ব্রহ্মচারী উতঙ্কও, এইভাবেই ছিলেন গুরুর বাড়িতে। যজ্ঞের নিমন্ত্রণ পেয়ে গুরু বেদ শিষ্যকে বললেন, বাড়িতে তুমি রইলে। যদি কোনও অসুবিধে হয় একটু দেখো। যদি কোনও ঝামেলাও হয় সামাল দিও। বেদ চলে গেলেন। বাড়িতে থাকলেন তার যুবতী স্ত্রী এবং ব্রহ্মচারী উতঙ্ক। ইতিমধ্যে বেদের পত্নী ঋতুমতী হলেন। সেকালে স্ত্রীলোকের ঋতুরক্ষার একটা ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। অর্থাৎ স্ত্রী ঋতুমতী হলে ঋতুস্নানের পর যে কোনও উপায়েই তার সঙ্গমের ব্যবস্থা করতেই হবে। হয়তো সমাজে এই নিয়ম যখন চালু হয়েছিল, তখন স্ত্রীলোকের সংখ্যা ছিল অল্প এবং সন্তানের চাহিদা ছিল বেশি। তাছাড়া কামশাস্ত্রের মতে এই সময়টাতে নাকি স্ত্রীলোকের আসঙ্গলিপ্সা প্রবল হয় এবং সন্তান ধারণের পক্ষেও নাকি সময়টা যথেষ্ট উপযোগী এবং উর্বর। ফলে যেনতেন প্রকারেণ ঋতুস্নাতা স্ত্রীলোকের সঙ্গমেচ্ছা পূরণ করাটা তখন ধর্মের তাৎপর্যে গ্রহণ করা হত।
মহর্ষি বেদের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর বান্ধবীরা এসে উতষ্ককে জানাল, তোমার অধ্যাপকের স্ত্রী ঋতুমতী হয়েছেন। এদিকে তোমার অধ্যাপক বিদেশে। তুমি এমন ব্যবস্থা কর যাতে এঁর ঋতুকাল নিষ্ফল না হয়। তাছাড়া এই কারণে তোমার অধ্যাপক-পত্নীও যথেষ্ট বিষণ্ণ হয়ে আছেন এষা বিষীদতি ইতি। একেবারে শেষ বাক্যে অধ্যাপকের স্ত্রীর যে পুরুষান্তর-সংসর্গে আপত্তি নেই সেটাও জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু উতঙ্ক সংসর্গকামিনী এই রমণীর ইচ্ছা একেবারে নস্যাৎ করে দিলেন।
হয়তো দীর্ঘদিন স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেদ-পত্নীর মন এই যুবক পুরুষটির প্রতি সরস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সরসতার সুযোগ উতঙ্ক নেননি। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে, সেকালের সমাজে যারা একটা সময়ে শুরু হয়ে বসতেন, তাদের জীবনের বহুলাংশ কেটে যেত বিদ্যালাভে। ফলে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করতে তাদের দেরি হয়ে যেত। বিয়ে করার পক্ষে বয়স বেশি হয়ে গেলেও বিদ্যা এবং ব্রাহ্মণ্যের কারণে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে পেতেও তাদের অসুবিধে হত না। তাছাড়া বয়স বেশি হলেও ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ ঋষি-মুনিদের সরসতা কম ছিল না। বড় ঘরের মেয়ে, রাজার ঘরের সুন্দরী মেয়েদের তারা মন দিতে ভালবাসতেন। কবি যতই বলুন
সত্য থাকুন ধরিত্রীতে
শুষ্ক-রুক্ষ মুনির চিতে
জ্যামিতি আর বীজগণিতে-
আমরা জানি ঋষি-মুনির হৃদয় মোটেই জ্যামিতি আর বীজগণিতের তত্ত্বের মতো ছিল না। ভাগবত পুরাণের সৌভরি মুনি, অথবা রামায়ণ-মহাভারতের বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র, পরাশর ভরদ্বাজ–কেউই স্ত্রীলোকের মন নিয়ে কাঠিন্য প্রকাশ করেননি। সময়কালে সে সব কথা আসবে।
আমি যা বলছিলাম সেটা একটা সমস্যার কথা। প্রৌঢ়-বৃদ্ধ মুনি-ঋষিরা যে সব মেয়েকে বিয়ে করে আনতেন, তাদের বয়স যেহেতু কম হত, তাই তাদের নিয়ে সমস্যাও কিছু ছিল। এঁদের মধ্যে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ জানি না- এমন সতী-সাধ্বী মহিলা যথেষ্টই ছিলেন। কিন্তু সেকালের কতগুলি সাবধানবাণী থেকে কতগুলি সমস্যাও সঠিক ধরা যায়। যেমন রামায়ণ, মহাভারত বা মনু সংহিতার মতো প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে গুরুগৃহবাসী শিষ্যদের বারবার শাসন করা হয়েছে যে, তারা যেন গুরুপত্নীর সঙ্গে বেশি মেশামিশি না করে। মনু মহারাজ তো একেবারে চোখ রাঙিয়ে বলে দিয়েছেন যে, দেখ বাপু। শিষ্য যদি বিশ বছরের যুবক হন- আর গুরুর গিন্নিটি যদি হন যুবতী, তাহলে গুরু সেবার নাম করে গুরুমার গায়ে তেল মাখানো, কি স্নান। করানো, কি ঝামা দিয়ে পিঠ ঘষে দেওয়া– এ সব তো বারণই, এমনকি প্রণাম করার ছুতো করে গুরুপত্নীর পা ছোঁয়াও একেবারে বারণ।
এই বারণ-সাবধান থেকে যে কথাটা বেরিয়ে আসে, তা হল গুরুগৃহে যুবক শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নীর অধিকরণ-সামীপ্য। দূরত্বটা বহির্বাটী এবং অন্তর্বাটীর হলেও ইনিও আছেন, উনিও আছেন। এখন সমস্যাটা হল– প্রৌঢ় অথবা অতিরিক্ত বিদ্যাব্যসনী স্বামীর ঘর কতে করতে কখনও কোনও বসন্তের উতলা হাওয়ায় কোনও যুবতী গুরুপত্নী যদি একটি সমান-বয়সী শিষ্যের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন, তবে সেটা অন্যায় হলেও অস্বাভাবিক ছিল না। অন্যদিকে গুরুপত্নী-গমনের জন্য গুরুগৃহবাসী শিষ্যের অনন্ত নরকবাস নির্দিষ্ট থাকলেও যুবক শিষ্য বয়সের ধর্মে ব্রহ্মচর্য ভেঙে রমণে প্রবৃত্ত হতেন। ছোট-খাটোদের কথা ছেড়েই দিন, দেবতা বলে পরিচিত ইন্দ্ৰ গৌতম পত্নী অহল্যার রূপ-মুগ্ধ হয়ে গুরু গৌতমের সাজ নিয়েই অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। আর রামায়ণের কবি সেখানে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, অহল্যা তার স্বামীর শিষ্যটিকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবু যে তিনি ইন্দ্রের বাহুবন্ধনে শয্যাশায়িনী হয়েছিলেন, তার কারণ নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের রমণ কেমনতর, তাই দেখবার জন্য দেবরাজ-কুতূহলা। আর প্রসিদ্ধ পাণ্ডব-কৌরব বংশের উৎপত্তিই যে হয়েছিল গুরুপত্নী-গমনের ফলে- সে কথায় আমি পরে আসব।
তাই বলছিলাম– যুবক শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নীর সমানাধিকরণ যদি প্রৌঢ়-বৃদ্ধ গুরুগৃহটি হয়, তবে তাদের পারস্পরিক সরসতা অন্যায় হলেও অস্বাভাবিক ছিল না সেকালে এবং তার সামাজিক কারণ তো ছিলই। গুরুর অনুপস্থিতিতে এবং গুরুপত্নীর বান্ধবীদের তাড়নায় বেদ-শিষ্য উতঙ্ক তো রীতিমতো এক ধর্মীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ঋতু-রক্ষার কাজটা যতই ধর্মীয় হোক, উতঃ রাজি হলেন না। গুরু-পত্নীর বান্ধবীদের তিনি বললেন তোমাদের মতো মেয়েদের কথায় আমি মোটেই নাচতে রাজি নই। আমার গুরুমশাই আমাকে নানা কাজের কথা বলে তার ঘর সামলাতে বলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আমায় তিনি এটা বলে যাননি যে, দরকার হলে আমার স্ত্রীর ঋতুরক্ষার মতো অকাজটাও তুমি করে দিও ন হ্যহপাধ্যায়েন সন্দিষ্টঃ অকাৰ্য্যমপি ত্বয়া কাৰ্যমিতি।