ভালো না লাগলেও হাত বাড়িয়ে দিল রঘুনাথ, দাও। মাথাটা ধরে আছে। ধোঁয়ায় যদি চিন্তার ধোঁয়া ওড়ে।
-তুর এত চিন্তা কিসের? গলায় ধোঁয়া আটকে চুনারাম খুকখুক করে কাশল, আজ দিনটার দফারফা সেরে দিয়ে গেল লুলার বউটা। কুন কুক্ষণে যে ওর সাথে দেখা হল হে ভগবান। দেখা না হলে কখুন আমরা ঘর ধরে যেতাম।
আয়েশ করে বিড়ি টেনে রঘু পুকুরের দিকে তাকাল, দাদু গো, এবার আমি তাহলে কইফুল তোলা শুরু করি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, তা আর বলতে। চুলরাম পুকুরের চারধারে, এমনকী স্থির হয়ে থাকা দৈত্যের মতো জলটাকে নিবিড় চোখে দেখল, যা দাদু। ঝেঁপিয়ে পড়। আর দেরি করা উচিত হবে না। বেলা তো টিকলিতে উঠে গিয়েচে। আমাদের ফিরতে দেরি দেখে তুর মা নিশ্চয় খুব ভাবচে।
-তা ভাববে বইকি। জলের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথের চোখ ছোট হয়ে এল, মনের ভেতর ভয় হামাগুড়ি দিলেও বাইরে সে তা ভুল করেও বুঝতে দিল না, পায়ে পায়ে পুকুরয়াড়ির মুড়োয় গিয়ে দাঁড়াল সে। চুনারাম বিড়ির শেষটুকু ফেলে দিল জলে, তার চোখের তারায় সামান্য হলেও ভয়ের কাঁপুনী ছড়িয়ে পড়ল, বেশি দূর যাবি নে, যা তোলার ধারে-ধারে তুলে চটপট উঠে পড়বি। পুরনা পুকুর আর ছোকরা বাঘের গোঁ বোঝা দায়।
এই বয়সে সাঁতার কাটায় রঘুনাথ হয়ে উঠেছে ওস্তাদ। এ গাঁয়ের কোনো ছেলে ছোকরা তার সাথে ডুবসাঁতার-চিৎসাঁতারে পারে না। ভরা বর্ষায় রঘুনাথ গাঙ পেরিয়ে চলে যায় ভিন পাড়ে, তার হাঁপু ধরা তো দূরে থাক, সামান্য বড়ো করেও শ্বাস ছাড়ে না। লুলারাম তার সাঁতারের বহর দেখে বলেছিল, রাজোয়ার বংশের মান রাখবি তুই। তুর যদি মন চায়, আমার বিদ্যেটাও শিখতে পারিস। তোর মতোন চ্যালা পেলে আমি শরীল নিংড়ে দু-হাত উজাড় করে সব দিয়ে যাব। কি রে নিবি? লুলাখুড়ার কথা শুনে হাঁ-হয়ে গিয়েছিল রঘুনাথ। চট করে তার মুখে কোনো ভাষা আসে নি। সেদিন প্রস্তাবটা শুনে ভয়ে তার গলা জড়িয়ে গিয়েছিল। লুলারাম এ তল্লাটের নাম করা ডাকাত। এ বিদ্যায় তার বুদ্ধি প্রখর। নিজের গাঁয়ে কিংবা তার আশেপাশে সে কোনো কাণ্ড করে না। কিন্তু ভিন গাঁয়ে তার দাপট নোনা অঞ্চলের বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর। গ্রামের প্রায় মানুষ এ সংবাদ জানলেও ভয়ে কেউ মুখের উপর কিছু বলে না। তবে মাঝে মাঝে থানার জিপ আসে কালীগঞ্জ থানা থেকে। ওরা বেশির ভাগ আসে মাঝ রাতে। পাকুড়তলায় জিপ দাঁড় করিয়ে ওরা হেঁটে আসে লুলারামের দোতলা ঘর অবধি। পাড়ার কুকুরগুলো তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, চিল্লিয়ে–চিল্লিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় গেরস্থের। ঘুম চোখে রঘুনাথ অনেকদিন শুনেছে খিস্তি-খেউড়। চোখ ডলে নিয়ে লুলারাম কাকা হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছে থানার মেজবাবুর সামনে, আজ্ঞে বাবু, ছি-চরণের ধুলো যখন পড়েছে তখন টুকে ভেতরে আসুন। কিচু না হোক এক গেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে যান।
মেজবাবুর চোখ আগুন উগরায় আঁধারে, মারব এক লাথ, মেরে সার গাদায় ফেলে দেব। হারামীর বাচ্চা, থানার হাজিরা কি তোর বাপ দিতে যাবে? যদি শুনি ফের বিলা করেছিস-তোর চ্যাং মাছ কেটে তোকেই ভেজে খাইয়ে দেব। আমাদের সব সময় তোর উপর নজর আছে। চরকুঠিয়া-হাটাগাছার কেসটার এখনও ডিসিশন হয়নি। যদি প্রমাণ হয় ডাকাতিতে তুই ছিলিস তা হলে পেঁদিয়ে তোর পেছনের হাড়-মাংস আলাদা করে দেব।
মেজবাবুর ধমকানীতে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপে ঢিলি। থানার মেনিমুখো মানুষগুলো কি যে বলে তার মগজে তিলমাত্র ঢোকে না। তবে লুলারাম লতপতে চোখে তাকায়, তার দৃষ্টিতে ভয় তো নেই উল্টে বদলা নেবার বাসনা। রঘুনাথ ঘুমশরীরে বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে সব শোনে, শোনামাত্র ভয়ে গা-হাত-পা কাঠ হয়ে যায়, দুর্গামণি ভয়ে ফিসফিসায়, আতঙ্কে কালো হয়ে যায় তার মুখ, এ ব্যাটা, ঘর চ। কার ঢিল কার গায়ে লাগবে ঠাকুর জানে। ছিঃ ছিঃ, ঠাকুরপোর চরিত্র আর শুধরালো না! এ সব দেখাও পাপ, শোনাও পাপ। চ, ব্যাটা ঘর চ।
লুলারাম খুড়ার কথাগুলো এখনও মনের ভেতর ঘাই দেয়। সৎ-পথে তার মাটির দোতলা ঘরখানা ওঠে নি। এই ঠাঁটবাট, চলা ফেরা এসবের জন্য টাকা-পয়সা দরকার। এ সব খরচা আসে কোথা থেকে? চুনারাম পেছনের চামড়ার খড়ি উসকে বলে, উৎপাতের ধন চিৎপাতে যাবে, তুই দেখে নিস দাদু। চাঁদ-সূয্যি এখনও আলো দেয় রে, তুই দেখে নিস দাদু, ওদের ভালো হবেনি। যারা পরের ধনে পোদ্দারী করে তাদের সেই ধন খসে যায়।
নাল ফুলের ডাঁটায় বাঁ-হাতের বেড় ভরে গিয়েছে রঘুনাথের। জলজ ডাঁটাগুলো থেকে অদ্ভুত একটা সুঘ্রাণ আসছে, টাটকা ফুলগুলোও কম যায় না, সুগন্ধ গায়ে মেখে ওরা সব যেন জলকুমারী। রঘুনাথ ওদের নরম শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, আদর করে। মন ভরে যায়। এতক্ষণ জলে থাকার মেহনতটা সুদে আসলে উঠে যায়। ডাঙার কাছে সাঁতরে গিয়ে সে চুনারামকে ডাকে, দাদু, ধরো। জলে ভেসে গেলে আর আমি জড়ো করতে পারব না। হেঁপসে গিয়েচি।
হাঁটুজলে নেমে নালফুলের ডাঁটিগুলো যত্ন নিয়ে ডাঙায় ছুঁড়ে দিচ্ছিল চুনারাম। বার বার জল থেকে ডাঙায় ওঠা সময় সাপেক্ষ কাজ, সময় বাঁচাতে চুনারামের বুদ্ধিটা মনে মনে তারিফ করল রঘুনাথ। মনে মনে সে ভাবল আজ ঘরে ফিরলে দুর্গামণির আঁধার মুখে আলো ঝরে পড়বে। অনেক দিন পরে মায়ের খুশি মুখটা দেখতে পাবে সে। গুয়ারাম খাটতে যাবার পর থেকে কেমন মেঘলা হয়ে আছে দুর্গামণির মনটা। রঘুনাথ আড়চোখে দেখেছে। তারও মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। অভাবই এই মন খারাপের জন্য দায়ী–একথা বুঝতে আর বাকি নেই রঘুনাথের। আর একটু বড়ো হয়ে অভাবের টুঁটিটা সে টিপে ধরবে। লুলারাম কাকার কথাগুলো সে আজও মন থেকে মুছে ফেলতে পারে নি। কথাটায় দম আছে; মদের মতো নেশা হয় শুনলে। পরের ধন চুরিয়ে যারা বাঁচে তারাও তো মানুষ। তাদের কেউ ডরে, কেউ ঘেন্না করে। তবে তারা বেশ ঠাটবাট নিয়ে থাকে। তাদের কাছে নিজ-হাত জগন্নাথ। কোনো কাজই তো পাপের নয়। বিধান যদি এই হয় তাহলে পাপের কোনো প্রশ্ন ওঠে না। রঘুনাথ অন্যমনস্ক হয়ে গেল ভাবতে-ভাবতে। জলে গা-ভাসাতে আর ভালো লাগল না তার। উড়ুলমাছের চেয়েও জোর-গতিতে সাঁতার কেটে সে ডাঙার কাছাকাছি এল। চুনারামকে বলল, তুমি ডাঙায় ওঠো, আমি একদিকটা সামলে নিচ্ছি।