–মিচে কথা। লুলারাম চোখের নিমেষে তার খড়খড়ে হাতটা চেপে ধরে ঢিলির বাসনা তেল চুবানো মাথায়, মা’র দিব্যি, শুতে-বসতে আমি তুমার মুখ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই নে। আমি যা বলেছি তা সত্যি গো! কেন বলেচি-জানো? মা’র জন্য আমার কুনোদিন মন খারাপ করে না। এমনকী মা’র কথা আমার একদম মনে পড়ে না। তুমার সঙ্গে আমার একহপ্তাও হয়নি, অথচ তুমার জন্যি আমার বুক টাটায়। আমার চোখে নিদ আসে না।
.
এই অনুগত লুলারাম এখন লোহার মোটা শিক, বাঁকানো যায় না। রাত-বেরাতে সে ঢিলিকে বিছানায় ফেলে বাহ্যি করার নাম করে ঝারির ঘরে ঢুকে যায়। ভিকনাথের খাটা গতর মড়ার মতো ঘুমোয়। তেল-টিনের দরজায় টোকা পড়লেই ঝারি এলোমেলো শাড়িতেই বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দরজায় শেকল তুলে সে আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে চলে আসে জগৎখালির বাঁধ-ধারে। শরীরের দাবি মিটিয়ে ভোর রাতে সে ফিরে যায় নিজের ঘরে। ওরা ভাবে–এসব কেউ টের পায় না। অথচ হাওয়া-জল-গাছ সব জানে। মরা চাঁদে জানে, তারা জানে। ঝারি ভয়ে ভয়ে বলে, পেট বেঁধে গেলে কি করব গো? তখুন ডুবে মরতেও যে জলা জুটবে না।
-ভয় কি, প্রভা বুড়ির শেকড়বাটা খাইয়ে দেব। পচা লাউজালির মতো কখন পেট খসে যাবে, ভিকনাথ তো ছেলেমানুষ, ওর বাপও টের পাবে না। লুলারামের কণ্ঠস্বরে অশ্বত্থের ছায়া ঢলে পড়ে, তুমি চিন্তা করো না তো! আমি তো আছি, আমি তো মরে যাইনি। আমার যা জমিজমা আছে তুমি বসে খেয়েও শেষ করতে পারবে না।
ঝারির কাজলটানা চোখে স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে ওঠে, সত্যি বলছো, আমাকে ছুঁয়ে বলো।
লুলারাম তাকে ছোঁয়, শুধু ছোঁয়া নয়–বুকের যাঁতায় পিষতে থাকে বুক, ঝারির শরীর কাদামাছের মতো মোড়া মারে উত্তেজনায়, কথা জড়িয়ে যায়, উঃ, আমি মরে যাবো গো, আর পারচি নে! ছাড়ো, ছাড়ো! আলো ফুটচে চারধারে। ভিকনাথ জেনে গেলে আমারে গলা দাবিয়ে মেরে দেবে। ইবার আমাকে যেতে দাও।
–ও শালাকে আমি ছাড়ব ভাবছো? ওর মরণ আমার হাতে। বেশি তেড়িবেড়ি করলে গলায় হেঁসুয়া চালিয়ে দেব। লুলারামের লুললুলে শরীর পাকানো দড়ির মতো শক্ত হয়ে উঠল, কঠিন চোয়াল নড়ে উঠল, তুমারে রাজরানী করে রাখব। আগে পাগলীটার গতি করি, তারপর
-যা করার তাড়াতাড়ি করো। আমার তর সয় না। ফি-রাতে পেলিয়ে আসতে মন করে না। খালি ভাবি–আমি কি রাতচরা গোরু?
গোরু কেনে হবে গো, তুমি আমার হরিণী! আহা কী রূপ, কী রূপ! লুলারামের পিছল জিভ চুকচুক শব্দ করে ওঠে শঙ্খ লাগা সাপের মতো।
এসব ভাবলে তার মনটা চৈত্রের রোদে ফাটা জমির মতো ফেটে চৌচির, আর সেই ফাটলের মধ্যে লুকিয়ে-ছাপিয়ে বসে থাকে রাগের ফণাধারী সাপ, তার শুধু ফোঁসফোঁসানী, ওই দুটা তিলে খচ্চর মানুষকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য মনটা শীতকাতর কুকুরছানার মতো যন্ত্রণায় কুঁইকুঁই করে। সব খবর ঢিলির কানে আছে, মনে আছে। লোক ভাবে সে পাগল। হ্যাঁ পাগল। লুলারামই তাকে পাগল করে ছেড়েছে। শুধু খেতে-পরতে পেলে কি একটা বৌয়ের সব পাওয়া হয়ে যায়, আর কিছু কি দরকার হয় না জীবনভর। লুলারামের ভালোবাসাটা এখন খরায় ঝলসে খড়খড়ে ঘাস; প্রাণ নেই, টান নেই-যা আছে শুধু অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের ধুলো ওড়া। এর শাস্তি ওকে পেতে হবে। মাথায় খাঁ খাঁ রোদ নিয়ে ঢিলি শক্ত হয়ে দাঁড়াল, নিজের অজান্তে হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এল তার, মাথাটা চোখের নিমেষে বুমবুমিয়ে উঠল, নাক ছাপিয়ে নেমে এল গাঢ় নিঃশ্বাস। এমন অস্বস্তিবোধ হলে সে বুঝতে পারে মাথার অসুখটা বাড়ছে, এবার সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে, নিজেকে আর ধরে রাখার কোনো ক্ষমতা থাকবে না ওর। ঢিলি কী ভেবে আবার পুকুরঘাটের দিকে দৌড়ে গেল, এবার আর ধীর পায়ে নামল না, ডাঙা থেকে ব্যাঙের মতো ঝাঁপ দিল পুকুরে। তার ছিপছিপে সুন্দর শরীরটা মৃগেল মাছের মতো ঢুকে যেতে লাগল জলের গভীরে। প্রায় মিনিট খানেক পরে কালবাউস মাছের মতো চুলভর্তি মাথা ঠেলে জলের উপরভাগে উঠে দু-হাত থাবড়াতে লাগল ঢেউওঠা জলের উপর। পাড়ে যে দু-জন পুরুষমানুষ দাঁড়িয়ে আছে তখন তার সে খেয়াল নেই। প্রায় একরকম ভয় পেয়ে রঘুনাথ চিৎকার করে উঠল, ও কাকি, উঠে আসো গো… উঠে আসো। আমার বড্ড ভয় করছে।
কথাটা কানে গিয়েছিল ঢিলির, ভয় কি রে বেটা, ভয় কি? জল আমার সই রে, আগুন আমার মিতে। তুর কুনো ভয় নেই বেটা, আমাকে কেউ মারতে পারবে না। আমি হলাম মা বুড়োমার বেটি। মা চণ্ডীর বেটি। আমার ক্ষতি করবে কিনা ওই ভিকনাথের বউটা! ছ্যাঃ!
জল দাপিয়ে পাড়ে উঠে এল ঢিলি, ওর চুল বেয়ে জল নামছে খড়ের চাল বেয়ে জল নামার মতো, পুরো মুখখানার মলিনতা ধুয়ে গিয়ে সুন্দর দেখাচ্ছে বর্ষার কদমফুলের মতো। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছিল চুনারাম, সে আর থাকতে না পেরে সামনে এগিয়ে এসে মুখ নিচু করে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল খুড়শ্বশুরকে দেখে ঢিলি নিশ্চয়ই লাজ পাবে, শরমে চোখের আড়ালে চলে যাবে। চুনারাম যা ভেবেছিল তাই হল। ঢিলির সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল উভয়ে। লজ্জায় গুটিয়ে গেল ঢিলি, লম্বা হাতের চাপাকলি আঙুল দিয়ে সে ঘোমটা দিল সযত্নে। ঠাণ্ডা জলে তার মাথাটা বুঝি ঠাণ্ডা হয়েছে, সে আর আশেপাশে না তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে সোজা চলে গেল বাঁধের দিকে। বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়ার সুখ অনুভব করল রঘুনাথ, পরমুহূর্তে ঢিলিকাকির জন্য তার কষ্ট হল, বুকের ভেতর গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল, পুরো মুখটা নিমেষে বিষাদছায়ায় ভরে উঠল। চুনারাম বিড়ি ধরিয়ে এবার একটা বিড়ি রঘুনাথের দিকে এগিয়ে দিল, নে ধরা। বাপের ছিমুতে খাস আর আমার ছিমুতে খাবি নে তা কি হতে পারে?