নাগ-জাতীয় জন-জাতিকে পর্যুদস্ত করার জন্য। কারণ ইতিহাস-মতে এই অঞ্চলে নাগদের প্রভুত্ব এবং ক্ষমতা দুই ছিল। ‘তক্ষক’ শব্দের সঙ্গে তক্ষশিলার মিল এবং সেখানে বৌদ্ধ-প্রভাবের অনুষঙ্গে তক্ষকের নগ্ন ক্ষপণকের বেশ ধারণও এই নিরিখে ব্যাখ্যা করা। যাই হোক এত তর্কের মধ্যে না গিয়ে আমরা আপাতত উতষ্কের আক্রোশ লক্ষ্য করব। উতঙ্ক বললেন, যে কাজ আপনার করা উচিত ছিল, মহারাজ সেই কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
ইঙ্গিতটা অবশ্যই তক্ষশিলা-বিজয়ের দিকে। তক্ষশীলার নাগজাতীয়দের অনেকেই জনমেজয়ের হাতে পর্যদস্ত হলেও তক্ষকের এখনও কিছুই হয়নি। উতঙ্ক তাই বললেন, সেই তক্ষক নাগ আপনার বাবাকে মেরেছে–তক্ষকেশ মহীন্দ্রে যেন তে হিংসিতঃ পিতা- আপনি তাকে মারার কথা ভাবুন, আপনি বালকের মতো অন্য কাজ করে যাচ্ছেন–বাল্যদিবান্যদেব ত্বং কুরুতে নৃপসত্তম। উতঙ্ক জনমেজয়কে চেতিয়ে দিয়ে বললেন,তক্ষক বিনা অপরাধে আপনার বাবা পরীক্ষিতকে দংশন করেছে। শুধু কি তাই? আপনার পিতার চিকিৎসার জন্য মহামুনি কাশ্যপ আসছিলেন, তক্ষক তাকেও কায়দা করে ফিরিয়ে দিয়েছে। অতএব এই অবস্থায় অন্য কিছু নয়, আপনি সর্প-যজ্ঞ করুন যাতে তক্ষককে পুড়িয়ে মারা যায়। উতষ্ক এবার রাজাকে জানালেন- তক্ষক তাকে হেনস্তা করেছে। সব শুনে জনমেজয় একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, মহাভারতের উপমায় সেটা–আগুনে ঘি–দীপ্তোগ্নি ইবিষা যথা।
০০৫. উগ্রশ্রবা সৌতির গল্প
০৫.
কাহিনী জমে উঠেছে। উগ্রশ্রবা সৌতির গল্পে সমবেত মুনি-ঋষিরা এখন রীতিমতো ‘সাসপেনস’ নিয়ে বসে আছেন। উতঙ্ক জনমেজয়কে ক্ষেপিয়ে তোলার পর তিনি কী করলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। সৌতি কিন্তু কিছু বললেন না, সাসপেনসটা ধরে রাখলেন। উতঙ্কও যে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের একটা কারণ–এইটুকু বলেই সৌতি বললেন, বলুন আর কী শুনতে চান? কীই বা আর বলব- কিং ভবন্তঃ শ্রোতুমিচ্ছত্তি, কিমহং ব্রুবাণি ইতি।
ঋষিরা অনেকক্ষণ গল্প শুনেছেন। কুলপতি শৌনক তখনও অগ্নিশরণগৃহে। ঋষিদের একটু লজ্জাই করল। এই বারো বছরের যজ্ঞ মহর্ষি শৌনকেরই ঘাড়ে। মূল দায়িত্ব তার বলে ব্যস্ততাও তার বেশি। ঋষিরা মজাসে গল্প শুনছেন, আর ওদিকে কুলপতি শৌনক–কোথায় যজ্ঞকাষ্ঠ, কোথায় সোম-রস, কোথায় কোন বৈদিক বসবেন–এ সব নিয়ে মরছেন। সমবেত ঋষিদের লজ্জা হল। তারা বললেন–সৌতি! কুলপতি শৌনক আসুন এখানে। আমাদের তো অনেক কিছুই শুনতে ইচ্ছা। কিন্তু কী জান, দেবতা-অসুর-গন্ধর্ব-মনুষ্য-নাগ–এঁদের খবর কুলপতি শৌনকও ভাল মতো রাখেন–মনুষ্যোরগ-গন্ধর্ব-কথা বেদ চ সর্বশঃ। কাজেই তিনি এলে আমাদের প্রশ্ন করারও যুত হবে।
অর্থাৎ সৌতি উগ্রশ্রবার ফাঁকি দেবার উপায় নেই। যারা জানেন অল্প, তাদের কাছে গল্প ফঁদা এক জিনিস, কিন্তু শৌনকের মতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান প্রাধ্যাপকের সামনে কি চলবে না। কাহিনীকার এবং সহৃদয় রসিক শ্রোতা এক সঙ্গে বসবেন, তবেই না মহাকাব্যকথা আরম্ভ হবে। তা মহর্ষি শৌনক এসে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনি কিন্তু এসেই আগে কিছু শুনতে চাইলেন না। নতুন কথক-ঠাকুর কেমন কতখানি জানেন তিনি, সেসব খোঁজ-ভঁজ নিয়ে তবে তিনি আসল কথায় যাবেন। নতুন কথককে পরীক্ষা করার জন্য তিনি বললেন- তোমরা বাবা রোমহর্ষণ ছিলেন পুরাণ-বিজ্ঞ মানুষ; স্বয়ং ব্যাসের কাছে তাকে মহাভারতের কাহিনী পড়তে হয়েছে। তা বাপু, তুমিও কি সেইরকম পড়াশুনা করে এসেছ–ক্কচিৎ ত্বমপি তৎ সর্বমধীষে লৌমহর্ষণে–নাকি ফাঁকি আছে তোমার বিদ্যায়? আচ্ছা বেশ, থাক এসব কথা–তুমি বরং একটু ভূত-বংশের কাহিনী বলো দেখি, শুনি–শ্রোতুমিচ্ছামি ভার্গব। সৌতি উগ্রশ্রবার পরীক্ষা আরম্ভ হল। আসলে শৌনক যে সব ছেড়ে ভৃগুবংশের কথাটাই প্রথম শুনতে চাইলেন, তার কারণ–তিনি নিজেও ভৃগুবংশীয়। আত্মবংশের সব কিছুই তাঁর জানা। সৌতি উগ্রশ্রবার তাই বড় পরীক্ষা সামনে।
ভৃগু-বংশের নাম শোনা মাত্রই পণ্ডিতরা কিন্তু টান-টান হয়ে বসেন। সুকৃথঙ্কর থেকে সুকুমারী ভট্টাচার্য–অনেক পণ্ডিতেরই ধারণা যে, মহাভারত-রচনা, বিশেষত মহাভারতের প্রক্ষিপ্তাংশে ভৃগুবংশীয়দের ভাল রকম হাত আছে। আমি সেই সব বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। মহাভারত যেমনটি আমাদের হাতে এসেছে, তাই নিয়েই আমাদের বিচার। তবে হ্যাঁ, পণ্ডিতরা যে সৌতি উগ্রশ্রবাকে মহাভারতের ‘থার্ড এডিটর’ বলেছেন, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। প্রসঙ্গত বলি- তাদের মতে মহাভারতের প্রথম সম্পাদক ব্যাসদেব, দ্বিতীয় সম্পাদক ব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন, যিনি জনমেজয়কে মহাভারত-কথা “শুনিয়েছেন। আর আমাদের থার্ড এডিটর’ সৌতি উগ্রশ্রবা–যেমনটি বৈশম্পায়ন এবং তাঁর পিতা রোমহর্ষণের কাছে পুরাণ-কথা, ভারতের ইতিহাস শিখেছেন, তেমনটি আমাদের বলেছেন। বেশির মধ্যে এই, তার কাহিনীতে আছে তার নিজের কালের হাওয়া, নিজের সময়ের সমস্যা এবং সংকট। সেও তো সামাজিক ইতিহাসই বটে, না হয় সেটা কিছু পরবর্তী সময়ের, তাতে আমাদের কী অসুবিধে? আমরা সেটাও জানতে চাই।
সৌতি উগ্রশ্রবা বলতে আরম্ভ করলেন। মহর্ষি ভৃগুর স্ত্রী ছিলেন পুলোমা। আগেই জানিয়ে দিই- প্রথম কল্পে ব্রহ্মা যাদের দিয়ে তার সৃষ্টিকার্য আরম্ভ করেছিলেন, ভৃগু তাদের অন্যতম। ওদেশে যাকে আমরা অ্যাডাম বলে ডেকেছি, আমাদের দেশে ওরকম অ্যাডাম’অন্তত দশজন আছেন। তাদের বলা হয় ব্রহ্মার মানসপুত্র। তাদের মধ্যে জনা পাঁচেক ব্রহ্মবাদী হয়ে ব্রহ্মসাধনে মন দিলেন, আর অন্য পাঁচজন বিবাহাদি করে সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলেন। আমাদের ভৃণ্ড এই দ্বিতীয় দলের। তার স্ত্রীর নাম পুলোমা। তিনি যথেষ্ট সুন্দরী, কিন্তু তার স্বভাবটা ভৃগুর মতোই অর্থাৎ এঁর সঙ্গে ওঁর মত মিলত খুব কথকঠাকুরের ভাষায়–সমশীলিনী। ঋষির সঙ্গে আনন্দে তার দিন কাটছে, এরই মধ্যে ভৃগুর সন্তান এল পুলোমার গর্ভে।
মহর্ষি ভৃগু একদিন গর্ভবতী স্ত্রীকে আশ্রমে একা রেখে বেরিয়েছেন নদীতে স্নান করার জন্য। ব্রাহ্মণ মানুষ; স্নানে একটু সময় লাগে–সন্ধ্যা আহ্নিক, সূর্য-প্রণাম আর অবগাহন করতে যে সময় লাগে, সে সময় খুব কম নয়। এরই মধ্যে একটি রাক্ষস এসে পৌঁছলেন ভৃগুর আশ্রমে। ভৃগুর সুন্দরী স্ত্রীটিকে দেখে রাক্ষসের মন বড় পুলক হল, বেশ কামাবেশও হল। লক্ষণীয় ব্যাপার হল–এই রাক্ষসের নামও পুলোমা।
দুই পুলোমা–অর্থাৎ ভৃগুর স্ত্রী পুলোমা এবং রাক্ষস পুলোমা–এই দুজনের দেখা হওয়ার আগেই একটা জ্ঞানের কথা শোনাই। মনে রাখতে হবে রাক্ষস’ শব্দটা শোনামাত্রই আপনারা যারা পুরুষ্টু গোঁফওয়ালা বিশাল দাঁতওয়ালা, হা-হা-ধ্বনিযুক্ত কতগুলি জীবের কল্পনা করেন, তাদের আমরা রীতিমতো নিরাশ করব। রাক্ষসেরা সকলেই দেবতাদের বৈমাত্রেয় ভাই এবং তাদের বাবা একজনই- মহর্ষি কাশ্যপ। পুরাণে-ইতিহাসে এবং দর্শনে যেমনটি আছে তার বিস্তৃত আলোচনায় গেলে আপনারা আবার আমাকে জ্ঞানদাতা ঠাকুরদাদাটি ভাববেন বলে তার মধ্যে যাচ্ছি না, যদিও গেলে ভাল হত। তবে জেনে রাখুন- তারা ভাল রকম সংস্কৃত জানতেন, বেদ-বেদাঙ্গ-ব্যাকরণের জ্ঞানও তাদের বেশ টনটনে। দেবতাদের থেকে তাদের গুণ কোথাও কোথাও বেশি। বস্তুত তাদের মতো ইঞ্জিনিয়ার এবং শিল্প-রসিক তো সে যুগে কমই ছিল। রাবণের স্বর্ণলঙ্কা অথবা ময়দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থ অথবা ত্রিপুর দুর্গ স্মরণ করলেই রাক্ষসদের শিল্প-সত্তার পরিচয় পাবেন আপনারা। দেখতেও তারা কেউ খারাপ নন, রীতিমতো সুপুরুষ।
এত সব গুণ থাকা সত্ত্বেও কতগুলি দোষই এঁদের একেবারে রাক্ষস করে ছেড়েছে। দোষের মধ্যে প্রধান হল ছয় রিপু, বিশেষত কাম-ক্রোধ তাদের এতই বেশি প্রবল, অপিচ নিজের ওপর তাদের সংযমও এতই কম যে, শুধু ষড়রিপুই তাদের রাক্ষস বানিয়ে দিল। নইলে দেখুন, দেবতা-রাক্ষসে যতই শাশ্বতিক বিরোধ থাক, তাদের মধ্যে এমনিতে মিলটাই বেশি। বিয়ে-থাও কিছু কম চলত না। এই পুলোমা রাক্ষসের কথাই ধরুন। পুরাণে-ইতিহাসে পুলোমা’ নামে কিন্তু দু-তিন জন রাক্ষস আছেন। রাক্ষসদের পুরো একটা শুষ্টিকেও তাদের মায়ের নামে পুলোমার গুষ্টি বলা হয়েছে মহাভারতে। পুলোমা আর কালকা–একজন দৈত্য-সুন্দরী অন্যজন অসুর-সুন্দরী- পুলোমা নাম দৈতেয়ী কালকা চ মহাসুরী। এরা দুজনেই তপস্যা করে ব্রহ্মর কাছে নিজেদের ছেলেদের জন্য বর চেয়ে নিয়েছিলেন। এই পুলোমার ছেলেরাই পৌলোম গুষ্টির রাক্ষস–পৌলোমৈশ্চ মহাসুরৈঃ।
পুলোমা নামে এই রাক্ষস-সুন্দরীর কথা বলে নিলাম এইজন্য যে, রাক্ষসদের মধ্যে পুলোমা নামটা মেয়েদেরও চলত, ছেলেদেরও চলত। এই রকমটা ব্রাহ্মণ-ঋষিদের মধ্যেও চলত, যেমন আস্তীক-মুনির পিতা জরৎকারু মুনির পত্নীও জরৎকারু, যদিও এই স্ত্রী-জরৎকারু নাগ-বংশের মেয়ে। সেকথা পরে। কারণ দেবরাজ ইন্দ্র যাকে সপ্রেমে বিয়ে করেছিলেন, সেই শচী-দেবী কিন্তু এক রাক্ষসে পুলোমার মেয়ে। শচীদেবীকে অনেকেই আদর করে পৌলোমী বলে ডাকেন। এখনকার অনেক মা’ও সাদরে কন্যার নাম দেন পৌলোমী। এমন রাক্ষুসে নাম শুনে দুঃখ পাবার কিছু নেই। আমার বক্তব্য, দুটো আলাদা আলাদা উদাহরণ থেকে এটা কিন্তু বেশ প্রমাণ হল যে, পুলোমা নামটা রাক্ষস-দৈত্যদের মধ্যে বেশ চলত। আমার তো বেশ সন্দেহ হয়, মহর্ষি ভৃগু হয়তো এক রাক্ষসীকেই বিয়ে করেছিলেন, হয়তো রাক্ষস-ঘরেরই এক পরমা সুন্দরী কন্যা তিনি। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ এই মুহূর্তে কিছু দিতে পারছি না বটে, তবে পুরাণে ইতিহাসে এ তাবৎ যত ‘পুলোমা পাওয়া গেছে, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, তারা সবাই রাক্ষস-ঘরের সন্তান। ঠিক এই দৃষ্টিতে দেখলে ভৃগুর স্ত্রী পুলোমার সঙ্গে রাক্ষস পুলোমার পূর্ব-পরিচয় থাকাও অসম্ভব নয় এবং সত্যি বলতে কি পূর্ব-পরিচয় ছিলও।
যাই হোক, ভৃগুমুনি স্নান করতে গেছেন, আর এই অবসরে রাক্ষস পুলোমা ঢুকে পড়লেন ঠার আশ্রমে। তার বেশ-বাস বা চেহারার মধ্যে কোনও রাক্ষুসেপনা ছিল না। কেননা সুন্দরী পুলোমা তাকে দেখে ভয়ও পাননি, লজ্জাও পাননি। বরং সেকালের আতিথ্যের আদর্শে থালায় করে বেশ কিছু ফল-মূল খেতে দিয়ে ঘরে নেমন্তন্ন করলেন রাক্ষসকেন্যময়ত বন্যন ফল-মূলাদিনা তদা। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও অন্তত রাক্ষস ততটাই ভদ্র যে, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও পুলোমার মনে কিন্তু ভৃগুপত্নীকে পাবার জন্য কামনা ছিল হৃচ্ছয়েনাভিপীড়িত। রাক্ষস পুলোমা ভাবলেন–এই সুযোগ। বাড়িতে ভৃণ্ড-মুনি নেই। এই অসামান্যা রূপবতী ভৃগুপত্নীকে হরণ করে নিয়ে যাবেন তিনি। আজ থেকে ভৃগুপত্নীকে আপন বাহুর ডোরে পাবেন তিনি–এই চিন্তায় বড় খুশি হয়ে উঠলেন রাক্ষস পুলোমা–হৃষ্টমভূদ রাজন জিহীর্যুস্তাম্ অনিন্দিতাম্।
মনে মনে তার খুশি হওয়ার একটা কারণও ছিল। রাক্ষস পুলোমা দেবীকে আগেই চিনতেন। হয়তো সেই পুতুল-খেলার বয়স থেকে, হয়তো বা পৌগণ্ডের দিনশেষে যেদিন যৌবনের উদভেদ দেখা দিল পুলোমার শরীরে, সেদিনই জনান্তিকে রাক্ষস বরণ করেছিল এই অনুপমা সুন্দরীকে–সা হি পূর্বং বৃতা তেন পুলোম্না তু শুচিস্মিতা। সুন্দরী পুলোমা হয়তো সে কথা জানতেন। হয়তো বা জানতেন না। কিন্তু পুলোমার বাবা অন্তত জানতেন যে, রাক্ষস পুলোমা তার মেয়েকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক তার মেয়ের সম্বন্ধে রাক্ষসের এই মনন-বরণ পুলোমার বাবা পছন্দ করেননি।
মহাভারতের বিখ্যাত টীকাকার নীলকণ্ঠ যেভাবে এই দুই যুবক-যুবতীর হৃদয় ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে বেশ বুঝতে পারি–অতিরিক্ত বেদাভ্যাসের ফলে তার বুদ্ধি হয়তো খানিকটা কালিদাসীয় পদ্ধতিতে জড় হয়ে গিয়েছিল–বেদাভ্যাসজড়ঃ। নইলে ভাবুন একবার, নীলকণ্ঠ যখন মহাভারতের শ্লোকে দেখলেন–পুলোমা রাক্ষস ভৃগুর সঙ্গে বিয়ের আগেই সুন্দরী পুলোমাকে চেয়েছিলেন এবং পুলোমার বাবা সেটা জেনেও মেয়েকে তার হাতে দেননি, তখনই তিনি ব্যাখ্যা করলেন–ছোটবেলায় তার মেয়ে পুলোমা যখন কেঁদে কেঁদে একসা হত, তখন তার বাবা তাকে ভয় দেখিয়ে বলতেন—আর তো রাক্ষস। ধরে নিয়ে যা, এক্ষুনি ধরে নিয়ে যা এই মেয়েটাকে–বাল্য কিল রুদতীং কন্যাং রোদননিবৃত্ত্যর্থং ভীষয়িং পিত্রা উক্তং ‘রে রে রক্ষ! এনাং গৃহাণেতি। নীলকণ্ঠের ধারণা–এই রকম কোনও ভয় দেখানোর সময় পুলোমা রাক্ষস কথাগুলি শুনতে পায়-এক মেয়েটিকে মনে মনে বরণ করে।
বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে আমার ভাবনা এতটা বাৎসল্যময়ী নয়। নির্দোষ তো নয়ই। আমি এই ঘটনার মধ্যে ক্রমে ক্রমে পরিচিত দুই মুগ্ধ হৃদয়ের স্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাই। সুন্দরী পুলোমার পিতা এই হৃৎস্পন্দন অস্বীকার করেছেন। তিনি এই যুবক-যুবতাঁকে মিলিত হতে দেননি। এবং তার কারণ দুটো হতে পারে। পুলোমা যদি রাক্ষস-ঘরের মেয়ে হন, তবে অধিকতর উৎকৃষ্ট পাত্রের জন্য তার পিতার অপেক্ষা থাকতে পারে। আর পুলোমা যদি আর্যগোষ্ঠীরই মেয়ে হয়ে থাকেন, তবে তথাকথিত অনার্য রাক্ষসের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ায় তার আর্যজনোচিত শুদ্ধতায় আঘাত লাগতে পারে।
যাই হোক, রাক্ষস পুলোমা এত-শত বোঝেন না। তিনি জানেন–তার সঙ্গে বঞ্চনা করা হয়েছে। সুন্দরী পুলোমার বাবা লুকিয়ে ভৃগুর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন মেয়ের। রাক্ষস তাতে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। এতদিন পরে তিনি তার পুরাতনী নায়িকাকে খুঁজে পেয়েছেন। রাক্ষসের ঘরে জন্মে এমন শুচিবাইও তার নেই, যাতে শুধু অন্যের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে পূর্ব-পরিচিতা অথবা যৌবন-মুখর দিনের প্রথম চাওয়া রমণীটিকে ছেড়ে দেবেন তিনি। রাক্ষস ভৃগুপত্নীকে অপহরণ করার মতলব করল।
ভৃগু যখন স্নানে গেছেন, তখনও তার ঘরে পবিত্র হোমাগ্নি জ্বলছিল। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের ঘরে যজ্ঞের আগুন কখনও নির্বাপিত হয় না। ঘরের মধ্যে প্রতিনিয়ত যে গার্হপত্য অগ্নি জ্বলছে, সেই আগুন থেকে আগুন নিয়েই ব্রাহ্মণের অন্য যজ্ঞ-প্রক্রিয়া চলে। ভৃগুপত্নীকে হরণ করার আগে সেই পবিত্র আগুনের দিকে রাক্ষসের চোখ পড়ল। আর্য-গোষ্ঠীর চরম বিশ্বাসের প্রতীক এই আগুনকেই সাক্ষী মানলে রাক্ষস। বললেন,-সত্যি করে বলো তো তুমি, এই সুন্দরী পুলোমা কার বউ?
রাক্ষস রীতিমতো বৈদিক পদ্ধতিতে অগ্নিকে স্তুতি করে বললন-তোমাকে না সবাই দেবতাদের মুখ বলে ডাকে? তা সেই মুখে সত্যি করে বলতো- পুলোমা আসলে কার বউ? আমিই তো তাকে প্রথম আমার স্ত্রীরূপে বরণ করেছিলাম–ময়া হীয়ং বৃতা পূর্বং ভার্যার্থে বরবর্ণিনী? কিন্তু তারপর? এই রমণীর পিতা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাকে বঞ্চিত করে এঁকে ভৃগুর হাতে সম্প্রদান করেছেন। পুলোমা অগ্নিকে অনুনয় করে বললেন, আচ্ছা তুমিই বলো আগুন, কাজটা কি ঠিক হল? আচ্ছা, সে যদি বা লুকিয়ে চুরিয়ে কোনও চক্রান্তে ভৃগুর স্ত্রী হয়েও থাকে, সেয়ং যদি বরাবরাহা ভৃগোর্ভার্যা রহোগ, তথাপি ন্যায়ত সে আমারই স্ত্রী কি না–তুমিই সত্যি করে বল। সেই যেদিন থেকে এর বাবা অন্যের হাতে দিয়ে দিয়েছেন আমারই বরণ করা বধূকে, সেদিন থেকে মনে আমার আগুন জ্বলছে–প্ৰদহন্নিব তিষ্ঠতি।
পুলোমা অগ্নিকে এবার তার শেষ সিদ্ধান্ত জানালেন। বললেন–সুন্দরী পুলোমা আমারই স্ত্রী হবেন বলে সম্পূর্ণ নির্ধারিত ছিল। সেখানে মাঝখান থেকে ভূগু যে তাকে বিয়ে করে ফেলেছেন–এতে আমি নিশ্চয়ই খুব পুলকিত বোধ করছি না–অসম্মতমিদং মে’দ্য। তুমি জেনে রেখ, আগুন! আজ আর আমি ছাড়ব না, আজকে তারই আশ্রম থেকে তার স্ত্রীকে হরণ করব আমি।
ঠিক কথাটি বলবার জন্য অর্থাৎ সুন্দরী পুলোমা ন্যায়ত তারই স্ত্রী, নাকি ভৃগুর–এই শঙ্কা নিবারণের জন্য রাক্ষস পুলোমা অগ্নিকে যেভাবে বলেছিলেন তাতে মহাভারত যদি বেদ হত, তাহলে এতক্ষণ আমরা একটি অগ্নিসূক্ত শুনতে পেতাম। বৈদিকরা অগ্নিকে দেবতাদের মুখ বলেই কল্পনা করেছেন, কারণ মানুষের দেওয়া আহুতি-দ্রব্য দেবতারা অগ্নির মুখ দিয়েই গ্রহণ করেন–অগ্নির্বৈ দেবানাং মুখম্–এবং রাক্ষস পুলোমাও তাই বলেছে। অগ্নি মানুষের সমস্ত পাপ-পুণ্যের সাক্ষী, সর্বজ্ঞ এবং তিনি সমস্ত মানুষের প্রাণজ্যোতি–বৈদিকরা এই ভাবেই অগ্নির কল্পনা করেছেন যার শেষ পরিণতি–আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পুণ্য কর। রাক্ষস পুলোমার মুখে বৈদিক ঋষির অগ্নি-স্তুতি শুনে মহাভারতের মধ্যে যেমন বেদের প্রতিষ্ঠা দেখতে পেলাম, তেমনই রাক্ষসদের সম্বন্ধে আমাদের চিরাচরিত ধারণাটাও বা কিছু ঠিক হল। অর্থাৎ বৈদিক রীতি-নীতি রাক্ষসদের কিছু অজানা ছিল না।
পুলোমা রাক্ষস যেভাবে অগ্নিকে সাক্ষী ঠাউরেছেন, তাতে এখন অগ্নি-দেবতাকে ভাবতে এবং দেখতে লাগছে ঠিক মানুষের মতোই। মহামতি যাস্ক, যিনি প্রথম বৈদিক অভিধানকার বলে চিহ্নিত, তিনি অবশ্য অনেকের মত সংকলন করে বলেছেন–দেবতাদের বুঝি বা মানুষের মতোই দেখতে–পুরুষবিধাঃ স্য। মানুষের হাত-পা, চোখ-মুখ, গায়ের রং–সবই বৈদিক দেবতাদের মধ্যেও দেখেছেন। এখানে তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই নয় শুধু, আমরা অগ্নিকে রাক্ষস পুলোমার দুঃখে দুঃখিতও হতে দেখছি–তস্যৈত বচনং ত্বা সপ্তাৰ্চিদুঃখিতো শম্। রাক্ষস পুলোমা যে বঞ্চিত হয়েছেন, সে কথা অগ্নি মনে মনে মানেন ঠিকই, কিন্তু এই যে ভৃগুমুনি–আগুন থেকেই যাঁর জন্ম এবং যিনি স্বয়ং ভগবানের বুকেও পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন–সত্যি কথা বললে তাঁর ক্রোধ থেকে নিস্তার পাবেন কী করে?
এদিকে মিথ্যা কথা বলার ভয়, অন্যদিকে ভূণ্ডর অভিশাপের ভয়–অতএব দুই দিক রক্ষা করেই অগ্নি বললেন–দানব! তুমিই যে আগে এই সুন্দরী পুলোমাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করেছিলে, সে কথা আমি জানি; কিন্তু বিধি অনুসারে মন্ত্রপাঠ করে তুমি তো এই মেয়েকে। বিয়ে করনি–কিং ত্বিয়ং বিধিনা পূর্বং মন্ত্রবন্ন বৃতা ত্বয়া। অন্যদিকে এই কন্যার পিতা পুলোমাকে বৈদিক বিধি অনুসারে মন্ত্রপাঠ করে ভৃগুর হাতে সম্প্রদান করেছেন। হ্যাঁ, জানি, পুলোমার পিতার এখানে স্বার্থ ছিল। তিনি ভেবেছিলেন–মেয়েকে ভৃগুর হাতে দিয়ে তিনি ভৃগুর কাছ থেকে বর-লাভ করবেন এবং সেই আশাতেই তোমার হাতে তিনি মেয়ে দেননি–দদাতি ন পিতা তুভ্যং বরলোভান্মহাযশাঃ।
জেনে রাখা ভাল, ভারতে বিবাহের বিধি চিরকাল, একরকম থাকেনি। পরবর্তী কালের স্মৃতিশাস্ত্রেও এই নিয়ে ঘোর বিবাদ আছে। কেউ বলেন–সম্প্রদান-মন্ত্রেই বিবাহ সম্পন্ন হয়, কেউ বলেন, পাণি গ্রহণ হলে তবেই বিবাহ সম্পন্ন হবে, আবার কেউ বা সপ্তপদী-গমনের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এখানে সেই তর্ক তোলার প্রয়োজন নেই। এবং তর্ক বাদ দিয়েও এটা বোঝা যাচ্ছে–পুলোমা সেকালের দিনের এক অতীব প্রার্থনীয়া রমণী। একদিকে এক রাক্ষস তাঁকে মনে মনে বরণ করেছেন, আর এক দিকে এক ঋষি-চূড়ামণি এই রমণীকে লাভ করার জন্য কন্যার পিতাকে বর দিতে চেয়েছেন। পুলোমার পিতা কী বর পেয়েছিলেন মহাভারতের কবি তা স্পষ্ট করে বলেননি, কিন্তু রাক্ষস পুলোমা অগ্নির কথায় তার আপন বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া মাত্রই ভৃগুপত্নীকে তুলে নিয়ে গেলেন আশ্রম থেকে। অপহরণ, পরের স্ত্রীকে নিজের ভেবেই অপহরণ করলেন।
ভৃগুপত্নী পুলোমা গর্ভবতী ছিলেন। রাক্ষসের দ্রুততা এবং নিজের ভয়–এই দুয়ে মিলে পথের মধ্যেই তার গর্ভচ্যুত হল। গর্ভচ্যুত হয়ে জন্মাবার ফলেই তার পুত্রের নাম হল চ্যবন। রাক্ষস পুলোমা চ্যবনের অদ্ভুত তেজে ভস্মীভূত হলেন–এই অলৌকিক কথা আপনারা বিশ্বাস করুন বা না করুন–সেটা মহাভারত-কথার বড় কোনও অঙ্গ নয়। এমনকি ভৃগুপত্নী সপুত্রক বাড়ি ফিরে এলে ভৃগুমুনি সব শুনে অগ্নিকে ‘সর্বভুক’ হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন সেটাও খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হল–উগ্রশ্রবা সৌতি এর পর চ্যবন মুনির নাতি রুরুর যে কাহিনী বলবেন–তার মধ্যেও সেই সাপে কাটার ঘটনা আছে। রুরু এবং প্রমদ্বরার প্রেমকাহিনী নিয়ে সুবোধ ঘোষ মশাই ভারত-প্রেমকথায় অমর চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে সর্পদংশনের ব্যাপারটা ঐতিহাসিক কোনও গুরুত্ব লাভ করেনি। কিন্তু তারও একটা গুরুত্ব আছে। সে কথায় পরে আসছি।
মহাভারতে দেখা যাবে–রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনীর শেষে নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনক এবার সোজাসুজি রাজা জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের কাহিনী শুনতে চাইলেন। কিন্তু তার আগে ভৃগুবংশের কাহিনী শুনতে চেয়ে শৌনক যে শুধু সৌতি উগ্রশ্রবার বাচন-ক্ষমতা যাচাই করে নিলেন–তাই শুধু নয়, এর পিছনে অন্যতর এক উদ্দেশ্যও ছিল। জনমেজয়ের পিতা পরীক্ষিতের সর্পদংশনে মৃত্যু হয়েছে–এই কথার প্রসঙ্গেই তিনি ভৃগুবংশের কথা শুনতে চেয়েছেন এবং তার কারণ ভৃগুবংশের অধস্তনদের মধ্যেও এই সর্পদংশনের ঝামেলা গেছে। সর্পদ্রষ্টা প্রিয়া পত্নীকে নিজের অর্ধেক আয়ু দিয়ে ফিরে পাবার পরেও রুরুর ক্রোধ শান্ত হয়নি। তিনি যেখানেই সাপ দেখতেন, মেরে ফেলতেন। তার এই সর্পহত্যার আক্রোশ অবশেষে এক মুনির প্রযত্নে শান্ত হয়। জনমেজয়ের আক্রোশও শান্ত হয় আস্তীক-মুনির প্রযত্নে। ঘটনার এই সমতার জন্যই শৌনক ভৃগুবংশের পুরাতন আক্রোশ এবং দুঃখকে জনমেজয় রাজার সঙ্গে একাত্মতায় স্মরণ করেছেন।
কুলপতি শৌনক এই অনুরূপ ঘটনা পুনরায় স্মরণ করতে চেয়েছেন, তার কারণ, তিনি নিজে ভৃগুবংশের জাতক এবং অনেক পুরাণ-মতেই তিনি স্বয়ং রুরুর পৌত্র। রুরুর ছেলের নাম শুনক। তার ছেলে শৌনক। পণ্ডিতেরা মহাভারত-কথার মৌলাংশের পূর্বেই ভৃগুবংশের এই বিরাট আখ্যান-আখ্যাপনের মধ্যেই ভার্গবদের প্রক্ষেপের অভিসন্ধি খুঁজে পেয়েছেন এবং হয়তো কোনও কোনও জায়গায়, তাদের গবেষণা মিথ্যা নয়। শুধু ভারত-কথা কেন, ভারতের অন্য যে মহাকাব্য, সেই রামায়ণ-রচনার পেছনেও ভাগবদের অবদান আছে।
যাঁরা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়েছেন, তাঁরা সেই বিখ্যাত গল্পটির প্রথম পয়ারটা খেয়াল করবেন–
চ্যবন মুনির পুত্র নাম রত্নাকর।
দস্যুবৃত্তি করে সেই বনের ভিতর।
একটু আগেই আপনারা শুনেছেন চ্যবন মুনি ভৃগুর পুত্র। তার পুত্র রত্নার বাল্মীকি—পুত্র না হলেও শিষ্য তো বটে। কৃত্তিবাস বাল্মীকির দস্যুস্বভাব এবং অনার্য প্রকৃতির খোঁজ পেয়েছেন স্কন্দপুরাণের বর্ণনা থেকে। কিন্তু অন্য কোনও প্রাদেশিক রামায়ণ যেখানে বাখীকিকে চ্যবন-মুনির পুত্র বলেনি, সেখানে কৃত্তিবাসের এই বক্তব্য বড় একটা পয়েন্টার। আরও আশ্চর্য সেই প্রথম/দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের কবি অশঘোষ তার বুদ্ধচরিত নাটকে লিখেছেন যে, চ্যবন-মুনিই নাকি রামায়ণ রচনার একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, কিন্তু ওই কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। ফলে বাল্মীকির হাতেই প্রথম জন্ম নিল রামায়ণের কাব্য-কথা– বাল্মীকিরাদৌ চ সসৰ্জ পদ্যং/জগ্রন্থ যন্ন চ্যবনো মহর্ষিঃ।
এত কথা বললাম এই কারণে যে, মহাকাব্য সংকলন বা রচনার ব্যাপারে ভার্গব-বংশীয়দের বিলক্ষণ হাত ছিল, তাতে বড় সন্দেহ নেই, কিন্তু যেখানে সেখানে প্রক্ষেপের ধুয়া তুলে তাদের কালের মৃদু-মন্দ স্বাদ-গন্ধটুকু বাদ দেওয়ায় আমাদের ভীষণ আপত্তি আছে। আমরা মহাভারতকে পূর্ণ প্রাণে পেতে চাই, বিশেষত সেই পূর্ণতা যখন ব্যাখ্যাযোগ্যও বটে।
.
০৬.
সেকালের ব্রাহ্মণ-বংশগুলি এবং ক্ষত্রিয় বংশগুলির মোটামুটি বোঝাপড়াটা একরকম ছিল। হস্তিনাপুরে পাণ্ডবদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেলে পরীক্ষিত যেমন নাগবংশীয়দের অত্যাচার এড়াতে পারেননি, তেমনই ব্রাহ্মণ উতঙ্কও নাগদের অসভ্যতায় ক্ষুব্ধ। ভৃগুবংশীয়দের কাহিনী, বিশেষত রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনী শুনতে চেয়ে মহর্ষি শৌনক শুধু আগুনে ঘি দিলেন। অর্থাৎ ভাবটা এই–এদের বড় বাড় বেড়েছে, উগ্রশ্রবা। আমাদের পূর্ববংশীয়রাও এদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাননি। শৌনকের এই ভাবটা যদি বা থেকেও থাকে, কিন্তু নিরপেক্ষ কথক-ঠাকুর সে কথায় তত আমল দেননি। জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের আগে যত কাহিনী এসেছে, সবই নাগ-বংশীয়দেরই কাহিনী। ক, বিনতা, জরৎকারু, আস্তীক-মুনি–সকলেই নাগবংশের সঙ্গেই জড়িত। সত্যিই তো মহাভারতের মূল পর্বে যাবার আগে নাগবংশীয়দের এত কথা শুনব কেন? স্বাভাবিকভাবেই প্রবৃত্তি হয় বলতে–এগুলি সব প্রক্ষেপ। পণ্ডিতেরা অবশ্য তাইই বলেছেন। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয় এই কাহিনীগুলির একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্বও আছে।
রাজনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্বটা এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয় নিম্নবর্গীয় একটি জাতি-গোষ্ঠী কিভাবে চরম শত্রুতা থেকে আর্যগোষ্ঠীর বন্ধুতে পরিণত হল এবং আর্যগোষ্ঠীর দিক থেকেও নবাগত এবং বশ্যতাপ্রাপ্ত বন্ধুকে কিভাবে উপাস্যতা দান করা হল–মহাভারতের মূল পর্বের প্রথমে সেই সামাজিক ইতিহাসটুকুই ধরা আছে।
তবে এই সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস ধরবার জন্য আমরা মহাভারতের উপাখ্যান অংশকে আগেই ব্যাহত করব না। বরং উপাখ্যানের হাত ধরেই আমরা ইতিহাসে গিয়ে পৌঁছব। কথা হল, হস্তিনাপুরের বর্তমান রাজা জনমেজয় পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্পষজ্ঞ করেছিলেন। কাজেই সর্পযজ্ঞের আগে আসে পরীক্ষিতের মৃত্যুর কথা।
পরীক্ষিত হলেন ক্ষীণ পাণ্ডব-বংশের প্রথম এবং শেষ অঙ্কুর। পুরাণের ভাষায় সন্তানবীজং কুরু-পাণ্ডবানা। যুধিষ্ঠির মহারাজ মৃত অভিমন্যুর এই পুত্রটিকে সিংহাসনে বসিয়ে মহাপ্রস্থানে চলে গেলেন ভাইদের নিয়ে। ভালই রাজত্ব করছিলেন পরীক্ষিত। প্রজারা খুশি, ব্রাহ্মণরা নির্বিঘ্নে যাগ-যজ্ঞ করছেন, রাজকোষ পূর্ণ, সমস্ত দেশ আনত-সামন্ত। কিন্তু তবু তার রাজত্বের দিনগুলোকে খুব মধুর বলা যাবে না। পৌরাণিরো খবর দিয়েছেন পরীক্ষিতের আমলে দ্বাপরযুগ শেষ হয়ে কলি-যুগ প্রবেশ করেছে। কলি’ বলতে আপনারা যদি শুধু যুগের পরিমাণ ধরেন তাতে আমার আপত্তি আছে। কলি শব্দের এক অর্থ হল বিবাদ। অর্থাৎ পরীক্ষিতের আমলেই ঝগড়া-ঝাটি, বিবাদের আমদানি হয়ে গেল ভাল রকম। ঘটনাটা ধর্মের ভাষাতেও সুন্দর বলা যায়।
আমাদের শাস্ত্রে যুগের পরিমাণ ব্যাপারটা এমনই বিশাল এক জিনিস যে, এখনকার ক্রিশ্চান ক্যালেন্ডারের নিয়মে সাল-তারিখ মেপে কখনওই বলা যাবে না যে–অমুক দিন কলিযুগ আরম্ভ হল। আসলে ঝগড়া-বিবাদ অথবা কলিযুগ পরীক্ষিতের রাজত্বের অনেক আগেই আরম্ভ হয়ে গেছে। দ্বারকায় কৃষ্ণের জ্ঞাতি-গুষ্টিরা যখন আকণ্ঠ মদ গিলে নিজেরাই মারামারি করে মরলেন, তখনই যুধিষ্ঠির-অর্জুনের মতো লোকেরা বুঝে গেলেন–ধরাধামে সুস্থভাবে আর বাঁচা যাবে না। পুরাণ বলেছে–যুধিষ্ঠির দেখলেন–শুধু দ্বারকায় নয়, ঘরে বাইরে, নগরে রাষ্ট্রে–সর্বত্র বাদ-বিসংবাদ, লোভ, হিংসা, কুটিলতা একেবারে ছেয়ে গেছে পুরে চ রাষ্ট্রে চ গৃহে তথাত্মনি/বিভাব্য লোভানত-জিহ্ম-হিংসনা। তিনি বুঝলেন–ঢুকে পড়েছে কলি, আর নয়–অভদ্ৰহেতুঃ কলিরবৰ্তত। তিনি ভাইদের নিয়ে মহাপ্রস্থানে চলে গেলেন। সিংহাসনে বসলেন পরীক্ষিত।
সমস্ত পুরাণ, এমনকি মহাভারতের থেকেও ভাগবত পুরাণ ব্যাপারটা ধরেছে খুব ভাল। এখানে দেখা যাচ্ছে–পরীক্ষিত রাজা হয়েই খেয়াল করলেন যে, তার রাজমণ্ডলের সর্বত্র কলি ঢুকে পড়েছে–যদা পরীক্ষিত কুরু-জাঙ্গলে বসন/কলিং প্রবিষ্টং নিজচক্রবর্তিতে। দেখুন, কলি একটা মানুষ নয় মোটেই, যে রাজ্যে ঢুকে পড়ল। কলি মানে সেই লোভ, হিংসা, মিথ্যা আর কুটিলতা। পুরাণকার সব অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিরূপে কলিকে একটা মানুষের চেহারা দিয়েছেন। পরীক্ষিত যেই খবর পেলেন–কলি ঢুকে পড়েছে, অমনই তিনি ধনুক-বাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন–কলিকে মারবার জন্য। পরীক্ষিতের দিগ-বিজয় শুরু হল।
তারপর ভদ্ৰাস্ব, কেতুমাল, উত্তর-কুরু-সব ঘুরে এসে পরীক্ষিত একটা আশ্চর্য ঘটনা লক্ষ্য করলেন। পরীক্ষিত দেখলেন–একটি ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে। তার তিনটে পা-ই ভাঙা আর তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটি গরু–এমন করুণ তার অবস্থা যেন সদ্য তার বাছুরটি মারা গেছে–বিবৎসামিব মাতরম্। ষণ্ড-বৃষ এবং গাভী দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
ভারতের ভাবনা-রাজ্যে রূপকের একটা বিশাল জায়গা আছে। আধুনিকেরা যারা চলচ্চিত্রে, কবিতায়, স্থাপত্যে অথবা ছবিতে ‘সিমবলিজম’ নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করেন, আর অনেকটাই না বুঝে বিস্ময়মুকুলিত নেত্রে বক্তৃতা দেন, তাদের আগে নিজের দেশের সিমবলিজম’গুলো বুঝতে অনুরোধ করি, তারপর পিকাসোরদা, কামু-কাফকা নিয়ে যা বলবেন, শুনব। এই যে ষণ্ড-বৃষটিকে এইমাত্র দেখলেন পরীক্ষিত, ইনি আসলে ধর্ম। দেবদেব মহাদেবকে যে আপনারা বৃষ-বাহন দেখেন, তিনি আসলে ধর্মবাহন, জ্ঞান-বাহন। সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর-কলি, এই চার যুগ ষাঁড়ের চার পা। সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর-সত্যযুগে ধর্মের রমরমা অতএব ষাঁড়ের চার-পা’ও ঠিক-ঠাক। ত্রেতাতে ষাঁড়ের এক পা ভেঙে গেছে, সে তিনপায়ে দাঁড়িয়ে। দ্বাপরে অন্যায়-অধর্ম বেড়ে গেল। দুই পায়ে দাঁড়িয়ে রইল ষাঁড়। আর কলিতে তার তিন পাই ভেঙে গেছে, এক পায়ে নড়বড়ে হয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে বলি ধর্মের ষাঁড়।
আর ওই যে গাভীটিকে দেখলেন পরীক্ষিত, উনি হলেন পৃথিবী। গাভীকে আমরা দোহন করে দুগ্ধ বার করি, তেমনই পৃথিবীকেও আমরা দোহন করে শস্য বার করি, খনিজ-পদার্থ বার করি। সেইজন্য গাভী পৃথিবীর প্রতিরূপ। পরীক্ষিত দেখলেন বৃষরূপী ধর্ম আর গাভীরূপিণী পৃথিবীর মধ্যে নানা সুখ-দুঃখের কথা হচ্ছে। কৃষ্ণ যখন বেঁচেছিলেন, পাণ্ডবরা যখন রাজ্য শাসন করছিলেন, তখন কত সুসময় ছিল আর এখন কলি এসে কী দুরবস্থা করেছে–এই সব তারতম্যের আলোচনা চলছে। পরীক্ষিত দেখলেন; কিন্তু ওই গোমিথুনকে তিনি ধর্ম আর পৃথিবী বলে তখনও বোঝেননি।
তৃতীয় আরও একটি সত্তার উপস্থিতিও পরীক্ষিতের নজর এড়াল না। পরীক্ষিত দেখলেন– একটি লোকলোকটির আচার-আচরণ বর্বরের মতো–সে একবার নিস্তেজ ষণ্ডটিকে লাথি মারছে, আরেকবার গাভীটিকে লাথি মারছে। তার হাতে একটা লাঠি এবং সেই লাঠি দিয়ে দুটি প্রাণীকে সে মেরে ফেলার ভয়ও দেখাচ্ছে। ধর্মরূপী বৃষটি নিরুপায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে এবং লোকটির বিভীষিকায় সে প্রস্রাব করে ফেলেছে–মেহন্তমিব বিভ্যত। লোকটার ভাব-সাব রাজার মতো, আচরণ নির্ভীক, এবং তাকে দেখতে যেমনই হোক, সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল, তার জামা-কাপড় আসল সোনার জরি দিয়ে মোড়ানো। পরীক্ষিত এই কম্পমান গোমিথুন এবং এই জঘন্য লোকটিকে দেখে তাদের সামনে রথ থামালেন। লোকটিকে বললেন, কে হে তুমি, আমার রাজত্বে বাস করে দুর্বল পশু দুটির ওপর জোর খাটাচ্ছ? দেখতে তো বেশ রাজার মতো, গায়ে এমন সোনার পিরান, অথচ কাজটা যে করছ–সেটা রাজোচিতও নয় ব্রাহ্মণোচিতও নয়– নরদেববাসি বেশেন নটবং কর্মণাদ্বিজঃ।
পরীক্ষিত বেশ রেগেই গেলেন। বললেন, কী ভেবেছ তুমি? আজকে কৃষ্ণ ধরাধামে নেই বলে, গাণ্ডীবধ অর্জুন নেই বলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে? নিরপরাধ প্রাণীকে তুমি এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে পীড়ন করবে? আজ তোমার নিস্তার নেই, তোমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনো। পরীক্ষিত এবার ধর্মরূপী বৃষ এবং গোরূপা পৃথিবীকেও চিনে ফেললেন এবং তাদের অবস্থা দেখে কলিকেও চিনতে তার দেরি হল না। সঙ্গে সঙ্গে শাণিত খঙ্গ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কলিকে মারার জন্য-নিশাতমাদদে বঙ্গং কলয়ে’ধর্মহেতবে। কলি দেখল- মহা-বিপদ। প্রাণে মারা যাবার চেয়ে রাজার পায়ে পড়া ভাল। কলি রাজার পা জড়িয়ে ধরল।
পরীক্ষিত বললেন, ঠিক আছে, তুমি প্রাণে বাঁচলে বটে, কিন্তু আমার রাজ্যে তোমার জায়গা হবে না এক রত্তি।–ন বর্তিতব্যং ভবতা কথঞ্চন/ক্ষেত্রে মদীয়ে ত্বমধর্মবন্ধু। পরীক্ষিত পায়ে-পড়া কলিকে তার অকরুণার কারণ দেখিয়ে বললেন, তোমার মতো অধর্মের বন্ধু যদি আমার রাজ্যে থাকে, তাহলে আমাদের প্রজাদের মধ্যে হিংসা, লোভ, দম্ভ-অহঙ্কার, খুন, রাহাজানি, চুরি-বদমাশি–সবই অত্যন্ত বেড়ে যাবে।
এই যে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন পরীক্ষিত, এইগুলোই কলির স্বরূপ। কবিরা দম্ভ-অহংকার আর নানা অসদ গুণের রূপ কল্পনা করে তার নাম দিয়েছেন কলি। পরীক্ষিত বললেন, তোমার সাহস তো কম নয় বাপু। এই ব্রহ্মাবর্ত কত পবিত্র স্থান! সরস্বতী আর দৃষদ্বতী নদীর মাঝখানের এই জায়গাটুকুতে ব্রাহ্মণ সমাজের কত পবিত্রতার স্মৃতি। ব্রাহ্মণরা এখানে কত মন্ত্রে যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুকে আবাহন করেন-যজ্ঞেশ্বরং যজ্ঞ-বিতানবিজ্ঞাঃ। আর তুমি কিনা সেইখানে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণদের সমস্ত আন্তর ধর্মের প্রতীক একটি গোমিথুনকে মারতে চাইছ? বেরও, বেরিয়ে যাও তুমি আমার রাজ্য থেকে।
পরীক্ষিত রাজার ক্রোধাবেশ দেখে কলি ভয়ে কাঁপতে থাকল বটে, তবে হাল ছাড়ল না। বলল, আপনি আমাদের সার্বভৌম রাজা বটে। আমাকে তাড়িয়ে দিলে তো হবে না, থাকার জন্য আমাকেও একটা জায়গা দিতে হবে। তা আপনিই বলে দিন–কোথায় আমি থাকব স্থানং নির্দেন্ধুমহসি। পরীক্ষিত বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তবে কোনও ভাল জায়গায় তুমি থাকতে পাবে না। তোমার আবাস হোক-তাস-পাশার জুয়োচুরিতে, অঁড়িখানায়, স্ত্রীলোকের সুখসঙ্গে, আর থাক প্ৰাণীহত্যা, খুন, রাহাজানির মতো কুকর্মের মধ্যে। এই চার জায়গায় যত অধর্ম। তুমি থাকো এই অধর্মের মধ্যে, কিন্তু খবরদার! এই সব সৎ-সাধনের জায়গায় তোমায় যেন না দেখি।
কলি বলল, এই চার জায়গায় মাত্র স্থান দিলেন, মহারাজ? আর একটু কৃপা হবে না? রাজা বললেন, যাও, যাও সোনা-চাদির জায়গাটাও না হয় তোমায় ছেড়ে দিলাম–পুনশ্চ যামানায় জাতরূপমদাৎ প্রভু। কলিকে পরীক্ষিত যেভাবে স্বীকৃতি দিলেন–তার ফলটা কী দাঁড়াল? জুয়েচুরির মধ্যে যে মিথ্যার বেসাতি আছে, পানশালায় যে হাম-বড়া ভাব আসে মনে, স্ত্রী-সঙ্গের মধ্যে যে কামনার প্রশ্রয় আছে, অকারণ প্রাণীহত্যার মধ্যে যে ক্রুরতা আছে, আর টাকা-পয়সা নিয়ে যে শক্রতা তৈরি হয়-এইসব জায়গাতে কলির স্থান একেবারে পাকা হয়ে গেল।
পুরাণ থেকে এই উপাখ্যানটুকু যে স্মরণ করতে হল, তার কারণ আছে। পরীক্ষিত মহারাজের আমলে কলি ঢুকে পড়ল–এই ধৰ্মীয় তথ্যের মধ্যে প্রধান ইঙ্গিত হল–তার আমলে আর সেই সুখ-শান্তি, সেই সত্য এবং ধর্মবোধ আর রইল না, যা তার পিতা পিতামহের আমলে ছিল। নীতি এবং ধর্মবোধ যে কতটা চলে গেছে পরীক্ষিত মহারাজের আপন উদাহরণই তার জন্য যথেষ্ট। সরস্বতীর তীরে দণ্ডপাণি কলির পদাঘাতে ক্লিষ্ট গোমিথুনকে দেখে কলির ওপরে তার যতই রাগ হোক, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অধস্তন পুরুষ হয়ে তিনি নিজে যে কাণ্ড করে বসলেন, তাতে বোঝা যায়-অন্যায় এবং অভব্যতা কী চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। আসলে তার রাজত্বকালে কলি-প্রবেশের প্রধান তাৎপর্যই হল–লোভ, হিংসা, দ্বেষ, অসত্য এবং দম্ভ সর্বত্র এমনভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল যে, পরীক্ষিতের পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব হয়নি। বরং অন্যায়ের প্রতিরূপ কলি তার কাছে যা প্রার্থনা করেছে, তিনি তা মঞ্জুর করেছেন। যেখানেই হোক, যে পর্যায়েই হোক অন্যায়-অনীতি এবং অভব্যতাকে পরীক্ষিত মহারাজ প্রায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন–কলিকে তিনি স্যাংশন’ দিয়েছেন।
এই যে স্বীকৃতি, কলির প্রতি পরীক্ষিতের এই যে বিবশ আচরণ–এর কারণ দু’ধরনের সমাজিক পরিস্থিতি থেকে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এক, তিনি সব জেনে বুঝে অন্যায্য কলিকে মেনে নিয়েছেন এবং তার নিজের মানসিকতাও খানিকটা ওইরকমই ছিল। দুই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যেহেতু কোনও অসামান্য ব্যক্তিত্বই আর জীবিত ছিলেন না এবং পরীক্ষিত–যাঁকে মহাভারতের কবিই ক্ষীয়মাণ কুরুবংশের শেষ অঙ্কুর বলে চিহ্নিত করেছেন –সেই পরীক্ষিতের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তার রাজত্বে অন্যায়-অসভ্যতা, হিংসা-দ্বেষ এমন চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে, পরীক্ষিতের পক্ষে কলিকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় ছিল না।
আমরা দ্বিতীয় কল্পটাকেই মেনে নিতে চাই, কারণ পরীক্ষিত তার স্বীকৃতিতে কলির আবাস নির্দিষ্ট কতগুলি স্থানে বেঁধে দিতে চাইছেন। তাঁর রাজত্বে কলি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, অতএব তাকে সর্বত্র ছড়াতে না দিয়ে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পৌরাণিকেরা যে শক্তিমত্তার আভাসটুকু দেখেছেন, সেটা যে তেমন কোনও সত্য নয়–সেটাও পৌরাণিকেরা জানেন এবং জানেন বলেই পরীক্ষিতের পরবর্তী ব্যবহার তারা উল্লেখ করতে ভোলেননি। অর্থাৎ পরীক্ষিত অন্যায়-অসত্যকে যতই নিয়ন্ত্রিত করুন, সেগুলি তার সময়ে সহজ হয়ে উঠেছিল, এবং সহজ বলেই দেশের রাজা হওয়া সত্ত্বেও, জনগণের ভাগ্য-নিয়ন্তা হওয়া সত্ত্বেও অন্যায় আচরণ করতে তারও বাধেনি। ঘটনাটা পরিষ্কার করে জানাই।
মহারাজ পরীক্ষিতের মধ্যে তার প্রপিতামহ পাণ্ডুর কিছু গুণ ছিল। মহারাজ পাণু শিকার করতে বড় ভালবাসতেন। এটাকে যদি আজকের ভাষায় হবি’ বলা যায়, তবে সেকালের ভাষায় এই হবির নাম হল মৃগয়া। মৃগয়াতে অকারণে পশুবধ করা হয় বলে পুরাতনেরা ব্যাপারটা বড় পছন্দ করতেন না। আরও পছন্দ করতেন না–মৃগয়া যখন হবি’র পর্যায়ে চলে যেত। পুরাতনেরা বলতেন, মৃগয়া হল এক ধরনের ব্যসন, কামজ ব্যসন, যা রাজাদের চারিত্রিক দোষ তৈরি করে। রাজারা পশুবধ করতে করতে প্রমত্ত হয়ে ওঠেন, তাদের আর সময়-অসময়, কাণ্ডাকাণ্ড-জ্ঞান থাকে না। পুরাতনেরা এই প্রমত্ততার জন্যই মৃগয়াকে কামজ-ব্যসনের মধ্যে গণ্য করেছেন এবং তারা রাজাদের সব সময় সাবধান করেছেন যেন এই প্রমত্ততা তাদের গ্রাস না করে।
পুরাতনেরা যাই ভাবুন, রাজারা রাজার মতোই চলেন। প্রপিতামহের দৃষ্টান্তে পরীক্ষিত মহারাজেরও মৃগয়ায় যাওয়াটা বেশ অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। তিনি মৃগয়ায় বেরিয়ে বন্য শূকর, মহিষ, বাঘ মারতে মারতে চলেছেন। এমন সময় একটি সুন্দর হরিণ পরীক্ষিতের চোখে পড়ল। রাজা বাণ ছুড়লেন ঠিকই, কিন্তু বাণটি ভাল করে তার গায়ে বিদ্ধ হল না। বাণের আগায় বক্র ফলক ছিল, ফলে বাণটি হরিণের শরীরে লেগে ঝুলে রইল এবং বাণবিদ্ধ অবস্থাতেই হরিণ দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করল। পরীক্ষিত হরিণের পিছনে ধাওয়া করলেন। গভীর বনের মধ্যে ধাবমান হরিণ এক সময় রাজার দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। পরীক্ষিত তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বনরাজির প্রান্তে এক মুক্ত তৃণভূমির মধ্যে এসে পৌঁছলেন।
এটি একটি গো-চারণ ক্ষেত্র। অনেক গরু একসঙ্গে ঘাস খাচ্ছে, গোবৎসেরা রোমস্থায়মান গাভীর দুগ্ধ পান করে মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলেছে। বড় শান্ত, বড় অলস পরিবেশ। রাজা দেখলেন-এই মুক্ত তৃণভূমির বিজন প্রান্তে এক মুনি পদ্মাসনে বসে আছেন–ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি। ভাবগত পুরাণ পরীক্ষিতকে যথাসম্ভব বাঁচানোর জন্য তাকে অতিশয় ক্লান্ত এবং পিপাসার্ত বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষিত যত না ক্লান্ত ছিলেন, কারণ মহাভারতেও তার ক্লান্তি এবং পিপাসার কথা বলা আছে, কিন্তু সেই পিপাসার চেয়েও পরীক্ষিত বেশি ছিলেন মৃগয়া-ব্যসনী। ভাগবতে পরীক্ষিত মুনির কাছে বার বার পিপাসার জল চেয়ে সদুত্তর পাননি। কিন্তু মহাভারতে পরীক্ষিত-মহারাজ ধ্যানরত মুনিকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি অভিমন্যর পুত্র পরীক্ষিত। আমি একটি হরিণকে বাণ-বিদ্ধ করেছি। কিন্তু হরিণটা কোনওরকমে পালিয়েছে। আপনি কি হরিণটাকে দেখেছেন–ময়া বিদ্ধো মৃগো নষ্টঃ কচ্চিত্তং দৃষ্টবানসি?
পরীক্ষিতের ভাব-ভঙ্গি ভাল ছিল না। তপস্যারত একটি মুনিকে দেখা মাত্রই ধনুক-বাণ নামিয়ে রেখে জুতো খুলে অতি বিনীতবেশে তার সামনে উপস্থিত হওয়ার কথা বিনীতবেশেন প্রবেষ্টব্যানি তপোবনানি নাম–তার পূর্বজরাও চিরকাল তাই করেছেন। কিন্তু রাজা ধনুবাণ তো ত্যাগ করেনইনি, বরং সেগুলি উদ্যত ছিল–লক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া মাত্রই যাতে লক্ষ্য ভেদ করা যায়। এইভাবে ধনুক উঁচিয়ে একজন অহিংস ব্যক্তির সামনে প্রায় সহিংস আচরণ এবং পুনরায় তার প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার মধ্যেও এমন কোনও ভণিতা ছিল না–যা তখনকার দিনের প্রচলিত শিষ্টাচারের সঙ্গে মেলে–অপৃচ্ছদ্ধনুরুদ্যম্য তং মুনিং ক্ষুণ্ডুমান্বিতঃ।
ধ্যানরত মুনির সঙ্গে দেখা হলে তার সঙ্গে কথা বলার শিষ্টাচার ছিল এইরকম–আপনার তপস্যার কুশল তো–অপি তপো বর্ধতে! অথবা তাকে যদি বিরক্ত করছি বলে মনে হয় তাহলে ভাষাটা হওয়া উচিত–আপনার তপস্যার বিঘ্ন সৃষ্টি করছি না তো? মুনিবর প্রণাম। কিন্তু পরীক্ষিতকে দেখতে পাচ্ছি–তিনি মুনি দেখামাত্রই প্রশ্ন করলেন, এই যে ঠাকুর! আমি অভিমন্যর ছেলে রাজা পরীক্ষিত…. আমার বাণ-বিদ্ধ মৃগটিকে দেখেছেন– ভো ভো ব্ৰহ্মণ অহং রাজা পরীক্ষিদভিমন্যজঃ। শান্ত আশ্রমপদে-এই যে ঠাকুর! অহং রাজা–এই ভাবটুকু কোনও বিনীত শিষ্টাচারের পরিচয় দেয় না–যা অডিম, অর্জুন বা তার প্রপিতামহ পাণ্ডুরও পরিচয় বহন করে।
মুনি মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। পরীক্ষিতের কথার কোনও উত্তর তিনি দিলেন না। হয়তো উত্তর দিতে ভালও লাগেনি। হয়তো মৌনতাও সেইজন্যই। রাজা পরীক্ষিত অপেক্ষা করেননি, সামান্য শিষ্টাচারে প্রণাম পর্যন্ত করলেন না। উপরন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে কাছে পড়ে থাকা একটা মরা সাপ তার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। তাও হাত দিয়ে নয়, ধনুকের প্রান্তভাগ দিয়ে সাপটি মুনির গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে তিনি তাচ্ছিল্যভরে চলে গেলেন-সমুৎক্ষিপ্য ধনুষ্কোটা স চৈনং সমুপৈক্ষত। পরিষ্কার বোঝা যায়–মরা যে সাপটি তিনি নিজের হাতে তুলতে ঘৃণাবোধ করেছেন, সেই সাপটি মুনির গলায় ঝুলিয়ে দিতে তার কোনও দ্বিধা হল না। ঘটনাটা ঘটানোর পর পরীক্ষিতের ক্রোধ শান্ত হল বটে, গলায় সাপ ঝুলানো মুনিকে দেখে তার একটু খারাপও লাগল বটে, কিন্তু সাপটি গলা থেকে নামিয়ে দেওয়ারও কোনও প্রয়াস তিনি নিলেন না। তিনি চলে গেলেন নিজের নগরে। বিস্তীর্ণ আরণ্যক পরিবেশে উন্মুক্ত গোচারণ-ভূমিতে মৃত সাপ গলায় নিয়ে মুনি বসে রইলেন তেমনই–নিরপেক্ষ, উদাসীন।
এবারে সেই প্রশ্নটা আবার তুলি। পরীক্ষিতের রাজত্বকালে কলি-প্রবেশের তাৎপর্য এইখানেই। দেশের রাজা নিজেই যেখানে সদাচার-বিরোধী ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি অসদাচার প্রতিরোধ করবেন কী করে? মহাভারতের কবি ওজর দিয়ে বলেছেন–পরীক্ষিত মুনিকে ততখানি ধার্মিক বলে বুঝতে পারেননিন হি তং রাজশাদূর্লস্তথা ধর্ম পরায়ণ–অতএব সেইজন্যই তিনি এই অশালীন আচরণ করে ফেলেছেন। আমরা বলি–তপস্বী যদি ভণ্ডও হতেন, তবু দেশের রাজা, যিনি প্রখ্যাত যাদব-বৃষ্ণিকুল এবং কৌরব-কুলের পবিত্র শোণিত বহন করছেন আপন শরীরে, তার এই ব্যবহার কি শোভা পায়?
এই ক্রুর আচরণের প্রত্যুত্তরে মুনি কিন্তু কোনও শাপ দিলেন না। মহারাজ পরীক্ষিত রাজশ্রেষ্ঠ পাণ্ডব-বংশের ধুরন্ধর পুরুষ। হরিণ হারিয়ে কিছু ক্রোধাবেশ হয়ে থাকবে তার অথবা লক্ষ্যবস্তুতে যে কোনও রাজার এই আবেশই থাকা দরকার–এইরকম ভেবে রাজার দোষটুকুও গুণপক্ষে আরোপ করে মুনি তাঁকে মনে মনে মুক্তি দিলেন। যেমন তিনি বসে ছিলেন, তেমনই বসে রইলেন-ঋষিস্তু অসীৎ তথৈব সঃ। রাজার ক্রোধ অথবা মৃত সর্পের ঘৃণা শরীরে বহন করেও মুনির মনের প্রশান্তি নষ্ট হবে কেন–হয়তো এইরকম কোনও আধ্যাত্মিক তর্কেই মুনি যেমন ছিলেন, তেমনই বসে রইলেন। রাজা তখন হস্তিনানগরে।
.
০৭.
যে মুনির গলায় মহারাজ পরীক্ষিত মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে এলেন, এখনও আমরা তার নাম জানি না। মুনির নাম শমীক। শান্ত সমাহিত চিত্ত। পরীক্ষিত তাকে যে এত বড় অপমান করে গেলেন–তা তিনি মনেও রাখলেন না। কিন্তু শমীক মুনির একটি অল্পবয়স্ক পুত্র ছিল। তার নাম শৃঙ্গী। যেমন তিনি তেজস্বী তেমনই তার তপোবল। এই অল্প বয়স্ক মুনি বালক আপন সংযম এবং তপস্যার বলে ইতোমধ্যেই প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তুষ্ট করেছেন। কিন্তু তপোবল বা ইন্দ্রিয়-সংযম তার যথেষ্ট থাকলেও বালকের স্বভাবে কিছু ক্রোধ ছিল। সে ক্রোধ এতটাই যে, তিনি একবার ক্রুদ্ধ হলে তাকে প্রসন্ন করা খুব কঠিন হতশৃঙ্গী নাম মহাক্রোধ দুম্প্রসাদো মহাব্রতঃ!
শমীক মুনির গলায় মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে পরীক্ষিত যখন চলে গেছেন, শৃঙ্গী তখন সদ্য বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি ফেরার পরই তার এক বন্ধু-কৃশ তার নাম তিনিও ঋষিকুমার, তার সঙ্গে শৃঙ্গীর দেখা হল। বন্ধুর পিতা শমীককে দেখে কৃশর খারাপ লাগছিল। কাজেই শৃঙ্গীর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন, ভাই! তুমি তো জপে তপে খুব তেজস্বী হয়েছ বলে শুনি। তোমার বাবাও যথেষ্ট তপস্বী এবং তেজস্বী। কিন্তু এরপর থেকে আমরা ঋষি বালকেরা যখন কথা বলব, তখন তুমি আর তেজ বেশি দেখিও না, বেশি কথাও যেন বোলো না– মাস্ম কিঞ্চিদ বচো বদ। এত তুমি ব্ৰহ্মর্ষির পৌরুষ দেখাও, এত বড় বড় কথা তুমি বল। তা আর একটু পরেই তুমি দেখতে পাবে-তোমার মৌনী পিতা কেমন একটি শব গলায় ঝুলিয়ে বসে আছেন।
শৃঙ্গী রাগে জ্বলে উঠলেন। কী! আমার পিতা শব ধারণ করে আছেন–শৃঙ্গী জ্বলে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন করে সম্ভব হল এই ঘটনা অপৃচ্ছত্তং কথং তাতঃ সমে’দ্য মৃতধারকঃ? কৃশ বললেন, কেমন করে আবার? মহারাজ পরীক্ষিত হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে হরিণ না পেয়ে তোমার বাবাকে সেই হরিণের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। আর তিনিও মৌনী হয়ে আছেন বলে কোনও জবাব দিলেন না। ব্যস্ যা হবার তাই হল। পরীক্ষিত ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে কোথা থেকে একটি মরা সাপ তুলে নিয়ে এসে ঝুলিয়ে দিলেন তার গলায়। সেই অবধি তোমার পিতা সেই সর্প-শব ধারণ করেই বসে আছেন আর মহারাজ পরীক্ষিত এখন হস্তিনাপুরে বসে আছেন।
শৃঙ্গী মুনির চোখ দুটি রাগে লাল হয়ে উঠল, শরীর জ্বলে গেল ক্রোধে কোপ সংরক্তনয়নঃ প্রজ্বলম্নিব মনা। অসংবৃত ক্রোধে এক মুহূর্তে তিনি আচমন-শুদ্ধ অভিশাপের জল তুলে নিলেন হাতে। অভিশাপ দিলেন যে পাপিষ্ঠ আমার ব্রতক্লিষ্ট পিতার গলায় মৃত সর্প প্রদান করেছে, আজ থেকে সাতদিনের মাথায় তীক্ষ্ণবিয তক্ষক আমার কথায় কুরুকুলের গ্লানি ওই পাপিষ্ঠ রাজাকে যমালয়ে প্রেরণ করবে।
মহাভারতের অনুসরণে এই যে শেষ অনুচ্ছেদটি লিখে ফেললাম এর মধ্যে অন্তত দুটি জিনিস আছে লক্ষ্য করার মতো। এক, আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই যে আপনাদের ঋষি-মুনিরা আছেন, কী রকম লোক এরা? অ্যাঃ! কথায় কথায় এত রাগ? পান থেকে চুন খসলেই অভিশাপ? সবটাই যেন এঁদের খেয়াল খুশি!
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনই দেব না। আরও দু-একটা জব্বর জব্বর অভিশাপের ঘটনা জমে উঠুক, কারণে নয় অকারণে দু-একবার ক্রোধাবেশ হোক মুনি ঋষিদের, তখন এর উত্তর দেব। বরং কথা প্রসঙ্গে এখন দ্বিতীয় বিষয়টাই বেশি করে মাথায় রাখা ভাল। সে বিষয়টা কিন্তু পুরনো–সেই নাগরাজ তক্ষকের বিষ। শৃঙ্গী মুনি রাগের মাথায় যে অভিশাপটা দিলেন তার ভাষাটা খেয়াল করেছেন কি? শৃঙ্গী বলেছেন, আমার কথায় চালিত হয়ে নাগরাজ তক্ষক ব্রাহ্মণকুলের অপমানকারী কুরুকুলের কলঙ্ক সেই পাপিষ্ঠ রাজাকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাবে মদবাক্য-বলচোদিতঃ সপ্তরাত্রাদিতে নেতা যমস্য সদনং প্রতি।
আগেই বলেছি- নাগজাতীয়রা কেউ সাপ টাপ নন। তারা রীতিমতো মানুষ এবং এই মানুষদের সঙ্গে তৎকালীন ব্রাহ্মণ-সমাজের বনিবনাও দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। নইলে নাগরাজ তক্ষক, যিনি অবশ্যই নাগ গোষ্ঠীর এক প্রধান নেতা, তিনি ব্রাহ্মণের কথায় চালিত হবেন কেন? লক্ষণীয় বিষয় হল–আমরা এর আগে ব্রাহ্মণ উতষ্ককে দেখেছি। তিনি তক্ষকের ওপরে ভীষণ ক্রুদ্ধ। জনমেজয়কে তিনি তক্ষকের বিরুদ্ধে উত্তেজিতও করেছেন। আবার ব্রাহ্মণ-সমাজের অন্যাংশকেও এখন আমরা লক্ষ্য করছি। তারা ক্ষত্রিয় রাজার ওপরে বিরক্ত হয়ে নাগ-জন-জাতির পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছেন। স্বয়ং নাগরাজ তক্ষক তাদের শাসনে চলেন। ব্যাপারটার মধ্যে যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক চোরাবালি কিছু লুকিয়ে আছে সেটা একটু বুঝে নিতেই হবে।
শৃঙ্গী-মুনি পরীক্ষিতকে অভিশাপ দিয়ে পিতা শমীকের কাছে গেলেন। তিনি তখনও সেই অবস্থায় মরা সাপ গলায় নিয়ে বসে আছেন, যেমনটি তিনি আগে ছিলেন শৃঙ্গী রাগে কেঁদে ফেললেন। পিতার মৌনতা বিঘ্নিত হল। শৃঙ্গী সদর্পে বললেন, যে দুরাত্মা আপনার এই অবস্থা করেছে তার খবর শোনামাত্র আমি তাকে অভিশাপ দিয়েছি, বাবা।–হেমাং ধর্ষণাং তাত তব তেন দুরাত্মনা। আজ থেকে সাত দিনের মাথায় নাগরাজ তক্ষক তাকে মৃত্যুদন্ড দেবে।
শান্ত মহর্ষি শমীক পুত্রের অভিশাপ উচ্চারণে খুশি হলেন না। তিনি বললেন, কাজটা তুমি ভাল করনি, পুত্র! এতে আমার তো সুখ তো কিছু হলই না বরং তুমি তোমার তপস্বীর ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে- ন মে প্রিয়ং কৃতং তাত নৈষ ধর্মস্তপস্বিনাম। শমীক পুত্রকে বুঝিয়ে বললেন, পরীক্ষিত মহারাজ আমাদের রাজা বটে। সমস্ত সময় তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদের তিনি রক্ষা করেন। আর তুমি তার এই বিপদ ঘটালে? ভাল নি, পুত্র! ভাল কাজ করনি।
পিতা-পুত্র, দুই মুনির ভাব চরিত্র দেখলেন নিশ্চয়। দুজনে দু’রকম। একজন রাজাকে অভিশাপে ধ্বংস করতে চাইছেন, অন্যজন তাকে রক্ষা করতে চাইছেন। শমীক পুত্রকে রীতিমতো তিরস্কার করে বললেন, তুমি সত্যব্রত। তোমার অভিশাপ মিথ্যা হবে না জানি। কিন্তু পুত্র যাতে গুণবান যশস্বী হয়ে ওঠে তার জন্য বয়স্ক পুত্রকেও পিতা শাসন করেন–পিত্রা পুত্রো বয়স্থ’পি সততং বাচ্য এব তু। আমি তাই করছি। তুমি যে অভিশাপই দিয়ে থাক, আমি কিন্তু মহারাজ পরীক্ষিতের কাছে তোমার এই আকস্মিক ক্রোধের খবর জানাব। আমি জানাব, যে আপনি আমাকে অপমান করেছেন জেনে আমার বদরাগী বুদ্ধিহীন, অশিক্ষিত ছেলে আপনাকে অভিশাপ দিয়েছে।–মম পুত্রেণ শপোসি বালেনাকৃতবুদ্ধিনা।
মহর্ষি শমীক পুত্রকে সম্পূর্ণ লজ্জা দিয়ে পরীক্ষিতকে সব জানানোর জন্য তার প্রিয় শিষ্য গৌরমুখ মুনিকে পাঠালেন, পরীক্ষিতের কাছে। শমীকের উদ্দেশ্য ছিল একটাই দেশের রাজা, যিনি এতকাল ধরে ব্রাহ্মণ-সজ্জনের প্রতিপালন করে এসেছেন, সেই তিনি যেন না ভাবেন যে, ব্রাহ্মণেরা তার বিপক্ষে চলে গেছেন। অপিচ ব্রাহ্মণদের পক্ষ থেকে যে আকস্মিক অভিশাপ নেমে এসেছে তার ওপর সে অভিশাপ যেন তার অজ্ঞাত না থাকে। অন্তত অভিশাপের সম্মুখীন হবার মতো মানসিক প্রস্তুতি যেন পরীক্ষিতের থাকে। শমীক সেই আশ্বস্ততাটুকু দিতে চেয়েছেন রাজাকে। এর মধ্যে যে অপমানটুকু রাজার পক্ষ থেকে মৃত সর্পের আকার নিয়ে এসেছিল তার কার্যকারণ সূত্র শমীক তাঁর অসীম ক্ষমায় ব্যাখ্যা করে নিতে পেরেছেন, কিন্তু সে ব্যাখ্যা তার পুত্রের কাছে অবোধ্য থেকে গেছে। মনে রাখতে হবে পরীক্ষিতের রাজত্বকালে কলিপ্রবেশ ঘটে গিয়েছিল। তার শেষ পরিণতিতে পরীক্ষিত স্বয়ং এক সচ্চরিত্র সজ্জন মুনিকে অপমান করে বসেছেন, সেই কলির প্রকোপ কিন্তু অন্যত্রও বেড়ে গিয়ে থাকবে। অর্থাৎ তার শাসনের মধ্যে সেই শক্তি বা সেই বাঁধন ছিল না, যা সমগ্র ব্রাহ্মণ সমাজকে ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। শমীক নিজগুণে পরীক্ষিতের অপরাধ ক্ষমা করেছেন বটে, কিন্তু অন্যেরা তা পারছেন না। আর সেই সুযোগে অন্য জাতি-গোষ্ঠী যারা রাজার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না অথবা পরীক্ষিতের দুর্বল শাসনে যারা মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে তারা এই বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ-গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে পরীক্ষিতকে সিংহাসন থেকে চ্যুত করার জন্য।
চলে আসুন এবার তক্ষকের কথায়। নাগরাজ তক্ষক নাগকুলের অন্যতম বিধ্বংসী ব্যক্তিত্ব। বিধ্বংসী তিনি একাই নন, আরও অনেকে আছেন তার সঙ্গে মহর্ষি শৌনক আমাদের মতোই জিজ্ঞাসা নিয়ে বসেছিলেন। নাগগোষ্ঠীর নানা কাহিনী শুনে আমাদের মতোই তার প্রশ্ন জেগেছে। কথক-ঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবার কাছে তিনি অনুযোগের সুরে বলেছেন, তুমি অনেক সর্প-কাহিনী শোনালে বটে, তবে তুমি কিছুতেই সর্পদের নাম বলছ না –পন্নগানাং তু নামানি নকীয়সি সূতজ। সাধারণদের কথা নাই বা বললে, অন্তত সর্প প্রধানদের নামগুলো বল তুমি। সৌতি বলতে আরম্ভ করলেন। সর্প প্রধানদের মধ্যে প্রথম নাম ইল শেষ নাগের, দ্বিতীয় নাম বাসুকির। তারপর ঐরাবত, তক্ষক, কালিয় ধনঞ্জয়, মণিনাগ, এলাপত্র, নহুষ, কৌরব্য, হস্তিপিণ্ড, ধৃতরাষ্ট্র, কুঞ্জর, হলিক ইত্যাদি।
সৌতি যত নাম করেছেন আমি তত করলাম না। আমার স্বার্থে আমি কতগুলি সর্প-নাম বেছে নিয়েছি যাঁদের সঙ্গে কুরু-পাণ্ডব বংশের অনেক রাজ-নামের মিল আছে। পন্ডিতেরা অনুমান করেন, যে ধৃতরাষ্ট্র-ধনঞ্জয় অথবা কৌরব্য-নহুষ–এই নামগুলি নাগ-গোষ্ঠীর প্রধানদেরই নাম বটে, কিন্তু এই নামগুলি এতটাই জনপ্রিয় বা সম্মানিত ছিল যে, কুরুকুলের অনেকেই সেই নামগুলি সচেতনভাবে এবং সসম্মানে গ্রহণ করেছেন। কথাটা একটু খুলেই বলি।
অসভ্যতা হলেও আপনি যদি এখনও কোনও বীরেন বা শশধর নাগকে তাঁর জাতির কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বীরেনবাবু উত্তর দেবেন আমরা কায়স্থ; আর শশধরবাবু তার জাতির ইতিহাসটুকু আরও পূর্বে নিয়ে গিয়ে আপন পিতৃবংশের মাহাত্ম সূচনা করে বলবেন, আমরা বহু পূর্বে ক্ষত্রিয় ছিলাম, তবে এই শ্যাম বঙ্গ-দেশে আমরা কায়স্থ বলেই পরিচিত হয়েছি। বস্তুত বীরেন নাগ কি শশধর নাগ ‘শুদ্ধ-কৌলিক’ কায়স্থ, নাকি বাহাত্তুরে কায়স্থ’ –তা নিয়ে নানা বিবাদ বিসংবাদ আছে। এমনকি কায়স্থরা ক্ষত্রিয় জাতির অধস্তন কি না তা নিয়েও এক সময় বিশ্বকোষ রচয়িতা নগেন্দ্র নাথ বসু এবং বৈদ্য-কায়স্থ মোহমুদগরের লেখক উমেশচন্দ্র গুপ্তের উতোর চাপান বেশ ভাল রকম জমেছিল। আমি অবশ্য পরম সম্মানিত এই কায়স্থ জাতির মূল নিয়ে কোনও তর্কেই যাব না। কারণ আমি শুধু নাগ-বাবুদের নিয়ে চিন্তিত।
বঙ্গজ নাগরা কায়স্থ বা ক্ষত্রিয় যাই হোন না কেন, প্রাচীন ভারতের উত্তর, পশ্চিম এমনকি দক্ষিণেও নাগরা কিন্তু নিজেদের বংশ-মূল হিসেবে মহাভারতীয় বিখ্যাত নাগদের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। দিল্লির একটি লৌহ স্তম্ভ লিপিতে চন্দ্র নামে এক নাগ রাজার নাম পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে তার পুরো নাম হয়তো চন্দ্রাংশ। পৌরাণিকেরা এই নাগদের বংশ পরিচয় দেবার সময় বড় গর্বভরে বলেছেন বিদিশার ভাবী নাগ-বংশের রাজাদের কথা শুনুন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন চন্দ্রাংশ। তিনি শেষ নাগের পুত্র-শেষস্য নাগরাজস্য পুত্রঃ পর-পুরঞ্জয়ঃ।
যদি বলেন, পুরাণের কথায় বিশ্বাস করি না, ঐতিহাসিকরা তার থেকে ভাল। তাহলে বলতে হবে–বিদিশা অর্থাৎ এখনকার ভিলসার কাছাকাছি বেশনগর, পদ্মবতী (পদম পাওয়া), কান্তিপুরি আর মথুরায় নাগেরাই ছিলেন রাজা। কুষাণ রাজত্বের পরের দিকে তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নাগরা উত্তর ভারত এবং মধ্য-ভারতে ভাল রকম আঁকিয়ে বসেছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত থেকে স্কন্দগুপ্ত পর্যন্ত সবারই অনেক সময় গেছে এই নাগদের দাবিয়ে রাখতে। আর আমাদের বিখ্যাত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ইতিহাসের গৌরব যিনি বিক্রমাদিত্য বলে বিখ্যাত–তিনি বড় বুদ্ধিমান মানুষ। দাবিয়ে রাখার ঝামেলার থেকে এক নাগকন্যাকে বিবাহ করাটা তার কাছে অনেক বেশি শ্রেয় মনে হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রমাণ চাইলে সময় মতো দেওয়া যাবে।
আমাদের জিজ্ঞাসা- ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক বাহক মহারাজ বিক্রমাদিত্যের এই বুদ্ধি হল কোত্থেকে? আমরা বলব তার সামনে উদাহরণ ছিল অনেক। অর্জুন যে নাগকন্যা উলুপীকে বিবাহ করেছিলেন এই উদাহরণই শুধু নয়। আর্যসভ্যতার প্রথম কল্প থেকে নাগরা যে আর্যদের শত্রু অথবা আর্যদের শত্রুপক্ষকে যে অনেক সময়ই সর্পের কল্পনায় দেখা হত– এ কথা বিক্রমাদিত্য জানতেন। বেদের মধ্যে বৃত্র থেকে আরম্ভ করে অনেক শক্ৰকেই অহি’বা সর্পরূপেই কল্পনা করা হয়েছে। এঁদের সঙ্গে যুঝতে হলে হয় তাদের মারতে হবে, নয়তো তাঁদের সঙ্গে রফায় আসতে হবে। আযায়ণের প্রথম দিকে এই শত্রুতা বেশি ছিল, পরের দিকে মিল মিশ বিবাহ–সবই হয়েছে। অর্থাৎ রফা।
নাগদের মধ্যে দু’রকমের বৃত্তি দেখা যাবে ইতিহাস-পুরাণে। কোথাও তারা ভাল, কোথাও মন্দ। মহাভারতের ক আর বিনতার গল্পে এই ভাল মন্দর খবরটুকু দেওয়া আছে, কিন্তু সেই কাহিনীতে যেতে হলে সমুদ্রমন্থনের কথা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আমি পরে আসছি সে কথায়। আগে জানাই–কদ্রুর ছেলেরা হলেন সাপ, আর বিনতার ছেলে হলেন গরুড়। এঁদের পিতা কিন্তু একজনই মহর্ষি কাশ্যপ। অর্থাৎ এঁদের বংশমূলে সাপ বা পাখির কোনও গন্ধ নেই। একই মুনির দুই পুত্র- এক পক্ষে সর্পকুল, অন্যপক্ষে পক্ষী সুপর্ণ। হাইনরিখ জিমারের। রূপকের ভাষায় একটা হল –darker aspects of God’s essence, আর অন্য দিকে রয়েছে তার conquering principle –গরুড়, সুপর্ণ।
ব্যাপারটা ইতিহাসেও একই রকম। পণ্ডিতরা বলেন কুরু পাণ্ডবদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল কেন্দ্র, যাকে আমরা হস্তিনাপুর বলি, সেই হস্তিনাপুরে আগে নাগদের বাসা ছিল। হস্তিনাপুরকে আগে নাগ পুরই বলা হত। মহাভারতের মহারাজ পাড়ুর বিশেষণ হল নাগপুর-সিংহ। বলতে পারেন-নাগ-মানে তো হাতিও বটে; বিশেষত হস্তিনাপুর গজসাহবয় –এইসব নাম থেকে হস্তিনাপুরের সঙ্গে হাতির সাযুজ্যটাই আসে বেশি অতএব সর্প নাগ নয়, হস্তিনাগ থেকেই হস্তিনাপুরের উৎপত্তি। আমরা কিন্তু এখানে সৌতির বলা সেই সৰ্পনামগুলি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে নামের সঙ্গে হাতির নাম মিশে গেছে। অর্থাৎ সেই ঐরাবত, হস্তিপদ, হস্তিপিন্ড, কুঞ্জর ইত্যাদি। সর্প-নাগদের সঙ্গে হস্তি নাগের ভিন্নতা এইভাবেই নষ্ট হয়ে গেছে। নাগপুর হয়ে গেছে হস্তিনাপুর। পণ্ডিতেরাও এসব কথার উত্তর দিয়েছেন। OST 166109a Later when the distinction between the Naga and serpent clans was forgotten, the elephant was also associated with them. ধরে নিতে পারি– পাণ্ড রাজার নাগপুরে সর্প নাগরাই থাকতেন।
আমি অবশ্য ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার করে দিতে চাই। মহাভারত বলেছে যেসব শত্রু আগে কুরুরাষ্ট্র দখল করে রেখেছিল, যার কুরুদের ধন-সম্পদ হরণ করেছিল, মহারাজ পান্ডু সেই সব দেশ পুনরায় অধিকার করে সেগুলিকে করদ রাজ্যে পরিণত করলেন-তে নাগপুর-সিংহেন পাণ্ডুনা করদীকৃতাঃ। যাঁদের রাজ্য পুনরায় দখল করলেন পাণ্ডু, আমাদের ধারণা–তারা সকলেই নাগ-গোষ্ঠীর রাজা। তাদের জয় করেছিলেন বলেই তিনি নাগপুর-সিংহ। পাণ্ডু থেকে আরম্ভ করে একেবারে যুধিষ্ঠিরের সময় পর্যন্ত নাগ রাজারা বেশ স্তিমিত হয়েই ছিলেন খাণ্ডব-বন দহনের সময় স্বয়ং নাগরাজ তক্ষককে নিজের জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হয়। যদিও তিনি প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয়ে থাকলেও দুর্যোধন বা যুধিষ্ঠিরের দর্পিত এবং সংযত রাজত্বকালে তিনি মাথা উঁচু করেননি মোটেই। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পৃথিবী বীরশূন্যা হয়ে গেল। পরীক্ষিত রাজা হয়ে বসলেন বটে, কিন্তু তার দুর্বল রাজত্বের সুযোগ নিয়ে একদিকে যেমন (রূপকাকারে কল্পিত) কলির প্রবেশ ঘটল, তেমনই ঘটল নাগদের অভ্যুত্থান। নাগরাজ তক্ষক সেই অভ্যুত্থানের প্রতীক।
লক্ষণীয় বিষয় হল আমরা যে শেষ নাগ বা বাসুকি নাগের কথা বলেছি, এঁরা কিন্তু আপন নাগ-গোষ্ঠী ত্যাগ করে আর্য গোষ্ঠীতে যোগদান করেছিলেন। শেষ নাগ পরবর্তী সময়ে বিষ্ণুর অনন্তশয্যা। আর্যগোষ্ঠীর কাছে তিনি পরম সম্মানিত। স্বয়ং কৃষ্ণ জ্যেষ্ঠ বলরাম শেষাবতার রূপে চিহ্নিত। আর বাসুকি হলেন সেই অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যিনি রাজা হয়ে আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে নাগ গোষ্ঠীর মিলন সেতু রচনা করেছিলেন এবং তিনিই সমস্ত নাগ গোষ্ঠীকে আর্যগোষ্ঠীর প্রকোপ থেকে মুক্ত করে আসন্ন উচ্ছেদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। সে কথায় পরে আসছি। আপাতত শমীক পুত্র শৃঙ্গীর অভিশাপ নিজের কানে শুনে মহারাজ পরীক্ষিতের কী অবস্থা হল একটু দেখে নিই।
.
০৮.
শমীক-মুনির সংবাদ নিয়ে তাঁর শিষ্য গৌরমুখ হস্তিনায় এসে পৌঁছলেন পরীক্ষিতের কাছে। পরীক্ষিত শমীককেও চেনেন না, তাঁর পুত্র শৃঙ্গীকেও চেনেন না, গৌরমুখকেও তার চেনার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তি যখন ভয়ংকর অভিশাপ বাক্যটি শোনাল, তখন অনুতাপে তার হৃদয় জর্জরিত হল। শমীক যে মৌনব্রত নিয়ে বসেছিলেন, সেইজন্য যে তিনি মহারাজ পরীক্ষিতের কথায় উত্তর দিতে পারেননি–এই অসম্ভব ভুলটুকু পরীক্ষিতকে পীড়িত। করে তুলল– ভূয় এবাভবদ্ৰাজা শোকসন্তপ্তমানসঃ।
হাজার হলেও কুরুকুলের অধস্তন পুরুষ। অন্যায় একবার করে ফেলেছেন বটে, কিন্তু সে অন্যায় অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গে মর্মচ্ছেদ অনুতাপ আঁকে যত দগ্ধ করতে লাগল, তার মৃত্যুর অভিশাপ সেই অনুপাতে তাঁর কাছে অনেক বেশি সহনীয় ছিলন হি মৃত্যুং তথা রাজা শ্ৰুত্ব বৈ সোন্বতপ্যত। শমীক মুনি উপদেশ পাঠিয়েছিলেন রাজা যেন আত্মরক্ষার যথাযথ উপায় অবলম্বন করেন। রাজা পরীক্ষিত সেই উপদেশ মাথায় রেখে মন্ত্রীদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে নিজের জন্য নিচ্ছিদ্র সুরক্ষার ব্যবস্থা নিলেন। একটি মাত্র স্তম্ভের ওপর একটি বাড়ি বানিয়ে চতুর্দিকে সর্প চিকিৎসক নিযুক্ত করে, চারদিকে বিষ-নাশক ওষুধ ছড়িয়ে, সর্পমন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের ওপর তদারকির ভার দিয়ে পরীক্ষিত মহারাজ সুরক্ষিত হয়ে রইলেন। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারে না, লোক জনের যাতায়াত বন্ধ, সর্বব্যাপ্ত বায়ুরও যেন সে বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ। এমনই এক নিচ্ছিদ্র ঘেরাটোপের মাঝখান থেকে পরীক্ষিতের রাজকার্য চলতে থাকল।
রাজা রাজার মতো সুরক্ষায় ঘেরা থাকলেন, ওদিকে নাগ-রাজ তক্ষকও তার সময় সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। শৃঙ্গী-মুনির চরম ঘোষণার দিনটি, অর্থাৎ ছ দিন পেরিয়ে সপ্তম দিনটি এসে গেল। বিষ-বৈদ্য অথবা সাপের ওঝা –এগুলির মধ্যে সত্যতা যতটুকু আছে, তা রূপকথার রসিকদের আনন্দ দিতে থাকুক, কিন্তু পরীক্ষিতের মৃত্যু যেভাবে ঘটল, তার মধ্যে ইতিহাসের রসটুকুও রীতিমতো ব্যাখ্যাযযাগ্য। নাগরাজ তক্ষক পরীক্ষিতের আত্মগুপ্তির সমস্ত উপায় এবং সম্ভাবনাগুলি পূর্বাহ্নেই জেনে গিয়েছিলেন। আমাদের অনুমান-সপ্তম দিন পর্যন্ত তিনি নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করে দেখেছেন-কারা পরীক্ষিতের কাছাকাছি ঘেঁষতে পারছেন, আর কারা পারছেন না। এই নিবিষ্ট পরীক্ষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সোজা পথে পরীক্ষিতকে মারা যাবে না, চোরাগোপ্তা বাঁকা পথে পরীক্ষিতকে শেষ করে দেবেন তিনি। মহাভারতের কবি লিখেছেন–তক্ষক লোম্মুখে শুনেছেন যে অনেক লোক বিষহর মন্ত্রে পরীক্ষিতকে রক্ষা করে চলেছেন অর্থাৎ জোরদার পাহারা চলছে সেখানে। অবস্থা বুঝে তক্ষক ঠিক করলেন–ছল করেই ঠকাতে হবে পরীক্ষিতকে, তাকে মারতেও হবে ছল করেই–ময়া বঞ্চয়িতব্যো’সৌ…. মায়াযোগেন পার্থিবঃ।
মনে রাখতে হবে–নাগ জনজাতির মানুষেরা কৌরব-পাণ্ডব বংশের হাতে নানাভাবে পর্যস্ত হয়ে পালাতে বাধ্য হলেও তাদের শত্রুতার মধ্যে অসুর-রাক্ষসদের শক্তিমত্তা ছিল না। তাদের সামরিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হওয়ায় সম্মুখযুদ্ধে তারা সব সময়েই খুব সহজভাবে আর্যগোষ্ঠীর নায়কদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু নিজেদের জায়গা জমি ছেড়ে চলে যাওয়ার অপমান এবং পরাজয়ের গ্লানিটুকু তাদের মনের মধ্যে এতই দৃঢ়–নিবদ্ধ ছিল যে, শত্রুতার সুযোগ পেলেই তার শত্রুতা করতেন। কিন্তু সেই শত্রুতার মাধ্যম ছিল চোরাগোপ্তা আক্রমণ, পণ্ডিতদের ভাষায়– Yet they were very acute in accomplishing the wargild and often stabbed their enemy in the back.
পরীক্ষিতের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও এই ব্যাক-স্ট্যাবিং বা ছলনাটাই হয়েছে। মহাভারতে পরীক্ষিতের মৃত্যুকালীন অথবা মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বের সময়টুকু যদি বিচার করে দেখেন, তাহলে লক্ষ্য করে দেখবেন, শেষের দিনে পরীক্ষিত অনেক ভারমুক্ত। তার নিচ্ছিদ্র সুরক্ষা–ব্যবস্থার মধ্যে খানিকটা শিথিলতাও এসেছে বলে মনে হচ্ছে। দিনের পর দিন লক্ষ্য করে নাগরাজ তক্ষক বুঝেছেন যে, একমাত্র তপস্বী মুনি-ঋষিরাই পরীক্ষিতের দরবারে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন। কারণটা খুব পরিষ্কার। পরীক্ষিতের আয়ুঃশেষ নিধারিত হয়ে গেছে, অতএব তিনি যতটা পারেন মোক্ষ-সাধন সম্পন্ন পুণ্যশ্লোক ঋষি-মুনিদের সৎসঙ্গে ভগবৎ কথা শ্রবণ করে পুণ্যলাভের চেষ্টা করছেন। পুরাণ থেকে জানা যায় যে, ব্যাস-পুত্র শুকদেব শ্রীমদ্ভাগবতের মতো কৃষ্ণ-কথাশ্রয়ী মহাপুরাণ ওই সাতদিনের মধ্যেই পরীক্ষিতের কাছে কীর্তন করেন। ভাগবতের আপন বর্ণনা অনুযায়ী পরীক্ষিতের ভাগবত-সভায় ব্রহ্মর্ষি-মহর্ষির অভাব ছিল না।
সে যাই হোক, নাগরাজ তক্ষক যখন দেখলেন যে, পরীক্ষিতের সামনে পৌঁছনোর সবচেয়ে সোজা উপায় সাধুর বেশ ধারণ করা, তখন তিনি তার সাঙ্গোপাঙ্গ নাগ- অনুচরদের তপস্বীর ছদ্মবেশে ফুল-ফল, কুশ এবং জল উপহার নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে যেতে বললেন। তারা আদেশ পালন করল এবং মহাভারতের লোকাত্তর বর্ণনা অনুযায়ী তক্ষক এই সময় একটি কৃমি কীটের আকার গ্রহণ করে লুকিয়ে রইলেন সুমিষ্ট ফলের অন্তর্দেশে। পরীক্ষিত বিচার করলেন না একটুও। সাধু-সজ্জনের উপহার দেওয়া আপাত নিদোষ সেই ফলটিতে কামড় লাগাতেই একটি সামান্য কীটমাত্র দেখা গেল। কীটের চেহারা মহাকাব্যের বর্ণনার খাতিরে ছোট এবং রোগা–অণুঃ হ্রস্বকঃ। কিন্তু এই বর্ণনায় আরও দুটো শব্দ আছে। ছোট হলেও তার গায়ের রঙ তামাটে আর তার চোখ দুটি ঘন কালো। আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে নাগ-জনজাতির শত্রুতা, সৌহাদ্য এবং বৈবাহিক মিশ্রণ দুই-ই এত বেশি গাঢ় ছিল, যে, এই চেহারায় ইঙ্গিতটুকু নৃতত্ত্বের সরসতায় ব্যাখ্যা করা মোটেই অসম্ভব নয়।
পরীক্ষিত কিন্তু বেশ রিলাক্সড়মুডে’ বসে আছেন। অভিশাপের শেষ সপ্তম দিনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পরীক্ষিতের মৃত্যুভয় অনেকটাই কেটে গেছে, তার বিষাদ অনেকটাই মন্দীভূত– অস্তমভ্যেতি সবিতা বিষাদশ্চ ন মে ভয়। বেশ লঘু চপল ভঙ্গিতে তিনি ফলের ভিতরে থাকা কীটটাকে হাত দিয়ে ধরলেন এবং সেটিকে গলার ওপর রেখে বলতে লাগলেন- আমি শমীক মুনির কাছে অপরাধ করেছি, সেই অপরাধের স্বালন হোক এবার। এই কীট তক্ষক হয়ে দংশন করুক আমাকে।
এই কথার মধ্যে অপরাধ স্বালনের অনুতাপ যত ছিল, তার চেয়ে লঘুতা ছিল অনেক বেশি। পরীক্ষিত হাসছিলেন, নিজের গলার ওপরে কৃমি-কীট এদিক ওদিক করে ফেলে তিনি হাসছিলেন। মহাভারত মন্তব্য করেছে–রাজার বোধ-বুদ্ধি, কর্তব্য–অকর্তব্যের অনুতাপ তত ক্রিয়া করছিল না। মরণোম্মুখ ব্যক্তির এই বোধ থাকে না, রাজারও এই সময় তা নেই। তাই তিনি হাসছিলেন- কৃমিকং প্ৰাহসক্তৃর্ণং মুমূর্য নষ্টচেতনঃ। মহাভারতে দেখা যাচ্ছে তক্ষক রাজার ওই হাস্যরত অবস্থাতেই স্বমূর্তি ধারণ করে দংশন করে এবং রাজা মারা যান।
বস্তুত নাগ-তপস্বীদের দেওয়া ফলের মধ্যে তক্ষক কৃমিকীট হয়ে লুকিয়ে ছিলেন– এ কথা তত আদরণীয় নয়। ঘটনার গতি প্রকৃতি দেখে অনুমান হয়–তপস্বী মুনি-ঋষির ভেকধারী অন্য অনুচর নাগদের মধ্যেই স্বয়ং তক্ষকই লুকিয়ে ছিলেন। একুট সুমিষ্ট ফলের বাইরের আকার দেখে ফলান্তগত কীটের যেমন সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনই সজ্জন সাধুর বেশধারী নাগ মুনি-ঋষিদের আপাত শান্ত আকৃতির মধ্যও তক্ষককে মোটেই চেনা যাচ্ছিল না। দিনের শেষবেলায় পরীক্ষিত উত্তেজিত; কিন্তু হয়নি, কেউ তাকে কিছু করতে পারেনি তাই তিনি হাসছেন-মৃত্যুর লক্ষণাঙ্কিত বোধ-বুদ্ধিহীন হাসি। মহাভারতের বর্ণনায় রূপক থেকে পুরাণকারেরা, বিশেষত ভাগবত-পুরাণের কবি আসল ঘটনাটা ঠিক ঠিক বার করে এনেছেন। সুমিষ্ট ফল অথবা ফলান্তৰ্গত কীটের কথা কবি উল্লেখও করেননি। তিনি একটি মাত্র দৃঢ় নিবদ্ধ পংক্তিতে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন–শৃঙ্গী মুনি তক্ষককে লাগিয়েছিলেন পরীক্ষিতকে মেরে ফেলার জন্য এবং তক্ষক সোজা ব্রাহ্মণ ঋষি মুনির ছদ্মবেশ ধারণ করে পরীক্ষিতের সামনে এসে তাকে দংশন করলেন–
তক্ষকঃ প্রহিতো বিপ্রাঃ ক্রুদ্ধেন দ্বিজ-সুনুনা।
দ্বিজরূপ প্রতিচ্ছন্নঃ কামরূপো’দশনুপম।
এটা দংশন, না আকস্মিক অস্ত্রাঘাত, তা সুধীজনেরা বিচার করুন তবে আমার মত ইতিহাস এবং নৃতত্তের বিশ্বসে এটাকে অস্ত্রাঘাত বলেই মনে করে। মনে রাখবেন–ভারতের চিরন্তন নীতিশাস্ত্রে সর্পের সব সময় খল জনের তুলনা দেওয়া হয়েছে। সর্পঃ ক্রঃ সপাৎ ক্রুরতরঃ খলঃ–এ সব সাধারণ নীতি উপদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, এখানে অন্তত পনেরো থেকে কুড়িটা সংস্কৃত সুক্তিরত্ন আমি সাজিয়ে দিতে পারি যেখানে খলজনের সাজাত্যে সর্পের তুলনা এসেছে। তক্ষকও এই রকম এক খল প্রকৃতির ক্র মানুষ। পাণ্ডব বংশের ওপর তার ক্রোধ ছিল বহুদিনের। সেই যেদিন খাণ্ডব বন দহন করে অর্জুন তাকে স্থান–ষ্ট করেছিলেন, ততদিনের ক্রোধ। যদিও অর্জুন বেঁচে থাকতে তিনি কিছুই করতে পারেননি, কিন্তু অর্জুন মহাপ্রস্থানে যেতেই, তিনি তার সময় সুযোগ খুঁজছিলেন। এই অবসরে শৃঙ্গী মুনির পিতার কাছে কোনও কারণে পরীক্ষিতের অপরাধ ঘটে যাওয়ায় তক্ষক সেই সুযোগ পান।
শৃঙ্গী নিশ্চয় তক্ষকের সঞ্চিত ক্রোধের কথা জানতেন এবং তিনি সোজাসুজি তাকে নিযুক্ত করেন পরীক্ষিতকে মেরে ফেলার জন্য। নইলে মহাভারতের অন্যত্রও আমরা অনেক অভিশাপ শুনতে পাব। তাতে দেখবেন–তুই এই করেছিস, তোর এই, হবে, সেই হবে ইত্যাদি এইরকমই অভিশাপের নমুনা। কিন্তু এখানে শৃঙ্গী মুনির কথা কত পরিষ্কার, সে কথার কত জোর–আজ থেকে সাতদিনের মাথায়. তক্ষক সেই রাজাকে যমের বাড়ি নিয়ে যাবে এবং তা আমার বাক্যে, আমার কথায় প্ররোচিত হয়ে মাক্যবলচোদিতঃ। পুরাণ কথায় ভাগবতে, তো শৃঙ্গী মুনির কাজটা আরও পরিষ্কার। ক্রুদ্ধ মুনির দ্বারা প্রেরিত হয়ে তক্ষক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরে এলেন পরীক্ষিতকে দংশন করতে প্রহিতো দ্বিজসূনুনা। আরে! ব্রাহ্মণ কি আর দংশন করে? খল এবং কুরপ্রকৃতির লোকই সাধু সেজে এসে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে পরীক্ষিতকে। আজকের দিনে, নিজে যে পারে না, সে যেমন মাস্তান দিয়ে মার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে, মাডারের ব্যবস্থা করে, তেমনই এখানেও নাগরাজ তক্ষক তার পুরনো হিস্যা’ মিটিয়ে নিলেন, যদিও তার নিমিত্ত হয়ে রইলেন শৃঙ্গী মুনি।
শৃঙ্গীর পিতা শমীক পান্ডব বংশের রাজত্বের অনুগামী। তিনি একদিকে পুত্রের অভিশাপের অনিবার্যতা স্বীকার করছেন। (কারণ তক্ষক তখন কাজে লেগে গেছেন–) আবার অন্যদিকে পরীক্ষিতের কাছে শিষ্য পাঠিয়ে তাকে সাবধান করছেন; খল সর্পের আঘাত থেকে বাঁচবার জন্য তাকে আত্মরক্ষার উপায় অবলম্বন করতে বলছেন। অভিশাপ যদি অনিবার্য হয়, তবে আত্মরক্ষার উপায় বৃথা, অন্তত তৎকালীন দিনের অভিশাপের মনস্তত্ত্ব তাই বলে। অথচ শমীক পরীক্ষিতকে আত্মরক্ষা করতে বলছেন। তার মানে, পুত্রের অভিশাপের অনিবার্যতার থেকেও তক্ষকের চোরাগোপ্তা আক্রমণের বাস্তবটুকু এখানে বেশি বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ। শৃঙ্গী-পিতা শমীক-মুনির পরস্পরবিরোধী কথা দুটি এবং পরীক্ষিতের দিক থেকে আত্মরক্ষার প্রবল চেষ্টা –এই দুটি ব্যবহারই বিপরীত দিক থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, নাগ। জনজাতির অন্যতম নায়ক ব্রাহ্মণ-সমাজের একাংশের অনুমোদন লাভ করে নিজের প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছেন মাত্র। রূপক-প্রিয় মহাকবি পরীক্ষিতের অপরাধ, ব্রাহ্মণের অভিশাপ আর বিষবাহী তক্ষক–দংশনের উপন্যাসে যে অসাধারণ গল্পটি লিখেছেন, তার মধ্যে ঐতিহাসিকের টিপ্পনি শুধু এক জায়গাতেই। তা হল–এই মাত্র পরীক্ষিতের এক স্তম্ভলম্বী রাজসভায় যে রাজনৈতিক খুনটি হয়ে গেল, তাতে অর্জুনের একান্ত আত্মবংশ পরীক্ষিত মারা গেলেন, এবং তাতে নাগরাজ তক্ষকের ব্যক্তিগত ক্রোধও কিছুটা শান্ত হল বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে নাগ-গোষ্ঠী বা জনজাতির ওপর এই খুনের প্রভাব পড়ল অন্যরকমভাবে। রক্তের বদলে রক্ত- আর্যগোষ্ঠী রক্তের বদলায় মেতে উঠলেন।
পরীক্ষিত মারা যেতেই ব্রাহ্মণেরা পরীক্ষিতের মন্ত্রী এবং পুরবাসীদের সঙ্গে একজোট হয়ে তার উপযুক্ত পুত্র জনমেজয়কে সিংহাসন বসালেন। জনমেজয় যখন পিতার সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স অল্প। যদিও মহাভারতের কবি তাঁকে একেবারেই শিশু বলেছেন, তবে নিতান্ত শিশুটিই তিনি ছিলেন না। সিংহাসনে বসার কিছুকালের মধ্যেই তার বিয়ে হয়। তার স্ত্রীর নাম বপুষ্টমা। জনমেজয়ের এই অতীব স্পৃহণীয়া হৃদয়হারিণী পত্নীর সম্বন্ধে এখনই কোনও কথা বলছি না। যদি প্রসঙ্গ আসে, তবে সে আলোচনা পরে আসবে। আপাতত এইটুকুই জানাই–সিংহাসনে বসার সময়ে পিতার আকস্মিক মৃত্যু সম্বন্ধে তত সচেতন ছিলেন না এবং উপযুক্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রী-ব্রাহ্মণেরাও তাকে তেমন করে কিছুই অবহিত করেননি। তাই বলে মন্ত্রীরা পরীক্ষিত-হন্তা তক্ষকের কথা ভুলে বসেছিলেন, তা নয়। আমরা জানি যে, জনমেজয় রাজা হয়ে এক সময় তক্ষশিলা জয় করতে গিয়েছিলেন এবং তারও আগে-পাঠক। স্মরণ করুন সেই কুকুরীর অভিশাপের কথা। কুকুরীর অভিশাপ মোচনের জন্য জনমেজয়। যাকে পৌরোহিত্যে বরণ করেন, সেই সোমশ্র ব্রাহ্মণ ঋষি কতবার ঔরস পুত্র বটে তবে। তার মা ছিলেন নাগ জাতীয়া। জনমেজয় তক্ষক নাগের হাতে পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে থাকবেন। তাই কুকুরী যখন অভিশাপ দিল- তোমারও ওপর ভয় নেমে আসবে অতর্কিতে– তখন জনমেজয় আবারও সপঘাতের কথাই ভেবেছেন হয়তো। অন্তত পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে নাগ জনজাতির সঙ্গে যে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শক্রতা আরম্ভ হয়েছিল তারই নিরিখে জনমেজয় এমন একজনকে চিরন্তন পৌরোহিত্যে নিয়োগ করলেন, যাঁর ঘনিষ্ঠ মেলা মেশা আছে নাগ জনজাতির সঙ্গে।
সোমশ্রবা এক সপীর পুত্র। জনমেজয় সোমশ্রকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এসে ভাইদের বলেন। তার আজ্ঞাবহ হতে। আর ঠিক সোমশ্ৰবাকে নিযুক্ত করেই যে তিনি তক্ষশিলা জয় করতে বেরলেন তার পেছনে সোমশ্রবার পরামর্শ ছিল বলে আমরা অনুমান করি। হয়তো তিনিই বলেছিলেন যে, পরীক্ষিতের মৃত্যুর কারণ তক্ষককে সেইখানেই পাওয়া যাবে। তক্ষশিলা আর তক্ষক–এই তক্ষ’ নামের সাদৃশ্যটা খুব বড় কথা নয়, তক্ষক যে ওইখানেই থাকতেন, তার একটা বড় প্রমাণ মহাভারতের বনপর্বে। সেখানে দেখা যাবে পাণ্ডব মধ্যম অর্জুন অমোঘ অস্ত্র লাভ করার জন্য শিবের তপস্যা করতে গেছেন আর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী আর অন্য ভাইদের, নিয়ে বিমনা হয়ে বসে আছেন। এই অবস্থায় দেবর্ষি নারদের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। নারদ তাকে নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াবার উপদেশ দিলেন। বেড়ানোও হবে, পুণ্যও হবে, সময় ও কেটে যাবে স্বচ্ছন্দে। এই নানা তীর্থের নাম এবং তাঁর মাহাত্মের মধ্যে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের কথা এল। শোনা। গেল– কাশ্মীরে বিতস্তা নদীর জল-ধোয়া কোনও এক অঞ্চলে নাগরাজ তক্ষকের বাসভূমি -–কাশ্মীরেম্বেব নাগস্য ভবনং তক্ষকস্য চ। বিতস্তাখ্যমিতি খ্যাতং সর্বপাপ-প্রমোচন।
সেকালে এমন ছিল। শুধু আর্যগোষ্ঠীর আর ব্রাহ্মণ্যের কেন্দ্রগুলিই শুধু তীর্থ হিসেবে পরিগণিত হত না। কোনও স্থানকে আপন তপস্যায় এবং মাহাত্মে তীৰ্থীকরণের ক্ষমতা আর্যদের যেমন ছিল, আর্য-বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীরও তেমন ছিল। বলতে পারেন এই কাশ্মীরদেশি নাগ ভবনের মালিক তক্ষক আর পরীক্ষিত-হস্তা তক্ষক একই ব্যক্তি কিনা? হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এমন হতে পারে–খাণ্ডব দাহের সময় অর্জুনের তাড়া খেয়ে তক্ষক কাশ্মীরের প্রত্যন্ত দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে–তক্ষক একটি বিখ্যাত নাগবংশের উপাধিমাত্র। কাশ্মীরে বিতস্তা নদীর তীরভূমিতে তক্ষক নাগবংশ এতটাই বিখ্যাত ছিল যে তাদের আবাসভূমি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। যে কোনও কারণে এই বিখ্যাত বংশের সঙ্গে পাণ্ডবদের শত্রুতা হয় এবং মহারাজ পরীক্ষিত তার বলি হন।
জনমেজয় তক্ষশিলা, জয় করে ফিরে এলেন বটে, কিন্তু তক্ষককে তিনি সেখানে পাননি। মহাভারতে দেখবেন এই তক্ষশিলা জয়ের পর-পরই মহর্ষি বেদের শিষ্য উতঙ্ক উপস্থিত হন হস্তিনাপুরে জনমেজয়ের রাজসভায় এবং তিনি তক্ষকের সম্বন্ধে জনমেজয়কে উত্তেজিত করেন। ঠিক এইবার জনমেজয় পিতার মৃত্যু সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে প্রাচীন মন্ত্রীদের জিজ্ঞাসা করেন এবং মন্ত্রীরাও আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জনমেজয়ের কাছে নিবেদন করেন। সে সব ঘটনা আমরা আগে বলেছি।
জনমেজয়ের রাজসভায় জরুরি বৈঠক বসল। মন্ত্রী এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সবার মত চেয়ে জনমেজয় বললেন, উতষ্কের হেনস্থা এবং পিতার মৃত্যু- এই দুয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি তক্ষককেও পুড়িয়ে মারতে চাই। মন্ত্রী পুরোহিতেরা একযোগে সর্পযজ্ঞের আয়োজন করতে বললেন। যাজ্ঞিকেরা আভিচারিক বৃত্তির প্রতীক কালো কাপড় পরে ধূমাকুলিতনেত্রে আগুনে আহুতি দিতে থাকলেন আর সাপেরা যে যেখানে ছিল, সব এসে পড়তে লাগল যজ্ঞের আগুনে।
আসল কথা হল– জনমেজয় তক্ষকের ওপর রাগে সমস্ত নাগ-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সর্পযন্ত্র একটা রূপকমাত্র। আমি পরে মহাভারত থেকে দেখাব বিশাল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকেও বেশ কয়েকবার যন্ত্রের রূপকে বেঁধে দিয়েছেন কবি। জনমেজয়ের সৰ্পর্সত্রে সেই রূপকটুকু পরিষ্কার করা নেই, যাতে বোঝা যায় জনমেজয় সমগ্র নাগ-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই তাঁর জেহাদ ঘোষণা করলেন! পণ্ডিতের ভাষায় –janamejaya …..chalked out a plan for a wholesale massacre of their race.
লক্ষণীয় বিষয় হল– নাগ-গোষ্ঠীর মধ্যে সকলেই একরকমের লোক নন। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁদের সঙ্গে আর্য-ব্রাহ্মণ্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মহর্ষি কাশ্যপের দুই স্ত্রী ক এবং বিনতার কাহিনী আমি এখানে বিস্তারিতভাবে বলছি না। কিন্তু কশ্যপের এই দুই স্ত্রীর মধ্যে দাসিবৃত্তির শপথ নিয়ে একটা বাজি ধরার ব্যাপার ছিল। সম্পূর্ণ শ্বেতবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবার ল্যাজটি কালো না সাদা, এই নিয়ে দুই সতীনে বাজি ধরলেন। কদ্রু বললেন- উচ্চৈঃশ্রবার ল্যাজটি কালো, বিনতা বললেন সাদা। বাজি জিতবার জন্য কদ্রু তার সর্প-পুত্রদের আদেশ দিলেন উচ্চৈঃশ্রবার ল্যাজে গিয়ে আটকে থাকার জন্য। সর্পপুত্রদের বেশিরভাগই এই শঠতায় রাজি হলেন, কিন্তু অনেকে আবার রাজি হলেনও না, তারা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বেরিয়ে এলেন।
মা কদ্রু এই সাপদের অভিশাপ দিলেন বটে, কিন্তু সেই অভিশাপ শুনেও নাগ-জাতির মধ্যে সব থেকে প্রভাবশালী শেষনাগ চলে গেলেন তপস্যা করতে। কঠিন নিয়ম আর ব্রত আচরণে তার শরীরের চামড়া শিরা-শুকিয়ে গেল এবং স্বয়ং ব্রহ্ম তাকে একজন খাঁটি মুনির মতোই সম্মান দিলেন-তপ্যমানং তপো ঘোরং…জটাচীরধরং মুনি। শেষনাগ ধার্মিক মুনির সম্মানে ভূষিত হয়ে ব্রহ্মার বর লাভ করলেন। এটাই বড় কথা নয়, ব্রহ্মার ইচ্ছায় তিনি সমস্ত পৃথিবীকে আপন ফণাগ্রে ধারণ করে রইলেন। অর্থাৎ নাগ হওয়া সত্ত্বেও আর্যগোষ্ঠীর নিয়ম আচার পালন করে তিনি আর্য-অনার্য সকলের মধ্যেই পূজা-পদবি লাভ করলেন। পৃথিবীর স্থিতিশীলতার জন্য সকলেই তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইল।
শেষ বা অনন্ত নাগের মতোই আরেক পুণ্যবান ধার্মিক হলেন নাগরাজ বাকি। সমুদ্র মন্থনের সময় দেবাসুর দুই পক্ষের মর্যাদা লাভ করে তিনি মন্থন-রজুর ভূমিকা গ্রহণ করে অমৃত-লাভে সহায়তা করেছিলেন। প্রধানত তারই করুণায় এবং পরামর্শে সমস্ত নাগগোষ্ঠী জনমেজয়ের ক্রোধ থেকে মুক্তি পায়। বাসুকির বোন হলেন জরৎকারু। তপস্বী মুনি জরৎকারুর সঙ্গে নাগিনী জরৎকারুর মিলনে মহামুনি আস্তীকের জন্ম হয় এবং এই আস্তীকের হস্তক্ষেপেই জনমেজয়ের সর্পসত্র বা wholesale massacre বন্ধ হয়ে যায়।
আগে যেমন ব্রাহ্মণী পুলোমা এবং রাক্ষস পুলোমার কথা বলেছি, তেমনই ব্রাহ্মণ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে নাগ-বংশীয় জরৎকারুর মিলন হল। এঁদের নাম-সাম্যেই বোঝা যায় যে, একদিকে আর্য এবং নাগ গোষ্ঠীর শ্রেণীগত মিলন এবং সংমিশ্রণ যেমন ঘটেছিল, তেমনই এঁদের পারস্পরিক কৃষ্টির সংমিশ্রণও ঘটেছিল। বাসুকি নাগ যে ব্রাহ্মণ জরৎকারুর সঙ্গে তার ভগিনী জরৎকারুর বিয়ে দিলেন তার পেছনে তার গোষ্ঠীস্বার্থের ব্যাপার ছিল পুরোপুরি। মহাভারতে এই স্বার্থের কথাটা বলা আছে ভবিষ্যদবাণীর মতো করে। বাসুকি-ভগিনী জরৎকারু যখন গর্ভবতী হয়ে বাসুকির কাছে ফিরে এলেন, তখন বাসুকি বলেছিলেন, তোমার গর্ভে যে পুত্র হবে, সেই নাগকুলের মঙ্গল বয়ে আনবে, জনমেজয়ের সর্পসত্র থেকে সেই আমাদের আমাদের বাঁচাবে —
পন্নগানাং হিতাথায় পুত্রস্তে স্যাৎ ততো যদি।
স সপসত্ৰাৎ কিল নো মোক্ষয়িষ্যতি বীর্যবান।।
বাসুকি-ভগিনী দাদাকে স্বামীর আশ্বাস শুনিয়ে বলেছেন–নাগদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি নিয়ে তুমি চিন্তা কোর না। সে আমার গর্ভে এসে গেছে।
বলা বাহুল্য–এটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়। নাগদের মঙ্গল ঘটেছিল নাগিনীর মুনিপুত্র আস্তীকের মাধ্যমে। নাগিনীর গর্ভজাত হলেও ব্রাহ্মণের জাতি পেতে তার অসুবিধা হয়নি, কারণ মহর্ষি জরৎকারু তাকে স্বেচ্ছায় বিবাহ করেছিলেন। আস্তীকও নাগভবনে থেকেই তার ব্রাহ্মণ্যের তপশ্চর্যা চালিয়ে গেছেন- গৃহে পন্নগরাজস্য প্রযত্না পরিরক্ষিতঃ। জনমেজয় যখন তক্ষকের কারণে সর্পকুলের ওপর তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রতিজ্ঞা নিলেন, তখন মাতুল বাকির পরামর্শে এগিয়ে এলেন সেই আস্তীক, যাঁর পিতার ঔরস সংস্কার ব্রাহ্মণ্য আর মাতার শোণিত–সংস্কার নাগজাতীয়। ব্রাহ্মণ্য এবং আর্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এই নাগিনীপুত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলেই দেশের রাজার ওপরে তিনি সেই ব্যক্তিত্ব আরোপ করতে পেরেছিলেন, যাতে জনমেজয় সর্পযজ্ঞ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অন্যদিকে তক্ষককে দেখুন। জনমেজয় তাকে তক্ষশিলায় পাননি। পাবেন কী করে? পরীক্ষিতকে হত্যা করার পর জনমেজয়ের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তাকে পালাতেই হয়নি শুধু, তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এমন এক দেবতার কাছে যিনি আর্য-সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রধান প্রতিভূ। তিনি ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র অন্তরীক্ষে অথবা স্বর্গে, যেখানেই তিনি থাকুন, তক্ষককে আশ্রয় দিতে তার বাধেনি। এতটাই তাঁকে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তার মুখ। দিয়ে বরদানের মতো এই শব্দগুলি বেরিয়েছিল –তুমি আমার ঘরে চুপটি করে বসে থাক তে দেখি। আমি দেখব–কোন সর্পত্রের আগুন তোমায় কী করে বসেহ ত্বং মসকাশে সুগুপ্তো/ ন পাবকত্ত্বাং প্রদহিষ্যতীতি।
মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা আর্য সংস্কৃতির দ্বিতীয় স্তর। কেন না প্রথম স্তরে আছেন দেবতারা। আর ইনিও যে সে দেবতা নন। ঋকবেদে সর্বাপেক্ষা অধিক স্তব-স্ততি যাঁর উদ্দেশ্যে, নিবেদিত, সেই ইন্দ্র হলেন তক্ষকের বন্ধু-প্রতিম। তার মানে তক্ষক ছোড় টা ছেড়ে বড়-ডারে ধরেছেন। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উপাস্য বর্গের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব আছে। তিনি ইন্দ্রের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত আছেন। কিন্তু মজা হল, উপাস্য যিনি, তার সমস্ত শক্তিমত্তা এবং জনপ্রিয়তাই উপাসক-নির্ভর। তক্ষক যখন কিছুতেই আসছেন না, তখন মুনিরা মন্ত্রের জোরে ইন্দ্রের সিংহাসন ধরেই টান দিলেন। যাতে কান টানলে মাথা আসে, ইন্দ্রের সঙ্গে তক্ষকও আসেন। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মনস্তত্ত্ব এই–যাঁকে এতকাল ধরে এত মন্ত্র পড়ে, এত ঘি পুড়িয়ে তুষ্ট করলাম, তিনি কিনা আমাদের রাজহস্তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আশ্রয় দিতে চাও দাও, কিন্তু মনে রেখ– তুমি আমাদের উপাস্য হলেও আমাদের স্বার্থবিরোধী জনকে আশ্রয় দিয়েছ বলে, তোমাকেও আমরা ছাড়ব না, তোমাকেও একসঙ্গে আগুনে পোড়াব- তমিন্দ্রেণৈব সহিতং পাতয়ধ্বং বিভাবসৗ।
ইষ্ট অনুগত ভক্তের আস্থা হারালে দেবতা যে আর উপাস্য থাকবেন না, তা দেবতারাও জানেন। মহাভারত বলেছে- ঋষিদের যজ্ঞের ক্ষমতা দেখে ইন্দ্রও ভয় পেয়ে তক্ষককেও ছেড়ে পালালেন- হিত্বা তু তক্ষকং ত্রস্তঃ স্বমেব ভবনং যযৌ। এ হল এখনকার দিনের রাজমন্ত্রীর ব্যবহার। কুখ্যাত মাস্তানকে রাজনৈতিক বুদ্ধিতে আশ্রয় দিয়েছেন হয়তো, কিন্তু যখন দেখা গেল জনগণ বেঁকে বসল, পাটি ভাল চোখে দেখছে না, তখনই আর নেতা তাকে চিনতে পারেন না– জনগণ চায় না, অতএব আমি তোমায় চিনি কী করে? ইন্দ্র তক্ষককে ত্যাগ করে নিজের ঘরে ঢুকলেন। তক্ষক মারা পড়েন আর কী!
ঠিক এই অবস্থায় এসেছে আস্তীক-মুনির মধ্যস্থতা। পিতৃকুলের লোকের সঙ্গে মাকুলের গোলমাল। তিনি জনমেজয়ের সভায় দাঁড়িয়ে দিব্য ভাষায় জনমেজয়ের যজ্ঞ-প্রশংসা করে জনমেজয়ের মন ভিজিয়ে দিলেন এবং নিজের ব্যক্তিত্বে সামরিক-শক্তিহীন নাগকুলের সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। তক্ষক তো বাঁচলেনই জনমেজয়ের রাজরোষ থেকে বাঁচল সমস্ত সর্পকুল। নিশ্চিন্ত হলেন বাসুকি, যিনি পূর্বাহ্নেই আর্য-সংস্কৃতির অঙ্গীভূত তথা নিজগোষ্ঠীর হঠকারিতায় সাময়িকভাবে বিব্রত, চিন্তিত।
মহাভারত জানিয়েছে–যে সমস্ত সাপের বিষ খুব বেশি ছিল, তারাই মারা পড়েছিল জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দৰ্খাস্ত মহাসুট্রে…দীপ্তানল-বিষোণাঃ। আসল কথা-নাগ-গোষ্ঠীর যে সমস্ত ব্যক্তি তৎকালীন আর্য-ক্ষত্রির শক্তির বিরোধিতায় নেমেছিলেন, জনমেজয় তাদেরই মুলোৎপাটন করে ছেড়েছিলেন। বাকি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আগে থেকেই আর্যগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, বাদবাকি অন্যেরা আস্তীক-মুনির মধ্যস্থতায় আর্য-সংস্কৃতিতে আত্মীকৃত হলেন। এর ফলে প্রাচীনতর তথা সমসাময়িক নাগ-জনজাতির সঙ্গে জনমেজয়ের আর কোনও শত্রুতা রইল না। আস্তীকের ব্যক্তিত্ব এবং তর্কযুক্তি জনমেজয়ই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনমেজয়ের সভাস্থ অন্য ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতেরা সকলেই একসময় বুঝেছেন যে, সর্পবংশবিনাশী ওই প্ৰধ্বংসী যজ্ঞ আর চলা উচিত নয়। তারা সকলে মিলে পরামর্শ দিয়েছেন যজ্ঞ বন্ধ হোক, আস্তীক বর লাভ করুন–
ততো বেদবিদস্তাত সদস্যাঃ সর্ব এব তু।
রাজানমূঢুঃ সহিতা লভতাং ব্রাহ্মণো বর৷৷
রাজা জনমেজয় মেনে নিলেন মন্ত্রী পুরোহিতের কথা। বললেন, আপনারা যেমন চাইছেন, আস্তীক যেমন চাইছেন, তেমনটিই হোক। যজ্ঞ বন্ধ হোক, সর্পকুলের ওপর সমস্ত উপদ্রব বন্ধ হোক–সমাপ্যতামিদং কর্ম পন্নগাঃ সন্তু অনাময়াঃ। সভাস্থলে আনন্দের কোলাহল উঠল। ব্রাহ্মণ সজ্জন যাঁরা যজ্ঞে উপস্থিত হয়েছিলেন, অতিথি, শিল্পী, কর্মকার যারা উপস্থিত–তাঁরা সবাই জনমেজয়ের দান-মান পেয়ে জনমেজয়কে আশীর্বাদ শুভেচ্ছা জানালেন। এই দান মানের প্রাপকদের মধ্যে আমার কাছে একজন বড় গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সূত-জাতীয় পুরাণবক্তা। তিনি গল্প বলেন। মহাভারতের কবি এই সূত জাতীয় ব্যক্তিটির নাম স্বকণ্ঠে বলেননি। তবে আমাদের অনুমান–তিনিই লোমহর্ষণ, আমাদের বর্তমান কথক ঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবার পিতা। মিলনের আনন্দে দান-মানের প্রগ্রহ যখন মুক্ত হয়েছিল, তখন এই সূত জাতীয় কথক-ঠাকুরটিও জনমেজয়ের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হননি- তেভ্যৎ প্রদদৌ বিত্ত শতশোধ সহষণঃ। লোহিতাকায় সূতায়……। নাম না বললেও পণ্ডিতেরা অর্থ করেছেন সূতায় লোমহর্ষণীয়। সৌতি উগ্রশ্রবা যাঁর কাছে মহাভারতের পাঠ নিয়েছেন, সেই লোমহর্ষণ কিন্তু একটু পরেই জনমেজয়ের এই সভাতেই সুযোগ পাবেন মহাভারত শোনার।
.
০৯.
জনমেজয়ের রাজসভায় আস্তীক মুনির মধ্যস্থতায় যেভাবে নাগদের সঙ্গে শাসক ক্ষত্রিয়ের মিলন ঘটল, তাতে আমরা এখনই মহাভারতের মূল কাহিনীতে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু সেই পথে আমাদের বাধা হলেন স্বয়ং আমাদের কথক ঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবা। আমি আগে বলেছি–মহাভারতের তৃতীয় সম্পাদক হিসেবে উগ্রশ্রবাসৌতি আগে তাঁর নিজস্ব কালের হাওয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আমি বলেছি-নাগদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে –কীভাবে তারা শত্রু থেকে বন্ধু, এমনকি উপাস্যতার পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন সেটা দেখানো সৌতি উগ্রশ্রবার ভাবনার মধ্যে ছিল। এখন বলছি শুধু নাগ নয়, মানুষের মর্ত্যভূমিতে যাদের আমরা দেবতা বলি, রাক্ষস বলি অসুর বলি– তাদের প্রাথমিক পরিচয় উন্মোচন। করাটাও সৌতির ‘মেথডোলজি’র মধ্যে পড়ে।
মনে রাখতে হবে এর পরে মহাভারতে আমরা প্রধান প্রধান অনেক দেবতাকেই দেখতে পাব যাঁরা মনুষ্য রমণীর প্রেম-পাশে বদ্ধ হবেন। দেখতে পাব- শুধু প্রেম কেন মনুষ্য রমণীর গর্ভে দু-একটি পুত্র কন্যা লাভ করতেও তারা বেশ আগ্রহী। দেবতারা অলৌকিক শক্তি বশে মনুষ্য সমাজের ওপর এই অলৌকিক অধিকার বিস্তার করেছেন– ধর্মের যুক্তিতে একথা আদরণীয় মনে হলেও আমি যে সে পথে এতক্ষণ হাঁটিনি, তা বোধ করি বিলক্ষণ বুঝেছেন। আর আমাদের সৌতি উগ্রশ্রবার আধুনিক মননশীলতাও তো কিছু ভোলবার নয়। তিনি মূলত গল্প বলা কথক ঠাকুর হলেও তিনি মহাভারতের ইতিহাস শোনাতে বসেছেন, কাজেই গল্প বলা অথবা কথকতার অন্তরে তিনি তৎকালীন দিনের সামাজিক ইতিহাসটুকুও যে ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলবেন–সে কথা বলাই বাহুল্য।
কদ্রু বিনতা এবং অন্যান্য নাগদের পরিচয় দিতে দিতেই তিনি অমৃত মন্থনের প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এর পিছনে অবশ্যই তার উদ্দেশ্য আছে। হঠাৎ করে এক গল্পের খেই হারিয়ে তিনি অন্যগয়ে যাননি। নাগদের প্রসঙ্গে দেবতা আর অসুরদের পারস্পরিক স্থিতি মহাভারতের আরম্ভেই তার জানানোর প্রয়োজন আছে এবং তা জানানোর সবচেয়ে সহজ এবং বড় উপায় হল সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান। সৌতি উগ্রশ্রবা স্বকণ্ঠে এই উপাখ্যানের তাৎপর্য বলবেন না, কারণ তিনি মোহময়ী কথকতায় আবিষ্ট। বিশেষত এই তাৎপর্য জানাতে হলে তাকে পুরাণ কথাও বলতে হত বিস্তর, তাতে আধুনিক প্রক্ষেপবাদীদের আরও পোয়া বারো হত। কিন্তু সৌতি বলেননি বলেই আমাদের দায় আসে তার কথা ঠিক ঠিক বুঝিয়ে বলার।
দেখুন সমুদ্রমন্থনের কাহিনী এতটাই পুরনো এবং এতটাই তা গভীর যে ভারতের পুরাণগুলির অধিকাংশের মধ্যেই এই কাহিনীর আলাপ এবং বিস্তার শোনা যাবে। আর পুরাণ গুলি যেহেতু আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক ইতিহাস অতএব সৌতি উগ্রশ্রবার মহাভারতকে বুঝতে হলে পুরাণ কথা দিয়েই মহাভারতকে বুঝতে হবে, কারণ সেই প্রথমে আমরা উগ্রশ্রবার পরিচয় দিতে গিয়ে তার বিশেষণ দিয়েছি- ‘লোমহর্ষণ-পুত্র উগ্রশ্রবা সৌতিঃ পৌরাণিকঃ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ‘পৌরাণিক যখন ভারত আখ্যান শোনাচ্ছেন তখন তো আর তিনি পুরাণের কথা বলবেন না, আখ্যানের অন্তরে তিনি শুধু ইঙ্গিত করবেন। সে ইঙ্গিত আমাদের বুঝতে হবে সমান হৃদয় দিয়ে পৌরাণিকের সমব্যথা নিয়ে।
জানি, এখনই বলবেন– এই তো আবার আরম্ভ করলে ভ্যাজর ভ্যাজর। যে রকম প্রস্তুতি হয়েছিল তাতে এখনই বেশ পাণ্ডব-কৌরব আর চন্দ্রবংশের পরম্পরা শোনা যেত। তা না, যত সব উটকো প্রক্ষিপ্ত কাহিনী নিয়ে তোমার মাথা-ব্যথা। আমি বলব মাথা ব্যথা শুধু আমার নয়, আপনাদেরও মাথাতেও সেই ব্যথা আমি খানিকটা ধরিয়ে দিতে চাই। কেন না ব্যথা না। থাকলে–আইনস্টাইন-স্টিফেন হকিংও জলভাত, ব্যাস-বাল্মীকিও জলভাত। সেই জলভাতী বিদ্যায় ওপর-চালাকি করার সুবিধে হতে পারে, কাজের কাজ কিছু হয় না। তবু আপনাদের আকাক্ষা মতো আমি আগেই ঘটনার তাৎপর্যে প্রবেশ করব না, বরং ঘটনাটার সঙ্গে সঙ্গে মাথা–ব্যথার টিপ্পনিগুলি দিয়ে যাব।
সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যানে মহাভারতে কোনও ভণিতা নেই। সৌতি উগ্রশ্রবা বললেন, সুমেরু নামে একটি মহাপর্বত আছে। সে পর্বতের আকার যেমন সুন্দর, তেমনই তার চাকচিক্য। সোনার মতো সে পাহাড়ের রং আর সেখানে বিচরণ করেন শুধু দেবতারা আর গন্ধর্বরা-কনকাভরণং চিত্রং দেবগন্ধর্বসেবিত। এত উঁচু সেই পাহাড় যেন স্বর্গকেও আবরণ করে দেয় নাকমাবৃত্য তিষ্ঠতি। সেই সুমেরু পর্বতের সবচেয়ে উঁচু শিখরে উঠে স্বর্গবাসী। দেবতারা অমৃত আহরণ করার জন্য আলোচনা আরম্ভ করলেন। দেবতাদের অমৃত মন্ত্রণা আরম্ভ হতেই ভগবান নারায়ণ ব্রহ্মাকে ডেকে বললেন, দেবতারা অসুরাদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র মন্থন করুক, তাতেই অমৃত পাওয়া যাবে দেবৈ রসুরসঘৈশ্চ মধ্যতাং কলশোদধিঃ। উদধি মানে সমুদ্র আর কলশ মানে কলসী।
ছোটবেলায় যদি রূপক কর্মধারয় সমাস পড়ে থাকেন, তাহলে কলশ রূপ সমুদ্র বুঝতে কোনও অসুবিধেই নেই। সমুদ্র যার বৃহৎ রূপ, কলশ তারই ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। সেই সমুদ্র-কলশ মন্থন করে অমৃত তুলতে হবে। কিন্তু কেন, কী কারণ ঘটল অমৃত মন্থন করার? মহাভারত তা বলেনি, কারণ অন্যান্য পুরাণে তা বলা আছে। সমুদ্র মন্থনের কারণ নিয়ে পুরাণে পুরাণে মতভেদ আছে। কিন্তু ভেদ যাই থাকুক, কারণ একটা ছিলই। একটি পুরাণে অমৃত লাভ করা বা অমৃত পান করার পূর্বাবস্থা বর্ণিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে দেবতাদের অবস্থা খুবই খারাপ। অসুর-দানবদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা মোটেই পেরে উঠছেন না। মাঝে মাঝে তাদের অস্ত্রাঘাত এমন কঠিন হয়ে বাধছে দেবতাদের বুকে যে, তাদের অনেকেই মারা যেতে আরম্ভ করলেন। তাদের আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি রইল না–
তদা যুদ্ধে সুরৈর্দো বধ্যমানাঃ শিতায়ুধৈ।
গতাসবো নিপতিতা নোত্তিষ্ঠের স্ম ভূরিশঃ।
ধরে নিই, এই অবস্থায় তারা সুমেরু পর্বতের সু-উচ্চ শিখরে উঠে সমুদ্র মন্থন করার কথা ভাবতে আরম্ভ করলেন।
অন্যতর আরও একটি বিখ্যাত পুরাণে সমুদ্রমন্থনের কারণ একেবারেই ভিন্নতর। সেখানে দেখা যাচ্ছে ব্যাপা মুনি দুর্বাসা পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন –চচার পৃথিবীমিমা। ভ্রাম্যমাণ মুনির সঙ্গে এক বিদ্যাধর বধুর দেখা হয়ে গেল এক মুক্ত বনস্থলীর মধ্যে, একান্ত আকস্মিকভাবে। কোনও পুরাণ মতে ইনি হলেন অপ্সরা সুন্দরী মেনকা। যাই হোক মেনকাই হোন, আর বিদ্যাধরীই হোন তার হাতে জড়ানো ছিল গন্ধে উন্মাদ করে দেওয়া একটি মালা। মালাটি স্বর্গের সন্তানক পূষ্প দিয়ে তৈরি। এমন তার গন্ধ যে সমস্ত বন সেই গন্ধে মম করছিল; সেই বনের পথ বেয়ে যারা আসছিল তারা সবাই আকৃষ্ট হচ্ছিল এই উন্মাদিনী মালার গন্ধে। ওই বনের পথে সেই বিদ্যাধরীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খ্যাপা দুর্বাসার।
পুরাণকার এই অধ্যায়ের প্রথমাংশে উন্মত্ত শব্দটা ব্যবহার করেছেন অন্তত পাঁচ পাঁচ বার। প্রথমত দুর্বাসার চেহারা ছিল ‘উম্মত্ত’ পাগলের মতো উন্মত্তরূপধূ। তিনি যে ব্রত পালন করেছিলেন তা এতই দুষ্কর যে, তার কষ্টে মানুষ পাগল হয়ে যায়–উন্মত্ততধৃগ বিপ্রঃ। সেই দুর্বাসা বনভূমির মধ্যে বিদ্যাধরীর হাতে জড়ানো সন্তানক-পুষ্পের উম্মদ গন্ধ পেয়ে তার কাছে মালাখানি চেয়েই বসলেন। খ্যাপা মুনিকে দেখে বিদ্যাধর বধূ দ্বিতীয় কোনও চিন্তা না করে সাদরে সপ্রণিপাতে সন্তানক-মালা দিলেন মুনির হাতে। মুনি অধিকতর মর্যাদায় সেই মালা জড়িয়ে নিলেন নিজের মাথায়। ফুলের গন্ধে মাতাল মৌমাছিরা উড়ে এসে বসতে থাকল দুর্বাসার মাথায় জড়ানো মালায়। শুষ্ক ব্রতক্লিষ্ট চেহারার মধ্যে রুক্ষ জটাজুটে কোমল মধুর মালা জড়িয়ে উন্মত্তের মতো মুনি পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন-তামাদায়াত্মননা মূর্ধি … পরিবভ্রাম মেদিনীম্।
ঠিক এই রকমভাবে ভ্রমণ করতে করতে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে। মদমত্ত ঐরাবতে চড়ে তিনি হেলে-দুলে আসছেন। না, দুর্বাসা তাতে কোনও রাগ করেননি। মদোন্মত্ত হাতি, দুলে দুলেই তো আসবে। কিন্তু বহু পরিভ্রমণের পর দেবরাজ ইন্দ্রকে দেখে এতই আনন্দিত হলেন যে, তিনি তাঁর মস্তকলম্বী উন্মত্ত-পদা’ মালাখানি উন্মত্তের মতো ছুঁড়ে দিলেন দেবরাজের দিকে। দেবরাজ মালাটি ধরে নিলেন বটে, কিন্তু আধুনিক সভায়। সভাপতির মতো তিনি মালাখানি নিজে না পরে তা দুলিয়ে দিলেন গজরাজ ঐরাবতের মাথায়। দেখে মনে হল যেন কৈলাস-শিখর থেকে গঙ্গা নামছেন ভূঁয়ে।
যে মালা দুর্বাসার মাথায় ছিল সেই মালা সম্মান করে নিজের মস্তকে স্থাপন না করে ইন্দ্র যে হাতির মাথায় দুলিয়ে দিলেন, তাতেও দুর্বাসা ক্রোধ করেননি। কিন্তু সন্তানক-পুষ্পের উন্মাদ গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ঐরাবত হাতি তার শুড় দিয়ে টেনে নিল মালাটি। তারপর হাতির যেমন বুদ্ধি হয়। মালাটি শুড় দিয়ে খুব খানিকটা আঘ্রাণ করে সেটা পায়ের তলায় পিষে ফেলল গজরাজ ঐরাবত। ব্যস্। আর যায় কোথা। ব্রতক্লিষ্ট মুনি হয়েও যে দুর্বাসা বিদ্যাধরসুন্দরীর কাছ থেকে আগ্রহভরে চেয়ে নিয়েছেন, যে মালা একমাত্র দেবরাজের ইন্দ্রের হঠকারিতায় ভূমিতে নিষ্পিষ্ট হল–এই অমযাদা এবং অপরাধ দুর্বাসা সইতে পারলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দেবরাজকে অভিশাপ দিলেন–ওরে বদমাশ তুই ইন্দ্রের ঐশ্বর্য পেয়ে এতই গর্বিত এবং মত্ত হয়ে গিয়েছিস যে, আমার দেওয়া চিরলক্ষ্মীর প্রতীক সেই মালাটা তোর পছন্দ হল না। কোথায় মালাটা হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকাবি, কোথায় আমার পায়ে পেন্নাম করে বলবি–আমি আপনার প্রসাদ লাভ করে ধন্য হলাম, মুনিবর! তা না, মালাটা ফেলে দিলি মাটিতে–প্ৰসাদ ইতি নোক্তত্তে… ন চাপি শিরসা ধৃতা।
দুর্বাসা যথেষ্টই রেগে গেছেন। ক্রোধ এবং পরুষ ব্যবহার করার ব্যাপারে তিনি যে অন্য সহৃদয় মুনি-ঋষিদের সঙ্গে তুলনীয় নন, এ বিষয়ে তিনি নিজেও অত্যন্ত সচেতন। দেবরাজের অবমাননায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত অভিশাপ উচ্চারণ করলেন, তুই যখন লক্ষ্মীমতী মালাটাকে মাটিতে ফেলে দিলি তথন আজ থেকে তোর স্বর্গরাজ্য লক্ষ্মীহীন হয়ে যাবে তস্মাৎ প্রণষ্টলক্ষ্মীকং ত্রৈলোক্যং তে ভবিষ্যতি। অভিশাপ শুনে সঙ্গে সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্র হুড়মুড়িয়ে নামলেন ঐরাবতের গজ আসন থেকে। মুনিকে প্রণাম করে তখন দেবরাজ ইন্দ্র অনুনয় বিনয় আরম্ভ করলেন, যাতে অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন তাড়াতাড়ি। কিছুতেই কিছু হল না। দুর্বাসা বললেন, আমার দয়া-টয়া অত নেই বাছা– নাহং কৃপালু হৃদয়ো ন চ মাং ভজতে ক্ষমা। ওই সব দয়া-করুণা যাঁদের আছে, সেই গৌতম বশিষ্ঠ ইত্যাদি মুনিদের চিকৃত স্তবেই তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমি হলাম গিয়ে দুর্বাসা। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে, আমার এই জটজুটধারী ভ্রূকুটি-কুটিল মুখখানি দেখে ভয় না পায়। আর তাছাড়া তুমি যে এই বারবার তখন থেকে অনুরোধ-উপরোধ করে যাচ্ছ, তার কোনও ফল হবে না। আমি ক্ষমা করব না- নাহং ক্ষমিষ্যে বহুন্য কিমুক্তেন শতক্রতো।
দুর্বাসা দুর্বার গতিতে চলে গেলেন। আহত মনে নানা আশঙ্কা নিয়ে দেবরাজও চলে গেলেন অমরাবতীতে। গিয়ে দেখলেন–সমস্ত স্বর্গভূমি তার নিসর্গ সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। গাছে পাতা নেই, ওষধি ফুল অপধ্বস্ত, শীর্ণ লতা-বল্লরী শীর্ণতরা–ততঃ প্রভৃতি নিঃশ্রীকং সশং ভুবন-ত্রয়। স্বর্গভূমির দেবতারা সব বিমনা হয়ে রইলেন, ঋষিদের মনে যজ্ঞে মন নেই, তপস্বীরা তপস্যা করেন না, মানুষেরা দান-ধ্যানে ভুলে গেল।
তৎকালীন দিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যজ্ঞ-দান-তপস্যার বহুতর বিঘ্ন ঘটেছে মানেই অবস্থা যথেষ্ট সংকটময়। কিন্তু আমার প্রস্তাব এবং প্রকরণের জন্য যে সমস্যাটা দরকার, সেই সমস্যাটার কথা এইবার আসবে। পুরাণকার বললেন– স্বর্গের এই বিধ্বস্ত অবস্থায় সমস্ত লোক লোভে এমন উন্মত্ত হয়ে উঠল যে, সবাই ছোট-খাট জিনিস নিয়েও ঝগড়া করতে লাগল-লোভাপহতেন্দ্রিয়াঃ। স্বল্পে’ পি হি বভূবুস্তে স্বাভিলাষা দ্বিজোত্তম। সমস্ত জগৎ নিঃশ্রীক। এবং সত্ত্ব গুণ বিরহিত হওয়ার ফলে দৈত্য-দানবেরা এবার দেবতাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করা আরম্ভ করলেন। দেবতাদের শক্তি হল সত্ত্বগুণ আর সত্ত্বহীনতাই দৈত্য দানবের। শক্তি। ফলে এই সময়ে অসুর-দানবদের তেজোবৃদ্ধি ঘটায় তারা এবার দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন এবং বলহীন দেবতাদের হারিয়ে দিলেন দেবান্ প্রতি বলোদ্যোগং চর্দৈতেয়-দানবাঃ। বিজিতান্ত্রিদশা দৈত্যৈঃ…
অসহায় বিপন্ন দেবতারা চিন্তিত মনে প্রজাপতিব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা তাঁদের সবাইকে নিয়ে উপস্থিত হলেন তিন ভুবনের পালক ভগবান বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু দেবতাদের করুণ অবস্থা অনুভব করে বললেন, আমি তোমাদের সাহায্য করব, তোমরা সমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভ করার ব্যবস্থা করো-মথ্যতাম অমৃতং দেবাঃ সহায়ে ময্যবস্থিতে।
আমরা এতক্ষণে সেই প্রতিপাদ্য বিন্দুতে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে পুরাণগুলি এবং মহাভারত একই কথা বলছে- দেবগণ তোমার অমৃত মন্থন করো। কিন্তু পুরাণগুলি ঘেঁটে মর্মকথা যেটা বেরিয়ে এল, সেটা হল-সমুদ্র মন্থনের কারণ, অর্থাৎ দেবভূমি স্বর্গরাজ্য নিঃশ্ৰীক, সৌন্দর্যহীন, বৃক্ষলতাহীন হয়ে গিয়েছিল, দেবতাদের কিছুই করণীয় ছিল না এবং অসুর দানবেরা স্বর্গরাজ্য দখল করে নিয়েছিল। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় মহাভারতের বর্ণনায় আমরা দেবতাদের সুমেরু পর্বতে আরোহণ করতে দেখেছি বস্তুত আমরাও একই সঙ্গে সেই সুমেরুর উচ্চ চুড়ে আরোহণ করে দেখতে পারতাম যে, জায়গাটা কেমন? কিন্তু সেই ভৌগোলিক বিবরণের আগে প্রয়োজনের প্রশ্নটা আছে–এই দেবতারা কারা? অসুর-দানবেরা কারা? অথবা আগে মানুষই বা কারা? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দেবতাদের সমুদ্রমন্থনের। আগে আরও একবার আমাদের মহাভারত এবং পুরাণ সমুদ্র মন্থন করতে হবে। আরও একটা কথা হল সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান এমনই এক বিষয় যা শুধু উপাখ্যান বা আখ্যায়িকমাত্র নয়, সমুদ্র-মন্থনে যেহেতু ব্ৰহ্ম বিষ্ণু মহেশ্বর সহ সমস্ত অসুর-দানব নাগ এবং স্বর্গরাজ্যের দেবতা সকলেই ‘ইনভলভড’ সেই হেতু দেবতা, অসুর এবং অন্যান্যদের পরিচয় দেওয়া আমাদের। নিতান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আমরা চাই, এই আবশ্যক কাজটা মহাভারতের সমুদ্রমন্থনের সূত্র ধরেই আসুক। তাতে দেবতা এবং অসুরেরা পিচ পরমেশ্বর বিষ্ণুও ঠিক কী ‘পোজিশনে দাঁড়িয়ে আছেন–সেটা বোঝা যাবে। তার পরে আরম্ভ হবে পরিচয় করিয়ে দেবার কাজ–দেবতা, অসুর, মানুষ—সবার।
মহাভারতে বিষ্ণু ব্রহ্মাকে বলেছেন–দেবতা এবং অসুরেরা সবাই মিলে সমুদ্র মন্থন করুক, তাতেই অমৃত পাওয়া যাবে দেবৈরসুরসঘৈশ্চ মথ্যতাং কলশোদধিঃ। ভগবান বিষ্ণুর আদেশটা যথেষ্টই পরিষ্কার। কিন্তু এই আদেশের মধ্যে যে গুপ্ত কথাটা আছে, সেটা বলতে মহাভারতের কবির রুচিতে বেধেছে। কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক পুরাণকারেরা সেই গুপ্ত কথাটা ফাস করে দিয়েছেন। আমরা এর আগে বলেছি যে স্বর্গভূমি তার সৌন্দর্য হারিয়েছিল এবং দৈত্য দানবেরা দেবতাদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বর্গভূমি থেকে। তাদের যে লাভ খুব একটা হয়েছিল তা নয়, কারণ ধন-সম্পদহীন একটি গজভুক্ত কপিথবৎ ভূখণ্ড লাভ করে তাদের আর শ্রী বাড়বে কতটুকু। কিন্তু মনুষ্য-সমাজের চিরন্তন বিরোধিতার একটা মনস্তত্ত্ব এর মধ্যে আছে। একটি ভাঙা বাড়ি অথবা অনুর্বর ভূমি নিয়েও যদি জ্ঞাতিশত্রুতা বাধে, তবে জয়ী হলে সেই ভাঙা বাড়ি অথবা নিষ্ফলা ভূমির অধিকার বোধই কিন্তু পরম তৃপ্তি দেয়। হয়তো অসুরদেরও সেই তৃপ্তি হয়েছিল।
ভাগবত পুরাণে দেখা যাচ্ছে–অমৃত মন্থনের প্রস্তাব করেই প্রভু নারায়ণ দেবতাদের। পরামর্শ দিলেন–যাও তোমরা আপাতত শুক্রাচার্যের শিষ্য অসুরদের সঙ্গে সমস্ত ঝগড়া। মিটমাট করে নাও। মিটমাট করে ততদিন সামলে থাক, যতদিন না অমৃত ওঠে-যাও-দানব দৈতেয়ৈঃ তাবৎ সন্ধি বিধীয়তাম। যারা মেরে-কেটে পালিয়ে গেল, তাদের সঙ্গে সন্ধি? দেবতাদের মনে লজ্জা দ্বিধা দুই-ই হল। প্রভু নারায়ণ দেবতাদের অন্তর বুঝে বললেন বাপু হে! দরকার পড়লে শত্রুর সঙ্গেও মিটমাট করে কাজ গুছিয়ে নিতে হয়–অরয়োপি সন্ধেয়াঃ সতি কার্যার্থে গৌরবে। তারপর? তারপর সাপ আর ইঁদুরের গল্প। একই আধারে এক বস্তার মধ্যে সাপ আর ইঁদুর আটকা পড়েছে। এবার সেই আবদ্ধ স্থান থেকে পথ বার করবার জন্য সাপ প্রথমে ইঁদুরের সঙ্গে সন্ধি করে। তারপর যখন পথ তৈরি হয়ে যায়, তখন খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। সময়ে মূষিক সাপের পেটে যায়– অহি মূষিকবদদেবা হ্যর্থস্য পদবীং গতৈঃ। অর্থাৎ অমৃত ওঠা পর্যন্ত ভাব করবে অসুরদের সঙ্গে। তারপর দেখা যাবে।
বিষ্ণু পুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণ এসব কথা না বললেও সমুদ্র মন্থনে অসুরদের প্রয়োজনটা বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভু নারায়ণ বুঝতে পেরেছিলেন–সমুদ্র মন্থন করতে যে। অসম্ভব শক্তি লাগবে সেই অসম্ভব শক্তির জোগান দেওয়া একা দেবতাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নারায়ণ তাই বলেছিলেন-তোমরা সাহায্যের জন্য অসুরদের কাছে যাও, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলবে মিষ্টি করে। বলবে– সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উঠলে আমরা-তোমরা দু’পক্ষই সমান ভাগ পাব। অমৃত পান করে তোমরাও যেমন বলশালী হবে, তেমনই আমরাও বল লাভ করব– তৎপনাৎ বলিনো যুয়মমরা ভবিষ্যথ। নারায়ণ এবার পরিষ্কার করেই বলে দিলেন যে, দেব-দানবের দ্বৈত সাধনায় শেষ পর্যন্ত অমৃত যখন উঠবে, তখন তিনি এমন ব্যবস্থা করবেন–তথা চাহং করিষ্যামি–যাতে দেবদ্বেষী অসুরেরা অমৃতের ভাগ একটুও না পায় এবং দেবতারাই পান সবটা। ভাগবত পুরাণ নারায়ণের জবানীতে বলেছে–শুধু কষ্ট করবে দৈত্যরা, কিন্তু ফল পাবে তোমরাক্লেশভাজো ভবিষ্যন্তি দৈত্য যুয়ং ফলগ্রহাঃ।
এইরকম মারাত্মক এক পরিকল্পনার পর স্বাভাবিকভাবেই দৈত্য-দানবদের সঙ্গে দেবতাদের সাময়িক সন্ধি হল। কিন্তু সন্ধির প্রস্তাবটা কোন দৈত্যরাজ মেনে নিলেন, সে প্রসঙ্গে মহাভারত যেমন নীরব, অধিকাংশ পুরাণও তেমনই নীরব। শুধু মৎস্য পুরাণ, ভাগবত পুরাণের মতো দু-একটি পুরাণ এব্যাপারে ঐতিহাসিকের কর্তব্য সেরে বলছে যে–দেবতারা পুরুষোত্তম বিষ্ণুর সঙ্গে পরামর্শ সেরেই চলে গেলেন দৈত্যরাজ বলির কাছে উপেয়ুবলিং সুরাঃ। মৎস্য পুরাণে এতটাই বলা হয়েছে যে, দেবতারা যেন অন্তত কিছুকাল দৈত্যরাজ বলিকেই নিজেদের প্রভু বা স্বামী বলে মানেন-দানবেন্দ্রা বলিঃ স্বামী স্তোককালং নিবেশ্যতাম্। অসুর দৈত্যদের তখন এমনই দেব বিদ্বেষ ছিল যে, দেবতাদের দেখলেই তারা যুদ্ধোদ্যোগ শুরু করে দিতেন। অতএব হঠাৎ করে অনেকগুলি দেবতাকে একসঙ্গে আসতে দেখেই তারা অস্ত্র হাতে সজ্জিত হলেন। দেবতাদের হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না, অতএব নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করাটা যে নিতান্ত অন্যায় হবে, সে সম্বন্ধে আর কেউ না থোক, অন্তত দৈত্যরাজ বলি অবহিত ছিলেন।
মহারাজ বলি খুব কম লোক নন। বলির জন্ম এমনই এক বিখ্যাত বংশে, যে বংশে পরপর। কয়েকজন অসুর রাজা পরম বিখ্যাত হয়েছেন এবং তা এতটাই যে পরমেশ্বর বিষ্ণুকে অন্তত দু-তিনটি অবতার গ্রহণ করতে হয় অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে। তাছাড়া বলি মহারাজের ঠাকুরদাদা হলেন স্বয়ং প্রহ্লাদ।
আমাদের ধারণা দৈত্যকুলে এই প্রহ্লাদের পর থেকেই অসুরদের মধ্যে অন্তত অসুর রাজাদের মধ্যে অন্য ধরনের কিছু মূল্যবোধ তৈরি হয়। ফলে অসুরেরা দেবতাদের দেখে অস্ত্র হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৈত্যরাজ বলি তাদের নিষেধ করেন- নষেধ দৈত্যরা শ্লোক্যঃ সন্ধিবিগ্রহকালবিৎ। নিষেধ করেন, কেন না তিনি অশেষ কীর্তিমান (পুরাণের ভাষায় ‘শ্লোক্যঃ’) এবং কখন কার সঙ্গে সন্ধি করতে হবে অথবা কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, সেটা তিনি ভালমতই জানেন। অন্তত এখন এই অসহায় নিরস্ত্র দেবতাদের ওপর অস্ত্রক্ষেপণ যে তার মতো বড় মানুষকে মানায় না এটা তিনি বোঝেন।
মৎস্য পুরাণ যেমন বলছে, তাতে দেবতারাও দৈত্যরাজ বলির কাছে কাছে প্রার্থনা জানাবার সময় যথেষ্ট নত হয়েই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন আমরা তোমার সঙ্গে কোনও বিরোধ চাই না, দৈত্যরাজ। আমরা তোমার কথাতেই চলব আমরা তোমার ভৃত্য–অলং বিরোধেন বয়ং ভৃত্যাস্তব বলে’ধুনা। চল, আমরা এই মহাসমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভ করি। বস্তুত তোমার দয়াতেই এই অমৃত লাভ সম্ভব হবে- ত্বপ্রসাদা সংশয়ঃ। হাজার হলেও প্রহ্লাদের। নাতি। বলি সঙ্গে সঙ্গে রাজিই শুধু হলেন না, দেবতাদের আপাত স্তুতি স্তাবকতায় তিনি এতই খুশি হলেন যে তাদের অভয় দিয়ে বললেন- আমি একাই এই সমুদ্র মন্থন করে তোমাদের অমৃত এনে দিতে পারতাম-শক্তো’হমেক এবাত্র মথিতুং ক্ষীরবারিধি। আরে! দূর থেকে এসে যদি শত্রুও প্রণত হয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করে, তবে তার ব্যবস্থা না করলে পরলোকে যে আমার ঠাই হবে না কোনও।তা যাক গে, তোমরা যা বলছ, আমি তোমাদের প্রতি স্নেহবশত নিশ্চয়ই তা পালন করব –পালয়িষ্যামি তৎ সর্বান্ অধুনা স্নেহমাস্থিতঃ।
ভাগবত পুরাণের আরও একটা সংবাদ এই প্রসঙ্গে আমাদের দরকার।
ভাগবত বলেছে– দেবতাদের কথা বলি যেমন মেনে নিলেন, তেমনই মেনে নিলেন অন্য দৈত্য-দানবেরাও শম্বর, অরিষ্টনেমি ইত্যাদি দৈত্য নায়কেরাও যাঁরা সকলেই ত্রিপুরাবাসী শম্বরো’ বিষ্টনেমিশ্চ যে চ ত্রিপুরবাসিনঃ। এই ত্রিপুর’ নামের এই জায়গাটাকে আমাদের খুব নিবিষ্ট হয়ে মনে রাখতে হবে। আর সেখানকার অধিবাসী দৈত্যরাজ বলির সাঙ্গোপাঙ্গ অসুর পার্ষদদেরও মনে রাখতে হবে, কারণ একটু পরেই আমরা এই ত্রিপুরের কথায় আসব।
ওদিকে সমুদ্র মন্থনের জোগাড় যন্ত্র আরম্ভ হয়ে গেল। সোজা কথা তো নয়। সমুদ্র মন্থনের মন্থন দণ্ড নিবাচিত হল মন্দর পর্বত। সে পর্বতকে সমূলে উপড়ে নিয়ে আসা হল সমুদ্রের ওপর। নাগরাজ বাসুকি নাগদের পক্ষ থেকে দেব-দানব দুই দলেরই উপকারে শামিল হলেন। তিনি হলেন মন্থন রঞ্জু। স্বয়ং বিষ্ণু কর্ম-রূপ ধারণ করে স্থির কঠিন পৃষ্ঠের অবলম্বন। দিলেন সমুদ্রের তলায়, যাতে মন্দর পর্বতের মন্থন দণ্ডটি স্থান-ভ্রষ্ট না হয়। দেবতারা বিষ্ণুকে নিয়ে, আর দানবেরা বলি রাজাকে নিয়ে সদলবলে এসে পৌঁছলেন ক্ষীর সাগরের তীরে।
০১০. সমুদ্র মন্থনের প্রস্তাব
১০.
সেই যখন ভগবান বিষ্ণু সমুদ্র মন্থনের প্রস্তাব নিয়ে দেবতাদের বললেন, দৈত্যরাজ বলির কাছে যেতে, তখন তাঁদের তিনি বলেছিলেন, দৈত্য-দানবেরা যা চায় তাই মেনে নিও যুয়ং তদনুমোদধ্বং যদিচ্ছত্যসুরাঃ সুরাঃ। সমুদ্র থেকে মহামূল্য বস্তু কিছু উঠলে, তা নিয়ে যেন ‘এটা চাই সেটা চাই’ বলে লোভ কোরো না। অথবা জিনিসটা না পেলে ক্রোধবশে কিছু করে বোস না। দেবতারা বিষ্ণুর পরামর্শ শুনেছিলেন। দেব-দানব সকলেই যখন সমুদ্র মন্থনে উদযুক্ত হলেন, তখন স্বয়ং বিষ্ণু, দেবতাদের নিজ বুদ্ধি খাটাবার কোনও সুযোগ না দিয়ে কারণ বুদ্ধি খাটালে হয়তো দেবতারা বোকামিই করতেন–অতএব সেই ভয়েই বিষ্ণু নিজে এসে প্রথমে নাগরাজ বাসুকির মুখের দিকটা ধরলেন। যদিও মহাভারত কিংবা মৎস্যপুরাণের মতে ইনি নাগরাজ বাসুকি নন, ইনি অনন্ত বা শেষ নাগ। ইনি অনন্তই হোন অথবা বাসুকি, বিষ্ণু তার মুখের দিকটা ধরতেই তাকে অনুসরণ করে দেবতারাও সবাই বিষ্ণুর পিছনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
বিষ্ণুর বুদ্ধিটা ছিল সেই অভিজ্ঞা জননীটির মতো। জননীর দুই বালক পুত্র পিঠোপিঠি ভাই। তারা মাছের টুকরো বড় না ছোট তাই নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া করে। ছোট জন প্রতিদিন জেদের বশে বড় টুকরোটি চায় এবং পুরো খেতে পারে না, শেষ পর্যন্ত ফেলে দেয়। অথচ বড় জনের পাতে বড় টুকরোটি দেখলেই ক্ষোভে অভিমানে সে কেঁদেকেটে একসা করে এবং অবশ্যই ক্রন্দনের অস্ত্রে বড় টুকরোটি ছিনিয়ে নিতে সফল হয়। অভিজ্ঞা জননী শেষে ছোট মাছটাই প্রথমে দিতে আরম্ভ করলেন বড় ছেলের পাতে। ছোট জন নিজস্ব ধারণায় আগের মতোই দাদার থালা থেকে মাছ-ভাজা ছিনিয়ে নিত এবং জননী আপন অভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ায় বড় ছেলেকে বলতেন, দে বাবা দিয়ে দে। তুই না বড়। ছোট ভাই হয় না? ওই না হয় বড় টুকরোটা খাক। ছোটজন ছোট টুকরো বড় ভেবে পরমানন্দে মাছ ভাজা খায়। তিনজনেই আপন আপন নিয়মে খুশি হয়ে থাকলেন।
বিষ্ণুর ব্যাপারটাও প্রায় এইরকম। যেই না তিনি বাসুকি নাগের মুখের দিকটা গিয়ে ধরলেন অমনি দানব রাজা বলি সপার্ষদ এসে বিষ্ণুকে বললেন, আমরা কি এতই হেয়? অত্যন্ত অমঙ্গলের চিহ্ন, সাপের এই পুচ্ছদেশ আমরা ধরব কেন, আমরা কি এতই ফেলনা? দেখুন, নিত্য বেদপাঠ কি যাগযজ্ঞ আমরা সেগুলো যথেষ্ট করি। তাছাড়া কতবড় বংশে আমাদের জন্ম। স্বাধ্যায়–শ্রুত সম্পন্নাঃ প্রখাতা জন্মকৰ্মভিঃ। আমরা কি লেজের দিকটা ধরতে পারি, না সেটা আমাদের মানায়? বিষ্ণু সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হেসে দেবতাদের পেছনে নিয়ে বাসুকির পুচ্ছভাগ স্পর্শ করে দাঁড়ালেন স্বয়মান বিসৃজ্যাগ্রং পুচ্ছং জগ্রাহ সামরঃ।
স্থান বিভাগ অর্থাৎ কে কোনদিকে দাঁড়াবেন ঠিক ঠাক হয়ে গেল। দেবতা এবং দানব দুই পক্ষই আপন আপন নেতাদের জয়ঘোষ উচ্চারণ করে বাসুকির রঞ্জু দিয়ে মন্দর পর্বতকে ঘোরাতে লাগলেন। অসুরদের দেহে শক্তি অনেক বেশি; স্বয়ং বলিরাজ বাঁ হাতে নাগরাজের মাথাটি ধরলেন আর ডান হাতে টান দিলেন তাঁর অগ্ৰশরীরে। বিষ-ভীত দেবতারা টান দিলেন পুচ্ছ দেশে। সমুদ্র মন্থন আরম্ভ হল।
ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার হল–মহাভারত থেকে অধিকাংশ পুরাণ–সর্বত্রই দেখা যাবে যে, ভগবান বিষ্ণু সমস্ত দেবতাকে বলেছেন- তোমরা সমস্ত রকমের ওষধি আর লতা সমুদ্রের মধ্যে ফেলল, তারপর সমুদ্র মন্থন করো। দেব-দানবেরা সকলেই অতঃপর বহুতর বৃক্ষ-লতা ওষধি সমুদ্রে ফেলেছিলেন, তাছাড়া মন্দর পর্বতের গাছ গাছড়া, শিকড়ও প্রচুর পড়েছিল সমুদ্রে। সমুদ্র মন্থনের উপাখ্যান যেভাবে আরম্ভ এবং শেষ হয়েছে, তার সঙ্গে এই গাছ-গাছড়া শিকড় বাকড়ের সম্পর্ক কী, সে কথা পরে আসবে, আপাতত শুধু এই ঘটনাটির উল্লেখ করে রাখলাম।
সমুদ্র মন্থন করে কখন কী উঠল, কোনটা প্রথম পাওয়া গেল, তা নিয়ে মহাভারত পুরাণে, পরাণে পুরাণে নানা ভেদ বিকল্প আছে। মহাভারত বলেছে– নানা বৃক্ষের নির্যাস আর মথিত লতার রসের সঙ্গে কিছু সোনা মিশে যাওয়ায় যে তরল মিশ্রণ তৈরি হল, তাতে নাকি লবণ সমুদ্র ক্ষীর সমুদ্রে পরিণত হল। সেই দুগ্ধ–সাগর থেকে প্রথম পাওয়া গেল ঘৃত যা মানুষের আয়ুবর্ধক এক অতি উৎকৃষ্ট বস্তু বলে আমাদের মধ্যে পরিচিত রোত্তমৈ-বিমিশ্রঞ্চ ততঃ ক্ষীরাদভূদ ঘৃত। টীকাকার নীলকণ্ঠ টিপ্পনি কেটে বলেছেন– এতে আজগুবি ভাবার কিছু নেই। বাপু। আমাদের চিরকালের দেখা গরুগুলি কখনও এমনি জলও খায়। আবার নুন-জলও খায়। গরু সেই জলের সঙ্গে ঘাস পাতা আর অন্যান্য বর্জ্য বস্তু ভক্ষণ করেও উত্তম দুগ্ধই প্রসব করে, তাহলে বৃক্ষ লতার সমন্বয়ে লবণোদধি মন্থন করেই বা ঘি উঠবে না কেন- যথা ক্ষার অক্ষারং বা জলং গবি তৃণাদিরসং প্রাপ্য ক্ষীরং ভবতি, তদিত্যৰ্থঃ। আমাদের হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় কিন্তু আরও একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একে অলীক কল্পনা বলার কিছু নেইনালীকম্ ইদং সম্ভারয়িতুং শক্যতে। আসলে সিদ্ধান্তবাগীশ তার জীবকালেই ডালডা কিংবা ভেষজ বনস্পতি ঘৃতের আগমনী শুনতে পেয়েছেন। অতএব তার বক্তব্য–কেন বাবা আজকে ভেষজ বিজ্ঞানীরাও তত তৃণ বনস্পতি থেকে ঘি বানাচ্ছেন, অতএব এটাই বা অলীক হবে কেন- বৈজ্ঞানিকাশ্চ তৃণা ঘৃতমুৎপাদয়ন্তীতি নালীকমিদং সম্ভাবয়িং শক্যতে।
যাই হোক, সমুদ্রমন্থন করে উৎকৃষ্ট ঘৃতই উঠুক আর ভেষজ বনস্পতিই উঠুক, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল এই প্রাপ্তিটুকু অথবা আবিষ্কার। পণ্ডিতেরা অনেকে বলেন আর্যরা তাদের পূর্বভূমি থেকে এদিকে আসতে আসতে যত নতুন জিনিস দেখতে পেয়েছেন, সবই তারা সমুদ্র মন্থনের ফল বলে বর্ণনা করেছেন। সে যাই হোক, সমুদ্র থেকে ঘি ওঠার পরেই কিন্তু দেব-দানব সবারই দম ফুরিয়ে গেল। সামনে সমাসীন ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দেবতারা আর্জি জানালেন, কতকাল ধরে এই সমুদ্র মন্থন করে যাচ্ছি, অমৃত যে ওঠেই না প্রভু। একমাত্র বিষ্ণু ছাড়া দেব-দানব সবাই যে বড় ক্লান্ত হয়ে গেলেন ঋতে নারায়ণং দেবং সর্বে’ন্যে দেবদানবাঃ। সবার অবস্থা দেখে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে বললেন, আপনি সবাইকে বল দিন, ভগবান! সবাই যে ক্লান্ত হয়ে গেল।
বিষ্ণু বললেন, আমি সবাইকে শক্তি দিচ্ছি, তোমরা সমুদ্র মন্থন চালিয়ে যাও। এই শক্তি কোনও অলৌকিক ঐশ্বর্য কিনা জানি না, তবে বিষ্ণু হয়তো কর্মরত সমস্ত দেব-দানবকে সেইভাবে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন, যাতে আবার সবাই সমুদ্র মন্থনে লেগে পড়েন। সেই মন্থনের ফলে এবার পাওয়া গেল চাঁদকে। পূর্ব-দিগবধুর মুখ-চুম্বন করে চাঁদ উঠল আকাশে। পুরাণ-ইতিহাসের উদাসীন অকিঞ্চন বৈরাগী শিব সেই চাঁদকে চেয়ে নিলেন আপন জটাকলাপের আভূষণ হিসেবে–যযাচে শঙ্করা দেবো জটাভূষণকৃম্মম। এ খবর আমরা অবশ্য মহাভারতে পাইনি, মহাদেবের এই শশাঙ্ক-প্রার্থনার সংবাদ দিয়েছে পদ্মপুরাণ। স্বয়ং মহাদেব যেহেতু আহ্লাদ করে চন্দ্রকে যাচনা করে নিয়েছেন, তাই দেব-দানব কেউ সে ব্যাপারে কথা বললেন না।
মহাভারতের সমুদ্রমন্থন বর্ণনায় এবারে যাঁকে পাওয়া গেল, তিনি হলেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে নিয়ে দেব-দানবদের মধ্যে যে একটা বিশাল গণ্ডগোল পেকে গিয়েছিল, তার সম্বন্ধে মহাভারতের কবি একটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন পরে। কিন্তু লক্ষ্মীর আবির্ভাবের সময় কবি একেবারে নিশ্চুপ। ভাগবত পুরাণ কিম্বা পদ্ম পুরাণ কিন্তু জানিয়েছে যে, লক্ষ্মী লাভের জন্য দেবতা দানব সবার মধ্যে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। দানব দৈত্যরা অবশ্য বেশি কিছু করেননি। তারা শুধু একবার লোলদৃষ্টিতে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়েছিলেন। তা সে দেবতারাও তাকিয়েছিলেন। আর না তাকানোর মতো অহেতুক কিছু ছিল না। পৌরাণিক বর্ণনায় লক্ষ্মী যেভাবে সবার মধ্যে সলজ্জ হাসিতে, পায়ে নুপুরের ধ্বনি তুলে হাঁটতে আরম্ভ করেছিলেন–ততস্ততে নূপুরবস্তু শিঞ্জিতে / বিসপতী হেমলতেব সাবভৌ –তাতে দেব দানব সবারই দৃষ্টি পড়তে বাধ্য। যাই হোক, লক্ষ্মীর নিজের পছন্দটি কিন্তু একেবারে সপ্তম সুরে বাঁধা। দেব-দানব তার দিকে তাকিয়েই রইলেন শুধু, আর তিনি সাবহেলে বিসর্পিণী স্বর্ণলতার মতো আস্তে আস্তে গিয়ে ত্রিভুবনপতি ভগবান শ্রীহরির বুকে মুখ লুকোলেন- পশ্যতাং সর্বদেবানাং যযৌ বক্ষঃস্থলং হরেঃ। কিছু কিছু পুরাণ অবশ্য বলেছে যে, লক্ষ্মীকে দেখে দেব-দানবের সোচ্ছ্বাস অগ্রসর-ভাব পিতামহ ব্রহ্মাকে একটু চিন্তিত করে তুলেছিল। তিনি তাই দেব-সংসারে সবচেয়ে বুড়ো অভিভাবকের মতো লক্ষ্মীকে নারায়ণের হাতে তুলে দিলেন।
সমুদ্র মন্থন আবারও আরম্ভ হল। মহাভারতে কালকূট বিষ উঠেছে সবার শেষে। কিন্তু পৌরাণিকেরা অমৃত-মন্থনের উপাখ্যানে নাটকীয়তা সৃষ্টি করার জন্য বাসুকির মুখ দিয়ে বিষোদগার দেখতে পেয়েছেন আগেই। ভাগবত এবং অগ্নিপুরাণের মতো আবার প্রথমেই বিষ সৃষ্টি। বিষ্ণুপুরাণ এবং পদ্ম-পুরাণে দেখা যাচ্ছে সুরভি’র মতো আকুল মনমাতানো গন্ধ পাওয়া গেল আগে। অন্য মতে এই সুরভি হল স্বর্গের কামধেনুটি আর স্বর্গের সুগন্ধ বয়ে এনেছিল পারিজাত ফুল। সুরভির পরেই মন্থনের মুখে উঠে এসেছে উৎকৃষ্ট বারুণী মদ্য। মহাভারতে এই সুরার নামমাত্র উল্লেখ থাকলেও পদ্মপুরাণ এই সুরা-দেবীকে নায়িকার প্রতিরূপে চিহ্নিত করেছে। সে মদঘূর্ণিতলোচনা, স্বলিতপদা এবং টলটলে কাপড় পরা–দেবতারা নাকি ত্যাগ করেছিল তাকে, আর ঠিক সেই কারণেই অসুরেরা তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
আমাদের মৎস্য পুরাণ অবশ্য বারুশী মদ্যের ব্যাপারে সবচেয়ে বাস্তব তথ্যটি দিয়েছেন। একথা কিছুই অবোধ্য নয় যে, এতক্ষণ মন্দর-দণ্ড ঘুরিয়ে সমুদ্র মন্থন করে। দেব-দানব-দু’পক্ষেরই যা পরিশ্রম হয়েছিল, তাতে তাদের শক্তি উদ্ৰিক্ত করবার প্রয়োজন ছিল। মৎস্য পুরাণ তাই বলেছে– নানা ওষধি আর জীব জন্তুর বসা মেদে তৈরি হল উৎকৃষ্ট বারুণী মদতদঘুমেদ-সোৎসর্গাবারুণী সমপদ্যত। বারুণীর গন্ধে দেব-দানব সাবই আকুল হলেন এবং অন্য পুরাণগুলি দেবতাদের সম্মান রক্ষার জন্য যতই বলুন–তারা মদ্য স্পর্শ করেননি, আমরা জানি- দেব দানবেরা সবাই বানিকটা করে বারুণী পান করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করে নিলেন তদাস্বাদেন বলিনো দেবদৈত্যাদয়ো’ভব। দ্বিগুণ শক্তিতে পুনরায় মন্দর পরিবর্তন আরম্ভ হল।
দেব দানব সকলের মিলিত শক্তিতে সমুদ্র থেকে অনেক কিছুই উঠেছিল। ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব, নন্দনের মন্দার মঞ্জরী– এগুলি তো মন্থনের সাধারণ ফল। বিষ যা উঠেছিল মহাদেব তা পান করে নীলকণ্ঠ হলেন। পৌরাণিকদের অনেক কাহিনী এবং মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের পরম্পরায় অনেকের মধ্যে এইরকম ধারণা আছে যে, স্বয়ং লক্ষ্মী অমৃতের পাত্র হাতে উঠেছিলেন সমুদ্রের গভীর থেকে। কিন্তু আমাদের মহাভারত এবং অধিকাংশ পুরাণে যা পাই তাতে দেখা যায় অমৃতের ভাণ্ড হাতে নিয়ে যিনি সমুদ্র থেকে উঠলেন, তিনি হলেন দেব বৈদ্য ধন্বন্তরী। শুভ্র কমণ্ডলুর মধ্যে অমৃত ধারণ করে ধন্বন্তরী দাঁড়ালেন দেব-দানবে সবার সামনে–শ্বেতং কমণ্ডলুং বিভ্র অমৃতং যত্র তিষ্ঠতি।
যে বস্তুর জন্য এত অপেক্ষা এত পরিশ্রম, এমনকি যার জন্য দেব-দানবের চিরন্তন বিরোধ পর্যন্ত সাময়িকভাবে মিটে গেছে, সেই অমৃত উঠেছে–এবারে কিন্তু প্রথমে দৈত্য-দানবের মধ্যে একেবারে শশারগোল পড়ে গেল। সবাই বলে আমি নেব অমৃত। এ বলে, আমি খাব ও বলে, আমি খাব –অমৃতার্থে মহান্নাদো মমেদমিতি জল্পতা। মহাভারত, কী পুরাণ এতক্ষণ যেমন দেখেছেন, তাতে সম্পূর্ণ সমুদ্র মন্থনকালে অসুর দানবেরা সবাই একেবারে নীরব ছিলেন। দেবতারা যেভাবে কথাটা বলেছিলেন, অর্থাৎ অমৃত পাওয়া গেলে সমান ভাগে ভাগ করে নেব আমরা, সেই কথাটায় অসুরেরা এত বিশ্বাস করেছিলেন যে, অন্য কোনও পদার্থ-হাতি ঘোড়া পারিজাত ফুল,কৌস্তভ মণি কিচ্ছুটি তারা চাননি। একটি একটি করে ভাল জিনিস উঠেছে, সবই দেবতারা ভাগ করে নিয়েছেন–যতে দেবাস্তবতা জগুরাদিত্যপথমাশ্রিতা। তারপর তিন ভুবনের ধনৈশ্বর্যবিধায়িনী লক্ষ্মীও যখন ভগবান নারায়ণের বক্ষঃলগ্না হলেন, তখন তারা তাদের একমাত্র ভরসা ধন্বন্তরীর হাতে রাখা অমৃত পাত্রের দিকে হাত বাড়ালেন
ততস্তে জগৃহ দৈত্যা ধৰন্তরিকরে স্থিত।
কমণ্ডলুং মহাবী যত্রাস্তে ত দ্বিজামৃত।
এত চেষ্টা সত্ত্বেও অমৃত লাভ করা সম্ভব হল না দৈত্যদের পক্ষে। ভগবান নারায়ণ দেবতাদের আগেই কথা দিয়েছিলেন অতএব সেই মতো তিনি অপূর্ব মোহিনী মূর্তি ধারণ করে দাঁড়ালেন দৈত্যদের সামনে। মোহিনী রমণীর রূপ দেখে অসুরেরা এতটাই মোহিত হলেন যে, তারা পরম বিশ্বাসে ধন্বন্তরীর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া সেই অমৃতের কমণ্ডলু দিয়ে দিলেন রমণীর হাতে। রমণী মায়াবিনী– সমস্ত দৈত্যকে তিনি পংক্তি ভোজনে বসিয়ে দিলেন, কিন্তু অমৃতের ভাগ তিনি দিলেন না। দৈত্যরা শুধু চেয়ে চেয়ে রমণীর ললিত-গতি, উচ্চাবচ শরীর বিভঙ্গ দেখে মেতে রইল।
ভারি আশ্চর্য, লোকের ধারণা– কালো মেয়ে নাকি (সৌন্দর্যের) কোনও কনসেপ্টের’ মধ্যে আসে না, কিন্তু মহাভারতের কবি যেহেতু পরেও বিশেষত দ্রৌপদীর মধ্যে কালো মেয়ের শ্ৰেষ্ঠতা নিরূপণ করবেন, অতএব এই মোহিনী মূর্তির মধ্যেও আমরা সেই কালো রূপের মর্যাদা দেখতে পাব। মহাভারতের কবি যেহেতু অতি সংক্ষেপে এই বর্ণনা সেরেছেন, অতএব এখানে না পেলেও আমরা ভাগবত পুরাণে খবর পেয়েছি যে, বিষ্ণুর সেই মোহিনী মায়া মুর্তি ছিল নিকষ কালো–প্রেক্ষনীয়োৎপলশ্যামাং সাবয়ব-সুন্দর। নবীন বয়সী রমণীর কাঞ্চী দামে উদ্বেলিত হাঁটা চলায় তথা স্তনভারকৃশোদরী’ মোহিনীর উদ্দাম কটাক্ষে বশীভূত দৈত্য দানবদের মনে জেগে উঠল কামনার আগুন–দৈত্য-যুথপ চেতঃস্ কামম্ উদ্দীপয়ন্ মুহুঃ। যারা এতক্ষণ, অমৃত পানের জন্য ‘অহং পূর্বং অহং পূর্বং’–আমি আগে আমি আগে–করছিলেন, তাঁরা স্তব্ধ হয়ে বসে শুধু রমণীর কটাক্ষ ভিক্ষা করছিলেন।
আর এই মোহিনীও তো যে সে নয়, স্বয়ং বিষ্ণু দৈত্যদের প্রতারণা করার নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই মোহিনী মূর্তি ধারণ করেছিলেন। তাছাড় মনোহরণ শরীর বিভঙ্গেই শুধু নয়, পদ্মপুরাণ বলেছে– মোহিনী দৈত্যদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন– আমি তোমাদের, তোমাদের ঘরেই আমি থাকব– যুস্মাকং বশগা ভূত্বা স্থস্যামি ভবতাং গৃহে। বিলুব্ধ দৈত্যরা রমণীকে লাভ করার বিশ্বাসে তারই হাতে অমৃতের পাত্র ন্যস্ত করলেন। আর তখনই তারা দেখতে। পেলেন–মোহিনী সেই অমৃত দেবতাদের পান করিয়ে দিলেন তাদেরই সামনে, আর এক একটি লোল অপাঙ্গ-পাতে দৈত্যদের থামিয়ে রাখলেন শুধুই।
সময় বেশি লাগেনি। দৈত্য-দানবেরা খানিক পরেই বুঝলেন–সব মায়া; বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় তারা প্রতারিত হয়েছেন। দেবতা এবং দানবদের মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এরই মাঝখানে অমৃত বিন্দু লাভ করে রাহু কেতুর কী অবস্থা হল, সে ঘটনা আর বলছি না। কারণ সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ এই রাহু-কেতুর রূপক আবরণে বাঁধা আছে। আমাদের বক্তব্য সেই দেবাসুর যুদ্ধে অসুরদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটেছিল, কারণ দেবতারা পূর্বাহ্নেই অমৃত পানে বলীয়ান হয়েছিলেন।
অমৃত জিনিসটা যে কী, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে রীতিমতো মতভেদ আছে। কেউ বলেন–সোমরস, কেউ বলেন-সোম অর্থাৎ চাঁদের জ্যোৎস্নাই অমৃত আবার কেউ বলেন–অমৃত অমৃতই, সোম বা চাঁদ হলেন সেই অমৃত ধারণ করার পাত্র-মাত্র। এ বিষয়ে আমাদের একটা নিজস্ব প্রস্তাব আছে। সহৃদয় পাঠকুল সে প্রস্তাব মানতেও পারেন আবার উপযুক্ততর প্রমাণ দিয়ে সে প্রস্তাব অমূলক প্রতিপন্ন করতে পারেন। বস্তুত অমৃত বস্তুটা কী তার সম্বন্ধে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে।
আমি আগে অন্যান্য পুরাণের প্রমাণে জানিয়েছি যে, অমৃত মন্থনের আগে দেবতারা কোনওভাবেই অসুরদের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তারা বারংবার অসুরদের হাতে প্রহার লাভ করছিলেন এবং অনেকে মারাও পড়ছিলেন। এখন যেহেতু সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উঠে এসেছে, অতএব কথাটা আরও একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আপনারা মৎস্য পুরাণের মতো প্রধান এবং প্রাচীন পুরাণে দেখবেন-সেকালে দেবতা এবং অসুরদের যুদ্ধ আরম্ভ হলে বেশি সংখ্যায় মারা পড়তেন দেবতারাই–পুরা দেবাসুরে যুদ্ধে হতাসবঃ সুরাঃ। কিন্তু দানব-দৈত্যরা যদি ভীষণভাবে আহত হয়ে মরণোন্মুখও হতেন, তবে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার সঞ্জীবনী মন্ত্রে বাঁচিয়ে তুলতেন তাদের। শুধুই মন্ত্র কিনা জানি না, কিন্তু দৈত্যগুরু মন্ত্রের সঙ্গে এমন ওষুধ দিতেন তার শিষ্য দৈত্যদের যাতে ক্ষত নিরাময় তো হতই, তারা মৃত্যুর মুখ থেকে জেগে উঠতেন সুপ্তোখিতের মতো জীবাপয়তি দৈত্যেন্দ্রা যথা সুপ্তোপিতানিব। এই মৃত সঞ্জীবনের মন্ত্র নাকি শুক্ৰ শিখেছিলেন দেবদেব মহেশ্বরের কাছ থেকে। একমাত্র শুক্র ছাড়া যেহেতু ব্ৰহ্মা বিষ্ণু, সুর নর দানব কেউই এই মাহেশ্বরী বিদ্যা জানতেন না, অতএব সর্বত্র শুক্রাচার্যের মর্যাদা ছিল আলাদা, তার মেজাজও ছিল আলাদা। এই প্রসঙ্গেই কচ-দেবযানীর কথাই পরে আসবে, তবে সে কথা পরেই হবে। আপাতত জানাই–শুক্রাচার্য যেহেতু অসুরপক্ষপাতী ছিলেন, তাই এই বিদ্যার প্রভাবে অসুরদের সবটাই ছিল সুবিধা আর অন্যদিকে দেবতাদের অসহায় মৃত্যু। তবে আমার মতে এই বিদ্যা যতটা মন্ত্রময়ী তার থেকেও বেশি ওষধিময়ী। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় অসুরদের বাড়বাড়ন্ত দেখে দেবরাজ ইন্দ্র, দেবগুরু বৃহস্পতি এবং অন্যান্য দেবতা একেবারে হতাশ হয়ে সমুদ্র মন্থনের কথা ভাবতে আরম্ভ করেন।
হাতি ঘোড়া, পারিজাত অথবা কৌস্তভ মণি, কি লক্ষ্মীদেবী সমুদ্র মন্থনের গৌণ ফল মাত্র। কিন্তু মুখ্য ফল যে অমৃত, তার শক্তি যে দেবতাদের সুস্থ করে তোলার কাজেই নিযুক্ত হবে, সেটা অসুরদের মৃতসঞ্জীবনীর প্রতি তুলনা থেকেই অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় কথা হল-সমুদ্র মন্থনের সময় যত বৃক্ষ লতা, ওষধিকে সমুদ্রে এনে ফেলতে বলা হচ্ছে বারবার। এটা একটা ‘পয়েন্টার’ মন্থনের ফলে যা উঠেছে– হাতিঘোড়া বাদ দিয়ে তার ক্রমিক পর্যায়টি লক্ষ করুন। মৎস্য পুরাণ বলেছে বিশাল বিস্তার মন্দর পর্বত ঘুরতে থাকলে অমৃত লক্ষ শ্বাপদ এবং ফল সমন্বিত বৃক্ষের সারাংশে পুষ্ট ওষধির রসে দুগ্ধসাগর দধিসাগরে পরিণত হল। তারপর সহস্র জীব শ্বাপদের বসামেদে দধিসাগর সুরায় পরিণত হল।
দেখুন, এখানে দুগ্ধ দধি অথবা ঘৃত সুরা এগুলি কিন্তু বড় কথা নয়। বড় হল–ক্রমিক পর্যায়গুলি। পুষ্পৌষধি বা বসা-মাংসের মিশ্রণে কী তৈরি হতে পারে তা নিয়ে পৌরাণিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে কিন্তু যে সমস্ত পৌরাণিকের বিভ্রান্তি নেই, তারা তাদের বক্তব্যে যথেষ্টই ঋজু। মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে পরিচিত হরিবংশ পুরাণে এই ঋজুতা দেখতে পাই। পৌরাণিক বলেছেন
সমস্ত দেবতা এবং অসুর লবণ সমুদ্রের জলে মন্দর পর্বতকে মন্থন-দণ্ড বানিয়ে সমুদ্র মন্থন করলেন। সমুদ্রের জলে ছিল হাজারো রকমের ওষধি-বীরুঘো হিমবদরসম্। সম্পূর্ণ হাজার বছর ধরে মন্থন করার ফলে সমস্ত ওষধি দুগ্ধে পরিণত হল এবং তা থেকেই উঠে এল অমৃত
সমাঃ সহস্রং মথিতং জল ওষধিভিঃ সহ।
ক্ষীরভূতং সমাযোগা অমৃতং প্রত্যপদ্যত।।
হরিবংশের এই ঋজু কথাগুলি কবি থেকে আরম্ভ করে ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক সবাই মেনে নিতে পারে। দেবতাদের প্রয়োজন ছিল ওষধিজাত এমন এক মৃত্যুঞ্জয়ী প্রলেপ যা তাদের বাঁচিয়ে রাখবে, যা তাদের মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে তুলবে অবলীলায়। এবারে মহাভারতে লক্ষ্য করে দেখুন–এই অমৃতের ঔষধ হাতে নিয়ে উঠে এলেন যিনি, তিনি কিন্তু আর কেউ নন, তিনি দেব-বৈদ্য ধন্বন্তরি। দেবকুলে তিনি আয়ুর্বেদের চিকিৎসক বলে বিখ্যাত। গরুড় পুরাণ ধন্বন্তরির হাতে ধরা অমৃতকে ঔষধের মর্যাদা দিয়েই সমুদ্র মন্থনের কাহিনী শেষ করেছে। পৌরাণিক বলেছেন- ভগবান শ্রীহরি ক্ষীরসাগর মন্থনের সময় ধন্বন্তরির অবতার গ্রহণ করেছিলেন। অমৃতের কমণ্ডলু হাতে নিয়ে তিনি ক্ষীর সাগর থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর তারপর? তারপর দেব-দানবের যুদ্ধ যতই লাগুক, ভগবান ধন্বন্তরি তার অমৃত বিদ্যা শিখিয়ে দিলেন তার প্রিয় শিষ্য সুতকে–
ক্ষীরোদমথনে বৈদ্যো দেবো ধন্বন্তরি হর্ভূৎ।
বিভ্রৎ কমণ্ডলুং পূর্ণ অমৃতেন সমুখিতঃ।
আয়ুর্বেদমষ্টাঙ্গং সুতায় স উক্তবান্।
দুগ্ধ, ঘৃত, ওষধি, ‘ফার্মেন্টেশন’- সুরা, অমৃত, ধন্বন্তরি এবং সুশ্রুত এক পংক্তিতে এগুলি যদি পর পর ঋজুভাবে সাজিয়ে দিই তবে অমৃতের অর্থ গিয়ে দাঁড়াবে সেই অশেষ রোগহর নিরাময়কারী ঔষধ, যা দেব দানবের যুক্ত পরিশ্রমের আবিষ্কার এবং যা হয়তো শুক্রাচার্যের মৃত-সঞ্জীবনীর তুলনায় আরও বেশি ফলপ্রদ, আরও বেশি আকাক্ষিত। তাই ছলে-বলে দেবতারাই সেই অমৃত অধিকার করতে ব্যস্ত হয়েছিলেন, আর অসুরেরা বাদ পড়েছিলেন মোহিনী মায়ায়। আমার মূল বক্তব্য কিন্তু বাকি রয়েই গেল। কারণ সমুদ্র মন্থন করে যে অমৃত উঠল, সেই অমৃতটুকু কিন্তু আমার প্রতিপাদ্য নয়, আমার প্রতিপাদ্য হল সেই বিষয়টুকু সে বিষ, যা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে দেবতারা জেতেন, সেই ছলনা, যাতে অসুরেরা পরাজিত হন।
.
১১.
অসুর-দানবেরা শত পরিশ্রম করেও অমৃতের অধিকার লাভ করতে পারলেন না, অন্যদিকে দেবতারা-মানুষ যাদের উদ্দেশে স্তুতি গান করেছে, মানুষ যাদের কাছে সহায়হীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছে-সেই দেবতারা অসুরদের সঙ্গে ছলনা করলেন। নিরপেক্ষ জনে ভাবতে আরম্ভ করল–দেবত্বের মধ্যে যদি সত্য, সত্ত্ব, সমদর্শিতা না থাকল, তাহলে কীসের দেবত্ব? কী হবে মনুষ্যত্বকে দেবত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে? বস্তুত অমৃত নিয়ে চিরকালীন এক কপট- নাটকের এই যে প্রস্তাবনা হল–তার নিন্দা সইতে হয়েছে দেবতাদেরই। লক্ষ্মী আর অমৃত–অন্য কিছু নয়, মহাভারতের মতে শুধু লক্ষ্মী আর অমৃতের অধিকার নিয়েই দেবতা আর অসুরদের বিরোধ শাশ্বতিক রূপ ধারণ করল-অমৃতার্থে চ লম্ফর্থে মহান্তং বৈরমাশ্রিতাঃ।
এই ঘটনার পর দেবতার প্রতি মানুষের নম্র নেত্রগাত, ধূপের ধোঁয়া আর সুমঙ্গলী স্তুতির নিরিখে দেবতাদের দেখতে চাই না, দেখতে চাই দেবতার বিরুদ্ধ পক্ষ অসুরদের অনুভব আর তর্ক-যুক্তিতে। বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের বিপরীত পক্ষে থেকে যে রাজনৈতিক দল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, সেই বিষময় শব্দরাশির মধ্যে আতিশয্য থাকলেও কখনও যেমন সত্যও থাকে, ঠিক তেমনই অসুরদের চরম আক্ষেপের মধ্যে অতিশয়োক্তি কিছু থাকলেও সত্যও আছে কিছু। বিশেষ করে অমৃত না পাওয়ার যন্ত্রণায় অসুরদের যে সব কথাবার্তা পৌরাণিকেরা লিপিবদ্ধ করেছেন, সে সব কথা মহাভারতের মধ্যে স্পষ্টভাবে বলা না থাকলেও সৌতি উগ্রশ্রবা অমৃত-মন্থনের কাহিনী বলে দেবতা, অসুর এবং অবশ্যই মানুষের পারস্পরিক স্থিতিটি নির্ণয় করে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, পুরাণকারের কথা বুঝলেই মহাভারতের মধ্যে অমৃত-মন্থনের কাহিনীটিও যথাযোগ্য হয়ে পড়বে।
দেবী-ভাগবত পুরাণের বর্ণনা মতো তখন দৈত্যদের অধিপতি ছিলেন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ। তার রাজত্বকালে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য একবার তপস্যা করতে গেলে দেবতারা দেবগুরু বৃহস্পতিকে পাঠালেন দৈত্যদের সঙ্গে ছলনা করতে। দেবগুরু শুক্রাচার্যের রূপ ধরে দৈত্যদের বিশ্বাস উৎপাদন করে নিলেন প্রথমে। তারপর তাদের নানা ভুল শিক্ষা দিলেন বছরের পর বছর। তপস্যা সেরে স্বয়ং শুক্রাচার্য যখন ফিরে এলেন তখন দৈত্যরা তাকে মানতেই চাইলেন না। যা হোক, শেষ পর্যন্ত শুক্রাচার্য নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন এবং দৈত্যরা সেই জোরে আবারও লিপ্ত হল সংগ্রামে। পৌরাণিক সংখ্যায় এই যুদ্ধ হয়েছিল সম্পূর্ণ একশো বছর ধরে এবং প্রহ্লাদ প্রথমে ভেবেছিলেন–যুদ্ধে আর জেতা যাবে না। কিন্তু দৈত্য-প্রধানেরা সাহস দিয়ে বললেন, দেখুন মহারাজ, জয়-পরাজয় অদৃষ্টের খেলা। অদৃষ্ট কেউ দেখেনি, কে সেই অদৃষ্ট নির্মাণ করে তাও জানি না–কেন দৃষ্টং ক বা দৃষ্টং কীদৃশং কেন নির্মিত। কাজেই আরও একবার যুদ্ধে যাব–যা হবার তা হোক।
একশো বছর নাই হোক, শত সংখ্যার গৌরবে অন্তত কয়েক বছর যুদ্ধ তো হয়েইছিল এবং শেষমেশ প্রহ্লাদের দল শুক্রাচার্যের কল্যাণে জিতে নিলেন দেবতাদের। ভীত সন্ত্রস্ত দেবতারা তখন আশ্রয় নিলেন মহামায়া চণ্ডিকার কাছে। তাকে স্তব করে তুষ্ট করলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। সিংহবাহিনী দেবী দেবতাদের আর্ত প্রার্থনা শুনে দেখা দিলেন এবং বললেন, ভয় পেয়ো না তোমরা। এই আমি যাচ্ছি, তোমাদের যাতে শুভ হয়, আমি সেই চেষ্টাই করব–ভয়ং ত্যজন্তু ভো দেবাঃ শং বিধাস্যে কিলাধুনা। দেবতাদের আশ্বাস দিয়েই সিংহারূঢ়াতি সুন্দরী দেবী প্রহ্লাদ এবং তার দৈত্য সেনাপতিদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ এবং তার দল-বল সবাই একটু ভয়ই পেলেন। তবুও মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে প্রহ্লাদ বললেন, পালিয়ে যাবার কোনও কারণ নেই। দরকার হলে যুদ্ধ করব। ইনি অবশ্যই উপস্থিত হয়েছেন দেবতাদের রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তবু আমরা পালাব না–যোদ্ধব্যং নাথ গন্তব্যং পলায্য দানবোত্তমাঃ। তোমরা ভয় পেয়ো না। আমি এখন এই ত্রিভুবন-পূজা মহামায়ার স্তুতি করব, কারণ তিনি সবার জননী এবং ভক্তদের তিনি সব সময় দেখেন–সর্বেষাং জননীং শক্তিং ভক্তানামভয়ঙ্করীম্।
খানিকক্ষণ স্তব করেই প্রহ্লাদ কিন্তু দেবীর কাছে দৈত্য-দানবদের চিরকালের সমস্যাগুলি অত্যন্ত সযৌক্তিকভাবে নিবেদন করতে আরম্ভ করলেন। বললেন, শত কোটি প্রণাম জানিয়েই তোমাকে বলছি মা। দেবতা কি দানব-তাতে তোমার কী যা, আসে মা? ছেলেরা ভালই হোক আর মন্দ, তুমি মা হয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাদের দেখবে কী করে–মাতুঃ পুত্ৰেযু কো ভেদো’ পশুভেযু শুভেষু চ? দেবতারা যেমন তোমার ছেলে, আমরাও তো তেমনই। তুমি না। বিশ্বজননী! তা তুমি যদি বল-তোরা অসুরেরা বড় স্বার্থপর, নিজেরটা ছাড়া কারোরটা বুঝিস না, তাহলে বলি মা, আমরা যেমন স্বার্থপর, দেবতারাও তেমনই স্বার্থপর-তেপি স্বার্থপরা নূনং তথৈব বয়মপত। যদি বল–তোরা দিন-রাত ভোগ-সুখ আর কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে আছিস, তাহলে বলব–দেবতারাও ওই নিয়েই আছে। তারাও বৈষয়িক সুখ-ভোগে মত্ত আছে, আমরাও আছি। তাহলেই দেখ–দেবতা আর অসুরে আদতে কোনও ভেদই নেই, তবুও যে তোমরা এরকম একটা ভেবে যাচ্ছ–ওরা ভাল, এরা খারাপ–এই ধারণাটা একেবারে ভুল গো জননী, এই ভেদটা তোমাদের মোহ–নান্তরং দৈত্য-সুরয়োর্ভেদো’য়ং মোহসম্ভব।
বিশ্বজননী চণ্ডিকার কাছে প্রহ্লাদ আজকে আর কিছু লুকোতে চান না। প্রহ্লাদ জানেন–স্বার্থপর, দোষী, ভোগী–এই কথাগুলি নিতান্তই সাধারণীকরণের মাত্রা। এতে কিছুই প্রতিপন্ন হয় না। তবু এই পদ্ধতিতেই তিনি সমস্ত ব্যাপারটা আরও একটু ফিলসফাইজ’ করে দিলেন-কারণ পরমেশ্বরী চণ্ডিকা পূর্বাহ্নেই দেবতাদের আর্তি শুনে এসেছেন, তার মনটাও এখনও দেবতাদের ব্যাপারে করুণাঘন হয়ে আছে। অতএব সাধারণীকরণের পদ্ধতিই আপাতত যুক্তিযুক্ত।
তার মধ্যে প্রহ্লাদ পরম বিষ্ণুভক্ত, বেদ-বেদান্ত, দর্শন তার ভালই জানা আছে। তিনি তাই একেবারে দার্শনিক যুক্তি সাজিয়ে বললেন, দেখ মা! দেবতারাও প্রজাপতি কাশ্যপের বংশধর, দৈত্য-দানবেরাও তাই। আমাদের মধ্যে তো কোনও বিরোধই থাকবার কথা নয়। তবে আমাদের ওপরেই কেন এই বিরুদ্ধ ভাব, মা জননী! তুমি অসুর আর দেবতাদের মধ্যে সাম্যভাব দেখাও, বিশ্বজননীকে সেটাই যে মানায়। দেখ মা, সত্ত্ব, রজঃ আর তমোগুণের ইতরবিশেষে দেবতা, অসুর–সবারই জন্ম হয়েছে, দেহধারী জীব মাত্রেই কাম, ক্রোধ, লোভ আছে, থাকবে। সেখানে তুমি দেবতাদের মধ্যেই শুধু গুণ দেখতে পাবে–এ কথাটা কেমন হল মা-গুণান্বিতা ভবেয়ুস্তে কথং দেবভূতোমরা?
প্রহ্লাদ এবার অভিমান করে বললেন, আমার তো মনে হয়, মা-যুদ্ধ দেখতে তোমার ভাল লাগে, তাই তুমি তোমার কৌতুকের সাধ পূরণ করার জন্য আমাদের মধ্যে এমন বিরোধ বাধিয়ে রেখেছ–ত্বয়া মিথথা বিরোধোয়ং কল্পিতঃ কিল কৌতুকাৎ। বাস্তবিক তোমার যদি ঝগড়া দেখতে ভাল না লাগত, তাহলে ভাইতে ভাইতে এমন বিরোধ লেগে থাকবে কেন? তোমার ইচ্ছেতেই এমনটি ঘটছে। প্রহ্লাদ এবার চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেবীকে বললেন, ধর্মের তত্ত্ব আমার কিছু জানা আছে মা—জানামি ধর্মং ধর্মজ্ঞে–আর ইন্দ্রকেও আমি ভালমতো জানি। কিন্তু শুধু বিষয়-আশয় নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে রয়েছে সব সময়। তা এই তিন ভুবনের ভার তো মা তোমার হাতে, তুমি সবাইকেই শাসন করতে পার। কিন্তু বিষয়-লালসার সওয়াল যেখানে, সেখানে কোন পণ্ডিত কথা রাখে, তুমিই বল মা?
প্রহ্লাদ ধাপে ধাপে উঠছেন। বিশ্বজননীর যুক্তি এবং নীতিবোধের কাছে তার প্রতিবেদন। প্রহ্লাদ দার্শনিকতার সঙ্গে পুত্রের অভিমান মিশিয়ে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের সাধারণীকরণের যুক্তিতে কথা বলেছেন এতক্ষণ। এবার তিনি দেবতাদের অন্যায় এবং স্বার্থপরতাগুলি একে একে দৃষ্টান্তের মতো উপস্থিত করছেন বিশ্বেশ্বরী জগজ্জননীর সামনে। সত্যি কথা বলতে কি, এই অংশটুকুর জন্যই আমি এই পুরাণ কথার অবতারণা করেছি, কারণ সমুদ্রমন্থন নিয়ে অসুরদের মধ্যে, বিশেষত মহামতি প্রহ্লাদের মনেও কত বিরূপ সমালোচনা অবদমিত হয়ে ছিল, তা এই অংশে প্রকট হয়ে উঠবে।
প্রহ্লাদ দেবতা এবং অসুরদের বিষয়-লালসার সাজাত্য দেখিয়ে এবারে দেবতাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। বললেন, এই যে এত বড় সমুদ্র মন্থন হয়ে গেল, দেবতা-অসুর সমানভাবেই কত পরিশ্রম করল, কিন্তু তার ফল কী? অমৃত বন্টনের ছলে ভগবান বিষ্ণুই তো দেবতা আর অসুরদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করলেন। আর বিষ্ণু! তিনি তো এই তিন ভুবন পালন-পোষণ করেন বলে জানি। তিনি নিজে কী করলেন? আপন লোভ চরিতার্থ করার জন্য তিনি নিজে স্বর্গসুন্দরী লক্ষ্মীকে আত্মসাৎ করলেন। তাও বুঝতাম–তিনি একটা বস্তু গ্রহণ করেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু তার প্রত্যক্ষ মদত পেয়ে ইন্দ্র তো সবই হস্তগত করল–অশ্বরাজ উচ্চৈঃশ্রবা, গজরাজ ঐরাবত অথবা সুরভির মতো একটি কামধেনু সবই বিষ্ণুর ইচ্ছায় ইন্দ্রের ভাগে গেল–সুরৈঃ সর্বং গৃহীতং বৈষ্ণবেচ্ছয়া। এত বড় বড় সব অন্যায় করেও দেবতারা তবু সাধু বলে নাম কিনলেন-অনয়ং তাদৃশং কৃত্বা জাতা দেবাস্তু সাধবঃ। আর আমরা হলাম যত খারাপ।
প্রহ্লাদ এবার দেবতাদের সম্বন্ধে নিজের মত পরিষ্কার করে জানালেন। সমুদ্রমন্থনের সময় দেবতাদের নানান স্বার্থপরতা উল্লেখ করে প্রহ্লাদ বললেন, তুমি যাই ভাব–দেবতারাই যত অন্যায় অনীতির মূল, অন্তত ধর্মনীতির দিক দিয়ে দেখলে তাদের দুর্নীতি-পরায়ণ বলে স্বীকার করতেই হবে–অন্যায়িনঃ সুরা নং পশ্য ত্বং ধর্মলক্ষণ। নীতি-ধর্মের কথা যখন উঠলই, তখন বিষ্ণুর দিকেই তাকাও না। ভগবান বিষ্ণু দরকার পড়লেই দেবতাদের ঠিক নিজের নিজের জায়গায় বসিয়ে দেন, আর আমাদের তিনি দেন শুধু পরাজয়ের যন্ত্রণা। বিষ্ণুর দিক থেকে এটা কি অন্যায় নয়? অন্তত ধর্মনীতি তো তাই বলে যে, এটা অন্যায়।
প্রহ্লাদ ধর্মের প্রশ্ন তুলে পূর্ব মীমাংসা, যুক্তিবাদ, বেদ, ব্রাহ্মণ, ধর্ম মীমাংসা–সবই ছুঁয়ে গেলেন, তারপরেই অনবদ্য তার্কিক যুক্তি সাজিয়ে সমুদ্রমন্থনে দেবতাদের স্বার্থপরতার কথা শেষ করে তাদের কামবশতার কথাও তুললেন, কারণ কামনা-বাসনার ব্যাপারে লোকে শুধু এককভাবে অসুরদেরই দায়ী করে, দেবতাদের নয়।
প্রহ্লাদ তাই রীতিমতো হতাশার ভাব ফুটিয়ে বললেন, কোথায় ধর্ম, কেমন ধর্ম, সাধুতাই বা কোথায়–আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও। এই সংসারে স্পৃহাহীন বৈরাগী কে আছেন অথবা কোনওদিন সেই বৈরাগীকে আমরা দেখতে পাব কি–নিঃস্পৃহঃ কোপি সংসারে ন ভবেন্ন ভবিষ্যতি। এই যে চন্দ্র, দেবসমাজে তো তার যথেষ্ট বড় জায়গা। তিনি তার পূজনীয় আচার্য-পত্নীকে জেনে-শুনে জোর করে হরণ করে নিলেন। আর দেবরাজ ইন্দ্র? ধর্মের সিদ্ধান্ত কি তিনি জানেন না? তিনিও তো গৌতম-গুরুর প্রিয়া পত্নীকে ধর্ষণ করলেন। আবার যদি দেবগুরু বৃহস্পতির কথাই ধর, তিনি তার অনুজ-পত্নীকে গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষণ করলেন এবং গর্ভদ্রুত তার শিশু-পুত্রটিকে অভিশাপ দিয়ে অন্ধ করলেন।
প্রহ্লাদ যতগুলি ঘটনার উল্লেখ করলেন, এগুলি পুরাণ-কথায় প্রত্যেকটিই দেবতাদের মানসিক বিচ্যুতির ঘটনা। কিন্তু সব কথা বলে প্রহ্লাদ আবারও এলেন বিষ্ণুর কথায়। তিনি নিজে বিষ্ণুভক্ত, অতএব বিষ্ণুর দিক থেকে কোনও অন্যায় ঘটলে তার সবচেয়ে বেশি বুকে বাজে। সমুদ্র-মন্থনে অমৃত লাভ করার পর তিনি যে বঞ্চনা করেছেন এবং আপন পৌত্র বলি-রাজার সঙ্গেও যে অন্যায় করেছেন বিষ্ণু, তাতে তার ক্ষোভ আছে যথেষ্টই। প্রহ্লাদ বললেন–সমুদ্র মন্থনের পর আমাদের রাহু যে লুকিয়ে একটু অমৃত পান করেছিল, তাতে কী এমন অপরাধ ঘটেছিল? ভগবান বিষ্ণু এত বড় সত্ত্বগুণের আধার হয়ে তিনি কিনা রাহুল মাথাটাই কেটে নিলেন–অপরাধং বিনা কামং তদা সত্ত্ববম্বিকে?
সবার শেষে প্রহ্লাদের নিজের বাড়ির ঘটনা এল। প্রহ্লাদ একেবারে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। জগজ্জননী চণ্ডিকার কাছে নালিশ জানিয়ে বললেন, অমন যে আমার ধার্মিক নাতিটি, তার কী হল? ধার্মিক, সত্যনিষ্ঠ বলে জগতে যাঁদের সুনাম আছে, আমার নাতি বলিরাজ তাদের মধ্যে অন্যতম। তার দান-ধ্যানের সীমা নেই। শান্ত, বিনয়ী, বেদবিহিত যজ্ঞ-কর্মে তিনি সর্বদাই ব্যস্ত-যজ্বা দানপতিঃ শান্তঃ সত্ত্বজ্ঞঃ সর্বপূজক। এমন যে ধর্মপরায়ণ আমার নাতিটি, ভগবান শ্রীবিষ্ণু বামন রূপ ধারণ করে ছলনা করলেন। শুধু কি তাই? তার রাজ্য হরণ করে তাকে নিঃশেষ করে দিলেন একেবারে! অথচ দেখ মা, তবু মনীষী সজ্জনেরা দেবতাদেরই শুধু ধার্মিক বলে। আসলে কী জান, ধর্ম-টর্ম জগতে এখন কিছু নেই, এ জগতে যারা চাটুকার তারাই জেতে, ধর্ম এখন চুলোয় গেছে–জয়ন্তি চাটুবাদাশ্চ ধর্মবাদাঃ ক্ষয়ং গতাঃ।
প্রহাদ তার বক্তব্য শেষ করলেন একেবারে অভিজ্ঞ যুক্তিবাদী আধুনিক বৃদ্ধটির মত। এত যুক্তি জগজ্জননী চণ্ডিকার পক্ষে একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব হয়নি। দেবতাদের স্বার্থপরতা এবং ত্রুটিগুলি তিনি স্বীকার করে নিতেও বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে অসুরদের তিনি স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠিতও হতে দেননি। তাদের বাবা-বাছা’করে পাঠিয়ে দিয়েছেন পাতালে।
এতক্ষণ ধরে দেবী-ভাগবত পুরাণ থেকে অসুরদের জবানীতে এই যে দেব-সমালোচনা শোনালাম, তার কারণ এই নয় যে, এই পুরাণখানিকে আমি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মনে করি। দেবী-ভাগবত পুরাণে দেবী চণ্ডিকার মাহাত্ম্যই প্রথম এবং শেষ কথা, ফলত স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু পর্যন্ত এখানে এক বিষ্ণুভক্তের মুখেই সমালোচনার পাত্র। কিন্তু তবুও দেবী-ভাগবতের এই অংশটুকু স্মরণ করলাম এই কারণে যে, দেবতা এবং অসুরদের পারস্পরিক স্থিতিটা এই সমালোচনা থেকে বুঝতে সুবিধা হবে। মহাভারতের অমৃত-মন্থন-পর্বে দেবতা এবং অসুরদের ন্যায়-অন্যায়ের বাহ্যিক একটা ইঙ্গিত আছে, সেই ইঙ্গিতটা পুরাণগুলির মধ্যে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু দেবী-ভাগবত পুরাণে যেহেতু আলোচনার সঙ্গে সমালোচনাটাও বাড়তি পাওয়া গেল, তাই সেটা উল্লেখ করে আমি আমার অন্য উদ্দেশ্যগুলিও সাধন করতে চাইছি, যদিও সেই সাধনায় অন্যান্য পুরাণ তথা ভারতীয় দর্শনগুলিও আমাদের সাহায্য করবে।
বস্তুত ছলনা, হিংসা, অসংযম, স্বার্থপরতা, ধর্ষণ–এই অন্যায় আচরণগুলিকে আমরা সব সময় অসুর-রাক্ষসদের ক্রিয়া-কাণ্ড বলেই এতকাল ভেবে এসেছি। এমনকি মনুষ্য-সমাজের মধ্যেও যাদের মধ্যে আমরা ইন্দ্রিয়-বৈকল্য তথা কাম-ক্রোধ-হিংসা বেশি দেখতে পাই, আমরা আর তাদের মানুষ বলি না। অসুরদের সম্বন্ধে কোনও ধারণা না থাকলেও আমরা সংযমহীন, অনিয়ন্ত্রিত মানুষের মধ্যে অসুরের চিহ্ন দেখতে পাই। একটি মানুষের গায়ে অসম্ভব শক্তি থাকলে আমরা তার মধ্যে আসুরিক শক্তি লক্ষ্য করি; এমনকি একটি মানুষ অতিরিক্ত ভোজন করলেও তাকে আমরা তুলনা দিই রাক্ষসের সঙ্গে এবং এর মধ্যে যদি কারও অতিরিক্ত খিদে থাকে, তো সেই খিদে রাক্ষুসে খিদে না হয়ে যায় না।
অন্যদিকে, এর বিপরীত কোটিতে যে সমস্ত মানুষের মধ্যে পবিত্রতা, সততা অথবা সত্ত্বগুণ বেশি লক্ষ্য করা যায়, আমরা তাদের দেবতা বলে সম্বোধন করি। যাঁদের মধ্যে দয়া এবং সহৃদয়তার মাত্রা সমধিক, তারা দেবতুল্য মানুষ বলে প্রতিনিয়ত তাদের কাছে আমরা নত হই। সংযতেন্দ্রিয়, নিঃস্বার্থ, নীতিযুক্ত মানুষ আমাদের কাছে দেবতার সম্মানেই সম্মানিত। মানুষই যখন এই পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন, সেখানে দেবতা মানেই তো তিনি পবিত্রতা, সততা অথবা নীতি-ধর্মের প্রতিমূর্তি।
বাস্তবে কিন্তু ঘটনাগুলি এত সাধারণ বা বৈচিত্র্যহীন নয়। পুরাণ ইতিহাসে দেবতাদের চরিত্র যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনুষ্য-সমাজকে যদি বাদ দিয়ে পুরোপুরি আলাদা করেও ফেলা। যায়, তবে দেবতাদের মধ্যেও প্রচুর আসুরিক গুণ দেখা যাবে, আবার বহু অসুরের মধ্যেও লক্ষ্য করা যাবে পবিত্র দেব-গুণ। আর মানুষের গুণ? সে তো দেবতা এবং অসুর–দুই পক্ষেরই সাধারণ ধর্ম। এই নিরিখে দেখতে গেলে একমাত্র মানুষই আমার কাছে শেষ পর্যন্ত দেবতা কিংবা রাক্ষসে পরিণত হবেন। সত্যি কথা বলতে কি-দেবতা কিংবা অসুর–এঁরা মানুষই কিনা সেটা প্রমাণ করতে হলে আমাকে বেগ পেতে হবে রীতিমতো।
এই বেগের আগেও অবশ্য আবেগের একটা ব্যাপার আছে। মনে রাখতে হবে–ভারতীয় দর্শনে ঈশ্বর’ বলে একটা কথা আছে। অনেকেই ঈশ্বর বা পরমেশ্বরের সঙ্গে দেবতাকে এক করে ফেলেন। বেদ-উপনিষৎ-পুরাণের মধ্যে ভারতীয় দেবতার যে বিবর্তন পাওয়া যায়, তাতে বেদের যুগ শেষ হতে না হতেই নূতন এক পরম তত্তের অন্বেষণ আরম্ভ হয়ে গেছে। পুরাণ-ইতিহাসের বর্ণনায় সমুদ্রমন্থনে নিযুক্ত যে সমস্ত দেবতাকে দেখলেন অথবা যে সমস্ত দেবতার সমালোচনা শুনলেন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কাছে, সেই ইন্দ্রাদি দেবতারা কিন্তু বেদের বর্ণনায় অসীম শক্তিধর। তবে কিনা বেদে ইন্দ্র, বায়ু, সোম, সূর্য ইত্যাদি যে যে দেবতার স্তুতি যখন যখন রচিত হয়েছে, তখন সেই সেই স্তুতি-সূক্তের মধ্যে কিন্তু সেই ব্যক্তি দেবতাই চরম মাহাত্ম্যে ধরা দিয়েছেন। অর্থাৎ বৈদিক ঋষি যখন ইন্দ্র-সম্বন্ধীয় সূক্ত রচনা করছেন, তখন অন্য দেবতারা গৌণ, ইন্দ্রই প্রথম এবং শেষ কথা। আবার যখন সূর্য-সূক্ত রচনা করছেন ঋষি, তখন সূর্যই সব, তিনিই মুখ্যতম, অন্যেরা অপ্রধান।
পণ্ডিতেরা বলেন, এইরকম বহু-দেবতার ব্যক্তি স্তুতির চরম পর্বে ক্লান্ত ঋষির হৃদয়ে এক এবং অদ্বৈত তত্ত্বের অন্বেষণ জেগেছে। দিনের পর দিন শত-সহস্র যজ্ঞে বৈদিক দেবতার ব্যক্তি-স্তুতি রচনা করতে করতে বৈদিক ঋষির মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত হতাশা ধ্বনিত হয়েছে–কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ-এত ঘি পুড়িয়ে হব্য-কব্য নিবেদন করে কোন্ দেবতার উদ্দেশ্যে আর আহুতি দেব আমরা? পণ্ডিতেরা বলেন, এই হতাশা থেকেই অদ্বৈত তত্ত্বের অন্বেষণ আরম্ভ হয়–যার চরম পরিণতি উপনিষদ আর বেদান্ত দর্শনের মধ্যে। উপনিষদের মধ্যে দেখা যাবে ইন্দ্র-বায়ু-সূর্যের মতো দেবতাদের স্থান নিতান্তই গৌণ, প্রায় মানুষের মতোই তাদের স্থিতি এবং অবস্থান। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল-উপনিষদের তত্ত্ব বা ব্ৰহ্মতত্ত্ব জানবার জন্য আমরা যাদের আগ্রহান্বিত দেখতে পাচ্ছি, তাদের মধ্যে দেবতা, অসুর এবং মানুষদের জায়গাটা একেবারেই সমান, একস্তর।
অবশ্য উপনিষদ বা বেদান্ত-দর্শনের চরম উপাস্য তত্ত্ব যে ব্রহ্ম, সেই তিনিও কিন্তু বেশিদিন তার কাঠিন্য বজায় রাখতে পারেননি। উপনিষদের জ্ঞান সাধনার ধারা এতই কঠিন, এতই তা গভীর এবং সূক্ষ্ম যে সেই পথে–ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া/দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি–সাধারণ জনের ঈশ্বর বিষয়িনী তৃষ্ণা একটুও নিবারিত হয়নি। উপনিষদের পূর্ব যুগের ইন্দ্রাদি দেবতার মূর্ত কল্পনা তখনও মানুষের মনে অম্লান, এবং বেদের প্রামাণ্য অবিসংবাদিতভাবে চিরন্তন। অন্যদিকে উপনিষদ বা বেদান্ত দর্শনের চরম দার্শনিক তত্ত্বগুলিও মানুষকে গভীরতা দেয়, তার দার্শনিক জিজ্ঞাসা পরিতৃপ্ত করে, তাকে মুক্ত পুরুষের মাহাত্ম্য দেয়। ঠিক এই রকম একটা অবস্থা থেকেই মানুষ-দার্শনিক এমন একটি দেবতাকে কামনা করে বসল–যাঁর রূপ-রস এবং আঙ্গিক হবে বৈদিক দেবতার মতো, আর তার অন্তরে থাকবে উপনিষদের সেই পরম তত্ত্ব-জ্যোতি। অর্থাৎ যিনি মানুষের প্রার্থনায় এবং ভালবাসায় ধরা দেবেন অথচ তার তত্ত্বটি হবে গভীর এবং জ্ঞানগম্য। আমাদের আলোচ্য মহাভারতে যেহেতু এইরকমই এক পরম দেবতার সন্ধান পাব আমরা, তাই আগেভাগেই আমরা তার আগমনী রচনা করছি।
মহাভারতের আখ্যান-উপাখ্যান মুলতুবি রেখে এই পরম দেবতার প্রতিষ্ঠা আমার সহৃদয় পাঠক-মণ্ডলীর কাছে যে হৃদয়গ্রাহী হবে না, তা জানি। আর আমি আনুষ্ঠানিক বা দার্শনিকভাবে সে প্রতিষ্ঠার বিস্তারে যাবও না। তার কারণ কৃষ্ণ যে কী করে আস্তে আস্তে ভগবান হয়ে গেলেন–মহাভারতের প্রক্ষেপবাদীদের কাছে তা যত আশ্চর্যের ঘটনাই হোক, আমার পক্ষে মহাভারতের প্রমাণ দিয়েই সেটা দেখানো কিছু অসম্ভব নয়। আরও অসম্ভব নয় এই জন্য যে, তিনি এক ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু কৃষ্ণকে নিয়ে আমি একটুও চিন্তিত নই, কারণ মহাভারতে তিনি স্বয়ং-প্রকাশ। আমি শুধু চিন্তিত সেই পরম ঈশ্বর নিয়ে–যাকে ক্কচিৎ আমরা কৃষ্ণ বলে ডেকেছি, শিব বলে ডেকেছি অথবা দুর্গা বলেও ডেকেছি–সেই পরম ঈশ্বর তত্ত্বকে যেন দেবতা বলে গুলিয়ে না ফেলি। আবারও বলছি, পরম ঈশ্বর বা ভগবান নয়, আপাতত আমার আলোচ্য শুধু দেবতা, অসুর এবং মনুষ্য। এই তিনটি প্রাণীকে বুঝে নিয়েই আমরা সৌতি উগ্রশ্রবার আসর ছেড়ে একেবারে মহারাজ জনমেজয়ের রাজসভায় উপস্থিত হব। কারণ নাগ, অসুর অথবা দেবতাদের কাহিনী বলে সৌতি উগ্রশ্রবা ততক্ষণে আমাদের মহাভারত-কথার মূল আসরে বসার যোগ্যতা তৈরি করে দেবেন।
.
১২.
ওঁরা বলেছেন, মনে বড় আনন্দ হয়। এমন আনন্দ, যা লাভ করলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এবং আনন্দ তার কাছে লঘু হয়ে যায়–যং লধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ। শম-দমের সাধন, এখানেও কিছু চাই না, মরে যাবার পরেও কিছু চাই না’–এমন একটা নিঃস্বার্থ ভাব, আর মুক্তির জন্য উদগ্র একটা ইচ্ছে–এই সব দুর্লভ যোগ্যতা যার আছে, তিনিই–একমাত্র তিনিই হলেন ব্রহ্মবিদ্যায় অধিকারী।
বেশ তো, ব্রহ্মবিদ্যার ছাত্র কী রকম হবে–সেটা তো বোঝা গেল, তা এই বিদ্যায় কার দেখা মিলবে? কী পাব? দেখা মিলবে সেই অমৃত জ্যোতির, পাবে পরম আনন্দ। তিনি কোথায় থাকেন? কোথাও না, কিন্তু সর্বত্র–তিনি অণুর থেকেও ছোট, সব চেয়ে বড়র থেকেও তিনি বড়।
এ তো কিছুই বুঝলাম না। ভীষণ কঠিন। হ্যাঁ কঠিন। ব্রহ্মতত্ত্ব বড় কঠিনই বটে। সহজ কিছু চাও তো ভগবানকে ডাক। তিনি ব্রহ্ম-স্বরূপ। তাকে কেমন দেখতে? ভারি সুন্দর। গোপবেশ বেণুকর, নবকিশোর নটবর। থাকেন কোথায়? গোলোকে, বৈকুণ্ঠে। হ্যাঁ, এই চেহারাটা বেশ পছন্দ হয়েছে। তা একে পেতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকার দরকার? ভক্তি, শরণাগতি, ভালবাসা। বাঃ এ তো বেশ সহজ, আমি পারব, আমি এঁকেই চাই।
দুটো পরম উপাস্য তত্ত্বের পার্থক্য দেখলেন? প্রথমটা বুঝতেই পারছি না। কিন্তু দ্বিতীয়টা বেশ বুঝতে পারছি। কেন বুঝতে পারছি জানেন? পরম উপাস্য তত্ত্ব হলেও তার একটা চেহারা আছে, তার কিছু ক্রিয়াকলাপ আছে, এবং থাকবার একটা ঠিকানা আছে। অর্থাৎ আমরা ভারতের মানুষেরা অদ্বৈত, দ্বৈত দ্বৈতাদ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত–এমনই হাজার কিসিমের সূক্ষ্ম আলোচনা সেরে নিয়ে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে পরম ঈশ্বরের চেহারা, ঠিকানা এবং সারা জীবনের ‘অ্যাকটিভিটি’ ভাল রকম বিচার না করে তাকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা ভগবান বলে মানতে রাজি হইনি।
আমার বক্তব্য–স্বয়ং ভগবানেরই যখন এই অবস্থা, তখন সাধারণ দেবতাদের কথা আর কী বলব? তাদের ঠিকানা, তাদের রূপ, ক্রিয়া-কলাপ, ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, লোভ, হিংসা, ভালবাসা–সবই আমরা দেখতে পেয়েছি ইতিহাসে পুরাণে। বলতে পারেন–পৌরাণিক কথক ঠাকুরের কল্পনা আর আমাদের অফুরান বিশ্বাস–এই দুয়ের যোগফল হল আমাদের দেবতা।
বলতেই পারেন। অনেকে অনেক কথাই বলছেন, তো আপনারা বললে আর ক্ষতি কী! তবে কিনা, এই আধুনিক যুগে বসে মহাভারতের অমৃত-কথা আরম্ভ করেছি, তাই পৌরাণিকের কথার ভিতরে কোথায় ইতিহাসের অভিসন্ধি মেশানো আছে, সেটুকু আমরা অসীম সমব্যথায় দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, না হলে, আমার মহাকবির হৃদয়টাই যে একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাবে। বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে উত্তরাধিকারী কি কখনও পূর্বপুরুষের সঙ্গে কৃতঘ্নতা করে? অতএব শুনুন মহাশয়! স্বর্গ নামে একটা জায়গা আছে।
ঠাকুমা-দিদিমা, কৃত্তিবাস-কাশীদাসের বর্ণনায় স্বর্গের কথা শুনেছি কত। বড় মনোরম সে জায়গা। সেখানে দেবতারা থাকেন। গন্ধর্ব-কিন্নরেরা সেখানে নাচে, গান গায়। স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা বিলোভনী নৃত্যভঙ্গিতে সবার মনোরঞ্জন করে, রূপে-রসে মন ভোলায়। মানুষ বেঁচে। থাকতে সেখানে যেতে পারে না। মানুষ যদি অনেক পুণ্য করে, ইহলোকে যদি ভাল ভাল কাজকর্ম করে, তবে নাকি মৃত্যুর পর স্বর্গে যায়। আমাদের বেদ, মহাভারত, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র এবং অন্যান্য শাস্ত্রও তাই বলে। এমনভাবে বুলে যাতে মনে হয়–স্বর্গ যেন পৃথিবীর ওপর, অন্তরীক্ষ-লোকের ওপর এক দুর্লভ জায়গা। আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কোনও কল্পনার জগৎ।
‘কল্পনার জগৎ’ কথাটা ঠিকই আছে, কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কি না সেটাই শুধু বোঝবার। ভারি আশ্চর্য লাগে শুনতে, যখন মহাভারতেই দেখতে পাই–পৃথিবীবাসী কত রাজা স্বর্গে গেছেন দেবরাজ ইন্দ্রকে রণক্ষেত্রে সাহায্য করতে। রামায়ণের দশরথ গেছেন, পাণ্ডব কৌরবের পূর্বপুরুষ পুরূরবা গেছেন, দুষ্মন্ত গেছেন, আরও কত মানী রাজা, তাঁদের নাম। করতে চাই না। কালিদাসের কুমার রঘু তো স্বর্গরাজ্য আক্রমণই করেছিলেন। অপরদিকে মানুষের এই কর্মভূমি পৃথিবীতে দেবরাজ ইন্দ্রের গতায়াতও কিছু কম ছিল না। মানুষের মানসিক উন্নতি হলে, অথবা মর্ত্য রাজা যদি শতবার অশ্বমেধ করতেন তো ইন্দ্রের ভয় হত–তার ইন্দ্ৰত্বই চলে যাবে হয়তো। আরও একটা কথা, এই পৃথিবীর মানবী রমণীরাও দেবতাদের কম প্রিয় ছিলেন না–মহাভারতের অন্যতম প্রসঙ্গে সে সব কথা পরে জানাব। এখন শুধু একটা গল্প বলব–সোমদেব-ভট্টের কথাসরিৎসাগর থেকে।
গল্পটা বলব, কেননা, স্বর্গের সঙ্গে মর্ত্যভূমির যোগাযোগ কত গভীর, কত সহজ হতে পারে, সেটা বোঝা যাবে এই কাহিনী থেকে। আরও বলব এই কারণে যে, গল্পটা পাণ্ডব বংশেরই উত্তরপুরুষ জনমেজয়ের ছেলেকে নিয়ে। অবশ্য গল্প শোনার আগে মনে রাখবেন–কথাসরিৎসাগরের কবির পক্ষে মহাভারত-পুরাণ বা ভারতের ঐতিহ্যবিরোধী কোনও কথা বলা সম্ভব নয়। তাই কথাসরিতের কাহিনীকে শুধুই গল্প বলে উড়িয়ে দেবেন না। গল্পের অন্তরে যে বিশ্বাসটুকু আছে, সেই বিশ্বাস যে সাধারণ বিশ্বাস, সেটা মনে রেখেই গল্পটা শুনবেন।
গল্পের পটভূমি-ইতিহাস-বিখ্যাত সেই বৎস-দেশ। এমন সুন্দর সে দেশ যে মনে হয় বিধাতা যেন স্বর্গভূমির সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য প্রতিযোদ্ধার মতো তৈরি করেছিলেন এই দেশ-স্বর্গস্য নির্মিতো ধাত্রা প্রতিমন্নু ইব ক্ষিতৌ। এই বৎস দেশের মধ্যে আবার কৌশাম্বী নগরী, যেন পদ্মফুলের হলুদ-বরণ হৃদয়খানি। এই কৌশাম্বীতেই থাকতেন রাজা শতানীক, জনমেজয়ের ছেলে পরীক্ষিতের নাতি। অসীম তার প্রতাপ, প্রবল তার ক্ষমতা। রাজার স্ত্রীর নাম বিষ্ণুমতী। রাজার ঘরে এত ঐশ্বর্য, এত সম্পত্তি কিন্তু তার ছেলে নেই। মনের দুঃখে রাজা মৃগয়া করতে বেরিয়েছেন এবং হঠাৎ করে শাণ্ডিত্য মুনির সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে যায়। মুনি যাগ-যজ্ঞ করে মন্ত্রপূত পায়েস খাইয়ে দিলেন রানিকে। যথাসময়ে রানির ছেলে হল, তার নাম হল সহস্রানীক। ছেলে বড় হতে তাকে যুবরাজ করে দিয়ে রাজা শতানীক ভাবলেন কিঞ্চিৎ ভোগ-বিলাস করবেন এবার। ছেলে বড় হয়ে গেছে, আর কত রাজকর্ম করবেন তিনি।
কিন্তু ক্ষত্রিয়ের ঘরে আরাম বেশিদিন সয় না। ভোগ করব ভাবলেই ভোগ করা যায় না। রাজা সুখেই আছেন, তার মধ্যে স্বর্গরাজ্য থেকে ইন্দ্রের দূত মাতলি এসে পৌঁছলেন শতানীকের কাছে-দূতস্তস্মৈ বিসৃষ্টো’ভূদ রাজ্ঞে শক্রেণ মাতলিঃ। কী? না, স্বর্গে বড় বিপদ চলছে, অসুরদের সঙ্গে লড়াই লেগেছে দেবতাদের। অতএব এই বিপন্ন অবস্থায় ইন্দ্র শতানীককে স্মরণ করেছেন সাহায্য করার জন্য সাহায়কেচ্ছয়া। রাজা শতানীক সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী-সেনাপতি আর প্রিয় পুত্রের হাতে রাজ্যের ভার সঁপে দিয়ে মাতলির রথে চড়ে গিয়ে পৌঁছলেন স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রের কাছে। যুদ্ধের ভার বুঝে নিয়ে তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রণাঙ্গনে নেমে পড়লেন।
পাণ্ডবকুলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটির ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। অসুরদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ হল তার। যম-দংষ্ট্রা নামে এক অসুর দলের অনেককেই তিনি মেরেও ফেললেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্বয়ং ইন্দ্র দেখছেন এই অবস্থায় অসুরদের সঙ্গে লড়াইতে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এই অবস্থায় ইন্দ্র কী করেন? একে তো লড়াই তখনও চলছে, এদিকে মর্ত-বন্ধুর মৃত্যু ঘটল। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিজের প্রিয় সারথি মালিকে পাঠিয়ে দিলেন কৌশাম্বীতে। মাতলি অশেষ শ্রদ্ধায় রথে করে বয়ে নিয়ে চললেন রাজা শতানীকের মৃতদেহ মাতল্যানীতদেহ।
কৌশাম্বীতে যখন রাজার মরদেহ এসে পৌঁছল, তখন হাহাকার পড়ল রাজবাড়িতে। রানি বিষ্ণুমতী শতানীকের অনুগামিনী হলেন চিতাগ্নিতে। রাজলক্ষ্মী আশ্রয় লাভ করলেন শতানীকের পুত্র সহস্রানীকের কাছে।
ঘটনাটা খুব সামান্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল-কৌশাখী থেকে কতদূর এই স্বর্গরাজ্য, যেখান থেকে ইন্দ্রের বার্তাবহ দূত এসে পৌঁছয় মর্থ্য রাজার কাছে? কতদূর এই স্বর্গরাজ্য, যেখান থেকে কোনও অলৌকিক পদ্ধতিতে নয়, বায়ুপথে নয়, একেবারে রথে করে সংগ্রাম-ভূমি থেকে মরদেহ বয়ে আনা যায় কৌশাম্বীতে?
গল্পটা আরও একটু বলি। শতানীকের মৃত্যুর পর নবীন রাজা সহস্রানীক রাজ্য চালাতে আরম্ভ করেছেন। ওদিকে কোনও মতে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রও হটিয়ে দিয়েছেন অসুরদের। স্বর্গে বিজয় মহোৎসব আরম্ভ হল আর এই আনন্দ-বিজয়ের দিনে ইন্দ্রের মনে পড়ে গেল এই মর্তসধার কথা। তার দুঃখের দিনে মর্ত্য থেকে শতানীক এসেছিলেন তারই হয়ে যুদ্ধ করার জন্য। তিনি মারা গেছেন তারই জন্য। ইন্দ্র আবারও মাতলিকে পাঠালেন কৌশাখীতে, যাতে বন্ধুপুত্র সহস্রানীক তার এই বিজয়োৎসবে যোগ দেন
ততঃ শত্রু? সুহৃৎপুত্রং বিপক্ষ-বিজয়োৎসবে।
স্বর্গং সহস্রানীকং তং নিনায় প্ৰেষ্য মাতলিম্।
আমার কাছে এটা খুব বড় কথা নয় যে, সহস্রানীক স্বর্গের বিজয় মহোৎসবে অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন। বড় কথা নয় এটাও যে, মর্ত্যের রাজাকে স্বর্গসুন্দরী তিলোত্তমা ডেকেছিলেন ক্ষণিক ভালবাসার জন্য। এত সব কাহিনীর বিস্তারে আমি আর যাব না। কারণ, আমার প্রশ্ন রয়ে গেছে সেই একটাই–কৌশাম্বী থেকে কত দূর সেই স্বর্গভূমি, যেখানে পৃথিবী রাজা সহস্রানীক নন্দন-বনের অন্তরালে দেব-পুরুষদের রমণী-বিলাসে মত্ত দেখেছিলেন? কোথায়, কত দূর সেই স্বর্গভূমি যেখান থেকে ফেরবার সময় মাতলির রথ-ঘর্ঘরে ডুবে গিয়েছিল তিলোত্তমার প্রেমের আহ্বান? আমরা সেই স্বর্গের ঠিকানা চাই।
আচ্ছা, গল্প শুনে মনটা যখন হালকাই আছে, তবে স্বর্গভূমির দার্শনিক চর্চা করে প্রাথমিকভাবে বিষয়টাকে একটু গভীর করে নেওয়াই ভাল। বস্তুত স্বর্ণ ব্যাপারটা একটা স্থান-বিশেষ, নাকি এই জায়গাটা একটা কল্পিত সুখের ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’–তা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে প্রবল মতভেদ আছে। বেদান্ত দর্শনের পণ্ডিতেরা বলেন-বেদের মন্ত্রে, উপনিষদের নানা তথ্য এবং পুরাণ-ইতিহাসের মধ্যে যেহেতু দেবলোক বা স্বর্গলোকের নানা বর্ণনা আছে, অতএব এ রকম একটা স্বতন্ত্র সুখভোগের স্থান অবশ্যই আছে, যেখানে দেবদেহ লাভ করে স্বর্গসুখ ভোগ করা যাবে। বেদাতীদের যুক্তি খুব সোজা। তারা বলেন–ধর, তুমি একটি শুয়োর। সারাক্ষণ নোংরা-কাদায় শুয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করা সেই শুয়োরের দেহ ধারণ করে অথবা শুয়োরের ভাবনা-চিন্তা মাথায় নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের মতো স্বর্গসুখ ভোগ করবে, তা কি হয় বিড়-বরাহাদি-দেহেন ন হ্যৈং ভুজ্যতে ফলম্? স্বর্গসুখ চাইলে বাপু বেদ-বিহিত কর্ম করো, চিত্ত শুদ্ধ করো, তাহলে মরণান্তে দেবদেহ লাভ হবে, ভোগ করবে অনন্ত স্বর্গসুখ।
একই ভাবে খারাপ ভাবে জীবন চালিয়ে হাজারো অন্যায় করার পর নরক ভোগ করার জন্যও যে অন্য কোনও স্বতন্ত্র দেহ লাগবে, সেটাও মেনে নিয়েছেন দার্শনিকেরা। বাচস্পতি মিত্রের মতো সর্বদর্শনস্বতন্ত্র পণ্ডিত পর্যন্ত বলেছেন–ধর, তোমার অন্যায়-অভব্যতার নিরিখে বহু বহু বছর নরক-যন্ত্রণা নির্দিষ্ট হল। তত তোমার আয়ু যদি ষাট, সত্তর কি আশি হয়, তাহলে তো আর এই মানবদেহে শতবর্ষের শাস্তি-যন্ত্রণা ভোগ করা সম্ভব নয়। তাই নরক-ভোগ করার জন্যও স্বতন্ত্র দেহ চাই। দেহ যেমন চাই, তেমনই নরক নামে আলাদা কোনও জায়গাও আছে, তার প্রমাণ-কঠোপনিষদে যম-নচিকেতার কথোপকথনের জায়গাটা, অথবা ঋগবেদে বর্ণিত–বৈবস্বতং সংগমনং জনানাং/যমং রাজানমিহ তৰ্পয়ধ্ব–এই রকম একটা জায়গা।
বেদান্ত-দর্শনের পণ্ডিত যাঁরা, তাদের কাছে স্বর্গের যে ঠিকানা পেলাম, তা অবশ্যই পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত বায়ুমণ্ডলের ওপরে কোনও জায়গা। আমাদের এই পৃথিবীতে নূতন দেহধারী নানা জীবকুলে আকীর্ণ এমন একটা জায়গা খুঁজে বার করা মুশকিল। বরং এ ব্যাপারে আমাদের পূর্ব-মীমাংসা দর্শনের আচার্যরা অনেক বেশি বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। ওঁরা বলেন, স্বর্গ বলতে আলাদা কোনও জায়গা, অথবা বিশেষ কোনও লোক বোঝায় না। স্বর্গ মানেই সুখ অথবা প্রীতি। এমন সুখ, যার মধ্যে দুঃখের স্পর্শমাত্র নেই এবং নিজের ইচ্ছামতো যেখানে সুখের বস্তু লাভ করা যায়–সেটাই স্বর্গ। তাহলে কি স্বর্গ বলে আলাদা কোনও জায়গা নেই? দুঃখস্পর্শহীন সুখই কি তাহলে স্বর্গকিং লোকবিশেষঃ স্বর্গঃ? উত সুখমাত্রম্?
পণ্ডিতেরা বলেন–মীমাংসক আচার্যদের চিন্তাভাবনা ভাল করে বিচার করলে দেখা যাবে–স্বর্গ বা নরকের জন্য আলাদা কোনও জায়গা স্বীকার করার কোনও প্রয়োজনই নেই। বিবরণ-জামেয়সংগ্রহ নামের একখানি গ্রন্থে বেদান্তীরা মীমাংসকদের মত উল্লেখ করে বলেছেন–ওঁদের মতে স্বৰ্গই বল আর নরকই বল–সে সবই এইখানে, এই মাটির পৃথিবীর ভোগসুখের মধ্যেইহৈব নরকস্বর্গাবিতি মাতঃ প্রচক্ষতে। জানি না, এই শ্লোক থেকেই ছোটবেলায় সেই কবিতা তৈরি হয়েছিল কি না–কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক… ইত্যাদি ইত্যাদি। ওঁদের মতে–মানুষ যদি মনে সুখ পায়, তাহলে স্বর্গ সেইখানেই। আর যদি সুখের বদলে যন্ত্রণাটাই প্রবল আকারে মনকে আচ্ছন্ন করে, তবে নরক-যন্ত্রণা সেইটাই-মনঃপ্রীতিকরঃ স্বর্গো নরক-স্ত-বিপর্যয়ঃ।
মীমাংসকদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন–অখণ্ড এবং নিরবচ্ছিন্ন সুখ অনুভব করার জন্য এমন একটা জায়গা চাই যেখানে শীত-উষ্ণ, এসবের দ্বন্দ নেই–যা প্রীতিঃ নিরতিশয়া অনুভবিতব্য, সা চ উষ্ণ-শীতাদি-দ্বন্দ-রহিতে দেশে শক্যা অনুভবিতু। আর আমাদের এই দেশটা এমনই যেখানে জীবনের একটা মুহূর্তও বুঝি কাটে না যেখানে এই দ্বন্দ্ব নেই–অস্মিংশ্চ দেশে মুহূর্তশতভাগো’পি দ্বন্দে ন মুচ্যতে।
বুঝেছি, বেশ ঝামেলার কথা বলে ফেলেছি আমি। আসলে ‘দ্বন্দ’ শব্দের দ্বন্দটা ঘুচলেই সব দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। এই যে দার্শনিক বললেন–”শীত উষ্ণ এসবের দ্বন্দ্ব’–এই দ্বন্দ্ব মানে জোড়া, আর এই জোড়াটা শুধু শীত-উষ্ণ বা ঠাণ্ডা গরমের নয়, দুঃখ-সুখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়এই সবই দ্বন্দ্ব। ভগবদ্গীতায় দেখবেন–প্রথম দিকেই কৃষ্ণ বলেছেন–বাপু! নিদ্বন্দ্ব হতে হবে, দ্বন্দাতীত হতে হবে—শীতোষ্ণ-সুখদুঃখেষু লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। মীমাংসক সেই কথাটাই বলেছেন অন্যভাবে, দুঃখ করে–জগতে এমন একটা জায়গা নেই, যেখানে এক মুহূর্তও দ্বন্দহীন নিরবচ্ছিন্ন সুখে কাটবে। অতএব নিরবচ্ছিন্ন সুখের জন্য একটা আলাদা জায়গা থাকবেই, আর সেটাই দেবলোক, মানে স্বর্গ।
মুশকিল হল–যে দার্শনিক-মীমাংসক এই মত ব্যক্ত করেছেন, তিনি এমনই বড় মানুষ যে তাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না মোটেই। আর ঠিক সেই জন্যই আর এক মীমাংসক-ধুরন্ধর দুদিক বাঁচিয়ে বললেন–শ্রুতি-স্মৃতি, ইতিহাস-পুরাণে স্বর্গ শব্দের দ্বারা যে অখণ্ড সুখের কথা বোঝানো হয়, সেই সুখ মর্ত্যলোকে সম্ভব নয়-এমন কথা বলে যদি স্বর্গভূমির মতো সুখের উপযোগী তেমন কোনও বিশেষ স্থান কল্পনাও করে নেওয়া যায়, তবুও কিন্তু এটা অপ্রমাণ হয় না যে–নিরতিশয় সুখই আসলে স্বর্গ। অর্থাৎ মীমাংসক মতে স্বর্গ বলে একটা নির্দিষ্ট সুখ-স্থানের কল্পনা করার প্রয়োজন কিছু নেই, সুখ কিংবা প্রীতিই স্বর্গ বলে মীমাংসকদের সাধারণ সিদ্ধান্ত।
আমরা যে পথে স্বর্গের ঠিকানা দেখাতে চাইছি, তাতে মীমাংসকদের বলা–মনের প্রীতিকর স্থানই স্বর্গ এবং সেটা এই পৃথিবীতেই–অত্রৈব নরক-স্বর্গেী–এই কথাটা আমার কাছে বড়ই জরুরি। তবে এই কল্পনার সুখস্থানের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট জায়গাও পুরাণ-ইতিহাসের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় কি না সেটাই এখন দেখবার। পরলোক দেব-দেহ লাভ করে স্বর্গসুখ ভোগ করার কথাটা নাই বা মিলল, কিন্তু হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের মতো দেবস্থান বা স্বর্গ বলে এই পৃথিবীতেই কিছু ছিল কি না, সেটা পুরাণকারদের বর্ণনার আনুকুল্য থেকে বোঝাও যেতে পারে হয়তো।
মনে রাখতে হবে-মানুষের যেমন ঘরবাড়ি আছে, দেবতাদেরও তেমনই ঘরবাড়ি আছে। তবে হ্যাঁ, দেবতা বলে কথা, তাদের ঘরবাড়ি কি আর সাধারণ খড়ের চালায় কুঁড়ে-ঘরের মতো হবে? বরং ইন্দ্রাদি দেবতার বাসস্থান প্রাচীন কালের রাজা-মহারাজাদের রাজবাড়ির সঙ্গে খানিকটা তুলনীয় সুতে পারে।
স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র যেখানে থাকেন, সেই সুবিশাল জায়গাটার নাম অমরাবতী-স্বর্গের মধ্যে আরেক স্বর্গ। সেই অমরাবতীর মধ্যে আবার যে প্রাসাদ তার নাম বৈজয়ন্ত প্রাসাদ। তার একপাশে আছে নন্দনকানন, যেখানে পারিজাত ফুলের সমারোহ। সেই প্রাসাদের মধ্যে ইন্দ্র-সভার বর্ণনা খোদ মহাভারতেই পাওয়া যাবে, যদিও সে বর্ণনা কোনও কল্পিত স্বর্গের ছবি নয়, তার মধ্যে বাস্তবতাও আছে যথেষ্ট।
ইন্দ্রসভার স্থপতি স্বয়ং বিশ্বকর্মা। অনেক জায়গা নিয়ে যে এই সভা তৈরি হয়েছে, কিংবা এটির চূড়া যে হবে খুব উঁচু, সেটা খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হল–সভার দুপাশে অনেক ঘর এবং সভায় আসন আছে প্রচুর–বেশ্যাসনবতী রম্যা। এই সভার সু-উচ্চ আসনে ইন্দ্রের পাশে যে ইন্দ্রাণী শচী বসে থাকবেন, সেটা কিন্তু বড় কথা নয়। বড় কথা হল–এই সভার সভাসদদের মধ্যে আমরা সেইসব মানুষ, মুনি-ঋষিদের দেখছি, মর্ত্যলোকে যাদের সব সময় দেখি। পরাশর, পর্বত, দুর্বাসা, যাজ্ঞবল্ক্য–এ রকম বিশিষ্ট মুনির নাম দিয়েই মহাভারতের কবি ইন্দ্রসভার অধ্যায় প্রায় শেষ করে দিয়েছেন। মাঝখানে ক্ষণিকের অতিথির মতো কতগুলি অপ্সরা-গন্ধর্ব আর গায়েন কিন্নরদের কথা এসেছে এবং তা এসেছে নিতান্তই গৌণভাবে। মর্ত্য মুনি-ঋষিদের নামগুলি যেখানে সংখ্যায় এবং ভাস্বরতায় এতই বেশি উজ্জ্বল যে মহাভারতের কবির আশয়টা বেশ খায়। বোঝা যায়, তিনি কোনও অতিলৌকিক বর্ণনা করছেন না, ইন্দ্রসভার মাহাত্মে দিব্যভাব থাকতে পারে, কিন্তু মর্ত্যর মানুষের সঙ্গে তার বেশ যোগ আছে।
ইন্দ্রসভার পর মহাভারতে যম-সভ্যর বর্ণনা এবং তার বৈশিষ্ট্য হল প্রখ্যাতকীর্তি মর্তের রাজারা, যারা মৃত্যুর পর যম-সভার সদস্য হয়েছেন। যম যেহেতু মৃত্যুলোকের অধিপতি, অতএব তার রূপ-কল্পনা হয়েছে সেইভাবেই; কিন্তু মনুষ্যলোকের বেশিরভাগ রাজাদেরই সেই সভায় দেখতে পাচ্ছি বলে এটাকেও আমি অতিলোক বলে কিছু ভাবছি না। যম-সভার পরেই বরুণ-সভা এবং সবকিছু ছাপিয়ে এই সভার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে নদী-নামের মধ্যে। সিন্ধু, কাবেরী, গঙ্গা-সরস্বতীই শুধু নয়, ভারতের তাবৎ চেনা নদীগুলিকে যদি বরুণ-সভায় হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন–এমন দেখতে পাই, তবে আমি অন্তত সে সভাকে পৃথিবীর বাইরে কোনও স্থান বলে মানতে রাজি নই।
এরপর আছে কুবের সভা। ধনেশ্বর কুবেরের বাসস্থান কল্পনা করা হয় হিমালয়ে, কৈলাস পর্বতের পাশে। শিব তার সখা। শিবের জটালগ্ন চন্দ্র-শকলের জ্যোৎস্না-ছায়া পড়ে তার গৃহের প্রাঙ্গণে। কুবের-সভার বৈশিষ্ট্য হল সেখানকার লোকগুলি। সমভূমির মানুষের মতো তাদের চেহারা নয়। কবি তাদের যক্ষ বলেছেন, রাক্ষস বলেছেন–বলুন। কিন্তু ওই নামগুলি! হেমনেত্রঃ–যদি বলি কটা চোখ! পিঙ্গলকঃ–যদি বলি হলদেটে লালচে গায়ের রঙ। শোনিতোদঃ প্রবালকঃ-যাঁদের গায়ের রঙ কিছু লালচে। পাহাড়ি এলাকার লোক, অতএব মহাভারতের বর্ণনায়–শকর্ণ-মুখাঃ সর্বে। কান, মুখ সব পেরেকের মতো। উপমাটা পেরেকের চেহারায় নয়; সমভূমির মানুষের মতো নয় বলেই এই উপমা।
কিন্তু যক্ষনামের মধ্যে–বৃক্ষবাসী, অনিকেতঃ চীরবাসা–এগুলো কি কোনও নাম? নাকি ধনেশ্বর কুবেরের পার্ষদ হয়েও পাহাড়িয়াদের দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে এখানে–গাছের কোটরে থাকে, বাড়ি-ঘর ভাল করে বানাতে পারে না এবং গাছের বাকল পরে। পাহাড়ে চলতে হয় বলেই এদের হাত-পা চলে তাড়াতাড়ি, নিরলস-বাতৈরিব মহাজবৈঃ। আবার আবহাওয়ার কারণে শরীর গরম রাখতে হয় বলেই কুবের-পার্ষদের উপাধি জুটেছে–ক্রব্যাদ, পিশাচ, রাক্ষস এবং এরা ভীষণ রকমের মাংসাশী–মেদোমাংসাশনৈরুগ্রৈঃ উগ্ৰধৰা মহাবল। বস্তুত আমি কুবেরের সভাতেও কোনও অলৌকিকতা দেখিনি। তার ওপরে হিমালয়, পারিযাত্র, বিন্ধ্য, মহেন্দ্র আর কৈলাস পর্বত-যেখানে কুবেরের উপাসনা করছে, সেই কুবের-সভা আমার কাছে খুব অপরিচিত নয়, অতিলৌকিক তো নয়ই।
সবার শেষে নারদের মুখে ব্রহ্ম-সভার বর্ণনা। সমস্ত দেবতা, রাক্ষস, গন্ধর্ব, কিন্নর পিতামহ ব্রহ্মার সভায় গতায়াত করছেন–সেটা আমার কাছে বড় কথা নয়। বড় কথা–সেই চেনা-পরিচিত ঋষি মুনি আর নারদের শেষ কথাটি। নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, তেমন সুন্দরসভা আমি কোথাও দেখিনি। লোক-দুর্লভ সেই সভা। কিন্তু একটাই তার উপমা আছে। এই তোমার সভাটি যেমন, ঠিক তেমনই সেই ব্ৰহ্ম-সভা-সভেয়ং রাজশার্দুল মনুষ্যেষু যথা তব। এই শেষ কথার পর ধরে নিতে পারি ব্রহ্মা, ইন্দ্র, যম, বরুণ–যিনি যত বড় দেবতাই হোন না কেন, তাদের বাড়ি-ঘর রাজসভা সব মানুষের আদলেই তৈরি হয়েছে, কারণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সভাটিই একেবারে ব্রহ্মসভার মতো–মনুষ্যেষু যথা তব।
.
১৩.
রাগ করবেন অনেকেই। এমন কি রাগ করার সঙ্গত কারণও আছে। এতদিন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে রয়েছি-ইন্দ্র, যম, বরুণ, ব্রহ্ম–এত বড় বড় সব দেবতা। আর তাদের বাড়ি-ঘর নাকি সব আমাদের মতো। এসব অলক্ষুণে কথা বললে কার না রাগ হয়? রেগে গিয়ে বলতেই পারেন–এতক্ষণ বাড়িঘর দেখালে, এবার বলবে-দেবতাদের চেহারাও বুঝি বা আমাদের মতোই।
বলব, হয়তো এই কথাই বলব। কিন্তু আপনারা যে সব গ্রন্থ বা সাহিত্যকে শাস্ত্রের মূল্য দিয়ে থাকেন, তার প্রমাণ দিয়েই বলব। তবে কিনা রাগ আপনাদের হতেই পারে। আজকেই তো নয় শুধু, ব্যাস, বাল্মীকি আর যত পৌরাণিকের দল তাদেরও তো দেবতাদের ওপর শ্রদ্ধা-ভক্তি কিছু কম ছিল না, কিন্তু হাজার শ্রদ্ধা নিয়েও তারা দেবতাদের চেহারা, চরিত্র, ছলনা এমন কি চরিত্রহীনতাও যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা কি কোনওভাবেই মনুষ্য-চরিত্রের বাইরে? আপনারা দেবতাদের করুণায় বিশ্বাস করবেন, তাদের অঘটনঘটনপটীয়সী শক্তিতে বিশ্বাস করবেন, তাদের ভক্তবশ্যতা স্বীকার করবেন–অথচ তাদের মনুষ্যোচিত চেহারা, ভাব-ভঙ্গি অথবা অন্য কোনও রসাবেশ স্বীকার করবেন না–এ কেমন একগুয়ে কথা!
তবে ব্যাস-বাল্মীকির ভাগ্য ভাল, তারা এ দেশে জন্মেছেন। আরও ভাগ্য কেন না, হিন্দুধর্মের মতো এক বিরাট-বিশাল সর্বংসহ ধর্মের তারা প্রাণদাতা। আমাদের দেশে ব্যাস-বাল্মীকির প্রামাণ্য এবং শ্রদ্ধেয়তা এতই বেশি যে, যারা তাদের ধর্ম বা ঈশ্বরানুসন্ধান মানেন না, তারাও কিন্তু এই দুই মহাপুরুষকে সমালোচনার আগে এবং পরে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারেন না। আমার ধারণা, এই দুই ঋষি যদি পৃথিবীর মধ্য-মরুভূমিতে জন্মাতেন, তবে তারা জীবৎকালেই মহাভারতের আদিপর্ব এবং রামায়ণের বালকাণ্ড লিখেই অকালে যমদণ্ড লাভ করতেন। আর যদি অন্য দুটি প্রাচীন দেশ গ্রিস কিংবা রোমে এঁদের জন্ম হত, তবে একেবারে প্রাণে না মারা পড়লেও এঁদের চড়-চাপাটি খেতে হত নির্ঘাত।
যদি বলেন–কী হলে কী হতে পারত–এসব কথা আমার প্রথমোক্ত দেশ সম্বন্ধে অনালোচ্য, তো ঠিক আছে, সেটা আলোচনার বাইরে থাকাই শ্রেয়। কারণ অনুমানযোগ্য। কিন্তু গ্রিস-দেশীয়দের সম্বন্ধে আমার অনুমান আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। এসব কথা আমি অন্যত্র কিছু লিখেছি, কিন্তু পাঠকের একাংশ আমাকে সাভিমানে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন–কোথায় কী লিখেছেন মশায়! ওসব রেফারেন্স জানতে চাই না, পাঠক হিসেবে আমরা কী এইটুকু একসঙ্গে পেতে পারি না? অতএব আমি নাচার।
তাছাড়া গ্রিস-দেশীয় সেই দার্শনিকের কথা আমায় আরও একবার তুলতেই হত, কারণ তার রাগও ঠিক আপনাদের মতোই। অর্থাৎ আপনাদের রাগ যে কারণে, তারও রাগ সেই কারণেই। পৃথিবীর অনবদ্য আরেক মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিসির নাম আপনাদের জানাই আছে। সেই মহাকাব্যের লেখক হোমার যেহেতু দেবতাদের চেহারা, চরিত্র, চরিত্রহীনতা, মহত্ত্ব, দাক্ষিণ্য এবং করুণা–সবই বর্ণনা করেছেন; অতএব দার্শনিকেরা অনেকেই তার ওপরে ক্ষিপ্ত হয়েছেন। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন–ওসব বকানি, মকানি তাও কবিত্বের ভাব-মাখা; হোমার যা করেছেন, তার একমাত্র শান্তি তাকে বেতিয়ে সোজা করা। আর শুধু হোমারই নয়, তার ভাব-শিষ্য আর্চিলোকাসকেও ধরে বেত মারা উচিৎ–Homer should be whipped and Archilochus likewise.
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশে যাঁরা পরম উপাস্য তত্ত্বকে কোনও সাকার সবিশেষ বাঁধনে বাঁধতে চান না, তারা পর্যন্ত কেউ ব্যাসদেবকে বেতিয়ে সোজা করার কথা বলেননি। এমন কি দার্শনিক স্থিতিতে যারা নিতান্ত বিরুদ্ধবাদী, তেমন বৌদ্ধ দার্শনিকেরা পর্যন্ত মহাভারতের কবিকে এমন হেনস্থা করেননি। আর যদি শঙ্করাচার্যের মতো অদ্বৈতবাদী। তার্কিক-ধুরন্ধরকে প্রশ্ন করেন, তবে তিনি হয়তো সেই পরম তত্ত্বকে নিরাকার, নির্বিশেষ, নির্গুণ বলে প্রায় বৌদ্ধদের শূন্যের পর্যায়ে ফেলে দেবেন, কিন্তু কদাপি ব্যাস-বাদবায়ণকে পেটানোর প্রস্তাব দেবেন না। নিন্দুকেরা বলে-শঙ্কর নাকি একদিকে ব্রহ্মকে নিরাকার নির্বিশেষ বলেছেন, আর আমজনতার সুখের জন্য ব্রহ্মের রূপ-কল্পনা করে লুকিয়ে লুকিয়ে হরি-হর-ভবানীর অপূর্ব স্তোত্র রচনা করেছেন। অধিকতর পণ্ডিতেরা অবশ্য বলেন–শারীরিক ভাষ্যকার শঙ্কর এক লোক, আর স্তোত্রকার শঙ্কর আরেক লোক। এসব অবশ্য সেই প্রক্ষিপ্তবাদীদের জ্ঞান-প্রপঞ্চ, যাঁদের পড়তে হয়েছে অনেক, কিন্তু বুঝতে হয়েছে কম।
যাক এসব কথা, আমাদের দেশের ঠাকুর-দেবতার হাত-পা না থাকলে চলে না, ভাল করে মিষ্টি করে ডাকলে, তাদের বৈকুণ্ঠ কি স্বর্গ থেকে পড়িমরি করে ছুটে আসতে হয়। আর ভাব-ভালবাসার ক্ষেত্রে তো তাকে আমার যত প্রয়োজন, আমাকেও তার ঠিক ততটাই প্রয়োজন। পঙ্কজ মল্লিকের সানুনাসিক অনবদ্য কণ্ঠ প্রসঙ্গত স্মরণীয়–তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে, তুমি তাই এসেছ নীচে ইত্যাদি। আমাদের দেশে চরম সাধনা করে কেউ যদি ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে যাবার বর লাভ করেন, অথবা কেউ যদি ঈশ্বরের সমান আকৃতি লাভ করার বর লাভ করেন, তাহলে সেই বর অনেকে নিতে চান না, তা জানেন? তারা বলেন, ধুচ্ছাই, মুক্তি দিয়ে আমি কী করব, ঠাকুরের সঙ্গে মিশে গিয়ে কী আনন্দটা হবে আমার?
মা গো! নির্বাণে কি আছে ফল,
জলেতে মিশায়ে জল,
চিনি হওয়া ভাল নয় মন,
তিনি খেতে ভালবাসি।
আমাদের ঠাকুর-দেবতা হলেন চিনি। স্পষ্ট গোটা গোটা পরিষ্কার চেহারা, রূপ আছে, রঙ আছে, স্বাদ আছে। হাত-পা-ওয়ালা রূপী, গুণী, রসিক ঠাকুর চাই আমাদের। ঘরের মধ্যে যোগে বসে জ্যোতিঃস্বরূপকে জেনে যাঁরা মুক্তি লাভ করছেন, করুন,-কিন্তু সে মুক্তি রামপ্রসাদ চান না–দেখলেনই তো। আবার বৈষ্ণবদের কথা বলুন, তারা আরও কড়া। চৈতন্যপীরা হেসে বলেন, আমাদের ঠাকুর আমাদের যদি সেধেও মুক্তির বর-দান করেন, তবে আমরা নিই না, আমরা ওই ধরনের বর সাধারণত প্রত্যাখ্যান করে থাকি। স্বয়ং ভগবানও এটা জানেন, তাই তিনি নাকি নিজেই ভাগবত পুরাণে কবুল করেছেন যে–ওদের মুক্তি দিতে চাইলেও ওরা নেবে না, কী সাংঘাতিক! ওরা খালি আমাকে চায়। আমাকে দেখতে চায়, আমাকে কাছে পেতে চায়, আর কাজ-কর্ম করে দিতে চায়–দীয়মানং ন গৃহৃত্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ।
শাক্ত গেল, বৈষ্ণব গেল, এবার শৈবের কথা শুনবেন? তাহলে একটা শ্লোক বলতে গিয়ে আমাকে রীতিমতো একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে–শ্লোকের গল্প। এই শ্লোকটি আছে মোটামুটি কঠিন একটি সংস্কৃত অলংকার গ্রন্থে। কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ আলংকারিক মম্মটাচার্য তার কাব্যপ্রকাশের মধ্যে একটি অলংকারের উদাহরণ দিতে গিয়ে এক শৈব-ভক্তের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। শ্লোকটি বলার আগে জানাই–এই শিব-ভক্ত সাধুটি স্বাভাবিক কারণেই রুদ্রাক্ষমালা পরেন গলায়। গায়ে ভস্ম মাখেন, আর তার আরাধ্য দেবতা শিব যে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত, সেই শিব-মন্দিরের সিঁড়িগুলি তিনি সযত্নে মুছে দেন প্রতিদিন।
কিন্তু একদিন সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। আশুতোষ শিব তার ভক্তের সেবা-পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে মুক্তির-বর দান করে বসলেন। শিব সোজা-সরল ভোলেভালা মানুষ, তিনি জানেন-মোকের জন্যই লোকে এত সাধ্যি-সাধনা, উপাসনা করে। অতএব ভক্তটিকে তিনি কোনও প্রশ্ন-ট্রশ্ন না করে লোক-দুর্লভ মুক্তির বর দিয়ে পূর্বাহ্নেই আপ্লুত করে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এ ভক্তটি সে-রকম নয়। মোক্ষ-লাভ করে সে পরমানন্দে ‘শিবোহং শিবো’হং’ করে মোটেই জলদ-গম্ভীর স্বরে কথা কয়ে উঠল না। উলটে সে একটু রেগেই গেল। যদিও পরমারাধ্য দেবতা তাকে বর দিয়েছেন এবং বরও লৌকিক দৃষ্টিতে বড় সুলভ নয়, অতএব ঠার ক্রোধ এবং ক্ষোভ অভিমানে পরিণত হল।
দেখা গেল–এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তার পূর্ব-পরিচিত উপাসনার সাধনগুলির সঙ্গে সে সাভিমানে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। গলার রুদ্রাক্ষ মালাটি–যা তাকে এতকাল শিব-সাধনার প্রেরণা জাগিয়েছে, সেই মালাটি সে খুলে ফেলেছে গলা থেকে। গায়ের যে ভস্মরাগ, সর্বাঙ্গে যে বিভূতি তাকে এতকাল বৈরাগ্যের অনুভূতি দিয়েছে, সেই অতি-পরিচিত অচেতন পদার্থটিকে সে বিদায় জানিয়ে বলে–ছাইভস্ম আমার! এতকাল কত ভক্তিতে প্রতিদিন তোমাকে গায়ে মেখেছি বৈরাগ্যের সাধন হিসেবে। কাল থেকে আর তোমার প্রয়োজন থাকবে না, বিদায় তোমাকে, চিরবিদায়। তোমার ভাল হোক। ভাই রুদ্রাক্ষ-মালা! এতকাল শিব-মন্ত্র জপ করার সময় কত শক্তি জুগিয়েছ তুমি, রুদ্রাক্ষ-মালা ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন শিবের উদ্ভাস জেগে উঠত মনে–বিদায় ভাই, আর তোমার কোনও প্রয়োজন নেই আমার কাছে। তোমার মঙ্গল হোক। আমি মোক্ষলাভ করেছি–ভস্ম, মালা–এসব এখন মূল্যহীন, বৃথা। ভম্মোচূলন ভদ্রমস্তু ভবতে রুদ্রাক্ষমালে শুভ।
সবার শেষে শিবমন্দিরের শুভ্র-শীতল সোপানগুলি দেখে এই ভক্তের প্রাণ একেবারে কেঁদে উঠল। মনের গভীর থেকে তার আর্তি বেরিয়ে এল–হা সোপান-পরম্পরাং গিরি কান্তালয়ালংকৃতি। কী রকম সে সোপান–যা নাকি হিমালয়-দুহিতা পার্বতীর ভালবাসার ধন যে শিব, তার বাস-গৃহের অলংকারের মতো। হায় সেই সোপানাবলি! বিদায়, আর সেই শিব-মন্দিরের সোপানগুলিকে পরিমার্জনা করার কোনও দায়ই রইল না আমার।
যদি সেই ভস্ম, সেই সোপান-পংক্তি আর রুদ্রাক্ষমালা একযোগে প্রশ্ন করে বলে-কেন বাপু! আজ থেকে তোমার এই নির্বিকার ভাব কেন? শিবভক্ত শৈব তাতে রেগে যায়, ক্ষোভে সে বলে–এই দেখ না। প্রভু কত খুশি হয়েছেন আমার আরাধনায়, উপাসনায়। তিনি বড় সুখী হয়ে আমাকে মোলাভের বর দিয়েছেন। কী রকম সে মোক্ষ? শৈব বলে–অন্যের কাছে তা। যত বড়ই হোক আমার কাছে তা এক মহা অন্ধকারের নামান্তর। আরও এক মহামোহের প্রতিরূপ? আরও এক বিপন্ন বিস্ময়। কেন কেন? এমন বলছ কেন? মোক্ষকে কেউ কী অন্ধকার বলে? শৈব এবার আপন দুঃখের কথাটা বলে–হায়! যে শিবের সেবা করার জন্য আমি গায়ে ভস্ম মাখতাম, রুদ্রাক্ষ-মালা পরতাম, প্রতিদিন সযতনে মুছে দিতাম শ্বেত-শুভ্র মন্দিরের সোপান-পংক্তি, সেই তোমার সেবা করার আনন্দটুকু যে ছিন্নভিন্ন করে দিল এই মোক্ষের অন্ধকার–আমি এমনটি চাইনি। তুষ্ট হয়ে এ তুমি আমায় কী দিলে প্রভু যুৎ-সপৰ্যাসুখাল/লোকচ্ছেদিনি মোক্ষনামণি মহামোহে নিধীয়ামহে। এই শিবভক্তটি কী চায়, তা শুধু একটি পংক্তির ব্যঞ্জনায় এই কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে। সোপানপংক্তির বর্ণনায় সে বলেছিল—গিরিসুকান্তালয়ালংকৃতিম–শৈলদুহিতা পার্বতীর ভালবাসার ধন যে শিব তার মন্দির সোপান। অর্থাৎ এই শৈব শিব-পার্বতী ভালবাসাটা বোঝে। সে এই ভালবাসা না চাইলেও শিবের ভৃত্য হওয়ার সুখটুকু চায়। মোক্ষ-লাভে সেই শিব-পরিচর্যা-সুখের সমস্ত সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শিবভক্ত এখন ক্ষুব্ধ, বিরক্ত।
বৈষ্ণবদের কথা স্বল্পমাত্র বলেই আমি শেষ করছি, বস্তুত রসিক শেখর কৃষ্ণের নিত্যসেবার। সুখ আর লীলা-মাধুর্য আস্বাদন করার জন্য বৈষ্ণবদের যে আকুতি আছে, তার বিবরণ দিতে গেলে মহাভারত-কথার অর্ধেকই তাতে চলে যাবে। বরং শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণবের উদাহরণ দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইলাম, সেটা হল–সাধারণ দেবতার কথা ছেড়েই দিলাম, সাক্ষাৎ পরমেশ্বরের ক্ষেত্রেও মনুষ্যোচিত হাব-ভাব, রসবত্তা আমাদের প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। আমাদের দেশে সর্বশক্তিমান দেবতাপুরুষেরও জন্ম আছে, শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য এমন কি মৃত্যুও আছে এবং এই মনুষ্যোচিত রূপকার কিন্তু ব্যাস-বাল্মীকি এবং পৌরাণিকেরাই।
উপনিষদের মধ্যে যে অনাদি অনন্ত পরব্রহ্মের স্বরূপ আমরা জেনেছি, তাঁকে স্বরূপত সেই রকম জেনেও যে কোনও মুহূর্তে তাকে আমার রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, শিব কিংবা উমা হৈমবতীর সাকার রূপ দিতে আমাদের অসুবিধে হয়নি এবং তাদের জন্ম-মরণের কল্পনা করতেও আমাদের হৃদয় কম্পিত হয়নি। তার কারণ, আমরা যতখানি দার্শনিক, তার চেয়েও বেশি ভাবুক-রসিক। রসবত্তা আর দার্শনিকতা একই হৃদয়ে থাকার ফলেই বেদব্যাস কিংবা বামীকিকে আমাদের অতি সূক্ষ্মদশী দার্শনিকেরাও কেউ চাবুক মারার সাহস দেখাননি। আবার অন্যদিকে মহাকাব্যের কবিকেও দার্শনিকদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলতে হয়নি-বাপু হে! তোমরা যা করছ, এ শুধুই তর্ক, শুধুই যুক্তি, হৃদয়ের কাছে এর কোনও আবেদন নেই। বলতে হয়নি এসব কথা। আর বলতে হবেই বা কেন? আমাদের কবিরা মূলত দার্শনিক, আবার দার্শনিকেরাও মূলত কবি। এই পারস্পরিক পরিপূরণ এমনি-এমনিই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এবং তার কারণ, আমাদের চরম সূক্ষ্ম যে ব্রহ্মতত্ত্ব–তিনি একদিকে অদ্বৈত এবং বিজ্ঞানস্বরূপ অন্যদিকে তিনি রসস্বরূপ এবং আনন্দস্বরূপ। একদিকে তাকে বলতে হয়-অশব্দম্ অস্পর্শ অরূপ অব্যয়’অন্যদিকে তাকে বলতে হয়-”এষ আত্মা সর্বগন্ধঃ সৰ্বরসঃ’ ইত্যাদি। এ দেশে একদিকে আপনারা যেমন শঙ্করের মতো সূক্ষ্মদর্শী দার্শনিকের মুখে হরিহর-ভবানীর স্তোত্র শুনবেন, অন্যদিকে দেবতার গল্প-বলা বেদব্যাসের মুখে অদ্ভুত এক কবিতা শুনবেন।
কবিতাটা মহাভারতে নেই, তবে বেদব্যাসের নামেই এ কবিতা চলে, যেমন চলে শঙ্করাচার্যের মুখে হরিহর-ভবানীর স্তোত্র। ব্যাস বলছেন, ক্ষমা কোরো প্রভু! ক্ষমা কোরো আমাকে। আমি তিনটে বড় দোষের কাজ করে ফেলেছি, প্রভু! তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়ে–ক্ষন্তব্যং জগদীশ ত-বিকলতা-দোষত্ৰয়ং মক্তৃতম্। মুনি-কুলের তিলক বেদব্যাস, তিনি কী দোষ করেছেন এমন, যার জন্য শেষ জীবনে এসে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে তাকে? ব্যাস বলছেন, দোষ করেছি তিনটে। প্রথম দোষ-তুমি নীরূপ, নিরাকার। মানুষের আপন সৃষ্ট কোনও রূপের মধ্যে তোমাকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। কিন্তু তবু আমি ধ্যানযোগে সেই অনন্ত-রূপ-নীরূপ ঈশ্বরের রূপ-কল্পনা করেছি–রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতঃ ধ্যানেন যৎ কল্পিত। আমার দ্বিতীয় দোষ-তুমি সর্বব্যাপী, বিভূ। কিন্তু নানা তীর্থস্থানের মধ্যে তুমি জাগ্রত আছ–এই রকম তীর্থ-মাহাত্ম্য কল্পনা করে আমি তোমার সেই বিভূত্ব, ব্যাপি নষ্ট করে দিয়েছি। যিনি অগ্নিতে যিনি জলেতে যিনি তৃণ-তরুময় স্থলেতে, সেই বিশাল-ব্যাপ্ত সত্তাকে আমি সীমিত করে ফেলেছি কতগুলি তীর্থ স্থানের চতুঃসীমার মধ্যে। আর আমার শেষ এবং তৃতীয় দোষ-তুমি অনির্বচনীয়, অনির্দেশ্য-স্বরূপ। শব্দ-অর্থ-অলংকার, আর ভাষা ছন্দে তোমাকে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু পরম ঈশ্বরের স্তব-স্তুতি রচনা করে শব্দের গৌরব-সীমায় তোমাকে যে আমি বেঁধে ফেলেছি, এতে তোমার অনির্বচনীয়তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আমার এই তিনটে দোষ তুমি ক্ষমা করে দিও, প্রভু।
দেখুন, অরূপ, অব্যয়, অসীম, অনির্দেশ্য ব্রহ্ম-স্বরূপকে কৃষ্ণের রূপে, শিবের রূপে, দুর্গার রূপে বেঁধে ফেলার জন্য পৌরাণিক ব্যাসকে যেমন ক্ষমা চাইতে হচ্ছে, তেমনই শঙ্করাচার্যেরও এমনই ক্ষমা চাওয়ার কথা–তিনি ওই একই কাজ জেনেশুনে করেছেন বলে। অথচ কার্যক্ষেত্রে ব্যাস এবং শঙ্কর পরস্পরের প্রতিপূরক। কারও সঙ্গে কোনও বিরোধই নেই। তবে ব্যাস যা করেছেন, বিভিন্ন পুরাণের মধ্যে কৃষ্ণ, শিব, দুর্গার জন্ম-মরণ পর্যন্ত দেখিয়ে তিনি যা করেছেন, তাতে অন্য কোনও দেশে জন্মালেও তার মহা-বিপদ হত।
প্রাক্-সক্রেটিস যুগের দার্শনিক জেনোফেনিস্ ছিলেন নিজের কালের মহান পণ্ডিত। ভগবানের সম্বন্ধে তার ধারণাটা প্রায় ঔপনিষদিক। ঈশ্বরের সম্বন্ধে তার অতি উচ্চ ধারণা ছিল এবং এই পৃথিবীর নানান সৃষ্টি-বিষয়ে ঈশ্বরের করুণা-স্পর্শ তাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করত। ঈশ্বরের প্রতি তার নির্ভরতা এতটাই যে, তিনি ভাবতেন-ভগবান যদি এই পৃথিবীতে মধু সৃষ্টি না করতেন, তাহলে লোকে ডুমুর গাছ কিংবা বটের ফলকেই অনেক বেশি মিষ্টি বলে ভাবত–If God had not made yellow honey, men would consider figs far sweeter. এ হেন জেনোফেনিস যখন দেখলেন– হোমার-হেসিয়ড অন্তরীক্ষ-লোকের দেবতাদের নানা কুকীর্তি, বঞ্চনা, ছলনার কথা লিখে মহাকাব্য রচনা করেছেন এবং সুধী-জনতা। সে লেখা পড়ে বিমলানন্দ লাভ করছেন, তখন তিনি আর থাকতে পারেননি। রাগে ক্ষোভে তিনি বলে উঠেছেন–এ কী অসভ্যতা? দেবতারা কি সব মানুষ নাকি? দেবতারা কি এতই ক্ষুদ্র-সত্ত্ব যে, মানুষের সমাজে যা লজ্জাকর এবং ঘৃণ্য–সেইসব চুরি-জোচ্চুরি, ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য সব বৃত্তি দেবতাদের ওপর চাপিয়ে হোমার একটা মহাকাব্য লিখে ফেললেন। আর হেসিয়ড ‘থিওগনি’ লিখে খুব নাম কিনলেন?
জেনোফেনিস্ হোমার-হেসিয়ডকে নিতান্ত মূর্থের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়ে নাম না করে মন্তব্য করেছেন–সাধারণ লোকেরা ভাবে–দেবতাদের বুঝি জন্ম হয়, তারা বুঝি মানুষের মতোই জামা-কাপড় পরেন, অথবা দেবতার আকৃতি বা মুখের ভাব বুঝি মানুষের মতোই হবে। মানুষেরা কেন নিজেদের মতো করে দেব-কল্পনা করে তার একটা যুতসই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। জেনোফেনি। তিনি বলেছেন–এই যে ইথিওপিয়ানরা বলে–তাদের দেবতারা নাকি নাক-খাদা আর তাদের চেহারা নাকি কালো-কোলো, তার কারণ ওরা নিজেরাই নাক খাদা আর। কালো। আবার অন্যদিকে ব্রেসিয়ানরা যে বলে–তাদের দেবতাদের চক্ষু দুটি নাকি হালকা নীল আর চুলগুলি নাকি লাল–তার কারণ, ওদের নিজেদের চোখই নীল আর চুলগুলি লাল।
দুটি উদাহরণ দেওয়ার পর জেনোফেনি ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করেছেন–তা ইথিওপিয়ান, আর ব্রেসিয়ানদের দোষ কী দেব? গোরুরা যদি আর্টিস্ট হত, আর মানুষ যা করে তা যদি গোরুরাও করতে পারত, তাহলে গোররা দেবতার ছবি আঁকত গোরর আদলেই। আর যদি ঘোড়া বা সিংহের মনুষ্যোচিত ক্ষমতা থাকত তাহলে ঘোড়ারা দেবতার ছবি আঁকত ঘোড়ার আদলে, আর সিংহেরা সিংহের আদলে—But if cattle and horses or lions had hands, or were able to draw with their hands and do the works that men can do, horses would draw the forms of the Gods like horses and cattle like cattle, and they would make their bodies such as they each had themselves.
আর বাকি কী রাখলেন জেনোফেনিস্? হোমার-হেসিয়ডকেও তিনি নিশ্চয় ওই গোরু-ঘোড়ার পর্যায়েই ফেলে দিয়েছেন। আমার ভয়–আমাদের ব্যাস-বাল্মীকি যদি এই গ্রিক-দেশীয় কঠিন মানুষটির হাতে পড়তেন, তা হলে তাদের কী বেগতিকই না হত! সে যাই হোক, জেনোফেনিস যত কড়া মন্তব্যই করুন, অন্তত দার্শনিক সূক্ষ্মতার ক্ষেত্রে আমাদের। সাংখ্য-বেদান্ত বৌদ্ধদের ধারেকাছে যে তিনি যেতে পারবেন না, সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। এই হলফ-নামা করার পর আমার দায়িত্ব আছে যৎসামান্য। আমি ব্ৰহ্মা-পরমাত্মা-ভগবানের কঠিন তত্ত্বের মধ্যে আর একটুও যাব না এবং এই তত্ত্বকে কী চোখে আমরা দেখি তা আগেই সামান্য বলেছি। আমরা এখন শুধু ইন্দ্র-বায়ু ইত্যাদি দেবতা এবং অসুর-রাক্ষসদের সামাজিক স্থিতিটা সংক্ষেপে বলে দিয়েই জনমেজয়ের সভায় বসে মহাভারতের কথা শুনব। এ কথা আগেই বলব, কারণ পরবর্তী সময়ে সূর্য, ইন্দ্র, বায়ুর মতো। দেবতার ঔরস থেকেই আমরা পাণ্ডব-ধুরন্ধরদের জন্মলাভ করতে দেখব। আবার অসুর-রাক্ষসদের বিচারও একটু করব, কারণ আর্য-শক্তির গৌরবে ভীম-পুত্ৰ ঘটোৎকচের জম্মটাও আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। অতএব আর সামান্যতম ধৈর্য ধরলেই–উপাখ্যান আর ইতিহাসে ডুবে যাব আমরা।
.
১৪.
মহাভারতের শান্তিপর্বে দেখা যাবে–দৈত্যরাজ বলির সঙ্গে ইন্দ্রের দেখা হয়েছে। অবশ্য দেখাটা খুব সহজে হয়নি, অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পরেই দেবতাদের রাজার সঙ্গে দৈত্যদের রাজার এই একান্ত শান্ত সাক্ষাৎকার ঘটেছে। দেবাসুরের যুদ্ধ নেই, অশান্তি নেই, পরস্পর ধেয়ে যাওয়া নেই, একেবারে শান্ত সাক্ষাৎকার। তবে এই কথার আগে দুটো কথা আছে। প্রথমেই জানাই, আবারও মনে রাখবেন–ইন্দ্র’ নামের মধ্যে যতখানি দেবত্ব আছে, তার থেকে বেশি আছে ‘রাজত্ব। অর্থাৎ ইন্দ্র একটা উপাধি মাত্র। ইহলৌকিক এবং প্রাক্তন পুণ্যবলেই ইন্দ্র’ হওয়া যায়। অসুর-রাক্ষসও এই ইন্দ্র হতে পারেন, মানুষও হতে পারেন ইন্দ্র। তবে কিনা একবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে তার যেমন আর নাম থাকে না, শুধু পি এম’ আসছেন, পি এম’ বলছেন–এই রকম একটা ব্যাপার ঘটে যায়, অপিচ প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে গেলেও যেমন তার পুরনো তকমাটা যায় না, ইন্দ্রের ব্যাপারও খানিকটা সেইরকম। এই মুহূর্তে যে দৈত্যকুলতিলক বলি-রাজার সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের দেখা হবে, সেই বলি-রাজার বংশে অন্তত তিনজন ইন্দ্র আছে। পৌরাণিকেরা জানিয়েছেন-দৈত্য-কুলে পরপর তিন পুরুষ ধরে যাঁদের ইন্দ্রত্ব লাভ করার ইতিহাস আছে, সেই বংশে এই বলি-রাজার জন্ম।
সেই দৈত্যরাজ বলির সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের সাক্ষাৎকারের পটভূমিকা এইরকম। দেবরাজ ইন্দ্র শক্তি লাভ করে তখন সমস্ত দৈত্যকে স্বর্গ থেকে হটিয়ে দিয়েছেন। স্বয়ং দৈত্যরাজ বলি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। সিংহাসনে আসীন অবস্থায় বলির সঙ্গে দেবরাজের দু-একবার যে সাক্ষাৎ হয়নি, তা মোটেই নয়। কিন্তু দৈত্যরাজের ক্রিয়া-কর্ম, বৃত্তি তথা লোক-ব্যবহার সম্বন্ধে ইন্দ্রের যতটুকু বোঝা আছে, তার থেকে না-বোঝার অংশ বেশি এবং সেই কারণে বলির সম্বন্ধে কৌতূহলও তার কম নয়। তা ইন্দ্রের এখন সুখের সময়, তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে পৌঁছলেন, মনে ইচ্ছা–দুদণ্ড গল্পও করবেন, স্বর্গজয়ের সুখ-সংবাদও দেবেন, আর দৈত্যরাজ বলির সম্বন্ধে দুটো প্রশ্নও করবেন, কারণ, বলির সঙ্গে ব্রহ্মার যোগাযোগও কিছু কম ছিল না।
ইন্দ্র ব্রহ্মাকে বললেন, পিতামহ। এই দৈত্যরাজ বলিকে আমি ঠিক চিনতেও পারছি না, বুঝতেও পারছি না। ব্যাপারটা কী, একটু বুঝিয়ে বলুন তো-তং বলিং নাধিগচ্ছামি ব্ৰহ্মম্নাচক্ষব মে বলি। বলি এত দান-ধ্যান করত, এত তার সহায়-সম্পদ, অথচ এখন তার কী অবস্থা, তা কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন।
আসলে ইন্দ্র তার স্বর্গের সিংহাসন লাভ করার পরেও বলির প্রভাব ব্যাপ্ত দেখেছেন সর্বত্র। ব্রহ্মাকে তিনি বলেছেন যে মনে হচ্ছে, বলিই যেন বায়ু হয়ে চারদিকে বইছেন, বলিই যেন বরুশ হয়ে জলে আছেন, সূর্য-চন্দ্রের প্রখর-মৃদুল কিরণমালায় তারই জ্যোতি যেন ফুটে বেরচ্ছে–স বায়ুৰ্বরুশশ্চৈব স রবিঃ স চ চন্দ্রমা। এই যে অগ্নি, বায়ু, সূর্য-চন্দ্রের মধ্যে ইন্দ্র বলিকে দেখতে পেলেন এটাই দৈত্যরাজ বলির প্রভাব এবং ব্যাপ্তি। এই প্রভাব বলির সিংহাসনচ্যুতির পরেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে–অধিকারী শাসক হিসেবে তিনি এতটাই বড়। ইন্দ্র তাই ব্রহ্মার কাছে ছুটে এসেছেন–বলির ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিন তো, পিতামহ। তিনি এখন কোথায় কীভাবে রয়েছেন?
ব্ৰহ্ম বুঝতে পারলেন-বলির অবিচ্ছিন্ন প্রভাব-প্রতিপত্তির ব্যাপারে দেবরাজ ইন্দ্রের রীতিমতো ঈর্ষা আছে। উত্তর দেওয়ার সময় ইন্দ্রকে সে কথাটা না বুঝতে দিলেও ব্রহ্মা একটু কড়া করেই বলেন, কাজটা তুমি ভাল করলে না, দেবরাজ! বলি কোথায় কীভাবে রয়েছেন সেটা জিজ্ঞাসা করে তুমি ভাল কাজ করলে না–নৈতত্তে সাধু মঘব যদেমনুপৃচ্ছসি। যাই হোক, জিজ্ঞাসা যখন করেছ, তখন মিথ্যা বলব না। একটি শূন্য গৃহ যেখানে কেউ থাকে না, এমন জায়গায় বলি রয়েছেন। কিন্তু তার চেহারাটা আর দৈত্যরাজের মতো নেই। একটি খালি বাড়ির ভিতর তিনি উট, ষাঁড়, ঘোড়া অথবা গাধা-এদের যে কোনও একটির রূপ ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বলির করুণ অবস্থা শুনে ইন্দ্র বললেন, যদি কোনও রিক্ত-নির্জন বাড়িতে আমার সঙ্গে বলির দেখা হয়ে যায়, তবে আমি কি তাকে মেরে ফেলব পিতামহ? ব্রহ্মা এই আশঙ্কাই করছিলেন। তিনি বললেন, বলির ওপর একেবারেই কোনও হিংসা আচরণ কোরো না দেবরাজ! বলি কিন্তু হত্যার যোগ্য নন মোটেইমাম্ম শত্রু বলিং হিংসীন বলির্বধমতি। বরং যদি পার তো তার কাছে ন্যায়-নীতির উপদেশ শুনতে চেয়ে কিছু।
ইন্দ্র রাজকীয় মর্যাদায় ঐরাবতে চড়ে বলিকে খুঁজতে চললেন পৃথিবীতে। এক জায়গায় তার দেখাও মিলল, লোকপরিত্যক্ত এক শূন্য গৃহে বলি একটি গাধার রূপ ধারণ করে বাস করছেন। আমার মতে–এই গাধার ছদ্মবেশ কিছুই নয়। দৈত্যরাজ বলি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। অতএব দেবতাদের ফাঁকি দেবার জন্য অত্যন্ত দীন-হীন বেশে মূর্খের ভাব-বিকার দেখিয়ে একটি লোক পরিত্যক্ত গৃহে বাস করছিলেন বলি। ইন্দ্রের সঙ্গে তার দেখা হল একান্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে।
ইন্দ্র খোটা দিলেন প্রথমেই। বললেন, দানবরাজ! আপনি যে পুরো গাধা হয়ে রয়েছেন, আর গাধারা যেমন তুষ খায়, আপনিও তো তেমন তুষই খাচ্ছেন। সত্যি করে বলুন তো, আপনার খারাপ লাগে না? কষ্ট হয় না–ইয়ং তে যোনিরধমা শোস্যথ ন শোচসি? আর এ কী জঘন্য অবস্থা হয়েছে আপনার? কী দূরদৃষ্ট? শত্রুরা এখন আপনার মাথার ওপর। রাজলক্ষ্মী অন্যের কণ্ঠলগ্ন। বন্ধু-বান্ধব সহায় কেউ নেই। আপনার পরাক্রম এবং উৎসাহও কিছু দেখছি না।
ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বলেছিলেন-বলিকে হিংসা কোরো না। তার কাছ থেকে বরং নীতিশাস্ত্রের উপদেশ শুনো। কিন্তু চিরকালের শত্রু যখন বিপদে পড়ে, তখন কি তাকে একটু কথা না শুনিয়ে পারা যায়, নাকি নিজের হর্ষোক্কাসই বা চেপে রাখা যায়। ইন্দ্রও তাই কথা শোনাচ্ছেন বলিকে। ইন্দ্র বললেন, এককালে আপনার আত্মীয়-স্বজনেরা হাতি-ঘোড়ায় চড়ত আর সব সময়েই আপনাকে ঘিরে রাখত। আপনি নিজের প্রতাপে সমস্ত লোককে অভিভূত করে রাখতেন, আর আমাদের তো গণনার মধ্যে আনতেন না-লোকান্ প্রতাপয় সর্বান্ যাস্যম্মা অবিতর্কয়। এসব কি আপনার মনে পড়ে? দৈত্য-দানবরা এক সময়–আপনি কখন কী আজ্ঞা করেন, তা পালন করার জন্য মুখিয়ে থাকত। আপনার রাজ্য পালন করার মর্যাদাও তো কিছু কম ছিল না। এমনই আপনার মহিমা যে, হাল চাষ না করলেও জমিতে শস্য ফলত আপনার প্রভাবে। সে সব এখন কোথায়? এখন এই সমুদ্রের পূর্বতীরে পরিত্যক্ত শূন্যগৃহে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনি তুষ খেয়ে যাচ্ছেন। আপনার কষ্ট হয় না বলিরাজ-শোচসি আহো ন শোচসি?
ইন্দ্র এবার দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি তুলনায় বলির মনে আঘাত দিয়ে বললেন, কী দিন ছিল আপনার। আপনি যখন আত্মীয়-স্বজনদের ধন দান করতেন, তারা যখন আপনাকে ধন্যধ্বনি দিত, তখন কেমন লাগত আপনার–তদাসীত্তে মনঃ কথম্? কেমন লাগত–যখন দারুণ সেজেগুজে স্বর্গের বিলাস-ভবনে গিয়ে বসতেন, আর শত শত স্বর্গসুন্দরীরা, সালংকারা দেবরমণীরা আপনার সামনে ঝুমুর নাচত– ননৃতু দেবযোষিতঃ–তখন কেমন লাগত আপনার? আচ্ছা, আপনার সেই সোনার ছাতাটাই বা কোথায় গেল, হিরা-পান্না খচিত সেই সোনার ছাতাটা, যেটা আপনার মাথার ওপর ধরা থাকত সব সময়? সেই সোনার পানপাত্র? ভৃঙ্গার-ভরা সুবাসিত বারি? সেই চামর দুটি? স্বয়ং ব্রহ্মার দেওয়া সেই মালাটা? কিছুই তো দেখছি না, বলিরাজ-ব্রহ্মদত্তাঞ্চ তে মালাং ন পশ্যামসুরাধিপ।
দানবরাজ বলি অনেকক্ষণ ধরে ইন্দ্রের পিত্তি-জ্বলানো কথাগুলি শুনলেন। সাময়িকভাবে একটু রাগও হল তার। একটু রাগের নিঃশ্বাসও পড়ল। কিন্তু বলি ধৈর্য হারালেন না। বরং একটু মজা করেই বললেন, আমার পানপাত্র, সোনার ছাতা, চামর-দুটি, এমনকি সেই ব্ৰহ্মদত্ত মালাটাও তুমি এখন দেখতে পাবে না, দেবরাজ। সব গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি। সময় যখন আসবে, তখন টুক-টু করে সব বার করব, তখন দেখবে–যদা মে ভবিতা কালস্তদা ত্বং তানি দ্রক্ষ্যাসি। এখন আমার সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি সব গেছে, আর আপনার হয়েছে বাড়-বাড়ন্ত, কিন্তু তাই বলে আপনি যেমন হামবড়াই করছেন–এটা আপনার বংশ এবং যশ-কোনওটার সঙ্গেই খাপ খাচ্ছে না।
দানবরাজ বলি এবার তত্ত্বকথা বলতে আরম্ভ করলেন। সুখে স্পৃহা নেই, দুঃখে মন অনুদ্বিগ্ন, সমস্ত পার্থিব সুখেরই শেষ আছে-অতএব গাধার মতো জীবন যাপন করেও বলির মনে কোনও দুঃখ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুখ এবং দুঃখ-দু’য়েরই স্বরূপ তিনি জানেন। অতএব বলি দুঃখ পান না–যদেবমভিজানাসি কা ব্যথা মে বিজানতঃ! বলি বিরাট আলোচনা করলেন মহাকাল নিয়ে। মানুষের ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, সমৃদ্ধি-পতন, জয়-পরাজয়–সবই মহাকালের ছন্দে বাঁধা আছে। বলি বললেন, আজকে আমি গাধা হয়ে তুষ খাচ্ছি বলে আপনি পরিহাস করছেন, কিন্তু আপনিও বেশি পৌরুষ দেখাবেন না-মা কৃথাঃ শক্র পৌরুষম। আপনি যে আজকে ভাল অবস্থায় আছেন–এটা আপনি করেননি। আবার আমি যে এখানে গাধা হয়ে আছি–এটাও আমি করিনি–নৈতদস্মৎকৃতং শত্রু নৈতচ্ছ ত্বয়া কৃত। যে করেছে, সে হল মহাকাল, তার হাত থেকে রেহাই নেই কোনও।
বলি এবার একটা লৌকিক উপমা দিলেন। বললেন, কত সুন্দরী সুলক্ষণা রমণীকে দেখি, কী খারাপ ভাগ্য তাদের, কী কষ্টেই না তারা থাকে। আবার কুৎসিত কুরূপা কত মহিলা পরম সৌভাগ্য-সমৃদ্ধির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তাও দেখি। মহাকালের কাজটাই এইরকম। সমস্ত চরাচরে প্রাণীরা যে গতি লাভ করে, সেই গতি আপনি এড়িয়ে যাবেন কোথায়–গতিং হি সর্বভূতানামগত্বা ক গমিষ্যতি?
বৈরোচন বলি ইন্দ্রকে ভালরকম চেনেন। অমৃত-মন্থন থেকে আরম্ভ করে অনেক ক্ষেত্রে তার সঙ্গে ইন্দ্রের দেখা হয়েছে। দুজনেই পৃথিবীকে দেখেছেন, চিনেছেন অনেক। কিন্তু ইন্দ্র যেভাবে যেচে বলিকে নানা কথায় পরিহাস করেছেন, বলি তার জবাব দিচ্ছেন একটু একটু করে। বলি বললেন, আগেও যেমন আপনার ছেলেমানুষি দেখেছি, এখনও দেখছি আপনি সেইরকমই ছেলেমানুষ আছেন–কৌমারমেব তে চিত্তং যথৈবাদ্য তথা পুরা। আরে, আমাকে তো আপনি এককালে দেখেছেন। দেবতা, গন্ধর্ব, রাক্ষস, নাগ, মানুষ, সকলেই আমার শাসনে ছিল। এমনকি আমি যে দিকে দাঁড়িয়ে থাকতাম, শুত্রুরা সে দিকটাকেই নমস্কার করে বলত–যে দিকে বৈরোচন বলি রয়েছেন, সেই দিককে নমস্কার–নমস্তস্যৈ দিশে’পস্তু যস্যাং বৈরোচনো বলিঃ।
বলি নিজের উদাহরণ দিয়ে ইন্দ্রকে বোঝালেন–আর আজকে আমার অবস্থা দেখছেন তো? বসে বসে তুষ খাচ্ছি। সেইরকম আপনিও যেমন আজকে রাজলক্ষ্মীর অধিকার লাভ করে ভাবছেন যে, তিনি আপনার কাছে আছেন–ও ধারণাটা মিথ্যে। সম্পূর্ণ মিথ্যে–স্থিতা ময়ীতি তস্মিথ্যা। বলি এবার কেটে কেটে বললেন, আরে! আপনার চেয়ে গুণী আরও হাজারটা ইন্দ্র আগে চলে গেছেন। এই রাজলক্ষ্মী তাদের কাছেও ছিলেন, তারপর আমার কাছেও ছিলেন, আবার এখন গেছেন আপনার কাছে, কাজেই মাথাটা বেশি গরম করবেন না, এত
মেজাজও দেখাবেন না–মৈবং শক্র পুনঃ কাষীঃ শাস্তো ভবিতুমহসি। শুধু মনে রাখবেন আপনার আগে আপনার মতো আরও হাজারটা ইন্দ্রের জমানা চলে গেছে এবং তারা কেউ শক্তি বা ক্ষমতায় আপনার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না–
বহুনীসহস্রাণি সমতীতানি বাসব।
বলবীর্যোগপন্নানি যথৈব ত্বং শচীপতে।
মহাভারতে বলি-বাসব-সংবাদ যেমনটি আছে, আলোচনা বেশ বড়, তত্ত্বও অনেক গভীর। সম্পূর্ণ অধ্যায়টিকে ছোট করে আমি আপনাদের একটা ধারণা দিতে চেয়েছি এবং তার উদ্দেশ্য একটাই। দানবরাজ বলির জবানিতে আমি শুধু দেখাতে চাইলাম যে, দেবতারা বিষ্ণু-স্বরূপিনী মোহিনীর নবীন-নবনীনিন্দিত হস্ত থেকে যতই অমৃত পান করে থাকুন, দেবতারা কেউ অমর নন। এমনকি এই প্রসঙ্গে অমর শব্দটার গুঢ়ার্থও কিছু বোঝা যেতে পারে। পৌরাণিকেরা কথাত্তরে বলেছেন, আমাদের এই সংসার-যাত্রা কোনকালে আরম্ভ হয়েছে, তা যেহেতু জানি না, অতএব সংসারচক্রকে আমরা অনাদি বলি, কিন্তু দেহ আছে যাদের, তাদের দীর্ঘ জীবন কখনওই দেখি না–ন হ্যস্য জীবিতং দীর্ঘং দৃষ্টং দেহে তু কুচিৎ। কেউ বালক বয়সেই মরে যাচ্ছে, কেউ বা একশো বছর বেঁচেও থাকছে। কিন্তু একশো বছর যে বেঁচে আছে, তাকে যে লোকে ‘অনন্ত’জীবী বলে, তা কিন্তু অল্পজীবীদের তুলনায়। আর একশো বছর বেঁচেও যে মরল না, যাকে দেখে মনে হয়–কী দীর্ঘ আয়ু! আহা এঁর বুঝি মরণ নেই, ইনি বেঁচেই থাকবেন, তাকেই লোকে ‘অমর’ বলে–জীবিতো ন ম্রিয়ত্যগ্রে তস্মাদ অমর উচ্যতে। এই নিরিখে দেবতারাও কেউ অমর নন। তাদের জন্ম-মৃত্যু সবই প্রায় মানুষের মতোই।
বলা যেতে পারে–এ তো মানুষের কথা হল। মানুষের মধ্যে যারা দীর্ঘজীবী, তাদের কথাপ্রসঙ্গে আমরা অনেক সময় বলি–উনি অমর। স্বর্গের দেবতাদের কি ওরকম মানুষের মতো ভাবলে চলে? ধম্মে সইবে এসব কথা? তাহলে প্রশ্ন আসবে–দেবতাদের শরীর আছে কি না, অথবা তাদের আকৃতি-প্রকৃতিও বা মানুষের সঙ্গে মেলে কি না? যদি শরীর থাকে, আর মানুষের আচার-ব্যবহারের সঙ্গেও তাদের মিল থাকে, তবে তাদেরও জন্ম-মরণ থাকবে তাতে আশ্চর্য কী?
দেবতাদের শরীর আছে কি না-এ তর্ক আজ থেকে নয়, এ তর্ক বেদের আমল, মানে ধরুন অন্তত তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে এই তর্ক চলছে। কথাটা আমাদের ধরতে হবে যাস্ক মুনির অভিধান নিরুক্ত থাকে। যাস্কই বোধ হয় প্রথম লোক যিনি চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অর্থাৎ পাণিনিরও আগে শব্দের নিরুক্তি বিচার করে একটা অভিধান লিখেছিলেন। এই অভিধানের মধ্যে বৈদিক দেবতাদের নিয়ে একটা বড় সড় বিচার আছে। দেবতাদের শরীরের কথাটা আমাদের এখান থেকেই শুরু করতে হবে।
দেবতাদের শরীর আছে, কি নেই–এই নিয়ে যাস্কের সময়েই দু’রকম মত ছিল। এক পক্ষ বলতেন, দেবতাদের দেখতে হয়তো মানুষের মতোই–পুরুষবিধাঃ সুরিত্যেক। আর অন্যরা বলেন, মোটেই তা নয়। দেবতাদের শরীর-টরীর কিছু নেই। তারা সব আকাশস্থ অদৃষ্টির জীব। মানুষের মনোলোকেই তার প্রতিমা। যারা ভাবেন-দেবতার শরীর নেই, যাস্ক তাদেরকে ঠেলে ফেলে দেননি ঠিকই, কিন্তু তার নিজের পক্ষপাতটা যেন শরীরবাদীদের দিকেই, যদিও শেষ পর্যন্ত অশরীরবাদীদের কথা বলে তিনি দুই মতই স্বীকার করে নিয়েছেন–অপি বা উভয়বিধাঃ স্যুঃ। বৈদিক দেবতাদের শরীর এবং ক্রিয়াকাণ্ড মানুষের মতো বলেই যাঁরা ভাবেন, তাদের কতগুলি যুক্তি আছে। যুক্তিগুলি যাস্ক যেভাবে সাজিয়েছেন আমি তা এক এক করে বলছি।
প্রথম কথা হল, ঋষিরা সমস্ত বেদের মন্ত্রবর্ণের মধ্যে দেবতাদের এমন ভাবে স্তুতি করেছেন, যাতে মনে হবে দেবতাদের মানুষের মতোই চেতনা আছে। আর চেতনা যাঁদের আছে, তাদের শরীর থাকবে না? এও কি কোনও কথা? বলতে পারেন–চেতনা তো গোরু-ঘোড়রও আছে, তাহলে দেবতাদের গোরু-ঘোড়ার মতোও দেখতে হতে পারে। যাস্ক বললেন, বাবা! ওই জন্যই আগে বলেছি–দেবতাদের হয়তো মানুষের মতোই দেখতে হবে–পুরুষবিধাঃ স্যুরিতি। গোরু-ঘোড়ার তো আর হিতাহিত বোধ নেই, কাল কী হবে–বোধ নেই, কাজেই ওই রকম চেতনার কথা আমরা বলছিও না। মানুষের যেমন চেতনা, মানুষের যেমন কাজকর্ম দেবতাদেরও তেমনই হওয়া সম্ভব। নইলে দেবতাদের উদ্দেশে বেদের অর্ধেক স্তুতি-সূক্ত উন্মত্তের প্রলাপ বলে মনে হবে।
পরিচিত ব্যক্তি বাড়িতে এলে আমরা যেমন বলি–আসুন, বসুন, তামাক খান, তেমনই ঋষিদের মুখে শোনা যাবে-ইন্দ্র! তুমি এস এস। এই কুশের আসনে বস, সোমরস তৈরিই আছে–পান কর–আ যাহি সুষমাহিত ইন্দ্র সোমং পিবা ইম। এদং বহিঃসদে মম। স্তুতির ভাষায় এই অভিবাদন-অভিনন্দনের মাত্রাটা চেতন মানুষের প্রতিরূপ কোনও চেতন শরীরী দেবতার উদ্দেশেই ব্যবহার করা যায়। নইলে বলতে হয়–যিনি এই অভিবাদন করছেন, তিনি পাগল। ঋগবেদের প্রায় প্রতিটি সূক্তেই ঋষিরা ইন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, সূর্য ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশে–এস’, যাও’, ‘খাও’, ‘পান কর’, ‘আমাদের শত্রু জবাই কর’, ‘আমাদের এটা দাও, সেটা দাও’–ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত করে দেবতাদের চেতন সত্তা মেনে নিয়েছেন-চেতনাবদ্ভিঃ স্বতায়ো ভবন্তি।
যাস্ক তার দ্বিতীয় যুক্তি সাজিয়েছেন দেবতাদের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে। তিনি বলেছেন, বেদের মন্ত্রের মধ্যে দেবতাদের হাত, পা, চোখ, মুখ, কান-সব কিছুরই বর্ণনা আছে মানুষের মতো করেই। ইন্দ্রের বলিষ্ঠ বাহুর ওপর নির্ভর করে স্তুতিকারী ঋষিরা নির্ভয়ে জীবন কাটাতে চেয়েছেন-ঋম্বা ত ইন্দ্র স্থবিরস্য বাহু উপ স্বেয়াম শরণা বৃহন্তা। একই শরীরে বেদ-বর্ণিত আদিত্য সূর্যের ভাস্বর মুখ, সবিতা-সুর্যের হিরণ্যহস্ত আর মিত্রের চক্ষুকে সন্নিবেশ করলে যে দেব-পুরুষের রূপ বৈদিকদের হৃদয়গোচর হয়েছিল, বস্তুত সেই রূপই পরবর্তী কালে পাণ্ডবজননী কুন্তীরও নয়নগোচর হয়েছিল। ইন্দ্রের বজ্রমুষ্টির আশ্রয় গ্রহণ করাটাকে যদি একটা রূপকের মতো ধরে নিই–যদি ধরে নিই শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তার বজ্রমুষ্ঠির কথাটা কল্পনা করেছেন ঋষিরা, তাহলে ইন্দ্রের হনু-দুটিকে নিশ্চয় শত্রুদমনে রূপক বলে ভাবা যাবে না। অথচ ইন্দ্রের মুষ্টির মতো তার হনুর প্রশংসাও তো কিছু কম নেই বেদে-মৎস্বা সুশি হরিবস্তদীমহে ত্বে আর ভূষন্তি বেধসঃ। আর শুধু, ইন্দ্র অথবা সূর্যই নয়, অগ্নি, অশ্বিনীকুমার, বায়ু–এই সব দেবতারই নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা থাকায় দেবতার শরীরবাদীরা বলেছেন দেবতার চেহারা মানুষের মতোই হবে।
দেবতাদের যান-বাহন, বাড়ি-ঘর, দুর্গের কথাও বেদের মধ্যে অনেক পাওয়া যাবে। পাওয়া। যাবে নানা ধরনের ক্রিয়া-কাণ্ড-খাওয়া, পান করা, যুদ্ধ করা, বধ করা, অশ্ব অথবা রথ-চালনা করা, বাঁশি বাজানো, গর্জন করা ইত্যাদি। এতগুলি মনুষ্যোচিত ক্রিয়াকলাপ দেখে বৈদিকরা অনেকেই দেবতার শরীরে বিশ্বাস করেছেন।
ভারি আশ্চর্য ব্যাপার হল, শুধু বৈদিকদের একাংশমাত্রই নয়, দেবতাদের বিশিষ্ট শরীরের অস্তিত্ব নিয়ে বৈদান্তিকরাও কম মাথা ঘামাননি। স্বয়ং শঙ্করাচার্য, যিনি নিরাকার-নির্বিশেষ ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই মানেন না, তিনি পর্যন্ত বলেছেন, দেবতাদের রূপ আছে, শরীরও আছে। সেরকম না হলে আমরা একেকজন দেবতা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই করতে পারতাম না–ন হি স্বরূপরহিতা ইন্দ্রাদয়ঃ চেতসি আরোপয়িতুং শক্যন্তে। আমাদের কাছে যেটা বড় প্রয়োজন, সেটা হল–দার্শনিক শঙ্কর দেবতার শরীর স্বীকার করে নেওয়ার জন্য যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটা মহাভারতের উদাহরণ। কন্যাবস্থায় কুন্তীর সানন্দ সপ্রেম আহ্বান লাভ করে সূর্য যে তার বাহুপাশে ধরা দিয়েছিলেন, এই ঘটনাটাই দেবতার শরীর-প্রমাণে সাহায্য করেছে শঙ্করকে।
তবে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের তুলনা দিতে গিয়ে শঙ্কর বলেছেন–দেবতারা মানুষের মতো জীবই বটে, তবে তারা উন্নত শ্রেণীর জীব। ক্ষমতায়, বুদ্ধিতে এবং ঐশ্বর্যে তারা মানুষের চেয়ে অনেক বড়। ঠিক এই কথাটাই অন্যভাবে বলেছেন পৌরাণিকেরা। পৌরাণিক
বলেছেন–আমরা নিজেদের কথা বলছি না, তত্তদশী ঋষিরাই এই কথা বলেন। তারা বলেন, মানুষের শরীর, আকার অথবা চেহারা যেমন, দেবতাদেরও প্রায় তাই
মানুষস্য শরীরস্য সন্নিবেশস্তু যাদৃশঃ।
তক্ষণন্তু দেবানা দৃশ্যতে তত্ত্বদর্শনাৎ৷৷
তবে কিনা মানুষের বুদ্ধি যত, দেবতাদের বুদ্ধি তার থেকে অনেক বেশি–বুদ্ধতিশয়যুক্ত দেবানাং কায়মুচ্যতে। লক্ষণীয় বিষয় হল, শুধু দেবতা নয়, বুদ্ধির আতিশয্য জিনিসটা অসুর-রাক্ষসদেরও যথেষ্ট পরিমাণ আছে এবং তা মানুষের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ অসুর-রাক্ষস-নাগরাও কিন্তু মানুষের চেয়ে উচ্চ স্তরের জীব। এই ধারাণাটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন সাংখ্য-দর্শনের প্রবক্তা ঈশ্বরকৃষ্ণ। পরে আসছি সে কথায়।
০১৫. ভীষ্ম তখনও শরশয্যায়
১৫.
ভবিষ্যতের কথা এখনই প্রসঙ্গত এসে গেল। পিতামহ ভীষ্ম তখনও শরশয্যায় শুয়ে আছেন। আর যুধিষ্ঠির তার ভাইদের সঙ্গে কৃষ্ণের সঙ্গে ঘিরে বসে আছেন। শরশয্যায় শুয়ে শুয়েই ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। রাজনীতি, ধর্মনীতি, দেবতা, অসুর–কত কথাই না আসছে। প্রশ্নের পর যুধিষ্ঠির হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ঠাকুরদাদা! তুমি তো সব শাস্ত্রই জান। তো আমার একটা কথার উত্তর দাও। আমার প্রশ্ন–এ জগতে দৈবই বড়, না, পুরুষকার বড়?
পিতামহ ভীষ্ম কষ্ট-ক্লমহীন নীরোগ মানুষটির মতো বলে উঠলেন–আরে! ঠিক এই প্রশ্নই তো স্বয়ং বশিষ্ঠমুনি করেছিলেন পিতামহ ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। চতুর্বেদ তার কণ্ঠভূষণ। সেখানে ব্ৰহ্ম যেমন করে প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছিলেন, সেটাই তুমি শোনো। ব্রহ্মা বলেছিলেন-বীজ ছাড়া শস্য হয় না, বীজ ছাড়া ফলও হয় না। বীজ থেকেই বীজ। বীজ থেকেই ফল। একজন কৃষক ক্ষেতে যে ধরনের বীজ ছড়ায়, সেই রকমই শস্য পায়। খুব খানিকটা হাল চালিয়ে ক্ষেতটাকে বীজ ছড়ানোর উপযুক্ত করা হল, তারপর ধর, বীজটাই বপন করলাম না। তার ফল কী? জমিটা নিষ্ফলা যাবে। ঠিক তেমনই পুরুষকার ছাড়া দৈবও কিছু করতে পারে না। ক্ষেত হল দৈব, বীজ হল পুরুষকার।
ব্রহ্মা ক্ষেত্র-বীজের কথা বলেই মানুষের জীবনে চলে এলেন। বললেন–যেমন কর্ম তেমন ফল। ভাল কাজ করো, ভাল ফল পাবে। পুণ্যের কাজ করো সুখ পাবে। পাপের কাজ করো, দুঃখ পাবে। যে লোক কাজ করে, খাটে, সে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে না, ভাগ্য তাকে সহায়তা করবে না–এ হতেই পারে না-কৃতী সর্বত্র লভতে প্রতিষ্ঠাং ভাগ্যসংযুতা। তুমি কাজ করো, সৌভাগ্য তোমার হাতের মুঠোয়, শুধু দৈব নিয়ে বসে থাকলে হবে না। পুরুষকার প্রয়োগ করো, ভোগ, সুখ স্বর্গ–তুমি যা চাও তাই পাবে–প্রাপ্যতে কর্মর্ণা সর্বং ন দৈবাদকৃতত্মনা।
ব্রহ্মা জীবনের কথা ছেড়ে এবার বাস্তব উদাহরণে আসছেন। তিনি বললেন–এই যে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, এত সব দেবতা, নাগ, যক্ষ–এরা সবাই মানুষ ছিলেন, কিন্তু শুধু পুরুষকারের দ্বারা এঁরা দেব-পদবি লাভ করেছেন-সর্বে পুরুষকারেণ মানুষ্যাদেবতাং গতাঃ।
দেখুন, দৈব কিংবা পুরুষকারের যে বিতণ্ডা, তাতে আমি একটুও আগ্রহী নই। আমার আগ্রহ শুধু একটা কথা নিয়ে–সবাই মনুষ্যভাব থেকে দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন–মানুষ্যা দেবতাং গতাঃ–শুধু এই কথাটুকুই আমার দরকার। উপরের শ্লোকটিতে দেবতা, নাগ, যক্ষের কথা বলা আছে, কিন্তু দৈত্য-দানবের কথা বলা নেই। নেই যে, তার বড় কারণ কিছু নেই। আসলে দেবতা, দৈত্য, দানব, যক্ষ, রাক্ষস নাগ–এঁরা সব এক পিতার পুত্র। মহাভারতের কবির বাঁধা কথাটা যেটা প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়, তা হল
দেব-দানব-গন্ধর্বা দৈত্যাসুর-মহোরগাঃ।
যক্ষ-রাক্ষস-নাগাশ্চ পিশাচা মনুজা স্তথা।
মহাভারতের কবি যে মোটামুটি একটা ক্রম দিলেন, এই ক্রমটাই পরবর্তীকালে দার্শনিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
সাংখ্য-দর্শনের প্রবক্তা ঈশ্বরকৃষ্ণ লিখেছেন–দেব-শরীর আট রকমের–অষ্টবিকল্লো দৈবঃ। তারা কারা? টীকাকার লিখলেন ব্রহ্মা, প্রজাপতি, ইন্দ্র, পিতৃগণ, গন্ধর্ব, নাগ, রাক্ষস এবং পিশাচ। পিশাচ থেকে ধরে একেবারে ব্রহ্মা পর্যন্ত– এঁরা পরপর উঁচু স্তরের জীব। এরা দেবযোনি, যেহেতু এঁদের মধ্যে সত্ত্বগুণ বেশি। কিন্তু এই সত্ত্বগুণটাও পিশাচের চেয়ে রাক্ষসের মধ্যে বেশি, রাক্ষসদের থেকে নাগদের মধ্যে বেশি। এইভাবে ব্রহ্মা পর্যন্ত,-যেটাকে শঙ্করাচার্য। বলেছেন–জ্ঞান এবং ঐশ্বর্যের প্রকাশটা এদের মধ্যে পরপর বেশি–পরেণ পরেণ ভূয়সী ভবতি।
কঠিন কথা বলে আরম্ভ করেছি, তাই বলে কঠিনভাবেই চালিয়ে যাব না। আমাদের কথাটা হল-ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা তথা অসুর-রাক্ষস-নাগ-গন্ধর্বরা–এদের জন্ম-পদবি এক –এরা সকলেই দেবতা, দেবযোনি। এঁদের কেউ বেশি ভাল, কেউ একটু মন্দ। কিন্তু দেবতা হওয়া সত্তেও এরা যে মনুষ্যধৰ্ম অতিক্রম করে গেছেন, তা মোটেই নয়, সাংখ্যের দার্শনিক লিখেছেন-জরা-মরণের কষ্ট দেবতাদেরও আছে। তবে তা একটু অন্যরকম। মানুষের যেমন–গায়ের রং পুড়ে গেল, দাঁত পড়ে গেল, লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারি না–ঠিক এমনটা না হলেও দেবতাদেরও বার্ধক্য কিংবা মরে যাবার কষ্ট আছে–সচ দেবভূমাবপি ভবতি।
আমরা বলি–সে আবার কী? সারা জীবন কত শুনেছি–এই মর্ত্যভূমিতে জন্মেই যত কষ্ট! সেই মাতৃগর্ভে জন্ম থেকে কষ্ট আরম্ভ হয়, তারপর কিছুদিন ভালয়-মন্দে যেতে না যেতেই বার্ধক্য শুরু হয়ে গেল, আরম্ভ হল রোগ-ভোগ, তারপর মৃত্যু তো আছেই। দার্শনিক বললেন–স্বর্গের দেবতাদের যত সুখ ভাবছ, তত সুখ মোটেই নয়। হ্যাঁ, জন্মের ব্যাপারটায় দেবতাদের অত কষ্ট নেই সত্যি, কারণ দেবতাদের জন্ম নাকি-তড়িদবিলসিতবৎ-চক্ষের নিমেষে তারা জন্ম নিতে পারেন, কিন্তু তাই বলে দেবভূমিতে রোগ-শোক নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেই–এমনটি মোটেই নয়।
সাংখ্যের যুক্তিদীপিকার লেখক রীতিমতো বেদের প্রমাণ দিয়ে বলেছেন–জানেন, এই যে ইন্দ্র, তাঁর একবার প্রচণ্ড অনিদ্রা রোগ হয়েছিল। দিনে-রাতে কখনই তার ঘুম আসে না। তিন ভুবনে এমন বৈদ্য-চিকিৎসক ছিলেন না, যাঁরা ইন্দ্রের অনিদ্রা রোগ সারানোর জন্য চেষ্টা করেননি। দিন দিন তিনি রোগা হয়ে যেতে লাগলেন। শেষে ঋষিরা তাঁকে ‘ত্বাষ্ট্রীয়’ সামগান শোনাতে আরম্ভ করলেন। সামগানের মধুর শব্দের ইন্দ্রে অনিদ্রা রোগ সেরে গেল–ইং ক্ষামমপি ন সর্বভূতানি প্রস্বাপয়িতুং নাশকুব। তমেতেন সাম্না ত্বষ্ট্ৰীয়েণ অস্বাপয়ৎ।
আমরা বলব-বেদের প্রমাণ তো আর অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু ওই একটা উদাহরণ থেকে কীই বা বোঝা যায়? সাংখ্য-কারিকার টীকাকার বলবেন–শুধু কি ইন্দ্র! স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মর শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল বায়ু-রোগে। আর চন্দ্র, তিন ভুবনকে স্নিগ্ধ আলোর জ্যোৎস্না-ধারায় স্নান করিয়ে দেন যিনি, তার যে কঠিন যক্ষ্মা হয়েছিল-প্রজাপতে বায়ু-রক্ষয়ীৎ, দক্ষাভিশাপাচ্চ সোমস্য ক্ষয়ঃ।
কথাটা শুনেই অবহিত হয়ে বসতে হবে আমাদের। দু’দণ্ড পরেই মহাভারতে শান্তনু, ভীষ্ম অথবা কুরু-পাণ্ডবের কত কাহিনী শুনব। কিন্তু কুরু-পাণ্ডবের বংশের নামই যে চন্দ্র-বংশ। মহামান্য দেবতাদের অন্যতম যে চন্দ্র, তিনিই তো কুরু-পাণ্ডবের বংশ-মূল, তার আবার যক্ষ্মা হল কবে? তিনি কি আমাদের মতো মানুষ নাকি, যে যক্ষ্মায় কাবু হবেন তিনি! দর্শনের টীকাকার বলবেন–আমাদের মতো সাধারণ মানুষ না হলেও স্বর্গভূমিতে বসে তার এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হয়নি। অর্থাৎ দেবতা হলেও রোগ-ভোগের কষ্ট থেকে তার পরিত্রাণ নেই। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, মানুষের তুলনায় তিনি কিছু বড়-মানুষ বটে, হ্যাঁ তার, জ্ঞান-ঐশ্বর্য মানুষের থেকে বেশ খানিকটা উঁচু স্তরের বটে, কিন্তু বোগ-শোক, জরা-মরণ তারও আছে।
আমরা চমকিত হয়ে বলব–কুরু-পাণ্ডব বংশের প্রথম জনক মহান চন্দ্র দেবতার এই গুরুতর অস্পৃশ্য অসুখের কথা কি মহাভারতের মধ্যে পাব? তাহলে তো আগে-ভাগে সেই অসুখের খবরটাই নেওয়া দরকার। একটি রোগগ্রস্ত অসুস্থ দেবতার খবর মহাভারতের মধ্যে পেলে একদিকে যেমন দেবতার মনুষ্য-ধর্মিতা জরা-মরণশীলতা আমাদের কাছে ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে উঠবে, তেমনই অন্যদিকে কুরু-পাণ্ডব বংশের প্রথম প্রতিষ্ঠাতার প্রতি কিছু সমবেদনাও জানানো সম্ভব হবে এই সুযোগে। ঘটনাটা ছিল এইরকম।
প্রজাপতি দক্ষের সাতাশটি মেয়ে ছিল। অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা–ইত্যাদি নামে যে সাতাশটি নক্ষত্রের নাম আমরা জানি, দক্ষের মেয়েরা হলেন এই সাতাশ নক্ষত্র-সুন্দরী। দক্ষ এই সাতাশটি মেয়েকে এক সঙ্গে চন্দ্রের হাতে সম্প্রদান করলেন- সপ্তবিংশতিং কন্যাং দক্ষঃ সোমায় বৈ দদৌ। দক্ষের সাতাশ মেয়ে সাতাশ জন নক্ষত্র সুন্দরীরূপে-গুণে তারা কেউ কম নন। কিন্তু এদের মধ্যে রোহিণী ছিলেন সবচেয়ে সুন্দরী–অত্যরিচ্যত তাসান্তু রোহিণী রূপ-সম্পদা। সে সৌন্দর্য এমনই অপ্রতিম যে, চন্দ্র তাঁর রূপের মোহে তার অন্য স্ত্রীদের অবহেলা করতে লাগলেন। সব সময় তিনি রোহিণীর ঘরেই পড়ে থাকেন, রোহিণীকেই ভালবাসেন, রোহিণী ছাড়া তিনি আর দ্বিতীয় কিছু জানেন না। চন্দ্রের এই আচরণে অন্য নক্ষত্র সুন্দরীরা সবাই ভীষণ রেগে গেলেন। নিজেদের সহোদরা বোনটি হলে কী হয়, স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হতে কার ভাল লাগে!
ছাব্বিশ নক্ষত্র-সুন্দরী স্বামীর ওপর অভিমান করে এক সঙ্গে দল বেঁধে বাপের বাড়ি চলে এলেন। পিতা দক্ষের কাছে সকলে মিলে নালিশ করলেন-দেখ বাবা এত তোড়জোড় করে তুমি চন্দ্রের সঙ্গে আমাদের বিয়ে দিলে, কিন্তু স্বামী আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তারা যত সোহাগ সব ওই তোমার আদরের মেয়ে রূপেশ্বরী রোহিণীর ওপর। সব সময় তাঁর আঁচল ধরে ঘুরছে–সোমা বসতি নাস্পাসু রোহিণীং ভজতে সদা। দক্ষের ছাব্বিশটি মেয়ে বাপের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল–কী হবে আর ওই স্বামীর বাড়ি থেকে। আমরা আজ থেকে এখানেই থাকব, নুন-ভাত যা জোটে খাব, দেখব–কবে তার সময় হয়-বৎস্যামো নিয়তাহারা স্তপশ্চরণতৎপরাঃ।
দক্ষ মনে মনে প্রমাদ গুণলেন। এত গুলি মেয়ে একসঙ্গে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, এবং এসেছে তাদেরই এক ভগিনীর প্রতি নির্মম ঈর্ষায়। দক্ষ সোজা জামাই-বাড়ি গিয়ে চন্দ্রকে বললেন–এ তোমার কেমন ব্যবহার? আমার সাতাশটি মেয়েকে তুমি এক সঙ্গে বিয়ে করেছ অথচ সবার দিকে তুমি একরকম করে তাকাও না। এ তোমার কেমন ব্যবহার? সবাইকে তুমি সমানভাবে দেখ। সাতাশটি স্ত্রীর মধ্যে শুধু একতমার প্রতি এই নিদারুণ পক্ষপাত কি ধর্মে সইবে বলে মনে কর–সমং বর্তস্ব ভার্যাসু মা ত্বধর্মো মহান্ স্পৃশে। স্নেহময় পিতা ফিরে এসে মেয়েদের বললেন–এবার স্বামীর বাড়ি যাও, মা-জননীরা। আমি জামাইকে খুব শাসন করে এসেছি। সে এখন সবাইকে সমান দেখবে।
বাবার কথা শুনে দক্ষ-কন্যারা আবার হই-হই করে চন্দ্রের গৃহে উপস্থিত হল। কিন্তু কোথায় কী! চন্দ্র যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন। সেই রোহিণী। সেই রোহিণী। তাকেই তিনি ভালবাসেন, তাঁকে নিয়েই তাঁর দিন-রাত কাটে। দক্ষকন্যারা আবার ফিরে এলেন বাপের বাড়ি। এবারে আর নতুন অভিমানে তারা কেঁদে বুক ভাসালেন না। বরং ঠান্ডা মাথায় তারা পিতা দক্ষকে বললেন-বাবা, তোমারও তো বয়স হয়েছে। জীবনের যে কটা দিন আছে, আমরা তোমার সেবা শুশ্রূষা করে কাটিয়ে দিতে চাই। আমরা এখানেই থাকব, বাবা–তব শুশ্রষণে যুক্তা বৎস্যামো হি তবাশ্রমে দক্ষ-কন্যারা এবার নিরুত্তেজিতভাবে বাবা দক্ষকে জানালেন–তুমি তো সেই এত করে বলে এলে। সে তোমার কথা শুনলে তো? সে যা হোক, আমরা আর ফিরে যাচ্ছি না।
মেয়েরা যাই বলুক। দক্ষের আত্মাভিমানে লাগল এসব কথা। তিনি আবারও গেলেন জামাই-বাড়ি এবং অভিশাপের ভয় দেখিয়ে সব মেয়েকে সমদৃষ্টিতে দেখার শাসন জারি করে ফিরে এলেন বাড়িতে। মেয়েরা তার কথায় আবার স্বামীর বাড়ি গেল এবং পুনরায় তার একই অপব্যবহার দেখে বাপের বাড়ি ফিরে এল। তাদের এবার রাগও হল খুব স্বামীর ওপরে তো বটেই, বাবার ওপরেও খানিকটা। বারবার স্বামীর ভালবাসা ভিক্ষা করে, বাপকে দিয়ে সালিশি করিয়ে এবং তাতেও বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোন রমণীর ভাল লাগে! দক্ষ-কন্যারা এবার পিতাকে বললেন-তোমার সোনার চাঁদ জামাই এখনও রোহিণীর ঘরেই বসে আছেন। তোমার কথা শুনতে তার বয়ে গেছে, আমাদের ভালবাসার কোনও দায়ই তার নেই–ন তদ্বচো গণয়তি নাস্পাসু স্নেহমিচ্ছতি। তা তোমার যদি আমাদের বাঁচানোর এতই তাগিদ থাকে, তবে সেই ব্যবস্থা করো, যাতে আমাদের স্বামী আমাদের ভালবাসে।
দক্ষ রাগে দিগবিদিক্-জ্ঞানশূন্য হয়ে পুনরায় জামাতার ঘরে এলেন এবং মুখে কঠিন অভিশাপ উচ্চারণ করলেন তার উদ্দেশে। মহাভারত বলেছে–চন্দ্রকে শাস্তি দেবার জন্য দক্ষ ভয়ঙ্কর যক্ষ্মা রোগের সৃষ্টি করলেন এবং যক্ষ্মা চন্দ্রের শরীরে প্রবেশ করল।
চন্দ্রের যক্ষ্মা রোগের কাহিনী এইটুকুই। হয়তো এই কাহিনীর মধ্যে অন্যতর দুটি বিশ্বাস লুকোনো আছে এবং সেই বিশ্বাসই প্রতিপন্ন হয়েছে রোগগ্রস্ত চন্দ্রমার কাহিনীতে। প্রাচীনরা বিশ্বাস করতেন–অতিরিক্ত স্ত্রী-সম্ভোগের ফলে যক্ষ্মা হয় এবং এই ধারণা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও চালু ছিল। আমাদের ধারণা, এই চিরন্তনী ধারণাই উপাখ্যানের আশ্রয় নিয়েছে রোহিণী-চন্দ্রের নিবিড় সম্ভোগে। আরও একটা বিশ্বাস যা আছে, তা শুধু বিশ্বাস নয়, মাহাত্ম-খ্যাপন। চন্দ্র এই সাংঘাতিক রোগ থেকে পূর্ণ মুক্তি পাননি, কিন্তু খানিকটা যে তিনি সেরে উঠেছিলেন, তা শুধু সরস্বতীর তীরে প্রভাস তীর্থে স্নান করে।
আমাদের পূর্ব প্রস্তাব অনুসারে চন্দ্রের যক্ষ্মা রোগটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল–দেবতাদেরও মানুষের মতোই রোগ-শোক আছে, এমনকি রোগ যে সারে না, তাও দেখা। গেল ওই চন্দ্রের ক্ষেত্রে। অমাবস্যা থেকে চন্দ্রের যে একেকটি কলা বৃদ্ধি হতে থাকে, তার কারণ সরস্বতী-প্রভাসে অমাবস্যার দিন নাকি চন্দ্র তার রোগ মুক্তির জন্য স্নান করেছিলেন এবং সেইদিন থেকে পনেরো দিন তিনি ভাল থাকেন, তার শরীরটিও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু পূর্ণিমার দিন তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখা গেলেও আবার তার শরীর শুকোতে থাকে। ফলে পরের অমাবস্যায় আবার তাকে তীর্থ-স্নান করতে হয়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি–সরস্বতীর তীর্থে স্নান করে চন্দ্র তার শরীরে দীপ্তি অর্থাৎ প্রভা ফিরে পেয়ে জগৎ আলো করেছিলেন বলেই ওই তীর্থের নাম প্রভাস।
যাই হোক, চন্দ্রের পুরো রোগ মুক্তি হল না। সাংখ্যকারিকার টীকাকার মন্তব্য করলেন–নৈনং যক্ষ্মাদমুঞ্চৎ–যক্ষ্মা চন্দ্রকে ছাড়েনি। ইন্দ্র, প্রজাপতি ব্রহ্মা, চন্দ্র–এই সমস্ত মহান দেবতা যেখানে সামান্য রোগ-শোকই এড়াতে পারছেন না, সেখানে মরণ যে তাদের হবেই সে কথা আর বেশি করে বলার কী আছে। দেবতাদের মরণকাল ঘনিয়ে এলে তাদের শরীরে কী কী দুর্লক্ষণ দেখা যায়–সাংখ্য দার্শনিকেরা তার একটা তালিকাও দিয়েছেন। বস্তুত, বিভিন্ন পুরাণেও আমরা দেখেছি যে, দেবলোক থেকে চ্যুত হওয়ার সময় দেবতাদের দিন বড় দুঃখে কাটে, এবং এই শেষের দিনটির কথা ভেবে তারা রীতিমতো ভয়ও পান।
দেবতাদের জরা-মরণ নিয়ে আর কোনও গভীর তত্ত্ব আমরা শোনাব না। কারণ আমাদের মতে তারা মানুষেরই নামান্তর। তবে একই সঙ্গে জানাই অসুর-রাক্ষস অথবা দৈত্য-দানবেরা কিন্তু দেবতাদেরই জাত ভাই। তারা একই বাপের ছেলে। বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যেমন ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, মামলা চলে, দেবতা আর অসুরদের মধ্যে সম্বন্ধটাই ওই একইরকম। স্বর্গের সম্পত্তি নিয়ে দুই বৈমাত্রেয় ভাইদের ঝগড়া। মামলার দরকার হলে দুই পক্ষই ব্রহ্মাকে সাক্ষী মানতেন। এঁদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। হার-জিৎ দুই পক্ষেই প্রায় সমান। আর যদি কালচারের কথা তোলেন, তো বলি–সে জিনিসটা অসুর-রাক্ষসদের বড় কম ছিল না। এরা প্রত্যেকে ভাল রকম সংস্কৃত জানতেন। সমুদ্রমন্থনের সময় বাসুকির পৃচ্ছদেশ ধরবার প্রস্তাবে দৈত্যরাজ বলির প্রতিক্রিয়া স্মরণ করুন। অপিচ বাল্মীকি রামায়ণে স্বয়ং রাক্ষসরাজ রাবণের সংস্কৃত এবং বেদে অধিকার লক্ষ্য করুন ভাল করে।
তবে মুশকিল একটা ছিল। প্রজাপতি কশাপের এই দৈত্য-রাক্ষস পুত্রেরা যেহেতু স্বর্গের অধিকার ভাল করে কোনও দিনই পাননি, তাই হঠাৎ হঠাৎ লুটপাট, নরহত্যা, নারীহরণ, ধর্ষণ–এইসব বদগুণ তাদের মধ্যে বেশি এসে গিয়েছিল। মহামতি গিরীন্দ্রশেখর বসু তাই কুত্রাপি অসুর রাক্ষসদের ‘গুণ্ডা’ বা ‘ডাকাত’ বলে সম্বোধন করেছেন। আজকাল রাষ্ট্রীয় নেতারা যেমন অনেক অসামাজিক কাজ নিজে করতে পারেন না বলে গুণ্ডা লাগান, সেকালেও তেমন ছিল। স্বয়ং বিশ্বামিত্র মুনি রাক্ষস লাগিয়ে ব্যাস পিতা পরাশরের বাবা শক্ট্রিকে হত্যা করিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মানতে হবে মহাভারত এবং পুরাণে অতি উৎকৃষ্ট গুণের অসুর-রাক্ষসেরও অভাব নেই কোনও।
অসুর-রাক্ষসেরা অবশ্য আগে মোর্টেই খারাপ ছিলেন না। প্রথম প্রথম এক বাপের দুই ছেলের যেমন ভাব-ভালবাসা থাকে, তেমনটি দেবতা এবং অসুরদের মধ্যেও ছিল-অসুরা যে পুরা হ্যাঁসন্ তেষাং দায়াদ-বান্ধবাঃ। তবে সমস্ত গোলমালের মূলে কিন্তু ওই পৃথিবীর অধিকার নিয়ে দুই পক্ষের বনিবনা না হওয়া। এমনকি অনেকে বলেন, অসুর-রাক্ষসেরা আগে দেবতাদের চেয়েও ভাল মানুষ ছিলেন এবং তারা খারাপ হয়েছেন দেবতাদের জন্যই। অবশ্য তারও কারণ কিন্তু সেই ভূমির অধিকার।
প্রায় বৈদিক যুগের অতি প্রামাণ্য গ্রন্থ শতপথ ব্রাহ্মণ, যেটিকে সকলে বেদ বলেই মানেন, সেই গ্রন্থে অসুর আর দেবতাদের সম্বন্ধে খুব প্রামাণিক একটা কথা পাওয়া যাবে। শতপথ বলছেন–প্রজাপতি যেমন দেবতাদের সৃষ্টি করেছেন, তেমনই অসুরদেরও সৃষ্টি করেছেন তিনিই–উভয়ে প্রাজাপত্যাঃ। তা এক সময় অসুররাই সমস্ত পৃথিবী দখল করে নিয়েছিলেন। অধিকার সম্পূর্ণ হবার পর অসুরেরা নিজেদের মধ্যে পৃথিবীটা ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথাও ভাবলেন। নেতারা আপন আপন অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য মাপ-জোকও আরম্ভ করে দিলেন। বিতাড়িত দেবতারা আরও বিপন্ন হয়ে উপস্থিত হলেন যজ্ঞপতি বিষ্ণুর কাছে। তারা ঠিক করলেন–ভাগাভাগির সময়েই অসুরদের ধরতে হবে। নইলে একবার নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে আর কিছুই মিলবে না। দেবতারা বিষ্ণুকে সঙ্গে নিয়ে অসুরদের কাছে গিয়ে দেখলেন–মাপজোক, নকশা চলছে জমির অধিকার নিয়ে। দেবতারা বললেন–সব যে নিজেরাই ভাগ করে নিচ্ছ, আমাদের কী হবে? আমরা কি কিছুই পাব না? আমাদের ধারণা–অসুররা যদি দেবতাদের কাছে এসে বলতেন–আমাদের কী হবে, তবে তারা বধির হয়ে থাকতেন।
কিন্তু অসুরেরা কত ভাল মানুষ দেখুন। তারা বললেন–তাই তো তোমাদেরও কিছু পাওয়া উচিত বটে। তা বাপু, সবাইকে তো আর দিতে পারব না। বরং, তোমাদের নেতা ওই বিষ্ণুর শুতে যতটুকু জায়গা লাগে, সেটা দেব তোমাদের–যাব দেবৈষ বিষ্ণুরভিশেতে, তাববো দপ্ন ইতি। এরপরের কাহিনী পুরাণে বলি-রাজার উপাখ্যানে কীর্তিত হয়েছে। বিষ্ণু শুলেন। কিন্তু শুয়ে, ফুলে, ফেঁপে তিনি সমগ্র পৃথিবী দখল করে নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন দেবতাদের।
এমন ঘটনা একবার নয়। বারবার ঘটেছে। অমৃত লাভের ক্ষেত্রেও ওই একই ঈর্ষা এবং ছলনা কাজ করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। একটি পুরাণে আমরা অতি অদ্ভুত ব্যাপারও একটা দেখেছি। সেখানে বলা হয়েছে–অসুরেরা ধন্বন্তরির হাত থেকে অমৃত-কলস ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু দেবতাদের প্রাপ্য ভাগ তারা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও অমৃত পান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার আগেই মোহিনী মায়ার জালে আবদ্ধ হয়েছেন অসুরেরা। মহাভারতের কথায় এই প্রসঙ্গে আগে আমি বলেছি যে, অমৃত এবং লক্ষ্মী–এই দুটি বিষয় নিয়েই দেবতা আর অসুরদের দ্বন্দ্ব চিরতরে শাশ্বতিক এক রূপ নিল-অমৃতার্থে চ লক্ষ্মর্থে মহান্তং বৈরমাশ্রিতাঃ।
তবে অমৃত আর লক্ষ্মীরও আগে যেটা, সেটা হল-ভূমির অধিকার। স্বর্গের অধিকার। আমাদের জিজ্ঞাসা–সেই স্বর্গভূমি কোথায়? আমরা সেই স্বর্গের ঠিকানা চাই।
.
১৬.
খুব সামান্য কথা। দেবতাদের শরীর মানুষের মতোই। তাদের আচার-ব্যবহার ভাব-ভঙ্গিও মানুষের মতো। তাদের বাড়ি-ঘর, বাগান, দুর্গ, রাজসভাও মানুষের মতো। সব কিছুই যখন মানুষের মতো, সেখানে তাদের বাসস্থান স্বর্গভূমিও যে মানুষের থাকবার মতোই একটা জায়গা হবে, সেটা খানিকটা অনুমানযোগ্য।
দেখুন, আমরা এর আগে দার্শনিক তথ্য দিয়ে জানিয়েছিলাম যে, স্বর্গ বলে একটা জায়গার কল্পনা করা হয়েছে বটে, তবে অনেকের মতে মনের প্রীতিকর জায়গাটাই হল স্বর্গ আর তার বিপরীত হল নরক। এ বিষয়ে মহাভারতও একমত হয়েছে। স্বয়ং ভৃগুমুনি সেখানে সদুপদেশ দিয়ে বলেছেন–দেখ, শারীরিক, মানসিক কোনও দুঃখই যেখানে নেই, সেই জিনিসটাকে বলে সুখ। আর সেই সুখ শুধু স্বর্গেই আছে, অন্যত্র নেই–নিত্যমেব সুখং স্বর্গঃ। উপদেশকামী ভরদ্বাজ বললেন, আমরা তো জানি–সেই রকম সুখ-স্বর্গ লাভ করতে হলে তো পরলোকে যেতে হবে। এখানে সেই পরলোক পাব কোথায়? সে পরলোকের কথা যে কেবল শুনেইছি, চোখে তো দেখিনি–অম্মাল্লোকাৎ পরো লোকঃ শায়তে ন তু দৃশ্যতে।
ভৃগুমুনি এবার জিজ্ঞাসু সুজনকে পরলোকের ঠিকানা বলছেন। তিনি বললেন–আছে, আছে। হিমালয় ছেড়ে আরও উত্তরে যাও, সেইখানে সেই পরলোকের সন্ধান পাবে–
উত্তরে হিমবৎপার্শ্বে পুণ্যে সর্বগুণান্বিতে।
পুণ্যঃ ক্ষেম্যশ্চ কাম্যশ্চ স পরে তোক উচ্যতে।
মুনি বললেন–সেখানে পাপী লোকের জায়গা নেই, লোভ নেই কারও, রোগ-শোক ব্যাধির বালাই নেই এবং সেখানে থাকেন যারা তারাও কিন্তু মানুষই–মানবা নিরুপদ্রবাঃ। স স্বর্গসদৃশশা দেশ স্তত্র স্থ্যক্তা শুভা গুণাঃ।
উত্তরে হিমাবৎপার্শ্বে–এই জায়গাটার সম্বন্ধে প্রাচীন ঋষি-মুনি-পৌরাণিকদের একটা নস্টালজিয়া’ আছে। মহাভারতের বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেকেই এই জায়গাটাকে মাঝে মাঝেই স্মরণে এনেছেন এবং তার কারণ নস্টালজিয়া। আমরা যখন এরপরে মহাভারতে মহারাজ পাণ্ডুর পুত্রলাভের প্রসঙ্গে পৌঁছব, তখন দেখব–পাণ্ডু অন্য পুরুষের সম্প্রয়োগে কুন্তীর গর্ভে পুত্রলাভ করতে চাইছেন। কুন্তী মানছেন না, পাণ্ডু তখন উদাহরণ দিয়ে বলছেন–উত্তর-কুরু দেশে এখনও এই নিয়ম আছে–উত্তরেষু চ রম্ভোরু কুরুযু অদ্যাপি পূজ্যতে।
পণ্ডিতেরা বলেন-মধ্য এশিয়ার পামির বা পূর্ব তুর্কিস্থানের মহাভারতীয় নাম হল ইলাবৃত-বর্ষ। এই উত্তর-কুরু সেই ইলাবৃত-বর্ষের আরও উত্তরে। গিরীন্দ্রশেখর বসু লিখেছেন–উত্তর-কুরু দেশেই ব্রহ্মলোক বা বিষ্ণুলোক। ঋকবেদে বিষ্ণুকে উন্নত’ অর্থাৎ উত্তরদেশবাসী বলা হয়েছে এবং সেই রাজ্যে প্রচুর শৃঙ্গী হরিণ পাওয়া যায়–ভূরিশঙ্গা গাবঃ। গিরীন্দ্রশেখরের নিজের ভাষায়–”পৌরাণিক নির্দেশ অনুসারে মনে হয় বিষ্ণুর রাজ্য ক্যাসপিয়ন সাগরের উত্তরে ছিল। হিন্দু তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী ক্যাসপিয়ন সাগরের তীরে যাইতেন তাহার প্রমাণ আছে। (দ্রষ্টব্য : বাকুতে হিন্দুমন্দির’ নামক প্রবন্ধ : নূতন পত্রিকা, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)। উত্তর কুরু সাইবেরিয়া বা রাশিয়ার কোনও স্থান বলিয়া মনে হয়। উপনিষদে ব্রহ্মলোক যাইবার পথে আর’ হ্রদ ও বিজরা নদীর উল্লেখ আছে। আর হ্রদ ও Lake Aral বোধহয় একই। বিজরা ও আধুনিক Pachora একই বলিয়া মনে হয়।”
ব্ৰহ্মলোক বা বিষ্ণুলোকের সামান্য একটা হদিশ পাওয়া গেল। এবারে স্বর্গ লোকের কথা বলি। বর্ষ মানে স্থান, জায়গা; যেমন ভারতবর্ষ– ভরত-বংশীয়দের জায়গা। এই রকমভাবে ভরত বংশীয়দেরও অতি-পূর্ব পুরুষ হলেন ‘ইল’। তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটি স্থান–যার নাম ইলাবৃত-বর্ষ। গিরীন্দ্রশেখর এই ইলাবৃত-বর্ষকেই স্বর্গভূমি বলে চিহ্নিত করেছেন এবং সে জায়গাটা মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। সম্ভবত পামির বা পূর্ব তুর্কীস্থান ইলাবৃতবর্ষের অন্তর্গত। গিরীন্দ্রশেখরের ধারণা–এই জায়গার নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই ইলাবৃত-বর্ষের সভ্যতা লুপ্ত হয় এবং নিতান্ত অলাভাবের জন্যই ইলাবৃত-বর্ষ থেকে ভারতের দিকে তারা আসতে থাকেন। কালবশে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তখন একদলের নাম হয় দেব অন্য দলের নাম অসুর।
অসুর শব্দটা যথেষ্ট পুরনো। এক সময় ‘অসুর’ শব্দে লোকে দেবতাও বুঝত। ঋগবেদে বহু জায়গায় দেবতাদের অসুর বলা হয়েছে। অসুরদের মধ্যে যে অদেবত্ব কিছু ছিল না, তার সবচেয়ে বড় ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ আবেস্তার ‘আহুর’ শব্দে। ভাষাতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন সংস্কৃত ‘অসুর’ শব্দই আঁবেস্তার ‘আহুর’। এবং জে আবেস্তাতে আহুর মানেই দেবতা–যেমন আহুরা মাজদা। তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, সুরাসুরে দ্বন্দ্ব যতই থাকুক, তাতে কারুরই মান্যতা নষ্ট হত না এবং পূর্বে তাদের ঠিকানাও ছিল এক–সেই ইলাবৃত-বর্ষ।
পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের উত্তরে এবং হেমকূট পর্বতমালার দক্ষিণে হল কিম্পূরুষ-ব। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের সীমা নিষধ পর্বত পর্যন্ত। আর ওই নিষধ পর্বতের উত্তরেই ইলাবৃত-বর্ষ। এটাই যে স্বর্গ তার কী প্রমাণ আছে? এবারে গিরীন্দ্রশেখর যা বলেননি, সে প্রমাণও দাখিল করছি। এক তো হল মহাভারতের সেই উত্তরে হিমবৎপার্শ্বের সেই সুখস্থানটি যাকে মহাভারত বলেছে–স স্বর্গসদৃশো দেশঃ। দ্বিতীয় প্রমাণ আছে পুরাণে। পুরাণ বলেছে-ইলাবৃত-বর্ষ জায়গাটা কী রকম? না, সেখানে দৈত্যরাজ বলির মহান যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছিল–যে যজ্ঞে বিষ্ণু বামন হয়ে পৃথিবী ভিক্ষা করে বলির রাজ্যাধিকার নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন–সেটাই ইলাবৃত-বর্ষ। আমাদের পূর্বকথিত ত্রিপুর দুর্গও এইখানেই। জিজ্ঞাসা করতে পারি–জায়গাটার আর কোনও বিশেষত্ব আছে কি? আছে। দেবতারা যেখানে জম্মেছিলেন, দেবতারা যেখানে বিবাহাদি করেন, যেখানে দেবতাদের অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ-সব কাজ হয়, এমন কি কন্যা সম্প্রদান করতে গেলেও দেবতাদের যে জায়গাটা ব্যবহার করতে হয়–সেই জায়গাটাই হল ইলাবৃত বর্ষ–
দেবানাং জন্মভূমি র্যা ত্ৰিযু লোকেষু বিশ্রুতাঃ।
বিবাহাঃ কুতবশ্বৈব জাতকর্মাদিকাঃ ক্রিয়াঃ।
এবারে মহামতি গিরীন্দ্রশেখরের অনুমানটা জানাই–দেবতারা ইলাবৃত-বর্ষ অর্থাৎ আধুনিক তুর্কিস্থান থেকে কাশ্মীরের পথে প্রথম ভারতে আসেন। তারা কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব এবং পাঞ্জাব থেকে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত আস্তে আস্তে অধিকার করে নেন। তারপর বিন্ধ্যের দক্ষিণেও রাজ্যবিস্তার করেন। ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে কাশ্মীর বা অন্তরীক্ষে এসে বসবাস শুরু করেন বলেই অন্তরীক্ষের অন্য নাম পিতৃলোক। অন্তরীক্ষ মানে মধ্যবর্তী দেশ। দেবলোক, পিতৃলোক এবং মর্ত্যলোক যথাক্রমে ইলাবৃতবর্ষ, কাশ্মীর এবং উত্তর ভারত।
গিরীন্দ্রশেখরের আরও বক্তব্য হল–দেবতারা যখন প্রথম ভারতে আসেন, তখন প্রথমে তারা ইন্দ্রের অধীন ছিলেন। স্বর্গ বা ইলাবৃত বর্ষের অধিপতির সাধারণ নাম ইন্দ্র। ভারতে তখন রাজা বলে কেউ ছিল না। ভারতে নেমে আসার পর দেবতারা মানব নামে পরিচিত হন কারণ ইন্দ্রের প্রতিভূ হলেন প্রজাপতি মনু–যাঁর নামে এই মানব জাতি। ইলাবৃত-বর্ষ ভারতীয়দের আদি বাসস্থান বলেই অতি পবিত্র তীর্থ বলে গণ্য হত। যুধিষ্ঠিরের সময়েও লোকে স্বর্গে তীর্থ করতে যেত। ক্রমে স্বর্গের পথ দুর্গম হয়ে পড়ে। কাশ্মীর থেকে তুর্কিস্থান যাওয়ার যে বণিকপথ এখনও আছে, সেটাই স্বর্গে যাওয়ার আদিপথ বা দেবযান-পথ বলে মনে হয়। উত্তরপ্রদেশের উচ্চ ভূমি এবং পর্বতও পরবর্তী কালে স্বর্গ নাম লাভ করেছিল।
স্বর্গারোহণের কথাটা এখন এমনই শুনতে লাগে, যেন সে স্বর্গ বুঝি মৃত পুণ্যাত্মাদের মরণোত্তর আশ্রয়ভূমি। আমাদের দেশে এই সেদিনও লোকে বুড়ো হয়ে গেলে জীবনের শেষ কদিন বিশ্বেশ্বরের সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য কাশী যেতেন। আমরা পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদীকেও মৃত্যুর ঠিক আগে নিজের জায়গা ছেড়ে স্বর্গে আরোহণ করতে দেখেছি। যদিও যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ এবং তারও পূর্বে ইলাবৃত-বর্ষের স্বর্গ একেবারেই আলাদা। কিন্তু এই যে পুরাণে-ইতিহাসে সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার কথাটা শোনেন, সেটা ছিল ওই মৃত্যুর পূর্বে কাশী যাওয়ার মতো।
স্বর্গ বলে যে জায়গাটা ছিল, সেখানে যেতে হলে পাহাড়-নদী পেরিয়ে বন্ধুর পথ বেয়ে ওপরে উঠতে হত। সেই জন্যেই স্বর্গে যাওয়াটা যাত্রামাত্র নয়, সে ছিল স্বর্গারোহণ। সেইজন্যই উত্তর আরও উত্তর দেশের উচ্চ ভূমি বা পর্বতই ছিল স্বর্গ। আর্যরা যতদিন ইলাবৃত-বর্ষে ছিলেন তখন সেটাই ছিল স্বর্গ। কিন্তু কাশ্মীর হয়ে তারা যখন আরও নীচে উত্তর প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন, তখন ইলাবৃত-বর্ষের পথ তাদের কাছে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যুধিষ্ঠিরকে তাই বদরীনারায়ণ এবং মানস সরোবরের পথে স্বর্গারোহণ করতে হয়েছে। ইলাবৃত-বর্ষ যে দেবতাদের বাসভূমি সে তো আমরা পুরাণ থেকে শ্লোক উদ্ধার করে বলেইছি। গিরীন্দ্রশেখরের ধারণা–ইলাবৃত-বর্ষের মধ্যে যে মেরু-পর্বত (এই মেরু পৃথিবীর অক্ষপ্রান্ত মেরু নয়) সেইখানেই দেবতাদের বাস ছিল। বায়ুপুরাণে আছে–বেদ-বেদাঙ্গ জানা পণ্ডিতেরা নাকপৃষ্ঠ, দিব, স্বর্গ ইত্যাদি পর্যায়বাচক শব্দে মেরুমহিমা কীর্তন করেন। এই গিরিতেই দেবলোক বিরাজিত বলে সমস্ত শ্রুতি বা বেদে বলা আছে–দেবলোকে গিরৌ তস্মিন্ সর্বশ্রুতি গীয়তে।
ঠিক এই জায়গাটা থেকেই আবারও আমরা মহাভারতের অমৃত-মন্থনের প্রস্তাবে ফিরে যাব। আপনাদের মনে আছে কি–আমি সেই বলেছিলাম–অথবা আমার কথা মনে রাখার দরকার কী, আপনারা অমৃত-মন্থনের পূর্বে মহাভারতের সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করুন। সেই মেরুগিরি, যা উজ্জ্বল সুবর্ণপ্রভ, দেবতা-গন্ধর্বদের আনাগোনা যেখানে সব সময়। অধার্মিক লোকেরা যেখানে যেতে পারে না এবং যা নিজের উচ্চতায় স্বর্গকেও আবৃত করে রেখেছে-নামাবৃত্য তিষ্ঠতি। দেবতারা সেই মেরুপর্বতের শৃঙ্গে উঠে অমৃত আহরণ করার মন্ত্রণা আরম্ভ করলেন–তস্য শৃঙ্গমুপারুহ্য..তাসীনা দিবৌকসঃ।
এখানে এই পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করার মধ্যে একটা রহস্য আছে বলে আমাদের ধারণা। আগেকার দিনে দূরস্থান নির্ণয় করার জন্য লোকে গাছে উঠে দেখত। পাহাড়ে উঠেও দেখত। যদি বিশ্বাস করি–দেবতাদের স্বর্গে খাদ্য-পানীয়ের অকুলান হলে, নদ-নদী শুকিয়ে গেলে তারা নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রয়োজনে মেরুপর্বতের শৃঙ্গে আরোহণ করে মন্ত্রণা আরম্ভ করেছিলেন–তে মন্ত্রিতুমারব্ধাস্তাসীনা দিবৌকসঃ– তাহলে ব্যাপারটা সুধীজনের কাছে সমর্থনযোগ্য যতটাই হোক, বিশ্বাসযোগ্য হয় বটেই। অমৃত-মন্থনের শ্রেষ্ঠ ফল যদি শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনীর মতো কোনও পরম ঔষধ হয়, তাহলে হস্তী, অশ্ব, সুরভি ইত্যাদি গৌণ ফল আর্যদের নূতন দেশ আবিষ্কারের সূত্রেই এসেছে। অমৃত-মন্থনের বাস্তব তাৎপর্য সেইখানেই। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, গাছের ফল শেষ হয়ে যাওয়া অথবা স্থায়ী আবাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর্যদের যে নতুন করে দেশ খুজতে বেরতে হয়েছে–সে কথা পুরাণগুলি থেকে যথোপযুক্ত স্থানে প্রমাণ দেব। হয়তো এই প্রবন্ধে নয়, অন্যত্র।
দেবতা, অসুর, রাক্ষস–এঁদের পারস্পরিক স্থিতি নিয়ে বহু আলোচনার অবসর আছে। আমি তার মধ্যে যাচ্ছি না। শুধু মনে রাখুন–মানুষের সঙ্গে এঁদের বড় তফাত নেই। পুরাণ-কথা এবং দর্শন গ্রন্থগুলি থেকে এঁদের পারস্পরিক স্থিতি বোঝাতে গেলে যে সময় এবং জায়গা লাগবে তাতে আপাতত আমাদের মহাভারত-কথার ছন্দ নষ্ট হতে পারে। আপাতত তাই বিরতি।
অমৃত-মন্থনই যখন হয়ে গেল, তখনই আমাদের দায় আসল সৌতি উগ্রশ্রবার কাছে ফিরে যাওয়ার। অমৃত-মন্থনের কাহিনী বলে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন–দেবতাদের মধ্যেও মানুষের মতোই লোভ, তৃষ্ণা, ছলনা এবং হিংসার বৃত্তিগুলিও আছে। বৈরোচন বলি এবং দেবরাজের কথোপকথনের অংশমাত্র দেখিয়ে দেবতাদের নশ্বরতার কথাও যে আমরা খানিকটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, তার কারণ আর কিছুই নয়, এতে প্রমাণ হবে–দেবতারা কেউই মনুষ্যবৃত্তির উর্ধ্বে নন–আকারে ইঙ্গিতে এবং ব্যবহারে এই কথাটাও অমৃত-মন্থন কাহিনীর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে আমরা মনে করি।
সৌতি উগ্রশ্রবার মুখে অমৃত-মন্থনের কাহিনী এসেছিল নাগদের প্রসঙ্গ থেকে। আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল–তক্ষকের প্রসঙ্গ থেকে। নাগরা রক্ষা পেলেন তাদেরই পরমাত্মীয় আস্তীক মুনির করুণায় এবং মধ্যস্থতায়। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ শেষ হয়ে গেল নাগ জন-জাতির সঙ্গে তৎকালীন ক্ষত্রিয়দের মিলন-যজ্ঞে।
একই সঙ্গে সৌতি উগ্রশ্রবার কাজও কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। আধুনিক রাজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও এবার জনমেজয়ের রাজসভার কাহিনীতে চলে যাবেন। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের সানন্দ সমাপনে সভাস্থলে আনন্দের কলতান উঠল। সমবেত ঋষি-মুনি থেকে আরম্ভ করে শিল্পী-স্থপতি, সূত-মাগধ কেউ জনমেজয়ের দান-মান থেকে বঞ্চিত রইলেন না। এই দান-গ্রহীতার তালিকায় আরও একটি নামের কথা আমি পূর্বে বলেছিলাম। তিনি হলেন এই সৌতি উগ্রশ্রবার পিতা লোমহর্ষণ। জনমেজয়ের সভায় ব্যাস-বৈশম্পায়নের সান্নিধ্যে মহাভারত শুনে লোমহর্ষণ মহাভারতে কথক-ঠাকুর হয়ে উঠবেন পরে।
লোমহর্ষণ অবশ্য তখনও লোমহর্ষণ হননি, কারণ মহাভারত তখনও বলা হয়নি। এই যে জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞ মিটে গেল, সভাস্থ সকলের মন ভরে উঠল আনন্দে, তখনই সূচনা হল মহাভারত-কথার। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের আরম্ভেই মহামতি ব্যাস এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।
জনমেজয়ের বড় ইচ্ছা ছিল–অতিবৃদ্ধ এই প্রপিতামহের কাছে নিজের পূর্বজদের রাজকাহিনী শুনবেন। কিন্তু সর্পযজ্ঞের ব্যস্ততা আর প্রতিহিংসার তাড়নার মধ্যে সে কাহিনী শোনার অবসর হয়নি। আজ যখন মিলন আর সংহতির সূচনা করে যজ্ঞ শেষ হল, তখন অপার আনন্দে জনমেজয় অতিবৃদ্ধ-প্রপিতামহের জন্য সোনার আসন তৈরি করালেন রাজসভায়। জনমেজয়ের তৈরি সেই আসন আজও আছে মানুষের মনে। আজও ভাগবত-পাঠের আসরে যে মান্য ব্যক্তিটি বক্তার আসনে বসেন, সেই আসনটির নাম ব্যাসাসন।
ব্যাসাসনে উপবিষ্ট ব্যাসের কাছে জনমেজয় হাত জোড় করে অনুরোধ জানালেন পাণ্ডব-কৌরবের সমস্ত ঘটনাই আপনি সামনে থেকে দেখেছেন–ভবান প্রত্যক্ষদর্শিবান আপনি আমাদের কাছে তাদের সমস্ত ঘটনা এবং তাদের চরিত্র বর্ণনা করুন। শুধু তাই নয়, এই যে বিরাট কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঘটে গেল, সেই যুদ্ধ কেন ঘটল, কেনই বা এত প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল–আপনি শোনান আমাদের।
জনমেজয়ের প্রশ্নের মধ্যে কুরু-পাণ্ডবের রাজনৈতিক ইতিহাসের জিজ্ঞাসাই শুধু ছিল না, তার মধ্যে তৎকালীন ভারতবর্ষের সামগ্রিক রাজনীতির জিজ্ঞাসা ছিল। জনমেজয় শুধু কুরু-পাণ্ডবের জ্ঞাতিবিরোধটুকুই জেনে ক্ষান্ত হতে চান না, এই বিরাট যুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধ কত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল, যাতে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন দুই পক্ষে এবং মারা গেলেন-জনমেজয় এই রাজনৈতিক বৃত্তান্ত আমূলান্ত জানতে চান–তচ্চ যুদ্ধং কথং বৃত্তং ভূতান্তকরণং মহৎ?
হায়! যে বালক এই মুহূর্তে ঠাকুরদাদার কাছে নাতিটির মতো প্রশ্ন করে বসল পাণ্ডব-কৌরবের গল্প বলুন–সেই পাণ্ডব-কৌরবের গল্প বলা কি অতই সহজ! ব্যাসের বয়স এবং সম্বন্ধের তুলনায় জনমেজয় একটি বালকমাত্র। জনমেজয় অর্জুনের নাতি। অতএব তার কাছে পাণ্ডব-বীর অর্জুন অথবা ভীমের বীরত্ব কিংবা যুধিষ্ঠির-কৃষ্ণের বিশাল ব্যক্তিত্বময় কাহিনীটুকুই সব চাইতে বড়। কিন্তু ব্যাস! তিনি যে স্বয়ং এই পাণ্ডব-কৌরব বংশের জন্মদাতা। এই বংশের ওপর যে তার অশেষ মায়া। সেই মহান বংশের জাতকেরা পরস্পর হানাহানি করে মরল–এক পক্ষ জিতল, এক পক্ষ হারল–এসব কথা কেমন করে নিজ মুখে বলবেন ব্যাস। তিনিও যে পাণ্ডব-কৌরবের পিতামহ। বলতে পারেন–মুনি-ঋষিদের আবার অত মায়া কী? তারা তো সুখ-দুঃখে, লাভালাভে সমান দৃষ্টি। তাদের আবার কীসের মায়া? আমি বলি-মুনি-ঋষি হলেও তারা আগে মানুষ। মহাভারতের পরবর্তী অংশে আমি মাঝে-মাঝেই দেখাব–এই নিষ্কাম সমাধি-লগ্ন মানুষটি কোন মায়ায়, কোন সুতোর টানে পাণ্ডব-কৌরবের মর্ম-কথায় জড়িয়ে গেছেন। কিন্তু আজ এই বালক জনমেজয়ের সামনে সেই মায়া, সেই একান্ত মনুষ্যোচিত ব্যক্তিসত্তার প্রথম উন্মোচন ঘটল।
ব্যাস ব্যাসাসনে বসেও নিজ মুখে মহাভারতের কাহিনী বলতে পারলেন না। নিজে বললে নানা কথায়, বিভিন্ন প্রসঙ্গের উপক্রমে তার পক্ষপাত–একতরের প্রতি পক্ষপাত, অন্যতরের প্রতি দোষদৃষ্টি প্রকাশ পেতে পারে। অতএব যে নৈর্ব্যক্তিকতায় কবি তার মর্মশায়ী ঘটনা বিবৃত করেন, যে রসবত্তায় এক প্রেমিক তার না-পাওয়া প্রেমিকার সঙ্গে aesthetic distance বজায় রেখেও তাকে ভালবেসে যান, তার গল্প বলেন, ঠিক সেই নৈর্ব্যক্তিকতায় সেই রসবত্তায় মহামতি ব্যাস মহাভারতের কাহিনী লিখে রেখেছেন। কিন্তু সে কাহিনী তিনি নিজে বলতে পারছেন না। তাই আপন বংশের জাতক বালক জনমেজয়ের মুখে পাণ্ডব-কৌরবের গল্প বলার অনুরোধ শুনেই তিনি তাঁর প্রিয়-শিষ্য বৈশম্পায়নকে আদেশ করলেন তার স্বলিখিত মহাভারতের কাহিনী শোনানোর জন্য–শশাশ শিষ্যমাসীনং বৈশম্পায়নমন্তিকে। ব্যাস বললেন-কুরু-পাণ্ডবের বিরোধ কেমন করে ঘটেছিল- যেমনটি তুমি আমার কাছে শুনেছ সব খুলে বলতদস্মৈ সর্মচক্ষু যম্মত্তঃ শ্রুতবানসি। বৈশম্পায়ন গুরুর আদেশ পেয়ে মহাভারতের অমৃত-কথা আরম্ভ করলেন-বৈশম্পায়ন উবাচ।
বৈশম্পায়ন। কথক ঠাকুরদের মধ্যে তাঁর মতো বক্তা আর নেই। স্বয়ং ব্যাস নিজের হাতে তাকে তৈরি করেছেন বিচিত্র মহাভারত-কথা জনসমক্ষে শোনানোর জন্য। অন্য কথক-ঠাকুরদের মতো তিনি সূত-জাতীয় নন। তিনি ব্রাহ্মণ। গুরুর আদেশ পাওয়া মাত্র তার যেটা কর্তব্য অথবা ইচ্ছে ছিল তা কিন্তু তিনি করতে পারলেন না। এবং এইখানেই তার বুদ্ধি। যে গুরুদেব তাকে হাতে ধরে মহাভারত কথা শিখিয়েছেন, যিনি নিজ মুখে নিজের প্রশংসা করতে পারবেন না–এই ভয়ে নিজে মহাভারতের কথা বললেন না, বৈশম্পায়নের ইচ্ছে ছিল সেই গুরুর প্রসঙ্গটাই আগে তোলার। কিন্তু বুদ্ধিশালী এই কথক-ঠাকুর রাজা জনমেজয়ের আগ্রহটা কোথায়–তা খেয়াল করেছেন। রাজা চান–তার পিতৃ-পিতামহের বীরত্ব-কাহিনী শুনতে। আর বৈশম্পায়ন চান–বিদ্যাদায়ী গুরুর মহিমা কীর্তন করতে। কিন্তু দুয়ের দ্বৈরথে শ্রোতার আগ্রহই যেহেতু বড় কথা, তাই বুদ্ধিশালী বৈশম্পায়ন আগে গোটা মহাভারতের সংক্ষিপ্তসার শুনিয়ে দিলেন রাজা জনমেজয়কে। এতে রাজার জিজ্ঞাসা শান্ত হল বটে, কিন্তু বিস্তারিত বিবরণের জন্য তার আগ্রহ হয়ে উঠল দ্বিগুণ। বৈশম্পায়ন এইটাই চাইছিলেন। এরপর রাজা যেই বিস্তারিত কাহিনী শুনতে চাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে বৈশম্পায়ন আপন গুরু বেদব্যাসের জীবন-কথা শুনিয়েছেন জনমেজয়কে কিন্তু তাও বড় সংক্ষেপে। আমার কথা হল–জনমেজয়ের আগ্রহ সত্ত্বেও মহাভারতের কথক-ঠাকুর যেমন শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করেই মহাভারতের কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তেমনই আজকের দিনে মহাভারত-কথা শোনাতে হলে তার জটিল জায়গাগুলি আমাকে যে যথাসম্ভব সহজ পদ্ধতিতে বলতে হবে, সেই অঙ্গীকার নিয়েই আমাদের উপাখ্যান-ভাগ আরম্ভ হবে আগামীতে। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।
.
১৭.
চন্দ্রবংশ। সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশ। কৌরব, পাণ্ডব, ভীষ্ম, শান্তনু যে বংশের অধস্তন গৌরব-মূর্তি, সে বংশের প্রথম পুরুষ হলেন চন্দ্র। আমরা বংশমূল থেকেই মহাভারত-কথা আরম্ভ করব। তার কারণ, মহাভারত-কথা পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধকাহিনীই শুধু নয়, সে শুধু একটামাত্র বংশের ইতিহাসও নয়, ভারতের ইতিহাস। আরও মনে রাখতে হবে- মহাভারত-কথায় আমরা শুধু অতি সংক্ষিপ্তভাবে অর্জুন-কৰ্ণ, ভীম-দুর্যোধন অথবা ভীষ্ম-যুধিষ্ঠিরের বীরত্ব, সাহস এবং মর্যাদায় মোহিত হই। কিন্তু এই বংশে এত বড় বড় সব রাজপুরুষ আছেন, যে, তাদের শৌর্য-বীর্য অথবা মহানুভবতা তাদের অধস্তনদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। অপিচ তাঁদের কীর্তিকলাপ এবং বংশধারাগুলি পরিষ্কার ভাবে জানলে পরে দেখা যাবে–মহাভারতের যুদ্ধ মোটেই কুরু-পাণ্ডবের গৃহ-বিবাদমাত্র নয়, এই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু আগেকার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বিবাদও। আমরা তাই প্রথম থেকে আরম্ভ করছি।
প্রথমে চন্দ্র। সেকালের দিনে অনেক প্রসিদ্ধ বংশেরই মূল পুরুষকে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতাঁকে কল্পনা করা হত। প্রাচীন চীন-দেশেও এই রীতি ছিল। আমাদের দেশেও চন্দ্র-সূর্যের প্রতাঁকে দুটি বিখ্যাত বংশধারার কল্পনা। রাম-রঘু ইক্ষাকু বংশের মূলে আছেন সূর্য আর পাণ্ডব-কৌরব, ভীষ্ম-শান্তনুর মূল পুরুষ হলেন চন্দ্র।
আদি মানব-মানবী বলতে ওদেশে যেমন শুধু অ্যাডাম এবং ইভ, আমাদের দেশে তেমন ‘প্রোজেনিটর’ অন্তত দশজন আছেন। মহাভারত-পুরাণের মতে ব্রহ্ম তাঁর মন থেকে অন্তত দশটি পুত্র উৎপাদন করেন এবং সেই দশজনকেই তিনি পুত্র-সৃষ্টির কাজে নিযুক্ত করেন। এঁদের বলা হয় প্রজাপতি। এই প্রজাপতিদের অন্যতম হলেন মহর্ষি অত্রি।
ব্রহ্মার দ্বারা আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি অত্রি পুত্র-সৃষ্টির তপস্যায় বসলেন। পরম আনন্দ-স্বরূপ ব্ৰহ্ম-জ্যোতিকে তিনি তাঁর দুই নয়নের মধ্যবর্তী স্থানে উদ্ভাসিত দেখতে পেলেন। ঠিক এই সময়ে দেবদেব শঙ্কর প্রিয়া পার্বতাঁকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন অত্রির সামনে। তাদের দেখে তপস্যারত অত্রির নয়ন বেয়ে এক বিন্দু আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল; আর সেই আনন্দের অশ্রুবিন্দু থেকেই জন্ম হল শিশু চন্দ্রের তস্মাৎ সোমো’ ভবচ্ছিন্নঃ তার স্নিগ্ধ আলোয় তিন ভুবন আলোয় আলো হয়ে গেল। দিদ্বধূরা শিশু-চন্দ্রকে ধারণ করলেন আপন গর্ভে।
বস্তুত, আকাশে চাঁদ ওঠে বলেই দিগবধূর কল্পনা। দিবধূদের গর্ভস্থ সন্তানকে ব্রহ্ম এক মনোহর যুবা-পুরুষে পরিণত করেন এবং সমস্ত ব্ৰহ্মর্ষি-দেবর্ষি তাঁকে বৈদিক সোম-মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত করলেন। বেদে সোমরস কোনও ওষধির নির্যাসই হোক, অথবা লতার নির্যাস, ঋষিরা সোমের উদ্দেশে বহু স্তুতি-সূক্ত রচনা করেছেন। তাকে রাজা বলেও সম্বোধন করেছেন সোমং রাজানং হবামহে..ইত্যাদি। বেদে সোমের এই রাজকল্পনা থেকেই পুরাণে সোমকে দেবতা, পিতৃগণ এবং ওষধির আধিপত্য দেওয়া হয়েছে। ঋষিমুনিদের অহরহ স্তুতিতে তার শরীর আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল–স্তয়মানস্য তস্যাভূদ অধিকো ধামসম্ভব।
যুবা-পুরুষ চন্দ্রের চেহারাটি এমনই সুন্দর এবং কমনীয় হল যে অন্য আরেক প্রজাপতি দক্ষ তার সমস্ত নক্ষত্র-কন্যাকে সম্প্রদান করলেন চন্দ্রের হাতে। নক্ষত্রসুন্দরী রোহিণী এবং চন্দ্রের গভীর অনুরাগের কথা আমরা আগে বলেছি এবং সেই অনুরাগের ফলে দক্ষ-প্রজাপতির অন্য কন্যাগুলির কী দুরবস্থা হয়েছিল, তাও আমরা সবিশেষ কীর্তন করেছি। চান্দ্রের যক্ষ্মা-রোগের কাহিনীও আমরা মহাভারত থেকে শুনিয়েছি। শুধু যেটা বলিনি–সেটা হল চন্দ্রের একগুয়ে প্রকৃতির কথা, যদিও দক্ষ-প্রজাপতির সনির্বন্ধ অনুরোধ-উপরোধ প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা থেকে চন্দ্রের স্ত্রৈণতা এবং একগুয়েমি–দুটোই বেশ ভালভাবেই প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করি।
মুশকিল হল–চন্দ্রের জীবন-কাহিনীর সব অংশ মহাভারতে নেই। কোথাও বা অনেক বড় কাহিনী সূত্রাকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পাণ্ডব-কৌরব-বংশের মূল পুরুষকে আমরা এত সহজে ছেড়ে দিতে পারি না। তাই প্রচুর-পুষ্পমোদী মধুকরের মতো অনেক কাহিনীই আমাকে বিভিন্ন পুরাণ থেকে সংগ্রহ করে এনে এই ভারত-কথার মধুকোষে সঞ্চয় করতে হচ্ছে।
মহাভারতের কবি একেবারে অন্যপ্রসঙ্গে বনপর্বে একবার বলেছিলেন–দেবগুরু বৃহস্পতির যিনি স্ত্রী ছিলেন, তাকে চন্দ্রের স্ত্রীও বলা যায়–বৃহস্পতেশ্চান্দ্রমসী ভার্যাসী যা যশস্বিনী। এই সংক্ষিপ্ত পরিচয়টুকুর মধ্যে যে ব্যঞ্জনা আছে, সে ব্যঞ্জনা আর ভাষার স্থূলতায়। ব্যক্ত করেননি কবি। হয়তো সে প্রসঙ্গও আসেনি। অথবা হয়তো সেই গভীর কথাটা তাঁরও মনে ছিল–যা তিনি মহামতি বিদুরের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন উদ্যোগ-পর্বে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন–মহা-মহা-ঋষি-মুনি আর বড় বড় কীর্তিশালী বংশের মূল খুঁজতে যেও না কখনও-কুলানাঞ্চ মহাত্মনাং… প্ৰভবো নাধিগন্তব্যঃ।
এই সাবধান-বাণী এই জন্য যে, মহৎ বংশের গায়ে কলঙ্কের চিহ্ন থাকলে অল্পস্বত্ত্ব লোকের মুখ বড় মুখর হয়ে ওঠে। যাদের ধারণ ক্ষমতা কম, তারা ওইটুকু দিয়েই বিশিষ্ট জনের বিচার করতে শুরু করে। মহাভারতের কবি তাই কুরু-পাণ্ডব বংশের মূল ব্যক্তিটির চরিত্র-চর্চার মধ্যে যাননি। আমরা অবশ্য সেই চর্চায় যাচ্ছি। যাচ্ছি পৌরাণিকদের হাত ধরে, যদিও খলস্বভাব দুর্মতিদের জন্য আমার দুর্ভাবনা এবং করুণা–দুইই রয়ে গেল।
পুরাণ বলেছে–দক্ষ-কন্যাদের সঙ্গে বিবাহাদি সম্পন্ন হওয়ার পর চন্দ্র ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা আরম্ভ করলেন। উগ্র তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু যখন বর দিতে চাইলেন–তখন চন্দ্র। বললেন–আমি যেন ইন্দ্রলোক জয় করতে পারি–ততো বরে বরা সোমঃ শত্রুলোকং জয়ামহ্যম। সমস্ত দেবতাকে আমি যেন আমার গৃহে প্রত্যক্ষ দেখতে পাই। তার মানে, আমরা যারা এতদিন ইন্দ্রকেই দেবরাজ্যের অন্যতম নায়ক ভাবতাম, তা কিন্তু ঠিক নয়। চন্দ্র ইন্দ্রলোকের অধিকার চান এবং দেবতাদেরও তিনি স্বভবনে চোখের সামনে দেখতে চান। তিনি চান–দেবতারা তাঁর বাড়িতে নিত্য আহার করেন–প্রত্যক্ষমেব ভোক্তারো ভবন্তু মম মন্দিরে। এ ভাব যেন সেই নতুন এবং উঠতি বড়লোকের মতো–তিনি বড় একটি এস্টেট চান এবং চান–বড় বড় লোকেরা তাঁর বাড়িতে থানাপিনা করুন–এতে তিনি নিজে মর্যাদাসম্পন্ন বোধ করেন। অর্থাৎ চন্দ্র তার মহান পুণ্যবলে জনার্দন বিষ্ণুর বরে স্বর্গলোকের অধিকার পেতে চলেছেন, এবং দেবতা বলে কথিত মহামানবদের সঙ্গে এখন থেকে তার নিত্য ওঠা-বসা চলবে।
শুধু এইটুকুই নয়। ভগবান বিষ্ণুকে তিনি বলেছেনএকটি রাজসূয় যজ্ঞ করতে চাই আমি, এবং সেই যজ্ঞে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের কাজ করবেন স্বয়ং দেবতারা, আর শূলী শম্ভু সদা নিযুক্ত থাকবেন আমার রক্ষাকার্যে। ভগবান বিষ্ণু চন্দ্রের সমস্ত প্রার্থনা পূরণ করলেন। তার রাজসূয় যজ্ঞে সামগান করলেন স্বয়ং লোকপিতামহ ব্রহ্মা। অন্যান্য দেবতা সমস্ত যজ্ঞকার্য সমাধা করলেন সানন্দে। রাজসূয় যজ্ঞের পর কমনীয়, সুন্দর চন্দ্র আপন উজ্জ্বলতায় কমনীয়তর, সুন্দরতর হলেন।
অভাবনীয় ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল ঠিক এর পর থেকেই। স্বর্গের অধিকার, দেবতাদের পৌরোহিত্য, রাজসূয় যজ্ঞ–এই সব কিছু মিলে চন্দ্রের শারীরিক উজ্জ্বলতা শুধু নয়, এসব তার মান-মর্যাদা এবং রাজকীয়তাও অনেক বাড়িয়ে তুলল। পুরাণ বলেছে–চন্দ্রের এই অলোক সামান্য মাহাত্ম্য লক্ষ করে দেব-রমণীরা চন্দ্রকে দেখে মুগ্ধ হতে লাগলেন, শারীরিক এবং মানসিক ভাবে। অন্তত ন’জন সুন্দরী দেব-স্ত্রী, যাঁদের নাম শুনলে অবাক হতে হবে–তারা তাদের স্বামী ছেড়ে চন্দ্রের সেবা করতে চাইলেন দাসীর মতো–কামবাণাভিতপ্তাস্যো নব দেব্যঃ সিষেবিরে। এঁদের সবাইকে সাধারণ জনে চিনবেন না–যেমন প্রজাপতি কর্দমের স্ত্রী সিনীবালী, কিংবা বিভাবসুর স্ত্রী দ্যুতি, অথবা জয়ন্তের স্ত্রী কীর্তি। এঁরা না হয় অচেনা, অথবা এঁদের নামের মধ্যে হয়তো রূপকের প্রশ্রয় আছে, কিন্তু স্বয়ং নারায়ণের স্ত্রী লক্ষ্মীও তার স্বামীকে ছেড়ে চন্দ্রের প্রেমে পড়লেন–লক্ষ্মী নারায়ণং তত্বা সিনীবালী চ কদম। সব চেয়ে বড় কথা–এঁরা না হয় স্বামী ছেড়ে চলে এলেন, কিন্তু চন্দ্র? চন্দ্রও সেই দেব-রমণীদের সঙ্গে আপন স্ত্রীর মতোই ব্যবহার করতে লাগলেন-স্বকীয়া ইব সোমোপি কাময়ামাস তাস্তদা।
ধরে নিতে পারি–এই নয় জন দেবপত্নীর কথাটা পৌরাণিকের অতিশয়োক্তি। কেননা, দ্যুতি, কীর্তি, প্রভা, এমনকি লক্ষ্মী–এই স্ত্রীলিঙ্গ-নামগুলি পরিচিত দেবপত্নীদের নাম হিসেবে খুব যুৎসই নয়। প্রধানত চন্দ্রের শারীরিক সৌন্দর্য এবং দেবসমাজেও তার অতুল প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এই নামগুলি ব্যবহার করা হয়েছে-সোমঃ প্রাপ্যাথ দুষ্প্রাপ্য ঐশ্বর্যমৃষিসংস্কৃত-এবং তা করা হয়েছে একটু পরেই আসল সত্য ঘটনাটি বলার জন্য। রাজার প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্মী নারায়ণকে ছেড়ে কৃতী রাজার আশ্রয় নিয়েছেন–এই রূপক পুরাণে এবং সংস্কৃত সাহিত্যে সহস্রবার লক্ষ্য করা গেছে।
লক্ষ্মী শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য। রাজা ঐশ্বর্য এবং প্রতিপত্তিশালী হলেই কবিরা এই উৎপ্রেক্ষা করে, কবিত্ব করে বলেছেন যে, লক্ষ্মী নারায়ণকে ছেড়ে রাজার আশ্রয় নিয়েছেন। কাজেই দ্যুতি, কীর্তি, দ্যপ্রভা, লক্ষ্মীর মতো স্ত্রীরা চন্দ্রের সাহচর্য পাওয়ার জন্য অভিভূত হলেনল্গ–এ কথাটা খুব বড় কথা নয়। আসলে চন্দ্র যে আপন প্রভাবে রমণী-সমাজে কতটা কাম্য হয়ে উঠেছিলেন, এটা যেমন এই ঘটনায় প্রমাণিত হল, তেমনই স্ত্রৈণতার ব্যাপারে চন্দ্রেরও যে খুব গুরু-লঘু বোধ ছিল না, সেটাও একাধারে বলে দেওয়া গেল। মূল সত্যি ঘটনাটা কিন্তু এর পরে আসছে–যে ঘটনায় সাক্ষী শুধু পুরাণগুলি নয়, সাক্ষী আছে মহাভারতের সেই সংক্ষিপ্ত পংক্তিটি–বৃহস্পতির যিনি স্ত্রী, তিনি আসলে চন্দ্রেরই স্ত্রী-বৃহস্পশ্চান্দ্রমসী ভার্যাসী যা যশস্বিনী। ঘটনাটি এবার বলি।
চন্দ্রের তখন বিশাল ঐশ্বর্য, অগাধ প্রতিপত্তি। ত্রিভুবন তার কাছে খুবই ছোট কথা, সপ্ত লোকের আধিপত্য তার করতলগত-সপ্তলোকৈকনাথত্ব অবাপ তপসা সদা। এই রকমই এক স্বাধিকার আর সুখের সময়ে চন্দ্র তার ভবন-সংলগ্ন উদ্যানের মধ্যে পাচারে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎই সেখানে দেখতে পেলেন এক সুন্দরী রমণী। উদ্যানের ফুলের আভরণ তাঁর গায়ে। স্তন-জঘনের সৌন্দর্যে পরম আকর্ষণীয়া। কোমল শরীর, যেন ফুল ছিঁড়তে গেলেও তার আঙুলে ব্যথা লাগবে–পুষ্পস্য ভঙ্গে’ প্যতিদুর্বলাঙ্গীম্।
চন্দ্রে বিলাস-উদ্যানে যে রমণীটিকে এইমাত্র দেখা গেল ইনি দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী–তারা। নিসর্গ-সৌন্দর্যের মধ্যে সৌন্দর্যের আধারভূতা এই রমণীটিকে দেখে চন্দ্র মনের আবেগ রুদ্ধ করতে পারলেন না। নির্জন উদ্যানভূমির সমতলে দাঁড়িয়ে তিনি তারাকে আলিঙ্গন করলেন। তারার গ্রন্থিবদ্ধ কেশরাশি আলুলায়িত হল– কেশেষু জগ্রাহ বিবিক্তভূমৌ। বোঝ গেল, স্বয়ং দেবগুরুর পরিণীতা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা চন্দ্রের রূপে এবং প্রতিপত্তিতে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন–তদরূপকাত্যা হৃতমানসেন–যে, এই বলাৎকারী রসিককে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, তিনি শরীরে ও মনে খুশি হলেন। অনেক দিন সেই উদ্যান-ভূমির মধ্যেই কেটে গেল রসে-রমণে। চন্দ্রের সঙ্গে তারার সাহচর্য ঘনীভূত হল।
বৃহস্পতির পত্নী বাড়ি ফেরার নামও করলেন না। উদ্যান-বিলাসের দিন শেষ হলে চন্দ্র তারাকে একেবারে নিজের বাড়িতে নিয়ে তুললেন। সুন্দরী তারার সাহচর্য-সুখ এমনই যে চন্দ্রের তৃপ্তি কখনও শান্তির পর্যায়ে আসে না-বিধুগৃহীত্বা স্বগৃহং ততোপিন তৃপ্তিরাসীচ্চ গৃহেপি তস্য।
অন্য একটি পুরাণে দেখা যায়–চন্দ্রের বিলাসোদ্যানে তারার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। এখানে বৃহস্পতি স্বয়ং নিজের কপাল নিজে পুড়িয়েছিলেন। বৃহস্পতি দেবগুরু, ফলে দেবতারা সকলেই তার যজমান। চন্দ্রও তাই। কোনও কারণে সেদিন বৃহস্পতির স্ত্রী তারা যজমান শিষ্যের বাড়িতে এসেছিলেন–গতৈকদা বিধোধাম যজমানস্য ভামিনী। সেই প্রথম চারিচক্ষুর মিলন হল এবং দুজনেই দুজনকে দেখে রবিষ্ট হলেন। তারা আর শিষ্যবাড়ি থেকে ফিরে যাননি। চন্দ্রও তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও উদ্যোগ করেননি। এদিকে নিজের বাড়িতে বসে দিনরাত তারার চিন্তায় বৃহস্পতির দিন কাটতে লাগল। তিনি কিছু বলতেও পারছেন না, কিছু করতেও পারছেন না। ভাবলেন–বামুন-ঘরের বউ, কিছুদিন গেলেই সুমতি হবে, তারা ফিরে আসবেন। কিন্তু বৃহস্পতির গণনা মিথ্যা হল, তারা ফিরলেন না।
অনেক দিন চলে গেল। বৃহস্পতি এবার এক শিষ্যকে চন্দ্রের বাড়িতে পাঠালেন তারাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। তারা ফিরলেন না, চন্দ্রও তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার নামও করলেন না। একবার নয়, বৃহস্পতির শিষ্য বারবার গেলেন চন্দ্রের বাড়িতে বার্তাবহ হয়ে। বারবার বিফলতায় ক্রুদ্ধ হয়ে বৃহস্পতি নিজেই এবার উপস্থিত হলেন শিষ্যবাড়িতে। চন্দ্রের বাড়িতে। হুংকার দিয়ে চন্দ্রের উদ্দেশে বললেন–ব্যাপারটা কী হচ্ছে? আমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে তুমি নিজের ঘরে আটকে রেখেছ? তুমি কি জান না–আমি দেবগুরু, আর তুমি আমার শিষ্য, যজমান?
প্রথমে একটু ভালভাবেই বলেছিলেন বৃহস্পতি। একটু রেখে ঢেকে। কিন্তু চন্দ্রের মুখে অবহেলার হাসি দেখে বৃহস্পতি বললেন-লজ্জা করে না তোর? গুরুর স্ত্রীকে ভোগ করে যাচ্ছিস? তাকে আটকে রেখেছিস বাড়িতে? গুরুপত্নীগামী পুরুষ যে কত বড় মহাপাতকী–সে কি তুই জানিস না? তুই যদি সত্যিসত্যিই তাকে ভোগ করে থাকি, তাহলে তুই এই দেবস্থানে থাকার যোগ্য নোস একটুওন দেবদনাহাঁসি যদি ভূক্তেয়মঙ্গনা। বৃহস্পতি এবার আসল কথাটা বললেন। বললেন-কালো চোখের সুন্দরী আমার বউটি। আহা! তাকে তুই এই মুহূর্তে ছেড়ে দে, নইলে অভিশাপ দেব এবার। বৃহস্পতি বোঝাতে চাইলেন–তার স্ত্রীর কোনও দোষই নেই, যত দোষ তার শিষ্যের।
চন্দ্রের মাথা রাজার মতোই ঠান্ডা। বৃহস্পতির অনুযোগ একটুও গ্রাহ্য না করে তিনি ঠান্ডা মাথায় বলতে আরম্ভ করলেন–বামুন মানুষের অত কি রাগ করলে চলে, ঠাকুর! ক্রোধের মতো একটা রিপু থাকলে মানুষ কি ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে পারে সেই ব্রাহ্মণ-গুরুকে-ক্রোধাত্তে। তু দুরারাধ্যা ব্রাহ্মণা ক্রোধবর্জিতাঃ। সামান্য দুটো কথা বলার পরেই চন্দ্র এবার বৃহস্পতির তর্ক-যুক্তিতে এলেন। অর্থাৎ বৃহস্পতি যে এতক্ষণ—‘আটকে রেখেছিস’, ‘ভোগ করেছিস, ‘ছেড়ে দে’–এসব কথা বলে বোঝাতে চাইছেন– তার স্ত্রীর কোনও দোষ নেই, চন্দ্রই জোর করে তার স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই অনর্থ ঘটিয়েছেন–সেই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে চন্দ্র এবার আইনি কায়দায় কথা বলতে আরম্ভ করলেন। চন্দ্র বললেন-সময় হলে তিনি নিজেই ফিরে যাবেন আপনার বাড়ি। এখানে ক’দিন সুখে আছেন, ভালই আছেন, তাতে আপনার কী ক্ষতিটা হল শুনিকা তে হানিরিহানঘ? আর আমি কি তাকে জোর করে আটকে রেখেছি নাকি? এখানে তিনি নিজের ইচ্ছেয় আছেন এবং এখানে থাকতে ভালও লাগছে তার-ইচ্ছয়া সংস্থিতা চাত্ৰ সুখকমার্থিনী হি সা।
চন্দ্র একেবারে আধুনিক মতে ধর্ষণের দায় এড়িয়ে গেলেন। অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়, বরং স্বেচ্ছায় তিনি সুখে আছেন। তার ভাল লাগছে–সুখকামার্থিনী হি সা। সবার শেষে গুরুকে তিনি আশ্বস্ত করে দিলেন–এই তো, আর কিছুদিন থেকে তিনি হয়তো স্বেচ্ছাতেই আপনার বাড়ি যাবেন–দিনানি কতিচিৎ স্থিত্ব, স্বেচ্ছয়া চাগমিষ্যতি। ভাবটা এই-’মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু রেখো সারাক্ষণ’–ইচ্ছা না হলে কিন্তু যাবেন না।
ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ বৃহস্পতি বাড়ি ফিরলেন। পৌরাণিক বলেছেন–শুধু দুর্ভাবনায় চিন্তাতুর হয়ে নয়, কামাতুর হয়েও ফিরলেন বৃহস্পতি–জগাম স্বগৃহং তুর্ণং চিন্তাবিষ্টো স্মরাতুরঃ। পৌরাণিক বৃহস্পতির মনস্তত্ত্ব বুঝেই এই মন্তব্য করেছেন। ঘরে থাকতে দৈনন্দিন দাম্পত্য অবহেলায় যে স্ত্রীকে বৃহস্পতি প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করেননি, সেই স্ত্রীকেই পুরুষাস্তরের শঙ্গার-সংসর্গ-লিপ্ত অবস্থায় কল্পনা করে বৃহস্পতি হয়তো কামাতুর হলেন। ঘরে ফিরে বেশিদিন তার থাকা হল না। আবার এলেন চন্দ্রের বাড়িতে। এবারে বাড়ির দারোয়ানরাই তাকে বাধা দিল। দ্বারপালেরাও প্রভুর ইচ্ছা বোঝে। বৃহস্পতি বাইরে থেকেই তর্জন গর্জন করতে লাগলেন। বললেন–দেবতারা অধম! ঘরে শুয়ে আছিস কী করতে–কিং শেষে ভবনে মন্দ পাপাচার সুরাধম? ভাল চাস তো আমার বউ আমায় ফিরিয়ে দে, নইলে তোর কপালে আমার অভিশাপ নাচছে–দেহি মে কামিনীং শীঘ্র নোচেচ্ছাপং দদাম্যহম্।
চন্দ্র বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে। বিজয়ীর হাসি। পরের বউ স্বেচ্ছায় তার বাড়িতে এসে রয়েছে। বাড়ি যাচ্ছে না। তাই বিজয়ীর হাসি হেসে চন্দ্র বাড়ির বাইরে এসে বললেন–মেলা বকছেন কেন, ঠাকুর-কিমিদং বহু ভাষসে? যে অসামান্যা রূপসীটিকে আপনি বউ-বউ’ বলে স্বাধিকার ব্যক্ত করছেন, সে অন্তত আপনার উপযুক্ত নয়। আপনার যদি একান্তই স্ত্রীলাভের এত ইচ্ছা থাকে, তবে নিজের মতো চেহারার একটি খেদি-পেঁচি জোগাড় করে আনুন না, কে আটকাচ্ছে–কুরূপাঞ্চ স্বসদৃশীং গৃহাণান্যাং স্ত্রিয়ং দ্বিজ। টাকা নেই, পয়সা নেই, বউকে ভাল করে আরামে রাখার মুরোদ নেই; আপনার মতো ভিখারির ঘরে কি আর এত সুন্দরী একটি রমণীর মন টেকেভিক্ষুকস্য গৃহে যোগ্যা নেদৃশী বরবর্ণিনী। মেয়েরা নিজের সমান যোগ্য পুরুষকেই পছন্দ করে–এই সরল সত্যটা সম্বন্ধে যদি আপনার একটুও বোধ থাকত তা হলেও হত। চন্দ্র এবার শেষ এবং চরম কথাটা শুনিয়ে দিলেন। বললেন–আপনি এখন যেতে পারেন, গুরুঠাকুর! তারাকে আমি ফিরিয়ে দেব না। আপনার যা ইচ্ছে এবং যা পারেন করুন–যচ্ছক্যং কুরু তৎ কামং ন দেয়া বরবৰ্ণিনী।
দেবগুরু বৃহস্পতি মহা বিপদে পড়লেন। শাপ দিয়ে ভস্ম করে দেবেন তারও উপায় নেই কোনও। অভিশাপ মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়েই আসছিল–কিন্তু চন্দ্র সে অভিশাপের ভয় পাচ্ছেন না একটুও। একে তো তিনি পূর্ব তপস্যার বলে বলীয়ান; দ্বিতীয়ত বৃহস্পতির স্ত্রী স্বয়ং তার অনুরক্তা। এই অবস্থায় বৃহস্পতি বারংবার তার স্ত্রীর অধিকার চাওয়ায় চন্দ্র তাকে শুনিয়ে দিয়েছেন–আপনি নিজেই কামার্ত গুরুদেব নইলে পালিয়ে যাওয়া একটি স্ত্রীলোকের জন্য কেউ আপনার মতো এরকম করে না, কামাৰ্ত্তস্য চ তে শাপো ন মাং বাধিতুমহসি-অতএব আপনার শাপে আমার কিছুই হবে না
বৃহস্পতি কোনও শাপ উচ্চারণ করতে পারলেন না। তার নিজের স্ত্রী তার সঙ্গে বঞ্চনা করেছে, চন্দ্রকে অভিশাপ দিয়ে কী লাভ হবে তার। রাগে কাঁপতে কাঁপতে এবার তিনি আর নিজের বাড়ি ফিরে এলেন না। সোজা উপস্থিত হলেন ইন্দ্রালয়ে, ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্রের কাছে নালিশ জানিয়ে বৃহস্পতি বললেন–আমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে চন্দ্র হরণ করেছে। বারবার তাকে বলছি, কিন্তু সে আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে এ ব্যাপারে?
ইন্দ্র দেবতাদের রাজার মতোই বৃহস্পতিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–আমি অবশ্যই আপনার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনব আপনার কাছে। দরকার হলে যুদ্ধ করব। ইন্দ্র প্রথমে একটি দূত পাঠালেন চন্দ্রের কাছে। দূত গিয়ে প্রথমে ইন্দ্রের সদুপদেশ অনেক শোনাল-পরের স্ত্রী, বিশেষত গুরুপত্নীকে কি তোমার মতো নীতিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের ভোগ করা শোভা পায়? তাছাড়া ঘরে কি তোমার ভোগ্যা স্ত্রীর অভাব আছে? দক্ষের কন্যারা সকলেই তোমার স্ত্রী। এত নক্ষত্র-সুন্দরী থাকতে তোমার আবার গুরুপত্নীকে সম্ভোগ করার ইচ্ছে হল কেন–গুরুপত্নীং কথং ভোণ্ডুং ত্বমিচ্ছসি সুধানিধে?
ইন্দ্র দূতের মুখে এইটুকু জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। সুধাকর চন্দ্রের তৃপ্তির জন্য তিনি আরও কিছু ভাবনা-চিন্তাও করেছেন। দূতমুখে ইন্দ্র জানালেন–বেশ তো, তোমার নক্ষত্র-সুন্দরীদের যদি একান্তই ভাল না লাগে, তবে মনোহর এই স্বর্গভূমিতে সম্ভোগ-তৃপ্তির ব্যবস্থা কি কিছু কম আছে? অপ্সরা সুন্দরী মেনকা আছেন, রম্ভা আছেন, উর্বশী আছেন। তুমি ভোগ করো। কে না করেছে? গুরুপত্নী তারাকে তুমি ছেড়ে দাও বাপু-ভূঙ তাঃ স্বেচ্ছয়া কামং মুঞ্চ পত্নীং গুয়োরপি। তাছাড়া এই নিয়ে দেবতাদের মধ্যে অকারণ একটা ঝগড়াঝাটি পাকিয়ে উঠবে, সেটাও তত বাঞ্ছনীয় নয়। ইন্দ্র বোধহয় সামান্য যুদ্ধের ইঙ্গিত করলেন।
চন্দ্র অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে দূতের মুখে ইন্ত্রের কথা শুনলেন। এবার তার জবাব দেবার পালা। চন্দ্রের জবাবের মধ্যে শুরুর প্রতি ভক্তি বিশেষ প্রকাশ পেল না; কেঁচো খুঁড়তে সাপের মতো দেবগুরুর ব্যক্তিগত পূর্ব জীবনের এমন কতগুলি ঘটনা চন্দ্রের মুখে উচ্চারিত হল, যা ইন্দ্রদুতের কাছে তো বটেই, বৃহস্পতির কাছেও বড় কতিমধুর ছিল না। আসলে বৃহস্পতি নিজের জালে নিজেই ধরা পড়েছিলেন, অথবা বলা উচিত নিজের কপাল নিজেই পুড়িয়েছিলেন। কেমন করে তা বলি?
.
১৮.
ইন্দ্রের দূতকে শুনিয়ে স্বয়ং ইন্দ্রের উদ্দেশেই কথাটা বললেন চন্দ্র। চন্দ্র বললেন–যেমন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র ঠাকুরটি, ঠিক তেমনই তার গুরুদেব এই বৃহস্পতি ঠাকুর। দুজনের বুদ্ধিই ঠিক এক রকম–পুরোধাপি চ তে তাক্ যুবয়োঃ সদৃশী মতিঃ। আরে, পরকে উপদেশ দেওয়ার সময় সবাই মস্ত বড় পণ্ডিত, কিন্তু কাজের বেলায় পণ্ডিতেরা নিজের উপদেশ নিজেই খেয়াল করতে পারেন না–পরাপদেশে কুশলা ভবন্তি বহুবো জনাঃ। এই যে বাক্যবাগীশ বৃহস্পতি, তোমাদের গুরু-ঠাকুর। তিনি না মানব-জাতির হিতের জন্য বিরাট শাস্ত্র লিখে ফেলেছেন! তো তার শাস্ত্রের বচন এখন কেমন লাগছে?
মনে রাখা দরকার সেকালের দিনে শুরু হয়ে বসাটা অত সহজ কাজ ছিল না। শুধু ব্রাহ্মণ্য নয়; বিদ্যা, শিক্ষা এবং তপস্যা–সব দিক দিয়েই শুরুদেবদের যথেষ্ট এলেম থাকার দরকার ছিল। বিশেষত যারা সম্পূর্ণ একটি সমাজের গুরু হতেন, অথবা বড় বড় রাজবংশের শুরু হতেন, তাদের রাজনীতির বোধও ছিল অতি উচ্চ মার্গের। বৃহস্পতি সমস্ত দেব-সমাজের গুরু। রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজনীতি নিয়ে তিনি যে রীতিমতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ একখানি গ্রন্থ লিখে ফেলেছিলেন–সে প্রমাণ মহাভারতের মধ্যে বারংবার আছে। সেকালের দিনে রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলি অর্থশাস্ত্রের অন্তর্গত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র খুললেই সেটা বোঝা যায়। স্বয়ং কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রের মধ্যে দেব-সমাজের নীতিনির্ধারক বৃহস্পতি এবং অসুর-সমাজের নীতিকার শুক্রাচার্যের নানা মন্তব্য উদ্ধার করেছেন রাষ্ট্র এবং সমাজ-নীতির বিষয়গুলি পরিষ্কার করার জন্য।
এতে কোনও সন্দেহই নেই যে, বৃহস্পতির নীতি-নিয়মগুলি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী অর্থাৎ কৌটিল্যের আবির্ভাবের আগেই যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। মহাভারতীয় চরিত্রগুলির মধ্যে যাঁরা জ্ঞানী-গুণী এবং পণ্ডিত বলে পরিচিত, তারা বৃহস্পতির রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন জানতেন, ঠিক তেমনই জানতেন শুক্রনীতি। আসল কথা, বৃহস্পতির শাস্ত্রের সঙ্গে শুক্রাচার্যের নীতি নিয়মের পার্থক্য ছিল। ভাল পড়ুয়ারা দুটোই জেনে ক্ষেত্রবিশেষে নিজের মত ব্যক্ত করতেন। মহাভারতে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন পিতামহ ভীষ্ম। তিনি বৃহস্পতি এবং শুক্র–দুজনের লেখা অর্থশাস্ত্রই খুব ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন।
কিন্তু অনেকেই আবার এমন ছিলেন, যারা রাষ্ট্রের মঙ্গল বিধানে বৃহস্পতি অথবা শুক্র–একজনের মত বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব–পাঞ্চাল-যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্নকে যখন বৃহস্পতি-নীতির পাঠ দিতেন অধ্যাপক, তখন সেই পাঠ শুনে-শুনেই বৃহস্পতির শাস্ত্র অধিগত করেছিলেন পাণ্ডব-ঘরণী দ্রৌপদী। রাষ্ট্র-বিষয়ক সেই সব চিন্তা সমস্ত জীবনে দ্রৌপদীর কত যে কাজে লেগেছে, সে সব আমরা পরে দেখব। এখন দেখতে হবে-বৃহস্পতি নিজে বই লিখে নিজের কী ক্ষতি করেছেন? কারণ, চন্দ্র বলেছেন–পরকে উপদেশ দেওয়ার সময় সবাই খুব দড়, কিন্তু নিজের বেলায় সে উপদেশ খাটে না মোটেই। অতএব সামান্য হলেও আমাদের জানতে হবে–কী সেই উপদেশ, যা পরকে দেওয়ার সময় বৃহস্পতির সমস্যা হয়নি, এবং যা কার্যক্ষেত্রে তার সমস্যা বাড়িয়েছে।
বস্তুত, রাষ্ট্র এবং সামাজিক নীতি নির্ধারণে বৃহস্পতির নির্দেশ খুব অল্প নয়। যুদ্ধের উদ্যোগ করা উচিত কিনা, অথবা যুদ্ধ আরম্ভ হলে কীভাবে কোন ব্যুহ অনুসারে সৈন্য সাজিয়ে রাজা যুদ্ধ করবেন–এইসব কূটনৈতিক বিষয়ে যেমন বৃহস্পতির সুস্পষ্ট মত আছে, তেমনই সামাজিক তর্কযুক্তির ক্ষেত্রেও বৃহস্পতির বহুত্তর বক্তব্য আছে এবং সেই বক্তব্যগুলিই এই মুহূর্তে চন্দ্রের অনুকূলে এসেছে।
স্বর্গের মতো একটা রাজ্যে, দেবতাদের মতো ভোগী সমাজে শুরু হয়ে বসার ফলে মেয়েদের ব্যাপারে বৃহস্পতির অভিজ্ঞতা কিছু কম ছিল না। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি তার নীতিশাস্ত্রে বিধান দিয়েছিলেন যে, কোনও রমণী যদি স্বেচ্ছায় পুরুষের সম্ভোগবাসনায় সম্মতি দেয়, তবে তাকে ভোগ করায় পুরুষের তত দোষ লাগে না। চন্দ্র বললেন–আমি তো তাই করছি। গুরুর পত্নী স্বয়ং আমার আসঙ্গ-লিপ্সা করছেন, আমি তার বাসনা পূরণ করছি তারই সম্মতিক্রমে। তবে এই নিয়ে দেবতাদের সঙ্গে আমার বিরোধের কোনও কারণই ঘটতে পারে না–কো বিরোধোত্র দেবেশ কাময়ানাং ভজ স্ক্রিয়। তারা বৃহস্পতির ধর্মপত্নী হতে পারেন, কিন্তু তিনি ভালবাসেন আমাকে, বৃহস্পতিকে তিনি ভালবাসেন না একটুও। তো বৃহস্পতি নিজের লেখা ধর্ম-নীতি অনুসারে কী করে এই অনুরক্তা রমণীটিকে আমি জেনে-বুঝে তার কাছে যেতে দিই–অনুরক্তা কথং ত্যাজ্য ধর্মতো ন্যায়তস্তথা।
ইন্দ্রের দূত কথাপ্রসঙ্গে একসময় একটু যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছিল। চন্দ্র সেকথা ছাড়েননি। নিজের দাপট দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন–যান, যান। বড় বড় কথা না বলাই ভাল। নিজের স্ত্রী, পরের স্ত্রী–এত উপদেশের কিছু দরকার নেই। আমার ক্ষমতা আছে আমি ভোগ করছি। যার ক্ষমতা আছে, সব কিছুই তার নিজের স্বকীয়ং বলিনাং সর্বং দুর্বলানাং ন কিঞ্চন–দুর্বল লোকের কিছুই নিজের নয়। চন্দ্র এবার দেবগুরুর উদ্দেশে বড় কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন এবং সে কথাটার মধ্যে বৃহস্পতির নিজস্ব ব্যর্থতার কথাও বড় প্রকট হয়ে উঠল। চন্দ্র বললেন–অনুরাগিণী স্ত্রীর সঙ্গেই লোকে ঘর বাঁধে, নতুন জীবন শুরু করে। কিন্তু স্ত্রী যদি একজনকে ভালই না বাসতে পারেন, তার সঙ্গে তবে থাকবেন কী করে? তারা বৃহস্পতির ঘরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু যেদিন তিনি দেখলেন যে তার স্বামী তাকে ছেড়ে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সঙ্গে শৃঙ্গার-রমণে মত্ত হচ্ছেন, সেদিন থেকেই সুন্দরী তারা আর বৃহস্পতিকে ভালবাসেন না। তিনি বিরক্ত হয়ে গেছেন বৃহস্পতির ওপর–বিরক্তেয়ং তদা জাতা চকমেনুজকামিনীম্। অতএব যাও দূত! তারাকে আমি ফেরত দেব না। ইন্দ্রর যা ইচ্ছে হয় করতে পারেন।
এই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল। অবধারিতভাবে প্রশ্ন আসে-বৃহস্পতির অনুজ ভ্রাতাটি কে? তার সঙ্গে বৃহস্পতির সম্পর্কই বা কী? এই কথাগুলো অল্প হলেও বলতে হবে আমায়। যদিও মনে ভয় আছে–আপনারা ভাবতে পারেন–মহাভারতের কথারম্ভেই এসব। কী আরম্ভ হল? এর বউ পালাচ্ছে। তার বউ কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রেমলিন্দু। এসব কী হচ্ছে? সবিনয়ে জানাই–এগুলি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কেন না প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে-বৃহস্পতি কিংবা চন্দ্র-এঁরা প্রত্যেকেই বিশাল ব্যক্তিত্ব। আমি একথা বলছি না যে, বিশাল ব্যক্তিত্ব মানেই সাত খুন মাপ। কিন্তু উলটো দিকে ভাবতে হবে–বিশাল ব্যক্তিত্ব হলে কিছু খুন তো মাপ হয় বটেই।
মনু রাজধর্মাধ্যায়ে বলেছিলেন-অন্যায়কারী ব্যক্তির শক্তি এবং বিদ্যা ভালমতো বিচার করে যতটুকু শাস্তি তার প্রাপ্য রাজা সেইটুকু দণ্ডই দেবেন-তং দেশকালৌ শক্তিঞ্চ বিদ্যাঞ্চাবেক্ষ্য তত্ত্বতঃ। আজ যদি মহামান্য সুনীতি চ্যাটার্জি এবং আমি চুরির দায়ে ধরা পড়ি, তাহলে একই অভিযোগে আমার যা শাস্তি হবার কথা সুনীতিবাবুরও তাই হবার কথা। কিন্তু শাস্তি দেবার সময় সুনীতিবাবুর মহতী বিদ্যাবত্তা তথা সাংস্কৃতিক জগতে তার মহান অবদানের কথা বিচার করে আদালত তাকে আমার চাইতে কম শাস্তি দেবেন, অথবা শাস্তি নাও দিতে পারেন। শুধু মৃদু তিরস্কার করেও ছেড়ে দিতে পারেন। একইভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মমতা ব্যানাজী বা মনমোহন সিং যদি আমার সঙ্গে একই অপরাধে অভিযুক্ত হন, তবে তাদের যা। শাস্তি হওয়া উচিত, আমারও তাই হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখবেন, একই শাস্তি হচ্ছে না। তার কারণ, এতদিন তারা যে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাদের পিছনে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন আছে, সেটা আদালতের বিচার-চর্যার মধ্যে আসবে এবং স্বভাবতই তখন তার শাস্তি আমার তুলনায় অনেক হালকা হয়ে যাবে। ইচ্ছা করলে কিছুদিন পূর্বেই অযযাধ্যাকাণ্ডের মামলায় বি জে পি নেতা কল্যাণ সিংহের সামান্য শাস্তির কথা স্মরণ করতে পারেন।
বলতে পারেন–এও কি কোনও গণতান্ত্রিক বিচার হল? নাকি এটার মধ্যে বিচারব্যবস্থার কোনও সমদৃষ্টি লক্ষিত হল? আমি বলব–যে গণতান্ত্রিকতায় আমার বুদ্ধি এবং সুনীতিবাবুর বুদ্ধিকে এক মাত্রায় ফেলে বিচার করা হবে অথবা যে বিচারব্যবস্থায় আমাকে এবং জ্যোতি বসু-নরসিমা রাও-এর শক্তিকে সমদৃষ্টিতে দেখা হবে–সেই গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়াই ভাল, তাতে সমাজের বিপদ বাড়বে। বিদ্যা-বুদ্ধি, শক্তি, নিপুণতা তাতে ধুলোয় মিশে যাবে। মনে রাখতে হবে–মানুষের চারিত্রিক এবং ইন্দ্রিয়জ ক্রটিগুলি একান্তই মনুষ্যোচিত। তার জন্য জন-সমাজে একজন বিরাট পুরুষের অবদান তুচ্ছ হয়ে যায় না। আদালতের ন্যায়াধীশও সেই বিচারটা মাথায় রাখতে পারেন বলেই তিনি ন্যায়াধীশ। বিচার-ব্যবস্থা আমার-আপনার হাতে থাকলে উত্তম-অধমের তুল্যমূল্যতা হত এবং ঠিক সেই কারণেই আমি-আপনি বিচারপতি হবার উপযুক্ত নই।
আমি যে বেশ বড়সড়ো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম তার কারণ একটাই, বৃহস্পতি কিংবা চন্দ্রকে আমরা যেন আমাদের সাধারণ বিচার-বুদ্ধিতে পরিমাপ না করি। তাছাড়া সমাজের বিধি-ব্যবস্থা তখন কেবল নতুন তৈরি হচ্ছে। ইন্দ্রিয়ের শিথিলতাকে মানুষ তখন কেবল সংযমের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে আরম্ভ করেছে। ফলত আমাদের আধুনিক পরিশীলিত বুদ্ধি দিয়ে যদি মহাভারতীয় চরিত্রগুলির বিচার করতে আরম্ভ করি, তাহলে সেটা সমীচীন তত হবেই না, বরং অন্যায় হবে।
মহাভারতে দেখবেন–দেবগুরু বৃহস্পতি চিত্রশিখণ্ডী’র শিষ্য। সৃষ্টির প্রথম কল্পে ব্রহ্মা যে মানস-পুত্রদের জন্ম দেন তাদের মধ্যে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু এবং বশিষ্ঠ–এই সপ্তর্ষি চিত্রশিখণ্ডী’ নামে বিখ্যাত। এঁদের মধ্যে চন্দ্র অত্রির পুত্র। বৃহস্পতি আঙ্গিরার পুত্র। সমাজের ন্যায়-নীতি এবং রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন প্রথম তৈরি করেন ওই চিত্রশিখণ্ডী নামে পরিচিত সাতজন ঋষিই–আস্যৈঃ সপ্তভিরুগীর্ণং লোকধর্মমনুত্তমম্। এই সাত মুনির নিয়ম-কানুন এবং মনু মহারাজের ধর্মশাস্ত্র–যাঁরা প্রথম অধিগত করেন তারা হলেন বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্য। এক্ষেত্রে বৃহস্পতি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়সমাজে বৃহস্পতির মাধ্যমেই রাষ্ট্র এবং লোকধর্মের নীতিগুলি প্রথম প্রচারিত হয়–বৃহস্পতিসকাশাদ বৈ প্রান্সতে দ্বিজসত্তমাঃ। বৃহস্পতি তার সমস্ত বিদ্যা শিক্ষা চেদি বংশের রাজা উপরিচর বসুকে দান করেন, কিন্তু সে কথা পরে।
আমার বক্তব্য–বৃহস্পতি খুব কম লোক ছিলেন না। সমস্ত দেব সমাজের গুরু তো বটেই। এত বড় মর্যাদার জন্যই হোক, অথবা অন্য কোনও কারণে বৃহস্পতির চারিত্রিক শিথিলতা কিছু ছিল। তবে চন্দ্র যেমন বললেন–বৃহস্পতি তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর প্রতি আসক্ত ছিলেন, সেটা মহাভারতে তেমন করে পাই না। বরং উলটো কথা পাই যে, তিনি কোনও এক সময় তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উতথ্যের (কোনও মতে উশিজ) পত্নী মমতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গেও লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার গতির ওপর বৃহস্পতির নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তিনি যেভাবে যা চেয়েছিলেন, ঘটনা সেভাবে ঘটেনি। বৃহস্পতির সেই চরিত্র-স্থলনের ফল ঋষি ভরদ্বাজ, এবং এর কথাও পরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের কাছে।
কনিষ্ঠের স্ত্রীর সঙ্গে প্রণয়াসক্ত হওয়ার যে অবক্ষেপ আমরা চন্দ্রের মুখে শুনেছি, সে ব্যাপারে মহাভারত স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও, কনিষ্ঠের সঙ্গে বৃহস্পতির সদ্ভাব ছিল না। মোটেই। বৃহস্পতির ছোট ভাই হলেন সংবর্ত। তিনিও ব্রাহ্মণ-প্রবর ঋষি ছিলেন, কিন্তু বৃহস্পতির সঙ্গে তার দুঃসম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তার পক্ষে বাড়িতে থাকাই সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, রাগে অভিমানে তিনি একদিন পরনের জামা-কাপড় পর্যন্ত খুলে রেখে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছিল, আমরা তা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি।
একটি সম্পন্ন পরিবারে প্রায় সকলেই বিদ্যা-বলশালী হলেও যদি তাদের মধ্যে কেউ চরম সম্মানের পদবী লাভ করেন, তাহলে তার ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির সঙ্গে সঙ্গে মেজাজও কিছু চড়া হয়। বৃহস্পতিকে দেবতারা তাদের গুরু হিসেবে বরণ করে নেওয়ার পর, আমাদের ধারণা–তার মধ্যেও এক ধরনের স্ফীতবোধ কাজ করছিল। কারণ, ইন্দ্র অসুরদের হারিয়ে দেওয়ার পর নিজে বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ করেছেন–ইন্দ্ৰত্বং প্রাপ্য লোকেষু ততো বব্রে বৃহস্পতিম্।
মহাভারতে দেখছি–কুরু-পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ মরুত্ত রাজা একবার এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে কথা আরম্ভ হয়েছে বৃহস্পতি আর সংবর্তকে নিয়েই। দুজনেই মহর্ষি অঙ্গিরার পুত্র, তেজে-তপস্যায় দুজনেই পিতার তুল্য–পিতুস্তুল্যৌ বভূবতুঃ। দুজনের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আধুনিক পরিবারের দুরবস্থার মতোই তাদের ভাতের হাঁড়ি আলাদা হল–তাবতি স্পর্ধিনৌ রাজন্ পৃথগাস্তাং পরস্পর। কিন্তু হাঁড়ি আলাদা হলেই সব সময় পারিবারিক শান্তি সর্বাংশে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বৃহস্পতির তখন বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে। পৃথগান্ন হয়েও তিনি ছোটভাই সংবর্তকে যথেষ্ট অত্যাচার উৎপীড়ন করতে থাকলেন। মানসিক অত্যাচার শেষ বিন্দুতে পৌঁছোলে সংবর্ত পৈত্রিক এবং নিজের ধন-সম্পত্তি সব ছেড়ে-ছুঁড়ে–আমাদের মতো এক কাপড়েও নয়–একেবারে উলঙ্গ হয়ে বনে চলে গেলেন
স বাধ্যমানঃ সততং জাত্রা জ্যেষ্ঠেন ভারত।
অর্থানুসৃজ্য দিবাসা বনবাসমবোয়ৎ।
এর মধ্যে বৃহস্পতির অবস্থার আরও উন্নতি হল। দেবগুরুর পদ পেলেন তিনি। ওদিকে মরু রাজার সঙ্গে স্বর্গের ইন্দ্রের তত ভাব-ভালবাসা ছিল না। ইন্দ্রের সঙ্গে স্পর্ধা করেই তিনি যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন এবং সেই যজ্ঞের পুরোহিত হবার জন্য তিনি বৃহস্পতিকেই গিয়ে ধরলেন। দেবরাজ মরুত্তের অভিসন্ধি পূর্বাহ্নেই বুঝেছিলেন এবং বৃহস্পতিকে তিনি আগেই সাবধান করে বলে দিয়েছিলেন–দেখুন ব্রাহ্মণ! আমি দেবরাজ আর আপনি হলেন সেই দেবরাজের পুরোহিত। যে হাতে আপনি দেবরাজের যজ্ঞে আহুতি দেন, সেই হাতে যেন কোনও মর্ত্যরাজার যন্ত্রে আহুতি দেবেন না। ইন্দ্র এবার পরিষ্কার জানালেন-দেখুন, রাজা মরুন্তু এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। আপনি যেন কোনওভাবেই তার পৌরোহিত্য করবেন না–বৃহস্পতে মরুত্তস্য মা কার্ষীঃ কথঞ্চন। এবার চরম সাবধানবাণী, হ্যাঁ, আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ, আপনার স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আছে–তবে যদি মরুত্তের পৌরোহিত্য করতে হয় করুন; কিন্তু আমাকে বাদ দিতে হবে তাহলে। হয় আপনি মরুত্তকে স্বীকার করুন, নয় আমাকে, যে কোনও একটা–পরিত্যজ্য মরুং বা যথাযোষং ভজস্ব মাম্।
বৃহস্পতি কেমন যেন একটু থমকে গেলেন। একটু চুপ করেও গেলেন। ভেবে দেখলেন নিশ্চয়ই যে, দেবতাদের সামাজিক স্থিতি এবং আভিজাত্য মানুষের থেকে অনেক বড়। দেবতাদের সঙ্গে মিলে-মিশে চললে তারও মর্যাদা অনেক বাড়বে। আরও বুঝলেন যে, ব্রাহ্মণোচিত স্বাধীনতায় আজ যদি ইন্দ্রকে প্রত্যাখ্যান করার হঠকারিতা করেন, তাহলে ভবিষ্যতে তাঁকে মনুষ্যলোকের এ-রাজা-সে রাজার পৌরোহিত্য কুড়িয়ে দিন কাটাতে হবে। তার থেকে এই চিরকালের বাধা কাজ বৃহস্পতির মর্যাদা এবং সম্পত্তি–দুইই বাড়বে। ইন্দ্রকে তিনি সোজা বলেই দিলেন–আরে! কত অসুর-রাক্ষস বধ করে তুমি এই তিন ভুবনের অধিপতি হয়েছ, সমস্ত লোক তোমার ওপরেই নির্ভর করে আছে, সেই তোমার মতো বড় মানুষের পৌরোহিত্য করে আমি কি আর মানুষের পৌরোহিত্য করতে পারি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক দেবরাজ; যে-আমি এর দেবযজ্ঞে আহুতি দেওয়ার সময় ঘিয়ের হাত ধরেছি, সেই আমি কখনও মানুষের যজ্ঞে ঘিয়ের হাত ধরব না
সমাসিহি দেবেন্দ্র নাহং মর্তস্য কহিচিং।
গ্রহীষ্যামি সুবং যজ্ঞে শৃণু চেদং বচো মম।
এদিকে মরুত্ত-রাজা বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করে পুরোহিত-বরণের জন্য বৃহস্পতির কাছে উপস্থিত হলেন। বললেন–আপনাকে আগে যে যজ্ঞের কথা বলেছিলাম, সেই যজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে। আপনি আমাদের কুলগুরু। অতএব চলুন, সেই যজ্ঞের পৌরোহিত্য গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন। বৃহস্পতি বললেন–আমার পক্ষে এই পৌরোহিত্য করা সম্ভব নয় রাজা। দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে পৌরোহিত্যে বরণ করেছেন। আমিও তার প্রার্থনা স্বীকার করেছি। কাজেই এ কাজ সম্ভব নয়।
পদবিতে উঠলে যা হয়। এখনকার দিনের বড় মানুষের মুখে যেমন শুনি–সম্ভব নয়, আমার সময়-টময় নেই, তাছাড়া ওই সময়টায় সি এম-এর একটা প্রোজেক্ট প্ল্যান আমাকে দিতে হবে-বৃহস্পতির অবস্থাও একই রকম। মরুত্ত রাজা কত করে বললেন-সে কি ঠাকুর? আমি আপনার কতকালের যজমান। সেই বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে আপনি আমাদের ক্রিয়া-কর্ম সবই করছেন। আমাকে অস্বীকার করলে চলে কী করে? বৃহস্পতি বড় মানুষের। মতোই বলে দিলেন–সম্ভব নয়। মরণহীন দেবতাদের যাজন করে দিন কাটছে আমার। আমি কীভাবে তোমার মতো মরণশীল মানুষের যাজন করি–অমর্ত্যং যাজয়িত্বাহং যাজয়িয্যে কথং নরম্?
মরুত্ত ফিরে এলেন। পথে বিপত্তারণ নারদের সঙ্গে দেখা। রাজা সব ঘটনা তাকে আনুপূর্বিক জানালেন। নারদ বৃহস্পতিকেও চেনেন, তার ছোট ভাই সংবর্তকেও চেনেন। কলহের মনস্তত্ত্ব ডাল জানা থাকায় নারদ এও বুঝতে পারলেন যে একমাত্র সংবর্তকে পৌরোহিত্যে বরণ করলেই বৃহস্পতি যেমন জব্দ হবেন তেমনই তার রাগ হবে। নারদ বললেন–মহারাজ আপনার চিন্তার কোনও কারণই নেই। আপনি সোজা চলে যান মহর্ষি অঙ্গিরারই অন্য পুত্র সংবর্তের কাছে। তিনি বৃহস্পতির ছোট ভাই। তিনিই আপনার যজ্ঞ-কর্ম সম্পন্ন করবেন। নারদ সংবর্তের ঠিকানাও দিলেন মরুত্ত-রাজাকে। রাজা কাশীতে গিয়ে সংবর্তের দেখা পেলেন এবং যথাবিধি তাকে যজ্ঞের আমন্ত্রণও জানালেন।
সংবর্ত এই বিশাল যজ্ঞ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। বৃহস্পতির উৎপীড়নে তিনি ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিগম্বর হয়ে কাশীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। রাজার কাছে তিনি তার অক্ষমতার কথা লুকোলেন না। বললেন-দেখুন রাজা! মানসিক-শারীরিক নানা জ্বালা-যন্ত্রণায় আমার বায়ুরোগ ধরে গেছে, আর আমি চলি-ফিরিও নিজের ইচ্ছামতো-বাতপ্রধানেন ময়া স্বচিত্তবশবর্তিনা-স্বভাবটাও আমার বিকারগ্রস্ত। এ অবস্থায় আপনি আমায় যজ্ঞ সম্পাদনের। ভার দিয়ে ঠিক কাজ করছেন না বোধহয়। সংবর্ত এবার রাজাকে এড়ানোর জন্য তাকে বৃহস্পতির ঠিকানা দিয়ে বললেন–আমার দাদা হলেন বৃহস্পতি। এ সমস্ত বড় বড় যজ্ঞ তিনিই খুব ভাল করে করতে পারবেন। তাছাড়া তিনি স্বয়ং দেবরাজের পুরোহিত। তাকে দিয়ে। আপনার কাজ হবে ভাল–বর্ততে যাজনে চৈব তেন কর্মাণি কারয়।
বৃহস্পতিকে যজ্ঞ করানোর প্রস্তাব করার পর সংবর্ত কিন্তু নিজের ক্ষোভটুকু আর চেপে রাখতে পারলেন না। বলে ফেললেন–বৃহস্পতি আমার বড় ভাই হলে কী হয়, তিনি আমার ঘর-সংসার, গৃহস্থধর্ম সব নষ্ট করেছেন। আমার যজমান যাঁরা ছিলেন, তারা আমার দাদার চাপে কেউ আর আমাকে পৌরোহিত্যে বরণ করে না। এমন কি, জানেন–আমার ঘরের ঠাকুর-বিগ্রহগুলি পর্যন্ত আমার দাদা নিয়ে নিয়েছেন। তিনি আমার সব বরবাদ করে শুধু এই শরীরটা মাত্র ছেড়ে দিয়েছেন–পূর্বজেন মক্ষিপ্তং শরীরং বর্জিতং ত্বিদ। সংবর্ত আরও জানালেন–এখন যদি দাদা বৃহস্পতির অনুমতি ছাড়াই আমি আপনার যজ্ঞ করি, তাহলে আর দেখতে হবে না। আপনি মহারাজ আগে তার কাছে যান। মরুত্ত পূর্বের ঘটনা বিবৃত করলেন এবং বৃহস্পতির প্রত্যাখ্যানের খবরও তাকে জানালেন।
বৃহস্পতি এবং সংবর্তের দ্বন্দ্বের শেষ হয়নি। তবে এই উপাখ্যানের পরম্পরায় জানাই সংবর্ত মরুত্ত রাজার যজ্ঞে পৌরোহিত্য করেছিলেন এবং বৃহস্পতির অনিচ্ছা, বিদ্বেষ এবং বাধা সত্ত্বেও তিনি স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রকে মন্ত্রে বশীভূত করে মরুত্ত রাজার যজ্ঞে সোমপান করতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু আপাতত এই উপাখ্যানের পরম্পরা আমাদের কাছে তত জরুরি নয়। জরুরি শুধু সংবর্তের ক্ষোভটুকু। তিনি বলেছিলেন–আমার বড় ভাই হয়েও তিনি আমার ঘর-সংসার, গার্হস্থ্য ধর্ম ছারখার করে দিয়েছেন, আমার যজমান নষ্ট করেছেন, ঘরের দেবতাও তিনি নিয়ে নিয়েছেন–গার্হস্থ্যঞ্চৈব যাজ্যাশ্চ সর্বা গৃহ্যাশ্চ দেবতাঃ।
আমাদের জিজ্ঞাসা হয়–কী এমন ঘটেছিল, যাতে এই ব্রাহ্মণ ঋষির সোনার সংসার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? কী এমন ঘটেছিল, যাতে তাকে পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্ত ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিলউন্মত্তবেশং বিভ্রং স চংক্রমীতি যথাসুখম্। ঠিক এই সময়ে আমাদের চন্দ্রের কথা স্মরণ করতে হবে। চন্দ্র ইন্দ্রের দূতকে বলেছিলেন–যান আর কথা বাড়াবেন না। সুন্দরী তারা সেইদিন থেকেই তার স্বামী বৃহস্পতির ওপর বিরক্ত হয়ে গেছেন, যেদিন তিনি দেখেছিলেন-তার ভালবাসার স্বামী তার নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত- বিরক্তেয়ং তদা জাতা চকমেনুজকামিনীম্।
এই জন্যই কি সংবর্তের ঘর-সংসার গার্হস্থ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? যাকে নিয়ে গৃহস্থ-ধর্ম, সেই স্ত্রীই যদি অন্য পুরুষের দ্বারা লঙ্ঘিত হয়ে থাকে তবে তাকে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বিবাগী হয়েই বেরোতে হবে উন্মত্রে বেশে। চন্দ্র সংবর্তের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পরিষ্কার বলে দিলেন-সুন্দরী তারাকে আমি ফিরে পাঠাব না। সে তার স্বামীকে ভালবাসে না। সে ভালবাসে আমাকে, আর আমিও তাকে ভালবাসি। তুমি ইন্দ্র আর বৃহস্পতি, দুজনকেই বোলো-যদি ঘর বাঁধতে হয় তো ভালবাসার রমণীটিকে নিয়েই ঘর বাঁধা ভাল, অপছন্দের বউকে নিয়ে ঘর বাঁধা যায় না–গৃহারম্ভন্তু রক্তায়াং বিরক্তায়াং কথং ভবেৎ। যাও তুমি দূত। গিয়ে বলো তোমার ইন্দ্রকে–তার তো অনেক ক্ষমতা, তিনি যা ইচ্ছে করুন। আমি তারাকে ফেরত পাঠাব না–ন দাস্যেহং বরারোহাং গচ্ছ দূত বদ স্বয়ম্।
.
১৯.
বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দিলেন না চন্দ্র। ইন্দ্রের দূত ইন্দ্রের কাছে ফিরে গেলেন। দেবসমাজে এই ঘটনা নিয়ে দারুণ হই-হই পড়ে গেল। দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরুর অবমাননায় অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। তার নিজেরও অপমান কিছু কম হয়নি। তার সনির্বন্ধ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন চন্দ্র। অতএব আর সহ্য করা যায় না। ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির সম্মানে যুদ্ধের উদ্যোগ নিলেন। দেবসৈন্যদের মধ্যে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল।
বড় বড় যুদ্ধে যা হয়। কে কোন পক্ষ সমর্থন করবেন, কে কার পক্ষে যোগ দেবেন–এসব সিদ্ধান্ত খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। দেবতাদের যুদ্ধোদ্যোগ দেখামাত্র অসুর-গুরু শুক্রাচার্য। চন্দ্রের কাছে এলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে তার চির শত্রুতা। সেই শত্রুতাবশতই যেন ব্যাপারটা অন্যায় হলেও তিনি চন্দ্রের পক্ষ সমর্থন করে তাকে বললেন-বৃহস্পতির বউকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও দরকার নেই তোমার-মা দদস্বেতি তং বাক্যমুবাচ শশিনং প্রতি–আমি তোমাকে সাহায্য করব। দেবদেব শঙ্কর শুক্রাচার্যকে চন্দ্রের পক্ষপাতী দেখে ইন্দ্রের পক্ষে যোগ দিলেন। তিনি তার মস্ত আজগব ধনুক দিয়ে চন্দ্রকে শায়েস্তা করবেন বলে ঠিক করলেন। বৃহস্পতির স্ত্রীর সঙ্গে চন্দ্রের আচরণে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। রুদ্র-শিব যেহেতু এক সময়ে বৃহস্পতির পিতার শিষ্য ছিলেন,–স হি শিষ্যো মহাতেজাঃ পিতৃঃ পূর্বে বৃহস্পতেঃ–অতএব বৃহস্পতিকে সমর্থন করলেন স্বয়ং মহাদেব। দৈত্য-দানবেরা শুক্রাচার্যের নেতৃত্বে চন্দ্রের পক্ষে যোগ দিলেন।
বিশাল যুদ্ধ পাকিয়ে উঠল। মহাদেব ব্রহ্মশির অস্ত্র ছুঁড়ে দৈত্য-দানবদের অনেককে মেরে ফেললেন বটে, তবে চন্দ্রকে তিনি কিছু করতে পারলেন না। চন্দ্র বিষ্ণুর বর-পুষ্ট। অতএব দেবপক্ষেরও ক্ষয়ক্ষতি কিছু কম হল না। অনেক দেবতাও চন্দ্রের হাতে মারা গেলেন এবং বাকি যারা থাকলেন, তত্র শিষ্টান্তু যে দেবাঃ–তারা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে গিয়ে আর্জি জানালেন–এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। ব্রহ্মা এসে ইন্দ্র-পক্ষের রুদ্র-শিবকে এবং চন্দ্র-পক্ষের শুক্রাচার্যকে যুদ্ধের প্ররোচনা ছড়াতে নিষেধ করলেন–ততে নিবাৰ্য্যোশনসং রুদ্রং জ্যেষ্ঠঞ্চ শঙ্কর। শুক্রাচার্যকে তিনি ভর্ৎসনা করে বললেন–তোমার কি সঙ্গদোষে এমন অপকর্মে দুর্মতি হল–কিমন্যায়ে মতির্জাতা সঙ্গদোষান্মহামতে। আর চন্দ্রকে বললেন–গুরুর স্ত্রীকে এই মুহূর্তে ছেড়ে দাও, চন্দ্র! নইলে স্বয়ং বিষ্ণুকে ডেকে এনে তোমার সর্বনাশ করে ছাড়ব আমি–নো চেদ বিষ্ণুং সমাহয় করিষ্যামি তু সংক্ষয়ম।
অবস্থা বুঝে চন্দ্রের পক্ষপাতী শুক্রাচার্য পর্যন্ত চন্দ্রের পিতা মহর্ষি অত্রির নাম করে বললেন–আজকেই ছেড়ে দাও গুরুপত্নীকে। তোমার পিতারও এই ইচ্ছে জেনো-মুঞ্চ ভার্যাং গুয়োরদ্য পিত্রাহং প্রেষিতস্তব। ব্রহ্মা এবং শুক্রাচার্য–দুজনের কথায় চন্দ্র শেষ পর্যন্ত গুরুপত্নী তারাকে ছেড়ে দিলেন বটে, কিন্তু ততদিনে তারা গর্ভবতী হয়েছেন। তারা বৃহস্পতিকে পছন্দ করেন না, তবু বৃহস্পতি তার অধিমাত্র লাভেই পরম আনন্দে ফিরলেন। দেব, দানব, ব্রহ্মা, শিবও–সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন। সর্বত্র শান্তি ফিরে এল।
এইভাবে বেশ কিছুদিন গেল। গর্ভবতী তারা সযত্নে গর্ভ রক্ষা করলেন, এবং শুভদিনে শুভ নক্ষত্রে এক অসাধারণ পুত্র প্রসব করলেন। পুত্রের আকৃতি-প্রকৃতি চন্দ্রের মতো, জ্যোতিষ এবং সামুদ্রিক শাস্ত্রের সমস্ত সুলক্ষণ সেই পুত্রের সর্বাঙ্গে। বৃহস্পতি পুত্রমুখ দেখে বড় খুশি হলেন। এবং শাস্ত্র-বিধি অনুসারে পুত্রের জাতকর্মাদি ক্রিয়াও সম্পন্ন করলেন-জাতকর্মাদিকং সর্বং প্রহৃষ্টেনান্তরাত্মনা। চন্দ্রের কাছে তারার পুত্র জুন্মের সংবাদ এসে পৌঁছল লোকপরম্পরায়। সব শুনে চন্দ্র লোক পাঠালেন বৃহস্পতির কাছে। সে গিয়ে চন্দ্রের নাম করে বৃহস্পতিকে বলল–এত জাঁকজমক করে যে ছেলের জাতকর্মাদি ক্রিয়া করছ, সে মোটেই তোমার ছেলে নয়। সে আমার ছেলে। বৃহস্পতি জোর দিয়ে বললেন–এ ছেলে চন্দ্রের হতে যাবে কেন, এ আমারই ছেলে। দেখতেও তো হয়েছে আমারই মতো–উবাচ মম পুত্র মে সদৃশো নাত্র সংশয়ঃ।
আবার চন্দ্র আর বৃহস্পতির ঝগড়া-ঝাটি আরম্ভ হল। আবারও যুদ্ধ লাগে আর কি। দেবসমাজে যুদ্ধের স্ট্র্যাটিজি’ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হল, নানা ‘মিটিং’ চলল ঘন-ঘন যুদ্ধাৰ্থমাগতাস্তেষাং সমাজঃ সমজায়ত। প্রজাপতি ব্রহ্মা সব খবর শুনে আবারও এসে উপস্থিত হলেন। যুদ্ধ প্রায় লেগে গেল। প্রজাপতি ব্রহ্ম আগে দেব-দানব সকলকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তারপর তারার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমিই মা সত্যি করে বল তো-পুত্রটি কার? চন্দ্রের না বৃহস্পতির? তুমি সত্যি করে বললেই এই সাংঘাতিক যুদ্ধ আর লাগে না–সত্যং বদ বরারোহে যথা ক্লেশঃ প্রশামতি।
বস্তুত এ প্রশ্ন দেবতারা আগেই করেছিলেন তারাকে। অন্তত মহাভারতের পরিশিষ্ট-রূপী হরিবংশ তাই বলেছে। কিন্তু তারা এই প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি। আমাদের ধারণা–দেবতারা বৃহস্পতির পক্ষ হয়ে পূর্বে চন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন বলেই চন্দ্রের অনুরাগিণী তারা হ্যাঁ বা না-কোনও জবাবই দেননি–পৃচ্ছ্যমানা যদা দেবৈৰ্নাহ সা সাধ্বসাধু বা। কিন্তু প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন আসন্ন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি-রক্ষার তাগিদে তারাকৈ ওই একই প্রশ্ন করলেন, তখন আর উত্তর না দিয়ে উপায় থাকল না তারার। ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করলেন-বল মা! এ ছেলে কার–কস্যায়ং তনয়ঃ শুভে? শান্তির দূত পিতামহ ব্রহ্মার সামনে লজ্জায় মাথা নিচু করে তারা বললেন–এ পুত্র চন্দ্রের। বলেই তারা দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লেন–চন্দ্রস্যেতি শনৈরন্তর্জগাম বরবৰ্ণিনী। বিবাহিত স্বামীর ঘরে বসে অন্য পুরুষের পুত্র গর্ভ ধারণ করেছি–এ কথা বলতে কোন রমণীই বা লজ্জা না পাবে। তারাও তাই কথাটা বলেই লজ্জায় ঘরে ঢুকে পড়লেন তাড়াতাড়ি।
হরিবংশে দেখছি–তারার কথা শোনামাত্রই প্রজাপতি ব্রহ্ম সেই নবজাতকের মস্তক আঘ্রাণ করে তার নাম রেখেছেন বুধ। অন্য মতে তারার কথাটা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্র বৃহস্পতির বাড়ি থেকে তাঁর পুত্রটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এবং তার নাম রাখেন বুধ।
যা দেখা গেল, তাতে চন্দ্রবংশে আরও একটি নক্ষত্রের জন্ম হল। বুধের জন্মলগ্নে চাঁদ, তারা বা বৃহস্পতির–ইত্যাদি নক্ষত্র-তারকার কলঙ্ক যাই থাকুক, এখনও পর্যন্ত এই বংশের জাতকের মধ্যে খুব একটা মানুষ-মানুষ ভাব দেখলাম না। দেখলাম, কেমন যেন একটা দৈবভাব। তবে তা শুধু দেবতাদের ঘটনা বলেই এই দৈবীভাব। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের। আনাগোনায় দেবতা, অতিদেবতা, দেবগুরুর ব্র্যহস্পর্শে ঘটনা যতই গম্ভীর হয়ে উঠুক, তবু কিন্তু এই ঘটনার বিন্যাসে মানুষের জীবনের স্পর্শ আছে। অর্থাৎ মানুষের জীবনেই এরকম ঘটে থাকে, ঘটে এবং ঘটবেও। কিন্তু যেহেতু চন্দ্র, তারা, বুধ, বৃহস্পতি ইত্যাদি শব্দে নক্ষত্রলোকের অভিসন্ধি মেশানো আছে, অতএব মহাভারতের কবি তাদের জীবন-বিস্তারে মন দেননি। নক্ষত্রলোকের প্রতাঁকে ধরা এইসব জীবনের কাহিনী আমাদের শুনতে হয়েছে পুরাণ থেকে, হরিবংশ থেকে।
কিন্তু যে মুহূর্তে কুরু-পাণ্ডবের বংশমূলে মানুষের শব্দ-স্পর্শ যোগ হয়েছে সেই মুহূর্তে মহাভারতে মনুর কথা এসেছে। মনু থেকেই এই মানব-জাতি, মহাভারত যাকে বলেছে–মনোর্বংশে মানবানাং ততো য়ং প্রথিতো’ভবৎ। বস্তুত মহাভারতের আদিপর্বে দুই জায়গায় কুরু-পাণ্ডবের পূর্বতন বংশ-পরস্পরা বর্ণিত আছে। এই দুই জায়গাতেই চন্দ্র, বৃহস্পতি কিংবা তারার কোনও হদিশ নেই। এমনকি বুধেরও জন্মের কোনও খবর ভাল করে পাওয়া যায় না। মহাভারতের এই দুই লিস্টিতেই বৈবস্বত মনু থেকে মানব-জাতির উৎপত্তি। মনুর নয়টি পুত্র এবং একটি কন্যা। এই কন্যাটি সত্যিই কন্যা না পুত্র, তা নিয়ে পৌরাণিকদের মধ্যে বিবাদ আছে এবং সে কথায় আমি পরে আসছি।
আপাতত জেনে রাখতে হবে যে-মনুর নয় পুত্রের মধ্যে অন্তত চার জন বড় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্তত চারটি বিখ্যাত রাজবংশের মূল হলেন এই চারজন মনুপুত্র। অযযাধ্যায় যে বিখ্যাত ইস্ফাকু-রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং যার অধস্তন হলেন স্বয়ং নরচন্দ্রমা রামচন্দ্র, সেই ইস্ফাকু মনুর এক পুত্র। ইস্ফাকুর অন্যতম এক পুত্র থেকেই বৈদেহ-বংশের প্রতিষ্ঠা এবং এই বংশের অধস্তন হলেন সীতাপতি জনক, অর্থাৎ রামের শ্বশুর। অর্থাৎ বৈদেহ জনকও সূর্যবংশেরই বটে।
মনুর আরেক পুত্র নাভানেদিষ্ঠ। তিনি রাজত্ব করতেন বৈশালীতে। প্রতি এবং সুমতি এই বংশের নামী পুরুষ এবং তারা ছিলেন ইস্ফাকু-বংশজ দশরথের সমসাময়িক। মহারাজ শর্যাতি মনুর আরেক কীর্তিমান পুত্র। সম্ভবত তিনি রাজত্ব করতেন কুশস্থলীতে যা পরবর্তী কালের দ্বারকা বলা যায়। চতুর্থ মনুপুত্র নাভাগও যথেষ্ট বিখ্যাত তবে তিনি ঠিক কোথায় রাজত্ব করতেন বলা মুশকিল। এই বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হলেন মহারাজ অম্বরীষ যিনি নানা কারণে কীর্তিশালী হয়েছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল–মনুপুত্রদের প্রত্যেককেই একভাবে সূর্যবংশীয় বলা যায়; কেননা, বৈবস্বত মনুর পিতা হলেন বিবস্বান্-সূর্য। কিন্তু অযযাধ্যার সম্রাট ইক্ষাকু এতটাই বিখ্যাত হয়েছিলেন যে সূর্যবংশের সমস্ত সুনামটুকু যেন তার ওপরেই বর্তেছিল। ফলত একমাত্র ইক্ষাকুর বংশই সূর্যবংশ বলে বিখ্যাত হয়েছে। এবারে সেই মেয়েটির কথায় আসি, যার নাম ইলা এবং যাঁর থেকে চন্দ্রবংশের পরম্পরা।
বেশির ভাগ পুরাণেই দেখা যাবে ইলা মেয়ে ছিলেন না, পুরুষই ছিলেন এবং তার নাম ইলা নয়, তার নাম ইল। একটি পুরাণ তো এমন কথাও বলেছে যে, মনু মহারাজ তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইলকে রাজপদে অভিষিক্ত করে তপস্যা করার জন্য নন্দন বনে চলে গিয়েছিলেন
অভিষিচ্য মনুঃ পুত্রমিলং জ্যেষ্ঠং চ ধার্মিকঃ।
জগাম তপসে ভূয়ঃ স মহেন্দ্ৰবনালয়।
কিন্তু অন্যান্য পুরাণে ইল নামটি আসার সঙ্গে সঙ্গেই একটি মজার উপাখ্যান। ইল নাকি রাজা হয়েই দিগ্বিজয়ে যাত্রা করেন। পৃথিবীর নানা দেশ জয় করার পথে এক সময় তার অশ্বটি একটি বনে প্রবেশ করে। কোনও পুরাণে এই বনের নাম শরবন, কোথাও বা কুমারবন, আবার কোনও পুরাণে এটি উমাবন। যাই হোক এই বনে মহাদেবের আবাস ছিল এবং এই বনে প্রবেশের ব্যাপারে পূর্বেই একটি নিয়ম চালু হয়েছিল। অবশ্য সেই নিয়মের ব্যাপারেও অন্য একটি গল্প আছে। কথিত আছে-এক সময় সনক সনন্দ প্রমুখ ব্রহ্মবাদী ঋষিগণ মহাদেবের দর্শন লালসায় এই অসাধারণ বনভূমিতে প্রবেশ করেন। সেই সময় দেবদেব শঙ্কর পার্বতীর সঙ্গে ক্রীড়াসক্ত ছিলেন এবং শৈলদুহিতার বসন-ভূষণও কথঞ্চিৎ অসস্তৃত ছিল। এই অবস্থায় ব্রহ্মবাদী ঋষিদের দেখে পার্বতী বড় লজ্জা পেলেন এবং কোনও মতে বস্ত্র সম্বরণ করে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে থাকলেন–লজ্জাবিষ্ট স্থিতা তত্র বেপমানাতিমানিনী।
ব্ৰহ্মবাদী ঋষিরা ব্রহ্মানন্দে মগ্ন। তাদের মনে স্ত্রী-পুরুষের ভেদাভেদ, রমণ-মৈথুন বড় একটা ক্রিয়া করে না। দেবদেব শঙ্করের উদাসীন ক্রীড়াকৌতুক এবং পার্বতীর বিপর্যস্ত অবস্থা দেখামাত্রই ব্ৰহ্মর্ষিরা স্থান ত্যাগ করে নর-নারায়ণ আশ্রমের দিকে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু পার্বতাঁকে তখনও সংকুচিত আর অভিমানিনী দেখে ভগবান শিব নিয়ম করে দিলেন–যে পুরুষ এরপর ওই বিহার-বনে ঢুকবে সেই মেয়ে হয়ে যাবে। যারা এই নিয়মের কথা জানত, তারা সকলেই বনভূমির বহিঃসীমা অতিক্রম করত না। কিন্তু দিগ্বিজয়ে ভ্রাম্যমান ঘোড়াটি অথবা তার মালিক ইল রাজা–তাদের কারুরই এই শিবের নিয়ম জানা ছিল না। অত্যন্ত আকস্মিকভাবে ইল এক সুন্দরী নারীতে পরিণত হলেন, এমনকি তার ঘোড়াটিও ঘোটকীতে পরিণত হল। স্ত্রী স্বরূপে ইলর নাম হল ইলা।
স্ত্রীত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীরে স্তন-জঘনাদির স্ত্রী লক্ষণগুলিও প্রকাশিত হল। তার গলার স্বর থেকে আরম্ভ করে গতি-স্মিত-কটাক্ষেও এল রমণীয় পরিবর্তন। বনের মধ্যে ভ্রমণ করতে করতে স্ত্রী রূপিণী ইলের মনে একটু উদাসীন ভাবও দেখা গেল। তিনি ভাবলেন–ছিলাম রাজপুরুষ, হলাম এক রমণী। এখন কেই বা আমার বাবা আর কেই বা মা। কার সঙ্গেই বা আমার বিয়ে হবে, কে জানে? হয়তো এইভাবে বিমনা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তিনি সেই শিবের বিহারভূমির বাইরে চলে এলেন। ঠিক এই সময়ে চন্দ্র-পুত্র বুধ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনের বহিঃপ্রান্তে। ইলাকে তিনি দেখতে পেলেন এবং তার মনোহরণ রূপে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি শুধু উপায় খুঁজতে লাগলেন–কীভাবে এই রমণীকে আত্মসাৎ করা যায়-বুধস্তদাপ্তয়ে যত্নমকবরাং কামপীড়িতঃ।
চন্দ্রপুত্র বুধ ইলাকে লাভ করার আশায় ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করলেন। ইলাকে তিনি অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করেছেন এবং বুঝেছেন–এই রমণীর পূর্ব-স্মৃতি যথাযথ নেই। বুধ এও বুঝেছেন–ব্রাহ্মণের বাক্য জনসমাজে মান্যতা লাভ করে, অতএব ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করে। বেশ নাটকীয়ভাবে যদি ইলাকে প্রার্থনা করা যায়, তবে তার বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বুধ হাতে দণ্ড-কমণ্ডলু ধারণ করে বিশ্বসনীয় ব্রাহ্মণ-উপাধ্যায়ের মতো একখানি পথিও ধরে। রাখলেন নিজের হাতে। কতিপয় ব্রাহ্মণবালক ফুল-জল, সমিৎকাঠ নিয়ে তাকে অনুসরণ করল এবং বুধের ব্রাহ্মণত্ব আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল।
বুধ দূর থেকে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সেই শিব-বিহার-ভূমির বহিঃপ্রান্তে এসে পৌঁছলেন, যেখানে বিহ্বল-বিভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন ইলা। বুধ অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ইলাকে কয়েকটা কথা বললেন। বললেন এমনভাবে যেন ইলা তার কতকালের বিবাহিতা স্ত্রী। বুধ বললেন–এ কী হল? তুমি হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে চলে এলে কেন? আমার অগ্নিহোত্রের কাজকর্ম সব ফেলে দিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ তুমি–অগ্নিহোত্রশুশ্রুষাং ক গতা মন্দিরাৎ মম? একটু বকার মতো করে কথা কয়টি বলেই বুধ কিন্তু সুর পালটালেন। বললেন–আমাদের বিহার-বেলাও যে শেষ হতে চলল সুন্দরী! কেন এমন সময়ে এমন সন্ত্রস্ত হয়ে আছ? এমন একটি সন্ধ্যা কি নষ্ট করা চলে? ঘরে চলো। ঘর-দোর মুছে ফুলের সাজে আমাদের মিলন-গৃহ সুসজ্জিত করো-কৃত্বোপলেনং পুষ্পৈরলঙ্গুরু গৃহং মম।
ইলা বললেন–মহর্ষি! কারণ ব্রাহ্মণের সাজে বুধকে তিনি মহর্ষিই ভেবেছিলেন–ইলা বললেন–মহর্ষি! আমার কিছু মনে নেই। আমি কে, আপনি কে, আমি কোথায় জন্মেছি কিচ্ছুটি মনে নেই আমার। বুধ বললেন–কেন? তোমার নাম তো ইলা। আর আমি তো সেই বুধ, আমার পিতা মহামান্য এক ব্রাহ্মণ–পিতা মে ব্রাহ্মণাধিপঃ। কথাটার মধ্যে খুব একটা মিথ্যাও নেই। কারণ জননী তারা এবং বৃহস্পতির সম্বন্ধে নিজেকে ব্রাহ্মণের পুত্র বলে পরিচয় দিতে কোনও অসুবিধাই ছিল না বুধের।
ইলা বুধের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তথাকথিত স্বামীর বাড়িতে গিয়ে উঠলেন এবং থাকতে লাগলেন বিশ্বস্তা বিবাহিতা বধুটির মতোই। অনেক পুরাণই বলেছে–ইলার এই স্ত্রীত্ব ছিল সাময়িক এবং মহাদেবের কাছে তিনি নাকি বর পেয়েছিলেন–একমাস তিনি স্ত্রী হয়ে থাকবেন এবং একমাস থাকবেন পুরুষ হয়ে। পুরুষ অবস্থায় তার নাম হবে সুদম আর স্ত্রী। অবস্থায় তার নাম হবে ইলা। মহাভারতের কবি যে একবারও এই ইলা-সুদ্যুম্নের কথা বলেননি, তা নয়। তবে তিনি অন্য পুরাণকারদের মতো এমন গল্প করে বলেননি। মহাভারতের প্রায় অন্তকালে অনুশাসনপর্বে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে একবার বলা আছে–বৈবস্বত মনুর বংশজ হলেন ইলা-সুন্ন-মননশ্চ বংশজ ইলা সুদ্যুম্নশ্চ ভবিষ্যতি। কবির এক-পংক্তির উক্তি থেকেই মোটেই বোঝা যায় না যে, যিনি ইলা তিনি সুদ্যুম্ন।
এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে আমার যা মনে হয় নিবেদন করি। অধিকাংশ পৌরাণিকেরা বলেছেন যে স্ত্রী অবস্থায় ইলার সঙ্গে বুধের মিলনে পুরূরবার জন্ম হয় এবং বুধ যেহেতু চন্দ্রের পুত্র, তাই চন্দ্রের পুত্র-পরম্পরা চালু হয়ে গেল পুরূরবার জন্ম থেকেই। পুরূরবার জন্মের কথা বলেই পৌরাণিকেরা বলেছেন ইলার পুরূষাবস্থায় সুদ্যুম্নের পুত্র হলেন উৎকল এবং গয়–পৌরাণিকেরা যে যাই বলুন, আমাদের ধারণা সুদ্যুম্ন ইলার এক স্বামী এবং অন্য স্বামী হলেন বুধ। আসল কথা বৃহস্পতি এবং চন্দ্র–দুজনেই যদি তারার স্বামী হতে পারেন, তবে সুদুন্ন এবং বুধ–এই দুজনেও ইলার দুই স্বামী হতে পারেন। আমার ধারণা যে মিথ্যা নয়, কিংবা একেবারে অবাস্তব নয় সেটা অন্যান্য পুরাণের প্রমাণ দিয়েই বলি।
বায়ু পুরাণ বলেছে–প্রথম মানব মনুর নিজের সমান গুণের নয়টি পুত্র ছিল–মনোঃ প্রথমজস্যাসন্নব পুত্ৰাস্তু তৎসমাঃ। লক্ষণীয় বিষয় হল, এই নয় পুত্রের মধ্যে ইক্ষাকুই হলেন জ্যেষ্ঠ এবং এই লিস্টিতে ইল’ বলে কোনও পুত্রের নাম নেই। জ্যেষ্ঠও তিনি নন, রাজাও তিনি নন। বায়ু পুরাণে স্পষ্ট বলা আছে–ইক্ষাকু ইত্যাটি নটি পুত্রের জন্মের পর ব্রহ্মার আদেশে মনু পুত্রকাম হয়ে একটি যজ্ঞ আরম্ভ করেন। সেই যজ্ঞে তিনি মিত্রাবরুণ দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দিতেই যজ্ঞবেদি থেকে দিব্যাম্বরধরা দিব্যাভরণভূষিতা’ ইড়াদেবীর সৃষ্টি হল। মনু সেই রমণীকে ইলা বলে সম্বোধন করলেন। ইড়া’ নামে বৈদিক-ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে একটি শব্দ পাওয়া যাবে। সেই শব্দের সঙ্গে এই ইড়ার কোনও সম্বন্ধ আছে কিনা সে আলোচনায় যাওয়ার কোনও কারণই নেই এই মুহূর্তে। আমার যেটুকু বলার তা হল–মনু ইলা নামে একটি কন্যাই লাভ করেছিলেন, পুত্র নয়।
জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলা মনুকে বললেন–আমি মিত্রাবরুণের অংশে জন্মেছি, অতএব তার কাছেই আমায় যেতে হবে। অর্থাৎ ইলা নিজেকে মোটেই মনুর কন্যা ভাবছেন না, মিত্রাবরুণের কন্যা হিসাবেই তিনি পরিচিত হতে চান। স্বয়ং মিত্রাবরুণও ইলাকে বলেছেন তুমি আমাদের কন্যা–আবায়োস্ত্বং মহাভাগে খ্যাতিং কন্যা গমিষ্যসি। বায়ু পুরাণ আরও বলেছে–ইলা যখন মিত্রাবরুণের আশীর্বাদ নিয়ে মনুর কাছে ফিরে আসছেন, সেই প্রত্যাবর্তন-কালীন সময়ে মাঝপথে চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে তার মিলন হয়–বুধেনান্তরমাসাদ্য মৈথুনায়োপমন্দ্রিতা।
কথাটা বিশ্বাস করতে অসুবিধা নেই কোনও। মিত্রাবরুণ এক যুগল বৈদিক দেবতা। আমি পূর্বেই জানিয়েছি দেবতাদের আকৃতি-প্রকৃতি মানুষের মতোই। যে কোনও কারণেই হোক দেব-পিতার গৃহ থেকে তিনি মনু-পিতার গৃহে ফিরছিলেন। পথে নির্জন অরণ্যভূমিতে– পুরাণারেরা অবৈধ কলঙ্ক এড়ানোর জন্য যে বনকে মহাদেবের বিহারভূমিরূপে কীর্তন করেছেন, সেই বনস্থলীর মধ্যেই বুধের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং কোনও ওজর ছাড়াই সাধারণভাবেই সে মিলন সম্পূর্ণ হয় এবং জন্ম হয় পুরুরবার। বায়ু পুরাণ বলেছে-পুরুরবার জন্ম দিয়েই ইলা পুনরায় সুদ্যুম্নের কাছে ফিরে আসেন-বুধাৎ সা জনয়িত্ব তু সুদ্যুম্নং পুনরাগতা। সংস্কৃতে যাদের সাধারণ জ্ঞান আছে তারা উপরিউক্ত সংস্কৃত পংক্তিটির অর্থ করবেন আমাদের মতো–অর্থাৎ ইলা সুদ্যুম্নের কাছে ফিরে আসেন-সুদ্যুম্নং পুনরাগতা।
বায়ু পুরাণ সত্য কথাটা একবার মাত্র বলে ফেলেছে। কিন্তু মজা হল, ইলাকে নিয়ে যে কল্পকাহিনী পূর্বেই তৈরি হয়ে গেছে, তা বায়ু পুরাণের কথকঠাকুরদের পক্ষে এড়ানো অসম্ভব ছিল। তাই বায়ু পুরাণ পূর্বে বলে নিয়েছে–ইলাই পরে মনুর পুত্র সুদ্যুম্ন নামে বিখ্যাত হন। অর্থাৎ সেই বাধা গত–ইলা মেয়েও ছিলেন আবার ছেলেও ছিলেন। কিন্তু শুধু বায়ু পুরাণ কেন, অধিকাংশ পুরাণই একই কথা বলেছে। এর মধ্যে শুধু দেবীভাগবত পুরাণ মনু বংশের সব কথা বাদ দিয়ে চন্দ্র-তারা বৃহস্পতির উপাখ্যানের পরম্পরায় পরের অধ্যায় আরম্ভ করেছে এইভাবে–সুদ্যুম্ন নামে এক অতীব যশস্বী রাজা ছিলেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে মৃগয়া করতে করতে সেই মহাদেবের বিহারভূমিতে ঢুকলেন আর স্ত্রীতে পরিণত হলেন। বস্তুত, সুদ্যুম্ন বলে সম্পূর্ণ পৃথক একটি পুরুষ মানুষের কথা অন্য কোনও পুরাণ বলেনি। দেবীভাগবতের প্রমাণে আমরা সুদ্যুম্ন নামে একটি পৃথক পুরুষকেই শুধু চিহ্নিত করতে চেয়েছি।
ইলা অথবা সুদ্যুম্ন–কে আগে মেয়ে ছিলেন, কে পুরুষ ছিলেন, এই তর্কে আমরা যাচ্ছি না। পৌরাণিকদের এই কল্পনা আমার কাছে তত আদরণীয়ও নয়। বরং আমি যেটা বিশ্বাস করি, তারই পরম্পরা ধরে বলি-হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণের মতো নামী পুরাণগুলি থেকে জানা যায়–প্রথমজন্মা মনুর নয় মহান পুত্রের কেউই যখন জন্মাননি, তখনই মিত্রাবরুণের যজ্ঞ থেকে ইলা জন্মেছিলেন–অনুৎপন্নেষু নবসু পুত্রেম্বেতেষু ভারত। অর্থাৎ মনু যতই পুত্র কামনা করে যজ্ঞ করে থাকুন, তার প্রথম সন্তানটি কিন্তু পুত্র নয়, কন্যাই। তবে কন্যা হলেও তার মূল্য কম ছিল না। হয়তো সুদ্যুম্ন নামে কোনও রাজার সঙ্গে তার প্রথম বিবাহ বা মিলন কিছু হয়েছিল। কিন্তু চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কোনও ভাবে তিনি সুদমকে ভুলেই ছিলেন। কেননা চন্দ্রপুত্র বুধের আকর্ষণ তার কাছে এতই বেশি ছিল যে, সুমকে ভোলা তার পক্ষে অসম্ভব হয়নি। কিন্তু সেই মিলন সম্পূর্ণ হওয়ার পর যখন বুধের ঔরসে পুরূরবার জন্ম। হল, তারপরেই হয়তো পুর্বতন স্বামীর সম্বন্ধটুকু তার মনে পড়েছে এবং তিনি ফিরেও এসেছেন সুদ্যুম্নের কাছে। এই প্রত্যাবর্তনের কথা যে যে পুরাণে আছে, সেই সেই পুরাণে এটা যে ভাবেই থাকুক, আমাকে বিশ্বাস করতে হবে সেই বায়ু পুরাণের কথা-সুদ্যুম্নং পুনরাগতা–অর্থাৎ তিনি আবার সুদৃশ্নের কাছে ফিরে এলেন।
০২০. একমাস পুরুষ আর একমাস স্ত্রী
২০.
পৌরাণিকেরা বলেছেন–একমাস পুরুষ আর একমাস স্ত্রী হয়ে থাকার ফলে সুদ্যুম্নের পক্ষে বেশিদিন রাজত্ব করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ এই নয় যে, তিনি রাজা হিসাবে অকৃতকার্য ছিলেন। আসলে পুংত্ত্ব এবং স্ত্রীত্বের বিপরিবর্তনে যেভাবে রাজ্য শাসন চলছিল তাতে প্রজারা সুদ্যুম্নের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিল না এবং তারা তাকে তেমন করে আর অভিনন্দনও করত না–প্রজাস্তস্মিন্ সমুদ্বিগ্না নাভ্যনন্দ মহীপতিম্।
আমি পূর্বে বলেছি–ইলা ছিলেন মনুর প্রথম কন্যা সন্তান। মনুপুত্রদের পরিচয় দেবার সময় মহাভারতও তাকে কন্যা বলেই স্ত্রীলিঙ্গ শব্দে এবং বিশেষণে চিহ্নিত করেছে–তথা চৈবাষ্টমীম্ ইলা। অর্থাৎ মহাভারতের মতে ইলা মনুর অষ্টম সন্তান এবং তিনি কন্যা। আগেই বলেছি, সম্ভবত সুদ্যুম্ন নামে এক রাজার সঙ্গে তার প্রথম মিলন সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে সানন্দ মিলনে পুরূরবার জন্ম দেওয়ার পর আবারও যখন তিনি সুদ্যুম্নের কাছে ফিরে এলেন–সুদ্যুম্নং পুনরাগতা–তখন হয়তো রাজার বিষয়ে প্রজাদের অসন্তোষ ঘটে থাকবে। হয়তো সেই কারণেই প্রজারা রাজাকে আর অভিনন্দন করত না। সুদ্যুম্ন কিন্তু বুধের পুত্র পুরূরবাকে পুত্রের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং তাকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল, প্রজাদের অসন্তোষ ঘটলে সুদ্যুম্ন কিন্তু নিজ-ভুক্ত রাজ্যখানিও পুত্র পুরূরবাকে দিয়ে যেতে পারেননি। চন্দ্রবংশাবতংশ বুধের পুত্র পুরূরবাকে তিনি নিজের ঘরে রেখে যতই যত্ন-আত্তি করুন, সুদ্যুম্ন ওরফে ইল রাজা কিন্তু তাকে নিজের রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারলেন না। কারণ হয়তো সেই প্রজাদের অসন্তোষ। প্রাচীন পুরাণ বলেছে–পুরুষাবস্থায় ইল রাজা (অর্থাৎ সুদ্যুম্ন) পুরূরবাকে প্রতিষ্ঠান নামে এক নতুন রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন–প্রতিষ্টানে ভিষিচ্যাথ স পুরূরবসং সুতম।
আমরা এতক্ষণ ধরে ইল রাজা বা ইলার কাহিনী শোনালাম শুধু এই তথ্যটুকুর জন্য। কারণ এই প্রতিষ্ঠানেই কুরু-পাণ্ডব বংশের পূর্ববর্তী রাজারা সকলেই রাজত্ব করতেন। নতুন নগরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলেই হয়তো এই নগরের নাম প্রতিষ্ঠান এবং এই সুযোগে জানানো দরকার যে এই প্রতিষ্ঠান হল এখনকার ইলাহাবাদের নিকটবর্তী একটি জনস্থান। পৌরাণিকেরা বলেছেন–পুরূরবাকে প্রতিষ্ঠান রাজ্যে বসিয়ে দিয়ে সুন্ন রাজা ইলাবৃতবর্ষে চলে গেলেন– জগামেলাবৃতং ভোক্তৃং বর্ষং দিব্যলাশন। কী রকম ইলাবৃতবর্ষ? না, যেখানে দেবতাদের উপযুক্ত ভোগ লাভ করা যায়।
আমি পূর্বে বলেছি-ইলাবৃতবর্ষই মোটামুটি স্বর্গরাজ্যের ঠিকানা এবং আরও বলেছি ভারতবর্ষে মনুই হলেন দেবতাদের প্রথম প্রতিভূ। হরিবংশে দেখবেন–মনু লোকান্তরিত হয়ে সুর্যলোক প্রাপ্ত হবার পর তার দশ পুত্র পৃথিবী ভাগ করে নিলেন–দশ তদ্দৎ ক্ষত্রমকরোৎ পৃথিবীমিমা। অথচ প্রথমে মনুপুত্রদের কথা বলতে গিয়ে পৌরাণিক কিন্তু মনুর নটি পুত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। তাহলে দশম পুত্রটি কে? আমরা বলব–তিনি ইলা এবং তিনি পুত্র নন। কন্যা। অপিচ তিনিই মনুর প্রথম সন্তান।
মহাভারতে যেখানে প্রথমবার কৌরব-পাণ্ডবদের বংশ-পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, সেখানে পিতার নাম না করে পরিষ্কার বলা হয়েছে পুরূরবা জন্মগ্রহণ করেন ইলার গর্ভে–পুরূরবাস্ততে বিদ্বান্ ইলায়াং সম্পদ্যত। এই কিছুদিন আগেও একটি বিবাহিতা রমণীর জীবনে একাধিক পুরুষের আনাগোনা ঘটলে তিনি আর স্বামীদের পদবি ব্যবহার না করে দেবী’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। একইভাবে ইলার জীবনেও সম্ভবত দুটি পুরুষের রতি-আসক্তি থাকায় পুরূরবা আর পিতার নামে বিখ্যাত হননি। মায়ের নামে তিনি ‘ঐল পুরূরবা’, ঠিক যেমন বৈদিক যুগে মামতেয় দীর্ঘতমা, জাবাল সত্যকাম। গর্ভধারণ এবং পালন একসঙ্গে চালিয়ে ইলাই তার মা এবং বাবা দুইই, মহাভারতের ভাষায়–সা বৈ তস্যাভবম্মাতা পিতা চৈববতি নঃ শ্রুত।
মহাভারত ইলাকে একসঙ্গে পুরূরবার বাবা এবং মা বলায় পর্তীকালে পৌরাণিকদের মহাদেবের অভিশাপ নামিয়ে এনে তাকে একবার পুরুষ একবার স্ত্রীতে রূপান্তরিত করতে হয়েছে। পুত্রের জন্ম দিয়েই বুধ যে-স্বর্গেই চলে যান না কেন, ইলার অন্যতর স্বামী বুধের ঔরসজাত পুত্রের রাজ্যের ব্যবস্থা করে দিয়ে হয়তো ইলাকে নিয়েই চলে গিয়েছিলেন সেই পরম রম্য স্থানে, যার নাম ইলার নামসাজাত্যে ইলাবৃতবর্ষ।
মৎস্য পুরাণ বলেছে–সূর্য বংশ এবং চন্দ্রবংশের আদিতে মনুর প্রথম পুত্র ইলই ছিলেন প্রথম রাজা-সোমার্কংশয়োরাদাবিলো’ভূ-মনুনন্দনঃ। আমার মতে ইল নয়, মনুর প্রথম কন্যা সন্তান ইলাই ছিলেন নামত রাজা এবং কার্যত তার প্রথম স্বামী সুদ্যুম্ন এই রাজ্য চালাতেন। তারপর এর মধ্যে ইলার গর্ভজাত পুত্রের পিতৃত্ব চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে প্রজাদের অসন্তোষে সুদ্যুম্ন রাজ্যচ্যুত হন এবং মূল সূর্যবংশ বা মনুবংশের পরম্পরা চলতে থাকে মনুর প্রথম পুত্র সন্তান ইক্ষাকুর নামে। আর বুধপুত্র ঐল পুরূরবা ঠাকুরদাদা চন্দ্রের নাম নিয়ে রাজ্য আরম্ভ করলেন প্রতিষ্ঠানপুরে ইলাহাবাদের কাছে। হরিবংশ মন্তব্য করেছে–মনুর বংশ পরম্পরায় ইকু যেমন সুন্দর একটি রাজ্য পেলেন শাসন করার জন্য, সুদ্যুম্ন তা পেলেন না-সুদ্যুম্নে নৈনং গুণমবাপ্তবান্। আমাদের কল্পনায়–চন্দ্রবংশের সূত্রপাতেই এই যে প্রাপ্য রাজ্য না পাওয়ার ঘটনাটুকু ঘটে গেল, এই না পাওয়ার রাজনীতি নিয়তির মতো স্পর্শ করে রইল সেই পাণ্ডব-বংশ পর্যন্ত। কারণ ঐল পুরূরবার রাজধানী প্রতিষ্ঠানপুরই পরে হস্তিনাপুরে পরিণত হয়েছে এবং পাণ্ডবরা সেই রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। পরের কথা পরে আসবে, আমরা চন্দ্রবংশের পরম্পরায় এবার পুরূরবার কথা বলি।
শুধু পুরূরবা নয়, ঐল পুরূরবা, ইলার ছেলে পুরূরবা। চন্দ্রের নাতি পুরূরবা। বৈবস্বত মনুর সঙ্গে তার বংশ-পরম্পরা সংসৃষ্ট হলেও মূল পরম্পরা নেমে এল চন্দ্র থেকে। চন্দ্র, বুধ, পুরূরবা। এই প্রথম একটা নাম পেলাম যার মধ্যে তথাকথিত দেবতার তেজটুকু পেলাম, বুধ-নক্ষত্রের আলোটুকু পেলাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ মানুষও পেলাম–ঐল পুরূরবা, স্ত্রী-পুরুষের একাকার মানস থেকে জাত ইলার ছেলে পুরূরবা।
লক্ষণীয় বিষয় হল–এই একটি রাজনাম, যার মধ্যে বৈদিক যুগের শেষ স্বাক্ষরটুকু রয়েছে, আর মহাভারত পুরাণের আরম্ভও তাকে দিয়েই। তখনও স্বর্গবাসী দেবগণের সঙ্গে মনুষ্যলোকের গভীর যাতায়াত ছিল। বেদে আছে পুরূরবা যখন জন্মেছিলেন তখন নাকি স্বর্গমোহিনী অপ্সরারা তাকে দেখতে এসেছিলেন, তাঁর জন্মোৎসবে নৃত্য করেছিলেন সমস্মিন্ জায়মান আসত গা উতেমবর্ধদ্যঃ স্বতঃ। কে জানত এক মোহিনী অপ্সরার সঙ্গেই তার সমস্ত জীবন বাধা হয়ে যাবে! ঘটনাটা আনুপূর্বিক জানাই।
পৌরাণিকেরা জানিয়েছেন–পুরূরবা জন্ম লাভ করার পর তার জন্মদাতা পিতা বুধ তাকে মায়ের কাছে রেখে স্বর্গের পথে ফিরে গিয়েছিলেন। ঠিক যে জায়গাটায় পুরূরবা জন্মেছিলেন সে জায়গাটা অবশ্যই অরণ্যসঙ্কুল পার্বত্য অঞ্চল। তীর্থযাত্রাধ্যায়ে মহাভারতের কথা যদি ঠিক হয়, তবে বলতে হবে পুরূরবার সেই জন্মস্থান পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছিল পুরু-পর্বত নামে-পর্বতশ্চ পুরুর্নাম যত্ৰ জাতঃ পুরুরবাঃ। পিতৃবিরহিত পুরূরবাকে নিয়ে তাঁর মা ইলা মোটেই ভেঙে পড়েননি কারণ মানুষ নামে খ্যাত প্রথম পুরুষ মনুর তিনি বংশধর। তার আকৃতি প্রকৃতি সাহস একটু আলাদা। পিতার কাছে তিনি রাজ্যের অধিকার চাননি। সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিত্বে এবং চেষ্টায়–সে চেষ্টার মধ্যে সুন্ন নামে কোনও অভিমত বশংবদ পুরুষের স্বেচ্ছাবদান থাকুক আর নাই থাকুক–তিনি পুত্র পুরূরবাকে প্রতিষ্ঠান রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এইজন্যই তিনি মহাভারতের শ্লোকে পুরূরবার মাতাও বটে পিতাও বটে। টীকাকারেরা প্রাচীন শ্লোক উদ্ধার করে বলেছেন–এ ব্যাপারে মা হয়েও তিনি পুরুষের স্বভাবে পুত্রকে রাজ্যদান করেছিলেন, সেই কারণেই তিনি একই দেহে পুরূরবার মাতা এবং পিতা দুইই–মাতৈব লব্ধপুংভাবা রাজ্যদানাৎ পিতাপ্যভূৎ মুখ্যঃ পিতা তু বুধ এব। সেই কারণে পুরূরবাও ঐল পুরূরবা।
মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি–প্রতিষ্ঠানে রাজধানী স্থাপন করে যে ক্ষুদ্র রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা হল, পুরূরবার রাজত্বকালে সেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। পুরূরবা শুধু নবীন প্রতিষ্ঠানপুরের রাজা রইলেন না। এই ভারতবর্ষ যে বিশাল ভূখণ্ডের অন্তর্গত সেই জম্বুদ্বীপের অন্তত তেরোখানি উপদ্বীপের ওপর পুরূরবার অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল-ত্রয়োদশ সমুদ্রস্য দ্বীপান পুরূরবাঃ। এ কথার মধ্যে অতিশয়োক্তি একটু-আধটু থাকতেই পারে। প্রাচীনকালের স্বর্ণপ্রস্থ কি চন্দ্ৰশুকের মতো উপদ্বীপ পুরূরবার অধিকারে নাই থাকুক, কিন্তু এই তেরো দ্বীপের ভুক্তি দেখিয়ে একথা অবশ্যই প্রমাণ করা গেল যে, পুরূরবার ক্ষমতা এবং মর্যাদা ছড়িয়ে গিয়েছিল তার রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানপুরের আদলে দক্ষিণ-ভারতেও অন্য একটি রাজধানী তৈরি হয়েছিল। মহামান্য সাতবাহন বংশের গৌতমীপুত্র সাতকণী এবং অন্যান্য রাজারা এইখানেই রাজত্ব করতেন।
দক্ষিণ ভারতের প্রতিষ্ঠান-পুরী যে উত্তর-ভারতের আদলে অথবা নাম-সাম্যেই তৈরি হয়েছিল, তার একটা বড় প্রমাণ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পতনের পরেই দাক্ষিণাত্যে যে সমস্ত রাজবংশ মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাদের অন্তত একটি ধারা দাক্ষিণাত্যের প্রতিষ্ঠান-পুরীকে মহিমান্বিত করে তোলে। গৌতমীপুত্র সাতকণীর ইতিহাস আরম্ভ হয়েছে আরও অনেক পরে। পুরাণমতে দাক্ষিণাত্যের প্রতিষ্ঠানে সাতবাহন বংশের প্রথম রাজা ছিলেন গৌতমীপুত্র পুলোমা, যাকে স্ট্রাবো বলেছেন ‘P(1)olemaios of Baithan’ অর্থাৎ স্ক্রাবোর বৈঠান’ অথবা দেশীয় উচ্চারণে যেটা পৈঠান, সেটাই সংস্কৃত পুরাণ-মহাভারতের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু উত্তরভারতে পুরূরবার রাজধানী প্রতিষ্ঠান, যেটাকে আমরা, আধুনিক ইলাহাবাদের কাছে স্থান দিয়েছি, আধুনিক অপভ্রংশে সেই প্রতিষ্ঠান একখানি গ্রাম নামের মধ্যে টিকে আছে। তার নাম পিহান। জয়চন্দ্র বিদ্যালংকার অনেক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি ধরার চেষ্টা করেছেন পিহান’ নামটির মধ্যে। অন্যদিকে কিছু পণ্ডিত মোটামুটিভাবে গঙ্গার তীরে প্রয়াগের কাছে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছেন, স্পষ্ট করে পিহান’ নামটি আর তারা উল্লেখ করেননি।
পুরূরবার প্রতিষ্ঠান পিহানই হোক অথবা অন্য কিছু, অন্তত এই প্রসঙ্গে আমরা ধরে নিতে পারি যে, আর্যরা ততদিনে কাশ্মীর-পাঞ্জাবের বাসভূমি ত্যাগ করে উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং রাজত্বের জন্য নতুন একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত পূর্বতন দেবভূমির সঙ্গে পুরূরবার যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি। বরং বলা যায় দেবতা অথবা দেবকল্প ব্যক্তিরাই তখনও পুরূরবার সঙ্গী। মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি–পুরূরবা মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সদা-সর্বদা দেবতা বা দেব-সদৃশ ব্যক্তিদের দ্বারাই পরিবৃত থাকতেন–অমানুষৈবৃতঃ সর্মৈানুষঃ সন্ মহাযশাঃ। পরিষ্কার বোঝা যায়, আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যারা নতুন নগরীর প্রতিষ্ঠায় পুরূরবার সঙ্গী হয়েছিলেন তারা কেউই তখনও চলে যাননি।
প্রতিষ্ঠান নগরীর রাজা হয়ে, জম্বুদ্বীপের অর্ন্তগত অন্তত তেরোটি বিশাল ভূখণ্ডের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে পুরূরবার মান মর্যাদা যেমন বেড়ে গেল, তেমনই তার মত্ততাও কিছু বেড়ে গেল। ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা অতিরিক্ত হয়ে গেলে অতি বিচক্ষণ এবং ধীমান ব্যক্তিরও স্বলন ঘটে, পুরূরবার মধ্যেও সেই স্বলন দেখা দিল। যে সমস্ত দেবপ্রতিম ব্যক্তি পুরূরবার সঙ্গে ছিলেন, তারাও এই স্বলন রোধ করেননি অথবা তারা স্বার্থবশে পুরূরবার পতনের সঙ্গী হয়েছিলেন।
আমাকে দু-এক জনে বলেছেন–মহাভারতের মধ্যে পাণ্ডবদের প্রতি মহাভারতের বক্তার যেন পক্ষপাত আছে। পাণ্ডবদের সবই ভাল আর কৌরবদের সব খারাপ, এমন একটা ভাব যেন লক্ষ্য করা যায়। কথাটা আরও গাল-ভরা করে একই নোক বলেছিলেন–মহাভারতের কবি, বক্তা–এঁরা তো সব রয়্যাল প্যাট্রোনেজে দিন কাটাতেন, তাই চলমান রাজবংশের সুখ্যাতি তাদের করতেই হত। আমি বলি–এ সব ধারণা খানিকটা মহাভারত না পড়ার ফল, আর খানিকটা মহাভারতের গৌণ-গ্রন্থ পড়ার ফল। কতগুলি সাহেব এবং বাঙালি সাহেব আছেন, তারা আবার নানা রকম ইজ’ মিশ্রিত মহাভারতের ওপর লেখা গৌণ গবেষণাগ্রন্থ পাঠ করে নানা সিদ্ধান্ত দেন।
দিতেই পারেন। মহাভারত এতই বড় ব্যাপার যে সেটিকে নানা দিক থেকে বিচার করা যেতেই পারে এবং নানা মতামতও দেওয়া যেতে পারে। আমার কাছে সে সকলই শিরোধার্য। কিন্তু দুঃখ পাই, যা নয় তাই বললে। রাজা-রাজড়ার আনুগত্যে সৃত-মাগধদের পক্ষপাত নিশ্চয়ই ধরা পড়ত কিন্তু তাই বলে তারা ইতিহাস এড়িয়ে যেতেন না। পূর্বতন বংশধারায় কলঙ্ক থাকলে, হিংসা-অসুয়া থাকলে, তাও তারা লুকোতেন না। কোনও না কোনও জায়গায় ঠিক তাঁরা বলে দিতেন। এই কথাটা পাণ্ডবদের মূল পুরুষ পুরূরবা সম্বন্ধেও খাটে বলে এখনই কথাটা তুললাম এবং পরেও এসব কথা আসবে।
বেদের মধ্যে পুরূরবার কীর্তি কাহিনী কিছু আছে। ঋগবেদের মূল পর্বের নিরিখে পুরূরবার প্রসঙ্গ যতই অর্বাচীন হোক–কিছু পণ্ডিত ঋগবেদে পুরূরবার কথাবস্তুকে অর্বাচীনই বলে থাকেন–তবু মনে রাখতে হবে সেই বিখ্যাত উক্তিটি-ইতিহাস-পুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ–অর্থাৎ মহাভারত-পুরাণগুলি দিয়েই বেদের কথা পরিপূরণ করতে হবে, সাবানসিয়েট’ করতে হবে। আর এখানে সেই ‘সাবটানসিয়েশন’ খুব ভালভাবেই করা যায়।
দেখবেন–প্রায় প্রত্যেক পুরাণেই মর্ত্যভূমির রাজা পুরূরবার সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর মিলন-বিরহের কথা সবিস্তারে বলা আছে। কিছু আছে মহাভারতেও। ইতিহাস পুরাণের এই সবিস্তার কাহিনীর মূল উৎস কিন্তু বেদ। বেদের মধ্যে পুরূরবা-উর্বশীর কাহিনীটি আছে কথোপকথনের আকারে, যাকে পরিভাষায় বলে সংবাদ-সূক্ত। দেবতা, যজ্ঞ, আহুতি আর প্রার্থনাই যেখানে বৈদিক সূক্তগুলির প্রধান অভিজ্ঞান–সেখানে উর্বশী-পুরূরবার এই কথোপকথনের অংশটুকু এতই মধুর এবং নাটকীয় যে, পণ্ডিতজনেরা অনেকেই এই সংবাদ-সূক্তটিকে পরবর্তী সংস্কৃত নাটকের বীজ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উর্বশী-পুরূরবার মিলন-বিরহের কথায় আমি পরে আসছি। আমার বক্তব্য আপাতত অন্য কিছু। বেদে উর্বশী-পুরূরবার কথোপকথন অংশের শেষে দেখা যাবে–উর্বশী পুরূরবাকে বলছেন–এই দেবতারা বলছেন পুরূরবা তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী হবে, তোমার পুত্রেরা সকলেই হোমদ্রব্য দিয়ে দেবতাদের আহুতি রচনা করবে, তুমি স্বর্গে আমোদিত হবে-প্রজা তে দেবান্ হবিষ যজাতি স্বর্গ উ ত্বমপি মায়াসে।
বস্তুত সারা সংবাদ-সূক্তটিতে যাগ-যজ্ঞ দেবতাদের কথা কিছু নেই। একেবারে শেষ পংক্তিতে উর্বশীর এই হোম-যজ্ঞের উপদেশ পৌরাণিকদের ভাবিত করেছে। তারা পুরূরবা উর্বশী আখ্যানের শেষ পর্বে দেখিয়েছেন কীভাবে পুরূরবা বৈদিক অগ্নিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসছেন এবং কীভাবে শেষ পর্যন্ত অগ্নিসমিন্ধন করে পুরূরবা আপন অভিলাষ পূরণ করছেন।
আমি আসলে শেষ কথাটা আগে বলে ফেলেছি-পুরূরবা বৈদিক অগ্নিকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। মহাভারতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়ে যা মনে হয়, তা হল–প্রতিষ্ঠানপুরের রাজা হবার পর তার মর্যাদা যখন খুব বেড়ে গেল, তখন তার মধ্যে ঐশ্বর্যের মত্ততাও কিছু জন্ম নিল। মহাভারত বলেছে–রাজা হবার পর পুরূরবা ঐশ্বর্য এবং শক্তিতে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। এর প্রথম ফল হল–তিনি রাজ্যের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিবাদ-বিসম্বাদ আরম্ভ করলেন- বিঃৈ স বিগ্রহং চক্রে বীর্যোন্মত্তঃ পুরূরবাঃ। যজন-যাজন-অধ্যাপনে যতটুকু সম্পত্তি ব্রাহ্মণদের লাভ হত, পুরূরবা তা সবই জোর করে নিয়ে নিতেন। ব্রাহ্মণরা কান্নাকাটি কম করতেন না। তাদের সমস্ত অনুরোধ-উপরোধ ঠেলে ফেলে দিয়ে পুরূরবা তাদের ধন-রত্ন কেড়ে নিতেন-জহার চ স বিপ্রাণাং রত্নাব্যুৎক্রোশমপি।
ঠিক এই জায়গাটায় আমাদের টিপ্পনি দিতে হবে সামান্য।
মনে রাখতে হবে–পুরূরবা পিতৃপরম্পরায় কোনও বাধা রাজ্য পাননি। প্রধানত তার। মায়ের চেষ্টা অথবা তার পালক পিতার চেষ্টায় তিনি প্রতিষ্ঠানপুরে রাজ্য লাভ করেছিলেন। সে যুগে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের যে বিভাগ ছিল, তা শুধুই বর্ণের তর-তম। ব্রাহ্মণরা সাধারণ যাগ-যজ্ঞ নিয়ে থাকলেও রাজদরবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল নিবিড়। বিশেষত ক্ষত্রিয় রাজার পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে, তাদের যাগ-যজ্ঞের কাজও খানিকটা ব্যাহত হত। আবার পদে পদে ব্রাহ্মণের অনুজ্ঞা না পেলে বা না মানলে ক্ষত্রিয় রাজাদেরও অসুবিধে হত।
আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যখনই কোনও ক্ষত্রিয় রাজা অন্যত্র রাজ্য জয় করে তার অধিকার কায়েম করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণরাও তাদের সঙ্গে আসতেন। বঙ্গদেশেও ব্রাহ্মণ্য অধিকার এইভাবে ঘটেছে, দাক্ষিণাত্যেও তাই ঘটেছে। ধরে নিতে পারি কাশ্মীর-পাঞ্জাব থেকে উত্তরপ্রদেশে আসার সময় গঙ্গার স্রোতধৌত ভূমিখণ্ডেও ব্রাহ্মণ অধিকার একইভাবে জন্মেছে। ইতিহাস-পুরাণে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখা যাবে প্রায়ই এই দুই উচ্চ বর্ণের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ক্কচিৎ কখনও যে গণ্ডগোল ঘটেছে–যেমন পরশুরাম, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের সময় (এবং এছাড়াও আরও কিছু উদাহরণ আছে), সেই ক্রাইসিস পিরিয়ড’গুলি ছাড়া ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা চিরকালই এক সুসংহত শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। যারা নিম্নবর্ণের ওপর উচ্চবর্ণের অত্যাচারের ইতিহাস রচনা করেছেন, তারাও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এই মিলিত শক্তিকেই অত্যাচারের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু মুশকিল হল, আর্যায়ণের প্রথম কল্পে এই সংহতি অত সম্পূর্ণ ছিল না। স্মরণ করা যেতে পারে বেণ রাজার কথা। প্রায় প্রত্যেক পুরাণে এবং অবশ্যই মহাভারতেও বেণের উপাখ্যান পাওয়া যাবে পৃথু রাজার প্রসঙ্গে। পৌরাণিক শ্রুতি অনুসারে পৃথু হলেন এই পৃথিবীর প্রথম রাজা। মহারাজ পৃথুর নাম থেকেই আমাদের এই বাসভূমির নাম পৃথ্বী অথবা সংযুক্ত বর্ণ ভেঙে পৃথিবী। পৃথিবীতে প্রথম আইনের শাসন নিয়ে আসা অথবা পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার মর্যাদা দেওয়া হয় পৃথুকেই। কিন্তু যে পুরুষটি থেকে পৃথুর জন্ম হয়, সেই বেণই কিন্তু ছিলেন প্রথম রাজা। মহাভারতে যেখানে পুরূরবার কথা আছে, তার কিছু আগেই বেণের কথা আছে।
মহাভারত এবং পুরাণগুলিতে দেখা যাবে-বেণ রাজা হবার পরেই দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের অস্বীকার করে বসেন। ঐশ্বর্যে মদমত্ত হয়ে তিনি প্রচার করতে থাকেন–দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের মান্য করার কিছু নেই, পুজো যদি করতেই হয় তো আমাকে করো। আমি রাজা, আমিই এই সংসারে একমাত্র পূজনীয় ব্যক্তি–অহমিজ্যশ্চ পূজশ্চ। বেণ অত্যন্ত অত্যাচারী হয়ে পড়লেন, কাউকেই তিনি আর মানেন না। এই অবস্থায় ব্রাহ্মণ-ঋষিরা সংঘবদ্ধ হলেন এবং মন্ত্রপূত কুশের আঘাতে তাকে মেরে ফেলেন। অত্যাচারী বেণের মৃত্যুর পর সমবেত ঋষি-ব্রাহ্মণ মৃত বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করতে আরম্ভ করলেন-মমন্থ দক্ষিণং চোরু ঋষয়ে ব্রহ্মবাদিনঃ 1 সেই উরু-মন্থনের ফলে জন্ম নিল নিষাদেরা–দেখতে তারা হ্রস্বকায়, রক্তচক্ষু, কৃষ্ণকেশ। নিষাদেরা জন্মানো-মাত্রই ঋষিরা তাদের বললেন–ব্যাটারা বসে থাক চুপ করে–যার সংস্কৃত শব্দ হল ‘নিষীদ’। এই নিষীদ’ থেকেই নিষাদ শব্দ। নিষাদ- যাদের আমরা পরবর্তীকালে ম্লেচ্ছ বলে ডেকেছি, ব্যাধ বলে ডেকেছি অথবা অনার্য-অধম ক্রুর এক জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছি, সেই নিষাদেরা অতঃপর বিন্ধ্যপর্বতের প্রত্যন্তভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নিল–যে চান্যে বিন্ধ্যনিলয়া ম্লেচ্ছাঃ শতসহস্রশঃ।
নৃতত্ত্বের নিরিখে এই নিষাদ-মেচ্ছদের কথা আমরা পরে ভাবব, আপাতত জানাই–ঋষিরা এরপর বেশের দক্ষিণ বাহু মম্বন করা আরম্ভ করলেন এবং সেই মন্থনের ফলে জন্মালেন মহারাজ পৃথু-ইন্দ্রের মতো তাকে দেখতে, ইন্দ্রের মতোই তার প্রভাব প্রতিপত্তি। পৃথিবীর সেই প্রথম রাজা জন্মগ্রহণ করেই বুঝলেন তার মধ্যে রাজধর্মের শুদ্ধবুদ্ধিটুকু আছে। দেবতারা এবং ঋষিরা সমস্বরে তাকে বললেন–রাজা! তুমি তোমার নিজের পছন্দ-অপছন্দ বাদ দিয়ে সমস্ত মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টি দাও–প্রিয়াপ্রিয়ে পরিত্যজ্য সমঃ সর্বেষু জন্তুষু।
উপদেশ আরও অনেক আছে; পৃথু মহারাজ সে সবই মেনে নিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তার প্রতিজ্ঞা হল-ব্রাহ্মণরা সকলেই আমার প্রথম মান্য পুরুষ, আমি তাদের বিরুদ্ধে যাব না–ব্রাহ্মণাঃ মে মহাভাগাঃ নমস্যাঃ পুরুষর্ষঃ। আমার কাছে এই প্রতিজ্ঞাটুকুই বড় কথা। মনে রাখতে হবে–আর্যায়ণের প্রথম কল্পে ব্রাহ্মণরাই ছিলেন সবচেয়ে শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষ। তারা সমাজের নীতি-নিয়ম যেমন তৈরি করতেন রাজনীতি, দণ্ডনীতিও তাদেরই তৈরি। বেণ সেই ব্রাহ্মণদের নীতি-নিয়ম অস্বীকার করে আপন বৃদ্ধিতে বলশালী হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু সংঘবদ্ধ ব্রাহ্মণ্য-শক্তির সঙ্গে তিনি এঁটে উঠতে পারেননি। তাকে মরতে হয়েছে।
বেণও কিন্তু নিজে রাজা হননি। সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের অনুমতি ক্রমেই তিনি রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু যাগ-যজ্ঞ, দেবতা এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কথায় কথায় ব্রাহ্মণদের অনুজ্ঞা-উপদেশ তিনি মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গীয় পণ্ডিত-জনের মতে বেণই প্রথম পুরুষ, যিনি এতকালের পরিচিত দেবতা-শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের অধিকার অস্বীকার করেন। আমার ধারণা–ওই নিষাদ-ম্লেচ্ছদের কথা বললাম– আর্যায়ণের প্রথম পর্যায়ে দেশজ ওই ব্যক্তিরাই ব্রাহ্মণ্য-শক্তির বিরুদ্ধে বেণের সহচারী ছিলেন। বেণের মৃত্যুতে এবং দেব-ঋষি-মনোনীত পৃথুর রাজত্বে তারা পিছু হঠে গিয়ে বিন্ধ্যপর্বতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আর্য-সভ্যতার বিকাশের প্রথম পর্বে দেশজ ব্যক্তিদের দক্ষিণে তাড়িত হওয়ার যে কল্পনা ঐতিহাসিকেরা সচরাচর করে থাকেন, তার ছায়া এই বেণের বাহু-মনের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় বলে আমাদের বিশ্বাস।
বেণের ঘটনার সঙ্গে আমি পুরূরবার জীবনের সাদৃশ্য দেখাতে চাইছি। পুরূরবার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে গঙ্গানদীর তীরে। আর্যায়ণের দ্বিতীয় পর্যায় সেটা। নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা মানেই রাজার সেখানে একক প্রতিষ্ঠা। এরই মধ্যে ঋষি-ব্রাহ্মণেরা এসে যখন এই করো, সেই করো’ অথবা এটা ঠিক নয়, এটা অনুচিত’ বলে উপদেশ দিতে আরম্ভ করলেন, তখন সেই নীতি-নিয়মের শৃঙ্খল, আর আচার-বিচারের বিধি-নিষেধ কোনও এক-নায়ক রাজার মনোমত হয়? অতএব রাজা পুরূরবার দিক থেকে আরম্ভ হল সেই অত্যাচার উৎপীড়ন, ব্রাহ্মণ্যের মূল-উৎপাটনের সেই প্রচেষ্টা, যা আমরা বেণের আমলে দেখেছি। ব্রাহ্মণদের সঞ্চিত ধন-রত্ন লুষ্ঠিত হল, তাদের নীতি-নিয়মের বাক্য স্তব্ধ হল।
পুরূরবার রাজ্যে ব্রাহ্মণ্যের এই অপমান-উৎপীড়নে ব্যথিত হয়ে ব্রহ্মার মানসপুত্র সনৎকুমার ব্রহ্মলোক থেকে এলেন পুরূরবাকে বোঝাতে–সনৎকুমারস্তং রাজন্ ব্রহ্মলোকা উপেত্য হ। শ্রুতি-স্মৃতির নানা সদাচার উপদেশ করে সনকুমার পুরূরবাকে অনেক কথা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তার সমস্ত অনুরোধ বৃথা হল। রাজা কানেই নিলেন না সে সব কথা–প্রত্যগৃহ্নান্ন চাপ্যসৌ। উৎপীড়ন, উৎপাটন, লুণ্ঠন আগের মতোই চলতে লাগল। ব্রাহ্মণ ঋষি-মুনিরা আবার সংঘবদ্ধ হলেন। ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ মহর্ষিদের অভিশাপে রাজার রাজত্ব গেল। হিংসা লোভ আর শক্তিমত্তার জ্বালায় রাজার চেতনা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মহর্ষিরা লোভী বলোম্মত্ত রাজাকে অভিশাপে বিনষ্ট করলেন–ততো মহর্ষিভিঃ কুদ্ধৈ সদ্যঃ শতপ্তা বিনশ্যত।
আশ্চর্য হল, এর পরেই মহাভারতের বর্ণনায় দেখছি রাজা পুরুরবা গন্ধর্বলোকবাসিনী উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন এবং ব্রাহ্মণ্য ক্রিয়াকলাপের জন্য তিনি পবিত্র অগ্নি বহন করে। নিয়ে এসেছেন নিজের বাড়িতে-আনিনায় ক্ৰিয়ার্থে মীন যধাবদবিহিতংস্ত্রি। এই অংশটাই বড় ভাবনার। তাহলে কি পুরূরবা মরেননি? ব্রাহ্মণরা কি অভিশাপ দিয়ে পুরূরবার জীবন। বিনষ্ট করতে পারেননি?
.
২১.
পুরূরবা মারা যাননি, ঠিক যেমন আমাদের ধারণা অত্যাচারী বেণও মারা যাননি। বেশের রাজত্ব এবং শাসন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেশের দক্ষিণ বাহু মন্থন করে পৃথুর জন্ম হল– আধুনিক দৃষ্টিতে এই ভাষ্যও তত আদরণীয় নয়। মন’ শব্দটার মধ্যে একটা অন্বেষণের ইঙ্গিত থাকে সব সময়। শাস্ত্র মম্বন করা অথবা মৌখিকভাবে আমরা যেমন বলি জায়গাটা মথে ফেলেছি’–অথবা সেই সমুদ্রমন্থন- সর্বত্রই এই মন্থন বা মথে ফেলার মধ্যে একটা অন্বেষণের ব্যাপার থাকে। বাহু’ জিনিসটা ক্ষাত্র-শক্তির প্রতীক। বেণকে সিংহাসনচ্যুত করে তারই দক্ষিণ বাহু মন করে যে পৃথু রাজাকে পাওয়া গেল, তা আসলে বেণেরই বংশধারায় কোনও বিশ্বস্ত ক্ষত্রিয়কে খুঁজে বার করার ব্যাপার। দক্ষিণ মানে অবশ্যই ফেভারেবল’। বেণের বংশধারায় ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতি অনুগত ব্যক্তিটিই হলেন পৃথু। পৃথুকে লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত ব্রাহ্মণরা তাকে বলেছেন- মনে-প্রাণে প্রতিজ্ঞা করো, পৃথু! প্রতিজ্ঞাধিরোহস্ব প্রতিজ্ঞা করো- ‘আমি এই ভূলোকবাসী ব্রাহ্মণদের সযত্নে পালন করব। তাদের আমি দণ্ড দেব না কোনওদিন–অদ্যা মে দ্বিজাশ্চেতি প্রতিজানীহি হে বিভো। পৃথু স্বীকার করে নিয়েছেন ব্রাহ্মণদের কথা–এবমস্তু।
কথা হল– বেণের মতো চন্দ্রবংশীয় পুরূরবারও একটা রূপক-মৃত্যু আছে। মনে রাখতে হবে, মহাভারতে গন্ধর্বলোক থেকে পুরূরবা যে উর্বশীকে নিয়ে এলেন, সে ঘটনাটা বর্ণিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের হাতে পুরূরবার ধ্বংসের পর।
পুরূরবার সিংহাসনে আরোহণ, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তার বিরোধ এবং তাঁর ধ্বংস নিয়ে যদি একটা ঘটনা-পরম্পরা সাজিয়ে তোলা যায়, তাহলে উর্বশীর সঙ্গে তার মিলন, বিরহ এবং পুনর্মিলনের ঘটনা-পরম্পরা সাজিয়ে পুরূরবা কাহিনীতে দ্বিতীয় একটি স্তরও তৈরি করে ফেলা যায়। যদিও এমনটি কখনও জোর করে বলা ঠিক হবে না যে, পুরূরবা জীবনের প্রথমাংশের মধ্যে উর্বশীর অস্তিত্ব নেই অথবা এমনও ঠিক নয় যে, পুরূরবা-উর্বশীর প্রেম-কাহিনীর মধ্যেও তার ব্রাহ্মণ্য-বিরোধের অংশটুকু নেই। মনুষ্য-জীবন বাঁধা গত্ মেনে চলে না, অতএব পুরূরবার জীবনেও ব্রাহ্মণ-বিরোধের অংশ শেষ হয়েছে, তারপর উর্বশীর কাহিনী আরম্ভ হয়েছে–এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই।
বায়ু-পুরাণে দেখতে পাচ্ছি–সমুদ্রমেখলা এই পৃথিবীর সমস্ত অধিকার ভোগ করেও পুরূরবার লোভ কিছু কমেনি। ধন-রত্নের তৃষ্ণাও কিছু কমেনি তার–তুতোষ নৈব রত্নানাং লোভাদিতি হি নঃ শ্রুত। পুরূরবা যখন রাজত্ব করছেন সেই সময়েই নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিরা এক বিশাল যজ্ঞ আরম্ভ করেন। দেব-কারিগর বিশ্বকর্মা এই মহান যজ্ঞের জন্য সোনা দিয়ে যজ্ঞভুমি বাঁধিয়ে দেন। যজ্ঞ আরম্ভ হল। স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি এই যজ্ঞেরক্রিয়াকলাপ দেখার জন্য উপস্থিত হলেন।
এদিকে মহারাজ পুরূরবা শিকারে বেরিয়েছেন। তার সঙ্গে লোক-লস্কর সৈন্য-সামন্ত ভিড় করে চলল এবং সেটা খুব বড় কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তার সঙ্গে সঙ্গে চললেন স্বর্গসুন্দরী উর্বশী, যিনি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন পুরূরবার আসঙ্গলিপ্সায়-উর্বশী চকমে যজ্ঞং দেবহৃতিপ্রণোদিতা। মৃগয়ায় বেরিয়ে এ দেশ সে দেশ ঘুরে পুরূরবা উপস্থিত হলেন নৈমিষারণ্যে–যেখানে সোনায় বাঁধানো যজ্ঞভূমিতে ঋষিদের যজ্ঞ চলছে পুরোদমে।
যজ্ঞস্থলীর পূণ্যমন্ত্র আর হবির্গন্ধে অতি-বড় অমানুষেরও হৃদয় দ্রবীভূত হয়, শ্রদ্ধায় চক্ষু নিমীলিত হয়। কিন্তু চন্দ্রবংশাবতংস বুধপুত্র ঐল পুরূরবার কানে মন্ত্র-গানের স্বরসঙ্গতি প্রবেশ করল না, তার মন আকুলিত হল না হবির্গন্ধে। যজ্ঞভূমিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ পড়ল সুবর্ণময় যজ্ঞভূমির ওপর। লোভে তার হৃদয় আলোড়িত হল, কার্যাকার্য জ্ঞান লুপ্ত হল। তার ইচ্ছে হল সেই মুহূর্তে নৈমিবারণ্যের সুবর্ণময় যজ্ঞভূমি উৎখাত করে নিয়ে যান লোভেন হতবিজ্ঞান স্তদাদাতুং প্রচক্রমে। ইচ্ছা এবং প্রক্রিয়া একই সঙ্গে শুরু হল। যজ্ঞযাজী ঋষি-ব্রাহ্মণদের ধৈর্য বেশিক্ষণ থাকল না। তারা মন্ত্রপূত কুশের আঘাতে মেরে ফেললেন। পুরূরবাকে। ঋষিদের কুশাঘাত বস্ত্র হয়ে নেমে এল পুরূরবার ওপর। রাত্রির শেষে সূর্যোদয়ের আগেই মারা গেলেন পুরূরবা–ততো নিশান্তে… কুশবজৈ নিষ্পিষ্টঃ স রাজা ব্যাহরত্তনুম।
সেই একই কথা। বেণের যেমন হয়েছিল। ঋষিদের হাতে মারা গেলেন পুরূরবা। সবচেয়ে বড় কথা– পুরূরবার এই নৈমিষারণ্য অভিযানের সময়ে অর্থাৎ রাজা যখন সেই পুণ্যস্থানের সুবর্ণময় যজ্ঞভূমি লুণ্ঠনের চেষ্টা করছেন সেই সময়ে স্বর্গসুন্দরী উর্বশী কিন্তু পুরূরবার পাশেই আছেন– আজহার চ তৎসত্রং স্বর্বেশ্যাসহসঙ্গতঃ। তাহলে অন্তত বায়ুপুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী পুরূরবার জীবনে ব্রাহ্মণ-বিরোধিতার অংশটুকু উর্বশীর সঙ্গ-গন্ধ-বিরহিত নয়।
আশ্চর্যের বিষয় হল- পৌরাণিকেরা যে সব সূত্র থেকে পুরূরবার জীবন কাহিনী বিবৃত করেছেন, সেইসব সুত্রের মধ্যে একমাত্র মহাভারত বায়ু এবং ব্রহ্মান্ড পুরাণ ছাড়া আর কোথাও এই ব্রাহ্মণ-বিরোধিতার তথ্যটুকু তেমনভাবে ধরা নেই। উর্বশীর সঙ্গে পুরূরবা মিলন-বিরহের অধ্যায়টুকু আমরা না হয় আলদাভাবে একটা নতুন স্তরেই সাজিয়ে নেব। কিন্তু পুরূরবার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা যে একটা হয়েছিল এবং পুরোপুরি মারা না গেলেও তার যে সাময়িক রাজ্যচ্যুতি গোছের কিছু হয়েছিল, তা মহাভারতের অন্য অংশ থেকেও বোঝা যায়। না, স্পষ্ট করে রাজ্যচ্যুতির কথা কিছু বলা নেই মহাভারতে। কিন্তু যে ভাবেই হোক তেমন কোনও বিপাকে তাকে অবশ্যই পড়তে হয়েছিল, তা বোঝা যায় মহাভারতের শান্তিপর্বে এসে। রাজ্যশাসন চালাতে গেলে ব্রাহ্মণদের ভূমিকা যে কতটা জরুরি, অপিচ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক সমন্বয় যে কতটা প্রয়োজনীয়, সে কথা পুরূরবার নানা প্রশ্নে সাতঙ্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছে।
মহাভারতের শান্তিপর্বে পুরূরবার সঙ্গে একজন দেবতা এবং একজন ঋষির কথোপকথন সংকলিত হয়েছে। দেবতা এবং ঋষি-দুজনের কাছেই পুরূরবার প্রশ্ন ছিল একটাই–কিসে বড় ব্রাহ্মণরা? এবং কেনই বা পদে পদে মানিয়ে চলতে হবে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে? বেণের ক্ষেত্রে তার পরবর্তী বংশজ পৃথু মহারাজকে ব্রাহ্মণেরা রাজা করেছিলেন; কারণ বেণ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তিনি কাউকে মানতেন না এবং তার অত্যাচার ছিল প্রাবাদিক পর্যায়ের। পুরূরবার অত্যাচার ব্যাপারটা সে রকম নয় বোধ হয়। তার নামে যে ব্রাহ্মণদের ধন-রত্ন লুণ্ঠনের দোষারোপ করা হয়েছে, আমাদের ধারণা–তার কারণ নিহিত আছে তার রাজ্য শাসনের পদ্ধতিতে। প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মণরা যেহেতু যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়েই থাকতেন তাই রাজারা তাদের ওপর কোনও করের বোঝা চাপাতেন না। এই সাধারণ নীতির কথাটা কালিদাস তার নাটকের মধ্যেও বলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। মহারাজ দুষ্যন্ত যখন শকুন্তলাকে প্রথমবার দেখে এসে বনের মধ্যে বিদূষকের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তখন তার সমস্ত মন-প্রাণ আচ্ছন্ন। শকুন্তলা ছাড়া আর কিছু তিনি ভাবতেই পারছেন না। আরও একটিবার যাতে শকুন্তলার সঙ্গে দেখা করা যায়–তার জন্য যুক্তিবুদ্ধি, নানা ওজর এবং বাহানা তৈরি করতে লাগলেন। দুষ্যন্ত বললেন– তপস্বীরা যে আমাকে কেউ কেউ চিনেও ফেলেছে। এখন বলো তো কী করে আবার সেই কণ্ব-মুণির আশ্রমে ঢুকি? বিদূষক বললেন–তুমি দেশের রাজা। তোমার আবার অত ছুতো বার করার প্রয়োজন কী? বললেই হল- নীবার-ধানের একের ছয় ভাগ দেওয়ার কথা তোমাদের, সেই জন্য আবার এসেছি। রাজা বললেন–তুমি একটি মূর্ব। অন্য জাতিবর্ণের লোকেরা আমাদের যে কর দেয় তা বড়ই নম্বর। এঁদের রক্ষা করার জন্য আমরা অন্য জিনিস পেয়ে থাকি। ধনরত্বের চেয়ে তা অনেক বড়। ওঁরা ওঁদের তপস্যার এক ভাগ দেন রাজাকে। রাজার কাছে সেই তপস্যার পুণ্যধন অক্ষয়। অর্থাৎ করের কোনও প্রশ্নই নেই। ধর্মশাস্ত্রগুলিতেও ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ হয়েছে। চরম ভাষায়। কিন্তু পুরূরবা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে কর নিতেন। কী খাতে সেই কর সংগ্রহ করা হত, তা স্পষ্ট করে না জানা গেলেও মহামতি কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সেই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শর্তাব্দীতেই জানিয়ে দিয়েছেন–পুরূরবার সর্বনাশ হয়েছে চতুর্বর্ণের সব মানুষের ওপর ট্যাকস চাপিয়ে—লোভাদ ঐলশ্চাতুবর্ণম অত্যাহারয়মাণঃ।
আমাদের ধারণা, এই কর গ্রহণের নীতিই সাময়িকভাবে পুরূরবার রাজ-সিংহাসন কন্টকিত করে তুলেছিল এবং ঠিক এই পর্যায়ে তার মনে অবধারিত প্রশ্ন জেগেছে–ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের চাইতে কিসে বড়–কস্মাচ্চ ভবতি শ্ৰেষ্ঠস্তন্মে ব্যাখাতুমহতি? বায়ুদেবতার সঙ্গে তার এই কথোপকথনের প্রসঙ্গে আরও একটা বড় প্রশ্ন জেগেছে পুরূরবার মনে। তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন–আপনি ঠিক করে বলুন তো আমাকে শাসন করার জন্য এই যে পৃথিবী ক্ষত্রিয়দের অধিকারে আসে, সেই পৃথিবী আসলে কার প্রশাসনে থাকবে? যে রাজা বাহুবলে এই পৃথিবীর অধিকার লাভ করেন, পৃথিবী কি সেই ক্ষত্রিয়ের ভোগ্য, নাকি ব্রাহ্মণের–দ্বিজস্য ক্ষত্রবন্ধো বা কস্যেয়ং পৃথিবী ভবেৎ?
বায়ু দেবতা জাতি-বর্ণের অণুক্রমে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব পুরূরবাকে বুঝিয়েছেন। ব্রাহ্মণ শুধু বর্ণ-শ্রেষ্ঠ নয়, বর্ণ-জ্যেষ্ঠও বটে। আর পৃথিবীর অধিকার? বায়ু উপমা দিয়ে বলেছেন- সে হল ঠিক স্বামী আর দেবরের মতো। সেকালের দিনে স্বামী মারা গেলে চিৎ কখনও স্বেচ্ছায় সহমরণের কথা শোনা যায় বটে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিধবা স্ত্রী স্বামীর ছোট ভাইকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতেন। ঋগবেদ থেকে আরম্ভ করে পুরাণ পর্যন্ত সর্বত্রই দেখা যাবে যে, অনেক স্ত্রীই স্বামীর মৃত্যুর পর দেবরকে বিবাহ করেছেন। বায়ু এই উপমাটি স্মরণ করে পুরূরবাকে বললেন-দেখ, এই সমস্ত ভূমিখন্ডের স্বত্ব ব্রাহ্মণেরই বটে। কোনও রাজার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ যে ভূমির অধিকার ভোগ করেন, যে শস্য-সম্পদ তিনি খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করেন, সে সবই কিন্তু তারই। অর্থাৎ তিনি কারও পাচ্ছেন-পরছেন না, তিনি নিজেরটাই নিজে ভোগ করছেন, নিজেরটাই খাচ্ছেন। এমন কি তিনি যদি কাউকে কিছু দেন–জমি-জায়গা যা কিছু– সেও তিনি নিজেরটাই দিচ্ছেন–স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুভক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
অন্যদিকে কোনও ভূমিখণ্ডের শাসনকর্তা হিসেবে ক্ষত্রিয় যে রাজ্য ভোগ করছেন সেটা হল অনেকটা ওই মৃত-জ্যেষ্ঠের স্ত্রীর অধিকার-লাভের মতো। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ তার যজন-যাজনের বৃত্তিতে স্থিত থেকে রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করেন স্বেচ্ছায়। তিনি রাজ্য শাসন করেন না, অতএব তাঁর পরিত্যক্ত রাজ্য ভোগ এবং শাসন করেন ক্ষত্রিয়। পৃথিবী যেন এক বিবাহিতা রমণী; তিনি যেন জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ স্বামীর অভাবে ক্ষত্রিয়কেই অধিকারী হিসেবে নির্বাচন করেছেন–আনন্তৰ্য্যাত্তথা ক্ষত্রং পৃথিবী কুরুতে পতিম।
কথাটা আজকের সামাজিক পরিস্থিতিতে তেমন করে বোঝা যাবে না। ব্রাহ্মণরা ত্যাগ-বৈরাগ্য, পরোপকারের সমস্ত বৃত্তি আজই ভুলে গেছে, তা নয়। ব্রাহ্মণদের ভাঙন শুরু হয়েছে বহুঙ্কাল। খ্রিস্টিয় নবম-দশম শতাব্দীতেই অপক্ষীণ ব্রাহ্মণ্য নিয়ে সজ্জনদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। সে প্রমাণ অন্যত্র দেব। কিন্তু মহাভারতের যুগে বিদ্যাবত্তা, ত্যাগ-বৈরাগ্য এবং পরোপকার বৃত্তি ব্রাহ্মণ-সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। লক্ষ্য করে দেখবেন–ব্রাহ্মণ ঋষি বাড়িতে এলে রাজারা শুধু আত্মনিবেদনই করতেন না, আপন ভোগ্য রাজ্যটিও তারা বিনা দ্বিধায় ব্রাহ্মণের হাতে তুলে দিতেন। ব্রাহ্মণরা এই আদর স্বীকার করতেন, কিন্তু তাই বলে রাজ্যের দিকে হাত বাড়াতেন না। উপস্থিত ব্রাহ্মণকে এই রাজ্য-নিবেদনের কথা মহাভারতে বহু জায়গায় আছে। উদাহরণ হিসেবে আপনারা সেই মুহূর্তটুকু পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যখন দ্রোণাচার্যকে ভীষ্ম ডেকে এনেছিলেন বাড়ির বালকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। ভীষ্ম তাকে বলেছিলেন- আপনি এসেছেন এই বড় অনুগ্রহ। কুরুদের যা আছে বিত্ত বৈভব রাষ্ট্র সবই আপনার। আপনিই এখানকার রাজা, আমরা আপনার ভৃত্য– ত্বমেব পরমো রাজা সর্বে চ কুরব স্তব।
সেকালে উপযুক্ত ব্রাহ্মণদের প্রতি রাজা-মহারাজাদের এই ভাবটুকুই ছিল। তবে এই সমন্বয় আসতেও কিছু সময় লেগেছে বলে মনে হয়। আর্যায়ণের প্রথম কল্পে বেণকে যেমন আমরা দেখেছি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে পুরূরবার ক্ষেত্রেও যা দেখলাম, তাতে মনে হয় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের পারস্পরিক বোঝাবুঝিতেও সময় লেগেছে কিছু। পুরূরবার প্রশ্ন থেকেই বোঝা গেছে ব্রাহ্মণদের সর্বময় কর্তৃত্বে তার সংশয় ছিল, উপেক্ষা ছিল। বায়ুদেবতার মুখ দিয়ে যে উপদেশ শুনতে পাচ্ছি, তাতে ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে পুরূরবার সংশয় এবং দ্বিধাটুকু পরিষ্কার বোঝা যায়। আরও বোঝা যায় কাশ্যপ মুনির সঙ্গে পুরূরবার কথোপকথনে।
ঐল পুরূরবা কাশ্যপ মুনিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–ব্রাহ্মণ যদি ক্ষত্রিয়কে ত্যাগ করে অথবা উটোটা যদি হয়, ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে ত্যাগ করে, তাহলে সাধারণ প্রজারা কাকে আশ্রয় করে, কার ওপরেই বা নির্ভর করে? কাশ্যপ বললেন- বিচক্ষণ লোকেরা জানেন যে, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় যদি নিজেরা নিজেরা বিবাদ-বিসংবাদ করে, তাহলে ক্ষত্রিয়ের রাজ্য থাকে না, রাজ্য চলে যায় দস্যুদের হাতে–ব্রাহ্ম-ক্ষত্রং যত্র বিরুধ্যতীহ/ অন্বগলং দস্যবস্ত ভজন্তে। এই প্রশ্নোত্তর থেকেই বোঝা যায় পুরূরবার জীবনে কী ঘটেছিল। আপন রাষ্ট্রে তিনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিরোধিতা করেছিলেন এবং তার রাজ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতোই হয়েছিল। হয়তো ধ্বংসসান্মুখ অবস্থায় এই কথোপকথন তাকে তখনকার সমাজের প্রচলিত পথে চলতে প্রেরণা জুগিয়ে থাকবে এবং হয়তো বা তিনি নিজেকে খানিকটা শুধরেও নিয়েছিলেন।
কাশ্যপের উত্তরদানের মধ্যে বার বার একটা কথা উচ্চারিত হয়েছে–যদি ক্ষত্রিয়েরা ব্রাহ্মণকে ত্যাগ করেনদা ব্ৰহ্ম ক্ষত্রিয়াঃ সংত্যজন্তি। বার বার সেই একই আশঙ্কা, কেন না পুরূরবা সেই আশঙ্কা তৈরি করেছিলেন। মনে রাখা দরকার এখনকার দৃষ্টিতে এই ব্রাহ্মণ্য কিন্তু চাল-কলার ভিক্ষাসর্বস্ব পৌরোহিত্য নয়। এখানে ব্রাহ্মণ সেকালের সমস্ত বিদ্যাবত্ত এবং সংস্কৃতির প্রতীক আর রাজা বা ক্ষত্রিয় হলেন রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক। অন্যথায় আজকের জাতি-ব্রাহ্মণ্য নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বরঞ্চ ঘৃণা আছে। বিদ্যা-শিক্ষাহীন ক্ষাত্রশক্তি বা শাসন কোন পর্যায়ে চলে যেতে পারে এখনকার ভারতই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমরা যেমন বলি-রাজনীতিকরা সব লুটে-পুটে খাচ্ছে, ওঁরা সেটাকেই বলেন–অম্বগবলং দস্যবস্ত ভজন্তে বিদ্যাব্রাহ্মণ আর ক্ষাত্রশক্তির বিরোধিতার সুযোগে দস্যুরা তাদের অধিকার কায়েম করে। এখনকার রাজনীতিকদের স্বার্থসর্বস্ব দস্যু ছাড়া কীই বা আর বলব?
রাজধর্ম নিয়ে পুরূরবার সঙ্গে বায়ুদেবতা এবং কাশ্যপ মুনির সঙ্গে এই কথোপকথন আমরা পুরূরবার জীবনের একটা অধ্যায় বলে মনে করি। তবে সনকুমার যখন ব্রহ্মলোক থেকে তাকে বোঝাতে এসেছিলেন এই কথোপকথন সেই সময়ে হয়নি বলেই মনে হয়। আমাদের ধারণা, ব্রাহ্মণরা যখন কুশবদ্রে পুরূরবাকে ধ্বংস করলেন অথবা তার রাজ্যচ্যুতি ঘটালেন, এই কথোপকথন এসেছে সেই সময়ে। কারণ পুরূরবা এখন অনেক শান্ত এবং জিজ্ঞাসু। ঋষিরা, দেবতারা তার সংশয় নিরসন করেছেন-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মিলনের সমাধান দিয়ে। পুরূরবা এই সমাধান স্বীকার করেছেন নিশ্চয়।
আমরা এই রকমই একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি, কেন না বেদ থেকে আরম্ভ করে পুরাণ পর্যন্ত সর্বত্রই পুরূরবার মাহাত্ম কীর্তিত হয়েছে ভূরি ভূরি। ব্রাহ্মণ্য-বিরোধের সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়ে পুরূরবা আবারও নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বলেই মনে হয় এবং তার অসংযমের ইতিহাসটুকু বেদ-পুরাণ আর মনে রেখে দেয়নি। মহাভারত এবং মহাভারতের অনুসরণে আরও দু-একটি পুরাণ পুরূরবার জীবনের এই কলঙ্কিত অংশটুকু বর্ণনা করেছে বটে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত পুরাতন গ্রন্থগুলি, যেমন শতপথ ব্রাহ্মণ বা বেদ-এইসব জায়গায় পুরূরবার সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর মিলন কীভাবে হল–তারই হার্দিক বর্ণনা আছে শুধু। ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার মতো গদ্যজাতীয় সাময়িক ইতিহাস নিয়ে এইসব গ্রন্থের লেখকরা বিব্রত হননি। কিন্তু মহাভারতের কবি যেহেতু ঐতিহাসিকের মতো বেশ বড়সড় একটা মন্তব্য করেছেন পুরূরবার ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতা নিয়ে, আমাদেরও তাই খানিকটা সময় দিতে হল ঐতিহাসিকদের সূত্র বজায় রেখে। তবে এবার আমরা কাব্যে চলে যাব। কারণ স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর সঙ্গে মর্ত্য রাজা পুরূরবার মিলনের ইতিহাসটুকু স্বাভাবিক কারণেই ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতার অংশ থেকে মধুরতর এবং আমাদের কাছে তা অন্য কারণে গুরুতরও বটে।
উর্বশী-পুরূরবার মিলন-কাহিনী অতি প্রাচীন এবং জটিল। এই কাহিনীর উপাদান আছে খোদ ঋগবেদে, শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে তো বটেই এবং আছে বিভিন্ন পুরাণে। কাহিনীটি বেদে যেমন আছে, তা যেন আদি-অন্তহীন একটা মাঝখানের সংলাপের মতো। তা থেকে আগুপিছু বোঝা যায় না কিছুই। শতপথ ব্রাহ্মণের মতো প্রাচীন গ্রন্থ তাই বেদোক্ত এই সংবাদ-সূক্তের ভূমিকা রচনা করে দিয়েছে। অন্যদিকে প্রাচীন পুরাণগুলি উর্বশী-পুরূরবার মিলন কাহিনী গ্রন্থনা করেছে বেদ এবং শতপথ ব্রাহ্মণের উপাদান একত্রিত করে। বেদ-ব্রাহ্মণ এবং পুরাণের এই প্রিয় বিষয়টির জনপ্রিয়তা এতই বেশি ছিল মহাকবি কালিদাসও এই রোমাঞ্চকর কাহিনীর আবেদন ঠেলে ফেলতে পারেননি। তিনি ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নামে সেই বিখ্যাত নাটকটি লিখে আপন কালের কাছে ঋণমুক্ত হয়েছেন।
সবাই জানেন–উর্বশী স্বর্গের এক সুন্দরী অপ্সরা। পৌরাণিকেরা কেউ তার উৎপত্তি ঘোষণা করেছেন সমুদ্রমন্থনের অন্যতম ফল হিসেবে, কেউ বা তার উৎপত্তির কথা বলেননি। জন্ম-মরণের বাঁধা ছকে উর্বশীকে অনেকেই দেখতে চান না। তিনি শুধু সুন্দরী রূপসী নই মাতা নহ কন্যা গোছের। অনাদি অনন্ত কাল ধরে তিনি আছেন, শুধু যৌবনবতী উর্বশী। বেদের মধ্যে যেহেতু উর্বশীকে প্রথম পাই, তাই তার নাম নিয়ে অর্থচর্চা আরম্ভ হয়েছে প্রায় বেদের আমল থেকেই। পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা যেহেতু বিভূতিযুক্ত সমস্ত মহাজনের মধ্যেই সূর্যের প্রতীক দেখতে পান, অতএব পুরূরবা তাদের কাছে Solar hero আর উর্বশী হলেন উষার প্রতীক। প্রভাতের আলো ফুটবার আগে উষার অরুণিমা চোখে দেখি মোহিনী মায়ার মতো। উর্বশী সেই উষা। ঋগবেদের সংবাদসূক্তে উবর্শীর সঙ্গে মিলনের জন্য পুরূরবার অনন্ত হাহাকার আছে। ক্ষণিকোদিতা উষার পেছন পেছন চলা সূর্যের মিলনেন্সার মধ্যেই আছে একই হাহাকার-ধ্বনি। পুরূরবা-উর্বশীর মিলন-বিরহ তাই পাশ্চাত্য বৈদিকের কাছে সূর্য আর উষার মিলন-বিরহের সুরে বাঁধা। ম্যাক্স মুলার অতি সরল ভাষায় বেদের কথা বলবেন–Urvasi loves pururavas মানে আর কিছুই নয়–the sun rises, আবার Urvasi sees pururavas naked sic the dawn is gone. Wasica Urvasi finds puruavas again gerte the sun is setting.
কে বলে বৈদিক কবিরা ইনটেলেকচুয়াল ছিলেন না। এত প্রতীকী কবিতা যাঁরা খ্রিস্টজন্মের অন্তত হাজার বছর আগে লিখতে পেরেছেন, তাদের ভাবনা-চিন্তা যে যথেষ্ট আধুনিক–সে কথা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানেন, এসব প্রতীকী বিবরণে এখনই আমরা মন দেব না, কারণ পুরূরবা কিম্বা উর্বশীকে আমরা কল্পলোকের অধিবাসীও মনে করি না, রূপকও মনে করি না। চন্দ্রবংশের তৃতীয় পুরুষেই যদি রূপক এসে যায়, তবে মহাভারতের ইতিহাস আরম্ভেই স্থালিত হবে। আমাদের মতে পুরূরবা রীতিমতো ঐতিহাসিক পুরুষ এবং আর্যায়ণের দ্বিতীয় পর্যায়ে আর্যদের সভ্যতা যখন উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হল, তখনও পুরূরবার ব্যবহার ঐতিহাসকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এমন কি উর্বশীকেও এই সূত্রে বুঝে নেওয়া অসম্ভব নয়।
আমি আগেই জানিয়েছি–পুরূরবার পিতা বুধ পুত্রের জন্ম দিয়েই স্বর্গে ফিরে গেছেন, এমন কি তার পালক পিতা সুদ্যুম্নকেও আমরা ইলাবৃতবর্ষে ফিরে যেতে দেখেছি। অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত স্বর্গভূমির সঙ্গে এই পৃথিবী বা ভারতবর্ষের যোগাযোগ যথেষ্ট রয়েছে। আরও লক্ষণীয় বিষয় হল–ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলে পুরূরবাকে আমরা স্বয়ং মনুর সঙ্গে উল্লিখিত হতে দেখেছি এবং সেই একই ঋক্মন্ত্রে তিনি অগ্নিদেবের বন্ধুত্বমগ্নে মনবে দ্যামবাশয়ঃ পুরূরবসে সুকৃতে সুকৃত্তরঃ। এই ঋকের অর্থ হল- অগ্নি! রাজা পুরূরবা ভাল কাজ করলে তুমি তাকে বেশি ফল দিয়েছ। পরিষ্কার বোঝা যায়, পুরূরবা আগে ভাল কাজ করেননি। যখন করেছেন, তখন ভাল ফলও পেয়েছেন দেবতার কাছে।
পুরূরবা অগ্নিদেবের বন্ধু কী করে হলেন সে কথা পরে আসবে। কিন্তু পূবোক্ত ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার কথা মনে রেখেও ঋগবেদ তাকে উল্লেখ করেছে পরম উপকারী বলে ‘সুকৃত’ বলে। অন্যদিকে পুরাণগুলি খুললে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠিত ওঠা-বসার কথা এতই প্রকট হয়ে উঠবে যে, উর্বশীর মতো স্বর্গসুন্দরীকে মত মানুষ পুরূরবার স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করাটাও অলৌকিক ভাবনা বলে মনে হবে না।
উর্বশী স্বর্গের অপ্সরা বলে পরিচিত। সাধারণভাবে অপ্সরারা জলের সঙ্গে জড়িত বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। সংস্কৃত ‘অপ’ শব্দের অর্থ জল,আর সৃ’ ধাতুর অর্থ হল সরে সরে যাওয়া। এই দৃষ্টিতে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যায় অপস্বিয়মান মেঘই হল অঙ্গরা। আবারও বলি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই রূপকও আমাদের পছন্দ নয়। আমাদের ধারণা-সেকালের প্রাচীন জনপদগুলির মধ্যে উত্তর ভারতের বিভিন্ন নদ-নদী এবং পর্বতের সানুদেশে যে সমস্ত সুন্দরী রমণীর দেখা পাওয়া যেত, তারাই অপ্সরা। ইতিহাস-পুরাণে অপ্সরারা প্রধানত নৃত্যের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বেদের ভাষায় তারা দেবপত্নী’ও বটে।
‘দেবপত্নী’ শব্দটার মধ্যে যতই মর্যাদা থাকুক মূলত অপ্সরারা ছিলেন স্বৰ্গবেশ্যা। দেবতারা আপন রতিসুখ চরিতার্থ করতেন এদের দিয়েই এবং প্রয়োজনে এদের ব্যবহার করতেন তাদের ওপর, যারা স্বর্গ অধিকার করে নিতে চান। অর্থাৎ দেবতা নামক উন্নতবুদ্ধির মানুষরা উন্নতিকামী ব্যক্তিকে অপ্সরার ভোগসুখে মত্ত রেখে নিজের অধিকার মজবুত রাখতে চেষ্টা করতেন। পুরুষের ব্যাপারে অপ্সরারা ছিলেন অত্যন্ত খোলামেলা এবং তাদের লাজ-লজ্জাও ছিল কম। ফলে শারীরিক সৌন্দর্য এবং দৈহিক আকর্ষণ দুটিই তারা প্রকটভাবে ব্যবহার করতেন উন্নতিকামী পুরুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য।
সেকালের দিনে গণিকারাই ছিলেন যথাসম্ভব শিক্ষিত এবং বিদগ্ধা রমণী। সেদিক দিয়ে স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরা-সুন্দরীরা আরো এক কাঠি ওপরে। আর উর্বশীর তো কথাই নেই। তিনি অঙ্গরা সুন্দরীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা, নাগরিক বৃত্তির যোগ্যতম আধার। শুধুই স্বৰ্গবেশ্যামাত্র হলে স্বয়ং কবিগুরুর হাত দিয়ে অমন সুন্দর কবিতাটি উপহার পেতাম না, আর কবির কবি কালিদাসও তাকে তার নাটকের নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করতেন না। উর্বশীকে তাই একটু অন্য চোখে আমাদের দেখতে হবে এবং উর্বশীর সৃষ্টিও বড় সাধারণভাবে হয়নি।
.
২২.
বাবা যদি বলতেই হয় তবে ব্যাকরণ-সম্মতভাবে নির্ভুল নর-নারায়ণ–এই যুগল ঋষিকেই সুন্দরীশ্রেষ্ঠা উর্বশীর বাবা বলে মেনে নিতে হবে। ঋষি নর-নারায়ণ এবং উর্বশী কেমন যেন বিপরীত শোনায়। মহাভারত পাঠের আগে একটি মঙ্গলাচরণ-শ্লোক উচ্চারণ করতে হয়। সেই শ্লোকের আরম্ভটা এইরকম–নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্। ভগবান নারায়ণ আর নরশ্রেষ্ঠ নর নামক পুরুষকে নমস্কার করে মহাভারত পাঠের নিয়ম। নর-নারায়ণ এই যুগল দেবতা বিষ্ণুর সাক্ষাৎ অংশ বলে পরিচিত। মহাভারতের পরবর্তী অংশে নর-নারায়ণকে অর্জুন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, নর-নারায়ণ নামে দুই যুগল ঋষির কল্পনাও আছে পুরাণে। তবে ঋষি হলেও পুরাণগুলিতে নর-নারায়ণ ঋষির মাহাত্ম্য বিষ্ণুর থেকে কোনও অংশে কম নয় এবং আপাতত তাদের ঋষি ধরে নিয়েই আমাদের কথা আরম্ভ করতে হবে; কারণ পুরূরবার প্রেয়সী উর্বশীর জনক এই যুগল ঋষির একজন।
নর-নারায়ণ হিমালয়ের বদরিকাশ্রমে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মন দিলেন। অতি অদ্ভুত সেই তপস্যা। তাদের তপস্যার তেজে তিন ভুবন যেন তাপিত হয়ে উঠল। স্বর্গরাজ্যের অধীশ্বর ইন্দ্র প্রমাদ গণলেন। শেষপর্যন্ত হয়তো তার ইন্দ্র-পদটাই চলে যাবে। ইন্দ্র ঠিক করলেন যেভাবে যোক এই দুই মুনির তপস্যা নষ্ট করে দিতে হবে। তিনি নিজে ঐরাবতে চড়ে উপস্থিত হলেন ঋষিদের তপস্যা-ভূমিতে। ঋষিদের উদ্দেশে বললেন–আপনারা কী চান বলুন? আমি আপনাদের তপস্যা দেখে বড় খুশি হয়েছি। অতএব না দেওয়ার মতো জিনিস হলেও আপনারা চাইলে তা দেব–অদেয়মপি দাস্যামি তুষ্টোস্মি তপসা কিল।
ইন্দ্র অনেকবার একই কথা বললেন। কিন্তু মুনিরা এতই যোগযুক্ত হয়ে তপস্যায় ডুবে আছেন যে, ইন্দ্রের কথা তারা কানে শুনতেই পেলেন না। উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা। ইন্দ্র তখন ভয় দেখাতে আরম্ভ করলেন। দৈবী মায়া বিস্তার করে দুই ঋষিকে ভয় দেখানো শুরু করলেন। বাঘ-সিংহ থেকে আরম্ভ করে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত, আগুন লাগানো কিছুই বাদ গেল না। ঋষিদের ধ্যান ভাঙল না, তপস্যা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত করা গেল না তাদের।
ইন্দ্র এবার ভালবাসার দেবতা কামদেবকে স্মরণ করলেন। তার সঙ্গে এলেন ঋতুরাজ বসন্ত। যে কামদেবকে ইন্দ্র অন্য সময় খুব বেশি একটা আমল দেন না, প্রয়োজন বুঝে ইন্দ্র তাকে খুব তোয়াজ করলেন। বললেন- ভাই! তোমার মতো ক্ষমতাবান দেবতা আর