-পারবি রে দাদু?
-না পারার কি হল? রঘুনাথের গলায় ছোকরা হয়ে ওঠার জেদ ঝরে পড়ল। নাল ফুল আর ডাঁটাগুলোকে নিয়ে সে জল সাপড়ে ডাঙায় উঠে এল। ডাঙায় উঠে বাঘ দেখার মতো চমকে উঠল সে, বুকের মধ্যে চলতে থাকল আটাচাকির মেসিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলাক্ষবাবু কোঁচা সামলে সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন। ভরদুপুরে এদের পুকুরয়াড়িতে দেখতে পাবেন আশা করেন নি; তিনি অবাক হলেন, কি ব্যাপার, তোমারা এখানে কী করছ?
চুনারাম ভেজা হাত পরনের খাটো ধুতিতে মুছে নিয়ে হাসল, এই যে বাবু, নালফুল তুলছিলাম। পেটের ধান্দায় কুথায় না যেতে হয় গো!
-তা বলে যাওয়ার আর জায়গা পেলে না? শেষ পর্যন্ত আমার এই পুকুরটাই তোমাদের নজরে পড়ল? বলিহারি দিই তোমাদের চোখকে। নীলাক্ষবাবুর গলা চুঁইয়ে ঘৃণা আর বিস্ময় পাশাপাশি ঝরে পড়ল, তিনি এক দৃষ্টিতে নালফুলগুলোর দিকে তাকালেন, এগুলো তুললে যে, অনুমতি নিয়েছ?
অসহায় ঘাড় নাড়ল চুনারাম, জলের মুফুতে জিনিস, কত লোকে তো নেয় বাবু, আমি না হয় দুটো ডাঁটা না বলে তুলে নিয়েছি।
কেন নিলে? আমার জলের ফসল আমার, মানো তো কথাটা? রাগে লাল দেখাচ্ছে নীলাক্ষবাবুর চোখ দুটো। সেই অগ্নিবর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ম্যাদামারা হয়ে গেল চুনারামের, তার ভাবখানা এমন, সে যেন টানাজাল ফেলে সব মাছ ধরে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এখন ধরা পড়ে যাওয়াতে কাঁচুমাচু মুখ। তাকে দেখে হুঁকরে উঠলেন নীলাক্ষবাবু, জান, আমি তোমাকে থানায় ঢুকিয়ে বেধড়ক মার খাওয়াতে পারি।
-জানি, সে ক্ষেমতা আপনার আচে, বাবু! আপোসের পথে হাঁটতে চাইল চুনারাম, এবারকার মতো ছেড়ে দিন গো, বেলা বাড়চে ঘর যাই। তাছাড়া ভোখও লেগেচে জব্বর। পেটের ভেতর খিদে ভাবটা কুকুরের নখ হয়ে আঁচড় কাটচে।
অনেকক্ষণ পরে নীলাক্ষবাবুর নজর রঘুনাথের উপর পড়ল, তোমার সাথে এটা কে?
–আজ্ঞে, গুয়ারামের ব্যাটা।
-ওঃ। তা এখন থেকে ওকে হাত ধরে সব শেখাচ্চো বুঝি? নীলাক্ষবাবু ঠোঁট বেঁকাল, রক্তের দোষ আর যাবে কোথায়? কালকেউটের ছা তো কালকেউটেই হয়। কেউ হেলে সাপ হলে ওরা তাকে মেরে ফেলে।
–দুটো ডাঁটার জন্যি এত কতা বলা কি নেয্য হয়, বাবু? চুনারামের কথায় হোঁচট খেলেন নীলাক্ষবাবু। তিনি আগের মতো উত্তেজিত হলেন না, শুধু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তোমাদের সাহস দেখে আমার খুব অবাক লাগছে। দিনে দিনে আর কত কী যে দেখতে হবে।
দেখার তো সবে শুরু। মুখ ফসকে রঘুনাথের গলা ঠেলে বেরিয়ে এল কথাগুলো। নীলাক্ষবাবু অবাক চোখে তাকালেন, তুমি চুপ করো হে ছোকরা? সেদিনের ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরয়, তার আবার বড়ো বড়ো কথা।
এখন তো ছোট মুখে বড়ো কথা শোনা যায়। রঘু কথাগুলো বলেই মাঝ পুকুরের দিকে তাকাল, নালফুলগুলো আমরা না নিলে ও গুলান পচে যেত। জল নষ্ট হোত ওতে। বদঘেরাণ ছাড়ত, সেটা কি ভালো হোত?
ভালো-মন্দ যা বোঝার আমি বুঝব, তুমি আগ বাড়িয়ে কথা বলার কে? নীলাক্ষবাবুর চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। রাগে ফুঁসছিলেন তিনি। ছেলেটার স্পর্ধা দেখে তিনি বিস্মিত। ছোটলোকদের এই বাড় কোনোমতে সহ্য করা যাবে না, ফলে গায়ে গরম তেল ছিটিয়ে পড়ার যন্ত্রণা শুরু হল নীলাক্ষবাবুর, তোমার বাবার নাম কি আমি জানতে পারি?
-শ্রীগুয়ারাম রাজোয়ার! রঘুনাথ ঘাবড়াল না।
নীলাক্ষবাবু দাঁত দিয়ে দাঁত ঘষলেন, হালকা হলেও সেই ঘর্ষণের শব্দটা তার কানে বোলতার ভোঁ-ভোঁ আওয়াজের মতো বিশ্রী শোনাল, দরকার হলে আমি আজই থানায় যাব। আজ পুকুরে নালফুল তুলছে, কাল সুযোগ পেলে মাছ ধরবে। এটা কি মামার বাড়ি? যা খুশি তাই করবে। থানার বড়বাবু আমার চেনা-জানা। দেখি শেষ পর্যন্ত কী করা যায়। নীলাক্ষবাবু উবু হয়ে ডাঁটাগুলো খামচে ধরলেন, তারপর সক্রোধে ছুঁড়ে দিতে চাইলেন জলের দিকে। চুনারাম কালবিলম্ব না করে বাবুর পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল, এ কাজ করবে নি বাবু, বড়ো আশার জিনিস। ঘরে কুনো বাজার নেই। এগুলান নিয়ে গেলে চচ্চড়ি হবে। কত আশা করে নাতিটা পুকুর থিকে তুলেছে।
-ঠিক আছে, আজকের মতো নাও। পরে যদি দেখি ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। নীলাক্ষবাবু গা থেকে ক্রোধ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। যাওয়ার সময় তিনি কড়া চোখে রঘুনাথের দিকে। কটমট করে তাকালেন, শোন ছোকরা, তোমার সাথে আমার আবার দেখা হবে। আজকের দিনটার কথা মনে রেখো, তাতে দু’পক্ষের মঙ্গল। রঘুনাথ গুরুত্ব দিল না নীলাক্ষবাবুর কথাকে, অবজ্ঞায় শক্ত হয়ে উঠল তার ঠোঁট, আমিও চাইচি-চটজলদি আবার দেখা হোক। যত দেখা হবে তত সম্পর্ক আরও ভালো হবে।
ওরা দু-জন দুদিকে ছিটকে গেল।
ফেরার পথে চুনারামের মুখে কোনো শব্দ নেই। খাঁ-খাঁ রোদের ভেতর সে একমনে হাঁটছিল। রঘুনাথ তাকে তাতানোর জন্য বলল, কি গো দাদু, ভয়ে কি দম এটকে গেল নাকি?
পায়ের গিঁট ফুটিয়ে চুনারাম ভয়ার্ত চোকে তাকাল, বাবু লোক ভালো নয়, হারামীর হদ্দ। আশেপাশের গাঁ-গুলাকে জ্বালিয়ে মারচে। ভয় তো হবেই। খরিস সাপের লেজে পা দেওয়া তো মুখের কথা নয়।
-মিচিমিচি ভয় পেওনি তো? রঘুনাথ দম নিল, এই তো দেখলে লাঙল যার জমি তার নিয়ে কত লড়াই হয়ে গেল। কারা জিতল? সে তো তুমি নিজের চোখে দেখলে! ফলে বাবুদের অতো ফটফটানী থাকবে না। তবে সময়ের সাথে ওরা যদি না বদলায় তাহলে পরে মুখ থুবড়ে পড়বে।