-তুই এসব কতা শিখলি কুথা থেকে?
–কেসনগর থিকে মাস্টুর আসে, সে আমাদের আখ খেতে কেলাস নেয়।
–আগে বলিস নি তো?
–মাস্টুর মানা করেছে।
-মাস্টুর আর কী কী বলেচে? আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ল চুনারাম। তার ভয়-ভয় করলেও সে কথাগুলো শুনতে চায়।
রঘুনাথ উৎসাহিত হয়ে হাতের মুঠি পাকাল, তারপর গলার রগ ফুলিয়ে ডান হাত মুঠো করে ছুঁড়ে দিল শূন্যে, লড়াই-লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই। বুঝলে দাদু, লড়াই ছাড়া এদেশে কিছু হবার নাই। কুশলবাবু বলেচে-সে আসছে রোববার আসবে। এবার গাঙধারে মিটিং হবে। হলদেপোঁতা ধাওড়া থেকে শুরু করে বসন্তপুর ধাওড়া থিকেও লোক আসবে। ইবারের মিটিংটায় খাস জমি দখল নিয়ে কথা হবে।
-খাস জমি যে দখল নিবি–জমিটা কুথায়? চুনারাম খ্যা-খ্যা করে কালো দাঁত দেখিয়ে হাসল, বাবুদের বোন্দুক আচে, তুই বাপু ওসব ঝুটঝামেলায় যাবি নে। গুয়া যদি জানে তো লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়বে। ওর রাগ তো জানিস, দিবে ঘর থেকে বের করে। কথায় কথায় বেলা ঢলে পড়ে, অশ্বত্থের ডালে হাজার-কিসিমের পাখি এসে জড়ো হয়েছে। ওদের ছোট-বড়ো চিৎকারে বাতাস পুলকিত হয়ে হিল্লোল তুলেছে তেলা পাতায়। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল রঘুনাথের, টিউকলটার দিকে তাকিয়ে সেই শুকনো ভাবটা খরার মাটির চেয়েও খড়খড়ে হয়ে উঠল।
দাদু, তুমি টুকে দাঁড়াও। রঘুনাথ ছুটে গেল কলের দিকে। সরকারি এই কলের জল যেন চিনি পাতা সরবত। খরানী দিনে এর শীতল জল যেন পাতাল থেকে স্বেচ্ছায় উঠে এসেছে মানুষের সেবায়। এই শেষ-দুপুরেও কলপাড়ে ভিড়ের কোনো শেষ নেই। নূপুর মাটির কলসী নিয়ে এসেছে জল নিতে, ওর বেণী করা তেল জবজবে চুল শিরদাঁড়ার দু’দিকে ঝুলে আছে কালো রঙের সাপের মতন। টিউকলের হ্যাণ্ডেলে চাপ দিলে ভসভসিয়ে জল উঠছে পাতাল ছুঁড়ে। নূপুর অবাক হয়ে দেখছে সেই স্ফটিকস্বচ্ছ জল। রঘুনাথ গিয়ে সেখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, এই সর বলছি। তেষ্টা পেয়েচে। ভরপেট জল খাবো। এই বুন, কল দাবিয়ে দে নারে।
আব্দারের কথায় নূপুর বেজে উঠল খুশিতে, নে। তবে মুখ লাগাবি নে। জানিস রঘুদা, এই ধাওড়াপাড়ার টিউকলে কত বাবুলোকে তেষ্টা মেটায়।
রঘুনাথ খুশি হল না কথা শুনে। কলসীতে জল ভরে নূপুর তার ছোট্ট কোমরের খাঁজে আটকে নিল। অমনি কলসী চুয়ানো জলে তার হলদে রঙের পুরনো ফ্রকটা ভিজে রঙবদল করে ফেলল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নূপুর বলল, রঘুদা, তুর খোঁজে সেই বামুনপাড়ার ঢ্যাঙ্গা ছেলেটা এসেছিল। জেঠি বসতে বললে সে বসল না। যাওয়ার সময় বলল, সে কালীগঞ্জ থিকে বিকেলবেলায় ফিরবে। তোকে ঘরে থাকতে বলেছে। কী যেন দরকার।
রঘুনাথ চুপ করে থাকল। সূর্য সময়-অসময়ে এখন ঘরে আসে। দশ বছর আগেও তার বাপ-ঠাকুরদা এদিকের ছায়া মাড়াত না। তবে কি সময় ঢলছে? নাকি নতুন করে সূর্য উঠবে আবার।
.
০৩.
বিকেলবেলায় লাখুরিয়ার ওদিক থেকে একখণ্ড মেঘ কালো দৈত্যের চেহারা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধাওড়াপাড়ার মাথার উপর, চক্কর কেটে চতুর চিলের মতো ওড়ে, উড়তে উড়তে হুস করে মানিকডিহির ঘাটের কাছে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়, তাকে আর দেখতে পায় না চুনারাম। শুধু বুক ফুঁড়ে উঠে আসা একটা বড়োশ্বাস বুকের পাকা লোম কাঁপিয়ে সরসরিয়ে নেমে যায় পায়ের গোড়ালির দিকে। চুনারাম অস্ফুটে বলে ওঠে, আজও ভাগলো, আজও ঠকালো। শালা আকাশটাও কেমুন হারামী হয়েচে দেখো, ঢালব ঢালব করেও ঢালচে না। মানুষগুলার সাথে ধ্যাসটুমু মারাচ্চে। চুনারাম আর নিজেকে নিজের ভেতর ধরে রাখতে পারে না, চাপা রাগটা ক্ষরিস সাপের মতো ফণা তুলতে চায় প্রকৃতির বিরুদ্ধে। দেশ-গাঁ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলে এখন তার অত চিন্তা নেই, তার যত চিন্তা শুধু গুয়ারামকে নিয়ে। ছেলেটা বুনোপাড়ার দলের সঙ্গে মুনিষ খাটতে মানিকডিহির ঘাট পেরিয়ে নয়াগ্রামের দিকে চলে গিয়েছে। ওদিকটায় বর্ধমান, শুনেছে সেখানে নাকি চাষকাজের লোকের বড্ড অভাব, টাকা ছড়ালেও কাজের লোক পাওয়া যায় না, ফলে মাঠকাজে সেখানে বরষার দিনে ভীষণ অসুবিধে। বৃষ্টি না হলে ছেলেটা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে বিদেশ বিভুঁইয়ে, যা সাথে করে নিয়ে গিয়েছে তা-ও আঁজলা চুয়ানো জলের মতো নিঃশেষ হয়ে যাবে, আসলে বসে খেলে সসাগরা পৃথিবীটাকে চিবিয়ে খেতে মানুষের বেশিদিন লাগবে না। দুলাল আর ইন্দুবালার ঘর আসার কথা শুনেছে সে, তবে ওরা এবার বসন্তপুর ধাওড়া হয়ে আসবে, সেখানে দুলালের বড় মেয়ে বিন্দুর বিয়ে হয়েছে, তাদের সংসারে কী সব অশান্তি, তা মিটমাট করে না এলে বিদেশে-বিভুঁইয়ে গিয়েও শান্তি নেই দুলালের। দুলাল এই আসে ওই আসে বলে চুনারামের ভেতরটাতে অপেক্ষার ট্যাক গজিয়ে গিয়েছে, এখন একটা উন্মনা অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে হরসময়। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকতে বেলা গড়ে যায় পশ্চিমে, রোদের তেজ মরে আসে শুকনো তেজপাতার মতো, আর ঠিক তখনই রঘুনাথকে দুলালের ঘরে বলে কয়ে পাঠাল চুনারাম। রঘুনাথের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, বিশেষ করে খাওয়ার পরে তার একটু গড়িয়ে নেওয়ার দরকার, এটা এখন এক প্রকার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তবু চুনারামের অনুরোধকে ঠেলতে পারল না রঘুনাথ, আর সেই সঙ্গে দুর্গামণিও চাইছিল রঘুনাথ যেন দুলালের ঘরে যায় এবং খোঁজ নিয়ে আসে। মায়ের দুঃখী মুখের কথা ভেবে রঘুনাথ দুলালের ঘরে গিয়েছিল, এবং সেখানে দুলালের বুড়ি মা ভূষণী ছাড়া আর কেউ নেই। ভূষণী বুড়ি খনখনে স্বরে যা বলল তার অর্থ করলে দাঁড়ায়, সে ছেলে এখুন আসবে না গো। আসা কি মুখের কথা? এ তো লাখুরে-হলদেপোঁতা ধাওড়া নয়, পথ যে অনেকটা, এট্টা নদী পেরতে হয়, তাপ্পর হাঁটা পথে ক’ ক্রোশ আমি ঠিক জানি নে বাবু। ছেলেটারে আগে ঘর ধরতে দাও, ঘর এলে আমি তারে তুমাদের ঘরে পেঠিয়ে দেবো। চিন্তা করো না।